নুড়ি পাথরের দিনগুলি – ১৫

১৫

কমলেশ রায় অফিসে, নিজের ঘরে বসে আছেন। তাঁর মন খারাপ। মন খারাপের নানা কারণ রয়েছে। সবটা বুঝতে পারছেন না। কিছু স্পষ্ট, কিছু অস্পষ্ট। জীবনের সবচেয়ে লম্বা পথটাই হেঁটে ফেলেছেন। কত চড়াই-উতরাই পেরিয়েছেন। কেরিয়ারের শীর্ষে পৌঁছেছেন। মানুষের ভালবাসা, সম্ভ্রম কম পাওয়া হল না। যেমন তাঁকে মানায়, তেমন একজন জীবনসঙ্গিনী পেয়েছেন। কেরিয়ার তৈরির সময় নিঃশব্দে আগলে রেখেছিল সে। কাজ, ট্যুর, পার্টি নিয়ে পাগলের মতো মেতে থাকতে গিয়ে দিনের পর দিন সময় দিতে পারেননি নবনীকে। সে এক দিনের জন্যও অনুযোগ করেনি। আর? আর আহিরীর মতো চমৎকার একটা মেয়ে আছে। তার পরেও আজ কেমন ফাঁকা, ছোট লাগছে নিজেকে। কমলেশ নিজেকেই বললেন, “ব্যাক টু ইয়োর সেন্সেস। নিজের চেতনায় ফেরো।”

অফিসে আসার পরেই ত্রিপাঠী তাঁর কাছে একটা ‘কনফিডেনশিয়াল’ ফাইল পাঠিয়েছে। তাতে লেখা, কম্পিউটার ভাইরাসের ঘটনায় যে ‘পিসি’টিকে চিহ্নিত করা গেছে, সেটি আর কারও নয়, খোদ জেনারেল ম্যানেজারের পার্সোনাল সেক্রেটারি নিলয় সান্যালের। এটা নিলয়ের দ্বিতীয় কম্পিউটার মেশিন। তার ডেস্কেই আছে। ফাইলে ত্রিপাঠী আরও লিখেছে, সৌহার্দ্য ছেলেটি ঠিকই বলেছিল, তবে মেশিন খুঁজতে কারও ব্যক্তিগত‌ কম্পিউটার ঘাঁটতে হয়নি। সার্ভার থেকেই মেশিনের নম্বর বার‌ করা গেছে। বোঝা গেছে, কোন মেশিন থেকে গোলমালটা হয়েছে। নিলয় সান্যাল এখনও জানে না, গোটা অফিসের কম্পিউটার সিস্টেম কোলাপ্‌স করার পিছনে তার মেশিন দায়ী।

কমলেশ রায়ের মনে পড়ল, বিভূতি এই ছেলেটি সম্পর্কে সতর্ক করেছিল। বাইরের যে এজেন্সি এখানে ব্র্যান্ড প্রোমোশনের বরাত পেয়েছে, সেখানকার কোন তরুণীর সঙ্গে নাকি নিলয়ের ভাব-ভালোবাসা হয়েছে। কাজের ব্যাপারে ব্যক্তিগত দুর্নীতির সম্ভাবনা আছে।

কমলেশ ইন্টারকমের দিকে হাত বাড়িয়েও সরিয়ে নিলেন। বাইরে থেকে নিলয় আড়ি পাতে না তো? তিনি মোবাইলে ত্রিপাঠীকে ধরলেন।

“তোমার ফাইল দেখেছি।‌ ইঞ্জিনিয়াররা কি শিয়োর, এই ঘটনা ইচ্ছাকৃত?”

ত্রিপাঠী বললেন, “এখনও পর্যন্ত নয়।”

কমলেশ বললেন, “তা হলে কী করা উচিত?”

ত্রিপাঠী বললেন, “বুঝতে পারছি না স্যর। নিলয় সাবোটাজ় করেছে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে কিছু করা যাবে না। আবার বেনিফিট অব ডাউট দিতেও ভয় করছে স্যর। ও খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসে আছে। একেবারে আপনার ঘরে। স্যর, পুলিশকে ইনফর্ম করলে কেমন হয়? ওদের তো সাইবার ক্রাইম ডিপার্টমেন্ট আছে।”

কমলেশ বললেন, “একেবারেই নয়। কেউ যেন কিছু না জানে ত্রিপাঠী। আমাদের ইন্টার্নাল ইনভেস্টিগেশন আগে শেষ হোক। আপাতত নিলয়কে ট্রান্সফার করো।”

“ও সন্দেহ করবে না?”

কমলেশ বললেন, “না। এমন কাজ দাও যাতে খুশি হবে। অন্য কিছু নিয়ে মাথা ঘামাবে না।”

ত্রিপাঠী অবাক হয়ে বললেন, “খুশি হবে? আপনি কি ওকে প্রোমোশন দিতে বলছেন? এত বড় অপরাধের পর.‌.‌.‌”

কমলেশ বললেন, “অপরাধ এখনও তো প্রমাণ হয়নি ত্রিপাঠী। এমনও তো হতে পারে, দেখা গেল সবটা অ্যাক্সিডেন্টাল। আপাতত আমরা ওকে প্রোডাক্ট প্রোমোশন অ্যান্ড ব্র্যান্ডিং-‌এর কাজে আউটডোর পাঠিয়ে দেব। বাইরের যে এজেন্সি এ ব্যাপারে কাজ করছে তাদের সঙ্গে কোম্পানির তরফে লিয়াজ়োঁ রেখে কাজ করবে। এইচআর-কে বলো, যেন আজই ওকে ডেকে কথা বলে। আমি যত দূর ওকে জানি, এই অফার ও লুফে নেবে।”

ত্রিপাঠী বলল, “স্যর, আপনি যখন বলছেন তা-ই হবে।”

কমলেশ গলা নামিয়ে বললেন, “আমার কাছে খবর আছে, ‌ওই এজেন্সিতে কাজ করে এমন একটি মেয়ের প্রতি নিলয় দুর্বল। রিলেশনও আছে। ওর সঙ্গে কাজ করার লোভ ও ছাড়তে পারবে না। এর মধ্যে ইনভেস্টিগেশন শেষ করা হবে। অপরাধ প্রমাণ হলে ভাল, না হলেও সমস্যা নেই। প্রোমোশন, ব্র্যান্ডিং-‌এর কাজে ভুল ও করবেই। পার্সোনাল কারণে বাইরের এজেন্সিকে টাকাপয়সা পাইয়ে দেওয়ার চার্জে তখন ওর বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেব। সেই অ্যাকশন মৃদু না জোরালো হবে, তখন ঠিক করা যাবে। সন্দেহ যখন হয়েছে, অ্যাকশন নিতেই হবে। কেয়ারলেস থাকাটাও একটা অপরাধ। ওর মেশিন থেকে এত বড় গোলমাল হবে কেন? ‌ তুমি দ্রুত নিলয়কে সরানোর ব্যবস্থা করো। অন্য একজনকে আমার এখানে পাঠাও। নতুন কাউকে।”

ত্রিপাঠী নিশ্চিন্ত গলায় বললেন, “স্যর, এসব তো আমি জানতাম না। ‌এখুনি এইচআর হেডকে বলে নিলয়ের জন্য চিঠি তৈরির ব্যবস্থা করছি। আর আপনার প্রাইভেট সেক্রেটারির জন্য আমাদের কাছে কয়েকটা সিভি আছে। প্লেসমেন্ট এজেন্সিকেও ফোন করে দিচ্ছি।”

ফোন ছেড়ে খানিকটা নিশ্চিন্ত বোধ করলেন কমলেশ। একটা জটিল সমস্যার আংশিক সমাধান করা গেল মনে হচ্ছে। তবে এর পরে আরও জটিল সমস্যা আসছে। জটিল এবং স্পর্শকাতর। সেই সমস্যার কোনও আধখানা সমাধান হবে না।‌ যদি হয় পুরোটাই হবে, নইলে নয়। তিনি ফাইল টেনে নিলেন। গত কয়েক মাস প্রোডাকশনের প্রতিদিনের রিপোর্ট দেখেন কমলেশ।

কাল রাতে ঘুমোনোর আগেও নবনী মেয়েকে নিয়ে অনেকক্ষণ কথা বলেছেন। নবনী রাতে ঘুমের ওষুধ খান। বড়জোর দু’–একটা কথা বলেই চোখ বোজেন। কাল ছিলেন অস্থির এবং উত্তেজিত। রিডিং ল্যাম্প জ্বালিয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বই পড়ছিলেন কমলেশ। নবনী রাতের প্রসাধন সেরে খাটে বসে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “মেয়ের জন্য কিছু ভাবলে? ওর সঙ্গে কথা বলেছ?”

‌কমলেশ সংক্ষেপে উত্তর দিলেন, “ভেবেছি।”

বিরক্ত নবনী বললেন, “শুধু ভেবে কী হবে?”

কমলেশ ‌বইয়ের পাতা উলটে বললেন, “কী হবে জানি না। একটা চেষ্টা তো করতে হবে।”

নবনী বললেন, “আমার ধারণা, ওই বাজে ছেলেটার সঙ্গে আহি ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়িয়েছে। জেদ করে বাড়িয়েছে। যেহেতু আমি অর্জকের সঙ্গে ওর বিয়ের চেষ্টা করছি, তাই। মায়ের সব কথাই তো ওর কাছে শত্রুর কথা। মেজদি সেদিন বাইপাসে আহির গাড়ি দেখেছে। পরমা আইল্যান্ডের কাছে সিগনালে দাঁড়িয়েছিল। পাশে ওই খারাপ ছেলেটা বসে আছে। মুখে দাড়ি। তুমি কি মুখের সামনে থেকে বইটা সরিয়ে আমার কথা শুনবে?”

কমলেশ বই সরিয়ে বললেন, “মুখে দাড়ি থাকলেই খারাপ ছেলে হবে তার কোনও মানে নেই। আহির কলিগও হতে পারে।”

নবনী বললেন, “তুমি ফালতু তর্ক করছ। অর্জকের মা সেদিন দুঃখ করছিল। আহি তার ছেলের সঙ্গে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে টুকটাক চ্যাট করে, কিন্তু আসল কথায় যায় না। আমি বলেছি, এত দিন যখন অপেক্ষা করেছে, ছেলেকে আর ক’টা দিন অপেক্ষা করতে বলো।”

কমলেশ বললেন, “এটা তুমি বাড়াবাড়ি করছ নবনী। মেয়ের হয়ে তুমি কাউকে কথা দিতে পারো না। তার কোনও সিদ্ধান্ত যদি তোমার পছন্দ না হয়, তাকে সতর্ক করতে পারো ব্যস, তার বেশি নয়। তা ছাড়া অর্জক ছেলেটাই বা কীরকম? কোনও মেয়ে তাকে বিয়ে করতে না চাইলেও এভাবে হ্যাংলামো করতে হবে নাকি!‌‌”

নবনী রেগে গেলেন, “হ্যাংলামো বলছ কেন? কাউকে পছন্দ হওয়াটা হ্যাংলামো? তা ছাড়া‌ আহি যতই ওই ছেলেকে নিয়ে ঘুরে বেড়াক, আমি আমার মেয়েকে চিনি। মাথা ঠান্ডা করে ভাবলে সে অর্জকের মতো ছেলেকে নিশ্চয়ই মেনে নেবে। ও তো জীবনে সব কিছু হিসেব করে করেছে, বিয়েটাই বা করবে না ‌কেন?”

কমলেশ হেসে বললেন, “আহি কি এখনও তোমার সেই ছোট্ট খুকি? নিজের ভালমন্দ সে বোঝে না? অন্য কেউ বলবে আর সে মেনে নেবে?”

নবনী হিসহিসিয়ে বললেন, “না। বোঝে না। অনেক মাতব্বরকে তো দেখছি। বিয়ের রাত কাটতে না কাটতে সুটকেস টানতে টানতে ফিরে আসছে।”

কমলেশ বললেল, “আহি একজন শিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী মেয়ে, আর পাঁচ জনের সঙ্গে তাকে গুলিয়ে ফেলাটা ভুল হবে নবনী।”

নবনী নাক দিয়ে ফুঁয়ের আওয়াজ করে‌ বললেন, “শিক্ষা আর বুদ্ধির দৌড় দেখতে পারছি। একটা অকর্মণ্য, অযোগ্য, বেকার ছেলেকে নিয়ে ঘুরছে। আমার বিশ্বাস, ওই বদ ছেলে আহিকে নিজের ফ্যামিলি সম্পর্কেও কিছু বলেনি। ফ্যামিলিটাও খুব খারাপ। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর ওর বাবা একজন কমবয়সি মহিলাকে বিয়ে করে। সেই মহিলা…”

কমলেশ স্ত্রীকে থামিয়ে দিয়ে বলেছেন, “থাক, আমি জানি।”

নবনী ভুরু কুঁচকে বললেন, “জানো!‌ তুমি কীভাবে জানলে?”

কমলেশ বললেন, “তুমি বলার পর আমি কিছু খোঁজখবর নিয়েছিলাম।”

নবনী খানিকটা তেড়েফুঁড়েই বললেন, “তা হলে হাত গুটিয়ে বসে রয়েছ কেন? তোমার আহ্লাদের মেয়েকে ডেকে বলো, সে যেন নিজের পায়ে কুড়ুল না মারে।”

কমলেশ পাশ ফিরে শুতে শুতে বললেন, “নবনী, প্রেমে পড়লে মানুষের নিজের ভালমন্দ মাথায় থাকে না।‌ এখন শুয়ে পড়ো। রাত হয়েছে।”

নবনী উলটো পাশ ফিরতে ফিরতে চাপা গলায় বললেন, “নিজের ভালমন্দ কীভাবে বুঝতে হয় তুমি তো জানতে। জানতে না? এখন মেয়েকে শেখাতে পারছ না?”

সেই পুরনো খোঁচা। কমলেশ চুপ করে রইলেন। ইচ্ছে করলেই তিনি বলতে পারতেন, বিতানকে নিয়ে আহির সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। আজ সন্ধেবেলাই হয়েছে। একটু-আধটু কথা নয়, অনেকটা কথা। নবনী তাদের উর্বরা অর্গানাইজেশনের কোনও একটা প্রোগ্রামে গিয়েছিল। সেই সুযোগে কমলেশ তাঁর মেয়েকে স্টাডিতে ডাকেন। বিষয় যতই সিরিয়াস হোক, কমলেশ ‘ক্যাজ়ুয়াল মেথড’ ব্যবহার করলেন। ম্যানেজারি কায়দা। কোনও কোনও সময় গুরুগম্ভীর আলোচনার থেকে এই পদ্ধতি বেশি কাজ দেয়।

আহিরী এসে বলে, “বাবা, খুব ব্যস্ত আমি। খাতা দেখছি।”

কমলেশ হালকা গলায় বললেন, “বসতে হবে না। তোকে তিনটে প্রশ্ন করব, ঝটপট উত্তর দিয়ে চলে যাবি। কোনও প্রশ্ন করবি না। পরেও কখনও করবি না। কাউকে বলতেও পারবি না। দেখি তুই কত বড় স্মার্ট হয়েছিস। এগ্রি?”

আহিরী মজা পাওয়া গলায় বলে, “এগ্রি।”

“তোর কি বিতান নামে কোনও অকর্মণ্য, হাফ বেকার ছেলের সঙ্গে রিলেশন হয়েছে?”

আহিরী ঘাড় কাত করে বাবার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল। বলল, “হয়েছে। হাফ নয়, দু’-এক দিনের মধ্যে ফুল বেকার হয়ে যাবে। ছোটখাটো একটা পার্টটাইম কাজ করছে, সেটাও ছেড়ে দেবে।”

“তুই কি ওই ছেলেকে বিয়ে করতে চাইছিস?”

আহিরী কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “অবশ্যই চাইছি। বিয়ে করে আমি ওকে পিটিয়ে মানুষ করতে চাই। তবে বিতান চায় না। ও মনে করে, ওর মতো সামান্য একজন মানুষের সঙ্গে জড়িয়ে পড়াটা আমার জন্য লজ্জার ও ক্ষতিকর হবে। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। আমি কি উদাহরণ দিতে পারি? এটা কোনও প্রশ্ন নয়।”

কমলেশ গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। ভিতরে ভিতরে চমকেও উঠছেন। কিন্ত ভান দেখালেন অবজ্ঞার। বললেন, “পারিস। তবে সংক্ষেপে।”

আহিরী বলল, “রিসেন্টলি আমাদের কলেজের একটি ব্যাড টাইপ মেয়ে কলেজের গেটে আমাদের দু’জনকে দেখতে পায় এবং মোবাইলে ফোটো তোলে। কোনও ভাবে বিতান সেটা দেখেছে। সেটা নিয়েও সে অপরাধবোধে ভুগছে। এতে আমার কতটা ইমেজ নষ্ট হতে পারে তাই নিয়ে ভাবছে।”

কমলেশ একটু চুপ করে থেকে বললেন, “ওই ছেলেটার মোবাইল নম্বরটা আমাকে দে।”

আহিরী অবাক হয়ে বলল, “তুমি কি বিতানকে ফোন করবে?”

কমলেশ বললেন, “নো কোয়েশ্চেন।”

আহিরী কঠিন গলায় বলল, “আর যদি আমি না দিই?”

কমলেশ বললেন, “বেশি কিছু হবে না। এক জনের মোবাইল নম্বর জোগাড় করা বিরাট কোনও সমস্যা নয়। তবে তোর সাহস এবং আমার প্রতি বিশ্বাসের একটা পরিচয় পাব।‌ এবার তুমি কেটে পড়তে পারো।”

একটু পরে আহিরী ফোন নম্বর লেখা একটা কাগজের টুকরো এসে ধরিয়ে দেয়। কমলেশ ছদ্ম গাম্ভীর্য দেখিয়ে বলেন, “আশা করি তোমার এই বন্ধুটিকে তুমি কিছু বলবে না।”

আহিরী বলল, “আমার প্রতি তোমার বিশ্বাসের বহর দেখে অবাক হচ্ছি বাবা।”

কমলেশ হেসে বললেন, “রাইটলি সার্ভড। একেই বলে মুখের মতো জবাব। কার মেয়ে দেখতে হবে তো।”

আহিরী বলল, “আজ শিখলাম, বড় ম্যানেজারদের এটা এক‌টা কায়দা। পেটের কথা বের করতে র‌্যাপিড ফায়ার করে বসে। আমি কলেজে অ্যাপ্লাই করব। এই কলেজে বেশি দিন থাকা হবে বলে মনে হচ্ছে না।”

কমলেশ বললেন, “কেন? তোদের ওই শর্মিষ্ঠা দত্ত না কে আবার জ্বালাচ্ছেন?”

আহিরী বলল, “না। ঘেরাওয়ের ঘটনার পর থেকে আমাকে সমঝে চলে। একজন আমার পাকিং–এর জায়গা অকুপাই করেছিল। না বলতেই সে গাড়ি সরিয়ে নিয়েছে। অর্কপ্রভ সেনও এখন ‘ম্যাডাম ম্যাডাম’ করেন। নতুন বাড়ি তৈরির ব্যাপারে কী সব গোলমাল হয়েছে। শর্মিষ্ঠা দত্তকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে।”

কমলেশ বললেন, “তা হলে কলেজ ছাড়ার প্রশ্ন উঠছে কেন?”

আহিরী হেসে বলল, “মা আমাকে আমেরিকায় পাঠিয়েই ছাড়বে মনে হচ্ছে। পাত্রটি একটু হ্যাংলা টাইপ, হোয়াটসঅ্যাপ বেশি করে, তবে মন্দ নয়, আমার পাশে মানাবে।”

কমলেশ ‌একটুও দেরি না করে বললেন, “তুই যাবি আহি?”

আহিরী ঠোঁটের কোণে হেসে বলল, “স্যর, আপনার র‌্যাপিড ফায়ারের পালা শেষ। এ সম্পর্কে আর কোনও প্রশ্নের জবাব আপনি পাবেন না। অফিসের জেনারেল ম্যানেজার নয়, এবার বাবা হিসেবে মেয়ের উত্তর বুঝে নিন।”

পিতা–কন্যার এই গভীর ও গোপন কথোপকথন কি নবনীকে বলা যায়? কখনওই নয়। সে আদিখ্যেতা ভেবে আরও রেগে যেত।

কমলেশ রায় কাল অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলেন।

মুখ তুলে সামনের দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে তাকালেন কমলেশ। তারপর ফাইলপত্র সরিয়ে গাড়ির চাবিটা নিয়ে উঠে পড়লেন।

১৬

বিতান মন দিয়ে খাচ্ছে। তার খাওয়ার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে নতুন কিছুই ঘটেনি, কমলেশ রায় নামের ভদ্রলোকটির সঙ্গে সে মাঝেমধ্যেই লাঞ্চ করে।

কমলেশ রায় একটা চিকেন স্যান্ডউইচ নিয়েছেন। স্যান্ডউইচ শেষ করে কফি নিয়ে বসেছেন। ইচ্ছে করেই বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে এই মাঝারি ধরনের রেস্তরাঁটা বেছেছেন কমলেশ। বড় কোথাও গেলে বিতানের অস্বস্তি হতে পারত।

বিতান রেস্তরাঁর দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল। কমলেশকে দেখে এগিয়ে আসে।

“আহিরীর মোবাইলে আপনাদের ছবি দেখেছি।”

কমলেশ হেসে বলেন, “আমি কিন্তু ছবি না দেখেই তোমাকে চিনতে পেরেছি। দাড়ির কথাটা তো জানতাম। তা ছাড়া এই মুহূ্র্তে এখানে হ্যান্ডসাম ইয়ং ম্যান তো একজনই রয়েছে।”

বিতান বলে, “থ্যাঙ্ক ইউ।”

বিতানকে আজ সত্যি সুন্দর লাগছে। জিনসের ওপর নীল রঙের হাফ-স্লিভ একটা শার্ট পরেছে। এলোমেলো চুলে লম্বা–চওড়া চেহারার তরুণটিকে সুপুরুষ লাগছে। কমলেশ মনে মনে মেয়ের তারিফ করলেন। ভিতরে যাই থাক, বাইরে থেকে মেয়েদের প্রেমে পড়বার মতোই। ছেলেটি খুব স্মার্টও। প্রেমিকার বাবার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে এত স্বচ্ছন্দ থাকা সহজ নয়। অন্তত গড়পড়তা বাঙালি ছেলের পক্ষে তো নয়ই।‌ আজ সকালে ফোন করেই ছেলেটি সম্পর্কে একটা ভাল ধারণা তৈরি হয়েছিল কমলেশের। নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, “আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই বিতান। কথাটা জরুরি। এখনই বলা দরকার।”

বিতান একটুও না চমকে বলে, “বলুন।”

কমলেশ বলেন, “এভাবে হবে না। কথা বেশি নয়, কিন্তু মুখোমুখি বসা দরকার।”

বিতান ঠান্ডা গলায় বলে, “আচ্ছা বসব। আপনি বলুন কোথায় যেতে হবে।”

কমলেশ একটু ভেবে নিয়ে বলেন, “আজ দুপুরে তুমি কীভাবে প্লেসড?”

“চারটে পর্যন্ত কিছু নেই‌।”

বিতানকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বললেন, “ফাইন, তুমি আমার সঙ্গে আজ লাঞ্চ করো।”

বিতান অস্ফুটে বলে উঠেছিল, “লাঞ্চ!‌”

“এনি প্রবলেম?”

বিতান একটু ভেবে বলল, “না, ঠিক আছে। কোথায় যাব?”

সময় আর রেস্তরাঁর‌ ঠিকানা বলে কমলেশ একটু হালকা ঢঙে বললেন, “আমি চাই আমাদের এই সাক্ষাতের ঘটনাটা শুধু আমি আর তুমি জানব।”

বিতান বলল, “অবশ্যই।”

কালই ছেলেটিকে খানিকটা বুঝতে পেরেছিলেন কমলেশ, আজ আরও ভাল করে বুঝছেন। এই ছেলের নিজেকে নিয়ে কোনও রকম কুণ্ঠা নেই। খাওয়ার মাঝখানেই বিতান কথা বলতে চেয়েছিল। কমলেশ হাত তুলে বলেছিলেন, “আগে ধীরেসুস্থে খাও, তারপর।”

বিতান খাওয়া শেষ করে কফির বদলে আইসক্রিম নিল।

“এবার বলতে পারেন।”

কমলেশ বললেন, “কথা শুরুর আগে আমি কি তোমার ফ্যামিলির বিষয়ে কিছু জানতে পারি? তোমার ব্যাপারে কেবল ওইখানেই আমার একটা ইনফর্মেশন গ্যাপ আছে।”

বিতান একটু চুপ করে থাকে। তারপর অল্প কথায় মায়ের মৃত্যু, বাবার আবার বিয়ে, তাকে বাড়ি থেকে কার্যত তাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে।

“ওই মহিলা এখন অসুস্থ বাবাকে বাড়ি থেকে বার করে দিতে চাইছেন। বাবাও আর থাকতে চান না। আজও আমাকে ফোন করে কান্নাকাটি করলেন। অথচ এক সময় ওই মহিলা আর তাঁর মেয়ের জন্য কী‌ না করেছে মানুষটা।”

বিতান মুখ নামাল। কমলেশ নরম গলায় বললেন, “স্যরি, আমি জানতাম না। ভালবাসা যে শেষ পর্যন্ত কী চেহারা নেয় কে বলতে পারে?”

বিতান মুখ তুলে বলল, “আমার ক্ষতি হল। এই গোলমালে লেখাপড়াটাও ঠিকমতো হল না। জীবনের উৎসাহটাই হারিয়ে ফেললাম। যাক, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাবাকে আমি আমার কাছে নিয়ে আসব। যে ক’টা দিন বাঁচবেন, আমিই দেখব।” বিতান‌ থেমে একটু হেসে বলল, “যদিও আমার নিজেরই থাকার জায়গা নেই। তা হোক, একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”

কমলেশ থমকালেন। বিভূতির দেওয়া রিপোর্টে ছেলেটার সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল। কাল আহির কাছে শুনে সেই ধারণা বদলেছে। বুঝতে পেরেছেন, আহি এমন কোনও ছেলেকে ভালবাসতে পারে না, যার কিছু নেই। ঘরবাড়ি, চাকরি না থাকলেও কিছু তো আছে। কমলেশ এখন বুঝতে পারছেন, ছেলেটির মনের জোর আছে। মুমূর্ষু বাবার বিষয়ে যে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সে আহির ব্যাপারে নেবে না কেন? এই জোর ভাঙতে কতটা আঘাত দরকার? নিজেকে মনে মনে প্রস্তুত করলেন কমলেশ। এটা একটা মনের লড়াই হবে। অর্ধেকেরও কম বয়সি যুবকের সঙ্গে মনের লড়াই। কাল অনেক রাত পর্যন্ত ভেবে তিনি বুঝেছেন, বাবা হিসেবে এটাই তাঁর কর্তব্য।

কমলেশ রায় বললেন, “বিতান, এবার কাজের কথায় আসা যাক। আমার মেয়ের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক হয়েছে। সাধারণ সম্পর্ক নয়, যে সম্পর্ক দুটি ছেলেমেয়েকে সারা জীবন একসঙ্গে থাকার দিকে ঠেলে দেয়, সেই সম্পর্ক। এই সম্পর্কে তারা যুক্তিবুদ্ধি হারায়। বুঝতে পারে না বা চায় না, তারা একসঙ্গে থাকার উপযুক্ত কি না, একে অপরের যোগ্য কি না। তারা অবধারিত ভাবে ভুল করে।”

বিতানের চোখমুখ কঠিন হয়ে যায়। সে থমথমে গলায় বলে, “আপনি কী বলতে চাইছেন আমি বুঝতে পারছি।”

কমলেশ একটু ঝুঁকে পড়ে নিচু গলায় বললেন, “আমি আমার মেয়েকে ভালবাসি। সে কোনও কারণ কষ্ট পাক আমি চাই না বিতান। আশা করি তুমিও চাইবে না। যদি চাও, তোমার জীবনে উৎসাহ ফিরিয়ে আনার কিছু দায়িত্ব আমিও নিতে পারি। মুম্বইতে চাকরি, নিজের ফ্ল্যাট, অসুস্থ‌ বাবার চিকিৎসা….”

বিতান চোয়াল শক্ত করে বলে, “ব্যস, আর বলতে হবে না। আমার কিছু দরকার নেই। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি, অপমানিত হতে‌ আসিনি।”

কমলেশ একটু হেসে বললেন, “এর মধ্যে অপমানের কী দেখলে ইয়ং ম্যান? ডিল খুব পরিষ্কার। হিন্দি সিনেমায় তো এক সময় খুব দেখা যেত। এখনও দেখায় না কি? ‌কত দিন যে সিনেমা–থিয়েটার দেখিনি।”

বিতান দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আর‌ কথা বাড়াবেন না। আপনার কোনও ডিলে আসবার প্র‌য়োজন নেই। আপনি আমাকে কী শোনাতে এসেছেন? আমি খুব ভাল করেই জানি, আমার সঙ্গে আহিরীকে মানায় না। কোনও দিক থেকেই আমি ওর যোগ্য নই। আমি ওর মিনিমাম থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাটুকুও করতে পারব না। আমি সে কথা আপনার মেয়েকে জানিয়েও দিয়েছি।”

কমলেশ দু’হাত ছড়িয়ে হাসিমুখে বললেন, “ওহো, জানিয়ে দিয়েছ? দেন ইট’স ওকে।”

বিতান উঠে দাঁড়াল। তার চোখমুখে রাগে, অপমানে থমথম করছে।

“আপনি যখন আজ ফোন করে ডেকেছেন, তখনই বুঝেছিলাম, এরকম কিছু বলবেন। আমি রেডি হয়েই এসেছি। কিন্তু এতটা নীচে নেমে বলবেন ভাবতে পারিনি। স্যরি, বলতে বাধ্য হচ্ছি, আহিরীর বাবা হিসেবে আপনাকে ঠিক মানাছে না।”

কমলেশ ঠোঁটের কোণে হেসে বললেন, “ইয়ং ম্যান, এত রাগ করে না। প্রেমে পড়া মানুষ হয় দু’রকম। কাপুরুষ, নয় লোভী। তুমি যে লোভী নও সে তো বুঝতে পারছি, কিন্তু তুমি যে দেখছি.‌.‌.‌”

বিতান বলল, “আপনি কি আমাকে কাপুরুষ বলছেন?”

কমলেশ একই রকম হেসে কাঁধ ঝাঁকালেন। বিতান রাগে কিছুটা কাঁপছে। কমলেশ বুঝতে পারছেন, লড়াইয়ে তিনি জিতে গেছেন। খুব অল্প আয়াসেই জিতেছেন। মনে মনে নিজের পিঠ চাপড়ালেন তিনি।

“ও সব এবার বাদ দাও বিতান। আমি কি তোমাকে লিফট দেব?”

বিতান চাপা গলায় বলল, “স্যার, অনেক অপমান করলেন, এবার একটা কথা শুনে নিন। আমি আমার যাবতীয় কনফিউশন ঝেড়ে ফেলে আপনাকে জানিয়ে যাচ্ছি, আহিরী রাজি হলে আমি তাকে বিয়ে করব। থাকা–খাওয়া পরে বুঝে নেওয়া যাবে। অন্তত আপনার কাছে হাত পাতব না।”

বিতান বেরিয়ে গেলে মুচকি হেসে আরও একটা কফির অর্ডার দিলেন কমলেশ। এক ঝটকায় মন ভাল হয়ে গেছে তাঁর। এই ছেলে শেষ পর্যন্ত আহিকে বিয়ে করত হয়তো, কিন্তু দ্বিধা, হীনম্মন্যতায় যদি দেরি হয়ে যেত? দু’জনেই‌ সারা জীবন অসুখী হয়ে থাকত। এই ধাক্কাটার দরকার ছিল। নবনীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হল, কিন্তু মেয়ের ভালবাসার পাশে দাঁড়ানোটা অনেক জরুরি। ওরা ঠিক পারবে। আহিকে পাশে পেলে বিতান জীবনের উৎসাহ খুঁজে পাবে। কফি এল, তাতে একটা চুমুকও না দিয়ে বিল মিটিয়ে উঠে পড়লেন কমলেশ। নিজেকে খানিকটা পাপমুক্ত লাগছে। মনে মনে বললেন, এটা সাধারণ কোনও সম্পর্ক নয়, যে সম্পর্ক দুটি ছেলেমেয়েকে সারা জীবন একসঙ্গে থাকার দিকে ঠেলে দেয়, সেই সম্পর্ক। এতে যুক্তি-বুদ্ধি নেই। তারা অবধারিত ভাবে ভুল করে। ভুল করে তারা সুখী হয়। সারা জীবন অপরাধবোধ নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় না।

মোবাইলে আহিরীর ছবি ফুটে উঠল। কমলেশ এই ফোনটার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

“কী হয়েছে ডার্লিং?”

আহিরী থমথমে গলায় বলল, “বাবা তুমি বিতানকে কী বলেছ? ও বলছে, কালই আমাকে বিয়ে করতে চায়। কী বলেছ তুমি ওকে?”

কমলেশ চুপ করে রইলেন। বহু দিন পর তাঁর চোখের কোণ ভিজে উঠল।

১৭

অফিসে পৌঁছতেই নিলয় একটা মুখবন্ধ খাম এগিয়ে দিল। “স্যর, সৌহার্দ্য বসু এটা আপনার হাতে দিতে বলেছেন।”

কমলেশ ভুরু কুঁচকে বললেন,“আমাকে!‌”

নিলয়ের মুখ খুশি-খুশি। নিশ্চয়ই তাকে নতুন অ্যাসাইনমেন্টের কথা বলা হয়েছে। বলল, “হ্যাঁ স্যর।”

নিলয় বেরিয়ে যেতে সাদা লম্বা খামটা খুললেন কমলেশ। সৌহার্দ্যর খাম বলেই এত তাড়াতাড়ি খুললেন। এই ছেলে তাঁকে কী লিখেছে? ইংরেজিতে লেখা চিঠি। তাড়াহুড়ো করে লেখা। কমলেশ দ্রুত পড়তে লাগলেন।

‘স্যর, আপনার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা করে কথা বলব ভেবেছিলাম, কিন্তু এই মুহূর্তে সম্ভব হল না। একটু আগে বাড়ি থেকে ফোন করে জানিয়েছে, মা ভয়ংকর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মনে হচ্ছে, হাসপাতালে নিতে হবে। আমি বাড়ি যাচ্ছি।

‘স্যর, আমি এই কোম্পানি ছেড়ে দিচ্ছি। মেলে রেজ়িগনেশন পাঠিয়ে দিলাম। অল্প দিনের জন্য হলেও অফিসের দিনগুলো আমার ভাল কাটল। এই অফিসে জয়েন করে আপনার নাম জানতে পারি। চমকে উঠি। কারণ কমলেশ রায় নামটির সঙ্গে আমি আগে থেকেই পরিচিত। ভেবেছিলাম নেহাতই নামের মিল। পরে জানলাম, না, মানুষটাও এক। কোম্পানির সাইট থেকে আপনার অতীত অনেকটাই জেনেছি। কোথায় পড়েছেন, কত দিন বিদেশে ছিলেন, তারপর কলকাতায় না ফিরে কোথায় চাকরি করলেন, এই সব।

‘স্যর, আপনার শিক্ষা, কেরিয়ার, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। যেদিন আমি জানতে পারলাম, আপনি সব কর্মীদের পার্সোনাল ডেটাবেসে মায়ের নাম জানানো বাধ্যতামূলক করতে চেয়েছেন, আমার খুব আনন্দ হল। তার কারণ আমি আমার মাকে খুব ভালবাসি। তিনি আমার বন্ধু। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন কষ্ট আর অপমানের। কোনও অপরাধ ছাড়াই তাঁকে শাস্তি পেতে হয়েছে। অথচ তাঁকে যখন প্রতিশোধ নেওয়ার কথা বলি, তিনি আমাকে বকাবকি করে ঘর থেকে বার করে দেন। আমার মা শ্রীকণা বসু এতটাই ভাল।

‘স্যর, বলতে খুবই লজ্জা করছে, যে মানুষটা মাকে কষ্ট দিয়েছিল, অপমান করেছিল, অপেক্ষা করতে বলে পালিয়ে গিয়েছিল, তার নামও কমলেশ রায়। কী আশ্চর্য না? এই রাগে প্রথম দিন আপনার ঘরে একটা দামি কাপ ভেঙে ফেলেছিলাম।

আমাকে মাপ করবেন।’

চিঠি হাতে দীর্ঘক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন কমলেশ রায়। ঘোর কাটল ত্রিপাঠীর ইন্টারকমে। ত্রিপাঠী সৌহার্দ্যর রেজ়িগনেশনের খবর দিলেন। আর বললেন, “হিজ় মাদার ইজ় ইন ক্রিটিকাল কন্ডিশন। সিভিয়ার হার্ট অ্যাটাক।”

কমলেশ নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কোন হাসপাতাল?”

১৮

আহিরী বললে, “বাবা, তোমাকে হাসপাতালে যেতে হবে।”

“এত রাতে?”

আহিরী বলল, “হ্যাঁ। এত রাতেই যেতে হবে। আমি তোমাকে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাব।”

“তোর মা…?”

আহিরী বলল, “মা–ই তো বলল, তোর বাবাকে নিয়ে যা। উর্বরা অর্গানাইজেশনের সঙ্গে উনিও জড়িত ছিলেন। সেখান থেকেই মা সব কিছু জেনেছিল।”

কমলেশ বসে আছেন মেয়ের ঘরে। তিনি মেয়েকে বলেছেন। শ্রীকণার সঙ্গে প্রেম, তারপর বিদেশে পালিয়ে যাওয়া, সৌহার্দ্যর অফিসে জয়েন করা, আজ শ্রীকণার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভরতি হওয়া, সবটাই বলেছেন।

“আহি, নিজেকে সর্বক্ষণ অপরাধী লাগে। তোর মা আমাকে ছোট চোখে দেখে।”

আহিরী শান্ত ভাবে সব শুনেছে। তারপর বাবার গায়ে হাত রেখে বলেছে, “চিন্তা কোরো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। ‌বাবা, তুমি ওঁর কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইবে। আজই যাবে।”

কমলেশ বিহ্বল ভাবে বললেন, “শ্রীকণা কি আমার কথা বুঝতে পারবে?”

আহিরী বলল, “উনি না পারুন, তোমাকে বলতে হবে। তুমি হালকা হবে। মা খুশি হবে।”

হাসপাতালে এই সময়ে কাউকে ঢুকতে দেওয়ার কথা নয়। কন্ডিশন খুব খারাপ বলে সৌহার্দ্য ব্যবস্থা করল। ‘স্যর’ আসায় সে খুবই ছোটাছুটি করতে শুরু করে দেয়। নার্স বললেন, “পেশেন্টকে একদম বিরক্ত করবেন না। দেখে চলে আসবেন।”

সবাই কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল, ভিতরে শুধু ঢুকলেন কমলেশ রায়।

১৯

একটু পরেই সন্ধে নামবে।

মূর্তি নদীর পাশে দাঁড়িয়ে আছেন কমলেশ আর নবনী। আহিরী আর বিতান হানিমুনে গেছে জ়ুলুক। ওরা ট্রেক করবে, ক্যাম্পে থাকবে, বনফায়ার করে মুরগির রোস্ট খাবে। নবনীর এসবে খুব আপত্তি। এ কেমন হানিমুনের ছিরি? কমলেশ হেসে বললেন, “রাগ করে কী হবে? চলো আমরাও হানিমুনে যাই।” এ দিক-ও দিক ঘুরে ওঁরা দুজনে আবার মূর্তি নদীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।

নবনী স্বামীর হাত ধরে আছেন। কমলেশ নবনীর কাঁধে হাত রাখলেন।

সূর্য অস্ত গিয়েছে। কুলকুল আওয়াজে নুড়ি পাথর ধুয়ে চলে যাচ্ছে নদী।

————

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *