নীল

নীল

রাগে আমার শরীর ঝনঝন করে উঠল। লোকটা কে? নাকি ছাত্রীরা কেউ মজা করেছে? এত সাহস! মেয়েরা আমাকে আড়ালে ‘যম দিদিমণি’ বলে ডাকে।

যমের মতো ভয় পায় বলে ‘যম দিদিমণি’। যম দিদিমণি’র সঙ্গে এই ভয়ংকর ঠাট্টা করবার সাহস ওদের হতেই পারে না।

আমি আবার কাগজটা খুললাম। মোটে কয়েকটা লাইন। সেটাই যথেষ্ট। রাগে গোটা শরীরটা আবার ঝনঝন করে উঠল।

আজকাল এরকম হয়। রাগলে চোখমুখ লাল হয়ে যায়। গায়ের রং ফরসা বলে সেই লাল গালে, নাকের ডগায় চলে আসে। চোয়াল কঠিন হয়ে যায়। বাইরে থেকে বোঝা যায়। শুধু বোঝা যায় না, আমি সেরকম আচরণও করি। সেই আচরণ কোনও কোনও সময় মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। গত সপ্তাহেই একটা বিচ্ছিরি কাণ্ড করেছি। ক্লাস টেনের ফার্স্ট গার্ল ক্লাসে হাসছিল। ঘসঘস করে ডায়েরিতে লিখে গার্জেন কল করলাম। বাবা-মাকে ডেকে যাচ্ছেতাই করে বকলাম।

‘শুধু লেখাপড়ায় নম্বর পেলেই হয় না। মেয়েকে ঠিকমতো মানুষ করবেন। আমার মেয়ে পড়ার সময় হাসাহাসি করলে চড় মেরে দাঁতগুলো ফেলে দিতাম।’

আমি জানি এটা বাড়াবাড়ি। একটা ফুটফুটে কিশোরী সামান্য হাসাহাসি করছে বাড়ির লোককে ডেকে পাঠানো বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কী?

অথচ আমি এমন ছিলাম না। রাগ লুকিয়ে রাখতে পারতাম। মেজাজ খারাপ হলেও মিষ্টি করে হাসতে পারতাম। ছাত্রীরা খুব পছন্দ করত। বলত, ‘বীণাদি দারুণ! একদম রাগ করে না। হোমটাস্ক না করলে এমন সুন্দর করে হাসে যে আমরাই লজ্জা পেয়ে যাই।’

শুধু ছাত্রীরা নয়, কলিগরাও অবাক হত।

‘এই হাসির অভিনয় তুই কোথা থেকে শিখেছিস বীণা? ছুটির পর স্কুলে বসে খাতা দেখতে হবে শুনে আমরা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলাম, আর তুই মিটিমিটি করে হাসলি! যেন বিরাট খুশির খবর! কায়দাটা আমাদেরও শিখিয়ে দে।’

আমি বলতাম, ‘এমনি হবে না, খরচ করতে হবে।’

‘হাসি শেখার জন্য আবার খরচ কীসের! দাঁত বের করে থাকলেই তো হল।’

আমি বলতাম, ‘না, হল না। রাগ লুকোনোর একটা ম্যাজিক আছে। সেটাই আসল। নইলে দাঁতের ফাঁক দিয়ে রাগ বেরিয়ে আসবে, তখন হাসিকে আর হাসি মনে হবে না। আমি হলাম রাগ লুকোনোর ম্যাজিশিয়ান।’

আমার কথা শুনে সবাই জোরে হেসে উঠত।

আসলে ম্যাজিক-ট্যাজিক কিছুই নয়। ছেলেবেলা থেকেই আমি এমন। চেঁচামেচি, ঝগড়া সহ্য হত না। বাবা-মা’র সঙ্গে গোলমাল হলে ঘরের দরজা বন্ধ করে এক, দুই, তিন করে গুনতাম। এই পদ্ধতিতে রাগ পড়তে সাধারণত কুড়ি পর্যন্ত গুনতেই হয়। আমার পনেরো-ষোলোতেই কাজ হত। সব ভুলে যেতাম। আরও বেশি কিছু হলে বাথরুমে লুকিয়ে খানিকটা ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কেঁদে নিতাম। তারপর চোখের জলটল মুছে মা’র কাছে গিয়ে একগাল হেসে বলতাম, ‘খেতে দাও।’

‘ওমা! এই তো খেলি।’

‘আবার দাও। বকেছ তার ফাইন।’

মা হেসে ফেলত। বলত, ‘পাগল মেয়ে।’

সেই পাগল মেয়ে স্বাভাবিক হতে শুরু করল বিয়ের পর। লুকোনোর বদলে রাগকে বের করে আনতে শিখলাম। এও কি একরকমের ম্যাজিক? কে জানে। তবে হুট করে হয়নি, সময় লেগেছে। এ ব্যাপারে আমাকে সবথেকে বেশি সাহায্য করেছে আমার স্বামী। সুপর্ণ। সুপর্ণকে ভারী সুন্দর দেখতে। লম্বা, স্বাস্থ্যবান, মাথা ভরতি চুল। তবে গায়ের রং খানিকটা ময়লার দিকে। ময়লাই ভাল। ফ্যাটফ্যাটে সাদা পুরুষমানুষ আমার দু’চক্ষের বিষ।

এই ধরনের চিঠির তলায় সাধারণত নাম থাকে না। এটায় আছে। অপূর্ব। অপূর্ব মুখার্জি। হাতের লেখা দেখে বয়স বোঝা যাচ্ছে না। তবে পাকা হাতের লেখা। সেই লেখা যে সুন্দর এমনও নয়। প্রেমপত্র ধরে ধরে লেখা হয়। স্কুল-কলেজে আর পাঁচজন মেয়ের মতো আমিও কয়েকটা প্রেমপত্র পেয়েছিলাম। কিছুই মনে নেই, একটার শুধু হাতের লেখা মনে আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নকল। তার ওপর আবার ইচ্ছে করে কতকগুলো জায়গা কেটে কেটে নকশা আঁকা। ‘শেষের কবিতা’র পাণ্ডুলিপির মতো। নকলটা খারাপ করেনি, তবে বানানে অজস্র ভুল ছিল। বন্ধুরা আমাকে কিছুদিন ‘কবিগুরুর প্রেমিকা’ বলে খেপাল।

এটাও কি প্রেমপত্র? চল্লিশ ছুঁতে বেশি দেরি নেই এমন একজন মহিলাকে কে প্রেমপত্র দিল? ছি ছি।

আমি হাতের রুমাল দিয়ে নাকের দু’পাশ, গলা মুছলাম। ক’দিন হল দেখছি, মেজাজ খারাপ হলে একটু ঘেমে ঘেমে যাচ্ছি। প্রেশার হচ্ছে।

সুপর্ণর সঙ্গে যখন বিয়ে হয় তখন আমি পরীক্ষায় দুর্দান্ত রেজাল্ট করে স্কুলের চাকরিতে ঢুকে পড়েছি। দু’বছর হয়েও গেছে। মজার ব্যাপার হল যে রবিবার কাগজে আমার জন্য ‘পাত্র চাই’ বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিল সেই রবিবারই আমার বিয়ে পাকা হয়ে গেল। মাত্র একবেলা সময় লাগল। তবে বিজ্ঞাপনের কারণে নয়। সেদিন সকালে আমার দূর সম্পর্কের এক মামিমা সম্বন্ধ নিয়ে উপস্থিত হলেন। ছেলে আর ছেলের মা নাকি কোন বিয়েবাড়িতে আমাকে দেখেছে। সেদিনই মা-বাবার সঙ্গে কথা বলত, কিন্তু আমরা গাড়িতে হুস করে বেরিয়ে যাওয়ার কারণে বলতে পারেননি। তখন মামির কাছে খোঁজখবর নিয়েছে। রাজি থাকলে রবিবার সন্ধেবেলা কথা ফাইনাল করতে আসবে। বাবার তো মাথায় হাত।

‘ইস দেখো দেখি, গাদাখানেক টাকা নষ্ট হল, মিছিমিছি বিজ্ঞাপনটা দিলাম। বিয়েবাড়িটা যদি দুটোদিন আগে থাকত…।’

মামিমা বড় করে হেসে বললেন, ‘এটা একটা শুভ লক্ষণ। এখন ঠাকুরের কৃপায় যদি সবকিছু ঠিকঠাক হয়। ছেলে পাত্র হিসেবে অতি চমৎকার।’

পাত্র হিসেবে সুপর্ণ সত্যি চমৎকার। শুধু ভাল চাকুরে নয়, সুদর্শন, বিনয়ী এবং হাসিখুশি। কথাবার্তা হওয়ার পর বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। এই যুগে ভাবী শ্বশুরের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম চাট্টিখানি কথা নয়। বাড়ির সবাই গলে গেল। আমিও গলে গেলাম। এরকম একটা মানুষই যেন আমি মনে মনে চাইছিলাম। ঠোঁট টেপা গম্ভীর লোক আমার মোটে পছন্দ নয়। ওই লোকগুলো ভেতরে ভেতরে মহা পাজি হয়।

বাসরঘরে সুপর্ণ জমিয়ে দিয়েছিল। আমার পিসতুতো, মাসতুতো, খুড়তুতো বোনেরা বলল, ‘গান শোনাতে হবে জামাইবাবু। শোনাতেই হবে।’

ও বলল, ‘গান জানি না, তবে কবিতা বলতে পারি। দিদিমণি বউ তাই তার সঙ্গে মিলিয়ে কবিতা। চলবে?’

সবাই হইহই করে উঠল, ‘খুব চলবে।’

সুপর্ণ হাতমুখ নেড়ে শোনাল— ‘আমি আজ কানাই মাস্টার পড়ো মোর বিড়াল ছানাটি, আমি ওকে মারিনে মা মিছে…।’

বাসররাতে কনের হাসার ওপর কোনও নিষেধাজ্ঞা থাকে না। সে হেসে কুটোপাটিও খেতে পারে। একটাই শুধু নিয়ম, যতই হাসো মুখে আঁচল রাখতে হবে। আমি হাসতে হাসতে মুখে আঁচল রাখতেও ভুলে গেলাম।

সত্যিই পাত্র চমৎকার।

পাত্র হিসেবে চমৎকার এই মানুষটা স্বামী হিসেবে কতখানি গোলমেলে বুঝতে পারলাম ঠিক দশদিনের মাথায়। সেদিন সুপর্ণ দত্ত তার নববিবাহিতা স্ত্রীকে চড় মারে।

চিঠিটা এসেছে কাল বিকেলের ডাকে। আজ ফার্স্ট পিরিয়ডের পর কানাই দিল। কানাই আমাদের অফিস স্টাফ। অফিসের ঠিকানায় চিঠিপত্র এলে গুছিয়ে রাখে। আমি এইট বি-র ক্লাস করে রেজিস্টার জমা দিতে গিয়েছিলাম। কানাই বলল, ‘ম্যাডাম, আপনার চিঠি। আর এই ম্যাগাজিনটাও আছে।’ ম্যাগাজিন না কচু। এসব কলকাতার পাবলিশার্সদের বুলেটিন। স্কুল বইয়ের সিজন শুরুর তিনমাস আগে থেকে জ্বালাতন শুরু করবে। শিক্ষা, শিক্ষা পদ্ধতি, সিলেবাস এইসব নিয়ে হাবিজাবি ক’টা লেখা, বাকি সব বইয়ের বিজ্ঞাপন। আমি শুধু চিঠিটা নিলাম। বিয়ের পরে প্রথমদিকে কোয়ার্টারেই চিঠি নিতাম। যেদিন দেখলাম, সব চিঠির সঙ্গে সুপর্ণ আমার মায়ের চিঠিও পড়ছে সেদিন থেকে ঠিকানা বদলে স্কুলে করেছি। সুপর্ণর অবশ্য একটা গুণ ছিল। সে কখনও লুকিয়ে চিঠি পড়ত না। আমার সামনেই পড়ত। তারপর হেসে বলত, ‘বীণা, তোমার মা কিন্তু বেশ গুছিয়ে বাংলা লিখতে পারেন। তাই না?’

সাদা লম্বা খাম। তবে খানিকটা ভেজা ভেজা। কানাইয়ের কাণ্ড। জলের ওপর খামটা রেখেছিল। আমি কড়া চোখে কানাইয়ের দিকে তাকালে সে জিব কাটল। আমি দ্রুত খামের মুখ ছিঁড়ে কাগজটা বের করলাম।

এই ফাঁকে চড়ের গল্পটা বলে নিই। যে দিদিমণি ভুলেও কখনও ছাত্রীদের গায়ে হাত তোলেনি তার চড় খাওয়ার গল্পটা নিশ্চয়ই ইন্টারেস্টিং হবে। বিয়ের পর পর আমাদের তখন গাদাগুচ্ছের নেমন্তন্ন। প্রায় সন্ধেতেই সেজেগুজে ওর মোটরবাইকের পেছনে চেপে বেরিয়ে পড়ি। সুপর্ণ বিকেলে অফিস থেকে ফোন করে।

‘মনে আছে বীণা?’

‘হ্যাঁ, মনে আছে। আজ তো তোমার বন্ধুর বাড়ি।’

‘বন্ধু নয়, কলিগ। আমাদের অ্যাকাউন্টসে আছে। বিয়ের সময় কলকাতায় যেতে পারেনি।’

আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম, ‘আমার টায়ার্ড লাগছে। পরপর এতগুলো…। আজকের দিনটা ক্যানসেল করা যায় না? শরীরটা ভাল লাগছে না।’

সুপর্ণও চুপ করে থাকে মুহূর্তখানেক। তারপর বলে, ‘না, করা যায় না।’

আমি একটু আপসেট হই। নরম গলাতেই বলি, ‘কেন? নেক্সট শনিবার যদি যেতাম?’

সুপর্ণ কঠিন গলায় বলে, ‘না, আজই যাব।’

আমি তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিই। হেসে বলি, ‘ঠিক আছে বাবা, আজ যাচ্ছি, তবে এই উইকে কিন্তু আর নয়। আবার কটাদিন গ্যাপ দিয়ে।’

সুপর্ণ তীক্ষ্ণ গলায় বলে, ‘না, রোজই তোমাকে যেতে হবে। যতক্ষণ আমি বলব, ততক্ষণ যেতে হবে। বীণা, এ বাড়িতে তুমি আমার কথামতো চলবে, তোমার কথামতো নয়। আর হ্যাঁ, শোনো, আজ তোমার শাড়ি আমি বেছে দেব। পরশু তুমি নীল রং বেছেছিলে। আমি লক্ষ করে দেখেছি, ব্লু-তে তোমায় মানায় না। এরপর থেকে সাজগোজের আগে আমাকে জিজ্ঞেস করে নেবে।’

মোবাইল রেখে দিয়ে সারা বিকেল আমি চুপ করে বসে রইলাম। খুব কান্না পেল। তার থেকেও বেশি রাগ হল। দাঁতে দাঁত চেপে সেই রাগ লুকোলাম। সন্ধের মুখে গা ধুলাম, চুল বাঁধলাম। ওয়ার্ডরোব খুলে শাড়ি, জামা, হাতের ব্যাগ, রুমাল বের করলাম।

সবকিছুর রং নীল।

সুপর্ণ সেদিন বাড়ি ফিরে এসে আমাকে চড় মারে। তারপর ঠান্ডা গলায় বলে, ‘যাও, শাড়িটা বদলে এসো।’

অন্য কোনও মেয়ে হলে তুলকালাম কাণ্ড করত। আমিও হয়তো করতাম, কিন্তু পারলাম না। রাগতে গিয়ে দেখলাম, রাগ খুঁজে পাচ্ছি না। লুকোতে লুকোতে হারিয়ে ফেলেছি! আমি নিঃশব্দে শাড়ি বদলাতে গেলাম।

চিঠিতে কোনও সম্বোধন নেই—

‘সেদিন তোমাকে দেখার পর থেকেই আমার ইচ্ছে হয়েছিল, একটু কথা বলি। কিন্তু চারপাশে এত লোক ছিল যে পারলাম না। তোমার মোবাইলে কয়েকবার ফোন করে দেখলাম সুইচ অফ। মনে হয় নম্বরটা ভুল। তখন ভাবলাম চিঠি লিখব। তাও দুটো সপ্তাহ পার হয়ে গেল। চিঠি লিখতে অস্বস্তি হচ্ছিল। ভয়ও পাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম, যদি কিছু মনে করো। আজ সাহস করে লিখে ফেললাম। সেদিন তোমাকে নীল রঙে দারুণ দেখাচ্ছিল। খুব সুন্দর। বিউফুল। ইতি তোমার অপূর্ব।’

প্রথম ধাক্কাটা সামলে নেওয়ার পরই কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। আমি করিডরে দাঁড়িয়েই আরও একবার কাগজটার ওপর চোখ বোলালাম। এপাশ-ওপাশ তাকালাম। কেউ দেখছে না তো? দুটো মেয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এদিকে আসছিল, আমাকে দেখে আবার নেমে গেল। নিশ্চয় ভয় পেয়েছে। গত কয়েক বছরে আমি এই ব্যাপারটা করতে পেরেছি। ছাত্রীরা আমার কাছে ঘেঁষতে চায় না। কলিগরা পারলে অ্যাভয়েড করে। পুরনোরা কেউ কেউ ছেড়ে চলে গেছে। নতুনরাও অস্বস্তি পায়। কেন পাবে না? তারা আমার রাগ, বিরক্তি, খিটখিটেপনা সহ্য করবে কেন? কারও বাড়িতে নেমন্তন্ন হলে সবার আগে আমাকে বলা হত। আমি হতাম লিডার। হইচই বাধিয়ে দিতাম। সবার কাছ থেকে চাঁদা তুলে দোকানে ছুটতাম, উপহার কিনতাম। সবাই বলত, ‘বীণার টেস্ট খুব ভাল।’ একবার তো কী কেলেঙ্কারি। ছন্দার বিয়ের সময় চাঁদার পুরো টাকাটাই হারিয়ে বসলাম। বিয়ে বলে কথা, একটু-আধটু নয়, অনেকটা টাকা। আমার চোখে জল চলে এল। শুধু টাকার শোকে নয়, খুব চিন্তা হল। চিন্তা হবে না? বিয়ে দু’দিন বাদেই। নিজের এটিএম থেকে যে তুলে সেই সময়ের মতো ম্যানেজ করব তার উপায় নেই। বিয়ের পর আমার এটিএম কার্ড, চেকবই, ব্যাঙ্কের কাগজপত্র সব সুপর্ণর কাছে থাকত।

‘ওসব তোমার রেখে দরকার নেই। মেয়েরা আবার হিসেবপত্র বোঝে নাকি? যখন লাগবে চেয়ে নেবে।’

আমি বললাম, ‘ক্রেডিট কার্ডটা অন্তত দাও।’

সুপর্ণ হেসে বলল, ‘খেপেছ? বাড়িতে কাবুলিওয়ালা চলে আসবে।’

বাধ্য হয়ে রাতে ওকে সব বললাম। সুপর্ণ বলল, ‘একটা টাকাও দেব না।’

আমি বললাম, ‘কেন?’

সুপর্ণ বলল, ‘চাঁদার টাকাগুলো নিজের কাছে রাখার আগে একবারও আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে?’

‘এতে জিজ্ঞেস করার কী আছে? স্কুলের ব্যাপার।’ আমি অবাক হলাম।

‘জিজ্ঞেস করার আছে। সবই আমাকে জিজ্ঞেস করার আছে। আর যদি না থাকে তা হলে এখন বলতে এসেছ কেন? যাও বিরক্ত কোরো না।’

মনে পড়ে অনেক কষ্টে ধার করে সেই টাকা জোগাড় করেছিলাম। মাসে মাসে একশো-দুশো করে মিটিয়েছি। তারপর থেকে আর ওসবের মধ্যে যাই না। শুধু চাঁদা নয়, নেমন্তন্ন বাড়িতে যাওয়াও কমিয়ে দিয়েছি। আর এখন তো কলিগরাই আমাকে বাদ দিয়েছে। যেটুকু নয়, শুধু সেটুকু বলে। আমি জানি, দু’-একটা লুকোয়ও। স্কুলের ফাংশন-টাংশনেও আমি একঘরে। দর্শক আসনে বসে চলে আসি। শুধু অনেক বছর পর গতমাসে…।

কে অপূর্ব? কার এত সাহস? কে আমার সঙ্গে এই ঠাট্টা করল? আমাকেই করেছে তো? আমি খাম উলটে দেখলাম। না, কানাই ডুবিয়েছে ভালই। নাম ঠিকানার জায়গাটাই ভিজিয়েছে। থেবড়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তবু ‘বীণা দত্ত’ই তো মনে হচ্ছে। এই তো স্পষ্ট ‘দত্ত’ লেখা। অবন্তীনগর উচ্চবালিকা বিদ্যালয়টাও পড়তে পারছি।

সরস্বতী পুজোর দিন জন্মেছিলাম বলে মা শখ করে নাম রেখেছিল বীণা। নাম হিসেবে খুবই বিচ্ছিরি আর প্রাচীন। বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলত, ‘ভাগ্যিস সরস্বতী পুজোর দিন হলি, একটু এদিক-ওদিক হলে বিরাট ঝামেলা হত। লক্ষ্মী পুজোয় জন্মালে তোর নাম রাখতে হত পেঁচা। আমরা তোকে ডাকতাম মিস পেঁচা।’

ঠাট্টা হলেও একথায় রাগ হত। ফরসা, টানা টানা চোখ, টিকলো নাকের বালিকাকে পেঁচা বললে রাগ হবে না। আমি রাগ লুকিয়ে জোরে জোরে হাসতাম। বন্ধুরাও জানত, আমি রাগতে পারি না। তবে নাম একেবারে ব্যর্থ হল না। গান শিখলাম। বেশি কিছু নয়, মোটামুটি। গলা যে মারাত্মক কিছু তা নয়। বিয়েটিয়ের জন্য যতটা দরকার হয়। তবে আমার দরকার হয়নি। সুপর্ণর বাড়ি থেকে যখন দেখতে এসেছিল, মা লজ্জা লজ্জা মুখ করে একবার বলল, ‘মেয়ের গান শুনবেন না?’

আমার শাশুড়ি সুন্দর করে হেসে বলেছিলেন, ‘শুনে কী করব দিদি? ওর নামেই তো গান। কী বীণা, তাই না মা?’

আমার এত ভাল লাগল! যে নামের জন্য একসময় বন্ধুরা খেপিয়েছিল, সেই নামকে যে কেউ এমন চমৎকার করে ভাবতে পারে! সেদিন ভেবেছিলাম, বিয়ের পর গানটা নতুন করে শুরু করলে কেমন হয়?

শুরুও করেছিলাম। বাড়িতে হারমোনিয়াম নিয়ে বসতাম। স্কুলে অনুষ্ঠান হলে লজ্জা লজ্জা মুখে একটা-দুটো গাইতে শুরু করলাম। একদিন সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে এসে সুপর্ণ বলল, ‘শুনলাম, তুমি নাকি আজ স্কুলে গান করেছ?’

আমি উৎসাহী গলায় বললাম, ‘নবনীতাদির ফেয়ারওয়েল ছিল। তুমি কোথা থেকে শুনলে?’

সুপর্ণ শুকনো হেসে বলল, ‘ছোট জায়গা, খবর চলে আসে।’

আমি আহ্লাদি গলায় বললাম, ‘কী গান গেয়েছি বলো তো?’

জানি না। কী গান।’

আমি বললাম, ‘যারা কাছে আছে তারা কাছে থাক, তারা তো পারে না জানিতে—/ তাহাদের চেয়ে তুমি কাছে আছ, আমার হৃদয়খানিতে। গানটা সুন্দর না?’

‘গানটা সুন্দর।’

আমি একটু সরে এসে বললাম, ‘শুনবে?’

সুপর্ণ মুখ তুলে বলল, ‘হ্যাঁ শুনব।’

আমি খুব খুশি হলাম। বললাম, ‘জানো কোয়ার্টারের সবাই ধরেছে পুজোর সময় গাইতে হবে। ষষ্ঠীর দিন। এখানে স্টেজ হবে, রিহার্সাল হবে। ভাল হবে না?’

সুপর্ণ গম্ভীর গলায় বলল, ‘তুমি গাইবে না বীণা।’

আমি চমকে উঠলাম, ‘মানে!’

‘টিচার মানুষ বাইরে নাচগানের মধ্যে থাকাটা ঠিক নয়।’

‘রবীন্দ্রসংগীত তো খারাপ কিছু নয়।’

‘খারাপ ভালর প্রশ্ন উঠছে না। প্রশ্ন হল, আমার পছন্দ কি পছন্দ নয়। আমার বউ রাস্তায় রাস্তায় গেয়ে গেয়ে বেড়াক এটা আমার পছন্দ নয় বীণা।’

আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, ‘আমার তো পছন্দ।’

সুপর্ণ সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এখন আর তার কোনও দাম নেই।’

শুধু বাইরে নয়, এমনকী বাড়িতেও গান বন্ধ করে দিলাম। যত দিন গেল আমার কাছে। পরিষ্কার হতে থাকল, মানুষটার কাছে সত্যি আমার মতামতের আলাদা কোনও মূল্য নেই। তার ইচ্ছেই আমার ইচ্ছে। তার পছন্দই আমার পছন্দ। জামাকাপড়, গয়নাগাটি থেকে বকাঝকা আদর সবটাই পরিমাণে হয়তো অনেক, কিন্তু তার খুশিমতো। সেই খুশিতে আমাকে খুশি হতে হবে। মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে আমাকে আদরে সোহাগে ব্যতিব্যস্ত করে তুলত সুপর্ণ। একবারও জিজ্ঞেস করত না আমার ভাল লাগছে কি না, আমি ক্লান্ত কি না। আবার সারা সপ্তাহ অপেক্ষা করে থাকলেও গায়ে হাত দিত না। আমি ছটফট করলে বিরক্ত হত। এমনও হয়েছে, যখন না পেরে জোরাজুরি করেছি বালিশ আর চাদর হাতে ড্রইংরুমে শুতে চলে গেছে। আমার অপমানের দিকে ফিরেও তাকায়নি। সকালে স্বাভাবিক গলায় বলেছে, ‘চা দাও বীণা। তোমার বানানো চা না খেয়ে দিন শুরু করতে আজকাল ভাল লাগে না। ব্যাড হ্যাবিট করে দিয়েছ ডার্লিং।’

আমি বলতাম, ‘আদিখ্যেতা।’

বলে হাসতাম। হাসা উচিত নয়, তবু হাসতাম। কী করব? আমি যে রাগ লুকোতে পারি।

অনেকদিন পর গতমাসে আবার বাইরে গান করতে হল। টাউন হলে স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশন ছিল। আমাদের নিয়ম হল প্রতি বছরই শিক্ষিকাদের কেউ গান গেয়ে অনুষ্ঠান শুরু করবে। এবার পৌষালির গাওয়ার কথা ছিল। সকাল থেকে ওর ছেলের ধুম জ্বর। বড়দি আমাকে ডেকে বলল, বীণা, তোমাকে ম্যানেজ করতে হবে।’

‘আমি! আমি তো কত বছর গানটানের মধ্যে নেই বড়দি। আমাকে ছেড়ে দিন।’

‘ইমপসিবল, এতদিনের একটা নিয়ম, যা পারো করে দাও। প্লিজ। পুরোটা গাইতে হবে না, দু’-চারটে লাইনই যথেষ্ট। পৌষালি পারবে না শুনে ভেবেছিলাম শাল্মলীকে বলব। সে বেচারিরও কী অবস্থা তো দেখছ, গলাটলা বসে যাচ্ছেতাই অবস্থা।’

আমি চুপ করে রইলাম। বড়দি নিচু গলায় বলল, ‘আমি তোমার সমস্যাটা জানি। ইফ ইউ ওয়ান্ট আই ক্যান টক উইথ সুপর্ণ। বলব?’

আমার শরীর ঝনঝন করে উঠল। চোয়াল কঠিন হয়ে গেল। আমি ঠোঁট কামড়ে বললাম, ‘না, আমি গাইব।’

আমি গাইলাম। তিন-চার লাইন নয়, পুরো গানই গাইলাম। বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দ ধারা। গান খুব ভাল হল না। জড়তা ছিল। আবার একেবারে খারাপও নয়। সকলেই প্রশংসা করল। আমি অবশ্য গায়ে মাখিনি। বাড়ি ফিরে এসে সুপর্ণকে বলিনিও। আমার ধারণা ও খবর পেয়ে গেছে। তা ছাড়া এটা কোনও প্রয়োজনীয় কথা নয়। আজকাল সুপর্ণর সঙ্গে প্রয়োজন ছাড়া আমি কথা বলি না। সেও বলে না। দু’জনে চুপ করে টিভি দেখি। চুপ করে খাই। চুপ করে বসে থাকি ও চুপ করে শুতে যাই। আমাদের শোওয়ার জায়গা এখন আলাদা। সুপর্ণ ড্রইংরুমে ব্যবস্থা করেছে। বাবুকে নিয়ে আমি শুই। ছেলেটার বড্ড খারাপ স্বভাব হয়েছে, রাতে হাত-পা ছোড়ে। অনেকটা জায়গা লাগে।

মজার কথা হল, সুপর্ণ যে বিয়ের পর আমার সবকিছুতে ‘না’ বলত এমন নয়। বহু কিছুতেই সায় দিয়েছে। সিনেমা, থিয়েটার, বন্ধুর বাড়ি বা বাবার ওখানে যাব বললে নিজেই ব্যবস্থা করে দিত। নিয়েও যেত। শুধু এইটুকু নয়, বাইরে কোথাও বেড়াতে যেতে চাইলেও এক পায়ে খাড়া। এক দিনের নোটিশে অফিস ছুটি নিয়ে বসে আমাকে চমকে দিত।

‘চলো পাহাড়ে যাই। ছোড়দিরা পেলিং ঘুরে এল।’

‘খেপেছ, সি বিচ ফেলে পাহাড়! আমি ভাইজ্যাকের টিকিট কাটতে দিয়েছি।’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘টিকিট কাটতে দিয়েছ! সে কী, আমাকে একবার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলে না?’

সুপর্ণ অবাক হয়ে বলল, ‘এতে জিজ্ঞেস করার কী আছে? আই লাইক সি। সমুদ্র স্নান করার মতো মজা আর কীসে আছে? আই ট্রাভেল এজেন্টকে টিকিট করতে বলে দিলাম।’

আমি বাথরুমে গিয়ে মনে মনে গুনলাম। ষোলো, সতেরো, আঠেরো…। খেয়াল করলাম রাগ লুকোতে দেরি হচ্ছে। সময় লাগছে।

আমি বদলাতে শুরু করলাম। বাবু হওয়ার পর সেই বদলটা চোখে পড়ার মতো হল। সন্তান হওয়ার পর রাগী মানুষের রাগ কমে। শান্ত মানুষ আরও শান্ত হয়। আমার হল উলটো। দুম করে হল না, হল ধীরে ধীরে।

একদিকে সুপর্ণর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হল, অন্যদিকে একটা খিটখিটে মেজাজ, বিরক্তি, চাপা রাগ থাবা গেড়ে ভেতরে বসতে লাগল। গত দু’বছরে সেটা বড় আকার নিয়েছে। আমার বকুনিতে পরপর মোট চারজন কাজের মাসি কাজ ছেড়ে দিয়েছে। স্কুলেও একই কাগু। মেয়েরা সামান্য দুরন্তপনা করলে বকুনি, মারধর শুরু করলাম। একটা সময় সব টিচাররা কামাই করলে সাবস্টিটিউশন ক্লাসগুলো আমি কেড়ে নিতাম। হাসিমুখে চক ডাস্টার হাতে চলে যেতাম। পড়াতে ভালবাসতাম। এখনও বাসি, কিন্তু, এখন আর যাই না। একটার বেশি দুটো এক্সট্রা ক্লাস ঘাড়ে চাপলেই কলিগদের সঙ্গে ঝগড়া করি। গটগট করে হেডমিস্ট্রেসের ঘরে চলে যাই।

চিঠিটা কী করব? ফেলে দেব? সেটাই উচিত। অসভ্যতামিটা কে করেছে খুঁজতে শুরু করলে বিপদ হতে পারে। খবর ছড়িয়ে পড়বে। একটা স্ক্যান্ডালের মতো। আজকাল মেয়েরা অন্যরকম হয়ে গেছে। দশ বছর আগের মতো নেই। এরকম একবার হয়েছিল। আমাদের বাংলার টিচার তপতীর বিয়ের পর মেয়েরা বাথরুমে লিখেছিল— ‘তপতী ম্যাডাম আজ বরকে চুমু খেয়ে স্কুলে এসেছে।’

কথাটা দ্রুত স্কুলে ছড়িয়ে পড়ে। আমরাও জেনে যাই। ‘মাথা ধরেছে,’ বলে তপতী স্কুল থেকে হাফছুটি নিয়ে চলে গেল। কাজটা কে করেছে জানা যায়নি, তবে ক্লাস ইলেভেনের কোনও মেয়ের কাণ্ড, এটা ধরা গিয়েছিল। বড়দি বাথরুমের দেয়াল চুমকাম করালেন। গোটা ইলেভেন ক্লাসকে একদিনের জন্য সাসপেন্ড করলেন। তাতে আরও কেলেঙ্কারি হল। স্কুলের বাইরেও ঘটনা জানাজানি হয়ে গেল। আমার বেলায় কী হবে? মেয়েরা কী লিখবে? বীণাদি লাভলেটার পেয়েছে? ইস।

ভাবতে ভাবতে খামটা দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দিলাম করিডরের পাশের পাঁচিলের বাইরে। স্টাফরুমে এলাম ধীর পায়ে। খাম ফেললেও চিঠির কাগজটা যে কখন ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখেছি খেয়াল করিনি। অথবা কে জানে হয়তো খেয়াল করেছি।

স্টাফরুমে তন্দ্রা এককোণে বসে খাতা দেখছে। পায়ের আওয়াজে মুখ তুলে বলল, ‘কী হল বীণাদি, শরীর খারাপ নাকি?’ আমি মাথা নাড়লাম। জল খেলাম। এক কাপ চা পেলে হত। উঠে গিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে না।

লোকটা আমাকে কোথায় দেখল? কবে দেখল? নাকি সবটাই বানানো? বানানোই হবে। আমার মতো বুড়ি মহিলাকে ‘সুন্দর’ বলতে হলে বানিয়েই বলতে হয়। তার ওপর আবার ‘বিউটিফুল’! ঠাস করে একটা চড় লাগালে আমি কত বড় বিউটিফুল টের পেত।

বুধবার এই সময়টা আমার পরপর দুটো ক্লাস অফ। ফাঁকা স্টাফরুমে বসে থাকি। বসে বসে বিরক্তও লাগে। খাতাটাতা দেখার না থাকলে চুপ করে কতক্ষণ বসে থাকা যায়? আগে খুব বই পড়তাম। আজকাল ভাল লাগে না। মনে হয় সব গল্পই একরকম। নিজের জীবনের মতোই একঘেয়ে।

মুখ তুলে বাইরে তাকালাম। এদিকটায় অনেক গাছপালা। স্টাফরুমের জানলা জুড়ে কৃষ্ণচূড়া লাল হয়ে আছে। রোদ পড়ে ঝলমল করছে। বাঃ ভারী সুন্দর তো! গোটা গাছটা যেন লজ্জায় রাঙা! সামান্য কৃষ্ণচূড়া এত সুন্দর হয়?

সাধারণভাবে বাড়িতে এবং বাইরে রাগ, মেজাজ খারাপ, বিরক্তি এসব দেখাচ্ছিলাম, কিন্তু জিনিস ভাঙার কড়া রাগ আমি প্রথম দেখালাম বাবুর জন্মদিনের দিন। পাঁচ বছরের জন্মদিন। একটা কাচের ডিনার সেট ভেঙে ফেললাম। জিনিসটা ভারী সুন্দর ছিল। চারপাশে গোল করে ফুল পাতা আঁকা। পাতাগুলো সব ডিশের গায়ে, ফুলগুলো বাটিতে। টেবিলে মিলিয়ে মিলিয়ে সাজালে মনে হত টেবিল জুড়ে একটা গোটা বাগান!

গেস্টরা চলে গেলে সুপর্ণ আর আমি খেতে বসেছিলাম সেদিন। রাত এগারোটা বেজে গেছে। ওইসব এলাকা ন’টার পরই নিঝুম হয়ে যায়। গাদাখানেক রান্নাবান্না করে ক্লান্ত লাগছিল। খেতে ইচ্ছে করছিল না। তার ওপর বাবুর শরীরটাও ভাল ছিল না। সকাল থেকেই ঘ্যানঘ্যান করছে। সুপর্ণ খেতে খেতে বলল, ‘এবার স্কুলটা ছেড়ে দাও বীণা।’

আমি আকাশ থেকে পড়লাম। খাওয়া থামিয়ে বললাম, ‘চাকরি ছাড়ব! কেন? এতদিনের চাকরি ছেড়ে দেব!’

‘হ্যাঁ দেবে। ছেড়ে বাবুকে দেখবে।’

‘তার জন্য তো আয়া আছে।’

সুপর্ণ বলল, ‘আয়া দিয়ে ছেলের কাঁথা পরিষ্কার হয়, ছেলে মানুষ হয় না। সেই কারণেই চাকরি ছাড়বে।’

আমি শান্ত গলায় বলি, ‘না, ছাড়ব না।’

সুপর্ণ মুখে তুলে তাকাল। শক্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছ বীণা।’

‘চাকরি করাটা বাড়াবাড়ি নয়। আর সবই তো ছেড়েছি।’

সুপর্ণ ঠান্ডা গলায় বলল, ‘কালই রেজিগনেশন লেটার জমা দিয়ে আসবে।’

আমার রাগ বাড়তে লাগল। খুব চেষ্টা করলাম পুরনো ম্যাজিকে সেই রাগ লুকোতে। পারলাম না। সুপর্ণর থেকেও ঠান্ডা গলায় বললাম, ‘না। দেব না।’

সুপর্ণ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘শাট আপা আমি কাল থেকে তোমায় যেতে দেব না।’

আমি চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম, ‘তা হলে সমস্যা হবে।’

‘কী সমস্যা?’ সুপর্ণর ঠোঁটের ফাঁকে বিদ্রুপের হাসি৷

আমিও মুখ তুলে তাকালাম। বললাম, ‘দেখবে কী সমস্যা?’

‘হ্যাঁ দেখব।’

এক মুহূর্তও দেরি না করে হাতের ধাক্কায় টেবিলের পাশে সাজানো ডিনার সেটটা মেঝেতে ফেলে দিলাম। খুব যে কিছু ভেবে ফেললাম এমন নয়। লতাপাতা, ফুলসুদ্ধু প্লেট, বাটি খানখান আওয়াজে ভেঙে ছড়িয়ে পড়ল। পাশের ঘরে বাবু ঘুম ভেঙে কেঁদে উঠল ফুঁপিয়ে। আমি শান্তভাবে উঠে পড়লাম। হাত ধুয়ে ছেলেকে ঘুম পাড়াতে গেলাম বেডরুমে। গুনগুন করে গান করলাম, এই ঘুম ঘুম চাঁদ, ঝিকিমিকি তারা…। বাচ্চারা গান শুনলে চট করে ঘুমিয়ে পড়ে। বাবু ঘুমোত না, দেরি করত। একসময় এসে দেখি সুপর্ণ তখনও ডাইনিং-এ বসে আছে। তার মুখ রক্তশূন্য, ফ্যাকাশে। আমি ভাঙা কাচ তুলতে তুলতে নরম গলায় বললাম, ‘যাও শুয়ে পড়ে। জল খেয়েছ?’

বাবু হওয়ার পর থেকেই সুপর্ণর সঙ্গে যে ব্যবধান তৈরি হচ্ছিল, ভাঙা ডিনার সেট সেই ব্যবধান এক ধাক্কায় অনেকটা বাড়িয়ে দিল। আমি বুঝতে পারলাম, এবার সুপর্ণর পালা। সে আমার কাছে রাগ লুকোতে শুরু করেছে। সে ম্যাজিক শিখছে।

চিঠিটা আর একবার পড়লে কেমন হয়? আচ্ছা, কাজটা কোনও স্টুডেন্টের বাবা-কাকার নয় তো? মাঝবয়সি পুরুষমানুষগুলো বদ হয়। চান্সটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কয়েক বছর আগে এরকম একটা ঘটনা হয়েছিল। ক্লাস নাইনের এক ছাত্রীর বাবা আমাদের ইংলিশ টিচার বিদিশার জন্য রোজ মেয়েকে স্কুলে দিতে আসত। যতক্ষণ না বিদিশা আসে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত গেটের সামনে। বেচারির দোষ নেই। বিদিশা ছিল মারাত্মক ধরনের সুন্দরী। তার ওপর আবার রোজ রোজ চুলে ফুল লাগাত। শিমুল, পলাশ, টগর— যখন যেটা পেত। বিয়ে করে, চাকরি ছেড়ে বিদিশা চলে গেল আমেদাবাদ। তারপর সেই লোক আসা বন্ধ করল।

এই ‘অপূর্ব’ না কে সেও কি আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে? মা গো!

কানদুটো গরম লাগছে। রাগের গরম নয়, অন্যরকম গরম।

আমি তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে জগ থেকে গ্লাসে জল ভরে আনলাম। তন্দ্রার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললাম, ‘অ্যাই তন্দ্রা, চা খাবি?’

তন্দ্রা খাতা থেকে মুখ তুলে অবাক হয়ে তাকাল। কতদিন পরে সে আমাকে হাসতে দেখছে! কতদিন স্টাফরুমে কাউকে আমি চা খেতে বলিনি! অথচ আমিই ছিলাম চপ কাটলেট আনানোর পাণ্ডা। টিচাররা বলত, ‘বীণা, তুই হলি আমাদের তেলেভাজা রানি।’

সুপর্ণ তেলেভাজা পছন্দ করে না। ও ভালবাসে মিষ্টি। বাড়িতে তৈরি মিষ্টি। বিয়ের বছরখানেক পর একদিন আমি ওর মায়ের কাছ থেকে টেলিফোনে মুগ ডালের মিষ্টি শিখে নিলাম। সারা দুপুর ধরে অনেক পরিশ্রম করে বানিয়েও ফেললাম। সুপর্ণ অফিস থেকে ফিরলে বললাম, ‘তুমি মুখ হাত ধুয়ে নাও, একটা সারপ্রাইজ আছে।’

সুপর্ণ ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কী সারপ্রাইজ?’

‘আছে। এখন বল্লব না।’

সুপর্ণ জামাকাপড় ছাড়তে ছাড়তে বলল, ‘বীণ, তুমি জানো না, আমি সারপ্রাইজ পছন্দ করি না?’

আমি হেসে বললাম, ‘জানি, কিন্তু এটা করবে।’

পছন্দ করল না। গম্ভীর মুখে মিষ্টির প্লেট সরিয়ে রাখল সুপর্ণ।

‘কী হল?’

‘হজমের প্রবলেম চলছে।’

‘একটা খেলে কিছু হবে না। এত কষ্ট করে বানালাম।’

সুপর্ণ চায়ের কাপ টেনে নিয়ে বলল, ‘হবে না আমি জানি, কিন্তু খাব না। এরপর থেকে রুটিনের বাইরে কোনও টিফিন করার আগে টেলিফোনে আমাকে জিজ্ঞেস করে নেবে। জিনিসগুলো নষ্ট হল মিছিমিছি।’

তারপর আর কোনওদিন আমি বাড়িতে মিষ্টি বানাইনি।

শুধু স্কুল গেটের কথা ভাবছি কেন? পাজি লোকটা তো অন্য কোথাও আমাকে দেখতে পারে। বাজারে? আমাদের কোয়ার্টারের আশপাশে নয় তো? না না, তা হবে না। আমাদের চারপাশে সব ভদ্রলোকের বাস। অফিসার্স কোয়ার্টার। এখানে এরকম নোংরামি কখনও হতে পারে না। তবে লোকটা যে আমার ওপর নজর রাখে এটা বোঝা যাচ্ছে। নইলে নীল রংটার কথা বলল কী করে? নীল রঙের কী? শাড়ি? নাকি সালোয়ার কামিজ? শাড়ি হলে স্কুল। সালোয়ার হলে তাও দোকান-বাজার হতে পারে। নীল রঙের আর আমার কী আছে? না আর কিছু নেই।

উঠে গিয়ে তন্দ্রার পাশে বসলাম। চা খেলাম। গল্প করলাম। বাবুর গল্প, ওর মেয়ের গল্প। তন্দ্রা ওর এক ননদের কথা বলল। মেয়েটা নাকি ভীষণ কুচুটে তার লাগানি ভাঙানি। শাশুড়ির কান ভাঙায়। আমি বললাম, ‘একদিন আচ্ছা করে দিবি। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

তন্দ্রা হাসতে হাসতে বলল, ‘তোমাকে নিয়ে যাব।’

‘তাই যাস।’

‘বীণাদি, সেদিন কিন্তু তুমি ভারী ভাল গাইলে।’

আমি লজ্জা পেলাম। হেসে বললাম, ‘দূর, বড়দি জোর করল।’

‘ঠিক করেছে। শুনেছি, একসময় তুমি এসব খুব করতে। গান, নাচ মেয়েদের নিয়ে নাটকও করেছ। তখনও তো আমি জয়েন করিনি।’

‘রাখ তো, ওসব ছেলেমানুয বয়েসের ব্যাপার। বুড়ি হয়ে গেছি। ভাবছি কীর্তন শিখব।’

তন্দ্রা হেসে উঠল। আমিও হাসলাম। অনেকদিন পর স্টাফরুমে বসে হাসলাম। শুধু স্টাফরুমে হাসলাম না, পরের ক্লাসে গিয়ে একটা কাণ্ড করলাম। মেয়েদের বললাম, ‘আজ হিষ্ট্রি বই খুলতে হবে না। আজ আমি তোমাদের কাছ থেকে গল্প শুনব। রাজি?’ মেয়েরা আতঙ্কে এর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ল। আমি হেসে বললাম, ‘উঁহুঁ শুধু মাথা নাড়লে হবে না, গল্প কিন্তু হাসির হতে হবে।’

ফুটফুটে একটা মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে গল্প শুরু করতেই আমার একটা সাংঘাতিক কথা মনে পড়ল।

আমার একটা নীল রঙের নাইটি আছে না? আছে তো। তবে ওটা আমি পরি না। পরি না তার কারণ আছে। ঘরের আলো না নিভিয়ে ওই জিনিস পরা যায় না। শরীরের সব বোঝা যায়। ছেলে বড় হচ্ছে। কোনওদিন ভুল করিনি তো? আলো জ্বেলে, জানলা খুলে… এখন তো গরম, সাউথের জানলাটা তো খোলা থাকে… এ মা। বাইরে থেকে কেউ… না না, এসব আমি বেশি ভাবছি। আমার মাথাটি কি একেবারেই গেল নাকি? তা ছাড়া এরকম একটা বাজে বিষয় নিয়ে আমি এত ভাবছিই বা কেন? আমার বয়স কি চোদ্দো? নাকি যোলো? ছি ছি!

মেয়েরা গল্প বলে বেশি হাসাতে পারল না। তবু খুব হাসলাম। না হাসলে ওরা দুঃখ পাবে। ক্লাস থেকে বেরিয়ে ঠিক করলাম বাড়ি ফেরার পথে খামের মতো কাগজটাও ফেলে দেব।

ফেলেও দিলাম। বাজার পেরোনোর সময় ব্যাগ খুলে, কাগজটা দলা পাকিয়ে ছুড়ে ফেললাম রাস্তার ধারে। বিকেলের আলো মরতে শুরু করেছে। আমার এরকমই হয়, বাড়ি ফিরতে সন্ধে হয়ে যায়।

বাবুর ক্লাস সেভেন চলছে। পড়াশোনায় একদম মন নেই। সারাদিন খেলবে আর সন্ধে হলেই পড়ার টেবিলে মাথা রেখে ঘুম। প্রথম প্রথম ‘বাবা বাছা’ করতাম। আজকাল মেজাজ ঠিক থাকে না। ধৈর্য হারাই। থাকবে কী করে? গতবার ফেল করতে করতে বেঁচে গেছে। চুলের মুঠি ধরে ছেলেকে টেনে তুলি। তাতেও না হলে পিঠে চড় থাপ্পড় দিই।

বাবু খোলা বইয়ের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। বইটা সরিয়ে ভাঁজ করে রাখলাম। একটু ঘুমিয়ে নিক। সুপর্ণ এখনও ফেরেনি। ও আজকাল যতটা পারে দেরি করে ফেরে। অফিসের পর আড্ড জুটিয়েছে। বাঁচা গেছে।

শাওয়ার খুলে স্নান করতে একসময় ভাল লাগত। এখন সময় নষ্ট মনে হয়। তাড়াহুড়ো করে কয়েক মগ মাথায় ঢেলেই পালিয়ে আসি। বাথরুমে ঢুকে জামাকাপড় ছেড়ে শাওয়ার খুললাম। কাগজটা কি ফেলার আগে ছিঁড়ে কুটিকুটি করা উচিত ছিল? কেউ যদি তুলে দেখে? কী দেখবে? নামধাম তো কিছু নেই। একটা মেয়েকে একটা ছেলের লেখা চিঠি। সেই ছেলের নাম অপূর্ব কিন্তু মেয়েটা কে? যে পড়বে সে বেচারি খুব ঘাবড়ে যাবে।

আমি হাসতে হাসতে স্নান করতে লাগলাম। প্রথমে আস্তে, তারপর জোরে হাসতে লাগলাম। সমস্যা কী? বাইরে তো আওয়াজ যাচ্ছে না। এক চিলতে শাওয়ার থেকে যেন সহস্র ধারায় জল পড়ছে। বৃষ্টির মতো। তারা গড়িয়ে নামছে আমার মুখ, ঠোঁট, কাঁধ বেয়ে। ভিজিয়ে দিচ্ছে আমার স্তন, পেট, নাভিমূল। ছুঁয়ে যাচ্ছে আমার কটিদেশ, জঙ্ঘা, যোনিপথ। যেন আমাকে আদর করছে। আমাকে ভালবাসছে।

আমি ফিসফিস করে বললাম, ‘অপূর্ব, অপূর্ব, অপূর্ব…।’

অনেকদিন পর বালিশ হাতে গভীর রাতে সুপর্ণর কাছে গেলাম।

‘এ কী! তুমি?’

‘সরে শোও। আমি শোব।’

‘এইটুকু বিছানায়?’

আমি ফিসফিস করে বললাম, ‘হ্যাঁ সরো।’

সূপর্ণ অবাক গলায় বলল, ‘বাবু?’

‘ঘুমোচ্ছে।’

অনভ্যাসের অস্বস্তি সরাতে সুপর্ণর খানিকটা সময় লাগল। তারপর জড়িয়ে ধরল আমাকে। বহুদিন পর তো, তাই ব্যথা পেলাম। ভুলে যাওয়া ভাল লাগায় শিউরে উঠি।

কানাই মাথা চুলকে বলল, ‘একটা ভুল হয়ে গেছে ম্যাডাম।’

আমি খাতাগুলো গোছাতে গোছাতে বললাম, ‘কী হল?’

‘কাল আপনাকে একটা চিঠি দিয়েছিলাম..’

থমকে দাঁড়ালাম। ভুরু তুলে তাকালাম। কানাই ঢোঁক গিলে বলল, ‘চিঠিটা আপনার নয় ম্যাডাম। খামের ওপর লেখা ছিল রীণা দত্ত, জল লেগে এমন হয়ে গেল যে আমি রীণার বদলে ভুল করে পড়লাম বীণা…। খেয়াল হল, ছুটির পর, আপনি তখন বাড়ি চলে গেছেন।’

আমার পায়ের তলায় মাটি কি একটু কেঁপে উঠল? আমি নই! আমার চিঠি নয়? রীণা দত্ত! সে কে? নতুন আসা কোনও অল্পবয়সি টিচার? সুন্দরী ছাত্রী কেউ? কে?

কানাইকে প্রশ্নটা করতে গিয়ে নিজেকে সামলালাম। এ প্রশ্ন করা যায় না। অন্তত ওই চিঠি পড়ার পর কখনওই করা যায় না।

‘ম্যাডাম, খামটা ফেরত দেবেন?’ কাঁচুমাচু গলায় বলল কানাই।

ঘুরে দাঁড়িয়েও এক মুহূর্ত থমকালাম। স্বভাব অনুযায়ী একথা শোনার পর আমার শরীর ঝনঝন করে ওঠবার কথা। হল না। মুখ ফিরিয়ে নিচু গলায় বললাম, ‘সরি কানাই, ওই চিঠি আমি ফেলে দিয়েছি। খুলে পড়িওনি।’

কথাটা ঠিক নয়। ওই চিঠি আমি ফেলে দিইনি। আমি রেখে দিয়েছি।

দীর্ঘ করিডর ধরে আমি হাঁটছি। হাঁটছি নীল শাড়ি পরে, ক্লান্ত পায়ে।

আমার সময়, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০০৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *