নেই ভেদাভেদ
গত দুদিন স্কুলে আসেনি অয়ন, জ্বর হয়েছিল। আজ ক্লাসে ঢুকেই পরিবর্তন টের পেল। সামনের সারিতে নতুন মুখ দেখা যাচ্ছে। এরই সিটে বসে আছে সোনালিচুলো এক মেয়ে। খুব সুন্দর চেহারা, তবে একটা উদ্ধত ভাব প্রকাশ পাচ্ছে তাতে। অবাক হয়ে ও লক্ষ করল, ক্লাসের সমস্ত বাধাধরা সিট ওলটপালট হয়ে গেছে। বেশিরভাগ ছেলেই পেছনে, সামনের সিটগুলো মেয়েদের দখলে।
মেয়েটার সামনে গিয়ে গলা খাঁকারি দিল অয়ন। বলল, হাই! আমি অয়ন হোসেন।
চোখ তুলে তাকাল মেয়েটা। চাঁছাছোলা গলায় বলল, তাই নাকি? কী করতে পারি?
কিছু মনে কোরো না, সিটটা আমার। তোমাকে উঠতে হবে।
তোমার সিট? নাম লেখা আছে কোথাও?
এই কথায় সমস্বরে হেসে উঠল মেয়েরা। তবে ছেলেরা মুখ গোমড়া করে বসে রইল।
একটু অপ্রস্তুত বোধ করল অয়ন। বলল, নাম লেখা নেই। তবে ফাস্টবয় হিসেবে এখানে আমারই বসার কথা।
আর ফাস্ট হতে হবে না তোমাকে, আমি এসে পড়েছি, ঝাঁঝালো গলায় বলল মেয়েটা। একটা পরীক্ষা হোক, তারপরেই টের পাবে।
সেক্ষেত্রে পরীক্ষার রেজাল্ট বের না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলে হয় না? ততদিন পেছনে বসো।
কথাটার উপযুক্ত জবাব খুঁজে না পেয়ে রেগে গেল মেয়েটা। বলল, অত-শত বুঝি না! দেরিতে এসেছ, পেছনে যাও! এত কথা কীসের?
চলে এসো, অয়ন, পেছন থেকে একটা ছেলে বলল। ঝগড়া করে লাভ হবে না। ও উঠবে না।
এত সহজে হাল ছেড়ে দিতে রাজি ছিল না অয়ন। তবে ঘড়িতে দেখল, ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। অগত্যা কাঁধ ঝাঁকিয়ে সরে গেল ও। পেছনের সারি থেকে জিমি হাতছানি দিচ্ছে। ওর পাশের খালি সিটটা দখল করল ও।
এসেছিস তা হলে? জিমি বলল। বাসে এলি না যে?
আসব না ভেবেছিলাম, অয়ন বলল। কিন্তু ঘরে ভাল্লাগছিল না। দোনোমনো করতে করতে বাস মিস করেছি। শেষে বাবা গাড়িতে করে নামিয়ে দিয়ে গেছে।
জ্বর সেরেছে?
তা সেরেছে। কিন্তু ক্লাসে এসব হচ্ছে কী, বল তো! ওই মেয়েটা কে?
নতুন ভর্তি হয়েছে, পরশু এল। বিরাট বড়লোকের মেয়ে। নাম, ভিক্টোরিয়া ওয়েস্টমোর।
নামের কি ছিরি!
মেয়েরা রিয়া বলে ডাকে ওকে, তবে আমরা ডাকলেই খেপে যায়। ছেলেদের সহ্যই করতে পারে না ডাইনিটা।
ডাইনি! এতই খারাপ?
আর বলছি কী? পরশুদিন এসে সবগুলো মেয়েকে একাট্টা করে ফেলেছে, দিয়েছে আমাদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে। তারপর শুরু করল সিট নিয়ে তোলপাড়! সে কী গণ্ডগোল, তুই কল্পনাও করতে পারবি না। শেষে সামনের সিটগুলো ওদেরকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম আমরা।
ক্লাস টিচার কিছু বলেননি?
ম্যাডামকে আগেই ভজিয়ে রেখেছিল ডাইনিটা। উনি টু শব্দও করেননি।
তোরা এত সহজে ছাড়লি কেন?
ছেড়েছি কি আর সাধে? ওর সঙ্গে কথায় পারা আমাদের কম্মো নয়। আর এত চেঁচামেচি করতে পারে! নিজের চোখেই তো দেখলি, কেমন ব্যবহার করল তোর সঙ্গে। ছেলেদের দুচোখে দেখতে পারে না ও।
চরম পুরুষবিদ্বেষী মনে হচ্ছে।
ঠিকই ধরেছিস। তোর অপেক্ষায় ছিলাম আমরা। এসে গেছিস, কিছু একটা কর। সমুচিত জবাব দিতে হবে।
ভেবে দেখি, সংক্ষেপে বলল অয়ন।
এমন সময় ক্লাস শুরুর ঘণ্টা বাজল। প্রথম পিরিয়ড ইতিহাসের। ভীষণ বোরিং সাবজেক্ট। কিন্তু ওদের হিস্ট্রি টিচার মিসেস কারস্টেনের ক্লাস নেবার পদ্ধতি একদম অন্যরকম। বের হওয়া তো দূরের কথা, উল্টো মজা পায় সবাই।
আজ ক্লাসে ঢুকেই তিনি বললেন, আজ আমরা পড়ব আমেরিকার বিভিন্ন শহরের ইতিহাস। তবে কুইজের মাধ্যমে। দুটো দল থাকবে। কীভাবে করতে চাও? জোড় বনাম বেজোড় রোল নাম্বার হলে কেমন হয়?
পট করে হাত তুলে বসল রিয়া। বলল, আমার একটা প্রস্তাব আছে, ম্যাডাম। দল হবে ছেলেরা বনাম মেয়েরা।
খুব ভাল, আমার কোনও অসুবিধে নেই। কারও আপত্তি আছে?
আঁতে ঘা লেগেছে ছেলেদের-এ রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণা! কাজেই আপত্তি করল না কেউ।
একজন করে টিম লিডার ঠিক করো দুদল, ম্যাডাম বললেন।
সমস্ত জবাব সে-ই দেবে, অন্যেরা তাকে সাহায্য করবে। নইলে সবাই মিলে কথা বললে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।
মেয়েদের পক্ষ থেকে টিম লিডার হলো রিয়া, আর ছেলেদের অয়ন। ফার্স্টবয় ও, দলনেতা না হয়ে উপায় কী? কিন্তু ওর নামটা শুনে রিয়া এদিক ফিরে এমন এক বাকা হাসি দিল যে, রাগে সারা শরীর চিড়রিড করে উঠল অয়নের।
পাঁচটা করে প্রশ্ন করব, বললেন ম্যাডাম। সবাই তৈরি তো?
সবাই মাথা ঝাঁকাল।
ঠিক আছে, প্রথমে মেয়েদের পালা। তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করব আমাদের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি নিয়ে। এক নম্বর প্রশ্ন, ওয়াশিংটন শহরের মূল নকশা কে করেছিলেন?
পিয়ের চার্লস লেফেঁ, ঝটপট জবাব দিল রিয়া। কারও সাহায্য নিল না।
কোন্ দেশি ছিলেন ভদ্রলোক, জানো তো?
ফরাসি।
ভেরি গুড। কত সালে হোয়াইট হাউসের নির্মাণ কাজ শুরু হয়, বলতে পারবে?
১৭৯২ সালে।
চমৎকার! কত সালে ওয়াশিংটনে সরকার স্থানান্তরিত হয়?
১৮০০ সালে।
ঠিক। কোন প্রেসিডেন্ট প্রথম হোয়াইট হাউসে ওঠেন?
জন অ্যাডামস।
আর কোন প্রেসিডেন্ট সেটা উদ্বোধন করেন?
টমাস জেফারসন, ১৮০১ সালে।
বিউটিফুল! একশোতে একশো! হাততালি দিলেন ম্যাডাম।
উল্লাসে ফেটে পড়ল মেয়েরা। ছেলেদের মুখ কালো হয়ে গেছে, এসব প্রশ্নের জবাব মেয়েটা পেরে যাবে, কল্পনাও করেনি। অয়ন শুধু বিড়বিড় করে বলল, সহজ প্রশ্ন। আমিও পারতাম।
হাত তুলে সবাইকে শান্ত করলেন ম্যাডাম। থামো, থামো! এবার ছেলেদের পালা। তোমরা তৈরি?
উঠে দাঁড়াল অয়ন। তৈরি।
তোমাদেরকে প্রশ্ন করব আমাদের নিজেদের শহর, লস অ্যাঞ্জেলেস নিয়ে। প্রথম প্রশ্ন, লস অ্যাঞ্জেলেস কে আবিষ্কার করেন?
স্প্যানিশ পর্যটক গ্যাসপার দি পোর্তোলা, অয়নের চটপট জবাব।
কোন্ সালে, অয়ন?
১৭৬৯ সালে।
হয়েছে। এখন বলল, আমেরিকার অংশ হবার আগে লস অ্যাঞ্জেলেস কাদের উপনিবেশ ছিল?
স্পেন আর মেক্সিকোর।
গুড! কোন্ চুক্তির মাধ্যমে লস অ্যাঞ্জেলেসকে আমেরিকার হাতে তুলে দেয় মেক্সিকো?
১৮৪৭ সালের কাউয়েঙ্গা চুক্তি।
এবার শেষ প্রশ্ন, লস অ্যাঞ্জেলেস নামটা কোত্থেকে এসেছে?
১৭৮১ সালে ফ্রান্সিসকান পাদ্রীরা এখানে প্রথমবারের মত একটা শহর গড়ে তোলে। ওদের দেয়া নাম থেকেই লস অ্যাঞ্জেলেস শব্দদুটো এসেছে।
সেই নামটাই জানতে চাইছি, অয়ন। মাথা চুলকাল অয়ন। বিশাল বড় নাম, মনে করতে পারছি না।
আর কেউ পারবে? বাকিদের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুঁড়লেন ম্যাডাম।
চট করে হাত তুলল রিয়া। টিচারের ইশারা পেয়ে উঠে দাঁড়াল। হড়বড় করে বলল, এ পুয়েবলো দে নুয়েস্ত্রা সেনোরা লা রেইনা দে লস অ্যানহেলেস দে পোরকিউনকুলা। এর অর্থ-আমাদের মহীয়সী নারী, পোরকিউনকুলার দেবদূতদের রানির শহর।
ভেরি গুড! প্রশংসা করলেন মিসেস কারস্টেন। তা হলে দেখা যাচ্ছে, মেয়েরা একটা প্রশ্নের জবাব বেশি দিয়েছে। ওরাই জয়ী!
আমি বিশ্বাস করি না! ধপ করে বসে পড়ল অয়ন, ওর চোয়াল ঝুলে পড়েছে। এই মেয়ে দেখছি অসম্ভব ব্যাপার!
ততক্ষণে হুল্লোড় করে উঠেছে মেয়েদের দল। সেই চিৎকারে ওর গলার আওয়াজ চাপা পড়ে গেল।
দুই
সারাটা ক্লাসটাইম গুম মেরে কাটল। এমন বেইজ্জতি জীবনে হয়নি ছেলেরা। সবচেয়ে বেশি মেজাজ খারাপ হয়েছে অয়নের। একটা মেয়ের হাতে এমন পরাজয়ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছে না ও। জিমি অবশ্য বারবার সান্তনা দিয়েছে ওকে। এত কঠিন একটা প্রশ্ন, জবাব না পারাটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু ও একমত হতে পারেনি। জন্মের পর থেকে যে শহরে আছে, সেই শহরেরই আদি নাম পারল না–এটা মেনে নিতে পারছে না।
স্কুল ছুটির পর বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল সবাই। হঠাৎ আনন্দ উল্লাসধ্বনি শোনা গেল। মিছিল করতে করতে এদিকে আসছে ওদের ক্লাসের মেয়েরা, নেতৃত্ব দিচ্ছে রিয়া। একেবারে ছেলেদের সামনে এসে থামল মিছিলটা।
কী হে, পাবদা-পুঁটির দল, ঝিম মেরে গেলে নাকি? গলা উঁচিয়ে বলল রিয়া। কী আমার ফার্স্টবয় রে! ইতিহাসে একদম কাঁচা! বাকি সাবজেক্টগুলোর অবস্থা কী? পারো তো, নাকি নকল করে পরীক্ষা দাও?
সুর করে ছড়া কাটতে শুরু করল, মেয়েরা :
পাবদা-পুঁটি, পাবদা-পুঁটি,
জলের ভেতর কাঁদে,
পায় না ছাড়া যখন তারা
পড়ে জালের ফাঁদে।
আশপাশে দাঁড়ানো ছেলেরা শার্টের হাতা গোটাতে শুরু করল, খেপে গেছে। তাড়াতাড়ি হাত তুলে ওদেরকে শান্ত করল অয়ন। তারপর সোজা এগিয়ে গেল রিয়ার দিকে।
বলল, তোমার সমস্যাটা কী, রিয়া?
ভিক্টোরিয়া বলল, মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল মেয়েটা। আমার বন্ধুরাই শুধু আমাকে রিয়া বলে। এবং কোনও ছেলে আমার বন্ধু নয়!
আমি আবার বন্ধু-টন্ধু বুঝি না, ভোতা গলায় বলল অয়ন। যাকে যা ইচ্ছে, তা-ই বলে ডাকি। এই ধরো, এখন তোমাকে আমার কাউয়া বুড়ি বলতে ইচ্ছে করছে।
কাউয়া বুড়ি! কাউয়াটা আবার কী?
কাক। আমাদের দেশে কাককে ঠাট্টার ছলে কাউয়া বলে।
কী! আমি কাক? রিয়া রেগে যাচ্ছে।
নয়তো কী? অয়ন নরম গলায় বলল। সেই সকাল থেকে দেখছি, কাকের মত কা-কা করেই যাচ্ছ, করেই যাচ্ছ। কাউয়া না বলে উপায় কী?
দেখো, ভাল হবে না বলে দিচ্ছি!
খারাপের দেখেছ কী? জিমি এবার এগিয়ে এল। ভাগ্য ভাল মেয়ে হয়ে জন্মেছ, নইলে এতক্ষণে পিটিয়ে ছাতু বানিয়ে ফেলতাম।
কী! এত বড় সাহস? এসো না, দেখিয়ে দিচ্ছি-কে কাকে ছাত বানায়। অবলা নারী পেয়েছ? মার্শাল আর্ট জানি আমি।
ছি, জিমি, বলল অয়ন। এত অল্পে কেউ মারামারি করে? পিত্তি জালানো কণ্ঠস্বর ওর। নাহয় একটা ছড়াই বানিয়েছে ওরা। আমরাও একটা বানাই, শোধবোধ হয়ে যাবে।
এরপরই সুর করে বলল ও:
কাউয়া বুড়ি ভিক্টোরিয়া
কা কা কা কা করে,
সারাটাদিন চেঁচায় শুধু
থামতে তো না পারে!
একবার বলা হতেই বাকি ছেলেরাও সুর মেলাল। আর সহ্য হলো না রিয়ার। চিৎকার করে উঠল, শাট আপ!
থামল সবাই। অয়ন ওকে বলল, কাজেই বুঝতেই পারছ, যে তামাশা নিজে সহ্য করতে পারো না, তা অন্যকে নিয়ে না করাই ভাল।
হয়েছে! জ্ঞান দিতে হবে না। নিজের চরকায় তেল দাও।
সেটাই তো দিচ্ছিলাম, মাঝখান থেকে তুমি এসে গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধালে। আসলে তোমার সমস্যাটা কী? ছেলেদের সহ্য করতে পারো না কেন?
তোমরা… তোমরা বদমাশ, স্বার্থপর…
আর সব মেয়েই বুঝি মাদার তেরেসা?
ও আসলে সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভুগছে, পেছন থেকে বলল হ্যারি মরগান। ওর ধারণা, ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের যোগ্যতা বেশি।
ঠিকই তো! বলল রিয়া। লেখাপড়ায় তোমাদের চেয়ে ভাল আমি, আজ তো প্রমাণ দিলামই। তা ছাড়া মার্শাল আর্ট জানি, ঘোড়ায় চড়তে জানি, গাড়ি চালাতে পারি… তোমরা কেউ পারো এসব?
মাথা নাড়ল ছেলেরা।
অয়ন বলল, এটা কোনও যুক্তি হলো না। সবাই সবকিছু পারে না। এমন অনেক কিছু থাকতে পারে, যা অন্যেরা পারে, অথচ তুমি পারো না।
উদাহরণ দাও।
আমাদের অয়ন-জিমি গোয়েন্দা, বলে উঠল ভিকটর জেমস।
অনেক জটিল রহস্য সমাধান করেছে, বহু ক্রিমিনালকে ঘোল খাইয়েছে।
ওদের মত বুদ্ধি গোটা স্কুলে কারও নেই।
হুহ! গোয়েন্দা না ছাই! নাক সিটকাল রিয়া। ওসব আমরাও পারি, বুঝলে? ক্রিমিনালদের ঘোল খাওয়ানোর মত বুদ্ধি আমাদেরও আছে।
শুধু বুদ্ধি থাকলেই কি হয়? বুকে সাহসও থাকা চাই।
আমাদের সাহস নেই? একটা মেয়ে প্রতিবাদ করে উঠল। ভীতুর ডিম আমরা?
নয় তো কী? বলল জিমি। পারো তো শুধু ফিচফিচ করে কাঁদতে। সেবার পিকনিকে গিয়ে বনের ভেতর পথ হারিয়ে কী শুরু করেছিলে, ভুলে গেছ? ভাগ্যিস আমরা ছিলাম।
মোটেই কিছু করিনি! চেঁচিয়ে উঠল মেয়েটা।
তুমুল ঝগড়া বেধে গেল। ছেলেরা বলছে, ওদের সাহস বেশি আর মেয়েরা বলছে, না, মেয়েদেরই সাহস বেশি। কেউ হার মানতে রাজি নয়। পারলে হাতাহাতি বাধিয়ে দেয় আর কী।
কাছেই দাঁড়িয়ে বাসের জন্যে অপেক্ষা করছিল অন্যান্য ক্লাসের ছেলেমেয়েরা। আর সহ্য হলো না তাদের। এগিয়ে এসে হস্তক্ষেপ করল ব্যাপারটায়, ওদের থামাল।
কী হচ্ছে এসব! কড়া গলায় বলল ওপরের ক্লাসের একটা ছেলে, তার নাম নেভিল গারট্রড। মাছের বাজার বসিয়ে দিয়েছ একেবারে!
দেখুন না, নেভিল ভাই, নালিশ জানাল জিমি। এই মেয়েগুলো…
হয়েছে! হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল নেভিল। সব শুনেছি আমি। কাদের সাহস বেশি, এই কথা তো? ঝগড়াঝাটির দরকার কী, হাতে-কলমে প্রমাণ হয়ে যাক!
হাতে-কলমে! সবাই অবাক।
হ্যাঁ, এক কাজ করো। দুদল থেকে দুজন দুজন করে একটা ভূতের বাড়িতে এক রাত করে কাটিয়ে এসো। তা হলেই বোঝা যাবে, কাদের সাহস বেশি।
ভূতের বাড়ি কোথায় পাব? জিমি বিস্মিত গলায় বলল।
অভাব আছে নাকি? সোয়ানসন কোভ ধরে উত্তরে চলে যাও। সাগরের পাড়ে, পাহাড়ের মাথায় একটা পুরনো, ভাঙা বাড়ি আছে–গ্রিডলি হাউস। তিরিশ বছর ধরে পরিত্যক্ত। ভূত আছে বলে বদনাম আছে ওটার।
সত্যিই আছে?
তা জানি না। তবে গত হপ্তায় কয়েকজন কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কার গিয়েছিল ওখানে রাতের বেলা দুঘন্টাও টিকতে পারেনি। পড়ি-মরি করে ছুটে পালিয়েছে।
ইন্টারেস্টিং! মন্তব্য করল অয়ন।
কিন্তু সত্যিই ভূত থাকলে তো বিপদ ঘটতে পারে, বলল ভিক্টর।
ঝুঁকি নেয়াটা কি ঠিক হবে?
ওই দেখো, হেসে উঠল রিয়া। ভীরুর দল এখনই ভয় পেয়েছে। আমি ওসব ভূত-টুত বিশ্বাস করি না, পরোয়াও করি না। কাল থেকে উইকএণ্ড, আজ রাতেই যাব ওই বাড়িতে। আমার সঙ্গী হবে কে?
হাত তুলল নোরা, এতক্ষণ সে-ই ঝগড়া করছিল।
ঠিক আছে, যাও, বলল অয়ন। ভূতের ধাওয়া খেয়ে এসো। কাল রাতে আমি আর জিমি যাব।
কে কাকে ধাওয়া করে, দেখা যাবে, বলে গটমট করে চলে গেল রিয়া, তাকে নেবার জন্য গাড়ি এসেছে। জটলাও ভেঙে গেল।
বোকা মেয়ে, একটু পর বাসে উঠে বলল ভিকটর। শেষে না কোনও বিপদে পড়ে যায়।
দূর! বিরক্ত কণ্ঠে বলল জিমি। ভূত থাকলে না বিপদে পড়বে! যদি একটু সাহস করে, এক ঘুমে রাত পার করে দিতে পারবে। কোনও অসুবিধে হবে না।
যে রকম তাঁদড় মেয়ে! বলল হ্যারি। ও ঠিকই পারবে। এই আমি বলে দিচ্ছি।
অয়ন কিছু বলছে না, গভীর চিন্তায় মগ্ন। ওকে একটা ধাক্কা দিল জিমি। অ্যাই, অয়ন!
যেন ঘুম থেকে জাগল ও। বলল, কী ব্যাপার?
গুম মেরে আছিস যে! মেয়েটা তো ওদিকে ঠিকই ভাঙা বাড়িতে রাত কাটিয়ে আসবে। বাজিতে হারানো যাবে না ওকে।
অত চিন্তা করছিস কেন? ভুতুড়ে বাড়িতে যাবে যখন, ঠিকই ভূতের দেখা পাবে ও।
কিন্তু ভূত বলে কিছু নেই, প্রতিবাদ করল জিমি। তুই-ই তো বলিস।
সত্যিকারের ভূত দেখবে, তা তো বলিনি, শয়তানী হাসি ফুটল অয়নের ঠোঁটে। ভয় দেখাব আমরা, ভূত সেজে!
তিন
স্কুলে সুনাম আছে অয়নের–ভাল ছাত্র এবং শান্ত-সুবোধ ছেলে হিসেবে। তবে চাইলে ও দুষ্টের শিরোমণি হতে পারত। মাথায় যেরকম বুদ্ধি, শয়তানী শুরু করলে সবার নাকে দম তুলে দিতে পারত। ভাগ্য ভাল, সেই বুদ্ধি অয়ন ভাল কাজে ব্যবহার করে। তবে আজকের পরিস্থিতি ভিন্ন। ভিক্টোরিয়া ওয়েস্টমোর খেপিয়ে দিয়েছে ওকে। ওই মেয়ের দর্পচূর্ণ করতে না পারলে রাতে ঘুম হবে না ওর। আর রিয়াকে শায়েস্তা করার জন্য ভাল ছেলের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে-এটাই বাস্তবতা।
সারাটা বিকেল প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জাম সংগ্রহে ব্যস্ত রইল অয়ন। নিজের বাসা তো তোলপাড় করলই, জিমির বাসাতেও হানা দিল। অবাক হয়ে জিমি দেখল, জমানো টাকা খরচ করে দোকান থেকে কয়েকটা জিনিস কিনছে ও। এক ফাঁকে লাইব্রেরিতে গিয়ে গ্রিড়লি হাউস, মানে ওই বাড়িটা সম্পর্কেও পড়াশোনা করে এল। শঙ্কিত বোধ করল জিমি, অয়নের যেরকম প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে, শেষে মেয়েদুটো না হার্টফেল করে!
রাত আটটার দিকে খাওয়া-দাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়ল দুবন্ধু। সোয়ানসন কোভ বেশ দূরে, সেটা পেরিয়েও কয়েক মাইল এগোতে হবে ওদের। সাইকেলে যাচ্ছে, পৌঁছুতে ঘন্টাদুয়েক লেগে যাবে। ট্যাক্সি নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল জিমি, অয়ন রাজি হয়নি। প্রতিপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে রাজি নয় ও। ওদের অভিভাবকেরা দুজনের কিম্ভুত কাণ্ডকারখানায় অভ্যস্ত হয়ে গেছেন এতদিনে, রাতে বেরুতে চায় শুনে বাধা দেননি, কোনও প্রশ্নও করেননি।
অয়নের কাঁধে একটা হ্যাঁভারস্যাক, তাতে সমস্ত মালমশলা নেয়া হয়েছে। ওরা দুজনই শুধু এই নৈশ অভিযানে চলেছে। হ্যারি আর ভিকটরও আসতে চেয়েছিল, কিন্তু মানা করে দিয়েছে অয়ন। যত বেশি মানুষ, তত বেশি ঝামেলা। নীরবে শাই শাই করে প্যাডাল মেরে এগিয়ে চল ওরা।
গ্রিডলি হাউস সম্পর্কে কী কী জানলি? চলতে চলতে একসময় জিজ্ঞেস করল জিমি।
খুব বেশি কিছু না, জবাব দিল অয়ন। শুধু এটুকু জেনেছি যে, বাড়িটা তৈরি হয়েছিল চল্লিশের দশকে। মালিক পিটার গ্রিডলি ছিলেন নাবিক। সারা পৃথিবী চষে বেড়িয়েছেন এককালে। শেষ বয়সে লস অ্যাঞ্জেলেসে এসে থিতু হন, বাড়ি বানান। চিরকুমার ছিলেন ভদ্রলোক, বিয়ে-থা করেননি। বিশাল বাড়িটায় নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করতেন; সঙ্গে থাকত অল্প কয়েকজন চাকর-বাকর। ১৯৬৮ সালে মারা যান তিনি, নব্বই বছর বয়সে।
স্বাভাবিক মৃত্যু
না, খুন হয়েছিলেন ভদ্রলোক। সম্ভবত ডাকাতের হাতে। বাড়ি ভর্তি মূল্যবান জিনিসপত্র ছিল, তার মৃত্যুর পর গায়েব হয়ে যায় সেগুলো। চাকর-বাকররা পালিয়ে যায় ভয়ে। পুলিশের ধারণা, কাজটা তাদের যোগসাজশেই ঘটেছিল, তবে শেষ পর্যন্ত কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
ইন্টারেস্টিং! তারপর কী হলো?
মিস্টার গ্রিডলির কোনও আত্মীয়স্বজন ছিল না। কোনও উইলও তিনি করে যাননি। তাঁর উকিল অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু কোনও উত্তরাধিকারী খুঁজে বের করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত বাড়িটা পরিত্যক্ত হয়ে যায়। ওটা এখন সরকারি সম্পত্তি।
ভূতের ব্যাপারটা?
মিথ। অপঘাতে মারা যাওয়া একজন লোকের বাড়ি… বছরের পর বছর খালি পড়ে রয়েছে, কাজেই আপনাআপনিই সেটাকে ভুতুড়ে ভাবতে শুরু করেছে লোকজন। তবে কয়েকদিন আগে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। একটা কনস্ট্রাকশন ফার্ম বাড়িটা মেরামতের দায়িত্ব নেয়, তাদের কিছু ওয়ার্কার সেখানে কাজ করতে গিয়েছিল। কিন্তু প্রথম রাতেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে তারা। পালিয়ে বেঁচেছে। কী দেখেছিল, জানার চেষ্টা করেছে পত্রিকাঅলারা। কিন্তু তারা মুখ খোলেনি।
হুঁ, ব্যাপারটা সুবিধের মনে হচ্ছে না।
দূর! অযথাই ভয় পেয়েছে ব্যাটারা। একটু বেশি কল্পনাপ্রবণ হয়ে পড়েছিল হয়তো।
তা-ই যেন হয়, বিড়বিড় করল জিমি।
পথ শেষ হলো একসময়। গ্রিডলি হাউসের পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছুল ছেলেরা। ঘড়ির দিকে তাকাল অয়ন, দশটার ওপরে বাজে। একটানা সাইকেল চালিয়ে হাঁপিয়ে গেছে দুজনেই। রাস্তার পাশে বসে খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিল।
চল, যাওয়া যাক, ধাতস্থ হতেই উঠে দাঁড়াল জিমি।
বোস আরেকটু, বলল অয়ন। এত তাড়াতাড়ি গিয়ে লাভ নেই। এগারোটা বাজুক।
সময় যেন কাটতেই চায় না। জিমি উসখুস করতে লাগল। কিন্তু অয়ন নির্বিকার। ঘাসের ওপর শুয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। মনে হচ্ছে ঘুমিয়েই পড়েছে।
এগারোটা বাজল। হাতঘড়িতে ঘণ্টাধ্বনি দিতেই উঠে পড়ল অয়ন। সাইকেলদুটো লুকানো হলো ঝোঁপের ভেতরে। তারপর দুবন্ধু রাস্তা ধরে উঠতে শুরু করল।
বিশাল বাড়িটা চোখে পড়ল একটু পরই। পাহাড়ের ওপরে আকাশের পটভূমিতে কাঠামোটা ভৌতিক লাগছে। চারপাশে ভাঙাচোরা বাউণ্ডারি ওয়াল, সামনে বিরাট লোহার গেট কবজা থেকে আলগা হয়ে ঝুলছে। গেট পেরিয়ে রাস্তাটা চলে গেছে গাড়িবারান্দা পর্যন্ত। চওড়া খিলানঅলা দোতলা বাড়িটা এককালে নিশ্চয়ই খুব সুন্দর ছিল, এখন অযতে-অবহেলায় নষ্ট হয়ে গেছে। চারপাশে লম্বা লম্বা আগাছা আর ঝোঁপঝাড় জন্মেছে। বেশিরভাগ দরজা-জানালাই চৌকাঠ থেকে খুলে খুলে পড়ছে। সব মিলিয়ে পরিবেশটা বিদঘুঁটে ঠেকল।
গেট নয়, ভাঙা দেয়াল টপকে বাউণ্ডারির ভেতর ঢুকল অয়ন-জিমি। পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল বাড়িটার দিকে। দুজনেই কালো রঙের পোশাক পরেছে। দূর থেকে দেখলেও হঠাৎ করে বোঝা যাবে না। সদর দরজায় আবছা আলোর আভা দেখা যাচ্ছে। আড়াল থেকে উঁকি দিল
বিশাল একটা হলঘর, ওপরের অংশটা গিয়ে ঠেকেছে দোতলার ছাদে। হলঘরের মাঝখানে একটা মাঝারি আকারের পোর্টেবল লাইট জ্বলছে; তার পাশে মেঝেতে একটা চাদর বিছিয়ে বসে আছে রিয়া আর নোরা; স্যাণ্ডউইচ খাচ্ছে। একপাশে দুটো ভাজ করা স্লিপিং ব্যাগ দেখা গেল।
ঘরটার ওপর আবার মনোযোগ দিল অয়ন। একদিকে ঘোরানো চওড়া সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলার ব্যালকনিতে, হলঘরের ঠিক ওপরেই সেটা। কয়েক মুহূর্ত ভাবল ও, প্ল্যান খাড়া করল। তারপর জিমিকে ইশারা করে সরে এল সদর দরজা থেকে।
দোতলায় উঠতে হবে, বলল ও।
কীভাবে? জিমি ভুরু নাচাল। সিঁড়ির সামনে মেয়েদুটো বসে আছে।
অন্য একটা পথ খুঁজে নেব, আয়।
বাড়ির চারপাশে চক্কর দিতে শুরু করল দুজনে। টর্চ জ্বালল খুব কম-যখন জালল, হাত দিয়ে আলোটা আড়াল করে রাখল, স্থায়িত্বও হলো অল্প সময়ের জন্য। একটু পরই পথ পাওয়া গেল। মাটি থেকে দেয়াল বেয়ে ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে একটা মোটা লতা-ঝাড়। সেটার পাশে দোতলায় একটা জানালা দেখা যাচ্ছে, পাল্লাদুটো ভাঙা।
জিমির দিকে চেয়ে ছোট করে মাথা ঝাঁকাল অয়ন, তারপর লতা ঝাড় বেয়ে তরতর করে উঠে গেল ওপরে। জানালা দিয়ে শরীর গলিয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে। একটু পর জিমিও একই কায়দায় চলে এল।
দোতলার একটা কামরায় এসে ঢুকেছে ওরা। পুরনো একটা গন্ধ ঝাঁপটা মারল নাকে। টর্চ জেলে দেখল, আশপাশে বাতিল জিনিসপত্র স্তূপ করে রাখা। এককোণে একটা কাঠের বাক্স দৃষ্টি আকর্ষণ করল অয়নের, জিনিসটা ততটা পুরনো মনে হচ্ছে না। সেদিকে এগিয়ে গেল ও।
কী করছিস? অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল জিমি।
বাক্সটা ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে, বলল অয়ন। দেখি, ভেতরে কী আছে।
ফালতু কাজে সময় নষ্ট না করলে হয় না?
কাজটা ফালতু নয়। এই বাক্স এখানে কী করছে? দেখে তো তেমন পুরনো মনে হচ্ছে না।
ডালায় কোনও তালা নেই। খুলে ফেলল অয়ন, ভেতরে আলো ফেলল। পরমুহূর্তেই মুখ দিয়ে বিস্ময়সূচক আওয়াজ বেরুল ওর। বেশ অবাক হয়েছে।
বাক্সের ভেতর সুন্দর করে সাজানো আছে অসংখ্য সাদা কাগজের শিট–পরিমাণে শখানেক রিমের কম না। একটা তুলে নিয়ে পরীক্ষা করল ও–পার্চমেন্ট কাগজ।
আশ্চর্য তো! বিড়বিড় করল অয়ন। এখানে পার্চমেন্ট আনল কে?
অয়ন! জিমির গলায় স্পষ্ট বিরক্তি। এসব বন্ধ করবি? অযথা সময় নষ্ট হচ্ছে।
কী জানি! কাঁধ ঝাঁকাল অয়ন। হয়তো ঠিকই বলছিস। যে-কাজে এসেছি, সেটা আগে শেষ করা দরকার। এ নিয়ে পরে মাথা ঘামাব।
সাবধানে দরজা খুলে বেরুল ওরা। পা টিপে টিপে চলে গেল হলঘরের ওপরের ব্যালকনিতে। দেখল, স্লিপিং ব্যাগ বিছিয়ে শুয়ে পড়েছে রিয়া আর নোরা। পোর্টেবল লাইটটা নিভিয়ে দিয়েছে ইতিমধ্যে।
চমৎকার! অন্ধকারে নিঃশব্দে হাসল অয়ন। এ-ই তো চাই!
মেঝের ওপর হ্যাঁভারস্যাকটা নামিয়ে দ্রুত হাতে জিনিসপত্র বের করল ও। ছিদ্রঅলা একটা কার্ডবোর্ডের বাক্সে কতগুলো ইঁদুর ধরে এনেছিল, সিঁড়ি দিয়ে প্রথমেই ছেড়ে দিল ওগুলোকে নিচে। কিচ কিচ করে ছোটাছুটি শুরু করল ছোট প্রাণীগুলো, দু-একবার স্লিপিং ব্যাগের ওপর দিয়ে লাফালাফি করল–কিন্তু তাতে মেয়েদের ঘুমের কোনও ব্যাঘাত ঘটল না।
ছোট একটা ক্যাসেট প্লেয়ার বের করল অয়ন। বিকেলবেলা বসে বসে একগাদা হরর মুভি থেকে ভয়ঙ্কর সব শব্দ রেকর্ড করেছে ও। এখন সেটা ফুল ভলিউমে ছেড়ে দিল। পিলে চমকানো শব্দে ভরে গেল সারা বাড়ি। গভীর রাত, ঘুটঘুঁটে অন্ধকার, তার মধ্যে অপার্থিব শব্দ খনখন করে কানে বাজছে। জিমির নিজেরই শরীর কেমন জানি শিরশির করে উঠল। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, স্লিপিং ব্যাগের ভেতর শোয়া দেহদুটো একটুও নড়ল না।
অয়ন নিজেও কম অবাক হয়নি। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে খেপে গেল ও। ব্যাগ থেকে দুটো সাদা চাদর বের করল, আর সাদা দুটো মুখোশ। একসেট দিল জিমিকে, অন্যটা নিজে নিল। সারা শরীরে চাদর পেচিয়ে মাথায় মুখোশ পরল। দুটো বোতল নিল হাতে। লাল রঙ গুলে ঘন করে রক্ত বানিয়েছে অয়ন, বোতল ভর্তি রয়েছে সেই জিনিস।
সিঁড়ি দিয়ে হলঘরে নেমে এল দুজনে। তারপর ছোটাছুটি শুরু করল। দৌড়ের ফাঁকে ফাঁকে বোতল থেকে রক্ত ছিটাচ্ছে; স্লিপিং ব্যাগদুটোর ওপরেও ফেলল খানিকটা; কিন্তু কোনও প্রতিক্রিয়া নেই।
হঠাৎ কোত্থেকে যেন পায়ের সঙ্গে টানটান করা একটা দড়ি বেধে গেল, হুমড়ি খেয়ে পড়ল অয়ন। বেকায়দা একটা ল্যাঙ খেয়ে জিমিও ভূপাতিত হলো। পরমুহর্তেই আক্রান্ত হলো দুবন্ধু। অয়নের দুহাত মুচড়ে পেছনে নিয়ে যাওয়া হলো। ক্লিক করে দুটো শব্দ হলো–চামড়ায় ধাতব শীতল স্পর্শে ও বুঝল, হ্যাণ্ডকাফ পরানো হয়েছে। একটু পর।
একই দশা হলো জিমিরও।
পোর্টেবল লাইটটা জ্বলে উঠল হঠাৎ। সেই আলোয় ওরা দেখল, কোমরে দুহাত রেখে বিজয়ীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে রিয়া, পাশে নোরা। স্লিপিং ব্যাগের দিকে তাকাল অয়ন, এখনও ফুলে আছে। ডামি সাজিয়ে এতক্ষণ বোকা বানানো হয়েছে ওদের। মেয়েদুটো লুকিয়ে ছিল অন্ধকারে।
বাহ! বাহ! বলে উঠল রিয়া। কেমনতরো ভূত রে বাবা! ধরাই পড়ে গেল? চেহারাদুটো দেখি তো টান দিয়ে মুখোশদুটো খুলে ফেলল সে।
বলল, সে কী! ভূত কোথায়, এ দেখছি একজোড়া পাবদা-পুঁটি। অয়ন হোসেন আর জিমি পারকার… নিজেদের যারা গোয়েন্দা বলে পরিচয় দেয়। তা, সাঙ্গপাঙ্গরা সব কোথায়?
আর কেউ নেই, বলল অয়ন। আমরা দুজনই।
তাই নাকি? বিশ্বাস করতে বলো?
সে তোমার ইচ্ছা।
ছাড়া আমাদের, রিয়া! চেঁচিয়ে উঠল জিমি। ভাল হচ্ছে না কিন্তু!
ভিক্টোরিয়া বলো! রেগে গেল রিয়া। বন্ধুরাই শুধু আমাকে রিয়া বলে। তোমরা আমার শত্রু।
আমরা কেউ কারও শত্রু নই, শান্তস্বরে বলল অয়ন। তোমার ধারণা ভুল।
শত্রু নও তো ভয় দেখাতে এসেছ কেন?
দুষ্টুমি করতে। দুষ্টুমি তো মানুষই করে, নাকি? এই বাজিটার ব্যাপারে আমরা বড়জোর প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারি, শত্রু নই। শত্রুতা খুব খারাপ জিনিস।
তোমাদের সঙ্গে ভাল হতে বয়েই গেছে আমার। কী ভেবেছ আমাদের, কচি খুকি? ভূতের ভয় দেখালে, আর ভয় পেয়ে পালিয়ে গেলাম?
তুমি বুদ্ধিমতী, স্বীকার করি, বলল অয়ন। সত্যি বলছি, এতটা আশা করিনি আমি। বুঝলে কী করে?
হুঁহ! তোমাদের মত ছেলেদের হাড়ে হাড়ে চিনি আমি। এমন কিছু যে করবে, শুরুতেই অনুমান করেছিলাম। আমার মামা পুলিশ, তার কাছ থেকে হ্যাণ্ডকাফ চেয়ে এনেছি তোমাদের শিক্ষা দেব বলে। বদমাশের দল, এভাবে ভয় দেখায় কেউ? সেই কখন থেকে উল্টোপাল্টা শব্দ শুরু করেছ! আমি না থাকলে নোরা তো হার্টফেলই করত।
কখন থেকে মানে? অয়ন অবাক। আমরা তো মাত্রই এলাম।
অস্বীকার করে লাভ নেই। গত দুঘণ্টা থেকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছ তোমরা।
কী বলছ? প্রতিবাদ করল জিমি।
দুঘণ্টা আগে আমরা এখানে ছিলামই না। আমরা এসেছি এই একটু আগে।
তা হলে অন্য কেউ, রিয়া বলল। ক্লাসে পাবদা-পুঁটির অভাব আছে নাকি?
উঁহুঁ, ক্লাসের কেউ না, অয়ন মাথা নাড়ল। ওরা কেউ হলে আমরা জানতাম।
তোমরাও না, ওরাও না, চোখ ছোট ছোট করে প্রশ্ন করল রিয়া, তা হলে কে?
তৃতীয় কোনও পক্ষ। ব্যাপারটা ভাল ঠেকছে না। আমাদের হাত খুলে দাও, রিয়া…
ভিক্টোরিয়া বলো! কড়া স্বরে বলল রিয়া।
ঠিক আছে, ঠিক আছে, ভিক্টোরিয়া। আমাদের হাত খুলে দাও। এখান থেকে সরে পড়তে হবে। বিপদ ঘটতে পারে। চলো, তোমাদেরকে বাড়ি পৌঁছে দেব।
চালাকি হচ্ছে, না? এত সহজে যাচ্ছি না আমরা। রাত কাটাতে এসেছি, রাত কাটিয়েই ফিরব। তোমাদের হাতও খুলছি না। পা তো বাধা নেই। ইচ্ছে হলে যেতে পারো, তবে হাতকড়া পরা অবস্থায়। অবশ্য সকাল পর্যন্ত যদি অপেক্ষা করো, তা হলে বিকল্প কিছু ভাবা যেতে পারে।
রেগেমেগে কী যেন বলতে যাচ্ছিল জিমি, হঠাৎ ঘটঘট জাতীয় একটা শব্দ শোনা গেল। অয়নের ক্যাসেট প্লেয়ার নয়, এটা অন্য কোথাও থেকে আসছে। সেই শব্দ ছাপিয়ে আরেকটা আওয়াজ ভেসে এল। মোটা গলায় আর্তনাদ, যেন তীব্র যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে কেউ।
ও…ওটা কী? ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠল নোরা। আঙুল তুলে একদিক দেখাচ্ছে।
তাকাল ওরা। দেয়ালের গায়ে আবছা করে ফুটে উঠেছে একজন মানুষের মুখ, তাতে যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট। খালি এপাশ-ওপাশ করছে। কয়েক সেকেণ্ড পরেই মিলিয়ে গেল সেটা।
মিছে কথা বলছিলে, না? রাগী গলায় বলল রিয়া। আর কেউ আসেনি? তা হলে এবার কে ভয় দেখাল?
জানি না, মাথা নাড়ল অয়ন। আমার ধারণা নেই।
তার দরকারও নেই। আমি যাচ্ছি দেখতে। এমন শিক্ষা দেব… নোরা, এসো!
একা যেয়ো না।
সেটা আমি বুঝব! কই, নোরা, এসো! হলঘরের পাশের একটা দরজা ধরে বেরিয়ে গেল দুজনে।
ওই মেয়ের সঙ্গে লাগতে যাওয়া উচিত হয়নি, এখন বুঝতে পারছি, জিমি বলল। আগামী দিন স্কুলে গিয়ে ফলাও করে সব বলে বেড়াবে। ছি ছি, কী বেইজ্জতি! মুখ দেখাব কেমন করে?
আমি ভাবছি অন্য কথা, অয়ন চিন্তিত স্বরে বলল। এইমাত্র কী দেখলাম আমরা? এর জন্য কে দায়ী? ক্লাসের কেউ নয়। তা হলে কে?
উদ্বেগটা জিমির ভেতরও সংক্রামিত হলো। ঠিক তক্ষুণি নারীকন্ঠের একটা আর্তচিৎকার শোনা গেল। রিয়ারা যেদিকে গেছে, সেদিক থেকেই। গলাটাও পরিষ্কার চেনা গেল।
নোরা!
চার
চঞ্চল হয়ে উঠল দুবন্ধু।
চিৎকার শুনলি? জিমি বলল।
হুঁ, মাথা ঝাঁকাল অয়ন। নিশ্চয়ই বিপদে পড়েছে।
কিন্তু কী ধরনের বিপদ?
কী করে বলব? ঝড়ের বেগে চিন্তা করছে অয়ন। হঠাৎ দোতলার বাক্সটার কথা মনে পড়ল। পরক্ষণেই ব্যাপারটা বুঝে ফেলল ও।
জিমি, উত্তেজিত কণ্ঠে বলল ও। বোধহয় ধরতে পেরেছি ঝামেলাটা!
মানে?
পার্চমেন্ট কাগজ! ওটাই রহস্যের চাবিকাঠি।
কীসের রহস্য? অয়ন, তোর মাথা ঠিক আছে তো? আমরা এসেছি দুটো মেয়েকে ভয় দেখাতে, কোনও রহস্যের তদন্ত করতে না।
মাথা ঠিকই আছে। তবে এটা যে বদমাশ লোকের আস্তানা, তা আগে বুঝতে পারিনি।
তোর এই হিব্রু বলাটা বন্ধ করবি একটু? সোজা করে বল না, ভাই!
বলছি। পার্চমেন্ট কাগজ কেন ব্যবহার করা হয়, জানিস?
না তো!
টাকার নোট ছাপতে।
তাই?
হ্যাঁ। ওপরে এক বাক্স পার্চমেন্ট কাগজ পড়ে আছে। আর ওই শব্দটা খেয়াল কর। ছাপার মেশিনের মত মনে হচ্ছে না?
তুই কি বলতে চাইছিস…
হ্যাঁ, জাল নোট ছাপার একটা মেশিন আছে এ বাড়িতে। এজন্যেই মানুষকে ভূতের ভয় দেখিয়ে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে।
রিয়া আর নোরা কি এদের হাতেই ধরা পড়ল?
নয়তো কী? আমাদেরও ধরতে আসবে। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে, জিমি। সবার আগে এই হ্যাণ্ডকাফ দুটো খুলতে হবে।
কীভাবে? চাবি তো নেই। ডাইনিটা নিজেও মরল, আমাদেরও মেরে রেখে গেল।
দুপায়ের তলা দিয়ে ঘুরিয়ে হাতদুটো সামনে নিয়ে এসেছে অয়ন, দেখাদেখি জিমিও তাই করল।
এত সহজে হাল ছেড়ে দেয়ার কোনও মানেই হয় না, অয়ন বলল। একটা না একটা পথ আছেই।
চল ভাগি, প্রস্তাব দিল জিমি। পুলিশে গিয়ে খবর দেব। যা করার ওরাই করবে।
উঁহুঁ, সম্ভব নয়। এই অবস্থায় সাইকেল চালাতে পারব না। গেলে হেঁটেই যেতে হবে। অনেক সময় লেগে যাবে। ততক্ষণে আমাদের না পেয়ে হুঁশিয়ার হয়ে যাবে ক্রিমিনালরা। পুলিশ এসে কিছুই পাবে না।
তা হলে?
আশপাশে তাকাল অয়ন। স্লিপিং ব্যাগের পাশে মেয়েদের ব্যাগদুটো পড়ে আছে। জিমিকে বলল, আয়, ব্যাগদুটো খুঁজে দেখি। রিয়ার ব্যাগে হ্যাণ্ডকাফের চাবি থাকতে পারে।
মাথা নাড়ল জিমি। আমার তা মনে হয় না। নিশ্চয়ই পকেটে করে নিয়ে গেছে।
বেশি কথা বলিস না। খুঁজতে অসুবিধা কী?
ব্যস্ত হয়ে পড়ল দুবন্ধু। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি সত্যি চাবিদুটো পেয়ে গেল জিমি। চটপট নিজেদের মুক্ত করল ওরা।
তক্ষুণি কাদের যেন পায়ের শব্দ শোনা গেল।
জলদি আয়! জিমিকে তাড়া লাগাল অয়ন।
কোথায়?
দোতলায়। বেকায়দা পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য অস্ত্র প্রয়োজন।
ছুটে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেল দুবন্ধু। ছোঁ মেরে বারান্দা থেকে নিজের ব্যাগটা তুলে নিল অয়ন। তারপর দুজনে যেখান দিয়ে এসেছিল, সে কামরায় ঢুকে পড়ল। ছুটতে ছুটতে দেখতে পেয়েছে, দুজন লোক এসে ঢুকেছে হলঘরে।
দোতলায় যাচ্ছে ওরা, বলে উঠল একটা কণ্ঠ।
ধরো, ধরো! অন্যজন চেঁচিয়ে উঠল।
রুমে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিল অয়ন। হাঁপাতে হাঁপাতে জিমি বলল, এবার?।
জবাব না দিয়ে ব্যাগের মুখ খুলল অয়ন। রিয়াদের ভয় দেখাতে যা যা এনেছিল, সব ব্যবহার করা হয়নি। এগুলোর মধ্যে কোন্টা অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা যায়, ভাবছে। অচিরেই পেয়ে গেল সমাধান। মুখে হাসি ফুটল ওর।
এক বাক্স মার্বেল আছে ব্যাগে, জানালার কাঁচ ভাঙার জন্য এনেছিল। আরও আছে বেশ কিছু আতশবাজি আর পটকা, এবং এক বাক্স মাকড়সা-এ সবই কাজে লাগবে ওর। জিমিকে প্ল্যানটা বুঝিয়ে দিল ও, তারপর দুজনে এক কোণে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসল।
একটু পরেই দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকল দুই দুবৃত্ত। একটা আতশবাজিতে আগুন ধরিয়ে তাদের পায়ের কাছে ছুঁড়ে দিল অয়ন। তীব্র আলোয় চোখ ঝলসে গেল লোকদুটোর। আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে চোখের কাছে হাত তুলে পিছিয়ে গেল তারা। ছুটে গিয়ে তাদের গায়ে মাকড়সা ছেড়ে দিল জিমি।
কুৎসিত প্রাণীগুলো কিলবিল করে উঠতেই লাফাতে শুরু করল দুই গুণ্ডা। তাদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এল অয়ন আর জিমি। দৌড় দিল। নামার সময় সিঁড়ির ওপর মার্বেলগুলো ছড়িয়ে দিল অয়ন।
দারুণ খেপে গিয়ে ওদেরকে ধাওয়া করল লোকদুটো। কিন্তু সিঁড়িতে পা দিতেই মার্বেলে পা হড়কাল। দড়াম করে আছাড় খেল তারা, গড়াতে গড়াতে হলঘরে এসে পড়ল। বেকায়দা আছাড় খেয়ে ব্যথা পেয়েছে দুজনেই, ককিয়ে উঠল।
সামলে ওঠার আগেই আবার আক্রান্ত হলো তারা। ইতিমধ্যেই হ্যাণ্ডকাফ দুটো মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিয়েছে ছেলেরা, গুণ্ডাদের উপুড় করে ঝটপট পরিয়ে দিল। যে দড়িটা দিয়ে অয়নকে ফাঁদে ফেলেছিল রিয়া, সেটা দিয়ে গুণ্ডাদের পা-ও বেঁধে ফেলা হলো। ব্যাটারা চেঁচামেচি করছিল, কাজেই রুমাল দিয়ে তাদের মুখও বেঁধে ফেলতে বাধ্য হলো ওরা।
গুড জব! দুবন্ধু হাত মেলাল।
এবার খুঁজে বের করতে হবে মেয়েদের। বলল অয়ন।
পাঁচ
কিছুক্ষণ আগের ঘটনা।
হলঘরের পাশের দরজাটা পার হতেই একটা করিডর পেল মেয়েরা। টর্চের আলো ফেলল রিয়া, দুপাশে কয়েকটা দরজা দেখা যাচ্ছে।
এসো, দুজনে ভাগাভাগি করে খুঁজে দেখি, প্রস্তাব দিল ও।
আমার ভয় করছে, বলল নোরা।
ভয় তো তখনও করেছিল, কিন্তু দেখলে তো ভূতগুলো কে ছিল। ওদের দোস্তরাই লুকিয়ে আছে কোথাও। ভয়ের কিছু নেই। যাও!
ঠিক আছে, নোরার কণ্ঠে দ্বিধা।
ওকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ডানপাশের প্রথম দরজাটা খুলে ঢুকে পড়ল রিয়া। নোরা গেল বামে। কিন্তু রুমের ভেতর পা দিয়েই চিৎকার করে উঠল সে।
ছুটে ডানের কামরা থেকে বেরিয়ে এল রিয়া। বামের দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকে ও নিজেও থমকে গেল। রুক্ষ চেহারার দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে রুমের ভেতর, হাতে পিস্তল। একটা নোরার দিকে তাক করা, অন্যটা ওর দিকে ঘুরে গেল।
খবরদার! চাপা গলায় ধমকে উঠল একটা লোক। চেঁচালে মাথার খুলি উড়িয়ে দেব।
এসবের মানে কী? কড়া গলায় বলল রিয়া।
চুপ! কোনও কথা নয়। আগে বাড়ো।
করিডরের শেষ মাথায় একটা রুমে ওদের নিয়ে যাওয়া হলো। মেঝে থেকে একটা ট্র্যাপডোর খুলল এক লোক। অন্যজন হুকুম দিল, নিচে নামো।
পুরনো সিঁড়ি ধাপে ধাপে নেমে গেছে ভূগর্ভে। সেটা বেয়ে নেমে * গেল সবাই। আলোকিত একটা রুমে পৌঁছুল। বিশাল ঘর, আগে সম্ভবত ভাড়ার ছিল। এখন সমস্ত তাক-টাক সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ঘটঘট শব্দটা বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। এক কোণে একটা ছাপার মেশিন চলছে–সেটাই এর উৎস। দুজন লোক কাজ করছে তাতে।
রুমের ভেতর একটা টেবিল আছে, সঙ্গে কতগুলো পুরনো চেয়ার আর একটা বড় সোফা। এক কোনায় একটা বিছানাও দেখা গেল। ময়লা চিটচিটে চাদরে কতদিন সাবান পড়েনি কে জানে।
সোফায় বসে ছিল পঞ্চম লোকটা। ওদের দেখে উঠে দাঁড়াল।
আরে? বলল সে, কণ্ঠে বিস্ময়। টেড. এদের এখানে এনেছ কেন?
বড্ড বেশি ছোঁকছোঁক করছিল, বস, জবাব দিল টেড। প্রজেক্টরটা সরানোর আগেই রুমে এসে ঢুকল। ধরে না এনে উপায় কী?
ভাল করেছ, মেয়েদের সামনে এসে দাঁড়াল লোকটা। তা হলে, তোমরাই সেই দুঃসাহসী শিশু? তা, কোন দুঃখে হানাবাড়িতে রাত কাটাতে এসেছ?
আমরা শিশু নই, মুখ ঝামটে বলল রিয়া। ভাল হবে না বলে দিচ্ছি। আমাদের যেতে দিন।
সেটা তো আরও খারাপ হবে। সবাইকে গিয়ে আমাদের কথা বলে দেবে, তা হতে দেয়া যায় না। এরচেয়ে দুটো গুমখুন অনেক ভাল।
কথাটা শুনে দুজনেই কেঁপে উঠল।
কেন, খুনের প্রসঙ্গ আসছে কেন? নাহয় একটা ছাপাখানাই চালাচ্ছেন, এত রাখঢাকের কী আছে?
এটা কোনও সাধারণ ছাপাখানা নয়। টাকা ছাপি আমরা। এই দেখো! টেবিল থেকে সদ্য ছাপা একজোড়া কাগজ দেখাল লোকটা-একশো ডলারের অনেকগুলো নতুন নোট। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, তোমাদের ছেড়ে দিলে কত বড় বিপদ হতে পারে বুফনদের?
ভয় পেয়ে ঢোক গিলল রিয়া আর নোরা।
বাঁধো ওদের! নির্দেশ দিল লোকটা।
দুজনকে দুটো চেয়ারে বসিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল গুণ্ডারা। কাজ শেষ করে রেঙ বলল, হলঘরে আরও দুটো ছেলে আছে, মি. মরটন। কী করব?
ধরে নিয়ে এসো, বলল মরটন। আমি কোনও ঝুঁকি নিতে রাজি নই। টেডকে সঙ্গে নিয়ে যাও।
কাঁধ ঝাঁকিয়ে দুই গুণ্ডা চলে গেল। মরটন আবার সোফায় গিয়ে বসল।
গেল আমাদের আশা! শ্বাস ফেলে বিড়বিড় করল নোরা। অয়ন আর জিমি মুক্ত থাকলে একটা কথা ছিল।
ফালতু কথা বোলো না, রাগী গলায় বলল রিয়া। ওই পাবদা পুঁটিরা কিনা বাঁচাবে আমাদের। ভীতুর ডিম, দেখো, ঠিকই পালাবার পথ খুঁজছে।
ওদের তুমি চেনো না, রিয়া। মারাত্মক সাহসী, গুণ্ডা-পাণ্ডাদের থোড়াই পরোয়া করে। ধরা না পড়লে ঠিকই একটা ব্যবস্থা করবে।
হয়েছে, আর ছেলেদের হয়ে ওকালতি করতে হবে না। এরকম গুণ্ডাদের বিপক্ষে পুঁচকে দুটো ছোঁড়া? আর হাসিয়ো না। ইস, আমার মামাটা যদি এসে পড়ত!
মামার কথা ভেবে লাভ হবে না। এখন শুধু ঈশ্বরই পারেন আমাদের বাঁচাতে।
নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করল নোরা। ওকে আর কিছু বলতে পারল না রিয়া। ওর নিজের ভেতরটাও কেমন যেন করে উঠল।
ছয়
রিয়াদের পথ ধরে তল্লাশি শুরু করল অয়ন আর জিমি। বামদিকের প্রথম রুমটায় ছোট প্রজেক্টরটা পেল। দেয়ালের একটা ফোকর দিয়ে ছবি ফেলা হয়।
হুঁ, দামি জিনিস, মন্তব্য করল অয়ন। স্পেশাল লেন্স আছে, ছবি একদম জীবন্ত মনে হয়।
শব্দটা হচ্ছিল কীভাবে? জিমি প্রশ্ন করল।
হলঘরের ভেতর নিশ্চয়ই স্পীকার লুকানো আছে। খরচা ভালই করেছে ব্যাটারা। করবে না-ই বা কেন? সামান্য ভূতের ভয় দেখিয়েই যদি এরকম একটা প্রজেক্ট লুকিয়ে রাখা যায়, তা হলে এটুকু খরচ তত সামান্যই।
হ্যাঁ, ছাপাখানা বসানোর জন্য আদর্শ জায়গাই বেছেছে! পুরনো বাড়ি, বছরের পর বছর ধরে পরিত্যক্ত-আর কী চাই?
হুঁ, এখন কথা হচ্ছে-মেয়েদুটো গেল কোথায়?
ছাপার মেশিনের শব্দটা… বলল জিমি। নিচ থেকে আসছে মনে হচ্ছে না?
গুড পয়েন্ট, জিমি! মাটির নিচে নিশ্চয়ই কোনও কামরা আছে, যন্ত্রটা ওখানেই। মেয়েদেরকেও নিশ্চয়ই ওখানেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
কিন্তু দরজাটা কোথায়?
সেটাই খুঁজে বের করতে হবে। আয়, শব্দটা কোথায় বেশি-বের করি। দরজাটাও সেখানেই হবে।
করিডরে বেরিয়ে এল দুবন্ধু। একটু পরেই ট্র্যাপডোরটা পেয়ে গেল ওরা। হুট করে নিচে নামা চলবে না। ধরা পড়ে যাবে তা হলে। সাবধানে ট্রাপচোর ফাঁক করে নিচটী দেখার চেষ্টা করল ওরা।
আলো জ্বলছে নিচে, ফিসফিসাল অয়ন।
কারেন্ট পেল কোথায়? বলল জিমি। এ বাড়িতে কোনও সাপ্লাই নেই। জেনারেটরেরও শব্দ পাচ্ছি না।
নিশ্চয়ই কোথাও থেকে চোরাই লাইন নিয়েছে।
হাহ! নোট জালিয়াতি, বিদ্যুৎ চুরি-ব্যাটাদের ক্রাইম দেখছি একটা নয়।
কিন্তু কথা হচ্ছে, ওদেরকে কীভাবে উদ্ধার করা যায়?
তোর বুদ্ধির স্টক ফুরিয়ে গেল নাকি?
তা ফুরোয়নি। কিন্তু ভেতরের অবস্থা না জেনে প্ল্যানও খাড়া করতে পারছি না।
আগে বলবি তো!
ট্র্যাপডোর খুলে সিঁড়ি বেয়ে পা টিপে টিপে নামতে শুরু করল জিমি। অয়ন হতভম্ব হয়ে গেল। পেছন থেকে ফিসফিস করে ধমক দিল ও, অ্যাই, জিমি! কী করছিস?
জবাব না দিয়ে ঠোঁটের ওপর একটা আঙুল চেপে দেখাল জিমি, ওকে চুপ থাকতে বলছে। অয়নের কিছু করার রইল না। জিমি মাঝে মাঝে এমন সব দুঃসাহসিক কাণ্ড ঘটায় যে ভাবলেই গা হিম হয়ে আসে।
উঁকি দিয়ে কামরাটা কয়েক সেকেণ্ড দেখল জিমি, তারপর ফিরে এল।
বলল, তিনজন লোক আছে ভেতরে। দুজন মেশিন নিয়ে কাজ করছে, আরেকজন সোফায় বসে ঝিমোচ্ছে।
মেয়েরা?
আছে, চেয়ারের সঙ্গে বাঁধা। নোরাকে দেখলাম কাঁদছে, ডাইনির অবস্থাও বিশেষ সুবিধের নয়। ফিক ফিক করে হাসল জিমি।
হাসিস না, ওদের ওপর দিয়ে কম ধকল যায়নি।
ঠিক আছে, হাসব না। এখন কী করবি, তা-ই বল।
সামান্য ভাবল অয়ন। বলল, ওখানে তিনজন আছে, তাই তো?
হ্যাঁ।
দুজন কাজ করছে। আর একজন ঝিমোচ্ছ-মানে সবাই অপ্রস্তুত।
ঠিক।
তা হলে এ অবস্থায়ই কাবু করতে হবে ওদের।
কীভাবে?
চল, হলরুমে গিয়ে ওই দুই গুণ্ডার পিস্তল নিয়ে আসি। অস্ত্র দেখিয়েই কাবু করব ওদের।
যদি ভয় না পায়? উল্টো আক্রমণ করে বসে? তুই তো আর সত্যি সত্যি গুলি করতে পারবি না!
এজন্যই তুই থাকবি পেছনে। আতশবাজি আর পটকা নিয়ে। কয়েক মিনিট গুণ্ডাদের ব্যস্ত রেখে রিয়া আর নোরার বাধন খুলে দেব আমি। তুই তখন নিচে পটকা আর আতশবাজি ছুঁড়ে দিবি। সেই গোলমালের ভেতর পালিয়ে আসব আমরা। ট্র্যাপডোরটা আটকে দেব-ওরা ধাওয়া করতে পারবে না।
উঁহুঁ, বুদ্ধিটা আমার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। ঝুঁকি বেশি। অন্য কিছু ভাব। গুণ্ডাদের সামনে পড়া যাবে না।
এর চেয়ে ভাল কিছু মাথায় আসছে না। এটাই করতে হবে।
কিন্তু…
কোনও কিন্তু নয়। ঝুঁকিটা নিতেই হবে। জানিস তো, নো রিস্ক…
নো গেইন, বাক্যটা শেষ করল জিমি।
সাত
নোরার কান্নাটা সহ্য করতে পারল না মরটন খুব বেশিক্ষণ। শেষ পর্যন্ত ধমক দিল, অ্যাই, মেয়ে! চুপ করো!
চেঁচাবেন না! রিয়াও চেঁচিয়ে উঠল। লজ্জা করে না, বাচ্চা দুটো মেয়ের ওপর অত্যাচার করছেন?
ওরে, বাবা, তেজ কত! মুখ খিঁচিয়ে বলল মরটন। এমন চড় মারব, সবকটা দাঁত খসে যাবে।
গায়ে হাত তুলেই দেখুন, কপালে খারাবি আছে!
আরে, আবার মুখে মুখে কথা? এত সাহস পাচ্ছে কোথায়? নাকি ভাবছ আকাশ থেকে কোনও সুপারহিরো এসে তোমাদের রক্ষা করবে?
আকাশের সুপারহিরোর দরকার কী, যখন মাটিতেই সাধারণ হিরো আছে? কণ্ঠটা পেছন থেকে ভেসে এল।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেছে অয়ন, হাতে উদ্যত পিস্তল। কথাগুলো ওরই বলা। পাঁই করে ঘুরে দাঁড়াল মরটন।
অয়ন! কান্না থামিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে বলল নোরা।
চিন্তা কোরো না, বালিকারা, একগাল হাঁসল অয়ন। আমি এসে গেছি!
রিয়াও কম অবাক হয়নি। কিন্তু কথাটা শুনেই রেগে গেল সে। স্থান কাল-পাত্র ভুলে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, খবরদার! আমাদের বালিকা বলবে না।
এদিকে মরটন পুরো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। বিহ্বল কণ্ঠে সে বলল, এসব কী? কে তুমি?
পিস্তল নাচিয়ে অয়ন বলল, আমি কে, সেটা বড় কথা নয়। মাথার ওপর দুহাত তুলে পিছিয়ে যান, মিস্টার। আপনার দুই চ্যালাকেও মেশিন বন্ধ করে হাত তুলতে বলুন। চালাকি করার চেষ্টা করবেন না। পিস্তলে হাত ভাল না আমার। ট্রিগার চাপলে কোথায় না কোথায় গুলি খাবেন কোনও ঠিক নেই।
মিছে ভয় দেখাচ্ছ, খোকা। গুলি তুমি করবে না। বলল মরটন।
ঝুঁকি নিয়ে দেখতে পারেন, কঠিন গলায় বলল অয়ন। আমার কোনও আপত্তি নেই।
ভয় পেল এবার দুবৃত্তরা। কথামত হাত তুলে একত্র হলো। এগিয়ে গিয়ে ছুরি দিয়ে রিয়ার এক হাতের বাঁধন কেটে দিল, তারপর ছুরিটা ওর হাতে তুলে দিল অয়ন। দ্রুত নিজে মুক্ত হলো, তারপর নোরাকেও মুক্ত করল রিয়া।
রাগী গলায় মরটন বলল, রেড আর টেড কোথায়?
কারা, ওই গর্দভ দুটো? হাসল অয়ন। এসব লোককে যে কেন চাকরি দেন! সামান্য দুটো বাচ্চার সঙ্গেই পারে না।
কাজটা কিন্তু ভাল করছ না, ছোকরা। বাঘের লেজে পা দিয়ে ফেলছ!
বাঘ কোথায়, আপনারা হলেন টিকটিকি। লেজে পা দিয়েছি, ওটা এখনই খসে পড়বে।
চল যাই, বলল নোরা।
এত তাড়াতাড়ি নয়! গম্ভীর একটা গলা বলে উঠল।
ঝট করে ঘুরল ওরা। দেখল, দুহাত তুলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে জিমি–তার পেছনে পিস্তল ধরে রেখেছে বিশালদেহী একটা লোক। দাবার ছক উল্টে গেছে।
সরি, অয়ন, বলল জিমি। ব্যাটা কোত্থেকে এল, দেখতে পাইনি।
সশব্দে হেসে উঠল মরটন। বলল, সাবাস, জনসন! কাজের কাজ করেছ!
ইনি কে? গোমড়া মুখে বলল অয়ন। পরিষ্কার বুঝতে পারছে, হার হয়েছে ওদের।
এ হলো আমার পাহারাদার। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সবসময় আশপাশে লুকিয়ে থাকে ও?
এই সময় একটা ঘটনা ঘটে গেল। পিস্তল হাতে ছেলেমেয়েদের খুব কাছে চলে এসেছিল জনসন, খপ করে পাশ থেকে তার কবজি চেপে ধরল রিয়া। অদ্ভুত কায়দায় একটা মোচড় দিতেই আর্তনাদ করে উঠল লোকটা। পরমুহূর্তেই কাঁধের ওপর দিয়ে তাকে ছুঁড়ে দিল রিয়া। পিঠ দিয়ে মেঝের ওপর আছড়ে পড়ল ভারী দেহটা, ককিয়ে উঠল জনসন।
মরটন আর তার দুই সঙ্গী এই আকস্মিক ঘটনায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। এই সুযোগে অয়ন চেঁচিয়ে উঠল, পালাও!
দুদ্দাড় করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল ওরা। ট্র্যাপডোরটা ফেলে হুড়কো আটকে দিল, তারপর ওটার ওপরে ঘরের কোণ থেকে একটা ভারী আলমারি চারজনে মিলে টেনে এনে বসিয়ে দিল। দুবৃত্তরা ভাড়ার ঘরে আটকা পড়ল। ট্র্যাপডোরের পাল্লা কিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করল। শেষে কাজ না হওয়ায় হাল ছেড়ে দিল।
ধন্যি তোমার মার্শাল আর্ট, রিয়াকে বলল অয়ন। আমাদের জীবন বাঁচিয়েছ।
কী যে বলল, জীবনে এই প্রথম কোনও ছেলের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করছে রিয়া। আসল ক্রেডিট তোমাদের।
পুলিশকে খবর দেয়া যায় কীভাবে? বলল জিমি।
কোনও সমস্যা নেই, বলল রিয়া। হলঘরে আমার মোবাইল ফোনটা আছে।
কই, তোমার ব্যাগে তো কোনও মোবাইল দেখলাম না!
আমার ব্যাগে… তোমরা আমার ব্যাগ হাতিয়েছ? রিয়া রেগে। যাচ্ছে।
নইলে হ্যাণ্ডকাফের চাবি পেলাম কোথায়? হাসল জিমি। তোমার আগেই বোঝা উচিত ছিল।
কী! এত বড় সাহস! আমার ব্যাগে হাত দাও…
প্রমাদ গণল অয়ন। কিন্তু নোরা বলল, তুমি থামবে, রিয়া? শখ করে তো আর ঘটেনি। তা ছাড়া ওরা না থাকলে কী হতো, ভেবে দেখেছ?।
তাই তো! মনে পড়ল রিয়ার। অয়নকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, তোমরা আমাদের সাহায্য করতে গেলে কেন? আমরা তো শত্রু!
আবার ভুল করছ, শুধরে দিল অয়ন। আমরা কেউ কারও শত্রু নই! তোমরা বিপদে পড়েছিলে। সাহায্য করাটা আমাদের দায়িত্ব ছিল।
তাই? তোমাদের মত সাহসী ছেলে আমি আগে দেখিনি।
আমরাও তোমার মত সাহসী মেয়ে দেখিনি। আশা করি এখন বুঝতে পারছ, ছেলে আর মেয়ে বলে কোনও ভেদাভেদ নেই। মিলেমিশে কাজ করাটাই আসল। আজ আমরা না থাকলে তোমরা বাঁচতে না, আবার তুমি না থাকলে জনসনের হাত থেকে আমরা বাঁচতাম না। শোধবোধ হয়ে গেল তো?
হুঁ, ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল রিয়া। আচ্ছা শিক্ষা দিয়েছে তাকে এই অয়ন হোসেন। চোখে আঙুল দিয়ে ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়েছে। কী যে লজ্জা লাগছে ওর!
কথাবার্তা পরে বললে কেমন হয়? বলল জিমি। পুলিশে খবর দিতে হবে। ফোনটা কোথায়?
আমার স্লিপিং ব্যাগের নিচে, বলল রিয়া।
আমি নিয়ে আসছি, বলে ছুটল নোরা।
আমি খুব দুঃখিত, অয়ন, ধীরে ধীরে বলল রিয়া। তোমাদের সঙ্গে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি।
ও কিছু না, হাত নাড়ল অয়ন। এখন থেকে ভাল ব্যবহার করলেই চলবে। আমাদের আর পাবদা-পুঁটি বলবে না তো?
কক্ষনো না!
তা হলে আমরাও তোমাকে কাউয়া বুড়ি বলব না, জিমি হাসল।
ভাল কথা, ছেলেদের ক্লাসে সামনে বসতে দেবে?
তা-ও দেব।
তা হলে তো মিটমাট হয়েই গেল, বলল অয়ন। এবার হাত মেলাও, ভিক্টোরিয়া।
মিষ্টি করে হাসল রিয়া। বলল, ওই নামে ডেকো না। বন্ধুরা আমাকে রিয়া বলে।
হাত বাড়িয়ে দিল সে।
***