নীল আলোর ফুল

নীল আলোর ফুল

ছেলেদুটিকে দেখে মনে হচ্ছে, তারা স্কুলে যাচ্ছে। কেননা, তারা পরেছে স্কুলের ইউনিফর্ম। কালো হাফ প্যান্ট আর সবুজ জামা। জামা প্যান্টের মধ্যে গোঁজা। পায়ে বুট জুতো৷ কয়েকদিন হল কালি ফুরিয়ে যাওয়ায় জুতো পালিশ করা যায়নি। আজ জল-ন্যাকড়া দিয়ে জুতো পরিষ্কার করা হয়েছে। দুটি ছেলেরই চোখে মুখে স্কুল-যাওয়া সুলভ এক ধরনের গাম্ভীর্য রয়েছে। বড়টির মুখে খানিকটা চিন্তার ভাব। হোমটাস্ক করা না হলে অনেক সময় ছেলেদের মুখে এরকম চিন্তার ভাব দেখা যায়। হয়তো এই ছেলেটিরও আজ সেরকম কিছু হয়েছে।

এদের নাম মণি এবং কাঞ্চন। মণির বয়স এগারো। কাঞ্চনের নয়। স্কুল ইউনিফর্ম পরলেও মণি-কাঞ্চন এখন স্কুলে যাচ্ছে না। তারা তাদের বাবার সঙ্গে মামাবাড়ি যাচ্ছে। তাদের বেড়াতে যাওয়ার জন্য আলাদা জামা-প্যান্ট নেই। প্রতি বছর তাদের বাবা দু’সেট করে স্কুল ইউনিফর্ম কিনে দেয়। একবার পুজোয়, একবার পয়লা বৈশাখে। কোথাও যেতে হলে এটাই তারা পরে। এবার শীতে তারা স্কুলের জামা-প্যান্ট পরেই সার্কাস দেখতে গিয়েছিল। আজও পরেছে। মামাবাড়ি যাওয়া একটা আনন্দের ব্যাপার। মুখ গম্ভীর করে থাকার ব্যাপার নয়। তবু এদের মুখ গম্ভীর। কারণ তারা এই প্রথম তাদের মামার বাড়ি চলেছে।

মণি বলল, ‘বাবা, এই গাছটার নাম কী?’

প্রতাপ তাকাল। ঝাপসা গাছটা রাস্তা আগলে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতাপ বেশ অবাক হল। আগে এটা চোখে পড়েনি তো! অবশ্য ঠিক বারো বছর পরে সে এই পথে হাঁটছে। বারো বছর মোটেও কম সময় নয়। প্রতাপ ছেলেদের নিয়ে গাছের তলায় এসে দাঁড়াল। ভাল করে গাছটা দেখল। গাছটা সে চিনতে পারছে না। পাতাগুলো শুরু হয়েছে খানিকটা ওপর থেকে। সে বলল, ‘মণি, লাফ দিয়ে একটা পাতা ছিঁড়তে পারবি?’ বাবার কাছ থেকে লাফানোর নির্দেশ পেয়ে মণি উৎসাহ পেল। সে বলল, ‘বাবা, জুতো খুলে লাফাব?’ প্রতাপ বলল, ‘না, জুতো পরেই লাফাও।’ মণি লাফ দিয়ে গাছের পাতা ছেঁড়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পাতা পর্যন্ত মণির হাত পৌঁছোল না। এগারো বছর বয়স হলেও সে এখনও তেমন লম্বা হয়নি। প্রতাপ বলল, ‘আমি এবার একবার চেষ্টা করে দেখি।’

বাবা এবং দাদাকে লাফাতে দেখে কোনওরকম কারণ না জেনেই কাঞ্চন লাফাতে শুরু করল। তার ডান পায়ের বুট জুতো খুলে ছিটকে পড়ল রাস্তার পাশে।

পাতা হাতে নিয়েও গাছ চিনতে পারল না প্রতাপ৷ সে খানিকটা দুঃখিত গলাতেই বলল, ‘না রে, চিনতে পারছি না।’ মণি গম্ভীর হয়ে বলল, ‘হয়তো এই গাছটার নাম এখনও ঠিক হয়নি।’

প্রতাপ হাঁটতে শুরু করল। বলল, ‘অনেক সময় পাতা দেখে গাছ চেনা যায় না। তখন ফুল দেখে চিনতে হয়। এই গাছটার যখন ফুল হবে তখন দেখে মনে হবে, ইস এত চেনা একটা গাছ!’

কাঞ্চন খুঁড়িয়ে হাঁটছে। খুলে যাওয়া জুতো সে পরেছে কিন্তু ফিতে বাঁধতে পারেনি। জুতো নোংরা হয়ে গেছে। সে বলল, ‘বাবা, এই গাছটার ফুল কখন হবে?’ গাছ চিনতে না পারায় প্রতাপের মনটা একটু খারাপ হয়ে গেছে। সে অন্যমনস্ক হয়ে বলল, ‘জানি না।’ মণি বলল, ‘ফুল যবেই ফুটুক তোর কী? তুই চুপ কর।’ প্রতাপ বলল, ‘ঝগড়া করবে না। আমরা এসে গেছি। সামনের মোড়টা ঘুরলেই পৌঁছে যাব।’ কাঞ্চন বলল, ‘বাবা, আমি ঝগড়া করছি না দাদা করছে।’

প্রতাপ ছেলেদের দিকে তাকাল। সন্তানদের চেহারার অনেক কিছুই মায়ের মতো হয়। জন্মের সময় তারা চোখ, থুতনি বা ঠোঁটের মতো একটা কিছু মায়ের কাছ থেকে চেয়ে নেয়। তার দুই ছেলে অজন্তার কাছ থেকে সেসব কিছুই নেয়নি। নিয়েছে শুধু ঝগড়া করবার স্বভাবটা। তাদের মায়ের মতো ছোটখাটো বিষয় নিয়ে এরা ঝগড়া করতে খুব ভালবাসে। প্রতাপ বলল, ‘ঠিক আছে, তোমরা থামো। আমি চট করে পরীক্ষা করে দেখে নিই তোমাদের সব মনে আছে কিনা। কাঞ্চন, বলো তো মামার বাড়িতে ঢুকে তোমরা প্রথমে কী করবে?’ কাঞ্চন পড়া বলার মতো করে বলল, ‘প্রথমে কী করব? প্রথমে গিয়ে জুতো খুলব।’ মণি হেসে উঠল, ‘হি হি। জুতো খুলব? হি হি। এমা, হল না। জুতো খুলব কী রে বোকা? প্রথমে তো বড়দের প্রণাম করব। তাই না বাবা? আমারটা ঠিক হয়েছে?’ প্রতাপ তাড়াতাড়ি বলল, ‘দু’জনেরটাই ঠিক হয়েছে। এবার বলো তো তোমরা কী কী করবে না।’ মণি তাড়াতাড়ি বলল, ‘ঝগড়া করব না।’ কাঞ্চন বলল, ‘শান্ত হয়ে বসে থাকব। কিন্তু সোফায় পা তুলে বসব না। পা ঝুলিয়ে বসব।’ প্রতাপ হাসল। বলল, ‘ভেরি গুড। আর খাবার সময় কী করবে না মনে আছে?’

মণি মাথা কাত করে বলল, ‘মনে আছে বাবা। বারবার চাইব না। হ্যাংলামি করব না।’

প্রতাপ মণির মাথায় হাত রেখে বলল, ‘হ্যাংলামি নয়, বলো লোভ করবে না। নইলে সবাই ভাববে, তোমরা বাড়িতে ভাল ভাল খাবার খেতে পাও না। সেটা খুব লজ্জার ব্যাপার।’

মণি বাবার দিকে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ভাল খাবার দেবে বাবা?’ কাঞ্চন গম্ভীরভাবে বলল, ‘মাংস তো দেবেই।’ মণি বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে লুচিও দেবে। আমাদের ক্লাসের বাদল মামাবাড়ি গেলেই লুচি মাংস খায়।’ দাদার কথায় কাঞ্চন উৎসাহিত হল। বলল, ‘দই দিলে ভাল হয়। লাল দই।’ প্রতাপ বলল, ‘ছিঃ। কারও বাড়িতে যাওয়ার সময় এরকম ভাবতে নেই। যা দেবে তাই খেতে হয়।’ তারপর নরম গলায় বলল, ‘ঠিক আছে আমি তোমাদের একদিন লুচি মাংস খাওয়াব।’

‘কবে খাওয়াবে?’ কাঞ্চন সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করল।’

‘দেখি, একটা ছুটির দিন দেখে খাওয়াব। এখন খাওয়ার কথা বাদ দাও। মনে রাখবে, তোমরা খেতে যাচ্ছ না। তোমরা যাচ্ছ তোমাদের দিদাকে দেখতে। তোমাদের দিদা খুব অসুস্থ। তিনি হয়তো বেশিদিন বাঁচবেন না। সেইজন্যই তোমাদের সেখানে নিয়ে যাচ্ছি। তোমরা শান্ত হয়ে থাকবে, একদম হইচই করবে না। হাসাহাসিও বেশি করবার দরকার নেই। বেশি হাসাহাসি করলে অসুস্থ মানুষের ক্ষতি হয়।’ মণি গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আমরা কি দিদাকে চিনতে পারব?’ প্রতাপ অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘পারবে।’

‘কী করে পারব? আমরা তো আগে কখনও মামাবাড়ি যাইনি। আমাদের বাড়িতে দিদার কোনও ছবিও নেই।’

বড় ছেলের এই প্রশ্নে প্রতাপ একটু থামল। শান্ত গলায় বলল, ‘কিছু কিছু মানুষ থাকেন যাঁদের আগে না দেখলেও চেনা যায়। দিদাও এরকম একজন মানুষ। যাক এসব কথা। আসল জিনিসটা তোমাদের মনে আছে নিশ্চয়?’ দু’জনেই একসঙ্গে বলল, ‘হ্যাঁ, মনে আছে।’ প্রতাপ বলল, ‘কী বলো তো?’ মণি বলল, ‘আসল জিনিস হল, আমাদের কেউ কিছু দিতে এলে বলব, আমাদের দেবেন না। এই জিনিসটা আমাদের বাড়িতেও আছে।’ কাঞ্চন বলল, ‘ধ্যাত, এটা মোটেই আসল জিনিস নয়। আসল জিনিস হল ওখানে কেউ যদি কবিতা শুনতে চায় তা হলে আমি বাবুদের তালপুকুরে কবিতাটা বলব। বলার আগে দাড়িয়ে উঠে এইভাবে হাতজোড় করে বলতে হবে, নমস্কার, বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের বাবুদের তালপুকুরে। বাবুদের তালপুকুরে হাবুদের ডালকুকুরে সেকি বাস করলে তাড়া—। বাবা, এটাই আসল জিনিস না?’

প্রতাপ খুবই হতাশ হল। এত করে বলে দেওয়া সত্ত্বেও তার ছেলেরা আসল কথাটা ভুলে গেছে। সে বলল, ‘না, এটা আসল জিনিস নয়।’

বুড়ো বয়েসে আর সাতসকালে দুধ খেতে ভাল লাগে না। তবু খেতে হয়। শরীরটাকে রাখার জন্য খেতে হয়। রোগীর বাড়িতে আয়ার কাজ করতে এসে চপ-কাটলেট পাওয়া যায় না। রোগীর ফেলে দেওয়া দুধ, আধখাওয়া ফলমূলেই শরীর রাখতে হয়। কমলা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। যার যেমন কপাল। তার হল ‘ফেলা দুধ-ফলের’ কপাল। সে চোখ বন্ধ করে গলায় দুধটুকু ঢেলে নিল। বারান্দার কোণে গ্লাস নামিয়ে, আঁচল দিয়ে মুখ মুছল, গাল মুছল। এমনকী যেখানে দুধ লেগে থাকার কোনও সম্ভাবনা নেই, সেই কপালও মুছল। মুছে নিশ্চিন্ত হল। তবু ফাটা ঠোঁটের একপাশে দুধ লেগে রইল।

ঘরের ভেতর থেকে প্রতিমাদেবী ডাকলেন, ‘কমলা।’ কমলা বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকোল। বুড়ি আজ সেই ভোরে উঠে পড়েছে। রোগীর ঘুম ভাঙা মানেই আয়ার জ্বালাতন।

প্রতিমাদেবী আজ সত্যিই তাড়াতাড়ি উঠেছেন। কমলাকে দিয়ে জল গরম করিয়ে স্নান করেছেন। চওড়া পাড়ের নতুন একটা শাড়ি ভেঙেছেন। অনেকদিন পরে তিনি নতুন শাড়ি পরলেন। সুন্দর দেখাচ্ছে। তিনি চেয়ার টেনে বসে আছেন জানলার পাশে। তাঁর চোখ বোজা। চারতলার জানলা থেকে সকালের রোদ কিছুটা ঘরের মেঝেতে এসে পড়েছে, কিছুটা পড়েছে তাঁর গায়ে। রোদে একটা শীতশীত ভাব। সকালের দিকে শরীরটা বেশ খারাপ থাকে। বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করে না। আজ ঘুম ভাঙার পর দেখলেন, শরীর ভাল লাগছে। কমলার পায়ের শব্দে চোখ খুললেন প্রতিমাদেবী। বললেন, ‘কমলা, তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।’

কমলা ঘাবড়ে গেল। জরুরি কথা মানে? বুড়ি কি শাড়ির ব্যাপারটা ধরে ফেলেছে? হতে পারে। কাল গভীর রাতে সে ছাদ থেকে বড় বউয়ের একটা শাড়ি সরিয়ে রেখেছে। অন্ধকারে মনে হয়েছিল, জিনিসটা ভাল। হাত দিয়ে বোঝা গেছে, জিনিস ভাল নয়। জমিটা খারাপ। গায়ে দিলে খসখস করবে। মনে হয় না বিন্তি এই শাড়ি পরতে রাজি হবে। কিন্তু শাড়ির ব্যাপারটা তো বুড়ির জানবার কথা নয়! আবার হতেও পারে। মরার সময় যত কাছে এসে যায় মানুষের মধ্যে ভগবান একটা-দুটো করে ইস্পেশাল ক্ষমতা দিয়ে দেন। সেই ক্ষমতা সাধারণ মানুষের থাকে না। এরকম বেশ কয়েকটা কেস কমলা তার আয়া জীবনে দেখেছে। এই মানুষটার মধ্যেও হয়তো সেরকম কিছু হয়েছে।

প্রতিমাদেবী বললেন, ‘কমলা, তুমি নীচে যাও। নীচে গিয়ে রতনের মাকে বলো, আজ ঘর মোছার সময় যেন বালতিতে বেশি করে ফিনাইল ঢেলে নেয়। বউমাকেও একবার আসতে বলবে।’ শাড়ির কথা না ওঠায় কমলা খুশি হল। সে নিজেই শাড়ির কথা তুলল। হাসিমুখে বলল, ‘মাসিমা, এবার কিন্তু আমায় একটা শাড়ি দিতে হবে। এমনি শাড়ি নয়, ভাল শাড়ি৷ বিন্তির আবার শাড়ির ব্যাপারে ভীষণ খুঁতখুঁতানি। প্রিন্ট সাদামাঠা হলে ক্ষতি নেই, কিন্তু জমিটা ভাল হওয়া চাই। জমিতেই নাকি শাড়ির পরিচয়। গরিব ঘরের মেয়ে হলে কী হবে, মেয়ের আমার চয়েস আছে মাসিমা।’ কমলা দাঁত বের করে হাসল। সে পান খায় না, তবু তার দাঁতে হলুদ ছোপ। প্রতিমাদেবী অবাক হয়ে তাকালেন, ‘হঠাৎ শাড়ি দেওয়ার মতো কী হয়েছে?’ কমলা আকাশ থেকে পড়ল। বলল, ‘কী হয়েছে বলছেন মাসিমা! আজ এত ভাল একটা দিন। আপনার নাতিরা আসছে, জামাই আসছে। রান্নাঘরে তো হইচই লেগেছে। বড়দা নিজে এত্ত বাজার নিয়ে ফিরল। বউদি বলল, তুমিও খেয়ে যেয়ো আয়ামাসি। আমার কপালে কি আর সে সুখ আছে যে বসে একটু ভাল-মন্দ খাব? ভাবছি বিন্তিকে পাঠিয়ে দেব। আমার বদলে বিন্তি খেলেই হবে। নেমন্তন্ন বাড়িতে একজন গেলেই হল।’

প্রতিমাদেবী ভুরু কুঁচকোলেন। বউমা রান্নাবান্না শুরু করে দিয়েছে? মেনুর ব্যাপারে তাঁকে একবার জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। বিরক্ত মুখেই তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি কর্তাবাবুকেও একবার খবর দাও।’

কমলা সঙ্গে সঙ্গে গেল না। সে শাড়ির ব্যাপারটা পাকা করতে চায়। বলল, ‘আপনার দুই নাতিকে বড় সুন্দর দেখতে!’ প্রতিমাদেবী অবাক হয়ে বললেন, ‘তুমি কি তাদের দেখেছ কমলা?’

কমলা লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, ‘না, তা দেখিনি, তবে আমি আপনার মেয়ের ছবি দেখেছি। দিদিমণি তো একেবারে রাজকন্যে। বসার ঘরে ফটো আছে না? দিদিমণির গায়ের রং যেন ছবি ছেড়ে গড়িয়ে আসছে। হাত দিলে মনে হয়, খানিকটা বুঝি আঙুলে লেগে গেল। ছেলেরাও নিশ্চয় মায়ের মতো রূপ পেয়েছে। ছেলেরা মায়ের মতোই হয়, মেয়েরা হয় বাপের মতো। আমার বিন্তিরও তাই হয়েছে। বাপের কালো রং পেয়েছে।’ কমলা এমনভাবে বলছে যেন মেয়ের গায়ের কালো রং হওয়ায় সে বেশ গর্বিত।

প্রতিমাদেবী জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন। তিনি মনে মনে খুশি হচ্ছেন। কাল রাতে ঘুমোননার আগে তিনি একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। বহুদিন পরে তিনি এ-বাড়িতে কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেন। স্বামীকে সিদ্ধান্তের কথাটা জানানো দরকার।

কমলা খুশি মনে নীচে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। প্রতিমাদেবী ডাকলেন, ‘কমলা শোনো।’ কমলা হাসিমুখেই ঘুরে দাঁড়াল। প্রতিমাদেবী মুখ না ফিরিয়ে বললেন, ‘কমলা, এরপর থেকে দুধ খেতে হলে নিজের গেলাসে ঢেলে খাবে। আমাকে দেওয়ার আগেই ঢেলে নেবে৷ আমার গেলাসে মুখ দেবে না।’

একতলায় নামতে নামতে কমলা নিশ্চিন্ত হল। আর বেশিদিন নয়, এ-বুড়ির দিন ফুরিয়ে এসেছে। ভগবান একে ইস্পেশাল ক্ষমতা দিতে শুরু করেছেন। এখন এ এমন অনেক কিছু করতে পারবে যা সাধারণ মানুষ শত চেষ্টা করলেও পারবে না। নইলে দুধের ব্যাপারটা বুড়ি জানতে পারল কী করে?

এ-বাড়ির রাঁধুনির নাম বলরাম। তার মুখ সবসময়ই হাসিহাসি। হাসিহাসি মুখের সঙ্গে একটা নিশ্চিন্ত ভাব। হাসি এবং নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে সে অনায়াসে খুব খারাপ রান্না করে। তবে আজ বলরামের মুখ গম্ভীর। মুখ গম্ভীর হয়ে যাওয়ারই কথা। আজ তাকে রান্নার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই দায়িত্ব আজ নিয়েছে বাড়ির বউ তপতী। কুটননা কুটে বাটনা বেটে তপতীকে সাহায্য করবার কাজও বলরাম পায়নি। সে কাজ করছে রতনের মা। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, বলরামের কপালে আজ আরও অপমান জুটেছে। রান্নার বদলে তাকে দেওয়া হয়েছে ঘর ঝাঁড়পোছের কাজ। বাড়ির কর্তা রমাকান্তবাবু নিজে দাড়িয়ে সেই কাজের তদারকি করছেন। একতলার বসার ঘর এবং সিঁড়ির ঝুল পরিষ্কারের পর এখন দোতলায় হাত দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণের ঘরের তালা খুলে দিয়ে রমাকান্তবাবু বললেন, ‘এ-ঘরটা স্পেশাল করে করতে হবে বলরাম। তুই আর একটা ঝাঁটা নিয়ে আয় তো, আমিও হাত লাগাই।’ বলরাম গম্ভীরমুখে বলল, ‘আপনের হাত লাগানোর দরকার নাই। আমার হাতই যথেষ্ট।’ রমাকান্তবাবু বললেন, ‘না, যথেষ্ট নয়। আমি ওপরটা দেখছি, তুই হামাগুড়ি দিয়ে খাটের তলায় ঢুকে যা দেখি।’ বলরাম অবাক হয়ে বলল, ‘খাটের তলায় ঢোকার কী আছে?’ রমাকান্তবাবু বললেন, ‘যা বলছি তাই কর। মনে রাখবি আজ এ-বাড়িতে দুটো ছোট ছেলে আসছে। খাটের তলা হল ঘোট ছেলেপিলেদের ফেভারিট জায়গা। যে-কোনও সময় তারা সেখানে ঢুকে পড়ে। সুতরাং তারা যে-ঘরে থাকবে সে-ঘরে খাটের তলাটাই হল আসল। তুই খেয়াল রাখবি এক চিলতে ধুলো যেন না থাকে। মামার বাড়িতে প্রথমদিন এসে যদি ছেলেরা ধুলোর মধ্যে পড়ে সেটা খুবই খারাপ হবে।’ বলরাম মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘কর্তাবাবু, আমি খাটের তলায় ঢুকতে পারব না। আমার কোমরে ব্যথা। পূর্ণিমা-অমাবস্যায় টান মারে।’ মিথ্যে বলার সময় বলরাম মুখ ঘুরিয়ে নেয়। রমাকান্তবাবু গম্ভীরমুখে বললেন, ‘ঠিক আছে তোমাকে খাটের তলায় ঢুকতে হবে না। আমিই ঢুকছি। তুমি ওপরটা দ্যাখো। সাবধানে দেখবে। মনে রাখবে এটা ছিল আমার মেয়ের ঘর। জামাই নাতিরা এসে এ-ঘরেই বসবে। দে ফুলঝাড়ুটা আমায় দে তো।’

এতক্ষণ বাদে বলরাম খানিক উৎসাহ পেয়েছে। হেড অফ ফ্যামিলি যখন খাটের তলায় ঢুকে ঝুল ঝাড়ছে তখন তার পক্ষে ঘর মোছা খুব একটা অসম্মানের ডিউটি হয়নি। বলরামের মুখে হাসি ফুটল। সে বলল, ‘ঠিক আছে কর্তাবাবু, চিন্তার কিছু নাই। ঝাঁটা নিয়ে আমি এই দাঁড়ায়ে রইলাম। আপনে সাবধানে ঢুকে পড়েন। কপালটা একটু খেয়াল রাখেন। টাক না খায়েন।’

খানিক পরে কমলা এসে খবর দিল, রমাকান্তবাবুর ওপরে ডাক পড়েছে। রমাকান্তবাবু হামাগুড়ি দিয়ে খাটের তলা থেকে বেরিয়ে এলেন। তাঁর সারা গায়ে ঝুল, মাথায় মাকড়শার জাল।

কমলা মারাত্মক ভয় পেয়ে গেছে। আজ এ-বাড়ির হল কী? সবাই কি পাগল হয়ে গেল নাকি? মরণাপন্ন রোগী ভোরবেলা স্নান সেরে নতুন শাড়ি পরে নিচ্ছে, বাড়ির বউ রান্নাঘরে হইচই লাগিয়েছে, কর্তা নিজে খাটের তলায় ঢুকে ঝাঁট দিচ্ছে! হল কী? এ-বাড়িতে আজ বেশিক্ষণ থাকাটা ঠিক হবে বলে মনে হচ্ছে না। না বাবা, বিন্তিকে খেতে পাঠিয়ে কাজ নেই।

রোদ খানিকটা সরে গেছে। কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত রোদ ছিল প্রতিমাদেবীর গায়ে, এখন শুধু পায়ের পাতা ছুঁয়ে আছে।

রমাকান্তবাবু ঘরে ঢুকে বললেন, ‘কী হল, শরীর খারাপ লাগছে নাকি?’ প্রতিমাদেবী স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘চেয়ারটা নিয়ে এদিকে একটু বসো।’ তারপর পিঠের নীচে বালিশ দিয়ে আধশোয়া অবস্থাতে বসলেন। শান্ত গলায় বললেন, ‘একটু পরেই ব্যাঙ্ক খুলবে। তুমি ব্যাঙ্কে যাবে। লকার থেকে সমস্ত গয়না তুলবে। গাড়ি তুমি চালাবে না। মুকুলকে বলবে, সে যেন তোমায় নিয়ে যায়। তার একদিন অফিস দেরি করে গেলে কিছু ক্ষতি হবে না।’ গয়না তোলার কথায় রমাকান্তবাবু অবাক হলেন। বললেন, ‘আজ আবার গয়না দিয়ে কী দরকার?’ প্রতিমাদেবী চোখ বুজে বললেন, ‘দরকার আছে। আমি ঠিক করেছি গয়নাগুলো মণি-কাঞ্চনকে দিয়ে দেব। আর সেটা আজই দিতে হবে। আর সুযোগ পাব বলে মনে হচ্ছে না।’

রমাকান্তবাবু চমকে উঠলেন। তিনি যেন তাঁর স্ত্রীর পুরনো গলা শুনতে পেলেন! জেদের গলা।

‘প্রতিমা, তুমি নিশ্চয় ভেবে-চিন্তে কথাটা বলছ?’

প্রতিমাদেবী স্বামীর দিকে ফিরে তাকালেন। একটু হেসে বললেন, ‘এতে ভাবার কী আছে? বকুলের গয়না তার ছেলেদের দিয়ে দেব এতে ভাববার কী আছে? আমি তো অনেকদিন ধরেই ভেবে রেখেছি। যখনই ওগুলো দেখি, তখনই ভাবি কবে জিনিসগুলো ওদের হাতে তুলে দেব। কাল রাতে শুধু ঠিক করেছি, শুধু বকুলেরটা নয়, আমারগুলোও দিয়ে দেব। তাও ওরা আসছে শোনবার পর ঠিক করলাম। কেন বলো তো, তোমার আপত্তি আছে নাকি?’

রমাকান্তবাবু শান্ত গলায় বললেন, আমার আপত্তি নেই, তবে অন্যদের নেই বলি কী করে? গয়না তো শুধু তোমার মেয়ের নয়। তোমার ছেলে, তোমার পুত্রবধূ, এরাও তো আছে। তপতী তো মাত্র ক’দিন হল বউ হয়ে এ-বাড়িতে এসেছে। মুখে হয়তো কিছু বলবে না, কিন্তু মনে মনে তো আপত্তি করবে। সে তো আর বকুলকে চেনে না। অদেখা ননদের জন্য সে এতটা স্যাকরিফাইস করবে ভাবছ কেন? বকুলের গয়না তার ছেলেরা নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু তোমারগুলো? সে তো সবার প্রাপ্য।’ প্রতিমাদেবী মুখ ফিরিয়ে কড়া গলায় বললেন, ‘তুমি যে একেবারে সম্পত্তি ভাগ করতে বলে। আমি জানি, কেউই কিছু বলবে না। আর আমার জিনিস আমি কাকে কোনটা দেব তা নিয়ে আপত্তি অন্যরা করবে কেন? করলে শুনবই বা কেন?’

রমাকান্তবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আর যদি প্রতাপ আপত্তি করে? যে এ-বাড়িতে বারো বছর ঢোকেনি সে একদিন এসেই ব্যাগ বোঝাই করে এক লক্ষ টাকার গয়না নিয়ে ফিরে যাবে ভেবেছ?’

প্রতিমাদেবীর চোখ জ্বলে উঠল। তিনি স্বামীর চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ঢোকেনি নয়, ঢুকতে পারেনি। আমি ঢুকতে দিইনি।’

রমাকান্তবাবু শান্ত গলায় বললেন, ‘এটা ঠিক নয় প্রতিমা। তুমিও জানো, এটা ঠিক নয়। বিয়ের এক বছর কাটতে-না কাটতে আমরা মত বদলেছিলাম। তুমি নিজে ওদের আগরপাড়ার বাড়িতে গিয়েছিলে। আর কীভাবে বোঝাতে পারতাম যে ওদের বিয়ে আমরা মেনে নিয়েছি? তোমার মেয়ে সেদিন আমাদের কথা শোনেনি। যাক, তুমি মিছিমিছি এখনও এসব ভেবে কষ্ট পাচ্ছ। শরীরের এই অবস্থায় তোমার কোনওরকম উত্তেজনা ঠিক নয়। আজ একটা ভাল দিন, রাগারাগি করে দিনটাকে নষ্ট না করাই ভাল। আমি লকার থেকে গয়না তুলে আনছি। তুমি বরং আর একটু ভেবে দ্যাখো। সময় তো আছে।’

প্রতিমাদেবী অল্প হাসলেন। বললেন, ‘আমার ভাবা হয়ে গেছে, তোমায় আর কিছু ভাবতে হবে না। তুমি বউমাকে একবার পাঠিয়ে দাও, আমি তাকে বুঝিয়ে বলব। আর শোনো, তুমি নাকি বকুলের ঘর খুলে পরিষ্কার করছ?’

‘হ্যাঁ, প্রতাপ এসে ও ঘরেই বসুক।’

‘না, বকুলের ঘর খোলার দরকার নেই। তুমি গেস্টরুমে প্রতাপের থাকার ব্যবস্থা করো।’

ট্যাংরা মাছ কেনা সহজ কাজ নয়। অনেক দেখে শুনে কিনতে হয়। পেটে ডিম থাকলে সেই ট্যাংরার স্বাদ কমে যায়। আবার ডিম ছাড়া ট্যাংরায় মজা নেই। পাতের একদিকে ডিম পড়ে থাকতে হবে। সুতরাং মাছ কিনতে হয় এমন যাতে ডিমও থাকবে আবার স্বাদও নষ্ট হবে না। তাই বড় ট্যাংরার দিকে না ঝুঁকে নজর মেজ সাইজের মাছে দেওয়াই ভাল। খেয়াল রাখতে হবে রংটা যেন একটু কালো সাদা মেশানো হয়।

এতসব বিচার করে মুকুল আজ ট্যাংরা মাছ কিনেছে। বাজার থেকে ফেরার পথে তার মনে পড়ল, দিদি ট্যাংরা ভালবাসত। ধেড়ে বয়েসেও পাতে ট্যাংরা পেলে লাফিয়ে উঠত। একবার কাঁটা আটকে সে কী কেলেঙ্কারি। আশ্চর্য, খুবই আশ্চর্য। যে-মানুষটা নেই, যে-মানুষটা মরে গেছে তার কথা ভেবে সে আজ বাজার করল! মুকুলের মনটা খারাপ হয়ে গেল।

বাড়ি ফিরে দেখল ঘরে বসে আছে তপতী। থমথমে মুখে টিভি দেখছে। এলোমেলো রিমোট টিপে চ্যানেল বদলাচ্ছে ঘনঘন। নিশ্চয় কিছু ঘটেছে। মুকুল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হল তোমার? রান্না হয়ে গেছে?’ তপতী উত্তর দিল না। মুকুল কাছে গিয়ে গায়ে হাত দিয়ে বলল, ‘মাথাটাথা ধরল নাকি? রান্না করবে না? আরে হলটা কী বলবে তো।’ তপতী ঝটকা দিয়ে কাঁধ থেকে স্বামীর হাত সরিয়ে দিল। রাগে হিসহিসিয়ে উঠল। চাপা গলায় বলল, ‘কী হল সেটা তোমার মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো। উফ, মরতে বসেও যে মানুষ এত ফন্দি করতে পারে তা আমার জানা ছিল না।’

মুকুল উঠে গিয়ে দরজা ভেজিয়ে দিল। আজ এসব কথা বাড়ির আর কারও না শোনাই ভাল।

‘দরজা ভেজিয়ে আর কী হবে? তোমাদের বাড়ির কেলেঙ্কারি কোন লোকের জানতে বাকি আছে?’

‘আঃ তপতী আস্তে।’

তপতী গলা তুলে বলল, ‘কেন আস্তে কেন? নিজে পছন্দ করে গরিব ছেলেকে বিয়ে করার অপরাধে বাড়ির মেয়েকে যখন তোমার মা তাড়িয়ে দিয়েছিলেন তখন বুঝি আস্তে কথা বলেছিলেন? ফিসফিস করে বলেছিলেন বুঝি, বেরিয়ে যাও বাছা, লক্ষ্মী মা আমার?’

মুকুল বিরক্ত হল। বলল, ‘তোমাকে তো বলেছি তপতী, মা দিদিকে তাড়িয়ে দেয়নি। তবে বিয়েটা মেনে নিতে পারেনি। বিয়ের এক বছর যেতে-না-যেতে মা আগরপাড়ায় দিদির কাছে নিজে গিয়েছিল। ওদের অনেক দোষ ছিল। ছোট ছেলেটা হতে গিয়ে দিদির যখন ওই অবস্থা তখন জামাইবাবুর উচিত ছিল আমাদের জানানো। খরচাপাতি করে চিকিৎসা করলে দিদি হয়তো সেদিন বেঁচে যেত। কাজটা ভয়ংকর অন্যায় হয়েছে।’

তপতী মুখ বেঁকিয়ে বলল, ‘কেন, তোমার মা ভিক্ষে দিত?’

মুকুল একটা সিগারেট ধরাল। বলল, ‘মেয়ের ভালভাবে চিকিৎসার খরচ দেওয়াটা ভিক্ষে দেওয়া নয়। আর এতদিন বাদে তুমি এই প্রসঙ্গগুলো তুলছ কেন? আর বেছে বেছে আজকেই? তোমাকে তো বলেছি, মায়ের ধারণা ছিল, দিদির অনেক ভাল বিয়ে হতে পারত। মা দিদির জন্য সম্বন্ধ দেখাও শুরু করেছিল। মেয়ের ভাল বিয়ে দেবার ইচ্ছে সব মায়েরই থাকে। তবে মায়ের জেদটা একটু বাড়াবাড়ি রকমের বেশি। পরে মা ভুলটা বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু তখন আর ভুল সংশোধনের চান্স ছিল না। সেই সুযোগ ওরাই দেয়নি।’

তপতী সোফা থেকে উঠে পড়ল। টিভি বন্ধ করল। তার ঠোঁটে ব্যঙ্গের হাসি। বলল, ‘আর সেইজন্য আজ লক্ষ টাকার গয়না দিয়ে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইছে।’

‘গয়না!’

তপতী মুকুলের দিকে তাকিয়ে বলল ‘কেন তুমি জানো না? বাড়ির সব গয়না তোমার মা আজ নাতিদের দিয়ে দেবে ঠিক করেছে। দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলবে। আত্মীয়স্বজনকে ডেকে বলবে, দ্যাখো আমি কোনও অন্যায় করিনি।’

মুকুল অবাক হল। মা এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে! কই সে তো কিছু জানে না!

এমন সময় দরজা ফাঁক করে হাসিহাসি মুখে বলরাম বলল, ‘বউদিমণি, ডালে মনে হচ্ছে ধরা লেগেছে।’

তবতী বলল, ‘সেকী! তুমি গ্যাসটা কমিয়ে দিলে না?’

বলরাম আরও বেশি করে হাসল। বলল, ‘এটা কেমন করে হয় বউদি? আপনি রান্না করছেন, গ্যাসের কমা-বাড়া আমি কেমন করে ঠিক করি?’

তপতী বলরামকে ঠেলে বেরিয়ে পড়ল। সত্যি সারাবাড়িতে একটা পোড়া গন্ধ।

ডাল পোড়ার ঘটনায় হাসার অপরাধে বলরামকে তপতী শাস্তি দিয়েছে। তাকে মোট সাতবার বাজারে পাঠানো হয়েছে।

এবার সে গিয়েছিল গয়না বড়ি আনতে।

ব্যাজার মুখে বড়ি কিনে ফেরার পথে সে বড় অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখতে পায়। তাদের গলির ঠিক মুখটায় একটা ধেড়ে লোক দুটো ছোট ছেলেকে নিয়ে গাছের তলায় লাফাচ্ছে! বলরামের সন্দেহ হয়। সে নানা সময় কানাঘুষোয় শুনেছে, এ-বাড়ির জামাইয়ের মাথায় নাকি অল্প গোলমাল আছে। এই ধেড়ে লোকটা জামাইবাবু নয় তো? হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। দিনের বেলা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে পাগল ছাড়া আর কে লাফাবে? সঙ্গে আবার ঠিক দুটো ছেলেই আছে। বলরাম ফুট দশেক দূরে দাঁড়িয়ে পড়ে এবং ওয়াচ করতে থাকে। সমস্যা একটাই, পাগলটার পোশাকে একটা ভিখিরি ভাব আছে। ছেলেদুটোও যা পরে আছে তাও ঠিক মামাবাড়ি বেড়াতে আসার জিনিস নয়। মনে হচ্ছে, স্কুলে যাচ্ছে। তবু বলরাম ঝুঁকি নিল না। সে সরল না। লাফানো শেষ করে লোকটা বাচ্চাদের নিয়ে হাঁটতে শুরু করলে বলরাম তাদের পিছু নিল। খানিক এগিয়ে তিনজনে ঠিক এই বাড়ির গেটের সামনে এসেই থামল। আর তখনই বলরাম লাফ দিয়ে তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। বড় করে হেসে বলে, ‘আসেন জামাইবাবু, এসো বাছারা। আমার নাম বলরাম। এবাড়ির কুক। কুক মানে জানো তো? রাঁধুনি।’

লোকটার হাবভাব দেখে মণি-কাঞ্চনের ভীষণ হাসি পাচ্ছে। কিন্তু বাবার বারণ থাকায় হাসতে পারছে না। চোখ সরিয়ে এবার তারা তাদের মামাবাড়ির দিকে তাকাল। বাপ রে কত উঁচু পাঁচিল! পাঁচিলের ওদিকে হলুদ রঙের বাড়ি। সামনে একটা বড় গেট। সেই দরজার পেটে আবার ছোট আর একটা দরজা! খুব বড়লোকদের বাড়িতে বুঝি দুটো করে দরজা থাকে? ভারী মজার তো!

বলরাম থামেনি। সে বকেই চলেছে। ‘হাঙ্গামা কম হল নাকি? সকাল থেকে এক হাতে ঝাড়পোঁচ তো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। আমি রান্নার লোক ঠিকই, কিন্তু আজ হল স্পেশাল ডিউটি। এই তো দেখেন না বড়ি কিনে আনলাম। গয়না বড়ি। দাঁড়িয়ে আছেন কেন জামাইবাবু? ঢুকে আসুন। দাদা বাজার এনেছে, বউদি নিজে রান্না করছে। বউদিমণির রান্নার হাতটা ভারী চমৎকার। ডালটা একটু ধরে গেছে বটে…।’

মণিকাঞ্চন আর পারল না। তারা হেসে ফেলল।

প্রতাপ বলল, ‘শোনো বলরাম ভাই, আমি এখন আর যাব না। আজ আমার অনেক কাজ, যেতেই হবে। তুমি বরং এদের নিয়ে ঢুকে যাও।’ বলরাম গম্ভীরভাবে বলল, ‘তা ঠিক, কাজ আগে। কাজ ফেলে তো কিছু নয়। আপনি কোনও চিন্তা করবেন না। ছেলেদের আমি সোজা কর্তামার কাছে নিয়ে যাচ্ছি।’ তার বলার ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে, গেট পর্যন্ত এসেও প্রতাপের চলে যাওয়াটা যেন অস্বাভাবিক কোনও ব্যাপার নয়। প্রতাপ এবার ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি তা হলে চলি মণি-কাঞ্চন? তোমরা দাদু-দিদাকে বলে দিয়ে, আমি বিকেলবেলা এসে তোমাদের নিয়ে যাব। তখন তোমাদের দিদার সঙ্গেও দেখা করে নেব।’

কাঞ্চন বলল, ‘বাবা, ভয় করছে।’

প্রতাপ হেসে বলল, ‘দুর বোকা, ভয় করবে কেন? মামাবাড়িতে কারও ভয় করে?’

মণি আমতা আমতা করে বলল, ‘না, করে না। কিন্তু কী করব বাবা, আমাদের যে করছে?’

কাল রাত থেকেই প্রতিমাদেবীর মধ্যে একটা অস্থির ভাব। যত সময় যাচ্ছে ভাবটা তত বাড়ছে। বাড়াটাই স্বাভাবিক। তিনি বেশিক্ষণ শুয়ে বসে থাকতে পারছেন না। যেমন এখন জানলার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। শরীরটা দুর্বল কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। বরং ভাল লাগছে। আকাশ ঝকঝক করছে। শীত পড়তে আর দেরি নেই। গরম ভাবটা কম। সকাল থেকে মরা মেয়েটার কথা বারবার মনে পড়ছে৷ এতক্ষণ মনে হচ্ছিল বকুল যেন খাটের ওপর মুখোমুখি বসে আছে। এখন মনে হচ্ছে, পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কোনও কথা বলছে না, শুধু মিটিমিটি হাসছে হারামজাদি। প্রতিমাদেবীর চোখ ফেটে জল আসছে। তিনি অনেক কষ্টে সেই জল আটকে রেখেছেন। আজ আর তিনি হারতে চান না। বারো বছর পর তিনি জিততে চান।

রমাকান্তবাবু নিঃশব্দে ঘরে ঢুকলেন। তাঁর হাতে গয়নার বাক্স। বললেন, ‘নাও, এগুলো তুলে রাখো।’ প্রতিমাদেবী চমকে ফিরে তাকালেন। রমাকান্তবাবু বললেন, মণি-কাঞ্চন এসেছে। তপতী এখনই ওদের ওপরে নিয়ে আসছে। তুমি বসো।’

ওরা এসেছে? সত্যি এসেছে? প্রতিমাদেবীর বুকটা ধক করে উঠল। তিনি অস্ফুটে বললেন, ‘ওদের আসতে বলো। প্রতাপকে তুমি নিজে গিয়ে নিয়ে এসো। তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? মুকুল কোথায়? সে আজ অফিসে যায়নি তো? তপতী কী করছে?’

‘তুমি শান্ত হও প্রতিমা। প্রতাপ আসেনি।’

প্রতিমাদেবী থমকে গেলেন। বললেন, ‘প্রতাপ আসেনি। কেন আসেনি কেন?’

‘গেট পর্যন্ত ছেলেদের পৌঁছে চলে গেছে। শুনলাম বলরামকে বলে গেছে। যাক ছাড়ো তো ওর কথা। আমরা তো আর নতুন দেখছি না। বারো বছর ধরেই তো ওর গোঁয়ারতুমি দেখলাম।’

প্রতিমাদেবী আবার জানলার দিকে ফিরে তাকালেন। তা হলে কি তিনি হেরে গেলেন? হারামজাদির কাছে জেতা হল না এবারও?’

তপতী ডাকল, ‘মা।’

প্রতিমাদেবী মুখ ঘুরিয়ে দেখলেন, দুটো ফুটফুটে ছেলে তাঁর ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। বড় বড় চোখে তারা তাকিয়ে আছে। সেই চোখে ভয়।

যে-জল প্রতিমাদেবী এতক্ষণ কষ্ট করে আটকে রেখেছিলেন এখন দু’চোখ ভরে তা উপচে পড়ল। প্রতিমাদেবী সেই জল না মুছেই হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘এসো। কাছে এসো সোনা আমার।’

মণি-কাঞ্চনের আগরপাড়ার ভাড়া বাড়িতেও ছাদ আছে। তবে সেই ছাদ ছোট। খুবই ছোট। ছোট ছাদে ঝপ করে সন্ধে হয়ে যায়। বড় ছাদের মজা হল, বিকেল সহজে শেষ হতে চায় না, অনেকক্ষণ আলো থাকে। এই ছাদেও আছে।

ছাদের একদিকে ইট পেতে উইকেট হয়েছে। দুপুরে ছোট ভাগনে বলের খোঁজ করায় মুকুল গাড়ি চালিয়ে ব্যাট বল কিনে এনেছে। উইকেটের সামনে মণি সেই ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে আছে। বল করছে মুকুল। ছোটাছুটি করে বল কুড়োবার দায়িত্ব পেয়েছে বলরাম। উইকেটকিপার কাঞ্চন। তার চোখে মুখে বিরক্তি। বিরক্তি থাকাই স্বাভাবিক। এইমাত্র দাদার তোলা লোপ্পা একটা ক্যাচ হাত থেকে ফেলে দিয়েছে বলরামকাকু! শুধু ফেলে দিয়েছে না, ফেলে দিয়ে দাঁত বের করে হাসছেও। কাঞ্চন গম্ভীর গলায় বলল, ‘বলরামকাকু, তুমি হাসছ কেন? এর আগেও তো তুমি একখানা ক্যাচ ফেলে দিলে। তখনও দেখলাম হাসছ। তুমি জানো না, ক্যাচ পড়ে গেলে হাসতে নেই? তুমি বাদ। আমি মামিমাকে টিমে নেব। মামিমা, তুমি চলে এসো তো।’

তপতী একটু দূরে পাঁচিলের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে অবাক হয়ে বলল, ‘আমি! না না আমি নই। আমি বাবা খেলতে টেলতে পারব না।’ মুকুল হাসতে হাসতে বলল, ‘আহা, এসো না। ক্যাপ্টেন বললে তো মাঠে নামতেই হবে। এসো এসো।’

কাঞ্চন এক ছুটে তপতীর কাছে গেল। তাকে হাত ধরে টানতে লাগল। তপতী হাসছে। সে খুবই লজ্জা পেয়ে গেছে। সে বাড়ির বউ। বাড়ির বউ শ্বশুরবাড়িতে অনেক কিছু করতে পারে, কিন্তু ছাদে ক্রিকেট খেলতে পারে কি?

লজ্জায় গাল লাল করে তপতী কোমরে আঁচল জড়িয়ে খেলতে নেমে পড়ল।

ছাদের একপাশে রমাকান্তবাবু আর প্রতিমাদেবী চেয়ার নিয়ে বসে আছেন। রমাকান্তবাবুর হাতে বিকেলের চায়ের কাপ। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে প্রতিমাদেবী চা খান না। ভাল লাগে না। তবু তিনি আজ চা খাচ্ছেন। খেতে ভালই লাগছে। তিনি মুগ্ধ চোখে এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখেছেন। দু’চোখ ভরে দেখেছেন। তাঁর বারবার সন্দেহ হচ্ছে, এসব সত্যি তো? স্বামীকে একবার জিজ্ঞেস করবেন? থাক, দরকার নেই। সে যদি না বলে সেটা বড় দুঃখের হবে।

রমাকান্তবাবু বললেন, ‘মণিকে অনেকটা বকুলের মতো দেখতে হয়েছে। হাসলে মনে হচ্ছে, বকুল হাসছে।’

প্রতিমাদেবী অবাক হলেন। তাই নাকি? এতক্ষণ তো তাঁর মনে হচ্ছিল, ছোটটাই মায়ের মতো হয়েছে। চিবুকের কাছটা একেবারে বসানো বকুল। রমাকান্তবাবু বললেন, ‘ভাবছি ছেলেদুটোকে আমাদের কাছেই রেখে দেব।’

প্রতিমাদেবী চমকে উঠলেন। তিনি স্বামীর দিকে তাকালেন। বললেন, ‘মানে?’

রমাকান্তবাবু বললেন, ‘এর আবার মানে কী? ওরা এখানেই থাকবে। ভাল স্কুলে ভরতি করে দেব। মামাবাড়িতে থেকে কেউ পড়াশুনো করে না? অনেকেই করে।’

প্রতিমাদেবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘প্রতাপ রাজি হবে না।’

রমাকান্তবাবু রেগে গেলেন। বললেন, ‘কেন? নাতিদের ওপর আমাদের কোনও দাবি নেই নাকি? তা ছাড়া ওর কথা শুনতে হবে কেন? অনেক শুনেছি। আর নয়। ছেলেদের ভাল জামা কিনে দেবার মুরোদ নেই, শুধু বড় বড় কথা…।’

কথা শেষ হওয়ার আগেই ছাতে একটা হইচই হল। কাঞ্চন দু’হাত তুলে লাফাতে লাফাতে গিয়ে বউমাকে জড়িয়ে ধরল! মুকুলও হাততালি দিচ্ছে। আরে, বলরামটাও তিড়িং বিড়িং করছে যে! সকলে হাসছে আর চিৎকার করছে।।

রমাকান্তবাবু কথা থামিয়ে হাততালি দিয়ে উঠলেন। হাসতে হাসতে বললেন, ‘হা হা। কাণ্ডটা দেখলে প্রতিমা? অ্যাঁ দেখলে কাণ্ডটা? তপতী ক্যাচ ধরে মণিকে আউট করে দিল! অ্যাঁ! বউমা তো খেলাধুলোয় ওস্তাদ দেখছি! হা হা…।’

এমন সময় রতনের মা একতলা থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে এসে বলল, ‘একটা লোক এসেছে। বলছে, মণি-কাঞ্চনকে নিয়ে যাবে। লোকটা চিমসেপানা আর গায়ের রংটা কালা।’

প্রতিমাদেবী চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললেন, ‘ছিঃ রতনের মা, ওরকমভাবে বলছ কেন? উনি এবাড়ির জামাই।’

প্রতিমাদেবীর ঘরেই ব্যবস্থা হয়েছে।

সোফার ওপর মণি-কাঞ্চন পা তুলেই বসেছে। একতলা থেকে নিচু একটা টেবিল এনে দিয়েছে বলরাম। সেই টেবিলে প্লেট রেখে দু’জনে মন দিয়ে খাচ্ছে। তপতী গরম লুচি ভেজে এনেছে। লুচির সঙ্গে আলুভাজা।

প্রতাপ ওপরে এসে শাশুড়িকে প্রণাম করে গেছে। ওপরে যতটা সময় ছিল ততটা সময়ই সে ছিল মাথা নিচু করে। তাকে খেতে দেওয়া হয়েছে নীচে। সেখানে রমাকান্তবাবু এবং মুকুল আছে। একটু আগেই রমাকান্তবাবু জামাইয়ের কাছে হালকাভাবে মণি-কাঞ্চনকে রেখে দেওয়ার প্রস্তাব তুলেছিলেন।

প্রতাপ মাথা নিচু করেই বলেছে, ‘ওরা কি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে? মনে হয় না পারবে।’

এরপর রমাকান্তবাবু চুপ করে যান। তিনি আর এ প্রসঙ্গ নিয়ে এগিয়ে যেতে সাহস পাননি৷ সত্যি কথা বলতে কী তিনি যেন জামাইয়ের সঙ্গে বেশি কথা বলতেই সাহস পাচ্ছেন না।

প্রতিমাদেবী সামনে বসে নাতিদের খাওয়া দেখছেন। সকালে যে আড়ষ্টতা ছিল দিনের শেষে ছেলেদুটির তা অনেকটা কেটে গেছে মনে হয়। প্রতিমাদেবী সহজ হওয়ার জন্য বললেন, ‘মণি, তোমরা স্কুল থেকে ফিরে এসে জলখাবার খাও তো?’

মণি বলল, ‘হ্যাঁ, খাই।’ প্রতিমাদেবী আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন ‘কে দেয়?’

মণি লুচি ছিঁড়তে ছিড়তে বলল, ‘কে আবার দেবে? বাবা দেয়। অফিস যাওয়ার আগে বাবা সব করে যায়।’

পাশে বসা তপতী বলল, ‘ও। কী খাও? পাউরুটি?’

কাঞ্চন মণির দিকে তাকাল। তারপর মাথা নামিয়ে গম্ভীরভাবে বলল, ‘না, বেশিরভাগ দিনই আমরা লুচি মাংস খাই।’

প্রতিমাদেবী তপতীর মুখের দিকে তাকালেন।।

তপতী বলল, ‘এখন মাংস খাবে?’

কাঞ্চন বড় করে ঘাড় নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, খাব।’

তপতী মাংস আনতে উঠে গেল।

প্রতিমাদেবী বললেন, ‘তোমরা আর কিছু নেবে?’

মণি বলল, ‘দই আছে? থাকলে দই দিতে পারো।’

কাঞ্চন শাসনের ভঙ্গিতে বলল, ‘দাদা। বাবাকে বলে দেব কিন্তু।’

মণি বলল, ‘কী বলবি?’ কাঞ্চন বলল, ‘কী বলব? বলব, তুমি বারণ করা সত্ত্বেও দাদা চেয়ে চেয়ে খেয়েছে।’

মণি বলল, ‘আমিও বলব তুই খেলেছিস আর হাততালি দিয়ে হেসেছিস। বাবা হাসতে বারণ করেছিল না?’

প্রতিমাদেবী বললেন, ‘তোমাদের বাবা আর কী বারণ করেছে?’

মণি মুখ তুলে দিদার দিকে তাকাল। বলল, ‘আর একটা আসল জিনিস বারণ করেছে। কিন্তু সেটা আমরা ভুলে গেছি।’

প্রতিমাদেবী অবাক হওয়ার ভান করে বললেন, ‘সেকী, ভুলে গেলে!’ কাঞ্চন বলল, ‘আমি ভুলিনি।’

প্রতিমাদেবী বললেন, ‘কী বলো তো। দেখি তোমার কেমন মনে আছে কাঞ্চন?’ কাঞ্চন দিদার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলব না।’

প্রতিমাদেবী হেসে বললেন, ‘বলতে হবে না। আমি জানি, তোমাদের বাবা কী বারণ করেছে।’

মণি অবাক হয়ে বলল, ‘তুমি কী করে জানলে?’

প্রতিমাদেবী মণির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘আমি অনেক কিছু জানি৷ আমি তোমাদের দিদা না? দিদারা অনেক কিছু জানতে পারে। আমি জানি তোমাদের বাবা বলে দিয়েছে, তোমরা যেন তোমাদের মায়ের কোনও কথা আমার কাছে জানতে না চাও। তাই না?’

কাঞ্চন খাওয়া থামিয়ে অবাক হয়ে বলল, ‘কী করে জানলে? তুমি কি ম্যাজিক জানো?’

ভাই একা এত কথা বলে যাবে, আর সে চুপ করে থাকবে, এটা মণির পছন্দ হল না। সে গম্ভীরভাবে বলল, ‘বাবা বলেছে, তোমাকে যদি মায়ের কথা জিজ্ঞেস করি তা হলে তুমি নাকি দুঃখ পাবে। সত্যি কথা? তুমি দুঃখ পাবে? তুমি কি মায়ের কথা কিছু জানো?’

প্রতিমাদেবী নাতিদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তাঁর শরীরটা কেমন করছে। তিনি কি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন? দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘না, জানি না।’

কাঞ্চন হেসে উঠল, ‘হি হি। এমা, দিদা নিজের মেয়ের কথা জানে না। বাবা কিন্তু জানে।’

প্রতিমাদেবী মণির দিকে তাকালেন। বললেন, ‘কী জানে?’

কাঞ্চন বলল, ‘না গো দিদা, দাদা মিথ্যে বলছে। বাবা কিছু জানে না। শুধু বলে, তোমাদের মা একজন দারুণ মানুষ ছিল। সবার থেকে ভাল। তাই কখনও হয় দিদা? আমাদের মা কি পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে ভাল মানুষ ছিল?’

তপতী ঘরে ঢুকে দেখল, শাশুড়ি মুগ্ধ চোখে নাতিদের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর দুই চোখ ভেসে যাচ্ছে জলে।

বিকেলে ছাদে একসঙ্গে লাফালাফি করবার পর থেকেই এই দুই বালকের ওপর তপতীর মায়া ক্রমশ বাড়ছে। সকালে গয়নার ঘটনা মনে পড়ায় নিজেকে এখন তার খুব ছোট মনে হচ্ছে। মণি-কাঞ্চনের খাওয়া হয়ে গেলে সে নিজে শাশুড়ির কাছ থেকে চাবি চেয়ে আলমারি খুলল। গয়নার বাক্স বের করে বলল, ‘মা, বাক্সগুলো আপনি জামাইবাবুর হাতে দিয়ে দিন। আমি শুধু দুটো হার বের করে ওদের নিজের হাতে পরিয়ে দেব।’

প্রতিমাদেবী অন্যমনস্কভাবে বললেন, ‘দাও।’

হার পরানোর সময় মণি চুপ করে থাকলেও কাঞ্চন মৃদু আপত্তি করল। বলল, ‘একী, হার পরাচ্ছ কেন মামিমা? এমা, আমি কি মেয়ে নাকি? হার তো মেয়েরা পরে।’

স্কুল ইউনিফর্মের সঙ্গে মুক্তো বসানো হার পরে ছেলেদুটোকে বড় অদ্ভুত দেখাচ্ছে।

তপতী একগাল হেসে বলল, ‘বাঃ ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে। তাই না মা? মনে হচ্ছে, আমাদের বাড়িতে দুটো ফুটফুটে রাজকুমার এসেছে। এসো, তোমরা এই আয়নায় নিজেদের দ্যাখো, তোমরাও চমকে যাবে। নিজেদের চিনতেই পারবে না।’

দুই ভাই আয়নার কাছে এল। তারপর গলা থেকে হার খুলতে খুলতে বলল, ‘এ-জিনিসটা আমাদের বাড়িতে আছে। এটা আমাদের লাগবে না।’

কাঞ্চনও হার খুলে ফেলল। সত্যি, এ জিনিস তার লাগবে না। তার লাগবে অন্য জিনিস। আচ্ছা, কেউ ব্যাট-বলটা দেওয়ার কথা বলছে না কেন? সে নিজেই কি বলবে? বলা কি ঠিক হবে?

তপতী বলল, ‘এমা, খুলো না। বললাম না হার পরে তোমাদের দু’জনকে রাজপুত্রের মতো দেখাচ্ছে?’ মণি গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আমাদের রাজপুত্রের মতো দেখানোর দরকার নেই। আমরা তো সত্যিই রাজপুত্র। বাবা তো আমাদের মণিকুমার আর কাঞ্চনকুমার বলে ডাকে। বলে, তোরা রানির ছেলে তো। সেইজন্য তোদের নামও রাজপুত্রদের নামে।’

প্রতিমাদেবী বললেন, ‘থাক বউমা, তুমি গয়নার বাক্সগুলো আলমারিতে তুলে রাখো।’

রমাকান্তবাবু ঘরে ঢুকে বললেন, ‘মণি-কাঞ্চনকে নীচে নিয়ে যাচ্ছি। অনেকটা যেতে হবে। ঠিকই, আগরপাড়া তো কম পথ নয়। আমি কতবার বললাম, মুকুল গাড়ি করে পৌঁছে দিচ্ছে। প্রতাপ রাজি হল না। ওফ যা গোঁয়ার—।’ নাতিদের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেলেন রমাকান্তবাবু। দু’জনে ভারী শান্তভাবে সোফায় বসে জুতো পরছে। রমাকান্তবাবু স্ত্রীর দিকে গলা নামিয়ে বললেন, ‘শেষপর্যন্ত স্টেশন অবধি গাড়িতে যেতে রাজি হয়েছে। তুমি কি একবার ছেলেদুটোকে রাখবার কথাটা প্রতাপকে বলে দেখবে?’

প্রতিমাদেবী স্থির দৃষ্টিতে নাতিদের দিকে তাকিয়ে আছেন। সেই অবস্থাতেই বললেন, ‘থাক, দরকার নেই। তপতী, ওদের নীচে নিয়ে যাও আমি আসছি।’ তপতী অবাক হয়ে বলল, ‘সেকী! আপনি নীচে নামবেন কী? না না।’

প্রতিমাদেবী পুত্রবধূর দিকে তাকিয়ে শুকনো মুখে হাসলেন। বললেন, ‘অনেকদিন তো ওপরে বসে আছি, একদিন নামতে দাও বউমা।’

মুকুল গম্ভীরমুখে গাড়িতে স্টার্ট দিল। জেদ যখন সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন তাকে বলা হয় পাগলামি। মুকুলের মনে হচ্ছে, বারো বছর আগে তার মা যে জেদ দেখিয়েছিল আজ তা সীমা ছাড়িয়েছে এবং মা পাগল হয়ে গেছে। এখন আর তাকে কোনও কথাই শোনানো সম্ভব নয়। সে যা করবে ঠিক করেছে তাই করছে।

মুকুলের পাশেই গুটিসুটি মেরে বসে আছে প্রতাপ। তার অত বড় কিছু চিন্তা হচ্ছে না। তার চিন্তা, বাথরুমে কি জল ভোলা আছে? আগরপাড়ায় এখন জলের সমস্যা চলছে।

গাড়ির পিছনের সিটে যারা বসে আছে তাদের ছোট বড় কোনও সমস্যাই নেই। তাদের শুধুই আনন্দ। মণি আর কাঞ্চন তাদের দিদাকে মাঝখানে বসিয়েছে। দিদা একটা করে কথা বলছে আর দু’জনে হেসে তার কোলে গড়িয়ে পড়ছে।

কাঞ্চন গলা নামিয়ে বলল, ‘দিদা, তুমি আমাদের সঙ্গে থাকতে যাচ্ছ?’ প্রতিমাদেবী নাতির মতোই ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘বয়ে গেছে তোদের সঙ্গে থাকতে। আমি আমার মেয়ের কাছে যাচ্ছি। তোদের মায়ের কাছে।’

দিদার এরকম অদ্ভুত কথা শুনে মণি-কাঞ্চন আবার হাসার প্রস্তুতি নিল। মরা মানুষের কাছে যাওয়া যায় নাকি?

এই অন্ধকারেও গলির মুখের সেই অচেনা ঝাপসা গাছটা দেখা যাচ্ছে। আকাশে চাঁদ উঠেছে। সেই চাঁদের নীল আলো দিগন্ত ছাপিয়ে এসে পড়েছে গাছের মাথায়। হঠাৎ তাকালে মনে হচ্ছে, গাছ ভরে বুঝি থোকা থোকা নীল ফুল ফুটেছে।

নীল আলোর ফুল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *