নীল মানুষের বন্ধু – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

নীল মানুষের বন্ধু – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

রণজয়ের জন্য দর্জি এসেছে। তার নতুন প্যান্ট তৈরি হবে। বাগানের আম বিক্রি করে বেশ কিছু টাকা পেয়েছেন বাবা। ছেলে ফিরে আসায় তিনি এত খুশি হয়েছেন যে বলে দিয়েছেন, যত টাকা লাগে লাগুক, রণজয়ের জন্য তিনখানা করে প্যান্ট-শার্ট শিগগিরই তৈরি করতে হবে।

দর্জিকে ডেকে আনা হয়েছে বাড়িতে। রণজয়কে প্রথম দেখেই সে হাত-পা ছড়িয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল!

মাথায় জলটল দিয়ে তার জ্ঞান ফেরানো হল বটে, তবু সে চোখ ফ্যালফ্যাল করে বলতে লাগল, কী দেখলাম! ও কে? অসুর, না দৈত্য!

রণজয়ের দাদা সঞ্জয় বলল, আরে ছি ছি ছি, তুমি এত সহজে অজ্ঞান হয়ে গেলে? বইটই পড়ো না কিছু? মানুষ বুঝি লম্বা হতে পারে না? পৃথিবীর কত জায়গায় কত লম্বা লোক থাকে। গিনেস বুক অফ রেকর্ডস নামে একটা বই আছে। তাতে সাড়ে আট ফুট লম্বা মানুষের ছবি আছে। আমার ভাই তো মাত্র আট ফুট পাঁচ ইঞ্চি!

দর্জি বলল, মানুষ? ও সত্যি মানুষ?

সঞ্জয় বলল, হ্যাঁ, ও আমার ভাই রণজয়। হঠাৎ লম্বা হয়ে গেছে। বেশি লম্বা হয়ে গেছে!

দর্জি বলল, তা বলে একেবারে তালগাছের মতন লম্বা? ওর গায়ের রং নীল কেন? একেবারে কলমের কালির মতন নীল?

সঞ্জয় বলল, একটা অসুখে ওরকম নীল হয়ে গেছে। অসুখ করলে অনেকের গায়ের রং কালো হয়ে যায় না?

দর্জি তবু ঠিক বিশ্বাস করতে পারল না। সে বলল, রং কালো হয় শুনেছি, কিন্তু নীল রং হয় তা কখনো শুনিনি! দুর্গাপুজোর সময় মহিষাসুরের মূর্তিটাই তো নীল রঙের হয় দেখি!

সঞ্জয় বলল, কেন, শুধু মহিষাসুরের রং নীল কেন? শ্রীকৃষ্ণের গায়ের রং নীল নয়? শ্রীরামচন্দ্রের?

এ কথা বলেই সঞ্জয় কপালে হাত জুড়ে নমস্কার করে বলল, ওঁরা অবশ্য এমনিই নীল।

দর্জিটি বলল, দাদা, সত্যি করে বলুন তো, কাছে গেলে আমায় কামড়ে-টামড়ে দেবে না তো? তুলে আছাড় মারবে না?

সঞ্জয় হেসে বলল, আরে না না! আমার ভাইটি খুব নিরীহ! অতবড়ো চেহারা হলে কী হয়, আসলে এখনো শিশুই রয়ে গেছে। চল, চল, তোমার ভয় নেই কিছু!

বাড়ির ভেতরের দিকে উঠোনে একটা তোয়ালে শুধু কোমরে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে রণজয়। এতদিন সে বনে-জঙ্গলে থাকত, জামা-কাপড় সব ছিঁড়েখুঁড়ে গেছে। তার খালি গা, বুকেটুকে একটাও লোম নেই। সমস্ত শরীরটা নীল পাথরের মূর্তির মতন। যারা রণজয়কে চেনে না তারা দেখলে তো ভয় পাবেই!

একটা লম্বা টুল আনা হল। তার ওপর দাঁড়িয়ে দর্জি মাপ নিতে লাগল। তার হাত দুটো এখনো থরথর করে কাঁপছে, রণজয়ের মুখের দিকে সে তাকাতে সাহস পাচ্ছে না।

রণজয় মুচকি হেসে ফিসফিস করে বলতে লাগল, ভয় নেই! ভয় নেই!

কোনোরকমে রণজয়ের মাপ নেওয়া শেষ হল।

তখন রণজয় বলল, এবার আমার বন্ধুর জামা প্যান্টের মাপ নাও।

উঠোনের এক কোণে নীল ডাউন হয়ে বসে গুটুলি একটা পেয়ারা খাচ্ছে। তার দিকে তাকিয়ে দর্জির চোখ আমার কপালে উঠল। সে বলল, ওরে বাবা, এ আবার কী? এত ছোটো মানুষ? এও কী অসুখের ওপর ছোটো হয়ে গেছে নাকি?

গুটুলি তেজের সঙ্গে বলল, না, আমার অসুখটসুখ হয়নি। তা ছাড়া আমি মোটেও ছোটো মানুষ না। আমি একটু বেঁটে, এই যা! ছোটো মানুষ আর বেঁটে মানুষ কী এক?

দর্জি এবার ফিক করে হেসে ফেলে বলল, এইটুকু মানুষের গলার আওয়াজ তো কম নয়! ঠিক যেন একটা শানাই!

গুটুলির কাছে এসে ফিরে খুলে দর্জি বলল, এই, নড়াচড়া করবি না, চুপ করে দাঁড়া।

গুটলি আবার ধমকের সুরে বলল, আপনি আমাকে তুই তুই বলছেন কেন? আমি কী বাচ্চা ছেলে নাকি?

দর্জি তবু হাসতে লাগল।

মাপ নেওয়া শেষ করে দর্জি চলে যাবার পর সঞ্জয় বলল, মজার ব্যাপারটা দেখলে? রণজয়কে দেখে দর্জি ভয়ে ভিরমি খেয়েছিল। আর গুটুলিকে দেখেই হাসতে লাগল!

রণজয় বলল, গুটুলির চেহারাটা ছোট্টখাট্টো হলে কী হবে, ওর বুদ্ধি কারুর চেয়ে কম নয়।

এর পর এক মুচিকে ডেকে বানানো হল ওদের দুজনের জুতো।

অনেকদিন পর নতুন জামা-প্যান্ট-জুতো পরে, সেজেগুজে রণজয় গুটুলিকে নিয়ে বেরুল রাস্তায়।

গ্রামের অনেক লোকই এখন রণজয়ের কথা জেনে গেছে। ভয়টাও এখন ভেঙেছে। রণজয় কারুর কোনো ক্ষতি করে না। কোনো গাছটাছও ভাঙে না। কিন্তু গুটুলিকে দেখে সবাই মজা পায়। বাচ্চা ছেলেরা গুটুলিকে ঘিরে ধরে হাততালি দিতে দিতে বলে, এই বাঁটকুল! এই বাঁটকুল! কেউ কেউ তার গায়ে ঢিল ছোঁড়ে।

রণজয় ঘুরে দাঁড়ালেই অবশ্য সবাই চোঁ চোঁ দৌড় মারে।

গুটুলিকে নিয়ে রণজয় নদীর ধারে এসে বসল। সন্ধে হয়ে এসেছে। এখানে আর কোনো মানুষজন নেই।

রণজয় আস্তে আস্তে বলল, জানিস গুটুলি, অনেকদিন আগে এই রকম এক সময়ে আমি নদীর ধারে মাছ ধরতে এসেছিলাম। হঠাৎ এক সময় আকাশ থেকে একটা সাদা বল খসে পড়ল। সেই বলকে আমি ধরতে গেলাম। তারপর থেকেই আমার এই অবস্থা। চেহারাটাও লম্বা হতে লাগল আর গায়ের রংটাও বদলে গেল।

রণজয় নিজের কাহিনি বলে যাচ্ছে, গুটুলি কোনো সাড়াশব্দ করছে না।

এক সময় হঠাৎ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শুনে রণজয় চমকে মুখ ফেরাল।

গুটুলির থুঁতনিতে একটা আঙুল ছুঁইয়ে সে বলল, এ কী, তুই কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে?

গুটুলি তবু কান্না থামাচ্ছে না।

রণজয় আবার কাতরভাবে জিজ্ঞেস করল, তোর কী হয়েছে? বাড়ির জন্য কষ্ট হচ্ছে?

গুটুলি কাঁদতে কাঁদতেই বলল, আমার কোনো বাড়িই নেই!

রণজয় জিজ্ঞেস করল, তা হলে কীসের কষ্ট হচ্ছে? নতুন জুতোয় পায়ে ফোস্কা পড়েছে?

গুটুলি বলল, না, সে সব কিছু না। আমার কষ্ট হচ্ছে অন্য কারণে। বন্ধু, এবার তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে!

রণজয় বলল, সেকি! আমায় ছেড়ে যাবি কেন? আমার বাড়িই তো তোর বাড়ি। আমার মা তোকে ভালোবাসে। আমার দাদাও তোকে পছন্দ করে।

গুটুলি বলল, সে জন্যও নয়। তুমি লম্বা, আমি বেঁটে। তোমাকে দেখে লোকে ভয় পায়, আমাকে দেখে লোকে হাসে। কেউ আমার মাথায় চাঁটি মারে, কেউ ঢিল ছোঁড়ে। যখন বনে-জঙ্গলে ছিলাম, তখন বেশ ছিলাম। লোকজনের মাঝখানে থাকলে কেউ আমাকে গ্রাহ্য করবে না। তোমার পাশে থাকলে আমাকে আরও বেশি বেঁটে দেখায়! নাঃ, আমি চলেই যাব!

রণজয় বলল, তুই আমার একমাত্র বন্ধু। তুই চলে গেলে আমি থাকব কী করে? না, না, গুটুলি, তোকে আমি কিছুতেই ছাড়ব না!

গুটুলি মাটিতে চাপড় মারতে মারতে বলল, আমি লম্বা হতে চাই! আমি লম্বা হতে চাই! আমি তোমার মতন লম্বা হতে চাই!

রণজয় বলল, লম্বা হওয়ার অনেক জ্বালা রে, গুটুলি! দ্যাখ না, আমি ইচ্ছে মতন চলাফেরা করতে পারি না। কেউ আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলে না!

গুটুলি বলল, আর বেঁটে হওয়ার কী জ্বালা, তা তো তুমি বুঝবে না! এর থেকে লম্বা হওয়া অনেক ভালো। তোমার সেই সাদা বলটা কোথায়? সেটা জোগাড় করে আন। আমি লম্বা হব!

রণজয় বলল, সেটা কোথায় পাবো রে! মহাকাশের লোকেরা সেটা তো আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেছে।

গুটুলি বলল, ওসব জানি না। লম্বা না হলে আমি আর এখানে থাকতে চাই না। আমি আর বেঁচেও থাকতে চাই না।

রণজয় আলতো করে গুটুলির পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, অমন করিস না। মরার কথা বলতে নেই। ঠিক আছে, তুই লম্বা হতে চাস তো! দেখা যাক, কী ব্যবস্থা করা যায়। আর কয়েকটা দিন ধৈর্য ধরে থাক।

পরদিন ওরা গেল শহরের দিকে। ট্রেনে চেপে এল, কিন্তু কোনো অসুবিধে হল না। অনেকেই অবাক হয়ে তাকাচ্ছে বটে, রণজয়কে দেখে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলছে। কিন্তু ভয়ে চোখ উলটে ফেলছে না।

শহরের রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে রণজয় বলল, কী আশ্চর্য ব্যাপার বল তো গুটুলি! আগে আমাকে দেখলেই লোকে ভয়ে পালাত। এখন তো সে রকম কিছু হচ্ছে না। হঠাৎ সব বদলে গেল কী করে?

গুটুলি বলল, কারণটা বুঝলে না? আগে যখন তুমি জঙ্গল থেকে বেরুতে তখন তোমার খালি গা, জামা ছিল না। ছেঁড়াখোঁড়া ময়লা ধুতি জড়ান। আর মাথার চুলও আঁচড়াতে না। সবাই তাই মনে করত জঙ্গলের দৈত্য-দানব। এখন তোমার ভদ্দরলোকদের মতন নতুন পোশাক। আজকাল পোশাক দেখেই তো সবাই মানুষ চেনে!

রণজয় বলল, হায় রে, মানুষ দেখে চেনা যায় না। পোশাক দেখে ভদ্দরলোকদের চিনতে হয়। তা হলে তো দর্জিদেরই জয়!

গুটুলি বলল, তবু দ্যাখো, তোমাকে দেখে কেউ হাসছে না। আমায় দেখে হাসছে। এ পৃথিবীতে লম্বাদেরই জয়।

—তুই আমার সমান লম্বা হতে চাস, গুটুলি?

—না, না, তোমার সমান নয়। ছোটো ছেলেরা আমাকে দেখে ভয় পাক, তাও আমি চাই না। এই ধর, মাঝামাঝি। তোমার শরীর থেকে খানিকটা কমিয়ে যদি আমার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া যেত!

—ওঃ, তা হলে কী ভালোই হত! তুই আর আমি সমান সমান! আচ্ছা, সামনে ওটা কী দেখা যাচ্ছে, চল তো যাই!

গুটুলি সামনে তাকিয়ে দেখল।

রাস্তার ওপারে একটা পার্ক। তার একদিকটা টিন দিয়ে ঘেরা। সেখানে গেটের ওপর সাইনবোর্ডে লেখা : নবীন ব্যায়ামগার।

তার তলায় আবার ছোটো ছোটো অক্ষরে লেখা : শরীর মজবুত করতে হলে এখানে যোগ দিন!

গুটুলি আর রণজয় রাস্তা পার হয়ে সেই গেট ঠেলে ঢুকল।

দুপুরবেলা সেখানে আর লোকজন কেউ নেই, শুধু ব্যায়ামাগারের ম্যানেজার একা বাফুপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরে ওঠবোস করে যাচ্ছেন।

রণজয় কোনো ভুূমিকা না করেই বলল, আপনারা এখানে শরীর মজবুত করে দেন। আপনারা বেঁটে লোককে লম্বা করে দিতে পারেন?

ম্যানেজার মশাই বসা অবস্থায় রণজয়ের পা থেকে দেখতে লাগলেন। পেট-বুক-গল পর্যন্ত চোখ বোলাতে বোলাতে তাঁর মুখখানা অনেকটা হাঁ হয়ে গেল। তিনি বললেন, অ্যাঁ? অ্যাঁ? অ্যাঁ? আরও লম্বা? আপনি আরও লম্বা হতে চান?

রণজয় হেসে বলল, না, আমি না। এই যে আমার বন্ধু। এর কথা বলছি।

রণজয়ের আড়ালে গুটুলিকে আগে দেখতে পাননি ম্যানেজার মশাই। এবার তিনি ভালো করে দেখে নাক কুঁচকে বললেন, ধুৎ! ধুৎ! ধুৎ!

রণজয় বলল, এ কি, আপনি তিনবার ধুৎ বললেন কেন?

ম্যানেজার মশাই বললেন, আমি এক একটা কথা তিনবার তিনবার তিনবার বলি!

রণজয় বলল, আপনি একবারই বা ধুৎ বলবেন কেন?

ম্যানেজার মশাই বললেন, ওইটুকু বেঁটে বাঁটকুল কখনো লম্বা লম্বা লম্বা হয়? কোনো আশা নেই, আশা নেই, আশা নেই!

রণজয় বলল, সে কী মশাই? বেঁটে লোকরা কোনোদিন লম্বা হতে পারে না?

ম্যানেজার মশাই বললেন, ধুৎ! ধুৎ! ধুৎ! তা কখনো হয়! তবে আপনারা প্রফেসার হংসধবজের কাছে গিয়ে দেখতে পারেন। সে ওসব কী যেন করে শুনেছি!

রণজয় জিজ্ঞেস করল, ঠিক আছে। প্রফেসর হংসধবজের ঠিকানা?

ম্যানেজার মশাই ঘরে ঢুকে একটা কার্ড নিয়ে এসে বললেন, এই নাও, এই নাও, এই নাও! যাও, যাও, যাও,।

রণজয়ও তিনবার বলল, যাচ্ছি, যাচ্ছি, যাচ্ছি!

কার্ডখানাতে লেখা, প্রফেসার হংসধবজ রায়। যে-কোনো সমস্যা, চলে আসুন!

ঠিকানাটা খুব দূরে নয়।

রণজয় বলল, চল রে, আজই একটা কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। হংসঝবজের নামটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।

সেটা একটা সিনেমা হলের মতন বাড়ি। দুদিকে দুটো গেট। মাঝখানের দেওয়ালে নানা বয়সের অনেক নারী-পুরুষের ছবি। বেঁটে, মোটা, রোগা, লম্বা।

বাড়িটার সামনে এসে রণজয় বলল, এবার তুই আগে যা গুটুলি। আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি।

ভেতরের অফিস ঘরে প্রফেসার হংসধবজ রায় টেবিলে বসে লেখালেখি করছিল। গুটুলি তার কাছে গিয়ে বলল, এই যে শুনুন!

হংসধবজ এক পলক গুটুলির দিকে তাকিয়ে বলল, যা, যা এখন বিরক্ত করিস না। কাজ করছি!

গুটুলি বলল, আপনার সঙ্গে একটা কাজের কথা আছে!

হংসধবজ ড্রয়ার খুলে একটা লজেন্স বার করে গুটুলির হাতে দিয়ে বললেন, এই নে, যা পালা!

গুটুলি রাগ করে লজেন্সটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, আপনি কী আমাকে বাচ্চা ছেলে পেয়েছেন নাকি? আমার বয়েস একুশ।

হংসধবজ এবার দারুণ ধমক দিয়ে বলল, আ মল যা! তোর বয়েস কত আমি কী তা জানতে চেয়েছি? জেনে আমার লাভ কী? কেন আমায় বিরক্ত করছিস!

গুটুলি বলল, আমি একটা কাজের কথা বলতে এসেছি!

হংসধবজ বলল, আমি কোনো কাজের কথা শুনতে চাই না।

গুটুলি এবার বাইরের দরজার কাছে এসে হাঁক দিল, বন্ধু, তুমি এবার ভেতরে এস!

রণজয় ধপধপ করে পায়ের শব্দ করতে করতে ভেতরে আসতেই হংসধবজ চমকে তাকাল। চ্যাঁচাতে গিয়েও গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুল না। অজ্ঞান হয়ে সে চেয়ারসুদ্ধু উলটে পড়ে গেল!

গুটুলি বলল, দেখলে তো বন্ধু, বেঁটে লোকদের কেউ গ্রাহ্য করে ন। আমাকে বকে তাড়িয়ে দিচ্ছিল, আর তোমাকে দেখেই অজ্ঞান হয়ে গেল।

টেবিলের ওপর এক গেলাস জল রাখা ছিল। সেটা মাথায় ঢেলে দিতেই হংসধবজ চোখ মেলে তাকাল।

রণজয় বলল, ভয় নেই, ভয় নেই, ভয় নেই! আমরা কাজের কথা বলতে এসেছি!

হংসধবজ এবার দুজনকে দেখল ভালো করে তারপর উঠে বসে খুব উৎসাহের সঙ্গে বলল, তোমরা কাজ চাও! এক্ষুনি কাজ দিতে পারি। দু’হাজার টাকা করে মাইনে পাবে।

রণজয় অবাক হয়ে বলল, কাজ মানে চাকরি? আপনি আমাদের চাকরি দিতে চাইছেন? কী চাকরি?

হংসধবজ বলল, খুব সোজা কাজ। আমার বাড়ির দু’দিকের দরজায় তোমরা দুজনে দাঁড়িয়ে থাকবে। একজনের গায়ে লেখা থাকবে ‘আগে’, আর একজনের গায়ে লেখা থাকবে ‘পরে’।

রণজয় জিজ্ঞেস করল, তার মানে?

হংসধবজ বলল, আমার এটা একটা নার্সিংহোম। এখানে লোকে চিকিৎসা করতে আসে তো। বেঁটে লোকটির গায়ে লেখা থাকবে ‘আগে’, তার মানে আমার এখানে চিকিৎসা করাবার আগের অবস্থা। আর আর একজন ‘পরে’। তার মানে, চিকিৎসার পরের অবস্থা!

রণজয় বলল, আপনার এখানে বেঁটে লোককে লম্বা করা যায়?

হংসধবজ বলল, হ্যাঁ, কেন যাবে না। সব করা যায়!

রণজয় বলল, বাঃ বাঃ বাঃ! চমৎকার! তা হলে তো কোনো চিন্তাই নেই। আপনি আমার এই বন্ধুটিকে লম্বা করে দিন তো! তারপর আমরা আপনার সব কথা শুনব!

হংসধবজ ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, তোমার মাথা খারাপ? এই বেঁটে বঙ্কেশ্বরকে কি কেউ লম্বা করতে পারে?

গুটুলি ফুঁসে উঠে বলল, খবর্দার!

রণজয়ও হুৎকার দিয়ে বলল, আপনি আমার বন্ধুকে অপমান করছেন কেন? এই না বললেন, বেঁটে লোককে আপনি লম্বা করে দিতে পারেন?

হংসধবজ বলল, সে বলেছি বলেছি বেশ করেছি। আমার যা খুশি আমি তাই বলবো!

গুটুলি অমনি ছুটে গিয়ে হংসধবজের একটা হাতক ঘ্যাঁচ করে কামড়ে দিল।

হংসধবজ আঁতকে উঠে বলল, এ কী?

গুটুলি বলল, আমাকে অপমান করছ কেন? আমারও যা খুশি তাই করব?

হংসধবজ এবার ভয়ে চুপসে গিয়ে রণজয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমিও কামড়ে দেবে নাকি? তা হলে আর আমি বাঁচব না! আঁ? সত্যি সত্যি আর বাঁচব না!

রণজয় ঘাড় ধরে হংসধবজকে উঁচুতে তুলে নিল। তারপর বলল, আমি সব সময় কামড়াই না। তবে, আমারও যা ইচ্ছে তাই করব!

হংসধবজ পা দোলাতে দোলাতে বলল, নামিয়ে দাও, নামিয়ে দাও আমার ঘাড়ে ব্যথা, আরও ব্যথা হয়ে যাবে।

রণজয় ঘাড় ধরে হংসধবজকে তুলে নিল।

রণজয় তাকে মাটিতে নামাবার পর সে, বলল, আসল ব্যাপার কী জান, রোগা লোকেরা মোটা হয়ে গেলে একটু বেঁটে দেখায় আর মোটা লোকেরা খুব রোগা হয়ে গেলে খানিকটা লম্বা মনে হয়। আজকাল রোগা-মোটা করার অনেক জায়গা আছে, তাই আমি রোগা-লম্বা করার কথা বলি। আসল বেঁটেকে লম্বা করা আমার সাধ্য নয়। তবে তোমরা একটা কাজ করতে পার। তোমরা মেঘধবজ আচার্যের কাছে যাও।

গুটুলি জিজ্ঞেস করল, সে আবার কে?

হংসধবজ বলল, সে একজন জাদুকর আর বৈজ্ঞানিক। সে অনেক কিছু পারে। সে তোমাদের মনোবাঞ্ছা ঠিক পূর্ণ করে দেবে।

গুটুলি ধমক দিয়ে বলল, আবার শক্ত শক্ত কথা বলছো। ওই কথাটার মানে কী?

রণজয় বলল, চল, চল, এ কথাটার মানে আমি জানি!

হংসধবজের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে রণজয়েরা চলে এল মেঘধবজ আচার্যের বাড়িতে।

এ বাড়িটার সামনের দিকটা ভাঙা-চুরো, বন-জঙ্গলে ভরতি। কিন্তু ভেতরে পরপর তিনখানা ঘর লাল, নীল আর সবুজ রং করা।

রণজয়রা প্রথমে লাল রঙের ঘরটার দরজায় ধাক্কা দিল।

একজন বুড়ো মতন লোক শুধু মাথাটা বার করে জিজ্ঞেস করলেন, কী চাই

রণজয় বলল, আমরা মেঘধবজ আচার্যের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

বৃদ্ধটির মাথাভরতি চুল, মুখভরতি দাড়ি, চোখে রুপোলি ফ্রেমের চশমা।

রণজয়কে দেখে তিনি একটুও অবাক না হয়ে বললেন, বা বা বা বা! এই রকম একজনকেই তো খুঁজছিলাম। তুমি কী কলসির দৈত্য নাকি হে?

রণজয় বলল, আজ্ঞে না। আমি মানুষ!

বৃদ্ধ বললেন, তুমি মানুষ? তবে তো আরও চমৎকার। তুমি আমার জন্য একটু মরতে পারবে?

রণজয় গুটুলির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, একটুখানি মরা মানে কী রে?

বৃদ্ধ বললেন, তুমি দড়াম করে মরে যাও না। তারপর তোমার শরীরটা আমি কাটাছেঁড়া করবো। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করবো। দেখবো, দৈত্যদের সঙ্গে মানুষদের কী তফাত! দৈত্য বলে সত্যিই কিছু ছিল কিনা।

রণজয় বলল, আজ্ঞে, এই সামান্য কারণে তো আমি মরতে রাজি নই। আমার আরও বেশ কিছুদিন বাঁচার ইচ্ছে আছে!

বৃদ্ধ তাতে যেন বেশ বিরক্ত হয়ে বললেন, তবে ওই দৈত্যের মতন চেহারা নিয়ে আমার কাছে এসেছো কেন?

রণজয় বলল, শুনেছি, আপনি মানুষের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে পারেন। তাই আপনার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছি।

বৃদ্ধ বললেন, বটে? তোমাদের মনোবাঞ্ছা আমি পূর্ণ করব কেন শুনি? তাতে আমার কী লাভ হবে? আমার বুদ্ধি সময়ের দাম নেই?

রণজয় বলল, আমাদের মনোবাঞ্ছা যদি পূর্ণ হয়, তাহলে আপনাকে আমরা নিশ্চয়ই কিছু দেব। আপনি কী চান বলুন!

বৃদ্ধ মুখ ভেংচে বললেন, ইস! আবার বলে কী চান! তুমি আমার জন্য সামান্য মরতেও রাজি হলে না! আচ্ছা, আগে শুনি তোমাদের মনোবাঞ্ছা কী!

রণজয় হাত কচলে বলল, আজ্ঞে দেখুন, আমার এই বন্ধুটির উচ্চতা খুব কম। তাই নিয়ে ওর মনে খুব দুঃখ। আপনি ওকে লম্বা করে দিতে পারেন?

বৃদ্ধ এবার গুটুলিকে দেখে খুকখুক করে হেসে বললেন, কেন, বেশ তো চেহারাটা। লম্বা হয়ে কী হবে?

গুটুলি জিজ্ঞেস করল, আপনি লম্বা করে দিতে পারেন কি না, আগে সেটা ঠিক করে বলুন!

বৃদ্ধ দুদিকে ঘাড় নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, পারি। তা পারি। কিন্তু একটা মুশকিল আছে। পৃথিবীটা একটা নিয়মে চলে জানো তো? একটা বেঁটে লোক হঠাৎ লম্বা হয়ে গেলে আর একজন লম্বা লোককে বেঁটে হতে হবে! তোমার বদলে তা হলে কে বেঁটে হবে বল?

রণজয় আগ্রহের সঙ্গে বলল, আমি! আমি!

বৃদ্ধ বললেন, তুমি? ইস, এত বোকা তুমি? এতখানি লম্বা চেহারা কেউ নষ্ট করে?

রণজয় বলল, আমি এতটা লম্বা ধ্যাড়েঙ্গা থাকতে চাই না!

বৃদ্ধটি বললেন, বেশ, হবে এস!

বৃদ্ধটি এবার তাদের নিয়ে গেলেন নীল ঘরে। সে ঘরটা অনেক রকম যন্ত্রপাতিতে ভরতি। বৃদ্ধটি কয়েকটা প্লাগ লাগিয়ে দিলেন ওদের দুজনের গায়ে। তারপর একটা মেশিনের বোতাম টিপতেই গোঁ গোঁ শব্দ হতে লাগল।

রণজয় শুধু একটু সুড়সুড়ির মতন বোধ করল, আর কিছু টের পেল না। গুটুলি থরথর করে কাঁপছে।

একটু পরে বৃদ্ধটি আনন্দে হাততালি দিতে দিতে বললেন, বাঃ বাঃ! ঠিক হয়েছে! আমি আর তোমাদের দেখতে পাচ্ছি না।

রণজয় জিজ্ঞেস করল, তার মানে?

বৃদ্ধ বললেন, এই সহজ কথাটার মানেও বুঝতে পারলে না? তোমরা অদৃশ্য হয়ে গেছ। তোমাদের আর কেউ দেখতে পাবে না।

রণজয় নিজের গায়ে চোখ বুলিয়ে বলল, কই, আমি তো আমাকে দেখতে পাচ্ছি!

বৃদ্ধ বললেন, তা তো পাবেই। অদৃশ্য হলেও নিজেকে দেখা যায়।

রণজয় বলল, আমি গুটুলিকেও দেখতে পাচ্ছি।

গুটুলি বলল, আমি তোমাকেও দেখতে পাচ্ছি।

বৃদ্ধ বললেন, অদৃশ্য লোকেরা নিজেদের দেখতে পায় না কে বলল? একজন ভূত কি অন্য ভূতকে দেখতে পায় না? অন্য মানুষ আর দেখতে পাবে না তোমাদের।

রণজয় বলল, কিন্তু আমরা তো অদৃশ্য হতে চাইনি? এ কী করলেন?

বৃদ্ধ বললেন, আহা হা, ব্যস্ত হচ্ছ কেন? বেঁটে কিংবা লম্বা কি আর এমনি এমনি হওয়া যায়? আগে অদৃশ্য হতে হয়। এরপর তোমরা একজন বেঁটে আর একজন লম্বা হবে! চল, এবার পাশের ঘরে।

বৃদ্ধর কথামতন ওরা দু’জন চলে এল সবুজ ঘরে।

বৃদ্ধ এবার একটা পিচকিরি দিয়ে খানিকটা গন্ধ জল ছিটিয়ে দিলেন ওদের গায়ে। আপনমনে হাসলেন ফিকফিক করে ঘরটা অন্ধকার করে দিলেন সব আলো নিভিয়ে।

তারপর জিজ্ঞেস করলেন, এখনো ভেবে দ্যাখো, যে বেঁটে আছ, সে লম্বা হতে চাও লম্বা যে, সে বেঁটে হতে চাও?

গুটুলি আর রণজয় দুজনেই একসঙ্গে বলল, হ্যাঁ, চাই!

বৃদ্ধ বললেন, তা হলে এবারে পেছনের দেয়ালের দিকে দ্যাখো।

আবার আলো জ্বলতেই ওরা পেছন ফিরে দেখল, দেয়ালের গায়ে দুটো বিরাট গোল মতন আয়না। তাতে ফুটে উঠল দুটো বিকট মুখ!

গুটুলি দেখল, তার মুখখানা বিরাট লম্বা হয়ে গেছে। কান দুটো টেনিস র‌্যাকেটের মতন, নাকের ফুটো দুটো রাস্তার গর্তের মতন!

আর রণজয় দেখল, তার শরীরচা চেপ্টে একেবারে ছোট্ট হয়ে গেছে। মুখখানা একটা বাচ্চা কচ্ছপের মতন। নাক আর কান দেখাই যায় না!

গুটুলি চেঁচিয়ে বলল, ওরে বাবা, আমি এত লম্বা হতে চাই না!

রণজয় বলল, আমি এত বেঁটে হতে চাই না!

দু’জনে এই কথা বলে চিৎকার করতে লাগল। আর হাততালি দিয়ে হাসতে লাগলেন বৃদ্ধ।

একটু পরে বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন, তবে, তোমরা কী চাও?

ওরা দুজনেই বলল, আগের মতন করে দিন। আগের মতন করে দিন!

বৃদ্ধ আবার আলো নিভিয়ে দিলেন। দরজা খুলে দিয়ে বললেন, যাও, বাড়ি যাও! শুধু শুধু আমাকে এত খাটালে। আমার বাড়ির সামনে অনেক ভাঙা ইট আর জঞ্জাল জমে আছে। কাল এসে সাফ করে দিয়ে যেও!

রণজয় বলল, নিশ্চয়ই দেবো! কিন্তু কী ব্যাপারটা হল বলুন তো? আমরা দুজনেই বদলাবদলি হয়ে গিয়েছিলাম! গুটুলি খুব লম্বা আর আমি অত বেঁটে! আবার ঠিক জায়গায় ফিরে এসেছি?

বৃদ্ধ বললেন, কনভেন্স আর কনকেভ!

রণজয় অবাক হয়ে বলল, তার মানে?

বৃদ্ধ বললেন, যাও যাও বাড়ি যাও, আমাকে আর বেশি খাটিও না! বাড়িতে ডিকশনারি আছে? মানে দেখে নিও!

তারপর তিনি দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *