উপন্যাস
গল্প

নীল রঙের মানুষ

নীল রঙের মানুষ

তখন খুব ভোর। ভালো করে আলো ফোটেনি! একটু-একটু অন্ধকার আর একটু-একটু আলো মিশে একটা শরবতের রং তৈরি হয়েছে। শুধু আকাশের পূর্ব দিকটা সামান্য লালচে। একটু পরেই সূর্য উঠবে।

রণজয় বিশ্বাস নামে একজন যুবক সেই সময় নদীর ঘাটে গিয়েছিল। রণজয় প্রত্যেকদিনই খুব ভোরে ঘুমথেকে ওঠে। তারপর একা-একা নদীতে চলে আসে। তার বাড়ি থেকে নদী প্রায় দু-মাইল দূর। রণজয়ের খুব মাছ ধরার শখ। সে সারাদিন তো মাছ ধরেই, রাত্তির বেলাও নদীতে একটা ছিপ ফেলে রেখে আসে। ভোরবেলা এক একদিন গিয়ে দেখতে পায়, তার বঁড়শিতে একটা মস্তবড় মাছ ধরা পড়ে আছে।

সেদিন রণজয় নদীর দিকে এগোচ্ছে, এমন সময় আকাশে ফট করে একটা শব্দ হল। শব্দটা খুব জোর নয়, অনেকটা হাউই বাজি ফাটার শব্দের মতন। রণজয় ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখল, তার ঠিক মাথার ওপরের আকাশে, অনেক উঁচুতে কী যেন একটা জিনিস ফেটে গিয়ে খুব আলো আর আগুন বেরুচ্ছে। জিনিসটা এত উঁচুতে যে কোনও বাজি অতদূরে উঠতে পারে না। তা ছাড়া এখন তো কোনও পুজো-টুজো নেই, কে আর এখন গ্রামের আকাশে বাজি ফাটাবে!

রণজয় জানে অনেক সময় আকাশে এরোপ্লেনে আগুন ধরে যায়, তারপর সবসুদু ভেঙে পড়ে। প্রায়ই খবরের কাগজে এরকম খবর থাকে। সেই রকমই একটা কিছু হল নাকি? রণজয় আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।

যদিও খুব উঁচুতে, তবু সেই জিনিসটা ঠিক এরোপ্লেন মনে হয় না। একটা বিরাট গোল জিনিস। ফটফট করে শব্দ হচ্ছে আর সেটার এক-একটা টুকরো ভেঙে-ভেঙে ছিটকে যাচ্ছে। যদি হঠাৎ একটা টুকরো মাথায় এসে পড়ে, সেই ভয়ে রণজয় দৌড়ে তেঁতুল গাছের নীচে দাঁড়াল। তবু সে ওপরের দিকে না তাকিয়ে পারল না।

এরপর সে আর একটা আশ্চর্য জিনিস দেখল। সেই গোল জিনিসটা যখন একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে গেল, তখন দেখা গেল, সেটা থেকে বেরিয়ে কয়েকজন মানুষ হাওয়ায় ভাসছে। এত দূর থেকে তাদের খুবই ছোট দেখালেও বোঝা যায়, ওগুলো পাখি নয়।

সেই আকাশের জ্বলন্ত টুকরোগুলো ছিটকে কোনটা কোথায় চলে যাচ্ছে তার ঠিক নেই, শুধু একটা টুকরো কামানের গোলার মতন জ্বলতে জ্বলতে এসে পড়ল নদীতে। অনেকখানি জল ছিটকে উঠল আর জায়গাটা এমন ধোঁয়ায় ভরতি হয়ে গেল যে দু এক মিনিটের মধ্যে রণজয় চোখে কিছুই দেখতে পেল না। তারপর একটু পরিষ্কার হতেই দৌড়ে গেল নদীর ধারে। দেখল, নদীর মাঝখানে এক জায়গায় জলে খুব ভুড়ভুড়ি কাটছে আর একটা লোক যেন ডুবে যাচ্ছে সেখানে। লোকটার আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না, শুধু একটা হাত বেরিয়ে আছে জলের বাইরে, সেই হাতে কী যেন একটা গোল মতন জিনিস ধরা। আগুনে পুড়ে যাবার জন্যেই বোধহয় লোকটার হাতের রং মিশমিশে কালো।

রণজয় খুব ভালো সাঁতার জানে। একজন লোক ডুবে যাচ্ছে দেখে সে আর স্থির থাকতে পারল না। জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

কিন্তু রণজয় উদ্ধার করতে পারল না লোকটাকে। সাঁতরে নদীর মাঝখানে যাবার আগেই লোকটা ডুবে গেল। নদীটা খুব বড় নয়, কিন্তু জোয়ারের সময় খুব জল থাকে। কাল রাত্রেই জোয়ার এসেছে। রণজয় ডুবে ডুবে অনেক খুঁজল, কিন্তু লোকটির কোনও চিহ্ন পাওয়া গেল না। তবে, রণজয় দেখল, সেখানে সাদা রঙের একটা বল ভাসছে। এই বলটাই লোকটার হাতে ধরা ছিল। লোকটা ডুবে গেলেও বলটা ডোবেনি। রণজয় সেটা ধরে ফেলল।

বলটা খুব বড় নয়, অনেকটা ক্রিকেট বলের মতন। চকচকে কোনও ধাতু দিয়ে তৈরি, ভেতরটা ফাঁপা। জিনিসটা খুব সুন্দর, তাই রণজয় সেটা নিয়ে আবার ফিরে আসতে লাগল তীরের দিকে। একটা লোক তার চোখের সামনে ডুবে গেল, এজন্য তার মন খারাপ লাগল। পুলিসকে বোধহয় খবর দেওয়া উচিত-বড়-বড় জাল ফেলে যদি দেহটা পাওয়া যায়।

রণজয় আবার আকাশের দিকে তাকাল। সেই কয়েকজন এখনো সেখানে ওড়াওড়ি করছে। মোট পাঁচজন। পিঠে প্যারাসুট বাঁধা নেই অথচ লোকগুলো আকাশে পাখির মতন ভাসছে কী করে–এই ভেবে রণজয় আশ্চর্য হচ্ছিল, এমন সময় বহুদূর থেকে আর একটা গোল মতন জিনিস বিদ্যুৎবেগে সেখানে উড়ে এল। তার একটা দরজা খুলে যেতেই সেই পাঁচজন লোক ঢুকে গেল তার মধ্যে। সেটা আবার মিলিয়ে গেল মহাশূন্যে।

রণজয় খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে ভিজে গায়ে বসে রইল নদীর ঘাটে। কী হয়ে গেল ব্যাপারটা? গোল মতন জিনিসগুলো কী? মানুষ আকাশে ভাসে কী করে? ওরা কোথা থেকে এল, কোথায় চলে গেল? ওদের মধ্যে একজন আবার জলে ডুবে গেল কেন? সব ব্যাপারটাই কি স্বপ্ন?

কিন্তু স্বপ্ন হতে পারে না। রণজয়ের হাতে রয়েছে সেই বলটা। এরম বল সে আগে কখনো দেখেনি। জিনিসটা লোহার নয়, অ্যালুমিনিয়ামেরও নয়। জিনিসটা এমনই চকচকে যে সেটার দিকে তাকালে চোখ ঝলসে যেতে চায়। এরকম জিনিসের বল রণজয় কখনো দেখেনি। জিনিসটা যে খুব দামি সেটা বুঝতে পেরে রণজয় ঠিক করল, বলটার কথা এখন সে আর কারুকে বলবে না।

রণজয়ের এবার মনে পড়ল তার ছিপটার কথা। সেটা ধরে একটু টান দিতেই বোঝা গেল মাছ আটকেছে। তবে, বেশি বড় মাছ নয়, ছিপটা বেশ হালকা লাগছে। সে এক টান দিতেই মাছটা এসে পাড়ের ওপর পড়ল।

এবার রণজয়ের আরও অবাক হওয়ার পালা। একটা বিরাট বড় কাতলা মাছ, অন্ততঃ চার কেজি হবেই। এত বড় মাছ অথচ এত হালকা লাগল কী করে? ভাগ্যিস সুতো ছিঁড়ে যায়নি। রণজয় দুহাত দিয়ে মাছটা তুলে ধরল। তবু খুব হালকা লাগছে। এত বড় মাছ এত হালকা হয়। যাই হোক, বলটাকে প্যান্টের পকেটে লুকিয়ে রেখে রণজয় মাছটা নিয়ে বাড়ি ফিরল।

রণজয়ের বাবা একজন চাষি। রণজয় কিছুটা লেখাপড়া শিখলেও সে কোনও চাকরির চেষ্টা না করে বাবার চাষবাসের কাজেই সাহায্য করে। তাছাড়া সে গ্রামের ফুটবল টিমে ফুটবল খেলে। সামনের বছর তার বিয়ে হবার কথা।

রণজয়দের বাড়িটা মাটির তৈরি হলেও দোতলা। একে বলে মাঠকোঠা। বেশ পরিষ্কার ঝকঝকে তকতকে। বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ঢোকার সময় সে মাথায় একটা ধাক্কা খেল। রণজয় বেশ লম্বা হলেও নিজের বাড়ির দরজায় কোনওদিন আগে ধাক্কা খায়নি।

মাছটা উঠোনে ফেলে সে চেঁচিয়ে বলল, মা দেখো, আজ কত বড় একটা মাছ পেয়েছি।

রণজয়ের মা কাছেই ছিলেন, মাছটা দেখে খুব খুশি হলেন। তিনি বললেন, বাবা, এত বড় মাছ তো অনেকদিন দেখিনি! চার-পাঁচ সের হবে বোধহয়। তোর কাকার বাড়িতে খানিকটা পাঠিয়ে দেব, আর তোর মেসোমশাইয়ের বাড়িতে।

রণজয় বলল, কিন্তু এত বড় দেখতে হলে কী হয়। মাছটা কিন্তু হালকা!

মা মাছটা তোলার চেষ্টা করে বললেন, বলিস কী! হালকা কোথায়! এ তো দারুণ ভারী।

রণজয় অবলীলাক্রমে এক হাতে মাছটা ধরে উঁচু করে বলল, এই যে, দেখছ, কী রকম হালকা?

মা অবাক হয়ে রণজয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি মাছটা দেখছেন না, রণজয়ের মুখখানা দেখছেন। তারপর বললেন, তোকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে, একটু বেশি লম্বা দেখাচ্ছে কেন রে?

রণজয় হেসে বলল, আমি কি এক সকালের মধ্যেই লম্বা হয়ে গেলাম নাকি?

মা বললেন, কী জানি বাপু। কী রকম যেন লাগছে। তুই কোথাও পড়ে-উড়ে গিয়েছিলি নাকি? কপালে নীল রং হয়ে গেল কী করে?

রণজয় একটু আগে ধাক্কা খেয়েছে মাথার মাঝখানে। তার কপালে নীল রং হবে কী করে! সে অবিশ্বাস করে কপালে হাত দিল। না, কপালে কোনও ব্যথা-ঠ্যথা নেই তো!

মা বললেন, যা আয়নায় দেখে আয়! অনেকখানি নীল রঙ হয়ে গেছে!

রণজয় উঠে গেল দোতলার ঘরে। আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে দেখল সত্যিই তার কপালে একটা হালকা নীল রঙের ছাপ পড়েছে। শুধু কপালে নয়, তার মুখে আর গলাতে ও যেন হালকা নীল রঙের ভাব। সহজে বোঝা যাবে না, কিন্তু রণজয় আয়নার কাছে মুখ এনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। আর মায়েরা তো ছেলেদের শরীরের যে-কোনও বদল দেখলেই বুঝতে পারেন।

রণজয় হাত দিয়ে ঘষলো কপালটা। হাতে কোনও রং লাগল না। তা হলে কপালটা নীল হয়ে গেল কী করে?

আর একটা ব্যাপারেও রণজয় খুব অবাক হয়ে গেল। দেয়ালে ঝোলানো আয়নাটার সামনে দাঁড়ালেই সে তার মুখ দেখতে পেয়েছে সব সময়, কিন্তু এখন তাকে ঝুঁকে নিচু হয়ে দেখতে হচ্ছে। আয়নাটা তো ঠিক এক জায়গাতেই আছে। তাহলে সে কি হঠাৎ খানিকটা লম্বা হয়ে গেল? এ আবার কী অদ্ভুত ব্যাপার!

রণজয় পকেট থেকে সেই বলটা বার করল। বলটাকে দেখলেই মনে হয় খুব দামি। জিনিসটা এত চকচকে যেন মনে হয় ওর গা থেকে আলো ঠিকরে পড়ছে। তা ছাড়া, মনে হচ্ছে যেন ওটার মধ্যে কিছু একটা শব্দ হচ্ছে। ভালো করে শোনার জন্য রণজয় বলটা কানের কাছে নিয়ে এল। ঘড়ির মতন ঝিক-ঝিক শব্দ হচ্ছে ঠিকই, তবে খুবই আস্তে। তাহলে এটা বল নয়, কিছু একটা যন্ত্র।

সেটা হাতে নিয়ে রণজয় ধপ করে খাটের ওপর বসে পড়ে চিন্তা করতে লাগল। ব্যাপারটা তা হলে কি দাঁড়াল? আকাশ থেকে একটা লোক এই যন্ত্রটা হাতে নিয়ে খসে পড়ল নদীতে। বাকি লোকগুলো হাওয়ায় উড়ছিল, তারপর একটা গোল জিনিস এসে নিয়ে গেল তাদের। এসব কিছুর মানে কী?

সেদিন বিকেলের মধ্যেই রণজয় প্রায় সাত ইঞ্চি বেশি লম্বা হয়ে গেল, আর তার মুখের রঙ হয়ে গেল রীতিমতো নীল। তার বুক, হাত পায়েও নীল-নীল ছোপ। তার বাড়ির সবাই এই ব্যাপার দেখে খুব ভয় পেয়ে গেছে। নিশ্চয়ই কোনও কঠিন অসুখ হয়েছে রণজয়ের। যদিও অসুখের অন্য কোনও চিহ্ন নেই। তার গায়ের জোর হঠাৎ বেড়ে গেছে অসম্ভব। সে একটা লোহার সিন্দুকও এক হাতে তুলতে পারে। সকালবেলায় অত বড় মাছটা ওই জন্যই তার কাছে অত হালকা লেগেছিল।

নীল রঙের মুখ নিয়ে লজ্জায় সেদিন রণজয় আর বাড়ি থেকে বেরুলে না। শুয়ে শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবতে লাগল। সে কি স্বপ্ন দেখছে, না সত্যিই এসব কিছু হয়েছে? কিন্তু বলের মতন যন্ত্রটা যে হাতে রয়েছে, সেটা তো স্বপ্ন নয়! এই বলটার কথা রণজয় কারুকে এখনো বলেইনি। একবার তার মনে হল, এই বলটা নিশ্চয়ই অপয়া, এটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেই নিশ্চয়ই আবার সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু জিনিসটা এত সুন্দর যে কিছুতেই ফেলতে ইচ্ছে করে না।

রণজয়ের বাবা ডাক্তার ডাকতে চেয়েছিল, কিন্তু সে কিছুতেই রাজি হয়নি। ডাক্তার এসে তাকে দেখে গেলেই সবাই জেনে যাবে তার কথা। তার মুখের রং নীল হয়ে গেছে শুনেই সবাই দেখতে আসবে তাকে। সবাই তাকে দেখে যদি হাসে! সে পরে কলকাতায় গিয়ে বড় ডাক্তার দেখাবে।

তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে রণজয় সেদিন নিজের ঘরের আলো নিভিয়ে শুয়ে রইল। যতবার সে আয়নায় মুখ দেখেছে, ততবার মনে হয়েছে, তার মুখখানা বেশি রকম নীল হয়ে যাচ্ছে। তবে লম্বায় আর বাড়েনি। সেই সাত ইঞ্চিতেই থেমে আছে।

বলটাকে সে রেখেছে তার টেবিলের ড্রয়ারে। রাত্তিবেলা চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়ার পর রণজয় খাটে শুয়েও শুনতে পাচ্ছে সেটার ঝিক-ঝিক শব্দ। শব্দটা যেন বেড়ে যাচ্ছে মনে হয়।

রণজয় আর একবার উঠে ড্রয়ার খুলে বলটাকে দেখল। এবার আবার একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে। বলটা আপনি-আপনি ঘুরছে আর সেটা থেকে ঝলকে ঝলকে আলো বেরুচ্ছে। ঠিক যেন কীসের সিগন্যাল দিচ্ছে। সেটাতে হাত দিতে রণজয়ের ভয়-ভয় করতে লাগল। এটা কোনও সাংঘাতিক যন্ত্র নয় তো? কিংবা বোমা-টোমা যদি হয়? আজকাল মানুষ কত রকম যন্ত্র বানাচ্ছে। আমেরিকান আর রাশিয়ানরা মহাশূন্যে কত রকম পরীক্ষা যে চালাচ্ছে, তার ঠিক নেই। সেই রকমই একটা কোনও রকেট ভেঙে পড়েনি তো? কিন্তু এই যন্ত্রটা হাতে নিয়ে যে-লোকটা জলে ডুবে যাচ্ছিল, সে তো সাহেব নয়। তার গায়ের রং কালো ছিল।

হঠাৎ রণজয়ের খেয়াল হল, বোধহয় লোকটা কালো ছিল না, ওর গায়ের রং ছিল নীল। ভোরবেলার পাতলা আলোয় রণজয় ঠিক দেখতে পায়নি। অজানা ভয়ে শিউরে উঠল রণজয়। আলো জ্বেলে আবার মুখটা দেখল। সে এখন পুরোপুরি নীল রঙের মানুষ হয়ে গেছে।

হঠাৎ রাগের চোটে রণজয় বলটা তুলে নিয়ে এক আছাড় মারলো মেঝেতে। কিন্তু ভাঙলো না। একটু তুবড়েও গেল না। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, সেটা মাটিতে লাগলেও শব্দ হল না একটুও। রণজয় আরও কয়েকবার বলটা নিয়ে ড্রপ খাওয়ালো। না, এটাতে শব্দ হয় না। এটা সত্যিই একটা অদ্ভুত জিনিস। রণজয় ঠিক করল, এই যন্ত্রটা নিয়ে কোনও বৈজ্ঞানিককে দেখাতে হবে। তাদের গ্রামেরই একটি ছেলের নাম অভিজিৎ কর। সে বিজ্ঞানে খুব ভালো ছাত্র, এখন বসু বিজ্ঞান মন্দিরে গবেষণা করে। রণজয় কালই তার কাছে সব কথা খুলে বলবে।

কী মনে হল, রণজয় ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল বলটা হাতে নিয়ে। নেমে এল নিচে। মাঝ রাত, সবাই এখন ঘুমোচ্ছে। উঠোনে একটা শাবল পড়েছিল, সেটা তুলে নিয়ে চলে এল বাড়ির বাইরে। খানিকটা দূর গিয়ে একটা তাল গাছের নিচে বসে পড়ে মাটি খুঁড়তে লাগল। বেশ বড় একটা গর্ত খোঁড়ার পর বলটাকে তার মধ্যে রেখে মাটি চাপা দিল। গর্তটাকে ভালো করে বুজিয়ে নিশ্চিন্ত হল রণজয়। মাটিতে কান ঠেকিয়ে সে দেখতে চাইল, শব্দটা আর শোনা যায় কিনা! না, আর কোনও শব্দ নেই।

রণজয় উঠে দাঁড়িয়ে গায়ের ধুলোটা ঝেড়ে বাড়ি ফেরার জন্য যেই পা বাড়িয়েছে অমনি–।

রণজয় বেশ সাহসী ছেলে। ভূতের ভয় পায় না। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে তার দুটো হাত যখন কেউ চেপে ধরল, তখন ভয়ে তার মুখ দিয়ে আঁ-আঁ শব্দ বেরিয়ে এল। দুপাশে তাকিয়ে সে প্রথম কাউকে দেখতে পেল না। তারপর দেখল, দু-তিনজন লোক তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের গায়ের রং কুচকুচে কালো কিংবা নীল। তাদের একজন সরু পেনসিলের মতন একটা টর্চ জ্বালল, তারপর মাটি খুঁড়তে লাগল। একটুক্ষণের মধ্যেই সে বার করে ফেলল সেই বলটা। বলটা থেকে তখনো সেইরকম আলোর সিগন্যাল বেরুচ্ছে।

আর দুজন লোক রণজয়কে এমন চেপে ধরে আছে, যেন সে একটা চোর। কিন্তু রণজয় তোত কিছু চুরি করেনি। একবার তার ইচ্ছে হল, চেঁচিয়ে গ্রামের লোকদের ডাকে। তারপর ভাবল, দেখাই যাক না, কী হয়।

লোকগুলো তার হাত ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল। রণজয় বুঝতে পারল ওরা যাচ্ছে। নদীর দিকে। নদীর পাশের ফাঁকা মাঠে একটা বিরাট গোল জিনিস রয়েছে। আগের দিন আকাশে রণজয় এই রকমই একটা গোল জিনিস দেখেছিল। সেই জিনিসটার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর একজন বেশ লম্বা মতন নীল রঙের মানুষ। তারও হাতে একটা পেনসিলের মতন আলো। রণজয়ের আর কোনও সন্দেহ রইল না যে এরা এ পৃথিবীর মানুষ নয়।

যে তিনজন লোক রণজয়কে ধরে এনেছিল তারা লম্বা লোকটিকে কিচিরমিচির ভাষায় কী যেন বলল। লম্বা লোকটি বেশ খুশি হয়েছে মনে হল। সে রণজয়ের দিকে ফিরে তার চোখের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে রইল। লোকটা কোনও কথা উচ্চারণ করল না। কিন্তু রণজয়ের মনে হচ্ছে, লোকটা ঠিক কথা বলছে তার সঙ্গে। অর্থাৎ লোকটা মনে-মনে কথা বলছে, রণজয় ঠিক বুঝতে পাচ্ছে।

লোকটা বলছে, হে পৃথিবীর মানুষ, নমস্কার। আপনি যে আমাদের যন্ত্রটা সাবধান করে রেখেছিলেন, সে জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

রণজয় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল লোকটির দিকে।

লোকটি আবার মনে-মনে বলল, হে পৃথিবীর মানুষ, আপনার কোনও ভয় নেই। আপনি আমার সঙ্গে চলুন।

রণজয় এবার জিগ্যেস করল, আপনারা কে?

লোকটি বলল, আমরা অনেক দূর থেকে এসেছি। আপনাদের চন্দ্র সূর্য থেকেও অনেক দূরে সাত নম্বর গ্রহবলয় থেকে।

লোকটি তারপর সেই গোল জিনিসটার একটা দরজা খুলে বলল, আসুন, আপনাকে যেতে হবে আমাদের সঙ্গে।

রণজয় বলল, কেন, আমি আপনাদের সঙ্গে যাব কেন? আপনাদের জিনিস তো ফেরত পেয়ে গেছেন।

লোকটি বলল, আপনি আর এখানে থেকে কী করবেন? আপনি তো আর পৃথিবীর মানুষ নেই। আপনি তো এখন আমাদেরই একজন হয়ে গেছেন।

রণজয় রেগে গিয়ে বলল, তার মানে?

লোকটি বলল, আপনি রাগ করছেন কেন? আপনি নিজের চেহারা দেখেছেন? আপনার চেহারা বদলে গেছে। আপনি আমাদের যন্ত্রটা ছুঁয়েছিলেন, সেটা থেকে অতি নীল রশ্মি আপনার গায়ে লেগেছে। আপনাকে দেখলে পৃথিবীর মানুষ এখন ভয় পাবে। আপনাকে এখন আর এখানে কেউ আপন করে নেবে না! আপনি চলুন আমাদের সঙ্গে।

রণজয় বলল, না, আমি যাব না। আমার বাবা-মাকে কিছু না বলে আমি চলে যাব আপনাদের সঙ্গে? তা হয় নাকি?

লোকটি বলল, বাবা মা কি? বাবা মা কাকে বলে?

রণজয় বলল, বাবা-মা কাদের বলে আপনি জানেন না? আপনি কি রকম মানুষ?

লোকটি হাসতে হাসতে বলল, আমি তো মানুষ নই। আমাদের ওখানে বাবা মা বলে কিছু নেই!

রণজয়ের পাশের একজন লোক এই সময় তাকে ঠেলে সামনের দিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করল। রণজয় এক ঝটকা দিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে লোকটাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে বলল, খবরদার! আর আমার কাছে গায়ের জোর দেখাতে আসবেন না।

মাটিতে পড়ে যাওয়া লোকটি কোমর থেকে একটা পিস্তলের মতন অস্ত্র টেনে বার করল। লম্বা লোকটি তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে হাত তুলে নিষেধ করল তাকে। রণজয়ের চোখে চোখ রেখে বলল, আমাদের সঙ্গে জোর করে লাভ নেই। এই দেখুন।

লোকটি তার হাতের পেনসিলের মতন আলোটা একটা তেঁতুল গাছের দিকে ফিরিয়ে একটা বোম টিপল। সেটা থেকে এক ঝলক আগুন বেরিয়ে চোখের নিমেষে পুড়িয়ে দিল অতবড় গাছটা। অর্থাৎ ওই রকমভাবে ওরা রণজয়কেও পুড়িয়ে ফেলতে পারে।

লোকটি আবার বলল, আপনাকে আমরা মারতে চাই না। আমাদের একজন এই পৃথিবীতে জলে ডুবে মারা গেছে, তাই এখান থেকে আমরা একজনকেও নিয়ে যাব, তাতে দোষের তো কিছু নেই। আপনি আপত্তি করছেন কেন? আপনাকে আমরা যত্ন করেই রাখব।

রণজয় তবু জোর দিয়ে বলল, আমি যাব না। আমি কিছুতেই যাব না। যেখানকার লোকেরা বাবা-মা কাকে বলে তাই জানে না, সে রকম অদ্ভুত বিচ্ছিরি জায়গায় আমি কিছুতেই যাব না।

লোকটি বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, আপনার জন্য আমরা না হয় বাবা মা তৈরি করে দেব। এমন কিছু শক্ত নয়।

রণজয় বলল, বাবা-মা আবার তৈরি করা যায় নাকি? কী বুদ্ধি আপনার।

এবার দুজন লোক এক সঙ্গে চেপে ধরল রণজয়কে। রণজয় একটা ঘুষি মারল একজনের মুখে। সে ছিটকে যেতেই রণজয় অন্যজনের পেটে ছুঁ মারল মাথা দিয়ে। এখন যেন তার গায়ে অসুরের মতন শক্তি।

কিন্তু যতই জোর থাক চারজন একসঙ্গে আক্রমণ করায় সে আর পারল না। পড়ে গেল মাটিতে। একজন তার বুকে চেপে বসে নাকের ওপর ঘুষি মারতেই সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল তার চোখে!

রণজয় কয়েক মুহূর্তের জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। আবার চোখ মেলে দেখল, লোকগুলো তাকে ছ্যাচড়াতে-ছ্যাচড়াতে নিয়ে যাচ্ছে সেই গোল জিনিসটার দিকে। তারপর ধরাধরি করে তাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। রণজয়ের আর নিস্তার নেই। তাকে চলে যেতে হবে কোন অচেনা অদ্ভুত জায়গায়। এই পৃথিবীকে আর দেখতে পাবে না।

লম্বা লোকটি তখন ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছে, রণজয় শেষ শক্তিতে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। লম্বা লোকটিকে এক ধাক্কা দিয়ে সে লাফিয়ে পড়ল মাটিতে। লম্বা লোকটিও নিচে পড়ে গেছে। কিন্তু সে ওঠবার আগেই রণজয় দৌড়াতে শুরু করল নদীর দিকে। হঠাৎ তার মনে পড়েছে, নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লেই সে একমাত্র বেঁচে যেতে পারে। জলের মধ্যে এদের আগুন অস্ত্র কোনও কাজে লাগবে না। তা ছাড়া এরা বোধহয় সাঁতার জানে না। এদের একজন জলে ডুবে মরেছে।

লম্বা লোকটি রণজয়কে প্রায় ধরে ফেলেছিল, তার আগেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে। সে এত ভালো সাঁতার জানে যে এরা জলে নামলেও তাকে ধরতে পারবে না। রণজয় এক ডুব দিয়ে চলে গেল জলের গভীরে। অনেকখানি দূরে গিয়ে সে যখন দম নেবার জন্য আবার মাথা তুলল, দেখতে পেল যে লম্বা লোকটির পাশে অন্য লোকগুলোও। এসে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু তারা জলে নামেনি। ওরা বিজ্ঞানে এত বেশি উন্নতি করেছে বটে, তবু জলকে ভয় পায়। হয়তো ওদের গ্রহে এরকম নদীই নেই।

লোকগুলো কিছুক্ষণ সেইখানে অপেক্ষা করে তারপর আবার ফিরে গেল গোল জিনিসটার কাছে। একটু বাদেই সেটা উড়তে উড়তে চলে এল নদীর ওপরে। রণজয়ের ঠিক মাথার কাছে। রণজয় আবার ডুব দিল। শোঁ-শোঁ করে ডুব সাঁতার কেটে এগিয়ে যেতে লাগল স্রোতের সঙ্গে। আবার মাথা তুলতেই গোল জিনিসটা তেড়ে এল তার দিকে, সেটা থেকে একটা দড়ির ফঁস ঝুলছে। যেন মাছের মতন রণজয়কে গেঁথে জল থেকে তুলে নেবে। বুক ভরতি নিশ্বাস নিয়ে রণজয় ডুবে গেল অনেক নিচে।

বহুক্ষণ পর্যন্ত চলল এইরকম। রণজয় হাঁপিয়ে গেছে, দম ফুরিয়ে যাচ্ছে, তবু সে হার মানবে না।

ভোরের আলো ফুটে ওঠবার সঙ্গে-সঙ্গে এ লড়াই শেষ হল। গোল জিনিসটা আর অপেক্ষা করল না, সোজা উঠে গেল ওপরের দিকে। কী অসম্ভব তীব্র গতি। প্রায় চোখের নিমেষে মিলিয়ে গেল মহাশূন্যে।

আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর নিশ্চিন্ত হয়ে রণজয় আস্তে-আস্তে চলে এল তীরের দিকে। ওপরে উঠে সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। এত ক্লান্ত যে সে ধপ করে মাটিতে পড়ে গিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে রইল।

আকাশ এখন পরিষ্কার। অল্প-অল্প আলো ফুটেছে, তারারা সব বিদায় নিচ্ছে। ভোরের আকাশ কী সুন্দর দেখায়। অথচ ওই আকাশে কত রকম রহস্য আছে কে জানে। ওই আকাশে বেড়াতে যেতে কার না ইচ্ছে হয়। কিন্তু ওই লোকগুলো তাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল এমন একটা জায়গায়, যেখানে নদী নেই। যেখানকার লোক মা-বাবা কাকে বলে জানে না। সেখানকার চেয়ে এই পৃথিবী অনেক ভালো।

তারপর রণজয় তাকাল নিজের হাত পায়ের দিকে। তার সারা শরীর এখন নীল। সে এখন আর মানুষের মতন নয়। কেউ আর তাকে আপন করে নেবে না। হয়তো ছেলেরা তাকে দেখে ঢিল ছুঁড়বে। বাচ্চারা তাকে দেখে ভয় পাবে। রণজয়ের কান্না পেয়ে গেল। একা-একা খানিকক্ষণ কাঁদল সে। তারপর চোখ মুখে ভাবল, আর যে যাই ভাবুক, আমার মা-বাবাও কি আমাকে দূরে সরিয়ে রাখবে? না, তা হতেই পারে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *