৫
এখন রাত এগারোটা বেজে দশ মিনিট। নবনী ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছেন। থমথমে মুখ। সামনে টিভি চলছে। নবনী রিমোট টিপে খবরের চ্যানেলগুলো সার্ফ করে চলেছেন। যদি কোথাও আহিরীদের কলেজের খবর দেখায়। দেখাচ্ছে না। আটটা নাগাদ একবার দেখিয়েছিল। নবমী নিজে দেখেননি। টালিগঞ্জ থেকে মেজদির ছোট মেয়ে মঞ্জরি ফোন করে বলল।
“মাসি, আহিদির কলেজে গোলমাল হচ্ছে?”
নবনী বলল, “হ্যাঁ হচ্ছে। ছাত্রদের কী একটা গোলমাল চলছে। তুই কোথা থেকে শুনলি?”
মঞ্জরি বলল, “এই তো নিউজে দেখাল। ছেলেমেয়েরা সিঁড়িতে বসে চেঁচাচ্ছে। কলেজের নাম শুনে বুঝতে পারলাম, আহিদির কলেজ। ওদের প্রিন্সিপাল না কে, গোল মতো মুখ, টিভিতে বলল, ছাত্ররা নাকি হুলিগানিজম করেছে। ভাঙচুর করেছে, ওঁকেও নাকি মারতে গিয়েছিল।”
মঞ্জরি মেডিকেলে পড়ে। দিদির কলেজের খবর নিউজে বলেছে বলে সে গর্বিত। গোলমালে ঘাবড়েছে বলে মনে হল না। নবনীর উদ্বেগ বাড়ছে। নিউজে দেখিয়েছে মানে পরিস্থিতি ঘোরালো।
মঞ্জরি বলল, “আমি আহিদিকে ফোন করেছিলাম। ফোন বন্ধ। মা চিন্তা করছে।”
নবনী নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “আমি কথা বলেছি। ওর মোবাইলে চার্জ ফুরিয়ে গেছে। মাকে চিন্তা করতে বারণ কর। সব টিচার একসঙ্গে আছে, ভয়ের কিছু নেই। আমার সঙ্গে কথা হলে তোদের ফোন করতে বলব।”
মঞ্জরির ফোন কেটে দেওয়ার পর নবনী আবার আহিরীকে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। লাভ হয়নি। ফোন বন্ধ। তারপর থেকে সিরিয়াল দেখা বন্ধ করে, টিভির খবরগুলো দেখছেন, আবার যদি কিছু দেখায়। দেখাচ্ছে না। মারপিট, গুন্ডামির কথা তো আহিরী কিছু বলেনি! চেপে গেছে। তার সঙ্গে দু’বার কথা হয়েছে। প্রথম বার নিজেই ফোন করেছিল। আহিরী শান্ত গলায় বলেছিল, “মা, ফিরতে দেরি হবে। কলেজে আটকে গেছি।”
‘আটকে গেছি’ মানে যে কলেজের গেট বন্ধ করে আটকে রাখা হয়েছে, সে কথা বুঝতে পারেননি নবনী। আহিরীও বলেনি কিছু।
“কখন ফিরবি?”
আহিরী বলল, “বলতে পারছি না। রাত হবে।”
নবনী অবাক হয়ে বললেন, “রাত! কলেজে রাত পর্যন্ত কী কাজ?”
আহিরী বিরক্ত গলায় বলল, “কী কাজ জেনে তুমি কী করবে? রাত হবে বললাম তো। খেয়ে নিয়ো। আমি এখন ফোন ছাড়ছি।”
মেয়ের মুখে ‘খেয়ে নিয়ো’ শুনে খাটের ওপর ধপ করে বসে পড়েছিলেন নবনী। কী এমন কাজে আটকে গিয়েছে যে রাতে এসে খেতেও পারবে না? পরীক্ষা তো চারটের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। সাতটা বাজার মুখে নবনী নিজেই মেয়েকে ফোন করেন। বেশ কয়েক বার বাজার পর আহিরী ফোন ধরে। নবনী শুনতে পান, ফোনের ও পাশে তুমুল হট্টগোল হচ্ছে। কারা যেন চিৎকার করছে।
“কী হয়েছে?”
মেয়ের গলা শুনে মনে হচ্ছে, মুখের কাছে হাত চাপা দিয়ে কথা বলছে। নবনী বললেন, “এখনও তোর কাজ শেষ হয়নি?”
আহিরী চাপা গলায় বলল, “না হয়নি। আজ সারা রাত থাকতে হতে পারে।”
নবনী আর্তনাদ করে উঠলেন, “সারা রাত!”
আহিরী চাপা গলায় বলল, “মা, টেনশন কোরো না। এই জন্য তোমাকে কিছু বলতে চাই না। কলেজে অ্যাজিটেশন হচ্ছে। ছেলেমেয়েদের বিক্ষোভ।”
নবনী বললেন, “তাতে তোর কী? তুই তো ছেলেমেয়ে নোস। তুই চলে আয়।”
আহিরী এবার চাপা ধমকের গলায় বলে, “ছেড়ে দাও, তুমি বুঝবে না। সিচুয়েশন চলে আসার মতো নয়। কোনও টিচারই বেরোতে পারেনি। শোনো, আমাকে আর ফোন বা মেসেজও করবে না। ফোনে চার্জ নেই। সঙ্গে চার্জারও নেই।”
নবনী সন্দেহের গলায় বলল, “তুই তো পাওয়ার ব্যাঙ্ক সঙ্গে রাখিস।”
আহিরী বলল, “পাওয়ার ব্যাঙ্ক গাড়িতে।”
“নিয়ে আয়। ফোন বন্ধ করে রাখলে কী করে হবে? আমি তো ফোন করব।”
আহিরী দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “মা, ভাল করে শুনে নাও, আমরা ঘেরাও হয়ে আছি। ছাত্ররা করেছে। কলেজ থেকে বেরোনোর ব্যাপার নেই। গাড়ি পর্যন্ত গিয়ে পাওয়ার ব্যাঙ্কও আনতে পারব না। সো দিজ ইজ ইয়োর লাস্ট কল। দরকার হলে আমি যোগাযোগ করব। এবার দয়া করে রাখো।”
তারপর থেকে আর মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। কমলেশকে ফোন করেছিলেন নবনী।
“জানি। আহি ফোন করেছিল। চিন্তার কিছু নেই। শুনেছি পুলিশ-টুলিশ গেছে।”
নবনী আরও নার্ভাস হয়ে বললেন, “পুলিশ গেছে! গোলমাল হচ্ছে নাকি?”
কমলেশ ফোনেই মৃদু হেসে বললেন, “নবনী, এত চিন্তা কোরো না। আহি সেফ থাকবে। ও তো একা নয়, এভরিবডি ইজ দেয়ার।”
কমলেশ বাড়ি ফিরেছেন ন’টার পর। ড্রাইভারকে গ্যারেজে গাড়ি তোলার কথা বলতে গিয়ে একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, “দীনেশ, গাড়ি তুলে দাও। আমি যদি বেরোই, গাড়ি বের করে নেব।’
দীনেশবলল, “স্যর, দিদির গাড়ি দেখছি না।”
“ওর ফিরতে দেরি হবে। গাড়ি বাইরে রাখবে।”
আহিরী গাড়ি কেনার পর থেকে একটা গাড়ি বাইরে থাকে। যে আগে ফেরে সে গাড়ি গ্যারেজে ঢুকিয়ে দেয়। বাইরে মানে অবশ্য বাড়ির বাইরে নয়, গ্যারেজের সামনে, ড্রাইভওয়েতে। এদিককার বেশির ভাগ বাড়িতে এই সুবিধেটা রয়েছে। গেট দিয়ে ঢোকার পর লম্বা প্যাসেজ, তারপর গ্যারেজ। প্যাসেজেও অনায়াসে আর একটা গাড়ি রাখা যায়।
কমলেশ আজ স্নান সেরেছেন অনেকটা সময় ধরে। সকালে আহিরী বেরিয়ে যাওয়ার পরই মেকানিক ডাকা হয়েছিল। গিজারে বড় কিছু হয়নি। একটা ফিউজ কেটে গিয়েছিল। স্নান সেরে রোজকার মতো অল্প স্ন্যাকস আর একটা হুইস্কি নিয়ে স্টাডিতে বসেছেন। লার্জ পেগ স্কচ। বেশির ভাগ দিন এই একটাতেই থেমে যান। কোনও কোনও দিন আর একটা হাফ নেন। ব্যস, আর নয়। সময় নিয়ে খান। কমলেশ রায় এই সময়টা নিজের মতো করে কাটান। তাঁর এই স্টাডিটা মাপে ছোট, কিন্তু শৌখিন ভাবে সাজানো। পুরনো দিনের গথিক চেহারার ইন্টিরিয়র। বার্নিশ করা কাঠের টেবিল, চেয়ার, ডেস্ক। সিলিং পর্যন্ত উঠে গেছে তাক। তাক ভরতি বই। আহিরী ষখন স্কুলের নিচু ক্লাসে পড়ত, বাবার এই ঘরটার ওপর ওর লোভ ছিল খুব। সুযোগ পেলেই নিজের পড়ার ঘর ছেড়ে বইখাতা নিয়ে পালিয়ে আসত। বাবার স্টাডিতে না পড়লে তার নাকি পড়া মনে থাকে না। বড় হয়ে অবশ্য নিজের ঘরে গুটিয়ে গেছে। কমলেশ এই ঘরে বসে ম্যাগাজিন উলটোন, বই পড়েন। মেয়ের সঙ্গে গল্পও করেন। স্ত্রীর সঙ্গে টুকটাক কথা হয়। তবে নবনীকে একটু এড়িয়েই চলেন কমলেশ। দুটো কথার পরই নবনী কোনও না কোনও বিষয় নিয়ে অনুযোগ, আপত্তি, দোষারোপের দিকে চলে যাচ্ছেন। সব সময়েই যেন ভিতরে এক ধরনের বিরক্তি। সঙ্গে হালকা রাগও।
এই স্বভাব নবনীর আগে ছিল না। একটা সময় পর্যন্ত স্বাভাবিকই ছিলেন। মেয়ের ব্যাপারেই যেটুকু যা বাড়াবাড়ি করতেন। ছোটবেলা থেকে আহিরীকে লেখাপড়া নিয়ে কখনও বলতে হয়নি। তবে দুরন্ত ছিল মেয়েটা। ‘ওভারঅ্যাক্টিভ’ যাকে বলে। চোখে চোখে না রাখলে একটা না একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলত। আর ছিল সাজগোজের ঘটা। সুযোগ পেলেই মায়ের মেক-আপ কিট ধ্বংস করবে। ধরে ফেলার আগেই মুখে থ্যাবড়া করে পাউডার, ঠোঁটে মোটা করে লিপস্টিক লাগিয়ে পালাত। কমলেশ রায় মেয়ের এই কর্মকাণ্ডে খুবই আনন্দ পেতেন এবং অংশও নিতেন। নবনী সাজগোজের সরঞ্জাম মেয়ের হাতের নাগালের বাইরে রাখতেন। কখনও উঁচুতে, কখনও আলমারির ভিতর। নবনী বাড়ি না থাকলে মেয়েকে সেসব মাঝেমধ্যে বের করেও দিয়েছেন কমলেশ। বাড়ি ফিরে নবনী রাগারাগি করতেন খুব।
“তোমার আশকারায় মেয়ে বিগড়ে যাবে। এইটুকু বয়েসে সাজগোজের কী ঘটা!”
“আহা, বড় হোক, দেখবে পুরো উলটে গেছে।”
তাই হল। যত বড় হতে লাগল আহিরী, খাওয়া-দাওয়া, সাজগোজের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়ল। যেটুকু দরকার সেটুকুও করত না। চুলটা ঠিকমতো আঁচড়াত না পর্যন্ত। তার ওপর একবার বই মুখে বসলেই হল। টেনে তোলা ছাড়া উপায় ছিল না। নবনী এসব নিয়ে খিটিরমিটির করেই যেতেন। মেয়েকে টিউশনে নিয়ে যাওয়া, নাচের স্কুল, গানের স্কুলে নিয়ে যাওয়া তো ছিলই। উঁচু ক্লাসে উঠে নাচ, গান সব ছাড়ল আহিরী। তখন শুধু লেখাপড়া।
এই পর্যন্ত মোটের ওপর নর্মালই ছিলেন নবনী। গোলমাল হল আর একটু পরে। আহিরী তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। মেয়ে বড় হয়েছে বলে বাড়িতে নবনীর চাপ কমেছে। তিনি ‘উর্বরা’ নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হলেন। এই সংগঠন দুঃস্থ, পিছিয়ে পড়া মেয়েদের জন্য নানা ধরনের কাজ করে। লেখাপড়া থেকে নাচগান, হাতের কাজের প্রদর্শনী। কলকাতার বহু মহিলা এর সঙ্গে জড়িত। আহিরীই চাপ দিয়েছিল।
“ঘরে বসে বোর না হয়ে কিছু করো না মা!”
“কী করব? এই বয়সে নতুন করে পথে বেরিয়ে রোজগার করতে বলছিস?”
আহিরী বলল, “আমি কিছু বললেই প্যাঁচালো ভাবে নাও কেন? রোজগার করতে বেরোবে কেন? কত ধরনের সংগঠন আছে যারা মানুষের জন্য কাজ করে। এরকম কারও সঙ্গেও তো যুক্ত হতে পারো। দেখবে ভাল লাগবে।”
এরপর থেকে নবনী ‘উর্বরা’র সঙ্গে কাজ করেন। তবে নিয়মিত যেতে পারেন না। যেটুকু যান, ভাল লাগে।
একবার অফিসের কাজে সাত দিনের জন্য মুম্বই যেতে হয়েছিল কমলেশকে। ফিরে এসে খেয়াল করলেন, নবনী তাঁকে দেখে কেমন চুপচাপ হয়ে গেলেন। অন্য সময় লম্বা ট্যুর থেকে ফিরলে নবনীর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে যায়। সেবার কেমন একটা নিস্পৃহ ভঙ্গি।
জামাকাপড় বদলাতে বদলাতে কমলেশ বলেছিলেন, “কী হয়েছে নবনী? এনি প্রবলেম?”
নবনী ঠান্ডা গলায় বললেন, “না। ঠিক আছে।”
কমলেশ রায় বললেন, “তোমাকে দেখে কিন্তু তা মনে হচ্ছে না।”
নবনী অস্ফুটে বলেছিলেন, “বললাম তো সব ঠিক আছে।”
“উর্বরার কাজকর্ম চলছে? গিয়েছিলে?”
নবনী ঠান্ডা গলায় বলেন, “হ্যাঁ গিয়েছিলাম।”
কমলেশ ভুরু কুঁচকে বললেন, “শরীর খারাপ?”
নবনী এরপর বিরক্ত ভাবে বলেছিলেন, “এক কথা বারবার বলছ কেন? বলছি তো ঠিক আছি।”
কমলেশ বুঝেছিলেন, যদি কিছু হয়েও থাকে নবনী বলতে চাইছে না। অফিস গিয়ে মেয়েকে ফোন করেছিলেন। আহিরী তখন ইউনিভার্সিটিতে।
“বাবা, কখন ফিরলে?”
কমলেশ নরম গলায় বললেন, “ফ্লাইট লেট করেছে। তুই বেরিয়ে যাওয়ার পর বাড়িতে ল্যান্ড করেছি।”
আহিরী বলল, “প্লেন কি ছাদে ল্যান্ড করল?”
কমলেশ হেসে বললেন, “না, সামনের পার্কে। তুই কী করছিস?”
“ক্লাস নেই, পোর্টিকোতে বসে বই পড়ছি।”
কমলেশ উৎসাহ নিয়ে বললেন, “কী বই?”
আহিরী বলল, “থ্রিলার। হাউ ডান ইট টাইপের থ্রিলার। খুনি কে জানা আছে, কিন্তু কী করে খুন করল বোঝা যাচ্ছে না। ডিটেকটিভ হাবুডুবু খাচ্ছে। বাবা, এবার চট করে বলে ফেলো দেখি, কেন ফোন করেছ। গল্পের খুব ইন্টারেস্টিং পার্টে আটকে আছি। একটু পরেই ক্লাসে যেতে হবে।”
কমলেশ একটু থেমে বলেছিলেন, “তোর মায়ের কী হয়েছে?”
আহিরী বলল, “কী হয়েছে মানে! এই তো দেখে এলাম, সব ঠিক আছে।”
কমলেশ চিন্তিত ভাবে বললেন, “কেমন যেন মনে হল। আমাকে দেখে মুড অফ করে রইল।”
আহিরী ফিক করে হেসে বলল, “ও, তা হলে অভিমান। এত দিন বাড়িতে ছিলে না বলে অভিমান হয়েছে। নিশ্চয়ই ফোন-টোন করোনি।”
কমলেশ সিরিয়াস গলায় বললেন, “ঠাট্টা করিস না আহি। সামথিং রং মনে হল।”
আহিরী বলল, “ওটা সামথিং রাইট হবে বাবা। আমার সঙ্গে সময় নষ্ট না করে তুমি বরং মাকে ফোন করে মান ভাঙাও। টা টা।”
ব্যাপারটা মান-অভিমানের ব্যাপার নয়। কয়েক দিনের মধ্যে কমলেশ বুঝতে পারলেন, সত্যি কোথাও কোনও গোলমাল হচ্ছে। একদিন রাতে আদর করবার জন্য স্ত্রীকে কাছে টানলেন। নবনীও এলেন। চিরকালই কমলেশ এই সময়টায় স্ত্রীর ভাললাগার ওপর বেশি জোর দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, পার্টনারের খুশি হওয়ার ওপর নিজের তৃপ্তি অনেকটা নির্ভর করে। জোরজবরদস্তিতে সংগত নষ্ট হয়। সন্তর্পণে ব্যক্তিগত ভাললাগার জানলা-দরজাগুলো এক-এক করে খুলে দিতে হয়। স্বামী–স্ত্রীর শারীরিক সম্পর্ক শুধুমাত্র তাড়না মেটানোর প্রক্রিয়া নয়, পারস্পরিক ভালবাসাও বটে। সেদিনও একই ভাবে এগোতে যান কমলেশ। কিন্তু নবনীর কাছ থেকে সাড়া পেলেন না।
কমলেশ গাঢ় স্বরে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তোমার কি কোনও সমস্যা হচ্ছে?”
নবনী এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলেছিলেন, “তাড়াতাড়ি করো। আহি জেগে আছে।”
কমলেশ স্ত্রীর নগ্ন বুকে আলতো হাত রেখে বলেছিলেন, “আহি তো দরজা আটকে পড়ছে।”
নবনী স্বামীর হাত সরিয়ে বলেন, “তা হোক। জেগে তো আছে। যা করবার তাড়াতাড়ি করো।”
কমলেশ বুঝতে পেরেছিলেন, কোথাও সুর কেটেছে। যে সাত দিন তিনি ট্যুরে ছিলেন তার মধ্যেই কিছু একটা ঘটেছে। চাপাচাপি করলে চলবে না। নবনীকে সময় দিতে হবে। সময় দিয়ে জানতে হবে সমস্যাটা কোথায়। বিয়ের এতগুলো বছর পরে নিশ্চয়ই এমন কোনও জটিলতা তৈরি হবে না, যার সমাধান করা যায় না। আশ্চর্যের বিষয় হলেও, আজও সেই সমস্যার পুরোটা সমাধান করা যায়নি। তবে একটা ভাল ঘটনা, স্ত্রীর গুম মেরে যাওয়ার কারণ কমলেশ জেনেছেন।
বাইরে গিয়েছিলেন দু’জনে। আহিরীই পরামর্শ দিয়েছিল বাবাকে। বাবা-মায়ের গোলমালে নিজেকে যতটা দূরত্বে রেখে পরামর্শ দেওয়া যায় আর কী। বুদ্ধিমতী মেয়ে।
“মাকে নিয়ে কোথাও ঘুরে এসো না!”
কমলেশ বলেছিলেন, “কেন বলছিস?”
আহিরী বলেছিল, “ঘ্যানঘ্যানানি থেকে ক’দিন রিলিফ পাব। সকাল থেকে শুরু হয়ে যায়। কখন ঘুম থেকে উঠবি, কখন স্নানে যাবি, কখন বেরোবি, কখন ফিরবি। যেন এখনও স্কুলে পড়ি। উফ, মনে হয় ডাক ছেড়ে কাঁদি। ঘুরে এসো, আমাকে বাঁচাও।”
কথাটা কমলেশের মনে ধরে। বাইরে ক’দিন থাকলে নবনীর মনের জটটা কাটতে পারে। হয়তো সমস্যাটা বলবে।
“কোথায় যাই বল তো!”
“আমি কী বলব! মায়ের সঙ্গে কথা বলো।”
কমলেশ বললেন, “তোর মা যে মুডে আছে, সে কি কিছু বলবে...।”
আহিরী বলল, “এক কাজ করো। বাগডোগরার টিকিট কেটে প্লেনে চেপে বসো। এয়ারপোর্টে নেমে ঠিক করবে কোন পাহাড়ে উঠবে। দার্জিলিং না সিকিম।”
কমলেশ বললেন, “ মন্দ বলিসনি।”
আহিরী আড়মোড়া ভেঙে বলেছিল, “আমার আইডিয়া সব সময়েই ভাল হয়।”
কোনও পাহাড়ে নয়, বাগডোগরা থেকে গাড়ি নিয়ে সোজা ডুয়ার্স চলে গিয়েছিলেন কমলেশ। চালসায় মূর্তি নদীর পাশে এক চমৎকার রিসর্টে উঠলেন। চতুর্থ দিনটি ছিল পূর্ণিমার। রাতে গিয়ে নদীর পাশে বসেছিলেন দু’জনে। রিসর্ট থেকে বলে দিয়েছিল, বেশি দূরে যাবেন না। দু’দিন ধরে হাতি বেরোচ্ছে, আলোর কাছাকাছি থাকবেন। কমলেশ শোনেননি। আলোর কাছে থাকলে জ্যোৎস্না দেখা যায় না। তাঁরা খানিকটা সরে গিয়ে বসলেন। মূর্তি নুড়ি পাথরের নদী। এই নদীর জলে টুংটাং করে বাজনা বাজে। খানিক ক্ষণ চুপ করে শুনলে মনে হয়, বাজনার তালে জল বইছে। জ্যোৎস্নার রাতে এই নদী জলের থাকে না, রুপোর হয়ে যায়। রুপোর কণা নুড়ি পাথর ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। চার পাশে এক ধরনের ঘোর-লাগা মায়াবী জগৎ তৈরি হয়।
কমলেশ স্ত্রীর হাত ধরে নরম গলায় বলেছিলেন, “এবার আমাকে বলো।”
নবনী দূরে তাকিয়ে ছিলেন। যেখানে নদী শেষ বাঁক নিয়ে আড়ালে চলে গেছে।
“কী বলব?”
কমলেশ ফিসফিস করে বলেন, “যা বলতে পারছ না!”
নবনী নিচু গলায় বলেছিল, “তোমার ভাল লাগবে না।”
“তাও বলো।”
নবনী বললেন, “তুমি কি এই কথা শোনার জন্য এখানে এসেছ?”
কমলেশ এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে বললেন, “তুমি ভারমুক্ত হবে।”
নবনী স্বামীর দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বললেন, “তুমি প্রেম করতে?”
নবনী যে এই কথাটা বলবেন, ভাবতেও পারেননি কমলেশ। তাও আবার দাম্পত্য জীবনের এতটা পথ পেরিয়ে আসার পর! প্রথমটায় হকচকিয়ে গেলেও দ্রুত নিজেকে সামলে হেসে বলেন, “হ্যাঁ করতাম। তোমাকে তো গল্প বলেছি।”
নবনী বললেন, “হালকা করছ?”
কমলেশ বললেন, “এই বুড়ো বয়সে প্রেমের কথা বললে কি সিরিয়াস হব?” আওয়াজ করে হাসলেন কমলেশ। হাসতে হাসতেই বললেন, “ছাত্র বয়সে কত প্রেম করেছি তা কি মনে আছে?”
নবনী বললেন, “ওসব ছেলেখেলা নয়, আমি তোমার কোন প্রেমের কথা বলছি তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ।”
কমলেশ এবার খানিক বিরক্ত গলায় বললেন, “তোমার কি মাথা খারাপ হল নবনী? এই বয়সে এসব ছেলেমানুষের মতো কথা আমাদের মানায়?”
নবনী বললেন, “আমি তো তোমাকে কিছু বলতে চাইনি, তুমিই জোর করে শুনতে চাইছ।”
রাগতে গিয়েও কমলেশ নিজেকে সামলে নিলেন। স্ত্রীকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললেন, “নিশ্চয়ই তোমাকে কেউ কিছু বলেছে। আর তাই নিয়ে তুমি মন খারাপ করে বসে আছ।”
নবনী কেটে কেটে বললেন, “মন খারাপ করিনি। ধাক্কা খেয়েছি।”
“ধাক্কা খেয়েছ! কোন কালে আমার কার সঙ্গে কী সম্পর্ক ছিল তাই নিয়ে ধাক্কা খেয়েছ! এটা একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? কাম অন নবনী। সিলি বিষয় নিয়ে মন খারাপ কোরো না।”
নবনী বললেন, “তোমার প্রেমের গল্প শুনে ধাক্কা খাওয়ার মতো মন বা বয়স কোনওটাই আমার আর নেই। তা তুমি জানো।”
কমলেশ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, “দেন হোয়াটস দ্য প্রবলেম? এত দিন পরে কে কী বলেছে তাই নিয়ে মাথা গরম করছ কেন?”
নবনী কাঁধ থেকে স্বামীর হাত সরিয়ে দিয়ে বললেন, “প্রেম নয়, তোমার বিশ্বাসঘাতকতার গল্প আমাকে হার্ট করেছে। আমি মেনে নিতে পারছি না। তোমার মতো মানুষ একটা মেয়ের সঙ্গে এমন কাজ করতে পেরেছিল! এটা আমি মেলাতে পারছি না।”
কমলেশ গলা চড়িয়ে বললেন, “বিশ্বাসঘাতকতা! কার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি? কোন স্কাউন্ড্রেল তোমাকে এসব বলেছে! মিথ্যে কথা। অল লাইস। ড্যাম লাইস।”
কমলেশ রায়ের চিৎকারে চার পাশের নিস্তব্ধতাও যেন থমকে গেল। নবনী শান্ত ভাবে বললেন, “মিথ্যে হলে এত রাগ করছ কেন?”
কমলেশ উত্তেজিত গলায় বললেন, “আমার ভাবতে অবাক লাগছে নবনী, তুমি একজন অচেনা অজানা লোকের মুখে গসিপ শুনে, কেচ্ছা শুনে আমাকে দোষারোপ করছ! তোমাকে এটা মানায় না। তাও যদি বিশ বছর আগে হত। নতুন বিয়ে করছি, আমার রিলেশনের কথা শুনে ইউ আর ফিলিং ব্যাড। সেসব তো নয়। অনেকটা সময় পেরিয়ে এসেছি আমরা।”
নবনী শান্ত ভাবে বললেন, “বিশ বছর আগে তো ঘটনা শুনিনি। তুমি খুব ভাল করেই জানো, এটা কোনও গসিপ নয়, কেচ্ছাও নয়। এটা বিশ্বাসঘাতকতা। আর যার মুখ থেকে আমি এই গল্প শুনেছি, তিনি জানেনও না, আমার হাজব্যান্ডের নামও কমলেশ রায়, সেও চার্টার্ড পড়েছে, সেও বিদেশ থেকে ম্যানেজমেন্ট ডিগ্রি নিয়ে এসেছে, সেও বড় কোম্পানিতে কাজ করছে। সুখী সংসারে তারও একটা মেয়ে আছে। সে শুধু জানে, তার বান্ধবীকে বিট্রে করা লোকটা জীবনে এরকমই এসট্যাবলিশড হয়েছে। আমিও কিছু বলিনি। গল্প শুনেছি মাত্র।”
কমলেশ খানিক ক্ষণ চুপ করে রইলেন, “মেয়েটির নাম কী?”
চাঁদ অনেকটা ওপরে উঠে গিয়েছিল। নুড়ি পাথরের নদী জায়গায় জায়গায় ঝকঝক করছিল।
“নাম জানি না, জিজ্ঞেস করিনি।”
কমলেশ রাগ কমিয়ে খানিকটা অসহায় ভাবে বললেন, “আমি এরকম কিছু মনে করতে পারছি না। কত মেয়ের সঙ্গেই তো আলাপ হয়েছে।”
নবনী ঠোঁটের কোণে হেসে বললেন, “আমি তো তোমাকে মনে করতে বলিনি। কিছুই বলিনি। ঘটনাটা সামলাতে একটু টাইম নিচ্ছিলাম।”
কমলেশ স্ত্রীর দিকে ঘুরে বসলেন। তার দুটো হাত ধরে নরম গলায় বললেন, “আচ্ছা তর্কের খাতিরে না হয় মেনে নিলাম এরকম কোনও ঘটনা ঘটেছিল। তাতেই বা কী? প্রেমে ব্রেক আপ হতে পারে না? কত জনের তো ডিভোর্স হয়। সেটাও কি বিশ্বাসঘাতকতা?”
নবনী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “রিলেশনে ব্রেক আপ বা ডিভোর্সের কথা যে হচ্ছে না সেটা তুমি ভাল করেই বুঝতে পারছ কমলেশ। ‘আমি আসছি, তুমি অপেক্ষা করো’ বলে হারিয়ে যাওয়াটাকে কী বলে? বিশ্বাসভঙ্গ? নাকি পালিয়ে যাওয়া? যাক, আমি এ নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। আমি তোমার কাছ থেকে কোনও কৈফিয়ত চাইনি। তুমি যা করেছ, তার উলটো ঘটলে তোমার সঙ্গে আমার বিয়েটাই হত না। আমার বাবা কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে কি তোমাকে খুঁজে পেত? পেত না। তোমার মতো একজন কম্পিটেন্ট, ডিপেন্ডেবল, লয়্যাল হাজব্যান্ডই পাওয়া হত না আমার। আহির মতো মেয়ে? ভাগ্যিস সেদিন তুমি পালিয়ে গিয়েছিলে। আমি লাকি। তার পরেও ঘটনাটা জানার পর মনটা কেমন খচখচ করছে। ঠিকই বলেছ, ছেলেমানুষি। আশা করি ঠিক হয়ে যাবে।”
কমলেশ বললেন, “নবনী, বিলিভ মি, আই কান্ট ট্রেস দ্য লেডি... তুমি একতরফা শুনে আমার সম্পর্কে ধারণা খারাপ করছ।”
নবনী জোর করে হেসে বললেন, “তুমি যা শোনার জন্য এখানে আমাকে টেনে নিয়ে এসেছিলে তা তো শুনলে, আমিও খানিকটা হালকা হলাম। চলো উঠি, কাল সকালে ফেরা। গোছগাছ আছে।”
কমলেশ বললেন, “আর একটু বোসো।”
“আচ্ছা বসছি, কিন্তু ওসব কথা আর নয়।”
কমলেশ কিছু একটা বলতে গেলেন, রিসর্টের দিক থেকে একজন হন্তদন্ত হয়ে এসে দাঁড়াল। হাতে জোরালো টর্চ। ধমকের ঢঙে বলল, “এ কী! আপনারা এখানে কেন? আপনাদের না আলোতে বসতে বলা হয়েছিল? তাড়াতাড়ি রিসর্টে চলুন। খবর এসেছে, হাতি বেরিয়েছে।”
সেদিন গভীর রাতে নদীর ওপারে যখন দলছুট হাতি আকাশ কাঁপিয়ে ডেকে ওঠে, কমলেশ নবনীকে বুকে চেপে ধরেছিলেন। ভরসা দিতে চেয়েছিলেন। ফিসফিস করে বলেছিলেন, “ভয় নেই। আমি আছি।”
আজ এতগুলো বছর কেটে গেল, কমলেশ বুঝতে পারেন, নবনীর সঙ্গে সম্পর্কে কোথাও একটা চিড় রয়েই গেল। সেই চিড় কোথায়? ভরসা, বিশ্বাস না কি শ্রদ্ধায়? আজও স্পষ্ট নয়।
৬
নবনী স্টাডির দরজায় এসে দাঁড়ালেন।
“মেয়ের কোনও খবর নেবে না?”
কমলেশ একটা বিজনেস ম্যাগাজিন দেখছিলেন। জিএসটি নিয়ে একটা ভাল লেখা বেরিয়েছে। মুখ তুলে বললেন, “খবর নিয়েছি। টিচাররা সবাই সেফ আছে। চিন্তার কিছু নেই। তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে টিভি দেখতে পারো।”
নবনী থমথমে গলায় বললেন, “তুমি বললেই চিন্তা বন্ধ করে দেব এমনটা ভাবছ কেন? মাঝরাত পর্যন্ত মেয়েকে কতকগুলো গুন্ডা আটকে রাখবে আর আমি নিশ্চিন্ত হয়ে বসে টিভিতে সিরিয়াল দেখব?”
কমলেশ বললেন, “গুন্ডা বলছ কেন? ওরা স্টুডেন্টস। আহিরই সব ছাত্রছাত্রী।”
নবনী দাঁতে দাঁতে চেপে, চোখে ঘৃণা নিয়ে বললেন, “এরা ছাত্র! ছিঃ! আমরা কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়িনি? টিচারদের রাতদুপুর পর্যন্ত আটকে রাখাটা ছাত্রদের কাজ?”
কমলেশ বললেন, “তোমাদের সময়েও এসব হয়েছে নবনী। তার আগেও হয়েছে। ছেলেমেয়েরা এই ধরনের আন্দোলন চিরকালই করে। কোন ইস্যুতে করে দ্যাট ইজ দ্য কোয়েশ্চেন। তবে এটা ঠিক, আনরেস্ট বাড়ছে। গোটা দেশেই কলেজ ইউনিভার্সিটিগুলোতে গোলমাল লেগে আছে।”
নবনী এবার ঘরে ঢুকলেন। মোড়ায় বসলেন। মোড়াটা সাধারণ মোড়া নয়, হস্তশিল্প মেলা থেকে বেশ দাম দিয়ে কেনা। কাঠের ওপর পুতুল খোদাই করা। কমলেশ মনে মনে প্রমাদ গুনলেন, নবনী বসেছে মানে অনেকটা বলবে। শুধু বলবে না, ঠিকমতো কথার উত্তর না দিলে তাকে ‘ইগনোর’ করা হচ্ছে বলে রাগারাগিও করবে।
নবনী বললেন, “আহিকে নিয়ে চিন্তা হয়। লেখাপড়া করে এ কী গোলমালে পড়ল!”
কমলেশ বললেন, “আহি তো বড় হয়েছে। অত চিন্তার কিছু নেই।”
নবনী বললেন, “বড় হয়েছে বলেই তো আরও চিন্তা। এর পর অন্য জায়গায় মানিয়ে নিতে অসুবিধে হবে।”
কমলেশ অবাক হয়ে বললেন, “অন্য জায়গায়! তার মানে!”
নবনী একটু চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, “আহির একটা ভাল সম্বন্ধ পাওয়া গেছে। ছেলে আমেরিকায় থাকে। কম্পিউটার নিয়ে লেখাপড়া। বাড়িতে এসেছিল। আহির সঙ্গেও আলাপ হয়েছে।”
কমলেশ ভুরু কুঁচকে বললেন, “তুমি আমাকে বলেছিলে না?”
“বলেছিলাম। কিন্তু পুরোটা বলিনি। ওই ছেলের আহিকে পছন্দ হয়েছে। সে তাকে জানিয়েওছে এ কথা। অমন মেয়েকে তো পছন্দ হওয়ারই কথা।”
কমলেশ একটু চুপ করে থেকে মাথা নামালেন। হাতে রাখা ম্যাগাজিনের পাতা উলটে বললেন, “ভাল তো। আহির সঙ্গে কথা বলো। লেখাপড়ার জগতের ছেলেকে তো ওর ভাল লাগারই কথা।”
নবনী এবার ঝাঁঝের সঙ্গে বললেন, “অনেক বলেছি। মেয়ে বলছে এখন বিয়ে করবে না। কলেজে পড়াব পড়াব করে তো তিরিশ বছর বয়স করে ফেলল। আর কত দিন?”
কমলেশ ঠান্ডা গলায় বললেন, “এখানে সিস্টেমটাই তো এরকম। ভাল ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া নিয়ে থাকতে চাইলে চাকরি-বাকরি পেতে পেতে বয়স হয়ে যায়। কী অদ্ভুত!”
নবনী এবার আরও ঝাঁঝের সঙ্গে বললেন, “এখানে পড়ে থাকার দরকার কী? বিদেশে গিয়ে পড়ানোর চাকরি নেবে। কত ছেলেমেয়ে তো পড়াচ্ছে। এখানে সারা রাত কলেজে আটকে থাকার থেকে তো সেটা অনেক ভাল।”
কমলেশ মুখ তুলে বললেল, “আহি আপত্তি করছে নাকি?”
নবনী মুখ ঘুরিয়ে বললেন, “তুমি জিজ্ঞেস করো। মেয়ের সঙ্গে এত আদিখ্যেতার সম্পর্ক আর এইটা জিজ্ঞেস করতে পারছ না!”
কমলেশ শান্তভাবে বললেন, “আমি তো এতটা জানতাম না।”
নবনী এবার গলা তুলে বললেন, “জানতে না কেন? একমাত্র মেয়ে, তার বিয়ের ব্যাপার জানবে না? শুধু আমি জানব? কেন? তুমি চাকরি করছ আর আমি ঘরে বসে আছি বলে? মেয়েকে তো আমি মানুষ করে দিয়েছি। আমার ডিউটি শেষ। আমার যা কোয়ালিফিকেশন তাতে আমিও চাকরি করতে পারতাম। ভাল চাকরি পেয়েও করিনি। কেন করিনি? না আমি সংসার দেখব, মেয়ে মানুষ করব। মেয়ে তো আমার একার নয়, তোমারও।”
কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে গেলেন কমলেশ। হুইস্কির গ্লাস হাতে নিয়ে ছোট করে চুমুক দিলেন। নবনীকে তিনি সেই সময়ে অনেক বুঝিয়েছিলেন। চাকরির সুযোগ যখন এসেছিল বলেছিলেন, অবশ্যই করা উচিত। ওয়ার্কিং মায়ের ছেলেমেয়েরাও ভাল হয়, দারুণ কেরিয়ার করে। চারপাশে ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে। আবার বাবা–মা সর্বক্ষণ চোখে চোখে রাখার পরেও ছেলেমেয়েদের গোল্লায় যাওয়ার ঘটনা অজস্র। এইভাবে দুই আর দুইয়ে চার হয় না। নবনী রাজি হননি। বলেছিলেন, “পরে দেখা যাবে। মেয়েটা দুরন্ত।” এ কথাটা অবশ্য সত্যি। ছোটবেলায় আহি খুব ছটফটে ছিল। কমলেশ জানতেন, সেটা কোনও বিষয় নয়। সবাই যেভাবে অ্যাটেনড্যান্ট রেখে ছেলেমেয়ে সামলায়, সে ভাবেই সামলানো যেত। এখন কলকাতায় ভাল ভাল সব ক্রেশ হয়েছে। সেখানে রাখা যেত।
মেয়ে একটু বড় হয়ে যাওয়ার পর ঝামেলা অনেক কমে গিয়েছিল। লেখাপড়ার কথা বলতে হত না। সে নিজের পড়াশোনার ব্যাপারে গোড়া থেকে সিরিয়াস। নবনী অবশ্য হাল ছাড়েননি। মেয়েকে ডাক্তার–ইঞ্জিনিয়র বানানোর জন্য চেষ্টা চালিয়েছেন আপ্রাণ। নানা ধরনের টিউশন, কোচিং, মক টেস্টের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। একটা বয়সের পর আহিরী আপত্তি করল। বলে দিল, ডাক্তার–ইঞ্জিনিয়র হওয়ার মধ্যে সে নেই, সে টিচিং প্রফেশনে যাবে। সুতরাং তাকে নিয়ে মায়ের এই ছোটাছুটি বৃথা। নবনী চিরকালই মেয়ের ব্যাপারে পজেসিভ। তিনি চাইতেন, মেয়ে তাঁর কথা মতো জীবন তৈরি করুক। মেয়ের ‘ডাক্তার–ইঞ্জিনিয়র’ না হওয়াটা মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল। তার পরেও না মেনে উপায় ছিল না।
ইউনিভার্সিটি শেষ করে আহিরী গবেষণার কাজ শুরু করল। নবনী চাইলেন, গবেষণা করতে করতে আহিরী বিয়ে করে ফেলুক। এর পরে বয়স পেরিয়ে যাবে। ছেলেও দেখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু মেয়ে বেঁকে বসে। শ্বশুরবাড়ির হেঁশেল ঠেলতে ঠেলতে সে গবেষণার কাজ চালাতে পারবে না। কমলেশও তখন মেয়েকে সমর্থন করেছিলেন। বলেছিলেন, ক’টা দিন যাক। রিসার্চের কাজটা মন দিয়ে শেষ করুক। বিয়ে তো পালিয়ে যাচ্ছে না! নবনী রেগে ছিলেন খুব, কিন্তু করার কিছু ছিল না। তারপর জল আরও গড়িয়েছে। আহিরী চাকরি পেয়েছে। বয়সও বাড়ছে।
রাগ সংযত করে, গলা নামিয়ে নবনী বললেন, “মেয়ের দিকে এবার একটু নজর দাও।”
কমলেশ অবাক হয়ে বললেন, “এত বড় মেয়ের দিকে আমি কী নজর দেব! সে কলেজের টিচার।”
নবনী দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, “তাতে কী হয়েছে? কলেজে পড়াচ্ছে বলে মাথা কিনে নিয়েছে? তোমাকে কিনতে পারে, আমাকে পারবে না। যা বলছি করো। আশকারা দেওয়া বন্ধ করে, মেয়েকে সামলাও। এর পরে আপশোস করতে হবে।”
কমলেশ স্ত্রীর কথা তেমন বুঝতে পারেন না। আহিরীর ওপর কী নজর দেবেন? সে খুবই ভাল একটা মেয়ে। বাবা হিসেবে তিনি এই মেয়ের জন্য গর্ব বোধ করেন। ও বাইরে যাক অথবা দেশে থাকুক, আরও অনেক ওপরে উঠবে। হ্যাঁ একটা কথা ঠিকই, এখানকার শিক্ষাজগতের এখন অনেক রকম অস্থিরতা। রাজনীতি, দলাদলি বাড়ছে। সত্যি যারা লেখাপড়া ভালবাসে, লেখাপড়া নিয়ে থাকতে চায়, তারা মাঝেমধ্যেই হতাশ হয়ে পড়ে। বিদেশে চলে গেলে এই সমস্যা থাকবে না। কথায় কথায় ঘেরাও, কলেজ-ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের ভিতর মারপিট, হাঙ্গামা। লেখাপড়ার বদলে রাজনীতি ঢুকে পড়েছে অনেক বেশি। কিন্তু সেটাও তো আহিরীর সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়। জোর করে তো চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। কিন্তু এর সঙ্গে তাকে সামলানোর প্রশ্ন উঠছে কেন?
“তুমি কী বলছ আমি ঠিক বুঝতে পারছি না নবনী।”
নবনী একটু চুপ করে থেকে চাপা গলায় বললেন, “আহি খুব বাজে একটা ছেলের পাল্লায় পড়েছে। আমি খবর পেয়েছি, সেই ছেলে কিছু করে না। লেখাপড়াতেও ভাল না। এতটাই বাজে যে সে কোনও কাজ করতে গেলে তাকে দু’দিন পরে তাড়িয়ে দেয়। বাড়িতেও জটিলতা আছে। কী জটিলতা এখনও জানতে পারিনি। এর খপ্পর থেকে মেয়েটাকে বের করতে না পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
কমলেশ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। নবনী কী বলছে এসব! আহি এমন একজন ছেলে ‘বন্ধু’ হিসেবে বেছেছে! হতে পারে না। নিশ্চয়ই নবনী বাড়াবাড়ি করছে। নিজের পছন্দের ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে চায় বলে এসব বলছে। হয়তো একটু শুনেছে, বলছে অনেকটা।
“এত সব খবর তুমি পাও কোথা থেকে?”
নবনী স্বামীর দিকে তাকিয়ে একটু চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “নিজের লোকদের খবর রাখব না তো কার রাখব?”
কমলেশ একটু থমকে গেলেন। নবনী কি তাঁকেও খোঁচা দিল?
নবনী বললেন, “তুমি নিশ্চয়ই জানো এই ধরনের সম্পর্কের শেষ কোথায় হয়।”
কমলেশ নিজেকে সামলে শান্ত গলায় বললেন, “তুমি কোথাও ভুল করছ না তো নবনী? আহি একজন বুদ্ধিমতী মেয়ে। সে নিজের ভালমন্দ বোঝে।”
নবনী একটু চুপ করে থাকলেন। তারপর স্বামীর চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন, “যাদের বুদ্ধি থাকে তারা ভুল করে না?” একটু থমকে থেকে আবার বললেন, “আহি তোমারই তো মেয়ে। এই বিষয়ে তার ভুল হওয়াটা আশ্চর্যের হবে না। আমি তাই ভয় পাচ্ছি।”
কমলেশ বুঝতে পারলেন, নবনীর ইঙ্গিত খুব স্পষ্ট। সে ভুলতে পারেনি। পারবেও না।
নবনী বলল, “যাক ওসব কথা। তুমি আহির খোঁজ নাও। বারোটা বাজতে চলল। মোবাইল এখনও অফ। তোমার একবার যাওয়া উচিত। দূর থেকে হলেও দেখে আসা দরকার ওখানে কী হচ্ছে। আর মদ খাওয়ার কারণে তুমি যদি ড্রাইভ করতে না পারো তা হলে ক্যাব ডেকে দাও, আমি যাব।”
কথা শেষ করে নবনী চলে গেলেন। কমলেশ বুঝতে পারলেন, কথা বাড়িয়ে লাভ হবে না। নবনী অশান্ত। সে অনেকগুলো সমস্যার মধ্যে রয়েছে। কমলেশ হাত বাড়িয়ে মোবাইল টেনে নিলেন। নম্বর টেপার পর চাপা গলায় কথা বললেন।
“বিভূতি, কী খবর?”
“স্যর, মনে হচ্ছে একটা কিছু নড়চড় হয়েছে।”
“কী করে বুঝলে? তুমি কি ভিতরে ঢুকতে পেরেছিলে?”
“না স্যর, ভিতরে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। কলেজের গেটে পুলিশ আছে। তবে গোপাল বলল, এবার ফয়সালা হয়ে যাবে মনে হয়। প্রিন্সিপাল না কার ঘরে যেন মিটিং চলছে।”
কমলেশ বললেন, “গোপাল কে?”
বিভূতি বলল, “কলেজের দারোয়ান। আলাপ করে নিয়েছি স্যর।”
খুশি হলেন কমলেশ। এই সময়টুকুর মধ্যেই বিভূতি সিকিয়োরিটির সঙ্গে আলাপ করে ফেলেছে। চটপটে লোক। বছরখানেক আগে এর সন্ধান পেয়েছিলেন কমলেশ। একদিন অফিসে কাজ করছেন, নিলয় ফোন করে বলল, “স্যর, একজন দেখা করতে চাইছে। রিসেপশনে বসে আছে।”
কমলেশ বিরক্ত গলায় বললেন, “অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?”
নিলয় বলল, “না স্যর।”
কমলেশ অবাক হয়ে বললেন, “তা হলে আমাকে জানাচ্ছ কেন? অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া কারও সঙ্গে দেখা করার মতো সময় কি আমার থাকে নিলয়?”
নিলয় আমতা আমতা করে বলেছিল, “স্যর, লোকটা বলছে ওর কাছে নাকি জরুরি খবর আছে।”
কমলেশ আরও বিরক্ত হয়ে বললেন, “কী খবর?”
“বলছে আপনাকে ছাড়া বলা যাবে না।”
কমলেশ বললেন, “ওকে বলে দাও, আমার কোনও জরুরি খবরের প্রয়োজন নেই।”
রিসিভার নামাতে গেলে নিলয় প্রায় ফিসফিস করে বলল, “স্যর, লোকটা বলেছে প্রোডাকশন ম্যানেজার আদিত্য সাহা সম্পর্কে সিক্রেট কিছু…”
কমলেশ বহু দিন পরে অফিসে চিৎকার করে উঠেছিলেন।
“গেটে গার্ড কেউ নেই? ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দাও। এত বড় স্পর্ধা!”
এই ঘটনার ঠিক এক মাস পরে আদিত্য সাহা কোম্পানি ছেড়ে চলে যায়। কিছু দিনের মধ্যে জানা যায়, কোম্পানির নাম করে সে বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু টাকা নিয়েছে। সব থেকে খারাপ যেটা করেছে তা হল, কোম্পানি যেখানে যেখানে অর্ডার সাপ্লাই করে, সেখান থেকে অ্যাডভান্সও নিয়েছে। পুলিশে কমপ্লেন করার মতো কোনও প্রমাণ সে রেখে যায়নি। একমাত্র উপায় ছিল আগে খবর পেয়ে হাতেনাতে ধরা।
এই ঘটনার দেড় মাস পরে অচেনা নম্বর থেকে ফোন পেলেন কমলেশ।
“কে বলছেন?’
উলটো দিকের গলা অতি বিনয়ের সঙ্গে বলল, “আমি বিভূতি। বিভূতি বসাক। সবাই সংক্ষেপে বি. বি. ডাকে। আপনার কাছে গিয়েছিলাম স্যর, ভিতরে ঢুকতে দেয়নি। আপনার ফোন নম্বর জোগাড় করে ফোন করছি বলে অপরাধ নেবেন না।”
কমলেশ রায় ‘জেন্টলম্যান’ হিসেবে পরিচিত। চট করে খারাপ ব্যবহার তাঁর ধাতে নেই। তিনি ঠান্ডা গলাতেই বললেন, “আপনার কী চাই?”
“কিছু চাই না স্যর।”
কমলেশ বললেন, “কিছু চাই না তো ফোন করেছেন কেন? এই সময় তো আমি কারও সঙ্গে গল্প করি না।”
বিভূতি গদগদ গলায় বলল, “আমাকে ‘আপনি’ বলবেন না স্যর। বয়সে ছোট, অতি সামান্য মানুষ।”
এবার রাগ হল কমলেশের। চড়া গলায় বললেন, “কাজের কথা বলুন। আমি ব্যস্ত আছি।”
ফোনের ও পাশে বিভূতি নামের লোকটা একটু চুপ করে থেকে বলল, “স্যর, কিছু দিন আগে আমি আপনাকে আপনাদের প্রোডাকশন ম্যানেজারের খবরটা দিতে চেয়েছিলাম। আপনি তো শুনলেনই না।” লোকটা একটু থামল। তারপর বলল, “শুনলে এতটা ক্ষতি হত না। টাকার থেকে আপনাদের গুডউইলের ক্ষতি হয়েছে বেশি।”
এবার থমকেছিলেন কমলেশ। শান্তভাবে বললেন, “আপনি কি আদিত্য সাহার শত্রু?”
ও পাশে হালকা হাসির আওয়াজ হল।
“স্যর, আমি কারও শত্রু বা বন্ধু নই। আমি খবর জোগাড় করি। আদিত্য সাহার খবর পাওয়ার পর লেগে থাকি। খবর পাকা হওয়ার পরেই আপনার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম। ফর ওয়ান রিজন স্যর। যদি কিছু টাকা পাওয়া যায়।”
কমলেশ রায় বললেন, “স্পাই?”
“অনেকটা তাই স্যর। এক সময় পুলিশেও কাজ করেছি। তখন আন্ডারগ্রাউন্ডে খেলতাম। এখন প্রাইভেটে কাজ করি। ভাবলাম বড় কোম্পানিতে যদি কিছু কাজ পাই। অনেক সময় আপনাদেরও তো গোপন খবর লাগে।”
কমলেশ বললেন, “সরি বিভূতিবাবু, আমাদের কোনও গোপন খবর লাগে না।”
কথা শেষ করে ফোন কেটে দিয়েছিলেন কমলেশ। এর এক ঘণ্টা পরে কল লিস্টের নম্বর সার্চ করে লোকটিকে ডেকে নেন কমলেশ। অফিসে না, অফিস থেকে সামান্য দূরে এক কফি শপে ডেকে নেন। চকচকে কফি শপের জন্য এই লোক একেবারেই বেমানান। মাঝবয়সি, ছাপোষা চেহারা। ভিড়ে আলাদা করবার কোনও উপায় নেই। একেবারে ‘চর’ যেমনটি হওয়া উচিত। কমলেশ বলেছিলেন, “কোম্পানি নয়, আপনি আমার হয়ে কাজ করবেন। রাজি আছেন?”
বিভূতি বলল, “টাকাপয়সা ঠিক মতো পেলে রাজি না হওয়ার কোনও কারণ নেই স্যর।”
কমলেশ বললেন, “আমার জন্য জোগাড় করা ইনফরমেশন যে আপনি অন্য কাউকে দিয়ে দেবেন না সে গ্যারান্টি কী? আপনাকে বিশ্বাস করব কেন?”
বিভূতি কফি নয়, খাবার দিতে বলেছিল। খাওয়ার ভঙ্গি দেখলেই বোঝা যায়, খিদে আছে। যত্ন করে কেকে কামড় দিয়ে বলল, “কোনও গ্যারান্টি নেই। আপনাদের প্রোডাকশন ম্যানেজারের কাছ থেকে তো অনেক গ্যারান্টি পেয়েছিলেন। কী লাভ হল? ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে স্যর, গ্যারান্টি, কন্ডিশন, বিশ্বাস— এসব নিয়ে কাজ না করাই ভাল। এসব ধারণা আজকের দিনে ফালতু।”
কমলেশ খুশি হলেন। এই লোক ঠগ, জালিয়াত হলেও স্পষ্ট কথার মানুষ। বিভূতিকে তিনি মাসকাবারি ব্যবস্থায় রেখেছেন। মাসে মাসে টাকা দেন। দরকার হলে যোগাযোগ করেন। আর কেউ জানে না। তথ্য সংগ্রহের এই প্যারালাল সিস্টেম তাঁর একান্তই নিজের। ইতিমধ্যে সে কয়েকটা ছুটকো-ছাটকা কাজ করেছে। তার মধ্যে একটা জরুরি কাজ। প্রাইভেট সেক্রেটারি নিলয় সম্পর্কে ইনফরমেশন। নিলয় একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছে। প্রেম করাটা কোনও গুরুত্বপূর্ণ খবর নয়। খবর হল, যে মেয়েটির সঙ্গে নিলয় প্রেম করেছে সে এমন একটি সংস্থার কর্মী যারা সম্প্রতি কোম্পানির প্রোডাক্ট প্রোমোশন এবং ব্র্যান্ডিং-এর দায়িত্ব পেয়েছে। এর পিছনে কি নিলয়ের কোনও ইনফ্লুয়েন্স আছে?
বিভূতিকে আজ কমলেশ নিজের কাজে লাগিয়েছেন। আহিরী কলেজ থেকে ফোন করে ঘেরাওয়ের খবর জানানোর কিছু পরে, বিভূতিকে ফোন করেছিলেন।
“কী খবর চাই স্যর?”
এই ক’দিনে বিভূতির সঙ্গে সম্পর্ক সহজ হয়েছে। ভাল ম্যানেজার হতে গেলে গুপ্তচর পুষতে হবে, এমন কথা ম্যানেজমেন্ট শিক্ষার সিলেবাসে নেই। দেশ-বিদেশ কোথাও নেই। তার ওপর কাজটা ‘পারফেক্ট জেন্টলম্যান’-এর মতো নয়। বরং খানিকটা ‘নীচে নেমে যাওয়া’ই বলা যায়। কমলেশ রায়ের ইমেজের সঙ্গে যায় না। তার পরেও কমলেশের মনে হয়েছে, এটা জরুরি। গোপন তথ্য কোনও কোনও সময়ে মানুষ চিনতে সাহায্য করে। এই তথ্য হাতে থাকলে সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধে হয়। সিদ্ধান্ত না নিতে পারলেও সুবিধে হয়। ইমেজ নিয়ে বসে থাকা যায়, কাজ করতে গেলে রিয়েলিটির প্রয়োজন। একজন দক্ষ প্রফেশনাল নিজের মতো করে তার বাস্তব প্রয়োজন মেটায়। বিভূতিকে নিয়োগ করা অনেকটা সে রকমই। এর মধ্যে ন্যায়-অন্যায়ের কিছু নেই। ইনফরমেশনে ভরা এই দুনিয়াতে আরও একটি প্রক্রিয়ায় ইনফরমেশন আয়ত্তে আনবার চেষ্টা।
কমলেশ আজ বিভূতিকে বলেছিলেন, “খবর কিছু চাই না। তুমি সিচুয়েশনের ওপর নজর রাখবে। মাঝেমধ্যে আমাকে আপডেট দেবে।”
ইতিমধ্যে বার কয়েক সে ফোনে খবরও পাঠিয়েছে। জানিয়েছে, পুলিশ এসেছে, কিন্তু কলেজের ভিতর ঢোকেনি।
“স্যর, আমি কি ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করব? আপনার মেয়ে কেমন আছেন যদি জানতে পারি!”
কমলেশ তাড়াতাড়ি বললেন, “খবরদার না। তুমি বাইরে থাকো। কোনও ডেভেলপমেন্ট হলে জানিয়ো।”
কমলেশ উঠে পড়লেন। নবনীকে শান্ত করা দরকার। সত্যি সত্যি সে যদি মেয়ের কলেজে যাওয়ার চেষ্টা করে, সেটা একটা বিচ্ছিরি কাণ্ড হবে।
৭
আহিরী কলেজের দোতলায়। শর্মিষ্ঠা দত্তর ঘরের বাইরে চেয়ারে বসে আছে। চারপাশে ভাঙা কাচ, ভাঙা টবের টুকরো ছড়ানো। এগুলো পরিষ্কার করার জন্য লোক এসেছিল। শর্মিষ্ঠা দত্ত বারণ করেন। তখন তিনি রাগে আগুন হয়ে ছিলেন। দাঁত কিড়মিড় করে বলেছিলেন, “টিভি থেকে লোক আসছে। তারা এই সব ভাঙচুরের ছবি তুলবে। তখন ঠেলা বুঝতে পারবে ওরা।”
টিভির লোক ছবি তুলে নিয়ে গেছে। সেই ছবি দেখানোও হয়েছে। কেউ কোনও ‘ঠেলা’ বোঝেনি। ছেলেমেয়েরা ঘেরাও থেকে সরেনি।
আহিরীর ক্লান্ত লাগছে। খাওয়াদাওয়া কিছু হয়নি। চা-ও নয়। ছেলেরা টিচার্স রুমে চা এনেছিল। কেটলি-ভরতি চা, কাগজের কাপ, বিস্কুট নিয়ে ঢুকেছিল। সবাই ভদ্রভাবে তা প্রত্যাখান করে। যারা জোর করে আটকে রেখেছে, তাদের দেওয়া চা খাওয়া যায় না। যদিও আহিরীর খুব ইচ্ছে করছিল।
ঘেরাও হয়ে থাকতে যতটা খারাপ লাগছে, আহিরীর তার থেকেও বেশি অসহ্য লাগছে টিচার্স রুমে ঠায় বসে থাকা। সকলেরই কিছু না কিছু মত রয়েছে। কারও রাগ অর্কপ্রভ সেনের ওপর। তারা বলছে, ওঁর জন্যই যত ঝামেলা। সিলেবাসের বাইরে প্রশ্ন করা ঠিক হয়নি। করলেও তা পরে ছেলেমেয়েদের বুঝিয়ে বলা উচিত ছিল। অমন দুচ্ছাই করে তাড়িয়ে দেওয়াটা অন্যায় হয়েছে। আজকালকার ছেলেমেয়েদের ঠান্ডা মাথায় সামলাতে হয়। আবার কেউ বলেছে, ছেলেমেয়েরা অতি বদ। সব গোল্লায় গেছে। পরীক্ষার সময় পড়াশোনা করেনি বলে ঝামেলা পাকিয়েছে। ইস্যুটাকে কায়দা করে কলেজের দুর্নীতির দিকে নিয়ে গেছে। যাতে কেউ নিন্দে করতে না পারে। আবার কারও মত, এর পিছনে বড় মাথা আছে। কলেজে ঝামেলা পাকানোর জন্য ফাঁক-ফোকর খুঁজেছিল। মহিলারা সকলেই টেনশন করছেন। স্বাভাবিক। ঘর-সংসার আছে। এর মধ্যে দু’-একজন তো আহিরীকে বলেই বসল, “খুব বাঁচান বেঁচে গেছ। এই যদি বিয়ে-থা করে ছেলেমেয়ের মা হতে, দেখতে ঝামেলা কাকে বলে।”
আহিরীর বলতে ইচ্ছে করল, “ঠিকই বলেছেন। এখন আমি দিনের পর দিন নিশ্চিন্তে ঘেরাও হয়ে থাকতে পারব। মাসখানেকও বসে থাকতে পারি।”
কিন্তু সে কথা তো আর বলা যায় না। এরকম একটা জটিল সময়ে কেউ রসিকতা নিতে পারবে না।
আটটার পর থেকে পুরুষরাও অধৈর্য হয়ে পড়েছে। অনেকক্ষণ ‘কিছু নয়’ ভান করেছিল, আর পারছে না। মুখে বলছে ইস, অনেক লেখাপড়া করার ছিল। আসলে সুগার, প্রেশারের ওষুধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। কারও কারও আবার ঠিক সময়ে পারগেটিভস্ না খেলে পর দিন সমস্যা। নিশ্চিন্ত জীবনে আকাশ থেকে ঝপ করে ঝামেলা এসে পড়েছে।
আহিরী কোনও আলোচনাতেই নেই। ‘হুঁ-হ্যাঁ’-এর বেশি সে অংশগ্রহণও করছে না। বেশির ভাগ সময়টাই ঘরের বাইরে বারান্দায় পায়চারি করেছে। এর মধ্যে পরীক্ষা-হলের সেই টুকলি করা মেয়েটা— উর্বী— এসেছিল।
“ম্যাডাম, আমার মোবাইলটা প্লিজ দিয়ে দিন। বাড়িতে খবর দিতে পারছি না।”
আহিরী বলল, “তুমি বাড়ি যাওনি? এত রাত পর্যন্ত কলেজে কী করছ?”
উর্বী মাথা চুলকে আমতা আমতা করে বলল, “ওদের সঙ্গে আছি।”
আহিরী বলল, “আমাদের যারা ঘেরাও করে রেখেছে ওদের সঙ্গে?”
উর্বী কিছু বলল না। মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আহিরী মেয়েটির দিকে এবার ভাল করে তাকাল। দেখতে-শুনতে ভাল। সাজপোশাক চটকদার। সালোয়ার কামিজটা বেশ ফ্যাশনদুরস্ত। মজার কথা, সেই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কলেজে পড়ে আছে, কিন্তু চোখেমুখে কোনও ক্লান্তির ভাব নেই। তার মানে এর সঙ্গে মেক-আপ কিট আছে। সুযোগ পেলেই আড়ালে গিয়ে পাফ করে নিচ্ছে।
আহিরী বলল, “তুমি অফিসে গিয়ে আমার নাম করে বলো। আচ্ছা, এসো আমার সঙ্গে।”
মোবাইল হাতে নিয়ে উর্বী বলল, “ম্যাডাম, আর কখনও হবে না।”
আহিরী বলল, “আমাকে বলতে হবে না। নিজেকে বলো। তোমার বাড়ি কোথায়?”
“কাঁকুড়গাছি।”
আহিরী বলল, “বাবা, সে তো এখান থেকে অনেকটা দূর। ফিরবে কী করে?”
উর্বী হাসিমুখে বলল, “বাস পাব তো। না পেলে সিনিয়র দাদারা কেউ পৌঁছে দেবে। ওদের বাইক আছে।”
আহিরী বুঝতে পারল, এই মেয়ে চাইছে তার দেরি হোক এবং ‘সিনিয়র দাদা’রা কেউ পৌঁছে দিক।
আহিরীর মোবাইলে অনেকক্ষণ আগেই চার্জ ফুরিয়েছে। পাওয়ার ব্যাঙ্ক গাড়িতে বলে সমস্যা হচ্ছে। গিয়ে নিয়ে আসতে পারে, ছেলেমেয়েরা কিছু বলবে না। কিন্তু সে এই সুযোগ নেবে না। মোবাইল অফ করে রেখেছে। এক দিক থেকে ভাল হয়েছে। মা বড্ড জ্বালাতন করছে। যত দিন যাচ্ছে মায়ের সমস্যা বাড়ছে। খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। একবার থাইরয়েডটা চেক করানো উচিত। গাইনোকোলজির সমস্যাও হতে পারে। মাকে কে এসব বলবে? বাবার সঙ্গেও সম্পর্কটা কেমন যেন হয়ে গেছে। কোথাও একটা তাল কাটছে। বেশ কয়েক বছর ধরে এটা চলছে। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়। কিছু কি ঘটেছে? বুড়ো বয়েসে আর কী ঘটবে? বাবা নিশ্চয়ই প্রেমে পড়েনি। পড়তেও পারে। প্রেমের সঙ্গে বয়সের কী সম্পর্ক? কিঙ্কিণীর বাবা তো সিক্সটি ছুঁই-ছুঁইতে বিয়ে করল। মেয়েটি নাকি মেরেকেটে ছাব্বিশ। কিঙ্কিণী আহিরীর ইউনিভার্সিটির ব্যাচমেট। এখন বিদেশে রিসার্চ করছে। খুব ছোটবেলায় মা ক্যানসারে মারা যায়। বাবা-ই মেয়েকে মানুষ করেছে। এমনি মানুষ-করা নয়, পাখির ছানার মতো আগলে মানু্ষ করা। সেদিন ফেসবুকে কিঙ্কিণীর সঙ্গে কথা হল। সে বলল, “বাবা নতুন জীবন শুরু করছে।”
আহিরী লিখল, “সেটা কীরকম? নিউ জব?”
কিঙ্কিণী লিখল, “না। বাবা বিয়ে করেছে।”
আহিরী লিখল, “তাই নাকি!”
কিঙ্কিণী লিখল, “মেয়েটি আমার থেকে একটু ছোট। সেও বাবার মতোই একজন আর্টিস্ট। তবে ড্রয়িং নয়, স্কাল্পচার করে। কাঠের কাজে নাকি কলকাতায় নাম করেছে। বাবার সঙ্গে দু’বছরের রিলেশন। বিয়ের আগে বাবা আমার কাছে পারমিশন চেয়েছিল।”
আহিরী লিখল, “তুই নিশ্চয়ই হ্যাঁ বলেছিলি!”
“অবশ্যই বলেছি। বাকি জীবন মানুষটা একজন সঙ্গী পাবে, এতে আমি সবচেয়ে খুশি। দে আর অলসো ভেরি হ্যাপি। এই সামারে আমার এখানে দু’জনে আসছে।”
আহিরী লিখল, “মেসোমশাইকে আমার হয়ে কনগ্র্যাচুলেশনস জানাস।”
কিঙ্কিণী একটা স্মাইলি দিয়ে লিখল, “আমার নতুন মা আমাকে বলেছে, নাম ধরে ডাকলে বেশি খুশি হবে। আমি ভেবেছি তা-ই করব। আমার বাবাকে যে ভালবাসে সে আমার বন্ধু। কী, ভুল ভেবেছি?”
আহিরী লিখল, “একেবারেই নয়।”
কিঙ্কিণীর বাবা যদি বিয়ে করে ফেলতে পারে, তা হলে তার বাবার প্রেমে পড়তে দোষ কী?
খানিক আগে বিতানকে ফোনে ধরেছিল। এই ছেলের সব কিছুতেই রসিকতা।
“এখনও বন্দি? সাধে কি বলি, বেশি লেখাপড়া করা মানেই ঝামেলায় পড়া। টিচার ঘেরাও হচ্ছে, ডাক্তার মার খাচ্ছে, ব্রিজ ভাঙলে ইঞ্জিনিয়ার অ্যারেস্ট হচ্ছে, আইপিএস অফিসার হলে নেতা দাবড়াচ্ছে। আমি কত নিশ্চিন্ত, দেখো।”
আহিরী বলল, “আমরা মোটেই বন্দি নই। খানিক আগে স্টুডেন্টরা এসে বলল, আমরা বাড়ি চলে যেতে পারি। শুধু টিটার-ইন-চার্জ আর অর্কপ্রভ সেনকে ওরা ছাড়বে না। আমরা রাজি হইনি। এটা তো মানা যায় না। যদিও ওই দু’জনেই পাজি।”
বিতান বলল, “ও, তা হলে তোমরা এখন স্বেচ্ছাবন্দি?”
“মনে হচ্ছে, ছাড়া পাব। মিটিং চলছে।”
বিতান বলল, “বাড়ি ফিরবে কীভাবে?’
আহিরী বলল, “হেঁটে। এখন ছাড়ছি। মোবাইলে চার্জ প্রায় শেষ।”
বিতান বলল, “ছাড়া পেলে জানিয়ো।”
খানিক আগে শর্মিষ্ঠা দত্ত আহিরীকে ঘরে ডেকে পাঠান। নরম গলায় বলেন, “তুমি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলো। বলো, ঘেরাও তুলে নিতে।”
আহিরী আকাশ থেকে পড়ে, “আমি বলব! আমার কথা ওরা শুনবে কেন?”
চওড়া টেবিলের এক দিকে বসে আছেন অর্কপ্রভ সেন। তিনি বললেন, “তুমি বললে ওরা শুনবে। তোমাকে ওরা পছন্দ করে।”
আহিরী অবাক হয়ে দেখল, যে মানুষটা কথা বন্ধ করে দিয়েছিল, সে শুধু তার সঙ্গে এখন কথাই বলছে না, মনে হচ্ছে কথা বলার আগে এক কাপ মধুও গিলে নিয়েছে।
আহিরী বলল, “স্যর, আমাকে কেউ কেউ পছন্দ করে ঠিকই, কিন্তু আমি এসব পলিটিক্সের মধ্যে কখনও থাকি না। থাকবও না। তা ছাড়া, আমি একজন জুনিয়র টিচার। আমার কথা ছেলেমেয়েরা শুনবে কেন?”
টিচার-ইন-চার্জ বললেন, “তোমায় থাকতে হবে না। তুমি শুধু একটা অ্যাপিল করো। এতগুলো বয়স্ক মানুষ আটকে রয়েছেন। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে...”
আহিরীরা টিচার্স রুমে বসেই খবর পেয়েছিল, শর্মিষ্ঠা দত্ত বাইরের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা বলে দিয়েছে, ছাত্রদের ব্যাপারে জোরজুলুম করা সম্ভব নয়। আলোচনা করে মিটিয়ে নিতে হবে। অর্কপ্রভ সেন সরকারের কোনও হর্তাকর্তাকে ধরেছিলেন। তিনি নাকি আর এক কাঠি ওপরে গিয়েছেন। বলেছেন, এই কলেজের টাকাপয়সা নিয়ে কমপ্লেন আছে। এখানে হাত দেওয়া যাবে না। যে-কোনও সময় ইনভেস্টিগেশনের অর্ডার হয়ে যেতে পারে। এই সময় আগ বাড়িয়ে কলেজের পক্ষ নিয়ে কিছু করতে যাওয়া সম্ভব নয়। এতে শর্মিষ্ঠা দত্তরা খুবই ঘাবড়েছেন। অনেক জনকে হাতড়ে এখন আহিরীকেই ভরসা হয়েছে। নিশ্চয়ই অকর্প্রভ সেন মাথায় ঢুকিয়েছেন।
আহিরী বলল, “ম্যাডাম, আমি ঘেরাও তুলে নিতে বলতে পারব না। আপনাদের সঙ্গে আলোচনায় যাতে বসে, তার জন্য অনুরোধ করতে পারি। তবে মনে হয় না শুনবে।”
অর্কপ্রভ সেন টিচার-ইন-চার্জের দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বললেন, “অন্তত তাই হোক। দরকার হলে দু’–একটা ছোটখাটো ডিমান্ড মানতে হবে। তুমি কথা বলে দেখো আহিরী।”
ছেলেমেয়েরা আহিরীর কথা শুনেছে। তারা মিটিং-এ বসেছে। তাকে ভিতরের আলোচনায় ডাকা হয়েছিল। সে রাজি হয়নি। টিচার-ইন-চার্জ যেমন বলেছিলেন, ছাত্রছাত্রীরাও ডেকেছিল। এমনকী অর্কপ্রভ সেনও বলেছিলেন। আহিরী রাজি হয়নি। এই মিটিং-এ বসবার সে কে? এরা প্রয়োজনে তাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। তার বেশি নয়।
আহিরী শর্মিষ্ঠা দত্তর ঘরের সামনে থেকে সরে এল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে হল, যত রাতই হোক, বিতানকে আসতে বললে হত। গাড়ির পাশে বসে বাড়ি পর্যন্ত বকবক করতে করতে যেত। তারপর একটা ট্যাক্সি ধরে ফিরে যেত না হয়। এখন যতই বকবক করুক, বিতানের সঙ্গে পরিচয় কিন্তু ঠিক উলটো কারণে। তার কম কথা এবং নিস্পৃহতা আহিরীকে প্রথম আকর্ষণ করেছিল।
সেটা ছিল এক ডিসেম্বরের বিকেল। কল্যাণী ইউনিভার্সিটিতে একটা সেমিনার সেরে কলকাতায় ফিরছিল আহিরী। কলেজে সবে জয়েন করেছে। তখনও তার নিজের গাড়ি হয়নি। অর্ডার হয়ে গিয়েছে, কিন্তু রঙের জন্য পেতে সময় লাগছিল। আহিরী তখন সুযোগ পেলে বাবার গাড়ি নিয়ে বেরোয়। সেদিনও তা-ই করল। বাবা বলেছিল, “দীনেশকে নিয়ে যা।”
আহিরী ভুরু কুঁচকে বলেছিল, “কেন? আমি গাড়ি চালাতে পারি না? দু’জন ড্রাইভারের কী প্রয়োজন?”
বাবা হেসে বলেছিল, “তা অবশ্য ঠিক। এইটুকু পথ যেতে একজনই এনাফ। তাও বলছিলাম, পথেঘাটে যদি কোনও সমস্যা হয়।”
আহিরী কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “হলে হবে। দীনেশকাকা কি আমার সেভিয়ার? প্রবলেম হলে আমি ফেস করব। সারা পৃথিবীতে মেয়েরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ড্রাইভ করে চলে যাচ্ছে। আমাদের বেলায় এই আতুপাতুপনাটা এবার ছাড়ো।”
বাবা বললেন, “আই এগ্রি উইথ ইউ। তোমার মাকে কিছু বোলো না। আর আমাকে অফিসে ড্রপ করে দিয়ে যাও।”
কল্যাণী যাওয়ার রাস্তাটা চমৎকার। হাইওয়েতে ড্রাইভ করবার মজা আহিরীকে সব সময়েই টানে। হুহু করে পৌঁছে গেল। সেমিনার শেষ হতে হতে বিকেল। দু’-একজন আহিরীর সঙ্গে গাড়িতে ফেরার জন্য ছোঁক-ছোঁক করছিল। একেবারেই অচেনা। সেমিনারে আলাপ হয়েছে। আহিরী তাদের সহজ ভাবে কাটিয়ে দিল। তার নাকি কল্যাণীতে এক আত্মীয়ের বাড়ি যেতে হবে। তারা সাধাসাধি করলে রাতে বাড়ি ফেরা নাও হতে পারে। শেষে বলল, “ইস একসঙ্গে গেলে খুব ভাল হত। গল্প করা যেত। আশা করি পরে কখনও আমরা এই সুযোগ পাব।”
শীতের পড়ন্ত বেলা দিয়ে কলকাতার দিকে গাড়ি ছুটিয়েছিল আহিরী। স্পিকারে গান চলছে। কান্ট্রি রোডস, টেক মি হোম, টু দ্য প্লেস আই বিলং। আহিরী মনে মনে নিজের পিঠ চাপড়াল। ভাগ্যিস কাউকে লিফ্ট দেয়নি! একা চলার আনন্দটাই নষ্ট হত। মোবাইল টেনে নিয়ে বাবাকে ফোন করল।
“ফিরছি।”
“একাই আছিস? নাকি কোনও বয়ফ্রেন্ডকে তুলে নিয়েছিস?”
আহিরী বলল, “হ্যাঁ নিয়েছি। খানিক আগে জন ডেনভার হাত দেখিয়ে লিফ্ট চাইলেন। তুলে নিয়েছি। উনি এখন গান শোনাচ্ছেন। শুনতে পাচ্ছ না? কান্ট্রি রোডস, টেক মি হোম?”
বাবা হেসে বলেছিল, “পাচ্ছি। এনজয়।”
ফোন রাখার পাঁচ মিনিটের মধ্যে ডেনভারের ‘টেক মি হোম’ গান ছাপিয়ে টায়ার ফাটার আওয়াজ হল। নব্বই কিলোমিটার বেগে ছোটা গাড়ি সামান্য কেঁপে উঠল। সাবধানে গাড়ি পাশ করল আহিরী। সন্ধে নামছে। এক পাশে ধু-ধু খেত, অন্য পাশে মাঠ। রাস্তা পেরোলে এক কোণে ছোট্ট এক চিলতে চায়ের দোকান। শীতের বেলা ফুরিয়ে গিয়েছে। চায়ের দোকানে টিমটিমে আলো জ্বলছে। গাড়ি থেকে নেমেই ঠান্ডার কনকনানি টের পেল আহিরী। পিছনের বাঁ দিকের চাকাটা গিয়েছে। ডিকি খুলল আহিরী। গাড়ির যাবতীয় মেকানিজমের মধ্যে চাকা বদল সবচেয়ে সহজ কাজ। হাতে কালি লাগে, এই যা। গুনগুন করে ‘কান্ট্রি রোড’ গাইতে গাইতে জ্যাক ঘুরিয়ে গাড়ি তুলে ফেলল আহিরী।
ঝামেলা শুরু হল এর পর। ডিকি থেকে স্টেপনি গড়িয়ে এনে গাড়িতে লাগাতে গিয়ে আহিরী বুঝতে পারল, স্টেপনি নেতিয়ে আছে। কোনও কারণে মেরামত করা স্টেপনির ফুটোফাটা গোপনে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ডিকিতে বসেই হাওয়া বের করে দিয়েছেন তিনি। দীনেশকাকা খেয়াল করেনি। আহিরী নিজেকেও দোষ দিল। এতটা পথ যাবে, বেরোনোর সময় ডিকি খুলে দেখে নেওয়া উচিত ছিল। শিক্ষা হল। কিন্তু এখন কী হবে? আশেপাশে চাকা মেরামতের কোনও দোকান চোখে পড়ছে না। শীতের অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। এতক্ষণ পর একটু নার্ভাস হল আহিরী। দুটো ফেঁসে যাওয়া চাকা নিয়ে কী করবে সে? আচ্ছা বিপদে পড়া গেল তো!
রাস্তা পেরিয়ে ঝুপড়ি চায়ের দোকানে ঢুকে পড়ল আহিরী। দোকান এখনও জমেনি। দু’জন চা খাচ্ছে। তার মধ্যে একজন কমবয়সি, অন্য জন বুড়োটে ধরনের। কম বয়সের ছেলেটির গায়ে জ্যাকেট, মাথায় টুপি। কাঁধে ব্যাগ। বোঝা যাচ্ছে, ব্যাগটা ক্যামেরার। আহিরী একটু নিশ্চিন্ত হল। এতগুলো লোক যখন আছে, একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু যা শুনল তাতে মাথায় হাত। টায়ার সারাতে হলে বড় রাস্তা ছেড়ে বেশ খানিকটা ভিতরে যেতে হবে। কী করে যেতে হবে? চাকা গড়িয়ে তো যাওয়া যাবে না। ভ্যানরিকশা ধরতে হবে। আঁতকে উঠল আহিরী। গাড়ি ফেলে চাকা নিয়ে সে কীভাবে যাবে? বাবাকে কলকাতায় ফোন করবে? প্রশ্নই ওঠে না। ভীষণ অস্থির হয়ে পড়বে। এতটা পথ আসতেই তো অনেক সময় লাগবে। এ তো আর গাড়ির মেকানিক ধরে আনার মতো সহজ ব্যাপার নয়। টায়ার সারাতেই হবে। বাবা তো টায়ার মেরামতির দোকান নিয়ে আসতে পারবে না। সবচেয়ে বড় কথা, আহিরীর হেরে যাওয়াও হবে। সমস্যা হলে সে নিজেই তার সমাধান করবে, বলে এসেছে। পিনপিনে গলায় বলেনি, জোর গলায় বলেছে। টায়ার ফেটে যাওয়ার মতো সামান্য ঘটনাতেই সেই জোর ফুড়ুৎ? একেবারে কলকাতায় এসওএস পাঠাতে হচ্ছে! যা করার নিজেকেই করতে হবে। আহিরী দোকানের ভিতরে এগিয়ে গেল।
“এখানে কাউকে পাওয়া যাবে? গাড়ির চাকা সারানোর ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করতে পারেন এমন কাউকে?”
দোকানদার বিরক্ত গলায় বললেন, “কাকে পাবেন? দেখছেন একা মানুষ, দোকান সামলাচ্ছি!”
আহিরী একটু থমকে গিয়ে বলল, “আমি পে করব... টাকা দেব।”
দোকানদার আরও বিরক্ত হয়ে বলল, “টাকা দেবেন তো কী? দোকান ফেলে আপনার চাকা মাথায় নিয়ে দৌড়োতে হবে?”
এ কেমন কথা বলার ভঙ্গি! আহিরীর রাগ হল। তার পরেও সে নরম গলায় বলল, “আপনি যাবেন কেন? কাউকে একটা খবর দিন। ওই টায়ার মেরামতের দোকানেই খবর দিন না। ওরা এসে চাকাটা নিয়ে যাবে। আপনি যদি কষ্ট করে ওদের কারও ফোন নম্বর দিতে পারেন, আমি ফোন করে রিকোয়েস্ট করব।”
দোকানদার বলল, “চাকা মেরামতের দোকান কি আমার শ্বশুরের, যে বললেই ছুটে আসবে?”
আহিরীর রাগ বেড়ে গেল। এই লোক তো অতি বদ প্রকৃতির! হাইওয়ের ধারের চায়ের দোকানগুলো সব সময় খুব ভাল হয়। মানুষের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করার জন্য এরা বিখ্যাত। পথচলতি মানু্ষের বিপদে-আপদে দোকানের মালিক, কর্মচারীরা সবার আগে এগিয়ে আসে। কিন্তু এই দোকান হাইওয়ের ধারের চায়ের দোকানের কলঙ্ক। এতক্ষণ ধরে চারপাশটা কুয়াশা-মাখা ছবির মতো সুন্দর হয়ে ছিল, নিমেষে তার ওপর যেন খানিকটা কালি পড়ে গেল।
আহিরী ঠান্ডা গলায় বলল, “এভাবে বলছেন কেন? কেউ সমস্যায় পড়ে হেল্প চাইলে আপনি এভাবে কথা বলেন?”
দোকানদার এবার বসে থাকা দু’জন খদ্দেরের দিকে তাকিয়ে বলল, “ফুর্তি করতে এসে গাড়ি বিগড়োবে, তারপর বলবে আমায় সাহায্য করুন। এই তো পরশু রাতে এক দল ছেলেমেয়ে গাড়ি ধাক্কা মেরে... সব মাল খেয়ে টাল...”
আহিরী আর নিজেকে সামলাতে পারল না। গলা তুলে চিৎকার করে উঠল।
“শাট আপ। আমি কোনও ফুর্তি করতে এখানে আসিনি। আমি একজন প্রফেসর। কল্যাণী ইউনিভার্সিটিতে একটা সেমিনার অ্যাটেন্ড করতে এসেছিলাম। আপনি কোন সাহসে আমাকে অপমান করছেন?”
দোকানদারও তেড়েফুঁড়ে বলল, “আমার দোকানে ঢুকে আপনি কোন সাহসে হুজ্জতি পাকাচ্ছেন? এখানে কি গাড়ি সারানো হয়?”
আহিরী বলল, “ভদ্রভাবে কথা বলুন। একজন মহিলার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় জানেন না? একা পেয়ে কি অবলা ভাবছেন?”
দোকানদার বাইরে হাত দেখিয়ে বলল, “যান যান, যাকে খুশি ডাকুন। এটা কলকাতা নয়।”
এবার ক্যামেরার ব্যাগ-কাঁধে যুবকটি উঠে দাঁড়াল। আহিরীর পাশে এসে গলা নামিয়ে বলল, “বাদ দিন, এদের সঙ্গে চেঁচামেচি করে সময় নষ্ট। বাইরে আসুন। আমি দেখছি কী করা যায়।”
আহিরী বুঝল, সত্যি সময় নষ্ট। সে বাইরে চলে এল। যুবকটিও একটি কথা না বলে, রাস্তা পার হল। তারপর প্রায় ম্যাজিকের মতো একটি মোটরবাইক-চালককে পাকড়েও ফেলল। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, ছেলেটি স্থানীয়। মোটরবাইকের পিছনে একটা মস্ত ঝুড়ি বাঁধা। চালকের কানের কাছে যুবকটি ফিসফিস করে কিছু বলল। ছেলেটি আহিরীর দিকে ভয়ে ভয়ে একবার তাকিয়ে ঘাড় কাত করল। রাজি হওয়ার লক্ষণ। মোটরবাইক থেকে ঝুড়ি নামিয়ে চাকা তোলা হল। যুবকটি বাইকের পিছনে বসে হুশ করে চলে গেল অচেনা চালকের কাঁধ ধরে। যাওয়ার সময় ক্যামেরার ব্যাগটা রেখে গেল গাড়িতে। মশা আর ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচতে আহিরী কাচ তুলে বসে রইল গাড়িতে। খুব বেশি হলে পঁচিশ মিনিট। মেরামত করা চাকা এনে যুবকটি বলল, “নিন, লাগিয়ে নিন। আমি গাড়ির চাকা লাগাতে জানি না।”
“না না, আপনি কেন লাগাবেন? আমি করে নিচ্ছি। আপনার কাছে টর্চ আছে? এত অন্ধকারে নাট-বল্টুগুলো দেখতে পাব না। গাড়ির আলো জ্বালালেও নয়। হাত ফসকে পড়ে গেলে মুশকিল। আজ পর পর যা ঘটছে...”
যুবকটি বলল, “দেশলাই আছে।”
“দেশলাই? ওতে কি পারব?”
একটা দেশলাইকাঠি নিভে গেলে আবার আর একটা জ্বলে উঠছে। অস্বস্তি হচ্ছে আহিরীর। যুবকটি হাতে দেশলাই নিয়ে ঝুঁকে আছে। নিশ্চয়ই তার অসুবিধে হচ্ছে। কিন্তু উপায় কী? আহিরী বারণও করতে পারছে না। মনে মনে নিজের গালে একটা চড়ও মারল আহিরী। ছি ছি। একটা টর্চও রাখেনি সঙ্গে! যেন গাড়ির চাকা শুধু দিনেই বদলাতে হয়। আজ হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে, গাড়ি চালানো মানে শুধু স্টিয়ারিং ধরা নয়। তবে চায়ের দোকানের ঝগড়াটা করে ভাল হয়েছে। নইলে এই লোককে পাওয়া যেত না। সুন্দরী তরুণীর অপমান নিশ্চয়ই মেল শভিনিজমে লেগেছে। ইস, এখনও লোকটার নাম জানা হয়নি।
কাজ শেষ হলে আহিরী হাত ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, “আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব! আমার নাম আহিরী। আমি কলেজে পড়াই।” কলেজের নাম বলল আহিরী।
“আমি বিতান।”
বিতান হাত বাড়িয়ে গাড়ি থেকে ক্যামেরার ব্যাগটা নিল। আহিরী খানিকটা গদগদ ভাব দেখিয়ে বলল, “আপনি ছবি তোলেন? ফোটোগ্রাফার?”
বিতান নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বলল, “না, ফোটোগ্রাফার নই। পিছনে একটা ঝিল আছে। এই সময়টায় মাইগ্রেটরি বার্ডস আসে। খবর পেয়ে বন্ধুর ক্যামেরা নিয়ে এসেছিলাম।”
আহিরী বলল, “বাহ্, চমৎকার তো! আপনি কোথায় যাবেন?”
বিতান বলল, “আপনি আমাকে একশো বাহাত্তর টাকা দেবেন। এমারজেন্সি বলে টায়ারের দোকানে বেশি নিয়েছে। বাইকের ছেলেটাকে একশো টাকা দিয়েছি।”
আহিরী চটপট বলল, “এ তো কোনও টাকাই নয়। আপনি না থাকলে ঝামেলা হত। আপনি কোথায় যাবেন?”
“কলকাতা।”
আহিরী খুশি হয়ে বলল, “আসুন, গাড়িতে উঠুন। আমি নামিয়ে দেব।”
বিতান বলল, “না, আমি বাসে যাব।”
এরকম সরাসরি প্রত্যাখানের জন্য আহিরী প্রস্তুত ছিল না। বোকা বোকা হেসে বলল, “কেন? বাসে যাবেন কেন? আসুন দু’জনে গল্প করতে করতে চলে যাই। ভাল লাগবে।”
বিতান ঠান্ডা গলায় বলল, “আমার গল্প করতে করতে যেতে ভাল লাগবে না। আপনি টাকাটা দিন।”
এ তো ভদ্রভাবে অপমান! আহিরী থতমত খেল। আচ্ছা ঠেঁটা লোক তো! কথা না বাড়িয়ে ব্যাগ খুলে দুটো একশো টাকার নোট বের করে দিল।
বিতান বলল, “আমার কাছে ভাঙানি নেই।”
আহিরী গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বলল, “থাক। আপনার কাছ থেকে আমার হিসেব বুঝে নিতে ভাল লাগবে না।”
ঠিক এক সপ্তাহ পরে, এক দুপুরে ক্লাস করে টিচার্স রুমে ঢুকতে যাবে আহিরী, পিয়ন এসে জানাল, একজন দেখা করতে চায়।
বিতান সাতাশ টাকা ফেরত দিতে এসেছিল। আরও এক টাকা নিয়েছে দেশলাইয়ের জন্য। আহিরী তাকে জোর করে ধরে নিয়ে যায় গড়িয়াহাটের এক নামকরা চায়ের বুটিকে। বিতান রাজি হচ্ছিল না।
আহিরী কড়া গলায় বলল, “এসেছেন ভাল করেছেন। সেদিন আমাকে অনেক অপমান করেছিলেন। উপকার তার থেকে বেশি করেছিলেন বলে কিছু বলতে পারিনি। আজ সেই জবাবগুলো দেব। কলেজে দাঁড়িয়ে তো দেওয়া যাবে না। তাই আপনাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে। চিন্তা করবেন না, কলেজের গেটে নামিয়ে দেব।”
দু’মাস পরে বিতান তাকে সে দিনের ঘটনা সম্পর্কে চারটি তথ্য দেয়। এক, সেই চায়ের দোকানের দোকানদারটির মাথায় সমস্যা আছে। সে নাকি প্রায়ই ঝামেলা করে এবং মার-টারও খায়। রাস্তায় কেতরে থাকা গাড়ি নিয়ে ঝামেলা করলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে পারে আঁচ করে সেদিন আহিরীকে দোকান থেকে বের করে নিয়েছিল বিতান। নইলে এর মধ্যে সে ঢুকত না। তার মনে হয়েছিল, খানিকক্ষণের মধ্যেই মেয়েটি আরও রেগে যাবে এবং লোকটাকে একটা চড় মারবে। দ্বিতীয় তথ্যটি হল, সেদিন স্থানীয় মোটরবাইক চালককে সে জানিয়েছিল, ওই ম্যাডামের সঙ্গে পুলিশের চেনাজানা রয়েছে। খানিক আগেই সে পুলিশ ডাকার কথাও বলেছে, তাই ওর কাজটা করে দেওয়াই বুদ্ধিমানের হবে। তিন নম্বর তথ্য, পছন্দের মানুষ ছাড়া সত্যিই বিতানের কথা বলতে ভাল লাগে না। সুন্দরী হলেও না। সেদিন আহিরীকে সে যতটা দেখেছিল তার মধ্যে পছন্দ হওয়ার মতো অনেক কিছুই ছিল। কিন্তু সেই পছন্দ গাড়িতে উঠে গল্প করতে করতে দীর্ঘ পথ যাওয়ার মতো নয়। চার নম্বর তথ্যটি বলবার আগে একটু থমকেছিল বিতান।
“আমি খুঁজে খুঁজে তোমার কলেজে কেন গিয়েছিলাম জানো?”
আহিরী মোবাইল কানে চেপে ধরে বলেছিল, “আর যাই হোক, আমার টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য যে নয় সেটা বলতে পারি।”
বিতান বলল, “দেশলাইয়ের আলোয় অতক্ষণ দেখার পর মনে হয়েছিল, একবার ফটফটে দিনের আলোয় তোমাকে দেখা দরকার। কারণ তারপর যখনই তোমার মুখটা মনে পড়ছিল, সেই মুখের এক পাশ ছিল অন্ধকার।”
আহিরী মোবাইল ফোন কানে আরও জোরে চেপে বিছানায় উপুড় হয়ে বলেছিল, “দিনের আলোয় কী দেখলে?”
“বলব না।”
এই ছিল আলাপের প্রথম ভাগ। কম কথা বলা যে যুবকটিকে আহিরী তখন চিনেছিল, সে এখন তার সঙ্গে বকবক করতে খুবই পছন্দ করে। আহিরীও অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিতান চুপ করে গেলে তার চিন্তা হয়। তার থেকেও বড় কথা, এই ছেলে জীবনকে নিয়ে যে এরকম রসিকতা করতে পারে, সেদিন গম্ভীর মুখ দেখে একেবারেই বুঝতে পারেনি আহিরী।
রাত বারোটার অল্প আগে ছেলেমেয়েরা ঘেরাও তুলে নিল।
৮
বিতানকে ডোরবেল টিপতে হল দু’বার। তার পরেও কিছু ক্ষণ দাঁড়াতে হল। কেউ দরজা খুলছে না। আবার বেল-এ হাত রাখল বিতান। ফ্ল্যাটে কি কেউ নেই?
তৃতীয় বার বেল বাজানোর আগেই এক তরুণী দরজা খুলল। চেহারা কিঞ্চিৎ ভারীর দিকে। শর্ট প্যান্টের ওপর কালো রঙের একটা স্লিভলেস জামা পরেছে। তার ফরসা শরীর অনেকটাই উন্মুক্ত। টলটলে মুখে বিরক্তি। মেয়েটির হাতে বই। পড়তে পড়তে তাকে উঠে আসতে হয়েছে।
এই তরুণীর নাম ঊর্বী। বিতানকে দেখে সে মুখের বিরক্তি মুছে এক গাল হাসল।
“ও আপনি? পড়ছিলাম বলে বেল-এর আওয়াজ শুনতে পাইনি। সরি। আসুন, ভিতরে আসুন।”
দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল ঊর্বী। বিতান ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “না না, ঠিক আছে।”
বিতানের প্রতি উর্বীর আচরণ অদ্ভুত। কোনও দিন মুখ ঘুরিয়ে নেয়, কোনও দিন এমন ভাবে উচ্ছ্বাস দেখায় যে মনে হয়, বিতানকে সে খুবই পছন্দ করে। যেদিন পছন্দের ‘ফেজ’ চলে, হড়বড় করে অনেকটা কথা বলে ফেলে। এই ছোট ফ্ল্যাটে এক চিলতে একটা বসবার জায়গা রয়েছে। ড্রয়িংরুমের মতো। বেতের সোফা, বইয়ের র্যাক, লম্বা ফুলদানি। তবে সাজানো-গোছানো কিছু নয়। দেখে মনে হয়, অনেক দিন থেকে আছে, তাই নড়াচড়া কিছু করা হয়নি। বিতান এলে এখানে বসে। যেদিন তার মুড ভাল থাকে, ঊর্বীও বসে পড়ে। আবার কখনও সে নিজের ঘরে গিয়ে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দেয়। যাবার আগে তেতো গলায় বলে যায়, “আপনার বাবা এখন বাথরুমে ঢুকেছেন, অপেক্ষা করতে হবে। আজকাল বাথরুমে ওঁর মিনিমাম দু’ঘণ্টা সময় লাগে। বেশিও লাগতে পারে।”
বিতান বলে, “তা হলে বরং পরে আসি।”
ঊর্বী কাঁধ ঝাকিয়ে বলে, “সে আপনি বুঝবেন। ইচ্ছে করলে বাথরুমের বাইরে টুল নিয়ে বসে কথা চালাতে পারেন। আর তা না চাইলে দরজা টেনে দিয়ে চলে যেতে পারেন।”
ঊর্বীর মায়ের নাম মালবিকা। মহিলা বাড়ি থাকলে ঊর্বী বিতানের সঙ্গে কথা বলে না। ওই মহিলা বাড়িতে থাকলে বিতান আসেও না। যে কয়েক বার এসেছে, মালবিকা হয় সামনেই আসেননি, নয়তো “চা খাবে? খাবে না? আচ্ছা বোসো, তোমার বাবা আসছে।” বলে নিজের কাজে বেরিয়ে গিয়েছেন। উনি বিতানকে যে পছন্দ করেন না, সেটা হাবেভাবে স্পষ্ট করে রেখেছেন। সরাসরি কিছু বলেন না এই যা। এর মধ্যে বিতান কোনও অস্বাভাবিকতা দেখতে পায় না। স্বামীর প্রথম পক্ষের সন্তানকে পছন্দ করবার কোনও দায় এই মহিলার নেই।
মায়ের আড়ালে ঊর্বী মিটিমিটি হেসে বলে, “মা আপনাকে কেন পছন্দ করে না বলতে পারবেন?”
প্রশ্ন অস্বস্তিকর, উত্তর দেওয়া আরও অস্বস্তিকর। ঊর্বীর মতো তরল মনের মেয়ের পক্ষেই এই ধরনের প্রশ্ন করা সম্ভব। আর কেউ পারত না।
বিতান বলে, “ঠিক জানি না। মনে হয় পছন্দ করার কোনও কারণ নেই।”
ঊর্বী বলল, “আসলে আপনাকে দেখলে মা’র মনে পড়ে যায়, তার স্বামীর অনেক বয়স। আপনি যদি ছোট ছেলে হতেন, মা’র এতটা সমস্যা হত না। আপনার ওপর ছড়িও ঘোরাতে পারত। আমার মা ছড়ি ঘোরাতে পছন্দ করে। কিন্তু আমার ওপর পারে না। আপনার বাবার ওপর ঘোরায়।” কথা শেষ করে ঊর্বী হিহি আওয়াজ করে হাসে।
বিতান জানে, এই যুক্তি ভুল। ঊর্বীর মা বিয়ের সময়েই জানতেন, তিনি যাঁকে বিয়ে করতে চলেছেন, তাঁর একটি ছেলে আছে এবং সে বয়সে যথেষ্ট বড়।
ঊর্বী হাই তুলে বলে, “তবে আমিও ঠিক করেছি আমার থেকে বয়সে অনেকটা বড় কাউকে বিয়ে করব। বয়সে বড় হলে বরেরা কেয়ারিং হয়। বউদের বেশি ভালবাসে। বউয়ের কথা শোনে।”
বিতান চুপ করে থাকে। সামাজিকতার নিয়ম অনুযায়ী এই ফাজিল চরিত্রের মেয়েটি তার বোন। কিন্তু কখনও সে ‘দাদা’ ডাকে না, ‘আপনি’ সম্বোধন থেকেও সরে না। বিতান মেয়েটির এই আচরণ পছন্দ করে। কোনও ভনিতা নেই। এত কম বয়সেও তার মতামত স্পষ্ট।
ছোটবেলায় মায়ের মৃত্যুর পর বিতান কলকাতার বাইরে হস্টেলে থেকে লেখাপড়া করেছে। কলেজে পড়ার সময় সে আবার কলকাতায় ফেরে। এই ফ্ল্যাটে ক’দিন থাকার পরপরই বাবা ছোটখাটো একটা লেকচার দিলেন।
“পড়াশোনার জন্য বাড়ি নয়, বোর্ডিং হস্টেলই প্রপার জায়গা। সেখানে সবাই লেখাপড়ার মধ্যে থাকে, বন্ধুদের সাহায্য পাওয়া যায়। বাড়িতে থাকা মানে অনেক পিছুটান। এই জন্যই গুরুগৃহে গিয়ে শিক্ষা গ্রহণের প্রথা চালু ছিল। সেই সময়ের মানুষ তো আর বোকা ছিল না। তুমি কী বলো, ছিল?”
বিতান অস্ফুট স্বরে বলেছিল, “না, ছিল না।”
“তা হলে তুমিও হস্টেলে গিয়ে থাকো। খরচাপাতি যা লাগে খানিকটা আমার কাছ থেকে নেবে, খানিকটা টিউশন, পার্টটাইম কাজ করে উপার্জন করবে। এতে সাবলম্বী হবে। মনে রাখবে, নিজের পায়ে দাঁড়ানোটাই জীবনে আসল কথা। মানুষ ছাড়া জীবজগতের কেউ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না। কী, তাই তো?”
বিতান মাথা নেড়ে বলেছিল, “হ্যাঁ, তাই।”
“তা হলে ব্যবস্থা করে ফেলো। কলেজে পড়া শেষ হলে বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে আবার নিজের বাড়িতে ফিরে আসবে।”
বাবার উপদেশ মতো বিডন স্ট্রিটের হস্টেলে সিট নিল বিতান। তবে কলেজ শেষ করেও আর বাড়িতে ফেরা হয়নি। তত দিনে বাবা আবার বিয়ে করে ফেলেছেন। তাঁর পরিকল্পনার মধ্যেই ছিল, ছেলেকে দূরে সরিয়ে দিতে হবে। হয়তো মালবিকাই বলেছিলেন। এত বড় ছেলেকে নিয়ে তিনি নতুন সংসার বানাতে চাননি। কেনই বা চাইবেন?
সেই থেকে বিতান কখনও ভাড়া বাড়ি, কখনও মেসে থেকেছে। কিছু দিনের জন্য একটা প্রেসে সুপারভাইজারের কাজ করেছিল। তখন প্রেসেই রাত কাটিয়েছে। সকালে সেখানে স্নান-টান সেরে বেরিয়ে পড়ত। সারা দিন কলকাতা শহরে চক্কর দিয়ে আবার সন্ধের পর ঢুকে পড়ত। চক্কর কাটার জন্য কলকাতার মতো শহর ভূভারতে নেই। যে কোনও পথেই কত ঘটনা, কত গল্প!
বিতান এখন আছে বাইপাসের ধারে, বন্ধুর ফ্ল্যাটে। আট তলার ওপর দুর্দান্ত ফ্ল্যাট। জানলা খুললেই চকচকে বাইপাস দু’দিকে হাত বাড়িয়ে চিত হয়ে শুয়ে রয়েছে। হু হু করে গাড়ি, বাস ছুটছে। রাতে দূরের ফ্লাইওভারে মালার মতো জ্বলে ওঠে আলো। মনে হয়, শহরটা ভাসছে। বিতান বুঝতে পারে, এখানে না এলে কলকাতা শহরের একটা রূপ দেখা বাকি থেকে যেত। চকচকে, ব্যস্ত একটা নতুন কলকাতা। সে মনে মনে অনুভবকে ধন্যবাদ দেয়। মুখে দিতে গেলে যে গালাগালি শুনতে হবে! দু’-একবার বলতে গিয়ে শুনতে হয়েছে।
বিতানের এই ফ্ল্যাট পাওয়ার ঘটনাটাও একটা গল্পের মতো।
আসানসোলের ছেলে অনুভব বিতানের বন্ধু। স্কুল কলেজ দু’জায়গাতেই একসঙ্গে পড়েছে। একসঙ্গে স্কুল বোর্ডিং-এ থেকেছে। কলেজে পড়ার সময় অনুভব কলকাতায় থাকতে গিয়ে সমস্যায় পড়ল। টালিগঞ্জে যে দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে থাকত, তারা এক দিন দু্ম করে প্রোমোটারের কাছে বাড়িটা বেচে দিল। নিজেরা মাথা গোঁজার ঠাঁই করলেও, সেখানে তো বাইরের লোককে নিয়ে যাওয়া যায় না। ফলে রাতারাতি জলে পড়ল অনুভব। এদিকে কলেজে সেশন শুরু হয়ে গিয়েছে। কোনও হস্টেলে আর সিট ফাঁকা নেই। কলকাতা শহর দেখতেই এমন, বাড়ি আর বাড়ি। বাইরে থেকে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীদের থাকার জায়গা পাওয়া খুব সহজ নয়। পিজি থাকতে হলে অনেক খরচ। ছাত্রদের পক্ষে সেই টাকাপয়সা জোগাড় করা কঠিন। অনুভব হন্যে হয়ে কম পয়সায় থাকার জায়গা খুঁজতে লাগল। বিতানের হস্টেলেও গেল। সিট নেই। বিতান বলল, “দাঁড়া, সুপারের পায়ে পড়ে যাই।” সত্যি সত্যি সুপারের প্রায় হাতে পায়ে ধরে অনুভবকে নিজের ঘরে নিয়ে এসে রাখল বিতান। তবে আর একটা খাট ঢোকাতে পারল না। সুপার বললেন, “নিয়ম ভেঙে মানুষ পর্যন্ত অ্যালাও করেছি। খাট অ্যালাও করতে পারব না। মানবিকতা দেখাতে পারব, খাটবিকতা দেখাতে পারব না। প্রিসিডেন্স হয়ে যাবে। এর পর যে পারবে সে-ই বন্ধুর জন্য ঘরে খাট ঢোকাবে।”
কী আর করা যাবে? তিন মাস খাটে আর মেঝেতে ভাগ করে শুয়েছে দু’জনে। সেই সময় অনুভব বিতানের বাড়ির কথা কিছু কিছু জেনেছিল। তিন মাস পর অনুভবের বাবা ছেলের এই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ছেলের জন্য কসবার কাছে একটা ছোট ফ্ল্যাট কিনে ফেললেন। অনুভব সেখানে উঠে গেল। বিতানকেও টানাহেঁচড়া করেছিল। হস্টেল ছেড়ে ওর সঙ্গে গিয়ে থাকতে হবে। বিতান হেসে বলেছিল, “এখন নয়। এখন তো থাকার একটা জায়গা আছে। ভবিষ্যতে মনে হচ্ছে থাকবে না, সেই সময়ের জন্য তুলে রাখ। মনে থাকবে?”
অনুভব বলেছিল, “না। ভুলে যাব।”
বিতানের আশঙ্কার কারণ ছিল। তত দিনে বিতান তার বাবা পরিমল মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে কিছু কিছু খবর কানাঘুষোয় শুনতে পাচ্ছে। এক মহিলা নাকি তাদের কাঁকুড়গাছির সরকারি ফ্ল্যাটে নিয়মিত আসাযাওয়া করে। সঙ্গে একটি ছোট মেয়েও আসে। কখনও শোনা যাচ্ছে, মহিলার স্বামী মারা গিয়েছে, কখনও শোনা যাচ্ছে, ডিভোর্সের মামলা চলছে। বিতান এই সব তথ্যের সত্যমিথ্যে নিয়ে চিন্তিত ছিল না। তার জানার ইচ্ছেও ছিল না। সে শুধু বুঝতে পারছিল, তার নিজের বাড়িতে যাওয়ার দিন শেষ। এই মহিলা যে-কোনও দিন বলে বসবে, “বাসে অটোয় যাতায়াত আর পোষাচ্ছে না। এখানেই পাকাপাকি থাকব।”
তা-ই ঘটল। বাবা একদিন ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানাল, “বিয়ে করেছি। ফ্ল্যাটটা তো ছোট, বুঝতেই পারছিস। ওর আবার একটা স্কুলে-পড়া মেয়ে আছে... একটা বড় ফ্ল্যাট খুঁজছি... তত দিন...”
বিতান বলেছিল, “তুমি চিন্তা কোরো না বাবা। আমি ঠিক থাকার জায়গা পেয়ে যাব।”
কলেজ শেষ হল, হস্টেলে থাকাও চুকল। এখানে ওখানে ঘুরে ঘুরে থাকার প্রক্রিয়া চলতে লাগল। এরই মাঝখানে একদিন অনুভবের ফোন। এখুনি তার সেক্টর ফাইভের অফিসে দেখা করতে হবে। বিতান গেলে অনুভব বলল, “নতুন কাজ নিয়ে পুণেতে চললাম। শোন, আমি কসবার ফ্ল্যাট বেচে বাইপাসের ওপর একটা ফ্ল্যাট নিয়েছি। আটতলায় চমৎকার ফ্ল্যাট। খরচ করে সাজিয়েছি। তুই তো এখন হোমলেস। ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়াস। আমি ঠিক করেছি, তুই আমার ওই ফ্ল্যাটের পাহারাদার হবি। অন্য কারও হাতে ছাড়ব না, নষ্ট করে দেবে।”
“তালা বন্ধ করে রাখ।”
অনুভব বলল, “পোড়ো বাড়ির মতো পোড়ো ফ্ল্যাট হয়ে যাবে।”
“আত্মীয় কাউকে এসে থাকতে বল।”
“দখল হয়ে যাবে। বাজে না বকে বল, কত স্যালারি নিবি?”
বিতান বলল, “যদি রাজি না হই?”
অনুভব বলল, “তোর ঘাড় রাজি হবে।”
তারপর থেকে বিতানের ঠিকানা বাইপাসের আট তলায়। সত্যিই দারুণ ফ্ল্যাট। শুধু ফ্ল্যাট নয়, ফ্ল্যাটের সঙ্গে ফ্রিজ, টিভি, এসি, গিজার এমনকী নিজের ক্যামেরাটাও রেখে গিয়েছে অনুভব। বলে গিয়েছে, “প্রতিটা জিনিস ব্যবহার করবি শালা। এসে যদি দেখি কোনও কিছুতে জং ধরেছে, তোমার কপালে দুঃখ আছে।”
বিতান বলল, “খেপেছিস? অত ইলেকট্রিক বিল দেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে নাকি?”
অনুভব বলেছে, “তোমাকে কে বিল দিতে বলেছে হারামজাদা? ইলেকট্রিসিটি, মেনটেনেন্স, কেব্ল, সব ইসিএস-এ পে করব। তুই বেটা ভিখিরি, ভিখিরির মতো সব ফ্রিতে ভোগ করবি।”
ঊর্বী সরে দাঁড়াতে বিতান ভিতরে ঢুকল। যতই এই বাড়িতে বড় হোক, বছরের পর বছর কাটাক, যতই বাল্য আর কৈশোরের অজস্র স্মৃতি থাক, এখানে বিতানের আসতে ইচ্ছে করে না। অনেক বছর তো আসেওনি। পরিমল মুখোপাধ্যায় অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভরতি হলে মালবিকা খাতা ঘেঁটে নম্বর জোগাড় করে খবর দিলেন।
“তোমাকে তোমার বাবা দেখতে চাইছেন। পারলে একবার হাসপাতালে এসো। যে-কোনও সময় একটা অঘটন কিছু ঘটে যেতে পারে।”
‘অঘটন’ ঘটল না। তবে প্যারালিসিসে ভদ্রলোকের ডান দিকটা পড়ে গেল। এবার ছেলেকে বাড়িতে ডেকে পাঠালেন। বিতান গিয়ে দেখল, মানুষটা কেমন যেন মিইয়ে গিয়েছে। সেই দাপট নেই, অসহায়। বিতানকে কেমন যেন আঁকড়ে ধরছেন। এখন তিন-চার মাস অন্তর মাঝে মাঝেই মোবাইলে ফোন করেন, “একবার আসিস।”
বিতান বলে, “কোনও দরকার আছে? ফোনে বললে হয় না?”
পরিমল মুখোপাধ্যায় বলেন, “হয়তো হয়, তার পরেও আসিস একবার সময় পেলে। শরীরটা ভাল ঠেকছে না। এলে সকাল এগারোটার পর আসবি। ওই সময়টা ঊর্বীর মা অফিসে যায়। ঊর্বীও কলেজে বেরিয়ে যায়, বাড়িতে থাকে না।”
প্রথম দিকে বিছানায় শোয়া অবস্থাতেই ছেলের সঙ্গে কথা বলতেন। এখন ফিজিয়োথেরাপি করে অবস্থার খানিকটা উন্নতি হয়েছে। লাঠি নিয়ে পা টেনে টেনে বসার জায়গায় আসেন। কথা কিছুই বলেন না। চুপ করে থাকেন। বিতান অধৈর্য হয়ে বলে, “বাবা, কিছু বলবে?”
“না তেমন কিছু নয়। চাকরিবাকরি পেলি?”
বিতান বলে, “ছোটখাটো কাজ করি।”
এত বড় ছেলে ছোটখাটো কাজ করছে শুনে কোনও বাবারই খুশি হওয়ার কথা নয়, তার পরেও পরিমল মুখোপাধ্যায় বলেন, “গুড। ছোট থেকে বড় হওয়াই ভাল। তোর মা-ও এক সময় আমাকে এই কথা বলত। কাজের জায়গায় বেশি লাফালাফি কোরো না।”
আবার কিছুক্ষণের জন্য মানু্ষটা চুপ করে যায়। এক সময়ে বিতান বলে, “উঠলাম।”
পরিমল মুখোপাধ্যায় বলেন, “অবশ্যই উঠবি। ইয়ং ছেলে ঘরে বসে থাকা মানে সময় নষ্ট। তারা যত বাইরে থাকবে দুটো পয়সা উপার্জন করতে পারবে। তোর মা বলত, ঘরে বসা পুরুষমানুষের ভাগ্যও ঘরে বসা হয়। অ্যাই শোন, তোর কাছে শ’তিনেক টাকা হবে? আপাতত দুশো হলেও চলবে। অসুখের পর থেকে ঊর্বীর মায়ের কাছে এখন টাকাপয়সা, এটিএম কার্ড, সব থাকে। সব সময়ে চাইতে পারি না। চিন্তা করিস না, নেক্সট দিন যখন আসবি ফেরত পাবি।”
বিতান কখনও দু্শো, কখনও তিনশো টাকা দিয়ে উঠে আসে। টাকা ফেরতের কোনও প্রশ্ন ওঠে না। বিতান তার বাবাকে এই টাকা কেন দেয় সে নিজেও ঠিক জানে না। আবার হয়তো জানেও। মানুষটার চাওয়ার ভঙ্গি কিছু একটা দাবির মতো। যেন তার অধিকার আছে। ভাবটা এমন, যেন তিনি তাঁর একমাত্র সন্তানের সঙ্গে এমন কোনও অন্যায় কখনও করেননি যা করা যায় না। যদি ‘বাবা–বাছা’ বা ‘সেই সময় ওইটুকু বয়েসে তোকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে বড় অন্যায় করে ফেলেছিলাম’ ধরনের কোনও আচরণ দেখাতেন, তা হলে হয়তো এক-দু’বারের পর অনায়াসে সরে আসতে পারত বিতান। তা হয়নি।
তবে আজ বাবা নয়, ঊর্বির মা তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। মালবিকা মুখোপাধ্যায়। বিতান ভেবেছিল আসবে না। তার পরেও এসেছে। মহিলা বলেছিলেন, “অবশ্যই আসবে। তোমার বাবার ব্যাপারে আমি একটা ফাইনাল সেটলমেন্টে যেতে চাই।” বাবার সঙ্গে এই মহিলার ফাইনাল সেটলমেন্ট কী হবে, বিতানের জানার আগ্রহ নেই। সে কাঁকুড়গাছির এই ফ্ল্যাটে আসা একেবারের মতো শেষ করতে চায়।
ঘরে ঢুকে বিতান বলল, “তোমার মা কোথায়?”
ঊর্বী বলল, “ডাক্তারের কাছে গেছে। আপনি এলে বসতে বলেছে। চা খাবেন?”
বিতান বলল, “না।”
ঊর্বী ঘাড় কাত করে বলল, “না বলে ভাল করলেন। হ্যাঁ বললে বিরক্ত হতাম। আমার চা করতে একদম ভাল লাগে না। আপনার বাবাকে ডেকে দিতে হবে?”
বিতান বলল, “না। আমি ওর কাছে আসিনি।”
ঊর্বী বলল, “এবারও না বলায় খুশি হলাম।” তারপর মুচকি হেসে বলল, “আপনার পিতা এখন নিদ্রায় মগ্ন। দিনের বেশির ভাগ সময়টাতেই উনি আজকাল নিদ্রার মধ্যে থাকেন। কেউ ঘুম ভাঙালে বিশ্রী ভাষায় গালমন্দ করেন। আমাকে সবচেয়ে বেশি করেন। একদিন আমাকে বললেন, অ্যাই নচ্ছার মেয়ে, আমাকে ঘুম থেকে তুললি কেন? থাবড়া দিয়ে তোর দাঁত ফেলে দেব। আমি বললাম, আপনার দাঁতের অবস্থাই তো খুব খারাপ। আপনি কী করে অন্যের দাঁত ফেলবেন? উনি তেড়েমেড়ে বললেন, চুপ কর নষ্ট মেয়ে। তোর মা নষ্ট, তুইও নষ্ট। আমি হেসে বললাম, আপনি নষ্ট মেয়েকে বিয়ে করতে গেলেন কেন? তখন আর এক চোট গাল দিলেন। অতএব আমি তাঁকে নিদ্রা থেকে তুলে গালাগালি শুনতে রাজি নই। আপনি যদি চান ভিতরে গিয়ে কথা বলতে পারেন।”
বিতানের এসব শুনতে খুব খারাপ লাগল। বাবার কি মাথাটাও খারাপ হয়ে যাচ্ছে? সে বিড়বিড় করে বলল, “না, কথা বলতে চাই না।”
ঊর্বী হেসে বলল, “গুড। তা হলে বসে পড়ুন।”
সোফায় বসল বিতান। বেতের এই সোফা তার ছেলেবেলার। একটু মেরামত হয়েছে, গদি, কভার বদলেছে। এক সময়ে এখানে সে কত বসেছে! কত দাপাদাপি করেছে! তার জন্য বকাবকিও শুনতে হয়েছে। তার পরেও এখন এ বাড়ির সবই বিতানের অচেনা ঠেকে। চেনা–অচেনা লাগাটা আসলে মনের উপর নির্ভর করে। মস্তিস্ক অনেক সময় চেনা অংশগুলোকে মুছে অচেনা করে দেওয়ার খেলা খেলতে ভালবাসে।
ঊর্বী বই হাতে উলটোদিকের সোফায় ধপ করে বসে পড়ল। সে আজ কথা বলার মুডে আছে।
বিতান বলল, “তুমি পড়তে যাও।”
ঊর্বী পায়ের উপর পা তুলে গুছিয়ে বসল। তারপর মুখ ভেটকে বলল, “সে তো যেতেই হবে। জানেন, আমার লেখাপড়া করতে একদম ভাল লাগে না। কিন্তু পড়তে হবে। একটাই বাঁচোয়া, কলেজের এগজাম দু’দিন পিছিয়েছে। নইলে ডাহা ফেল করতাম। আমাদের কলেজে সেদিন রাত পর্যন্ত ঘেরাও হয়েছিল। টিচার-ইন-চার্জ, টিচার সবাই। কাউকে ছাড়া হয়নি। ভাগ্যিস হয়েছিল! আমিও ঘেরাওয়ে ছিলাম। সেই কারণে এগজাম পিছিয়েছে।”
কলেজ ঘেরাও শুনে বিতান ভুরু কোঁচকাল। কলেজের নাম জিজ্ঞেস করবে? থাক, কী হবে জেনে? ঊর্বী হাসছে। বলল, “আপনাকে একটা কথা বললে মজা পাবেন।”
বিতান বলল, “কী কথা?”
ঊর্বী ঝুঁকে পড়ে গলা নামিয়ে বলল, “জানেন, আমি নানান রকম কায়দায় টুকতে পারি। কেউ ধরতে পারবে না। ধরা পড়ার সময় পট করে এমন সমস্ত জায়গায় কাগজ লুকিয়ে ফেলি যে কেউ বার করতে পারবে না। বার করতে গেলেই কেস খেয়ে যাবে।” কথাটা বলে হিহি আওয়াজ করে হাসল। তারপর বলল, “এখন অবশ্য টেকনোলজির হেল্প নিই। হোয়াটসঅ্যাপে মেটিরিয়াল লিখে নিয়ে যাই। ওড়নার তলায় মোবাইল রেখে টুকি। টেকনিকটা ভাল না?”
একটা অন্যায় কাজের কথা যে কেউ এমন গর্বের সঙ্গে বলতে পারে বিতানের জানা ছিল না। সে চুপ করে রইল। ঊর্বী পা নামিয়ে ঠোঁট উলটে বলল, “লাস্ট দিন ধরা পড়ে গেলাম। আহিরী রায় বলে আমাদের একজন সুন্দরী ম্যাডাম আছেন। শুধু দেখতে সুন্দর নয়, খুব বুদ্ধি। পাশে এসে আমাকে বললেন, ওড়নার নীচ থেকে মোবাইলটা বার করে দিয়ে দাও। আমি তো পুরো বোমকে গেছি। যাহ্ শালা, বুঝল কী করে!”
বিতান চমকে উঠল। ঊর্বী আহিরীদের কলেজে পড়ে? কই, সে তো জানত না! অবশ্য জানার কথাও নয়। ঊর্বীর সঙ্গে লেখাপড়া নিয়ে কোনও দিন আলোচনা হয়নি।
বিতানের মুখ থেকে বেরিয়ে এল, “তারপর?”
ঊর্বী চোখ বড় বড় করে বলল, “কী আর হবে? আমি তো ভাবলাম খাতা ক্যানসেল করে দেবেন, নইলে বলবেন, গেট আউট। বাইরে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকো। ম্যাডাম যেমন বন্ধুর মতো ব্যবহার করেন, তেমনই আবার খুব রাগীও। আমি তো ভেবলে গেছি। আজ কেলো হল।”
বিতান স্থির চোখে তাকিয়ে বলল, “উনি কী করলেন?”
ঊর্বী কৌতুকের হাসি হেসে বলল, “ম্যাডাম সেসব কিছু করলেন না। শুধু আমার মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললেন, দু’দিন পরে পাবে। বুঝুন কাণ্ড। মোবাইল নেই মানে আমার ফেসবুক চ্যাট, গান শোনা, মুভি দেখা— সব ভোগে।” কথা থামিয়ে হাসতে লাগল ঊর্বী।
এই বাড়িতে বসে কোনও কিছুতে মজা পাওয়া অসম্ভব। তার পরেও বিতান মজা পাচ্ছে। আহিরীর গল্প শুনছে বলেই পাচ্ছে।
“তোমাদের ম্যাডাম ফোন নিয়ে নিল?”
ঊর্বী চোখ বড় করে বলল, “অবশ্যই নিয়ে নিল। কিন্তু এগেন থ্যাঙ্কস টু ঘেরাও। ঘেরাও চলতে চলতে রাত হয়ে গেল। আমিও গিয়ে ম্যাডামকে পাকড়াও করলাম। বললাম, রাত হয়ে গেছে, বাড়িতে খবর দিতে পারছি না। মোবাইলটা ফেরত দিন প্লিজ। উনি দিয়ে দিলেন। ম্যাডাম খুব সুইট না? ফোন কেড়ে নেওয়ার জন্য ম্যাডামের ওপর যতটা ফায়ার হয়ে গিয়েছিলাম, সব ওয়াটার হয়ে গেল।”
কথা শেষ করে ঊর্বী ঠোঁট সরু করে কৌতুকভরা মুখে বিতানের দিকে তাকিয়ে রইল। বিতান অস্বস্তিতে মুখ সরিয়ে বলল, “তোমার মাকে একটা ফোন করে দেখো তো কত দেরি হবে। আমার তাড়া আছে।”
ঊর্বী এই কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল, “ও, আর একটা কথা। আপনাকে বলব ভেবে রেখেছিলাম। কয়েক দিন আগে, গড়িয়াহাটে আপনার সঙ্গে মুখোমুখি হয়েও না চেনার ভান করেছিলাম। এর জন্য স্যরি। বাট আমার কিছু করার ছিল না।”
ঊর্বী কোন দিনের কথা বলছে বিতান মনে করতে পারল না। বলল, “আমার খেয়াল নেই।”
ঊর্বী বলল, “আপনার খেয়াল না থাকতে পারে, আমার খেয়াল আছে। সেদিন কেন মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম জানেন?”
বিতানের আর ভাল লাগছে না। সে বলল, “আমি এসব জানতে চাই না। তুমি মাকে ফোন করো, নইলে আমি চলে যাব।”
ঊর্বী বলল, “সে আপনার ব্যাপার। ইচ্ছে হলে চলে যাবেন। কথাটা শুনে যান। সেদিন সঙ্গে বন্ধুরা ছিল। আপনার সঙ্গে কথা বললে আপনার পরিচয় বলতে হত। কী বলতাম? দাদা? ওরা বলত, কেমন দাদা? মাসতুতো না মামাতো? তখন পড়তাম বিপদে। নিজের দাদা বললে তো আকাশ থেকে পড়ত। বিশ্বাসই করত না। বলত, হাউ ফানি! তোর যে দাদা আছে বলিসনি তো কখনও! তোর থেকে এত বড়! এসব কথার মধ্যে যাওয়ার থেকে না চেনাই ভাল। তাই না?”
বিতান ঠিক করে ফেলল এবার সে উঠে পড়বে। এর মধ্যেই একটা ঘটনা ঘটল।
ঊর্বী দ্রুত হাতে মোবাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে বলল, “এই যে, এই যে দেখুন আহিরী ম্যাডামের ছবি। দেখুন কী স্মার্ট দেখতে! আমি অবশ্য দূর থেকে তুলেছি। মাস তিনেক আগের ফোটো।”
ঊর্বী ঘুরে এসে এক রকম জোর করে বিতানের সোফার পিছনে এসে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা বিতানের চোখের সামনে ধরল। তারপর স্ক্রিনে আঙুল দিয়ে দ্রুত ফোটোটাকে বড় করে ফেলল। বিতান স্তম্ভিত হয়ে ছবিটা দেখল।
কলেজের গেটের সামনে বিতান আহিরীর গাড়ি থেকে নামছে। জানলা থেকে ঝুঁকে আহিরী হাসিমুখে হাত নাড়ছে। গাড়ির মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, সে এবার কলেজে ঢুকবে।
মাথাটা ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠল বিতানের। ঊর্বী ততক্ষণে উলটো দিকে চলে গেছে। হাসতে হাসতে বলল, “এই ছবি সেদিন ম্যাডাম যদি মোবাইল ঘেঁটে দেখে ফেলত? বিরাট কেলো হত।”
বিতান একটু চুপ করে রইল। গম্ভীর গলায় বলল, “ঊর্বী, তোমার ওই ম্যাডামের সঙ্গে আমার খানিকটা আলাপ আছে। উনি সেদিন আমাকে তাঁর গাড়িতে লিফ্ট দিয়েছিলেন। এইভাবে লুকিয়ে ওঁর ছবি তোলাটা তোমার উচিত হয়নি। এটা অন্যায়।”
ঊর্বী চোখ বড় করে বলল, “আমি তো ওঁর ফোটো তুলিনি! সম্পর্কে আমার আত্মীয় হয় এমন একজনের ফোটো তুলেছি। যেই দেখতে পেয়েছি, মোবাইল তুলে খচ।” হাত তুলে ফোটো তোলার ভঙ্গি দেখাল ঊর্বী। তারপর বলল, “ভেবেছিলাম একদিন ওঁকে ফোটোটা দেখিয়ে চমকে দেব। এটা অন্যায় হবে কেন?”
বিতান কী বলবে বুঝতে পারছে না। নিজের উপর রাগ হচ্ছে। প্রথম দিন বাদ দিলে গত এক বছরে সব মিলিয়ে সে দু’দিন আহিরীর কলেজে গিয়েছে। তাও কলেজের ভিতরে নয়, গেটের কাছে। এখন মনে হচ্ছে, সেটাও ঠিক হয়নি।
বিতান বলল, “তুমি তো শুধু আমার ফোটো তোলোনি, তোমার টিচারের ফোটোও তুলেছ।”
ঊর্বী গালের ভিতর ঠোঁট ঘুরিয়ে বলল, “আর এক দিনের ফোটোও আছে। সেটা গড়িয়াহাটে... এই যে... আপনি আর ম্যাডাম রেস্টুরেন্টে ঢুকছেন।”
এবার দূর থেকেই মোবাইল দেখাল ঊর্বী। হাতটা শুধু বাড়িয়ে দিল। বিতান ছবিটা স্পষ্ট দেখতে পেল না। ঊর্বী বলল, “ওই দিনের কথাই তো বলছিলাম। আপনাকে দেখেও না দেখার ভান করে আড়ালে সরে গিয়েছিলাম। তার আগে কিন্তু ফোটো তোলা হয়ে গেছে। আমার মোবাইলে পিক্সেল হেভি। ছবি তুলতে যে আমার কী ভাল লাগে!”
কথা শেষ করে ঊর্বী আবার হেসে উঠল। বিতানের মনে হল, তার মাথা কাজ করছে না। এই মেয়ে কি আহিরীকে কোনও ভাবে ব্ল্যাকমেল করার কথা ভাবছে? বিতানের মতো একজন ‘কিছু নয়’ ছেলের সঙ্গে সম্পর্কের কথা জানাজানি হয়ে পড়লে সেটা আহিরীর জন্য যথেষ্ট লজ্জার হবে।
ডোরবেল বেজে উঠল।
৯
চা তো এসেছেই, সঙ্গে বিস্কুটও এসেছে। তার পরেও মালবিকা বললেন, “কিছু খাবে? একটা ওমলেট করে দিই?”
বিতান বলল, “না। আমি খেয়ে এসেছি।”
বিতান শুধু চা নিল। প্রথম যখন এসেছিল, তখন প্রতিজ্ঞা করেছিল, এ বাড়িতে জলস্পর্শ করবে না। পরে মনে হয়েছিল, এসব ছেলেমানুষি। কার উপর রাগ-অভিমান? বাবার উপর? উনি তো অন্যায় কিছু করেননি। ঠিক করেছেন। বিয়ে না করলে বাকি জীবনটা একা থাকতে হত। তা হলে অভিমান কীসের? জীবন তৈরির টালমাটাল সময়ে তাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল বলে? হয়তো তাই। যে সময়ে বাবা-মা ছেলেমেয়ের পাশে থাকে, সেই সময় পরিমল মুখোপাধ্যায় তাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। একবারও তার কথা ভাবেননি। এ নিয়ে অভিমান তো তার ছিলই। কিন্তু অভিমানও একটা বয়স পর্যন্ত বহন করা যায়, তারপর ভুলে যেতে হয়। বিতান এ বাড়ি সম্পর্কে এখন নিস্পৃহ। ঊর্বীর মোবাইলের ছবিগুলো তাকে নতুন করে চিন্তায় ফেলেছে শুধু।
মালবিকার গলা আজ নরম। বললেন, “তোমার বাবার অবস্থা তো দেখছ, একেবারে শুয়ে পড়েছে।”
বিতান বলল, “শরীর কি আরও খারাপ হয়েছে?”
মালবিকা বললেন, “সে আর নতুন কী? রোজই একটু একটু করে বেশি খারাপ হচ্ছে। আজকাল তো বেশির ভাগ সময় ঘুমিয়েই থাকেন। তবে সমস্যা সেটা নয়। সমস্যা অন্য। সে জন্যই তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি। আমি বুঝতে পারছি, তোমার বাবা আর আমাদের সঙ্গে থাকতে চাইছেন না। চোখের সামনে আমাদের দেখলে বিরক্ত হচ্ছেন।”
বিতান অবাক হয়ে বলল, “মানে!”
মালবিকার বয়স পঞ্চাশ হতে এখনও বছর চার দেরি আছে। আগে বলা হত মেয়েরা কুড়িতে বুড়ি। সেই ধারণা বহু দিন খারিজ হয়ে গিয়েছে। এখন পঞ্চাশেও মহিলারা নিজেদের শরীর এবং মনে ফিটফাট থাকতে পারেন। মেয়েরা যত কাজের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, বয়সের ভার তত হালকা করতে পারছে। মালবিকাকে কিন্তু বেশ বুড়োটে লাগছে। চাকরি আর সংসারের ক্লান্তি চোখেমুখে।
মালবিকা বিরক্ত গলায় বললেন, “মানে আমি কী করে বলব বিতান? তোমার বাবা বলতে পারবে। হয়তো বড় অসুখে তার বোধোদয় হয়েছে। এখন ওঁর মনে হচ্ছে, যা করেছিলেন সেটা ঠিক হয়নি।”
বিতান চুপ করে রইল। এরকম একটা কথা বলার জন্য মহিলা তাকে ডেকে পাঠাবেন, সে ভাবতে পারেনি। এর জবাবই বা সে কী দেবে?
মালবিকা বললেন, “আমার মেয়েকে গোড়া থেকেই উনি সহ্য করতে পারেন না। শুধু আমার জন্য মেনে নিয়েছিলেন। এখন দেখলেই তেড়ে উঠছেন। খারাপ কথা বলছেন। আমার মেয়ে কেন এসব টলারেট করবে? আমারও কোনও কিছু এখন তাঁর পছন্দ হয় না। আমিও মেজাজ হারাচ্ছি। সারা দিন অফিস, ঘরের কাজ করতে হয়। আমি কেন ওঁর গালমন্দ শুনব? এমন তো নয় যে আমি তাঁর খাই-পরি, তাঁর বাড়িতে থাকি। এই ফ্ল্যাটটাও তো এখন ওঁর নয়। আমি অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নাম ট্রান্সফার করেছি। সরকারি খাতায় এই ফ্ল্যাট এখন আমার নামে দেখানো আছে।”
বিতান মহিলাকে মনে মনে তারিফ করল। খুব উদ্যোগী তো!
মালবিকা একটু চুপ করে থেকে বললেন, “তোমার বাবা বোধহয় ভুলে গিয়েছিল আমি ঘা-খাওয়া মানু্ষ। আগের বার মেয়ের হাত ধরে পথে পথে ঘুরতে হয়েছে। এবার আমি গুছিয়ে নিয়েছি।” একটু থেমে দম নিয়ে ফের বলতে শুরু করলেন, “আমি তঁার সেবাও করব, আবার গালও শুনব, কেন? কথায় কথায় তিনি তোমার মায়ের সঙ্গে আমার তুলনা করছেন। তুমি কত ভাল ছেলে, আমার মেয়ে কত বজ্জাত তার ফিরিস্তি দিচ্ছেন। এত দিন পরে এটা বুঝতে পারলেন!”
বিতান নিচু গলায় বলল, “আমাকে এসব বলছেন কেন?”
মালবিকা বিতানের মুখের দিকে এক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, “তুমি তোমার বাবাকে নিয়ে যাও বিতান।”
বিতান অবাক হয়ে বলল, “আমি নিয়ে যাব? কী বলছেন!”
মালবিকা চোখ কুঁচকে বললেন, “ঠিকই বলছি। আমি অনেক দিন দেখলাম, এবার তুমি দেখো।”
বিতানের মনে হল, মহিলা তার সঙ্গে রসিকতা করছেন। সে জোর করে হাসার চেষ্টা করল। বলল, “আমি কে?”
মালবিকা থমথমে গলায় বললেন, “তুমি ওঁর ছেলে। ছেলে নও? তোমার কোনও দায়িত্ব নেই?”
বিতানের মনে হল এখনই উঠে দাঁড়ায়। দরজা খুলে ছুটে পালায়। সে বলল, “এত বছর পরে হঠাৎ ছেলের দায়িত্ব পালন করার প্রশ্ন কোথা থেকে আসছে? উনি তো আমাকে বলে কখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেননি!”
মালবিকা বিদ্রূপের হাসি হেসে বললেন, “এত দিন পরে কোথায়? তুমি তো অনেক দিন থেকেই দায়িত্ব পালন করছ। বাবা ডাকলেই ছুটে আসছ, আমাকে লুকিয়ে টাকা দিয়ে যাচ্ছ, বাকি কথা আমি ঠিক জানি না। নিশ্চয়ই আরও কিছু আছে।”
বিতান চুপ করে রইল। বাকি কিছু না থাকলেও, মাঝে মাঝে আসা, টাকা দেওয়া, এগুলো সত্যি।
মালবিকা আবার স্বর বদল করলেন। নরম ভাবে বললেন, “দেখো বিতান, তুমি বড়, তোমাকে বলতে এখন কোনও অসুবিধে নেই। মানুষটাকে আমি ভালবেসেই বিয়ে করেছিলাম। এমন কোনও বড় পদে তিনি চাকরি করতেন না, এই দু’কামরার ফ্ল্যাটটাও আহামরি কিছু নয়। সেই সময়ে আমার একটা আশ্রয়ের দরকার ছিল ঠিকই, কিন্তু চাইলে ওঁর থেকে সফল কোনও পুরুষমানুষকেও... তোমার বাবাকে আমি সত্যিই ভালবেসেছিলাম। এখনও বাসি। বাসি বলেই জীবনের শেষ পর্যায়ে তাঁকে কষ্ট দিতে চাইছি না। আমার বিশ্বাস, তিনি এই বিয়ের জন্য এখন অনুশোচনা করেন। তাঁকে মুক্তি দেওয়া উচিত।’
বিতান অস্ফুটে বলল, “উনি আমার কাছে গেলে শান্তি পাবেন এমন আপনি ভাবছেন কেন?”
মালবিকা হাসলেন, “তুমিও জানো পাবেন।”
বিতান বলল, “এসব আপনি জোর করে বলছেন। বাবা-ই বা আমার সঙ্গে থাকতে কেন রাজি হবেন?”
মালবিকা বললেন, “সে তুমি ওঁর সঙ্গে কথা বললেই জানতে পারবে। আমাকে বারবার বলছেন। কিছু হলেই বলেন, ছেলের কাছে গিয়ে থাকব। আমি ওঁর মন বুঝেই বলছি। দেখো বিতান, তোমার টাকাপয়সার সমস্যা হবে না। তোমার বাবার পেনশনের টাকাপয়সায় আমার কোনও দাবি থাকবে না। ওই টাকায় ওঁর খরচ চলে যাবে। কিছু টাকা বেঁচেও যেতে পারে।”
বিতান প্রায় আর্তনাদ করে বলল, “এসব আপনি কী বলছেন? বাবাকে আমি কোথায় রাখব? আমার নিজেরই তো থাকার ঠিক নেই।”
মালবিকা চোখ সরু করে বললেন, “গড়িয়ায় যে দারুণ ফ্ল্যাটে তুমি থাকো, সেখানে রাখবে! বাবাকে তো তুমিই ফ্ল্যাটের কথা বলেছ। বলোনি?”
বিতান বলল, “ওই ফ্ল্যাট তো আমার নয়, আমার বন্ধুর। ও আমাকে থাকতে দিয়েছে।”
মালবিকা বললেন, “তোমাকে যখন দিয়েছে, তোমার বাবাকেও নিশ্চয়ই দেবে। যেদিন দেবে না, সেদিন কোনও অল্টারনেটিভ ব্যবস্থা করে নেওয়ার মতো বয়স তোমার হয়েছে।”
কথা শেষ করে উঠে পড়লেন মালবিকা। বিতানও উঠে দাঁড়াল। সে এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না। সত্যি বাবা তার কাছে চলে যেতে চায়?
মালবিকা বললেন, “আর কথা বাড়াব না। তোমার বাবা এবার ঘুম থেকে উঠবেন। আজ শনিবার, অফিস ছুটি বলেই তোমাকে আসতে বলেছিলাম। দেখো বিতান, তুমি আমার কথা না-ও শুনতে পারো। কিন্তু মনে রেখো, আমি ওঁকে আর এখানে রাখব না। দোষটা আমার নয়, দোষটা ওঁর। উনি আমাকে এক সময় সহ্য করতে পারতেন, এখন আর পারছেন না। কেন পারছেন না? তুমি সন্তান, বলা উচিত নয়, তাই বলছি না। আমি অন্য কোনও ব্যবস্থা নেব। দ্যাট উইল বি হার্ড। অনেক দূরে, অসুস্থ অক্ষমদের কোনও আশ্রমে রেখে আসব ওঁকে। হাজার বললেও সে জায়গার ঠিকানা তুমি পাবে না। সময় নাও, সময় নিয়ে ভাবো। একদিন আমি না থাকলে এসে ওঁর সঙ্গে কথা বলো। একটা ইনফর্মেশন দিই। মে বি সেন্টিমেন্টাল অ্যান্ড ফুলিশ, তাও তোমার জানা দরকার। তোমার বাবার মাথার বালিশের নীচ থেকে আই গট ইয়োর মাদার্স ফোটোগ্রাফ। বিয়ের ছবি। এটা আমার জন্য যথেষ্ট অপমানের নয় কি? আমি ওঁর রোগশয্যার পাশে বসে থাকব, আর উনি অন্য এক জনের ফোটো মাথায় করে রাখবেন, এটা কি মানা উচিত? তোমার মা পারতেন? যাক, এবার তুমি ভেবে দেখো। আমাকে জানিয়ো।’’
আবাসন থেকে বেরিয়ে বিতান দেখল, আকাশে মেঘ জমেছে। ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে অল্প অল্প। এখন বৃষ্টির সময় নয়, তার পরেও বৃষ্টি আসছে। দুম করে বৃষ্টি পড়লে কলকাতার চেহারাটা নিমেষে বদলে যায়। মজার হয়ে যায়। প্রথম দফায় এক চোট হুড়োহুড়ি লাগে। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে পথের মানুষ ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। কলকাতা শহরে এখন মাথা বাঁচানোর অনেক জায়গা। শহরে এ দিক ও দিক কত ফ্লাইওভার। নীচে দাঁড়িয়ে পড়লেই হল। কোথাও কোথাও সাজানো-গোছানো বাস স্টপও হয়েছে। বৃষ্টির ছাঁট বাঁচিয়ে সেখানে দিব্যি থাকা যায়। দু’পা অন্তর ছোটবড় শপিং মল। ঢুকে পড়লে নিশ্চিন্ত। তবে বিতানের এতটা নিশ্চিন্তি পছন্দ হয় না। মাথার ওপর ঝমঝম বৃষ্টি, জমা জল, ট্রাফিক জ্যাম তার ভাল লাগে। প্রকৃতি কিছুক্ষণের জন্য যাবতীয় শহুরে আদবকায়দা, নিয়মশৃঙ্খলা, অনেক ভেবে তৈরি করা রুটিনকে এলোমেলো করে দেয়।
অন্য দিন হলে এরকম আচমকা মেঘ দেখে খুশি হত বিতান। আজ ভাল লাগছে না। মনে হচ্ছে এখানে না এলেই হত। মালবিকা নামের মহিলাটির চাপের সামনে পড়তে হত না। ঊর্বীর মোবাইল ফোনে ছবি দেখতে হত না। শুধু এরা দু’জনই বা কেন? আড়ালে থেকে পরিমল মুখোপাধ্যায় কি কম চাপ দিচ্ছে? পালিয়ে কি থাকা যেত? আজ না হোক কাল ওই মহিলা ঠিক যোগাযোগ করত।
বিতান কাঁকুড়গাছির মোড়ে পৌঁছে একটা সিগারেট কিনে ধরাল। ধোঁয়া ছেড়ে মুখ তুলল। মেঘের আকাশ আরও কালো হয়ে এসেছে। উলটোডাঙার দিক থেকে টংটং করতে একটা অলস উদাসীন ট্রাম মেঘের ছায়ায় ভাসতে ভাসতে আসছে। ছুটন্ত ঝলমলে শহরের বুকে তাকে লাগছে বেমানান। মনে হচ্ছে, ‘অনেক হয়েছে, আর চলব না’ বলে যে-কোনও সময় থমকে দাঁড়াবে।
বিতান ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগল। মানুষ যথারীতি চঞ্চল হয়ে উঠেছে। বৃষ্টির আগেই যদি কোথাও পৌঁছে যাওয়া যায়। বিতানের কোনও তাড়া নেই। না কাজে যাওয়ার, না বাড়ি ফেরার। এই মুহূর্তে সে সেক্টর ফাইভে ছোটখাটো একটা কাজ করছে। রিয়েল এস্টেট কোম্পানির অফিসে দুপুর তিনটের পর বসতে হয়। পার্ট-টাইম কাজ। সকালবেলাটা একটি মেয়ে সামলায়। আগে পুরোটাই থাকত, রাত আটটা পর্যন্ত। বিয়ের পর সে আর অতটা দেরি করতে পারে না। তাই বিতানকে নেওয়া হয়েছে। বিতানের বেরোতে বেরোতে অনেক সময় রাত দশটাও হয়ে যায়। সম্ভাব্য কাস্টমার কেউ এলে বা ফোন করলে, প্রজেক্ট কত ভাল তা বোঝাতে হয়। শনি–রবিবার করে সাইট ভিজিট করাতে হয়। কলকাতার চারপাশে এখন অজস্র বাড়ি হচ্ছে। শহর ঠেলেঠুলে, জোর করে বড় হতে চাইছে। সকলেই চাইছে, যেখানেই থাকি শহরের সব সুবিধে যেন মেলে। কেউ আর বাড়ির ইট, বালি, চুনের কোয়ালিটি নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামায় না। ভাবটা এমন, ঘর তাসের হলেও আপত্তি নেই। প্রোজেক্ট থেকে বাইপাস, শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স যেন দূরে না হয়। যতই ডেস্কে ‘ডিসট্যান্স লিস্ট’ সাঁটা থাকুক, দূরত্বের সব প্রশ্নে সন্তুষ্ট করার মতো উত্তর সব সময় দেওয়া যায় না। তখন সুইমিং পুল, জিম, ফ্রি পার্কিং-এর কথা তুলে কথা ঘোরাতে হয়। সকালে যে মেয়েটি বসে সে এই বিষয়ে দক্ষ। দুটো কথার ফাঁকে ফাঁকে সে নানা কথা বানাতে পারে।
“ম্যাডাম, আপনি বেডরুম থেকে পাখির ডাক শুনতে পাবেন। ইন ফ্যাক্ট আমরা কিছু ফ্ল্যাট রাখছি যেখানে সকালে আপনার পাখির ডাকে ঘুম ভাঙবে। প্রাইসটা অবশ্য একটু বেশির দিকে। বুঝতেই তো পারছেন ম্যাডাম, শহরের সব ফেসিলিটির মধ্যে পাখির ডাক অ্যারেঞ্জ করা তো কস্টলি ব্যাপার।”
বিতান এসব পারে না। তার ভালও লাগে না। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কাজটা ছেড়ে দেবে। কাজ ছাড়ায় সে অভ্যস্ত। অনেক বার প্রতিজ্ঞা করেছে, হুট করে কাজ ছাড়বে না। কিন্তু সে প্রতিজ্ঞা রাখতে পারে না। আসলে চাকরি ভাল না মন্দ বড় কথা নয়, বাঁধাধরা কাজে মন বসে না তার। মনে হয়, কেরিয়ার তৈরি তার কম্ম নয়। সরকারি বেসরকারি কোনও চাকরির পরীক্ষা বা ইন্টারভিউই সে খুব জোরের সঙ্গে দিতে পারে না। অ্যাকাডেমিক কোয়ালিফিকেশন মারাত্মক ভাল কিছু নয় যে পরীক্ষায় কম নম্বর পেলে কিছু এসে-যাবে না। তাকে বেশি পরিশ্রম করেই পরীক্ষায় বসতে হবে। সে জীবনের উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। কী হবে কেরিয়ার করে? পরিশ্রম থেকে সরে যায় বিতান। এই মনোভাবের জন্য মাঝে মাঝেই টাকাপয়সার সমস্যা হয়। ভাগ্যিস বাড়িটা পেয়েছিল, নইলে বিপদ হত। এই বিষয়টা নিয়ে আহিরী প্রায়ই তাকে বোঝায়। রাগ করে। ক’দিন আগেও বলেছে।
“ভাল লাগে না বললে চলবে? কাজ তো করতে হবে। নইলে খাবে কী?”
বিতান হেসে বলে, “আমার খাওয়ার বেশি খরচ নেই, ও ঠিক জুটে যাবে।”
আহিরী বিরক্ত হয়ে বলে, “এ কেমন কথা! জুটে যাবে আবার কী? চিরকাল বন্ধুর বাড়িতে থাকবে?”
বিতান বলল, “ছোটখাটো একটা কিছু করলেই চলবে। খুব বড় কোনও কাজ করার মধ্যে আমি নেই। বসেদের চোখরাঙানিই বলো, কাজের টার্গেটই বলো আর দশটা–পাঁচটা চেয়ার টেবিলে বন্দি থাকাই বলো, আমার ভাল লাগে না। আমার কেরিয়ার ব্যাপারটাতেই কোনও ইন্টারেস্ট নেই। মনে হয়, কেরিয়ারের পিছনে ছুটলে জীবনকে প্রপারলি উপভোগ করা যায় না।”
আহিরী ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলে, “এসব অলস অকর্মণ্য লোকের কথা। তোমার কথা সত্যি হলে বেকার, হাত গুটিয়ে বসে থাকা লোকেরাই জীবনকে সবচেয়ে বেশি উপভোগ করত। হুইচ ইজ নট কারেক্ট। কেরিয়ার মানে শুধু উপার্জন করা নয়, লেখাপড়া করে যা শিখেছি তাকে কাজে লাগানো।”
বিতান বলল, “ঠিকই বলছ, কিন্তু আমার ভাল লাগে না। আমি তো তেমন লেখাপড়া শিখিওনি। ইচ্ছে থাকলেও সুযোগ হয়নি। কলেজের সময় থেকেই নিজের ব্যবস্থা নিজেকে করতে হয়েছে।”
“ভাল না লাগলেও তো মানুষকে অনেক কিছু করতে হয় বিতান।”
বিতান হেসে বলল, “সে তো নানা রকম রেস্পনসিবিলিটি থাকে। বাবা–মা, স্ত্রী–পুত্র, ফ্যামিলি। আমার সে ঝামেলা নেই। যাকে বলে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে থাকা একটা জীবনের অধিকার পেয়েছি।”
আহিরী নিচু গলায় বলেছিল, “আজ নেই, কাল যে হবে না তা ভাবছ কেন?”
বিতান বলে, “আমি কিছুই ভাবছি না।”
আহিরী রাতে ফোন করে থমথমে গলায় বলেছিল, “বিতান, তুমি কি সত্যি কিছু ভাবছ না?”
বিতান হেসে বিষয়টা সহজ করার চেষ্টা করে। “তুমি এত সিরিয়াসলি নিলে আহিরী!”
আহিরী থমথমে গলায় বলে, “কিছু কিছু জিনিস সিরিয়াসলি নিতে হয়।”
বিতান বলে, “আমি তো রসিকতাই করি।”
আহিরী আরও থমথমে গলায় বলে, “নিজের জীবন নিয়ে রসিকতা করা যায়, কিন্তু যেখানে অন্যের জীবন জড়িয়ে, সেখানে রসিকতা চলে না।”
বিতান থতমত খেয়ে বলে, “আহিরী, তুমি কী বলতে চাইছ ঠিক বুঝতে পারছি না।”
আহিরী একটু চুপ করে থেকে বলে, “থাক। আমার থেকে শুনতে হবে না। যেদিন নিজে বুঝতে পারবে সে দিনের জন্য অপেক্ষা করা ভাল।”
দু’দিন আগে, ঘেরাওয়ের সময়, কলেজ থেকে ফোন করেও আহিরী একটা ‘ভদ্রস্থ’ চাকরি পাওয়ার কথা বলেছে। সে কি আসলে তার সঙ্গে একটা ‘ভদ্রস্থ’ জীবন কাটানোর কথা ভাবছে? ঊর্বীর মোবাইলের তোলা ছবিটা সেই জন্যই অস্বস্তিতে ফেলেছে। লজ্জাতেও। কলেজের গেটে মেধাবী, সুন্দরী অধ্যাপিকার ফোটো থাকবে কোনও ‘ভদ্রস্থ’ যুবকের সঙ্গে। বিতানের সঙ্গে কেন?
পকেটে রাখা মোবাইলে মেসেজ ঢোকার আওয়াজ হল। বিতান মোবাইল বের করে দেখল, ঊর্বী তাকে মেসেজ করেছে! এই প্রথম। ফুটপাতের মাঝখানেই থমকে দাঁড়িয়ে মেসেজ পড়ল বিতান। ‘স্যরি। আমি সব ফোটো ডিলিট করে দিলাম।’
পকেটে মোবাইল ঢোকাতে না ঢোকাতে হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামল।