নীল পাথর (১)

নীল পাথর (১)

 বলিষ্ঠ বাহু দুটি থেকে মুক্তি পাবার জন্য নূরী আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে। আজ নূরীর চিৎকারে কেউ ছুটে এলো না। নির্জন বাড়িখানা যেন থমথম করছে। নূরী ভীষণভাবে কামড়ে দিলো বলিষ্ঠ হাতখানার উপর।

সঙ্গে সঙ্গে অস্ফুট শব্দ করে উঠলো ছায়ামূর্তি-উঃ!

মুহর্তে নূরীর মুখখানা দীপ্ত হয়ে উঠলো, বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললো–কে?…..

 নূরীর কানে মুখ নিয়ে চাপা কণ্ঠে বলে ছায়ামূর্তি–আমি হরিনাথ মাঝি…

হুর তুমি! অন্ধকারেই নূরী চিনতে পারে তার প্রিয়কে, দুবাহু দিয়ে বনহুরের কন্ঠ বেষ্টন করে। বলে–এত বিপদের মধ্যেও তোমার সেই দুষ্টুমি…..

বনহুরের কন্ঠ ছেড়ে দিয়ে অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নেয় নূরী।

বনহুর ওকে আরো নিবিড় করে টেনে নেয়।

 নূরী বলে উঠে–ছাড়ো।

 উঁহু, ছাড়বো না। কত সাধনার পর পেয়েছি…….

দুষ্টু!

যত খুশী বলো! একটু থেমে বলে–কতদিন এসেছি কিন্তু তোমার নাগাল পাইনি নূরী।

 চোরের মত চুপি চুপি এলে নাগাল পাবে কি করে?

বনহুর নূরীর কানে মুখ নিয়ে চাপা কণ্ঠে বললে–চোরই বটে। অমূল্য রত্ন চুরি করতে এসে যদি ধরা পড়ে যাই সেই ভয়ে….।

 নূরী হেসে বলে-হরিনাথ মাঝি সেজে তুমি……

 হাঁ, আমিই সব সময় ছায়ার মত পাশে ছিলাম তোমার। কতদিন সুযোগ খুঁজেছি তোমাকে কাছে পাবার জন্য, কিন্তু কি সাংঘাতিক মেয়ে তোমার জংলী মেয়ে সখীটা!

নূরী বনহুরের মুখে হাতচাপা দেয়–হুঁর, ওকে তুমি মন্দ বলো না যেদিন তুমি নদীবক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলে হরিনাথের বেশে, সেদিন চম্পার অনুচরগণ তোমাকে হত্যা করার জন্য তীর ধনু বাগিয়ে ধরতেই চম্পা ওদের বারণ করেছিলো, তোমাকে লক্ষ্য করে তীর যেন না ছোড়ে। সত্যি, সেদিন আমি চম্পার উপর ভীষণ রেগে গিয়েছিলাম ও তীর ছুঁড়তে দিলো না, বলে। ওর জন্যই তোমাকে আজ পেলাম হুর।

 বনহুর একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলে উঠলো–শুধু একবার নয় ধূরী, তোমার সখী আমাকে কয়েকবার মৃত্যুমুখ থেকে ফিরিয়ে নিয়েছে। ওর কাছে আমি ঋণী….

নূরী বলে–হুঁর, তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না, চম্পাকে তুমি এর পূর্বেও দেখেছো?

হাঁ কিন্তু চিনতে পারিনি। চম্পার যে পরিচয় তুমি পেয়েছে সেটাই তার আসল পরিচয় নয়।

 আমি জানি সে এক অসাধারণ মেয়ে।

তার চেয়েও বেশি। নূরী, তুমি জানো না, কিছুদিন পূর্বে তার সাহায্য আমাকে চরম এক– মুহূর্ত থেকে পরিত্রাণ দিয়েছে। ওর সহায়তা না পেলে সেদিন একটি সুন্দর ফুলের মত জীবন বিনষ্ট হয়ে যেতো, তাকে আমি উদ্ধার করতে সক্ষম হতাম না।

কার কথা বলছো হুর?

 সে এক মেয়ের কথা, নাম তার বিজয়া।

বিজয়া!

হাঁ। নীলা দ্বীপের রাজকন্যা বিজয়া–শোন তার কথা বলছি।

বনহুর বিজয়া সম্বন্ধে সব কথা খুলে বলে সংক্ষেপে নুরীর কাছে। এ কথাও বলে সে–বিজয়া আজও এই সূরজ দ্বীপে রয়েছে, যাকে তুমি সেদিন ঘোমটার আড়াল থেকে আমার পাশে। দেখেছিলে।

এবার হেসে উঠে নূরী–চিনেছিলে সেদিন তুমি আমাকে?

নূরীর কথায় বনহুরের মুখে হাসি ফুটে উঠে। অন্ধকারে নূরী বনহুরের হাসি দেখতে পায় না। তবু সে বুঝতে পারে, বলে–তাইতো আমি পালিয়েছিলাম।

 নাহলে তোমার সখীর সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতো। আমি তোমার ঘোমটা সরিয়ে ফেলতাম। সত্যি নূরী, কি যে ধৈর্য নিয়ে সেদিন আমি ফিরে এসেছি সেই পর্ণকুটির থেকে…. এত কাছে পেয়েও তোমাকে আমি স্পর্শ করতে পারিনি…… কাছে পাইনি নিবিড় করে….. বনহুর নূরীকে আবেগভরা হৃদয়ে টেনে নেয় কাছে, মুখের কাছে মুখ নিয়ে ডাকে-নূরী!

বনহুরের বুকে মুখ গুঁজে মধুর কন্ঠে বলে নূরী–বলো?

নূরী, আজ আমার কি যে আনন্দ হচ্ছে তোমাকে পেয়ে। নূরী–আমার নূরী…..

আমারও…..বনহুরের বুকে মুখ লুকায় নূরী। ভাবের আবেগে ভাষা হারিয়ে ফেলে যেন সে।

 এমন সময় বাইরে পদশব্দ শোনা যায়।

নূরী বলে উঠে–চম্পা আসছে।

বনহুর নূরীকে বাহুমুক্ত করে দিয়ে বলে–তাহলে চলি এবার?

 নূরী কিছু বলার পূর্বেই উধাও হলো বনহুর।

 দরজা খুলে গেলো, কক্ষে প্রবেশ করলো চম্পা।

তার পিছনে সেই বৃদ্ধা, হাতে তার জ্বলন্ত মশাল।

চম্পা বৃদ্ধার হাত থেকে মশালটা নিয়ে গুঁজে রাখে পাশের দেয়ালের ফাঁকে, তারপর বলে– মাইদি, তুমি এবার যেতে পারো।

বৃদ্ধা চম্পাকে অভিবাদন করে বেরিয়ে যায়।

 চম্পা এগিয়ে যায় নূরীর বিছানার পাশে। নূরীর নাম ধরে ডাকে।

নূরী উত্তর দেয়–চম্পাদি এসেছো?

হাঁ বোন এসেছি। চম্পা বসলো নূরীর বিছানার পাশে।

 নূরী ততক্ষণে বিছানায় উঠে বসেছে।

চম্পার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো নূরী। আজ তার মুখখানাকে ভিন্নরূপ লাগলো তার কাছে-বড় করুণ, বিষণ্ণ মনে হলো।

নূরী বললো–এ কদিন কোথায় ছিলে চম্পাদি?

সে কথা নাই বা শুনলে! একটু থেমে বললো চম্পা– নূরী, আমাকে অনেক দূরে যেতে হচ্ছে, বহুদূরে–হয়তো আর তোমার সঙ্গে দেখা নাও হতে পারে। তাই একটা কথা বলতে এলাম। নূরী, আমার লোক তোমাকে পৌঁছে দেবে তোমার প্রিয়ের কাছে। আর তোমাকে কেউ তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেবে না।

নূরী বলে উঠে–তোমার গল্প যে শেষ হয়নি চম্পাদি?

নূরীর কথায় চম্পার মুখোভাব গম্ভীর হয়ে পড়লো, কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললো–হাঁ, আজ তোমাকে গল্পটার শেষ অংশ শোনাবো।

খুশী হয় নূরী, বলে সে বলো?

চম্পা বলতে শুরু করে–হীন্দরাজ কন্যা চন্দ্রা সিন্দরাজ পুত্র জয়রাজকে সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসে কিন্তু চন্দ্রা জানতো তাকে সে কোনোদিনই পাবে না—তবু চন্দ্রা তাকে চিরকাল ভালবাসবে… একটু আনমনা হয়ে যায় চম্পা, তার বুকচিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। তারপর আবার বলতে শুরু করে–চন্দ্রা জয়রাজের প্রেমভিখারী নয়, তাকে সে কামনা করেছিলো, সে আশাও তার পূর্ণ হয়েছে। জয়রাজের বুকে মাথা রেখে চন্দ্রা নিজের জীবনকে স্বার্থক করে নিয়েছে। সেটুকু পাওয়াই যে চার জীবনে চরম পাওয়া…… নূরী আমার গল্প শেষ হলো।

নূরী বলে উঠলোনা, তোমার গল্প শেষ হয়নি–বলো সেই চন্দ্রা কে, কোন্ দেশে তার। বাড়ি?

খিলখিল করে হেসে উঠে চম্পা-চন্দ্রার পরিচয় জানতে চাও? বড় চালাক মেয়ে তুমি নূরী।

হাঁ, জানতে চাই; আর চালাক মেয়ে আমি– তাও বটে।

যদি বলি সেই চন্দ্রা আমি।

 আমি জানি তুমি ছাড়া সে আর কেউ নয়। চম্পাদি, এবার বলো তোমার সে জয়রাজ কে?

 জয়রাজ সম্বন্ধে আমি কিছুই বলতে পারবো না।

না, তোমাকে বলতে হবে।

যা বলেছি তার বেশি আমি বলতে পারবো না নূরী, তুমি আমাকে অনুরোধ করো না।

চম্পাদি, তোমার আরও একটি পরিচয় আছে যা তুমি এখনো আমার কাছে গোপন রেখেছে। বলো কে তুমি?

চম্পার হাসি যেন থামতে চায় না এবার।

নুরী বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে, সত্যি বড় অদ্ভুত মেয়ে চম্পা। জংলী মেয়ের বেশে সে এক সম্রাজ্ঞী।

চম্পার মুখে হাতচাপা দেয় নূরী, বলে সেতুমি না বললেও আমি জানি তুমি কে!

চম্পার মুখের হাসি মুহূর্তে মিলিয়ে যায়, বলে–সত্যি তুমি জানো?

হাঁ, জানি তুমিই আশা….

কিন্তু আশা কে তা জানো?

নূরী কোনো জবাব দিতে পারে না।

 চম্পাই বলে উঠে মনসুর ডাকুর নাম শুনেছো?

হাঁ, তার নাম আমার অতি পরিচিত।

সেই মনসুর ডাকুর কন্যা ইরানী…..

তুমি-তুমি ইরানী!

হাঁ নূরী, জানি তুমি আমাকে ঘৃণা করবে কিন্তু ….. না, আর নয়– আমার গল্প শেষ হয়েছে, এবার বিদায়! সঙ্গে সঙ্গে ইরানী মেঝের এক অংশে পা দিয়ে চাপ দেয়, অমনি সমস্ত কক্ষে ছড়িয়ে পড়ে একরাশ ধোয়া। নূরীর চোখের কাছে সব ঘোলাটে লাগে, অল্পক্ষণ পর সমস্ত ধোয়া সরে যায় কিন্তু চম্পার দেখা আর পায় না।

নূরী ডাকে- চম্পাদি …………. চম্পাদি…..

 কোনো জবাব আসে না।

নূরী কক্ষের চারদিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করে, কাউকে দেখতে পায় না।

ততক্ষণে ভোর হয়ে এসেছে।

*

বনহুর তার খেজুর পাতার শয্যা ত্যাগ করতেই বিজয়া একখানা কাগজের টুকরা এনে তার হাতে দেয়—- তিলক, পড়ে দেখো।

বনহুর বিজয়ার হাত থেকে কাগজের টুকরাখানা হাতে নিয়ে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়, তারপর বলে এটা কোথায় পেলে বিজয়া?

চম্পা আমাকে দিয়ে গেছে।

 বনহুর চমকে উঠে– চম্পা! কোথায় সে?

এই কাগজের টুকরাখানা দিয়ে সে বললো এটা বাবুকে দিস্ বোন। একটু থেমে বললো বিজয়া চম্পাকে আজ বড় বিষণ্ণ, মলিন লাগলো, কিছু যেন ঘটেছে ওর।

বনহুর চিঠির টুকরাখানা আবার চোখের সামনে তুলে ধরলো- ওতে লেখা ছিলো মাত্র একটি লাইন।

“বাবু, তোর পুরস্কার দিয়ে গেলাম, সূরজ নদীপারের বাড়িখানায় আছে, নিস্।”

 বিজয়া বলে উঠলো তিলক, চম্পা লেখাপড়া জানতো?

হাঁ, তাই মনে হচ্ছে। বললো বনহুর।

এমন সময় মাইদি বুড়ী এসে দাঁড়ায়, হাতে তার এক ঝুড়ি ফলমূল। বনহুর আর বিজয়াকে লক্ষ্য করে বললো— তোরা খেয়ে নে, যেতে হবে।

বিজয়া অবাক কণ্ঠে বললো– কোথায় যেতে হবে বুড়ীমা?

বুড়ী ফোকলা মুখে হাসি টেনে বললো- এ বনের মায়া এবার ত্যাগ করতে হবে তোমাদের। নাও খেয়ে নাও, বাছা, বেশি কথা বলো না।

বনহুর হেসে বলে- আচ্ছা খাচ্ছি। এসো বিজয়া, খেয়ে নাও।

বিজয়া এগিয়ে আসে, বনহুর ঝুড়ি থেকে একটা ফল তুলে নিয়ে বিজয়ার হাতে দেয়, তারপর খেতে শুরু করে সে নিজে।

বৃদ্ধা ততক্ষণে একটা ঝোলার মত থলের মধ্যে কি সব গুটিয়ে তুলতে থাকে।

 বিজয়া এটা লক্ষ্য না করলেও বনহুর লক্ষ্য করছিলো আর ফল নিয়ে গোগ্রাসে খাচ্ছিলো। খেতে খেতে মাঝে মাঝে কথা বলছিলো বনহুর বিজয়ার সঙ্গে।

ফল খেতে বনহুর ভালবাসে কাজেই প্রচুর ফল সে খেতো। ছোটবেলা থেকেই এটা তার অভ্যাস। তাই তার স্বাস্থ্যও ছিলো অদ্ভুত সুন্দর। যেন কেউ মুগ্ধ হতো তার অপরূপ সৌন্দর্যে।

 শিশুকালের অভ্যাস বনহুর আজও ত্যাগ করতে পারেনি, ফল পেলে সে খুশি হতো খুব। সমস্ত খাবার ত্যাগ করে সে ফল খেতো।

চম্পা এ খবরটা জানতে পেরেছিলো, বনহুরের জন্য তাই সে প্রচুর ফলমূল সংগ্রহ করেছিলো সূরজ দ্বীপের গহন বনের মধ্যেও।

বনহুর ফল খাচ্ছিলো আর সে কথাই ভাবছিলো– তার জন্য চম্পা অনেক পরিশ্রম করেছে। এখনো সে যা করছে তার ঋণ কোনোদিন পরিশোধ করতে পারবে না।

চম্পাই যে আশা আর আশাই যে মনসুর ডাকুর কন্যা ইরানী, এটা আজ সম্পূর্ণ খোলাসা হয়ে। গেছে বনহুরের কাছে।

বনহুর আর বিজয়ার খাওয়া হয়ে গেলে বৃদ্ধা এসে বলে– চলো এবার তোমরা।

 বনহুর আর বিজয়া অনুসরণ করে বৃদ্ধাকে।

কিছুদূর অগ্রসর হতেই তারা দেখতে পায় তিনটা অশ্ব দাঁড়িয়ে আছে। একটি ধবধবে সাদা, আর দুটি কালো।

বৃদ্ধা বনহুরকে লক্ষ্য করে বললো– এই অশ্বপৃষ্ঠে চেপে বসো, অনেক দূর যেতে হবে।

বৃদ্ধা কথাটা বলে নিজে একটা অশ্বপৃষ্ঠে চেপে বসলো। বনহুর বিজয়াকে লক্ষ্য করে বললো– অশ্বপৃষ্ঠে চাপতে পারবে বিজয়া?

বিজয়া রাজার মেয়ে, মাঝে মাঝে সে অশ্বপৃষ্ঠে ভ্রমণে বের হতো, তাই কিছুটা অভ্যাস ছিলো।

বনহুরের সহায়তায় সে একটি অশ্বে চেপে বসলো।

 বনহুরের জন্য রইলো সাদা অশ্বটা।

এবার বনহুর সাদা অশ্বপৃষ্ঠে উঠে বসতেই বৃদ্ধা নিজ অশ্বে কষাঘাত করলো।

বৃদ্ধার অশ্বচালনা দেখে বনহুর অবাক না হয়ে পারলো না। দক্ষ অশ্বচালকের মতই সে অশ্ব চালিয়ে চলেছে।

বনহুর আর বিজয়ার অশ্ব পাশাপাশি চলেছে। বিজয়া তেমন অশ্ব চালনায় পারদর্শী নয়, তাই বনহুর তাকে ছেড়ে যেতে পারে না।

বৃদ্ধা কিছুদূর এগিয়ে আবার থেমে পড়ে।

বনহুর আর বিজয়া পৌঁছলে পুনরায় সে অশ্ববেগ বাড়িয়ে দেয়।

বেশ কিছু সময় চলার পর তারা নদীতীরে এসে পৌঁছলো।

একখানা বজরা অপেক্ষা করছিলো তাদের জন্য। বৃদ্ধা ইংগিত করতেই বজরা নিয়ে মাঝিরা। এগিয়ে এলো।

বৃদ্ধা এবার বনহুরকে লক্ষ্য করে বললো– এই বজরায় চেপে ওপারে যেতে হবে।

বনহুর বিজয়াসহ বজরায় উঠে পড়লো।

 মাঝিরা বজরা ছাড়লো।

বজরার ছাদে গিয়ে বসলো বনহুর।

 বিজয়াও বজরার ছাদে বনহুরের পাশে এসে দাঁড়ালো।

 বনহুর বললো–বসো বিজয়া।

বিজয়া বসলো বনহুরের পাশে।

 বজরা ভেসে চলেছে।

বিজয়া বললো– সত্যি, এত সুন্দর বজরা এই গহন বনের মধ্যে নদীবক্ষে দেখতে পাবো ভাবতে পারিনি। এ বজরা এলো কোথা থেকে তিলক বলতে পারো?

 হাঁ পারি– এ সবই চম্পার কৃতিত্ব। বিজয়া, চম্পা এ বনের রাণী।

ওকে দেখলে কিন্তু তেমন মনে হয় না। অথচ ওর মধ্যে এত গুণ আছে! কে জানতো সে লেখাপড়া জানে! আচ্ছা তিলক, সে তোমাকে কি পুরস্কার দেবে?

বনহুর একটু হেসে বললো– ফুল।

ফুল?

হা।

ফুল নিয়ে কি করবে তিলক?

ফুল আমি ভালবাসি তাই।

 চম্পা জানতো বুঝি তুমি ফুল ভালবাসো?

 হয়তো জানতো।

বিজয়া আনমনে কিছু ভাবতে থাকে, বোধ হয় চম্পার কথাই ভাবছিলো সে।

নদীর জলরাশির দিকে তাকিয়ে বনহুর বলে–কি সুন্দর জলরাশি, দেখো দেখো বিজয়া কতবড় একটা মাছ। বনহুর বিজয়ার অন্যমনস্ক ভাবটা নষ্ট করার জন্যই কথাটা বলে।

বিজয়া বহু মাছ দেখেছে কিন্তু নদীর জলে মাছকে সাঁতার কাটতে কোনোদিন দেখেনি। খুশি হলো বিজয়া মস্তবড় মাছটা দেখে, বললো– তিলক, ঐ মাছটা ধরা যায় না?

যায়, কিন্তু ধরা বড় কষ্টকর।

বুঝেছি গভীর জলের মাছ ওটা, তাই তাকে ধরা মুস্কিল।

হা।

 যেমন তুমি।

বনহুর বিজয়ার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকায়, অবাক হবার ভান করে বলে তার মানে?

বিজয়া একটা দীর্ঘশ্বাস গোপনে চেপে বলে– তিলক, সে তুমি বুঝবে না।

বনহুর মৃদু হেসে বলে তোমাদের হেঁয়ালিপূর্ণ কথা বুঝা সবার পক্ষে সহজ নয়। বিজয়া, আজ একটা কথা তোমাকে জিজ্ঞেস করবো, অবশ্য তুমি সত্য কথা বলবে কিনা সন্দেহ।

তিলক, তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না?

করি কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে করি না, কারণ মেয়েদের লজ্জা তাদের কণ্ঠ রোধ করে দেয়। সব। সময় তারা সহজ-সরলভাবে সব কথা বলতে পারে না।

জিজ্ঞেস করো, আমি বলবো।

বলবে?

হা।

বিজয়া, আমি জানি তুমি আমাকে গভীরভাবে ভালবেসে ফেলেছো, যদিও আমার সম্বন্ধে সব জানো তবুও তুমি এ ভুলটা করে বসেছে। কিন্তু এবার তোমার ভুল ভাঙতে হবে, বিদায় দিতে হবে আমাকে।

তিলক।

জানি আমাকে বিদায় দিতে তোমার খুব কষ্ট হবে, তবুও যেতে হবে আমাকে……. একটু থেমে আবার বললো বনহুর— বিজয়া, তুমি কি চাও, কি পেলে সুখী হবে বলো?

বিজয়ার মুখ রাঙা হয়ে উঠে, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সে নদীর দিকে। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে ভাবে কিছু তারপর বলে– আমি যা চেয়েছিলাম তা পাবো না কোনোদিন জানি, তবু তোমার কাছে একটা অনুরোধ, রাখবে বলো?

বলেছি রাখবো!

তুমি যেখানেই থাকো আমাকে মনে রেখো। বিজয়া তোমার– এ কথা কোনোদিন ভুলে যেও না।

বনহুর নির্বিকার চোখে তাকালো বিজয়ার দিকে, তার ঐ জোড়া কুঁচকে উঠলো।

বিজয়াও চোখ তুললো কিন্তু বনহুরের দৃষ্টির কাছে সে স্থির থাকতে পারলো না, দ্রুত উঠে চলে গেলো সে বজরার সিঁড়ি বেয়ে নীচে।

বনহুর মৃদু হাসলো।

 বিজয়া নীচে নেমে আসতেই বৃদ্ধা মাইদি বুড়ী বললো– খারাপ লাগছে বুঝি?

না বুড়িমা।

তবে এলে কেন?

তোমার কাছে একটু বসবো বলে।

বসো মা, বসো।

বিজয়া বৃদ্ধার পাশে বসে পড়ে। কিছুক্ষণ নীরবে বসে বসে ভাবে, কি ভাবে সে নিজেই জানে, তারপর বলে–বুড়ী মা, একটা কথা তোমাকে জিজ্ঞেস করবো, সঠিক জবাব দেবে তো?

বলো, দেবো মা দেবো।

আচ্ছা বুড়ীমা, তুমি কি জীবনে কাউকে ভালবেসেছিলে?

বিজয়ার কথায় হাসে বুড়ীমা, তারপর বলে– এই কুৎসিত কদাকার মেয়ের ভালবাসা কে নেবে বোন! বেসেছিলাম একজনকে কিন্তু প্রতিদান পাইনি।

বৃদ্ধার কথায় বিজয়ার মনে বিপুল এক জানার বাসনা জাগে, আগ্রহভরা কণ্ঠে বলে তোমার সে কাহিনী আমাকে শোনাবে বুড়ীমা?

একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বৃদ্ধা, তারপর বলে সে কাহিনী বড় করুণ। বৃদ্ধার কথাটা যেন তার বুকের অন্তঃস্থল থেকে বেরিয়ে আসে। একটু থেমে বলতে শুরু করে আমার বাবা ছিলো মস্তবড় শিকারী। বনে বনে শিকার করে বেড়ানো ছিল তার নেশা। আমি কিন্তু সব সময় আমার বাবার সঙ্গে থাকতাম। কুৎসিত ছিলো আমার চেহারা তাই কোনো পুরুষ আমাকে বিয়ে করতে রাজী ছিলো না। আমার বাবা জংলী সর্দার, অনেক জংলী যুবককে বাবা আমাকে বিয়ে করতে বলতো, এমন কি ভয়ও দেখাতে কিন্তু কেউ তবু রাজী হলো না। শেষ পর্যন্ত বাপ-মা আমার বিয়ের কথাই ভুলেই গেলো। বয়স তো আর বসে রইলো না, বেড়েই চললো। দিন যায়– মন আমার চঞ্চল হয়ে উঠলো, একজন সাথীর জন্য ছটফট করতে লাগলো আমার হৃদয়। তখন একদিন একটা মস্তবড় বাঘ শিকার করলো আমার বাবা, নিয়ে গেলো শহরে। আমি ও গেলাম তার সঙ্গে। বহুলোক বাবা আর বাঘটাকে ঘিরে দেখতে লাগলো। এক একজন অবাক হয়ে গেছে বাঘটাকে দেখে কারণ এতবড় বাঘ সহসা দেখা যায় না। বেশ কয়েক দণ্ড পর ভীড় ঠেলে এগিয়ে এলো এক বাবু। বাবার কাছে বাঘটার দাম করতে লাগলো। বাবা যা দাম চাইলো তাই দিয়ে বাঘটাকে নিয়ে গেলো বাবুটা। কিন্তু বাঘটার সঙ্গে বাবু আমার মনটাকে চুরি করে নিয়ে গেলো। বাৰু আমার দিকে ফিরেও চাইলো না অথচ আমি বাবুকে গভীরভাবে ভালবেসে ফেললাম। তারপর থেকে আমি বাবুকে খুঁজে ফিরতে লাগলাম শহরের নানা জায়গায়। একদিন এক বাড়ীর সামনে দেখলাম সেই বাবুকে। মস্তবড় বাড়ি। গাড়িতে চেপে চলে গেলো কোথায়। আমি পথের একপাশে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম। একসময় ফিরে গেলাম সেখান থেকে। বাবা শহর ছেড়ে চলে গেলো। আমি পালিয়ে থাকলাম। রোজ ঐ পথের ধারে গিয়ে দাঁড়াতাম বাবুকে একনজর দেখতে পাবো বলে। বাবু গাড়িতে চেপে রোজ আমার পাশ কেটে চলে যেতো কিন্তু একবারও সে ফিরে তাকিয়ে আমাকে দেখতো না। তবু আমি তাকে একনজর দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। একদিন বাৰু যখন গাড়িতে উঠতে যাবে ঠিক তখন আমি গিয়ে দাঁড়ালাম বাবুর পাশে বার আমাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলো। আমি ডাকলাম বাবু! বাবু এবার তাকালো আমার দিকে, পকেট থেকে একটা টাকা বের করে আমার হাতে দিতে গেলো— আমি হাত গুটিয়ে নিয়ে বললাম– বাবু আমি ভিখারী নই। বাবু বললো– কি চাও আমার কাছে? আমি বুকে সাহস টেনে বললাম– বাবু তোকে ভালবাসি…. আমার কথা শেষ হলো না, সঙ্গে সঙ্গে বাবু আমার গালে প্রচণ্ড এক চড় বসিয়ে দিলো। আমি পড়ে গেলাম মাটিতে। পাথরের সিঁড়িতে মাথা ঠুকে কেটে গেলো, রক্তে সিঁড়ির ধাপ লালে লাল হয়ে উঠলো। বাবু ততক্ষণে গাড়িতে চেপে চলে গেছে। অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালাম, মাথার রক্তে জামা-কাপড় ভিজে পা দু’খানা আমার রাঙা হয়ে উঠলো। আমার চোখে প্রতি হিংসার আগুন জ্বলে উঠলো, আমি ফিরে এলাম আমার বাসস্থানে। কিন্তু সেই অদম্য ভালবাসার পরিবর্তে সেদিন আমার মনে ভীষণ ক্রোধের সৃষ্টি হলো। সমস্ত রাত ধরে আমি না ঘুমিয়ে ছটফট করতে লাগলাম। রাত ভোর হলো। একটা মতলব জাগলো আমার মনে, আমি আমার তীর-ধনুটা তুলে নিলাম হাতে। এক সময় এসে দাঁড়ালাম সেই জায়গায়, যে জায়গা থেকে রোজ আমি তাকে দেখতাম। আজ পূর্বের সে দৃষ্টি নিয়ে আমি সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই, আজ আমার চোখে হত্যার নেশা। প্রতীক্ষা করতে লাগলাম কখন বের হবে সে। অন্যান্য দিন হৃদয়ে জাগতো এক বিপুল উন্মাদনা– আজ সেই উন্মাদনা নেই, আছে এক দানবীয় হিংস্র মনোভাব। আমার আশা পূর্ণ হলো, প্রতিদিনের মত বেরিয়ে এলো সে। ঐ দণ্ডে আমি ধনুকে তীর জুড়লাম– মাত্র এক পলক, বাবু গড়িয়ে পড়লে মাটিতে ……এবার থামলো বৃদ্ধা, তার চোখেমুখে একটা বেদনার ছাপ ফুটে উঠলো, একটা দীর্ঘশ্বাস গোপনে চেপে নিয়ে বলতে শুরু করলো আবার বাবু মাটিতে পড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই আমি সেখান থেকে ছুটে পালিয়ে গেলাম। আর কোনোদিন সেদিকে যাইনি। তারপর চল্লিশ বছর কেটে গেছে, কাউকে আর ভালবাসতে পারিনি….. থামলো বৃদ্ধা, মন তার চলে গেছে সেই হারানো চল্লিশ বছর আগের দিনে।

হঠাৎ মাঝি এসে বললো— মাইদি, ঘাট আইছে।

 সম্বিৎ ফিরে পেলো বৃদ্ধা।

 বিজয়াও যেন কেমন আনমনা হয়ে পড়েছিলো, মাঝির ডাকে তার ও চমক ভাঙ্গে।

বৃদ্ধা বলে— এবার চলো, তোমাদের নামতে হবে।

বিজয়া পিছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলো বনহুর এসে দাঁড়িয়েছে তাদের পিছনে।

বৃদ্ধা বনহুর আর বিজয়াসহ নেমে পড়লো ভাঙ্গায়।

দু’জন লোক তাদের অভ্যর্থনা জানালো।

একজন যুবক, একজন বয়স্ক।

 বৃদ্ধা বললো– অশ্ব এনেছো?

 লোক দু’জনার মধ্যে একজন বললো– হাঁ, এনেছি।

কোথায় রেখেছো?

 ঐ যে গাছটার নীচে।

বনহুর আর বিজয়াসহ বৃদ্ধা অদূরস্থ একটি অশথ গাছের নীচে এসে দাঁড়ালো, দেখলো তিনটা অশ্ব দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।

বৃদ্ধার কথায় বনহুর আর বিজয়া অশ্বপৃষ্ঠে চেপে বসলো।

বৃদ্ধা তৃতীয়টিতে চাপলো।

বিজয়া অশ্বপৃষ্ঠে চেপে তাকালো বনহুরের দিকে, মনে তার ভয় জাগছিলো হঠাৎ কোনো বিপদ এসে না পড়ে।

বনহুর বুঝতে পারলো বিজয়া ভয় পেয়েছে, তাই সে হেসে বললো–আমি আছি।

বিজয়ার মনটা সাহসে ভরে উঠলো। খুশীতে দীপ্ত হলো তার মুখমণ্ডল। তাইতো, তার ভয় পাবার কি আছে, তিলক যদি পাশে থাকে সব ভয় দূর হয়ে যায়।

অশ্বগুলো ছুটতে শুরু করে।

বিজয়া দেখতে পায় তাদের কিছুটা দূরে আরও দুটি অশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্য করতেই বুঝতে পারে তারা অন্য কেউ নয়, সেই লোক দুটি যারা তাদের নদীতীরে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলো।

এক সময় তারা সেই বাংলো প্যাটার্নের বাড়িখানায় পৌঁছে যায়।

 বিজয়া অবাক না হয়ে পারে না। গহন বনের মধ্যে নির্জন স্থানে এমন সুন্দর বাড়ি দেখবে সে ভাবতে পারেনি।

বিজয়া মুগ্ধ হয়ে দেখছে।

বনহুর আর বিজয়াকে নিয়ে বাড়িটার মধ্যে প্রবেশ করে বৃদ্ধা।

চম্পার পুরস্কার দেখার জন্য বিজয়ার মনে বিপুল বাসনা জাগে। তিলক বলেছে তাকে চম্পা ফুল পুরস্কার দেবে। ফুল– না জানি কি ফুল, সে ফুল কে জানে!

বনহুর আর বিজয়াকে একটি কক্ষে এনে বসায় বৃদ্ধা, তারপর বেরিয়ে যায়। যাবার সময় বলে যায় সে এবার তোমার পুরস্কার আনছি।

বিজয়ার দিকে তাকায় বনহুর।

ওর মুখে হাসির আভাস-ফুল সেও ভালবাসে, তিলক পেলে তাকেও দেবে নিশ্চয়ই। বিজয়া বললো– তিলক, তোমার পুরস্কার আমাকে দেবে না?

বনহুর বললো- দেব!

 সত্যি?

হাঁ, যদি নাও!

নিশ্চয়ই নেবো, ফুল যে আমিও ভালবাসি।

এমন সময় বৃদ্ধার সঙ্গে কক্ষে প্রবেশ করে সেটা গোমটা ঢাকা চম্পার বান্ধবী।

বিজয়া প্রথমে অবাক হয়।

বৃদ্ধা হেসে বলে- বাবু, এই নাও পুরস্কার।

মুহূর্তে বিজয়ার মুখ গম্ভীর থমথমে হয়ে পড়লো। বিস্ময় নিয়ে তাকালো সে ঘোমটা-ঢাকা তরুণীর দিকে।

বৃদ্ধা তরুণীর হাতখানা বনহুরের হাতে তুলে দিয়ে বললো নাও।

বনহুর যত্ন সহকারে সুন্দর ফুলের মত হাতখানা নিজের মুঠায় চেপে ধরলো, তারপর সে তরুণীর ঘোমটা সরিয়ে ফেললো দ্রুত হাতে।

নূরী আর বনহুরের দৃষ্টি বিনিময় হলো।

উভয়ে উভয়ের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো মাত্র।

 বিজয়া বলে উঠলো– তিলক, এই কি তোমার ফুল?

বছর বৃদ্ধাকে বলে এর নাম কি বুড়ীমা?

বৃদ্ধা বললো– এরই নাম ফুল।

বিজয়া বিস্ময় নিয়ে দেখতে লাগলো, সত্যি ফুলের মতই সুন্দর মেয়েটি।

বৃদ্ধা এবার বললো তোমার পুরস্কার পেয়ে গেছে, এবার তোমরা বিদায় নাও। বৃদ্ধা হাতে তালি দিলো, সঙ্গে সঙ্গে সেই যুবক এসে দাঁড়ালো, যে যুবকটি নদীতীরে অপর একজনের সঙ্গে তাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছিলো। বৃদ্ধার সম্মুখে নতমুখে এসে দাঁড়ালো।

বৃদ্ধা বললো– এদের নিয়ে যাও এবার।

বনহুরের দিকে লক্ষ্য করে বললো যুবকটি– এসো তোমরা। আমার সঙ্গে…..বনহুর আর বিজয়া যুবকের অনুসরণ করলো। নূরীও অনুসরণ করলো তাদের।

বিজয়া বললো— তুমি আবার কোথায় যাবে?

নূরী কোনো কথা না বলে দাঁড়িয়ে পড়লো।

বনহুর বললো– বিজয়া, উপহারের জিনিসে অবহেলা করতে নেই।

ওকে নিয়ে কি করবে তুমি?

কোনো উপকারে আসতে পারে।

 বনহুরের কথা শুনে হাসে নূরী?

বিজয়া গম্ভীর হয়ে পথ চলতে শুরু করে। বিজয়া জানে না এই সেই নূরী, যাকে তিলক খুঁজে চলেছিলো কতদিন ধরে।

যুবকটি এগিয়ে চলেছে, তাকে অনুসরণ করছে বনহুর, বিজয়া আর নূরী।

বহুক্ষণ পথ চলার পর তারা একটা শব্দ শুনতে গেলো, থমকে দাঁড়ালো বনহুর ও বিজয়া, নূরীও দাঁড়িয়ে পড়লো।

বনহুরকে লক্ষ্য করে বললো বিজয়া ও কিসের শব্দ?

বনহুর কান পেতে শুনছিলো, এবার সে বললো– সমুদ্রের গর্জন বলে মনের হচ্ছে।

বনহুরদের সঙ্গে যুবকটিও থেমে পড়েছিলো, তাকে বললো বনহুর নিকটে বুঝি সমুদ্র আছে?

হাঁ, তোমাদের সেখানেই নিয়ে যাচ্ছি।

 বিজয়া বললো কেন? আমাদের সমুদ্রের দিকে কেন নিয়ে যাচ্ছো?

যুবকটি কিছু বলার আগেই বললো বনহুর—আমাদের জন্য সেখানে জাহাজ প্রতীক্ষা করছে।

বনহুরের কথায় চমকে উঠলো যুবকটি, যদিও তাকে কেউ লক্ষ্য করছিলো না তখন। বনহুরের দৃষ্টি ছিলো কিন্তু ওর দিকে, কথাটা বলে আড়চোখে সে তাকিয়ে দেখে নিলো একবার।

 বিজয়া বলে উঠলো–জাহাজ?

হাঁ বিজয়া, চম্পা আমাদের জন্য সেখানে জাহাজের ব্যবস্থা করেছে। এবার আমরা এই সূরজ বন ত্যাগ করবে।

বিজয়া খুশী হয়ে বললো- সত্যি বলছো তিলক?

হাঁ সত্যি, এবার তোমার বাবা-মার কাছে তোমাকে পৌঁছে দিতে সক্ষম হবে বলে আমার বড় আনন্দ হচ্ছে।

বিজয়া বললো তুমি তো আমাদের ত্যাগ করতে পারলে বেঁচে যাও…

আরো হয়তো কিছু বলতো বিজয়া, নূরীর দিকে তাকিয়ে সে নিশ্চুপ হয়ে যায়।

বনহুর আর অন্যান্য সবাইকে অবাক করে দিয়ে সম্মুখে এসে দাঁড়ায় মাইদি বুড়ী। একমুখ হেসে বলে এলাম বিদায় দিতে।

বিজয়া আর বনহুর অবাক না হয়ে পারে না, বৃদ্ধা তাহলে এতদিন আমাদের অনুসরণ করে এসেছে।

বনহুরদের পথ দেখিয়ে এবার নিয়ে চললো বৃদ্ধা।

কিছুদূর অগ্রসর হতেই অবাক হলো সবাই– যুবকটি কোথায় উধাও হয়েছে।

বিজয়া বললো– ও লোকটি গেলো কোথায়?

 বনহুর হেসে বললো– হয়তো জাহাজে চলে গেছে।

 বৃদ্ধা বনহুরের কথায় থমকে দাঁড়িয়ে ফিরে তাকিয়ে পুনরায় চলতে শুরু করলো।

*

জাহাজে পৌঁছে বনহুর দেখলো সেটা সম্পূর্ণ একটি মালবাহী জাহাজ। কয়েকজন খালাসী আর জাহাজের চালক ছাড়া আর কেউ নেই। আরও আশ্চর্য হলো বনহুরের দল, কারণ সেই যুবকটিকে তারা জাহাজে দেখতে পেলো। বনহুর অবশ্য আশ্চর্য হয়নি, সে পূর্বেই বলেছিলো তাকে আমরা জাহাজে পাবো।

সেই যুবকটিই বনহুর ও তার সঙ্গীদের জাহাজে অভ্যর্থনা জানালো।

বৃদ্ধা এবার বিদায় নিলো তাদের কাছে।

এটাই বৃদ্ধার শেষ বিদায়।

বনহুর আর বিজয়ার মাথায় হাত রেখে বৃদ্ধা আর্শীবাদ করলো। আর্শীবাদ করলো সে নূরীকেও।

নূরী কিন্তু বিজয়ার সম্মুখে বেশ জড়োসড়ো হয়েই রইলো, স্বামীকে পাশে পেয়েও সে নিশ্চুপ রইলো বোবার মত, যদিও তার মনে কত কথা উদয় হচ্ছিলো। বারবার ইচ্ছা হচ্ছিলো তার, বনহুরের গলা জড়িয়ে ধরে বলে, হুর, এতদিন এমনি করে কোথায় ছিলে তুমি? কেন তুমি দেখা দাওনি আমাকে?

তোমাকে ছেড়ে কত কষ্টে ছিলাম আমি, তুমি জানো না আমার মনের ব্যথা….

হয়তো বনহুরের মনেও এমনি কত কথা জাগছিলো- কাজের ফাঁকে ফাঁকে নূরীর মুখখানা তুলে ধরে হয়তো একটা চুম্বনরেখা এঁকে দিতো তার রক্তরাঙা ওষ্ঠদ্বয়ে কিন্তু নিজকে সংযত করে রেখেছিলো বনহুর অতি সাবধানে। নূরী যেন একজন সত্যি সত্যি অপরিচিতা জন। বিশেষ করে বিজয়ার সম্মুখে তারা উভয়ে উভয়কে এড়িয়ে চলতে লাগলো।

বিজয়া কিন্তু সব সময় বনহুরের পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে রইলো, বনহুর যেন ওর সঙ্গে মেশার সুযোগ না পায়।

নূরী ইচ্ছা করেই দূরে দূরে রইলো, অবশ্য দৃষ্টি বিনিময়ের মধ্যেই তাদের মনের কথাবার্তা চলছিলো।

 জাহাজে উঠার আগে বুড়ীমা বনহুরকে একটা কাগজের মোড়ক দিয়ে বললো তুই আমার জান বাঁচিয়েছিলি, সেজন্য আমি তোকে এটা দিলাম, কিন্তু এটা তিন মাসের আগে খুলবি না।

বনহুর হাসিমুখে মোড়কটা গ্রহণ করেছিলো।

তারপর জাহাজে এসে বনহুর হাত নেড়ে বিদায় নিলো বৃদ্ধার কাছে।

বিজয়া, নূরী এরাও হাত নাড়তে লাগলো।

বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে রইলো তীরে।

 জাহাজখানা ক্রমান্বয়ে সরে যেতে লাগলো অন্তরালে।

বনহুর জাহাজটাকে ঘুরে ফিরে দেখতে লাগলো, তার সঙ্গে রইলো সেই যুবকটি।

বৃদ্ধা বিদায়কালে বলেছিলো, এর নাম মাংতু, খুব ভাল ছেলে। মাংতু তোমাদের সঙ্গে থাকবে। ও থাকতে তোমাদের কোনো অসুবিধা হবে না।

বনহুর শুধু মাথা দুলিয়ে বৃদ্ধার কথাগুলো শুনছিলো।

এখন মাংতু বনহুরকে সঙ্গে করে সব দেখাচ্ছিলো।

বনহুর জাহাজের ভিতরে প্রবেশ করে দেখলো একটি যুদ্ধ জাহাজে যা যা দরকার সব আছে তার মধ্যে। বাইরে থেকে মালবাহী জাহাজ মনে হলেও ভিতরে অস্ত্র বোঝাই জাহাজের খোলসের ভিতরে প্রবেশ করে দেখতে পায় বনহুর কয়েকটা বড় বড় কামান বসানো রয়েছে। কামানের মুখগুলো এমনভাবে বাইরে বেরিয়ে আছে যা বাইরে থেকে একটুও বুঝা যায় না।

জাহাজের চারপাশে মেশিনগান বসানো আছে। যেদিকে যখন প্রয়োজন সেদিক থেকেই সেগুলো ব্যবহার করা হবে। জাহাজের একস্থানে অনেকগুলো রাইফেল ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র স্তূপাকার করে রাখা হয়েছে। একপাশে গোলা-বারুদের স্তূপ।

এবার জাহাজের পিছন অংশে বনহুরকে নিয়ে গেলো মাংতু।

বনহুর খুশি হলো দেখে, এ অংশে কতগুলো মূল্যবান মেসিন ও যন্ত্রপাতি রয়েছে। ওয়্যারলেস মেসিন, টেলিভিশন, চুম্বকযন্ত্র– যা বহুদূরের কোনো জাহাজকে আকর্ষণ করে, চুম্বক বাইনোকুলার— এ মেসিনে হাজার হাজার মাইল দূরের বস্তু নিকটে মনে হয়। এ ছাড়া মিটার ডিনামাইট, রকেট বোমা, হাতবোমা আরও অন্যান্য মারাত্মক অস্ত্র। যা দূর থেকে শত্রুদের ধ্বংস করা যায়, এরকম অনেক অস্ত্র রয়েছে। বনহুর সব দেখে নিলো ভালভাবে।

এবার বনহুর মাংতুকে বললো- যা প্রয়োজন সব রয়েছে দেখলাম। পারবে তুমি আমাকে সাহায্য করতে?

মাংত পাগড়িটা ঠিক করে নিয়ে মাথা দোলালো।

বনহুর ওর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললো– সাবাস!

এবার মাংতুসহ ফিরে এলো বনহুর বিজয়া আর নূরীর পাশে। এতক্ষণ গোটা জাহাজখানা ঘুরেফিরে দেখতে বেশ ঘেমে উঠেছে বনহুর, তার সুন্দর মুখমণ্ডলে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠেছে

বনহুর এসে দাঁড়াতেই বিজয়া এগিয়ে এলো বললো সে বড় ঘেমে গেছো তিলক!

 হা! কথাটা বলে সে হাতের পিঠে কপালের ঘাম মুছতে গেলো।

বিজয়া আঁচল হাতে বললো আমি মুছেদি।

 থাক, হয়ে গেছে।

বিজয়া তবু শুনলো না, সে আঁচল দিয়ে বনহুরের মুখমণ্ডল মুছে দিয়ে বললো– বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছো? বসো আমি হাওয়া করি। বিজয়া আঁচল দিয়ে হাওয়া করতে লাগলো।

বনহুর বাধা দিলো না ওকে, শুধু নূরীর দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো মাত্র।

নূরীর ইচ্ছা হচ্ছিলো একবার স্বামীর বুকে মাথা রেখে কিছু বলে, কিন্তু অতি কষ্টে সে মনকে শক্ত করে রেখেছিলো। তবু একটু ফাঁক খুজছিলো যে মুহূতে সে স্বামীকে এতটুকু কাছে পাবে।

জাহাজ তখন চলেছে।

মাংতু তাদের বিশ্রামের জন্য ক্যাবিন দেখিয়ে দিলো, এক ক্যাবিনেই থাকবে ওরা।

ওদের বিশ্রাম ক্যাবিনে পৌঁছে দিয়ে মাংতু চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর এক খালাসীর হাতে রাশিকৃত খাবার নিয়ে ফিরে এলো। বহুদিন এসব খাবার খেতে পায়নি তারা, সবাই খাবার পেয়ে খুশী হলো। সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে বিজয়া, কারণ সে রাজার মেয়ে, রাজ-খাবার খেয়ে তার অভ্যাস। বনহুর আর নরীর তেমন অসুবিধা হয়নি, কারণ তারা শিশুকাল হতেই জঙ্গলে বাস করেছে; জঙ্গলের ফলমূল খেয়ে বড় হয়েছে তবু তারাও খেতে বসে অনেক তৃপ্তি অনুভব করলো। আজ যে খাবার তারা পেয়েছে সে খাবারের মধ্যে রয়েছে মাছ, মাংস আর দুধ।

তৃপ্তি সহকারে খাবার খেলে বনহুর, বিজয়া আর নূরী। একই টেবিলে ওরা খাচ্ছিলো।

মাংতু টেবিলে খাবার রেখে চলে গিয়েছিলো।

 বনহুর খাচ্ছিলো এবং পরিবেশন করছিলো।

বিজয়া বনহুরের পাশে বসেছিলো। নূরী ছিলো কিছুটা দূরে।

নূরী লক্ষ্য করছিলো বনহুর মাছ খাচ্ছে না, কারণ সে জানে, বনহুর মাছ খেতে ভালবাসে কিন্তু কাঁটা বেছে খেতে পারে না। অনেকদিন নূরী পাশে বসে ওর মাছের কাঁটা বেছে দিয়েছে, তবেই মাছ খেয়েছে বনহুর। আজ বনহুর মাছ খাচ্ছে না দেখে মনটা ওর বড় খারাপ হয়ে গেলো। সেও মাছগুলো নিজের পাত থেকে উঠিয়ে রাখলো।

 বিজয়া লক্ষ্য না করলেও বনহুর লক্ষ্য করলো। সে পুনরায় মাছগুলো পাতে তুলে নিয়ে কাটাসহ মুখে দিতে গেলো। এবার নূরী নিশ্চুপ থাকতে পারলো না, সে দ্রুত চেয়ার ত্যাগ করে বনহুরের পাশে এসে হাত চেপে ধরলো কিন্তু মুখে সে কিছু বললো না।

বিজয়া আশ্চর্য হয়ে বললো– একি, ও তোমাকে মাছ খেতে দেবে না বুঝি?

বনহুর বললো– হয়তো এ মাছগুলো ও খেতে চায়। বেশ, নিয়ে যাও ফুল।

 বিজয়া কোনো কথা না বলে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। সে ভাবে, ওর এত সাহস তিলকের খাবার মাছ ও নিতে চায়! বিজয়া রাগতভাবে ওকে ধাক্কা দেয় যাও।

নূরী পড়ে যাচ্ছিলো বনহুর ওকে ধরে ফেলে।

ক্ষণিকের জন্য নূরী স্বামীর বুকে আশ্রয় নেয়, মন তার অপূর্ব এক অনুভূতিতে শিউরে উঠে। সহসা সরে যায় না নূরী স্বামীর বাহু থেকে।

বিজয়ার রাগ আরও বেড়ে যায়, বলে সে— তিলক, একি করছো, ছেড়ে দাও ওকে।

বনহুর একটু হেসে নূরীকে মুক্ত করে দেয়।

নূরী চলে যায় নিজের আসনে।

বিজয়া গম্ভীর মুখে খেতে থাকে। তিলক ওকে ধরে ফেলায় মনে মনে খুব ক্রুদ্ধ হয় সে।

নীরবে খাওয়া শেষ করে বনহুর। মাছ খাওয়া তার হয় না। নূরীও মাছ খায় না, কতদিন পর মাছ পেয়েছিলো বনহুর কিন্তু সে খেতে পারবে না, নূরী খাবে কি করে!

খাওয়া শেষ করেই বনহুর ছুটলো জাহাজের ক্যাপ্টেনের কাছে। জাহাজ এখন কোন্ দিকে কোন্ পথে চলেছে জানা তার একান্ত দরকার।

বনহুর ক্যাপ্টেনের ক্যাবিনের সম্মুখে পৌঁছতেই তার পাশ কেটে চলে গেলো মাংতু। প্রায় ধাক্কা খেতে গিয়ে একটুর জন্য বেঁচে গেলো সে।

বনহুর ক্যাপটেনের ক্যাবিনে প্রবেশ করে দেখতে পেলো, জমকালো এক নিগ্রো একটি ম্যাপ খুলে তন্ময় হয়ে দেখছে। বনহুর লোকটার পিছনে এসে দাঁড়ালো, ঝুঁকে দেখে নিয়ে আচমকা তার কাঁধে হাত রাখলো।

লোকটা চমকে উঠলো না বা চট করে ফিরে তাকালো না।

বনহুর বললো– ক্যাপ্টেন, এত মনোযোগ দিয়ে কি দেখছো?

এবার লোকটা ম্যাপ থেকে দৃষ্টি তুলে নিয়ে বনহুরের মুখে তাকালো, বললো- জাহাজখানা কোন্ পথে চলেছে তাই দেখছি।

কোন্ পথে এবং কোথায় যাচ্ছে এখনও আমার জানা হয়নি। তাছাড়া আমার সঙ্গে তোমার পরিচয়ও হয়নি এখন পর্যন্ত।

বনহুর এটুকু বলতেই লোকটা বলে উঠলো তোমার সম্বন্ধে আমার জানার কোনো উৎসাহ নেই। আমার পরিচয় দিচ্ছি, আমার নাম ফাংহু লং। আমি এ জাহাজের ক্যাপ্টেন।

আমি বুঝতে পেরেছি। তবে হাঁ, এই জাহাজে যখন আমি আছি তখন আমার সম্বন্ধে তোমার জানা একান্ত দরকার। অবশ্য মাংতুর কাছে আমার সম্বন্ধে সব জেনে নিয়েছো তবুও জেনে রাখো, আমি তোমার বন্ধুজন, তোমাকে আমি তোমার কাজে সাহায্য করতে পারি।

লোকটার জমকালো মুখে একটু হাসি ফুঠে উঠলো, দাঁতগুলো ঠিক যেন গাঢ় মেঘের মধ্যে বিদ্যুৎ চমকালো একটুখানি, বললো– পারবে আমাকে সাহায্য করতে?

বনহুর বললো পরীক্ষা করে দেখতে পারো।

 বেশ। বললো- বললো ফাংহু লং।

বনহুর বসলো তার পাশে, ম্যাপখানার উপরে ঝুঁকে পড়ে বললো– এ ম্যাপখানা দেখছি……

বনহুরের কথা শেষ হয় না, ফাংহু বলে উঠে- এটা হলো নীল নদের বিভিন্ন প্রবেশপথের ম্যাপ। এই যে রেখাগুলো দেখছো এ গুলো নীল নদ থেকে যে সব মোহনা অন্যান্য সাগরে বা নদীতে এসে যোগ হয়েছে সেগুলো।

আমরা এখন কোন পথ হয়ে কোনদিকে চলেছি বলবে কি?

নিশ্চয়ই বলবো। ম্যাপের একটি মোটা রেখার উপরে আংগুল দিয়ে লম্বালম্বি দেখিয়ে বললো এখন আমরা এই পথ ধরে চলেছি। নীল নদ অতিক্রম করে হীরা পর্বতের পাশ কেটে ফারহা নদের মোহনা দিয়ে বেরিয়ে আবার আমরা নীল নদে এসে পড়বো। নীলনদ হয়ে নীল দ্বীপে পৌঁছবো।

বনহুর ভ্রূকুঁচকে শুনছিলো ফাংহুর কথাগুলো। এবার সে বলে উঠলো– এত ঘুরে যাবার কি দরকার ছিলো ফাংহু লং, জংঙ্গী নদের প্রবেশপথ তো অতি সহজ পথ।

ফাংহু বললো– ও পথে যাওয়া আমাদের মোটেই সমীচীন হবে না।

কারণ?

 কারণ জানতে চাও তুমি?

ফাংহুর কথায় বললো বনহুর– হা।

 তবে এসো আমার সঙ্গে। ফাংহু ম্যাপখানা ভাঁজ করে রেখে ক্যাবিন থেকে বেরিয়ে পড়লো।

বনহুর অনুসরণ করলো তাকে।

মেসিনাদির ক্যাবিনে প্রবেশ করে এক পাশের দেয়ালের কাছে এসে দাঁড়ালো ফাংহু।

 বনহুর তার পাশে এসে দাঁড়ালো।

ফাংহু এবার ক্যাবিনের দেয়ালে একটি সুইচে চাপ দিলো, সঙ্গে সঙ্গে ক্যাবিন জমাট অন্ধকারে ভরে উঠলো। পরক্ষণেই জ্বলে উঠলো টেলিভিশনের বাল্বের নীল আলো। বনহুর তাকিয়ে আছে টেলিভিশনের পর্দায়। পর্দা কাঁপছে …..তারপর ফুটে উঠলো সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ঢেউয়ের দোলায় দুলছে একটি জাহাজ, পরপর আরও দুটি জাহাজ দেখা যাচ্ছে অস্পষ্টভাবে।

ফাংহু বললো— দেখেছো জঙ্গী নদের প্রবেশপথে পুলিশ জাহাজ কড়া পাহারা দিচ্ছে। আমাদের জাহাজ এ পথে এগুলেই ওরা আমাদের পাকড়াও করে ফেলবে।

বনহুর তখনও স্থির নয়নে তাকিয়ে আছে টেলিভিশনের পর্দায়। তীক্ষ্ম নজরে দেখছে সে ভাল করে জাহাজগুলোকে। অস্পষ্ট দেখা গেলেও বনহুরের চোখে ধরা পড়লো– প্রত্যেকটা জাহাজের ভিতরে রয়েছে পুলিশ।

ফাংহু বললো– আমরা চাই এই জাহাজগুলোর দৃষ্টি এড়িয়ে নীলনদ অতিক্রম করে বাইরে

বনহুর তখনও স্থিরভাবে তাকিয়ে আছে টেলিভিশনের পর্দায় শুধু জাহাজগুলোই সে লক্ষ্য করছে না, লক্ষ্য করছে জাহাজগুলোর আশেপাশে জলরাশি। সে বুঝতে পারে, চুম্বক টেলিভিশন দ্বারা হাজার হাজার মাইল দূরের দৃশ্য এই টেলিভিশনের পর্দায় টেনে নেওয়া হয়েছে। কিছুক্ষণ ভালভাবে দেখে নিয়ে হঠাৎ তার স্বভাবমত হেসে উঠে– হাঃ হাঃ হাঃ ..অদ্ভুত সে হাসির শব্দ।

চমকে উঠে ফাংহু লং, বিস্ময়ভরা চোখে তাকায় সে বনহুরের মুখের দিকে।

বনহুর হাসি বন্ধ করে বলে উঠে- ফাংহু, তুমি চাও এই জাহাজগুলোর দৃষ্টি এড়িয়ে নীলনদ অতিক্রম করতে কিন্তু আমি চাই এদের সম্মুখে দিয়ে বেরিয়ে যেতে।

অবাক হয়ে ফাংহু বনহুরের কথাগুলো শুনলো, তারপর বলে উঠলো– তুমি কি পাগল, পুলিশ আমাদের গ্রেফতার করার জন্য সমুদ্রবক্ষে টহল দিচ্ছে আর আমরা যাবো তাদের সম্মুখ দিয়ে? এটা কিছুতেই সম্ভব নয়।

 বনহুর এবার বলে উঠলো- ফাংহু, চোরের মত পালানোর চেয়ে বীরের মত গ্রেফতার হওয়া অনেক শ্রেয়। পুলিশ বাহিনীর সম্মুখ দিয়েই আমরা যেতে চাই ফাংহু। কথাটা বলে বেরিয়ে যাবার জন্য ফিরে দাঁড়াতেই দেখতে পায় মাংতু দাঁড়িয়ে আছে তাদের পিছনে। বনহুরকে দেখে সরে দাঁড়িয়ে পথ ছেড়ে দেয় মাংতু।

বনহুর বেরিয়ে যায়।

নিজের ক্যাবিনে এসে বসে ভাবতে থাকে কিছু।

বিজয়া আর নূরী তখন আপন মনে গল্প করছিলো। বনহুর খুশী হলো ওদের এই পরিবেশ লক্ষ্য করে। যা হোক, ওদের মধ্যে তবে মিল হয়ে গেছে।

বনহুর এবার গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকে।

জাহাজের একটানা ঝকঝক শব্দ তার মনকে অদ্ভুতভাবে চঞ্চল করে তোলে। তার ধমনির রক্ত ক্রমশঃ যেন উষ্ণ হয়ে উঠছে।

এমন সময় ফাংহু তার জমকালো বিরাট বপু নিয়ে ক্যাবিনে প্রবেশ করে, একটু কেশে নিজের উপস্থিতি জানালো সে।

বনহুর বললো– এসো।

ফাংহু বনহুরের পাশে এসে বসলো, দু’জনার মধ্যে এবার গভীরভাবে আলোচনা চললো। ফাংহুর সঙ্গে ইংরেজিতেই কথাবার্তা হচ্ছিলো কারণ ফাংহু ভাল বাংলা বলতে পারে না।

এরপর থেকে বনহুর আর ফাংহুর মধ্যে অত্যন্ত বন্ধুত্ব ভাব জমে উঠলো।

প্রায়ই ওরা একসঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতো এবং কাজও করতে একসঙ্গে। ফাংহুর চেহারাটা বিদঘুঁটে হলেও ওর মনটা ছিলো অত্যন্ত ভাল, বনহুর দু’চার দিন ওর সঙ্গে মিশেই বুঝতে পারলো। ওরা দুজন একসঙ্গে যখন কাজ করতো তখন মনে হতো যেন দুটি অদ্ভুত মানুষ। একজন অপূর্ব সুন্দর আর একজন কুৎসিত কদাকার। যেমন স্বর্গ আর নরক, আকাশ আর পাতাল।

 আজকাল বিজয়া আর নূরীর মধ্যেও বেশ ভাব জমে উঠেছে, উভয়ের উভয়কে না হলে চলেই না যেন।

 বিজয়া কিন্তু আজও নূরীকে বনহুরের সঙ্গে মিশতে দেয় না, নানা ছলনায় সে ওকে ওর কাছ হতে দূরে সরিয়ে রাখে।

অবুঝ বিজয়া জানে না নূরীর সঙ্গে তার তিলকের কি সম্বন্ধ।

একদিন বনহুর জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধ্যার অন্ধকার তখনও জমাট হয়ে উঠেনি।

বাইনোকুলার দিয়ে তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিলো সে সম্মুখের দিকে।

আশেপাশে কেই নেই তখন।

বিজয়া ক্যাবিনে ছিলো।

নূরী এসে দাঁড়ায় বনহুরের পাশে।

বনহুর তখনও স্থির নয়নে তাকিয়েছিলো সম্মুখপানে–দূরে অনেক দূরে। নূরীর উপস্থিতি সে বুঝতেই পারে না। নূরী ডাকে–হুঁর!

বনহুর চোখ থেকে বাইনোকুলার সরিয়ে ফিরে তাকায় নূরী..

হুর, এমন করে আর দূরে দূরে থাকতে পারবো না–উঃ অসহ্য ….নূরী বনহুরের বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলে।

বনহুর ওকে গভীর আবেগে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে মুখখানা উঁচু করে ধরে নূরী, আমারও কিন্তু তোমার মতই কষ্ট হচ্ছে। এত কাছে পেয়েও কত দূরে…. কিন্তু তুমি তো আমারই আছে– এটুকু সান্ত্বনা।

 আমার কিন্তু মনে হয় তুমি যেন অনেক দূরে সরে গেছো, আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে। হুর, কেন আমার এমন মনে হয় জানি না।

তোমার মনের দুর্বলতা দূরী, সব সময় হয়তো কিছু ভাবো।

কি ভাবি?

হয়তো আমাকে অবিশ্বাস করো।

নূরী একটু অভিমান করে বলে— অবিশ্বাস তোমাকে কোনো দিনই করি না, আমি জানি তুমি পবিত্র, নিষ্পাপ।

হাঁ, এই বিশ্বাসই আমাকে সব সময় জয়ী করেছে। নূরী….. আমার নূরী….. নূরীর মুখখানা তুলে ধরে বনহুর,তারপর গভীর চুম্বনে রাঙা করে তোলে ওর ওষ্ঠদ্বয়। কতদিন পর ওকে এত কাছে পেয়েছে।

ঠিক ঐ সময় বিজয়া এসে পড়ে সেখানে।

বনহুর নূরীকে বাহুমুক্ত করে দিয়ে সরে দাঁড়ায়।

বিজয়া নূরী আর বনহুরকে দেখো মুখখানা গম্ভীর করে ফেলে, বলে সে –তিলক, তুমি এখানে

হাঁ বিজয়া।

ফুল নিয়ে খেলা করছিলে, জানতাম না। তাহলে এখানে আসতাম না আমি।

 বিজয়া!

তিলক, এতদিন তোমার যে পরিচয় আমি পেয়েছি তা দেবতার মতই নির্মল। আর আজ আমার সে বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে। বেশ…. বিজয়া গম্ভীর মুখে চলে গেলো সেখান থেকে।

নূরী বিজয়াকে অনুসরণ করলো

বনহুরের মুখে ফুটে উঠলো একটা হাসির রেখা। ওরা চলে যেতেই বনহুর বাইনোকুলার। চোখে তুলে দূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।

*

আজ তিনদিন তিন রাত্রি জাহাজ এগিয়ে চলেছে।

সূরজ দ্বীপ এখন বহুদূরে।

জাহাজখানা বনহুরের নির্দেশমতই জঙ্গীনদ অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছে।

ফাংহু বনহুরকে বিশ্বাস করেছে এবং তার কথামতই কাজ করছে। মাঝে মাঝে মাংতু এসে বনহুর আর ফাংহুর কথাবার্তা শোনো। এদের খাবার পরিবেশন করে মাংতু নিজে।

কখনও কখনও বিজয়া আর নূরীর পাশে গিয়ে বসতো কিন্তু মাংতুর অভ্যাস সে কথা বলতো কম। পাগড়িটা কিন্তু সব সময় থাকতো তার মাথায় পাগড়ির আঁচলখানাকে সে এমনভাবে গলায় জড়িয়ে রাখতো যে তার মুখের অর্ধেকটা প্রায় ঢেকে থাকতো।

বিজয়া ওকে সুনজরে দেখতো না। কারণ ও প্রায়ই তাদের পাশে পাশে ঘুরঘুর করে বেড়াতো।

নূরী অবশ্য ওকে সমীহই করতো, মাংতুর আচরণ তার ভাল লাগতো। সব সময় ওদের খোঁজখবর নিতো মাংতু। কখন কি প্রয়োজন ওদের সে যেন বুঝতে পারতো। দরকারমত সব এনে। হাজির করতো মাংতু তাদের সামনে! নূরী আরও এক কারণে মাংতুকে ভালবাসতো, সে হলো বনহুরের প্রতি মাংতুর গভীর মনোযোগ। কখন সে কি খাবে মাংতু সেইভাবে সংগ্রহ করে খাবার টেবিলে এনে রাখতো। বনহুর ফল ভালবাসে, সাগরবক্ষেও মাংতু, রোজ খাবার টেবিলে কোথা হতে ফল জোগাড় করতো। বনহুর তৃপ্তির সঙ্গে খেতে।

নুরী এসব লক্ষ্য করতো, তার হুর কিসে খুশি হয়, তাতেই তার আনন্দ। মাংতু ছাড়া এ জাহাজে তাদের যে বড় অসুবিধা হতো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

জাহাজে নূরীর মন্দ লাগছে না। কামনার জন তার সঙ্গে রয়েছে, সে পাশে রইলে মৃত্যুকেও সে ভয় করে না।

বিজয়ার সম্মুখে তাদের মধ্যে লুকোচুরি মেলামেশাও নূরীর মনে নতুন এক উন্মাদনা সৃষ্টি করে। দূর থেকে বনহুর যখন ওকে শুভেচ্ছা জানায় তখন ওর বড় ভাল লাগে।

সেই ঘটনার পর থেকে বিজয়া কিন্তু বড় গম্ভীর হয়ে পড়েছে। নূরীর সঙ্গে বেশ মিল জমে উঠেছিলো, ঐদিনের পর থেকে কথা বলে না সে ওর সঙ্গে। নূরী কিন্তু সব সময় ওর সঙ্গে মিশতে চায়।

একদিন নূরী বসে আছে ক্যাবিনে,—- আজ তার মনটা সন্তান জাভেদের জন্য বড় চঞ্চল হয়ে উঠেছে, বারবার জাভেদের মুখখানা ভেসে উঠেছে তার মনের পর্দায়। কতদিন সে সন্তানকে দেখেনি। না জানি এখন জাভেদ কত বড় হয়েছে, কেমন হয়েছে।

এমন সময় বিজয়া ক্যাবিনে প্রবেশ করে, সোজা এসে দাঁড়ায় সে নূরীর পাশে, রুক্ষ কঠিন কণ্ঠে বলে— ফুল, তুমি জানো না তিলক আমার কে। জানলে তুমি সেদিন অমন করে ওর কাছে যেতে না প্রেম ভিক্ষা করতে।

নূরী ভ্রু কুঁচকে তাকায় বিজয়ার মুখের দিকে।

বিজয়া তবু বলেই চলেছে– তুমি যতই মনে করো তিলককে কিছুতেই তুমি আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না।

নূরী স্বচ্ছকণ্ঠে বলে উঠলো– বিজয়া, আমি চাইনে তোমার তিলককে কেড়ে নিতে।

তাহলে সেদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে কেন গিয়েছিলে ওর পাশে?

বলবো না।

জানি তুমি অপরাধী তাই বলবে না। কিন্তু মনে রেখো ফুল, তোমার আশা পূর্ণ হবে না কোনোদিন। তুমি জানো না, তিলক দেবতার চেয়েও পবিত্র।

চোখ দুটো আনন্দে দীপ্ত হয়ে উঠে। বিজয়া তাকে যতই তিরস্কার করছে ততই ওর মনে এক অপূর্ব অনুভূতি দোলা দিয়ে যাচ্ছে। স্বামীর গর্বে বুক তার স্ফীত হয়ে উঠেছে। তার স্বামী দেবতার চেয়েও পবিত্র …. বারবার বিজয়ার কথাটা তার কানে মধু বর্ষণ করে। ছুটে বেরিয়ে যায় নূরী।

বনহুর তখন জাহাজের ইঞ্জিনে কোনো একটা কাজে ব্যস্ত ছিলো। আশেপাশে তার কেউ নেই, সে একাই কাজ করছিলো।

এমন সময় নূরী ছুটে এসে বনহুরের কণ্ঠ ধরে তার বাহু দুটি দিয়ে, তারপর চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেয় ওর গাল দুটো।

বনহুর ভেবে পায় না নূরী হঠাৎ আজ এমন হলো কেন! আশ্চর্য হয়ে বলে— কি করছো নূরী।

বনহুরের কথায় কোনো জবাব না দিয়ে যেমন ঝড়ের মত এসেছিলো তেমনি বেরিয়ে গেলো সে।

বনহুর কিছু বুঝতে না পেরে একটু হেসে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলো।

এমন সময় ফাংহু ব্যস্তসমস্ত হয়ে প্রবেশ করলো সেখানে পরদেশী বাবু, শীগগীর আসুন, আমাদের জাহাজ থেকে দূরে কোনো একটা জাহাজ নজরে আসছে।

বনহুর হাতের পিঠে কপালের ঘাম মুছে ওপাশের টেবিল থেকে বাইনোকুলারটা হাতে তুলে নিয়ে বললো–চলো দেখি।

সম্মুখ ডেকে এসে দাঁড়ালো বনহুর আর ফাংহু লং। ফাংহু লং-এর হাতে বাইনোকুলার।

দু’জনই চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে দূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। বনহুর দেখতে পেলো– একটি জাহাজ দূরে, অনেক দূরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বনহুর সম্মুখে দৃষ্টি রেখেই বললো– আজ এক সপ্তাহ পর আমরা ঠিক জায়গায় এসেছি। জাহাজখানা জঙ্গীনদের প্রবেশপথে পাহারারত রয়েছে।

ফাংহু বললো- আমারও তাই মনে হচ্ছে।

বনহুর বললো– এটা পুলিশ জাহাজ তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কারণ জাহাজখানা নড়ছে না, কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে স্থির হয়ে আছে।

 ফাংহু বললো-পরদেশী বাবু, ওরা এখনও আমাদের দেখতে পায়নি, এখনও সময় আছে, পিছু হটে অন্য পথে নীলনদ পেরিয়ে যাওয়া কঠিন হবে না।

 ফাংহুর কথায় বনহুর চট করে কোনো জবাব না দিয়ে বাইনোকুলারের দৃষ্টি রেখে লক্ষ্য করতে লাগলো, তারপর বললো– আজ কদিন হলো আমরা নীলনদের দক্ষিণ দিক ধরে অগ্রসর হচ্ছি ফাংহু?

ফাংহু বললো- আজ এক সপ্তাহ হলো।

এবার বনহুর বাইনোকুলার চোখ থেকে নামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো, একটু হেসে বললো– একটি সপ্তাহ নষ্ট করে আমরা এতদূর অগ্রসর হয়েছি সেকি ফিরে যাবার জন্য। ফাংহু, তুমি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে নাও।

যুদ্ধ!

হা।

পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাও পরদেশী বাবু?

পুলিশের সঙ্গে বলে নয়, যারা আমাদের চলার পথে বাধা দেবে তাদের সঙ্গে।

হাঁ ঈশ্বর! ফাংহু কপালে হাত রেখে শব্দটা উচ্চারণ করলো।

বনহুর বুঝতে পারলো, ফাংহু ইচ্ছা করে যুদ্ধ করতে চায় না। যদিও তার জাহাজে যুদ্ধ সামগ্রীর কোনো অভাব নেই। ফাংহু চায় যতদূর সম্ভব যুদ্ধকে এড়িয়ে চলতে। অহেতুক জীবন নাশ তার পছন্দ নয়।

বনহুর পুনরায় বাইনোকুলারে দৃষ্টি রেখে সম্মুখে তাকালো, তীক্ষ্ম দৃষ্টি মেলে দেখতে লাগলো সে জাহাজখানাকে।

বাইনোকুলারে চোখ রেখে বললো বনহুর— ফাংহু, আমাদের জাহাজখানাকে সরাসরি সম্মুখে এগিয়ে চলার জন্য বলল।

ফাংহু চলে গেলো, জাহাজের চালককে নির্দেশ দিয়ে ফিরে এলো সে বনহুরের পাশে।

এবার বনহুর আর ফাংহু মেসিনরুমে প্রবেশ করলো। মেসিনরুমের সম্মুখে শার্শীর পাশে পাশাপাশি দুটো ছিদ্রপথ দিয়ে দেখতে লাগলো বনহুর।

জাহাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।

 বনহুর বললো- ফাংহু, ম্যাপখানা আমার দরকার।

ফাংহু দ্রুত ম্যাপখানা এনে বনহুরের সম্মুখে মেলে রাখলো।

বনহুর তীক্ষ্ম দৃষ্টি মেলে ধরলো ম্যাপখানায়। গভীর মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করতে লাগলো। মাঝে মাঝে ফাংহুকে জিজ্ঞেস করতে লাগলো এটা সেটা। নীল নদের অনেক পথ তার জানা নেই।

বনহুর ম্যাপের এক স্থানে আংগুল রেখে বললো– জঙ্গী নদের প্রবেশপথ ছেড়ে আমরা এখন কত মাইল দূরে আছি ফাংহু?

ফাংহু বললো— কয়েক মিনিটের মধ্যেই জানাচ্ছি। কথাটা বলে ফাংহু একটা সুইচে চাপ দিলো, সঙ্গে সঙ্গে মিটার লাইট জ্বলে উঠলো। ওদিকের একটা বাল্ব জ্বলছে আর নিভছে, সেই সঙ্গে কাঁপতে থাকে মাইল মিটার যন্ত্রটা। দ্রুত মিটারের কাঁটা সরে যাচ্ছে।

বনহুর আর ফাংহু তাকিয়ে আছে মাইল মিটার কাঁটার দিকে। মিটার কাঁটা এসে থেমে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে বনহুর বলে উঠলো–ফাংহু, আমাদের আয়ত্তের মধ্যেই আছে জাহাজখানা আর বিলম্ব নয়, আমাকে সাহায্য করো।

বনহুরের কথায় ফাংহু বললো– কি করতে চাও?

ঐ জাহাজটাকে আমি আটক করতে চাই। বনহুর জানে, চুম্বক মেসিনে পঞ্চাশ মাইলের মধ্যের বস্তুকে আকর্ষণ করা যায়, তাই সে ফাংহুকে জানালো তার মনের কথা।

ফাংহু সঙ্গে সঙ্গে ওয়্যারলেসে জাহাজের সমস্ত খালাসীর মধ্যে কথাটা জানিয়ে দিলো, এবার আমরা চুম্বক মেসিনের কাজ শুরু করবো।

ইঞ্জিন থেকে হেডচালক জানালে তারা প্রস্তুত আছে।

ফাংহু চুম্বক মেসিনের পাশে এসে দাঁড়ালো।

 বনহুর তখনো মাইল মিটারের কাঁটা লক্ষ্য করছিলো।

ফাংহু চুম্বক মেসিনের পাশে দাঁড়িয়ে সম্মুখের ছিদ্রপথে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। খালি চোখে কিছুই নজরে এলো না। ফাংহু বাইনোকুলারটা তুলে নিলো হাতে। দেখতে লাগলো সে বাইনোকুলারে চোখ লাগিয়ে। জাহাজখানা এখনো স্পষ্ট নজরে আসছে না।

মাইল মিটারের কাঁটা দ্রুত সরে যাচ্ছে।

জাহাজ অত্যন্ত স্পীডে এগুচ্ছে।

বনহুরও মাঝে মাঝে বাইনোকুলারে দৃষ্টি রেখে সম্মুখের জাহাজখানাকে লক্ষ্য করছে। এবার বনহুর বলে উঠলো— ফাংহু, তোমার কাজ শুরু করো।

ফাংহু চুম্বক মেসিনের যন্ত্র চালু করে দিলো, সঙ্গে সঙ্গে জাহাজখানা দুলে উঠলো ভীষণভাবে।

 বনহুর কিন্তু বাইনোকুলারে দৃষ্টি রেখে তাকিয়ে আছে সম্মুখের দিকে।

চুম্বক মেসিনের সুইচ চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দূরে ক্ষুদ্র জাহাজখানায় কি প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, এটাই তার জানা দরকার। তীক্ষ্ণ নজরে লক্ষ্য করছে বনহুর।

এখানে ফাংহু চুম্বক মেসিনের চাকা চালু করে দিয়ে সেও বাইনোকুলারের চোখ রেখে তাকাচ্ছে সামনে।

বনহুর বলে–এবার মনে হচ্ছে জাহাজখানা এগুতে শুরু করেছে।

ফাংহু জবাব দিলো– হাঁ, কাজ শুরু হয়ে গেছে পরদেশী বাবু।

বনহুর বললো– ফাংহু, খুব হুশিয়ার, স্পীডে মেসিন চালাও। জাহাজখানাকে যতদূর সম্ভব দ্রুত টেনে নিতে হবে।

পরদেশী বাবু, ধীরে ধীরে কাজ করাই আমাদের ভাল, কারণ জাহাজখানা পৌঁছার আগে আমাদের প্রস্তুত হয়ে নিতে হবে; কেননা, ও জাহাজে শত্রু আছে।

বনহুর বললো– শত্রু আছে বলেই দ্রুত কাজ করতে হবে। আমাদের জাহাজে সবাইকে প্রস্তুত হবার নির্দেশ দিয়ে দাও।

 ফাংহুকে কথাটা বলে বনহুর নিজে এসে চুম্বক মেসিনের সম্মুখে দাঁড়ায় তুমি যাও, নিজেও প্রস্তুত হয়ে নাওগে ফাংছ।

 ফাংহু অবাক হয়ে তাকায় বনহুরের মুখের দিকে– বলে কি, পরদেশী বাবু পারবে চুম্বক মেসিন চালাতে!

বনহুর ফাংহুর মনের ভাব বুঝতে পেরে বলে—- তুমি কিছু ভেবো না ফাংহু, নিশ্চিত মনে আমাকে বিশ্বাস করতে পারো।

ফাংহু মুচকি হেসে বেরিয়ে যায়।

বনহুর চুম্বক মেসিনের সুইচে হাত রাখলো, দক্ষিণ হাতে তার বাইনোকুলার। ওয়্যারলেসে মুখ রেখে এবার বনহুর নির্দেশ দিতে শুরু করলো।

 ফাংহু এবার এসে দাঁড়ালো ক্যাপ্টেন ক্যাবিনে। সে জাহাজের চালকদের জাহাজ চালানো ব্যাপারে হুশিয়ার করে চললো।

বনহুর দেখছে, অদ্ভুত কাজ করছে চুম্বক মেসিনটা। বহু দূরের জাহাজখানাকে দ্রুতগতিতে আকর্ষণ করে চলেছে। কিছু সময়েই যে জাহাজখানা তাদের আয়ত্তের মধ্যে এসে পড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

হঠাৎ বনহুর ফিরে তাকায় পিছনে, দেখতে পায় মাংতু অদূরে দাঁড়িয়ে তাকে লক্ষ্য করছে। বনহুর তাকাতেই সে এগিয়ে এলো, একটা রাইফেল এগিয়ে ধরলো- এটা রেখে দাও। পরদেশীবাবু।

বনহুর মাংতুর হাত থেকে রাইফেলটা নিয়ে পাশে হেলান দিয়ে রাখলো।

 মাংতু চলে গেলো।

বনহুরের মুখে একটু হাসির আভাস ফুটে উঠলো।

*

চিৎকার করে চলেছেন মিঃ জাফরী, শীগগীর আপনারা জাহাজের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যান। বোট নামিয়ে দিতে বলুন। দেখছেন না আমাদের জাহাজখানা কেমন বেগে পেছনে ছুটে চলেছে।

মিঃ লেহরী, মিঃ গুহ, মিঃ ইলিয়াস বিক্ষিপ্তের মত ছুটোছুটি করে চলেছেন, সকলের চোখেমুখেই উত্তেজনার ছাপ।

জাহাজের খালাসী এবং পুলিশ ফোর্স সকলেই উন্মাদের মত এদিক-সেদিক ছুটোছুটি করছে। ক্যাপ্টেন আর জাহাজের চালকগণ জাহাজের গতি রোধ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে।

সকলের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে জাহাজখানা দ্রুতগতিতে পেছনের দিকে ছুটে যাচ্ছে। মিঃ জাফরী ও তার দলবল সবাই ভয়ে, বিস্ময়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তাঁদের জাহাজ হঠাৎ এভাবে কেন পেছন দিকে ছুটতে শুরু করেছে, তার কারণ কিছুতেই বুঝতে পারে না।.

 পুলিশ ফোর্স কোনোদিন এমন অদ্ভুত ব্যাপার দেখেনি, তারা ভয়ে পাংশুবর্ণ হয়ে উঠেছে। মিঃ জাফরী বা তাদের অধিনায়কদের কথা না নিয়ে তারা পাগলের মত এদিক ওদিক ছুটছে, কেউ কেউ স্পীড বোট নামানোর চেষ্টা করছে।

মিঃ ইলিয়াস বললেন–একি ভূতুড়ে ব্যাপার!

মিঃ গুহ বললেন–অদ্ভুত! এটা ভূতুড়ে কাণ্ড ছাড়া কিছু নয়, নিশ্চয়ই কোনো দৈত্য-দানবের আকর্ষণে আমাদের জাহাজখানা এমনভাবে ছুটে চলেছে।

মিঃ লেহরী কাঁদো কাঁদো সুরে বললেন- বনহুরকে গ্রেফতার করতে এসে শেষ পর্যন্ত মরতে হলো।

মিঃ জাফরী এত বিপদেও মোটেই ঘাবড়ে যাননি, তিনি বলে উঠলেন– না মরতেই আপনারা ভূত হয়ে গেছেন। শীগগীর যান, ওয়ারল্যাসে আমাদের বিপদ-সংবাদটা আমাদের অন্যান্য জাহাজে জানিয়ে দিন।

 মিঃ ইলিয়াস ছুটলেন ওয়ারলেস মেসিন ক্যাবিনে। সংবাদটা দ্রুত জানিয়ে দিলেন অন্যান্য পুলিশ জাহাজে। আরও জানালেন, তোমরা দ্রুত ১ নং জাহাজখানার উদ্ধারে এগিয়ে এসো।

২ নং জাহাজখানা তখন নীল নদের পূর্ব অঞ্চলে পাহারারত ছিলো। পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ লোরী ছিলেন এ জাহাজে, আর ছিলো প্রায় বিশ-পঁচিশ জন পুলিশ। আরও ছিলো নানারকম মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র।

মিঃ লোরী তার জাহাজে বসে যখন জানতে পারলেন ১ নং জাহাজ বিপদগ্রস্ত হয়েছে তখন তিনি ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ক্যাপ্টেনকে জাহাজখানা দ্রুত নীল নদের দক্ষিণ দিক অভিমুখে রওনা দেবার জন্য নির্দেশ দিলেন।

৩নং জাহাজখানা বন্দীদের নিয়ে ইতোপূর্বেই কান্দাই অভিমুখে রওনা হয়ে গেছে।

আরও দু’খানা লঞ্চ ৪ নং এবং ৫ নং মধ্য নীল নদে ঘোরাফেরা করছিলো। কোনো জাহাজ যেন বিনা সার্চে পালাতে সক্ষম না হয়, এটাই ছিল তাদের লক্ষ্য। মিঃ ইলিয়াস ৪ নং এবং ৫নং লঞ্চেও ওয়্যারলেসে এই দুঃসংবাদ জানালেন।

মুহূর্তমধ্যে সব জাহাজেই এই দুর্ঘটনার প্রতিক্রিয়া শুরু হলো। সবাই যখন জানতে পারলো ১ নং পুলিশ জাহাজ জঙ্গী নদের প্রবেশপথ থেকে কোনো এক ভৌতিক আকর্ষণে উল্টোদিকে দ্রুত ছুটে চলেছে তখন ভীষণভাবে ঘাবড়ে গেলো তারা। কেউ ঠিকমত কোনো মতামত কাউকে জানাতে পারলো না

মিঃ জাফরী পুলিশ বাহিনীর আপ্রাণ চেষ্টায় দু’একটা স্পীড বোট পানিতে নামাতে সক্ষম হলেন কিন্তু তারা কেউ স্পীড বোর্টে নামতে পারলেন না। স্পীড বোট পানিতে নামানোর সঙ্গে সঙ্গে তলিয়ে যাচ্ছিলো। কারণ খুব বেগে জাহাজখানা পিছু হটে চলেছে। সাগরের ভীষণ জলোচ্ছ্বাসের মধ্যে বোট পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তলিয়ে যাচ্ছিলো।

মিঃ লোরী কোনোক্রমেই তার জাহাজ নিয়ে মিঃ জাফরীর জাহাজের নাগাল পেলেন না।

মিঃ লোরীর জাহাজেই ছিলেন মিঃ লালং, তিনি ব্যাপারটা জেনে স্তম্ভিত হতবাক হয়ে পড়েছেন। একি অদ্ভুত কাণ্ড, তবে কি সত্যি সত্যি ভৌতিক ব্যাপার! তিনি অনেক ভেবে বললেন–মিঃ লোরী, আপনারা যাই বলুন ভৌতিক ব্যাপার বা ঐ ধরনের কিছু নয়, নিশ্চয়ই কোনো চুম্বক পর্বতের আকর্ষণে জাহাজখানা ঐভাবে পেছন দিকে ছুটে চলেছে।

 মিঃ লারলং-এর কথা মিঃ লোরী বললেন– হাঁ, এ রকম হতে পারে।

মিঃ লালং বললেন— এ ক্ষেত্রে আমাদের জাহাজ নিয়ে ঐ দিকে আর অগ্রসর না হওয়াই ভাল, বরং ৫ নং এবং ৪নং জাহাজের সঙ্গে যোগাযোগ করে কি করা যায় ভেবে দেখা দরকার।

 মিঃ লারলং তৎক্ষণাৎ ওয়ারলেসে ৪ নং এবং ৫ নং জাহাজের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদেরকে ব্যাপারটা জানিয়ে দিলেন। এ জাহাজ দু’খানা সংবাদ পাওয়া মাত্র ২ নং জাহাজখানার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো, মিঃ লারলং এর সঙ্গে মিলিত হয়ে কি করা যায় ভেবে দেখবে।

 এ জাহাজ দু’খানার পুলিশ বাহিনীর মধ্যেও ভীষণ একটা আতঙ্ক সৃষ্টি হলো। সবাই ব্যস্তসমস্ত হয়ে অস্ত্রশস্ত্র বাগিয়ে ছুটোছুটি করতে লাগলো। অধিনায়কগণের মধ্যে শুরু হলো শলা পরামর্শ– এখন কি করা যায়!

মিঃ লালং ওয়্যারলেস মেসিন খুলে বসে আছেন। বারবার তিনি শুনতে পাচ্ছেন মিঃ ইলিয়াসের ভয়-বিহ্বল কণ্ঠ। মাঝে মাঝে কিছু শোনা যাচ্ছে না, কখনও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। কখনও শোনা যাচ্ছে মিঃ লেহরীর কণ্ঠস্বর- আমরা কোনোক্রমে জাহাজের গতি রোধ করতে সক্ষম হচ্ছি না। আমাদের জাহাজ একটানা পেছন দিকে এগিয়ে চলেছে। কয়েকখানা স্পীড বোট নিচে নামাতে সক্ষম হয়েছিলাম কিন্তু নামানোর সঙ্গে সঙ্গে তলিয়ে গেছে….. কথাগুলো কাঁপা কাঁপা সুরে শোনা যাচ্ছিলো, আবার ভেসে আসে সেই স্বর….. আমরা কেউ জাহাজ থেকে বোটে নামতে পারিনি…. যেভাবে জাহাজখানা ছুটে চলেছে তাতে যে-কোন মুহূর্তে ডুবো পাহাড়ে ধাক্কা। লেগে আমাদের জাহাজ ভেংগে চুরমার হয়ে যেতে পারে। মৃত্যু আমাদের অনিবার্য… হঠাৎ ওয়্যারলেসের শব্দ বন্ধ হয়ে যায়।

মিঃ লাবলং-এর মুখমণ্ডল গম্ভীর হয়ে পড়লো। পাশে দাঁড়িয়ে মিঃ লোরী সব শুনছিলেন, তিনি বললেন– সর্বনাশ, এতক্ষণ তবু ১ নং জাহাজের সঙ্গে যোগাযোগ ছিলো, এবার তাও বিচ্ছিন্ন। হলো। নিশ্চয়ই জাহাজের কোনো ক্ষতি হয়েছে নয় ওয়্যারলেস মেসিন নষ্ট হয়ে গেছে।

অনেক চেষ্টা করেও আর কোনো শব্দ শোনা গেলো না। দিশেহারা হয়ে পড়লেন মিঃ লালং এবং মিঃ লোরী। কি করবেন তারা ভেবে ব্যাকুল হলেন। সমস্ত জাহাজে একটা ভীষণ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। পুলিশ ফোর্সের মধ্যেও চাঞ্চল্য দেখা দিলো।

*

 মিঃ জাফরী মিঃ লেহরী এবং অন্যান্য পুলিশ অফিসারসহ পঁচিশ জন পুলিশকে বন্দী অবস্থায় নিয়ে এলো বনহুর ফাংহুর জাহাজে। বনহুরের সমস্ত দেহে জমকালো পোশাক ছিলো, মাথায় ছিলো পাগড়ি। পাগড়ির আঁচল দিয়ে মুখের অর্ধেক ঢাকা তবু মিঃ জাফরীর চিনতে বাকী রইলো না যে দস্যু বনহুরকে গ্রেফতারের জন্য তারা এত পরিশ্রম করে নীলনদের বুকে কড়া পাহাড়া দিচ্ছিলেন, সেই দস্যুই বিনা কৌশলে তাদের বন্দী করে ফেললো।

দস্যু বনহুর তাদের জাহাজ আটক করেছে এটা তারা কল্পনাও করতে পারেননি, পারলে কিছুতেই এভাবে সবাইকে আটক করতে পারতো না। ভীষণ একটা যুদ্ধ হতো এবং দু’পক্ষেই কিছু না কিছু হতাহত হতো। রাগে-ক্ষোভে মিঃ জাফরী অধর দংশন করতে লাগলেন।

পুলিশ বাহিনীকে সারিবদ্ধভাবে পিছমোড়া করে বেঁধে এক জায়গায় দাঁড় করানো হয়েছে।

সম্মানিত অফিসারগণকে পিছমোড়া করে না বেঁধে শুধু হাত দুখানায় শিকল পরানো হয়েছে। কারো কাছে কোন অস্ত্র নেই। অফিসারদের মুখমণ্ডল কালো হয়ে উঠেছে, কারো মুখে কোনো কথা নেই। মিঃ জাফরীর মুখ অত্যন্ত কঠিন দেখাচ্ছে। মিঃ ইলিয়াস তার বিশাল বপু নিয়ে রীতিমত ঘেমে নেয়ে উঠেছেন। মিঃ লেহরী, মিঃ গুহ এঁদের অবস্থা অবর্ণনীয়। এরা এতদিন দস্যু বনহুরের নামই শুনে এসেছিলেন, আজ সেই দস্যু বনহুরের হাতে বন্দী হয়ে হৃদকম্প শুরু হয়েছে তাঁদের।

বনহুর এসে দাঁড়ালো তাঁদের সম্মুখে।

বন্দী পুলিশ বাহিনী এবং অফিসাররা ভয় ও বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে দেখছে দস্যু বনহুরকে। যে দস্যু বনহুর ছিলো তাদের কল্পনার বস্তু, যে দস্যুকে গ্রেফতার করতে পারলে লাখ টাকা পুরস্কার, যে দস্যু বনহুরের সন্ধানে হাজার হাজার পুলিশ ফোর্স সদা-সর্বদা সারা দেশে সতর্ক পাহারারত রয়েছে, সেই দস্যু আজ তাদের সম্মুখে। আশ্চর্য হয়ে দেখছে পুলিশ বাহিনী।

বনহুর তার দক্ষিণ পা পাশের উঁচু বেঞ্চের উপর তুলে দাঁড়ালো। বনহুরের চোখ দুটো শুধু মুক্ত, মুখের নিচের অংশ সম্পূর্ণ ঢাকা।

 বনহুর নিজকে কোন সময় প্রকাশ করতো না, যখন সে দস্যুবেশে হাজির হতো কারো সম্মুখে তখন তার মুখের অর্ধেক ঢাকা থাকতো। সেই কারণে আজ পর্যন্ত কেউ বনহুরের আসল রূপ দেখেনি বা দেখার সুযোগ পায়নি। যারা বনহুরকে স্পষ্টভাবে দেখেছে তারাই শুধু জানে কেমন দেখতে সে।

এতগুলো পুলিশের লোকের মধ্যে একমাত্র মিঃ জাফরী ছাড়া কেউ বনহুরকে প্রকাশ্য দেখেনি, তিনিই শুধু জানেন বনহুরের চেহারা কেমন।

 এত বিপদের মধ্যেও পুলিশ বাহিনীদের মনে দস্যু বনহুরের আসল রূপ দেখার বিপুল বাসনা জাগছিলো। মরবে তবু দস্যু বনহুরকে একনজর দেখবে, এটাই যেন তাদের সাধ। সবাই তাকাচ্ছে। বারবার বনহুরের কালো কাপড়ে ঢাকা মুখখানার দিকে। কিন্তু দুটো চোখ আর একটা সুন্দর প্রশস্ত ললাট ছাড়া কিছুই নজরে পড়ছিলো না।

বনহুর এ জাহাজে তার ইচ্ছামত পোশাক পেয়েছিলো। যেমন তার পছন্দমত খাবারের অভাব ছিলো না তেমনি সব পেয়েছিলো সে এ জাহাজে। অস্ত্রশস্ত্র সবকিছু।

 মাংতু সব সময় সকলের অলক্ষ্যে খেয়াল রেখেছিলো বনহুরের উপর। তার যেন কোনোরকম অসুবিধা না হয়।

অবশ্য ফাংহুর সহযোগিতা কম ছিলো না, ফাংহু বনহুরকে বন্ধুর মতই গ্রহণ করেছিলো, তার সমস্ত শক্তি দিয়ে সে সাহায্য করে চলেছে বনহুরকে।

এ জাহাজে যারা খালাসীর বেশে ছিলো তারাও এক একজন কম নয়। দুঃসাহসী বীরযোদ্ধার মতই এক-একজন শক্তিশালী। বনহুর অল্প সময়েই সবাইকে চিনে নিয়েছে। এরা শুধু শক্তিশালী নয়, এরা সংগ্রামী পুরুষ। আরও একটা জিনিস বনহুর লক্ষ্য করেছে, এ জাহাজের প্রতিটি ব্যক্তি তাকে অত্যন্ত সম্মান আর সমীহ করে।

এ জাহাজে অনেক কিছুই বনহুরের কাছে রহস্যময় বলে মনে হয়েছে। কোনো একটা অলক্ষ্য শক্তি দ্বারা এ জাহাজের সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে, তাও বুঝতে পেরেছে বনহুর। সন্তুষ্ট হয়েছে সে এ জাহাজের প্রতিটি জিনিস দেখে, প্রতিটি মানুষের আচরণে।

আজকের এ জয়ের পিছনে ফাংহুর সহযোগিতা তাকে মুগ্ধ করেছে। যে পুলিশ বাহিনী তাকে গ্রেফতার করার জন্য সুদূর কান্দাই নগরী থেকে বেশ কিছুদিন হলো আহার-ন্দ্রিা ত্যাগ করে নীল নদের বুকে পাহারারত রয়েছে, তাদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে বনহুর। কৌশলে আঁদরেল পুলিশ বাহিনীকে সে হাতের মুঠায় এনেছে।

 বনহুর এবার গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো– মিঃ জাফরী, বহুদিন পর সাক্ষাৎ হলো। আপনি যেমন আমাকে ভুলেননি, আমিও তেমনি ভুলিনি আপনাকে। তাই অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে এসেছি বন্ধু! বলুন, এবার কি চান আমার কাছে?

মিঃ জাফরীর চোখ দুটো জ্বলে উঠলো রাগে-ক্ষোভে-দুঃখে, কারণ একবার নয়, কয়েকবার তিনি দস্যু বনহুরের হস্তে নাকানি-চুবানি খেয়েছেন। এবার তাঁদের এত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে পুনরায় বনহুরের হস্তে এসে পড়বেন ভাবতেও পারেননি, কারণ তারা সর্বতোভাবে প্রস্তুত হয়েই নীল নদে দস্যু বনহুরকে গ্রেফতার করতে এসেছিলেন। অস্ত্রশস্ত্রসহ পুলিশ বাহিনী কম ছিলো না তাঁদের হাতে, তবু এই পরাজয়! বনহুরের দিকে মিঃ জাফরী কটমট করে তাকালেন, কোনো জবাব দিলেন না।

বনহুর পুনরায় বললো– জানি আপনার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, আপনি চরম দুঃখ অনুভব করছেন। এবার বনহুর ফাংহুর দিকে তাকিয়ে বললো– ফাংহু, সম্মুখসারির বন্ধুদের বন্ধন মুক্ত। করে দাও।

ফাংহু অবাক হয়ে তাকালো বনহুরের মুখের দিকে।

বনহুর ফাংহুর মনোভাব বুঝতে পেরে একটু হেসে বললো বন্ধুর প্রতি প্রীতিকর আচরণ। করাই শ্রেয়। এরা আমার বন্ধুজন।

ফাংহু এবার পুলিশ অফিসারদের হাতের বাঁধন মুক্ত করে দিলো।

একপাশে কয়েকটা আসন ছিলো, বনহুর সেই আসনগুলো দেখিয়ে বললো– আসন গ্রহণ করুন আপনারা। ফাংহু, এদের জন্য গরম কফির ব্যবস্থা করো।

ফাংহু চলে যায়।

বনহুর একা দাঁড়িয়ে থাকে পুলিশ বাহিনীর সম্মুখে।

বনহুরের কথায় পুলিশ অফিসারদল আসন গ্রহণ না করে যেমন দাঁড়িয়েছিলেন তেমনি থাকেন।

বনহুর দু’একবার পায়চারী করে নিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ায়, তারপর বলে কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন, কারণ আমি আপনাদের বক্তব্য শুনতে চাই।

 মিঃ জাফরী এবার না বলে পারলেন না, বললেন তিনি– তুমি আমাদের বন্দী করে কি করতে চাও আমিও জানতে চাই বনহুর?

অট্টহাসিতে ভেংগে পড়ে বনহুর, সে হাসি যেন থামতে চায় না। তারপর বলে উঠে লাখ টাকা পুরস্কারের আশায় আপনি যেমন আমাকে খুঁজে ফিরছিলেন তেমনি আমিও আপনার বিনিময়ে লাখ টাকা চাই। আর আপনার সঙ্গীদের বিনিময়ে চাই আমাদের পঞ্চাশজন বন্দীর মুক্তি। বনহুর হীরালালের সঙ্গীদের কথাই বললো।

মিঃ জাফরী চমকে উঠলেন না, কারণ তিনি মনে করেছিলেন যাদের বন্দী করা হয়েছিলো তারা দস্যু বনহুরেরই অনুচর, কাজেই তিনি নীরব রইলেন।

মিঃ ইলিয়াস বললেন এবার কাউকে আমরা বন্দী করিনি।

বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বললো–মিথ্যে কথা বলে কোনো ফল হবে না মিঃ ইলিয়াস। কারণ, আমি সব জানি এবং জানি বলেই আপনাদের এত কষ্ট দিলাম।

দস্যু বনহুরের মুখে নিজের নাম শুনে অবাক হলেন মিঃ ইলিয়াস, কারণ বনহুর তাকে কি করে চিনেছে ভেবে পেলেন না তিনি।

বনহুর মিঃ জাফরীকে লক্ষ্য করে বললো– কি ভাবছেন মিঃ জাফরী? ইন্সপেক্টর পদ থেকে পুলিশ সুপার পদ লাভ করেছেন, দক্ষ পুলিশ অফিসার হিসেবে আপনার যথেষ্ট সুনাম আছে কিন্তু আজ পর্যন্ত আপনি দস্যু বনহুরকে আটক করতে পারলেন না, বড় আফসোস! একবার নয়, বেশ কয়েকবার বনহুরের কাছে পরাজয় বরণ করলেন, দুঃখ হয় তবু সেই বনহুরের পিছু ছাড়লেন না।

মিঃ জাফরী বনহুরের কথায় কোনো জবাব দিলেন না, মুখ ফিরিয়ে রাখলেন বিপরীত দিকে।

বনহুর বললো আবার এখন আপনারা আমাদের অতিথি, কাজেই আমাদের কাছে কোনোরকম অসম্মান বা অনাদর পাবেন না। ইচ্ছা করলে আমি আপনাদের সবাইকে হত্যা করে নীল নদে নিক্ষেপ করতে পারি। কেউ জানবে না আপনারা কোথায় আছেন কিংবা কোথায় গেছেন, কিন্তু তা করবো না, মুক্তিও দেবো না। এই নীল নদেই আপনাদের কাটাতে হবে যতদিন না আমার পাওনা আদায় হবে। কথাটা বলে ফাংহুর দিকে তাকায় বনহুর –এদের নিয়ে যাও।

ফাংহু এবার মিঃ জাফরীসহ অফিসারগণকে নিয়ে গেলো একটা বড় ক্যাবিনে, সেখানে তাঁদের রাখা হলো।

অন্যান্য পুলিশকে অপর একটা ক্যাবিনে আটকে রাখা হলো।

পুলিশ বাহিনীকে বন্দী করে রাখলেও তাদের প্রতি কোনো অসৎ ব্যবহার করলো না বনহুর বা ফাংহুর দলবল। অপর একটি জাহাজের ব্যবস্থা করা হলো, সেই জাহাজে পুলিশ অফিসার ও পুলিশ বাহিনীকে আটক রেখে বনহুর আর ফাংহু ছুটলো যে জাহাজে হীরালালের দলকে বন্দী করে কান্দাই অভিমুখে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো সেই জাহাজের উদ্দেশ্যে।

বন্দীদের নিয়ে জাহাজ নীল নদের কোন অংশ ধরে যাচ্ছিলো একথা বনহুর জেনে নিলো ভাল করে মিঃ জাফরীর জাহাজের ক্যাপ্টেনের কাছে। ক্যাপ্টেন লিউ পুলিশ জাহাজের ১ নং জাহাজখানা পরিচালনা করছিলেন।

বনহুর ক্যাপ্টেন লিউকেও বন্দী করে নিয়ে চললো সঙ্গে তাদের জাহাজে। কোন্ পথে তাদের ৩ নং জাহাজ গেছে সেই পথের নির্দেশ দিতে লাগলো মিঃ লিউ। অবশ্য বনহুর তার পাশে দাঁড়িয়ে চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে দেখছিলো সম্মুখপানে দূরে তার দৃষ্টি রইলেও ক্যাপ্টেন লিউকেও সে লক্ষ্য করছিলো ভালভাবে। কোনোরকম মন্দ অভিসন্ধি থাকলে তাকে সেই মুহূর্তে হত্যা করে নীল নদের জলে নিক্ষেপ করা হবে, একথাও ক্যাপ্টেন লিউকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিলো।

বনহুর যখন চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে সম্মুখে তাকিয়ে দেখছিলো তখনও তার মুখের নিচের অংশ কালো কাপড়ে ঢাকা ছিলো।

মিঃ লিউ তখন নির্বাক বিস্ময়ে বনহুরকে দেখছিলো। যে দস্যুকে গ্রেফতারের জন্য সমস্ত দেশব্যাপী এত আলোড়ন সেই দস্যুর পাশে সে এখন দাঁড়িয়ে! যদি তার মৃত্যুও হয় তবু তার দুঃখ নেই, কারণ মিঃ লিউ-এর বড় সাধ ছিলো দস্যু বনহুরকে একবার স্বচক্ষে দেখা।

বনহুরের জাহাজখানা স্পীডে এগুচ্ছে।

 যে জাহাজে পুলিশ অফিসারসহ পুলিশ বাহিনীকে আটক করা হয়েছিলো সে জাহাজ এখন নীলনদের পূর্ব-উত্তর অংশে স্থিরভাবে রয়েছে। বনহুরের নির্দেশমত অফিসারদেরকে এক ক্যাবিনে আটক করা হয়েছে আর পুলিশ বাহিনীকে বিপরীত এক ক্যাবিনে। ফাংহুর কয়েককন অনুচর পাহারা রয়েছে, যেন কোনো জাহাজ এ জাহাজের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারে। ফাংহুর অনুচরদের সঙ্গে রয়েছে নানা রকম আগ্নেয়াস্ত্র। তাছাড়াও ওয়্যারলেস মেসিন রয়েছে, কোনো বিপদ ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে ফাংহুর জাহাজে সংবাদ পৌঁছবে।

 ফাংহু মাঝে মাঝে টেলিভিশনের সুইচ টিপে দেখে নিচ্ছিলো। তাদের জাহাজের পাঁচশত মাইলের মধ্যে যে-কোন জাহাজ বা কোনো রকম জলযান থাকলে তা ধরা পড়বে এই শক্তিশালী টেলিভিশনে। পাশেই কয়েকটা সুইচ ১ নং সুইচে চাপ দিলে পশ্চিম, ২ নং সুইচে পূর্ব, ৩ নং সুইচে উত্তর, আর ৪ নং সুইচে দক্ষিণ দিকের সব ভেসে উঠে পর্দায়। কাজেই ফাংহু জানে, পুলিশ বাহিনীর জাহাজখানা কিছুতেই তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে পালাতে পারবে না।

ফাংহু মাঝে মাঝে ম্যাপ খুলে দেখে নিচ্ছিলো এখন তাদের জাহাজ কোন পথে চলেছে।

এবার ফাংহু টেলিভিশনের সুইচে চাপ দিতেই পূর্বদিকের সাগরবক্ষ ভেসে উঠলো পর্দায়। হঠাৎ আনন্দে চিৎকার করে উঠলো পেয়েছি, পেয়েছি….. ছুটলো সে বনহুরের কাছে।

ফাংহু ছুটে গিয়ে বনহুরকে একরকম প্রায় জড়িয়ে ধরে বলে– পরদেশী বাবু, পেয়েছি, পুলিশদের জাহাজখানা পর্দায় এসে গেছে।

বনহুর অবাক হয় না, তবু কণ্ঠে বিস্ময় ভাব এনে বলে– দেখা গেছে ফাংহু?

 হাঁ, এবার আমরা নিশ্চয়ই জাহাজখানাকে মিটার চুম্বক মেসিনের শক্তি দ্বারা টেনে আনতে সক্ষম হবো।

 চলো, দেখবো জাহাজখানা মিটার চুম্বকের মধ্যে আছে কিনা। আসুন ক্যাপ্টেন মিঃ লিউ, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে পা ধরে গেছে নিশ্চয়ই। তাছাড়া সিগারেট পানও হয়নি বহুক্ষণ।

ফাংহু আর বনহুর চলে গেলো।

 মিঃ লিউ-এর পাশে দাঁড়ালো মাংতু–স্যার, আসুন আমি আপনাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।

মিঃ লিউ এই যুবকটিকে দেখে অবাক হলো, কারণ এতক্ষণ সে এখানে কোথায় ছিলো বুঝতেই পারেনি তারা কেউ।

মিঃ লিউ বললো- চলো।

 মাংতু মিঃ লিউকে নিয়ে একটা ক্যাবিনে এলো। একটা চেয়ারে দেখিয়ে বললো— বসুন।

মিঃ লিউ মাংতুর আচরণে খুশী হলো, কারণ এখন তার যে অবস্থা তাতে প্রতি মুহূর্তে সে মৃত্যুর আশঙ্কা করে আসছে। বনহুরের হস্তে ধরা পড়ে সে বাঁচবে, এমন আশা তার ছিলো না। মিঃ লিউ জানে, কান্দাই শহরে কৃত লোককে দস্যু বনহুর হত্যা করেছে, তার কোন হিসাব নেই বহু ধনবান ব্যক্তিকে প্রাণ দিতে হয়েছে, বহু পুলিশ অফিসার, বহু ব্যবসায়ী, অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিই বনহুরের শিকার হয়েছে। মিঃ লিউ এ কথাও জানে, দস্যু বনহুর কোনোদিন মহৎ ব্যক্তির জীবননাশ করেনি, তবু লিউ-এর ভীষণ ভয়, যদি বনহুর তাকে ক্ষমা না করে হত্যাই করে বসে। মাংতুর কথায় সন্তুষ্ট হয় মিঃ লিউ, শূন্য আসনটা দখল করে বসে পড়ে। বেশ হাঁপিয়ে পড়েছিলো মিঃ লিউ, বহুক্ষণ তাকে বনহুরের পাশে ডেকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিলো।

 মিঃ লিউ আসন গ্রহণ করতেই মাংতু এক প্যাকেট মূল্যবান সিগারেট এনে সম্মুখে রাখলো তার।

 ক্ষুধার্ত শৃগাল যেমন মেষ শাবককে আক্রমণ করে তেমনি ক্যাপ্টেন লিউ সিগারেটের প্যাকেট দেখামাত্র থাবা মেরে তুলে নেয় হাতে, তারপর দ্রুত প্যাকেট খুলে একটা সিগারেট বের করে খুঁজে দেয় ঠোঁটের ফাঁকে। সিগারেটের অগ্নি সংযোগ করে একমুখ ধোয়া ছেড়ে বলে– এই, তোর নাম কি?

মাংতু!

বাঃ চমৎকার নাম। আমার এক ছেলের নাম মাংতু।

মাংতু হেসে বললো– তাই নাকি স্যার!

হ।

আপনার বুঝি ঐ একটি ছেলে?

না, একটি মেয়েও আছে।

তার নাম কি স্যার?

মাথাটা কাৎ করে একটু ভেবে নিয়ে বললো ক্যাপ্টেন লিউ- চাংতু।

তাই নাকি স্যার? খুশী হয়ে বললো মাংতু।

লিউ বললো এবার–চাংতু আমার বড় সুন্দরী মেয়ে। বড় কাজের মেয়ে। মাংতু?

বলুন স্যার।

তোমাকে আমার বড় ভাল লেগেছে।

তাই নাকি স্যার?

 হা। আমার মনে হচ্ছে তোমাকে চিরদিনের জন্য আপনজন করে নেই।

সে কেমন স্যার?

 দস্যু বনহুরের শিষ্য হলেও তোমাকে বড় ভদ্র বলে মনে হচ্ছে, তাই…..

থামলো মিঃ লিউ।

মাংতু মাথার পাগড়িখানা আর একটু টেনে ঠিক করে নিয়ে বললো– তাই কি বলুন স্যার?

তোমাকে জামাই করে নেবো ভাবছি,

মাংতু কান ধরে জিভ কাটলো, তারপর বললো–ছিঃ ছিঃ ও কথা বলবেন না স্যার।

কেন?

চাংতু যে আমার মায়ের পেটের বোনের নাম? দেখলেন না সেই কারণে আপনার কথা শুনে এত খুশী হয়েছিলাম।

মুহূর্তে দমে গেলো ক্যাপ্টেন লিউ। মুখখানা ভার করে কিছুক্ষণ একমনে সিগারেট পান করুলল, তারপর বললো– মাংতু, তুমি বড় ভাল ছেলে।

হাঁ স্যার, সবাই আমাকে তাই বলে।

 তবে দস্যুর দলে এলে কেন?

 বিপদে পড়ে।

বিপদে সে কেমন কথা মাংতু?

কোথাও চাকরি না পেয়ে শেষে দস্যুদলে যোগ দিয়েছি।

ছিঃ বড় ভুল করেছো মাংতু। যাক, যা হবার হয়ে গেছে, তুমি যাবে আমার সঙ্গে? খুব বড় চাকরি দেবো, মাসে তিন শো টাকা মাইনে পাবে।

কিন্তু যাবো কি করে?

 কেন, আমি তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবো।

সর্বনাশ, তা কি করে সম্ভব?

সবই সম্ভব মাংতু। তুমি জানো না আমি ক্যাপ্টেন, জাহাজেই আমি থাকি– জাহাজ নিয়েই আমার কাজ। এ জাহাজ থেকে পালানো আমার পক্ষে মোটেই দুষ্কর নয় যদি তুমি আমাকে সাহায্য করো।

সর্বনাশ, একবার বলেছেন আর বলবেন না স্যার। বনহুর যদি একটু টের পায় তাহলে আপনিও মরবেন, আমিও মরবো।

মাংতু, আমাকে বাঁচাতেই হবে। আমার স্ত্রী-কন্যা-পুত্র সবাই আছে। তুমি আমাকে বাঁচাও মাংতু…. তোমাকে অনেক টাকা পুরস্কার দেবো। তোমার আর চাকরি করতে হবে না।

মাংতু একগাল হেসে বলে কত টাকা দেবেন স্যার?

 যা তুমি চাও।

 সত্যি দেবেন?

 হাঁ দেবো।

তাহলে আপনি তৈরি থাকবেন।

মাংতু, তুমি আমার বন্ধু, না না সন্তান।

স্যার, আপনি পালিয়ে কোথায় যাবেন? এ যে সাগর চারদিকে শুধু থৈ থৈ পানি।

সে চিন্তা তোমাকে করতে হবে না মাংতু। তুমি শুধু একখানা স্পীড বোট আমাকে সাগরবক্ষে নামাতে সাহায্য করবে।

স্যার, তাতো করবো কিন্তু তার পরের অবস্থাটা আমার চিন্তা করেছেন?

 মাংতু, তোমাকেও আমি সঙ্গে নেবো।

 তারপর স্পীড বোট নিয়ে আপনি কি করে কোথায় যাবেন?

হাসলো ক্যাপ্টেন লিউ— আমি ক্যাপ্টেন, সাগর আর সমুদ্র আমার সাথী। কোথায় কিভাবে যাবো সঙ্গে থাকলেই দেখতে পাবে।

আচ্ছা স্যার, আপনাকে আমি যথাসাধ্য সাহায্য করবো। যাই দেখি…..

 মাংতু বেরিয়ে গেলো।

 ক্যাপ্টেন লিউ-এর মুখে খুশীর আভাস ছড়িয়ে পড়লো।

*

বনহুর টেলিভিশন পর্দায় দৃষ্টি রেখে আনন্দধ্বনি করে উঠলো– ফাংহু, জাহাজখানা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

 ফাংহু পকেট থেকে রুমালখানা বের করে তার কালো থেবড়ো মুখখানার উপর একবার দ্রুত বুলিয়ে নিয়ে বললো আমাদের জাহাজ থেকে মাত্র দেড়শত মাইল দূরে আছে ঐ জাহাজখানা।

বনহুর এবার ফিরে তাকালো মাইল মিটারের দিকে, যে মিটারে মাইলের মাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। বনহুরের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, কারণ তাদের জাহাজের গতি আরও বাড়িয়ে দিলে পুলিশ জাহাজখানাকে পাকড়াও করতে বেশি বেগ পেতে হবে না।

বনহুর নিজে এবার চললো ইঞ্জিন ক্যাবিনে, ফাংহু রইলো মেসিন ক্যাবিনে।

দক্ষ ইঞ্জিনচালকের মত জাহাজখানাকে স্পীডে নিয়ে চললো বনহুর। ফাংহু মেসিন ক্যাবিন থেকে তাকে পথের নির্দেশ দিয়ে চললো।

বনহুরকে সাহায্য করে চললো হেডচালক।

কখন যে মাংতু এসে তার পিছনে দাঁড়িয়েছিলো বনহুর জানে না, হঠাৎ বনহুরের দৃষ্টি যখন মাংতুর উপরে এসে পড়লো তখন সে আলগোছে সরে গেলে সেখান থেকে।

বনহুরের মুখে ফুটে উঠলে মৃদু হাসি।

জাহাজ তখন ভীষণ শব্দ করে ছুটে চলেছে।

বনহুরের সম্মুখে সাউণ্ড বক্সে শোনা যাচ্ছে ফাংহুর গলা, সে মেসিন ক্যাবিন থেকে অবিরত নির্দেশ দিয়ে চলেছে।

মিঃ লিউ সিগারেট পান শেষ করে ক্যাবিনে বসে বসে পালানোর মতলব আঁটছিলো আর প্রতীক্ষা করছিলো মাংতু কখন আসবে। তার মাথায় শুধু পালানোর চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছিলো না, তার মগজে আর একটি চিন্তার উদ্ভব হয়েছিলো। পালানোটা তার পক্ষে অত্যন্ত সহজ হবে, কারণ মাংতু তাকে সাহায্য করবে বলে কথা দিয়েছে। মিঃ লিউ-এর মনে লালসার সৃষ্টি হয়, যে দস্যু বনহুরের সন্ধানে তারা আজ প্রায় মাসাধিক কাল ধরে নীলনদে নানা বিপদ উপেক্ষা করে দিন কাটাচ্ছিলো, হাজার হাজার পুলিশ বাহিনী যাকে গ্রেফতারের আশায় উন্মুখ, সেই দস্যু বনহুর তার কাছাকাছিই অবস্থান করছে। এমন সুযোগ সে কোনোদিনই পাবে না। দস্যু বনহুরকে কোনোরকমে বন্দী করতে পারলে তার যথেষ্ট সুনাম হবে, তার সঙ্গে পাবে দু’লাখ টাকা। সারা জীবন তাকে কোনো কাজ করতে হবে না। সে জাহাজের ক্যাপ্টেন, কি করে গোটা জাহাজখানাকে আয়ত্তে আনতে হয় সে জানে। লিউ-এর মুখে হাসি ফুটে উঠলো, ভুলে গেলো সে। উপস্থিত বিপদের কথা।

এমন সময় মাংতু এলো তার ক্যাবিনে।

ক্যাপ্টেন লিউ খুশী হলো, তাড়াতাড়ি মাংতুর পাশে এসে ওর কাঁধে হাত রাখতে গেলো। মাংতু দ্রুত সরে দাঁড়ালো, তারপর বললো– বলুন কি করতে হবে?

 ক্যাপ্টেন লিউ বললো– মাংতু, তুমি আমার পরম বন্ধু, তোমার জন্য আমার অনেক দুঃখ হচ্ছে।

কেন?

তোমার মত একটি সৎ মহৎ ছেলে দস্যু বনহুরের মত শয়তান বদমাইশ লোকের সঙ্গে মেলামেশা করে সমস্ত জীবনটাকে নষ্ট করে দিচ্ছে।

ও? এই কথা।

 হাঁ, তাই আমার বড় দুঃখ হয়…….

মাংতু মিছামিছি একটা ব্যথাকাতর নিশ্বাস ত্যাগ করে বললো– কি করবো বলুন, সব মেনে নিতে হচ্ছে পেটের দায়ে।

মাংতু?

 বলুন স্যার?

সারা জীবন যাতে তোমাকে পেটের চিন্তা করতে না হয় এর ব্যবস্থা হয়ে যাবে। খুশীতে মাংতুর চোখে দুটো জ্বলে উঠে, বলে সে স্যার, কি করে হয়ে যাবে?

যদি আমার কথা শোন।

বলুন?

খুব গোপনীয় কথা।

বলুন?

ক্যাপ্টেন লিউ এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নেয়, তারপর চাপা গলায় বলে–মাংতু, অনেক টাকা পাবে যদি আমাকে তুমি সহায়তা করো।

করবো।

তুমি তো জানো দস্যু বনহুরকে পাকড়াও করার জন্য পুলিশ বাহিনী অহরহ তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে?

জানি।

 দস্যু বনহুরকে পাকড়াও করতে পারলে দু’লাখ টাকা পুরস্কার পাওয়া যাবে….

তাও জানি স্যার।

তাহলে এমন সুযোগ হাতে পেয়ে ছাড়ছো কেন মাংতু?

 সে আমার মনিব।

 রেখে দাও তোমার মনিব, টাকা ছাড়া এ দুনিয়ায় কেউ কারো নয়, টাকাই সব।

কাজেই আমাকে কি করতে হবে বলুন?

 তুমি যে আমাকে সাহায্য করবে বলেছিলে?

করবো।

কিন্তু পালানো ব্যাপারে নয়…

তবে?

দস্যু বনহুরকে গ্রেফতারের ব্যাপারে।

 এ কি করে সম্ভব?

 বলো আমাকে সাহায্য করবে কিনা?

করব কিন্তু……

কোনো কিন্তু নয়। আমি যা বলবো, তোমাকে সেইমত কাজ করতে হবে।

বলুন?

বনহুর যখন রাতের খাবার খাবে তখন তার খাবারের সঙ্গে একটু ঔষধ মিশিয়ে দেবে– বাস্, অঘোরে ঘুমিয়ে পড়বে তোমার দস্যুসম্রাট। তখন তুমি আমাকে সাহায্য করবে স্পীড বোট নামানোর ব্যাপারে। স্পীড বোট নিচে নামাতে পারলেই তখন আর কোনো চিন্তা নেই। দস্যু বনহুরকে কাঁধে নিয়ে নিচে নেমে পড়বো ঝুলানো সিঁড়ি বেয়ে, তারপর তুমিও আসবে আমার সঙ্গে নিচে স্পীড বোটে..

মাংতু হেসে উঠে চমৎকার বুদ্ধি এঁটেছেন স্যার।

হাঁ, তাহলে সারা জীবন আর পেটের চিন্তা করতে হবে না।

আমাকে ঠিক অর্ধেক দেবেন তো স্যার?

 হাঁ, এক লাখ আমার, এক লাখ তোমার।

সত্যি, আমার বড় আনন্দ হচ্ছে। এতদিন এই বুদ্ধিটা আমার মাথায় আসেনি।

এবার যখন বুদ্ধিটা তোমার মাথায় ঢুকেছে তাহলে কাজে লেগে পড়।

কিন্তু ….. ঘাড় চুলকায় মাংতু।

কিন্তু কি মাংতু? কিছু বলতে চাও?

হা।

 বলো?

রাত আসতে এখনও যে ঢের বাকী স্যার।

তা প্রায় চার-পাঁচ ঘণ্টা আছে।

স্যার, ঐ সময়ের মধ্যে আপনি আর আমি কোথায় থাকবো আর কেমন থাকবো তাই বা কে জানে। কেননা, আমাদের জাহাজ এখন পুলিশ জাহাজের একটিকে ধাওয়া করে চলেছে। আশা করা যায় আর বেশীক্ষণ বিলম্ব হবে না সেটাকে পাকড়াও করতে।

মাংতুর কথা শুনে ক্যাপ্টেন লিউ-এর মুখখানা কালো হয়ে উঠলো। পরক্ষণেই কিছু ভেবে বললো- মাংতু, তুমি মিছামিছি আশা পোষণ করছে, আমি জানি এই জাহাজখানা ভুলপথে চলেছে।

মাংতু বললো- তাই নাকি?

হা।

তাহলে তো ভীষণ ভয়ের কারণ।

তা তো নিশ্চয়ই। কোথায় কোন্ ডুবো পর্বত লুকিয়ে আছে কে জানে, হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে। জাহাজখানা নিমজ্জিত হতে পারে।

সত্যি আমার বুক কাঁপছে।

মাংতু?

বলুন স্যার।

আমাকে একটা জিনিস দিতে পারো?

কি জিনিস বলুন?

একটা অস্ত্র।

অস্ত্র।

হাঁ।

কি করবেন?

একটি অস্ত্র পেলে আমি জাহাজখানাকে ঠিকই ভুলপথে নিতে পারবো।

 কেমন করে স্যার?

তুমি একটা অস্ত্র আমাকে দাও, পরে দেখবে।

কি অস্ত্র নেবেন স্যার?

 পিস্তল।

 পিস্তল নেই আমার হাতে।

তবে রাইফেল?

রাইফেলও না…

তুমি দেখছি কোনো কাজের লোক নও মাংতু।

ঠিক তাই। স্যার, কাজের লোক হলে কি আর এই সামান্য চাকরি নিয়ে পড়ে থাকি স্যার। অন্য কোনো অস্ত্র নিলে দিতে পারি, যেমন কামান….

তুমি ঠাট্টা করছো মাংতু?

মোটেই না, কারণ কামানটা আমার হাতে আছে তাই ওটা আমি দিতে পারি।

মূর্খ।

মূর্খ আমি নই স্যার, মূর্খ আপনি।

 মাংতু!

রাগ করবেন না স্যার, কারণ আপনার মত ক্যাপ্টেন দস্যু বনহুরকে কাবু করে তাকে অজ্ঞান অবস্থায় বন্দী করে স্পীড বোটে সিঁড়ি বেয়ে নামবেন, সে কথা কল্পনা ছাড়া কিছু নয়। পারবেন দস্যু বনহুরকে কাঁধে করে দড়ির সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে, তাও চলন্ত জাহাজ থেকে?

পারবো।

পিস্তল তাহলে কি করতে চান?

 দরকার হলে বনহুরকে হত্যা করে তার লাশ নিয়ে গিয়ে পৌঁছাববা..

সরকারের কাছে, তাই না?

হাঁ, তাহলেই পাবো দু’লক্ষ টাকা। সরকার ঘোষণা করেছেন, দস্যু বনহুরকে মৃত কিংবা জীবিত যে-কোন অবস্থায় সরকারের সম্মুখে হাজির করতে পারলেই বাস্….

এমন সময় মেসিন গানের শব্দ শোনা যায়, তার সঙ্গে সংকেতধ্বনি।

 মাংতুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে।

ক্যাপ্টেন লিউ বলে উঠে ও কিসের শব্দ?

 মাংতু বলে আপনি এই ক্যাবিনে চুপচাপ অপেক্ষা করুন, ফিরে এসে সব জানাবো।

মাংতু ক্যাবিন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো, ঠিক সেই মুহূর্তে তাকে অনুসরণ করে মিঃ লিউ।

মাংতুর ঠিক পিছনেই আসছিলো সে। মাংতু ক্যাবিনের দরজায় এসে পা দিয়ে চাপ দেয় সঙ্গে সঙ্গে ক্যাবিনের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। ক্যাবিনের মধ্যে আটকা পড়ে যায় ক্যাপ্টেন লিউ।

মাংতুর হাসির শব্দ তার কানে আসে।

ক্যাপ্টেন লিউ-এর মুখ বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠে, মাংতুকে সে বিশ্বাস করে অনেক কথাই বলে ফেলেছে। সর্বনাশ, মাংতুকে সে যেমন সরল-সহজ মনে করেছিলো আসলে সে তেমন সোজা মানুষ নয়। ক্যাবিনের দরজায় মাথা ঠুকতে থাকে লিউ।

*

পুলিশ বাহিনীর জাহাজখানা এখন ফাংহুর জাহাজ থেকে মাত্র মাইল দুই দূরে রয়েছে। ওরা দেখতে পেয়ে মেসিন গান থেকে অবিরত গুলী ছুড়ছে। ফাংহুর কয়েকজন অনুচর এসে দাঁড়িয়েছে মেসিন গান হাতে নিয়ে, পাল্টা জবাব দেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছে তারা।

ফাংহু তখনও মাইল মিটারের সম্মুখে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছে তাদের জাহাজ থেকে পুলিশ জাহাজখানা কত দূরে রয়েছে। ফাংহু বা বনহুরের আদেশ পাওয়ামাত্র এরা গুলী চুড়বে।

বনহুর এখনও ইঞ্জিনে কাজ করে চলেছে।

সম্মুখে ঝুলানো সাউণ্ড বক্স থেকে ফাংহুর গলা শুনা যাচ্ছে। পথের নির্দেশ দিচ্ছে সে অবিরত। পুলিশ জাহাজটি এখন তাদের নাগালের মধ্যে এসে পড়েছে। পুলিশ জাহাজ থেকে মেসিনগানের গুলী এসে পড়ছে তাদের জাহাজের আশেপাশে। ফাংহু ক্রুব্ধ সিংহের ন্যায় ফুলছে, তবু সঙ্গীদের মেসিনগান কিংবা কামান থেকে গুলী ছুঁড়তে নির্দেশ দিচ্ছে না। অবশ্য বনহুরের নির্দেশ মেনে চলতে হচ্ছে তাকে। বনহুর বলেছে, ওরা গুলী ছুড়লেও তারা যেন গুলী না ছোড়ে, কারণ ও জাহাজে তাদেরই লোক বন্দী আছে।

পুলিশ বাহিনী এবার মরিয়া হয়ে গুলী ছুঁড়তে শুরু করলো। মেসিনগানের দু’একটা গুলী এসে পড়লো ফাংহুর জাহাজের ডেকে।

ফাংহুর একজন বিশ্বস্ত অনুচর মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে ফাংহু জানতে পারলো, ক্ষেপে গেলো সে ভীষণভাবে, মাইল মিটার ত্যাগ করে সে মেসিনগানের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।

হঠাৎ সাউণ্ড বক্স থেকে ফাংহুর গলা বন্ধ হয়ে গেলো।

বনহুর বুঝতে পারলে নিশ্চয়ই কোনো বিপদ ঘটেছে। ফাংহুর গলা আর শোনা যাচ্ছে না কেন? হেডচালককে ইঞ্জিনের দায়িত্ব দিয়ে ছুটলো বনহুর ডেকে।

ফাংহু তখন অগ্নিমূর্তি ধারণ করে মেসিনগান হাতে তুলে নিয়েছে।

বনহুর এসে দাঁড়াতেই ফাংহু বললো- পরদেশী বাবু, তুমি মেসিন ক্যাবিনে যাও। এখানে থাকলে গুলী লেগে যেতে পারে।

ফাংহুর কথা শেষ হয় না, সম্মুখস্থ পুলিশ জাহাজ থেকে একটা মেসিনগানের গুলী এসে ফাংহুর বুকে বিদ্ধ হলো!

ফাংহুর রক্তাক্ত দেহখানা হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো ডেকের উপর।

বনহুরের মুখমণ্ডল মুহূর্তে কঠিন হয়ে উঠলো, সে ক্রুদ্ধদৃষ্টি মেলে একবার পুলিশ জাহাজখানা দেখে নিয়ে ফিরে তাকালো ফাংহুর রক্তাক্ত দেহটার দিকে, তারপর ফাংহুর হাত থেকে ছিটকে পড়া  মেসিনগানটা উঠিয়ে নিলো সোজা করে।

এরপর বনহুরের রূপ পাল্টে যায়।

তার হাতের মেসিন গান গর্জে উঠে ভীষণভাবে।

কয়েক সেকেণ্ড গুলী চালাতেই মাংতু এসে দাঁড়ায় বনহুরের পাশে, বলে সে পরদেশী বাবু, থামো!

বনহুর মুহূর্তে ফিরে তাকায়।

মাংতু নিজে আর একটি মেসিনগান নিয়ে দাঁড়িয়েছে, তার চোখেমুছেও একটা উত্তেজনার ভাব। আবার বলে সে পরদেশী বাবু, তুমি ইঞ্জিনে যাও আমি এদিকে দেখছি।

বনহুর মোটেই আশ্চর্য হলো না মাংতুর হাতে মেসিনগান দেখে, সে বললো– মাংতু, তুমি পারবে পুলিশদের গুলীর পাল্টা জবাব দিতে?

পারবো, তুমি যাও বাবু।

বনহুর জানে, এ সময়ে জাহাজখানাকে খুব সাবধানে সম্মুখে নিতে হবে, কারণ একটু বেশি অগ্রসর হলে পুলিশ জাহাজের আয়ত্তে এসে যাবে এবং মেসিনগানের গুলীতে জাহাজের ক্ষতি সাধন হবে।

বনহুর ইঞ্জিন ক্যাবিনের দিকে চলে গেলো

মাংতুর মেসিনগান মুহূর্তে মুহর্তে গর্জে উঠতে লাগলো, অদ্ভুত দক্ষতার সাথে মেসিনগান চালাচ্ছে মাংতু।

ওদিকের পুলিশ জাহাজ থেকে অবিরত গুলী আসছে।

মাংতু নিজকে বাঁচিয়ে পাল্টা জবাব দিয়ে চলেছে।

অন্যান্য খালাসী এবং ফাংহুর অনুচর সবাই অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বনহুর কৌশলে জাহাজখানাকে পুলিশ জাহাজ থেকে দূরে রেখে চালাচ্ছিলো, যাতে পুলিশ জাহাজের নিশানার মধ্যে গিয়ে না পড়ে।

বেশ কিছু সময় দু’পক্ষের গুলী বিনিময় চলার পর হঠাৎ পুলিশ জাহাজের দিক থেকে গুলী আসা বন্ধ হয়ে গেলো। তখনও মাংতুর মেসিনগান অবিরাম গুলী বর্ষণ করে চলেছে। মাংতুর কয়েকজন সাথীও এসে যোগ দিয়েছে তার সঙ্গে। তারাও দূর থেকে মেসিনগান এবং মর্টার চালাচ্ছে।

অতি নিকটে এসে পড়েছে তারা, এ মুহূর্তে গুলী নিক্ষেপ করা আর মোটেই উচিত হবে না।

বনহুর এসে দাঁড়ায় মাংতুর পিছনে, বিস্ময়ে স্তব্ধ হয় মাংতুর মেসিনগান চালানো দেখে, কিছুক্ষণ সে কোনো কথা বলতে পারে না। তারপর এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রেখে বলে– বন্ধু, এবার থামো।

মাংতু একমনে কাজ করে চলেছিলো, তার চারপাশে বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে পড়ে আছে কয়েকটা রক্তাক্ত মৃতদেহ। ওপাশে ফাংহুর লাশটা চীৎ হয়ে পড়ে আছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে ডেকের কিছু অংশ। রণক্লান্ত ঘুমন্ত সৈনিকের মত দুটি আঁখি বন্ধ করে পড়ে আছে ফাংহু। বনহুর ফাংহুর লাশের দিকে তাকিয়ে বললো– ফাংহু ঘুমাক তুমি চলে এসো মাংতু, এবার আমরা পুলিশ জাহাজখানাকে আটক করবো।

মাংতু এবার ক্ষান্ত হলো।

 বনহুর আর মাংতু এসে ডেকের সম্মুখে দাঁড়ালো। উভয়ের হাতেই তখন রাইফেল।

মাংতু তার অন্যান্য সঙ্গীকে অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বললো।

এমন সময় নূরী তার ক্যাবিনের জানালা হতে দেখতে পায় বনহুর রুদ্রমূর্তি নিয়ে ডেকে এসে দাঁড়িয়েছে, পাশে তার মাংতু। দুজনার দেহেই রক্তের ছাপ লেগে রয়েছে।

শত্রু জাহাজখানাকে আক্রমণ করার জন্য তারা রুখে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারে নূরী, বুকটা কেঁপে উঠে হঠাৎ নূরী ভুলে যায় সবকিছু, সে ক্যাবিন থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়। সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায় সমুখ ডেকে, বনহুরের জামার আস্তিন চেপে ধরে বলে উঠে– না না, তুমি ও জাহাজে যেও না হুর, যেও না….. আমার বড় ভয় করেছে।

 বিজয়া নূরীর অদূরে ছিলো, নূরী যখন ক্যাবিন থেকে বেরিয়ে গেলো দ্রুতগতিতে তখন বিজয়া এসে দাঁড়ালো সেই জানালায়, যে জানালা থেকে নূরী দেখতে পেয়েছিলো তার হুরকে।

 বিজয়া এসে জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই তার নজরে পড়লো বনহুরের জামার আস্তিন চেপে ধরে আছে নূরী। বিজয়া এ দৃশ্য দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো। তার তিলকের সঙ্গে ওর কি সম্বন্ধ? কেন সে বারবার যায় তিলকের পাশে?

কিন্তু বেশিক্ষণ ব্যাপারটা ভাবার বা দেখার সময় হয় না বিজয়ার, কারণ ততক্ষণে পুলিশ জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে তাদের জাহাজখানা থেমে যায়। পড়তে পড়তে ক্যাবিনের দেয়াল ধরে নিজকে সামলে নেয় বিজয়া।

বনহুর নূরীকে ঠেলে দিয়ে রাইফেল হাতে আঁপিয়ে পড়ে পুলিশ জাহাজে।

পুলিশদের রাইফেল এবং মেসিনগানের গুলী শেষ হয়ে গিয়েছিলো, কাজেই তারা গুলী চালাতে পারে না। বনহুর নিজেও গুলী ছেড়ে না কাউকে লক্ষ্য করে, কারণ তাদের রাইফেলে গুলী নেই।

বনহুরের সঙ্গে মাংতু এবং তার দলবল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পুলিশ জাহাজে লাফিয়ে পড়ে।

তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়।

বনহুরের এক-একটি প্রচণ্ড ঘুষিতে ধরাশায়ী হয় পুলিশরা। যারা এতক্ষণ ধরে দর্পে মেসিনগান থেকে গুলী ছুড়ছিলো তারা এখন মরিয়া হয়ে লড়াই করে চলে।

পুলিশদের কয়েকজন ভীষণভাবে আহত হলো। ইতোপূর্বে বনহুর এবং মাংতুর মেসিনগানের গুলীতে কয়েকজন পুলিশ প্রাণ হারিয়েছিলো, তাদের লাশগুলো ডেকের উপর এদিক ওদিক বিক্ষিপ্ত পড়ে আছে।

বনহুরের সঙ্গে বেশীক্ষণ পারে না পুলিশদল, সবাই পরাজয় বরণ করে।

মাংতু তখন হীরালালের সহকারী পঞ্চাশজনকে বন্ধনমুক্ত করে দেয়।

হীরালালের সঙ্গীরা এক-একজন কম বীরপুরুষ নয়, তারা মুক্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশদেরকে বন্দী করে ফেলে।

সমস্ত পুলিশ ও পুলিশ অফিসার যারা বন্দীদের দায়িত্ববার নিয়ে কান্দাই অভিমুখে যাচ্ছিলেন, বনহুর আর মাংতু তাদের সবাইকে বন্দী করে ফেলে।

বনহুর আর মাংতু দলবলসহ যখন ফিরে এলো তাদের জাহাজে তখন নূরী আর স্থির থাকতে পারলো না, ছুটে এসে দু’বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরলো বনহুরের গলার তুমি জয়ী হয়েছে!

হাঁ নূরী। কিন্তু আমার জয়ের পিছনে রয়েছে ফাংহু আর মাংতুর অসীম প্রচেষ্টা। ফাংহু নেই, সে থাকলে এই মুহূর্তে ভীষণ খুশি হতো। নূরী, বড় আফসোস, ফাংহ জীবিত রইলো না।

এতক্ষণ আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলো বিজয়া, দেখছিলো সে সব কিছু। মুহূর্তে বিজয়ার মুখ কালো হয়ে উঠে, ফুলই তাহলে তিলকের সেই হারানো ধন, তার প্রিয়া নূরী! তিলক আজ থেকে সরে গেলো তার কাছ হতে দূরে অনেক দূরে।

 বিজয়া আর দাঁড়াতে পারে না, তার বড় কান্না পায়, সে ছুটে চলে যায় তার ক্যাবিনে। আজ আমার মনে পড়ে, ডেকের উপরে সন্ধ্যার অন্ধকারে তিলক আর ফুলকে নিবিড়ভাবে দেখেছিলো। সেদিন। মনে পড়ে, কিছু আগে তিলকের জামার আস্তিন চেপে ধরে কথা বলছিলো ওরা। তার পূর্বেও অনেক সময় তিলক আর ফুলকে দেখেছে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে। বিজয়ার মনে সন্দেহের ছায়া রেখাপাত করেছে, সমস্ত হৃদয়টা যেন ব্যথায় গুমড়ে কেঁদে উঠেছে তার। আজ সব ব্যথা-বেদনার হলো অবসান। তিলকের আশা আজ বিজয়ার হৃদয় থেকে সমূলে মুছে গেলো।

হারানোর বেদনা নিয়ে ক্যাবিনের বিছানায় লুটিয়ে পড়ে কাঁদে বিজয়া।

তখন বনহুরের বাহুর ক্ষতস্থানে নূরী আঁচল ছিঁড়ে যত্ন সহকারে বেঁধে দিচ্ছিল।

 মাংতু এসে দাঁড়ায় সেখানে, বলে পরদেশী বাবু, খুব চোট লেগেছে?

 হেসে বলে বনহুর– না, তেমন লাগেনি মাংতু

 মাংতু তবু সাহায্য করে নূরীকে বনহুরের ক্ষতস্থান বেঁধে দেওয়ায়।

বাধা হয়ে গেলে মাংতু বেরিয়ে যায়।

ক্যাবিনে প্রবেশ করতেই দেখতে পায় মাংতু, বিজয়া তার বিছানায় শুয়ে ফুফিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

মাংতু এসে দাঁড়ায়, কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখে, তারপর বসে ওর পাশে। পিঠে হাত রাখতেই চমকে উঠে বিজয়া- মাংতু তুমি?

হাঁ। কাঁদছো কেন?

মাংতু, তুমি বুঝবে না।

জানি, আমিও মানুষ।

মাংতু!

জানি কেন তোমার চোখে জল–সব জানি। কেঁদো না, কেঁদে কোনো ফল হবে না রাজকুমারী।

বিজয়া বিস্ময় নিয়ে তাকায় মাংতুর মুখের দিকে সে রাজকুমারী, একতা মাংতু জানলে কি করে!

মাংতু বিজয়ার মনোভাব বুঝতে পেরে বলে তুমি কে আমি জানি, তা ছাড়াও জানি তুমি কি চাও?

জানো, জানো মাংতু আমি কি চেয়েছিলাম?

হাঁ, এ পৃথিবীতে এমন অনেক কিছু আছে যা পাবার জন্য মানুষ উন্মাদ হয়ে যায়, তা বলে চাইলেই তা পাওয়া যায় না। একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে মাংতু, তারপর বলে নিজকে সংযত করে নাও রাজকুমারী, যা পাবার নয় তার জন্য দুঃখ করে লাভ নেই, বরং ত্যাগের মধ্যেই আছে পরম এক শান্তি। কথাটা বলে মাংতু বেরিয়ে যায়।

বিজয়া স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে, বিস্ময় জাগে তার মনে সামান্য একজন খালাসী মাংতু, তার মধ্যে এমন একটা মন লুকিয়ে আছে! সত্যিই তো, এ পৃথিবীতে অনেক কিছুই আছে যা চাইলেই পাওয়া যায় না। আকাশের চাঁদ কে না চায়, তাই বলে কি সবাই পায় সেই চাঁদকে। ত্যাগের মধ্যেই আছে পরম এক শান্তি….

এ জাহাজখানা তখন পুলিশ জাহাজটাকে আটক করে এগিয়ে চলেছে নীল নদের প্রবেশ মুখের দিকে।

হীরালালের সঙ্গীরা মুক্তির আনন্দে আত্মহারা। সবাই বনহুর আর মাংতুকে ঘিরে আনন্দ করছে। পুলিশ জাহাজেই পুলিশগণকে বন্দী করে রাখা হয়েছে।

 ফাংহুর লাশ সম্মানে নীল নদে ভাসিয়ে দেওয়া হলো। তার লাশটি যখন নীল নদে নামানো হলো তখন মাংতুর চোখে অশ্রু ঝরে পড়লো, সে অনেক কষ্টে নিজকে সামলে রাখলো।

ফাংহুর সঙ্গে আরও কয়েকজন নিহত হয়েছিলো, তাদেরকেও নীল নদে নামিয়ে দেওয়া হলো।

বনহুর এবার মাংতুকে বললো– মাংতু হীরালালের অনুচরগণ মুক্তি পেয়েছে, এবার পুলিশ জাহাজখানাকে মুক্তি দিয়ে দাও।

মাংতু বনহুরের কথা ফেলতে পারে না, সে পুলিশ ও তাদের জাহাজখানাকে মুক্তি দিয়ে দেয়। যে ক’জন পুলিশ ও পুলিশ অফিসার ছিলেন তাদেরকেও সেই জাহাজে বিদায় দেওয়া হলো।

পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ হারুন এবং মিঃ শরীফ ছিলেন ঐ জাহাজে। তারা বুঝতে পেরেছিলেন এ দস্যু বনহুর ছাড়া অন্য কেউ নয়, নাহলে কার সাধ্য তাদের পুলিশ জাহাজ আটক করে।

ছাড়া পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন পুলিশ ইন্সপেক্টারদ্বয়। তারা জাহাজ নিয়ে ফিরে চললেন কান্দাই অভিমুখে। দস্যু বনহুরকে গ্রেফতারের আশা উপস্থিত তাঁরা ত্যাগ করলেন।

দস্যু বনহুরের জাহাজখানা চললো নীল দ্বীপের উদ্দেশ্যে। বিজয়াকে পৌঁছে দিয়ে ফিরে যাবে সে কান্দাই—এর আস্তানায়।

বনহুরের বাহুতে যে আঘাত লেগেছিলো তা ক্রমান্বয়ে শুকিয়ে আসছিলো। তবু মাংতু প্রতিদিন নিজে এসে ওর ক্ষতস্থানে ঔষধ লাগিয়ে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিতো।

নূরী আর বিজয়া থাকতো তার পাশে।

বিজয়া আজকাল বড় গম্ভীর হয়ে পড়েছে, কেমন যেন মনমরা ভাব নিয়ে থাকে সে। বনহুরের পাশে সে আজকাল বেশি আসে না সব সময় দূরে দূরে সরে থাকে।

আজ কদিন জাহাজখানা একটানা নীলনদ অতিক্রম করে চলেছে। আকাশ পরিষ্কার, সন্ধ্যার। পর চাঁদ উঠে আকাশে।

 ফুরফুরে বাতাসে অনাবিল একটা শান্ত ভাব ছড়িয়ে আছে চারদিকে। আর একদিন পরই তাদের জাহাজখানা পৌঁছে যাবে নীলদ্বীপে।

বিজয়াকে নীলদ্বীপে তার পিতামাতার কাছে পৌঁছে দিতে পারলে বনহুর নিশ্চিন্ত হবে।

বনহুর নিজের ক্যাবিনে শুয়ে শুয়ে বিজয়ার কথাই ভাবছিলো, বিজয়া তাকে গভীরভাবে ভালবেসেছিলো। বহুদিনের বহু কথা আজ তার মনে আলোড়ন তোলে।

রাজকন্যা বিজয়া, রাজসুখ ত্যাগ করে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলো। তার ব্যথা বেদনার সমভাগী হয়েছিলো সে। বনহুর ওকে কিছু দেয়নি– নিজকে বড় অপরাধী মনে হয়।

বনহুর ক্যাবিন ত্যাগ করে বেরিয়ে আসে বাইরে। সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে অনেকক্ষণ, আকাশে চাঁদ হাসছে। বনহুর ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় জাহাজের পেছনে ডেকের দিকে।

দেখতে পায় সেখানে কে একজন ওদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।

বনহুর বুঝতে পারে বিজয়া ছাড়া কেউ নয়। আজ কদিন থেকে তাকে সব সময় নির্জনে একা একা থাকতে দেখেছে। নিশ্চয়ই বিজয়া তার উপর অভিমান করেছে।

অন্য সময় হলে বনহুরের এসব লক্ষ্য করার সময় হতো না, তাকে সর্বক্ষণ কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হতো। যেমন ক’ দিন আগেও বনহুর ছিলো ঠিক আলাদা মানুষ। হিংস্র সিংহের মতই ভয়ঙ্কর ছিলো তার রূপ তখন।

এ ক’দিন কেউ তার পাশে যাওয়ার সাহসী হয়নি শুধু ফাংহু ছাড়া। ফাংহুর মৃত্যু বনহুরকেও কম ব্যথা দেয়নি। সে জানতো, ফাংহু তাকে রক্ষা করার ব্রত নিয়েই নিজেকে উৎসর্গ করে দিলো। কদিন ওর সঙ্গে মিশেই সে বুঝতে পেরেছিলো ওকে। লোকটার পেছনে যদিও একটা শক্তি সর্বক্ষণ তাকে পরিচালিত করছিলো, তবু তার নিজস্ব ক্ষমতাও ছিলো অসীম, তাতে কোনো সন্দেহ ছিলো না। যেমন দুঃসাহসী তেমনি শক্তিশালী ছিলো ফাংহু।

এ জাহাজে আরও যারা ছিলো তারাও এক-একজন ভীষণ দুঃসাহসী এবং শক্তিশালী। শুধু তাই নয়, এরা অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছিলো। বনহুর দেখেছে, সবাই যেন এক অসীম শক্তি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। যে শক্তি এতগুলো মানুষকে যন্ত্রচালিতের মত চালিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, কি সে শক্তি, কে সে? আর কেউ না জানতেও বনহুরের কাছে তা গোপন ছিলো না, সে জানে কে সে।

সেই আশা যে তাকে বহুবার বহু কাজে সহায়তা করেছে, তার জীবন রক্ষার জন্য যে বারবার ছুটে এসেছে তার পাশে। আজও যে তার পুলিশের কবল থেকে বাঁচানোর জন্য এত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আশার প্রতি বনহুরের কম সহানুভূতি ছিলো না, যদিও সে বনহুরের কাছে নিজকে কোনো সময় প্রকাশ করতে চায়নি বা চায় না।

বনহুর এসে দাঁড়ায় বিজয়ার পাশে।

 জ্যোছনার আলোতে চারদিক ঝলমল করছে।

বনহুরের পদশব্দ পেয়ে বিজয়া ফিরে তাকায়, ওকে দেখে তাড়াতাড়ি চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই বনহু ডাকে- বিজয়া, শোন।

দাঁড়িয়ে পড়ে বিজয়া।

 বনহুর ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায় বিজয়ার পাশে।

বাতাসে বিজয়ার আঁচলখানা উড়ছিলো। জ্যোছনার আলোতে বিজয়ার মুখখানা থমথমে দেখাচ্ছিলো। বনহুরের কথায় মুখখানা ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে।

বনহুর পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে তাতে অগ্নিসংযোগে করে।

এ জাহাজে আসার পর বনহুর দামী সিগারেট এবং তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব পেয়েছিলো। কাজেই তার কোনো অসুবিধা ছিলো না। বনহুর সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে বলে–বিজয়া, আজকের রাত আমার এবং তোমার জীবনে শেষ রাত। তোমার কাছে আমি অনেক ব্যাপারে ঋণী। থামলো বনহুর, রেলিং-এ ঠেস দিয়ে সিগারেট পান করে চললো, কয়েকমুখ ধোয়া ছেড়ে বললো তুমি আমাকে যথেষ্ট দিয়েছে, তোমার প্রাণঢালা ভালবাস আমাকে অভিভূত করেছে। বিজয়া, তুমি আমার উপর অভিমান করো না, যখনই আমাকে ডাকবে আমি আসবো তোমার পাশে। এই নাও…. বাহুর নিজের হাতের আংগুল থেকে আংটিটা খুলে বাড়িয়ে ধরলো- এটা রাখো, আমার স্মৃতিস্বরূপ দিলাম। এটা সাধারণ আংটি নয়, এর মধ্যে বসানো আছে ওয়্যারলেস। যখন বিপদে পড়বে তখন আমাকে ডেকো, আসবো যেখানেই থাকি না কেন।

এবার বিজয়ার মুখ উজ্জ্বল দীপ্ত হয়ে উঠলো, সে বনহুরের হাত থেকে আংটিটা নিয়ে মুঠার। মধ্যে চেপে ধরলো, তারপর চোখে অশ্রু, মুখে হাসি নিয়ে বললো– সত্যি ডাকলে আসবে?

আসবো।

তিলক, এই আংটিই হবে আমার জীবনে সম্বল। কথাটা বলে বিজয়া আংটিটা মুঠায় চেপে ধরে ছুটে চলে গেলো সেখান থেকে।

বনহুর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ, ফিরে তাকাতেই নজরে পড়লো অদূরে দাঁড়িয়ে আছে মাংতু। বনহুর ফিরে তাকাতেই সরে গেলে সে দ্রতগতিতে।

*

বিজয়াকে নীল দ্বীপে পৌঁছে দিয়ে বনহুর মাংতুর কাছে বিদায় চাইলো। মাংতু বনহুরের জন্য পৃথক একটি জাহাজের ব্যবস্থা করে দিলো। সেই জাহাজে বনহুর, নূরী আর কয়েকজন নাবিক রইলো মাত্র।

বনহুর বিদায় মুহূর্তে মাংতুর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বললো– আশা, তোমার এ ঋণ জীবনে ভুলবো না! আমার অন্তরের শুভেচ্ছা রইলো তোমার জন্য, তোমার ত্যাগের কথা চিরদিন স্মরণ থাকবে।

মাংতুর মুখখানা তখন রক্তরাঙ্গা হয়ে উঠেছিলো, পর মুহূর্তে চোখ দুটো ওর অশ্রু ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো, দ্রুত সরে গেলো সে সেখান থেকে।

বনহুরের জাহাজখানা যখন মাংতুর জাহাজ থেকে দূর সরে যাচ্ছিলো তখন বনহুর আর নূরী এসে দাঁড়ালো ডেকের উপর। তারা দেখতে পেলো, মাংতু স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে তার জাহাজের ডেকের রেলিংয়ের পাশে।

বনহুর হাত নাড়তে থাকে।

নূরীও হাত নেড়ে মাংতুকে বিদায় সম্ভাষণ জানায়। ক্রমান্বয়ে মাংতুর জাহাজ থেকে বনহুরের ছোট্ট জাহাজখানা ধীরে ধীরে সরে যায়। এক সময় ঝাপসা হয়ে আসে মাংতুর জাহাজটা বনহুর আর নূরীর চোখে।

বনহুর চোখে বাইনোকুলার তুলে ধরে, দেখতে পায় মাংতু তখনো তার জাহাজের ডেকে রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

মৃদু হাসির আভাস ফুটে উঠে বনহুরের ঠোঁটের ফাঁকে।

নূরী তাকিয়ে ছিলো বনহুরের মুখের দিকে। ওর ঠোঁটের ফাঁকে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠতে দেখে বললো নূরী হাসছো যে?

নূরী, এখনো মাংতু ঠিক সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।

দেখি। নূরী বনহুরের হাত থেকে বাইনোকুলার নিয়ে চোখ ধরে বলে উঠে-তাইতো, মাংতু। এখনো তার ঠিক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, জাহাজখানা দেখছে।

হা। গম্ভীর কণ্ঠে বললো বনহুর।

নূরী বললো– সত্যি, মাংতু ছেলেটা বড় ভাল। ও না হলে আমাদের অবস্থা বড় শোচনীয় হতো। ওকে আমার খুব ভাল লেগেছিলো।

বনহুর হেসে বললো– ছেলে নয় মেয়ে!

 নূরী অবাক হয়ে তাকালো বনহুরের মুখের দিকে, বললো– মাংতু ছেলে নয় মেয়ে!

হা। বনহুর একটা সিগারেট বের করে তাতে অগ্নি সংযোগ করলো। বাইনোকুলারটা তখন তার গলার সঙ্গে ঝুলছিলো।

নূরী বলে চললো– মাংতু মেয়ে আশ্চর্য! সত্যি কত দুঃসাহসী সে। হুর, তুমি যখন জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে মেসিনগান চালাচ্ছিলে তখন মাংতুকেও দেখেছি তোমার পাশে দাঁড়িয়ে অসীম বীরত্বের সঙ্গে মেসিনগান চালাতে। তাছাড়া সে তোমার পাশে থেকে পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে ভীষণ লড়াই করে চলেছিলো।

হাঁ, ওর বীরতু আমাকেও কম আশ্চর্য করেনি।

আমি ভাবতেও পারিনি মাংতু পুরুষ নয় নারী।

 ওর মাথায় সর্বদা পাগড়ি দেখেও তোমার মনে সন্দেহ জাগেনি?

 তেমন করে খেয়াল করিনি হয়তো, তাই……

ওর আসল পরিচয় জানলে তুমি আরো অবাক হবে নূরী।

 তাই নাকি, ওর আরো কিছু পরিচয় আছে?

যে জাহাজখানা থেকে আমরা একটু আগে বিদায় নিলাম সে জাহাজখানা মাংতুর।

সত্যি?

হাঁ। ফাংহু তারই অনুচর।

 বল কি হুর?

এ জাহাজে যারা কাজ করছে তারা সবাই মাংতুর অনুগত কর্মচারী।

আমি জানতাম ফাংহুই ছিলো ঐ জাহাজের মালিক।

না, ফাংহুর মাংতুর দাস। মাংতুর পরিচালনায় গোটা জাহাজের লোক পরিচালিত হচ্ছিলো। শুধু তাই নয়, মাংতুর অদ্ভুত কাৰ্যদক্ষতা আমাকে বিস্মিত করেছিলো। ও জাহাজখানা তার এক সৃষ্টি।

নূরীর দু’চোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে উঠে, বলে সে মেয়েটি দেখছি একটি…..

 হ নূরী, সে এক বিস্ময়।

ওর আসল পরিচয় তুমি জানো?

জানি।

কে সে নারী?

সেই আশা

মাংতু আশা?

 হাঁ।

কথাটা শুনে নূরী একেবারে থ খেয়ে যায়। বিশ্বাস হতে চায় না যেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলে উঠে সে আশা এতদিন জাহাজে আমাদের সঙ্গে ছিলো?

শুধু জাহাজের নয়, সে সর্বক্ষণ তোমার পাশে ছিলো তোমার সখী চম্পার বেশে।

 এ তুমি কি বলছে হুর?

 হাঁ, সেই চম্পাই মাংতু আর মাংতুই হলো আশা। আর সেই আশা কে জানো?

ঢোক গিলে বলে নূরী– না।

আশাই হলো মনসুর ডাকুর কন্যা ইরানী।

বনহুরের কথাগুলো নূরী অবাক হয়ে শুনে যাচ্ছিলো। আশাই মনসুর ডাকুর কন্যা! কথাটা শুনে তার কণ্ঠ যেন রোধ হয়ে আসে। মাংতুর বেশে আশা তাদের সঙ্গে ছিলো এতদিন, এটা যেন ভাবতেই পারে না নূরী। আবার ওকে কাছে পাবার জন্য মনটা ওর উন্মুখ হয়ে উঠে। নতুন করে আবার ওকে দেখার বাসনা জাগে তার মনে।

কিন্তু মনের আশা তার আর পূর্ণ হবার নয়, আশা এখন অনেক দূরে। নূরীকে ভাবতে দেখে বনহুর হেসে বললো– নূরী, এখন আমরা আস্তানায় ফিরে চলেছি, কোনো বাধাই আর আমাদের পথ রোধ করতে পারবে না। জাভেদকে কতদিন তুমি দেখোনি, নিশ্চয়ই সে তোমার উপর অভিমান করে বসে আছে।

নূরী একটু হেসে বললো– জাভেদ কি শুধু আমার উপর অভিমান করেছে, তোমার উপর সে কি….

নূরীর কথা শেষ হয় না, বনহুর ওকে নিবিড়ভাবে টেনে নেয় কাছে।

দমকা বাতাসে নূরীর আঁচলখানা বনহুরের চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ে। দু’জনাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠে।

*

বনহুর আস্তানায় ফিরে প্রথমেই জাভেদকে তুলে নিলো কোলো। এই কমাসে জাভেদ অনেক বড় হয়েছে। পা পা করে হাঁটতে শিখেছে সে।

নাসরিন ওকে এতদিন মায়ের স্নেহে পালন করেছে, জাভেদ তাই ওকে বেশি করে চেনে। নূরীর কোলে যেতেই চাইলো না সে প্রথম প্রথম, পরে বোধ হয় সে চিনতে পেরেছে তার মাকে, তাই মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো।

বনহুর ওকে চুয়োয় চুমোয় ভরিয়ে দিয়ে ডাকলো– আব্বু, তুমি বড় দুষ্টু হয়েছে।

 নূরী একটু হেসে বললো– ঠিক তোমার মত।

বনহুর আর নূরী বেশ কিছুক্ষণ মেতে রইলো জাভেদকে নিয়ে।

 নাসরিন ও যোগ দিয়েছিলো তাদের সঙ্গে।

এক সময় নূরী নাসরিনের কানে মুখ নিয়ে বললো বুঝতে পেরেছি তুই মা হতে চলছিস।

 আঁচলে মুখ ঢেকে হাসলো নাসরিন, কারণ সত্যিই সে অন্তঃসত্ত্বা ছিলো।

জাভেদ বনহুরের গলা জড়িয়ে ধরে আধো আধো কণ্ঠে কত কথা বলে, হাসে সে বারবার ফিফিক করে।

বনহুর যখন জাভেদকে নিয়ে মেতে ছিলো তখন দরবারকক্ষে তার অনুচরগণ তার অপেক্ষায় প্রহর গুণছিলো। অনেক দিনের অনেক কাজ জমা হয়ে আছে তার জন্য।

রহমান এসে পায়চারী করছে বনহুরের কক্ষের দরজার বাইরে। তার চোখেমুখে একটাউত্তেজনার ভাব ফুটে উঠেছে। বনহুরকে এ মুহূর্তে তার নিতান্ত প্রয়োজন।

বনহুরকে আনন্দমুখর দেখে তাকে ডাকতে সাহসী হচ্ছে না সে।

এমন সময় কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে নাসরিন। স্বামীকে সে উত্তেজিতভাবে অপেক্ষা করতে দেখে থমকে দাঁড়ায়, বলে কি হয়েছে?

নাসরিন, একটি দুঃসংবাদ।

দুঃসংবাদ?

 হাঁ।

নাসরিনের চোখেমুখে একটা দুশ্চিন্তার ছায়াপাত হয়। সরে আসে সে ভীত-পদক্ষেপে স্বামীর পাশে, উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে- কি দুঃসংবাদ, বলো?

কান্দাই শহর থেকে আমাদের গুপ্তচর সংবাদ নিয়ে এসেছে বৌরাণীর নাকি খুব অসুখ, বাঁচবে কিনা সন্দেহ।

বলো কি, মনিরা অসুস্থ?

 হাঁ, কি অসুখ হয়েছে ডাক্তার ধরতে পারেনি।

তাহলে তো বড়ই দুশ্চিন্তার কারণ……….. একটু থেমে বললো নাসরিন– আমি সর্দারকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

হাঁ, তাই করো নাসরিন। আর শোন, হঠাৎ গিয়ে তুমি যেন কিছু বল না।

আচ্ছা বলবো না।

কথাটা বলে নাসরিন পুনরায় কক্ষে ফিরে যায়।

বনহুর তখন জাভেদকে আদর দিচ্ছিলো।

নাসরিন এসে দাঁড়ালো–সর্দার।

বনহুর ফিরে তাকালো নাসরিনের মুখের দিকে।

নাসরিন বললো- সর্দার, রহমান আপনাকে বাইরে ডাকছে।

 রহমান?

হাঁ।

বনহুর জাভেদকে নূরীর কোলে দিয়ে বলে- চলো।

নাসরিনের সঙ্গে বনহুর বেরিয়ে যায়।

নূরী জাভেদকে নিয়ে মেতে উঠে আনন্দে।

বনহুর আর নাসরিন কক্ষ হতে বেরিয়ে আসতেই রহমান বনহুরকে কুর্ণিশ জানায়।

বনহুর বলে উঠে— কি সংবাদ রহমান?

একটি অশুভ সংবাদ আছে সর্দার।

 অশুভ সংবাদ!

রহমান বলে– বৌরাণী ভয়ানক অসুস্থ।

মনিরা অসুস্থ?

 হ সর্দার, ডাক্তার বলেছে তার বাঁচার আশা খুব কম।

 বনহুর আর দাঁড়ালো না, সে ফিরে চললো কক্ষমধ্যে।

নূরী পদশব্দে ফিরে তাকাতেই বনহুরের মুখমণ্ডল লক্ষ্য করে চমকে উঠলো, তাড়াতাড়ি সরে এলো নুরী কিন্তু সহসা কোনো প্রশ্ন করতে পারলো না।

বনহুর দ্রুত ড্রেস পাল্টে নিলো। মাথায় পাগড়িটা বেঁধে নিয়ে রিভলভার তুলে নিলো হাতে, তারপর কোমরের বেল্টে রিভলভার ভরে নিয়ে ফিরে দাঁড়াতেই নূরী বললো– কোথায় যাচ্ছো হুর?

বনহুর বললো- কান্দাই শহরে। মনিরা অসুস্থ।

 কথা কয়টি বলেই বেরিয়ে গেলো বনহুর।

নূরী স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো পুতুলের মত। জাভেদ মাকে হঠাৎ নিশ্চুপ হয়ে যেতে দেখে কাঁদতে শুরু করে দিলো।

বনহুর আস্তানার বাইরে বেরিয়ে এলো।

 রহমান ইতোপূর্বেই তাজকে প্রস্তুত করে নিয়ে আস্তানার বাইরে অপেক্ষা করছিলো।

 বনহুর তাজের পাশে এসে দাঁড়াতেই তাজ অদ্ভুত শব্দ করে উঠলো।

রহমান তাজের লাগাম ছেড়ে সরে দাঁড়ালো।

 বনহুর মুহূর্তে বিলম্ব না করে উঠে বসলো তাজের পিঠে।

তাজ সম্মুখের পা দু’টি উঁচু করে আনন্দ প্রকাশ করলো।

বনহুর বললো- রহমান, মনিরা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমি ফিরবো না।

তাজ এবার ছুটতে শুরু করলো।

*

মনিরার শ্যার পাশে এসে জড়ো হয়েছেন তার আত্মীয় স্বজন সবাই। শিয়রে বসে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করে চলেছেন মরিয়ম বেগম।

বৃদ্ধ সরকার সাহেব শিয়রে দাঁড়িয়ে, তার চোখে ও অশ্রু। অন্যান্য আত্মীয়স্বজন যারা মনিরাকে দেখতে এসেছেন তারা সবাই বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। সকলের চোখেমুখেই একটা দুশ্চিন্তার ভাব ছড়িয়ে আছে।

নূর এখন বেশ বড় হয়েছে, সে বুঝতে শিখেছে অনেক কিছু। মায়ের অসুখ ভয়ানক হয়েছে বুঝা তার বাকি নেই, তাই নূর দূরে বসে ভাবছে মায়ের কথা।

শহরের বড় বড় ডাক্তার এসেছেন, তাঁরা তাঁদের সাধ্যমত চিকিৎসা করে চলেছেন কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।

মনিরার দেহ ক্ষীণ হয়ে গেছে, চোখ দুটি বসে গেছে, কালিমা পড়েছে চোখের নিচে। রক্তাক্ত গণ্ডদ্বয় ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। ডাক্তাররা হতাশ হয়ে পড়েছেন, কি রোগ হয়েছে কোনো ডাক্তার ধরতে পারছেন না।

ডাক্তারদের মুখেও চিন্তার ছাপ বিদ্যমান।

সন্ধ্যার অন্ধকার ক্রমে ঘনীভূত হয়ে আসছে। একে একে আত্মীয়স্বজন সবাই বিদায় গ্রহণ। করলেন। মনিরার বান্ধবী যারা এসেছিলো তারাও একে একে চলে গেলো।

ডাক্তাররাও বিদায় গ্রহণ করলেন একসময়। আবার আসবেন বলে কথা দিয়ে গেলেন তারা।

রাত বাড়ছে।

সমস্ত কান্দাই নগরী সুপ্তির কোলে ঢলে পড়েছে। চৌধুরী বাড়ীর দু’একজন চাকর ছাড়া সবাই ঘুমে অচেতন। আজ কদিন হলো তারা ঘুমোতে পারেনি। বাড়িতে কঠিন রোগী, কাজেই সবাই সব সময় উদ্বিগ্নভাবে রাত জেগে সময় কাটিয়েছে।

আজ আর জাগতে পারছে না ওরা, তাই যে যেখানে পেরেছে ঢলে পড়েছে নিদ্রায়।

বৃদ্ধ সরকার সাহেবও কদিন অবিরত জেগেছেন, আজ তিনি বসে বসে ঝিমুচ্ছিলেন, মরিয়ম বেগম তার অবস্থা লক্ষ্য করে বললেন- সরকার সাহেব, আপনি গিয়ে শুয়ে পড়ুন, আবার কখন কি হয় ডাক্তারের কাছে ছুটতে হবে।

 সরকার সাহেব সত্যি আজ বড় ক্লান্ত। বয়স হয়েছে অনেক কাজেই ক’দিন একটানা রাত জেগে তার অবস্থা কাহিল হয়ে পড়েছিলো। মরিয়ম বেগমের কথা তিনি ফেলতে পারলেন না; চলে গেলেন বিশ্রামের জন্য।

নূর কিন্তু এতক্ষণও বসে ছিলো মায়ের পাশে, করুণ চোখে তাকিয়ে ছিলো সে মায়ের রোগকাতর পাংশু মুখখানার দিকে। না জানি তার মার কি হবে কে জানে। নূরের শিশুমনেও দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে। আজ তার মনে বারবার জাগছে আলুর কথা। কোথায় গেছেন তিনি কেনই বা গেছেন। এতদিন আসেন না কেন তাই বা কে জানে। বড্ড রাগ হচ্ছে নূরের তার পিতার উপর। মায়ের অসুখ তবু কি তিনি দূরে থাকবেন?

মরিয়ম বেগম আদর করে বলেছেন— দাদু, তুমি শোবে– যাও।

নূর বলেছে না দাদী আম্মা, আমি শোবো না। তুমি একা একা মায়ের পাশে জেগে থাকবে, তা হবে না।

লক্ষ্মী দাদু আমার, যাও বলছি, গম্ভীর কণ্ঠে কথাটা বলেছিলেন মরিয়ম বেগম।

এবার নূর দাদী আম্মার কথা ফেলতে পারে না, সে নীরবে মায়ের শয্যা ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলো নিজের বিছানায়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ ভেবেছিলো অনেক কথা, তারপর এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে।

রাত গভীর।

মরিয়ম বেগম মনিরার শিয়রে বসে ঝিমুচ্ছিলেন, দু’চোখে তার আপনা আপনিই বন্ধ হয়ে আসছিলো। কিছুতেই আর চোখ মেলে রাখতে পারছিলেন না।

মনিরার চোখে ঘুম নেই, সর্বক্ষণ সে মাথাটা এপাশ ওপাশ করছে। মাঝে মাঝে অস্ফুট কণ্ঠে ডাকছে– মনির.. মনির… তুমি এসেছো…… এসো…. আরও সরে এসো…. মনির….. আমার মনির… এসেছো…….

 মনিরার কথাগুলো যদিও অস্পষ্ট ছিলো তবুও নিস্তব্ধ কক্ষে কথাগুলো বেশ বুঝা যাচ্ছিলো।

এমন সময় বনহুরের অশ্ব তাজ এসে থামলো চৌধুরী বাড়ির পিছনে। জমকালো ড্রেস পরিহিত বনহুর নেমে পড়লো তাজের পিঠ থেকে। এগিয়ে চললো সে চৌধুরীবাড়ির দিকে। কয়েক পা এগুতেই বনহুরের চারপাশে ঘিরে ফেললো অসংখ্য পুলিশ। প্রত্যেকের হাতেই গুলীভরা রাইফেল।

বনহুর আজ বড় অন্যমনস্ক ছিলো, তাই সে জ্ঞানশূন্যের মত ছুটে এসেছিলো, খেয়াল করেনি কোনো দিকে।

 পুলিশ মহলের সর্বদা দৃষ্টি ছিলো চৌধুরী বাড়ির দিকে। পুলিশ অফিসার আশরাফী গোপনে জানতে পেরেছিলেন দস্যু বনহুর পত্নী মিসেস মনিরা ভয়ানক অসুস্থ, বাঁচবে কিনা সন্দেহ। সুচতুর মিঃ আশরাফীর সন্দেহ হয়েছিলো, স্ত্রীর যখন এমন কঠিন অসুখ তখন নিশ্চয়ই স্বামী স্থির থাকতে পারবে না, যেখানেই থাক ছুটে আসবে সে একবার। তাই তিনি প্রায় এক সপ্তাহকাল অবিরাম চৌধুরীবাড়ির আশেপাশে গোপনে সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন রেখে তিনি নিজে পাহারা দিচ্ছিলেন।

আজ গভীর রাতে হঠাৎ তাদের কানে এসে পৌঁছে অশ্ব পদশব্দ। মিঃ আশরাফী এবং পুলিশ বাহিনীর চোখ আনন্দে নেচে উঠে। তারা বুঝতে পারে, গভীর রাতে নিস্তব্ধ প্রান্তরের দিকে অশ্ব পদশব্দ, নিশ্চয়ই দস্যু বনহুরের অশ্ব পদশব্দ এটা। পুলিশ বাহিনী সতর্ক এবং প্রস্তুত হয়ে নেয়।

সত্যিই তারা দস্যু বনহুরকে ঘিরে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। মিঃ আশরাফী বনহুরের বুক লক্ষ্য করে রাইফেল উঁচিয়ে ধরেন।

বনহুর বাধ্য হয় হাত দু’খানা উঁচু করে তুলে ধরতে। ততক্ষণে তাজ কিন্তু অন্ধকারে উধাও হয়েছে।

পুলিশ বাহিনী বনহুরের চারপাশে রাইফেল বাগিয়ে ধরে নিয়ে চলে।

 বনহুর কোনোরকম দ্বিধা না করে পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে এগিয়ে চললো।

অদূরেই পুলিশ ভ্যান অপেক্ষা করছিলো— একটি নয়, অন্ধকার ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে কয়েকটা ভ্যান লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো।

পুলিশ বাহিনী রাইফেল বাগিয়ে বনহুরকে নিয়ে ভ্যানের পাশে এসে দাঁড়ালো। বনহুরের চারপাশে অসংখ্য রাইফেলের মুখ স্থির হয়ে আছে।

ড্রাইভ আসনে উঠে বসলো পুলিশ ড্রাইভার।

 বনহুর নীরবে গাড়িতে উঠে বসলো।

 অন্যান্য পুলিশ অস্ত্র নিয়ে উঠে বসলো তার চারপাশ ঘিরে।

সম্মুখে তিনখানা পুলিশ ভ্যান, পিছনে তিনখানা। মাঝখানে বনহুরের গাড়ি। প্রত্যেকটা গাড়িতে দশজন করে সশস্ত্র পুলিশ দাঁড়িয়ে রইলো। উল্কা বেগে গাড়িগুলো ছুটে চলেছে হাঙ্গেরী কারাগার অভিমুখে।

জনহীন রাজপথ বেয়ে গাড়িগুলো এগিয়ে চলেছে। কয়েক মিনিট পর কান্দাই সেতুর উপর দিয়ে গাড়িগুলো ছুটতে শুরু করলো। কান্দাই নদীর বুকে এই সেতুটি সবচেয়ে বড়। প্রায় আধমাইল নিয়ে এই সেতুটি তৈরি হয়েছে। ওপারে হাঙ্গেরী কারাগার।

গাড়িগুলো দ্রুতবেগে ছুটে চলেছে।

সেতুর নিচে কান্দাই নদী।

বনহুর এই মুহূর্ত নষ্ট করে না, সে পুলিশ বাহিনীর বেষ্টনী ভেদ করে ঝাঁপিয়ে পড়লো সেতুর উপর থেকে কান্দাই নদীর গভীর জলে।

 সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ বাহিনীর রাইফেল এক সঙ্গে গর্জে উঠে। গাড়িগুলোও থেমে পড়ে একটির পর একটি লাইন করে।

 পুলিশ বাহিনী ভ্যান ত্যাগ করে লাফিয়ে পড়লো সেতুর উপর। মিঃ আশরাফী আদেশ দিলেন অবিরাম গুলী চালাতে।

 পুলিশ বাহিনী মিঃ আশরাফীর আদেশ অনুসারে সেতুর ধারে গিয়ে নদীবক্ষ লক্ষ্য করে বৃষ্টিপাতের মত গুলী ছুঁড়তে লাগলো।

*

চৌধুরীবাড়ির পিছন দিকের একটি কক্ষের পাইপ বেয়ে উঠে এলো বনহুর ছাদের রেলিংয়ের পাশে। অতি সন্তর্পণে রেলিং বেয়ে এগুতে লাগলো সে মনিরার কক্ষের দিকে। বনহুরের জামা কাপড় ভিসে চুপসে গেছে, কাঁধের একপাশের জামা রক্তে জবজব করছে। পুলিশের গুলী থেকে বনহুর রেহাই পায়নি, একটি গুলী এসে তার কাঁধের কিছুটা মাংস ছিঁড়ে নিয়ে বেরিয়ে গেছে।

 বনহুরের হাতে হাতকড়া ছিলো, অতি কষ্টে সে সাঁতার কেটে তীরে এসে উঠেছিলো, তারপর হাতকড়া খুলে ফেলতে তার বিলম্ব হয়নি। নদীর তীর বেয়ে কিছুটা এগুতেই একটা গাড়ি তার নজরে পড়েছিলো, হয়তো কোনো স্টীমার যাত্রী বা নৌকারোহীর গাড়ি হবে। মালিককে পৌঁছে দিয়ে ড্রাইভার নদীতীরে ঝিরঝিরে স্নিগ্ধ হাওয়ায় নিদ্রা যাচ্ছিলো, বনহুর সেই গাড়িখানার পাশে এসে দাঁড়ালো।

ড্রাইভার নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছিলো।

বনহুর ওর কাঁধে হাত রেখে ঝাঁকুনি দিতেই চমকে উঠে ড্রাইভ আসনে সোজা হয়ে বসলো, চোখ রগড়ে তাকাতেই তার দেহের রক্ত হিম হয়ে গেলো। জমকালো পোশাক পরা ভিজে শরীরে তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে কে এই ব্যক্তি। ড্রাইভারকে কোনো কথা বলতে সময় না দিয়ে বনহুর বলে ছিলো– গাড়ি ছেড়ে নেমে যাও।

বনহুরকে দেখে ভয়ে আরষ্ট হয়ে পড়েছিলো ড্রাইভার, টু’শব্দ না করেই নেমে পড়ে সে।

বনহুর মুহূর্ত বিলম্ব না করে ড্রাইভ আসনে উঠে বসে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছিলো। গাড়ি যখন ছুটছে তখন ড্রাইভারের হুশ হলো, তারপর সে চিৎকার শুরু করে দিলো।

ততক্ষণে বনহুরের গাড়ী নিয়ে উধাও হয়ে গেছে।

চৌধুরীবাড়ির পিছনে গাড়ি রেখে বনহুর সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে গিয়েছিলো বড় কক্ষটার দিকে। পুলিশ মহলের লোক এ সময় কেউ আশেপাশে ছিলো না। কারণ তারা তো বনহুরকে পাকড়াও করেই নিয়ে গেছে, তা ছাড়া বনহুর নদীগর্ভে পড়ে গেছে, এত তাড়াতাড়ি সে আবার চৌধুরীবাড়ি ফিরে যাবে বা যেতে পারে, এটা কেউ ধারণা করতে পারেনি। মিঃ আশরাফী পুলিশ বাহিনী নিয়ে তখন নদীতীর ঘিরে ফেলে বনহুরের অনুসন্ধান করে চলেছেন।

 বনহুর রেলিং বেয়ে, মনিরার কক্ষের পাশে এসে দাঁড়ায়। দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে তাকায় সে কক্ষমধ্যে। মনিরার ক্ষীণ দেহটার দিকে নজর পড়তেই দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে।

মাকে মনিরার শিয়রে বসে ঝিমুতে দেখে সরে আসে মায়ের পাশে, ধীর শান্ত গলায় ডাকে বনহুর মা! মাগো…..

 মরিয়ম বেগমের তন্দ্রা ছুটে যায়, চোখ মেলেই তিনি আনন্দমিশ্রিত কণ্ঠে অস্ফুট শব্দ করে উঠেন—- মনির, তুই এসেছি।

বনহুর মায়ের পায়ের কাছে বসে পড়ে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে–মা, এসেছি, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। মনিরা কেমন আছে মা?

 ভালো না বাবা? ডাক্তার বলেছে বাঁচবে কিনা সন্দেহ।

বনহুর এবার মায়ের পা ছেড়ে মনিরার পাশে গিয়ে বসে ঝুঁকে দেখতে থাকে মনিরাকে, তারপর ব্যাকুল কণ্ঠে ডাকে–মনিরা….. মনিরা আমি এসেছি….

মরিয়ম বেগম আঁচলে অশ্রু মুছতে থাকেন।

বনহুর বারবার ডাকে-মনিরা… মনিরা

কে জবাব দেবে– মনিরা অজ্ঞান।

হঠাৎ আপন মনেই সে বলে উঠে একবার– মনির…..আমার মনির তুমি.. হারিয়ে গেছো… আর কোনোদিন….তুমি আসবে না… না না….উঃ …. কেন…. কেন তুমি আসবে না… বুকটা আমার ভেংগে … চুরমার …. হয়ে গেছে … আঃ ……….আঃ

বনহুর স্তব্ধ হয়ে শুনছিলো মনিরার জড়িত কথাগুলো। দু’চোখ বেয়ে তার ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ছিলো মনিরার গণ্ডে, কপালে, চুলে।

মরিয়ম বেগম বেরিয়ে পাশের কামরায় চলে যান।

বনহুর মনিরার বোগপাংশু বিবর্ণ গণ্ডে চুমো দিয়ে বারবার ডাকে।

রাত ভোর হয়ে আসে, একসময় জ্ঞান ফিরে আসে মনিরার, চোখ খোলে তাকায় সে।

বনহুর সারাক্ষণ মনিরার মুখের উপর ঝুঁকে ছিলো, ওকে চোখ মেলতে দেখে বনহুরের আনন্দ আর ধরে না, তার নাম ধরে বলে- মনিরা, এই দেখো আমি এসেছি। মনিরা…

মনিরা এত অসুখেও স্বামীর কণ্ঠস্বর চিনতে পারে, চোখ দুটো তার মেলে যায় আপনা আপনি, অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠে– তুমি … এ…….সে….. ছ…

 বনহুর মনিরার হাতখানা মুঠায় চেপে ধরে ঝুঁকে পড়ে মনিরার মুখের উপর মনিরা, আমি এসেছে.. ওর মাথাটা তুলে ধরে বনহুর নিজের বুকের কাছে।

 মনিরার মুখে একটা অপূর্ব আনন্দদীপ্ত ভাবে ফুটে উঠে, কতদিন পর তার কামনার তার সাধনারজনকে নিবিড় করে পেয়েছে। বনহুরের বুকে মাথা রেখে প্রাণভরে নিশ্বাস নেয় মনিরা।

*

রাত ভোর হয়ে আসছে।

বনহুরের মন চঞ্চল হয়ে উঠে। বিদায় চায় সে মনিরার কাছে।

মনিরা জানে, ওকে ধরে রাখলে বিপদের সম্ভাবনা আছে, তাই সে স্বামীকে বিদায় দিলো।

বনহুর কথা দিলো প্রতি রাতে সে আসবে। যেমন করে হোক আসবে সে মনিরার পাশে। মরিয়ম বেগমের কাছে এসে বিদায় চাইলো বনহুর।

মরিয়ম বেগম আপত্তি করলেন।

বনহুর তখন রাতের ঘটনাটা সংক্ষেপে বললো মায়ের কাছে। মা ভাল করে লক্ষ্য করতেই আঁতকে উঠলেন, এতক্ষণ তিনি লক্ষ্য করতেই পারেননি! বনহুরের কাঁধের কাছে জামা ছিঁড়ে মাংশ কেটে রক্ত জমাট বেঁধে আছে, তার কালো পোশাকে রক্তের দাগ তেমনভাবে বুঝা যাচ্ছিলো না।

 মরিয়ম বেগম পত্রের এ অবস্থা দেখে কেঁদে ফেললেন। তিনি বললেন- এ অবস্থায় তোকে আমি ছেড়ে দেবো না মনির।

 মা, তুমি বুঝেও কেন অবুঝ হচ্ছো! জানো, ভোর হবার পূর্বেই পুলিশ এসে চৌধুরীবাড়ি ঘিরে ফেলবে। তোমার ছেলেকে তুমি পারবে পুলিশের হাতে তুলে দিতে? যদি পারো আমাকে ধরে রাখো…..

মরিয়ম বেগম আঁচলে অশ্রু মুছে বিদায় দিলেন– যাও, কিন্তু রোজ একটিবার করে আসবে।

আসবো মা, দোয়া করো।

 বনহুর একবার মনিরার দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে যায়, যে পথে এসেছিলো সেই পথে।

*

আস্তানায় ফিরে আসতেই নূরী ছুটে আসে, বনহুরের অবস্থা দেখে আঁতকে ওঠে সে, চট করে কোনো প্রশ্ন করতে পারে না। বনহুরের কাছে গিয়ে সাবধানে তার গা থেকে জামাটা খুলে ফেলে, কাঁধে চোখ পড়তেই শিউরে উঠে– একি করে হলো?

বনহুর দেয়ালের বড় আয়নাটার দিকে যেতে যেতে বলে—

পুলিশের গুলী, বলো কি হুর?

 হাঁ, সব পরে বলবো।

মনিরা কেমন আছে?

ভাল না।

এলে কেন তবে?

 প্রতিদিন যাবো কথা দিয়ে এসেছি।

নূরী নিজের আঁচল দিয়ে বনহুরের দেহ থেকে রক্তের ধারা মুছে দিতে লাগলো।

বনহুর বড় আয়নাখানার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। নিজের দেহের ক্ষতস্থানে লক্ষ্য করে বললো– একটুর জন্য গুলীটা আমার দেহ স্পর্শ করেছে। এ কিছু না, সেরে যাবে দু’দিনেই।

ক্ষতটা একেবারে সামান্য নয়, নূরী কিন্তু খুব চিন্তিত হয়ে পড়লো। সে জানো, বনহুর কোনোদিনই নিজের দেহের আঘাতকে বড় বলে মনে করে না।

*

পরদিন ডাক্তার এসে মনিরাকে পরীক্ষা করে আনন্দ মিশ্রিত কণ্ঠে বললেন– রোগী আজ অনেক ভাল দেখছি।

ডাক্তারের কথায় বাড়ির সকলে সান্ত্বনা পায়, যাক এবারও তাহলে মনিরা বাচলো। এবার নিয়ে তার কয়েকবার কঠিন অসুখ হলো, সব চেয়ে ডাক্তাররা এবার হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। এক রকম প্রায় আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন তাঁরা।

এরপর থেকে বনহুর পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে রোজ একটিবার করে চৌধুরীবাড়ি আসতো, মনিরার পাশে বসে নিজের হাতে ঔষধ খাওয়াতো, ফলমূল তুলে দিতে ওর মুখে।

ডাক্তাররা রোজ আসতেন, রোগীর হঠাৎ পরিবর্তন লক্ষ্য করে তারা বিস্মিত হলেন। তাদের প্রচেষ্টা সার্থক হয়েছে মনে করলেন।

ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে উঠলো মনিরা, নবজীবন লাভ করলো সে আবার।

দিনগুলো বেশ কেটে চললো, বনহুর বোজ কোনো না কোনো উপায়ে একটিবার মনিরার পাশে ছুটে আসতো। আর মনিরা স্বামীর সান্নিধ্য লাভ করে আনন্দে আত্মহারা হতো।

*

সেদিন পুলিশ কমিশনার তার অফিসে বসে মিঃ আশরাফী, মিঃ হারুন এবং মিঃ শরীফের সঙ্গে দস্যু বনহুরকে নিয়ে আলোচনা করছিলেন। নীলনদে কিভাবে দস্যু বনহুর তাদেরকে নাকানি চুবানি খাইয়ে বিদায় দিয়েছে, কিভাবে বন্দীদের মুক্ত করে নিয়েছে, এসব নিয়েই আলাপ চলছিলো। মিঃ জাফরীর জাহাজ কোথায় উধাও হলো, তারা আজও ফিরে এলেন না কেন, এ নিয়ে গভীর উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। আরও দু’খানা পুলিশ জাহাজ এখনও ফিরে আসেনি, এ নিয়েও পুলিশ মহলে উদ্বিগ্নতার অন্ত ছিলো না।

 হঠাৎ ফোন বেজে উঠে, কমিশনার রিসিভার তুলে নেন হাতে-হ্যালো, স্পিকিং কান্দাই পুলিশ কমিশনার আরিফ চৌধুরী…..।

ওপাশ থেকে ভেসে আসে গম্ভীর কণ্ঠস্বর… আপনার উদ্বিগ্নতার কারণ সেই মিঃ চৌধুরী … মি জাফরী তাঁর দলবলসহ পুলিশ জাহাজে নীলনদে ভালই আছেন…..তবে তারা আমার বন্দী হিসেবে নীলনদে অবস্থান করেছেন..

মুহূর্তে মিঃ আরিফ চৌধুরীর মুখমণ্ডল ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো।

পাশে বসে মিঃ শরীফ এবং অন্যান্য কয়েকজন পুলিশ অফিসার মিঃ আরিফের মুখোভাব লক্ষ্য করে তারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। কে কোথায় হতে ফোন করলো জানার জন্য উন্মুখ হয়ে প্রতীক্ষা করতে লাগলেন তাঁরা।

মিঃ চৌধুরী বলে উঠলেন– কে আপনি? কোথা থেকে বলছেন?…. হ্যালো, কে আপনি,

ওপাশ থেকে ভেসে আসে সেই কণ্ঠস্বর… আমি কে একটু পরেই জানতে পারবেন….. শুনুন….. হ্যালো….

মিঃ চৌধুরী বললেন… বলুন?

…… আপনার প্রিয় অফিসার মিঃ জাফরীও তাঁর সঙ্গীদের মুক্তি কামনা করলে দস্যু বনহুরকে গ্রেফতারের জন্য যা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন, ঐ অর্থ আপনি আমাকে পাঠিয়ে দিন, তাহলে তারা মুক্তি পাবেন…..

… তুমি…… তুমি তাহলে দস্যু বনহুর….

….. হা….. আপনার অনুমান সত্য…. দস্যু বনহুর কথা বলছি…. এবং আপনার বাংলোর ড্রইংরুম থেকে বলছি।

…. আমার ড্রইংরুম থেকে …. কমিশনারের মুখ রক্তাভ হয়ে উঠলো, দস্যু বনহুর আমার বাংলায় … কমিশনারের হাত থেকে রিসিভারখানা পড়ে যাচ্ছিলো। তিনি আবার তুলে নিলেন, শক্ত করে ধরে কিছু বলতে গেলেন কিন্তু পারলেন না।

ওপাশ থেকে সেই কণ্ঠ ভেসে এলো… আপনার বাংলায় যে কোন দিন রাত দুটোয় আসবো, অর্থ মজুত রাখবেন…. গুড বাই….

রিসিভার রাখার শব্দ হলো।

কমিশনার রিসিভার রেখে ঢোক গিলে বললেন– দস্যু বনহুর আমার বাংলো থেকে কথা বললো।

উপস্থিত পুলিশ অফিসারদের মুখে একটা গভীর আতঙ্কের ভাব ছড়িয়ে পড়লো। সবাই উন্মুখ হয়ে উঠলো বনহুর তাকে কি বললো শোনার জন্য।

কমিশনার সব কথা বলে চললেন।

*

বনহুরের মনে পড়লো সেই বৃদ্ধার দেওয়া মোড়কটির কথা। বৃদ্ধা বলেছিলো তিন মাস পর ওটা যেন সে খুলে ফেলে, তার আগে নয়।

বনহুর মোড়কটা বের করে আনলো, সে যত্নসহকারে খুলে ফেললল ওটাকে। মোড়কের মধ্যে রয়েছে একটি সংকেতপূর্ণ চিহ্ন তার নিচে লেখা আছে মাত্র দুটি শব্দ “নীল পাথর”।

বনহুর উবু হয়ে গভীর মনোযোগ সহকারে সংকেতচিহ্ন লক্ষ্য করেছিলো, এমন সময় তার সম্মুখে এসে বিদ্ধ হয় একটি তীরফলক।

বনহুর বিস্ময় নিয়ে চোখ তুলে তাকায়।

[পরবর্তী বই নীল পাথর (২)]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *