নূতনের মধ্যে পুরাতনের প্রকাশ

নূতনের মধ্যে পুরাতনের প্রকাশ

এই আমাদের ভারতবর্ষের উপর দিয়া বৈদিক আর্য্য মোঙ্গলীয়, শক-পল্লব, গ্রীক, মুসলমান, পর্তুগীজ, ফরাসী ও ইংরাজ জাতির জনস্রোত বহিয়া গিয়াছে। ইহার কি কোনই নিদর্শন নাই? বর্তমান কি অতীত ঐতিহাসিক যুগকে সম্পূর্ণরূপে ভুলিতে পরিয়াছে?

ইহা সম্ভব নহে। প্রকৃতির নিয়মই এই যে জীবিত প্রাণীর দেহ কোন কালেই সম্পূর্ণ তরুণ বা সম্পূর্ণ বৃদ্ধ নহে। অতীতের লক্ষণ বর্তমানে বিদ্যমান, কারণ বর্তমানের মূল বর্তমানের স্বরূপ, অতীত হইতেই গৃহীত হইয়াছে।

সুতরাং বর্তমান ভারতকে প্রকৃতরূপে বুঝিতে হইলে অতীত যুগের যথার্থ জ্ঞান আবশ্যক। এখানেই ইতিহাসের মৌলিক গবেষণা আমাদের কাজে লাগে, ঐতিহাসিকের চেষ্টা নিত্য ফলপ্রদ হয়।

আমি এই প্রবন্ধে দেখাইতে চেষ্টা করিব যে আমরা মুসলমান যুগ হইতে কি পাইয়াছি; সেই ছয় শত বৎসরের তুর্ক জাতির শাসন আমাদের দেশ, সমাজ ভাষা ভাব ও রীতিনীতির মধ্যে কি পরিবর্তন সাধন করিয়াছে–মুসলমান যুগে ভারতের কোন কোন দান আমাদের জাতীয় ভাণ্ডারে প্রচ্ছন্ন বা প্রকট ভাবে রহিয়াছে।

প্রথমেই আমরা দেখিতে পাই যে আকবর হইতে মহম্মদ শাহ পৰ্য্যন্ত প্রায় দুই শত বৎসর ভারতের সর্ব্বদক্ষিণ অংশ ভিন্ন এই মহা ভূখণ্ড একছত্র রাজার অধীন ছিল; খণ্ড রাজ্যের অহরহ সংঘর্ষ, আভ্যন্তরিক অশান্তি, ধনজনক্ষয়,

এই কালের জন্য প্রায় তিরোধান করিয়াছিল। প্রায় সমগ্র ভারত নিজ রাজনৈতিক একতা অনুভব করিয়াছিল। ইহার পূর্ব্বে আর এরূপ হয় নাই। কারণ আওরংজীবের ভারতীয় সাম্রাজ্য অশোক বা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের অধীন ভারত অপেক্ষা অনেক বৃহৎ এবং অধিক মাত্রায় কেন্দ্রীভূত। অশোকের সাম্রাজ্যে প্রত্যেক প্রদেশ নিজের পুরাতন পরিচিত শাসন পদ্ধতি অনুসারে চলিত; নিজ স্থানীয় ভাষা ব্যবহার করিত, নিজের জীবন পৃথক পথেই যাপন করিত; শুধু রাজধানী হইতে রাজপ্রতিনিধি ও রাজ-সেনাপতি আসিয়া সকলের উপরে বসিতেন। কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্যে-কাশ্মীর হইতে মাদ্রাজ পর্যন্ত সমস্ত ভারত ব্যাপিয়া ২০টি প্রদেশে ঠিক এক শাসন পদ্ধতি, এক সরকারী ভাষা, এক শ্রেণীর মুদ্রা, একই প্রকার পথের ও পত্রের ডাকের বন্দোবস্ত চলিত এবং পুরোহিত ও কৃষক ভিন্ন অপর সমস্ত সামাজিক শ্রেণীই অল্প বিস্তর উর্দু ভাষার সাহায্যে ভাবের আদান প্রদান করিতে পারিত।

এই রাজনৈতিক একতা যে মুঘল সাম্রাজ্যের সীমার মধ্যেই আবদ্ধ ছিল তাহা নহে। পার্শ্ববর্তী হিন্দু সামন্ত রাজগণ, এমন কি স্বাধীন মারাঠা রাজাও মুঘল শাসন পদ্ধতি, কর্ম্মচারীদের নাম ও কার্য্যবিভাগ, রাজসভার আদব কায়দা এবং মুদ্রা অনেকটা অনুকরণ করিয়াছিলেন। যদিও তাঁহারা ফার্সী বা উর্দু ভাষা ব্যবহার করিতেন না।

ইংরাজ শাসনে যে রাজনৈতিক একতা সমস্ত ভারতকে আচ্ছন্ন করিয়াছে, মুসলমানেরাই তাহার সূচনা করেন এবং সম্পূর্ণতার কাছাকাছি পৌঁছাইয়া যান। এই ২০টি সুবায় সর্ব্বদা সৈন্য ও কর্ম্মচারী, বণিক ও যাত্রী দেশের একপ্রান্ত হইতে অপর প্রান্তে অবাধে যাতায়াত করিত। সকলেই এই মহাদেশের একত্ব অনুভব করিত, তাহাদের প্রাদেশিক সঙ্কীর্ণতা অনেকটা দূর হইয়া নিখিল ভারতের এক জাতীয়তার ভাব মনে প্রথম জাগিল।

সত্য বটে, শুধু রাজনৈতিক একত্ব এক জিনিস আর জাতীয় একতা ভিন্ন, উচ্চতর ও কঠিনতর জিনিস। কিন্তু প্রথমটির অভাবে দ্বিতীয়টার জন্ম অসম্ভব। দেশের একতার সঙ্গে যদি দেশ শাসনে প্রজাদের অধিকার থাকে, যদি প্রজারা স্বরাজ শাসন করিতে পায়, তবেই জাতীয়তা সম্পূর্ণ পরিস্ফূট হইয়া উঠে। ইংরাজ যুগে এই ক্রমোন্নতির সূচনা হইয়াছে। মুঘল বাদশাহদের কাজ ইংরাজ কালে সম্পূর্ণ করিবেন

মুসলমানদিগের নিকট হইতে আমাদের দ্বিতীয় লাভ, ঐতিহাসিক সাহিত্য। হিন্দুরা দিন রাত পরমার্থ চিন্তায় ব্যস্ত, এই জগৎরূপ পান্থশালার সংবাদ রক্ষা করিতে তাহারা ঘৃণা করে। তাই সংস্কৃতে অসংখ্য উচ্চশ্রেণীর গ্রন্থ আছে, ইতিহাস একখানিও নাই। আছে শুধু ৪ খানা ঐতিহাসিক জীবনী, আর তাহাও ইতিহাস নামে প্রচ্ছন্ন কাব্য; তাহাতে ভাষার আবরণে ভাব লুকাইয়াছে, তারিখ ও ঘটনা কথার তুলনায় অতি কম।

আরবদের বুদ্ধি খুব হিসাবী, সংযত, শুষ্ক, বলিলেও বলা যাইতে পারে। তাহারা যাহার বিষয়েই লিখুক না কেন, প্রথমে ঘটনাগুলির একটি কালানুযায়ী কাঠামো প্রস্তুত করিয়া, তারিখ দিয়া ঠিক পূর্ব্বপরক্রমে সাজাইয়া তবে বর্ণনা করিতে হবে।

এজন্য মুসলমান ইতিহাসে আর যাহারই অভাব হউক না কেন, তারিখের কোন অভাব নাই।

আবার, সমস্ত মুসলমান জগত হিজরী সাল ব্যবহার করায় সৰ্ব্বত্রই কালগণনার এক পদ্ধতিই অনুসৃত হইয়াছে। পাঠক সহজেই বুঝিতে পারেন ঠিক কবে কি হইল। কিন্তু হিন্দুদের শিলালিপি মুদ্রা তাম্রশাসন ৩ গ্রন্থে অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন সন অনুসারে বৎসরের সংখ্যা দেওয়া হইয়াছে, প্রত্যেক খণ্ড রাজ্য নিজ নিজ রাজবংশীয় অব্দ ব্যবহার করিয়াছে, হয়ত এক শত বৎসরের মধ্যেই সেই বংশ লোপ পাইয়াছে, এবং এই অব্দ লোকে ভুলিয়া গিয়াছে। এই জন্য হিন্দুদিগের ভারত-ইতিহাসের বিশুদ্ধ কাল নির্ণয় করিতে পণ্ডিতগণকে এক শত বৎসর ধরিয়া- অর্থাৎ কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির স্থাপনা ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দ হইতে ১৮৮০তে গুপ্তকাল নির্ণয় পর্য্যন্ত–কঠিন পরিশ্রম করিতে হইয়াছে। মুসলমান ইতিহাসে এই গোলযোগ একেবারেই নাই।

আবার, একই অব্দ উত্তর ভারতে একরূপ, দাক্ষিণাত্যে অপর রূপ। যথা, “বদী সুদী” বৎসর, যাহাতে কৃষ্ণ ও শুক্লপক্ষ অনুসারে মাস গণিয়া বৎসরের শেষে একটা মলমাস (মারাঠীতে “পরবনী”) যোগ করিয়া চান্দ্র বৎসরকে সৌর্য্য বৎসরের সমান করা–দাক্ষিণাত্যে এক সময়ে আরম্ভ, উত্তর ভারতে অপর সময়ে আরম্ভ হয়। এই জন্য মারাঠী ভাষার ১৭ শতাব্দীর যে-সব ঐতিহাসিক উপাদান সংগ্রহ করিয়াছি, তাহার এই প্রণালী অনুযায়ী তারিখগুলিকে এ পৰ্য্যন্ত খ্রিস্টীয় তারিখে আনিতে পারি নাই। হিজরী সালে এ অসুবিধা নাই।

তৃতীয় ফল এই যে, মুঘল বাদশাহগণ এবং তাঁহাদের পূর্ব্ববর্তী কোন কোন মুসলমান সুলতান ভারতবর্ষের সহিত ভারত-বহির্ভূত জগতের সংশ্রব আবার স্থাপিত করেন। বৌদ্ধযুগে ভারতবাসীরা “এক-ঘরে কোণঠাসা” ছিল না; কত বিদেশীয় জাতি-চীন, তিব্বতী, সিংহলী, শক, হূণ, পার্থিব, বাহীক, যবন (অর্থাৎ গ্রীক বা আইওনীয়ান্), পারসিক-ভারতে প্রবেশ করিয়াছিল, কত ভারতীয় পণ্ডিত প্রচারক ও বণিক ঐসব বিদেশে গমন করে তাহার সংখ্যা নাই। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্ম্মের অবসানের পর হইতে ভারতবর্ষ বাহিরের এশিয়া হইতে বিচ্ছিন্ন হইল, আর ভাবের পণ্যদ্রব্যের, রক্তের আদানপ্রদান চলিল না। আমরা কূপমণ্ডুক হইয়া পড়িলাম।

বিজেতা মুসলমানগণ, রবীন্দ্রনাথের ডাকঘরের ঈশ্বরের দূতের মতো জোর করিয়া ভারতবর্ষের রুদ্ধ দ্বার খুলিয়া দিল। উত্তর পশ্চিমের খাইবার গিরি সঙ্কট দিয়া বৎসর বৎসর সহস্র লোকের স্রোত, বুখারা সমরকন্দ, বাখ খুরখান্, খারিজম (বর্তমান খীভা) ও উত্তর পারস্য হইতে ভারতে প্রবেশ করিতে লাগিল। বোলান গিরিবা অবলম্বন করিয়া পঞ্জাব ও সিন্ধু হইতে দক্ষিণ আফগানিস্তান (অর্থাৎ কান্দাহার) দিয়া দক্ষিণ পারস্যে অসংখ্য লোক যাতায়াত করিত; ১৬১৮ খ্রিস্টাব্দে এই পথে ১৪ হাজার উট বোঝাই মাল বৎসর বৎসর ভারত হইতে পারস্যে বিক্রয়ের জন্য যাইত।

শুধু উত্তর পশ্চিমের নহে, আমাদের পশ্চিম ও পূর্ব্বের দ্বারগুলিও মুসলমানেরা আবার খুলিয়া দিল; ভারতের শেষোক্ত দুইটি সমুদ্র কুল হইতে বৎসর বৎসর জাহাজ যাইত কত দেশ বিদেশে– টাটা বরোচ, সুরট, চউল, গোয়া, কারওয়ার, (বর্সলূর ও মাঙ্গালোর মুসলমান হস্তে ছিল না) প্রভৃতি পশ্চিম উপকূলের বন্দর দিয়া যাত্রী ও পথিক, বণিক ও কর্মপ্রার্থী সৈনিক, পারস্য আরব, তুর্কী, মিশর, টুনিস, আবিসিনিয়া এমন কি জাঙ্গিবার হইতে ভারতবর্ষে আসিত, ভারতের দ্রব্য তথায় যাইত। সেই মতো, পূর্ব্ব উপকূলের মুসলিপটন ও রাজমহেন্দ্রী হইতে মুসলমান জাহাজ শ্যামদেশ, সুমাত্রা জাবা চীন পৰ্য্যন্ত যাইত; সিংহল ও ব্রহ্মদেশের তো কথাই নাই। এইরূপে ভারতের সহিত বর্হিজগতের সম্বন্ধ আবার স্থাপিত হইল, যদিও জাতিভেদে পীড়িত হিন্দুগণ এই সুবিধা অতি কম মাত্রায় গ্রহণ করিল।

এই বিষয়ে ও বর্তমান ভারতের নিয়ন্তা ইংরাজ রাজ শুধু মুঘল বাদশাহের আরব্ধ কার্য্য পূর্ণতর ও বিস্তৃত করিয়াছেন। আজ আমরা ইউরোপ আমেরিকা, জাপান- হয়ত মার্স নক্ষত্রের সঙ্গেও সংলগ্ন হইয়াছি, নিখিল ভূমণ্ডলের সহিত ভারতের ভাবের পণ্যের জাতির বিনিময় চলিতেছে। কিন্তু ইহার সূচনা মুসলমান যুগে।

চতুর্থ দান : কোন কোন ইংরাজ ঐতিহাসিক এবং তাঁহাদের দেশীয় চেলারা বলিয়া থাকেন যে মুসলমান ধর্ম্মের প্রভাবেই মধ্যযুগে অনেকগুলি একেশ্বরবাদী ব্রাহ্মণ ও জাতিভেদ বিদ্বেষী উপাসক সম্প্রদায় হিন্দুদিগের মধ্যে উঠিয়া দাঁড়ায়– যেমন রামানুজ রামানন্দ, কবীর, দাদু, নানক ও চৈতন্যের দল। আমি কিন্তু এই মতের ভিত্তি দেখিতে পাইনা। অতি প্রাচীনকাল হইতে উপনিষদের যুগ, এমন কি তাহারও পূর্ব হইতে সকল হিন্দু ধর্ম্ম সংস্কারক ভক্ত ও চিন্তাশীল লেখক, তেত্রিশকোটি দেবদেবীর উপর একমাত্র পরম ঈশ্বরকে চরম উপাস্য বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন। সুতরাং ইস্লাম ধৰ্ম্ম হইতে ১২০০-১৬০০ খ্রিস্টাব্দে হিন্দুরা একেশ্বরবাদ শিখিয়াছে একথা সত্য হইতে পারে না। আসল কথা এই যে, ঐসময়ে আমাদের বাড়ীর পাশে একেশ্বরবাদী, জাতিভেদহীন, আড়ম্বরশূন্য উপাসনাকারী ও ভ্রাতৃভাবে আবদ্ধ বিশাল মুসলমান সমাজ দুবেলা চক্ষে দেখিয়া মধ্যযুগের হিন্দুরা ও ব্রাহ্মণ বিদ্বেষী, একাকার সমাজে মিলিত, সরল ভক্তিমার্গ অবলম্বী এইসব ধৰ্ম্ম সম্প্রদায় স্থাপন করিতে–মনের বিশ্বাস কার্য্যে পরিণত করিতে উৎসাহ পাইল।

পঞ্চম : মুসলমান যুগে কতকগুলি “পন্থ” অর্থাৎ ধর্ম্মমত হিন্দু ও মুসলমান- দিগকে ঈশ্বরের বেদীর সম্মুখে এক করিবার জন্য প্রকাশ্য চেষ্টা করে। যিনি রাম তিনিই রহিম; আল্লাহ্ ও রক্ষা একার্থবাচক দুই শব্দ মাত্র; মুসলমান জোলা কবীরের হিন্দু শিষ্য ছিল, হিন্দু চৈতন্যের “যবন হরিদাস” পদধূলি গ্রহণ করিত, নানকের ধর্ম্মে হিন্দু মুসলমান অবাধে প্রবেশ করিতে পারিত–এগুলি মধ্যযুগের ভারতের ধর্ম্ম সামঞ্জস্যের জ্বলন্ত সাক্ষ্য দিতেছে।

ইহা তো হইল জনসাধারণের কথা, নিরক্ষর সরলচেতা ভক্তমণ্ডলীর কথা। শিক্ষিত ও পদস্থ হিন্দু-মুসলমান একত্র মিলিতেন সুফীধর্ম্মের কল্যাণে। ইহা ধর্ম্মও বটে,ভাব ও চিন্তার চর্চা ও উপভোগও বটে। সুফীধর্ম্মের “পশ্চিম” শাখাঁটি গ্রীক দর্শন বিশেষত প্লেটো ও তাঁহার নামেমাত্র অনুচর, অনেক পরবর্তী যুগের “নব প্লেটোনীয়” সম্প্রদায়ের প্রভাবে পরিস্ফুট ও পূর্ণাঙ্গ হয়। (আরবেরা অনেক গ্রীক গ্রন্থ আরব্য ভাষায় অনুবাদ করিয়া ফেলে বিশেষতঃ গ্রীক দর্শন, এরিষ্টটেলের সমগ্র গ্রন্থাবলী। সুতরাং প্লেটো তাহাদের সুপরিচিত ছিল)।

কিন্তু সুফীধর্ম্মের “প্রাচ্য” আকারটির হিন্দু বেদান্তের সন্তান, ইহাতে গ্রীক দর্শনের প্রভাব ছিল না।’ প্রায় দুইশত বৎসর ধরিয়া ইহার খুব প্রচলন ছিল শিক্ষিত হিন্দু-মুসলমান একত্র মিলিত হইয়া এই ধর্ম্মের চর্চ্চা করিতেন; হাফিজ ও জেলালুদ্দীন রুমীর পদ্যপাঠ হইত; ভাবের আবেশে নৃত্য হইত; সদালাপ ও সৎসঙ্গ চলিতে থাকিত। অসংখ্য হিন্দু পারসিক ভাষায় সুফীধর্ম্ম সংসৃষ্ট পদ্য রচনা করেন। পদ্যাংশে এগুলি অত্যন্ত হীন হইলেও ইহাদের সংখ্যা হইতে বুঝিতে পারা যায় যে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভারতের আত্মা সুফীধৰ্ম্মে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিল–হয়ত রাজনৈতিক অবনতি বা অর্থনৈতিক দুরবস্থা হইতে পালাইয়া চিত্তের শান্তি পাইবার জন্য। এইরূপে অশিক্ষিত জনসাধারণের মধ্যে রামানন্দ, কবীর নানক ও চৈতন্য সম্প্রদায় এবং শিক্ষিত সমাজে সুফী মত হিন্দু-মুসলমান, জেতা ও বিজিতদিগকে একত্রে বন্ধনের উপায় হইল। এখন যেমন থিয়সফি।

মুসলমানদিগের নিকট হইতে হিন্দুরা সামাজিক প্রথা ও ব্যবহার, আদব কায়দা, পরিচ্ছদ ও পাকপ্রণালী সম্বন্ধে কি কি শিখিয়াছে তাহা আমরা ইংরাজী সভ্যতার প্রভাবে পরাভূত, বাঙ্গলাদেশ ভুলিয়া গিয়াছি; কিন্তু উত্তর পশ্চিম প্রদেশের ছোট ছোট শহরে তাহা এখনও পরিস্কার দেখিতে পাওয়া যায়। বাঙ্গলাদেশে পঞ্চাশ বৎসর পূর্ব্বে সব বনেদী হিন্দু ঘর মুসলমান আদবকায়দা ও পরিচ্ছদ অবলম্বন করিতেন। কিন্তু এই প্রভাব পল্লীগ্রামে বিস্মৃত হয় নাই; বঙ্গের বাহিরে মুসলমানেরা প্রায়শই “শহুরে” ছিলেন; গ্রামে কদাচিৎ যাইতেন এবং অতি অল্পক্ষণ থাকিতেন।

ষষ্ঠ : শিকার, বাজপাখী দিয়া অন্য পাখী মারা, অনেক রকম খেলা ও ব্যসন, একেবারে মুসলমানী প্রভাবে আচ্ছন্ন হইয়া পড়িল, এইসব বিভাগের শব্দগুলি আরবী ফার্সী না হয় তুর্কী ইহাই আমার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। নর্ম্মান জাতি ইংলন্ড বিজয় করিবার পর ঠিক এইমত ফরাসী শব্দ আসিয়া এইসব বিভাগে ইংরেজী ভাষাকে আচ্ছন্ন করিল, এবং আজ পর্যন্তও ব্যবহৃত হইতেছে।

সপ্তম : ভারতীয় রণনীতি ভারতের বাহিরের মুসলমান জগতের অনুকরণে অনেক পরিবর্তিত ও উন্নত হইল। একে ত মুসলমান সুলতান ও বাদশাহগণ অতি বিপুল সেনা লইয়া যুদ্ধ করিতেন। হিন্দু খণ্ড রাজাদের মত দু চার হাজার লোক লইয়া নহে, তাহার ফলে বহুসংখ্যক সৈন্য চালনা করা (strategy) বিদ্যা উদ্ভূত হইল; হিন্দু যুগের ছোট দাঙ্গা হাঙ্গামার প্রণালী (minor tracties) পড়িয়া রহিল।

এই রণনীতির উন্নতি কতকটা যুগধর্ম্মের ফলেও। ভারতীয় মুসলমানেরা তুর্কী দেশের দ্বার দিয়া ইউরোপের নব নব আবিষ্কৃত অস্ত্রশস্ত্র ও রণকৌশল শিখিতে লাগিল এবং হিন্দু রাজগণও তাহা যথাসম্ভব অনুকরণ করিলেন। দুর্গ নির্ম্মাণ প্রণালীর উন্নতি ইহার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।

অষ্টমদান শিল্পকলা, বিশেষতঃ স্থপতিবিদ্যা ও চিত্রাঙ্কন। মুসলমান যুগের প্রাসাদ, উদ্যান গৃহ, মসজিদ, সমাধী ও দুর্গ ভারতীয় কলার চরম সাক্ষ্য দিতেছে। সে যুগের হিন্দু-মুসলমান ধনী মাত্রেই এই শিল্পোৎকর্ষের ফলভাগী হইয়াছিলেন। দিল্লীর ময়ূর সিংহাসন ও কোহিনূর গিয়াছে, কিন্তু আগ্রার তাজমহল ও ফতেপুরের প্রাসাদ এখনও আছে।

গৃহনির্ম্মাণ অপেক্ষা চিত্রাঙ্কনে বাদশাহগণ ভারতকে অধিকতর ঋণী করিয়া রাখিয়া গিয়াছেন। শত শত বৎসরের অযত্ন ও অনাহারে অজন্তার চিত্রকরদের বংশধরগণ মৃতপ্রায় মূর্খে পরিণত হইয়াছিল। মহামতি আকবর তাঁহাদের নিজ সভায় ডাকিয়া আনিলেন, তাহাদের বুঝাইলেন যে আবার প্রকৃত গুণের আদর হইবে। ইহার ফলে তাঁহার সভায় চীনদেশ হইতে বুখারা ও খোরাসান দিয়া আগত চিত্রপ্রণালী ও খাঁটি পুরাতন হিন্দু চিত্রপ্রণালীর আশ্চর্য্য সমাবেশ হইয়া মুঘল কলা (Indo-saracen School of Painting)র জন্ম হইল; তাহাতে ভারতীয় প্রতিভা আবার আকাশ ছুঁইতে পারিল। এটি আমাদের নিজস্ব জিনিস, বিদেশীর নকল নহে।

.

[প্রভাতী, ১ম বর্ষ, নিদাঘ সংখ্যা, ১৩২৭।]

এই প্রবন্ধ সংক্ষিপ্ত আকারে “মুসলমান যুগ হইতে কি পাইয়াছি” শিরোণামে প্রবাসী (কাৰ্ত্তিক, ১৩২৭) পত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়।

১। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাদশাহ শাহজাহানের জ্যেষ্ঠপুত্র দারাশুকো কাশীর পণ্ডিতজনের সাহায্যে ৫০ খানি উপনিষদের এক ফার্সী অনুবাদ করেন, তাহার নাম সির-উল-আম্রার অর্থাৎ গূঢ়তম রহস্য। প্রায় ১২০ বৎসর পরে ফার্সী দেশীয় পণ্ডিত আঁকেতিল দু পেরোঁ (Anquetil du Perron) এই ফার্সী অনুবাদের এক লাটিন অনুবাদ প্রকাশ করিয়া উপনিষদগুলিকে ইউরোপে পরিচিত করাইয়া দেন। এই শেষোক্ত গ্রন্থ পড়িয়াই জন্মান দার্শনিক শোপেন হবার মুগ্ধ হইয়া বেদান্তকে জীবনের চরম সান্তনা বলিয়া ঘোষণা করেন।

২। মৌর্য্য বা গুপ্ত সম্রাটগণের যুগ ভিন্ন আর সর্ব্বসময়েই হিন্দু রাজগণের সৈন্য ছোট ছোট জনসমষ্টি মাত্র ছিল, যদিও এইসব সমষ্টি কখন কখন একত্র হইত। কিন্তু মুসলমান যুগে প্রায় সমগ্র ভারতের সৈন্য এক নেতার আজ্ঞায় চলিত ফিরিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *