নেকু-পুষু-মুনু
গাড়িটা মোড়টা ঘুরল। তোমাদের বাড়িটা দেখা যাচ্ছিল। দোতলার বারান্দা; মাধবীলতা।
ভাবলাম, যাই-ই না একবার।
এরকম কতবারই তো কত রাগারাগি তারপর সবই মিটমাট হয়ে গেছে।
রাগারাগি বলাটা অবশ্য ঠিক নয়। রাগটা চিরদিনই একতরফাই ছিল। পাখির তরফের। রাগ করেছে সে, আমি রাগ ভাঙিয়েছি। এইটেই নিয়ম হয়ে গেছিল। এই নিয়মের যে, কোনো ব্যতিক্রম হবে, বা কখনো হতে পারে এমন অবকাশ হয়নি। কখনোই না।
তাই-ই ভাবলাম; যাই-ই না একবার।
নিজেকে ছোটো করা হবে? হলই বা। কে আর কবে নিজেকে বড়ো করে কাউকে ভালোবাসতে পেরেছে বা বেসেছে? ভালোবাসলে তো ভালোবাসার জনের কাছে প্রতিনিয়ত ছোটোই হতে হয়। ছোটো হতে হতে যখন একেবারে নিজের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন হবার উপক্রম ঘটে তখন এক একবার মাথা তুলে দাঁড়িয়ে নিজের কাছেই নিজেকে জাহির করে, প্রমাণ করতে হয় যে, নিজের অস্তিত্বটা এখনও সম্পূর্ণত পরনির্ভর হয়ে যায়নি। এখনও শুধুমাত্র নিজের কারণেই বেঁচে থাকা যেতে পারে—অন্য কারও ভালোবাসা ব্যতিরেকেও।
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে, তোমার দরজায় পৌঁছে গেছি নিজেই জানি না। সত্যি পাখি। নিজেই জানি না।
তুমি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পেতলের নব ব্রাসো দিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করছিলে।
আমাকে দেখে তাচ্ছিল্যের গলায় বললে, হঠাৎ? কী মনে করে?
আমি বললাম, কিছু মনে করে নয়। কাল থেকে তোমার কথা বড়ো মনে হচ্ছিল। শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে আসা—ইচ্ছা করলেই তো আর আসা যায় না। তবু এমন করে মনে পড়ল যে, না এসে পারলাম না।
তারপর একটু চুপ করে থেকে বললাম, তুমি কি বিরক্ত হলে?
কাটা-কাটা গলায় তুমি বললে, না:; বিরক্ত হবার কী আছে? তবে এ সময়ে আমার স্বামী বাড়ি থাকেন না, তাই এ সময়ে তুমি না এলে ভালো হয়। আমায় দশ-জনকে নিয়ে ঘর করতে হয় তো।
আমি থতোমতো খেয়ে বললাম, অত ভেবে তো আসিনি। এদিকে একটা কাজ ছিল তোমার ব্যাবসাদার স্বামী তো আমাদের মতো চাকরির শিকলে বাঁধা জীব নয় যে, একটা বিশেষ সময়ে তাকে বেরোতে হয়। ভেবেছিলাম, অশোককেও পাব।
তারপর ভেবেছিলাম আগেও তো এমনি কতবার হঠাৎ হঠাৎ এসে পড়েছি আমাকে দেখে তো খুশিই হয়েছে; কখনও তো এমন বিরক্তি দেখাওনি!
ভেবেছিলে? বলে, তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে পাখি আমার দিকে তাকাল।
তারপর বলল, আমি চাই না যে, তোমার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক থাকুক। কারণ আমায় সংসার করতে হয়। আফটার অল আই হ্যাভ আ হাজব্যাণ্ড। আমাকে অনেক বুঝে-সুঝে চলতে হয়; চলা উচিত। তুমি আমার কে? দেওয়ার মতো কী তুমি আমাকে দিয়েছ; দিতে পারো?
আমি বললাম, তা তো নিশ্চয়ই। কিন্তু পনেরো বছরের সম্পর্কটা হঠাৎ মুছে ফেলতে চাইলেই কি মুছে ফেলা যায়? সম্পর্ক কি বালির ওপর পায়ের দাগ যে, ইচ্ছেমতো রগড়ে দিলে আর মুছে গেল?
অত জানি না। কিন্তু আমি পারি। আমার কিছুতেই আটকায় না। আমি সব পারি। পাখি বলল।
আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম, আমি পারি না।
তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমি যে পারি সেইটেই আমার পক্ষে অনেক।
আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে ক্লান্ত শ্রান্ত দেখে কিছু বলবে। কিন্তু তুমি কিছুই না বলে এমন একটা মুখ করে নিজের কাজ করতে লাগলে যে, মনে হল আমি তোমার কাছে টাকা বা কোনো করুণা ভিক্ষা করতে গিয়ে তোমার মুডের অপেক্ষায় বসে আছি।
আমি বললাম, চান করেছ? এত বেলা হল, চান করোনি এখনও?
না:। কাটাভাবে জবাব দিলে তুমি।
চান করবে না?
সময় হলেই করব। রান্নাবান্না সেরে চান করব।
আমি বললাম, ও! রান্না করছ বলেই বুঝি চুলের এই অবস্থা।
তারপর পরিবেশটাকে লঘু করার জন্যে বললাম যে, যে রাঁধে সে বুঝি চুল বাঁধে না?
পাখি বলল, রাঁধে হয়তো। তোমার মতো লোকের ভারসেটাইল বউরা। আমি সাধারণ মেয়ে, আমাকে কি এত মানায়? রাঁধা এবং একইসঙ্গে চুল বাঁধা।
তোমার কথাটার মধ্যে খোঁচা ছিল। কীসের খোঁচা, কেন খোঁচা তা আমি জানি, কিন্তু তোমাকে আমি কোনো দুঃখ দিইনি কখনো। যদি অন্য কারও হাতে দুঃখ পেয়ে থাকো তাহলে সেই দুঃখের দায়িত্বটা তুমি চিরদিনই পুরোপুরি আমার ঘাড়েই চাপিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছ। নিশ্চিন্ত হয়েছ, কারণ তুমি জেনেছ যে তোমাকে উলটে আঘাত করব না আমি কখনও। এই জানাটাকে ভর করে চিরদিনই তুমি যেমন খুশি তেমনভাবে আমাকে খুঁচিয়েছ; ব্যথা দিয়েছ খাঁচায়-বদ্ধ জানোয়ারের মতো।
আমি বসে পড়লাম, মোড়াটা টেনে নিয়ে।
তুমি আমাকে বসতেও বললে না।
হঠাৎ তুমি দরজা ছেড়ে ঘরের ভেতরে এসে বসলে ঠিক আমার সামনে। ফাঁসির আসামিকে জেরা করা উকিলের মতো মুখ করে। চান করোনি তুমি, চুল উসকো-খুসকো, বগলের কাছটা ঘামে ভিজে গেছে। ভেতরের জামা পরোনি। কেমন একটা ঢিলে-ঢালা, বিস্রস্ত, হাল ছাড়া, ডোন্ট-কেয়ার ভাব। যেন কিছুতেই তোমার আর কিছু এসে যায় না। সমস্ত পৃথিবী সম্বন্ধেই যেন তুমি সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে গেছ। আমার সম্বন্ধে তো পুরোপুরিই।
আমি যখন তোমার দিকে চেয়ে এসব ভাবছিলাম তুমি হঠাৎ বললে, তোমার অফিস নেই।
আমি বললাম আছে। অফিসের কাজ নিয়েই এ-পাড়ায় এসেছিলাম। বললাম তো— অফিসের গাড়ি নীচে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু অফিস কেন? তোমার যেমন হাজব্যাণ্ড আছে আমারও ওয়াইফ আছে। সবই আছে তবুও শুধু তোমাকে দেখতে বড়ো ইচ্ছা করছিল বলেই এসেছিলাম।
তারপর হঠাৎ আমি বোকার মতো বললাম, তোমার কখনো আমাকে দেখতে ইচ্ছা করে না—কোনোদিনও করেনি?
তুমি হারের লকেটটা কামড়ে ধরে বললে, তোমার কী ধারণা যে, তুমি খুব হ্যাণ্ডসাম বা তুমি এমন কিছু যে, তোমাকে দেখবার জন্যে আমি পাগল হয়ে থাকি, থাকব?
এসব কথার জবাব হয় না কোনো।
আজ পাখি আমাকে পদে-পদে অপমান করবে বলে মনস্থ করেছে। অপমানের জবাব অপমানেই দেওয়া যায়। কিন্তু আমি যে ওকে ভালোবাসি। ও মনে দুঃখ পায় এমন কিছু করা বা বলা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি কখনো। হবেও না কোনোদিন।
কিছুই না বলে আমি চুপ করেই বসে রইলাম।
তোমার ঘরের জানলা খোলা ছিল। কিন্তু পাখি তোমার মনের জানলা বন্ধ ছিল। কবে যেন তুমি দুড়দাড় শব্দে তা বন্ধ করে দিয়েছিলে অথচ আমার কানে সে শব্দ পৌঁছোয়নি। বাইরে ঝাঁ ঝাঁ করছিল রোদ। তাকানো যাচ্ছিল না সেদিকে। চোখের মধ্যে যতটুকু নরম আদ্রতা থাকে তার সবটুকু শুষে নিচ্ছিল সে বুঝি। কিন্তু আমার মনে হল তোমার চোখের ঝাঁঝ আজ বাইরের বৈশাখী দুপুরের ঝাঁঝের চেয়েও অনেক বেশি জ্বালা-ধরা। সেই ঝাঁঝে আমার চোখ পড়তেই আমার চোখ জ্বালা করে উঠল।
হঠাৎ তুমি বললে, তুমি কী চাও আমার কাছে? দয়া করে বলবে?
এই হঠাৎ প্রশ্নের কী জবাব দেব ভেবে পেলাম না। জবাবে হয়তো অনেক কিছু বলতে পারতাম কিন্তু কীভাবে গুছিয়ে বলব ভেবে পেলাম না।
কোনোদিনও ভালো কথা বলতে পারি না আমি। এমন অবস্থায় তো একেবারেই নয়।
আমি তবুও চুপ করে তোমার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। ভাবতে লাগলাম, দেখি! তুমি কত নিষ্ঠুর হতে পারো।
তুমি আবারও বললে। এবার কথা বলার সময়ে তোমার ঠোঁটের কোণে শ্লেষ্মার মতো ঘিনঘিন শ্লেষের ভাব ফুটে উঠল; তুমি বললে, সব পুরুষই সব মেয়ের কাছে যা চায়, তাই-ই তো তুমি চাও? তাই-ই যদি চাও তাহলে এত কষ্ট পাও কেন? আমাকেই বা এত বিরক্ত করো কেন? অনেক সহজে অনেকরকম কাঠ-খড় কেরোসিন পুড়িয়ে তো তুমি আমার চেয়ে অনেক উজ্জ্বল আলো জ্বালাতে পারো—নিজেকে এসে আলোয় পোড়াতে পারো—ছাই করতে পারো—মরতে আমার কাছে আস কেন? পুরোনো সেজবাতিকে এবার বাতিল করো। ঝাড়লন্ঠন জ্বালো এবার।
আমি তবুও চুপ করে রইলাম।
ভাবলাম, তুমি এতকথা শিখলে কোথায়? কে শেখাল?
তুমি বললে, জবাব দাও। চুপ করে রইলে কেন? তোমার জন্য আমার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। আমাকে নিয়ে তুমি গল্প লেখো, ঢাউস-ঢাউস উপন্যাস লেখো। তারজন্য কথা শুনতে হয় আমাকে, ছোটো হতে হয় লোকের কাছে। কী চাও তুমি? আমাকে ছাড়া আর কাউকে নিয়ে কি লিখতে পারো না? এত বড়ো কলকাতা শহরে মেয়ের কি অভাব?—আমাকে মুক্তি দাও। তোমার অনুপ্রেরণার পিন্ডি দিতে ইচ্ছে করে আমার গয়ায় গিয়ে। দোহাই তোমার, তোমার কল্পনার কারাগার থেকে আমাকে মুক্তি দাও। তোমার এই কলম নিয়ে খেলার জন্যে আমাকে যা মূল্য দিতে হয় তা আমি জানি। আমার স্বামী…..
আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, তোমার স্বামী কী বলে?
বলে, এসব বদমায়েশি, নোংরামো; বলে, তোমার বিরুদ্ধে কোর্টে কেস আনবে। আমার আত্মীয়স্বজন, হিতাকাক্ষী তারাও সবাই বলে।
আমি চুপ করে বসে ভাবছিলাম যে, পৃথিবীর সকলেই তোমার হিতাকাক্ষী; এক আমি ছাড়া।
আমি হাসলাম, বললাম, স্বপ্নে তোমাকে আদর করার অপরাধ কি আদালতে টিকবে? যা সত্যি তা তো এই-ই— তোমার এই ব্যবহার। এই সহানুভূতি। ইংরেজিতে একটা কথা আছে জানো তো? ‘‘ইফ উইশেস ওয়্যার হর্সেস বেগারস উড হ্যাভ রোড দম।’’ ইচ্ছা বা কল্পনা তো ঘোড়া নয় তা হলে আমিও দুরন্ত ঘোড়-সওয়ার হতে পারতাম।
পাখি বলল, তোমার ওসব ন্যাকা কথা ভালো লাগে না। আমরা মেয়েরা অনেক বেশি প্র্যাকটিকাল। স্বামী-ননদ-জা নিয়ে ঘর করি। ওসব প্রেম-প্রেম খেলা আমাদের মানায় না। বিয়ের আগে ওসব চলে। তোমার এই কাব্যের অনুপ্রেরণা হয়ে যে যন্ত্রণা পাচ্ছি তার চেয়ে স্বামীর আদর, হিন্দি ছবি, দহিকচুরি, ভেল-পুরি আমার কাছে অনেক বেশি সত্যি; স্পষ্ট। আবারও শুধোচ্ছি তোমায়, তুমি আমার জন্য কী করেছ? কী তুমি করতে পারো আমার জন্যে? আমার যদি কিছুমাত্র হারায়, ক্ষতি হয়, আমার সুনাম, চারিত্রিক যশ, তুমি কী করে পূরণ করবে? পারবে তা পূরণ করতে? কী আছে তোমার? কী ছাড়তে পারো তুমি আমার জন্য?
আমি খুব পিপাসায় ছিলাম। আলসের দাঁড়কাকের মতো আমার টাগরা শুকিয়ে গেছিল। কাক হাঁ করলে তার মুখের মধ্যে যেমন বীভৎস লাল রং দেখা যায়, আমার বুকের মধ্যেটা তখন তেমনই ললিপপের মতো লাল হয়ে গেছিল। আমার খুব বলতে ইচ্ছা করছিল, ‘পাখি, আমার নরম সাধের পাখি, এক গেলাস জল দেবে?’
কিন্তু পাখি আমাকে একটু জল চাইবার অবকাশও দিল না। দু-হাত নিজের কাঁধের দু-ধারে ছুড়ে দিয়ে বলল, কী দিয়েছ তুমি আমাকে যন্ত্রণা ছাড়া? কী দিতে পারো তুমি? পরক্ষণেই বলল, তোমার লেখা সব ক-খানি বই দিয়ে আমি উনুন ধরাব—ঘুঁটের কাজে লাগাব। এতোগুলো বই না লিখে দাঁতের মাজন ফেরি করাও তো ভালো ছিল।
আমি তবুও চুপ করে রইলাম।
তুমি, এবার জেদ ধরলে জবাবের জন্যে।
বললে, উত্তর তোমাকে দিতেই হবে। বলো তুমি, কী দিয়েছ আমাকে?
এবার আমি মুখ তুললাম। তেষ্টার আমার জিভ শুকিয়ে এসেছিল। যদিও তুমি ঘর্মাক্ত বিস্রস্ত রানি হয়েছিলে, তবু তোমাকে দেখে, তোমার দিকে তাকিয়ে আমার বড়ো ভালো লাগছিল। বড়ো ভালো লাগে যে আমার।—চিরদিনই লেগেছে। তোমাকে আমি যে বড়ো ভালোবাসি পাখি। মনে মনে বললাম—নি:শব্দে বললাম। সব কথা মুখে বলা যায় না—বললাম, পাখি, কী দিয়েছি তা তুমি বোঝোনি; জানোনি। আমি যা দিয়েছি, তা কি পৃথিবীর অন্য কোনো দ্বিতীয় পুরুষের কাছ থেকে তুমি পাবে? পেয়েছিলে কখনো?
তুমি তবু গর্জে উঠলে। বললে, কথা বলবে না তুমি?
আমি এবার মোড়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, না।
তোমার কিছু বলার নেই আমাকে?
তুমি আবারও বললে।
বললাম, না:।
বলার কিছু থাকলে তো বলবে?
ঘৃণার সঙ্গে বললে তুমি।
আবার, বললাম, না। বলার কিছুই নেই। তুমি আমাকে যা খুশি বলো আমার কিছু বলার নেই।
তারপর বললাম, হঠাৎই; আমি যাচ্ছি।
তুমি আমাকে একটু বসতেও বললে না, এক গেলাস জল খাওয়ালে না আমাকে। আমি যখন উঠলাম, দরজা পর্যন্ত এলে না তুমি এগিয়ে দিতে যেমন চিরদিন এসেছ। পাখি।
আমি সিঁড়ি বেয়ে নামছিলাম। প্রায় সিঁড়ির শেষে নেমে এসেছি, এমন সময় দেখি সিঁড়ির তলায় একটা নরম, আদুরে, দুধ-সাদা সুন্দরী বেড়ালনি শুয়ে আছে আর একটা হুলোবেড়াল—কালো, কুৎসিত, ঠিক দেখতে আমার মতো; ঘাড়ের লেমি ফুলিয়ে বেড়ালনির গায়ের কাছে শুয়ে, এই গরমে; সিঁড়ির তলায় ঠাণ্ডা, আদ্র ছায়াঘেরা জায়গাটুকু। বেড়ালনিটা আরামে, আবেশে, আশ্লেষে চোখ দুটোকে আধো-বুজে আছে।
ওর ছোট্ট গোলগাল ফর্সা মুখটাতে চেয়েই আমার মনে হল পৃথিবীর সব সুখ যেন এই বেড়ালনিটার মুখে এসে ঘর করেছে।
পাখি! তোমার ফর্সা মুখটা একদিন ঠিক এরকম ছিল।
হঠাৎ আমার বড়ো রাগ হল। প্রচন্ড রাগ। আমি হুলোবেড়ালটার পেটে কোঁৎ করে একটা লাথি মারলাম।
বললাম, ভাগ শালা। এখনও ভাগ। নইলে তোকেও আমারই মতো জবাবদিহি করতে হবে কোনো উষ্ণ, প্রচন্ড পিয়াসি-দুপুরে, তোকেও কাঠের পুতুলের মতো সোজা বসে উত্তর দিতে হবে। উত্তর নয়, নিরুত্তরের অসহায়তার মধ্যে বসে থাকতে হবে—তোকেও প্রশ্ন করা হবে—তোর সাধের বেড়ালনিকে কী দিয়েছিস? কী দিয়েছিলি তুই?
লাথি খেয়ে হুলোবেড়ালটা একলাফে দরজার ছিটকিনিতে ‘কটাং’ আওয়াজ করে ওর নির্লজ্জ লেজটাকে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্নর মতো করে পাকিয়ে তুলে ধরে পালিয়ে গেল। ব্যাটা বদমাইশ। হাঁদারাম।
কিন্তু বেড়ালনিটা তেমনই শুয়ে রইল; হাসি-হাসি মুখ করে।
ভাবলাম, হুলোটাকে না মেরে মারা উচিত ছিল এটাকে। এটা তেমনিই হাসিমুখেই শুয়ে আছে।—শয়তানি তক্কে তক্কে শুয়ে আছে কখন কোন জানলা দিয়ে কোনো বাড়ির অন্য হুলো লাফিয়ে নেমে, ওর কাছে এসে আবার ওর লোমে সুড়সুড়ি দেবে।
কুকুরীর বাচ্চাদের কী যেন একটা ইংরেজি নাম আছে?
কিন্তু বেড়ালনির ইংরেজি নাম কী?
জানি না আমি।
এইরকম মেনি বেড়ালনিদের মেনি বেড়ালনি—মুনু মুনু বাচ্চাদের ইংরিজিতে কী বলে?
না:। ইংরেজিটা একেবারেই জানি না।
বাংলাটা?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাংলাটা মনে পড়েছে; হঠাৎ মনে পড়ে গেল।
‘নেকু—পুষু—মুনু’।