নীল মানুষের মন খারাপ

নীল মানুষের মন খারাপ

গভীর জঙ্গল, এখানে মানুষ প্রায় আসেই না, দু’একজন কাঠুরে বা শিকারী দৈবাৎ এসে পড়লেও ভূতের ভয়ে পালিয়ে যায়। লোকের মুখে মুখে রটে গেছে যে ওই জঙ্গলে ভূত আছে। কেউ কেউ বলে, ভূত নয়, ব্রহ্মদৈত্য।

এই জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে একটা হাইওয়ে গেছে, সেখান দিয়ে ট্রাক যায়, অন্য গাড়ি যায়। কিন্তু কোনো গাড়ি কখনো থামে না এই জায়গায়। বিশেষত একটা পাহাড়ের গা দিয়ে যখন যেতে হয়, তখন ড্রাইভাররা রামনাম জপ করে। ওই পাহাড়ের আড়াল থেকে দিনে দুপুরেও একটা প্রকাণ্ড ভূতকে মুখ বাড়াতে নাকি দেখেছে কেউ কেউ।

সেই ভূত আসলে নীল মানুষ।

জঙ্গলের মধ্যে সংসার পেতে নীল মানুষ এমনিতে বেশ ভালোই আছে। তার ছোট্ট বন্ধু গুটুলি নানা রকম মজার কথা বলে। তাদের সেবা করবার জন্য রয়েছে তিন তিনটে কাজের লোক। রঘু, দামোদর আর ন্যাড়া গুলগুলি। এরা কুটনো কোটে, রান্না করে, বাসন মাজে, পা টিপে দেয়। ওই তিনজনকে দিয়ে গুটিলি আবার একটা পুকুরও কাটাচ্ছে। ওরা খন্তা—শাবল নিয়ে রোজ সকালে কয়েক ঘণ্টা করে পুকুর খোঁড়ার কাজ করে, কাছে দাঁড়িয়ে গুটুলি খবরদারি করে ওদের ওপর।

রঘু, দামোদর আর ন্যাড়া গুলগুলি আগে ছিল দুর্ধর্ষ ডাকাত। এখন তারা নীল মানুষের চেয়ে গুটুলিকেও কম ভয় পায় না। গুটুলির গাঁটে গাঁটে বুদ্ধি। এর মধ্যে ওরা পাঁচবার পালাবার চেষ্টা করেছে। পাঁচবারই গুটুলির বুদ্ধিতে ধরা পড়ে গেছে। প্রত্যেকবার ধরা পড়লেই ওদের শাস্তির মেয়াদ বেড়ে যায়।

সব কিছুই ঠিকঠাক চলেছে, তবু এক একদিন নীল মানুষ ছটফট করে ওঠে।

মাটিতে চিৎপাত হয়ে শুয়ে সে কান্না কান্না গলায় বলে, গুটুলি, ও গুটুলি! আমার কিছু ভালো লাগছে না!

গুটুলি ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, কেন, তোমার কী হলো, নীল মানুষ? শরীর খারাপ লাগছে?

নীল মানুষ একটা ঝড়ের মতো দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে উত্তর দিল, শরীর নয়, মন! আমার তো কখনো শরীর খারাপ হয় না!

গুটুলি জিজ্ঞেস করলো, কেন তোমার মন খারাপ লাগছে? নতুন কিছু খেতে ইচ্ছে করছে?

নীল মানুষ বললো, ধুৎ! খাওয়ার কথা কে বলছে। দিনের পর দিন জঙ্গলে পড়ে থাকতে কারুর ভালো লাগে?

গুটুলি বললো, আমার তো খুব ভালো লাগে। আমি এত বেঁটে বলে শহরে গেলেই লোকে আমাকে ঠাট্টা করে, মাথায় চাঁটি মারে, আমার জিনিসপত্র কেড়ে নেয়। তার চেয়ে এই জঙ্গলেই বেশ ভালো।

নীল মানুষ বললো, বেঁটে বলে তোমায় দেখে সবাই ঠাট্টা করে, আর এত লম্বা বলে আমায় দেখে সবাই ভয় পায়। কিন্তু আমি তো লেখাপড়া শিখেছি। আমার ইচ্ছে করে শহরে গিয়ে সিনেমা—থিয়েটার দেখতে, গান শুনতে, লোকজনের সঙ্গে মিশতে।

গুটুলি বললো, সে আর তুমি এজন্মে পারবে না। তুমি তো শুধু লম্বা নও, তুমি যে তালগাছ। তুমি এখনও রোজ রোজ লম্বা হচ্ছো। তোমায় আমি প্রথম যে—রকম দেখেছিলুম, তারচেয়েও তুমি এখন বেশি লম্বা হয়ে গেছ। মাপলে বোধ হয় দশ ফুটেরও বেশি হবে। তার ওপরে তোমার গায়ের রং একেবারে আকাশের মত নীল, এমনকি তোমার জিভটা পর্যন্ত নীল। তোমায় দেখলে তো মানুষ ভয় পাবেই।

—আমি যদি শহরে গিয়ে সামনে হাত জোড় করে বলি, ওগো, যদিও আমার শরীরটা এত লম্বা আর গায়ের রংটা অন্য রকম, কিন্তু আমি তোমাদের মতনই সাধারণ মানুষ। আমি কারুর ক্ষতি করতে চাই না।

—তোমার কথা শোনবার আগেই সবাই ভয়ে পালাবে। কিংবা শুনলেও বুঝতে পারবে না। তোমার গলার আওয়াজটা যে এখন জয়ঢাকের মতন হয়ে গেছে। আমিই শুধু বুঝতে পারি।

—যদি ফিসফিস করে বলি? হাঁটু গেড়ে বসে সবার কাছে ক্ষমা চাই?

—তা হলে ওরা তোমাকে বেঁধে চিড়িয়াখানায় ভরে দেবে।

—কেন?

—তোমাকে আর কেউ মানুষ বলে মানবে না! ভাববে অন্য কোনো জন্তু।

নীল মানুষ পাশ ফিরে হু হু করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো, ওহো হো, কেন আমায় মানুষ বলে মানবে না? আমি মানুষ, মানুষ! ওহো হো, কতদিন ফুটবল খেলা দেখেনি। কতদিন ফুটবল খেলিনি। একসময় আমি ফুটবল খেলতে কী ভালোই না বাসতাম।

নীল মানুষের দু’চোখ দিয়ে কলের জলের মতন গলগল করে কান্না ঝরতে লাগলো।

গুটুলি একটা গামছা দিয়ে তার চোখ মুছে দিতে দিতে বললো, আহা, কেঁদো না, কেঁদো না। লক্ষ্মী ছেলে, তোমার জন্য আমি ফুটবল এনে দেবো। তুমি এইখানেই ফুটবল খেলবে?

নীল মানুষ ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো, কার সঙ্গে খেলবো? একা একা বুঝি ফুটবল খেলা যায়।

—ওই রঘু, দামোদর আর ন্যাড়া গুলগুলি খেলবে তোমার সঙ্গে।

—দুর দুর, ওরা তো ছিল ডাকাত, ওরা ফুটবল খেলার কী জানে?

—একেবারে জন্ম থেকেই তো ডাকাতি শুরু করেনি। ছোটবেলায় ফুটবল খেলেছে নিশ্চয়ই।

—যারা ছোটবেলায় ফুটবল খেলে, তারা বড় হয়ে কখনো ডাকত হয় না। ফুটবল খেললে মন ভালো হয়ে যায়।

—ওদের ডেকে জিজ্ঞেসই করা যাক না, ওরা ফুটবল দেখা জানে কি না?

ডাকা হলো রঘু, দামোদর আর ন্যাড়া গুলগুলিকে। ওরা জল—কাদা মাখা হাত—পা নিয়ে লাইন করে দাঁড়ালো সামনে।

নীল মানুষ শুয়েই আছে মাটিতে। গুটুলি একটা গাছের গুঁড়ির ওপর বসে জিজ্ঞেস করলে, অ্যাই, তোরা কেউ ফুটবল খেলা জানিস?

হঠাৎ এরকম একটা প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল তিন ডাকাত। এ ওর মুখের দিকে তাকালো। হ্যাঁ কিংবা না কোন উত্তরটা দিলে ভালো হবে, তাই—ই বুঝতে পারছে না।

ন্যাড়া গুলগুলি ফস করে বলে ফেললো, হ্যাঁ। আমি অনেক ফুটবল খেলেছি। এ গ্রামে ও গ্রামে খেলতে গেছি। কত গোল দিয়েছি।

গুটুলি চোখ পাকিয়ে বললো, তা হলে লোকের পেটে ছুরি মারতে শিখলি কখন?

ন্যাড়া গুলগুলি লজ্জা পেয়ে কান চুলকে বললো, সে আমাকে অন্য একজন গুরু শিখিয়েছিল। কিন্তু ফুটবল খেলা আমি ভালোই জানি।

দামোদরই বা কম যাবে কেন? সে ঠোঁট উল্টো বললো, ফুটবল মানে ওই গোল গোল বলে লাথি মারা তো? সে আমি অনেক লাথিয়েছি।

রঘু ওদের চেয়ে আর একটু বড় ডাকাত। সে বললো, ও আর কী খেলেছে। আমি আমাদের গ্রামে খেলুড়ে দলের সর্দার ছিলাম। আমার দলকে খেলার জন্য কত জায়গা থেকে ডেকে নিয়ে যেত। সে অবশ্য গোঁফদাঁড়ি ওঠার আগের কথা।

গুটুলি বললো, আর গোঁফ দাঁড়ি গজাবার পর থেকেই বুঝি ডাকাতি শুরু করলি।

রঘু লজ্জা পেয়ে ভিত কেটে বললো, বারাবার ওই কথা বলে লজ্জা দাও কেন, গুটুলি দাদা? সে সব তো এখন ছেড়ে দিয়েছি।

গুটুলি বললো, ছেড়ে দিয়েছিস, না সুযোগ পাস না। যাক গে, যা এখন পুকুর কাটতে যা। এই নিয়ে পরে আবার কথা হবে।

ওরা চলে যাবার পর গুটুলি নীল মানুষকে বললো, তা হলে দেখলে তো? ওরা তিনজনেই একসময় খেলেছে বললো। আমি আজই বল জোগাড় করছি। তুমি খেলার মাঠটা ঠিক করবে চলো। ওঠো ওঠো, ওরকম মন খারাপ করে শুয়ে থাকতে নেই।

পাহাড়ের একপাশে খানিকটা ঢালু জায়গা। প্রায় সমতলই বলা যায়, মাঝে মাঝে কয়েকটি ছোটোখাটো গাছ রয়েছে সেই জায়গাটা পছন্দ হলো দু’জনেরই। নীল মানুষ পট পট করে গাছগুলো উপড়ে ফেললো। শুধু মাঠের দু’ধারে ছোট গাছ রইলো। সেই দুটো হবে গোল পোস্ট।

গুটুলি বললো, আজ রাতেই আমি বল জোগাড় করে আনছি। কাল খেলা হবে। আজ ভালো করে খেয়েদেয়ে ঘুমোও, মন খারাপ করে থেকো না। মন খারাপ থাকলে ভালো করে খেলা যায় না।

বিকেলের দিকে রঘু আর দামোদরকে নিয়ে গুটুলি চলে গেল শহরে।

যাবার পথে গুটুলি বললো, এই, তোরা আবার যেন পালাবার চেষ্টা করিস না। তাহলে এবার কিন্তু ধরে এনে কান কেটে দেবো।

দামোদর বললো, আরে ছি ছি, এখন পুকুর কাটা বন্ধ রেখে ফুটবল খেলতে বলছো, এখন কেউ পালায়? খেলাটা কত আমোদের জিনিস।

রঘু বললো, এক হিসেবে জঙ্গলে আটকে রেখে তুমি আমাদের উপকারই করেছো, গুটুলি দাদা। বছর খানেক এখানে থাকলে পুলিশ আমাদের কথা ভুলে যাবে। তখন নিশ্চিন্তে ফেরা যাবে, কী বলো?

জঙ্গল থেকে ওরা একটা হরিণ মেরে এনেছিল, শহরে এসে সেই মাংস বিক্রি করে যা টাকা পাওয়া গেল, তাতে ফুটবল কেনা হলো, আরও চা—বিস্কুট, নুন—মশলা, অন্য খাবার—দাবার কেনা হলো।

খেলা আরম্ভ হলো পরের দিন সকালে। বেশ সুন্দর রোদ উঠেছে, বেশি জোর হাওয়া নেই, ফুটবল খেলার পক্ষে বেশ ভালো দিন। একদিকে নীল মানুষ, আর একদিকে তিন ডাকাত। গুটুলি হলো রেফরি। সে একটা হুইশলও কিনে এনেছে।

ন্যাড়া গুলগুলি কিছুতেই সামনে আসতে চায় না, সে দামোদরের পেছনে লুকোচ্ছে। দামোদর তাকে বলছে, এই ঠেলছিস কেন, আমাকে ঠেলছিস কেন? রঘু বুক ফুলিয়ে বললো, তোরা সোজা হয়ে দাঁড়া, আগে থেকেই ভয় পাচ্ছিস কেন?

মাঝখানে বলটা রেখে গুটুলি হুইশল বাজাতেই তিন ডাকাত পিছিয়ে গেল অনেকটা। তারা নীল মানুষের কাছাকাছি গিয়ে বলে পা ছোঁয়াতে সাহস পায়নি।

গুটুলি ধমক দিয়ে বললো, ও কি হচ্ছে। মন দিয়ে খেলবি সবাই।

নীল মানুষ বলে একটা শট লাগালো।

অমনি সেটা চোখের নিমেষে প্রায় আকাশে উড়ে চলে গেল পাহাড় পেরিয়ে।

তিন ডাকাত হাঁ করে ওপরের দিকে চেয়ে রইলো। নীল মানুষ বললো, যাঃ, ও কি হলো? বলটা চলে গেল।

গুটুলি বললো, তাতে চিন্তার কিছু নেই। আমি আরও বল এনে রেখেছি। চিন্তার কিছু নেই। তবে নীল মানুষ, একটু আস্তে খেলো। ফুটবল খেলাটা তো আর গায়ের জোরের ব্যাপার নয়। একটু আস্তে।

আর একটা বল সে রঘুদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললো, এইবার তোমাদের দিক থেকে মারো।

রঘু বললো, দামোদর, তুই মারবি নাকি?

দামোদর বললো, ন্যাড়া গুলগুলিকে দাও। ও ভালো খেলে বলেছিল।

ন্যাড়া গুলগুলি বললো, আমার বল ওই দৈত্যের গায়ে লাগলে যদি সে চটে যায়। ও সবের মধ্যে আমি নেই।

দামোদর রঘুকে বললো, ওস্তাদ, তুমি আমাদের সর্দার, প্রথম বলটা তুমিই মারো।

রঘু বললো, তোরা সব ভীতুর ডিম। দ্যাখ আমি কেমন মারতে পারে। এটা হচ্ছে খেলা।

সাধারণ মানুষের তুলনায় রঘুর গায়ে বেশ জোর। সে কষে একটা ফ্রি কিক ঝাড়লো বলটাকে, সেটাও বেশ অনেক উঁচুতে উঠলো।

নীল মানুষ খুশি হয়ে বললো, বাঃ বাঃ, এই তো চাই।

সে লাফিয়ে হেড করতে গেল বলটাকে। তার মাথায় লেগেই বলটা ফটাস করে ফেটে গেল।

নীল মানুষ বললো, ওই যাঃ, কী হলো?

গুটুলি বললো, তাতে কিছু হয়নি, তাতে কিছু হয়নি। আরও বল আছে। কিন্তু তোমার আবার লাফিয়ে হেড করার কী দরকার ছিল, বলটা তো এমনিই এসে তোমার মাথায় লাগতো।

আর একটা বল সে ছুঁড়ে দিয়ে বললো, এবারে একটু আস্তে মারো, নিচু করে মারো।

নীল মানুষ বললো, এবারে খুব আস্তে, আলতো করে মারবো। এই দ্যাখো।

বলটা সে নিচু করে মারলো ঠিকই, সেটা এসে লাগলো রঘুর পেটে, কিন্তু তাতে বলটা থামলো না। রঘু বলটা সমেত উড়ে গিয়ে ধাক্কা খেল পেছনের গোল পোস্ট গাছটায়। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান।

দামোদর আর ন্যাড়া গুলগুলিও মাটিতে শুয়ে পড়ে চ্যাঁচাতে লাগলো, ওরে বাবারে, আমরা আর খেলবো না, আমাদের ছেড়ে দাও, আমরা পুকুর কাটবো, ফুটবল খেলতে পারবো না। ওরে বাবা রে…

নীল মানুষ গুটুলির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো, এটা আমার গোল হয়েছে না হয়নি?

গুটুলি তাকে মৃদু ধমক দিয়ে বললো, তুমি বড্ড ফাউল করো। আর খেলা হবে না। দেখি রঘু বেচারার কী হলো।

আর খেলা হবে না? আর খেলা হবে না বলতে বলতে নীল মানুষ হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো। তারপর মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে পড়ে কাঁদাতে কাঁদতে বলতে লাগলো, খেলা হলো না, খেলা হলো না আমার। কিছু ভালো লাগে না।

রঘুর মাথায় জল ঢেলে তার জ্ঞান ফেরানো হলো। তারপর তিন ডাকাতই দৌড়ে খেলার মাঠ ছেড়ে পুকুর কাটতে চলে গেল স্বেচ্ছায়।

সেই থেকে নীল মানুষের আরও মন খারাপ হয়ে গেল। সে কিছু খেতেও চায় না, কারুর সঙ্গে কথাও বলে না। শুধু গাছতলায় শুয়ে শুয়ে কাঁদে।

গুটুলি তিন ডাকাতকে ধমক দিয়ে বলল, ছি, ছি, ছি, তোরা কী বলতো। তোরা কি মানুষ! ছেলেটা একটু ফুটবল খেলতে চেয়েছিল, তোরা তাও খেলতে পারলি না? এই মুরোদ নিয়ে তোরা ডাকাত হয়েছিলি?

রঘু আর দামোদর লজ্জায় মাথা নিচু করে রইলো। ন্যাড়া গুলগুলি হাত জোড় করে বললো, দাদা, আর যা করতে বলো সব পারবো, কিন্তু ওই খেলার কথা উচ্চারণ করো না। বাবারে, এখনও আমার বুক কাঁপছে।

পরপর দু’দিন নীল মানুষ কিছু না খেয়ে রইলো আর কাঁদলো। গুটুলির কোনো কথাও সে শোনে না।

গুটুলি দেখলো এইরকম ভাবে আর কয়েকদিন চললে তো মহাবিপদ হবে। না খেয়ে খেয়ে নীল মানুষ খুব দুর্বল হয়ে যাবে আর সেই সুযোগে রঘু—দামোদরেরা যদি পালাবার চেষ্টা করে, তখন আর তাদের আটকানো যাবে না। এমনকি ওরা তখন নীল মানুষকে মেরে ফেলারও ব্যবস্থা করতে পারে।

সে তখন নীল মানুষের কানের কাছে মুখে এনে বললো, তোমার নিজের খেলা তো হলো না। কিন্তু তুমি ফুটবল খেলা দেখবে বলেছিলে, চলো আমরা শহরে ফুটবল খেলা দেখতে যাবো। শহরে যাবো!

নীল মানুষ বললো, আমি শহরে গেলে আর কেউ খেলবে। সবাই তো ভয়ে পালাবে।

গুটুলি বললো, সে ভার আমার ওপর ছেড়ে দাও। আমি যদি তোমায় ফুটবল খেলা দেখাতে না পারি, তা হলে আমার নামে তুমি কুকুর পুষো। আমি আর কোনোদিন তোমার কাছে মুখ দেখাতে আসবো না। এখন ওঠো, উঠে চাট্টি খেয়ে নাও তো লক্ষ্মীটি।

নীল মানুষ তখন ভূমিশষ্যা ছেড়ে উঠলো। নদীতে গিয়ে স্নান করলো। তারপর দু’দিনের খাওয়া একসঙ্গে খেয়ে মেঘ গর্জনের মতন একটি ঢেঁকুর তুলে বললো, আঃ। এবার দশ খিলি পান দাও তো।

তিন ডাকাত সঙ্গে সঙ্গে পান সাজতে বসলো।

কিন্তু কী করে যে নীল মানুষকে ফুটবল খেলা দেখানো হবে, তা আর গুটুলির মাথায় আসে না। যে—শহরটায় তারা জিনিসপত্তর কেনাকাটি করতে যায়, সেখানে মাঝে মাঝে ফুটবল খেলা হয় বটে। বাইরের টিমও খেলতে আসে। কিন্তু ফুটবল খেলা তো আর রাত্তিরে হয় না। দিনের আলো থাকতে থাকতে শেষ হয়ে যায়। দিনের আলোয় নীল মানুষকে নিয়ে সেই শহরে যাবার চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই। নীল মানুষকে দেখলেই সবাই বাড়িঘর ছেড়ে পালাবে।

একদিন যায়, দু’দিন যায়, তিন দিন যায়। নীল মানুষ রোজই জিজ্ঞেস করে কী গো গুটুলি, আমার ফুটবল খেলা দেখার কী হলো?

গুটুলি হাত তুলে বলে, হবে, হবে, ঠিকই হবে, আমাকে একটু সময় দাও।

জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে যে হাই—ওয়েটা গেছে, গুটুলি প্রায় সেই রাস্তাটার কাছে গিয়ে একটা পাথরের আড়ালে বসে থাকে। তখন কত রকম গাড়ি যায়, সে লক্ষ্য করে। ট্রাক, মোটরগাড়ি বাস। কত রকম মানুষ। কেউ এই জায়গাটায় থামে না।

একদিন সকালে একটা ট্রাকে করে একদল ছেলে যাচ্ছে, হঠাৎ তারা দেখলো রাস্তার মাঝখানে একটা বড় পাথরের চাঁই। ট্রাকটা আর যেতে পারবে না। ছেলের দল হৈ হৈ করে উঠলো। গতকাল বিকেলে তারা এই পথ দিয়ে গেছে, তখন এরকম কোনো পাথর ছিল না। তারা ড্রাইভারকে বললো, ব্যাক করো। ব্যাক করো। গাড়ি ঘোরাও। এটা ভূতের জায়গা।

ড্রাইভার গাড়ি ঘোরাতে গিয়ে দেখলো, পেছন দিকেও রাস্তায় এখন ওই রকম আর একটা পাথর। সেদিকেও যাবার উপায় নেই।

ছেলেরা তখন ট্রাক থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে সবাই মিলে একটা পাথর ঠেলে সরাবার চেষ্টা করলো।

তখন একটা হুইশল বেজে উঠলো। রেফারির পোশাকে একটা ফুটবল বগলে নিয়ে গুটুলি হাজির হলো সেখানে। এক হাত তুলে হাসি মুখে সে বললো, ওহে ছেলের দল, আজ তোমাদের এখানে নেমন্তন্ন। তোমরা তো শহরে ফুটবল খেতলে গিয়েছিলে, এবারে আমাদের টিমের সঙ্গে একটা ম্যাচ খেলে যাও।

কয়েকটা ছেলে চেঁচিয়ে উঠলো, ভূত! ভূত! এই তো সেই ভূত।

আর কয়েকটা ছেলে বলল, দূর, এ তো একটা বেঁটে বাঁটকুল। এ ভূত হলেও একে আমরা পরোয়া করি না।

গুটুলি বললো, ভূত—টুত কিছু নেই। তোমরা এই জঙ্গলের মধ্যে এসে একটা ম্যাচ খেলবে। তারপর খাওয়া—দাওয়া করবে। ফিরে এসে দেখবে রাস্তা পরিষ্কার! এসো, ভয় পাচ্ছো কেন?

ওই ছেলেদের যে ক্যাপ্টেন, সে বললো, খেলার ব্যাপারে আমাদের কেউ চ্যালেঞ্জ জানালে মোটেই ভয় পাই না। চুনী গোস্বামী, পি কে ব্যানার্জি হলেও লড়ে যেতে রাজি আছি। তোমাদের কেমন টিম, বলো তো দেখি।

রাস্তা ছেড়ে ওরা ঢুকে এলো বনের মধ্যে। গুটুলি ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এলো খেলার মাঠে।

ক্যাপ্টেন বললো, কই, তোমাদের খেলোয়াড় কোথায়?

গুটুলি আর একটা হুইশল বাজাতেই বেরিয়ে এলো রঘু, দামোদর আর ন্যাড়া গুলগুলি। তারা পরেছে হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জি। তারা মার্চ করে গিয়ে দাঁড়ালো মাঠের এক দিকে।

এদিকের ক্যাপ্টেন অবজ্ঞার সঙ্গে বললো, এই তোমাদের টিম। আর খেলোয়াড় কই?

গুটুলি বললো, আগে এই টিমকেই হারাও তো দেখি, তারপর আমার অন্য টিম বার করবো।

ক্যাপ্টেন বললো, তুমি কে হে বাপু? এই জঙ্গলের মধ্যে শুধু শুধু আমাদের আটকিয়ে এখানে নিয়ে এলে? আমাদের ক্লাবের নাম ইলেভেন বুলেটস। আমরা এই জেলার চ্যাম্পিয়ন। এই তিনটে লোকের সঙ্গে আমরা কী খেলবো? এ তো ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ।

ওদিক থেকে রঘু সর্দার বললো, ওহে, খুব যে বড় বড় কথা বলছো? খেলেই দেখো না, কটা গোল দিতে পারো।

ক্যাপ্টেন বললো, এগারো মিনিটে বাইশটা গোল দেবো, দেখবে?

গুটুলি বলটা মাঠের মাঝখানে ছুঁড়ে দিতেই ক্যাপ্টেন একাই বলটা নিয়ে ড্রিবল করতে করতে রঘু, দামোদর আর ন্যাড়া গুলগুলিকে তিনটে ল্যাং মেরে শুইয়ে দিয়ে ওপাশের গাছটার গায়ে বলটা ঠেকিয়ে বললো, এই নাও এক গোল।

অমনি কোথায় যেন ধুপ ধাপ ধুপ ধাপ শব্দ হলো।

ক্যাপ্টেন চমকে উঠে বলল, ওকি? ও কিসের শব্দ!

গুটুলি বললো, ও কিছু না ও কিছু না, আমাদের একজন সাপোর্টার হাততালি দিচ্ছে।

ক্যাপ্টেনের মুখখানা হাঁ হয়ে গেল, সে বললো, ওই আওয়াজ, ওই তোমাদের সাপোর্টারের হাততালি? কোথায় তোমাদের সেই সাপোর্টার?

গুটুলি বললো, ও নিয়ে তোমাদের চিন্তা করতে হবে না। নাও—নাও, আবার খেলা শুরু করো।

ক্যাপ্টেন ফিরে এসে আর একজনকে বললো, নে, এবার তুই গোল দিয়ে আয়।

দ্বিতীয় গোলটা অবশ্য তত সহজ হলো না। দামোদর—রঘু—ন্যাড়া গুলগুলি যথেষ্ট ফাইট দিল, এমনকি ন্যাড়া গুলগুলি বলটা পায়ে নিয়ে এদের দিকে অনেকটা এগিয়েও এসেছিল, কিন্তু হঠাৎ মেঘের ডাকের মতন বাঃ বাঃ শব্দ শুনেই সে এমন চমকে গেল যে বল বেরিয়ে গেল তার পা থেকে। এবারেও তারা গোল খেল।

এইরকম ভাবে পরপর এগারোটা গোল খাবার পর এদিককার ক্যাপ্টেন বললো, গোল খেয়ে পেট ভরেছে, না আরও চাও?

রঘু সর্দার বললো আর চাই না। যথেষ্ট হয়েছে। কী বলো গুটুলিদা।

গুটুলি বললো, হ্যাঁ, এবারে তোমরা সরে যাও। এবারে আমাদের আর একজন খেলোয়াড় আসবে। তোমরা তার সঙ্গে একটু খেলে দ্যাখো তো বাপু।

গুটুলি আবার হুইঁশল বাজাতেই গাছপালার আড়াল থেকে এক লাফে এসে হাজির হলো নীল মানুষ। তার মাপের তো কোনো প্যান্ট হয় না। তাই সে একটা ধুতি মালকোছা মেরে পরেছে। আর খালি গা। সে এসেই হাত জোড় করে বললো, বেশি জোরে বল মারবো না। খুব আস্তে আস্তে, কোনো ভয় নেই।

কিন্তু তার কথা কে শুনবে। ওদিককার এগারো জন খেলোয়াড়ই অজ্ঞান।

নীল মানুষ বললো, এ কী হলো? আর খেলা হবে না? ওদের গোল শোধ দেওয়া হবে না?

গুটুলি এক ডজন ফুটবল নিয়ে এসে বললো, খেলা দেখার শখ ছিল, সে শখ তো মিটেছে? এ নাও, এবারে একটা একটা করে মারো, ওদের গোল শোধ দাও।

পরপর বারোখানা বলে কিক কষিয়ে ওপারে পাঠিয়ে নীল মানুষ হাসি মুখে বললো, শোধ দেবার পরেও একখানা বেশি।

গুটুলি বললো, যথেষ্ট হয়েছে। এবারে তুমি রাস্তার ওপারের পাথর দুটো সরিয়ে দিয়ে এসো। আমি এই ছেলেগুলোর জলখাবারের ব্যবস্থা করি।

নীল মানুষ খুশি মনে লাফাতে লাফাতে চলে গেল রাস্তার দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *