দ্বিতীয় খণ্ড (আমার গুরু, আমার স্বর্গত পিতাকে)
2 of 6

নেচে নেচে আয় মা

নেচে নেচে আয় মা

এই পুজো এলেই বোঝা যায় আমরা কোন ভূমির ওপর দাঁড়িয়ে আছি! পায়ের তলায় সত্যিই কি কোনও জমি আছে? না চোরাবালি? হুঁস হারালেই ভরাডুবি। স্ত্রী পুত্র পরিবার নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে শুধু চিৎকার ছাড়বে—’গেলো, গেলো, কত্তা ডুবে গেল ভড়ভড় করে।

এত দিনে বুঝেছি, মা কেন আসেন? না ডাকতেই কেন ছুটে আসেন কৈলাস থেকে এই আবর্জনাময়, গন্ধময়, রাজনৈতিক কীট-অধ্যুষিত কলকাতায়? মা আসেন আমাদের জ্ঞান-নেত্র খুলে দেওয়ার জন্যে। বাছা, সংসারটিকে চিনে নাও। আমার বউ, আমার ছেলে, আমার মেয়ে বলে হেদিয়ে পড়ো, কেউ কারুর নয় রে, মুখপোড়া। সকলের হাতেই তিন হাত লম্বা গামছা। তোমার গলায় জড়িয়ে পাক মারার জন্যে প্রস্তুত। যতই নাকে কাঁদো নিষ্কৃতি পাবে না, বৎস! মনের মতো না হলেই ঝেড়ে কাপড় পরিয়ে দেবে। আঁতে ঘা লাগলে, কে কার পিতা, কে কার স্বামী।

কিছুকাল আগেও বাঁশ থাকত ঝাড়ে। এখন স্কন্ধবাহিত হয়ে চলে আসে বাড়িতে।

পাশের বাড়িতে এক ভদ্রলোক এলেন এক গাঁট শাড়ি নিয়ে। হরেকরকম ডিজাইন, হরেকরকম দাম। পঞ্চাশ থেকে শুরু, শয়ের ওপরে উঠে স্থিতি। নীচের দিকে ডিজাইন আছে জমি নেই। প্রায় উলঙ্গবাহার শাড়ি। এক বাড়িতে শাড়ির আগমনে আসেপাশের বাড়ি নেচে উঠল। দুদ্দাড় করে সব ছুটছে। ছোট ছুটছে, বড় ছুটছে। প্যান্ডেলে প্রতিমা আসেনি, এসেছে শাড়ি।

যে বস্তু বাড়ি বয়ে আসে, তার দাম তো বেশি হবেই। কত্তারা গৃহ সামলাতে হিমসিম। ‘আরে, এই একই মাল বাজারে অনেক কম দাম।’

‘হ্যাঁ, তোমাকে বলেছে।’

‘বলেছে মানে? বিয়ের উপহারের শাড়ি আনি, দ্যাখোনি। যেমন জমি, তেমনি ছাপা।’

‘এ শাড়ি তার চেয়ে ঢের ভালো।’

‘ঘোড়ার ডিম ভালো।’

‘তোমার চোখ নেই।’

‘চোখ থেকেও নেই।’ মেয়ের মন্তব্য।

‘তার মানে?’

‘এখুনি দুম করে ষাট-সত্তর টাকা বেরিয়ে যাবে!’

যে বাড়িতে শাড়ি এসেছে, সেই বাড়ির বড়বউ একটা কোটা শাড়ি নেবেনই। বড়কত্তা বেঁকে বসেছেন। ছিলেন সোজা আড় হয়েছেন। ‘নিতে হয় আসল জায়গা থেকে নেব। শুধু-শুধু বেশি দাম দিতে যাব কেন? যা বাজার পড়েছে!’ দুজনে ঠুসঠাস চলেছে। সেই ঠুসঠাস বাড়তে-বাড়তে রাত এগারোটায় দুজনের মুখ দ্যাখাদেখি বন্ধ। এপক্ষে অনশন। ওপক্ষে ভূমিশয্যা। বেওয়ারিশ রান্নাঘরে হুলো এসে এক লিটার মাদারডেয়ারি চেটেপুটে সাফ। মেজো গিন্নি বড়র ওপর টেক্কা দিয়ে দুটি শাড়ি নিয়ে নিয়েছে। মেজোর ঘরে বর্ষাতেও বসন্তের কোকিল ডাকছে। বড় বারোটার সময় সন্ধির প্রস্তাব তুলেছিল, ওপক্ষ মেঝেতে মুড়ি দিয়ে শবাসনে। দাঁড়কাকের গলায় বলে উঠল—’থাক খুব হয়েছে, নিজের চরকায় তেল দাও।’

এই ধরনের আগুন নেবাবার দমকল নেই। এ জল হাইড্রান্ট থেকে আসে না। আসে দু-নম্বর নল দিয়ে কালো চাকতির চেহারার। সে ট্যাপ তো আর সকলের বাড়িতে থাকে না। নিরীহ, সৎ সংসারীর অনেক জ্বালা!

গোদের ওপর বিষফোঁড়া। পাড়ায় এক করিতকর্মা দম্পতি এক্সপোর্ট কোয়ালিটির ফ্রক এনেছেন। ম্যাকসি, মিডি, মিনি, সেমি। চোখ-ধাঁধানো সব ডিজাইন। একশো-থেকে শুরু। বাড়িতে-বাড়িতে সব ফ্যাশান প্যারেড চলেছে। ভদ্রলোক এক লট করে ছাড়ছেন। কত্তারা চায়ের কাপ হাতে বাসঠ্যাঙানো বিধ্বস্ত মুখে করুণ হাসির রেখা টেনে বিচারকের আসনে বসেছেন, মেয়েরা এক-একটি পরে সামনে দিয়ে ঘুরে যাচ্ছে। মেয়ের মায়ের প্রশ্ন—’কেমন?’ ‘কেমন?’

কত্তার ক্ষীণ উত্তর—উত্তম। অতি উত্তম।

মনে-মনে ক্যালকুলেটিং মেশিন চলছে। সংখ্যার পর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। চা খাচ্ছেন, না পাঁচন খাচ্ছেন—বোঝা যাচ্ছে না মুখ দেখে।

দুপুরের মহিলা-মহলে কত্তাদের সমালোচনা হয়েই থাকে। উটি নিবারণের কোনও রাস্তা নেই। স্বয়ং ঈশ্বরও পারবেন না তার অসাধারণ সৃষ্টি নারীজাতিকে খুশি করতে। সংসারে মেয়েদের ভূমিকা বিধানসভার বিরোধী দলের মতো। হেলদি অপোজিসান। নিজেরটি ছাড়া, আব্রহ্ম স্তম্ব পর্যন্তং সবাই ভালো। অসাধারণ। ঈশ্বর যেটিকে জুটিয়ে দিয়েছেন। সেইটিই একমাত্র ডিফেকটিভ, ডিসপোজালের মাল। খুঁতখুঁতে, নাকউঁচু, স্বার্থপর, পরছিদ্রান্বেষী, উদাসীন, হাড়কেপ্পন, ওয়ানপাইস ফাদার-মাদার, জীবনটাকে বেগুনভাজা করে ছেড়ে দিলে। সামনে দিয়ে ছুঁচ গলে না, পেছন দিয়ে হাতি গলে যায়। যতই করো না কেন, বাবুর মন আর কিছুতেই পাওয়া যায় না। বিশেষণের মালা বিশেষ্যের গলায় লম্বাই হতে থাকে। একতরফা বিচারে আসামীর অপরাধের ফিরিস্তি বেড়েই চলে। বিচারক যেকোনও মুহূর্তে প্রাণদণ্ডের আদেশ দিয়ে দিতে পারেন, আহা, বাছা রে, কার হাতে তুমি পড়েছ মা জননী, এর তো হাজতেই থাকা উচিত মা, তোমার করুণায় স্বামী হয়ে চষে বেড়াচ্ছে।

মেয়ে বললে, ‘বাবা, আমাদের কি আর দেয়। এই তো দ্যাখো না, গতবার দুটো ফ্রক দিয়েছিল, একটার দাম পঁয়ষট্টি আর একটা পঁয়তাল্লিশ। ব্যস, পুজো হয়ে গেল। সব জমছে। ব্যাঙ্কে টাকার বাচ্চারা সুদে বাড়ছে। নাকে যেন কেঁদেই আছে—যা দিনকাল পড়েছে, মা! দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুমোতে পারি না। ওদিকে রোজ সাতটার সময় ঠেলে তুলতে হয়।’

মেয়ের মা ছাঁচি পান চিবোতে-চিবোতে একটি লাইন যোগ করলেন, ‘হাত দিয়ে জল গলে না।’

প্রবীণা প্রতিবেশী সেই অনুপস্থিতিতে পরের ছেলের পক্ষ নিয়ে বলতে গেলেন, ‘মেয়ের বিয়ের টাকা রাখছে।’

ধমক খেলেন, ‘রাখুন মেয়ের বিয়ে। আর যেন কারুর মেয়ে নেই। এদের কালে মেয়ের বিয়ে বাপকে আর দিতে হচ্ছে না। সে গুড়ে বালি।’

‘উলটে ফেললে মা, সে গুড়ে বালি নয়, সে বালিতে গুড়, বলো।’

বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গে এখন ঘরে-ঘরে একটি মাত্র প্রশ্ন, ‘কি গো, হয়েছে?’

‘কী হয়েছে? অম্বল?’

‘অম্বল তো তোমার বারোমাসই। ও আর নতুন করে হবে কি? বোনাস হয়েছে, বোনাস?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *