নীল মানুষের পরাজয়

নীল মানুষের পরাজয়

শেষ রাতের দিকে দারুণ ঝড়—বৃষ্টি আরম্ভ হল হঠাৎ। শীতকাল, এ সময় এরকম বাদলা হওয়ার কথা নয়া রণজয় আর গুটুলির ঘুম ভেঙে গেল। পাহাড়ের গায়ে একটা ছোট মতন গুহাকে ওরা বড়ো করে নিয়েছে, সেটাই এখন ওদের বাড়ি। রণজয় অন্য জায়গা থেকে একটা বড়ো পাথর এনে গুহার মুখটা আড়াল করে রেখেছে, বাইরে থেকে কিছু দেখা যায় না।

ঝড়ের শব্দে ঘুম ভেঙে যাবার পর গুটুলি প্রথমে উঠে এসে বাইরে একটু উঁকি মারলো। মড় মড় করে গাছ ভাঙার শব্দ হচ্ছে। বাতাসেও একটা গোঁ গোঁ শব্দ।

এরকম ঝড়—বৃষ্টি গুটুলি সাতজন্মে দেখেনি। সে ভয় পেয়ে ভেতরে ছুটে এসে রণজয়কে ডাকলো।

রণজয়ের ঘুম ভেঙে গেলেও সে সহজে উঠতো চায় না। বেশ শীত পড়েছে, সে কম্বলটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বললো, বৃষ্টি পড়ছে তাতে ভয়ের কী আছে? আমাদের গুহার মধ্যে তো আর জল ঢুকবে না!

গুটুলি বললো, কী রকম ভয়ংকর একটা শব্দ হচ্ছে। বাইরে এসে একবার শুনে দ্যাখো! মনে হচ্ছে যেন মহাপ্রলয় শুরু হয়ে গেছে। যদি সারা পৃথিবী ভেসে যায়!

রণজয় তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললো, হেঃ পৃথিবী ভাসলেই হলো আর কী! এখন ঘুমোও সকালে দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।

এই সময় বাইরে যেন একসঙ্গে একশোটা কামান দাগার শব্দ হলো। গুটুলি রণজয়ের হাত চেপে ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, ও কী? পাহাড় ভেঙে পড়ছে!

রণজয় হেসে বললো, এত ভয় কিসের গুটুলি ভায়া? বাজের আওয়াজ শোনোনি কখনো?

—এত জোরে বাজ পড়ে কখনো?

—আমরা গুহার মধ্যে রয়েছি তো, তাই আওয়াজটা বেশি মনে হচ্ছে। ঠিক আছে, চলো দেখি বাইরে। রঘু কোথায়?

—রঘু কাঁদছে!

রণজয়কে এবারে উঠতেই হল। গুহাটা অনেকখানি লম্বা, ভেতরে দু’তিনটি ঘরের মতন খোপ খোপ। তারই একটা খোপে ওদের রান্নাঘর, সেইখানেই থাকে রঘু। শীতর জন্য সেই ঘরটায় আগুন জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে।

রণজয় আর গুটুলি সেই ঘরে এসে দেখলো, রঘু দেয়ালে পিঠ দিয়ে, পা ছড়িয়ে বসে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে আর বলছে, আজ শেষ হয়ে গেলুম! আজ আকাশ ভেঙে পড়বে, পাহাড় ভেঙে পড়বে, আর কোনোদিন বাড়ির লোকদের দেখতে পাবো না গো!

রণজয় বললো, দেশের কী অবস্থা! ডাকাতগুলো পর্যন্ত এত ভীতু হয়? এই রঘু, চল, আমার সঙ্গে বাইরে চল, একটু বৃষ্টিতে ভিজে আসি!

এই সময় মেঝেটা একটু কেঁপে উঠলো আর বাইরে পাথর গড়িয়ে পড়ার শব্দ হলো।

গুটুলি দারুণ ভয় পাওয়া গলায় বলে উঠলো, ভূমিকম্প শুরু হয়েছে! মহাপ্রলয়!

রণজয় এবারে খুব দ্রুত গুটুলি আর রঘুকে দু’হাতে তুলে নিয়ে ছুটে চলে এলো বাইরে। ভূমিকম্প হলে গুহার মধ্যে থাকা সত্যিই বিপজ্জনক। বাইরে বৃষ্টি একেবারে চাবুকের মতন। একের পর এক গাছ ভেঙে পড়ার শব্দ হচ্ছে। কাছেই একটা ছোট পুকুর আছে, তার পাশে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। রঘু আর গুটুলিকে দুটি বেড়ালছানার মতন দু’বগলে নিয়ে রণজয় ছুটলো সেদিকে।

পুকুরটার ধারে পৌঁছতেই হঠাৎ খুব জোরে একটা বিদ্যুৎ চমকে চতুর্দিক সাদা হয়ে গেল। রণজয় মুখ তুলে আকাশটা দেখবার চেষ্টা করেও পারলো না। সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল মাটিতে।

রণজয়ের যখন জ্ঞান ফিরলো, তখন ঝড়—বৃষ্টির কোনো চিহ্ন নেই। দিনের আলো ফুটে গেছে। রণজয় ধড়মড় করে উঠে বসলো। কী হয়েছিল কাল রাত্তিরে? ভূমিকম্পে পৃথিবী চৌচির হয়নি, পাহাড়ও ভেঙে পড়েনি, তবু শুধু বিদ্যুৎ চমকে সে অজ্ঞান হয়ে গেল কেন? তার মাথায় কি বাজ পড়েছিল? মাথায় বাজ পড়লে কি কেউ বাঁচে?

রণজয় নিজের দু’গালে চড় মারলো কয়েকটা। ব্যথা লাগছে তো। তা হলে সে মরেনি। গুটুলি আর রঘু তার দু’পাশে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। পুকুর থেকে আঁজলা করে জল এনে রণজয় ছিটিয়ে দিল ওদের মুখে। একটু বাদেই ওদেরও জ্ঞান ফিরলো।

রঘু চোখ মেলেই বললো, আমি কি মরে গেছি? গুটুলি বললো, আমার কী হয়েছিল?

রণজয় বললো, ঝড়ে শুধু কয়েকটা গাছ ভেঙে পড়েছে, আর কিছুই হয়নি। সামান্য একটু মাটি কেঁপেছিল। রঘু, যা উনুনে আগুন দে। চা আর রুটি বানা, আমার খিদে পেয়েছে!

রঘু আবার কাঁদতে শুরু দিল ভেউ ভেউ করে।

রণজয় অবাক হয়ে বললো, আরে এ ডাকাতটা দেখছি বাচ্চাদেরও অধম হয়ে গেছে। এই, তোর এখন আবার কান্নার কী হল?

রঘু বললো আমি দোষ করেছি বটে, তা বলে কি কোনোদিন ছুটি পাবো না?

গুটুলি বললো, কতগুলো ডাকাতি করেছিলি মনে নেই? তোকে যদি পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিতুম, তা হলে সারাজীবন জেলে পচতে হতো।

রঘু বললো, রোজ রোজ রান্না করার চেয়ে জেলে থাকাও ভালো।

রণজয় ধমক দিয়ে বললো, যা, আগে চা—টা তৈরি কর। আমরা গুহায় আসছি একটু বাদে।

রঘু চলে যাবার পর গুটুলি বললো, ওস্তাদ, দ্যাখো, আকাশ এখন একেবারে পরিষ্কার। গতকাল বিকেলেও এরকম পরিষ্কার ছিল। তবু রাত্তিরে ওরকম ঝড়—বৃষ্টি হলো কী করে? আমরাই বা অজ্ঞান হয়ে গেলুম কেন?

রণজয় বললো, আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে…

সে কথা শেষ করার আগেই পেছনে শোনা গেল মানুষের পায়ের শব্দ। ওরা পেছন ফিরতেই দেখলো, দুটি কিশোরী মেয়ে পুকুরটার দিকে আসছে।

মেয়ে দুটিকে একেবারে হুবহু একরকম দেখতে। দু’জনেরই বয়েস হবে তের চোদ্দ, মাথায় লম্বা চুল, একজন একটা লাল রঙের, অন্যজন একটা হলদে ফ্রক পরা। দু’জনেরই কাঁধে ঝোলা—ব্যাগ। দু’জনেরই পায়ে হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা জুতো।

ওরা যেমন মেয়েদুটিকে দেখে অবাক হয়েছে, তেমনি মেয়ে দুটিও ওদের দেখে অবাক ভাবে থমকে দাঁড়ালো। রণজয় প্রায় আট ফুট লম্বা, গায়ের রং আকাশের মতন নীল, আর গুটুলিকে দেখতে একটি বাচ্চা ছেলের মতন হলেও তার নাকের নিচে পুরুষ্টু গোঁফ।

রণজয় আর গুটুলিকে দেখার পর মেয়ে দুটি একজন আর একজনের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসতে লাগলো।

রণজয়ের গলার আওয়াজ বাজখাঁই ধরনের নতুন লোকরা শুনলে চমকে যায়। তাই সে গুটুলির চোখের দিকে তাকিয়ে একটা ইঙ্গিত করলো।

গুটুলি জিজ্ঞেস করলো, এই তোমরা কারা গো? এই বনে কী করে এলে?

হাসি থামিয়ে লাল রঙের ফ্রক পরা মেয়েটি তার ঝোলা থেকে একটা ছোট্ট টেপ রেকর্ডার বার করে কানের কাছে এনে কী যেন শুনলো। তারপর সেটা অন্য মেয়েটির হাতে দিয়ে সে বললো, আমরা এখানে বেড়াতে এসেছি।

গুটুলি বললো, তোমরা এখানে বেড়াতে এসেছো? কোথা থেকে এলে? কিসে করে এলে? তোমাদের সঙ্গে আর কে আছে?

হলদে ফ্রক পরা মেয়েটি এবার অন্য মেয়েটির দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো, ও আমার সঙ্গে আছে, আমি ওর সঙ্গে আছি আর কেউ নেই।

—তোমরা এই জঙ্গলের মধ্যে এলে কী করে! তোমাদের গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে?

লাল ফ্রক এবার হলদে ফ্রকের দিকে তাকিয়ে বললো, আমাদের গাড়ি কি খারাপ হয়ে গেছে? কি জানি! আমরা বেড়াতে এসেছি।

—এই জঙ্গলে তোমরা দুটি মেয়ে বেড়াতে এসেছো, সঙ্গে কেউ নেই, এ তো বড় আশ্চর্য কথা। হলদে ফ্রক বললো, বেড়াতে আসা বুঝি আশ্চর্য কথা? তোমরা এখানে কী করছো, তোমরা বেড়াতে আসোনি?

রণজয় যতদূর সম্ভব আস্তে ফিসফিস করে গুটলিকে বললো, সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার কী জানিস, এই মেয়ে দুটো আমায় দেখে ভয় পেল না কেন? এই প্রথম দেখছি, কেউ আমায় দেখে ভয়ে কাঁপছে না। মেয়ে দুটো তো মনে হচ্ছে, ক্লাস এইট—নাইনে পড়ে! একা একা বেড়াতে এসেছে!

তারপর সে গলা তুলে ওদের বললো, না, আমরা এখানে বেড়াতে আসিনি। আমরা এখানে থাকি!

হলদে ফ্রক ও লাল ফ্রক চোখাচোখি করলো একবার, তারপর লাল ফ্রক বললো, তোমরা জঙ্গলে থাকো? তোমরা কী জন্তু?

এইবারে রণজয় প্রচণ্ড জোরে হুংকার দিয়ে বললো, অ্যাঁ কী বললে? আমরা জন্তু?

রঘু ডাকাতের মতন লোকও প্রথমবার রণজয়ের এই রকম হুংকার শুনে ভয়ে একেবারে কুঁকড়ে গিয়েছিল। মেয়ে দুটি আবার খিলখিল করে হেসে উঠলো। তারপর তারা পুকুরের ধারে এসে বসে পড়লো হাঁটু গেঁড়ে।

গুটুলি রেগে কয়েক পা এগিয়ে এসে বললো, এই খুকি, আমাদের জন্তু বললে যে? আবার হাসছো?

দুটি মেয়েই প্রত্যেকবার কথা বলার আগে নিজেরা চোখাচোখি করে কী যেন বলে নেয়। এবারে হলদে ফ্রক বললো, ভুল বলেছি বুঝি? তোমরা বললে কি না তোমরা জঙ্গলে থাকো, তাই আমরা ভাবলাম, জঙ্গলে তো জন্তুরাই থাকে।

গুটুলি বললো, জঙ্গলে মানুষও থাকে। কিন্তু তোমাদের বয়েসী মেয়েরা জঙ্গলে একা একা আসে না। এখানে অনেক রকম বিপদ হতে পারে।

লাল ফ্রক বললো, আমরা একলা আসিনি তো দু’জনে এসেছি। এখানে কি রকম বিপদ হয়?

গুটুলি বললো, হিংস্র জন্তু—জানোয়ার থাকে, অনেক চোর—ডাকাতও লুকিয়ে থাকে জঙ্গলে। হলদে ফ্রক বললো, তোমারই বুঝি চোর—ডাকাত? তোমরা আমাদের বিপদে ফেলবে?

গুটুলি বললো, আচ্ছা মুস্কিল তো, এই মেয়ে দুটো কিছু বোঝে না। আমরা চোর—ডাকত হলে কি তোমাদের আগে থেকে সাবধান করে দিতুম?

রণজয় বললো, আহা রে, মেয়ে দুটি সত্যি বড় সরল। ওরা বেড়াতে এসেছে, খুশী মতন বেড়িয়ে নিক। আমরা ওদের পাহারা দেবো।

মেয়ে দুটি আঁজলা করে পুকুর থেকে খানিকটা জল তুলে সেই জলের দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর সেই জলে জিভ ঠেকালো।

গুটুলি চেঁচিয়ে বললো, ওই পুকুরের জল খেও না। কাছেই একটা ঝর্ণা আছে, সেই ঝর্ণার জল ভালো।

ওরা সেই কথায় তেমন আমল দিল না। চুমুক দিয়ে জলটুকু খেয়ে নিয়ে একজন আর একজনের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে কী যেন বললো।

পুকুরের ধারে ছোট ছোট ঘাসফুল ফুটে আছে। ওদের একজন একটা ফুল ছিঁড়ে নিয়ে তাতেও জিভ ঠেকালো। অন্যজন আর একটা ফুল তুলে খেয়ে নিল টপ করে।

রণজয় বললো, আহারে ওরা বোধহয় রাস্তা হারিয়ে বনের মধ্যে চলে এসেছে। খুব খিদে পেয়েছে ওদের।

এই গুটুলি, ওদের ডাক না। ওরা আমাদের সঙ্গে জলখাবার খেতে পারে।

গুটুলি জিজ্ঞেস করলো, ওগো, ও মেয়ে। তোমাদের নাম কী?

লাল ফ্রক পরা মেয়েটি বললো, নাম? আমাদের নাম? হ্যাঁ, আমাদের একটা করে নাম আছে। আমার নাম রুমুনা আর ওর নাম ঝুমুনা। এইবার বলো তো, তোমাদের নাম কী?

গুটুলি বললো, আমাকে সবাই গুটুলি বলে ডাকে। আর এই যে আমার বন্ধুকে দেখছো, এর নাম রণজয়, কিন্তু ওকে সবাই বলে নীল মানুষ।

ঝুমুনা জিজ্ঞেস করলো, তোমরা একজন এত ছোট, আর একজন এত বড় কেন?

এই সময় দূর থেকে রঘু চেঁচিয়ে বললো, চা, চা রেডি! বাবুদের কি পুকুর পাড়ে চা দিতে হবে, না এইখানে আসা হবে?

রণজয় বললো, রঘু, এইখানে চা আর খাবার—টাবার নিয়ে আয়!

গুটুলি বললো, ওগো রুমুনা—ঝুমুনা, তোমরা আমাদের সঙ্গে চা খাবে এসো!

রুমুনা—ঝুমুনা পরস্পরের চোখের দিকে তাকালো। তারপর রুমুনা বললো, না, আমরা এখন ওই দিকে বেড়াতে যাবো!

তারা দু’জনে নেমে পড়লো পুকুরে। তারপর পাশাপাশি দুটি হাঁসের মতন নিঃশব্দে সাঁতার কাটতে কাটতে চলে গেল ওপারে। তারপর নেচে নেচে গা থেকে জল ঝরাতে লাগলো।

একজন একটা ফুল ছিঁড়ে নিয়ে তাতেও জিভ ঠেকাল।

পুকুরের ওই ধারে একটা বন—তুলসীর ঝোপ। মেয়ে দুটি সেখান থেকে টপাটপ ফুল ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে লাগলো।

রণজয় বললো, কী সুন্দর দেখাচ্ছে ওদের। ওরা কি মেয়ে, না প্রজাপতি?

গুটুলি চোখ গোল গোল করে বললো, ওরা জুতো পরে জমে নেমে গেল, জুতো পরে সাঁতার কাটলো। এই কী গুণ্ডা মেয়েরে বাবা! ওরা আবার ফুল খাই!

রণজয় বললো, অনেকে কুমড়ো ফুল আর বকফুল ভাজা খায়। আমরা ওই ফুল খেয়ে দেখিনি, হয়তো ভালোই লাগবে!

এই সময় রঘু একটা থালায় করে চায়ের কাপ আর রুটি নিয়ে এলো। থালাটা নামিয়ে রেখে সে গোমড়া মুখে জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কি পাখির ডিমের ওমলেট খাবে?

গুটুলি বললো, সে আবার কী? পাখির ডিমের ওমলেট মানে?

রঘু বললো, কালকের ঝড়ে অনেকগুলো গাছ ভেঙে পড়েছে তো। আমাদের গুহার সামনে ওরকম দুটো গাছে দেখলুম যে বেশ কয়েকটা পাখির বাসা। তার থেকে আট—দশটা ডিম কুড়িয়ে রেখেছি।

রণজয় বললো, ধুৎ! পাখির ডিম আবার কেউ খায় নাকি? ডিমগুলো যেখানে পেয়েছিস, সেখানে রেখে আয়। তবে একটা ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছিস। অনেকদিন মুরগির ডিম খাওয়া হয়নি। এই জঙ্গলে আমি কয়েকবার বন—মুরগির ডাক শুনেছি। দেখতে হবে তো ওরা কোথায় ডিম পাড়ে।

গুটুলি বললো, মেয়ে দুটো গেল কোথায়?

মেয়ে দুটিকে আর দেখা যাচ্ছে না। তারা ঢুকে পড়েছে পেছন দিকের জঙ্গলে।

গুটুলি মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললো, এটা কিন্তু বেশ চিন্তার বিষয়। এখান থেকে গাড়ির রাস্তা অন্তত দশ—বারো মাইল দূরে। সেখান থেকে মেয়ে দুটো কি এত সকালে হেঁটে চলে এলো? কিংবা, কাল রাত্তিরে ঝড়—বৃষ্টির মধ্যে ওরা এই জঙ্গলেই কাটিয়েছে? ওদের সঙ্গে কোনো পুরুষ মানুষ নেই কেন?

রঘু বললো, মেয়ে? কোথায় মেয়ে? তোমাদের ভয়ে এই জঙ্গলে ভূত—পেত্নী ছাড়া আর কোনো মানুষ ঢুকবে না!

রণজয় বললো, রঘু, চাল আর ডাল আছে তো? দুপুরে ভালো করে খিচুড়ি বানা। বৃষ্টি পড়লেই আমার খিচুড়ির জন্য মন কেমন করে। গুটুলি আর আমি ততক্ষণ দেখে আসি, মেয়ে দুটো কী করছে!

রঘু বললো, সত্যি দুটো মেয়ে এসেছে নাকি? আমি দেখতে যাবো না? রান্না না হয় পরে হবে!

রণজয় আঙুল তুলে ধমক দিয়ে বললো, যা, নিজের কাজ কর গিয়ে!

গুটুলি বললো, রঘু, আবার যদি পালাবার চেষ্টা করিস, তা হলে এবার কিন্তু তোর ঠ্যাং খোঁড়া করে দেবো!

রণজয় গুটুলিকে তুলে নিল কাঁধের ওপর। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে পুকুরের ধার ঘুরে পেছন দিকের জঙ্গলটায় ঢুকে পড়লো।

একটু খুঁজতেই দেখতে পাওয়া গেল মেয়ে দুটিকে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। একটা ফাঁকা জায়গায় মুখোমুখি বসে আছে রুমুনা আর ঝুমুনা, তাদের মাঝখানে দুটো ছাই রঙের খরগোশ। মেয়ে দুটি হাততালি দিচ্ছে আর খরগোশ দুটো নাচছে।

গুটুলি বললো, বুনো খরগোশ ওদের কাছে পোষ মেনেছে, এ কি অদ্ভুত ব্যাপার?

রুমুনা গুনগুন করে একটা গান শুরু করলো, ঝুমুনা তার ঝোলা থেকে একটা ক্যামেরা বার করে ছবি তুলতে লাগলো।

গুটুলিকে কাঁধ থেকে নামিয়ে দিয়ে রণজয় বললো, তুই ওই দিকটায় দাঁড়া। খরগোশ দুটো ধরতে হবে। খিচুড়ির সঙ্গে খরগোশের রোস্ট খুব ভালো জমবে।

রণজয়ের গলায় আওয়াজ পেয়ে গান থামিয়ে রুমুনা বললো, নীল মানুষ, এই জিনিস দুটোর নাম কী?

রণজয় বললো, জিনিস মানে? এ দুটো তো খরগোশ।

তোমরা খরগোশ চেন না? তোমরা কোন দেশের মেয়ে?

গুটুলি বললো, এরা আসলে মেয়ে কিনা আমার সন্দেহ হচ্ছে।

রণজয় বললো, ওগো রুমুনা, ঝুমুনা আজ দুপুরে আমাদের গুহায় তোমাদের নেমন্তন্ন। খিচুড়ি আর খরগোশের রোস্ট।

খরগোশ দুটো নাচ থামিয়ে ফেলেছে। কিন্তু পালাচ্ছে না। রণজয় হাত বাড়িয়ে খরগোশ দুটোকে ধরতে যেতেই রুমুনা বললো, এই, ওদের ধরবে না! রণজয়ের হাত দুটো সঙ্গে সঙ্গে অবশ হয়ে গেল। তার থেকেও শক্তিশালী যেন কেউ চেপে ধরলো তার হাত। সে প্রচণ্ড চেষ্টা করেও তার হাত দুটো নামাতে পারলো না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রণজয় বললো, এইবার বুঝেছি। প্রথমেই আমার সন্দেহ হয়েছিল…তোমরা দু’জন অন্য গ্রহ থেকে এসেছে, তাই না?

ঝুমুনা খরগোশ দুটোর গায়ে হাত বুলিয়ে বললো, এই যাঃ যাঃ। তোরা খেলতে যা!

খরগোশ দুটো এবার তিন লাফে পালিয়ে গেল পাশের ঝোপে।

রুমুনা বললো, আমরা তো অন্য গ্রহ থেকে আসিনি। আমরা অনেক দূরে থাকি, রাত্তিরবেলা তোমরা যে ছায়াপথ দেখতে পাও, সেইখানে। ছুটির সময় আমরা বেড়াতে যাই। আমরা দুজনেই তো ফুল নিয়ে পড়াশুনো করি, তাই তোমাদের এখানে ফুল চেখে দেখতে এসেছি। তোমাদের এই ছোট্ট জায়গাটায় অনেক রকম ফুল ফোটে।

ঝুমুনা বললো, আমরা নিজের মনে বেড়াবো, তোমরা তোমাদের কাজ করতে যাও না!

রণজয় বললো, কাল রাত্তিরে একটা মহাকাশযান তোমাদের এখানে নামিয়ে দিয়ে গেছে, ঠিক কিনা? সেই জন্যই হঠাৎ ওরকম ঝড়—বৃষ্টি আর ভূমিকম্প হলো। বেশ বড় স্পেসশিপ মনে হচ্ছে। তোমরা সঙ্গে অদৃশ্য বডিগার্ড নিয়ে এসেছো বুঝি?

রুমুনা বললো, বডিগার্ড আবার কী? কেন, আমরা নিজেরা বুঝি বেড়াতে পারি না?

রণজয় বললো, আমার হাত দুটো কে চেপে ধরে আছে? ছেড়ে দিতে বলো।

মেয়ে দুটি একথা শুনে হেসে গড়াগড়ি দিতে লাগলো। খুব মিষ্টি তাদের হাসির শব্দ। ঝর্ণার কুলকুল শব্দের মতন।

ঝুমুনা বললো, তোমার হাত আবার কে ধরে থাকবে? আমরা তো কারুকে দেখতে পাচ্ছি না। তুমি হাত দুটো ওরকম উঁচু করে আছো কেন, নিচে নামাও!

রণজয়ের হাত দুটো আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। সে তাকালো গুটুলির দিকে। গুটুলির মুখখানা ভয়ে শুকিয়ে গেছে। সে ফিসফিস করে বললো, ওস্তাদ, এই মেয়ে দুটোর চোখ একেবারে সবুজ। ভেতরে যেন আলো জ্বলছে! এরা কি সত্যিকারের মেয়ে?

রণজয় বললো, সেটাও একটা কথা বটে। ওগো রুমুনা—ঝুমুনা, তোমরা কি সত্যিকারের মেয়ে? নাকি তোমাদের চেহারা অন্যরকম, ইচ্ছে করে পৃথিবীর মেয়েদের রূপ ধরেছো?

রুমুনা বললো, আমরা আমাদের মতন, আমরা হঠাৎ পৃথিবীর মেয়ে সাজতে যাবো কেন? তোমরা বাপু এখন যাও, আমাদের অনেক কাজ আছে। তোমাদের পৃথিবীর সব রকম ফুল আমাদের একটু একটু খেয়ে দেখতে হবে। ওই যে ওই বড় গাছটায় ফুল ফুটে আছে, ওগুলো কী ফুল?

রণজয় বললো, ও তো শালগাছের ফুল। অত উঁচু থেকে তোমরা পাড়বে কী করে? দাঁড়াও, আমি পেড়ে দিচ্ছি।

রণজয় উঠে দাঁড়াবার আগেই ঝুমুনা তরতর করে সেই গাছে উঠে গেল। ঠিক গাছ বেয়ে ওঠা নয়, জুতো পরা অবস্থাতেই সে যেন হেঁটে গেল গাছটার ডগায়। খানিকটা ফুল পেড়ে এনে নিজে একটু খেয়ে দেখলো, বাকিটা দিল রুমুনাকে।

রণজয় বললো, হুঁ বুঝলুম মাধ্যাকর্ষণে তোমাদের আটকাতে পারে না। তা শোনো রুমুনা আর ঝুমুনা, এই পৃথিবীর মানুষ তোমাদের কাণ্ডকারখানা দেখে অবাক হয়ে যাবে। কিন্তু আমি মহাশূন্যের অন্য অনেক গ্রহ—নক্ষত্র ঘুরে এসেছি। আমি নীল মানুষের গ্রহে গেছি, অদৃশ্য মানুষদের গ্রহ দেখেছি, তারপর যেখানে মানুষখেকো রাক্ষুসে গাছ আছে…তোমরা ঠিক কী উদ্দেশ্যে এসেছো বলো তো? শুধু ফুল খেতে? আমাদের পৃথিবীর কোনো ক্ষতি করতে আসোনি তো?

রুমুনা বললো, কী বিচ্ছিরি কথা! আমরা তোমাদের ক্ষতি করবো কেন? আমরা বেড়াতে এসেছি, আজ রাত্তিরেই আবার ফিরে যাবো।

—বাঃ, তা হলে তো তোমরা আমাদের অতিথি। আজ দুপুরে খিচুড়ি খেতে চলো আমাদের সঙ্গে। আচ্ছা আমি যে খরগোশ দুটো ধরার চেষ্টা করলুম, তোমরা বাধা দিলে কেন?

—বলছি তো, তোমরা আমাদের বিরক্ত করো না। আমাদের ইচ্ছে মতন বেড়াতে দাও। তোমরা অন্য জায়গায় যাও।

—আমাকে এরকম বকে বকে কথা বলছো? জানো, তোমার বয়েসী ছেলেমেয়েরা আমাকে দেখেই কত ভয় পায়!

—যারা ভয় পায়, তুমি তাদের ভয় দেখাওগে! আমরা ভয় পেতে একদম ভালোবাসি না।

গুটুলি বললো, ওস্তাদ, চলো কেটে পড়ি! ওদের চোখের দিকে তাকালেই আমরা বুক কাঁপে!

রণজয় বললো, সে কিরে, দুটো পুঁচকে মেয়েকে দেখে আমরা ভয় পেয়ে পালাবো? তা হলে দ্যাখ—

রণজয় দু’হাতে রুমুনা আর ঝুমুনাকে তুলে নিয়েই ছুঁড়ে দিল শূন্যে, তারপর তাদের হাত বদল করে আবার লুফে নিয়ে বললো, এবার? কেমন লাগলো?

রুমুনা বললো, আমাদের মাটিতে নামিয়ে দাও!

ঝুমুনা মুচকি হেসে বললো, এটা আবার একটা খেলা নাকি? তোমরা অন্য একটা খেলা দেখবে?

মাটিতে দাঁড়িয়ে ঝুমুনা এক আঙুলের ছোঁয়া দিয়ে গুটুলি আর রণজয়কে শুধু ঘুরিয়ে দিল একবার। সঙ্গে সঙ্গে ওরা দু’জন দুটো দু’সাইজের লাট্টুর মতন বনবন করে ঘুরতে লাগলো।

রণজয় চেঁচিয়ে বললো, থামাও, আমাদের থামিয়ে দাও!

রুমুনা আর ঝুমুনা হেসে গড়াগড়ি খেতে লাগলো মাটিতে। দূরে হঠাৎ অনেক লোকজনের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। কারা যেন এইদিকেই আসছে।

রুমুনা—ঝুমুনা এবার হাসি থামিয়ে উঠে বসলো। ওদের মধ্যে একজন থামিয়ে দিল রণজয় আর গুটুলিকে।

রণজয় বললো, এবারে তোমাদের আর একটা থেলা দেখাই?

হুড়মুড় করে গাছপালা ভেদ করে বেরিয়ে এলো কয়েকজন পুলিশ। সবার হাতে বন্ধুক। তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে রঘু।

রঘু হাত তুলে বললো, ওই দেখুন স্যার, ওই সেই দৈত্যটা। খুব সাবধান, ওকে পালাতে দেবেন না। এই দৈত্যটাই এদিককার সব ডাকাতি করে। আর ওই যে বেঁটে বাঁটকুলটা, ওটা মহাশয়তান। এদের চিড়িয়াখানায় বন্ধু করে রাখুন স্যার।

রণজয়ের বিশাল চেহারা দেখে পুলিশের মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে। শুধু ওদের মধ্যে যে ইনসপেক্টর, সে রিভলভার উঁচিয়ে বললো, হ্যান্ডস আপ! দৈত্য কোথায়, এ তো একটা লম্বা লোক। গায়ে নীল রং মেখেছে। গিনেস বুক অফ রেকর্ডসে এর চেয়েও লম্বা লোক আছে।

রঘু বললো, না, স্যার, ও সত্যি দৈত্য। ওর গায়ে গুলি লাগলেও বোধহয় মরবে না। ওই বেঁটে গুটুলিটাকে আগে ধরুন।

ইনসপেক্টর বললো, এই মেয়ে দুটি কোথা থেকে এলো? রঘু বললো, দৈত্যটাই নিশ্চয়ই ওদের ধরে এনেছে, স্যার। ইনসপেক্টর রুমুনা আর ঝুমুনাকে জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কে মা? তোমরা কোথা থেকে এসেছো?

রুমুনা মিষ্টি হেসে বললো, আমরা বেড়াতে এসেছি। তোমরা কে? তোমরা বুঝি চোর—ডাকাত?

ইনসপেক্টর শব্দ করে হেসে উঠলো। তারপর রণজয়কে বললো, চল, চল ব্যাটা?

একজন পুলিশ গুটুলির ঠিক মাথার কাছে বন্দুক তাক করে আছে। রণজয় বুঝতে পারলো, সে একটু এগোবার চেষ্টা করলেই ওরা আগে গুটুলিকে গুলি করবে। বিশ্বাসঘাতক রঘু ওদের আগেই বলে দিয়েছে যে সে গুটুলিকে কতটা ভালোবাসে।

সে রুমুনা আর ঝুমুনার দিকে তাকিয়ে বললো, ওরা আমাদের ধরে নিয়ে যেতে এসেছে। তা হলে যাই? আর খেলা হলো না!

ইনসপেক্টর বললো, এই মেয়ে দুটিকেও যেতে হবে থানায়। চলো তো মা, চলো, কোনো ভয় নেই, আমার সঙ্গে চলো!

রুমুনা বললো, না, আমরা যাবো না। আমরা বেড়াতে এসেছি!

রণজয় বললো, তোমাদের যদি ওরা জোর করে ধরে নিয়ে যেতে চায়, আমি তোমাদের বাঁচাবো। দেখবে?

সে রুমুনা আর ঝুমুনাকে দু’হাতে তুলে নিয়ে খুব উঁচুতে ছুঁড়ে দিয়ে বললো, যাও! তোমরা তোমাদের দেশে চলে যাও!

রুমুনা আর ঝুমুনা ঠিক দুটো পাখির মতন উড়তে লাগলো বনের মাথায়। পুলিশরা হাঁ করে ওপরের দিকে চেয়ে রইলো। সেই সুযোগে রণজয় একজন পুলিশের বন্দুকটা কেড়ে নেবার চেষ্টা করতেই ইনপেক্টরটি চালিয়ে দিল তার বুকে একটা গুলি! রণজয় বসে পড়লো মাটিতে।

রুমুনা আর ঝুমুনা ওপরে উড়তে উড়তে একজন আর একজনকে বললো, ওই লম্বা লোকটা মোটে একটাই খেলা জানে। আয়, ওদের আমি অন্য একটা খেলা দেখাই!

ঝুমনা বললো, পরে যে লোকগুলো এলো, ওদের মুছে ফেললে কেমন হয়?

রুমুনা বললো, ওরা আমাদের জোর করে নিয়ে যেতে চাইছিল, ওরা লোক ভালো না। ওরাই বোধহয় চোর—ডাকাত! ওদের ঘুম পাড়িয়ে দি?

ঝুমুনা আর রুমুনা উড়তে উড়তে একটা সুন্দর গান ধরলো। ঠিক যেন বাঁশির মতন আওয়াজ রেরুলো তাদের গলা দিয়ে। সেই গান শুনে এক একজন পুলিশ ধুপধাপ করে পড়ে যেতে লাগলো মাটিতে। সবাই অজ্ঞান। এমনকি গাছের পাখিরাও ঘুমিয়ে পড়লো।

রুমুনা আর ঝুমুনা নিচে নেমে এসে রণজয় আর গুটুলির হাত ধরে আবার উড়ান দিল। বনের মাথা ছাড়িয়ে, অনেক অনেক ওপরে, প্রায় মেঘের কাছে চলে এলো ওরা। রণজয়ের বুকে গুলি লেগেছে, রক্ত ঝরছে সেখান থেকে, কিন্তু তার প্রাণ আছে। রুমুনা আঙুলে করে তার মুখের একটু থুতু রণজয়ের ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিতেই তার রক্ত বন্ধ হয়ে গেল।

চোখে ফুঁ দিয়ে ওদের জ্ঞান ফিরিয়ে আনলো ঝুমুনা। তারপর বললো, এবারে মেঘের পিঠে বসিয়ে দেবো তোমাদের। ভাসতে ভাসতে চলে যাবে সমুদ্রে। এই খেলাটা তোমরা জান?

রণজয় বললো, না, জানি না। লক্ষ্মী দুই মেয়ে, তোমাদের কাছে আমি হেরে গেছি। হেরে গিয়েও আনন্দ হচ্ছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *