নীল সায়রের অচিনপুরে
প্রথম পরিচ্ছেদ – ঝড়
ঢং!
বড়ো ঘড়িতে বাজল সাড়ে-সাতটা! এই হল বিমল ও কুমারের চা পানের সময়৷ রামহরি চায়ের ট্রে হাতে করে ঘরে ঢুকেই দেখল, তারা দুজনে একখানা খবরের কাগজের উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে, আগ্রহ ভরে৷
এই খবরের কাগজ ও এই আগ্রহ রামহরির মোটেই ভালো লাগল না৷ কারণ সে জানে, রীতিমতো একটা জবর খবর না থাকলে বিমল ও কুমার খবরের কাগজের উপর অমন করে ঝুঁকে পড়ে না৷ এবং তাদের কাছে জবর খবর মানে সাংঘাতিক বিপদের খবর! এই খবর পড়েই হয়তো ওরা বলে বসবে, ‘ওঠো রামহরি! বাঁধো তল্পিতল্পা! আজকেই আমরা কলকাতা ছাড়ব!’ কতবার যে এমনই ব্যাপার হয়েছে, তার আর হিসাব নেই৷
অতএব রামহরি ওই খবরের কাগজগুলোকে দু-চক্ষে দেখতে পারত না৷ তার মতে, ওগুলো হচ্ছে মানুষের শত্রু ও বিপদের অগ্রদূত!
রামহরি চায়ের ট্রে-খানা সশব্দে টেবিলের উপরে রাখল-কিন্তু তবু ওরা কাগজ থেকে মুখ তুলল না!
রামহরি বিরক্ত কন্ঠে বলল, ‘কী, চা-টা খাবে, না আজ কাগজ পড়েই পেট ভরবে?’
বিমল ফিরে বসে বলল, ‘কী ব্যাপার রামহরি, সক্কালবেলায় তোমার গলাটা এমন বেসুরো বলছে কেন?’
‘বলি, খবরের কাগজ পড়বে না চা খাবে?’
কুমার হেসে বলল, ‘খবরের কাগজের ওপর তোমার অত রাগ কেন?’
‘রাগ হবে না? ওই হতচ্ছাড়া কাগজগুলোই তো তোমাদের যত ছিষ্টিছাড়া খবর দেয়, তোমরা পাগলের মতো বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে চাও!’
বিমল হো হো করে হেসে উঠে বলল, ‘নাঃ-রামহরি আমাদের বড্ড বেশি চিনে ফেলেছে, কুমার!’
‘না, তোমাদের ছেলেবেলা থেকে দেখছি, তোমাদের চিনব কেন? ওসব কাগজ-টাগজ পড়া ছেড়ে দাও!’
‘হ্যাঁ, রামহরি, এইবার সত্যিসত্যিই কিছুকালের জন্য আমরা কাগজ-টাগজ পড়া একেবারে ছেড়ে দেব!’
রামহরি ভারি খুশি হয়ে বলল, ‘তোমার মুখে ফুল-চন্নন পড়ুক! আমি তাহলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচি!’
‘বাঁচবে কি মরবে জানি না রামহরি, তবে আমরা যে ইচ্ছা করলেও আর কাগজ পড়তে পারব না, এ বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই৷ কারণ এবারে যে-দেশে যাচ্ছি সেখানে খবরের কাগজ পাওয়া যায় না৷’
রামহরির মুখে এল অন্ধকার ঘনিয়ে৷ বলল, ‘তার মানে?’
‘আমরা যে শিগগিরই সমুদ্রযাত্রায় বেরোব৷’
‘ওরে বাবা সুমুদ্দরে? এবারে আবার কোন চুলোয়? পাতালে নয়তো?’
‘হতে পারে৷ তবে, আপাতত আগে যাব সাহেবদের দেশে-অর্থাৎ বিলাতে৷ সেখান থেকে একখানা গোটা জাহাজ রিজার্ভ করে যাব আফ্রিকা আর আমেরিকার মাঝখানে, আটলান্টিক মহাসাগরের এমন কোনো দ্বীপে, যার নাম কেউ জানে না৷’
‘সঙ্গে যাচ্ছে কে কে?’
‘আমি, কুমার, বিনয়বাবু, কমল, বাঘা আর তুমি-অর্থাৎ আমাদের পুরো দল৷ এবারের ব্যাপার গুরুতর, তাই দু-ডজন শিখ, গুর্খা আর পাঠানকেও ভাড়া করতে হবে৷’
রামহরি গম্ভীর মুখে বলল, ‘বেশ, তোমরা যেখানে খুশি যাও, কিন্তু এবারে আর আমি তোমাদের সঙ্গে নেই’-বলেই সে হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷
বিমল চায়ের ট্রে টেনে নিয়ে মুখ টিপে হেসে বলল, ‘রামহরি নাকি এবারে আমাদের সঙ্গে যাবে না! কিন্তু যাত্রার দিন দেখা যাবে সেইই হনহন করে আমাদের আগে আগে যাচ্ছে! . . . যাক, নাও কুমার চা নাও! চা খেতে খেতে কাগজখানা আর একবার গোড়া থেকে পড়ো তো শুনি! বার বার শুনে সমস্ত ঘটনা মনের মধ্যে একেবারে গেঁথে ফেলতে হবে৷’
কুমার খবরের কাগজখানা আবার তুলে নিয়ে চেঁচিয়ে পড়তে লাগল-
‘আটলান্টিক মহাসাগরে এক বিচিত্র রহস্যের সন্ধান পাওয়া গিয়াছে৷ যাঁহারা বলেন, এই বৈজ্ঞানিক যুগে পৃথিবীতে আর নতুন বিস্ময়ের ঠাঁই নাই, তাঁহারা ভ্রান্ত৷ ধরণি বিপুলা, মানব-সভ্যতার সৃষ্টি-রহস্যের কতটুকু ধরা পড়িয়াছে? প্রতি যুগেই সভ্যতা মনে করিয়াছে, জ্ঞানের চরম সীমা তাহার হস্তগত, তাহার পক্ষে আর নতুন শিখিবার কিছুই নাই৷ কিন্তু পরবর্তী যুগেই তাহার সে-গর্ব চূর্ণ হইয়া গিয়াছে৷
‘গ্রিকরা নাকি সভ্যতার উচ্চতম শিখরে আরোহণ করিয়াছিল-জ্ঞান-বিজ্ঞানে তাহারা ছিল অগ্রগণ্য৷ কিন্তু আজিকাল কলেজের ছাত্ররাও প্লেটো ও সক্রেটিসের চেয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে অধিক অগ্রসর! গ্রিক সভ্যতা বিলুপ্ত হইল, পৃথিবীকে বিজয়-চিৎকারে পরিপূর্ণ করিয়া আবির্ভুত হইল রোমীয় সভ্যতা! তাহার বিশ্বাস ছিল ভূমণ্ডলকে দেখিতে পায় সে নিজের নখ-দর্পণে! কিন্তু, রোমানদের অঙ্কিত পুরাতন মানচিত্রে আধুনিক পৃথিবীর প্রায় অর্ধাংশকেই দেখিতে পাওয়া যায় না৷ মধ্যযুগের পরেও এই সেদিন পর্যন্ত উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর মেরু, দক্ষিণ মেরু এবং আরও কত বড়ো বড়ো দ্বীপের অস্তিত্ব পর্যন্ত কাহারও জানা ছিল না! অন্যান্য গ্রহের কথা ছাড়িয়া দি, আজও পৃথিবীতে অনাবিষ্কৃত নব নব দেশ নাই, এমন কথা কেহ কি জোর করিয়া বলিতে পারে? দক্ষিণ আমেরিকায় ও আফ্রিকায় এখনও এমন একাধিক দুর্গম দেশ ও দুরারোহ পর্বত আছে, এ-যুগের কোনো সভ্য মানুষ সেখানে পদার্পণ করে নাই! ওই সব স্থানে অতীতের কত গভীর রহস্য নিদ্রিত হইয়া আছে, তাহা কে বলিতে পারে? হয়তো কত নতুন জাতি, কত অজানা জীব সেখানে নিজেদের জন্য স্বতন্ত্র এক সমাজ বা বসতি গড়িয়া বসবাস করিতেছে, আমরা তাহাদের কোনো সংবাদই রাখি না!
অতঃপর আগে যে রহস্যের ইঙ্গিত দিয়াছি তাহার কথাই বলিব৷
‘সম্প্রতি এস. এস. বোহিমিয়া নামক একখানি জাহাজ ইউরোপ হইতে আমেরিকায় যাত্রা করিয়াছিল৷
‘কিন্তু আটলান্টিক মহাসাগরের ভিতরে আচম্বিতে এক ভীষণ ঝড় উঠিল৷ এই স্মরণীয় দৈব-দুর্ঘটনার সংবাদ আমাদের কাগজে গত সপ্তাহেই প্রকাশিত হইয়া গিয়াছে এবং সকলেই এখন জানেন যে, ওরকম ভূমিকম্পের সঙ্গে ঝড় আটলান্টিক মহাসাগরে গত এক শতাব্দীর মধ্যে কেহ দেখে নাই৷ উক্ত দৈবদুর্বিপাকে আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যবর্তী বহু দ্বীপে ও তীরবর্তী বহু দেশে অগণ্য লোক ও সম্পত্তি ক্ষয় হইয়াছে৷ কোনো কোনো ছোটো ছোটো দ্বীপের চিহ্ন পর্যন্ত সমুদ্রের উপর হইতে একেবারে বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে! বহু বাণিজ্যপোত ও যাত্রীপোত অদ্যাবধি কোনো বন্দরে ফিরিয়া আসে নাই এবং হয়তো আর আসিবেও না৷
‘বোহিমিয়াও পড়িয়াছিল এই সর্বগ্রাসী প্রলয়ঝটিকার মুখেই! কিন্তু ঝটিকা দয়া করিয়া যাহাদের গ্রহণ করে নাই, বোহিমিয়া সৌভাগ্যবশত তাহাদেরই দলভুক্ত হইয়া পড়িয়াছে৷ গত আঠারোই তারিখে সে ক্ষতবিক্ষত দেহে আবার স্বদেশের বন্দরে ফিরিয়া আসিয়াছে৷ এবং তাহার যাত্রীরা বহন করিয়া আনিয়াছে এক বিস্ময়কর কাহিনি! জনৈক যাত্রী যে বর্ণনা দিয়াছে আমরা এখানে তাহাই প্রকাশ করিলাম!
‘অপার সাগরে ঝটিকা জাগিয়া বোহিমিয়ার অবস্থা করিয়া তুলিয়াছিল ভয়াবহ! ঝড়ের দাপটে প্রথমেই তাহার ইঞ্জিন খারাপ হইয়া যায়৷ সমুদ্রের তরঙ্গ বিরাট আকার ধারণ করিয়া উন্মত্ত আনন্দে জাহাজের ডেকের উপর ক্রমাগত ভাঙিয়া পড়িতে থাকে,-সেই তরঙ্গের আঘাতে দুইজন আরোহী জাহাজের উপর হইতে অদৃশ্য হইয়া যায়৷ জাহাজের চারিদিকে বহুক্ষণ পর্যন্ত উত্তাল তরঙ্গের প্রাচীর ছাড়া আর কোনো দৃশ্যই দেখা যায় নাই৷ প্রলয়ঝটিকার হুহুংকার এবং মহাসাগরের গর্জন সেই অসীমতার সাম্রাজ্যকে ধ্বনিময় ও ভয়ানক করিয়া তোলে৷ আকাশব্যাপী নিবিড় অন্ধকার অশ্রান্ত বিদ্যুৎবিকাশে অগ্নিময় হইয়া উঠে৷ প্রকাশ, এত ঘন ঘন বিদ্যুতের সমারোহ এবং বজ্রের কোলাহল নাকি কেউ কখনো দেখেও নাই শোনেও নাই! এই মহা হুলুস্থুলুর মধ্যে, এই শত শত শব্দ-দানবের প্রবল আস্ফালনের মধ্যে, প্রাকৃতিক বিপ্লবের এই সর্বনাশা আয়োজনের মধ্যে নিজের নির্দিষ্ট গতিশক্তি হারাইয়া বোহিমিয়া একান্ত অসহায়ভাবে বিশাল সমুদ্রের প্রচণ্ড স্রোতে এবং ক্রুদ্ধ ঝটিকার দুর্নিবার টানে দিগ্বিদিক ভুলিয়া কোথায় ছুটিতে থাকে, তাহা বুঝিবার কোনো উপায়ই ছিল না৷ জাহাজের ইলেকট্রিসিটি জোগান দিবার যন্ত্রও বিগড়াইয়া যায়৷ ভিতরে বাহিরে অন্ধকার, আকাশে ঝড়, সমুদ্রে বন্যা ও তাণ্ডবের বিপ্লব, জাহাজের কামরায় কামরায় শিশু ও নারীদের উচ্চ ক্রন্দনধ্বনি, কাপ্তেন কিংবর্তব্যবিমূঢ়, নাবিকেরা ভীতিব্যাকুল,-এই কল্পনাতীত দুর্ভাগ্যের মধ্য দিয়া বোহিমিয়া ভাসিয়া আর ভাসিয়া চলিয়াছে-কোন অদৃশ্য মহাশক্তির তাড়নায়-কোন অদৃশ্য নিয়তির নিষ্ঠুর আকর্ষণে! প্রতিমুহূর্তে তার নরক-যন্ত্রণাময় অনন্ত মুহূর্তের মতো-পাতালের অতলতা কখন তাকে গ্রাস করে, সকলে তখন যেন কেবল তাহারই প্রতীক্ষা করিতেছিল!
‘প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পরে ঝড় যখন শান্ত হইয়া আসিল, ভগবানের অনুগ্রহে বোহিমিয়া তখনও ভাসিয়া রহিল৷ এ-যাত্রা রক্ষা পাইল বুঝিয়া ধর্মভীরু যাত্রীরা প্রার্থনা করিতে বসিল৷
‘কিন্তু জাহাজ এখন কোথায়? তখন শেষ রাত্রি, চন্দ্রহীন শূন্যতা চতুর্দিকে আঁধার-প্রপাতের বাঁধ খুলিয়া দিয়াছে৷ জাহাজের ভিতরেও আলোর আশীর্বাদ নাই৷ কাপ্তেন ডেকের উপরে আসিয়া দাঁড়াইলেন৷
‘আটলান্টিক মহাসাগর তখনও যেন রুদ্ধ আক্রোশে গর্জন করিতেছে, তাহার বিদ্রোহী তরঙ্গদল তখনও মৃত্যুসংগীতের ছন্দে রুদ্রতাল বাজাইয়া ছুটিয়া যাইতেছে, জাহাজ তখনও তাহাদের কবলে অসহায় ক্রীড়নক!
‘অনেকক্ষণ পরে কাপ্তেন সবিস্ময়ে দেখলেন বহুদূরে অনেকগুলো আলোক-শিখা জমাট অন্ধকার পটে যেন সুবর্ণরেখা টানিয়া দিতেছে!
‘বোহিমিয়া সেইদিকেই অগ্রসর হইতেছিল৷
‘আলোক-শিখাগুলি ক্রমেই স্পষ্ট ও সমুজ্জ্বল হইয়া উঠিতে লাগিল! দূরবিনের সাহায্যে কাপ্তেন দেখিলেন, সেগুলো মশালের আলো এবং তাহারা রাত্রিচর আলেয়ার মতো এদিকে-ওদিকে চলাফেরা করিতেছে!
‘কাপ্তেন বুঝিলেন, বোহিমিয়া স্রোতের টানে কোনো দ্বীপের দিকে অগ্রসর হইতেছে এবং দ্বীপের বাসিন্দারা মশাল জ্বালিয়া যে-কারণেই হউক সমুদ্রতীরে বিচরণ করিতেছে৷ সাগরতীরবর্তী দ্বীপের বাসিন্দারা ঝড়ের পরে প্রায়ই এইরকম বাহিরে আসিয়া অপেক্ষা করে, বিপদগ্রস্ত জাহাজ বা নরনারীদের সাহায্য করিবার শুভ ইচ্ছায়৷
‘খানিকক্ষণ পরে হঠাৎ আলোগুলো অদৃশ্য হইয়া গেল৷ নিকটেই কোনো দ্বীপ আছে জানিয়া কাপ্তেন ভগবানকে বারংবার ধন্যবাদ দিলেন৷
‘তাহার পর পূর্ব আকাশে কুমারী উষা যখন তার লাল চেলির ঝলমলে আঁচল উড়াইয়া দিল, সাগরবাসী রূপসি নীলিমা যখন শান্ত স্বরে প্রভাতি স্তব পাঠ করিতে লাগিল, সকলের চোখের সামনে তখন ভাসিয়া উঠিল-স্বপ্নরঙ্গমঞ্চের অর্ধস্ফুট দৃশ্যপটের মতো এক অভিনব দ্বীপের ছবি!
‘সে দ্বীপটি বড়ো নয়-আকারে হয়তো চার-পাঁচ মাইলের বেশি হইবে না৷ কিন্তু তাহাকে সাধারণ দ্বীপের পর্যায়ে ফেলা যায় না৷ সে দ্বীপকে একটি পাহাড় বলাই উচিত!
‘তাহার ঢালু গা ধীরে ধীরে উপরদিকে উঠিয়া গিয়াছে৷ নীচের দিকটা কম ঢালু, সেখান দিয়া অনায়াসেই চলাফেরা করা যায়, কিন্তু তাহার শিখর দিকটা শূন্যে উঠিয়াছে প্রায় সমান খাড়া ভাবে৷ সাগরগর্ভ হইতে তাহার শিখরের উচ্চতা দেড় হাজার ফুটের কম হইবে না৷
‘দূরবিন দিয়া কাপ্তেন দেখিলেন, সেই পাহাড়-দ্বীপের কোথাও কোনো গাছপালা-এমনকী সবুজের আভাসটুকু পর্যন্ত নাই! আর-একটি অভাবিত আশ্চর্য ব্যাপার হইতেছে এই যে, দ্বীপের গায়ে নানাস্থানে দাঁড়াইয়া আছে মস্ত মস্ত প্রস্তরমূর্তি-এক-একটি মূর্তি এত প্রকাণ্ড যে, উচ্চতায় দেড়শত বা দুইশত ফুটের কম নয়! পাহাড়ের গা হইতে সেই বিচিত্র মূর্তিগুলিকে কাটিয়া-খুদিয়া বাহির করা হইয়াছে! দূর হইতে দেখিলে সন্দেহ হয়, যেন প্রাচীন মিশরি ভাস্করের গড়া মূর্তি!
‘কিন্তু গতকল্য যাহারা এই গিরি-দ্বীপে মশাল জ্বালিয়া চলাফেরা করিতেছিল, তাহাদের কাহাকেও আজ সকালে দেখা গেল না৷ এই দ্বীপের পাথুরে গায়ে যেমন শ্যামলতাও নাই, তেমনই কোনো জীবের বা মানুষের বসতির চিহ্নমাত্রও নাই! এমনকী, সেখানে একটা পাখি পর্যন্ত উড়িতেছে না!
‘তিনি বহুকাল কাপ্তেনি করিতেছেন, আটলান্টিক মহাসাগরের প্রত্যেক তরঙ্গটি তাঁহার নিকটে সুপরিচিত, নাবিক-ব্যবসায়ে তিনি চুল পাকাইয়া ফেলিয়াছেন, কিন্তু এই দ্বীপটিকে কখনো দেখেন নাই, বা তাহার অস্তিত্বের কথা কাহারও মুখে শ্রবণও করেন নাই৷ . . . অথবা এই দ্বীপের কথা শুনিয়াও তিনি ভুলিয়া গিয়াছেন? তাঁহার এমন ভ্রম কি হইতে পারে? দ্বীপের খুব কাছে আসিয়া নোঙর ফেলিয়া কাপ্তেন তাড়াতাড়ি নিজের কেবিনে ছুটিয়া গেলেন৷ চার্ট বাহির করিয়া অনেক খুঁজিলেন, কিন্তু তাহাতে এই শৈলদ্বীপের নামগন্ধও পাইলেন না! তবে এখানে এই দ্বীপটি কোথা হইতে আসিল?
‘অনেক ভাবিয়াও এই প্রশ্নের কোনো উত্তর না পাইয়া কাপ্তেন আবার বাহিরে আসিলেন৷ এবং তাহার পর জন-আষ্টেক নাবিককে বোটে চড়িয়া দ্বীপটি পরীক্ষা করিয়া আসিতে বলিলেন৷
‘নাবিকরা বোট লইয়া চলিয়া গেল৷ দ্বীপের তলায় বোট বাঁধিয়া নাবিকরা উপরে গিয়া উঠিল-জাহাজ হইতে সেটাও স্পষ্ট দেখা গেল; তারপর তাহারা সকলের চোখের আড়ালে গিয়া পাহাড়ের মধ্যে কোথায় অদৃশ্য হইল৷
‘দুই ঘণ্টার ভিতরে নাবিকদের ফিরিয়া আসিবার কথা৷ কিন্তু তিন-চার-পাঁচ ঘণ্টা কাটিয়া গেল, তবু কাহারও দেখা নাই! কাপ্তেন চিন্তিত ও ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন! আরও দুই ঘণ্টা গেল! বেলা ছয়টায় নাবিকেরা গিয়াছে, এখন বেলা একটা-তাহারা কোথায় গেল?
‘এবারে কাপ্তেন নিজেই সদলবলে নতুন বোটে নামিলেন৷ এবারে সকলেই সশস্ত্র! কারণ কাপ্তেনের সন্দেহ হইল, দ্বীপের ভিতরে গিয়া নাবিকেরা হয়তো বিপদে পড়িয়াছে! কল্য রাত্রে যাহাদের হাতে মশাল ছিল তাহারা কাহারা? বোম্বেটে নয় তো, হয়তো এই নির্জন দ্বীপে আসিয়া তাহারা গোপনে আড্ডা গাড়িয়া বসিয়াছে!
‘দ্বিতীয় দল দ্বীপে গিয়া উঠিল৷ মহাসাগরের অশ্রান্ত গম্ভীর কোলাহলের মাঝখানে সেই অজ্ঞাত দ্বীপ বিজন ও একান্ত স্তব্ধ সমাধির মতো দাঁড়াইয়া আছে৷ অতিকায় প্রস্তরমূর্তিগুলো পর্বতেরই অংশবিশেষের মতো অচল হইয়া আছে, তাহাদের দৃষ্টিহীন চক্ষুগুলো অনন্ত সমুদ্রের দিকে প্রসারিত৷ মানুষ-ভাস্কর তাহাদের গড়া মূর্তির মুখের ভাবে ফুটায় মানুষেরই মৌখিক ভাবের প্রতিচ্ছবি৷ কিন্তু এই দানব-মূর্তিগুলোর মুখের ভাব কী কঠিন!
‘কোনো মূর্তির মুখেই মানুষি দয়া-মায়া স্নেহ প্রেমের কোমল ও মধুর ভাবের এতটুকু চিহ্ন নাই! তাহাদের দেখিলে প্রাণে ভয় জাগে, হৃদয় স্তম্ভিত হয়! প্রত্যেকেরই অমানুষিক মুখে ফুটিয়া উঠিয়াছে হিংস্র কঠোরতার তীব্র আভাস! বেশ বুঝা যায়, যাহারা এই সকল মূর্তি গড়িয়াছে তাহারা দয়া-মায়ার সঙ্গে পরিচিত নয়৷ তাহারা অতুলনীয় শিল্পী বটে, কিন্তু প্রচণ্ড নিষ্ঠুর!
‘কাপ্তেন সারাদিন ধরিয়া সেই দ্বীপের সর্বত্র ঘুরিয়া বেড়াইলেন৷ পাহাড়ের ঢালু গা বাহিয়া যতদূর উপরে উঠা যায়, উঠিলেন৷ তাহার পরেই খাড়া শিখরের মূলদেশ৷ সরীসৃপ ভিন্ন কোনো দ্বিপদ বা চতুষ্পদ ভূচর জীবের পক্ষেই সেই শিখরের উপরে উঠা সম্ভবপর নয়৷ প্রায় হাজার ফুট উপর হইতে কাপ্তেন ও তাঁহার সঙ্গীরা চতুর্দিকে চাহিয়া দেখিলেন, কিন্তু কোথাও নাবিকদের দেখা নাই৷ তাহাদের সচেতন করিবার জন্য বারংবার বন্দুক ছোড়া হইল, সে শব্দে নীরবতার ঘুম ভাঙিয়া গেল, কিন্তু নাবিকদের কোনো সাড়া নাই৷
‘সন্ধ্যার সময়ে কাপ্তেন সঙ্গীদের সহিত শ্রান্ত দেহে হতাশ মনে জাহাজে ফিরিয়া আসিলেন৷
‘পরদিন আবার দ্বীপে গিয়া খোঁজাখুঁজি শুরু হইল৷ সেদিনও সূর্য অস্ত গেল, কিন্তু হারা-নাবিকদের সন্ধান মিলিল না৷
‘এই দুই দিনের অন্বেষণে আরও কোনো কোনো অদ্ভুত তথ্য আবিষ্কৃত হইল৷
‘ঝড়ের রাত্রে দ্বীপে মশাল লইয়া যাহারা চলাফেরা করিয়াছিল, তাহারা কোথায় গেল?
‘আলো লইয়া পৃথিবীর একমাত্র জীব চলাফেরা করিতে পারে এবং সেই জীব হইতেছে মনুষ্য! কিন্তু দ্বীপে মানুষের বসতির কোনো চিহ্নই নাই! তবে কি সেগুলো আলেয়ার আলো? কিন্তু আলেয়ার জন্ম হয় জলাভূমিতে, এই পাষাণের শুষ্ক রাজ্যে আলেয়ার কল্পনাও উদ্ভট, মরুর বুকে আলোক-লতার মতোই অসম্ভব৷
‘মানুষ যেখানে থাকে, সেখানে জলও থাকে৷ কিন্তু সারা দ্বীপ তন্নতন্ন করিয়া খুঁজিয়াও ঝরনা, নদী বা জলাশয় আবিষ্কার করা যায় নাই৷
‘কিন্তু যাহারা মশাল জ্বালিয়াছিল, তাহারা তো মানুষ? যদি ধরিয়া লওয়া যায় তাহারা কোথাও কোনো গুপ্তস্থানে লুকাইয়া আছে, তাহা হইলেও প্রশ্ন উঠে, কী পান করিয়া তাহারা বাঁচিয়া থাকিবে? জল কোথায়? নদী বা নির্ঝর তো ধনরত্নের মতো লুকাইয়া রাখা যায় না! অন্তত তাহার শব্দও শোনা যায়! এবং এই পাহাড়-দ্বীপে কৃত্রিম উপায়ে জলাশয় খনন করাও অসম্ভব! সমুদ্রের লোনা জলেও জীবের প্রাণ বাঁচে না! তবে?
‘দ্বীপে যাহারা এমন প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড মূর্তি বহু বৎসর ধরিয়া গড়িয়াছে, তাহারাও তো মানুষ? তাহারা কোথা হইতে জলপান করিত?
‘আর এমন সব বিচিত্র মূর্তি, ইহাদের পিছনে রহিয়াছে বিরাট এক সভ্যতার ইতিহাস! কিন্তু সমগ্র দ্বীপে কোথায় সেই সভ্যতার চিহ্ন? এতবড়ো একটা সভ্যতা তো কোনো গুপ্ত সংকীর্ণ স্থানের মধ্যে লুকাইয়া রাখা যায় না! এবং চার্টে পাওয়া যায় না, এমন একটা দ্বীপ সুপরিচিত আটলান্টিক মহাসাগরে কোথা হইতে আসিল, সেটাও একটা মস্ত সমস্যা!
‘জাহাজের আট-আটজন নাবিক কি কর্পুরের মতন উবিয়া গেল?
‘বোহিমিয়ার প্রত্যেক আরোহীর বিশ্বাস, এ-সমস্তই ভৌতিক কাণ্ড!
‘তৃতীয় দিনেও কাপ্তেন আবার দ্বীপে গিয়া নাবিকদের খুঁজিবার প্রস্তাব করিয়াছিলেন৷ কিন্তু ভূতের ভয়ে কেহই আর তাঁহার সঙ্গে যাইতে রাজি হয় নাই৷ কাজেই জাহাজের ইঞ্জিন মেরামত করিয়া তাঁহাকে আবার দেশে ফিরিয়া আসিতে হইয়াছে৷
‘আটলান্টিক মহাসাগরের আজোর্স দ্বীপপুঞ্জ ও কেনারি দ্বীপপুঞ্জের মাঝখানে এই নূতন গিরি-দ্বীপের অবস্থান৷
‘কিন্তু এই দ্বীপের বিচিত্র রহস্যের কিনারা করিবে কে?’
কুমার পড়া শেষ করে কাগজখানা টেবিলের উপরে রেখে দিল৷
কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে বিমল বলল, ‘কুমার, জীবনে অনেক রহস্যেরই গোড়া খুঁজে বার করেছি আমরা৷ এবারেও এ-রহস্যের কিনারা আমরা করতে পারব, কী বলো?
কুমার বলল, ‘ওসব কিনারা-টিনারা আমি বুঝি না! সফলই হই আর বিফলই হই, জীবনে আবার একটা বৈচিত্র্য খুঁজে পাওয়া গেল, এইটুকুতেই আমি তুষ্ট!’
বিমল সজোরে টেবিল চাপড়ে উৎসাহিত কন্ঠে বলল, ‘ঠিক বলেছ! হাতে হাত দাও!’
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – ব্ল্যাক স্নেক
কলকাতা থেকে বোম্বে থেকে ভারতসাগরে!
দেখতে দেখতে বোম্বাই শহর ছোটো হয়ে আসছে এবং বড়ো বড়ো প্রাসাদগুলোর চুড়ো নিয়ে বোম্বাই যত দূরে সরে যাচ্ছে, তার দুই দিকে ক্রমেই দীর্ঘতর হয়ে জেগে উঠেছে ভারতবর্ষের তরুশ্যামল বিপুল তটরেখা!
ক্রমে সে-রেখাও ক্ষীণতর হয়ে এল এবং তার শেষ চিহ্নকে গ্রাস করে ফেলল মহাসাগরের অনন্ত ক্ষুধা! তারপর থেকে সমানে চলতে লাগল নীলকমলের রং-মাখানো অসীমতার নৃত্যচাঞ্চল্য-নীল আকাশ আর নীল জল ছাড়া পৃথিবীর সমস্ত পরিচিত রূপ চোখের আড়ালে গেল একেবারে হারিয়ে৷
ডেকের উপরে জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে বিমল বলল, ‘কুমার, ভারতকে এই প্রথম ছেড়ে যাচ্ছি না, কিন্তু তবু কেন জানি না, যতবারই ভারতকে ছেড়ে যাই ততবারই মনে হয়, আমার সমস্ত জীবনকে যেন ভারতের সোনার মতো সুন্দর ধুলোয় ফেলে রেখে, আত্মার অশ্রুভেজা মৃতদেহ নিয়ে কোন অন্ধকারে যাত্রা করছি!’
কুমার নিষ্পলক দৃষ্টিতে ভারতবর্ষের বিলুপ্ত তটরেখার উদ্দেশে তাকিয়ে ভারী ভারী গলায় বলল, ‘ভাই, স্বদেশের কাছ থেকে বিদায় নেওয়া কখনো হয়তো পুরোনো হয় না! যে-ভারতের শিয়রে নির্ভীক প্রহরীর মতো অটলভাবে দাঁড়িয়ে আছে তুষারমুকুট অমর হিমাচল, যে-ভারতের চরণতলে ভৃত্যের মতো ছুটোছুটি করছে অনন্ত পাদোদক নিয়ে রত্নাকর সমুদ্র, যে-ভারতের পবিত্র মাটি, জল, তাপ, বাতাস আর আকাশ আজ যুগযুগান্তর ধরে আমাদের দেহ গড়ে আসছে লক্ষ লক্ষ রূপে জ্ঞান-বিজ্ঞান-সভ্যতার আদি পুরোহিত, যে-অপূর্ব মহিমার আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে আজ আমরা ভারতবাসী বলে গর্বে সব জাতির উপরে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারি, আমাদের এমন গৌরবের দেশ ছেড়ে যেতে যার মন কেমন করে না, নিশ্চয়ই সে ভারতের ছেলে নয়!’
বিমল বলল, ‘যাঁরা ভারতের ছেলে নয় তারাও তো ভারতকে ভুলতে পারে না, কুমার! অতীতের পর্দা ঠেলে তাকিয়ে দেখো! ভারতকে শত্রুর মতো আক্রমণ করতে এল যুগে যুগে শক, হুন, তাতার আর মোগল, কিন্তু আর ফিরে গেল না! কেউ গেল ভারতের মহামানবের সাগরের অতলে তলিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে, কেউ ডাকল পরম শ্রদ্ধায় ভারতকেই স্বদেশ বলে! অমন যে আপন সভ্যতায় গর্বিত গ্রিকগণ, তাদেরও অসংখ্য লোক আলেকজাণ্ডারের দল ছেড়ে স্বদেশ ভুলে উত্তর ভারতেই বংশানুক্রমে বাসা বেঁধে রয়ে গেল! আমাদের এই ভারতকে স্বদেশের মতো ভালো না বেসে কেউ যে থাকতে পারে, এ-কথা আমি বিশ্বাস করি না৷’
বিমল যা ভেবেছিল, তাই৷ বুড়ো রামহরির পুরোনো অভ্যাসই হচ্ছে মুখে ‘না’ বলা, কিন্তু কাজের সময়ে দেখা যায়, তারই পা চলছে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি!
প্রৌঢ় বিনয়বাবু নিজের কেতাব আর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিয়ে ঘরের চার-দেওয়ালের মাঝখানেই বন্দি থাকতে ভালোবাসেন, কিন্তু বিমল ও কুমার সারা পৃথিবীতে ছুটোছুটি করতে বেরোবার সময়ে তাঁকে ডাক দিলে তিনিও দলে যোগ না দিয়ে পারেন না! আর তিনি এলে কমলও যে আসবে, এটাও তো জানা কথা!
আর ওই বিখ্যাত দিশি কুকুর, বাঘের মতন মস্ত বাঘা! ঠিক ভাবে পালন করলে বাংলার নিজস্ব কুকুরও যে কত তেজি, কত বলী আর কত সাহসী হয়, বিমল ও কুমারের নানা অভিযানে বহুবারই বাঘা সেটা প্রমাণিত করেছে৷ এবারেও আবার নতুন বীরত্ব দেখাবার সুযোগ পাবে ভেবে সে তার উৎসাহী ল্যাজের ঘন ঘন আন্দোলন আর বন্ধ করতে পারছে না৷
এবারে দলের সঙ্গে চলেছে বারোজন শিখ, ছয়জন গুর্খা, আর ছয়জন পাঠান৷ এরা সকলেই আগে ফৌজে ছিল৷ অনেকেই ভারতের সীমান্তে বা মহাযুদ্ধে ফ্রান্সে ও মেসোপটেমিয়া প্রভৃতি দেশে লড়াই করে এসেছে৷ পাকা ও অভিজ্ঞ বলেই তারা তাদের নিযুক্ত করেছে এবং সকলকে বন্দুক, অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র ও পোশাক-পরিচ্ছদ দিতেও ত্রুটি করা হয়নি৷ এতগুলি সশস্ত্র সৈনিক নিয়ে নতুন অভিযানে যাবার জন্যে সরকারি আদেশও গ্রহণ করা হয়েছে৷
জাহাজ এখন এডেন বন্দরের দিকে চলেছে৷ তারপর ইউরোপের নানা দেশের নানা বন্দরে বুড়ি ছুঁয়ে ফরাসিদেশের মারসেয়্য-এ গিয়ে থামবে৷ সেখানে নেমে সকলে যাবে রেলপথে পারি নগরে৷ . . . আধুনিক আর্ট ও সাহিত্যের পীঠস্থান পারি নগরীকে ভালো করে দেখবার জন্যে বিমল ও কুমারের মনে অনেকদিন থেকেই একটা লোভ ছিল৷ এই সুযোগে তারা সেই লোভ মিটিয়ে নিতে চায়৷
পথের বর্ণনা দিয়ে লাভ নেই৷ কারণ আমরা ভ্রমণকাহিনি লিখছি না৷
পারি শহরে গিয়ে প্রথম যেদিন তারা হোটেলে বাসা নিল, সেইদিনই খবরের কাগজে এক দুঃসংবাদ পেল৷ খবরটি হচ্ছে এই :
মি. টমাস মর্টন গত উনিশে নভেম্বর রাত্রে রহস্যময় ও অদ্ভুতভাবে হঠাৎ মৃত্যুমুখে পড়েছেন৷ এখনও বিস্তৃত কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি, তবে এইটুকু জানা গিয়েছে যে, তাঁর মৃত্যুর কারণ ‘ব্ল্যাক স্নেক’-এর দংশন৷ পাঠকদের নিশ্চয় স্মরণ আছে যে, সম্প্রতি যে এস. এস. বোহিমিয়া আটলান্টিক মহাসাগরের নতুন দ্বীপের সংবাদ এনে সভ্য জগতে বিশেষ উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে, মি. টমাস মর্টন ছিলেন তারই কাপ্তেন৷
বিমল দুঃখিত কন্ঠে বলল, ‘কুমার, ভেবেছিলাম প্রথমে লন্ডনে নেমেই আগে মি. মর্টনের দ্বারস্থ হব৷ তাঁকে আমাদের সঙ্গী হবার জন্যে অনুরোধ করব৷ কারণ ওই দ্বীপে যেতে গেলে পথ দেখাবার জন্যে বোহিমিয়ার কোনো পদস্থ কর্মচারীর সাহায্য না নিলে আমাদের চলবে না, আর এ-ব্যাপারে মি. মর্টনের চেয়ে বেশি সাহায্য অন্য কেউ করতে পারবেন না৷ কিন্তু আমাদের প্রথম আশায় ছাই পড়ল৷’
কুমার বলল, ‘ভগবানের মার, উপায় কী? আমাদের এখন বোহিমিয়ার অন্য কোনো কর্মচারীকে খুঁজে বার করতে হবে৷’
‘কাজেই৷’
বিনয়বাবু বললেন, ‘কিন্তু বিমল, হতভাগ্য মি. মর্টনের মৃত্যুর ব্যাপারে যে একটা অসম্ভব সত্য রয়েছে, সেটা তোমরা লক্ষ করেছ কি?’
‘কীরকম!’-বলেই বিমল খবরের কাগজখানা আবার তুলে নিল৷ তারপর যেন আপন মনেই বিড়বিড় করে বলল, ‘ব্ল্যাক স্নেক- অর্থাৎ কেউটে সাপ!’
বিনয়বাবু বললেন, ‘হ্যাঁ ঠিক ধরেছ৷ ব্ল্যাক স্নেক৷ আমরা যাকে বলি কেউটে সাপ৷ ব্ল্যাক স্নেক পাওয়া যায় কেবল ভারতে, আর আফ্রিকায়৷ ইংল্যান্ডে অ্যাডার ছাড়া আর কোনোরকম বিষধর সাপ নেই৷’
কুমার বলল, ‘এই ডিসেম্বর মাসের দুর্জয় বিলিতি শীতে ইংল্যান্ডে অ্যাডার সাপও নিশ্চয় বাসার বাইরে বেরোয় না৷ ভারতের কেউটে সাপও এখানে এলে এখন নির্জীব হয়ে থাকতে বাধ্য৷’
বিনয়বাবু বললেন, ‘যথার্থ অনুমান করেছ৷ এমন অসম্ভব সত্যকে মানি কেমন করে? এ-খবরে নিশ্চয় কোনো গলদ আছে৷’
বিমল গম্ভীরভাবে অবাক হয়ে ভাবতে লাগল, মর্টনের মৃত্যুসংবাদের মধ্যে সন্দেহ করবার যথেষ্ট কারণ আছে বটে৷
তিন দিন পরে তারা ফরাসিদের বিখ্যাত শিল্পশালা দেখে পথের উপরে এসে দাঁড়িয়েছে, এমন সময়ে শুনল রাস্তা দিয়ে একটা কাগজওয়ালা ছোকরা চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে ছুটছে- ‘লন্ডনে আবার ব্ল্যাক স্নেক, লন্ডনে আবার ব্ল্যাক স্নেক!’
কমল তাড়াতাড়ি দৌড়ে গিয়ে একখানা কাগজ কিনে আনল৷
পথের ধারেই ছিল একটা রেস্তোরাঁ৷ বিমল সকলকে নিয়ে তার ভিতরে গিয়ে ঢুকল৷ তারপর, এক কোণের একটি টেবিল বেছে নিয়ে বসে বিনয়বাবুর হাতে কাগজখানা দিয়ে বলল, ‘আপনি ফরাসি ভাষা জানেন, কাগজখানা অনুগ্রহ করে আমাদের পড়ে শোনান৷ আমার সন্দেহ হচ্ছে, আজকেও এতে কোনো খবর আছে যা আমাদের জানা উচিত৷’
বিনয়বাবু কাগজের মধ্যে খুঁজে একটি জায়গা বার করে পড়তে লাগলেন :
লন্ডনে আবার ব্ল্যাক স্নেক!
লন্ডন কি ভারত ও আফ্রিকার জঙ্গলে পরিণত হতে চলল? লন্ডনে ব্ল্যাক স্নেকের আবির্ভাব কি স্বপ্নেরও অগোচর নয়?
তিনদিন আগে আমরা হঠাৎ-বিখ্যাত এস. এস. বোহিমিয়ার কাপ্তেন মি. টমাস মর্টনের ব্ল্যাক স্নেকের দংশনে মৃত্যুর খবর দিয়েছি৷ কাল রাত্রে ওই জাহাজেরই দ্বিতীয় অফিসার মি. চার্লস মরিস আবার হঠাৎ মারা পড়েছেন৷ এবং তাঁরও মৃত্যুর কারণ ওই ভয়াবহ ব্ল্যাক স্নেক৷
এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহরই কারণ নেই৷ ইংল্যান্ডে সর্পবিষ সম্বন্ধে সর্বপ্রধান বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, মি. মরিসের মৃতদেহ পরীক্ষা করে দেখেছেন৷ লাশের কন্ঠদেশে সর্পদংশনের স্পষ্ট দাগ আছে৷ শবদেহ ব্যবচ্ছেদের পরে পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে যে, ব্ল্যাক স্নেকের বিষেই হতভাগ্য ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে৷
এবং এ-ব্যাপারে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কথা হচ্ছে এই যে, মি. মরিসের শয্যার তলায় একটি মৃত ব্ল্যাক স্নেকও পাওয়া গিয়েছে৷ এজাতের ব্ল্যাক স্নেক নাকি ভারতবর্ষ ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না৷ সাপটার সারা দেহ ক্ষতবিক্ষত! খুব সম্ভব মি. মরিস মৃত্যুর আগে নিজেই ওই সাপটাকে হত্যা করেছিলেন৷
পুলিশ এখন নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলির উত্তর অন্বেষণ করছে :
ক ৷৷ লন্ডনে কেমন করে ব্ল্যাক স্নেকের আগমন হল?
খ৷৷ এস. এস. বোহিমিয়ার কাপ্তেন মি. টমাস মর্টনের বাসা থেকে দ্বিতীয় অফিসার মি. চার্লস মরিসের বাসার দূরত্ব সাত মাইল৷ মি. মর্টনকে যে-সাপটা কামড়েছিল, লন্ডনের মতো শহরের সাত মাইল পার হয়ে তার পক্ষে মি. মরিসকে দংশন করা সম্ভবপর নয়৷ তবে কি ধরতে হবে যে লন্ডনে একাধিক ব্ল্যাক স্নেকের আবির্ভাব হয়েছে? কেমন করে তারা এল? কেন এল?
গ৷৷ অধিকতর আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে এই : মি. মর্টন ও মি. মরিস দুজনেই এস. এস. বোহিমিয়ার লোক৷ ব্ল্যাক স্নেক কি বেছে বেছে বোহিমিয়ার লোকদেরই দংশন করছে, না দৈবক্রমে এমন অসাধারণ ঘটনা ঘটে গেছে?
সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে, বোহিমিয়ার আটজন নাবিক নিরুদ্দেশ হবার পর যে দ্বিতীয় নৌকাখানা শৈলদ্বীপে গিয়েছিল, তার মধ্যে কেবল তিনজন লোক পাহাড়ের সর্বোচ্চ শিখরের তলদেশে গিয়ে উঠেছিলেন৷ বাকি সবাই অত উঁচুতে উঠতে রাজি হননি৷ পূর্বোক্ত তিনজন হচ্ছেন কাপ্তেন মি. মর্টন, দ্বিতীয় অফিসার মি. মরিস ও তৃতীয় অফিসার মি. জর্জ ম্যাকলিয়ড৷ এখন তিনজনের মধ্যে কেবল মি. ম্যাকলিয়ডই জীবিত আছেন৷
বোহিমিয়ার প্রত্যেক যাত্রীর-বিশেষত যাঁরা ওই শৈলদ্বীপে গিয়ে নেমেছিলেন তাঁদের-মনে বিষম আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে৷ তাঁদের ধারণা তাঁরা ওই দ্বীপ থেকে কোনো অজ্ঞাত অভিশাপ বহন করে ফিরে এসেছেন৷
কিন্তু আমরা এই অদ্ভুত রহস্যের কোনোই হদিস পাচ্ছি না৷ কোথায় আটলান্টিক মহাসাগরের নবআবিষ্কৃত এক অসম্ভব বিজন দ্বীপ, কোথায় আধুনিক সভ্যতার লীলাস্থল লন্ডন নগর, আর কোথায় সুদূর এশিয়ার ভারতবাসী ব্ল্যাক স্নেক! এই তিনের মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে বার করতে পারে, পৃথিবীতে এমন মস্তিষ্ক বোধ হয় নেই৷ লন্ডনের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বড়ো বড়ো ডিটেকটিভদের মাথাও গুলিয়ে গিয়েছে৷
প্রত্যেক মৃত্যুর যে কার্য ও কারণের সম্পর্ক থাকে, এখানে তার একান্ত অভাব৷
মি. মর্টন ও মি. মরিস-দুজনেই রাত্রিবেলায় শয্যায় শায়িত বা নিদ্রিত অবস্থায় সর্প দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন৷ সাপ বিনা কারণে কেন তাদের আক্রমণ করল? যদি ধরে নেওয়া যায়, এর মধ্যে এমন কোনো দুষ্ট ব্যক্তির হাত আছে, যে সাপ লেলিয়ে দিয়েছিল, তাহলেও প্রশ্ন ওঠে-কেন লেলিয়ে দিয়েছিল? ওই দুই ব্যক্তির মৃত্যুতে তার কী লাভ? অনুসন্ধানে প্রকাশ পেয়েছে, মৃত ব্যক্তিদের কারোর কোনো শত্রু নেই৷
রহস্যময় শৈলদ্বীপ, রহস্যময় আটজন নাবিকের অন্তর্ধান, রহস্যময় এই কাপ্তেন ও দ্বিতীয় অফিসারের মৃত্যু এবং সবচেয়ে রহস্যময় হচ্ছে লন্ডনে ভারতবর্ষীয় ব্ল্যাক স্নেকের আবির্ভাব৷ এডগার অ্যালেন পো, গেবোরিও এবং কন্যান ডইলের উপন্যাসেও এমন যুক্তিহীন বিচিত্র রহস্যের সন্ধান পাওয়া যায় না৷
কাগজ পড়া শেষ করে বিনয়বাবু বললেন, ‘ব্যাপারটা ছিল একরকম, হয়ে দাঁড়াচ্ছে আর-একরকম৷ আমরা যাচ্ছিলাম কোনো নতুন দ্বীপের রহস্য আবিষ্কার করতে, কিন্তু এখন যে সমস্ত ব্যাপারটা গোয়েন্দাকাহিনির মতো হয়ে উঠছে৷’
কুমার বলল, ‘আমার বিশ্বাস, আসল ব্যাপার ঠিকই আছে, এই নতুন ঘটনাগুলো তার শাখা-প্রশাখা ছাড়া আর কিছুই নয়!’
বিমল বলল, ‘আমারও তাই মত৷ কিন্তু বিনয়বাবু, আজকের কাগজে আর-একটা নতুন তথ্য পাওয়া গেল৷ শৈলদ্বীপের পাহাড়ে, সবচেয়ে উঁচুতে উঠেছিলেন কেবল তিনজন লোক৷ তাঁদের মধ্যে বেঁচে আছেন খালি মি. জর্জ ম্যাকলিয়ড৷ আমাদের এখন সর্বাগ্রে তাঁকেই খুঁজে বার করতে হবে, কারণ আপাতত দ্বীপের কথা তাঁর চেয়ে বেশি আর কেউ জানে না৷’
‘কিন্তু কেউটে সাপের কামড়ে বোহিমিয়ার এই যে দু-জন লোকের মৃত্যু, এ-সম্বন্ধে তোমার কী মত?’
বিমল ওয়েটারকে ডেকে খাবারের অর্ডার দিয়ে বলল, ‘আপাতত আমি শুধু বিস্মিত হয়েছি৷ মি. ম্যাকলিয়ডের সঙ্গে দেখা না করে ওসব বিষয় নিয়ে ভেবেচিন্তে কোনোই লাভ নেই৷’
কুমার বলল, ‘কিন্তু, ঘটনা ক্রমেই যেরকম গুরুতর হয়ে উঠেছে, আমাদের বোধ হয় আর পারিতে বসে থাকা উচিত নয়৷’
বিমল প্রবল পরাক্রমে ওয়েটারের আনা খাবারের একখানা ডিস আক্রমণ করে বলল, ‘এসো কুমার, এসো কমল, আসুন বিনয়বাবু৷ পেটে যখন আগুন জ্বলে তখন ডিসের খাবার ঠান্ডা হতে দেওয়া উচিত নয়!… আমাদের স্বদেশের কেউটে সাপ কেন বিলেতে বেড়াতে এসেছে, সেটা জানবার জন্যে আমরা কালকেই লন্ডনে যাত্রা করব৷’
বিমলরা সদলবলে যখন লন্ডনে এসে হাজির হল তখন দিনের বেলাতেও কুয়াশার চারিদিক অন্ধকার এবং ঝুরঝুর করে ঝরছে বরফের গুঁড়ো৷ পথে পথে অত্যন্ত ব্যস্ত ভাবে যে জনতাপ্রবাহ ছুটছে, তাদের কিন্তু সেদিকে একটুও দৃষ্টি নেই৷ যেন তারা কুয়াশা ও তুষারেরই নিজস্ব জীব!
শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বিনয়বাবু ওভারকোটের পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন, ‘বিমলভায়া, বুঝতে পারছ কি, আমাদের ভারতীয় নেটিভ আত্মার ভিতরে এখন খাঁটি বিলিতি জন বুলের আত্মা ধীরে ধীরে ঢুকছে? অনেক ভারতবাসী আজকাল এইটে অনুভব করার পর দেশে গিয়ে নিজেদের আর নেটিভ বলে মনে করে না৷’
কুমার দাঁতের ঠকঠকানি কোনো রকমে বন্ধ করবার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল, ‘আত্মার উপরে যারা বিলিতি তুষারপাত সহ্য করে, যম তাদের গ্রহণ করুক! যে-দেশের উপরে সূর্য আর চন্দ্রের দয়া এত কম, আমি তাকে ভালো দেশ বলে মনে করি না! বেঁচে থাক ভারতের নীলাকাশ, সোনালি রোদ, রুপোলি জ্যোৎস্না আর মলয় হাওয়া, তাদের ছেড়ে এখানে এসে কে থাকতে চায়?’
এমনকী বাঘার ল্যাজ পর্যন্ত থেকে থেকে কুঁকড়ে না পড়ে পারছে না৷
সেদিন সকলে মিলে হোটেলের ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে বসে বিলিতি শীতের প্রথম ধাক্কাটা সামলাবার চেষ্টা করল!
পরদিনেও সূর্যের দেখা নেই, উলটে গোদের উপরে বিষফোড়ার মতো গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল৷ তারই ভিতরে বিমল, কুমার ও বিনয়বাবু রেনকোট চড়িয়ে এস এস বোহিমিয়ার লন্ডনের আপিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল৷
বিনয়বাবু বললেন, ‘স্বদেশ কী মিষ্টি! এমন দেশ ছেড়ে ভারতে যেতেও সায়েবদের নাকি মন কেমন করে!’
বিমল বলল, ‘হ্যাঁ, সাহারার অগ্নিকুণ্ডকেও বেদুইনরা স্বর্গ বলেই ভাবে৷’
এমনি সব কথা কইতে কইতে সকলে গন্তব্যস্থলে এসে উপস্থিত হল! সেখান থেকে খবর পাওয়া গেল যে, মি. জর্জ ম্যাকলিয়ডের ঠিকানা হচ্ছে,-নং হোয়াইটহল কোর্ট৷
তারা একখানা ট্যাক্সি নিল৷ তারপর চারিদিকের বৃষ্টিস্নাত কুয়াশার প্রাচীর ঠেলে ঠেলে ট্যাক্সি হোয়াইটহল কোর্টের এক জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল৷
বিমলরা গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির নম্বর খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে গেল৷
কয়েক পদ অগ্রসর হয়েই দেখা গেল, একখানা বাড়ির সামনে অনেক লোক ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে৷ প্রত্যেক লোকের মুখেই ভয়ের চিহ্ন ফুটে রয়েছে এবং ভিড় ক্রমেই বেড়ে উঠছে৷
পথের মাঝখানে একখানা বড়ো মোটরগাড়ি, তার উপরে বসে আছে দুজন কনস্টেবল৷ ভিড়ের ভিতরেও কয়েকজন কনস্টেবল রয়েছে, তারা বেশি কৌতূহলী লোকদের ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে৷
জনতার অধিকাংশ লোকই কিছুই জানে না, তাদের জিজ্ঞাসা করেও বিমলরা কিছুই আবিষ্কার করতে পারলে না৷
বিনয়বাবু বললেন, ‘জনতার ধর্ম সব দেশেই সমান, পথের লোক ভিড় দেখলে ভিড় আরও বাড়িয়েই তোলে! বিমল, কিছু জানতে চাও তো ওই কনস্টেবলদের কাছে যাবার চেষ্টা করো!’
বিমল উত্তেজিত জনতার ভিতর দিয়ে ধাক্কা খেতে খেতে অনেক কষ্টে অগ্রসর হল৷ বাড়ির নম্বর দেখে বুঝল, তারা সেই নম্বরই খুঁজছে৷ একজন কনস্টেবলকে জিজ্ঞাসা করল, ‘মি. জর্জ ম্যাকলিয়ড কি এই বাড়িতে থাকেন?’
‘হ্যাঁ! কিন্তু কাল রাত্রে তাঁর মৃত্যু হয়েছে৷’
বিমল স্তম্ভিত হয়ে গেল৷ তারপর শুধোল, ‘কী করে তাঁর মৃত্যু হল?’
কনস্টেবল তার দিকে সন্দিগ্ধ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করে বলল, ‘আপনি কি ভারতবাসী?’
‘হ্যাঁ৷’
‘তাহলে শুনুন৷ আপনাদেরই দেশের ব্ল্যাক স্নেক এসে মি. ম্যাকলিডয়কে দংশন করেছে৷ ভারতবর্ষ তার ব্লাক স্নেককে নিয়ে নরকে গমন করুক!’
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – গোমেজের প্রবেশ
তিন দিন পরের কথা৷ ঘড়ি দেখে বলা যায় এখন বৈকালি চা পানের সময়; কিন্তু লন্ডনের অন্ধকার-মাখা আকাশের দিকে তাকালে মনে হয়, এদেশে ঘড়ি তার কর্তব্যপালন করে না৷
একখানা নীচু ও বড়ো চেস্টারফিল্ড-এর উপরে বসে বিনয়বাবুর সঙ্গে কুমার চা ও স্যান্ডউইচের সদ্ব্যবহার করছিল৷ কমল শীতে কাবু হয়ে ‘রাগ’ মুড়ি দিয়ে বিছানায় পড়ে আছে চা ও স্যান্ডউইচ দেখেও সে গরম বিছানা ছাড়তে রাজি হয়নি৷
বিনয়বাবু একবার উঠলেন৷ ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর ভিতর দিয়ে বাইরে উঁকি মেরে হতাশভাবে বললেন, ‘লন্ডনে এসে পর্যন্ত সূর্যদেবের মুখ দেখলাম না, বিলিতি চন্দ্রকিরণ কীরকম তাও জানলাম না, অথচ বিলিতি কবিতার চন্দ্র-সূর্যের গুণগান পড়া যায় কত! কবিরা সব দেশেই মিথ্যাবাদী বটে, কিন্তু বিলিতি কবিরা এ-বিষয়ে দস্তুরমতো টেক্কা মেরেছেন৷’
কুমার তৃতীয় স্যান্ডউইচ খানা ধ্বংস করে বলল, ‘যে দেশে যার অভাব, তারই কদর হয় বেশি!’
বিনয়বাবু আবার আসন গ্রহণ করে বললেন, ‘কিন্তু বিমল এখনও ফিরে এল না! সেই কোন সকালে সে বেরিয়েছে, সন্ধ্যা হতে চলল, এখনও তার দেখা নেই!’
কুমার নিশ্চিন্ত ভাবে চতুর্থ স্যান্ডউইচে মস্ত এক কামড় বসিয়ে বলল, ‘বিমল যখন ফেরেনি তখন বেশ বোঝা যাচ্ছে তার যাত্রা সফল হয়েছে! হবে না কেন? কলকাতার পুলিশ কমিশনার সাহেব যেরকম উচ্চপ্রশংসা করে তাকে পরিচয়পত্র দিয়েছেন, তা পড়ে এখানকার স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কর্তারা নিশ্চয়ই বিমলকে সবরকম সাহায্য করতে প্রস্তুত হবেন!’
বলতে বলতে কুমার আবার পঞ্চম স্যান্ডউইচের দিকে হাত বাড়াচ্ছিল, কিন্তু বিনয়বাবু বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, ‘থামো কুমার, থামো! তুমি ভুলে যাচ্ছ, এখনও ডিনারের সময় হয়নি! অনেকে মনে করে বেশি খাওয়া বাহাদুরি, কিন্তু আমি মনে করি বেশি খাওয়া অসভ্যতা! সামনে যতক্ষণ খাবার থাকবে ততক্ষণই মুখ চলবে, এটা হচ্ছে পশুত্বের লক্ষণ!’
কুমার অপ্রস্তুত স্বরে বলল, ‘কী করব বিনয়বাবু, বরফমাখা বিলিতি শীত যে আমার জঠরে রাক্ষুসে খিধে এনে দিয়েছে!’
বিনয়বাবু ডাকলেন, ‘আয়রে বাঘা আয়!’
পশমি জামা গায়ে দিয়ে বাঘা তখন খাটের তলার সবচেয়ে অন্ধকার কোণে কুঁকড়ে পিছনের পায়ের তলায় মুখ গুঁজে দিব্য আরামে ঘুম দিচ্ছিল৷ হঠাৎ কেন তার ডাক পড়ল বুঝতে না পেরে বাঘা মুখ তুলে অত্যন্ত নারাজের মতো বিনয়বাবুর দিকে তাকিয়ে দেখল৷
কুমারের লোভী চোখের সামনে ডিসের উপর তখনও দু-খানা স্যান্ডউইচ অক্ষত অবস্থায় আক্রান্ত হবার জন্যে অপেক্ষা করছিল৷ সেই দু-খানা তাড়াতাড়ি তুলে নিয়ে বিনয়বাবু বললেন, ‘বাঘা, আমার হাতে কী দেখছিস?’
বাঘা দেখতে ভুল করলে না৷ শীতের চেয়ে খাবার বড়ো বুঝে সে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল, তারপর একটা ডন দিল, এবং তারপর দুই লাফে একেবারে বিনয়বাবুর কাছে এসে হাজির হল এবং সঙ্গে সঙ্গে কুমারের মুখের গ্রাস বাঘার মুখের ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল৷
কুমার জুলজুল করে খানিকক্ষণ বাঘার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘নিরেট খাবার যখন অদৃশ্য হল, তখন তরল জিনিসই উদরস্থ করা যাক’-এই বলে সে পেয়ালায় দ্বিতীয়বার চা ঢালতে লাগল৷
বিনয়বাবু বললেন, ‘কুমার, আমাদের সঙ্গে সেই দ্বীপে যাবার জন্যে, পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে রোজ কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে, তবু তো বোহিমিয়ার কোনো নাবিকই আজ পর্যন্ত দেখা দিল না৷’
কুমার বলল, ‘তার জন্যে দায়ী ওই তিনটি লোকের মৃত্যু৷ বোহিমিয়ার প্রত্যেক নাবিকই এখন ব্ল্যাক স্নেকের ভয়ে আধমরা হয়ে আছে৷’
এমন সময়ে দরজার পর্দা ঠেলে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করল বিমল৷
কুমার বলে উঠল, ‘এই যে বিমল! এতক্ষণ কোথায় ছিলে, কী করছিলে?’
বিমল তার ওভারকোটটা খুলতে খুলতে বলল, ‘কী করছিলাম? স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ডিটেকটিভ-ইনস্পেক্টার ব্রাউনের সঙ্গে শার্লক হোমসের ভূমিকা অভিনয় করছিলাম!’
‘তোমার হাসি হাসি মুখ দেখে মনে হচ্ছে অভিনয়ে তুমি সফল হয়েছ!’
‘খানিকটা হয়েছি বই কী৷ সেই অমাবস্যার রাত-এর ব্যাপারেই তো তুমি জানো, গোয়েন্দাগিরিতেও আমি খুব বেশি কাঁচা নই! . . . কিন্তু আপাতত তুমি হোটেলের চাকরকে ডাকো৷ ঘটনাপ্রবাহে পড়ে সকাল থেকে দাঁতে কিছু কাটবার সময় পাইনি, উদরে দুর্ভিক্ষের ক্ষুধা হইহই করছে! চা, গরম টোস্ট আর আসপারাগোস ওমলেটের অর্ডার দাও!’
কুমার ভয়ে ভয়ে বিনয়বাবুর মুখের পানে তাকিয়ে বলল, ‘কেবলই কি তোমার জন্যে ভাই? না, আমাদের জন্যেও ছিটেফোঁটা কিছু আসবে?’
বিনয়বাবু খাপ্পা হয়ে বললেন, ‘আমাদের মানে? আমি আর কিছু চাই না,-আমি তোমার মতো রাক্ষস নই!’
কুমার নির্লজ্জের মতো বলল, ‘আমিও রাক্ষসত্বের দাবি করি না, তবু আরও কিছু খেতে চাই!’
বিনয়বাবু বললেন, ‘খাও, খাও-যত পারো খাও! তুমি ব্রহ্মাণ্ডকে গপ করে গিলে ফেললেও আমি আর টুঁ শব্দ করব না!’
কুমার হাসতে হাসতে খাবারের অর্ডার দিয়ে এল৷
বিমল একখানা ইজিচেয়ারের উপরে শুয়ে পড়ে বলল, ‘বিনয়বাবু, এই ব্ল্যাক স্নেকের ব্যাপারটা বড়োই রহস্যময় হয়ে উঠেছে৷ গোড়া থেকেই আমরা লক্ষ করেছি, এই তিনটে ঘটনার মধ্যে কতকগুলো অসম্ভব বিশেষত্ব আছে৷ এক : তিনজন মৃত ব্যক্তিই এস. এস. বোহিমিয়ার লোক৷ দুই : যে তিন ব্যক্তি সেই অজানা দ্বীপের পাহাড়ে সবচেয়ে উঁচুতে উঠেছিলেন, মারা পড়েছেন কেবল তাঁরাই৷ তিন : ভারতের কেউটে সাপের দৌরাত্ম্য৷ পাঁচ : যাঁরা মারা পড়েছেন তাঁদের প্রত্যেকেরই বাড়ি পরস্পরের কাছ থেকে অনেক মাইল তফাতে আছে, অথচ সবাই মরেছেন কেউটের বিষে৷ সুতরাং এসব কীর্তি একটা সাপের নয়৷ ছয় : কেউটের আবির্ভাব সম্বন্ধেও কোনো সন্দেহ নেই, কারণ মি. চার্লস মরিসের শয়নগৃহে একটা মৃত সাপও পাওয়া গিয়েছে৷’
বিনয়বাবু বললেন, ‘ঘটনাগুলো এমন অসম্ভব যে, মনে সত্যি সত্যি কুসংস্কারের উদয় হয়! কোনো রহস্যময় হিস্র অপার্থিব শক্তিকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়৷ সেই শক্তি যেন অজানা দ্বীপে মানুষের পদক্ষেপ পছন্দ করে না৷ যারাই সেখানে গিয়েছে, সেই প্রতিহিংসাপরায়ণ অদৃশ্য শক্তির অভিশাপ বহন করে ফিরে এসেছে৷’
বিমল একখানা টোস্ট ভাঙতে ভাঙতে বলল, ‘আমি কিন্তু গোড়া থেকেই কোনো অদৃশ্য শক্তিকে বিশ্বাস করিনি৷’
‘তবে কি তুমি এগুলোকে দৈবদুর্ঘটনা বলে মনে কর?’
কুমার বলল, ‘দৈবদুর্ঘটনার মধ্যে এমন একটা ধারা থাকে না৷ এখানে প্রত্যেক ঘটনার মধ্যে যেন কোনো কুচক্রীর একটা বিশেষ উদ্দেশ্য কাজ করছে৷’
বিমল বলল, ‘ঠিক বলেছ৷ আমিও ওই সূত্র ধরেই সমস্ত খোঁজখবর নিয়েছি৷ ডিটেকটিভ-ইনস্পেক্টার ব্রাউনের সঙ্গে আমি আজ তিনটে মৃত দেহই পরীক্ষা করেছি, প্রত্যেক মৃত ব্যক্তির বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা কয়েছি, এমনকী যে ডাক্তার শব ব্যবচ্ছেদ করেছেন তাঁর মতমত নিতেও ভুলিনি৷’
বিনয়বাবু বললেন, ‘তাহলে তুমি নিশ্চয়ই একটা সিদ্ধান্তে এসে উপস্থিত হয়েছ?’
‘হ্যাঁ৷ এর মধ্যে কোনো অদৃশ্য শক্তির অভিশাপও নেই, এগুলো দৈবদুর্ঘটনাও নয়!’
‘তবে?’
‘শুনুন, একে একে বলি৷ ডাক্তারি পরীক্ষায় প্রত্যেক মৃতব্যক্তির দেহে সাপের বিষ পাওয়া গিয়েছে, তাঁদের দেহে সর্পদংশনের স্পষ্ট চিহ্ন আছে৷ কিন্তু মি. চার্লস মরিসের বাড়িতে গিয়ে আমি এক বিচিত্র আবিষ্কার করেছি৷ ওঁরই খাটের তলায় একটা ক্ষতবিক্ষত মৃত কেউটে সাপ পাওয়া গিয়েছিল৷ ডিটেকটিভ ব্রাউনের মতে, মি. মরিস নিজে মরবার আগে সাপটাকে হত্যা করেছিলেন৷ অসঙ্গত এ মত নয়৷ কিন্তু আমার প্রশ্ন প্রকাশ পেল যে, ক্ষতবিক্ষত সাপটা খাটের তলায় মরে পড়েছিল বটে, কিন্তু ঘরে কোথাও একফোঁটা রক্তের দাগ পাওয়া যায়নি! সাপের দেহের রক্ত কোথায় গেল? ডিটেকটিভ ব্রাউন আমার এই আবিষ্কারে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন৷ তখনই মৃত সাপটাকে শবব্যবচ্ছেদাগারে মি. মরিসের লাশের কাছে নিয়ে যাওয়া হল! লাশের গলায় সাপের দাঁতের দাগ ছিল৷ মরা সাপের দাঁতের সঙ্গে সেই দাগ মিলিয়ে দেখা গেল, মি. মরিস মোটেই সাপটার কামড়ে মারা পড়েননি, তাঁকে অন্য কোনো সাপ কামড়েছে! . . . এখন বুঝে দেখুন বিনয়বাবু, ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে! প্রথমত মি. মরিসের ঘরে কি তবে একসঙ্গে দুটো কেউটে সাপ ঢুকেছিল? একটা তাঁকে কামড়ে পালিয়েছে, আর একটাকে তিনি নিজেই হত্যা করেছেন? কিন্তু লন্ডনে একসঙ্গে দুটো কেউটের উদয় একেবারেই আজগুবি ব্যাপার! উপরন্তু মি. মরিস সাপটাকে মারলে ঘরের ভিতরে নিশ্চয়ই তার রক্ত পাওয়া যেত৷ দ্বিতীয়ত, সাপটাকে তাহলে নিশ্চয়ই কেউ আগে বাইরে কোথাও বধ করে ঘটনাস্থলে তার দেহটাকে ফেলে রেখে গিয়েছিল৷ কেন? পুলিশের মনে ভ্রম বিশ্বাস উৎপাদনের জন্যে! তাহলেই প্রমাণিত হচ্ছে যে, এই তিন তিনটে হত্যার মূলে আছে এক বা একাধিক মানুষ! আমার এই অভাবিত আবিষ্কারে স্কটল্যান্ড-ইয়ার্ডে মহাচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে৷ ওখানকার প্রধান কর্তা আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বললেন, -ধন্য আপনার সূক্ষ্ম বুদ্ধি! আমাদের শিক্ষিত ডিটেকটিভরা এতদিন গোলকধাঁধায় পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছিল, আপনিই তাদের পথ বাতলে দিলেন৷ এখন বেশ বুঝতে পারছি যে, কোনো সুচতুর মানুষই কেউটে সাপের সাহায্যে এই তিনটে নরহত্যা করেছে!-এখন বলুন বিনয়বাবু, আমার অনুসন্ধান সফল হয়েছে কি না?’
বিনয়বাবু উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে উঠলেন, ‘আমিও বলি, ধন্য বিমল৷ বাঙালির মস্তিষ্ক যে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকেও মুগ্ধ করবে, এটা আমি কখনো কল্পনা করতে পারিনি৷’
বিমল ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কল্পনা করতে পারেননি! কেন? সামান্য ওই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড, বাঙালির মস্তিষ্ক যে বারবার বিশ্বকেও অভিভূত করেছে! সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ, চিত্রে অবনীন্দ্রনাথ, বিজ্ঞানে জগদীশচন্দ্র, ধর্মে বিবেকানন্দ আধুনিক পৃথিবীতে বাঙালির নাম যে সমুজ্জ্বল করে তুলেছেন! এই সেদিনও বাংলার আঠারো বছরের মেয়ে তরু দত্ত বিলিতি সাহিত্যেও চিরস্মরণীয় কিরণ বিতরণ করে গেছেন! আগেকার কথা না-হয় আর তুললাম না৷ তবে শ্রীচৈতন্যের মতন ধর্মবীর পৃথিবীর যে কোনো দেশকে অমর করতে পারতেন! এমনকী জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মগুরু বুদ্ধদেবকে নিয়েও আমরা গর্ব করতে পারি, কারণ বুদ্ধদেবও জন্মেছিলেন বাংলারই সীমান্তে!’
বিনয়বাবু তাড়াতাড়ি বললেন, ‘বিমল, তুমি শান্ত হও-আমি অপরাধ স্বীকার করছি! হ্যাঁ, আমিও মানি, বাঙালি হয়ে জন্মেছি বলে আমরা সারা পৃথিবীতে গর্ব করতে পারি!’
বিমল খানিকক্ষণ চুপ করে বসে চা পান করতে লাগল৷ তারপর বলল, ‘বিনয়বাবু, আমি আর একটা বিষয় আবিষ্কার করেছি৷’
‘কী?’
‘খবরের কাগজের রিপোর্টেই দেখেছেন তো, বোহিমিয়ান কাপ্তেন মি. টমাস মর্টন সেই অজানা দ্বীপ ছেড়ে চলে আসতে রাজি ছিলেন না! জাহাজের লোকেরাই তাঁকে দেশে ফিরতে বাধ্য করেছিল? মর্টন সাহেবের পুরাতন ভৃত্যকে প্রশ্ন করে জানতে পেরেছি, তিনি নাকি আবার সেই দ্বীপে যাবার বন্দোবস্ত করেছিলেন, আর তাঁর সঙ্গে যেতেন মি. চার্লস মরিস আর মি. জর্জ ম্যাকলিয়ড৷’
‘কেন?’
‘সেইটেই তো হচ্ছে প্রশ্ন৷ ওঁদের উদ্দেশ্য ছিল যে কেবল সেই আটজন নিরুদ্দেশ নাবিকের খোঁজ করা, আমার তা মনে হয় না৷ আরও দেখা যাচ্ছে, কেবল যে-তিনজন লোক দ্বীপের সবচেয়ে-উঁচু শৈলশিখরে গিয়ে উঠেছিলেন, দ্বিতীয়বার দ্বীপে যাচ্ছিলেন তাঁরাই৷ এর মানে কী?’
কুমার বলল, ‘আরও একটা প্রশ্ন আছে৷ কেউটের কামড়ে মৃত্যুও হয়েছে কেবল ওই তিনজন লোকের৷ এরই বা অর্থ কী? বিমল প্রমাণিত করেছে যে, এইসব হত্যাকাণ্ডের মধ্যে মানুষের হাত আছে৷ কিন্তু সে মানুষ কে? বোহিমিয়ায় যে-তিনজন কর্মচারী আবার দ্বীপে যাবার চেষ্টা করছিলেন, তাঁদের হত্যা করে তার কী স্বার্থসিদ্ধি হবে?’
বিমল বলল, ‘কুমার তুমি বুদ্ধিমানের মতো প্রশ্ন করেছ৷ আজ হাইড পার্কে বসে, পুরো দু-ঘণ্টা ধরে আমিও এইসব প্রশ্নের সদুত্তর খোঁজবার চেষ্টা করেছি৷ গোয়েন্দার কাজ সত্য তথ্য নিয়ে বটে, কিন্তু সব কাজের মতো গোয়েন্দাগিরির ভিতরেও কল্পনাশক্তির দরকার আছে যথেষ্ট৷ . . . ধরো, তুমি আমি আর বিনয়বাবু বোহিমিয়ার কাপ্তেন মর্টন, প্রথম ‘মেট’ মরিস আর দ্বিতীয় ‘মেট’ ম্যাকলিয়ডের স্থান গ্রহণ করলাম৷ ঝড়ের পরদিন নিরুদ্দেশ নাবিকদের খুঁজতে খুঁজতে আমরা দ্বীপের সবচেয়ে উঁচু শৈলশিখরে উঠছি৷ জাহাজের অন্যান্য লোকেরা নীচে অপেক্ষা করছে৷ আমরা নাবিকদের কোথাও খুঁজে পাইনি৷ দ্বীপে কাল রাত্রে যারা আলো জ্বেলেছিল তারাও অদৃশ্য৷ সুতরাং মনে মনে বেশ বুঝতে পারছি যে, এই দ্বীপের মধ্যে কোনো একটা গভীর রহস্য আছে৷ কারণ পৃথিবী হঠাৎ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে এতগুলো লোককে গিলে ফেলেনি৷ হয়তো এই দ্বীপে বোম্বেটেদের গোপনীয় রত্নগুহা আছে৷ হয়তো আমরা তিনজনে তারই কোনো প্রমাণ দেখতে পেলাম৷ তখন নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে স্থির করলাম, এ-কথা জাহাজের আর কারোর কাছে প্রকাশ করা হবে না৷ পরে কোনো সুযোগে দ্বীপে আবার এসে সমস্ত গুহা লুন্ঠন করে টাকাকড়ি ভাগ করে নিলেই চলবে৷ এইভাবে আমরা সেদিনের মতো ফিরে এলাম৷ কিন্তু জাহাজের কুসংস্কার-ভীত নাবিক আর যাত্রীদের বিরুদ্ধতায় সে-যাত্রায় আর কোনো সুযোগ পাওয়া গেল না৷ তাই বিলেতে এসে আবার নতুন জাহাজ নিয়ে অদৃশ্য নাবিকদের খুঁজতে যাবার অছিলায় আমরা সেই দ্বীপে যাত্রা করবার ব্যবস্থা করতে লাগলাম! ইতিমধ্যে যে উপায়েই হোক আর-এক ব্যক্তি আমাদের গুপ্তকথা জানতে পারল৷ খুব সম্ভব, এ-ব্যক্তিও বোহিমিয়া জাহাজের কোনো নাবিক বা যাত্রী৷ হয়তো জাহাজে বসে আমরা কোনোদিন যখন পরামর্শ করছিলাম, আড়াল থেকে সে কিছু কিছু শুনতে পেয়েছিল৷ এখন তার প্রধান কাজ কী হবে? তার পথ থেকে জন্মের মতো আমাদের তিনজনকে সরিয়ে দেওয়া নয় কি?’
কুমার খানিকক্ষণ ভেবে বলল, ‘বিমল, তুমি মনে মনে যে কল্পনা করেছ, তার ভিতরে সমস্ত প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া যায় বটে! তবু বলতে হবে, এ তো কল্পনা৷’
বিমল বলল, ‘কিন্তু স্বাভাবিক কল্পনা৷ আসল ব্যাপারের সঙ্গে আমার কল্পনা হয়তো হুবহু মিলবে না, কিন্তু আমার হাতে যদি সময় থাকত তাহলে নিশ্চয়ই প্রমাণিত করতে পারতাম যে, এই কল্পনার মধ্যে অনেকখানি সত্যই আছে৷ …কিন্তু আমি গোয়েন্দাগিরি করতে বিলেতে আসিনি, এ-সব ব্যাপার নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চাই না৷ হ্যাঁ, ভালো কথা৷ আজকেও দ্বীপে যাবার জন্যে বোহিমিয়ার কোনো নাবিক আমাদের বিজ্ঞাপনের আহ্বানে উত্তর দেয়নি?’
কুমার মাথা নেড়ে জানাল, না৷
বিনয়বাবু বললেন, ‘বিমল, তাহলে তোমার মতে, বোহিমিয়ার কোনো লোকই এইসব হত্যাকাণ্ডের জন্যে দায়ী?’
বিমল বলল, ‘হতেও পারে, না হতেও পারে৷ সবই আমার অনুমান৷ আর এ অনুমান যদি সত্য হয়, তবে এটাও ঠিক জানবেন যে, সে আমাদের বিজ্ঞাপনের উত্তর না দিয়ে পারবে না৷’
‘কেন?’
‘তার পথ থেকে সব কাঁটা সরে গেছে৷ তার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে এখন, সেই দ্বীপে যাওয়া৷ কিন্তু সে দ্বীপে জাহাজ লাগে না৷ সুতরাং আমাদের জাহাজ সেখানে যাচ্ছে শুনলে সে কখনো এমন সুযোগ ছেড়ে দেবে না৷’
এমন সময়ে রামহরি ঘরে ঢুকে বলল, ‘খোকাবাবু, একটা সায়েব তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে চায়৷ সায়েব বটে, কিন্তু রং খুব ফর্সা নয়!’
‘তাকে এখানে নিয়ে এসো৷’
একটু পরেই যে-লোকটি ঘরের ভিতরে এসে দাঁড়াল, সত্যসত্যই তার গায়ের রং শ্যামল৷ লোকটি মাথায় লম্বা নয় বটে, কিন্তু চওড়ায় তার দেহ অসাধারণ-এত চওড়া লোক অসম্ভব বললেও চলে৷ দেখলেই বোঝা যায়, তার গায়ে অসুরের শক্তি আছে৷ লোকটির মাথায় একগাছা চুলও নেই, ছোটো ছোটো তীক্ষ্ণ চোখ, থ্যাবড়া নাক, ঠোঁটের উপরে প্রকাণ্ড একজোড়া গোঁফ৷
ঘরে ঢুকেই সে বলল, ‘কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেখে আমি এখানে এসেছি৷’
বিমল আগ্রহভরে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কি সেই অজানা দ্বীপে যেতে চান?’
‘হ্যাঁ৷’
‘আপনার নাম?’
‘বার্তোলোমিও গোমেজ৷ আমি এস. এস. বোহিমিয়ার কোয়ার্টার মাস্টারের কাজ করতাম৷’
বিমল, কুমার ও বিনয়বাবুর দৃষ্টি চমকে উঠল!
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – অনাহূত অতিথি
বোহিমিয়া জাহাজের ‘কোয়ার্টার মাস্টার’ বার্তোলোমিও গোমেজ! বিমলদের সঙ্গে সেই অজানা দ্বীপে যেতে চায়!
আশ্চর্য হবার কিছু নেই৷ কারণ এইরকম একটি লোকের জন্যেই বিমলরা খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছে, প্রচুর পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে৷ এবং এইরকম একটি লোক না পেলে তাদের পক্ষে যথেষ্ট অসুবিধা হবারই কথা!
কিন্তু বিমল যে-সময়ে বলছিল যে, বোহিমিয়ার তিনটি লোকের মৃত্যুর জন্যে ওই জাহাজেরই কোনো লোক দায়ী এবং হত্যাকারী তাদের বিজ্ঞাপনের উত্তর না দিয়ে পারবে না, ঠিক সেই সময়েই গোমেজের অভাবিত আবির্ভাবে তাদের পক্ষে না চমকে থাকা অসম্ভব! এমনকী শয্যাশায়ী কমলও রাগের ভিতর থেকে মুখ বার করে গোমেজকে একবার ভালো করে দেখে নিল৷ সে এতক্ষণ শুয়ে শুয়ে বিমলের মতামত শ্রবণ করছিল৷
সে-চমকানি গোমেজের চোখেও পড়ল৷ সে দুই ভুরু কুঁচকে একে একে সকলের মুখের দিকে বিরক্ত দৃষ্টিপাত করল৷ তারপর বলল, ‘আমাকে দেখে আপনারা বিস্মিত হলেন নাকি?’
বিমল তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ মি. গোমেজ, আমরা একটু বিস্মিত হয়েছি বটে! আপনার নামটি হচ্ছে পোর্তুগিজ, কিন্তু আপনার গায়ের রং আমাদের চেয়ে ফর্সা নয়! এটা আমরা আশা করিনি!’
তখন গোমেজের বাঁকা ভুরু আবার সোজা হল৷ সে হো হো করে হেসে উঠে বলল, ‘ ওঃ, এইজন্যে? কিন্তু আমারও জন্ম যে ভারতবর্ষেই! আমি আগে গোয়ায় বাস করতাম৷’
‘বটে, বটে? তাহলে আপনি তো আমাদের ঘরের লোক! আরে, এত কথা কি আমরা জানি? বসুন মি. গোমেজ, বসুন! এক পেয়ালা চা পান করবেন কি?’
‘না, ধন্যবাদ! আমার হাতে আজ বেশি সময় নেই৷ আমি একেবারেই কাজের কথা পাড়তে চাই! আপনারা আটলান্টিক মহাসাগরের সেই নির্জন দ্বীপে যেতে চান কেন?’
‘কোথাও কোনো বিচিত্র রহস্যের সন্ধান পেলে আমরা সেখানে না গিয়ে পারি না৷ এটা আমাদের অনেকদিনের বদঅভ্যাস৷ এই বদঅভ্যাসের জন্যে আমরা একবার মঙ্গল গ্রহেও না গিয়ে পারিনি৷’
‘কী বললেন? কোথায়?’
‘মার্স-এ!’
গোমেজ চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে বলল, ‘মার্স-এ? আপনি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন নাকি?’
‘মোটেই নয়৷ ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে আমরা সত্যসত্যই মঙ্গল গ্রহে গিয়েছিলাম৷ সে কাহিনি পৃথিবীর সব দেশের খবরের কাগজেই বেরিয়ে ছিল৷ আপনি কি পড়েননি ? ‘*
‘না৷ আমরা নাবিক মানুষ, জলের জগতেই আমাদের দিন কেটে যায়, খবরের কাগজের ধার ধারি না৷ বিশেষ ১৯১৪ হচ্ছে মহাযুদ্ধের বৎসর, তখন যুদ্ধের হইচই নিয়েই আমরা ব্যতিব্যস্ত হয়েছিলাম৷’
‘আচ্ছা, আমাদের কাছে পুরোনো খবরের কাগজগুলো এখনও আছে, আপনাকে পড়তে দেব অখন৷’
‘দেখছি, আপনারা হচ্ছেন আশ্চর্য, অসাধারণ মানুষ! …তাহলে আপনাদের বিশ্বাস, ওই আজানা দ্বীপে কোনো বিচিত্র রহস্যের সন্ধান পাওয়া যাবে?’
গোমেজের মুখের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে কুমার বলল, ‘মি. গোমেজ, আপনিও কি বিশ্বাস করেন না যে, সেই দ্বীপে কোনো অদ্ভুত রহস্য আছে?’
গোমেজ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘অদ্ভুত রহস্য বলতে আপনারা কী বোঝেন, বলতে পারি না৷ রহস্য মাত্রই অদ্ভুত নয়৷’
বিনয়বাবু বললেন, ‘আটলান্টিকের মাঝখানে হঠাৎ ওই দ্বীপের আবির্ভাব কি অদ্ভুত নয়?’
‘মোটেই নয়৷ আটলান্টিকের মাঝখানে এর আগেও ওইরকম জলমগ্ন দ্বীপ হঠাৎ আত্মপ্রকাশ করেছে৷ আটলান্টিক ঠান্ডা শান্ত সমুদ্র নয়৷ যাঁরা খবর রাখেন তাঁরা জানেন, আটলান্টিকের পেটের ভিতরে এত ওলটপালট হচ্ছে যে, যখন-তখন সে ছোটো ছোটো অজানা দ্বীপের জন্ম দিতে পারে৷’
‘কিন্তু সেই জনহীন দ্বীপে রাত্রে আলো নিয়ে কারা চলাফেরা করছিল?’
‘আমার বিশ্বাস, চোখের ভ্রমেই আমরা আলো দেখেছিলাম৷’
‘আপনাদের আটজন নাবিক সেই দ্বীপ থেকে কোথায় অদৃশ্য হল?’
‘কে বলতে পারে যে, তারা কোনো গুপ্ত গহ্বরে পড়ে যায়নি?’
‘সেই দ্বীপে আপনারা অনেক বিরাট প্রস্তরমূর্তি দেখেননি?’
‘দেখেছি৷ দ্বীপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কেবল সেই মূর্তিগুলোই৷ তা ছাড়া সেখানে দেখবার আর কিছুই নেই৷ এমনকী একফোঁটা জল পর্যন্ত নেই! সেখানে দু-চারদিনের বেশি বাস করাও সম্ভব নয়৷’
‘মি. গোমেজ, তাহলে আপনি কি আমাদের সেখানে যেতে মানা করছেন?’
গোমেজ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘না, না! যেতে আমি কারোকেই মানা করছি না! তবে আমার কথা হচ্ছে, দ্বীপে গিয়ে আপনারা কোনো অদ্ভুত রহস্য দেখবার আশা করবেন না৷’
বিমল বলল, ‘মি. গোমেজ, আপনাকে একটি কথা জিজ্ঞাসা করি৷ আপনি বলছেন, দ্বীপে কোনো রহস্য নেই৷ তবে মর্টন, মরিস আর ম্যাকলিয়ড সাহেব আবার সেই দ্বীপে যাবার ব্যবস্থা করেছিলেন কেন?’
সচকিত কন্ঠে গোমেজ বলল, ‘তাই নাকি? কেমন করে জানলেন আপনি?’
‘যেমন করেই হোক, আমি জেনেছি!’
‘কিন্তু আমি জানি না৷ হয়তো তাঁরা সেই নিরুদ্দেশ নাবিকদের খোঁজেই আবার সেখানে যাচ্ছিলেন৷’
‘হতে পারে মি. গোমেজ, হয়তো এটাও আপনার জানা নেই যে, পাছে তাঁরা আবার সেই দ্বীপে যান সেই ভয়ে কেউ তাঁদের খুন করেছে!’
গোমেজ চমকে উঠল৷ অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘আপনি কী বলছেন? সবাই তো জানে, তাঁদের মৃত্যু হয়েছে ব্ল্যাক স্নেকের কামড়ে!’
‘হ্যাঁ, ভারতীয় ব্ল্যাক স্নেক! কিন্তু মি. গোমেজ, লন্ডনে হঠাৎ এত বেশি ব্ল্যাক স্নেক কেমন করে এল? যদি ধরা যায়, আপনার মতো কোনো ভারতবাসী বিলেতে শখ করে ব্ল্যাক স্নেক নিয়ে এসেছে, তাহলে বরং-‘
বিমলকে বাধা দিয়ে গোমেজ সামনের কাঁচ-ঢাকা টেবিলের উপরে জোরে চড় মেরে ক্রুদ্ধ স্বরে বলে উঠল, ‘মশাই, আমি সাপুড়ে নই! আমি সঙ্গে করে আনব ভারতের সর্বনেশে ব্ল্যাক স্নেক? উঃ, অদ্ভুত কল্পনা!’
বিমল সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘না, না মি. গোমেজ! আমি আপনাকে কথার কথা বলছিলাম মাত্র, আপনার উপরে কোনোরকম অভদ্র ইঙ্গিত করা আমার উদ্দেশ্য নয়!’
গোমেজ শান্ত হয়ে বলল, ‘দেখুন, পুলিশ কীরকম গাধা জানেন তো? অনুগ্রহ করে এরকম কথা আর মুখেও আনবেন না! পুলিশ যদি একবার এই কথা শোনে, তাহলে অকারণেই আমার প্রাণান্ত-পরিচ্ছেদ করে ছাড়বে! ও-প্রসঙ্গ ছেড়ে দিয়ে এখন কাজের কথা বলুন! আপনারা কবে সেই দ্বীপে যাত্রা করবেন?’
‘আমরা তো প্রস্তুত৷ এতদিন কেবল বোহিমিয়ার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী নাবিকের জন্যেই অপেক্ষা করে বসেছিলাম৷ এখন আপনাকে যখন পেয়েছি, তখন যে-কোনোদিন যেতে পারি!’
‘আমার কাছ থেকে আপনারা কী সাহায্যের প্রত্যাশা করেন?’
‘প্রথমত, আপনি দ্বীপের সমস্ত কথা সবিস্তারে বর্ণনা করবেন৷ খবরের কাগজে নিশ্চয়ই সব কথা প্রকাশ পায়নি৷ দ্বিতীয়ত, আমাদের জাহাজের পথপ্রদর্শক হবেন আপনি৷ তৃতীয়ত, গেল-বারে দ্বীপের যে যে জায়গায় গিয়ে আপনারা নাবিকদের খোঁজ করেছিলেন আপনাকে সেসব জায়গা আবার আমাদের দেখাতে হবে৷ বিশেষ করে দেখতে চাই আমি দ্বীপের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের শিখরটা৷’
‘কিন্তু সেখানটা তো আমি নিজেই দেখিনি৷ সেখানে উঠেছিলেন খালি মি. মর্টন, মি. মরিস আর মি. ম্যাকলিয়ড৷’
হুঁ ৷ আর সেইজন্যেই হতভাগ্যদের পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে! এ-কথা পুলিশ জানে না, কিন্তু তাঁদের হত্যাকারী জানে, আর আমিও জানি!’
গোমেজ অবাক বিস্ময়ে বিমলের মুখের পানে তাকিয়ে রইল৷ তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘আপনার প্রত্যেক কথাই সেই দ্বীপের চেয়েও রহস্যময়৷’
বিমল যেন আপন মনেই বললে, ‘দ্বীপের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের শিখরে গিয়ে উঠলেই সকল রহস্যের কিনারা হবে!’
গোমেজ হাসতে হাসতে বলল, ‘যদিও আমি সেখানে উঠিনি, তবু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সেখানে উঠে আপনি পাথর ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবেন না! হতচ্ছাড়া সেই পাহাড়ে দ্বীপ! একটা জীব, একটা গাছ, একগাছা ঘাস পর্যন্ত সেখানে নেই! সমুদ্রের নীল গায়ে হঠাৎ যেন একটা কালো ফোড়ার মতো সে গজিয়ে উঠেছে! হাঁ, আর একটা অনুমানও মন থেকে মোছবার চেষ্টা করুন৷ আমার সঙ্গীদের মৃত্যুর সঙ্গে সেই দ্বীপের বা কোনো মানুষ-হত্যাকারীর কিছুমাত্র সম্পর্ক নেই, তাঁরা মারা পড়েছেন দৈবগতিকে, ব্ল্যাক স্নেকের দংশনে!’
‘ও-কথায় আপনি বিশ্বাস করুন, আমার বিশ্বাস অন্যরকম৷’
এমন সময়ে ল্যাজ দুলিয়ে বাঘার প্রবেশ৷ গম্ভীরভাবে এগিয়ে এসে গোমেজের পদযুগল বার-কয়েক শুঁকে যে কী পরীক্ষা করল তা কেবল সেই-ই জানে!
গোমেজ বলল, ‘ভারতের ব্ল্যাক স্নেক বিলেতে এসেছে বলে সবাই অবাক হচ্ছে, কিন্তু ভারতের দেশি কুকুরের বিলেত-দর্শনটাও কম আশ্চর্য নয়! আচ্ছা তাহলে উঠতে হয়! আপনাদের সঙ্গে আমার যাওয়ার কথাটা পাকা হয়ে রইল তো?’
‘নিশ্চয়! কাল সকালে অনুগ্রহ করে এসে নিয়োগপত্র নিয়ে যাবেন৷ আজ আমি বড়ো শ্রান্ত৷’
‘উত্তম৷ নমস্কার৷’
‘নমস্কার!’
গোমেজ প্রস্থান করল৷ বিমল একখানা ইজিচেয়ারে লম্বা হয়ে শুয়ে দুই চোখ মুদল৷
কুমার বলল, ‘কী হে, তুমি এখনই ঘুমোবে নাকি?’
‘না, এখন আমি ভাবব৷’
‘কী ভাববে?’
অতঃপর আমার কী করা উচিত? আগে এই হত্যারহস্যের কিনারা করব, না আগে দ্বীপের দিকে যাত্রা করব?’
কুমার বলল, ‘হত্যারহস্যের কিনারা করার জন্যে রয়েছে বিখ্যাত স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের শত শত ধূর্ত লোক, তা নিয়ে তুমি-আমি ভেবে মরব কেন?’
বিমল বলল, ‘ভেবে মরব কেন? তুমি কি এখনও বুঝতে পারোনি যে, হত্যারহস্য আর দ্বীপরহস্য-এ দুটোই হচ্ছে একখানা ঢালের এ-পিঠ আর ও-পিঠ?’
কুমার একখানা চেয়ার টেনে টেবিলের কাছে বসতে গেল, বিমল হঠাৎ চোখ খুলে ব্যস্ত স্বরে বলল, ‘তফাত যাও! আজ তোমরা কেউ এদিকে এসো না!’
কুমার হতভম্বের মতো বলল, ‘এদিকে আসব না? কেন?’
বিমল বিরক্তকন্ঠে বলল, ‘কথায় কথায় জবাবদিহি করতে আমি বাধ্য নয়! . . . তার পর আরও শোনো৷ বাঘা আজ রাত্রে আমাদের সঙ্গে এই ঘরেই থাকবে৷ আজ যা শীত পড়েছে, বাইরে থাকলে পর ওর কষ্ট হবে৷’
লন্ডনের শীতার্ত রাত্রি৷ পথে জনপ্রাণীর পদশব্দ পর্যন্ত নেই- বাতাসও যেন শ্বাস রুদ্ধ করে আড়ষ্ট হয়ে আছে৷ চারিদিকে ঝর ঝর ঝর ঝর করে যেন তুষারের লাজাঞ্জলি বৃষ্টি হচ্ছে৷ রাস্তার আলোগুলোর চোখ ক্রমেই ঝিমিয়ে আসছে-দপ করে যেন নিবে যেতে পারলেই তারা বাঁচে৷
গম্ভীর স্তব্ধতার অন্তরাত্মার মধ্যে যেন মুগুরের ঘা মেরে মেরে ‘বিগ বেন’ ঘাড়ি তার প্রচণ্ড কন্ঠে তিনবার চিৎকার করে উঠল-ঢং! ঢং! ঢং!
হোটেলে বিমলদের ঘরে এখন প্রধান অতিথি হয়েছে নিরন্ধ্র অন্ধকার৷ কয়েকটি নিশ্চিন্ত নিদ্রিত প্রাণীর ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস ছাড়া সেখানেও আর জীবনের কোনো লক্ষণই নেই, জীবনের সাড়া দেবার চেষ্টা করছে কেবল একটি জড় পদার্থ! টেবিলের ঘড়িটার কোনো ক্লান্তি নেই, নীরবতাকে শুনিয়ে শুনিয়ে সে ক্রমাগত বলে যাচ্ছে-টিক টিক, টিক টিক, টিক টিক, টিক টিক!
আচম্বিতে আর-একটা শব্দ শোনা গেল৷ খুব আস্তে আস্তে যেন কোনো জানলার একটা শার্সি খুলে যাচ্ছে! জানলার কাছে অন্ধকারের ভিতরে যেন একটা তরঙ্গের সৃষ্টি হয়েছে! কেমন একটা খুটখুট শব্দ হচ্ছে!
সে-শব্দ এত মৃদু যে কোনো ঘুমন্ত মানুষের কানই তা শুনতে পেল না৷
কিন্তু শুনতে পেল বাঘার কান! হঠাৎ সে গরর করে গর্জে উঠল!
ডান হাতে রিভলবার তুলে বিমল দেখল, জানলার কাছে শার্সির উপরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা স্তম্ভিত ও আড়ষ্ট মূর্তি! প্রকাণ্ড ওভারকোটে তার সর্বাঙ্গ ঢাকা এবং তার মুখখানাও অদৃশ্য এক কালো মুখোশের আড়ালে!
পঞ্চম পরিচ্ছেদ – রৌপ্যসর্পমুখ
আকস্মিক বৈদ্যুতিক আলোকের তীব্র প্রবাহে অন্ধ হয়ে মূর্তিটা সেইখানেই দাঁড়িয়ে রইল-ক্ষণিকের জন্যে৷ পরমুহূর্তেই জানলার ধার থেকে এক লাফ মেরে সে আলোকরেখার বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেল৷
বিমল তাড়াতাড়ি জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়াল, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তার তীক্ষ্ণ চক্ষু বাইরের শীতার্ত অন্ধকারের ভিতর থেকে কোনো দ্রষ্টব্যই আবিষ্কার করতে পারল না৷
ততক্ষণে বাঘার ঘন ঘন উচ্চ চিৎকারে ঘরের আর সকলের ঘুম ভেঙে গেছে৷
কুমার বিছানা থেকে লাফিয়ে পড়ে ত্রস্ত কন্ঠে বলে উঠল, ‘ব্যাপার কী বিমল?’
বিমল হেসে বলল, ‘এমন কিছু নয়৷ সেই ব্ল্যাক স্নেকের সাপুড়ে আজ আমাদের সঙ্গে গোপনে আলাপ করতে এসেছিল!’
‘বলো কী! কী করে জানলে তুমি?’
‘সে যে আসবে, আমি তা জানতাম৷ দ্বীপের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের শিখরে যে একটা বৃহৎ গুপ্তরহস্য আছে, এটা আমরা টের পেয়েছি৷ কাজেই ব্ল্যাক স্নেকের অধিকারী যে এখন আমাদের জীবন প্রদীপের শিখা নিবিয়ে দেবার চেষ্টা করবে, এটা কিছু আশ্চর্য কথা নয়৷ তাকে অভ্যর্থনা করবার জন্যে আমি প্রস্তুত হয়েই ছিলাম৷ দুঃখের বিষয় এই যে, তাকে আজ ধরতে পারলাম না!’
বিনয়বাবু বললেন, ‘কিন্তু তার চেহারা দেখেছ?’
‘দেখেছি বটে, তবে তাকে আবার দেখলে চিনতে পারব না৷ কারণ সে ঘোমটা দিয়ে এসেছিল৷’
‘ঘোমটা দিয়ে?’
‘অর্থাৎ মুখোশ পরে৷ কিন্তু সে তার একটি চিহ্ন পিছনে ফেলে রেখে গিয়েছে৷’
‘কী চিহ্ন?’
জানলার শার্সি টেনে পরীক্ষা করতে করতে বিমল বলল, ‘শার্সির এইখানে সে হাত রেখেছিল৷ কাচের উপরে তার ডান হাতের আঙুলের ছাপ আছে৷ জানেন তো বিনয়বাবু, কোনো দুজন লোকের আঙুলের ছাপ একরকম হয় না?’
‘জানি৷ পুলিশও তাই সমস্ত অপরাধীর আঙুলের ছাপ জমা করে রাখে৷’
‘কুমার, খানিকটা গ্রে পাউডার আর আঙুলের ছাপ তোলবার অন্যান্য সরঞ্জাম এনে দাও তো৷’
কুমার বলল, ‘আসামি যখন পলাতক, তখন আঙুলের ছাপ নিয়ে আমাদের কী লাভ হবে?’
‘অন্তত এ-ছাপটা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে পাঠিয়ে দিলে জানা যাবে যে, ব্লাক স্নেকের অধিকারী পুরাতন পাপী কি না! পুরাতন পাপী হলে-অর্থাৎ পুলিশের কাছে তার আঙুলের আর-একটা ছাপ পাওয়া গেলে তাকে খুব সহজেই ধরে ফেলা যাবে!’
‘কিন্তু আজ এখানে যে এসেছিল, সে যদি অন্য লোক হয়? হয়তো ব্ল্যাক স্নেকের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই নেই-সে একটা সাধারণ চোর মাত্র!’
‘কুমার, তোমার এ অনুমানও সত্য হতে পারে৷ তবু দেখাই যাক না! জিনিসগুলো এনে দিয়ে আপাতত তোমরা আবার লেপ মুড়ি দিয়ে স্বপ্ন দেখবার চেষ্টা করগে যাও!’
পরদিন সকালে বিনয়বাবুকে নিয়ে কুমার ও কমল যখন বেড়াতে বেরোল, বিমল তাদের সঙ্গে গেল না; সে তখন সেই আঙুলের ছাপের ফটোগ্রাফ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে৷
ঘণ্টাখানেক পরে তারা আবার হোটেলে ফিরে এসে দেখল, ঘরের মাঝখানে বড়ো টেবিলটার ধারে বিমল চুপ করে বসে বসে কী ভাবছে৷
কুমার শুধোল, ‘কী হে, আঙুলের ছাপের ফোটো তোলা শেষ হল?’
হুঁ ৷ এখানে এসে এই ছবিখানি একবার মিলিয়ে দেখো দেখি৷’
কুমার এগিয়ে এসে দেখল, টেবিলের উপর পাশাপাশি দু-খানা ফোটো পড়ে রয়েছে৷ খানিকক্ষণ মন দিয়ে পরীক্ষা করে সে বলল, ‘এ তো দেখছি একই আঙুলের দু-রকম দু-খানা ছবি৷ একখানা ছবি না-হয় তুমিই তুলেছ, কিন্তু আর একখানা ছবি কোথায় পেলে? স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে আনলে নাকি?’
‘না, দু-খানা ছবিই আমার তোলা৷ এখন বলো দেখি, এই দুটো ছাপের রেখা অবিকল মিলে যাচ্ছে কি না?’
‘হ্যাঁ, অবিকল মিলে যাচ্ছে বটে!’
অত্যন্ত উৎফুল্ল মুখে ছবিখানা পকেটে পুরে বিমল বলল, ‘কুমার, কাল সকালেই খবরের কাগজে দেখবে, ব্ল্যাক স্নেকের অধিকারী গ্রেপ্তার হয়েছে!’
কুমার বিস্মিত স্বরে বলল, ‘সে কী হে! তোমার এতটা নিশ্চিত হবার কারণ কী? আঙুলের ছাপই না-হয় পেয়েছ, কিন্তু এতে তো আর কারোর নাম লেখা নেই!’
বিমল কান পেতে কী শুনল, তারপর চেয়ারের উপরে সিধে হয়ে বসে বলল, ‘ওসব কথা পরে হবে অখন! সিঁড়িতে জুতোর শব্দ হচ্ছে, বোধ হয় মি. গোমেজ নিয়োগপত্র নিতে আসছেন! আগে তাঁর মামলা শেষ করে ফেলা যাক-কী বলো?’
গোমেজ ঘরের ভিতরে আসতেই বিমল উঠে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বলল, ‘গুড মর্নিং গোমেজ, গুড মর্নিং! আমরা আপনারই অপেক্ষায় বলছিলাম৷’
গোমেজ বলল, ‘আমার পরম সৌভাগ্য৷ কিন্তু শুনলাম কাল নাকি আপনাদের ঘরে চোর ঢুকেছিল?’
‘এখনই এ খবরটা কে আপনাকে দিল?’
‘আপনাদের ভৃত্য!’
‘ও, রামহরি? হ্যাঁ, কাল রাত্রে একটা লোক এই ঘরে ঢোকবার চেষ্টা করেছিল বটে! কিন্তু আমি জেগে আছি দেখে পালিয়ে গেছে৷’
‘বাস্তবিক, আজকাল লন্ডন শহর বড়োই বিপদজনক হয়ে উঠেছে৷ চারদিকে দিন-রাত চোর-ডাকাত-হত্যাকারী ঘুরে বেড়াচ্ছে! সবাই বলে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের পুলিশবাহিনীর মতো কর্মীদল পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় নেই৷ কিন্তু আমি এ-কথায় বিশ্বাস করি না৷ শহরের এত বড়ো রাস্তার উপরে আপনাদের এই বিখ্যাত হোটেল, অথচ বিলেতি পুলিশ সেখানেও চোরের আনাগোনা বন্ধ করতে পারে না! লজ্জাকর!’
বিনয়বাবু বললেন, ‘মি. গোমেজ, আমিও আপনার মতে সায় দিই৷ দেখুন না, ব্ল্যাক স্নেকের এই অদ্ভুত রহস্যের কোনো কিনারাই এখনও হল না!’
গোমেজ বলল, ‘কিন্তু ও-জন্যে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে বেশি দোষ দিই না৷ ও-রহস্যের কিনারা হওয়া অসম্ভব!’
বিমল বলল, ‘কেন?’
‘জানেন তো, সমুদ্রে আমাদের মতন যারা নাবিকের কাজ করে, তাদের এমন সব সংস্কার থাকে সাধারণের মতে যা কুসংস্কার! আমার দৃঢ়বিশ্বাস, ব্ল্যাক স্নেক রহস্যের মধ্যে কোনো অলৌকিক শক্তি কাজ করছে৷ অলৌকিক শক্তির সামনে পুলিশ কী করবে!’
বিমল হাসতে হাসতে বলল, ‘কিন্তু এই ব্ল্যাক স্নেকের রহস্যের সঙ্গে যে-শক্তির সম্পর্ক আছে, তাকে আমি অনায়াসেই দমন করতে পারি৷’
‘পারেন? কী করে?’
‘আমার এই একটি মাত্র ঘুসির জোরে!’-বলেই বিমল আচম্বিতে গোমেজের মুখের উপরে এমন প্রচণ্ড এক ঘুষি মারল যে, সে তখনই ঘুরে দড়াম করে মাটির উপরে পড়ে গেল! পর মুহূর্তেই সে গোমেজের দেহের উপরে বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে চেঁচিয়ে, ‘কুমার! কমল! শিগগির খানিকটা দড়ি আনো!’
বিনয়বাবু হাঁ হাঁ করে উঠে বললেন, ‘বিমল, বিমল! তুমি কি হঠাৎ পাগল হয়ে গেলে? মি. গোমেজকে খামোকা ঘুসি মারলে কেন?’
বিমল উত্তেজিত স্বরে বলল, ‘আরে মশাই, আগে দড়ি এনে গোমেজ-বাবাজিকে আচ্ছা করে বেঁধে ফেলুন, তারপর অন্য কথা!’
কুমার ও কমল যখন দড়ি এনে গোমেজের হাত-পা বাঁধতে নিযুক্ত হল, বিনয়বাবু তখন বারবার মাথা নেড়ে বলতে লাগলেন- ‘এ বড়োই অন্যায়, এ বড়োই অন্যায়!’
বিমল গোমেজকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল৷
কুমার হতভম্বের মতো বলল, ‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!’
বিমল বলল, ‘কাল রাত্রে এই গোমেজই মুখোস পরে আমাদের ঘরে ঢোকবার চেষ্টা করেছিল!’
ততক্ষণে গোমেজের আছন্ন ভাবটা কেটে গিয়েছে৷ সে একবার ওঠবার জন্যে ব্যর্থ চেষ্টা করে দাঁত-মুখ খিচিয়ে বলে উঠল, ‘মিথ্যা কথা!’
বিমল বলল, ‘মিথ্যা কথা নয়৷ আমার কাছে প্রমাণ আছে৷’
‘কী প্রমাণ?’
বিমল হাসিমুখে বলল, ‘বাপু গোমেজ, মনে আছে, কাল যখন আমি বলেছিলাম-‘হয়তো তুমিই ভারতীয় ব্ল্যাক স্নেককে বিলাতে নিয়ে এসেছ, তুমি মহা খাপ্পা হয়ে এই কাচ-ঢাকা টেবিলের উপরে চড় বসিয়ে দিয়েছিলে? কাচের আর পালিস-করা জিনিসের উপরে চড় মারলেই আঙুলের ছাপ পড়ে জানো তো? আমি গোড়া থেকেই সন্দেহ করেছিলাম, লন্ডনে যে-ব্যক্তি খুশিমতো ব্ল্যাক স্নেক খেলিয়ে বেড়াচ্ছে, সে আমাদের বিজ্ঞাপনের উত্তর না দিয়ে পারবে না৷ এই সন্দেহের কারণ উপস্থিত বন্ধুদের কাছে আগেই বলেছি৷ বিজ্ঞাপনের ফলে দেখা দিয়েছ তুমি৷ তাই তোমাকেও আমি সন্দেহ করেছি৷ কাজেই টেবিলের কাচের উপর থেকে তোমার আঙুলের ছাপের ফটো আমি তুলে রেখেছি৷ এই দেখো, তোমার সেই আঙুলের ছাপের ফটো! তারপর কাল গভীর রাতে এই ঘরে ঢুকতে এসে তুমি আবার বোকার মতো জানলার শার্সিতে হাত রেখেছিলে-আর, তোমার মরণ হয়েছে সেইখানেই৷ কারণ শার্সির উপরেও যে আঙুলের ছাপ পেয়েছি তার ফোটোর সঙ্গে আগেকার ফোটো মিলিয়েই আমি তোমাকে আবিষ্কার করে ফেলেছি-বুঝলে? বোকারাম, এখনও নিজের দোষ স্বীকার করো৷’
বিনয়বাবু প্রশংসা-ভরা কন্ঠে বললেন, ‘বিমল, তোমার সূক্ষ্মবুদ্ধি দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি!’
কুমার বলল, ‘গোয়েন্দাগিরিতেও যে বিমলের মাথা এত খেলে, আমিও তা জানতাম না!’
কমল এমন ভাবে বিমলের মুখের পানে তাকিয়ে রইল, যেন সে চোখের সামনে কোনো মহামানবকে নিরীক্ষণ করছে!
এতক্ষণে গোমেজ নিজেকে সামলে নিল৷ শুকনো হাসি হেসে মনের ভাব লুকিয়ে সে সংযত স্বরে বলল, ‘তোমাদের ওসব তুচ্ছ প্রমাণের স্বপক্ষে বা বিপক্ষে আমি এখন কোনো কথা বলতে চাই না৷ কিন্তু দেখছি, তোমাদের মতে আমিই হচ্ছি ব্ল্যাক স্নেকের মালিক! অর্থাৎ আমিই তিন-তিনটে মানুষ খুন করেছি?’
বিমল মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ, আমার তো তাই বিশ্বাস৷ অন্তত ওই তিনটে খুনের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক আছে৷’
‘প্রমাণ? বিজ্ঞাপন দেখে আমি এখানে এসেছি, এ প্রমাণ দেখে তো বিচারক আমার ফাঁসির হুকুম দেবেন না! আদালতে এটা প্রমাণ বলেই গ্রাহ্য হবে না!’
‘ওহো, গোমেজ! তুমি এখনও ল্যাজে খেলছ? তুমি জেনে নিতে চাও, তোমার বিরুদ্ধে আমরা কী কী প্রমাণ সংগ্রহ করেছি? আচ্ছা, সেসব যথাসময়ে জানতে পারবে! এখন প্রথমে আমি তোমাকে পুলিশের হাতে সমর্পণ করব৷ তারপর তোমার বাসা খানাতল্লাশের ব্যবস্থা করব৷’
‘কেন?’
‘সেখানে আরও কতগুলো ব্ল্যাক স্নেক আছে তা দেখবার জন্যে৷’
গোমেজ অট্টহাস্য করে বলল, ‘ওহে অতিবুদ্ধিবান বাঙালিবাবু! আমার বাসা থেকে তুমি যদি আধখানা ব্ল্যাক স্নেকও খুঁজে বার করতে পারো, তাহলে আমি হাজার টাকা বাজি হারব!’
বিমল গোমেজের দেহের দিকে এগিয়ে বলল, ‘কিন্তু তার আগে আমি তোমার জামার পকেটগুলো হাতড়ে দেখতে চাই৷’
‘কেন? তুমি কি মনে কর, আমার জামার পকেটগুলো হচ্ছে ব্ল্যাক স্নেকের বাসা?’
বিমল কোনো জবাব না দিয়ে গোমেজের দেহের দিকে হেঁট হল৷
ঠিক সেই মুহূর্তেই গোমেজ হঠাৎ তার বাঁধা পা দু-খানা তুলে বিমলের বুকের উপরে জোড়া-পায়ে বিষম এক লাথি বসিয়ে দিল! বিমল এর জন্যে মোটেই প্রস্তুত ছিল না, সে একেবারে চার-পাঁচ হাত দূরে ঠিকরে গিয়ে ভূতলশায়ী হল৷
তারপরেই সকলে সবিস্ময়ে দেখল, গোমেজের পায়ের বাঁধন কেমন করে খুলে গেল এবং হাত-বাঁধা অবস্থাতেই সে উঠে দাঁড়িয়ে বেগে দরজার দিকে ছুটল!
কিন্তু দরজার কাছে গম্ভীর মুখে বসেছিল বাঘা! সে হঠাৎ গোমেজের কন্ঠদেশ লক্ষ করে মস্ত এক লাফ মারল!
গোমেজ একপাশে সাঁৎ করে সরে গিয়ে বাঘার লক্ষ্য ব্যর্থ করলে বটে, কিন্তু বাঘা মাটিতে পড়েই বিদ্যুৎগতিতে ফিরে তার একখানা পা প্রাণপণে কামড়ে ধরল এবং কুমার, কমল ও বিনয়বাবু সময় পেয়ে আবার তাকে ধরে মাটির উপরে পেড়ে ফেলল!
বিমল উঠে দাঁড়িয়ে সহাস্যে বলল, ‘শাবাশ গোমেজ! ঘরে আমরা এতগুলো মদ্দ রয়েছি, আর তোমার হাত-পা বাঁধা! তবু তুমি আমাকে কুপোকাত করতে পেরেছ! তোকেও বাহাদুরি দিই বাঘা! তুই না থাকলে তো এতক্ষণে আমাদের মণিহারা ফণীর মতো ছুটোছুটি করতে হত! বাঁধো কুমার, গোমেজকে এবারে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলো!
গোমেজ রাগে ফুলতে ফুলতে বলল, ‘থাকত যদি হাত দুটো খোলা৷’
বিমল বলল, ‘কিন্তু সে দুঃখ করে আর কোনোই লাভ নেই! এখন আর বেশি ছটফট কোরো না! পকেটগুলো দেখাতে তোমার এত আপত্তি কেন? এটা তো দেখছি, রিভলবার৷ তুমি তাহলে সর্বদাই রিভলবার নিয়ে বেড়িয়ে বেড়াও? আইনে এটা যে সাধুতার লক্ষণ নয়, তা জানো তো? এটা বোধ হয় ডায়েরি? হুঁ, পাতায় পাতায় অনেক কথাই লেখা রয়েছে৷ হয়তো পরে আমাদের কাজে লাগতে পারে- কুমার, ডায়েরিখানা আপাতত তোমার জিম্মায় থাক! এটা কী? কার্ড বোর্ডের একটা বাক্স! কিন্তু বাক্সটা এত ভারী কেন?’
গোমেজের মুখ সাদা হয়ে গেছে-ভয়ে কি যাতনায় বোঝা গেল না! সে ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘ও কিছু নয়! ওতে একটা খেলনা ছাড়া আর কিছু নেই!’
বিমল মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘খেলনা? হুঁ, শয়তানের খেলনা হচ্ছে মানুষের প্রাণ, বিড়ালের খেলনা হচ্ছে ইঁদুর! তোমারও খেলনা আছে শুনে ভয় হচ্ছে৷ দেখা যাক এ আবার কী-রকম খেলনা!’
বিমল খুব সাবধানে একটু একটু করে বাক্সের ডালাটা খুলল-কিন্তু তার ভিতর থেকে ভয়াবহ কিছুই বেরোল না৷ খানিকটা তুলোর মাঝখানে রয়েছে একটা রুপোর জিনিস৷ সেটাকে বার করে তুলে ধরল৷
গোমেজ বলল, ‘আমার কথায় বিশ্বাস হল না, এখন দেখছ তো ওটা একটা খেলনা, আমার এক বন্ধুর মেয়েকে উপহার দেব বলে কিনেছি!’
কুমার জিনিসটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘রুপো দিয়ে গড়া একটা সাপের মুখ!’
রুপোয় তৈরি সেই নিখুঁত সর্পমুখের দিকে সন্দেহপূর্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে বিমল বলল, ‘কুমার গোমেজের এই অদ্ভুত খেলনা দেখে সত্যিই আমার ভয় হচ্ছে! এটা জ্যান্ত নয়, মরা সাপও নয়, কিন্তু এমন জিনিস গোমেজের পকেটে কেন? এটা কোনো অমঙ্গলের নিদর্শন? অনেক ভারতবাসীর মতন গোমেজও কি সাপ পুজো করে?’
গোমেজ হঠাৎ হা হা করে বিশ্রী হাসি হেসে বলে উঠল, ‘না, হিন্দুদের মতন আমি সাপ-পুজো করি না- ওটা হচ্ছে খেলনা, আর আমি হচ্ছি খ্রিস্টান!’
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – সব কাকেরই এক ডাক
বিমল জানলার কাছে গিয়ে বাইরের আলোতে অনেকক্ষণ ধরে সেই রুপোর সাপের মুখটা উলটে-পালটে পরীক্ষা করল৷ এরকম অদ্ভুত জিনিস সে আর কখনো দেখেনি৷
এটা গড়েছে কোনো অসাধারণ কারিগর৷ মুখটা অবিকল একটা প্রমাণ কেউটে সাপের মতন দেখতে৷
পরীক্ষা শেষ হলে পর বিমল ফিরে ডাকল, ‘বিনয়বাবু, আপনারা এদিকে আসুন৷’
সকলে গেলে পরে বিমল বলল, ‘এটা কেবল সাপের মুখ নয়, এটা একটা যন্ত্রও বটে!’
‘যন্ত্র?’
হুঁ ৷ এই দেখুন, কল টিপলে সাপের মুখটাও হাঁ করে!’
বিমল কল টিপল, মুখটাও অমনি জ্যান্ত সাপের মতোই ফস করে হাঁ করল!
বিনয়বাবু চমৎকৃত স্বরে বললেন, ‘ওর মুখের ভিতরে যে দাঁতও রয়েছে!’
‘হ্যাঁ, কাচের দাঁত৷ এমনকী বিষদাঁত পর্যন্ত বাদ যায়নি৷ . . . কুমার, টেবিলের উপর থেকে ওই পিনকুশনটা নিয়ে এসো তো!’
কুমার সেটা নিয়ে এল৷ বিমল সাপের মুখটা পিনকুশনের উপরে রেখে স্প্রিং ছেড়ে দিতেই দাঁত দিয়ে সেই মুখটা কুশন কামড়ে ধরল!
স্প্রিং টিপে আবার মুখটা ছাড়িয়ে নিয়ে বিমল পিনকুশনটা আঙুল বুলিয়ে পরীক্ষা করে বলল, ‘কুশনটা ভিজে গেছে৷ তার মানে সাপের মুখ থেকে খানিকটা জলীয় পদার্থ কুশনের উপরে গিয়ে পড়েছে!’
কুমার বলল, ‘এই জলীয় পদার্থটি কী হতে পারে?’
বিমল ধীরে ধীরে গোমেজের কাছে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘গোমেজের দেহের উপরেই সে পরীক্ষা করা যাক!’
গোমেজের বাঁধা হাতের উপরে সাপের মুখ রেখে বিমল স্প্রিংটা টিপতেই সদাপ্রস্তুত রৌপ্যসর্প দন্তবিকাশ করল!
সঙ্গে সঙ্গে গোমেজের আশ্চর্য ভাবান্তর! সে কোনোরকমে হড়াৎ করে মেঝের উপরে খানিকটা তফাতে সরে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘রক্ষা করো! রক্ষা করো!’
বিমল বলল, ‘কেন গোমেজ? তোমার মতে এটা তো খেলনা মাত্র৷ -এর সঙ্গে তোমাকে খেলা করতেই হবে, নইলে কিছুতেই আমি ছাড়ব না!’
বিমল আবার এগিয়ে গেল, গোমেজ তেমনি করে আবার সরে গেল, -বিষম আতঙ্কে তার দুই চক্ষু ঠিকরে তখন কপালে উঠেছে!
বিমল হাঁটু গেড়ে মাটির উপরে বসে পড়ে বাঁ হাতে গোমেজকে চেপে ধরে কর্কশ কন্ঠে বলল, ‘বলো তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? নইলে এই রুপোর সাপের কবল থেকে তুমি কিছুতেই নিস্তার পাবে না!’
গোমেজ বিবর্ণ মুখে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘বিষ আছে! ওর ফাঁপা কাচের দাঁতে বিষ আছে৷’
‘কেউটে সাপের বিষ?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, কেউটে সাপের বিষ৷ যখন সব ব্যাপারই বুঝতে পেরেছ তখন আমাকে আবার জিজ্ঞাসা করছ কেন?’
বিমল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কুমার, ব্ল্যাক স্নেকের রহস্য এখন বুঝতে পারলে কি? এই সাংঘাতিক যন্ত্রটা একেবারে সাপের মুখের আকারে তৈরি করা হয়েছে-এমনকী এই কলের মুখটা কারোকে কামড়ালে ঠিক সাপে কামড়ানোর মতন দাগ পর্যন্ত হয়! এর ফাঁপা বিষদাঁতটা সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতে বিষ ঢেলে দেয়! এই জন্যেই মর্টন, মরিস আর ম্যাকলিয়ড ইহলোক থেকে অকালে বিদায় নিয়েছেন৷’
বিনয়বাবু বিস্ফারিত নেত্রে সর্পমুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী ভয়ানক!’
কুমার বলল, ‘কিন্তু ঘটনাস্থলে একবার একটা সত্যিকার কেউটে সাপও তো পাওয়া গিয়েছে!’
বিমল শুষ্ক হাস্য করে বলল, ‘হ্যাঁ, মরা সাপ! গোমেজ হয়তো তার নকল সাপের মুখের জন্যে আসল বিষদাঁত থেকে বিষ সংগ্রহ করেছিল৷ তারপর তাকে হত্যা করে ঘটনাস্থলে ফেলে গিয়েছিল, পুলিশের চোখে ধাঁধা দেবার জন্যে! আসল সাপ চোখে দেখলে আর নকল সাপের কথা সন্দেহ করবে না কেউ! কেমন গোমেজ, তাই নয় কি?’
গোমেজ রেগে কটমট করে বিমলের দিকে তাকাল, কিন্তু একটাও কথা কইল না৷
বিমল একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে গোমেজের পাশে গিয়ে বসল৷ তারপর বলল, ‘চুপ করে থাকলে চলবে না৷ তোমার বক্তব্য কী, বলো৷’
গোমেজ বলল, ‘আমার কোনো বক্তব্য নেই৷ আমি কিছু বলব না৷’
‘বলবে না? তাহলে তোমার সাপ তোমাকেই কামড়াবে৷’
‘তুমি এখন জেনেছ যে, ওর মুখে বিষ আছে৷ ও সাপ এখন আমাকে কামড়ালে আমাকে হত্যা করার অপরাধে তুমিই ফাঁসিকাঠে ঝুলবে৷’
‘বেশ, তাহলে তোমাকে পুলিশের হাতেই সমর্পণ করব৷ বিচারে তোমার কী হবে, বুঝতে পারছ তো?
গোমেজ হা হা করে হেসে বলল, ‘বিচারে আইনের কূটতর্কে আমি খালাস পেলেও পেতে পারি৷ আমি এখনও অপরাধ স্বীকার করিনি৷ আমার বিরুদ্ধে কোনো চাক্ষুষ প্রমাণ নেই৷ ওই রুপোর সাপের বিষেই যে তিনটে লোক মারা পড়েছে, একথা কোনো আইনই জোর করে বলতে পারবে না৷’
বিমল খানিকক্ষণ চুপ করে বসে ভাবতে লাগল৷ তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘গোমেজ, তোমার কথা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না৷ তুমি যে পাষণ্ড হত্যাকারী, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই৷ তবে আইনের কূটতর্কে তুমি খালাস পেলেও আমি বিস্মিত হব না৷ যদিও তোমার বিরুদ্ধে আমি যে মামলা খাড়া করেছি, তার ফলে তুমি ফাঁসিকাঠে মরবে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস৷ কিন্তু তাতে আমার লাভ কী? আমি পুলিশের লোক নই, তোমাকে ধরিয়ে না দিলেও কেউ আমাকে কিছু বলতে পারে না৷ তবে জেনেশুনেও তোমার মতন পাপীকে একেবারে ছেড়ে দেওয়াও অপরাধ৷ অতএব, তোমার সঙ্গে আমি একটা মাঝামাঝি রফা করতে চাই৷’
‘কীরকম রফা শুনি?’
‘তুমি কারোকে খুন করেছ কি না সেটা জানবার জন্যে আমার মাথাব্যথা নেই৷ আমরা কেবল এইটুকুই জানতে চাই, মর্টন, মরিস আর ম্যাকলিয়ড সেই অজ্ঞাত দ্বীপে গিয়ে কোন রহস্যের সন্ধান পেয়েছিলেন? আর তাঁদের সেই আবিষ্কারের কথা তুমি জানলে কেমন করে?’
গোমেজ উত্তেজিত স্বরে বলল, ‘সে দ্বীপে গিয়ে কেউ কোনো রহস্যের সন্ধান পায়নি৷ কোনো আবিষ্কারের কথা আমি জানি না৷ এসব তোমার বাজে কল্পনা!’
‘শোনো গোমেজ! যদি তুমি আমার জিজ্ঞাসার জবাব দাও, তাহলে তোমার উপরে আমি এইটুকু দয়া করতে পারি-তোমার হাতপায়ের বাঁধন খুলে আমি তোমাকে মুক্তি দেব৷ তারপর এক মিনিট কাল অপেক্ষা করে ফোনে তোমার কথা পুলিশকে জানাব৷ ইতিমধ্যে তুমি পারো তো যেখানে খুশি অদৃশ্য হয়ে যেও, আমরা কেউ তোমাকে কোনো বাধা দেব না৷’
‘আমি কিছু জানি না৷’
বিমল উঠে দাঁড়িয়ে কঠিন স্বরে বলল, ‘গোমেজ তুমি আগুন নিয়ে খেলা করতে চাও? আমার আপত্তি নেই৷ আমি এখনই তোমার কথা পুলিশকে জানাচ্ছি৷’ এই বলে সে টেলিফোনের দিকে অগ্রসর হল!
গোমেজ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘আচ্ছা, একটু অপেক্ষা করো৷’
বিমল দাঁড়িয়ে পড়ে দৃঢ়কন্ঠে বলল, ‘আমাকে আবার ভোলাবার চেষ্টা করলেই আমি পুলিশ ডাকব, পুলিশ তোমার পেট থেকে কথা বার করবার অনেক উপায়ই জানে৷’
‘আমার কাছ থেকে সব কথা জেনে নিয়েও তুমি যদি আমাকে ছেড়ে না দাও?’
‘আমি ভদ্রলোক৷ আমার কথায় এখন বিশ্বাস করা ছাড়া তোমার আর কোনো উপায় নেই৷’
‘বেশ, তাহলে আমার অদৃষ্টকেই পরীক্ষা করা যাক৷ বাবু, এভাবে আমার কথা কওয়ার সুবিধা হবে না, আমাকে তুলে বসিয়ে দাও৷’
কুমার তাকে তুলে বসিয়ে দিল৷ গোমেজ বলতে লাগল-
‘বাবু, আমার বলবার কথা বেশি নেই৷ তবে আমি যেটুকু জেনেছি, তা সামান্য হলেও তোমরা মাঝে পড়ে বাধা না দিলে সেইটেই হয়তো অসামান্য হয়ে উঠতে পারত৷ কিন্তু উপায় কী, আমার বরাত নিতান্তই মন্দ!
‘কেমন করে আমাদের জাহাজ সেই দ্বীপে গিয়ে পড়ল এবং কেন আমরা সেই দ্বীপে গিয়ে নেমেছিলাম, এসব কথা খবরের কাগজে তোমরা নিশ্চয়ই পাঠ করেছ৷ সুতরা সেসব কথা নিয়ে আমি আর সময় নষ্ট করব না৷ দ্বীপের সেই অদ্ভুত পাথরের মূর্তিগুলোর কথাও তোমরা জানো, তাদের নিয়েও কিছু বলবার নেই৷ কারণ আমরাও তাদের ভালো করে দেখবার সময় পাইনি৷
‘সারাক্ষণই আমরা সেই আটজন হারা সঙ্গীকে খুঁজতেই ব্যস্ত ছিলাম৷ কিন্তু ওইটুকু একটা ন্যাড়া দ্বীপ তন্নতন্ন করে দেখেও আমরা একজন সঙ্গীকেও খুঁজে বার করতে পারলাম না৷ অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম, একসঙ্গে আট-আটজন মানুষ কেমন করে অদৃশ্য হল৷
‘খুঁজতে বাকি ছিল কেবল পর্বত-দ্বীপের শিখরটা৷ মি. মর্টন, মি. মরিস ও ম্যাকলিয়ড আমাদের কিছুক্ষণ আগেই শিখরের উপরদিকে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেলেন৷ আমরা তাঁদের অপেক্ষায় খানিকক্ষণ নীচে দাঁড়িয়ে বিশ্রাম করতে লাগলাম৷
‘পনেরো মিনিট কাটল, তবু তাঁদের দেখা নেই! তখন আমরাও উপরে উঠতে শুরু করলাম৷
‘সকলের আগে উঠছিলাম আমিই৷ খানিক পরেই মি. মর্টনের গলা শুনতে পেলাম৷ তিনি সবিস্ময়ে বলছিলেন, ”এ কীরকম বর্শা! এর ডান্ডাটা যে সোনার বলে মনে হচ্ছে!”
‘তারপরেই মি. মর্টনকে দেখতে পেলাম৷ মি. মরিস আর মি. ম্যাকলিয়ডের মাঝখানে তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন, তাঁর হাতে একটা সুদীর্ঘ বর্শা,-কেবল তার ফলাটা বোধ হয় ব্রোঞ্জের৷
‘তাঁরা তিনজনেই আমাকে দেখে কেমন যেন থতমত খেয়ে গেলেন! মি. মর্টন তাঁর হাতের বর্শাটা মাটির উপরে ফেলে দিয়ে চেঁচিয়ে বললেন-গোমেজ, তোমাদের আর কষ্ট করে উপরে উঠতে হবে না, নাবিকদের কেউ এখানে নেই৷ চলো, আমরাও নেমে যাই৷
‘আমি বললাম-কিন্তু আপনার হাতে ওটা কী দেখলাম যে?
‘একটা ভাঙা পুরোনো বর্শা! কবে কে এখানে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল, কাজে লাগবে না বলে আমিও ফেলে দিলাম! চলো!
‘কিন্তু বর্শাটা যে ভাঙা নয়, সেটা আমি স্পষ্টই দেখেছিলাম, তার সুদীর্ঘ দণ্ড সূর্যের আলোতে পালিশ-করা সোনার মতো চকচকিয়ে উঠছিল! কিন্তু মি. মর্টন আমাদের উপরওয়ালা, কাজেই তাঁর হুকুম অমান্য করতে পারলাম না, নীচে নামতে নামতে কৌতূহলী হয়ে ভাবতে লাগলাম, মি. মর্টন আমাকে উপরে উঠতে দিলেন না কেন, আর আমার সঙ্গে মিথ্যা কথাই বা কইলেন কেন?
‘জাহাজে ফিরে এলাম৷ কিন্তু মনের ভিতরে একটা বিষম কৌতূহল জেগে রইল৷ বেশ বুঝলাম, ওঁরা একটা এমন কিছু দেখেছেন যা আমার কাছে প্রকাশ করতে চান না৷ কিন্তু কেন?
‘মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, যেমন করেই হোক ভিতরের রহস্যটা জানতেই হবে৷ জাহাজের কারোর কাছেই কিছু ভাঙলাম না, কিন্তু সর্বক্ষণই ওঁদের গতিবিধির উপর রাখলাম জাগ্রত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি!
‘পরদিনের সন্ধ্যাতেই সুযোগ মিলল৷ দূর থেকে দেখলাম, মি. মরিস ও মি. ম্যাকলিয়ডকে নিয়ে মি. মর্টন নিজের কামরার ভিতরে গিয়ে ঢুকলেন৷
‘এদিকে-ওদিকে কেউ নেই দেখে আমি পা টিপেটিপে কামরার কাছে গিয়ে দরজায় কান পেতে দাঁড়িয়ে রইলাম৷
‘শুনলুম মি. মরিস বলছেন,-ওটা সোনা না হতেও পারে!
‘মি. মর্টন দৃঢ়স্বরে বললেন,-আমি দিব্য গেলে বলতে পারি, বর্শার ডান্ডাটা সোনায় মোড়া না হয়ে যায় না! ওই একটা ডান্ডায় যতটা সোনা আছে তার দাম হবে কয়েক হাজার টাকা৷
‘মি. ম্যাকলিয়ড বললেন,-কিন্তু যদিই বা তাই হয়, তবে ওই সোনার বর্শার সঙ্গে শিখরের সেই আশ্চর্য ব্রোঞ্জের দরজার আর আমাদের নাবিকদের অদৃশ্য হওয়ার কী সম্পর্ক থাকতে পারে?
‘মি. মর্টন বললেন,-আমি অনেক ভেবেচিন্তে যা স্থির করেছি শোনো-সেই সর্বোচ্চ শিখরের গায়ে আমরা একটা ব্রোঞ্জ ধাতুতে গড়া বিরাট দরজা আবিষ্কার করেছি৷ সে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ কেন? নিশ্চয়ই তার ভিতরে ঘর বা অন্য কোথাও যাবার পথ আছে৷ সে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করল কারা? নিশ্চয়ই যারা ঝড়ের রাতে আলো জ্বেলে চলাফেরা করছিল তারাই৷ তারা যে কারা, তা আমি কল্পনা করতে পারছি না৷ তবে ওই স্বর্ণময় বর্শা দেখে অনুমান করা যায়, ওটা হচ্ছে তাদেরই অস্ত্র৷ খুব সম্ভব, তারা আমাদের আটজন নাবিককে আক্রমণ আর বন্দি করেছে৷ তারপর আমাদের সবাইকে দল বেঁধে দ্বীপের দিকে যেতে দেখে বন্দিদের নিয়ে তারা ওই দরজার পিছনে অদৃশ্য হয়েছে৷ আর যাবার সময় তাড়াতাড়িতে বর্শাটা ভুলে ফেলে রেখে গিয়েছে৷ এখন ভেবে দেখো, সাধারণ বর্শা যাদের সুবর্ণময় তাদের কাছে সোনা কত সস্তা! দ্বীপে যখন পানীয় জল নেই, তখন ওখানে নিশ্চয়ই কেউ বেশিদিন বাস করে না৷ তবে সোনার বর্শা নিয়ে কারা ওখানে বিচরণ করে? হয়তো তারা অন্য কোনো দ্বীপের আদিম বাসিন্দা, ওই দ্বীপে তাদের প্রাচীন দেবতার ধনভাণ্ডার বা গুপ্তধন আছে, মাঝে মাঝে তারা তা পরিদর্শন করতে আসে৷ শুনেছি, দক্ষিণ আমেরিকার আদিম বাসিন্দারা দেবতাদের বিপুল ধনভাণ্ডার এমনি করেই লুকিয়ে রাখত, আর তাদের কাছেও সোনারুপো ছিল এমনি সস্তা৷ হতভাগা কেলেভূত গোমেজটার জন্যে ভালো করে কিছু দেখবার সময় পেলাম না, কিন্তু আমাদের আবার সেখানে যেতেই হবে৷ আমার দৃঢ়বিশ্বাস, ওই দ্বীপে গেলে আমরা ধনকুবের হয়ে ফিরে আসব৷
‘তারপরেই মরিসের গলা পেলাম-সঙ্গে সঙ্গে শুনলাম কাদের পায়ের শব্দ, কারা যেন আমার দিকেই আসছে৷ কাজেই আমার আর কিছু শোনা হল না, ধরা পড়বার ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে এলাম৷ . . . বাবু, দ্বীপের আর কোনো কথা আমি জানি না, এইবারে আমাকে ছেড়ে দাও৷’
গোমেজের কথা শুনে বিমল কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল৷
তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, গোমেজ, তুমিও বলছ দ্বীপে জল নেই?’
‘না, সে-দ্বীপ মরুভূমির চেয়েও শুকনো!’
‘তোমাদের জাহাজ ছাড়া সেখানে আর কোনো জাহাজ বা নৌকা দেখেছিলে?’
‘না৷’
‘তাহলে মি. মর্টনের অনুমান সত্য নয়৷ অন্য কোনো দ্বীপের আদিম বাসিন্দারা সেই দ্বীপে এলে তোমরা তাদের জাহাজ বা নৌকা দেখতে পেত৷’
গোমেজ একটু ভেবে বলল, ‘হয়তো আগের রাত্রে ঝড়ে তাদের জাহাজ বা নৌকাগুলো দ্বীপ থেকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে৷’
‘হ্যাঁ, তোমার এ অনুমান অসঙ্গত নয়৷’
‘আর কেন, আমাকে মুক্তি দাও৷’
‘রোসো, গোমেজ, রোসো৷ তুমি তো এখনই পাখির মতন উড়ে পালাবে,-তারপর? আমাদের দ্বীপে যাবার পথ বাতলে দেবে কে?’
গোমেজ উৎসাহিত হয়ে বলল, ‘পথ বাতলাবার জন্যে তোমরা আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে চাও নাকি?’
‘পাগল৷ তোমার মতন মূর্তিমান ব্লাক স্নেককে আমরা সঙ্গে নিয়ে যাব? Longitude আর latitude-সুদ্ধ একখানা নকশা আমাকে এঁকে দাও৷’
গোমেজ হতাশভাবে বলল, ‘সেসব আমার পকেটবুকেই তোমরা পাবে৷’
কুমারের হাত থেকে গোমেজের পকেটবুকখানা নিয়ে বিমল আগে সেখানা পরীক্ষা করল৷ পরীক্ষার ফল হল সন্তোষজনক৷ তখন সে গোমেজের বাঁধন খুলে দিয়ে বলল, ‘পালাও শয়তান, পালাও! মনে রেখো, এক মিনিট পরেই আমি পুলিশকে তোমার কথা জানাব!’
বিমলের মুখের কথা শেষ হবার আগেই গোমেজ ঝড়ের মতন বেগে ঘরের বাহিরে চলে গেল!
বিমল ঘড়ি ধরে ঠিক এক মিনিট অপেক্ষা করল৷ তারপর ফোন ধরে বলল, ‘হ্যালো, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড? হ্যাঁ, শুনুন! আমি বিমল! মর্টন, মরিস আর ম্যাকলিয়ডকে খুন করেছে বোহিমিয়ার কোয়াটার মাস্টার বার্তোলোমিও গোমেজ! সে এক মিনিট আগে আমাদের হোটেল থেকে বেরিয়েছে! প্রমাণ? হ্যাঁ, সব প্রমাণই আমার কাছে আছে- এখানে এলেই সমস্ত পাবেন৷ গোমেজের অপরাধ সম্বন্ধে একতিল সন্দেহ নেই, শীঘ্র তাকে ধরবার ব্যবস্থা করুন৷ কী বললেন? পাঁচ মিনিটের মধ্যেই লন্ডনের পথে পথে পুলিশের জাল বিস্তৃত হবে? ডানা থাকলেও ওড়বার সময় পাবে না? আশ্চর্য আপনাদের তৎপরতা৷ আচ্ছা, বিদায়৷’
ফোন ছেড়েই বিমল ফিরে বলল, ‘ব্যস, এখানকার কাজে ইতি৷ ডাকো কুমার, ডাকো রামহরিকে৷ বাঁধো সব জিনিসপত্তর৷ আমরা আজকেই জাহাজে চড়ব৷’
বিনয়বাবু বললেন, ‘বিমল, তোমরা হচ্ছ একে বয়সে যুবা, তার উপরে বিষম ডানপিটে৷ কিন্তু দ্বীপে যাবার আগে আরও কিছু চিন্তা করা উচিত-এই হচ্ছে আমার মত৷’
বিমল বলল, ‘আয়োজন করে সর্বদাই চিন্তা করতে বসলে কাজ করবার কোনো ফাঁকই পাওয়া যায় না৷ যখন চিন্তা করবার সময়, তখন আমি যথেষ্ট চিন্তা করেছি, যার ফলে এত শীঘ্র ব্ল্যাক স্নেকের রূপকথা বাস্তব উপন্যাসে পরিণত হল৷ এখন এসেছে কাজ করবার সময়-চুলোয় যাক এখন ভাবনাচিন্তা৷’
কুমার বলল, ‘এখন আমরা হচ্ছি সেই আরব বেদুইনের মতো, রবীন্দ্রনাথ যাদের স্বপ্ন দেখেছেন! এখন আমাদের চারিদিকে ”শূন্যতলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন” আর আমাদের মানস-তুরঙ্গ তারই উপর দিয়ে পদাঘাতে বালুকার মেঘ উড়িয়ে ছুটে চলেছে সুদূর বিপদের কোলে বিপুল আনন্দে ঝাঁপিয়ে পড়বার জন্যে৷’
কমল করতালি দিয়ে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে উঠল, ‘ডাক দাও এখন ভূমিকম্পকে, ধরে আনো উন্মত্ত ঝটিকাকে, জাগিয়ে তোলো ভিসুভিয়াস-এর অগ্নি-উৎসবকে৷’
বাঘাও লাফ মেরে টেবিলে চড়ে ও ল্যাজ নেড়ে উঁচু মুখে বলল, ‘ঘেউ, ঘেউ, ঘেউ!’
বিনয়বাবু ভয়ে ভয়ে রামহরির কাছে গিয়ে বললেন, ‘সব কাকেরই এক ডাক৷ এসো রামহরি, আমরা ওঘরে গিয়ে একটু পরামর্শ করিগে৷’
সপ্তম পরিচ্ছেদ – জাহাজ দ্বীপে লাগল
আবার সেই অসীম নীলিমার জগতে! নীলিমার জগৎ-সূর্যালোকের অনন্ত ঐশ্চর্য চতুর্দিকে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছে, দিনের বেলার ছায়া এখানে কোথাও ঠাঁই পায় না! যেদিকে তাকানো যায় কেবল চোখে পড়ে দিগন্তে নিলীন নীল আকাশ আর নীল সাগর পরস্পরের সঙ্গে কোলাকুলি করছে গভীর প্রেমে৷
এত নীল জল এমন অশ্রান্ত বেগে কোথায় ছুটে যায় এবং ফিরে আসে কেউ তা জানে না৷ শূন্যে হচ্ছে স্থিরতার রাজ্য, মাটি হচ্ছে স্থিরতার রাজ্য, কিন্তু সমুদ্র কোনোদিন স্থির হতে শেখেনি, তার একমাত্র মহামন্ত্র হচ্ছে- ছুটে চলো, ছুটে চলো, ছুটে চলো!
সেদিন রাত্রে চাঁদ উঠেছে৷ পৃথিবীর প্রথম রাত্রি থেকে চাঁদ উঠে আসছে, জ্ঞানোদয়ের প্রথম দিন থেকে মানুষ চাঁদ-ওঠা দেখে আসছে, কিন্তু চাঁদের মুখ কখনো পুরোনো বা একঘেঁয়ে মনে হল না৷ যে সত্যিকার সুন্দর, সে হয় চিরসুন্দর!
সেদিন রাত্রে চাঁদ উঠেছে৷ জাহাজের ডেকে চেয়ারের উপরে বিনয়বাবুকে ঘিরে বসেছিল বিমল, কুমার ও কমল৷
সমুদ্রের অনন্ত জলে জ্যোৎস্না যেন দেওয়ালি-খেলা খেলছিল লক্ষ লক্ষ ফুলঝুরি নিয়ে এবং সাগরের ধ্বনিকে মনে হচ্ছিল সেই কৌতুকময়ী জ্যোৎস্নারই কলহাস্য৷
কুমার বলল, ‘বিনয়বাবু, পৃথিবীর জন্ম থেকেই সমুদ্র এ কী গান ধরেছে, এতদিনেও যা ফুরিয়ে গেল না!’
বিনয়বাবু মাথা নেড়ে বললেন, ‘না কুমার, পৃথিবী যখন জন্মায় তখন সে সমুদ্রের গান শোনেনি৷’
বিমল কৌতূহলী কন্ঠে বলল, ‘বিনয়বাবু, আপনি হচ্ছেন বৈজ্ঞানিক, এসব বিষয়ে আপনার জ্ঞান অসাধারণ৷ সদ্যোজাত পৃথিবীর প্রথম গল্প আপনার কাছে শুনতে চাই৷’
বিনয়বাবু বললেন, ‘তাহলে একেবারে গোড়া থেকে শুরু করি, শোনো৷ . . . কোটি কোটি বৎসর আগেকার কথা৷ মহাশূন্যে তখন আর কোনো গ্রহ উপগ্রহ বা তারকা ছিল না, আমাদের মাথার উপরকার ওই চাঁদ ছিল না, আমাদের এই জননী পৃথিবীও ছিল না৷ ছিল কেবল জ্বলন্ত, ঘূর্ণায়মান সুভীষণ সূর্য৷ তখন সে জ্বলত বিরাট এক অগ্নিকাণ্ডের মতো, তখন তার আকার ছিল আরও বৃহৎ, আর তখন সে ঘুরত আরও বেশি জোরে-তেমন দ্রুতগতির ধারণাও আমরা করতে পারব না৷
‘খুব জোরে একটা বড়ো আগুন নিয়ে ঘোরালে দেখবে, চারিদিকে টুকরো টুকরো আগুন ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে৷ সূর্যের ঘুরুনির চোটেও মাঝে মাঝে তার কতক অংশ এই ভাবে শূন্যে ঠিকরে পড়েছে, আর সেই এক-একটা খণ্ডাংশ হয়েছে এক-একটা গ্রহ৷ আমাদের পৃথিবী হচ্ছে তারই একটি৷
‘প্রত্যেক গ্রহও ঘোরে৷ পৃথিবী ঘুরতে ঘুরতে একদিন দু-ভাগ হয়ে গেল৷ তারই বড়ো অংশে অর্থাৎ পৃথিবীতে এখন আমরা বাস করি, আর ছোটো অংশটাকে আমরা আজ চাঁদ বলে ডাকি৷ এই পৃথিবী, আর ওই চাঁদও আগে এখনকার চেয়ে ঢের জোরে ঘুরতে পারত৷
‘সূর্য থেকে বিচ্ছিন্ন হবার অনেক লক্ষ বৎসর পর পর্যন্ত পৃথিবীও ছিল জ্বলন্ত৷ তখন তার মধ্যে কোনো জীব বাস করতে পারত না৷ তখনকার দিন-রাতও ছিল এখনকার চেয়ে ঢের ছোটো৷ সূর্য আর পৃথিবীর ঘূর্ণির বেগ ক্রমেই কমে আসছে-সঙ্গে সঙ্গে দিন-রাতও ক্রমেই বড়ো হয়ে উঠছে৷ সুদূর ভবিষ্যতে এমন সময়ও আসবে, যখন সূর্যও ঘুরবে না, পৃথিবীও ঘুরবে না-দিনও থাকবে না রাতও থাকবে না৷
‘অতীতের সেই পৃথিবীর কথা কল্পনা করো৷ আবহাওয়া এখনকার চেয়ে অনেক বেশি ঘন, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড মেঘ প্রায়ই সূর্যকে অস্পষ্ট করে তোলে, ঘন ঘন বিশ্বব্যাপী ঝটিকায় চতুর্দিক অন্ধকার হয়ে যায়, মাটির গা একেবারে আদুড়-সবুজের আঁচ পর্যন্ত ফোটে না, প্রায় দিবারাত্র ধরে অশ্রান্ত বৃষ্টি পড়ে৷
‘পৃথিবীর আদিম যুগে সমুদ্রের জন্মই হয়নি, সেই আগুনের মতন গরম পাথুরে পৃথিবীতে জল থাকতে পারত না৷ জলের বদলে তখন ছিল কেবল বাতাস মেশানো বাষ্প৷ খুব গরম কড়ায় খুব অল্প জল ছিটোলে দেখবে, তা তখুনি বাষ্প হয়ে উড়ে যায়৷ শূন্যে তখন যে পুরু মেঘ জমে থাকত, তা থেকে তপ্ত বৃষ্টি ঝরে পড়ত আগুনের মতো গরম পাথুরে পৃথিবীর উপরে, তারপর আবার তা বাষ্প হয়ে শূন্যে উঠে যেত৷ সেদিনকার পৃথিবীকে অনায়াসেই একটা বিরাট অগ্নিকুণ্ডরূপে কল্পনা করতে পারো৷
‘ক্রমে পৃথিবী যখন ঠান্ডা হয়ে এল, তখন গরম আবহাওয়ার বাষ্প পৃথিবীর উপরে নেমে এসে তপ্ত নদীর সৃষ্টি করল৷ যেখানে সুবৃহৎ গর্ত ছিল সেখানে জমা হয়ে জলরাশি ধরল সমুদ্রের আকার৷ তারপর জল ঠান্ডা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীতে দেখা দিলে জীবনের প্রথম আভাস৷
‘আজ এই জলের ভিতরে বেশিক্ষণ ডুবে থাকলে অধিকাংশ ডাঙার জীবরাই মারা পড়ে৷ কিন্তু আদিম কালে জীবনের প্রথম উৎপত্তি হয় এই জলের ভিতরেই বা সমুদ্র-জলসিক্ত স্থানেই৷ তারপর কত জীব জল ছেড়ে ডাঙার জীব হয়ে দাঁড়িয়েছে, কেউ কেউ ডাঙা থেকে আবার শূন্যে উড়তে শিখেছে, এমনকী কেউ কেউ মাটিকে ছেড়ে পুনর্বার সমুদ্রে ফিরে গিয়েছে, আজ আর তাদের ইতিহাস দেবার সময় হবে না৷’
কুমার বলল, ‘আশ্চর্য এই পৃথিবীর জন্মকাহিনি, উপন্যাসও এমন বিস্ময়কর নয়! আচ্ছা বিনয়বাবু, তাহলে কি ভবিষ্যতে পৃথিবী আরও ঠান্ডা হলেও সমুদ্রের জলও আরও বেড়ে উঠবে?’
বিনয়বাবু বললেন, ‘তাই হওয়াই তো স্বাভাবিক৷’
এমন ভাবে প্রতি সন্ধ্যায় গল্পগুজব করে তারা সমুদ্রযাত্রার একঘেয়েমি নিবারণ করে৷
জাহাজে গল্প বলার ভার নিয়েছিলেন বিনয়বাবু৷ বিমল প্রভৃতির আবদারে কোনোদিন তিনি বলতেন আকাশের গ্রহ-উপগ্রহের গল্প, কোনোদিন নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কথা, কোনোদিন বা সমুদ্র-তলের রহস্যময় কাহিনি৷ এই অতল জল-সমুদ্রের উপর বসে বিনয়বাবুর অগাধ জ্ঞান-সমুদ্রে ডুব দিয়ে বিমলরা নিত্য নবরত্ন আহরণ করেছে৷
একদিন বৈকালে চার্ট দেখে বিমল বলল, ‘আমাদের জাহাজ কেনারি দ্বীপপুঞ্জের কাছে এসে পড়েছে৷ গোমেজের পকেটবুকের কথা মানলে বলতে হয়, আমরা কালকেই সেই অজানা দ্বীপের কাছে গিয়ে পৌঁছোতে পারি৷’
কুমার মহা উৎসাহে বলল, ‘তাহলে আজ রাত্রে আমার ভালো করে ঘুম হবে না দেখছি৷’
সাগরে জলের অভাব নেই, তবু হঠাৎ সন্ধ্যার সময়ে আকাশ ঘন মেঘ জমিয়ে জলের উপর জল ঢালতে লাগল৷ রামহরি তাড়াতাড়ি জাহাজের পাচকের কাছে ছুটল খিচুড়ির ব্যবস্থা করতে৷ কমল বসল দ্বিতীয়বার চায়ের জল চড়াতে৷ এবং কুমার আবদার ধরল, ‘বিনয়বাবু, আজ আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের গল্প নয়, আজ একটা ভূতের গল্প বলুন৷’
বিমল বলল, ‘কিন্তু এই সামুদ্রিক বাদলায় সামুদ্রিক ভূত না হলে জমবে না৷’
বিনয়বাবু সহাস্যে বললেন, ‘বেশ, তাই সই৷ আমি একটা ভূতের বিলেতি কাহিনি পড়েছিলাম৷ সেইটেই সংক্ষেপে তোমাদের বলব-কিন্তু স্থান-কাল-পাত্রের নাম বদলে-
‘ধরে নাও, গল্পের নায়ক হচ্ছি আমি৷ এবং জাহাজে চড়ে যাচ্ছি কলকাতা থেকে রেঙ্গুনে৷ ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রী৷
‘জাহাজে উঠে বয়কে বললাম, আমার মোটঘাট সতেরো নম্বর কামরায় নিয়ে চলো৷ আমি নীচের বিছানায় থাকব৷
‘বয় চমকে উঠল৷ বাধো বাধো গলায় বলল, স-তে-রো নম্বর কামরা?
‘হ্যাঁ৷ কিন্তু তুমি চমকে উঠলে কেন?
‘না হুজুর, চমকে উঠিনি! এই দিকে আসুন৷
‘সতেরো নম্বর কামরায় গিয়ে ঢুকলাম৷ এসব জাহাজের প্রথম শ্রেণির কামরা সাধারণত যে-রকম হয়, এটিও তেমনি৷ উপরে একটি ও নীচে একটি বিছানা৷ আমি নীচের বিছানা দখল করলাম৷
‘খানিকক্ষণ পরে ঘরের ভিতরে আর-একজন লোক এসে ঢুকল৷ তার ভাবভঙ্গি দেখে বোঝা গেল, সে আমার সহযাত্রী হবে৷ অতিরিক্ত লম্বা ও অতিরিক্ত রোগা দেহ, টাক-পড়া মাথা, ঝুলে-পড়া গোঁফ৷ জাতে ফিরিঙ্গি৷
‘তাকে পছন্দ হল না৷ যে খুব রোগা আর খুব লম্বা, যার মাথায় টাক-পড়া আর গোঁফ ঝুলে-পড়া, তাকে আমার পছন্দ হয় না৷ আমি বলে একটা মনুষ্য যে এই কামরায় হাজির আছি, সেটা সে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনল না৷ টপ করে লাফ মেরে সে একেবারে উপরের বিছানায় গিয়ে উঠল৷ স্থির করলাম, এরকম লোকের সঙ্গে বাক্যালাপ না করাই ভালো৷
‘সেও বোধ হয় মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে, আমার মতন নেটিভের সঙ্গে কথাবার্তা কইবে না৷ কারণ সন্ধ্যার পরে একটিমাত্র বাক্যব্যয় না করেই সে ‘রাগ’ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল৷
‘আমিও দিলাম লেপ মুড়ি৷ এবং ঘুম আসতেও দেরি লাগল না৷
‘কতক্ষণ পরে জানি না, হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল৷ কেন ঘুম ভাঙল তাই ভাবছি, এমন সময়ে উপরের সাহেব দড়াম করে নীচে লাফিয়ে পড়ল! অন্ধকারে শব্দ শুনে বুঝলাম, সে কামরার দরজা খুলে দ্রুতপদে বাইরে ছুটে গেল! ঠিক মনে হল, যেন কেউ তাকে তাড়া করেছে৷
‘তার এই অদ্ভুত আচরণের কারণ বুঝলাম না৷ কিন্তু এটা অনুভব করলাম যে, আমার কামরার মধ্যে দুর্দান্ত শীতের হাওয়া হুহু করে প্রবেশ করছে! আর, কীরকম একটা পচা জলের দুর্গন্ধে সমস্ত কামরা পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে!
‘উঠলাম৷ ইলেকট্রিক টর্চটা বার করে জ্বেলে চারিদিকে ঘুরিয়ে দেখলাম, জাহাজের পাশের দিকে কামরায় আলো-হাওয়া আসবার জন্যে যে পোর্টহোল থাকে, সেটা খোলা রয়েছে এবং তার ভিতর দিয়েই হুহু করে জোলো হাওয়া আসছে!
‘তখনই পোর্টহোল বন্ধ করে দিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম এবং সঙ্গে সঙ্গে শুনলাম, আমার উপরকার বিছানার যাত্রীটির নাক ডেকে উঠল সশব্দে!
‘আশ্চর্য! সশব্দে লাফিয়ে পড়ে বাইরে ছুটে গিয়ে আবার কখন সে নিঃশব্দে ফিরে এসে একেবারে ঘুমিয়ে পড়েছে? লোকটা পাগল-টাগল নয় তো?
‘আর সেই বদ্ধ, পচা জলের দুর্গন্ধ৷ সে কী অসহনীয়! এ কামরাটা নিশ্চয়ই খুব বেশি স্যাঁৎসেঁতে! কালকেই কাপ্তেনের কাছে অভিযোগ করতে হবে . . . আপাদমস্তক লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম৷
‘সকালে ঘুম ভাঙবার পরেই সর্বপ্রথমে লক্ষ করলাম যে, খোলা পোর্টহোলের ভিতর দিয়ে আবার হুহু করে ঠান্ডা হাওয়া আসছে!
‘নিশ্চয়ই ওই সাহেবটার কাজ! আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেল তো৷
‘আর একটা লক্ষ করবার বিষয় এই যে, কামরার মধ্যে সেই বদ্ধ, পচা জলের দুর্গন্ধ আর পাওয়া যাচ্ছে না!
‘আস্তে আস্তে বেরিয়ে ডেকের উপরে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ প্রভাতের সূর্যালোক আর স্নিগ্ধ বাতাস ভারি মিষ্ট লাগল৷
‘ডেকের উপর পায়চারি করতে করতে জাহাজের ডাক্তারের সঙ্গে দেখা হল, তাঁকে আমি অল্পবিস্তর চিনতাম৷
‘ডাক্তার আমাকে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি সতেরো নম্বর কামরা নিয়েছেন?
‘হ্যাঁ৷
‘কালকের রাত কেমন কাটল?
‘মন্দ নয়৷ কেবল এক পাগল সায়েব কিছু জ্বালাতন করেছে৷
‘কীরকম?
‘সে মাঝরাতে লাফালাফি করে পরের ঘুম ভাঙিয়ে দেয়, দুপদুপিয়ে বাইরে ছুটে যায়, কিন্তু পরে পা টিপে টিপে এসে কখন শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে৷ আবার মাঝে মাঝে পোর্টহোল খুলে দেওয়াও তার আর এক বদ-অভ্যাস!
‘ডাক্তার গম্ভীর স্বরে বললেন, কিন্তু ও-কামরার পোর্টহোল রাত্রে কেউ বন্ধ করে রাখতে পারে না!
‘তার মানে!
‘তার মানে কী, আমি জানি না৷ তবে এইটুকু জানি, ওই কামরায় যারা যাত্রী হয়, তারা প্রায়ই সমুদ্রে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে!
‘আপনি কি আমাকে ভয় দেখাবার চেষ্টায় আছেন?
‘মোটেই নয়৷ আমার উপদেশ, ও-কামরা ছেড়ে দিয়ে আপনি আমার কামরায় আসুন৷
‘এত সহজে ভয় পাবার ছেলে আমি নই৷ আমি কামরা ছাড়বার কোনো কারণ দেখছি না৷
‘যা ভালো বোঝেন করুন-এই বলে ডাক্তার চলে গেলেন৷
‘একটু পরেই বয় এসে জানাল, কাপ্তেনসাহেব আমাকে জরুরি সেলাম দিয়েছেন৷
‘কাপ্তেনের কাছে গিয়ে দেখলাম, তিনি অত্যন্ত চিন্তিত মুখে পায়চারি করছেন৷ আমাকে দেখেই জিজ্ঞাসা করলেন, বাবু, আপনার কামরার সাহেবের কোনো খবর রাখেন?
‘কেন বলুন দেখি?
‘সারা জাহাজ খুঁজেও তাঁকে আর পাওয়া যাচ্ছে না৷
‘পাওয়া যাচ্ছে না? কাল রাত্রে তিনি একবার বাইরে বেরিয়ে ছিলেন বটে, কিন্তু তারপর আবার তাঁর নাক-ডাকা শুনেছি তো!
‘আপনি ভুল শুনেছেন! কামরার ভিতরে বা বাইরে তাঁর কোনো চিহ্নই নেই!
‘প্রথমটা স্তম্ভিত হয়ে রইলাম৷ তারপর বললাম, শুনছি সতেরো নম্বর কামরার যাত্রীরা নাকি প্রায়ই সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে?
‘কাপ্তেন থতমত খেয়ে বললেন, একথা আপনিও শুনেছেন? দোহাই আপনার, যা শুনেছেন তা আর কারোর কাছে বলবেন না, কারণ তাহলে এ-জাহাজের সর্বনাশ হবে! আপনি বরং এক কাজ করুন৷ এ-যাত্রা আমার কামরাতেই আপনার মোটঘাট নিয়ে আসুন৷ সতেরো নম্বরে আজই আমি তালা লাগিয়ে দিচ্ছি!
‘অকারণে আমার কামরা আমি ছাড়তে রাজি নই৷ আপনাদের কুসংস্কার আমি মানি না৷
‘কাপ্তেন খানিকক্ষণ চুপ করে কী ভাবলেন৷ তারপর বললেন, ”আমারও বিশ্বাস, এসব কুসংস্কার৷ আচ্ছা, আজ রাত্রে আমি নিজে আপনার কামরায় গিয়ে পাহারা দেব৷ তাতে আপনার আপত্তি আছে?
‘না৷
‘সন্ধ্যার পর কাপ্তেন আমার কামরার মধ্যে এসে ঢুকলেন৷
‘সে-রাত্রে কামরার আলো নেবানো হল না৷ দরজা বন্ধ করে কাপ্তেন আমার সুটকেসটা টেনে নিয়ে তার উপরে চেপে বসে বললেন, এই আমি জমি নিলাম! এখন আমাকে ঠেলে না সরিয়ে এখান দিয়ে কেউ যেতে আসতে পারবে না৷ চারিদিক বন্ধ৷ একটা মাছি কি মশা ঢোকবারও পথ নেই!
‘কিন্তু আমি শুনেছি, ওই পোর্টহোলটা রাত্রে কেউ নাকি বন্ধ করে রাখতে পারে না!
‘ওই তো ওটা ভিতর থেকে বন্ধ রয়েছে!-বলতে বলতেই কাপ্তেন-এর দুই চক্ষু বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে উঠল এবং তাঁর দৃষ্টির অনুসরণ করে আমিও তাকিয়ে দেখলাম, কামরার পোর্টহোলটা ধীরে ধীরে আপনিই খুলে যাচ্ছে!
‘আমরা দুজনেই লাফ মেরে সেখানে গিয়ে পোর্টহোলের আবরণ চেপে ধরলাম-কিন্তু তবু সেটা সজোরে খুলে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে কামরার আলো নিবে গেল দপ করে!
‘হুহু করে একটা তীক্ষ্ণ বরফ-মাখা বাতাসের ঝাপটা ভিতরে ছুটে এল এবং তারপরেই নাকে ঢুকল তীব্র, বদ্ধ, পচা জলের বিষম দুর্গন্ধ!
‘আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, আলো, আলো!
‘কাপ্তেন টপ করে দেশলাই বার করে একটা কাঠি জ্বেলে ফেললেন৷
‘বিদ্যুৎবেগে ফিরে উপরের বিছানার দিকে তাকিয়ে সভয়ে দেখলাম, সেখানে একটা মূর্তি সটান শুয়ে রয়েছে!
‘পাগলের মতন একলাফে ঝাঁপিয়ে পড়লাম,-কিন্তু কীসের উপরে? বহুকাল আগে জলে-ডোবা একটা ভিজে ঠান্ডা মৃতদেহ, তার সর্বাঙ্গ মাছের মতন পিচ্ছল, তার মাথায় লম্বা লম্বা জল-মাখা রুক্ষ চুল এবং তার মৃত চোখদুটোর আড়ষ্ট দৃষ্টি আমার দিকে স্থির! আমি তাকে স্পর্শ করামাত্র সে উঠে বসল এবং পরমুহূর্তেই একটা মত্তহস্তী যেন ভীষণ এক ধাক্কা মেরে আমাকে মেঝের উপর ফেলে দিল,-তারপরই কাপ্তেনও আর্তনাদ করে আমার উপর আছাড় খেয়ে পড়লেন৷
‘মিনিট-দুয়েক পরে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে আবার দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে দেখা গেল, উপরের বিছানা খালি, ঘরের ভিতরেও কেউ নেই এবং কামরার দরজা খোলা!
‘পরদিনই সতেরো নম্বর কামরার দরজা পেরেক মেরে একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হল৷ আমার কথাও ফুরল৷’
রামহরি কখন ফিরে এসে কোণে বসে একমনে গল্প শুনছিল৷ সে সভয়ে বলে উঠল, ‘ওরে বাবা! সুমুদ্দরে কত লোক ডুবে মরে, সবাই যদি ভূত হয়ে মানুষের বিছানায় শুতে চায়, তাহলে তো আর রক্ষে নেই! আমি বাপু আজ রাত্রে একলা শুতে পারব না!’
কুমার উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘চলো, এইবারে খিচুড়ির সন্ধানে যাত্রা করা যাক!’
বিমলের আন্দাজই সত্য হল৷ পরদিন খুব ভোরেই দেখা গেল, দূরে সমুদ্রের নীলজলের মাঝখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে যে দ্বীপটি তাকে দ্বীপ না বলে পাহাড় বলাই ঠিক৷
দূরবিনে নজরে পড়ল, নৈবেদ্যের চূড়া-সন্দেশের মতো একটি পর্বত যেন সামুদ্রিক নীলিমাকে ফুটো করে মাথা তুলে আকাশের নীলিমাকে ধরবার জন্যে উপরদিকে উঠে গিয়েছে৷ দেখলেই বোঝা যায়, সেই পর্বতের অধিকাংশ লুকিয়ে আছে মহাসাগরের সজল বুকের ভিতরে৷
তার শিখরদেশটা একেবারে খাড়া, কিন্তু নীচের দিকটা ঢালু৷ এবং সেই ঢালু পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি বিরাট প্রস্তরমূর্তি৷ অনেক মূর্তির পদতলের উপরে বিপুল জলধির প্রকাণ্ড তরঙ্গদল রুদ্ধ আক্রোশে যেন ফেনদন্তমালা বিকাশ করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বারংবার!
সমস্ত পাহাড়টা একেবারে ন্যাড়া-বড়ো বড়ো গাছপালা তো দূরের কথা, ছোটোখাটো ঝোপঝাড়েরও চিহ্ন পর্যন্ত নেই৷ যেমন সবুজ রঙের অভাব-তেমনি অভাব জীবন্ত গতির৷ কোথাও একটিমাত্র পাখিও উড়ছে না৷
বিনয়বাবু ভীত কন্ঠে বললেন, ‘এ হচ্ছে মৃত্যুর দেশ!’
রামহরি বলল, ‘যারা জলে ডুবে মরে, তারা রোজ রাতে ঘুমোবার জন্যে ওইখানে গিয়ে ওঠে৷’
কুমার বলল, ‘এই মৃত্যুর দেশেই এইবারে আমরা জীবন সঞ্চার করব৷ যদি এখানে মৃত্যুদূত থাকে, আমাদের বন্দুকের গর্জনে এখনই তার নিদ্রাভঙ্গ হবে৷’
বিমল বলল, ‘যাও কমল, সেপাইদের প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে আসতে বলো৷ এইবারে হয়তো তাদের দরকার হবে৷’
কমল খবর দিতে ছুটল৷ খানিক পরেই ডেকের উপরে চারজন করে সার বেঁধে দাঁড়াল শিখ, গুর্খা ও পাঠান সেপাইরা৷ তাদের চব্বিশটা বন্দুকের বেওনেটের উপরে সূর্যকিরণ চমকে চমকে উঠতে লাগল৷
বিমল হেসে বলল, ‘বিনয়বাবু, ওদের আছে চব্বিশটা বন্দুক আর আমাদের কাছে আছে পাঁচটা বন্দুক, চারটে রিভলভার৷ তবু কি আমরা দ্বীপ জয় করতে পারব না?’
অষ্টম পরিচ্ছেদ – অষ্ট নরমুণ্ড
বোটে চড়ে বিমল সঙ্গীদের ও সেপাইদের নিয়ে দ্বীপে গিয়ে উঠল৷ জাহাজে রইল কেবল নাবিকরা৷
কী ভয়াবহ নির্জন দ্বীপ! সূর্যের সোনালি হাসি যেন তার কালো কর্কশ পাথুরে গায়ে ধাক্কা খেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে সমুদ্রের গর্ভের মধ্যে! নানা আকারের বড়ো বড়ো পাথরগুলো চারিদিক থেকে যেন কঠিন ভ্রূকুটি করে ভয় দেখাচ্ছে! যেদিক তাকানো যায়, ভৌতিক ছমছমে ভাব ও তৃষ্ণাভরা নির্জীব শুষ্কতা!
এরই মধ্যে দিকে দিকে দাঁড়িয়ে আছে প্রেতপুরের দানব-রক্ষীর মতন প্রস্তরমূর্তির পর প্রস্তরমূর্তি! একসঙ্গে এতগুলো এত উঁচু পাথরের মূর্তি বোধ হয় আধুনিক পৃথিবীর কোনো মানুষ কখনো চোখে দেখেনি, কারণ তাদের অধিকাংশই কলকাতার অক্টারলোনি মনুমেন্টের মতন উঁচু এবং কোনো কোনোটা তাদেরও ছড়িয়ে আরও উঁচুতে উঠেছে৷ মূর্তিগুলোর পায়ের কাছে দাঁড়ালে তাদের মুখ আর দেখা যায় না৷ পাহাড় কেটে প্রত্যেক মূর্তিকে খুদে বার করা হয়েছে!
খানিকটা তফাতে দাঁড়িয়ে কয়েকটা মূর্তির আপাদমস্তক দেখতে দেখতে বিমল বলল, ‘এই এক-একটা মূর্তি গড়তে শিল্পীদের নিশ্চয়ই পনেরো-বিশ বছরের কম লাগেনি৷ সব মূর্তি গড়তে হয়তো এক শতাব্দীরও বেশি সময় লেগেছিল! এইটুকু একটা জলশূন্য দ্বীপে এতকাল ধরে এত যত্ন আর কষ্ট করে এই মূর্তিগুলো গড়বার কোনো সংগত কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না!’
কুমার বলল, ‘হয়তো মর্টন সাহেবেরই অনুমান সত্য! হয়তো এটা কোনো জাতির দেবতার দ্বীপ! হয়তো যাদের দেবতা তারা এখানে মাঝে মাঝে কেবল ঠাকুর পূজা করতে আসে!’
বিনয়বাবু মাথা নেড়ে বললেন, ‘এ মূর্তিগুলো কোনো জাতির দেবতার মূর্তি হতে পারে, কিন্তু একটা সবচেয়ে বড়ো কথা তোমরা ভুলে যেয়ো না৷ পৃথিবীর সমস্ত সমুদ্রের চার্ট সাহেবরা তৈরি করে ফেলেছে৷ কিন্তু কোনো চার্টেই এই দ্বীপের উল্লেখ নেই৷ তার অর্থ হচ্ছে, এই দ্বীপটাকে এতদিন কেউ সমুদ্রের উপরে দেখেনি৷ মূর্তিগুলোর গায়ে তাজা শেওলার চিহ্ন দেখছ? ওই শেওলা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কিছুদিন আগেও ওরা জলের তলায় অদৃশ্য হয়ে ছিল৷ এখন ভেবে দেখো, জলের তলায় ডুব মেরে কোনো মানুষ-শিল্পীই কি এমন বড়ো মূর্তি গড়তে পারে?’
রামহরি বলল, ‘সমুদ্রের জলে যেসব কারিগর ডুবে মরেছে, এ মূর্তিগুলো গড়েছে তাদেরই প্রেতাত্মা?’
কমল বলল, ‘ব্যাপারটা অনেকটা সেইরকমই দাঁড়াচ্ছে বটে!’
বিমল বলল, ‘যে দ্বীপ জলের তলায় অদৃশ্য, সেখানে কেউ পূজা করতে আসবেই বা কেন?’
কুমার বলল, ‘কিন্তু মর্টন সাহেব এখানে কাদের হাতের আলো দেখেছিলেন? কাদের সোনার বর্শা তিনি কুড়িয়ে পেয়েছিলেন? দ্বীপের শিখরের কাছে সেই ব্রোঞ্জের দরজাই বা কে তৈরি করেছে?’
বিনয়বাবু বললেন, ‘দ্বীপটা ভালো করে দেখবার পর হয়তো আমরা ওসব প্রশ্নের সদুত্তর পাব৷ কিন্তু আপাতত দেখছি, কোনো মূর্তির কোথাও কোনো শিলালিপি বা সাংকেতিক ভাষা খোদাই করাও নেই৷ ওসব থাকলেও একটা হদিস পাওয়া যেত৷ কিন্তু মূর্তিগুলোর মুখের ভাব দেখেছ? প্রাচীন মিশর, ভারতবর্ষ, চীন, আসিরিয়া, ব্যাবিলন আর গ্রিস দেশের ইতিহাস-পূর্ব যুগের শিল্পীরা আপন আপন জাতির মুখের আদর্শই মূর্তিতে ফুটিয়েছে৷ সুতরাং ধরতে হবে এখানকার শিল্পীরাও স্বজাতির মুখের আদর্শ রেখেই এসব মূর্তি গড়েছে৷ কিন্তু সে কোন জাতি? আধুনিক কোনো দেশেই মানুষের মুখের ভাব এমন ভয়ানক হয় না৷ এদের মুখের ভাব কীরকম হিংস্র পশুর মতো, যেন এরা দয়া-মায়া কাকে বলে জানে না৷ বিমল, কুমার! তোমরা প্রাচীন যুগের কিছু কিছু ইতিহাস নিশ্চয়ই পড়েছ? প্রাচীন যুগটাই ছিল নির্দয়তার যুগ৷ বাবিলন, আসিরিয়া আর মিশর প্রভৃতি দেশের ইতিহাসই হচ্ছে নিষ্ঠুরতার ইতিহাস৷ তাদের ঢের পরে জন্মেও রোম দয়ালু হতে পারেনি৷ খ্রিস্টকে সে ক্রুশে বিঁধে হত্যা করেছিল, বিরাট একটা সভ্যতার জন্মভূমি কার্থেজের সমস্ত মানুষকে দেশসুদ্ধ পৃথিবী থেকে লুপ্ত করে দিয়েছিল৷ সে-যুগের নির্দয়তার লক্ষ লক্ষ কাহিনি শুনলে আধুনিক সভ্যতার হৃৎপিণ্ড মূর্ছিত হয়ে পড়ে৷ কিন্তু এই দ্বীপবাসী মূর্তিগুলোর মুখ অধিকতর নৃশংস৷ তার একমাত্র কারণ এই হতে পারে, যে-পাশবিক সভ্যতা এখানকার মূর্তিগুলো সৃষ্টি করেছে তার জন্ম হয়তো মিশরেরও অনেক হাজার বছর আগে-সামাজিক বন্ধন, নীতির শাসন ছিল যখন শিথিল, মানুষ ছিল যখন প্রায় হিংস্র জন্তুরই নামান্তর৷ ভগবান জানেন, আমরা কাদের প্রতিমূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে আছি!’
বিমল বলল, ‘বিনয়বাবু, আপনার কথাই সত্য বলে মনে হচ্ছে৷ মূর্তিগুলোর পোশাক দেখুন৷ এমন সামান্য পোশাক মানুষ সেই যুগেই পরত, যে-যুগে সবে সে কাপড়চোপড় পরতে শিখেছে৷’
এ-সব আলোচনা রামহরির মাথায় ঢুকছিল না, সে বাঘাকে নিয়ে কিছুদূরে এগিয়ে গেল৷ একজায়গায় প্রায় দুশো ফুট উঁচু একটা মূর্তি ছিল,-তার পদতলে একটা পাথরের বেদি, সেটাও উচ্চতায় দশ-বারো ফুটের কম হবে না৷ বেদির গা বেয়ে উঠেছে সিঁড়ির মতন কয়েকটা ধাপ!
এ-মূর্তিটা আবার একেবারে বীভৎস৷ চোখদুটো চাকার মতন গোল, নাসারন্ধ্র স্ফীত, জন্তুর মতন দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়েছে এবং দুই ঠোঁটের দুই কোণে ঝুলছে আধাআধি গিলে-ফেলা দুটো মানুষের মূর্তি!
এই মানুষখেকো দেবতা ও দানবের মূর্তি দেখে রামহরির পিলে চমকে গেল৷
এমন সময় বাঘার চিৎকার শুনে রামহরি চোখ নামিয়ে দেখল, ইতিমধ্যে সে ধাপ দিয়ে বেদির উপরে উঠে পড়েছে এবং সেখানে কী দেখে মহা ঘেউঘেউ রব তুলেছে৷
ব্যাপার কী দেখবার জন্যে রামহরিও কৌতূহলী হয়ে সেই বেদির উপরে গিয়ে উঠল এবং তারপরেই ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সেইখানে বসে পড়ে পরিত্রাহি চিৎকার করতে লাগল-‘ওরে বাবা রে, গেছি রে৷ এ কী কাণ্ড রে৷’
চিৎকার শুনে সবাই সেখানে ছুটে এল৷ বেদির উপরে উঠে প্রত্যেকেই স্তম্ভিত!
বেদির উপরে পাশাপাশি সাজানো রয়েছে কতকগুলো মানুষের মুণ্ডু! মানুষের মাথা কেটে কারা সেখানে বসিয়ে রেখে গিয়েছে, কিন্তু তাদের মাংস ও চামড়া পচে হাড় থেকে খসে পড়েনি৷ সেই পাথুরে দেশে প্রখর সূর্যের উত্তাপে শুকিয়ে সেগুলো মিশরের মমির মতন দেখতে হয়েছে৷
বিমল গুনল, ‘এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট৷’
কুমার রুদ্ধশ্বাসে বলল, ‘এখানে আটজন নাবিকই হারিয়ে গিয়েছিল!’
বিমল দুঃখিত স্বরে বলল, ‘এগুলো সেই বেচারাদেরই শেষ চিহ্ন৷ কুমার, এই রাক্ষুসে দেবতাদের পায়ের তলায় কারা নরবলি দিয়েছে! তাহলে বোঝা যাচ্ছে, এই দ্বীপে এমন সব শত্রু আছে যাদের হাতে পড়লে আমাদেরও এমনই দশা হবে৷’
বিনয়বাবু বললেন, ‘নরবলি দেয়, এমন সভ্য জাতি আর পৃথিবীতে নেই৷ বিমল, আমরা কোনো অসভ্য জাতিরই কীর্তি দেখছি৷’
বিমল নীচে নেমে এল৷ তারপর সেপাইদের সম্বোধন করে বলল, ‘ভাই সব! আমরা সব নিষ্ঠুর শত্রুর দেশে এসে পড়েছি! সকলে খুব হুঁশিয়ার থাকো, কেউ দলছাড়া হয়ো না! এ- শত্রু কারোকেই ক্ষমা করবে না, যাকে ধরতে পারবে তাকেই দানব-দেবতার সামনে বলি দেবে, সর্বদাই এই কথা মনে রেখো! এসো আমার সঙ্গে!’-বলে সে আর-একবার সেই ভয়ংকর মুণ্ডগুলোর দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখল,-একদিন যারা জীবন্ত মানুষের কাঁধের উপরে আদরে থেকে এই সুন্দরী ধরণীর সৌন্দর্য দেখত, আতর-ভরা বাতাসের গান শুনত, কত হাসিখুশির গল্প বলত৷
রামহরি তাড়াতাড়ি সেপাইদের মাঝখানে গিয়ে বলল, ‘বাছারা, তোমরা আমার চারপাশে থাকো, এই বুড়ো বয়সে আমি আর ভূতুড়ে দেবতার ফলার হতে রাজি নই!’
কমল বলল, ‘কিন্তু ওদের ধড়গুলো কোথায় গেল?’
বিনয়বাবু বললেন, ‘কোথায় আর, ভক্তদের পেটের ভিতরে৷’
সকলে শিউরে উঠল৷
বিমল গোমেজের পকেটবুকখানা বার করে দেখে বলল, ‘মর্টন সাহেবরা পশ্চিম দিক দিয়ে শিখরের দিকে উঠেছিলেন৷ আমরাও এই দিক দিয়েই উঠব৷ দেখে মনে হচ্ছে, এই দিক দিয়েই উপরে ওঠা সহজ হবে, কারণ এদিকটা অনেকটা সমতল৷’
আগে বিমল ও কুমার, তারপর বিনয়বাবু ও কমল এবং তারপর প্রত্যেক সারে দুইজন করে সেপাই পাহাড়ের উপরে উঠতে লাগল৷ সকলেরই বন্দুকে টোটা ভরা এবং দৃষ্টি কাকের মতন সতর্ক৷
কিন্তু প্রায় বিশ মিনিট ধরে উপরে উঠেও তারা সতর্ক থাকবার কোনো কারণ খুঁজে পেল না৷ গোরস্থানেও গাছের ছায়া নাচে, পাখির তান শোনা যায়, ঘাসের মখমল-বিছানা পাতা থাকে, কিন্তু এই ছায়াশূন্যতা, বর্ণহীনতা ও অসাড়তার দেশে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীটপতঙ্গের দেখা নেই-একটা ঝিঁঝিঁপোকাও বোধ হয় এখানে ডাকতে সাহস করে না৷ এ যেন ঈশ্বরের বিশ্বের বাইরেকার রাজ্য, সর্বত্রই যেন একটা অভিশপ্ত হাহাকার স্তম্ভিত হয়ে অনন্তকাল ধরে নীরবে বিলাপ করছে৷ কেবল অনেক নীচে সমুদ্রের গম্ভীর ধ্বনি শোনা যাচ্ছে, সে যেন অন্য কোনো জগতের আর্তনাদ!
কুমার বলল, ‘পাহাড়ের শিখর তো আর বেশিদূরে নেই, কোথায় সেই সোনার বর্শা আর কোথায় সেই ব্রোঞ্জের দরজা?’
বিমল বলল, ‘সোনার বর্শাটা আর দেখবার আশা কোরো না, কারণ খুব সম্ভব সেটা যাদের জিনিস তাদের হাতেই ফিরে গেছে! আমাদের খুঁজতে হবে কেবল সেই দরজাটা!’
কুমার বলল, ‘আর শ-খানেক ফুট উঠলে আমরা শিখরের গোড়ায় গিয়ে পৌঁছোব৷ তার পর দেখছ তো? শিখরের গা একেবারে দেয়ালের মতো খাড়া, টিকটিকি না হলে আমরা আর ওখান দিয়ে ওপরে উঠতে পারব না!’
বিমল বলল, ‘তাহলে দরজা পাব আর নীচেই৷ কারণ মর্টন সাহেবরা যে এই পথ দিয়েই এসেছিলেন, সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷ এই দেখো তার প্রমাণ৷’-বলেই সে হেঁট হয়ে পাহাড়ের উপর থেকে একটা খালি টোটা কুড়িয়ে নিয়ে তুলে ধরল!
কুমার বলল, ‘বুঝেছি৷ সাহেবরা হারানো নাবিকদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্যে বন্দুক ছুড়েছিল, এটা তারই নিদর্শন!’
বিমল উৎসাহ ভরে বলল, ‘সুতরাং-আগে চলো, আগে চলো ভাই!’
বিনয়বাবু তখন চোখে দূরবিন লাগিয়ে সমুদ্রের দৃশ্য দেখছিলেন৷ হঠাৎ তিনি বিস্মিতকন্ঠে বলে উঠলেন, ‘অনেক দূরে একখানা জাহাজ!’
বিমল দূরবিনটা নিয়ে দেখল, বহু দূরে-সমুদ্র ও আকাশের সীমারেখায় একটা কালো ফোঁটার মতো একখানা জাহাজ দেখা যাচ্ছে৷
বিনয়বাবু বললেন, ‘লন্ডনে থাকতে শুনেছিলাম, এ-পথ দিয়ে জাহাজ আনাগোনা করে না, তবে ও-জাহাজখানা এখানে কেন?’
বিমল বলল, ‘জাহাজখানা এখনও অনেক তফাতে আছে, দেখছেন না এত ভালো দূরবিনেও কতটুকু দেখাচ্ছে? সম্ভবত ওখানা অন্য পথেই চলে৷ . . . কিন্তু ও-সব কথা নিয়ে এখন আমাদের মাথা ঘামাবার সময় নেই-আগে চলো, আগে চলো ভাই৷’
সব আগে চলেছিল বাঘা৷ তাকে এখন দেখা যাচ্ছিল না৷ কিন্তু হঠাৎ তার সচকিত কন্ঠের ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা গেল৷
বিমল চিৎকার করে বলল, ‘হুঁশিয়ার, সবাই হুঁশিয়ার! বাঘা অকারণে গর্জন করে না৷’
তারপরেই দেখা গেল, বাঘা ঝড়ের বেগে নীচের দিকে নেমে আসছে৷ সে বিমলদের কাছে এসেই আবার ফিরে দাঁড়াল এবং ঘন ঘন ঘেউঘেউ করতে লাগল৷
বিমল ও কুমার বন্দুকের মুখ সামনের দিকে নামিয়ে অগ্রসর হল৷ আচম্বিতে খুব কাছেই উপর থেকে একটা শব্দ এল-যেন প্রকাণ্ড কোনো দরজার কপাট দুড়ুম করে বন্ধ হয়ে গেল৷
বিমল ও কুমার এবার ফিরে পিছনদিকে তাকাল৷ দেখল, সেপাইরা প্রত্যেকেই বন্দুক প্রস্তুত রেখে সারে সারে উপরে উঠে আসছে-তাদের প্রত্যেকেরই মুখে-চোখে উদ্দীপনার আভাস৷
বিমল ও কুমার তখন বেগে শিখরের দিকে উঠতে লাগল৷
কিন্তু আর বেশিদূর উঠতে হল না৷ হঠাৎ তারা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ তাদের সুমুখেই মস্তবড়ো একটা বন্ধ দরজা এবং আশে-পাশে জনপ্রাণীর সাড়া বা দেখা নেই৷
তারা অল্পক্ষণ দাঁড়িয়ে দরজাটা দেখতে লাগল৷ এরকম গড়নের দরজা তারা আর কখনো দেখেনি-উচ্চতা বেশি না হলেও চওড়ায় তা অসামান্য৷ খোলা থাকলে তার ভিতর দিয়ে পাশাপাশি ছয়জন লোক একসঙ্গে বাইরে বেরোতে বা ভিতরে ঢুকতে পারে৷ এবং তার আগাগোড়াই ব্রোঞ্জ ধাতুতে তৈরি৷
বিমল এগিয়ে গিয়ে দরজায় সজোরে বারকয়েক ধাক্কা মেরে বলল, ‘কী ভীষণ কঠিন দরজা! আমার এমন ধাক্কায় একটুও কাঁপল না!’
কুমার বলল, ‘কারিকরিও অদ্ভুত৷ দেখছ,
দুই পাল্লার মাঝখানে একটা সুচ গলাবারও ফাঁক নেই৷’
বিনয়বাবু বললেন, ‘দরজার গায়ে আর তার চারপাশে শ্যাওলার দাগ দেখো! এর মানে হচ্ছে, এই দরজাটাও এতদিন ছিল সমুদ্রের তলায় অদৃশ্য৷ এটা এমন মজবুত আর ছিদ্রহীন করে গড়া হয়েছে যে, সমুদ্রের শক্তিও এর কাছে হার মানে!’
কমল হতাশ ভাবে বলল, ‘এখন উপায়? হাতিও তো এ-দরজা ভাঙতে পারবে না!’
বিমল বলল, ‘কুমার, নিয়ে এসো তো সেপাইদের কাছ থেকে আমাদের ডাইনামাইটের বাক্স৷ দেখি এ-দরজার শক্তি কত!’
কুমার সিপাইদের দিকে ফিরে চেঁচিয়ে বলল, ‘ডাইনামাইট! ডাইনামাইট!’
তখুনি ডাইনামাইটের বাক্স এল৷ দরজার তলায় সেই ভীষণ বিস্ফোরক পদার্থ সাজিয়ে একটা পলিতায় আগুন দিয়ে বিমল সবাইকে নিয়ে তাড়াতাড়ি আবার নীচের দিকে নেমে গেল৷
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না৷ খানিক পরেই একসঙ্গে যেন অনেকগুলো বজ্র গর্জন করে উঠে সমস্ত পাহাড়টা থরথরিয়ে কাঁপিয়ে দিল!
বিমল হাত তুলে চিৎকার করে বলল, ‘পথ সাফ! সবাই অগ্রসর হও৷’
নবম পরিচ্ছেদ – সত্যিকার প্রথম মানুষ
সবাই বেগে ঘটনাস্থলে গিয়ে উপস্থিত হয়ে দেখল, কুণ্ডলীকৃত ধূম্রপুঞ্জের মধ্যে পাহাড়ের শিখরটা প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেছে এবং সেই পুরু ব্রোঞ্জের দরজার একখানা পাল্লা ভেঙে একপাশে ঝুলছে ও একখানা পাল্লা একেবারে ভূমিসাৎ হয়েছে৷
দরজার হাত দশেক পরেই দেখা যাচ্ছে একটা দেওয়াল বা পাহাড়ের গা৷ ধোঁয়া মিলিয়ে যাবার জন্যে বিমল ও কুমার আরও কিছুক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করল৷ তারপর বন্দুক বাগিয়ে ধরে এগিয়ে গেল৷
দরজার পরেই মস্তবড়ো ইঁদারার মতো একটা গহ্বর নীচের দিকে নেমে গিয়েছে এবং তারই গা বেয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে সংকীর্ণ পাথরের সিঁড়ির ধাপ!
বিমল হুকুম দিল, ‘গোটাকয়েক পেট্রোলের লন্ঠন জ্বালো! নইলে এত অন্ধকারে নীচে নামা যাবে না!’
কুমার কান পেতে শুনে বলল, ‘নীচে থেকে কীরকম একটা আওয়াজ আসছে, শুনছ? যেন অনেক দূরে কোথায় মস্ত একটা মেলা বসেছে, হাজার হাজার অস্পষ্ট কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে!’
সত্যই তাই৷ নীচে-অনেক দূর থেকে আসছে এমন বিচিত্র ও গম্ভীর সমুদ্রগর্জনের মতন ধ্বনি, যে শুনলে সর্বশরীর রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে৷
বিমল সবিস্ময়ে বলল, ‘নির্জন, নির্জন এই পাহাড়-দ্বীপ, কিন্তু এর লুকানো গর্ভে, চন্দ্র-সূর্যের চোখের আড়ালে কি নতুন একটা মানুষজাতি বাস করে? পৃথিবীতে কি কোনো পাতাল রাজ্য আছে? তাও কি সম্ভব?’
কুমার বলল, ‘পাতাল-রাজ্য থাক আর না থাক, কিন্তু আমরা যে হাজার হাজার লোকের গলায় অস্পষ্ট কোলাহল শুনছি, সে-বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই!’
বিনয়বাবু বললেন, ‘হাজার হাজার কন্ঠ মানে হাজার হাজার শত্রু৷ তারা নিশ্চয়ই ডাইনামাইটে দরজা ভাঙার শব্দ শুনতে পেয়েছে- তাই চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে ছুটে আসছে আমাদের টিপে মেরে ফেলবার জন্যে৷’
রামহরি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘ও খোকাবাবু! ওরা আমাদের টিপে মেরে ফেলবে না গো, টিপে মেরে ফেলবে না৷ ওরা খাঁড়া তুলে নরবলি দেবে৷ আমাদের মুণ্ডুগুলো রেঁধে গপগপ করে খেয়ে ফেলবে৷ জাহাজে চলো খোকাবাবু, জাহাজে চলো৷’
বিমল কোনোদিকে কর্ণপাত না করে বলল, ‘চলো কুমার৷ আগে তো সিঁড়ি দিয়ে দুর্গা বলে নেমে পড়ি, তারপর যা থাকে কপালে৷’
কুমার সর্বাগ্রে অগ্রসর হয়ে বলল, ‘জলে-স্থলে-শূন্যে বহুবার উড়েছে আমাদের বিজয়-পতাকা৷ বাকি ছিল পাতাল, এইবার হয়তো তার সঙ্গেও পরিচয় হবে! আজ আমাদের-মাতাল হয়ে পাতাল পানে ধাওয়া৷ ওহো, কী আনন্দ!’
কমল হাততালি দিয়ে বলে উঠল,
‘স্বর্গকথা ঢের শুনেছি,
ঘর তো মোদের মর্তে,
কী আছে ভাই দেখতে হবে
আজ পাতালের গর্তে৷’
বিনয়বাবু ধমক দিয়ে বললেন, ‘থামো কমল, থামো৷ এদের সঙ্গে থেকে তুমিও একটা ক্ষুদ্র দস্যু হয়ে উঠেছ৷’
ততক্ষণে কুমার ও বিমলের মূর্তি সিঁড়ির ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেছে৷
দেখেই রামহরি সব ভয় ভাবনা ভুলে গেল! উদ্বিগ্ন স্বরে বলে উঠল, ‘অ্যাঁ, খোকাবাবু নেমে গেছে? আর কি আমরা জাহাজে যেতে পারি-তাহলে খোকাবাবুকে দেখবে কে?’-বলেই সেও সিঁড়ির দিকে ছুটল তির বেগে৷
বিনয়বাবু ফিরে সেপাইদের আসবার জন্যে ইঙ্গিত করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলেন৷
পাহাড়ের গা কেটে এই সিঁড়িগুলো তৈরি করা হয়েছে৷ প্রত্যেক ধাপের মাপ উচ্চতায় এক হাত, চওড়ায় আধ হাত ও লম্বায় কিছু কম, দেড় হাত৷ এ সিঁড়ি দিয়ে পাশাপাশি দু-জন লোক নামতে গেলে কষ্ট হয়৷ বিশেষ সিঁড়ির রেলিং নেই-একদিকে একটা ঘুটঘুটে কালো গর্ত জীবন্ত শিকার ধরবার জন্যে যেন হাঁ করে আছে- একটিবার পা ফসকালেই কোথায় কত নীচে গিয়ে পড়তে হবে তা কেউ জানে না৷
বিনয়বাবু বললেন, ‘সকলে একে একে দেওয়াল ঘেঁষে নামো৷ এ হচ্ছে একেবারে সেকেলে সিঁড়ি৷ একে সিঁড়ি না বলে পাথরের মই বলাই উচিত৷’
ততক্ষণে কুমার ও বিমল গুনে গুনে পঞ্চাশটা ধাপ পার হয়ে এমন এক জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল যে, অসম্ভব বিস্ময়ে তাদের মুখ-চোখের ভাব হয়ে গেল কেমনধারা৷ এরকম কোনো দৃশ্য দেখবার জন্যে তারা মোটেই প্রস্তুত ছিল না-পৃথিবীর আর কোথাও এমন দৃশ্য এ-যুগে আর কেউ কখনো দেখেনি৷
চতুর্দিকে মাইলকয়েকব্যাপী একটা উনুনের মতন জায়গা কেউ কল্পনা করতে পারেন? এমনি একটা উনুনেরই মতন জায়গার সুমুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে বিমল ও কুমার হতভম্বের মতন চারিদিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাতে লাগল৷
উপরদিকটা ডোমের খিলানের মতন ক্রমেই সরু হয়ে উঠে গেছে-কিন্তু পুরো ডোম নয়, কারণ তার মাঝখানে প্রকাণ্ড একটা ফাঁক৷ সেই গোলাকার ফাঁকটার বেড় অন্তত কয়েক হাজার ফুটের কম নয়৷ তার ভিতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে আকাশের নীলিমার অনেকখানি এবং তার ভিতর দিয়ে ঝরে পড়ছে এই অত্যাশ্চর্য উনুনের বিপুল জঠরে সমুজ্জ্বল সূর্য-কিরণ-প্রপাত!
পাহাড়ের গা থেকে একটা পনেরো-বিশ ফুট চওড়া জায়গা ব্র্যাকেটের মতন বেরিয়ে পড়েছে, বিমল ও কুমার তারই উপরে দাঁড়িয়ে আছে৷ পাহাড়ের গা ঘেঁষে সেই স্বাভাবিক ব্র্যাকেটটা অনেক দূরে চলে গিয়েছে এবং যে-সিঁড়ি দিয়ে তারা নেমেছে সোপানের সার এইখানেই শেষ হয়ে যায়নি, ব্র্যাকেটটা ভেদ করে নেমে গিয়েছে সামনে আরও নীচের দিকে৷
বিমল বলল, ‘কুমার! অদ্ভুত কাণ্ড! এই দ্বীপের মতন পাহাড়টা ফাঁপা-শিখরটাও কেবল ফাঁপা নয়, ছ্যাঁদা৷ তাই স্কাইলাইটের কাজ করছে! এমন ব্যাপার কেউ কখনো দেখেছ-পাহাড়ের পেটের ভিতরে মাইলের পর মাইল ধরে গুহা-দেশ৷’
কুমার বলল, ‘নীচে জনতার গোলমাল আর চারিদিকে তার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি ক্রমেই বেড়ে উঠছে! উপরের মস্ত ছ্যাঁদা দিয়ে প্রখর আলো আসছে-কিন্তু আলো-ধারার বাইরে দূরে ছায়ার ভিতরে নীচে ঝাপসা ঝাপসা নানা আকারের কী ওগুলো দেখা যাচ্ছে বলো দেখি?’-বলতে বলতে সে দুই-এক পা এগোবার পরেই হঠাৎ বিনামেঘে বজ্রাঘাতের মতন প্রকাণ্ড একটা মূর্তি যেন শূন্য থেকেই আবির্ভুত হয়ে একেবারে তার ঘাড়ের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং কুমার কিছু বোঝবার আগেই তাকে ঠিক একটি ছোট্ট খোকার মতো দু-হাতে অতি সহজে তুলে নিয়ে মাটির উপরে আছাড় মারবার উপক্রম করল৷
কিন্তু বিমলের সতর্ক দুই বাহু চোখের পলক পড়বার আগেই প্রস্তুত হয়ে শূন্যে উঠল, সে একলাফে তার কাছে গিয়ে পড়ে বন্দুকের কুঁদো দিয়ে মূর্তিটার মাথায় করল প্রচণ্ড এক আঘাত৷
সে-আঘাতে সাধারণ কোনো মানুষের মাথার খুলি ফেটে নিশ্চয়ই চৌচির হয়ে যেত, কিন্তু মূর্তিটা চিৎকার করে কুমারকে ছেড়ে দিয়ে একবার কেবল টলে পড়ল, তারপরেই টাল সামলে নিয়ে বেগে বিমলকে কেড়ে এল!
বিমল আবার তার মাথা টিপ করে বন্দুকের কুঁদো দিয়ে আঘাত করতে গেল৷
কিন্তু সেই মূর্তিটার গায়ের জোর ও তৎপরতা যে বিমলের চেয়েও বেশি: তৎক্ষণাৎ তার প্রমাণ মিলল!
সে চট করে একপাশে সরে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে একটানে বন্দুকটা বিমলের হাত থেকে কেড়ে নিল! আজ পর্যন্ত কোনো মানুষই কেবল গায়ের জোরে অসম্ভব বলবান বিমলের হাত থেকে এমন সহজে অস্ত্র তেড়ে নিতে পারেনি৷
পর মুহূর্তে বিমলের হাল কী যে হত বলা যায় না, কিন্তু ততক্ষণে তাদের দলের আরও কেউ কেউ সেখানে এসে পড়েছে এবং গর্জন করে উঠেছে রামহরির হাতের বন্দুক৷
বিকট আর্তনাদ করে মূর্তিটা শূন্যে বিদ্যুৎবেগে দুই বাহু ছড়িয়ে সেইখানে আছাড় খেয়ে পড়ল, আর নড়ল না!
কুমার তখন মাটির উপরে দুই হাতে ভর দিয়ে বসে অত্যন্ত হাঁপাচ্ছে!
বিমল আগে তার কাছে দৌড়ে গিয়ে ব্যস্তস্বরে সুধোল, ‘ভাই, তোমার কি খুব লেগেছে?’
কুমার মাথা নেড়ে বলল, ‘লেগেছে সামান্য, কিন্তু চমকে গেছি বেজায়! ও যেন আকাশ ফুঁড়ে আমার মাথায় লাফিয়ে পড়ল!’
বিমল মুখ তুলে দেখে বলল, আকাশ ফুঁড়ে নয় বন্ধু! ওই দেখো, সিড়ির এপাশেই একটা গুহা রয়েছে! ওটা নিশ্চয়ই ওইখানে লুকিয়ে ছিল!’
কুমার উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কিন্তু কী ভয়ানক ওর চেহারা আর কী ভয়ানক ওর গায়ের জোর! ওকে মানুষের মতো দেখতে, কিন্তু ও কি মানুষ?’
বিমল বলল, ‘এখনও ওকে ভালো করে দেখবার সময় পাইনি৷ এসো, এইবারে ওর চেহারা পরীক্ষা করা যাক!’
তারা যখন সেই ভূপতিত মৃত শত্রুর কাছে গিয়ে দাঁড়াল, তখন বিনয়বাবু হাঁটু গেড়ে মূর্তিটার পাশে বসে দুই হাতে তার মাথাটি ধরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন৷
মূর্তিটা লম্বায় ছয়ফুটের কম হবে না-দেখতেও সে সাধারণ মানুষের মতন, আবার মানুষের মতন নয়ও! কারণ তার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সাধারণ মানুষের চেয়ে বড়ো ও অধিকতর পেশিবদ্ধ৷ তার গায়ের রং ফর্সাও নয়, কালোও নয় এবং সর্বাঙ্গে বড়ো বড়ো চুল! তার মুখ মঙ্গোলিয়ান না হলেও, খানিকটা সেইরকম বলেই মনে হয়, আবার তার মধ্যে আমেরিকার ‘রেড-ইন্ডিয়ান’ মুখেরও আদল পাওয়া যায়৷ সারা মুখখানায় পশুত্বের বিশ্রী ভাব মাখানো৷ মুখে দাড়ি-গোঁফ নেই, মাথায় দীর্ঘ কেশ, গায়ে উলকি এবং পরনে কেবল একটি চামড়ার জাঙ্গিয়া৷
বিমল বলল, ‘কুমার, এ নিশ্চয়ই মানুষ, তবু একে মানুষের স্বগোত্র বলে তো মনে হচ্ছে না! এর দেহ আর মানুষের দেহের মাঝখানে কোথায় যেন একটা বড়ো ফাঁক আছে!’
বিনয়বাবু হঠাৎ উচ্ছ্বসিত স্বরে বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ এ মানুষ! পৃথিবীর প্রথম সত্যিকার মানুষ!’
বিমল বিস্মিত কন্ঠে বলল, ‘পৃথিবীর প্রথম সত্যিকার মানুষ? তার অর্থ?’
-‘তার অর্থ? অ্যানথ্রপলজি জানা থাকলে আমার কথার অর্থ বুঝতে তোমার কোনোই কষ্ট হত না! প্রথম সত্যিকার মানুষের নাম কী জানো? ক্রো-ম্যাগনন! আফ্রিকার উত্তর-পশ্চিম অংশ থেকে আন্দাজ বিশ-পঁচিশ হাজার বছর আগে ক্রো-ম্যাগনন মানুষেরা ইউরোপে গিয়ে হাজির হয়েছিল৷ আমাদের সামনে মরে পড়ে আছে, সেই জাতেরই একটি মানুষ৷ আমি একে খুব ভালো করে পরীক্ষা করেছি, আমার মনে আর কোনো সন্দেহই নেই৷’
বিমল বলল, ‘বিনয়বাবু, আপনার কথা যতই শুনছি ততই আমার বিস্ময় বেড়ে উঠছে৷ আমরা তো আপনার মতন পণ্ডিত কি বৈজ্ঞানিক নই, আমাদের আর একটু বুঝিয়ে বলতে হবে৷’
বিনয়বাবু বললেন, ‘আচ্ছা, তাই বলছি৷ আগে ইউরোপে সত্যিকার মানুষ আসবার আগে শেষ যে-জাতের মানুষ বাস করত তার নাম হচ্ছে ‘নিয়ানডের্টাল’ মানুষ-তাদের চেহারা বানরের মতো না হলেও তাদের দেখলে গরিলার মূর্তি মনে পড়ে৷ তাদের স্বভাব ছিল বনমানুষের মতো, চলাফেরার ভঙ্গিও ছিল বনমানুষের মতো, সেই ভীষণ বন্য হিংস্র প্রকৃতির মানুষের সঙ্গে আমাদের কিছুই মেলে না৷ তাদের সভ্যতা বলতে কিছুই ছিল না৷ ইউরোপে তারা রাজত্ব করেছিল দুই লক্ষ বৎসর ধরে৷ তারপর ইউরোপে সত্যিকার মানুষের আবির্ভাব হয়-ক্রো-ম্যাগনন মানুষ হচ্ছে সত্যকার মানুষদের একটি জাত৷ ক্রো-ম্যাগনন মানুষদের গড়ন ছিল মোটামুটি আমাদেরই মতো৷ তারা সব উন্নত, তাই নিয়ানডের্টাল মানুষদের সঙ্গে মেলামেশা না করে ইউরোপ থেকে তারা তাদের বিতাড়িত বা লুপ্ত করে৷ মনুষ্যোচিত অনেক গুণই যে তাদের ছিল, তার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে৷ তারা জামাকাপড় পরত, ঘোড়া পোষ মানিয়ে তার পিঠে চড়তে জানত, মৃতুদেহকে সম্মানের সঙ্গে গোর দিত, বঁড়শি গেঁথে মাছ ধরত, ছুরি, সুচ, প্রদীপ, বর্শা, তির-ধনুক প্রভৃতি ব্যবহার করত৷ ক্রমশ তারা যে খুব সভ্য হয়ে উঠেছিল এমন অনুমানও করা যায়৷ কারণ ফ্রান্স ও স্পেনের একাধিক গুহার দেওয়ালে দেওয়ালে তারা অসংখ্য জীবজন্তুর যেসব ছবি এঁকেছিল, তা এখনও বর্তমান আছে৷ এখনকার সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রকররাও তাদের চেয়ে ভালো ছবি আঁকতে পারেন না-সেসব ছবির লাইন যেমন সূক্ষ্ম তেমনি জোরালো৷ তাদের মূর্তি-শিল্পের-অর্থাৎ ভাস্কর্যেরও কিছু কিছু নমুনা পাওয়া যায়৷ যাদের আর্ট এমন উন্নত তাদের স্বভাবও যে নিয়ানডের্টাল যুগের তুলনায় অনেকটা উন্নত ছিল এমন কল্পনা করলে দোষ হবে না৷ পরে উত্তর এশিয়া থেকে আর্যজাতির কোনো দল যায় ভারতে, কোনো দল যায় পারস্যে এবং কোনো দল যাত্রা করে ইউরোপে৷ আর্যরা ভারতের অনার্যদের দাক্ষিণাত্যের দিকে তাড়িয়ে দেন৷ ইউরোপীয় আর্যজাতির দ্বারা ক্রো-ম্যাগনন প্রভৃতি ইউরোপীয় অনার্য বা আদিম জাতিরাও বিতাড়িত হয়৷ হয়তো নানাস্থানে ভারতের মতো ইউরোপেও আর্যের সঙ্গে অনার্যের মিলন হয়েছিল৷ ভারতের অনার্যরা যে অসভ্য ছিল না, দ্রাবিড়ীয় সভ্যতাই তার প্রমাণ৷ সুতরাং ইউরোপের আদিম অধিবাসী এই ক্রো-ম্যাগননরাও খুব সম্ভব অসভ্য ছিল না, তাই তারা ওখানকার আর্যদের সঙ্গে হয়তো অল্পবিস্তর মিশে যেতে পেরেছিল৷ মোটকথা, ইউরোপে ক্রো-ম্যাগনন লক্ষণ-বিশিষ্ট মানুষ আজও এখনও দেখা যায়-যদিও সেখানে ক্রো-ম্যাগনন মানুষের জাত লুপ্ত হয়েছে৷ বিমল, আমি এই বিপদজনক দেশে এসে পড়ে পদে পদে ভয়ে পাচ্ছি বটে, কিন্তু আজ এখানে এসে যে অভাবিত আবিষ্কার করলাম, তার মহিমায় আমার সমস্ত দুশ্চিন্তা সার্থক হয়ে উঠল৷ খাঁটি ক্রো-ম্যাগনন জাতের মানুষ আজও যে পৃথিবীতে আছে, এ খবর নিয়ে দেশে ফিরতে পারলে আমাদের নাম অমর হবে৷’
বিমল, কুমার ও কমল কৌতূহলে প্রদীপ্ত চোখ মেলে সেই সুপ্রাচীন জাতের আধুনিক বংশধরের আড়ষ্ট মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে রইল৷
তারপর বিমল বলল, ‘বিনয়বাবু, আপনার খাঁটি ক্রো-ম্যাগননরা কত বড়ো সভ্য ছিল জানি না, কিন্তু সে-জাতের একটি মাত্র নমুনা দেখেই আমার পিলে চমকে যাচ্ছে৷ উঃ, মানুষ হলেও এ বোধ হয় গরিলার সঙ্গে কুস্তি লড়তে পারত! এ জাতের সঙ্গে ভবিষ্যতে দূর থেকেই কারবার করতে হবে৷’
কুমার বলল, ‘এদিকে আমরা যে আসল কথাই ভুলে যাচ্ছি৷ জনতার কোলাহল ভয়ানক বেড়ে উঠছে, ব্যাপার কী দেখা দরকার৷’
কমল সেই সুদীর্ঘ ব্র্যাকেট বা বারান্দার মতো জায়গাটার ধারে গিয়ে নীচের দিকে উঁকি মেরে দেখল৷ পর মূহূর্তেই অভিভূত স্বরে চিৎকার করে উঠল, ‘আশ্চর্য, আশ্চর্য! এ কী ব্যাপার!’
বিমল ও কুমার তাড়াতাড়ি সেইখানে গিয়ে দাঁড়াল৷ নীচের দৃশ্য দেখে তাদেরও চক্ষু স্থির হয়ে গেল৷
দশম পরিচ্ছেদ – হারা মহাদেশ
এবারে তাদের দৃষ্টির সামনে উন্মুক্ত ও বিশাল দৃশ্যপটের মতন পরিপূর্ণ মহিমায় যা জেগে উঠল, আগেকার বিস্ময়ের চেয়েও তার কল্পনাতীত৷ সে দৃশ্য সম্পূর্ণরূপে বর্ণনা করতে গেলে পৃথিবীর কোনো ভাষাতেই কুলোবে না৷
উপর থেকে সমস্ত দৃশ্যটাকে মনে হচ্ছে ঠিক একখানা রিলিফ ম্যাপের মতো৷ শিখরের সেই বিরাট ফাঁকের ভিতর দিয়ে তখন দুপুরের পরিপূর্ণ সূর্যকে দেখা যাচ্ছিল৷ ফাঁকের মধ্যাগত উজ্জ্বল রৌদ্র নীচের দৃশ্যের উপরে গিয়ে যেখানে বায়োস্কোপের মেসিনের মতো একটা প্রকাণ্ড আলোকমণ্ডল সৃষ্টি করেছে সেখানে সর্বপ্রথমে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিশাল এক সরোবর! তাকে সাগরের একটা ছোটোখাটো সংস্করণও বলা চলে-কারণ সেই চতুষ্কোণ সরোবরের এপার থেকে ওপারের মাপ হয়তো মাইল দেড়েকের কম হবে না!
সরোবরটিকে দেখলেই মনে প্রশ্ন জাগে, এমন অদ্ভুত স্থানে কী করে এই অসম্ভব জলাশয়ের সৃষ্টি হয়েছে? এর মধ্যে শিল্পী মানুষের দক্ষ হাত যে আছে, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু ওখানে জল সরবরাহ হয় কোন উপায়ে? তার তলদেশে কি কোনো গুপ্ত উৎস আছে? না উন্মুক্ত শিখরপথ দিয়ে বৃষ্টির যে ধারা ঝরে, তাকেই ধরে রাখবার জন্যে এইখানে সরোবর খনন করা হয়েছে? এই সরোবরই বোধ হয় এখানকার সমস্ত জলাভাব নিবারণ করে৷ কারণ তার চারিদিক থেকে চারটি বেশ চওড়া খাল আলোকমণ্ডল পার হয়ে আলো-আঁধারির ভিতর দিয়ে দূর-দূরান্তরে অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে৷ প্রত্যেক খালটি যে কত মাইল লম্বা, তা ধারণা করবার উপায় নেই!
খালের মাঝে মাঝে রয়েছে স্বর্ণবর্ণ সেতু! সোনার সাঁকো! শুনতে আজগুবি বলে মনে হয় বটে, কিন্তু এ অতি সত্য কথা৷ তবে রং দেখে মনে হয়, এ যেন খাদ মেশানো সোনার মতো! হয়তো এদেশে লোহা মেলে না, কিংবা সোনার চেয়ে লোহাই এখানে বেশি দুর্লভ৷ হয়তো এখানে এত অতিরিক্ত পরিমাণে সোনা পাওয়া যায় যে, আমাদের দেশের লোহার দরে বিক্রি হয়৷ আগে আমেরিকাতেও অনেক দামি ধাতুরও কোনো দাম ছিল না৷ ইউরোপের লোকেরা সেই লোভে আমেরিকায় গিয়ে সেখানকার আদিম বাসিন্দাদের উপরে অমানুষিক অত্যাচার করেছিল৷ এখনও অনেক অসভ্যজাতি হিরার চেয়ে কাচকে বেশি দামি মনে করে৷
সরোবরের চারিধারে প্রথমে রয়েছে শস্যখেতের পর শস্যখেত৷ কিছু কিছু বনজঙ্গলও আছে, তবে বেশি নয়৷ সূর্যের আলো না পেলে ফসল ফলে না, উন্মুক্ত শিখরের তলায় যেখানে রোদ আনাগোনা করে সেইখানেই খেতে ফসল উৎপাদন করা হয়৷ দূরের যেসব জায়গায় রোদ পৌঁছায় না, সেখানে রোদের আভায় দেখা গেল গাছপালা বা শ্যামলতার চিহ্ন নেই বললেই হয়৷
আলোকমণ্ডলের বাইরে, শস্যখেতের পর খুব স্পষ্টভাবে চোখে কিছু পড়ে না বটে, কিন্তু এটুকু দেখা যায় যে, বাড়ির পর বাড়ির সারি কোথায় কত দূরে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গিয়েছে৷ কোনো বাড়ি দোতলা, কোনো বাড়ি তেতলা বা চারতলা! তাদের গড়নও অদ্ভুত-পৃথিবীর কোনো দেশেরই স্থাপত্যের সঙ্গে একটুও মেলে না৷
অনেক সুদীর্ঘ ও প্রশস্ত রাজপথ দেখা যাচ্ছে৷ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাজপথ-প্রত্যেকটিই দূর থেকে সরলভাবে সরোবরের ধারে এসে পড়েছে৷ প্রত্যেক রাজপথে বিষম জনতা৷ দলে দলে লোক অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে চিৎকার ও ছুটাছুটি করছে! স্ত্রী, পুরুষ, বালক, বালিকা! প্রত্যেক পুরুষের হাতে বর্শা ও ঢাল এবং পৃষ্ঠে সংলগ্ন ধনুক! বর্শা ও ধনুকের দণ্ড চকচক করছে, সোনায় তৈরি বা স্বর্ণমণ্ডিত বলে! মেয়েদের পরনে ঘাঘরা ও জামা, কিন্তু পুরুষদের পরনে কেবল জাঙ্গিয়া, গা আদুড়! স্ত্রী ও পুরুষ-সকলেরই দেহ আশ্চর্যরূপে বলিষ্ঠ, বৃহৎ ও মাংসপেশিবহুল৷ তাদের সকলেরই দীর্ঘতা প্রায় ছয় ফুট! সংখ্যায় তারা হয়তো আট-দশ হাজারের কম হবে না, বরং বেশি হওয়ারই সম্ভবনা৷ কারণ সূর্যকরে সমুজ্জ্বল সরোবরের তীরবর্তী স্থান, তারপর আলো-আঁধারির লীলাক্ষেত্র-এসব জায়গায় আর তিলধারণের ঠাঁই নেই, তারপর রয়েছে যে অন্ধকারময় সুদূর প্রদেশ, সেখানেও ছুটোছুটি করছে অসংখ্য মশাল৷
সরোবরের পূর্বে ও পশ্চিমে কেবলমাত্র দুইখানি প্রকাণ্ড অট্টালিকা রয়েছে৷ দুইখানি অট্টালিকার উপরেই রয়েছে দুটি বিশাল ও অপূর্ব গম্বুজ৷ দেখলেই বোঝা যায় একটি তার সোনার ও আর একটি রুপোর৷ প্রত্যেক অট্টালিকার উচ্চতা একশো ফুটের কম হবে না৷ খুব সম্ভব এর একটি রাজপ্রাসাদ এবং আর একটি দেবমন্দির৷ কারণ প্রথমোক্ত অট্টালিকার সুমুখের প্রাঙ্গণে দলবদ্ধ ও শ্রেণিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় দুই হাজার সশস্ত্র যোদ্ধা এবং শেষোক্ত অট্টালিকার চারিদিকে ভিড় করে রয়েছে শত শত মুণ্ডিত-মস্তক ব্যক্তি-হয়তো তারা পুরোহিত৷ এবং তাদের আশেপাশে স্বাধীনভাবে বিচরণ করছে দলে দলে হৃষ্টপুষ্ট গোরু৷ এবং সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এই রাজবাড়ি থেকে ঠাকুরবাড়ি পর্যন্ত, সেই প্রায় দেড়মাইলব্যাপী সরোবরের উপরে স্থাপন করা হয়েছে অতি অদ্ভুত ও বিচিত্র এক সেতু৷ আজ পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো মহাকাব্যেও এমন সেতুর কাহিনি বর্ণনা করা হয়নি! স্বর্ণময় সেতু এবং তার রৌপ্যময় রেলিং৷ সমস্ত সেতুর উপর দিয়ে রবির কিরণ যেন ঝকমকিয়ে পিছলে পড়ছে-তাকালেও চোখ ঝলসে যায়৷ এই একটিমাত্র সাঁকো তৈরি করতে যত সোনা ও যত রুপো লেগেছে, তার বিনিময়ে অনায়াসে মস্ত এক রাজ্য কেনা যায়৷
অবাক হয়ে এই সব দৃশ্য দেখতে দেখতে বিমলের মনে হল, সে যেন মাটির পৃথিবী ছেড়ে কোনো অলৌকিক স্বপ্নলোকে গিয়ে পড়েছে-সেখানে সমস্তই অভাবিত অভিনব, সেখানে কিছুই বাস্তব নয়, সেখানে প্রত্যেক ধূলিকণাও পৃথিবীর কোটিপতির কাছে লোভনীয়!
কুমার আচ্ছন্ন স্বরে বলে উঠল, ‘রূপকথায় এক দেশের কথা শুনেছি যেখানে সোনার গাছে ফোটে হিরারফুল৷ আমরা কি সেই দেশেই এসে পড়েছি?’
রামহরি কিছুমাত্র বিস্মিত হবার সময় পায়নি, সে যতই অসম্ভব ব্যাপার দেখছে ততই বেশি ভীত হয়ে উঠছে৷ সে দুই চোখ পাকিয়ে বলল, ‘এসব হচ্ছে মায়া-ডাইনি-মায়া, ময়নামতীর ভেলকি! রূপকথা যে-দেশের কথা বলে, সেখানে বুঝি খালি সোনার গাছে হিরের ফুল ফোটে? সেখানে যেসব ভূত-পেতনি, শাঁকচুন্নি, কন্ধকাটা, রাক্ষসখোক্ষসও থাকে, তাদের কথা ভুলে যাচ্ছ কেন?’
কুমার মৃদু হেসে বলল, ‘তাদের কথা ভুলে যাইনি, রামহরি! এখনই তো তাদের একজনের পাল্লায় পড়েছিলাম, তুমিই তো আমাদের বাঁচালে৷’
‘আবার তাদের পাল্লায় পড়লে শিবের বাবাও তোমাকে বাঁচাতে পারবে না৷ বাঁচতে চাও তো এখনও পালিয়ে চলো৷’
‘তোমার এই শিবের বাবাটি কে রামহরি? নিশ্চয়ই তিনি বড়ো যে-সে ব্যক্তি নন, আর তাঁকে শিবের চেয়েও ভক্তি করা উচিত৷ তাঁর নাম কী? যদি তাঁর নাম বলতে পারো, তাহলে এখনই এই সোনার দেশ ছেড়ে আমরা তোমার সঙ্গে লোহার জাহাজে চড়ে তাঁর বাসায় গিয়ে হাজির হব৷’
‘এ ঠাট্টার কথা নয় গো বাপু৷ শাস্তরে বলেছে, সুমুদ্দরের তলায় আছে রাক্ষসদের সুবর্ণ-লঙ্কা৷ আমরা নিশ্চয় সেইখানে এসে পড়েছি৷ শ্রীরামচন্দর না-হয় রাবণ আর কুম্ভকর্ণকেই বধ করেছেন৷ ধরলাম রাবণের ব্যাটা মেঘনাদও পটল তুলেছে৷ কিন্তু কুম্ভকর্ণের ব্যাটাকে তো কেউ আর বধ করতে পারেনি৷ বাপের মতন হয়তো তার ছ-মাস ধরে ঘুমনোর বদঅভ্যাস নেই, সে যদি এখন সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে ‘রে রে’ শব্দে তেড়ে আসে-তাহলে আর কি আমাদের রক্ষে থাকবে?’
কমল বলল, ‘দেখুন বিমলবাবু৷ এখানে মানুষ আছে, চতুষ্পদ জীবও আছে, ওই সরোবরের জলে হয়তো জলচরও আছে, কিন্তু কোথাও একটা পাখির ডাক পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না৷’
বিমল বলল, ‘ঠিক বলেছ কমল৷ আমি এতক্ষণ ওটা লক্ষ করিনি৷ এটা পুরোদস্তুর পাতাল-রাজ্যই বটে৷ কিন্তু আমি কী ভাবছিলাম জানো? সকলেরই মতে, এই দ্বীপটা এতদিন সমুদ্রের তলায় ডুবে ছিল, আজ হঠাৎ ভেসে উঠেছে, তাই নাবিকদের কোনো চার্টেই এর অস্তিত্ব পাওয়া যায় না৷ দ্বীপের উপরকার পাথরের মূর্তিগুলোয় আর ব্রোঞ্জের দরজার গায়ে সামুদ্রিক শ্যাওলা দেখে সেই কথাই প্রমাণিত হয়৷ কিন্তু এখানে এসে দেখতে পাচ্ছি, এই দ্বীপ-পাহাড়ের গর্ভটা হচ্ছে বিরাট একটা গুহার মতো,-এমনকী এর সবচেয়ে উঁচু শিখরটাও ফাঁপা, তার ভিতর দিয়ে অবাধে আলো আর বাতাস আসে৷ দ্বীপটা যখন সমুদ্রের তলায় ছিল, তখন ব্রোঞ্জের দরজা ভেদ করে সমুদ্রের জল নাহয় ভিতরে ঢুকতে পারত না৷ কিন্তু শিখরের অত-বড়ো ফাঁকটা তো কোনোরকমেই বন্ধ করা সম্ভব নয়, ওখানে সমুদ্রকে বাধা দেওয়া হত কোন উপায়ে?’
খানিকক্ষণ উপরের ফাঁকটার দিকে তাকিয়ে থেকে কুমার বলল, ‘তোমার প্রশ্নের একমাত্র উত্তর হচ্ছে-সম্ভবত কেবল পাহাড়ের শিখরের অংশটুকু বরাবরই জলের উপরে জেগে থাকত৷ এটা নিয়মিত জাহাজ চলাচলের পথ নয় বলে কোনো চার্টেই সামান্য একটা জলমগ্ন পাহাড়ের শিখরের উল্লেখ নেই৷
বিমল বলল, ‘বোধ হয় তোমার অনুমানই সত্য৷’
বিনয়বাবু এতক্ষণ একটিও কথা উচ্চারণ করেননি৷ তিনি স্তব্ধভাবে কখনো নীচের সেই অতুলনীয় দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে দেখছেন এবং কখনো বা মাথা হেঁট করে অর্ধনিমীলিত নেত্রে কী যেন চিন্তা করছেন,-ওই দৃশ্য ও নিজের চিন্তা ছাড়া পৃথিবীর আর সব কথাই তিনি যেন এখন সম্পূর্ণরূপে ভুলে গিয়েছেন৷
হঠাৎ কুমার তাঁকে ডেকে বলল, ‘বিনয়বাবু, আপনি একটাও কথা বলছেন না কেন?’
বিনয়বাবু চমকে বলে উঠলেন, ‘অ্যাঁ, কী বলছ? হ্যাঁ, এ-বিষয়ে আর কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না৷’
কুমার বিস্মিত স্বরে বলল, ‘কোন বিষয়ে কী সন্দেহ থাকতে পারে না?’
বিনয়বাবু বিপুল আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ঠিক যেন নৃত্য করতে করতেই বললেন, ‘লস্ট আটলান্টিস! লস্ট আটলান্টিস!’
বিমল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, ‘রামহরি, বিনয়বাবুকে ধরো! ওঁর কি ভয়ে মাথা খারাপ হয়ে গেল?’
বিনয়বাবু আরও চেঁচিয়ে বলল, ‘ওহো, লস্ট আটলান্টিস! লস্ট আটলান্টিস! ফাউন্ড অ্যাট লাস্ট!’
কুমার সভয়ে বলল, ‘কী সর্বনাশ! বিনয়বাবু কি শেষটা সত্যিই পাগল হয়ে গেলেন?’
বিমল তাড়াতাড়ি বিনয়বাবুর দুই হাত চেপে ধরে বলল, ‘লস্ট আটলান্টিস কী বিনয়বাবু?’
‘লস্ট আটলান্টিস! বিমল, তোমাদের যদি সামান্য কিছু ইতিহাসও পড়া থাকত, আমাকে তাহলে পাগল মনে করতে পারতে না! জানো নির্বোধ ছোকরার দল, আমরা আজ এক অমূল্য আবিষ্কারের পরে আবার আর এক অসম্ভব আবিষ্কার করেছি? ক্রো-ম্যাগনন মানুষ আর লস্ট আটলান্টিস!’
বিমল বলল, ‘কী মুশকিল, লস্ট আটলান্টিস পদার্থটা কী, আগে সেইটেই বলুন না!’
‘-লস্ট আটলান্টিস মানে আটলান্টিস নামে একটা হারিয়ে-যাওয়া মহাদেশ! যখন সভ্য ভারতবর্ষ ছিল না, সভ্য মিশর ছিল না, বাবিলন ছিল না, গ্রিস-রোম ছিল না, আটলান্টিস উঠেছিল তখন সভ্যতার উচ্চতম শিখরে! আজ সেই আটলান্টিস হারিয়ে গিয়েছে, আর পণ্ডিতেরা তাকে খুঁজে খুঁজে সারা হচ্ছেন! সেই মহাদেশেরই নাম থেকে নাম পেয়েছে আটলান্টিক মহাসাগর৷ ওহো কী আনন্দ! আমরা আজ সেই কতকালের হারানো মহাদেশে এসে উপস্থিত হয়েছি-আমরা তাকে আবার খুঁজে পেয়েছি! আমরা যখন এখান থেকে স্বদেশে ফিরে যাব, তখন সারা পৃথিবীর পণ্ডিতেরা আমাদের মাথায় তুলে নৃত্য করবেন!’
বিমল বলল, ‘সেই আনন্দে আপনি কি এখন থেকেই তাণ্ডব নৃত্য শুরু করলেন? কিন্তু বিনয়বাবু, এই দ্বীপের উপরটা মাইল পাঁচ-ছয়ের বেশি নয়, আর ভিতরটা না-হয় ধরলাম আরও কিছু বড়ো! একেই কি আপনি এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকার মতন একটা মহাদেশ বলতে চান?’
বিনয়বাবু ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললেন, ‘বিমল, তুমি হচ্ছ একটা মস্ত বড়ো আস্ত হস্তীমূর্খ! কেবল গোঁয়াতুÍমি করতেই শিখেছ, তোমাকে বোঝানো আমার সাধ্যের বাইরে৷’
কুমার মুখ বাড়িয়ে নীচের দিকে দেখতে দেখতে উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, ‘বিমল প্রস্তুত হও! লস্ট আটলান্টিস চুলোয় যাক৷ ওদের সৈন্যরা আমাদের আক্রমণ করবার জন্যে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছে৷’
সেই পাথরের বারান্দার ধারে গিয়ে বিমল দেখল, সংকীর্ণ সিঁড়ির ধাপগুলো পাহাড়ের গা ঘেঁষে প্রায় দেড়শো ফুট নীচে নেমে গিয়েছে-সেই ধাপের সার অবলম্বন করে নীচে নামবার কথা মনে হলেও মাথা ঘুরে যায়৷ কিন্তু সেই সিঁড়ি বেয়েই একে একে লোকের পর লোক উপরে উঠে আসছে এবং সোপানশ্রেণির তলাতেও হাজার লোক তাদের পিছনে পিছনে আসবার জন্যে সাগ্রহে অপেক্ষা করছে৷ শত্রুদের সম্মিলিত কন্ঠের ক্রুদ্ধ গর্জনে কান পাতা দায়!
বিমল কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে বেশ শান্ত ভাবেই বলল, ‘কুমার, আমরা এখানে নির্ভয়েই থাকতে পারি৷ ওরা নিশ্চয়ই বন্দুককে চেনে না৷ ওরা জানে না, সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আমরা যদি গোটাচারেক বন্দুক ছুড়তে থাকি, তাহলে ওদের পাঁচ লক্ষ লোককেও অনায়াসে বাধা দিতে
পারি৷’
পাতাল-রাজ্যের সৈনিকরা তখন সিঁড়ির দুই-তৃতীয়াংশ পার হয়ে এসেছে-তাদের কেউ করছে সোনার বর্শা আস্ফালন, কেউ ছুড়ছে ধনুক থেকে তির৷
বিমল বলল, ‘কিন্তু ওরা যদি কোনো গতিকে একবার উপরে উঠতে পারে, তাহলে আমাদের আর বাঁচোয়া নেই৷ তাহলে কালকেই ওদের দেবতার পায়ের তলায় আমাদের কাটা মুণ্ডুগুলো ভাঁটার মতো গড়াগড়ি যাবে৷ সুতরাং ওদের কিঞ্চিৎ শিক্ষা না দিয়ে উপায় নেই৷ . . . সেপাই৷’
সেপাইরা বিমলের কাছে গিয়ে দাঁড়াল৷
বিনয়বাবু ব্যস্তভাবে দৌড়ে গিয়ে বললেন, ‘বিমল, বিমল, তুমি ওদের উপরে গুলি ছুড়বে? বল কী! ওরা যে অদ্ভুত এক প্রাচীন জাতির দুর্লভ নমুনা!’
বিমল রুক্ষ স্বরে বলল, ‘রাখুন মশাই আপনার প্রাচীন জাতির দুর্লভ নমুনা! আপনি কি বলতে চান, ওরা নির্বিবাদে এখানে এসে আমাদের এই আধুনিক মানবজাতির নমুনাগুলিকে দুনিয়া থেকে লুপ্ত করে দিক? মাপ করবেন, এতটা উদার হতে পারব না৷ আটজন নাবিককে ওরা কী নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করেছে, আপনি কি তা শোনেননি-না-তাদের ছিন্নমুণ্ড দেখেননি?’
বিনয়বাবু ম্লানমুখে নিরুত্তর হলেন৷
বিমল বলল, ‘সেপাই! তোমরা পাঁচজন সিঁড়ির কাছে দাঁড়াও৷ পাঁচজনেই একবার করে বন্দুক ছোড়ো৷ তারপরেও যদি ওরা উপরে উঠতে চায়, তাহলে আবার পাঁচজন বন্দুক ছুড়বে!’
সেপাইরা যথাস্থানে গিয়ে দাঁড়াল৷
আগেই বলেছি, সেই সিঁড়ির ধাপে পাশাপাশি দুজন উঠতে বা নামতে কষ্ট হয়৷ শত্রুরাও একসারে একজন করে উপরে উঠে আসছিল৷ তখন প্রায় একশো জনেরও বেশি লোক সেই অতিসংকীর্ণ সুদীর্ঘ সোপানকে অবলম্বন করেছে! বিমলদের ভয় দেখাবার জন্যে তারা কেবল হইহই শব্দ নয়-অনেকরকম ভীষণ মুখভঙ্গি করতেও ছাড়ছে না৷
বিমল দুঃখিতভাবে মৃদু হেসে বলল, ‘বোকারা জানে না, মূর্তিমান যমের দলকে ওরা মুখ ভ্যাংচাচ্ছে৷ আটজন নিরস্ত্র নাবিককে বধ করে ওদের বুক ফুলে গেছে৷ . . . নাঃ, আর উঠতে দেওয়া নয়৷ সেপাই, ফায়ার!’
একসঙ্গে পাঁচটা বন্দুক ভীষণ শব্দে ধমক দিয়ে উঠল৷
পরমুহূর্তেই যা ঘটল, তা ভয়াবহ! সব-উপরের তিনজন লোক গুলিবিদ্ধ হয়ে নীচের লোকগুলোর উপরে ছিটকে পড়ল এবং তার পরেই দেখা গেল এক অসহনীয় ভীষণ দৃশ্য৷ হাজার হাজার কন্ঠের সুদীর্ঘ ভীত আর্তনাদের মধ্যে, সেই অতিউচ্চ অতিসংকীর্ণ সোপানশ্রেণি থেকে প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ জন লোক উপরের পড়ন্ত দেহগুলোর ধাক্কা সামলাতে না পেরে সিঁড়ির বাইরে গিয়ে ঠিকরে পড়ল এবং তারা যখন অনেক নীচের মাটিতে গিয়ে পৌঁছোল, তখন তাদের দেহগুলো পরিণত হল ভয়াবহ রক্তাক্ত মাংসপিণ্ডে৷ উপরের লোকদের অবস্থা দেখে নীচের সিঁড়ির লোকেরা কোনোরকমে দেওয়াল ধরে বা বেগে এ-যাত্রা আত্মরক্ষা করল৷
বিনয়বাবু মাটিতে বসে পড়ে দুই কানে হাত চাপা দিয়ে কাতর সুরে বলল, ‘আর সইতে পারি না-আর আমি সইতে পারি না! বিমল, থামো, থামো!’
বিমল অটলভাবে বলল, ‘এখনও নীচের ভিড় কমেনি, এখনও অনেকে আস্ফালন করছে, এখনও সুবিধা পেলে ওরা উপরে ওঠবার চেষ্টা করতে পারে৷ ওদের চোখ আর একটু ফুটিয়ে দেওয়া যাক, নরবলি দেওয়ার মজাটা ওরা টের পাক৷ . . . শোনো সেপাইরা, তোমরা সবাই মিলে এবার নীচের ওই ভিড়ের উপরে একবার গুলিবৃষ্টি করো তো৷’
গর্জে উঠল এবার একসঙ্গে চব্বিশটা বন্দুক সেই প্রকাণ্ড গুহাজগৎকে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত করে৷ নিম্নে সমবেত ভিড়ের ভিতরে পাঁচ-ছয়জন লোক তৎক্ষণাৎ ভূমিতলে লুটিয়ে পড়ল এবং হাজার হাজার কন্ঠের ভয়-বিস্ময়পূর্ণ তীব্র ও উচ্চ আর্তস্বরে চতুর্দিক পরিপূর্ণ হয়ে উঠল৷ মিনিট-পাঁচেক পরে দেখা গেল সেই বিপুল জনতা যেন কোনো মায়াবীর মন্ত্রগুণে কোথায় অদৃশ্য!
বিমল বলল, ‘ব্যস! বন্দুক যে কী চিজ, এইবারে ওরা বুঝে নিয়েছে৷-সিঁড়ির উপরে বোধ হয় কেউ আর পা ফেলতে ভরসা করবে না৷’
বিনয়বাবু যন্ত্রণা-ভরা স্বরে বললেন, ‘এ তো যুদ্ধ নয়, এ যে হত্যা! আমরা সবাই হত্যাকারী৷’
বিমল বলল, ‘কী করব বিনয়বাবু, আত্মরক্ষা জীবের ধর্ম!’
আরক্ত মুখে তীব্র কন্ঠে বিনয়বাবু বললেন, ‘হুঁ, আত্মরক্ষাই বটে! চমৎকার আত্মরক্ষা! আমরা হচ্ছি লোভী দস্যু৷ ওরা কি আমাদের দেশ আক্রমণ করেছে? আমরাই তো পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছি ওদের সোনার দেশ লুন্ঠন করতে-একটা প্রাচীন জাতিকে ধ্বংস করতে৷ ছি, ছি, ঘৃণায় অনুতাপে আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা হচ্ছে! ধিক আমাদের!’
তখন বিমলের খেয়াল হল-সত্যই তো, পরের দেশ আক্রমণ করেছে এসে তারা তো নিজেরাই৷ সুতরাং তাদের বিদেশি শত্রু বলে বাধা দেবার বা বধ করবার অধিকার যে এই পাতালবাসীদের আছে, সে-বিষয়ে তো কোনো সন্দেহ নেই! তখন সে লজ্জিতভাবে বলল, ‘বিনয়বাবু, আমি মাপ চাইছি! লস্ট আটলান্টিস সম্বন্ধে আপনি কী জানেন বলুন৷ যদি বুঝি ওরা সত্যই কোনো প্রাচীন সভ্য জাতির শেষ বংশধর, তাহলে ওদের বিরুদ্ধে আমি আর একটিমাত্র আঙুলও তুলব না, এখনই এখান থেকে বেরিয়ে সোজা জাহাজে গিয়ে উঠব৷’
-‘প্রতিজ্ঞা করছ?’
-‘প্রতিজ্ঞা করছি৷’
তখন শিখরের মুখ থেকে সূর্যালোক ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়েছে এবং সেই সঙ্গে নীচে থেকে অদৃশ্য হয়েছে পাতাল-রাজ্যের সমস্ত ঐশ্বর্যের চিত্রমালা৷ বাইরে শূন্যে আলোকোজ্জ্বল নীলিমাকে দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু গুহার ভিতরে ঘনিয়ে এসেছে নিশীথের প্রথম অন্ধকার৷ সে-অন্ধকারের ভিতরে পাতালপুরীর কোনো ভীত হস্ত আজ একটিমাত্র প্রদীপও জ্বালল না এবং সর্বত্রই থমথম করতে লাগল একটা অস্বাভাবিক বুকচাপা নিস্তব্ধতা৷
কুমার বলল, ‘সেপাইরা৷ আজকের রাতটা আমাদের এইখানেই কাটাতে হবে৷ লন্ঠনগুলো সব জ্বেলে রাখো, আর সিঁড়ির উপর ধাপে পালা করে চারজন লোক বসে সকাল পর্যন্ত পাহারা দাও৷ খুব হুঁশিয়ার থেকো, নইলে সবাইকে মরতে হবে৷’
বিমল বিনয়বাবুর সামনে বসে পড়ে বলল, ‘এখন বলুন আপনার লস্ট আটলান্টিসের গল্প৷’
বিনয়বাবু বললেন, ‘শোনো! কিন্তু জেনো, এটা গল্প নয়, একেবারে নিছক ইতিহাস৷ বড়ো বড়ো পৃথিবী বিখ্যাত পণ্ডিত যা আবিষ্কার বা প্রমাণ করেছেন, আমি সেই কথাই তোমাদের কাছে বলতে চাই৷’
একাদশ পরিচ্ছেদ – লস্ট আটলান্টিসের ইতিহাস
‘ধর, এগারো বা বারো বা তেরো হাজার বছর আগেকার কথা৷ যা বলব তা এত পুরোনো কালের কথা যে, দু-এক হাজার বছরের এদিক-ওদিক হলেও বড়োকিছু এসে যায় না৷ ওই সময়েই আটলান্টিস সাম্রাজ্য পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায়৷ কিন্তু তারও কত কাল আগে যে এই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, সে-কথা আর কেউ বলতে পারবে না৷
‘যেসব পুরোনো জাতি সভ্য ছিল বলে আজ পুরাণে বা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে, সেই মিশরীয়, ভারতীয়, চৈনিক, বাবিলনীয়, পারসি ও গ্রিক জাতির নাম তখন কেউ জানত না, অনেক জাতির জন্ম পর্যন্ত হয়নি!
‘ক্রো-ম্যাগনন প্রভৃতি সত্যিকার আদি মানুষজাতেরা যখন পৃথিবীতে রাজত্ব করছে, তখন পৃথিবীর চেহারা ছিল একেবারে অন্যরকম৷ আধুনিক খুব ভালো ছাত্ররাও ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার বছর আগেকার পৃথিবীর ম্যাপ দেখলে ক্লাসের লাস্ট-বয়ের মতন বোকা বনে যাবে৷
‘তখন রেলগাড়ি থাকলেও একবারও জল না ছুঁয়ে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ডাঙা দিয়ে আনাগোনা করা যেতে পারত৷ এমনকী মাঝে মাঝে দু-একটা প্রণালী পার হবার জন্যে দু-একবার মাত্র ছোটো ছোটো নৌকায় চড়ে ভারতবাসীরা ব্রহ্মদেশের ভিতর দিয়ে পদব্রজেই অনায়াসে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে হাজির হতে পারত৷ তখন সিংহল ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি এবং আমরা-অর্থাৎ বাঙালিরা আজ যেখানে বাস করছি সেই বাংলাদেশের উপর দিয়ে বইত অগাধ সমুদ্রের জলতরঙ্গ৷ বাঙালি জাতেরও জন্ম হয়নি!
‘ইউরোপে তখন ভূমধ্যসাগর ছিল না, তার বদলে ছিল দুটি ভূমধ্যবর্তী হ্রদ৷ ইতালি ছিল আফ্রিকার সঙ্গে সংযুক্ত৷ অর্থাৎ আফ্রিকা ও ইউরোপ ছিল পরস্পরের অঙ্গ-একই মহাদেশ৷ এবং ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ আর ফ্রান্স ছিল অভিন্ন৷
‘আটলান্টিস সাম্রাজ্যের অবস্থান ছিল আফ্রিকা ও আমেরিকার মাঝখানে৷ এক একটি প্রকাণ্ড দ্বীপ! গ্রিক পণ্ডিত প্লেটোর মতে, এশিয়া, এশিয়া-মাইনর ও লিবিয়াকে এক করলে যত বড়ো হয় এই দ্বীপটি আকারে তত বড়োই ছিল৷ অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে কিছু ছোটো৷
‘আটলান্টিসের উল্লেখ আধুনিক কোনো ইতিহাসেই পাওয়া যায় না৷ তার কারণ, যেখান থেকে আধুনিক ইতিহাসের আসল মালমশলা সংগ্রহ করা হয়েছে, সেই মিশর ও গ্রিস যখন সভ্য তখনও আটলান্টিসের অস্তিত্ব ছিল না৷ মিশর ও গ্রিস সভ্য হবার কয়েক হাজার বছর আগেই পৃথিবী থেকে আটলান্টিস হয়েছে অদৃশ্য৷ কিন্তু তখন আটলান্টিসের বহু বাসিন্দা স্বদেশ ছেড়ে পালিয়ে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই ছড়িয়ে পড়েছিল৷ কাজেই লোকের মুখে মুখে ও জনপ্রবাদে আটলান্টিসের অনেক কাহিনিই তখন সারা পৃথিবীতে বিস্তৃত হয়ে গিয়েছিল৷ আজ আমরা তার কথা প্রায় ভুলে গিয়েছি বটে, কিন্তু প্রাচীন মিশর ও গ্রিসের লোকেরা এই লুপ্ত আটলান্টিসের অনেক খবরই জানত৷
‘গ্রিক পণ্ডিত প্লেটোর বিখ্যাত বর্ণনা থেকে জানা যায়, আটলান্টিস দ্বীপ ছিল অসংখ্য লোকের বাসভূমি৷ তার নগরে ছিল শত শত অট্টালিকা, বিরাট স্নানাগার, বৃহৎ মন্দির, অপূর্ব উদ্যান, আশ্চর্য সব খাল ও বিচিত্র সব সেতু প্রভৃতি৷ একটি খাল ছিল তিনশো ফুট চওড়া, একশো ফুট গভীর ও ষাট মাইল লম্বা! তার তীরে তীরে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বন্দর এবং তার ভিতর দিয়ে আনাগোনা করত বড়ো বড়ো জাহাজ৷ একশো ফুট চওড়া সাঁকোরও অভাব ছিল না!
‘মন্দির ছিল শত শত ফুট উঁচু এবং সেই অনুপাতেই চওড়া৷ মন্দিরের চুড়ো ছিল সুবর্ণময় এবং বাহিরের দেওয়ালগুলো রৌপ্যময়৷ মন্দিরের ভিতরের অংশও সোনা, রুপো ও হাতির দাঁতে মোড়া ছিল৷ তাদের মধ্যে ছিল খাঁটি সোনায় গড়া মূর্তির ছড়াছড়ি!
‘শহরের পথে পথে দেখা যেত গরম জলের উৎস এবং ঠান্ডা জলের ফোয়ারা৷ রাজপরিবার, সাধারণ পুরুষ, নারী এমনকী অশ্ব প্রভৃতি পালিত পশুদেরও জন্যে ছিল আলাদা আলাদা স্নানাগার! নানা জায়গায় বড়ো বড়ো ব্যায়ামশালা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল৷ আটলান্টিসের মধ্যে পবিত্র জীবরূপে গণ্য হত ষণ্ডরা৷ এবং আটলান্টিসকে রক্ষা করবার জন্যে নিয়মিত মাহিনা দিয়ে পালন করা হত ষাট হাজার সৈন্যকে৷
‘প্লেটো বলেন, কিন্তু আটলান্টিসের অধিবাসীরা নাকি ঐশ্বর্যের ও শক্তির গর্বে অত্যাচারী, অবিচারী ও মহাপাপী হয়ে উঠেছিল-শেষটা আর ধর্মের শাসন মানত না৷ সেইজন্যে দেবতারাও তাদের উপরে বিরূপ হয়ে উঠেছিলেন৷ অবশেষে দেবতার ক্রোধে আচম্বিতে সমুদ্র সংহারমূর্তি ধরে এক দিন ও এক রাত্রির মধ্যেই সমগ্র আটলান্টিসকে গ্রাস করে ফেলল৷
‘এটা হচ্ছে রোম নগর প্রতিষ্ঠিত হবার নয় হাজার বছর আগেকার ঘটনা৷
‘প্লেটোর বর্ণনা যুগে যুগে বহু লোককে কৌতূহলী করে তুলেছিল বটে, কিন্তু আগে সকলেই ভাবতেন, তাঁর আটলান্টিস হচ্ছে কাল্পনিক দেশ৷
‘মিশর, বাবিলন, গ্রিস ও রোম প্রভৃতি দেশের পুরোনো সভ্যতা আজ অতীতের কাহিনি হয়ে দাঁড়িয়েছে বটে, কিন্তু তাদের অস্তিত্বের অগুন্তি চিহ্ন এখনও বিদ্যমান আছে৷ আটলান্টিসের অস্তিত্বের চিহ্ন কোথায়? এই হচ্ছে অবিশ্বাসীদের যুক্তি৷ কিন্তু ওঁরা ভুলেও একবার ভাবেন না যে, ওসব দেশ আটলান্টিসের মতো মহাসাগরের কবলগত হয়নি৷ কত যুগযুগান্তের আগে সে সভ্যতা অতল জলে ডুবে পড়েছে, আজ তার চিহ্ন পাওয়া যাবে কেমন করে?
‘কিন্তু এখনকার অনেক বড়ো বড়ো পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞ, প্লেটোর আটলান্টিসকে আর অলস কল্পনা বলে উড়িয়ে দেন না৷ তাঁরা বহু পরিশ্রম ও অনুসন্ধানের ফলে আটলান্টিসের অস্তিত্বের অসংখ্য প্রমাণ আবিষ্কার করেছেন, এখানে সে-সমস্ত কথা বলবার সময় হবে না৷ এ বিষয়ে অনেক গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে৷ যদি তোমাদের আগ্রহ থাকে, তাহলে অন্তত Lewis Spence সাহেবের The History of Atlantis নামে বইখানা পড়ে দেখো৷
‘একালের পণ্ডিতদের মত, উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার কাছে আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যে কেনারি, অজোর্স ও মেডিরা প্রভৃতি যেসব দ্বীপ দেখতে পাওয়া যায়, ওগুলি হচ্ছে জলমগ্ন আটলান্টিসেরই সর্বোচ্চ অংশবিশেষ৷
‘ফ্রান্সের Pierre Terminer (Director of Science of the Geographical Chart of France) সাহেব বলেন, পূর্বোক্ত দ্বীপগুলির কাছে আটলান্টিক মহাসাগর এখনও অশান্ত হয়ে আছে৷ ওখানে যে-কোনো সময়ে পৃথিবীর আর সব দেশের অগোচরে ভীষণ জলপ্লাবন বা খণ্ডপ্রলয় হবার সম্ভাবনা এখনও আছে৷ সুতরাং আটলান্টিস ধ্বংস হওয়ার সম্বন্ধে প্লেটো যা যা বলেছেন তা অসম্ভব মনে করা চলে না৷
‘তোমাদের কাছে আমি আগেই বলেছি যে ক্রো-ম্যাগনন মানুষরা উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা থেকে ইউরোপে গিয়ে হাজির হয়েছিল, আর্যদের বহু সহস্র বৎসর আগে৷ এ-বিষয়ে সব পণ্ডিতই একমত৷
‘বিশেষজ্ঞরা বলেন, বারংবার খণ্ডপ্রলয় বা সামুদ্রিক বন্যায় আটলান্টিস যখন ক্রমে ক্রমে পাতাল-প্রবেশ করছিল, তখন সেখানকার অসংখ্য বাসিন্দা আত্মরক্ষা করবার জন্যে উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকায় ও আমেরিকায় পালিয়ে যায়৷ ক্রো-ম্যাগনন মানুষরা উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকায় ও আমেরিকায় পালিয়ে যায়৷ ক্রো-ম্যাগ্নন মানুষরা উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার মতন জায়গায় কেমন করে এসে আবির্ভুত হয়েছিল, এ-সম্বন্ধে সদুত্তর পাওয়া যায় না৷ ওদের উৎপত্তির ইতিহাস আগে ছিল রহস্যময়৷ কিন্তু এখন বেশ বোঝা যাচ্ছে, তারা আটলান্টিসেরই পলাতক সন্তান৷ কারণ আটলান্টিস দ্বীপ ছিল উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকারই প্রতিবেশীর মতো৷
‘Donelly Brasseur be Bourbourg ও Augustas La Plongeon সাহেবরা বলেন- অতীত যুগে আটলান্টিস তার সন্তানগণকে সারা পৃথিবীর সর্বত্রই পাঠিয়ে দিয়েছিল৷ তাদের অনেকেই আজ আমেরিকায় রেড ইন্ডিয়ান নামে বিচরণ করছে৷ তারা প্রাচীন মিশরে গিয়ে সাম্রাজ্য স্থাপন করেছে৷ তারা উত্তর এশিয়ায় গিয়ে তুরানি ও মঙ্গোলিয়ান নামে পরিচিত হয়েছে৷ (Some Notes on the Lost Atlantis : Papyras : March, 1921.)
‘বিমল, কুমার, কমল! তোমরা সকলেই দেখছ, আজ আমরা যেখানে এসে হাজির হয়েছি, প্লেটো আর অন্যান্য পণ্ডিতদের বর্ণনার সঙ্গে এর কতটা মিল আছে? অদ্ভুত খাল, সেতু, প্রাসাদ, মন্দির, সোনা-রুপার ছড়াছড়ি! এমনকী পবিত্র ষণ্ড ও ক্রো-ম্যাগনন মানুষদেরও আমরা স্বচক্ষে দেখেছি! হারা আটলান্টিস যে এইখানকার সমুদ্রের ভিতরেই লুকিয়ে আছে, পণ্ডিতরা আগে থাকতেই তা আমাদের বলে রেখেছেন৷ এখনও কি তোমাদের মনে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে?
‘সমগ্র আটলান্টিসের সামান্য অংশই আমরা দেখতে পেয়েছি৷ আসল দেশটা যখন ডুবে যায়, তখন এই আশ্চর্য আর অসাধারণ গুহার ভিতর আশ্রয় নিয়ে কয়েক শত লোক প্রাণরক্ষা করেছিল৷ তাদের বংশধররা আজ হাজার হাজার বৎসর ধরে এই ক্ষুদ্র পাতাল-রাজ্যের মধ্যে নিজেদের সংখ্যাবৃদ্ধি করেছে, আর প্রাচীন অবিকৃত সভ্যতার প্রদীপ-শিখাটি এতদিন ধরে কোনো রকমে জ্বালিয়ে রেখেছে৷ দ্বীপের উপরে যেসব বিভীষণ, অতিকায় প্রস্তরমূর্তি দেখেছ, তাদের বয়স পনেরো-বিশ হাজার বৎসর৷ তারা সেই স্মরণাতীত কাল আগেকার অত্যাচারী নিষ্ঠুর আর এখনকার তুলনায় অর্ধসভ্য মানুষদের আকৃতি-প্রকৃতি ফুটিয়ে তুলেছে-তাদের মৌখিক ভাবের সঙ্গে তাই আধুনিক মানুষের মার্জিত মুখের ছবি মেলে না৷
‘আটলান্টিসের যেসব সন্তান পৃথিবীর অন্যান্য দেশে প্রস্থান করেছে, বিভিন্ন যুগের মানুষ আর বিভিন্ন সভ্যতার সংশ্রবে এসে তারা এখন নিজেদের বিশেষত্ব হারিয়ে ফেলেছে তাই আজ আর তাদের চেনা যায় না৷ কিন্তু এই পাতাল-রাজ্যের বাসিন্দারা সেই প্রাচীন সভ্যতারই খাঁটি নিদর্শন অবিকল ভাবে রক্ষা করতে পেরেছে৷ বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে এদের কোনো সম্পর্ক নেই বললেও চলে৷ কেবল মাঝে মাঝে-হয়তো যুগযুগান্তর পরে-সমুদ্রের জল সরে গেলে তারা ব্রোঞ্জের দরজা খুলে দ্বীপের উপরে এসে বাইরের জগৎকে বহুকাল পরে ফিরে পাওয়া বন্ধুর মতো এক-একবার চোখ মেলে প্রাণ ভরে দেখে নেয়৷ এমন ভাবে কোনো-একটা জাতি যে হাজার হাজার বৎসর ধরে বাঁচতে পারে, সেটা ধারণাই করা যায় না৷ কিন্তু এই ধারণাতীত ব্যাপারটাও সম্ভবপর হয়েছে৷ চোখের সামনে যাকে দেখছি তাকে অস্বীকার করবার উপায় নেই!
‘আমরা ভাগ্যবান, তাই এমন বিচিত্র দৃশ্য স্বচক্ষে দেখতে পেলাম-পাতালবাসী অতীতকে পেলাম জীবন্ত রূপে বর্তমানের কোলে! এখানকার মানুষদের উপর আমাদের শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত-কারণ এদেরই সভ্যতা হচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত সভ্যতার অগ্রদূত৷ এরা আমাদের কোনো অপকার করেনি৷ তবে এমন একটা দুর্লভ প্রাচীন জাতির উপর আমরাই-বা অত্যাচার করব কেন?
‘জানি, আমাদের হাতে যে অস্ত্র আছে তার সাহায্যে আমরা এখনই এই বেচারাদের সবংশে ধ্বংস করতে পারি-এখানকার ধনদৌলত লুটে নিয়ে গিয়ে পৃথিবীর বড়ো বড়ো রাজা-মহারাজারও চোখে তাক লাগিয়ে দিতে পারি৷ কিন্তু তাহলে আমাদের মনুষ্যত্ব কোথায় থাকবে? আরসিতে আমরা নিজেদের কাছেই কি আর নিজেদের কালো মুখ দেখাতে পারব?
‘বিমল! আমাদের উচিত, কাল সকালেই এই দ্বীপ ছেড়ে চলে যাওয়া৷ দুঃখের বিষয় কেবল এই যে, আমাদের এমন অসাধারণ আবিষ্কারের খবরও পৃথিবীতে প্রচার করতে পারব না৷ কারণ তাহলে এই অসহায় সোনার দেশ লুন্ঠন করবার লোভে পৃথিবীর চারিদিক থেকে দলে দলে দস্যু ছুটে আসবে৷’
বিনয়বাবু চুপ করবার পর অনেকক্ষণ ধরে কেউ কোনো কথা কইল না৷
তখন শিখরের ফাঁকে ফুটে উঠেছে রাতের কালো রং-মাখানো আকাশের গায়ে তারকাদের আলোর আলপনা৷ শিখরের মুখের কাছে অন্ধকার উজ্জ্বল হয়ে আছে৷ কিন্তু ভিতরের চারিদিকেই অন্ধকার যেন দানা পাকিয়ে সুকঠিন হয়ে উঠেছে!
কমল একবার উঠে দাঁড়িয়ে দেখল, নিস্তব্ধ পাতালপুরীর এদিকটাও অন্ধকারের ঘেরাটোপে ঢাকা, কেবল দূরে-বহুদূরে মাঝে মাঝে নিবিড় তিমির-পট ফুটো করে এক-একটা মিটমিটে আলোকশিখা দেখা দিচ্ছে৷ জীবনের কলঝংকার এখানে যেন একান্ত ভয়ে বোবা হয়ে গেছে৷ কেউ কোথাও ক্ষীণ স্বরে কাঁদবার প্রয়াসও করছে না!
বিমল বলল, ‘বিনয়বাবু, আপনার কথাই ঠিক! এই প্রাচীন জাতির উপরে অত্যাচার করা মহাপাপ, আমরা যে ধারণাতীত অপূর্ব দৃশ্য দেখবার আর নূতন জ্ঞানলাভ করবার সৌভাগ্য পেলাম, সেইটুকুই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট পুরস্কার৷ আমরা দস্যু নই-কাল সকালেই এখান থেকে বিদায় নেব৷’
বিনয়বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমার ইচ্ছে হচ্ছে, এদের সঙ্গে আলাপ করে এখানকার ভিতরের যা-কিছু জানবার, জেনেনি৷ কিন্তু এ ইচ্ছা বোধ হয় আর সফল হওয়া অসম্ভব, এরা আর আমাদের বন্ধুভাবে গ্রহণ করতে পারবে না৷’
পরদিন প্রভাতে উঠে বিমল দেখল, তখনও পাতালপুরীর রাজপথে জনমানবের দেখা নেই৷ সরোবরের দুই ধারে সেই সোনার ও রুপার গম্বুজওয়ালা দু-খানা অট্টালিকার প্রত্যেক জানলা-দরজা বন্ধ, কোথাও একজন সৈনিক পর্যন্ত বাইরে এসে দাঁড়ায়নি৷
যে অট্টালিকাকে তারা রাজবাড়ি বলে সন্দেহ করছে, তার চারিপাশে প্রায় চল্লিশ ফুট উঁচু দৃঢ় পাথরের প্রাচীর রয়েছে৷ প্রাচীরটা এমন চওড়া যে, তার উপর দিয়ে পাশাপাশি দুইজন লোক অনায়াসেই হেঁটে চলে যেতে পারে৷ প্রাচীরের মাঝে মাঝে এক-একখানা ঘর-বোধ হয় সৈনিকদের থাকবার জন্যে৷ দুটো প্রকাণ্ড সিংহদ্বার, তার ভিতর দিয়ে হাওদাসুদ্ধ হাতিও ঢুকতে পারে৷ সিংহদ্বারের পাল্লাও পুরু ব্রোঞ্জে তৈরি৷
কুমার বলল, ‘এই রাজবাড়িকে কেল্লা বললেও ভুল হয় না৷ যেখানে বাইরের শত্রুর ভয় নেই, সেখানে রাজবাড়িকে এমনভাবে সুরক্ষিত করা হয়েছে কেন?’
বিমল বলল, ‘মানুষ তো কোথাও নিরীহ জীবন যাপন করতে পারে না! বাইরের শত্রু নেই বটে, কিন্তু জাতি-বিরোধ প্রজা-বিদ্রোহ তো থাকতে পারে? রাজা তখন আশ্রয় নেন এই পাঁচিলের পিছনে!’
আচম্বিতে উপরে গুহার বাহির থেকে কারা একসঙ্গে হো হো করে হেসে উঠল!
বিমল চমকে মুখ তুলেই শুনল, কে চেঁচিয়ে ইংরেজিতে বলছে, ‘আরও আরও বাঙালি-বাবুরা যে দরজা ভেঙে আমাদের জন্যে সাফ করেই রেখে গেছে!’
প্রথমটা সবাই ভেবেছিল যে, পাতালবাসীরা হয়তো অন্য কোনো পথ দিয়ে গুহার উপরে উঠে আবার তাদের আক্রমণ করতে আসছে৷ কিন্তু ওদের স্পষ্ট ও আধুনিক ইংরেজি ভাষা শুনে বেশ বোঝা গেল, ওরা এই পাতালের বাসিন্দা নয়৷ তবে কি এখানকার খবর বাইরের লোকও জানে?
উপর অংশের সিঁড়িটার চারিদিকে দেওয়ালের আবরণ ছিল বলে কারোকে দেখা গেল না, কিন্তু কারা যে খটখট জুতোর শব্দ করে গুহার স্তব্ধতা ভেঙে নীচে নামছে এটা বেশ স্পষ্টই শোনা গেল!
কে এরা! নীচে নামে কেন?
আর একজন কে চেঁচিয়ে বলল, ‘গোমেজ, তোমার আলোটা একটু তুলে ধরো! এখানে পা ফসকালে সোজা নরকে গিয়ে হাজির হব!’
গোমেজ . . . গোমেজ? এবং তার দলবল? এ কী অসম্ভব ব্যাপার!-বিমল হতভম্বের মতো কুমারের মুখের পানে মুখ ফেরাল৷
গোমেজ তো এখন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড-এর ডিটেকটিভদের পাল্লায়, কিংবা লন্ডনের জেলখানায়! সে কোন জাদুমন্ত্রে পুলিশ, কারাগার ও আটলান্টিক মহাসাগরকে ফাঁকি দিয়ে এই শৈলদ্বীপে এসে হাজির হয়েছে?
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – খণ্ডপ্রলয়
জুতো-পরা ভারী ভারী পায়ের আওয়াজ ক্রমেই উচ্চতর হয়ে উঠছে!
হঠাৎ কুমারের চোখ পড়ল সিঁড়ির পাশের গুহাটার দিকে-কাল যেখান থেকে শত্রু বেরিয়ে তাকে আক্রমণ করেছিল৷ সে তাড়াতাড়ি বলল, ‘বিমল, মিথ্যে আর রক্তারক্তি কাণ্ড বাধিয়ে লাভ নেই! এসো, আমরা ওই গুহাটার ভিতরে ঢুকে পড়ি৷ বোধ হচ্ছে ওখানে আমাদের সবাইকার জায়গা হবে৷’
বিমল মাথা নেড়ে সায় দিয়ে সেপাইদের সেই গুহার ভিতরে ঢুকবার জন্যে ইঙ্গিত করল৷ আধ-মিনিটের মধ্যেই জায়গাটা একেবারে খালি হয়ে গেল৷ এমনকী, চালাক বাঘা পর্যন্ত সে ইঙ্গিত বুঝতে একটুও দেরি করল না!
গুহার মুখে গা-ঢাকা দিয়ে দাঁড়িয়ে বিমল ও কুমার শুনতে পেল পায়ের শব্দগুলো একে একে বারান্দায় এসে নামছে৷
তারপর চমৎকৃত কন্ঠে একজন বলল, ‘হে ভগবান! এ কী দেখছি!’-এটা হচ্ছে গোমেজের গলা!
আর একজন বলল, ‘আশ্চর্য, আশ্চর্য! পৃথিবীতে এমন ঠাঁই থাকতে পারে৷’
আর একজন বলল, ‘মাথার উপরে আলোর ঝরনা! পাহাড়ের মাঝখানে অনন্ত গুহা! তার মধ্যে বিশাল স্বপ্ন-শহর! সোনার গম্বুজ-রুপোর গম্বুজ-সোনা-রুপোর সাঁকো!’
গোমেজ বলল, ‘কোথাও জনপ্রাণী নেই, কারোর সাড়া নেই! আমরা কি রূপকথার সেই Sleeping beauty-র দেশে এসে পড়লাম? এখানেও কি কোনো রাজকন্যা এক শতাব্দীর ঘুমে অচেতন হয়ে আমাদের জন্যে সোনার খাটে শুয়ে আছে?’
আর-একজন বলল, ‘এখন তোমার কবিত্ব রাখো গোমেজ! এই অস্বাভাবিক স্তব্ধতা আমার ভালো লাগছে না৷’
কে একজন হঠাৎ সচকিত কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কী ভয়ানক! কী এটা? ভূত, না মানুষ, না জন্তু? . . . অ্যাঁ! এ যে দেখছি মরে একেবারে আড়ষ্ট হয়ে গেছে! বুকে বুলেটের দাগ!’
গোমেজ বলল, ‘এ সেই বাঙালিবাবুদের কাজ! কিন্তু তারা গেল কোথায়, আমি যে তাদের জ্যান্ত আগুনে পুড়িয়ে মারতে চাই৷’
আর-একজন চেঁচিয়ে উঠল, ‘দেখো, দেখো! নীচেও কত মরা লোক পড়ে রয়েছে?’
গোমেজ বলল, ‘দেখছি এখানে ছোটোখাটো একটা লড়াই হয়ে গেছে! কিন্তু বাবুদের তো কোনোই পাত্তা নেই! আমাকে ফাঁকি দিয়ে তারা আগেই পটল তুলে ফেলল নাকি? না, বন্দুকের বিক্রম দেখিয়ে এখানকার লোকদের তারা বশ করে ফেলেছে?’
অন্য একজন বলল, ‘চলো আমরা নীচে নেমে যাই৷ এ-দেশ আমরা দখল করবই৷ যদি কেউ বাধা দেয় তাকে যমালয়ে পাঠাব৷ হিপ হিপ হুররে!’
সকলেই একসঙ্গে হিপ হিপ হুররে বলে চেঁচিয়ে উঠল-তারপরেই আবার নীচের সিঁড়িতে পায়ের শব্দ৷
বিমল উঁকি মেরে দেখে নিল, তাদের দলেও চব্বিশ-পঁচিশ জন লোক আছে এবং সকলেরই হাতে বন্দুক৷
পায়ের শব্দগুলো যখন মিলিয়ে গেল বিমল তখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘আর আমি ওদের কেয়ার করি না৷ ওরা যখন ওই সরু সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেছে, তখন ওদের তো আমাদের হাতের মুঠোর ভেতরেই পেয়েছি৷’
বিনয়বাবু বললেন, ‘কাল আমরা সমুদ্রে এদেরই জাহাজ দেখেছিলাম৷’
কুমার বলল, ‘হুঁ’৷ তাহলে বেশ বোঝা যাচ্ছে, গোমেজ বিলেতি পুলিশের চোখে ধুলো দিতে পেরেছে৷’
বিমল বলল, ‘আরও একটা কথা বোঝা যাচ্ছে৷ গোমেজ অসাধারণ কাজের লোক৷ এর মধ্যেই সে নতুন দল বেঁধে জাহাজ জোগাড় করে প্রায় আমাদের সঙ্গে সঙ্গে এখানে এসে হাজির হয়েছে৷ গোমেজের বাহাদুরি আছে৷’
কমল বলল, ‘বোধ হয় ওদের জাহাজখানা আমাদের চেয়ে দ্রুতগামী৷’
‘সম্ভব৷ কিন্তু তাহলেও গোমেজের বাহাদুরি কম নয়৷ এখন চলো, বেরিয়ে দেখা যাক, নীচে আবার কী কাণ্ড বাধে৷ ওদের আর ভয় করবার দরকার নেই-সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে ওরা নিজেদেরই মৃত্যুফাঁদে পা দিয়েছে৷’
বিনয়বাবু বললেন, ‘কিন্তু বিমল, আর এখানে হানাহানি করে আমাদের লাভ কী? এই ফাঁকে মানে মানে আমরা সরে পড়ি না কেন?’
বিমল তিরস্কার-ভরা কন্ঠে বলল, ‘সে কী বিনয়বাবু! এই দস্যুদের কবলে সমস্ত দেশটাকে সমর্পণ করে? গোমেজ কীজন্যে এখানে এসেছে জানেন না? লুঠ করতে, হত্যা করতে, অত্যাচার করতে! আমরা বাধা দেব না,-বলেন কী!’
বিনয়বাবু বলে উঠলেন, ‘ঠিক বলেছ৷ আমার মনে ছিল না৷ হ্যাঁ, ওদের থেকে এই দেশকে রক্ষা করা চাই-ই!’
সবাই ছুটে বাইরে এল৷ বারান্দার ধারে গিয়ে হেঁট হয়ে দেখল, গোমেজ তার দলবল নিয়ে সরোবরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে৷
কিন্তু তখনও পাতালপুরী তেমনি নিস্তব্ধ, কোথায় একটা প্রাণীরও দেখা নেই৷ শিখরের মুখে সূর্যের কিরণোৎসবের ঘটা যতই বেড়ে উঠছে, ততই বেশি সমুজ্জ্বল হয়ে উঠছে পাতালপুরের দৃশ্য বৈচিত্র্য৷
গোমেজ সদলবলে আগে আগে রাজপ্রাসাদের দিকে গেল৷ কিন্তু সমস্ত প্রাসাদপ্রাচীর প্রদক্ষিণ করেও ভিতরে প্রবেশ করবার পথ পেল না৷ তারা তখন একটা বাগানের ভিতর দিয়ে অগ্রসর হল সেই স্বর্ণ-রৌপ্যময় আশ্চর্য সেতুর দিকে!
আচম্বিতে কোথায় তীব্র সুরে একটা ভেরির শব্দ শোনা গেল এবং পরমুহূর্তেই ঠিক যেন ভোজবাজির মহিমায় গোমেজ প্রভৃতির চারিপাশে শত শত বিপুলদেহ সৈনিকের মূর্তি হল আবির্ভুত! সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র পাতালরাজ্য আবার জ্যান্ত হয়ে উঠল! কাছে, দূরে, উত্তরে, দক্ষিণে, পূর্বে, পশ্চিমে যেদিকে চোখ ফেরানো যায়, লক্ষে পড়ে কেবল জনতার পর জনতার প্রবাহ- কেবল বিদ্যুৎগতির লীলা-কেবল অগ্নিবৎ উজ্জ্বল স্বর্ণবর্ষার নৃত্য৷ আর মেঘগর্জনের মতন সে কী গম্ভীর অথচ বিকট চিৎকার!
বিমল প্রশংসা-ভরা কন্ঠে উল্লাসভরে বলে উঠল, ‘ধন্য ক্রো-ম্যাগনন মানুষরা, ধন্য! কুমার, এরা কতটা চালাক, বুঝতে পারছ? এরা বন্দুকের ধর্ম ঠিক ধরে ফেলেছে! এরা এরই মধ্যে বুঝে নিয়েছে যে, দূর থেকে বন্দুকধারীদের আক্রমণ করা আর আত্মহত্যা করা একই কথা৷ তাই এরা আমাদের ভুলিয়ে ফাঁদে ফেলবার জন্যে আনাচেকানাচে নিঃশব্দে লুকিয়ে ছিল৷ ওরা ভয়ে কোথায় পালিয়েছে ভেবে আমরা যদি নীচে নামতাম, তাহলে আমাদেরও ঠিক এই দশাই হত৷ বাহবা বুদ্ধি!’
কুমার উত্তেজিত কন্ঠে বলল, ‘দেখো বিমল, দেখো! গোমেজের আট-দশ জন সঙ্গী একেবারে প্রপাত ধরণীতলে৷ গোমেজরা গুলিবৃষ্টি করে একদিকের পথ করে নিল৷ ওই দেখো, গোমেজরা সোনার সেতুর উপরে গিয়ে উঠল৷ ওদের দলে এখন মোটে এগারো জন লোক আছে৷’
সেতুর ভিতরে খানিকদূরে বেগে ছুটে গিয়ে গোমেজ ও তার সঙ্গীরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে দুই দিকে মুখ করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল এবং তারপর দুই দিকেই শিলাবৃষ্টির মতো গুলিবৃষ্টি করতে লাগল৷
মুশকিলে পড়ল তখন পাতালবাসীরা৷ সেই বৃহৎ জনতা স্বল্প-পরিসর সেতুর ভিতর দিয়ে যথেচ্ছভাবে আর এগোতে পারল না, যারা অগ্রসর হবার চেষ্টা করল তাদেরও অনেকেই হত বা আহত হয়ে সাঁকোর উপরে পড়ে গেল,-বাকি সবাই কেউ ছুটে পালিয়ে এল এবং কেউ-বা পড়ল জলে লাফিয়ে৷
গোমেজের দল তখন বাইরের জনতার উপরে দু-চোখো গুলি চালাতে শুরু করল,- অধিকাংশ গুলিই ব্যর্থ হল না, লোকের পর লোক মাটির উপরে আছাড় খেয়ে পড়তে লাগল এবং আহতদের আর্তনাদে কান পাতা দায় হয়ে উঠল৷
কমল বলল, ‘পাতালবাসীরা আবার পালিয়ে যাচ্ছে-পাতালবাসীরা আবার পালিয়ে যাচ্ছে৷’
কুমার বলল, ‘এখন আমাদের কর্তব্য কী?’
বিমল কী বলবার উপক্রম করল, কিন্তু তার মুখ দিয়ে কথা বেরোবার আগেই সকলকার পায়ের তলায় পাথরের বারান্দা দুলে উঠল৷
প্রত্যেকেই সবিস্ময়ে নীচের দিকে তাকাল, সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই অদ্ভুত দোল৷
তারপরেই সকলে সভয়ে শুনল, সেই সীমাশূন্য গুহার গর্ত থেকে, সেই মুখ-খোলা শিখরের বাহির থেকে, অনন্ত আকাশ থেকে, সুদূর সমুদ্র থেকে কী এক গম্ভীর ভয়ংকর অনির্বচনীয় শব্দতরঙ্গের পর শব্দতরঙ্গ ছুটে-আর ছুটে-আর ছুটে আসছে! সেই ভৈরব অপার্থিব বিশ্বব্যাপী হুহুংকারের মধ্যে-জলধি-কোলাহলের মধ্যে-ক্ষীণ তটিনীর কলনাদের মতো- কোথায় ডুবে গেল বন্দুকের চিৎকার, আহতদের কান্না, জনতার ভয়ার্ত রব! ঘন ঘন দুলছে পাহাড়, ঘন ঘন দুলছে বিমলদের পায়ের তলার বারান্দা, ঘন ঘন দুলছে সমগ্র পাতালপুরী এবং উপর থেকে ঝরো-ঝরো ঝরছে ছোটো-বড়ো শিলাখণ্ড৷
ভয়ে সাদা মুখে বিনয়বাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ভূমিকম্প, ভূমিকম্প! এ-অঞ্চলের সব দ্বীপ আগ্নেয়দ্বীপ-ভূমিকম্প হচ্ছে৷ পালাও-পালাও৷’
সকলে পাগলের মতো সিঁড়ির দিকে ছুটল-পাহাড়ের দোলায় সকলেরই পা তখন টলমলিয়ে টলছে৷ তারপর সেই সংকীর্ণ সিঁড়ি বেয়ে হুড়োমুড়ি করে, কখনো হামাগুড়ি দিয়ে, কখনো দেওয়াল ধরে কখনো হোঁচট খেয়ে এবং কখনো বা পড়তে পড়তে খুব বেঁচে গিয়ে তারা যে কেমন করে উপরে উঠে গুহার বাহিরে গিয়ে দাঁড়াল, এ-জীবনে সে-রহস্য কেউ বুঝতে পারবে না!
বাইরে বেরিয়ে দেখে, সমুদ্রেরও রুদ্রমূর্তি! তার লক্ষ লক্ষ জলবাহু ঊর্ধ্বে তুলে বারংবার লম্ফের পর লম্ফ ত্যাগ করে জগৎব্যাপী একটা দুর্দান্ত বিভীষিকার মতো সে যেন উপরের বিপুল শূন্যতাকে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে, তার গর্জনে গর্জনে তালে-বেতালে বাজছে যেন বিশ্বের সমস্ত বজ্রের সম্মিলিত কন্ঠ এবং ফেনায় ফেনায় তার ফুটন্ত টগবগে জলের নীল রং আচ্ছন্ন হয়ে গেছে৷ পাহাড় সেখানেও তার জড়তাকে ভুলে জীবন্ত এক অতিকায় দানবের মতো ক্রমাগত মাথানাড়া দিচ্ছে!
বিনয়বাবু চিৎকার করলেন, ‘সমুদ্রের জল বেড়ে উঠছে, শীঘ্র পাহাড় থেকে নেমে পড়!’
ঠিক যেন একটা উৎকট দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে প্রায় বাহ্যজ্ঞানহারার মতন তারা যখন কোনোক্রমে জাহাজে এসে উঠল, দ্বীপের উপরে ভূমিকম্প তখন থেমে গেছে বটে, কিন্তু দ্বিগুণ বেড়ে উঠেছে মহাসাগরের তা থই তা থই নৃত্য৷
বিমল হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘দেখুন বিনয়বাবু, দেখুন! সমুদ্রের জল দ্বীপের প্রায় শিখরের কাছে উঠেছে!’
বিনয়বাবু বললেন, ‘কত যুগে কতবার ওই দ্বীপের সঙ্গে সমুদ্র যে এমনি ভয়ানক খেলা খেলেছে, তা কে জানে!’
কুমার বলল, ‘গোমেজের জাহাজ এখনও এখানে ছুটোছুটি করছে! কিন্তু গোমেজ তার দলবল নিয়ে আর ফিরে আসবে না!’
হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এল আকাশ-ফাটানো একটা হাহাকার! যেন হাজার হাজার ভয়ার্ত কন্ঠ একসঙ্গে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল তীব্র নিরাশায়!
কমল চমকে বলল, ‘ও আবার কাদের কান্না?’
কুমার বলল, ‘শব্দটা যেন ওই দ্বীপের দিক থেকেই আসছে!’
বিনয়বাবুর মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল৷ থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে দ্বীপের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে বদ্ধকন্ঠে তিনি বললেন, ‘বিমল, বিমল! সে ব্রোঞ্জের দরজা! সে দরজা আমরা ভেঙে ফেলেছি-তাই এতদিনের পরে যুগযুগান্তরের নিষ্ফল চেষ্টার পর-সমুদ্র প্রবেশ করেছে ওই পথে!’
বিমল অতিকষ্টে কেবল বলল, ‘সর্বনাশ!’
‘বিমল, লস্ট আটলান্টিসের শেষচিহ্নও এবারে হারিয়ে গেল! ওই শোনো পৃথিবীর প্রথম সভ্যতার শেষ আর্তনাদ! আমরা হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করলাম-আমরা মহাপাপী!’
কুমার বাষ্পরুদ্ধস্বরে বলল, ‘না বিনয়বাবু৷ আমরা না ভাঙলেও গোমেজ গিয়ে আজ ওই দরজা ভাঙত৷ আমরা নিমিত্ত মাত্র৷ আটলান্টিস আবার হারিয়ে গেল মহাকালের অভিশাপে৷’
বিনয়বাবু দুই হাতে প্রাণপণে জাহাজের রেলিং চেপে ধরে দাঁড়ালেন৷ তার কম্পিত ওষ্ঠ দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে ক্রমাগত উচ্চারিত হচ্ছিল-‘লস্ট আটলান্টিস! লস্ট আটলান্টিস৷’
_________________________________
* মৎপ্রণীত ‘মেঘদূতের মর্তে আগমন’ উপন্যাসে বিমল ও কুমার প্রভৃতির মঙ্গল গ্রহে যাত্রার আশ্চর্য কাহিনি প্রকাশিত হয়েছে৷