নুড়ি পাথরের দিনগুলি – ১

আহিরীর মাথা গরম। যত সময় যাচ্ছে সেই গরম ভাব বাড়ছে। এখন দশটা বেজে চল্লিশ মিনিট। সকাল থেকে এই নিয়ে মোট তিন দফায় আহিরীকে মাথা গরম করতে হল। আহিরীর মনে হচ্ছে, এইভাবে চলতে থাকলে বিকেলের দিকে তার মাথা থেকে অল্প অল্প ধোঁয়া বেরোলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। সুতরাং যা করবার বিকেলের আগেই করতে হবে। শর্মিষ্ঠা দত্তর ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকতে হবে। তিনি যদি বলেন, “‌আহিরী, একটু পরে এসো। আমি একটা জরুরি কাজের মধ্যে রয়েছি। তুমি বরং বিকেলের দিকে এসো,” তখন বলতে হবে, “‌সরি ম্যাডাম। বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারব না। আমার কথা আপনাকে এখনই শুনতে হবে।”‌

কটকটে রোদের মধ্যেই গাড়ি পার্ক করল আহিরী। পার্ক করতে বেশ অসুবিধে হল। বার কয়েক আগুপিছু না করে জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। গাড়ি থেকে বেরিয়ে সানগ্লাস খুলে গাড়ির দিকে তাকাল আহিরী। গাড়ির আদ্ধেকটা রোদে রয়ে গেছে। লাল টুকটুকে এই গাড়ি তার অতি পছন্দের। কলেজে চাকরি পাওয়ার পর কিনেছে। ব্যাঙ্ক লোন নিয়েছে। কমলেশ রায় মেয়েকে বলেছিলেন, দরকার হলে তিনি ‌ডাউন পেমেন্টের সাপোর্ট দিতে পারেন। আহিরীর দরকার হয়নি। সে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকেই দিয়েছে। কমলেশ রায় বললেন, “ভেরি গুড। নিজের উপার্জনে কেনা গাড়ি কনফিডেন্সে থাকে। যা বলবি শুনবে।”

আহিরী মিটিমিটি হেসে বলেছিল, “‌কীরকম কনফিডেন্স?‌”

কমলেশ রায় সিরিয়াস মুখ করে বললেন, “‌এই ধর, মাঝপথে তেল ফুরিয়ে গেল, সে কিন্তু থামবে না। ঠিক কাছাকাছি কোনও পেট্রল পাম্পে তোকে নিয়ে যাবে। অন্য কারও গাড়ি হলে এই সুবিধেটা পেতিস না, তেল ফিনিশ, তার ছোটাছুটিও ফিনিশ।”

আহিরী হেসে বলে, “‌উফ বাবা, তুমি না একটা যা–‌তা। আমি ভাবলাম কী না কী বলবে। তেল ফুরোলে গাড়ি চলে?‌‌”

কমলেশ রায় বলেন,‌ “‌আলবাত চলে, ভালবাসা থাকলেই চলে। গাড়ি তো কোন ছাড়, দুনিয়ায় কত কিছু ভালবাসা দিয়ে চালিয়ে দেওয়া যায় তার ঠিক আছে?‌”

‌গাড়িটা সত্যি আহিরীর খুব প্রিয়। সেই গাড়িকে রোদ খেতে দেখে আহিরীর মেজাজ আরও বিগড়োল। গাড়ি লক করে ইট-বাঁধানো পথ ধরে হাঁটতে লাগল সে। এই সুন্দর দেখতে মেয়েটির মুখের দিকে তাকালে এখন মনে হবে, কাঁচা আমের শরবত ভেবে ভুল করে সে খানিকটা নিমপাতার রস খেয়ে ফেলেছে। সেই কারণে চোখ মুখ কুঁচকে আছে।

চোখমুখ কুঁচকে থাকলেও আহিরী রায়কে সুন্দর দেখাচ্ছে। কে বলবে, বয়স তিরিশ শেষ হতে চলল?‌ হঠাৎ দেখে এখনও ইউনিভার্সিটির ছাত্রী বলে ভুল হতে পারে। সে স্লিম এবং লম্বা। গড়পড়তা বাঙালি মেয়ের থেকে একটু বেশিই লম্বা। গায়ের রং ক্যাটক্যাটে ফরসা নয়, আবার কালোও নয়। তামাটে ভাব রয়েছে। তার মায়ের মতো। এসবের থেকে বড় কথা, চোখ বু্দ্ধিদীপ্ত, ঝকঝকে। লম্বা গলা, তীক্ষ্ণ মুখে জেদ আর তেজ দুটোই রয়েছে। এ ধরনের রূপে কমনীয়তা কম থাকবার কথা। আহিরীর বেলায় ঘটনা উলটো। তার উপস্থিতির মধ্যে এক ধরনের স্নিগ্ধতা রয়েছে। হালকা কিছু যোগব্যায়াম ছাড়া আহিরী এক্সারসাইজ বিশেষ কিছু করে না। একবার জিমে ভরতি হয়েছিল, বেশি দিন টানতে পারেনি। নিয়ম করে যাওয়া খুব কঠিন। প্রথমে সকালে ক’দিন গেল। ক’দিন পরে ঘুমই ভাঙত না। তারপর বিকেলের শিফ্‌ট নিল। তাও হল না। কোনও না কোনও কাজে আটকে যায়। আহিরী রূপচর্চাতেও নেই। রাতে শোওয়ার সময় নাইট ক্রিম আর বিয়েবাড়িটাড়ি থাকলে একবার পার্লারে ঢুঁ মেরে আসা। ব্যস, তার ‘‌রূপ-‌লাবণ্যের রহস্য’‌ এখানেই শেষ। তার পরেও অনেকে মনে করে, এই মেয়ে মুখে যাই বলুক, শরীরের জন্য অনেকটা সময় খরচ করে। এসব কথায় আহিরী মাথা ঘামায় না।

এ দিক থেকে‌ কলেজের মেন বিল্ডিং-‌এ ঢুকতে হলে একটা হাফ সার্কল পাক দিতে হয়। তারপর কলেজে ওঠার চওড়া সিঁড়ি। কলেজ কম্পাউন্ডের ভিতরে জায়গা অনেকটা। বেশিটাই নেড়া। লন একটা আছে বটে, কিন্তু সেখানে ঘাসের থেকে আগাছা বেশি। ইট–‌পাথর, ছোটখাটো গর্ত-টর্তও রয়েছে। একটা সময়ে বাগান করা হত। এখন সে পাট চুকেছে। কলকাতায় এতটা জায়গা নিয়ে কলেজ খুব বেশি নেই। বাউন্ডারির বাইরে খেলার মাঠটাও বড়। পুরনো কলেজ বলেই এত বড় কম্পাউন্ড।

মুখে রোদ পড়ছে। আহিরী কপালের কাছে হাত দিয়ে চোখ আড়াল করল। কলেজ কম্পাউন্ডে ঢুকে পড়লে সে আর সানগ্লাস পরে না। ছেলেমেয়েরা থাকে। হয়তো ভাববে, ম্যাডাম ফ্যাশন করছে। শাড়ি আর সালোয়ারেও এক ধরনের পার্সোনালিটি মেনটেন করতে হয়। আহিরীর মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে, প্যান্ট-শার্ট পরে আসতে। অনেক সুবিধে, কমফর্টেবলও। চটপট তৈরি হওয়া যায়। কত পেশাতেই তো মেয়েরা শার্ট-প্যান্ট পরছে। টিচাররা পারবে না কেন?‌ আহিরী ঠিক করেছে, একদিন প্যান্ট-শার্ট পরে দেখবে রিঅ্যাকশন কী হয়। সবে একটা বছর হয়েছে। আরও ক’টা দিন যাক।

এই এক বছরে আহিরী ছাত্রছাত্রীদের কাছে খুবই পছন্দের হয়ে উঠেছে। তার বেশ কয়েকটা কারণও আছে। সবথেকে বড় কারণ হল, সে পড়াচ্ছে খুবই ভাল। আহিরীর নিজেরও ধারণা ছিল না, এতটা ভাল পারবে। বরং একটু ভয়ে ভয়েই ছিল। বড় কলেজ, অনেক ছেলেমেয়ে। এর আগে পার্ট টাইম যেখানে পড়িয়েছে, সেই কলেজ এর তুলনায় কিছুই নয়। কলকাতা শহরের মধ্যেও ছিল না। ট্রেনে করে যেতে হত। সেখানে ছোট ক্লাস। ম্যানেজ করাও সহজ ছিল। মেয়েরাও পরীক্ষা পাশ করার মতো নোটস পেলেই সন্তুষ্ট থাকত। এখানে গোড়ার দিকে ফাঁকিবাজ ছেলেমেয়েরা তার ক্লাসে ঢুকত না, এখন তারাও ক্লাস করতে চাইছে। কেউ চাইলে ক্লাসের পরেও পড়া বুঝিয়ে দেয় আহিরী। অনেকে স্পেশাল নোটস চায়, নতুন নতুন রেফারেন্স বইয়ের নাম চায়। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আহিরী মেশেও সহজ ভাবে। কলেজের বড় অকেশনে তো বটেই, ছেলেমেয়েরা ছোটখাটো কিছুতে ডাকলেও গিয়ে বসে থাকে। এই তো ক’দিন আগে ডিপার্টমেন্টে ডিবেট হল। আহিরী জাজ হয়েছিল। ডিবেটের মোশনও ঠিক করে দিয়েছিল। বুক নয়, ফেসবুক। খুব হইহই হল। ‌আহিরী ম্যাডাম‌-এর বয়স তুলনামূলক ভাবে অন্য টিচারদের থেকে কম বলে ছেলেমেয়েরা তার কাছে হয়তো বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে। সব মিলিয়ে এক ধরনের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে।

স্বাভাবিক ভাবে উলটো ফলও হয়েছে। কিছু কলিগ আহিরীকে হিংসে করে। আড়ালে বলছে, “‌নতুন তো, তাই বেশি ফরফরানি। গোঁত্তা খেয়ে পড়লে বুঝবে। এরকম কত দেখলাম!”‌ নানা রকম বাঁকা কথা। সামনেও এটাসেটা মন্তব্য। এরা বেশির ভাগই সিনিয়র। কেউ কেউ আবার কলেজের মাতব্বর। আহিরী না শোনার ভান করত। এত অল্প দিনে কিছু বলা ঠিক নয়। তবে গত মাসে আর নিজেকে সামলাতে পারেনি। সেদিন টিচার্স রুমে দুম করে কেমিস্ট্রির প্রফেসর অর্কপ্রভ সেন বলে বসলেন, “‌আহিরী, তুমি নাকি কাল স্টুডেন্টস ক্যান্টিনে গিয়েছিলে?‌”

দু’–‌একজন পার্ট-টাইমার বাদ দিলে আহিরী অধ্যাপকদের মধ্যে সবার থেকে ছোট। অধিকাংশই তাকে ‘‌‌তুমি’‌ সম্বোধন করে। অর্কপ্রভ সেনের ষাট বছর হতে দেরি নেই। টিচার্স কাউন্সিলের মাথা। সব ব্যাপারে ওস্তাদি। শোনা যায়, টিচার ইন চার্জের সঙ্গে সাঁট আছে। আড়াল থেকে অনেকটাই অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কন্ট্রোল করেন। সেদিন ভদ্রলোকের প্রশ্নের মধ্যে এক ধরনের শাসনের ভঙ্গি ছিল। এর আগেও উনি গার্জেনগিরি করেছেন। অনেকের ওপরেই করেন। তারা ভয়ে চুপ করে থাকে। আহিরীর কোনও দিনই পছন্দ হয়নি। তার পরেও কিছু বলেনি। সহ্য করেছে। সেদিন আর পারল না। উত্তর দিয়ে বসল।

“স্যর, শুধু কাল তো নয়, আমি এর আগেও ওখানে গিয়েছি। মাঝেই মাঝেই যাই।”‌

অর্কপ্রভ সেন ভুরু কুঁচকে বললেন, “‌তাই নাকি!‌ কেন যাও জানতে পারি?‌”‌

আহিরী হেসে বলল, “‌স্টুডেন্টস ক্যান্টিনে চা–‌টা খুব ভাল। ছেলেমেয়েদের হুজ্জুতির ভয়ে বোধহয় ভাল করে বানায়।”‌

অর্কপ্রভ ভুরু তুলে বললেন, “টিচার্স রুমের চায়ের থেকেও ভাল?‌ স্ট্রেঞ্জ!‌ যাই হোক, হতে পারে, তা বলে তুমি চা খেতে ছাত্রদের ক্যান্টিনে গিয়ে বসবে?‌ মাধবকে বললেই তো সে এনে দিত। আমরা সকলেই না হয় খেয়ে দেখতাম। নো নো, ওদের ক্যান্টিনে যাওয়াটা তোমার ঠিক হয়নি আহিরী। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে টিচারকে একটা ডিসটেন্স মেনটেন করতে হয়। নইলে ওরা মাথায় চেপে বসে। তা ছাড়া.‌.‌.‌ তা ছাড়া এখনকার ছেলেমেয়েরা অ্যাগ্রেসিভ ইন নেচার, বিশেষ করে কলকাতা শহরের ছেলেমেয়েরা। কথায় কথায় স্ল্যাং ইউজ করাটা এদের কাছে কোনও ব্যাপার না। শিক্ষকদের সম্মান কীভাবে দিতে হয় জানে না, জানতে চায়ও না। ছেলেমেয়েরা কীভাবে মেলামেশা করে দেখো না? কম্পাউন্ডের ভিতর‌ ঘাড়ে হাত দিয়ে, কোমরে হাত দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে!‌ ছি ছি! আমরা ভাবতেও পারতাম না। ওদের মাঝখানে গিয়ে বসাটা তোমার একেবারেই ঠিক হয়নি। কখন কী অপমান করে দেবে তার ঠিক আছে?”

কথা শুনতে শুনতেই আহিরীর মনে হল, মানুষটাকে হালকা শিক্ষা দেওয়া দরকার। সে কোথায় যাবে না যাবে, এই লোক তা বলবার কে?‌ চাকরিতে ঢোকার সময় কোথাও তো বলা ছিল না, শিক্ষকরা স্টুডেন্টস ক্যান্টিনে যেতে পারবে না! সে যখন কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়ত, কত বার স্যর-ম্যাডামরা তাদের ক্যান্টিনে গিয়েছে। একসঙ্গে আড্ডা হয়েছে। সেই আড্ডায় টপিক হিসেবে সাহিত্য, থিয়েটার, সিনেমা এমনকী সেক্সও থাকত। ইনি কোন আমলে পড়ে আছেন?‌

আহিরী বোকা বোকা মুখ করে বলল, “স্যর, মাধবদাকে বললে এখানে চা এনে দিত নিশ্চয়ই, কিন্তু ক্যান্টিনের চা ক্যান্টিনেই বসে খেতে হয়। নইলে টেস্ট পাওয়া যায় না। চায়ের দোকানের চা যদি আপনি বাড়ি নিয়ে গিয়ে সোফায় বসে খান, ভাল লাগবে? তা ছাড়া আমি যত ক্ষণ থাকি, ওরা খুবই সম্মান করে। সবথেকে বড় কথা, চমৎকার সব গল্প হয়। এখনকার ছেলেমেয়েরা কত কী জানে! ওদের সঙ্গে না মিশলে হিশাম মাতার বা কার্ল ওভ নসগার-এর মতো লেখকদের কথা আমি জানতেই পারতাম না। জানতেই পারতাম না, কিউ বা টেন মিনিট্‌স-এর মতো দারুণ সব শর্ট ফিল্ম তৈরি হয়েছে। থার্ড ইয়ার ইকনমিক্সের একটি ছেলের সেতার শুনে তো আমি থ! ইউটিউবে দিয়েছে। আপনি কি শুনবেন, স্যর?”

অর্কপ্রভ সেন গলাখাঁকারি দিয়ে বলেন, “ও, তুমি ইনটেলেকচুয়াল এক্সারসাইজ করতে ছেলেদের ক্যান্টিনে যাও?”

আহিরী হেসে বলল, “এক্সারসাইজ না বক্সিং জানি না, তবে ভাল লাগে। আমির খান, প্রিয়ঙ্কা চোপড়া নিয়েও আড্ডা হয়। আমি আবার হিন্দি মুভির পোকা কিনা! একটা সময়ে কলেজ-ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা দেওয়া হয়ে গেলেই হল-এ ছুটতাম।”

অর্কপ্রভ সেন ব্যঙ্গের ভঙ্গিতে বললেন, “তা হলে তো ছেলেমেয়েরা মনের মতো শিক্ষক পেয়েছে। যা খুশি বলতে পারে।”

আহিরী বলল, “অল্প বয়সে নিজেদের মধ্যে একটু স্ল্যাং ইউজ করবে না? কান না দিলেই হল! আমি তো ওদের মোরাল শিক্ষা দিতে যাই না। আর ভালমন্দের সীমারেখাটাও এখন অত স্পষ্ট নয়। আমরা এমন অনেক কিছু ভাল বলে জানতাম, যেগুলো আসলে খুব খারাপ।”

টেবিলের কোণের দিকে বসে খাতা দেখছিলেন পলিটিক্যাল সায়েন্সের ব্রততী মুখোটি। মুখ না তুলে বললেন, “আহা অর্কপ্রভদা, বুঝতে পারছেন না কেন, আহিরীর এখনও প্রেসিডেন্সির ঘোর কাটেনি। ওখানেই পড়ে আছে। নিজেকে স্টুডেন্ট ভাবছে। ছোট মেয়ে তো। তাই না আহিরী?”

আহিরী বিদ্রূপের হাসি হেসে বলল, “একদম ঠিক বলেছেন ব্রততীদি। যত দিন স্টুডেন্ট থেকে স্টুডেন্টদের বোঝা যায় আর কী। বড় হয়ে গেলে তো টিচার হয়ে যাব। তখন আর ছাত্রদের বোঝার ঝামেলা থাকবে না। আমাদের দেশে এই একটা সুবিধে। ছাত্রদের না বুঝেও দিব্যি শিক্ষক হয়ে থাকা যায়।”

অর্কপ্রভ সেনের মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিলেন, “তা ক্যান্টিনে বসে তুমি ছাত্রদের কী বু্ঝলে?”

আহিরী ক্লাসে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছিল। শান্ত গলায় বলল, “পুরোটা বুঝতে পারিনি স্যর। এটুকু বুঝেছি, পড়াতে গেলে মাঝে মাঝে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশতে হবে। ওদের মধ্যে গিয়ে বসতে হবে। ওদের মুখের, মনের ল্যাংগোয়েজ জানতে হবে। পৃথিবীর সব বড় কলেজ-ইউনিভার্সিটিতেই শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশেন। এই বিষয়ে কোনও ট্যাবু থাকা ঠিক নয়। কলকাতা শহরের কোনও কলেজে স্টুডেন্টস ক্যান্টিনে একজন টিচারের বসা নিয়ে এত আলোচনা, ভাবতেই অবাক লাগে। ভেরি আনফরচুনেট। যাই স্যর, ক্লাস আছে।”

অর্কপ্রভ সেন তারপর থেকে আহিরীর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। ব্রততী মুখোটি ঘটনাটা চাউর করে দিয়েছিলেন। বেশির ভাগ পুরনো অধ্যাপকই আহিরীর কথা ভাল মনে নেননি। কয়েক জন অবশ্য ওকে সমর্থন করেছে। যেমন শ্রীপর্ণ বলেছে, “বেশ করেছ। অর্কপ্রভ সেন লোকটা খারাপ। ঝামেলায় ফেলার চেষ্টা করবে। সাবধানে থাকবে।” শ্রীপর্ণ এখানে দু’বছর হল বদলি হয়ে এসেছে। হিস্ট্রি পড়ায়। ভিতু, কিন্তু ভালমানু্ষ‌। আহিরী মৃদু হেসে বলেছিল, “চিন্তা করবেন না। আমাকে ঝামেলায় ফেললে নিজেকেও ঝামেলায় পড়তে হবে।”

অর্কপ্রভ সেনকে যেমন ছাড়েনি, শর্মিষ্ঠা দত্তকেও তেমনই আহিরী আজ ছাড়বে না বলে ঠিক করেছে। মহিলার পিছনে অন্য কেউ আছে। আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়ছে। অর্কপ্রভ সেনই হবে। তাকে ঝামেলায় ফেলছে। কথাটা ভেবে আরও মাথা গরম হয়ে আছে। আহিরী আজ ঘুম থেকে উঠে প্রতিজ্ঞা করেছিল, ঠান্ডা মাথায় কলেজে ঢুকবে। একটু ঠান্ডা নয়, ফ্রিজে-রাখা ঠান্ডা। অতিরিক্ত ঠান্ডা মাথা ছাড়া শর্মিষ্ঠা দত্তর সঙ্গে ঝগড়া করা যায় না।

শর্মিষ্ঠা দত্ত কলেজের টিচার-ইন-চার্জ। তিন বছর ধরে উনিই কলেজ সামলাচ্ছেন। বেশির ভাগ সময়েই নিজের ইচ্ছে মতো চলেন এবং বিভিন্ন জনকে নানা ভাবে জ্বালাতন করেন। কেউ আপত্তি করতে গেলে শান্ত ভঙ্গিতে এমন সব কথা বলেন যে মাথায় আগুন ধরে যায়। লজিক গোলমাল করতে থাকে। কিছু ক্ষণের মধ্যে ‘আপনার ‌যা খুশি হয় তাই করুন’ বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে আসা ছাড়া উপায় থাকে না। এটা মহিলার এক ধরনের ফাঁদ। ‘রাগিয়ে দাও’ ফাঁদ। যাতে কথা ভেস্তে যায়। তাই আগে থেকে সতর্ক থাকতে হয়। মাথা এতটাই ঠান্ডা করে যেতে হয় যাতে গরম হতে সময় লাগে। কোনও বিষয়ে আপত্তি করতে গেলেই উনি বড় গোলপানা মুখটা এমন দুঃখী-দুঃখী করে রাখেন যে মনে হয়, উনি বড় অসহায়। নিজের কোনও স্বার্থ নেই, দেশ ও দশের সেবায় এই কলেজের টিচার-ইন-চার্জ হয়ে বসে আছেন। অন্য কেউ দায়িত্ব নিলে গঙ্গায় গিয়ে ডুব দেবেন। গঙ্গার কোন ঘাটে গিয়ে ডুব দেবেন তাও ঠিক করা আছে। শুধু সময়ের অপেক্ষা। এই সামান্য কথাটা কেউ বুঝতে চাইছে না। ভাবছে তাদের ইচ্ছে করে ঝামেলায় ফেলা হচ্ছে। কলেজের টিচিং, নন-টিচিং স্টাফরা অবশ্য অন্য কথা বলে।

বলে, ঝামেলা নয়, একে বলে বংশ বিতরণ। শর্মিষ্ঠা দত্তের আলিপুরের ফ্ল্যাটে একটা ছোটখাটো বাঁশঝাড় আছে। কলেজে আসার সময় তিনি সেখান থেকে বাছাই কিছু বাঁশ কেটে নিয়ে আসেন। কলেজে এসে সেই বাঁশ বিলি করেন। বিলি করার সময় মুখ এমন গদগদ করে রাখেন যে মনে হয়, বাঁশ নয়, হাতে করে ফুল এনেছেন। আসলে মহা ধুরন্ধর মহিলা। যে বিশ্বাস করবে সেই ঠকবে।

যে তিনটি কারণে আজ আহিরীর মাথা গরম হয়েছে তার একটার জন্যও সে নিজে দায়ী নয়। দায়ী তার মা, বাথরুমের গিজার এবং ডার্ক গ্রে রঙের একটা উটকো গাড়ি।

মা সকাল থেকেই ঘ্যানঘ্যান শুরু করেছিল। সেই এক সাবজেক্ট। বিয়ে, বিয়ে আর বিয়ে।

একমাত্র সন্তানের সুযোগ্য পাত্রের জন্য নিজের মতো সন্ধান চালাচ্ছিলেন নবনী। পেয়েও গিয়েছেন। এক বান্ধবী-কাম-দিদির পুত্র কম্পিউটার নিয়ে লেখাপড়া করে আমেরিকার পোর্টল্যান্ডে থাকে। সেখানেই তার কাজকর্ম, একশো চোদ্দো তলার ওপর ফ্ল্যাট, মার্সেডিজ-বেঞ্জ গাড়ি। নবনীকে সেই দিদি শুকনো মুখে বলেছিল, “ছেলেটার সবই আছে, নেই শুধু বউ।”

নবনী চোখ কপালে তুলে বলেছিলেন, “সে কী!‌ এমন হিরের টুকরো ছেলের বউ নেই কেন?”

“সেটাই তো কথা। ছেলে না পারে প্রেম করতে, না কোনও মেয়েকে তার মনে ধরে।”

নবনী বললেন, “এ আবার কেমন কথা? আমেরিকার মতো অত বড় দেশে বিয়ে করবার মতো কোনও মেয়ে পাচ্ছে না!‌‌”

“বলেছিল, বাঙালি মেয়ে ছাড়া বিয়ে করবে না। এখন বলছে, বিয়েই করব না। অপছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে ছাড়াছাড়ির হয়ে যাওয়ার থেকে বিয়ে না করাই ভাল।”

ছেলের নাম অর্জক। চেহারা গোলগাল, ফরসা। হাবভাব নরমসরম। নিচু গলায় কথা বলে। আমেরিকার মতো শহরে বাস করেও খানিকটা লাজুক। বান্ধবী-কাম-দিদিকে ম্যানেজ করে নবনী অর্জককে একদিন বাড়ি নিয়ে এলেন। মেয়ের ছুটি দেখেই ব্যবস্থা করেছিলেন। কিছুই তেমন ভাঙেননি। মেয়েকে শুধু বলেছিলেন ‘বন্ধুপুত্র’। অর্জককে লাঞ্চ খাওয়ালেন। মেনুতে বড়ি দেওয়া শুক্তো, ডাঁটাচচ্চড়ি, মৌরলা মাছের ঝোলও ছিল। ছেলে পরিপাটি করে খেল।

নবনী মেয়ের সঙ্গে আলাপ করালেন। খেতে খেতে দু’জনের কথা হল। বেশির ভাগটাই দেশ–বিদেশের শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে। এখানকার ভাল ছেলেমেয়েরা কেন টিচিং প্রফেশনে আসতে চাইছে না, তাই নিয়ে আলোচনা। ইউনিভার্সিটির পড়া শেষ করে, কলেজে চাকরি পেতে পেতে অনেকটা সময় চলে যাচ্ছে। মাঝখানে নেট পাশ করে, গবেষণা শেষ করতে হবে। তারপর কলেজ সার্ভিস পরীক্ষা। স্কুলেও তাই। বিএড-এ চান্স পেতেই দুটো বছর লেগে যায়। পাশ করে বসে থাকো, কবে স্কুল সার্ভিসের পরীক্ষা হবে। ইন্টারভিউ, রেজাল্ট, পোস্টিং নিয়ে লম্বা সময়ের ব্যাপার। কোন ছেলেমেয়ে এতটা সময় বসে থাকবে? কাঁহাতক স্কলারশিপের সন্ধানে ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায়? এর সঙ্গে তো ধরা-করা আছেই।

এই বিষয়ে আহিরী–অর্জক দু’জনেই মোটের ওপর একমত হল। তবে একেবারেই শুকনো, কেজো কথা। আহিরী যে খুব কিছু বলেছে এমনটাও নয়, অর্জকই বলছিল। বাইরে থাকলেও সে দেশের খবর রাখে। আহিরীর বেশ ভাল লাগল। ছেলেমেয়েরা বাইরে গেলে, দেশের কিছু নিয়ে আর মাথা ঘামায় না। ফেসবুক, হোয়াটস্অ্যাপে চলতি বিষয় নিয়ে হালকা কমেন্টস দেয়, নয়তো জোকস্ ফরোয়ার্ড করে। এই ছেলে একটু আলাদা মনে হচ্ছে।

এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। সমস্যা শুরু হয়েছে তারপর থেকে। এই সামান্য সময়েই অর্জক আহিরীকে পছন্দ করে ফেলেছে। সাধারণ পছন্দ নয়, বাড়াবাড়ি ধরনের পছন্দ। এক দিনের আলাপে এতটা পছন্দ অবশ্যই ‘বাড়াবাড়ি’ বলে আহিরীর মনে হয়েছে। তবে নবনী এই খবর জানার পর এত খুশি হয়েছেন যে কী করবেন বুঝতে পারছেন না। অর্জকের মায়ের অবস্থাও পাগল-পাগল। পাগল হওয়াটাই স্বাভাবিক। ছেলে শেষ পর্যন্ত ‘মনের মতো মেয়ে’ খুঁজে পেয়েছে বলে কথা। মেয়েও রূপে-গুণে ছেলের যোগ্য। আমেরিকা পৌঁছে এই মেয়ে অনায়াসে স্কাইপে তার মায়ের কাছ থেকে হাতে-কলমে বড়ি-শুক্তো, সজনে ডাঁটা, মাছের ঝোল রান্না শিখে নেবে। কিচেনে ল্যাপটপ রেখে দেখে নেবে, কেমন করে বড়ি-শুক্তোয় ফোড়ন দিতে হবে, সজনে ডাঁটায় কতটা নুন–মিষ্টি লাগবে, মাছের ঝোলে কত ক্ষণ ঢাকা লাগবে।

এদিকে অর্জক ফিরে গেছে পোর্টল্যান্ডে, রেখে গেছে আহিরীর কাছে গোপন বার্তা— “তাড়াহুড়োর কিছু নেই। যদি কোনও দিন ইচ্ছে হয়, আমাকে কল করবেন। এই আমার ফোন নম্বর। আমি অপেক্ষা করব। সম্পর্ক এমন একটা অনুভূতি যা কোনও কিছু দিয়ে মাপা যায় না। সময় দিয়ে তো নয়ই। তাই খুব অল্প সময়ের জন্য আপনার সঙ্গে আলাপ হলেও আমি অপেক্ষা করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাকিটা আপনার সিদ্ধান্ত।”

অর্জক কোথা থেকে মোবাইল নম্বর পেল? মাকে জিজ্ঞেস করে স্পষ্ট জবাব পায়নি আহিরী। সে নিশ্চিত, এ কীর্তি মায়ের। নবনী মেয়েকে চাপ দিতে শুরু করেছেন। কখনও ঠান্ডা মাথায়, কখনও রেগে। আহিরী সামলে চলেছে। কিন্তু কত দিন পারবে বুঝতে পারছে না। এত দিন বলে আসছিল, আগে চাকরিতে সেট্‌ল করবে, তারপর বিয়ের কথা। চাকরির এক বছর হয়ে গেল। ফলে সেই অজুহাত আর চলছে না। এদিকে বিতানের কথা বাড়িতে এখনও জানাতে পারেনি আহিরী। সমস্যা আছে। বিতান ঠিকমতো কোনও কাজকর্ম করে না। তার ওপর বয়সে তার থেকে প্রায় দেড় বছরের ছোট। বাবা মুখে কিছু বলবে না, কিন্তু প্রায়-বেকার কাউকে মেয়ের জন্য মেনে নিতে নিশ্চয়ই মনে মনে কষ্ট পাবে। মানুষটা এই কষ্ট যাতে না পায় তার জন্য আহিরী অপেক্ষা করে আছে। বিতান ঠিকঠাক একটা কাজ পাক। মা অবশ্য বেকার এবং কম বয়স, দুটোর একটাও মানবে না। তবে এসবের থেকেও বড় সমস্যা বিতান। আহিরীর মনে হয়, বিতান নিজে দ্বিধায় রয়েছে। কনফিউজড। যদিও বিয়ের কথা তার সঙ্গে কখনও হয়নি। তার পরেও বোঝা যায়, ছেলেটা এক ধরনের সংশয়ে আছে। আহিরীর মতো মেয়েকে বিয়ে করবার মতো যোগ্যতা তার আছে কি না, এই নিয়ে সংশয়।

আহিরী নিজে না বললেও নবনী তাঁর মেয়ের সঙ্গে বিতানের যোগাযোগের খবর রাখেন। কানে খবর এসেছে, তাঁর অধ্যাপিকা মেয়ে একজন ওঁচা ছেলের সঙ্গে মিশছে। তিনি ঠারেঠোরে মেয়েকে প্রায়ই বলেন, “ভুল সঙ্গী বাছাই জীবনের সবচেয়ে বড় গোলমাল। বেমানান, অযোগ্য সঙ্গী নিয়ে কেউ কোনও দিন সুখী হয়নি। কেবল আপশোসই করতে হয়েছে।”

আহিরী রেগে গিয়ে বলে, “মা, তুমি কি কলেজ ছেড়ে আমেরিকায় গিয়ে আমাকে হেঁশেল ঠেলতে বলছ? সেটাই আমার জন্য ঠিক হবে? কোনও আপশোস থাকবে না?”

নবনী থমথমে গলায় বলেন, “হেঁশেল ঠেলতে হবে কেন? ও দেশে কলেজ-ইউনিভার্সিটি নেই? সেখানে বাঙালি ছেলেমেয়েরা পড়ায় না? আমেরিকায় গিয়ে কেরিয়ার করা, নাকি এখানে অভাব-অনটনের সংসার করা, কোনটা আপশোসের সেটা নিজেই বিচার করো। বিচারবুদ্ধি করার মতো শিক্ষা তোমাকে আশা করি আমরা দিতে পেরেছি।”

আজও ব্রেকফাস্ট টেবিল থেকে এক কথা শুরু হয়েছিল। বেশির ভাগ সময়েই এই ঘ্যানঘ্যানানি আহিরী কানে ঢোকায় না। নিজের মতো ভাবনাচিন্তা চালায়। যাকে বলে প্যারালাল থিঙ্কিং। আজ দুম করে মাথাটা গেল গরম হয়ে। শর্মিষ্ঠা দত্তর জন্য আগে থেকেই তেতে ছিল। মায়ের ঘ্যানঘ্যানানিতে বেড়ে গেল। শুরু হল উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়।

নবনী বললেন, “এবার একটা কিছু ফাইনাল কর। ছেলেটা কত দিন অপেক্ষা করবে?”

আহিরী বলল, “মা, আমি তো কাউকে অপেক্ষা করতে বলিনি।”

“এরকম করে বলছিস কেন আহি? অর্জক তো কোনও অন্যায় করেনি।”

আহিরী বলল, “আমিও তো কোনও অন্যায় করছি না। কাউকে অপেক্ষা করতে বলিনি, শুধু সেই কথাটাই বলছি।’

নবনী বললেন, “অবশ্যই অন্যায় করছিস। এত ভাল একটা ছেলে, মাথা কুটলে পাবি?”

আহিরী বলল, “মাথা কুটে দেখব পাই কি না। তবে এখন তো কুটতে পারব না মা। এগারোটা থেকে কলেজে পরীক্ষার ডিউটি। পর পর চার দিন ডিউটি দিয়ে টিচার-ইন-চার্জ আমাকে টাইট দিচ্ছে। এর আগেও এই কাণ্ড করেছে।”

নবনী বললেন, “তুই কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছিস আহি? আমি বলছি বিয়ের কথা, আর তুই বলছিস পরীক্ষার ডিউটি!‌‌”

আহিরী বলল, “হ্যাঁ করছি। রোজ এক কথা বললে ঠাট্টা ছাড়া আর কী করব? সিরিয়াস মুখে আলোচনাসভা বসাব? আমি তো তোমাকে বলেছি, আমি এখন বিয়ে করব না। তুমি তাও বলে যাচ্ছ।‌‌”

“তিরিশ বছর বয়েস হয়ে গেল, তার পরেও কেন বিয়ে করবি না জানতে পারি? বিয়ের বয়স তো পেরিয়ে গেছে। এই বয়েসে আমার বিয়ে তো কোন ছার, তুই হয়ে হাঁটতেও শিখে গেছিস।”

আহিরী বলল, “কী করা যাবে মা, সবাই তো সমান নয়। আমার ছেলেপুলে হলে তারা না-হয় কিছু দিন পরেই হাঁটতে শিখবে। ‌তাড়াহুড়োর কিছু নেই। ডেস্টিনেশনে পৌঁছনো নিয়ে কথা। তাড়াহুড়ো করে খরগোশের কী হাল হয়েছিল মনে নেই?”

নবনী থমথমে গলায় বললেন, “ফাজলামি বন্ধ কর। কেন বিয়ে করবি না জানতে পারি?”

“না, পারো না। মা, তিরিশ কেন, এখন যদি আমার বয়স তিরানব্বইও হয়, তা হলেও আমি বিয়ে করব না।”

নবনী গলা তুলে বললেন, “চুপ কর। এটা তোর কলেজ নয়, আমিও তোর ছাত্রছাত্রী নই যে যা বলবি‌ শুনতে হবে। তুই কি ভেবেছিস আমি কিছু জানি না? সব জানি। জানি তুই কেন এই বিয়েতে রাজি হচ্ছিস না । জেনে ‌রাখ, আমিও আটকাব।”

আহি বলে, “কী জানো তুমি?”

নবনী বলেল, “সময় হলেই বলব কী জানি।”

এর পরে না রেগে উপায় আছে? এই ছিল দিনের প্রথম রাগের সূত্রপাত।

দ্বিতীয় বার মাথা গরম হল বাথরুমে ঢুকে। আহিরী গিজার অন করে দিয়েছিল আগেই। স্নানের জন্য শাওয়ার খুলতে দেখল, জল গরম হয়নি। গিজার গোলমাল করেছে। যতই গরম পড়ুক, সকালবেলার স্নান অল্প গরম জলে করাটা আহিরীর অভ্যেস। সন্ধেয় কলেজ থেকে ফিরে গা ধোয়ার সময় গরম জল লাগে না। মা এই নিয়ে কম বকাবকি করেনি।

“এ আবার কী ব্যাড হ্যাবিট বানিয়েছিস আহি? দিনে গরম রাতে ঠান্ডা!‌ শরীর খারাপ করবে যে।’

আহিরী‌ বলে, “গরম জলে তেজ বাড়ে, ঠান্ডা জলে ক্লান্তি দূর হয়। মা, সকালে আমার তেজ দরকার। সারা দিনের ফুয়েল।”

“বাজে বকিস না।‌ অসুখে পড়লে বুঝবি।”

আজ সকালে ঠান্ডা জলেই স্নান সারতে হল। গ্যাসে যে একটু জল গরম করে নেবে সে সময়ও ছিল না।

তিন নম্বর রাগের কারণ একটা ছাই রঙের গাড়ি। কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে তার গাড়ি পার্ক করার জায়গায়।

আহিরী বাঁক নিল। ছাতাটা নেওয়া উচিত ছিল। মাথা গরমের কারণে ছাতা গাড়ি থেকে নিতে ভুলে গেছে। কম্পাউন্ডের পশ্চিম দিকে বিশাল বাড়ি তৈরি হচ্ছে। তার ছায়া এসে পড়েছে লনে। আগাছা, ইট, গর্তের জন্য লন দিয়ে হাঁটা যায় না। গেলে একটু শর্ট-কাট হত। আহিরী হাঁটার স্পিড বাড়াল।

কলেজের নতুন ভবন হচ্ছে। সাত না আট তলা হওয়ার কথা। চারতলা পর্যন্ত উঠে কাজ থমকে গেছে। টাকা–পয়সা নিয়ে কী নাকি গোলমাল। বাড়িটা শেষ হলে কলেজ অনেকটা বড় হয়ে যাবে। নতুন ফ্যাকাল্টি হবে। অনেক ডিপার্টমেন্ট সরে আসবে। পুরনো বাড়িতে জায়গার সমস্যা হয়। ছাত্র‌ছাত্রী অনেক বেশি হয়ে গেছে। অনেক সময় ক্লাসরুম পাওয়া যায় না। নতুন ভবনের কাজ বন্ধ হওয়া নিয়ে কলেজে টেনশন আছে। বেশ কয়েক বার গর্ভনিং বডির এমার্জেন্সি মিটিং হয়েছে। স্টুডেন্টস অ্যাজিটেশনও হয়েছে। কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে, শিগগিরই বড় গোলমাল পাকবে। আহিরী এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। টিচার্স রুমে কেউ কিছু বললে চুপ করে থাকে। চাকরিতে জয়েন করার আগে বাবা বলেছিল, “আহি, ‌এই প্রথম চাকরি করতে যাচ্ছিস, কয়েকটা জিনিস মাথায় রাখবি।”

সব কথা না মানলেও ‌বাবার পরামর্শ শুনতে আহিরীর ভাল লাগে। আসলে মানুষটাকেই তার খুব ভাল লাগে। মায়ের ঠিক উলটো। ঠান্ডা মাথা। ‘পারফেক্ট জেন্টলম্যান’ বোধহয় একেই বলে। একজন ভদ্রলোকের যা যা গুণ থাকা দরকার, বাবার মধ্যে তার সব ক’টাই আছে বলে আহিরীর ধারণা। এমনি এমনি তো মানুষ বড় হয় না। কমলেশ রায় আজ যে এত বড় চাকরি করেন, তার জন্য অনেক যোগ্যতা লাগে। বাষট্টি বছর বয়স হয়ে গেল, কোম্পানি তঁাকে ছাড়ার কথা ভাবতে তো পারছেই না, উলটে দায়িত্ব বাড়াচ্ছে।

ছোটবেলা থেকেই আহিরী দেখে আসছে, বাবা অন্য মানুষকে মর্যাদা দেয়। আচার-ব্যবহার, কথাবার্তা পছন্দ না হলে চুপ করে যায়, কিন্তু অপমান করে না। বাবা কখনও ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজ করেছে বলে আহিরী বিশ্বাস করে না। তার ‘না’ বলাটাও মার্জিত।‌ আবার কেউ বলতে পারবে না মানুষটা দাম্ভিক। হালকা বা তরল মনেরও নয়। তার চারপাশে সব সময়ে একটা কঠিন অথচ মধুর ব্যক্তিত্বের দেয়াল। একেই বোধহয় বলে প্লেজেন্ট পার্সোনালিটি। নিজের নীতি, আদর্শ থেকে মানুষটাকে সরানো কঠিন। আহিরী কত বার দেখেছে, চাকরি চাইতে বাড়ি পর্যন্ত লোক চলে এসেছে। আত্মীয়স্বজন, নেতাদের রেফারেন্স, এমনকী মায়ের পরিচিতজনও। হাতেপায়ে ধরেছে। বাবা ভদ্র ভাবে ফেরত পাঠিয়েছে। ছোটবেলার একটা ঘটনা খুব মনে পড়ে। আহিরী তখন ক্লাস নাইনে। ঠিক হল, ফান্ড তোলার জন্য তাদের স্কুলে বড় ফাংশন হবে। স্যুভেনিরে বিজ্ঞাপনের জন্য অনেক স্টুডেন্টের সঙ্গে আহিরীর হাতেও ফর্ম দেওয়া হল। যাদের বাবা-‌মা বড় চাকরি করে বা নিজে ব্যাবসা করে, তাদের কাছ থেকে মোটা টাকার বিজ্ঞাপন চাই। বাবা বিজ্ঞাপন দেয়নি। আহিরী অনেক আবদার করেছিল। কান্নাকাটি করতেও ছাড়েনি। বাবা তারপরও দেয়নি।

আমি যদি টাকার ব্যবস্থা করে দিই, স্কুল তোমাকে আলাদা চোখে দেখবে। তোমার ভুল ত্রুটি চট করে ধরবে না। শাসন করবার প্রযোজন হলে দশবার ভাববে,” বাবা বলেছিল।

আহিরী বায়না করেছিল, ‘‌‘বাবা, এটা আমার প্রেস্টিজ। প্লিজ তুমি দাও।”‌

“‌বাবার বিজ্ঞাপন দেওয়াটা কোনও মেয়ের প্রেস্টিজ হতে পারে না। লেখাপড়া করে নিজের প্রেস্টিজ তৈরি কর, আহি।”

আহিরী বলেছিল, “‌অনেকেই তো দিচ্ছে।”‌

বাবা বলেছিল, “‌অনেকে করলেই ভুল কাজ কখনও ঠিক হয় না। স্কুলের ফান্ড রেজ করবার জন্য স্টুডেন্টদের জড়ানো ঠিক নয়। এটা ভুল। আমি সমর্থন করি না। যে মেয়েরা দিতে পারবে না তারা হীনম্মন্যতায় ভুগবে। আইসোলেটেড ফিল করবে।”‌

সেই বয়সে যে প্রশ্ন করা যায় না, সেদিন আহিরী সেই প্রশ্ন করেছিল। সে ছোটবেলা থেকেই আর পাঁচ জনের থেকে পরিণত।

‘‌‘ভুল করেই না হয় দাও। বাবা, তুমি কি কখনও ভুল করোনি?‌”‌

আহিরীর মনে আছে, কমলেশ রায় সেদিন একটু চুপ করে গিয়েছিলেন। তারপর বলেছিলেন, “‌যদি করেও থাকি, আরও ভুল করবার জন্য সেটা কোনও লাইসেন্স নয়। এই বয়সেই সবটা বুঝতে পারবে না। বড় হলে পারবে।”

আহিরী বাবার কথা সেদিন বিশ্বাস করেনি। অসম্ভব, বাবা কখনও ভুল করতে পারে না। আহিরী স্কুল ছাড়ার পর এই মানুষটাই নিজে থেকে প্রতি বছর স্কুলে বড় অ্যামাউন্টের ডোনেশন পাঠিয়ে দেয়। কেউ জানতেও পারে না। বছর তিন হল জানতে পেরেছে আহিরী। স্কুলের এক পুরনো টিচারের সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল। বাবাকে জিজ্ঞেস করায় কিছু বলেনি, মুচকি হেসেছে শুধু। একে খুব পছন্দ না করে উপায় আছে?‌

কলেজে জয়েন করবার আগে বাবা যখন পরামর্শ দিয়েছে, আগ্রহ নিয়ে শুনেছে আহিরী।‌ কমলেশ রায় বলেছিলেন, “‌কাজের জায়গায় গিয়ে সব বিষয়ে মাথা ঘামাবি না। নিজের কাজে মন দিবি। আগে কাজের ব্যাপারে নিজেকে উপযুক্ত প্রমাণ করবি, তারপর অন্য কথা।”

এখনও পর্যন্ত বাবার কথা মেনে চলার চেষ্টা করে আহিরী। ছাত্রছাত্রীদের ছাড়া কোনও কিছু নিয়ে মাথা ঘামায় না। নতুন ভবনের গোলমাল নিয়েও কখনও কথা বলে না। তবে বাড়ি আটকে থাকার ঘটনাটা যে ধীরে ধীরে জট পাকাচ্ছে সেটা টের পায়।

আহিরী কবজি ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখল। সে মিনিট পাঁচ-‌সাত লেটে আছে।

কলেজ বিল্ডিং–এ ঢোকার সিঁড়িতে গোপাল রক্ষিতের মুখোমুখি হল আহিরী। থমকে দাঁড়াল।

“গোপালবাবু, গাড়িটা কার?‌”‌

গোপাল রক্ষিত অন্য কিছু ভাবছিল। থতমত খেয়ে বলল, “‌কোন গাড়ি দিদি?‌”‌

ভুরু কুঁচকে আহিরী বলল, “‌ওই যে পিছনে পার্ক করে রেখেছে। ছাই রঙের গাড়ি।”

গোপাল রক্ষিত বলল, “লাইব্রেরির পিছনে?‌ শেডের নীচে?‌”

আহিরী বিরক্ত গলায় বলল, “‌আবার কোথায় হবে?‌ এক বছর ধরে তো আমি ওখানে গাড়ি রাখছি। এত দিন তো কেউ ওখানে যায়নি। আজ হঠাৎ কার সাধ হল?”‌‌

গোপাল কলেজের সিকিয়োরিটি ইন-চার্জ। নতুন বাড়ি তৈরির সময় থেকে সে টেনশনে আছে। লক্ষ লক্ষ টাকার ইট, বালি, সিমেন্ট, লোহা পাহারার দায়িত্ব তার ঘাড়ে। মোটে ছ’‌জনের টিম নিয়ে এই কাজ করতে হয়। কোটি টাকার মালপত্রের তুলনায় এই সংখ্যা কিছুই নয়। তবে একটা সময় প্রায় তিরিশ-‌চল্লিশ জন লেবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে থেকে গেছে। বাড়ি যেখানে তৈরি হচ্ছিল তার পিছনে দরমা-‌বেড়ার ঘর বানিয়েছিল। অত লোক থাকলে চোর-‌ডাকাত ঢোকার সাহস পায় না। কাজ বন্ধ হয়ে যেতে এখন তারাও কেউ নেই। সবাই চলে গেছে। কলেজ ছুটি হয়ে গেলে শুনশান। পর পর ছুটির দিন থাকলে তো কথাই নেই। যতই কলকাতার মতো শহর হোক, যতই উঁচু পাঁচিলে ঘেরা কম্পাউন্ড আর বড় গেট থাকুক, কলেজ তো আর বড় রাস্তার ওপরে নয়! একটু ভেতরে ঢুকতে হয়। সামনের রাস্তাটা ফাঁকা। এ দিকে নতুন তিনটে তলায় জানলা-‌দরজা, গ্রিল, টাইলস বসে গেছে। সেসবও দামি জিনিস। কেউ খুলে নিয়ে গেলে ভাল দামে বিক্রি করতে পারবে। ফলে চাপ বেড়েছে। এই সময়ে সিকিয়োরিটির সংখ্যা বাড়ানো দরকার। অথচ কলেজ মানতে চাইছে না। এইমাত্র শর্মিষ্ঠা দত্তের সঙ্গে তার খানিকটা কথা কাটাকাটি হয়ে গেল। মহিলা খালি নিজেরটুকু দেখে। সে গিয়েছিল সিকিয়োরিটি বাড়ানোর আর্জি নিয়ে।

“‌ম্যাডাম, এই ক’জন সিকিউরিটি দিয়ে এত বড় বাড়ি পাহারা দেওয়া অসম্ভব।”

শর্মিষ্ঠা দত্ত অবাক হওয়ার ভান করে বললেন, “‌এত বড় বাড়ি কোথায়?‌ আটতলার মধ্যে মাত্র তিনটে তলা হয়ে পড়ে আছে। বাকি তো দাঁত বের করা ইট আর আখাম্বা কতকগুলো লোহার রড। বাড়ি কোথায় গোপাল? চুরি করবার মতো কী আছে ওখানে?‌‌”‌

গোপাল বলল, “ম্যাডাম, মালপত্র তো অনেক। মাত্র ছ’‌টা লোকে নজর রাখা যায়?‌ দিনে তিন জন, রাতে তিন জন থাকি। তার ওপর ছুটিছাটা আছে। কম করে আরও চার জন লাগবে। পুরনো এই বাড়িটাও তো দেখতে হয়। এখানেও তো কম্পিউটার, ল্যাবরেটরি ইকুপমেন্ট, এসি মেশিন, ফার্নিচার— সব আছে।”

শর্মিষ্ঠা দত্ত বললেন,‌ “‌তুমি কি খেপে গেলে?‌ আটকে থাকা বাড়ির জন্য এক ডজন পাহারাদার রাখব?‌ সরকার আমাকে ছেড়ে কথা বলবে?‌ সরকার কলেজে টাকা দেয় লেখাপড়া করার জন্য না পাহারাদার পোষার জন্য?‌ এক কাজ করো, কাজ যখন আটকে গেছে, তুমিও দু’জন লোক কমিয়ে দাও। আবার কাজ শুরু হলে দেখা যাবে।”

গোপাল আর্তনাদ করে ওঠে, “‌পাগল হয়েছেন ম্যাডাম?‌ দরজা-জানলা সব খুলে নিয়ে যাবে!”

শর্মিষ্ঠা দত্ত শান্ত ভাবে বললেন, “অডিটের লোকজন একদিন ঠিক তোমার মতোই বলবে, আপনি কি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন মিসেস দত্ত?‌ খোদ কলকাতায় একটা আধ-তৈরি বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য মাইনে দিয়ে এতগুলো লোক রেখেছিলেন!‌ না গোপাল, তুমি দেখো লোক কীভাবে কমানো যায়। ডিউটি ডবল করে দাও। জানলা-দরজা চোরে খুলে নিয়ে গেলে আবার হবে। সেটা অপচয় নয়। তার দায় আমার নয়। সেটা চুরি, পুলিশ দেখবে। টাকাপয়সার অপচয় হলে সব আমার ঘাড়ে পড়বে। উফ, এই আপদের জায়গা ছেড়ে যে কবে যাব! যা লেখাপড়া করেছিলাম সব তো ভুলতে বসেছি। লোহা, সিমেন্ট নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। কে জানে, এর পর হয়তো রাতে এসে তোমার সঙ্গে লাঠি হাতে বাড়ি পাহারা দিতে হবে।”

গোপাল মনে মনে গাল দিতে দিতে আসছিল। আহিরীর কথা পুরোটা বুঝতে সময় লাগল তার।

“‌আপনার জায়গায় কেউ গাড়ি রেখেছে দিদি?”‌

এবার একটু থমকে গেল আহিরী। ‘‌আপনার জায়গা’‌ কথাটা ঠিক নয়। কলেজে প্রথম দিকে গাড়ি এনে দেখেছিল, গেটের দিকে পার্ক করার উপায় নেই। ইতিমধ্যেই অনেকে গাড়ি রেখেছে। সকলেই চায় সিঁড়ি থেকে নেমে গাড়িতে উঠে বসতে। একটুও যেন হাঁটতে না হয়। একদিন জায়গা খুঁজতে খুঁজতে আহিরী শেষ পর্যন্ত কলেজের পিছনে গিয়ে একটা শেডও খুঁজে পেল। তার ছোট গাড়িটা অনায়াসে রাখা যাবে। রোদ-‌জল লাগবে না। সমস্যা একটাই, গাড়ি রেখে খানিকটা হাঁটতে হবে। সে আর কী করা। যারা আগে থেকে আছে তারা তো সামনেই গাড়ি রাখবে। আহিরী সেই শেডের নীচেই গাড়ি রাখছে। এক বছর পর আজ হঠাৎ দেখছে, শেডের নীচে অন্য গাড়ি। যতই রাগ হোক, জায়গাটাকে ‘‌‌নিজের’‌ বলা যায় না। কলেজের জায়গা।

“‌গোপালবাবু, আপনি কাউকে কিছু বলবেন না। শুধু কার গাড়ি খোঁজ নিয়ে আমাকে জানাবেন।”‌

গোপাল রক্ষিত বলল, “‌আচ্ছা দিদি, জানাব।”

আহিরী সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে মুখ ফিরিয়ে আবার বলল, “‌কাউকে কিছু বলবেন না যেন।”‌

শর্মিষ্ঠা দত্তর কাছে যাওয়া হল না আহিরীর। পরীক্ষার সময় হয়ে গেছে। অফিস থেকে জানল, তার ডিউটি থ্রি বি-‌তে। মানে তিন তলায়। অফিসের কর্মচারী নির্মাল্য খাতা গুছিয়ে দিয়ে বলল, ‌“‌কী ম্যাডাম, পর পর চার দিন ডিউটি পড়ে গেল?‌”

আহিরী ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপের হাসি হেসে বলল, “কী করব বলুন নির্মাল্যদা, জুনিয়র হওয়ার খেসারত দিচ্ছি।”

নির্মাল্য গলা নামিয়ে বলল, ‘‌‘হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্টকে বললেন না কেন?‌ আর কারও তো পর পর ডিউটি পড়েনি। মাঝখানে একটা দিন অফ পড়েছে। আপনার একার কেন পড়বে?‌”‌

আহিরী বলল, “‌বলেছিলাম। উনি বললেন, এগজাম ডিউটি নাকি শর্মিষ্ঠা দত্ত নিজে দেখছেন। তিনি চেয়েছেন, আমি রোজ ডিউটি দিই।”

নির্মাল্য বলল, “‌ও, তা হলে আর কী করবেন।”

আহিরী দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “‌ঠিক করেছি, আজ ওঁর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করব। আমার কোয়ালিফিকেশনের কোন অংশটা দেখে ওঁর মনে হয়েছে, পরীক্ষা-হলে আমি ভাল গার্ড দিতে পারি?‌ অনার্স-মাস্টার্সে ভাল রেজাল্ট করলে বুঝি এক দিনও গ্যাপ ছাড়া পরীক্ষা-হলে টহল মারতে হয়?‌”

নির্মাল্য চাপা গলায় বলল, “‌অবশ্যই জিজ্ঞেস করুন। এসব আর কিছুই নয়। বদমাইশি। দেখবেন এই মহিলা শিগগিরই খুব বড় ঝামেলায় ফাঁসবে।”

পরীক্ষার মাঝখানেই গোপাল এসে খবর দিয়ে গেল, সাদা গাড়ি জিয়োগ্রাফির প্রমিত তরফদারের। এত দিন ড্রাইভার এসে ছেড়ে যেত, এবার থেকে গাড়ি কলেজে থাকবে। আহিরীর বিরক্তি বাড়ল। সামান্য বিষয়, কিন্তু নতুন ফ্যাকড়া তো বটেই। দূর, আর গাড়িই আনবে না সে। ক্যাব ডেকে চলে আসবে। এমএ পাশ করার পর বাবাই গাড়ি চালানো শিখিয়েছিল। মায়ের আপত্তি ছিল। মা পুরনো বিশ্বাস-‌অবিশ্বাস থেকে বেরোতে পারে না। মেয়েদের সম্পর্কে তার মত হল, “‌লেখাপড়া শেখো, চাকরি করো, কিন্তু অতিরিক্ত লাফালাফি কোরো না। মনে রেখো, শেষ পর্যন্ত তোমাকে ভাল একটা বিয়ে করে সংসারে থিতু হতে হবে।”

একমাত্র সন্তান আহিরীকেও তিনি এই প্রাচীন বিশ্বাসে চালাতে চান। পারেন না। কলেজে পড়ার সময়েই সে মাকে বলে দিয়েছে, “‌মা, অনেক কাল বাঙালি মেয়েরা বসে বসে জীবন কাটিয়েছে, এবার তাদের লাফাতে হবে। কত লাফ বাকি তোমার ধারণা আছে?‌ সব সুদে-আসলে তুলতে হবে না?‌”

“যা গিয়ে লাফা। গোল্লায় যা।”‌

আহিরী মায়ের দু’কাঁধে হাত রেখে হাসিমুখে বলেছিল, “‌চিন্তা কোরো না, লাফ শুরু করে দিয়েছি। আজ কলেজে সিগারেট খেয়েছি। গোটা একটা সিগারেট। ছেলেরা বলেছিল, দু’টানেই কাশতে কাশতে মরে যাবি। একটুও কাশিনি। বাট ভেরি ব্যাড টেস্ট। আর খাব না। বিশ্বাস হচ্ছে না?‌ আচ্ছা, আমার মুখের গন্ধ শুঁকে দেখো।”

মেয়ে মুখ এগোলে নবনী ছিটকে গিয়েছিলেন। আহিরী হেসে বলেছিল, “‌এবার তোমাকে আর একটা লাফানোর খবর দেব। পোল ভল্ট টাইপ। এই সামারে আমি আর কেমিস্ট্রির তপা যাচ্ছি জুলুক। তিব্বতের বর্ডার। জায়গাটা ছবির থেকেও একটু বেশি সুন্দর। গরমের সময়ে জুলুক রডোডেনড্রনে ছেয়ে যায়। আমি এবং তপা, আমরা দু’জনেই সুন্দরী এবং অ্যাট্রাকটিভ বলে কলেজের অনেক ছেলে আমাদের সঙ্গে ভিড়তে চাইছে। তুমি শুনে খুশি হবে মা, আমরা তাদের মধ্যে দু’‌জনকে ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে বেছে নিয়েছি। দু’জন মেয়ের সঙ্গে দু’‌জন ছেলে।’

নবনী আঁতকে উঠে বলেছিলেন, “‌কী বলছিস!‌” আহিরী মাকে ছেড়ে দিয়ে ধপাস করে বিছানায় বসে পড়ে বলল, “‌ঠিকই বলছি। ইন্টারভিউতে প্রশ্ন ছিল খুবই সহজ। একটা পাজল। পাজলটা হল— পাহাড়ি পথের ধারে, বলো দেখি কে অপেক্ষা করে?‌ মোট কুড়িটা ছেলে উত্তর দিয়েছে। কেউ বলেছে ফুল, কেউ বলেছে ঝরনা, কেউ বলেছে কুয়াশা, কেউ বলেছে প্রেমিকা। সব ক্যানসেল। মাত্র দু’জনের জবাব আমাদের মনে ধরছে। তাদের আমরা নিয়েছি। এরা কে কী বলেছে জানতে চাও?‌”‌

নবনী বিস্ফারিত চোখে বলেন, “‌তুই ছেলেদের সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছিস!‌”

আহিরী মুচকি হেসে বলে, “‌শুধু তাই নয়, টেন্টেও আমরা ভাগাভাগি করে থাকব। ওনলি ফর লেডিজ বলে কিছু থাকবে না। পাহাড়ে নারী পুরুষে ভাগাভাগি করা যায় না। প্রকৃতি জেন্ডার ডিভিশন পছন্দ করে না।”

সেদিন আর কথা বাড়াননি নবনী। ‌এই মহিলা যে মেয়ের গাড়ি চালানো নিয়ে আপত্তি করবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী! নবনী স্বামীকে বলেছিলেন, “‌আহি গাড়ি চালিয়ে কী করবে? আমাদের‌ ড্রাইভার আছে, তোমার অফিসের গাড়ি আছে, তুমি নিজে গাড়ি চালাতে পারো। আর কী লাগবে?‌”

কমলেশ রায় হেসে বলেছিলেন, “‌তোমার যদি মাঝরাতে ময়দানে হাওয়া খেতে ইচ্ছে করে নবনী?‌ অত রাতে তো ড্রাইভার পাবে না। আমিও ঘুমোব। মেয়েই তখন ভরসা। তোমাকে নিয়ে যাবে।”‌

‌“‌কলকাতার রাস্তাঘাট এখন খুব বাজে। সারাক্ষণ শুধু অ্যাক্সিডেন্ট হচ্ছে।”

আহিরী বলেছিল, “‌মা, স্ট্যাটিসটিক্স বলছে, মেয়েরা অনেক কম অ্যাক্সিডেন্ট করে। তারা বেশি অ্যালার্ট, ধীরস্থির। ডোন্ট ওরি। খুব শিগগিরই তোমাকে আর বাবাকে নিয়ে আমি লং ড্রাইভে যাব। চলো, দোলের সময় আমরা শান্তিনিকেতন যাই।”

নবনী জোর গলায় বলেছিলেন, “‌যাব না।”‌

শেষ পর্যন্ত অবশ্য যাওয়া হয়েছিল।‌ বর্ধমান পর্যন্ত কমলেশ গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যান। বাকি পথ স্টিয়ারিং ধরেছিল আহিরী। সুন্দর নিয়ে গেছে। রাস্তা কোনও কোনও জায়গা খারাপ ছিল। তার পরেও ঝাঁকুনি কম দিয়েছে। যদিও নবনীকে প্রথম দিকটা দেখে মনে হচ্ছিল, দম বন্ধ করে বসে আছেন।

গাড়ি নিয়ে কলেজে এলে সুবিধে হয়। খরচ কম। তার থেকে বড় কথা, দেরি করে বাড়ি থেকে বেরোনো যায়। বাস, ক্যাব, মেট্রোর জন্য তাড়াহুড়ো করতে হয় না। কলেজের পর দরকার মতো এ দিক-সে দিক যাওয়া যায়। বিতানের সঙ্গে দেখা করাটা সহজ হয়। দু’জনে এ দিক-ও দিক চলে যায়। বিতান রসিকতা করতে ছাড়ে না।

“‌রূপকথায় পড়েছি, রাজকুমার ঘোড়া নিয়ে এসে দাঁড়াত, রাজকন্যা লাফ দিয়ে উঠত পিঠে। রাজকুমার তখন ঘোড়া ছোটাত টগবগ টগবগ। এখন হচ্ছে উলটো। রাজকন্যা গাড়ি নিয়ে আসছে, রাজকুমার দরজা খুলে লাফ দিয়ে উঠছে। রাজকন্যা গাড়ি ছোটাচ্ছে সাঁইসাঁই করে।”‌

আহিরী গিয়ার বদলে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দেয়। বলে, “‌তাও তো তুমি নিজেকে রাজকুমার ভাবতে পারছ।”

বিতান হেসে বলে, “‌বেকার রাজকুমার।”‌‌

নিজের গাড়িতে চড়ে অভ্যেস হয়ে গেছে আহিরীর। এখন গাড়ি ছাড়া চলাচল করতে অসুবিধে হয়। গাড়ি ছাড়া কলেজে এলে সিস্টেমে গোলমাল হয়ে যাবে।

পরীক্ষা চলার সময় দোতলা থেকে হালকা হট্টগোল ভেসে আসছিল। আহিরী গা করল না। কে জানে, ঝগড়া-টগড়া লেগেছে হয়তো। তিন নম্বর রো–‌এ একটা মেয়ে ওড়নার নীচে মোবাইল রেখে উত্তর টুকছিল। আহিরী তাকে হাতেনাতে ধরল। পুরুষ ইনভিজিলেটর হলে ধরা কঠিন ছিল। ছাত্রী হোক আর যাই হোক, সে তো একটা মেয়েকে বলতে পারত না, “‌দেখি তোমার ওড়নাটা সরাও তো।” বললে তুলকালাম কাণ্ড হয়ে যেত। এই মেয়ে সম্ভবত সেই ভাবেই তৈরি হয়ে এসেছিল। ভাবতে পারেনি, তার ঘরেই কোন ম্যাডাম গার্ড দেবে।

আহিরী কাছে গিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল, “‌দাও, মোবাইলটা দাও।”‌

‘‌‘আর হবে না ম্যাডাম।”‌

আহিরী কড়া গলায় বলল, “‌মোবাইলটা দাও।”‌

মেয়েটি কাঁপা হাতে মোবাইল এগিয়ে দিল।

“‌তোমার নাম কী?‌”

“‌আর করব না।”

আহিরী কড়া গলায় বলল, “‌নাম কী তোমার? কোন ইয়ার?‌”‌

মেয়েটি মাথা নামিয়ে বলল, “‌উর্বী সেন। সেকেন্ড ইয়ার।”

‌আহিরী ‌বলল, “‌এখনই এসব শুরু করে দিলে? ‌‌মোবাইলে কে তোমাকে উত্তর পাঠাচ্ছে?‌”

উর্বী নামের মেয়েটি চুপ করে রইল। আহিরী বলল, “‌আর ক’দিন পরীক্ষা বাকি আছে?‌”‌

“‌দু’দিন ম্যাম।”‌

আহিরী বলল,‌ “‌ইচ্ছে করলে আমি তোমার খাতায় নম্বর মাইনাস করে দিতে পারি। খাতা ক্যানসেলও করে দিতে পারি। কিন্তু আমি সেসব কিছু করছি না। পরীক্ষা দাও। মোবাইল আমার কাছে রইল। অফিসে জমা থাকবে। দু’দিন পরে পাবে। এটাই তোমার পানিশমেন্ট।’‌‌‌’

পরীক্ষা শেষ হলে, অফিসে খাতা দিল আহিরী। বাজেয়াপ্ত করা মোবাইল ফোন জমা দিতে গেলে নির্মাল্য বলল, “‌এটা কী?‌”‌

“সেকেন্ড ইয়ারের উর্বী সেন। ফোন দেখে টুকছিল। এক দিন আটকে রেখে দিয়ে দেবেন।”

নির্মাল্য হেসে বলল, “‌বাপ রে, মোবাইল নিয়েছেন!‌ এর থেকে ওকে আটকে রাখলে বেঁচে যেত। এখনকার ছেলেমেয়েরা মোবাইল ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারে না।’‌‌’

আহিরী বলল, “শুধু ছেলেমেয়েদের দোষ দিয়ে কী হবে?‌ আমরাও কি পারি?‌‌”

টিচার্স রুমে এল আহিরী। ব্যাগ গুছিয়ে নিল। এবার শর্মিষ্ঠা দত্তর কাছে যাবে। গিয়ে বলবে, পরীক্ষার আর দু’দিন বাকি রয়েছে। আর যেন তাকে ডিউটি না দেওয়া হয়। এবার যারা দেয়নি, তারা দেবে। তার পরেও যদি রোস্টারে তার নাম রাখা হয়, সেও ব্যবস্থা নেবে। সিক লিভ নিয়ে নেবে।

যতটা সম্ভব মাথা ঠান্ডা করে টিচার্স রুম থেকে বেরোল আহিরী। দোতলায় টিচার-ইন-চার্জের অফিস। সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই শুনতে পেল, ওপরে হইহট্টগোল হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীরা চিৎকার করছে। কী বলছে বোঝা যাচ্ছে না। থমকে দাঁড়াল আহিরী। ঝনঝন করে কাচ ভেঙে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাটির কিছু একটা ভাঙা হল। তারপর চেয়ার ওলটানোর আওয়াজ। আহিরী কী করবে বুঝতে পারছে না। সে কি ওপরে যাবে?‌ আবার ভাঙচুরের আওয়াজ। এবার নীচেও ছেলেমেয়েরা ছোটাছুটি করছে। দুদ্দাড় করে ওপরে উঠছে। আহিরী এগোতে গিয়ে দেখল, গোপাল রক্ষিত দু’‌জন সিকিয়োরিটি গার্ডকে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে আসছে।

“‌কী হয়েছে?‌” উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল আহিরী।

“‌জানি না দিদি। শর্মিষ্ঠা ম্যাডাম ফোন করে ডেকে পা‌ঠালেন। সায়েন্সের কোয়েশ্চেনে কী গোলমাল হয়েছে বলে ছেলেমেয়েরা নালিশ করতে গিয়েছিল, ম্যাডাম ভাগিয়ে দিয়েছে। ওরা ঘরের বাইরে এসে ভাঙচুর শুরু করেছে। আপনারা ওপরে যাবেন না।”

ততক্ষণে আরও টিচাররা চলে এসেছে। সিঁড়ির মুখে জটলা। জানা গেল, অর্কপ্রভ সেন সিলেবাসের বাইরে থেকে প্রশ্ন করেছেন। পরীক্ষা চলার সময়ে ছেলেমেয়েরা তাঁকে জানায়। উনি বলেছেন, “‌এটা প্রাইমারি স্কুল নয় যে যা পড়াব তাই পরীক্ষায় আসবে। পরীক্ষা দিলে দেবে, না দিলে না দেবে।”‌ পরীক্ষার পর ছেলেমেয়েরা টিটার-ইন-চার্জের ঘরে গেলে তিনি যাচ্ছেতাই বলে প্রায় গলাধাক্কা দিয়েছেন। ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে এসে দরজার কাচ ভেঙেছে। করিডরে রাখা মাটির টব ভেঙেছে।

এবার ওপরে স্লোগান শুরু হল, “‌নতুন ভবনের কোটি টাকা কোথায় গেল, শর্মিষ্ঠা দত্ত জবাব দাও।”‌

সিকিয়োরিটির লোকরা ওপরে গেলে ছাত্রদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু হয়। কিছু ক্ষণের মধ্যেই ঘটনা জটিল দিকে বাঁক নিল। ছাত্রদের মারা হয়েছে এবং ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি করা হয়েছে, এই অভিযোগে কলেজের মেন গেট আটকে ছেলেমেয়েরা সিঁড়িতে বসে পড়ে। টিচারদের কলেজ থেকে বেরোতে দেওয়া হবে না। জানা গেল, শ্লীলতাহানির অভিযোগ এনেছে সেকেন্ড ইয়ারের উর্বী সেন নামে এক ছাত্রী। নাম শুনে আহিরী অবাক হল। এই মেয়ে মোবাইল থেকে টুকছিল না?‌

কর্মজীবনে এই ধরনের পরিস্থিতিতে আহিরী আগে কখনও পড়েনি। আজ বিতানের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। সে ফোন বের করে নম্বর টিপল।

“‌যেতে পারছি না।”

বিতান মুখে চুকচুক আওয়াজ করে বলল, “‌ইস, আমি সেভ করে, চুল আঁচড়ে, ভাল শার্ট পরে তৈরি হলাম আর তুমি বলছ যেতে পারছি না। একটু পরেই না হয় এলে!”

“‌ঠাট্টা কোরো না। বেরোতে রাত হতে পারে।”‌

বিতান আঁতকে উঠে বলল,‌ “অ্যাঁ!‌ কলেজের প্রফেসরদেরও কি নাইট ডিউটি শুরু হল?‌ ভাগ্যিস লেখাপড়া শিখিনি!”‌

আহিরী গলা নামিয়ে বলল, “‌ঘেরাও হয়েছি। স্টুডেন্টরা গেট আটকে বসে পড়েছে। চিৎকার শুনতে পাচ্ছ না?‌”

বিতান বলল, “‌এই রে‌! আমি যাব?‌”‌

আহিরী বলল, “‌কী করবে?‌ আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে‌?‌”‌

বিতান চিন্তিত হওয়ার ভান করে বলল, “‌তাও তো বটে। আমি গিয়েই বা কী করব? তার পরেও যদি বলো, তোমার বিপদের সময় পাশে না থাকাটা কি ঠিক হবে…”‌

বিতানের নাটকীয় ভাবে বলার ঢঙে আহিরী হেসে ফেলল। বলল, “‌আমার কোনও বিপদ হয়নি। ঠাট্টা বন্ধ করে তুমি নেক্সট উইকের জন্য ঠিকমতো তৈরি হও।”

বিতান বলল, ‘‌‘কী আর তৈরি হব? বাড়িতে বলে পড়ার তো কিছু নেই।‌ কোয়েশ্চেন তো সবই আনকমন। তার থেকে একজন জ্যোতিষীর কাছে গেলে কেমন হয়?‌”

আহিরী অবাক গলায় বলল, “জ্যোতিষী!‌”

‘‌‘চমকে উঠলে কেন?‌ একটা চান্স নিতাম। যদি কোয়েশ্চেনের প্যার্টান বলে দিতে পারে। আজকাল জ্যোতিষীরা নানা রকম অ্যাপ ব্যবহার করছে। সেসব কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতের কাছাকাছি যদি আসতে পারে।”

‌আহিরী কথার মাঝখানেই বলল, “‌প্লিজ বি সিরিয়াস। বিতান, এবার তোমার ভদ্রস্থ একটা কাজ পাওয়া খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।”

বিতান একটু চুপ করে থেকে সামান্য হেসে বলল, “‌ভদ্রস্থ কাজ পেতে হলে একজন ভদ্রলোক হতে হবে তো। আহিরী, আমি তো প্রপার ভদ্রলোকই নই।”

আহিরী নিজের ভুল বুঝতে পারল। কথাটা বেশি রুক্ষ হয়ে গেছে। এভাবে বলাটা ঠিক হয়নি। ‌সে চাপা গলায় বলল, “‌স্যরি। আমি ওভাবে বলিনি। তুমি একটা ভাল চাকরিবাকরি পেলে আমার ভাল লাগবে। তুমি ঠিক পাবে। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।’‌‌’

বিতান অল্প হেসে ‌বলল, “আরে বাবা, আমি কিছু মনে করিনি। আমাকে কখনও মনে করতে দেখেছ?”

আহিরী নরম গলায় বলল, “সেই জন্যই তোমাকে বলি। এখন রাখছি। দেখি, গোলমাল কত দূর গড়াল।’

ফোন বন্ধ করে আহিরী টিচার্স রুমে আসে। বিতানের জন্য তার মন কেমন করে উঠল।

“তোমার বাবার নাম কী?”

“স্যর, বাবার নাম শ্রীদেবাদিত্য বসু, মায়ের নাম শ্রীমতী শ্রীকণা বসু।”

কমলেশ রায় এতক্ষণ টেবিলে রাখা কাগজপত্র নাড়াচাড়া করতে করতে টুকটাক কথা বলছিলেন। তাঁর মাথা বেশির ভাগ সময়েই ছিল নিচু। মাঝে মাঝে হাত বাড়িয়ে বোন-চায়নার ফিনফিনে সাদা কাপ তুলে চুমুক দিচ্ছিলেন আলতো করে। কাপের গায়ে সরু সোনালি বর্ডার। চায়ের রংও সোনালি। দার্জিলিঙের ক্যাসলটন বাগানের চা। এই চা শুধুমাত্র জেনারেল ম্যানেজার এবং তার চেম্বারে আসা লোকজনকে দেওয়া হয়। চওড়া টেবিলের উলটো দিকে বসা ছেলেটির সামনেও একই রকম কাপে চা দেওয়া হয়েছে। পাশে একটা ছোট প্লেটে কয়েকটা কুকিজ। ছেলেটি এখনও পর্যন্ত কোনওটাই ছোঁয়নি। হাত গুটিয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে। এ ঘরে তার জড়সড় হয়ে বসে থাকারই কথা। কোনও অফিসে জেনারেল ম্যানেজারের ঘরে নতুন কোনও এমপ্লয়ি ঢুকলে সে খানিকটা জড়সড় হয়েই থাকে। যথেষ্ট স্মার্ট হলেও থাকে। এই ছেলেও প্রথম ঢুকেছে। চাকরির ইন্টারভিউয়ের সময় কমলেশ রায়কে একে দেখেছিল। কনফারেন্স রুমে তিনি অনেকের সঙ্গে বসেছিলেন। কোনও প্রশ্ন করেননি। মুখ তুলেও তাকাননি। ফাইল দেখছিলেন। সেও তো অনেক দিন হয়ে গেল।

ছেলেটির জবাব শুনে কমলেশ রায় ভুরু কোঁচকালেন। ভুরু কোঁচকানো অবস্থাতেই মুখ তুললেন।

“কী নাম বললে?”

ছেলেটি গলা নামিয়ে বলল, “দেবাদিত্য বসু এবং শ্রীকণা বসু।”

এতক্ষণ এই ছেলেটির চোখের দিকে কমলেশ সেভাবে তাকাননি। ঘরে ঢোকার সময় এক ঝলক দেখেছেন। ঝকঝকে চেহারা। সুদর্শন এবং স্মার্ট। কালো ট্রাউজারের ওপর হালকা নীল চেকের সরু ফর্মাল শার্ট পরেছে। তখনও চোখমুখ খেয়াল করেননি। এবার করলেন। ছেলেটির চোখে এক ধরনের মায়া রয়েছে। খুব প্রকট কিছু নয়, ছায়ার মতো লেগে আছে। নজর করে দেখলে বোঝা যায়। পুরুষমানুষের চোখে মায়া মানায় না। এই ছেলেটির ক্ষেত্রে মানিয়েছে।‌‌ তাকে সুন্দর লাগছে।

কয়েক মুহূর্তের অস্বস্তি। নিজেকে দ্রুত সামলালেন কমলেশ। ফের কাপ তুলে আলতো চুমুক দিলেন। ধুস, এসব কী ভাবছেন!‌ কর্মচারীর চোখে মায়া না নিষ্ঠুরতা তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন কেন? ভুরু কোঁচকানোর মতোই বা কী ঘটেছে? শ্রীকণা অন্য কারও নাম হতে পারে না? কমলেশ নাম কি শুধু তঁার একারই র‌য়েছে? মোটেও নয়। জগতে কত জনের নাম যে ‘কমলেশ’ তার ঠিক নেই।‌ স্কুলেই তো আরও দু’জন কমলেশ ছিল। ছেলেরা সকলকে আলাদা আলাদা নামে ডাকত। একজন ছিল লম্বা। তাকে ডাকা হত ‘ঢ্যাঙা কমলেশ’। দ্বিতীয় কমলেশেরও একটা নাম ছিল।‌‌ ক্লাস এইটে এসে ভরতি হল সেই ছেলে। নাকি নাইনে? ছোটখাটো চেহারা। নামটাও হয়েছিল মজার। কী যেন নাম? নাহ্‌, এখন আর মনে পড়ছে না। তবে নিজেরটা মনে আছে। বন্ধুরা তাকে ডাকত ‘ফুল মার্কস কমলেশ’। পরীক্ষায় ফুল মার্কস পাওয়ার কল্যাণে এই নাম। কেউ কেউ ছোট করে বলত, ‘ফুল কমলেশ’। ছোটকাকা এই নাম শুনে বলল, “ঠিকই আছে। ফুল মার্কস পাওয়া ছেলেরা বেশির ভাগ সময়ই ‘ফুল’ হয়। স্কুল-‌কলেজের পরীক্ষার নম্বর নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে থাকে যে জীবনের বাকি পরীক্ষাগুলোয় কখন জিরো পেয়ে বসে আছে জানতেই পারে না। যখন জানে তখন নিজেকে বোকা মনে হয়।”

‘কমলেশ’ এতগুলো থাকলে, ‘শ্রীকণা’ থাকতে অসুবিধে কী? এবার মনে মনে লজ্জা পেলেন কমলেশ। জীবনের অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। নদীতে অনেক ঢেউ এসেছে, আবার চলেও গেছে নিজের মতো। তীরে পড়ে থাকা নুড়ি–পাথরের দাগ বারবার মুছে দিয়েছে। নুড়ি পাথরের সেই সব দিনগুলোর কথা কেউ মনে রাখে না। তিনিও রাখেননি।

সামনে বসা ছেলেটির প্রতি আরও একবার প্রসন্ন হলেন কমলেশ। এই ছেলে সত্যি ভাল। সাধারণ ‘ভাল ছেলে’দের‌ মতো নয়, তার থেকে বেশি ভাল। বাবার নাম জিজ্ঞেস করায়, একসঙ্গে মায়ের নামও বলল। বাঙালি ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই অভ্যেস একবারেই নেই। যেন বাবার পরিচয়ই শেষ কথা। মায়ের কথা মনে থাকে না। যুগ যুগ ধরে এই বিশ্রী অভ্যেস চলে আসছে। তিনি নিজেও তো তাই। কখনও কি বাবার সঙ্গে মায়ের নাম বলেছেন? মনে পড়ছে না। এখন কি আর এই অভ্যেস বদলানো যাবে? এই বয়সে? অবশ্য এখন তো আর কেউ তাঁকে বাবা-মায়ের নাম জিজ্ঞেস করবে না। করলে ভাল হত। নিজেকে শুধরে নেওয়া যেত।

কমলেশ নরম গলায় বললেন, “তোমার বাড়ি কোথায় সৌহার্দ্য?”

“স্যর, এখন টালিগঞ্জে। আগে থাকতাম‌ হুগলিতে, জনাইয়ের কাছে।”

“জনাই!‌ এক সময়ে ওখানে আমার এক মাসি থাকতেন। বাড়িতে পুজো হত। ছোটবেলায় যেতাম। জনাইয়ের কোথায়?”

“ঠিক জনাইতে নয় স্যর। আরও খানিকটা যেতে হত। গ্রামের নাম ছায়াপাতা।”

কমলেশ বললেন, “ছায়াপাতা!‌ এই না‌মের মানে কী?”

“এই নামে ‌আমাদের গ্রামে একটা নদী আছে। মনে হয় সেখান থেকে গ্রামের নাম হয়েছে।”

কমলেশ অল্প হেসে বললেন, “নদীর নাম ‌ছায়াপাতা!‌ সুন্দর নাম।”

“নদী ছোট স্যর। গরমের সময় হেঁটে পার হওয়া যেত।”

কমলেশ একটু অবাক হলেন। এই ছেলের হাবভাব, কথাবার্তার মধ্যে গ্রাম, নদীর চিহ্নমাত্র নেই। তার বদলে যদি বলত, ছোটবেলায় মুম্বইয়ের দাদার বা বেঙ্গালুরুর কোরামঙ্গলায় থাকতাম, তা হলে মানাত। নিশ্চয়ই অনেক ছোটবেলায় চলে এসেছে। কমলেশ নিজেকে সামলে বললেন, “ভেরি গুড। ‌নিজেদের বাড়ি?”

“হ্যাঁ স্যর। নিজেদের বাড়ি ছিল।”

ছিল!‌ এখন নেই? কমলেশ ভুরু কোঁচকালে সৌর্হাদ্য নিজে থেকেই বলল, “বাবা মারা যাওয়ার পর আমি আর মা কলকাতায় চলে আসি। আমি অবশ্য তার আগে থেকেই কলকাতার হস্টেলে থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শুরু করেছিলাম।”

কমলেশ নিচু গলায় বললেন, “ওহো, স্যরি।”

অফিসের কর্মচারীদের সঙ্গে এত ব্যক্তিগত স্তরে নেমে কমলেশ কথা বলেন না। কর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব রাখাটা ম্যানেজারদের ডিউটির মধ্যে পড়ে। তাঁর মতো জেনারেল ম্যানেজারের জন্য তো বটেই। ভীষণ জরুরি কিছু না থাকলে জেনারেল ম্যানেজারের ঘরে তার ঢোকার সুযোগও পাওয়ার কথা নয়। সৌহার্দ্য অবশ্য এই ঘরে নিজে থেকে ঢোকেনি, তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। কমলেশ নিজেই ডেকেছেন। গত শনিবার লাঞ্চের পর ফিনান্স ম্যানেজার মনোজ ত্রিপাঠী ইন্টারকমে তাঁকে ধরেন। সবাই ‘ত্রিপাঠী’ নামে চেনে। এই অফিসে তঁার পজিশন কমলেশ রায়ের পরেই। কমলেশ সব বিষয়ে এঁর ওপর নির্ভর করেন।‌

ত্রিপাঠী বলল, “স্যর, দশ মিনিট টাইম দিতে হবে।”

কমলেশ বলেছিলেন, “অসম্ভব। গাদা কাজ নিয়ে বসে আছি। তোমরা যেখানে যত জট পাকাও, আমাকে খুলতে হয়। আজ শনিবার ভেবেছিলাম তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাব, বুঝতে পারছি রাত হয়ে যাবে। এবার চাকরিবাকরি ছেড়ে পালাব।”

ত্রিপাঠী হেসে বললেন, “আপনি তো কম বার পালাতে চেষ্টা করেননি স্যর। রেজিগনেশন পাঠিয়ে দিয়েও মুক্তি পাননি। কোম্পানি ছাড়েনি। ছাড়বেও না। আপনি যত ব্যস্ত থাকুন, আমি আপনার ঘরে যাচ্ছি স্যর। নতুন প্রোজেক্টের ফাইলটা কালকের মধ্যে ব্যাঙ্কে না পাঠালে লোন আটকে যাবে। এই নিয়ে ওরা তিন বার অ্যালার্ট করেছে। আজও তো রীতিমতো থ্রেট করল। বলল, আর দেরি করলে লোন প্রোপোজাল ক্যানসেল হয়ে যাবে।”

কমলেশ বললেন, “তুমি ছেড়ে দাও ত্রিপাঠী।”

ত্রিপাঠী বললেন, “হবে না স্যর। কয়েকটা বিষয় আপনাকে ওয়াকিবহাল করতে হবে। অত টাকার ব্যাপার, ব্যাঙ্ক যখন-তখন ফোন করে আপনার কাছে কোয়্যারি করতে পারে। জাস্ট ফিফটিন মিনিটস স্যর।”

সেই পনেরো মিনিটের মিটিং-এই সৌহার্দ্যের ঘটনা জানতে পারলেন কমলেশ। কাজ করতে করতেই ত্রিপাঠী বলে দিলেন।

“অফিসে নতুন একটি ছেলে অ্যাকাউন্টসের অদ্ভুত একটা ভুল ধরেছে।”

কমলেশ বলেন, “অ্যাকাউন্টসে কাজ করা ছেলে, হিসেবে ভুল ধরেছে এ আর ইন্টারেস্টিং কী হল? তার কাজই তো ভুল ধরা।”

ত্রিপাঠী হেসে বলেন, “না স্যর, ওই ছেলে অ্যাকাউন্টসে জয়েন করেনি, হি ইজ অ্যান ইঞ্জিনিয়র। আমরা নতুন প্রোজেক্টের জন্য নিয়েছি। বাচ্চা ছেলে, কিন্তু ইতিমধ্যেই এক্সপিরিয়েন্স-রিচ। বেশ ক’টা কোম্পানিতে কাজ করে এসেছে। ইন্টারভিউয়ের স‌ময় আপনি ছিলেন।”

কমলেশ বললেন, “মে বি।‌ মনে নেই আমার। ওর হাতে অ্যাকাউন্টস গেল কী করে?”

ত্রিপাঠী বললেন, “প্রোজেক্ট তৈরির সময় ও হিসেবপত্রের কিছু কাগজ চেয়েছিল, ভায়াবিলিটি প্রোজেকশন তৈরি করতে। তখনই ভুলটা মার্ক করেছে। তারপর কম্পিউটারে বেশ কয়েক বছরের ট্যাবুলেশন দেখে, ভুল সম্পর্কে কনফার্মড হয় আর আমাকে জানায়। আশ্চর্যের বিষয়, বেশ কয়েক বছর ধরে এই ভুল চলছিল। ফলে অতি সামান্য হলেও কোম্পানিকে একটা লোকসান বেয়ার করতে হয়েছে। সেই লোকসানের পরিমাণ বিন্দুর মতো, কিন্তু এত বছরের বিন্দু যোগ করলে পরিমাণ একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয় স্যর। হিসেবের এমন জায়গায় ভুলটা মাথা নিচু করে লুকিয়ে ছিল যে কারও চোখে পড়েনি। ছেলেটি ধরল।”

কাজ থামিয়ে দেন কমলেশ। মুখ তুলে প্রশংসা ভরা গলায় বলেন, “‌বাহ্‌, নাম কী ছেলেটির?”

ত্রিপাঠী উৎসাহের সঙ্গে বলে, “সৌহার্দ্য, সৌহার্দ্য বোস। সবে জয়েন করেছে।”

কমলেশ বললেন, “ছেলেটির সঙ্গে আমার আলাপ করতে ইচ্ছে করছে।”

ত্রিপাঠী এবার আরও উৎসাহ নিয়ে বলেন, “করুন না স্যর, খুব ভাল হয়। ছেলেটির ভাল লাগবে। তা ছাড়া.‌.‌.‌ তা ছাড়া এই ধরনের কাজ করলে কোম্পানি পাশে থাকে, সেটাও বুঝবে।”

কমলেশ বললেন, “ঘটনাটা অফিসের সবাই জেনেছে?”

“সবাই নয়, অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টের স্টাফরা জেনেছে। তবে বুঝতেই তো পারছেন, বিষয়টা এমন নয় যে সবার পছন্দ হবে। এত বছর পরে একটা জিনিস ধরা পড়ল, আর সেটা করল কিনা একজন নিউকামার। যার এক্তিয়ারে অ্যাকাউন্টস পড়েই না। জেলাসি তো হবেই। সেই কারণেই আপনি যদি ডেকে কথা বলেন, অফিসে একটা মেসেজ যাবে। আমি আজ একবার দেখা করতে বলি?”

কমলেশ তাড়াতাড়ি বলেছিলেন, “না না, আজ নয়। দেখছ না আজ কী অবস্থা? তুমি বরং সোমবার পাঠাও। লাঞ্চের পর কোনও একটা সময়ে… ঠিক আছে তিনটের সময়। ওর সঙ্গে চা খাব। যাবার সময় নিলয়কে বলে যাও, ও যেন অ্যাপয়েনমেন্টে নোট করে রাখে। কী নাম বললে যেন?”

“সৌহার্দ্য, সৌহার্দ্য বসু।”

ত্রিপাঠী বেরোনোর সময় নিলয়কে খাতায় অ্যাপয়েনমেন্ট লিখিয়ে দিল। নিলয় গত পাঁচ বছর ধরে কমলেশ রায়ের পিএ-‌র কাজ করছে। চৌখস ছেলে। বসের চেম্বারের সামনে টেবিলে বসে থেকে অফিসের অনেক খোঁজখবর রাখে। ‘সৌহার্দ্য’ নামটা শুনে বলল, “স্যর, কোন সৌহার্দ্য? নতুন জয়েন করেছে যে?”

ত্রিপাঠী ঘাড় নাড়লেন। নিলয় বলল, “স্যর কি ওকে প্রাইজ দেবেন?”

ত্রিপাঠী এই ছেলেটিকে খুব একটা পছন্দ করেন না। কৌতূহল বেশি।

“তুমিও তা হলে খবর পেয়ে গেছ?”

নিলয় প্রশ্নের জবাব দিল না। সামান্য হাসল। বলল, “সবাই কিন্তু ভাল ভাবে নেয়নি স্যর। মাত্র ক’দিন ঢুকেই.‌.‌.‌”

ত্রিপাঠী খানিকটা কড়া গলায় বললেন, “আমারও তো সেটাই প্রশ্ন। যারা এত দিন আছে, তারা কী করছিল? হয় ধরতে পারেনি, নয় জেনেও চুপ করে ছিল।”

নিলয় দ্রুত নিজেকে বদলে ফেলে বলল, “ঠিকই, স্যর। তা হলে কাল তিনটে লিখে রাখি?”

সেই সৌহার্দ্য এসেছে তিনটে বাজবার দশ মিনিট আগে। তাকে অপেক্ষা করতে হয় আরও কুড়ি মিনিট। কমলেশ রায় ওর্য়াকশপ ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলছিলেন। ওয়ার্কশপে একটা ছোট সমস্যা হয়েছে। বাইরের কোনও একটা ক্নাব থেকে ছেলেপিলে এসে টাকা চেয়েছে। ‘তোলা’ যাকে বলে। হুমকি দিয়ে গেছে। দীর্ঘ কর্মজীবনে কমলেশ বুঝেছেন, এই ধরনের সমস্যা হল ফোড়ার মতো। ফেলে রাখলে পেকে গিয়ে যন্ত্রণা বাড়ায়। ওর্য়াকশপ ম্যানেজারকে তিনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ছেলেগুলো কে? কত বড় গুন্ডা? এত দিন পরে হঠাৎ সাহস হল কোথা থেকে? নেতা কে? কিছু টাকা দিতে কোনও অসুবিধে নেই, কিন্তু তাতে প্রশ্রয় দেওয়া হবে। সবটা বুঝতেই ওয়ার্কশপ ম্যানেজারকে ডেকে কথা বলতে চেয়েছিলেন। তার সঙ্গে কথা সেরে সৌহার্দ্যকে ঘরে ডেকে নিয়েছেন। ইন্টারকমে চা দিতে বললেন।

“সৌহার্দ্য, ‌তোমার কথা শুনলাম। ভেরি গুড।”

“থ্যাঙ্ক ইউ স্যর।”

“তুমি কোন স্ট্রিম নিয়ে বি টেক করেছ?”

“মেকানিক্যাল, স্যর। তবে আমার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ইচ্ছে ছিল না। ফিজিক্স নিয়ে জেনারেল স্ট্রিমে পড়তে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম রিসার্চ করব। সুযোগ হয়নি।”

‘সুযোগ হয়নি’ ধরনের কথা কমলেশের পছন্দ নয়। এটা হেরে যাওয়া কথা। যারা পারে না, তাদের কথা। সুযোগ হয় না, সুযোগ নিজেকে করে নিতে হয়। কমলেশ বললেন, “চা খাচ্ছ না কেন? খাও।”

সৌহার্দ্য হাত বাড়িয়ে কাপটা নিল। সাবধানে ধরে চুমুক দিল। তার ভঙ্গি দেখে মনে হল, দামি কাপটা নিয়ে সে খানিকটা সতর্ক। কমলেশ আবার চোখ নামিয়ে নিলেন। কাগজপত্র দেখতে লাগলেন। দামি কাপ-‌ডিশে চা খাবার অভ্যেস তাঁর ছোট থেকেই। খুব ধনী না হলেও উচ্চবিত্ত ঘরের ছেলে ছিলেন তিনি। পরিবার যতই স্বচ্ছল হোক, অভিজাত হোক, একটা জিনিস তিনি বুঝেছিলেন, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। স্কুল পেরিয়ে কলেজ, তারপর চার্টার্ড পাশ। শেষে বিদেশে গিয়ে দু’বছর ম্যানেজমেন্ট পড়া। লম্বা জার্নি। পরিশ্রম করতে হয়েছে। নিজে সুযোগ তৈরি করে, সেই সুযোগ নিজেকেই দিতে হয়েছে। ফুটবল খেলার মতো। একে ড্রিবল করে, তাকে ট্যাকল করে গোলের সামনে বল এগিয়ে নাও। মনে রেখো, গোলে নিজেকেই মারতে হবে।

“তোমার বাবা কী করেন?”

“স্যর, স্কুলে পড়াতেন। ওই ছায়াপাতা গ্রামেই স্কুল ছিল।”

কমলেশ মনে মনে বোঝার চেষ্টা করলেন, এই ছেলের বয়স‌ কত?

“বাবার কী হয়েছিল?”

“হার্টের সমস্যা ছিল।”

“ওহো।”

কমলেশ চুপ করে রইলেন। এত কথা বলা ঠিক হচ্ছে না। কাজে নতুন জয়েন করে সে একটা ভাল পারফরমেন্স দেখিয়েছে। তার মানে এই নয়, তার পরিবারের এত সব খুঁটিনাটি জানতে হবে। কেন তিনি এমন করছেন? সৌহার্দ্যও সম্ভবত বুঝতে পারল, বেশিক্ষণ থাকা হয়ে গেছে। সে চায়ের কাপে দ্রুত চুমুক দিল।

“স্যর, আমি কি এবার উঠতে পারি?”

কমলেশ বললেন, “হ্যাঁ, এসো। তোমার তো কাজ আছে। শোনো সৌহার্দ্য, তুমি যা করেছ সেটা কোম্পানির জন্য ভাল হয়েছে। আমরা খুশি হয়েছি। এত দিন চোখ এড়িয়ে যাওয়া একটা ভুল তুমি নোটিশ করিয়ে দিলে। এরকম সিনসিয়ারিটি নিয়ে এবং অ্যালার্ট হয়ে কাজ করবে। আই উইশ ইউ অল সাকসেস।”

সৌহার্দ্য উঠে দাঁড়ায়। কমলেশ উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে তার হাতটা চেপে ধরেন। ঝাঁকিয়ে বলেন, “ভাল থাকো। মন দিয়ে কাজ করো।”

সৌহার্দ্য চলে যাওয়ার জন্য ঘুরতে যায় আর তখনই একটা ছোট অঘটন ঘটে। তার বাঁ হাতের আলতো ধাক্কায় বোন-চায়নার ফিনফিনে কাপটা টেবিল থেকে মোটা, নরম কার্পেটের ওপর পড়ে এবং ভেঙে যায় অতি হালকা আওয়াজ করে। সৌহার্দ্য সে দিকে ফিরেও তাকায় না। যেন কাপ পড়ে যাওয়ার ঘটনা সে জানতে পারেনি।

সৌহার্দ্য ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে আরও একটু অপেক্ষা করেন কমলেশ। তারপর ইন্টারকমে পর পর দুটো নম্বর ধরেন। প্রথমটা নিলয়কে।

“ক্লিনিং-‌এর কাউকে পাঠাও। ঘরে একটা কাপ ভেঙেছে।”

পরের ফোনটা ধরেন ত্রিপাঠীকে।

“শোনো, এই ছেলেটির জন্য কিছু করা যায়?”

ত্রিপাঠী একটু অবাক হয়ে বলল, “কার কথা বলছেন স্যর?”

কমলেশ রায় বললেন, “আরে ওই যে, তোমার সৌহার্দ্য।”

ত্রিপাঠী এবার তড়িঘড়ি বললেন, “ওহো, আজ গিয়েছিল তো। আমার খেয়াল ছিল না স্যর। কী করতে বলছেন?”

কমলেশ একটু চুপ করে থেকে বললেন, “একটা ইনক্রিমেন্ট যদি বাড়িয়ে দেওয়া যায়। রিওয়ার্ডস হিসেবেই ধরো, অথবা একটা পোস্ট লিফট করে দাও যদি।”

“আপনি যদি চান তা হলে এইচ আর ডিপার্টমেন্টকে বলছি স্যর, কিন্তু.‌.‌.‌ আমার মনে হয় এই মুহর্তে এত কিছু না করাই ভাল। এমনিতেই এক্সপিরিয়েন্স থাকার জন্য আমরা ওকে খানিকটা লিফট দিয়েই এনেছি। নেগোসিয়েশনের সময় ও যা চেয়েছিল। আপনি ডেকে চা খাইয়েছেন, ব্যস, আপাতত ওটাই এনাফ। বেশি করলে মনে হবে, কোম্পানি এত দিন হিসেবে বড় কোনও গোলমাল করছিল, আমরা বিরাট কোনও লসের হাত থেকে বাঁচলাম। সেটা মনে হয় ঠিক হবে না।”

কমলেশ একটু ভেবে বললেন, “দ্যাট’স ট্রু।”

ত্রিপাঠী বললেন, “তার পরেও যদি বলেন আমি ফাইলটা দেখতে পারি।”

“দরকার নেই। তুমি বরং একটা কাজ করো ত্রিপাঠী। এইচ আর হেডকে বলে দাও, এবার থেকে এমপ্লয়িদের পার্সোনাল ফাইলে মাদার্স নেম মাস্ট। মায়ের নাম লিখতেই হবে। আদারওয়াইজ সার্ভিস বুক কমপ্লিট হবে না।”

ত্রিপাঠী খানিকটা হতচকিত হয়ে বললেন, “মায়ের নাম!‌ ‌আমি কি স্যর এইচ আর হেডকে একটা ফোন করতে বলব?”

কমলেশ বললেন, “না, তুমি বলে দাও।”

ফোন রেখে ফাইল টানলেন কমলেশ রায়। একটু পরেই বুঝতে পারলেন, কাজে পুরোপুরি মন বসছে না। ভিতরে এক ধরনের অশান্তি হচ্ছে। অশান্তি ঝেড়ে ফেলবার চেষ্টা করলেন। পারলেন না। খচখচ চলতেই লাগল। আরও খানিক পরে অশান্তির কারণ ধরতে পারলেন কমলেশ। সৌহার্দ্য বসুর মায়াভরা চোখদুটো তাঁর পরিচিত। এই চোখ তিনি আগে কোথাও দেখেছেন। কোথায় দেখেছেন?

টেবিলের ওপর রাখা মোবাইল বেজে ওঠে। স্ক্রিনে মেয়ের মুখের ফোটো। প্রত্যেক বারের মতো আজও ফোন ধরার আগে কয়েক মুহূর্ত মেয়ের ফোটোর দিকে তাকিয়ে রইলেন কমলেশ। ফোটোটা আহিরীই বাবার মোবাইলে সেভ করে দিয়েছে। তার পাঁচ বছর বয়সের মুখ। দুষ্টুমিতে ভরা। এই মুখ একবার না দেখে ফোন কানে নিতে পারেন না কমলেশ।

শ্রীকণা বললেন, “নতুন অফিস কেমন লাগছে?”

সৌহার্দ্য স্নান করে এসেছে। মাথায় তোয়ালে ঘষতে ঘষতে বলল, “সবে তো কিছু দিন হল। মনে হয়, আরও ছ’মাস ভা‌ল লাগবে। তারপর আর নয়।”

শ্রীকণা বললেন, “এবার একটা কোথাও থিতু হয়ে বোস। বছর কাটতে না কাটতে তো অফিস বদলে ফেলছিস। এই নিয়ে ক’টা কোম্পানি হল বল তো?”

সৌহার্দ্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কোমরে বড় একটা সাদা তোয়ালে জড়ানো, গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। মায়ের সঙ্গে সে আয়নার মধ্যে দিয়ে কথা বলছে। তার চেহারা নিয়মিত জিমে যাওয়া, পেটানো। এই ছেলেকে অবশ্যই রূপবান বলা যায়।

“এখন এটাই নিয়ম মা। কোম্পানি জাম্প করতে হয়। বেটার থেকে বেটার থেকে বেটার। যতক্ষণ না তুমি প্রপারলি জাজড হচ্ছ, তোমার এমপ্লয়াররা তোমার কদর বুঝতে পারছে। তারপর একসময় সাঁইইই।”

সৌহার্দ্য ডান হাত দিয়ে প্লেনের উড়ে যাওয়া দেখাল। শ্রীকণার ছেলের কথা পছন্দ হল না। ছেলেটা বড্ড কেরিয়ার-পাগল হয়ে গেছে। যত দিন যাচ্ছে পাগলামি বাড়ছে। টাকা চিনেছে খুব। শুধু উপার্জন নয়, দু’হাতে খরচ করতেও শিখেছে। তবে শুধু নিজের জন্য নয়, মায়ের জন্যও খরচ করে। সে সবের অনেক কিছু বেহিসাবি খরচ। বারণ করলে খেপে যায়। সৌহার্দ্য যে দিন তাঁর ঘরে এসি মেশিন লাগিয়ে দিল, সেদিন তো শ্রীকণা ষথেষ্ট রাগারাগি করেছিলেন।

“তুই কি খেপে গিয়েছিস সোহো? এসি দিয়ে আমার কী হবে? চার তলার ওপর ফ্ল্যাট। তার ওপর আমার ঘরটা দক্ষিণমুখী। জানলা খুলে দিলে হাওয়ায় ভাসিয়ে দেয়। এসি চালিয়ে মরব নাকি? আমার ওসব অভ্যেস নেই বাপু।”

সৌহার্দ্য বলেছিল, “সামান্য মাস্টারের বউ হয়ে অনেক কষ্ট করেছ। আর নয়, এখন তুমি একজন ওয়েল প্লেসড ইঞ্জিনিয়ারের মা। এবার নতুন করে লাইফ এনজয় করো। কোনও কিছুতে পুরোপুরি স্যাটিসফায়েড হবে না। ভাববে, আরও ভাল চাই। এই যে ফ্ল্যাটে আমরা রয়েছি, এটা আর আমার পছন্দ হচ্ছে না। কলকাতায় যা পলিউশন তাতে আরও ওপরে থাকা উচিত।”

ছেলের এই কথায় শ্রীকণা আরও বিরক্ত হন। বলেন, “জীবন তো শেষ করে আনলাম। আর কী এনজয় করব?”

সৌহার্দ্য বলে, “তোমার মতো করে এনজয় করবে। খাবেদাবে, বেড়াবে। পুজোর সময় তোমাকে নিয়ে কুলু–মানালি যাব ভেবেছি। কেমন হবে? তোমার অন্য কোনও প্ল্যান থাকলে বলতে পারো।”

শ্রীকণা বললেন, “ধুস, পাগল! আমি কোথাও যাব না।”

সৌহার্দ্য ‌চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, “একটা সময় সংসারে টাকাপয়সা ছিল না। বাবা ধারদেনা করে জমি-‌বাড়ি কিনে বসল। একবারও ভাবল না, সংসার কীভাবে চলবে। ওইটুকু তো বেতন ছিল, তাই দিয়ে মাসের প্রথমে লোন মেটাতে হত, ফলে বাকি দিনগুলো খুঁড়িয়ে চলতে। এখন আর নয়।”

শ্রীকণা ছেলের ছেড়ে রাখা জামা গোছাতে গোছাতে বললেন, “তোর বাবা শান্তশিষ্ট পাড়াগাঁ পছন্দ করত। সেই জন্যই ওখানে জমি-বাড়ি কিনেছিল। খুব দাম তো ছিল না। ভেবেছিল, সারা জীবন থাকবে।”

সৌহার্দ্য বলল, “ভুল করেছিল।”

শ্রীকণা বললেন, “অমন ভাবে বলছিস কেন? তোকে তো লেখাপড়া শিখিয়েছে। মানুষ করেছে।‌”

সৌহার্দ্য ট্রাউজার্স পরতে পরতে বলল, “কোথায় শিখিয়েছে? আমার তো হায়ার স্টাডিজ করবার ইচ্ছে ছিল। হায়ার সেকেন্ডারিতে আমার রেজাল্টও খুব ভাল ছিল। স্বপ্ন দেখতাম, বিজ্ঞান নিয়ে পড়ব। গবেষণা করতে বিদেশে যাব। সেসব আর হল কই? বাবা তো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পাঠিয়ে দিল, যাতে তাড়াতাড়ি রোজগার শুরু করি। এটা লেখাপড়া শেখানো হল? আমি মানুষ হলাম ঠিকই, কিন্তু সেটা রোজগেরে মানুষ। বাবার ইচ্ছেমতো মানুষ।‌ আর এখন তাতেই আমি আমার সমস্ত মনপ্রাণ ঢেলেছি। হায়ার স্টাডিজ গো টু হেল।”

শ্রীকণা চুপ করে রইলেন। এটা অভিমানের কথা। এটা সত্যি যে ওর বাবা-ই জোর করে ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়েছেন। সৌহার্দ্য যখন গাঁইগুঁই করেছিল, রেগে গিয়েছিলেন। “শুধু পণ্ডিত হলে ভাত জুটবে? জেনারেল স্ট্রিমে পড়াশুনো করে কী করবি? আমার মতো স্কুলমাস্টার হবি?”

সৌহার্দ্য বাবাকে ভয় পেত। একেবারে পছন্দ করত না। যতটা সম্ভব এড়িয়ে থাকা যায় তার চেষ্টা করত। মানুষটা ছিল রগচটা। যুক্তি শুনতে চাইত না। দুমদাম খেপে যেত। নিজে যা ঠিক মনে করত, হাজার ভুল হলেও সেখান থেকে নড়ত না। ধ্যানধারণাও পুরনো দিনের। পরিবারে তার কথাই ছিল শেষ কথা। শ্রীকণা ঠিক তার উলটো। শান্ত, স্নিগ্ধ। বাবার উচ্চকিত ব্যক্তিত্বের কাছে চুপ করে থাকা একজন মানুষ। সৌহার্দ্য ছোটবেলা থেকেই দেখছে, বাবার ধমক-ধামকের সামনে এই মহিলা সব সময়েই গুটিয়ে থাকে। যেন বিরাট কোনও অপরাধ করেছে। মাকে আড়ালে বহু বার কাঁদতেও দেখেছে সৌহার্দ্য। মায়ের ওপর রাগ হত। সেই রাগ থেকেই তৈরি হত টান। বাবার কাছ থেকে যত সরে এসেছে সে, তত কাছে এসেছে মায়ের।

বাবার কথায় সৌহার্দ্য সেদিন নিচু গলায় বলেছিল, “আমি ফিজিক্স পড়ব। আমি অ্যাস্ট্রোফিজিক্স নিয়ে গবেষণা করতে চাই।’

“অ্যাস্ট্রোফিজিক্স!‌ ‌এই সব পাকামি তোমার মাথায় কে ঢোকাল? গবেষণা মানে তো বুড়ো বয়স পর্যন্ত বেকার।”

সৌহার্দ্য বলল, “বেকার কেন হবে? স্কলারশিপ জোগাড় করব। বিদেশে যাব।”

“এখন ওসব ভাবতে হবে না! আগে মন দিয়ে জয়েন্ট এন্ট্রান্স দাও। তারপর দেখা যাবে।”

সৌহার্দ্য তার মাকে ধরেছিল। শ্রীকণা স্বামীকে বলেছিলেন। একেবারেই সুবিধে হয়নি।

“যা বোঝো না, তার মধ্যে ঢুকো না। এটা ছেলের সঙ্গে আদিখ্যেতার ব্যাপার নয়। এটা ওর কেরিয়ারের বিষয়। ও যা ভাবছে, তত দূর পর্যন্ত যেতে না পারলে জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে। একমুখ দাড়ি আর কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ফ্যা-ফ্যা করে প্রাইভেট টিউশন করতে হবে। আমি যা ঠিক করেছি সেটাই হবে। ওকে এমন বিষয় নিয়ে পড়তে হবে যাতে চাকরি পেতে অসুবিধে না হয়। সংসারে যেন দুটো পয়সা দিতে পারে। এই যে বাড়ি-জমির জন্য গাদাখানেক লোন করে ফেলেছি, তা তো ওকেই টানতে হবে। এই নিয়ে আর বিরক্ত কোরো না। আমি আমার ছেলেকে চিনি, তার দৌড় জানি।”

শ্রীকণা বলেছিলেন, “আমিও চিনি। সোহো খুব ভাল ছেলে।”

“চুপ করো। তুমি কেমন মানুষ চেনো, নিজের জীবন দিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পাওনি?”

শ্রীকণা থমকে গিয়ে নিচু গলায় বলেছিলেন, “বারবার তুমি এই প্রসঙ্গ তোলো কেন? সে তো অনেক বছর আগে চুকেবুকে গেছে।”

“আমি তুলি না, তুমি তুলতে বাধ্য করাও। তোমাকে মনে করিয়ে দিই। এখন যাও, আর ভ্যানভ্যান কোরো না।”

শ্রীকণা চোখ মুছতে মুছতে সরে গিয়েছিলেন। কোনও কিছু নিয়ে একটু আপত্তি করলেই জীবনের সবচেয়ে দুর্বল সময়টার কথা তোলে তাঁর স্বামী। অথচ ফুলশয্যার রাতে অন্য কথা বলেছিল।

“তোমরা গোপন করেছ, কিন্তু আমি কিছু খবর পেয়েছি শ্রীকণা। কী খবরের কথা বলছি, তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। অন্য কেউ হলে এই বিয়ের আগে দু’বার ভাবত। আমি ভাবিনি। কারণ আমি একজন লেখাপড়া জানা শিক্ষিত মানু্ষ। শিক্ষিত মানুষ অতীতকে আঁকড়ে থাকে না। সামনেটা দেখে। আমি সব ভুলে তোমার সঙ্গে সংসার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আশা করব, তুমিও ভুলে যাবে।”

শ্রীকণা সেদিন মুগ্ধ হয়েছিলেন। এমন একজন মানুষকে জীবনে পেয়েছেন বলে নিশ্চিন্ত বোধ করেছিলেন। কিছু দিন যেতে সব উলটে গেল। এই লোকই বারবার পুরনো কথা মনে করিয়ে দেয়। একটু মাথা তুলতে গেলেই যেন আঘাত করে। শ্রীকণা বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর স্বামী আসলে একজন নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ। শ্রীকণার অতীতের সম্পর্কের কথা জানার পরেও ভেবেচিন্তে তাকে বিয়ে করেছে। বুঝতে পেরেছিল, এই নরম প্রকৃতির মেয়েকে সে এই দুর্বলতা দিয়ে দমিয়ে রাখতে পারবে। শ্রীকণা এই মানুষটাকে যতটা না ভয় পেয়েছেন, তার থেকে বেশি ঘৃণা করেছেন। চেষ্টা করেছেন, ছেলে যাতে এসব বুঝতে না পারে। তার পরেও ছেলে অনুভব করেছে।

যাই হোক, শেষ পর্যন্ত সৌহার্দ্য ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে এবং ঘোষণা করেছে, ‌কেরিয়ারের শেষ পর্যন্ত দেখে সে ছাড়বে।‌

কথা বলতে বলতে ছেলের ঘর গোছাচ্ছেন শ্রীকণা। এত বয়স হয়ে গেল, তার পরেও সৌহার্দ্যর ঘর অগোছালো করে রাখবার অভ্যেস যায়নি। এখনও যেন হস্টেলে থাকে। যেখানে সেখানে বাসি জামাকাপড় ফেলে রাখে। বই, কাগজপত্র, ল্যাপটপ বিছানার ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। বিছানার চাদর এলোমেলো, বেড কভার মাটিতে। ওয়ার্ড্রোবের অবস্থা তথৈবচ। বেরোনোর সময় জামাকাপড় খুঁজে খুঁজে পায় না। অথচ কাজের মাসিকেও কিছুতে হাত দিতে দেবে না। শ্রীকণাকেই সমস্ত কিছু করতে হয়।

শ্রীকণা বললেন, “তোর জীবন তো পুরোটাই বাকি আছে। সঞ্চয় তো লাগবে।”

‌সৌহার্দ্য ওয়ার্ড্রোব খুলে শার্ট পছন্দ করতে লাগল। হ্যাঙারসুদ্ধই গায়ের ওপর ধরছে, আবার তুলে রাখছে। শেষ পর্যন্ত একটা নেভি ব্লু টি-‌শার্ট বেছে ফেলল। বলল, “সে আমি বুঝে নেব। মা, তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, তোমার ছেলের জব পেতে কখনও অসুবিধে হবে না। একটার পর একটা কাজ পেয়েও যাচ্ছি। অলওয়েজ জাম্পিং। নেক্সট জাম্প মারব কলকাতার বাইরে। নতুন প্রজেক্ট ইনিশিয়েট করার একটা এক্সপিরিয়েন্স দরকার ছিল। সেই কারণেই এখানে জয়েন করেছি। এই ফ্ল্যাট বেচে কলকাতা থেকে একেবারে ফুস হয়ে যাব।’

শ্রীকণা বাসি জামাকাপড় আলাদা করতে করতে বললেন, “আমি আর কোথাও যাব না।”

‌সৌহার্দ্য পিছন থেকে মাকে জড়িয়ে ধরল। “তোমাকে ছাড়া আমি কোথাও যাব না। দেশের মধ্যে তো ছেড়েই দাও, যখন দেশের বাইরে যাব, তখনও তোমাকে ব্যাগে ভরে নেব।”

শ্রীকণা ছেলের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেন। মায়ের ব্যাপারে এই ছেলের এক ধরনের অবসেশন আছে। ছোটবেলাতেও এই ছেলে মায়ের সঙ্গে লেগে লেগে থাকত। বড় হয়েও থাকে। যা বলবার সব মাকে। এক সময় রাগ, অভিমান এমনকী প্রেমের কথাও বলেছে। এখন কেরিয়ার, পার্টি, ক্লাব, বান্ধবীর কথা বলে। এ সবের আর কতটুকুই বা মাকে বলা যায়? তাও যতটুকু বলা যায়, বলে। ছোটবেলার অভ্যেস যায়নি। তবে রাত করে ফিরলে জেগে বসে থাকা চলবে না। নিজের কাছে চাবি রেখেছে সৌহার্দ্য। নিঃশব্দে দরজা খুলে ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ে। শ্রীকণার চিন্তা হয়। এই ছেলে ঘর-সংসার করবে না? ‌সৌহার্দ্যকে বলতে গেলে উড়িয়ে দেয়।

“খেপেছ? বিয়ে করে মরব নাকি?”

“কেন? মরবি কেন? কেউ বিয়ে করে না?”

সৌহার্দ্য বলে, “যে করে তাকে করতে দাও, বিয়ের কনসেপ্ট উঠে গেছে মাই ডার্লিং মাদার। এই তো মা–বেটায় দারুণ আছি‌। আমি ফ্রি। যেচে কেন বাঁশ নিতে যাব?”

বাবার মৃত্যুর পর খুব সংক্ষেপে পারলৌকিক কাজকর্ম সেরে সৌহার্দ্য বলেছিল, “ছায়াপাতার পাততাড়ি সব গুছিয়ে নাও। বাড়ি-জমি সব বেচে দেব। কথাও হয়ে গেছে। পাশ দিয়েই হাইওয়ের কানেক্টিং রোড হবে। জমির দাম হুট করে অনেকটা বেড়ে গেছে, এর পর হয়তো আবার পড়ে যাবে। সব বেচে আমরা কলকাতায় সেটল করব। লোন-টোন মিটিয়েও হাতে ভাল টাকা থাকবে।”

শ্রীকণা আপত্তি করেছিলেন। বলেছিলেন, “ভিটেমাটি ছেড়ে এখান থেকে চলে যাব সোহো?”

সৌহার্দ্য তেড়েফুঁড়ে বলেছিল, “অবশ্যই যাবে। ছায়াপাতা গ্রাম তোমার কীসের ভিটেমাটি? কলকাতায় জন্মেছ, কলকাতায় বড় হয়েছ। বিয়ে করে গ্রামে এসেছিলে। তাও বাবার এখানে চাকরি ছিল বলে। অন্য কোথাও হলে সেখানে যেতে। এই জায়গায় কীসের টান তোমার?”

শ্রীকণা বলেছিলেন, “বাহ্‌, তোর বাবা এখানে বাড়ি করেছে। যতই ছোট হোক, বাড়ি তো। লাগোয়া একটু জমিও আছে। সেটা ভিটেমাটি নয়!‌”

সৌহার্দ্য বলল, “বাবা জীবনটা এখানে কাটিয়ে যাবে বলে ঠিক করেছিল, কাটিয়েও গেল। কিন্তু আমি তো তা ঠিক করিনি মা। পাড়াগাঁয়ে পড়ে থাকলে আমার চলবে না। বাবার মতো স্কুলমাস্টার হওয়া আমার জীবনের টার্গেট নয়। বাবা-ই তো আমাকে বলেছিল। অনেক হয়েছে, আমি আর টেনেটুনে-চলা সংসার দেখতে চাই না। বাবা বেঁচে থাকতে এসব কথা তো বলতে পারিনি, তাই এখন বলছি।”

শ্রীকণা বুঝেছিলেন, বাবার ওপর রাগ সৌহার্দ্যর কোনও দিনই কমবে না।‌ তিনি বলেছিলেন, “তুই তো পাড়াগাঁয়ে পড়ে নেই। কলকাতায় হস্টেলে থেকে কলেজে পড়ছিস।”

সৌহার্দ্য বলল, “এখন তার খরচ কোথা থেকে পাব? তা ছাড়া‌ আমি তোমাকেও একা থাকতে দেব না। চলো, সব গুছিয়ে নাও। আমরা ওখানে ফ্ল্যাট কিনব। আমি সব হিসেব করে নিয়েছি।”

শ্রীকণা বুঝেছিলেন, আর আপত্তি করে লাভ নেই। আর সত্যিই তো, পাড়াগাঁয়ে একা পড়ে থেকে কী করবেন? ছেলে ছাড়া ছায়াপাতার জীবনের প্রতি তাঁর কোনও মমতাও নেই। স্বামীর স্মৃতি এমন কিছু সুখপ্রদ নয় যে আঁকড়ে পড়ে থাকলে সে খুব সুখের হবে।

সৌহার্দ্য ফসফস করে গায়ে খানিকটা ডিয়োডোরেন্ট স্প্রে করে বলল, “মা, ফিরতে দেরি হবে। কৃতির বার্থডে পার্টি আছে।”

শ্রীকণা ভুরু কুঁচকে বললেন, “কৃতি!‌ সে আবার কে?”

সৌহার্দ্য চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, “আমার এক্স কলিগ। শি ইজ বিউটিফুল। কত ছেলে যে লাইন মেরেছিল! ফাইনালি শি ম্যারেড আ বিজনেস গাই। লোকটা বোকাসোকা, কিন্তু ভাল।”

শ্রীকণা চোখ বড় বড় করে বললেন, “ছি, কী ভাষা!‌ মায়ের সঙ্গে কেউ এভাবে কথা বলে? আমি কি তোর ওই ‘ইয়ার’ নাকি?”

ধমক দিলেও শ্রীকণা ভাল ভাবেই জানেন, তাঁর গুণধর পুত্রটি মায়ের সঙ্গে কোনও কোনও সময়ে এতটাই সহজ। এর থেকেও বেশি স্ল্যাং ব্যবহার করে বসে। মাকে সে গুরুজনের থেকে অনেক বেশি ‘বন্ধু’ বলে মনে করে।

আর শুধু কি ছেলেই মনে করে? তিনি মনে‌ করেন না? অবশ্যই করেন। আর করেন বলেই জীবনের গভীর, গোপন কষ্টের কথাটিও তিনি তার কাছে বলে ফেলেছিলেন। রাগে-‌দুঃখে সেদিন এতটাই ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলেন যে নিজেকে সামলাতে পারেননি।

সোহোর বাবা অতি তুচ্ছ কোনও বিষয় নিয়ে রাগারাগি করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। তিন দিন বাড়ি ফেরেনি। কলকাতায় গিয়ে বসে ছিল। সৌহার্দ্যর সামনে তখন ফার্স্ট সিমেস্টার পরীক্ষা। নির্বিঘ্নে পড়বে বলে বাড়িতে এসেছিল। কোথায় কী! গোটা বাড়িতে এলোমেলো অবস্থা। শ্রীকণার প্রবল জ্বর। সৌহার্দ্য এত বিরক্ত হয়েছিল যে মাকে জিগ্যেস করছিল, “এরকম একটা মানুষকে তুমি কী করে বিয়ে করেছিলে মা? হি ইজ আ ব্রুট‌!”

শ্রীকণা নিজেকে সামলাতে পারেননি। থমথমে মুখে অস্ফুটে বলেছিলেন, “যাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম, সে তো কিছু না বলে পালিয়ে গেল।”

সৌহার্দ্য থমকে গিয়েছিল। মায়ের মুখ থেকে এরকম জবাব পাবে, সে ভাবতে পারেনি। মা নিশ্চয়ই তাকে শোনাতে চায়নি। নিজের মনেই আক্ষেপ করতে চেয়েছিল।

সেদিন কথাটা না শোনার ভান করেছিল সৌহার্দ্য। মা যেন কোনও রকম অস্বস্তিতে না পড়ে। পরে বাবার মৃত্যুর পর চেপে ধরেছিল। তত দিনে আরও খানিকটা বড় হয়ে গিয়েছে সে। মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক সহজ হয়েছে আরও। শ্রীকণা ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবে বলেছিলেন। নামও বলেছিলেন।

ভুরু কুঁচকে সৌহার্দ্য বলেছিল, “পরে আর খোঁজ পাওনি?” শ্রীকণা বলেছিলেন, “চেষ্টাও করিনি। নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়েছেন। আমার মতো সাধারণ মেয়েকে মনে রাখার কোনও কারণ নেই। তা ছাড়া, তারপর তো তোর বাবার সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল।”

সৌহার্দ্য দাঁত চেপে বলেছিল, “স্কাউন্ড্রেল।”

শ্রীকণা বলেছিলেন, “ছি, ওরকম বলতে নেই।”

সৌহার্দ্য বলেছিল, “কেন বলতে নেই? অপেক্ষা করতে বলে যে ভ্যানিশ হয়ে যায় তাকে খিস্তি ছাড়া আর কী দেব? কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করব?”

শ্রীকণা বললেন, “হয়তো মুখ ফুটে বলতে পারেননি।”

সৌহার্দ্য নাকমুখ কুঁচকে বলেছিল, “তোমাদের জেনারেশনের এই সব প্রেম‌-ভালবাসাকে সাধে কি আমরা রিজেক্ট করেছি মা! আমরা যা করি সরাসরি করি। পরস্পরকে বলে করি। পছন্দ হলেও বলি, না হলেও বলি। আমাদের রিলেশন এবং ব্রেক-আপ দুটোই ওপেন। নো অ্যাম্বিগুইটি। আমাদের ছলনা করতে হয় না, পালাতেও হয় না। উই আর জেনুইন।”

শ্রীকণা বলেছিলেন, “হয়তো তাই। তবে সবাই সমান নয়। আমার কোনও আপশোস নেই। বরং আমি খুব খুশি। তোর বাবাকে বিয়ে না করলে তোকে পেতাম না।”

সৌহার্দ্য বলেছিল, “আপশোস কেন হবে? তুমি কম কীসের? কথাটা তা নয়, কথা হল, উনি পালালেন কেন?”

শ্রীকণা বললেন, “ভুলে যা‌‌।”

সৌহার্দ্য ঝাঁঝ নিয়ে বলেছিল, “ভুলে তো এখনই গিয়েছি, তার পরেও যদি কোনও দিন দেখা হয়, কলার চেপে ধরব।”

শ্রীকণা বললেন, “ছি ছি, ‌বলছি না ওরকম বলে না!”

সৌহার্দ্য ঠোঁট উলটে ‌বলেছিল, “ঠিক আছে, দেখা হলে হ্যান্ডশেক করে বলব, আপনি একজন সাহসী মানুষ মিস্টার। এক সুন্দরী তরুণীকে দাঁড় করিয়ে রেখে ভেগে গিয়েছিলেন। এর জন্য আপনাকে ব্রেভারি অ্যাওয়ার্ড দেওয়া উচিত।”

শ্রীকণা বললেন, “থাক ওসব কথা।”

সৌহার্দ্য কৌতুক-ভরা গলায় বলল, “জানে মা, সেদিন আমি আমার বসের ঘরে একটা মজার কাণ্ড করেছি। চা খাওয়ার পর একটা দামি কাপ টেবিল থেকে ফেলে দিয়েছি।”

শ্রীকণা থমকে গিয়ে বললেন, “সে কী!‌”

সৌহার্দ্য হেসে বলল, “আরও ‌মজার কথা কী জানো? বস বুঝতেই পারেনি, আমি ইচ্ছে করে কাপটা ফেলে দিয়েছি।”

“তুই কি পাগল?”

সৌহার্দ্য ঝুঁকে পড়ে মায়ের গালে গাল ছুঁইয়ে বলল, “লোকটা ভাল, কিন্তু লোকটার নাম আমার পছন্দ নয় মা। সো আই মেক দ্য ফান।”

শ্রীকণা বললেন, “নাম পছন্দ নয়!‌ কী নাম? যত বড় হচ্ছিস পাগলামি বাড়ছে তোর।”

সৌহার্দ্য কথার জবাব না দিয়ে বলল, “চললাম মা। ফিরতে রাত হবে। খেয়ে শুয়ে পড়বে।”

কৃতির বার্থডে পার্টিতে হার্ড ড্রিঙ্কস বলতে শুধু ওয়াইনের ব্যবস্থা ছিল। সেই ওয়াইনই সৌহার্দ্য অনেকটা খেয়ে ফেলল। যতক্ষণ না মাথা ঝিমঝিম করে। পার্টি ফাঁকা হতে কৃতি এসে চাপা গলায় বলল, “নো মোর সো! ইউ হ্যাভ টু ড্রাইভ।”

সুন্দরী কৃতি একটা চকলেট রঙের অফ-শোল্ডার স্লিভলেস গাউন পরেছে। বুক থেকে শুরু হওয়া সেই পোশাকে তাকে দেখাচ্ছে হলিউডের ফিল্মস্টারের মতো। কানে বড় ঝোলা দুল রাখলেও গলায় কিছু পরেনি। এতে তার নগ্নতা আরও বেড়েছে।

সৌহার্দ্য হেসে বলল, “কৃতি, ‌ভাবছি, আজ রাতে আর ফিরব না। তোমার কাছে থেকে যাব।”

কৃতি চোখ পাকিয়ে বলল, “ডোন্ট বি নটি সো! তুমি কি চাও আমার বর তোমাকে খুন করুক? সে মেট্রো স্টেশনে একজনকে নামাতে গিয়েছে। এক্ষুনি ফিরবে। যদি এসে দেখে তুমি আমার সঙ্গে ফ্লার্ট করছ তা হলে কী হবে বলো তো?”

সৌহার্দ্য বলল, “যা খুশি হোক, তোমার ওয়াইল্ড বিউটি আমাকে অলরেডি খুন করে ফেলেছে কৃতি। নাউ আই অ্যাম আ ডেড ম্যান।”

কাঁধে চড় মেরে কৃতি ফিসফিস করে বলল, “সত্যি মেরে ফেলব কিন্তু।”

সৌহার্দ্য অভিনয় করে বলল, “ইস, বিয়ে করবার আগে একবার বললে না!”

কৃতি চোখে কৌতুক এনে বলল, “কেন? বললে কী হত? আমাকে বিয়ে করতে?”

সৌহার্দ্য বলল, “শিয়োর!”

কৃতি বলল, “সেই কারণেই বলিনি।‌ তোমার অন্য গার্লফ্রেন্ডদের কী হত তখন?”

সৌহার্দ্য হেসে বলল, “এই জন্য তোমাকে এত পছন্দ করি। তুমি আমার জন্য ভাবো।”

ফ্ল্যাট থেকে বেরোনোর আগে, দরজার সামনে কৃতিকে এক হাতে জড়িয়ে চুমু খেল সৌহার্দ্য। বেশি সময় দিল না কৃতি। নিজেকে মুক্ত করে হাত দিয়ে ঠোঁটের শেড ঠিক করতে করতে গাঢ় গলায় বলল, “শুধু চুমুতে হবে না নটি বয়। বর ট্যুরে গেলে খবর পাঠাব। আসতে হবে।”

নীচে নেমে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে সৌহার্দ্য ফোনে নম্বর টিপল। ও পাশে একবার ফোন বাজতেই চিকন গলায় জবাব পেল।

“সৌহার্দ্যদা, তুমি!‌ হোয়াট আ সারপ্রাইজ‍‌!‌ এত দিন‌ কোথায় ভ্যানিশ হয়েছিলে?’

এক হাতে স্টিয়ারিং সামলে সৌহার্দ্য বলল, “মনানী, বালিগঞ্জ ফাঁড়ি দিয়ে যাচ্ছি। তোমাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। একবার ঘুরে যাই?”

মনানী গলায় আপশোসের সুর এনে বলল, “ইস, ব্যাড লাক। আমি এখন বেঙ্গালুরুতে। দু’মাস হল প্রোমোশন দিয়ে কোম্পানি পাঠিয়ে দিয়েছে।”

সৌহার্দ্য বলল, “কনগ্রাচুলেশনস! কিন্তু আমি যে ভেঙে পড়লাম মনানী। এখনই তোমাকে যে আদর করতে ইচ্ছে করছে।”

মনানী বলল, “নো প্রবলেম। ফ্লাইট ধরে চলে এসো। রাত তিনটেয় একটা ফ্লাইট আছে না?” কথা শেষ করে খিলখিল করে হেসে উঠল মনানী।

সৌহার্দ্য ছদ্ম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ঠাট্টা করছ?”

মনানী নামের মেয়েটি ফিসফিস করে বলল, “রাগ কোরো না সৌহার্দ্যদা। নেক্সট মান্থে কলকাতা যাচ্ছি, একটা ফুল ডে তোমার জন্য। এখন একটা উমম্‌ নাও।”

মোবাইলে চুমুর জবাব দিয়ে ফোন কেটে দিল সৌহার্দ্য। গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিল। ওয়াইনটা চমৎকার ছিল। যত সময় যাচ্ছে, ফুরফুরে ভাবটা বাড়ছে। সৌহার্দ্য নিজেকেই মনে মনে প্রশ্ন করল, রিয়েল না ভার্চুয়াল? কোন চুমুটা ভাল‌? দুটোই দু’রকম ভাবে ইন্টারেস্টিং নয় কি? বাবা যদি বেঁচে থাকত, এখন ছেলেকে দেখে কী ভাবত? কোন সৌহার্দ্যটা ভাল? রিয়েল না ভার্চুয়াল? নাকি দু’জনে দু’রকম ভাবে ইন্টারেস্টিং? হেসে ফেলল সৌহার্দ্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *