2 of 2

নীল আলোয় – শেখর বসু

নীল আলোয় – শেখর বসু

ঢুকতেই মৃদু নীল আলো ওদের ‘আবছা করে দিল। নীল আলো সব জায়গায়। দরজা থেকে একদম শেষের ওই বাঁকানো কাউন্টার পর্যন্ত। পায়ের নীচে নীল কার্পেট। পা ফেলতেই প্রায় ডুবে গেল। নীল কার্পেটে পা ডুবিয়ে ডুবিয়ে ওরা এগুতে লাগল।

স্টুয়ার্ড এগিয়ে এল। কালো স্যুটপরা নায়কের মতো দেখতে স্টুয়ার্ড। হাতে মেনু। খুব যত্নের সঙ্গে ওদের কোণের টেবিলে বসাল।

অর্ডার নিয়ে চলে যেতেই ওরা চারিদিকে তাকাল। মৃদু নীল পাথরে তৈরি দেয়াল। সিলিংয়ে পাথরের তৈরি নীল ফুল। পাপড়ির আড়াল থেকে নীল আলো ছড়িয়ে পড়েছিল সারা ঘরে। সিলিংয়ের এক দিকে নীল কাগজের চেন। এপাশে মাথার পরে একগাদা ঢাউস বেলুন আঙুরের মতো ঝুলছিল।

বেয়ারা খুব কায়দা করে সাবা টেবিল জুড়ে খাবার কাঁটাচামচ ন্যাপকিন সাজিয়ে দিয়ে গেল। ওরা খেতে খেতে এটা-সেটা বলতে লাগল। একটু পরে বেয়ারা একটা গ্লাসে হুইস্কি নিয়ে এল। যে বড় সে গ্লাসে চুমুক দিল।

যে বড় তার বয়েস কত হবে? বছর পঁয়তাল্লিশ। বেশ দেখতে কিন্তু। এমনিতে গম্ভীর-গম্ভীর। হাসলে মনে হয় দিলখোলা, আড্ডাবাজ। বিরাট চাকরি। বিরাট প্রতিপত্তি। বউ মনের মতো।

যে ছোট তার বয়স বছর দশেক। ইংরেজি স্কুলে পড়ে। ভাল ছাত্র, স্বাস্থ্যবান। জ্যোতিষী বলেছে, পাঁচজনের একজন হবে। মাসে একদিন বড়র সঙ্গে বেড়াতে বেরোয়।

আজ যেমন। একটু আগে ওরা জাদুঘরে ছিল। এখন এখানে। খাওয়াদাওয়া শেষ করে ফিরতে ফিরতে সেই রাত্তির।

এর মধ্যে এক ঘণ্টা কেটে গেল। দুজনের খাবার শেষ। টেবিলও সাফ। জাদুঘর, এ তা নিয়ে দুজনের মধ্যে বিস্তর কথাবার্তা হয়েছে। একটা বেলুন সুতো ছিড়ে কার্পেটে গড়াচ্ছিল। যেটা এখন ছোটর হাতে। বড়র হাতের মুঠোয় হুইস্কির গ্লাস। সে ঝিম মেরে বসেছিল। টেবিলে আর একটা গ্লাস। গ্লাসে কয়েকটা বিল পাকানো। বড় বলল—‘যোগ কর তো।’ ছোট জানে কি যোগ করতে হবে। গ্লাস থেকে বিলগুলো বার করে নিয়ে যোগ করতে বসল। মুখে মুখে, কর গুনে। তারপর বলল—

—পঁয়তাল্লিশ টাকা পঞ্চান্ন পয়সা।

—ঠিক তো।

—বারে! এ ত ছোট যোগ।

—বড় যোগ পারবে?

—কেন পারব না।

ব্যেরা। বেয়ারা কাছেই ছিল। ছুটে এল। পুরু কার্পেটে পায়ের শব্দ উঠল না। একটু বাদে আর একটা গ্লাসে হুইস্কি নিয়ে এল; খালি গ্লাসটা নিয়ে গেল। তারপর আবার। তারপর আবার।

কোণ ঘেঁষে নাচগানের জায়গা। স্যুটপরা কয়েকজন লোক, ড্রাম বাঁশি, কংগো ইত্যাদি ঠিকঠাক করছিল। একটি সুন্দরী মেম তাদের কিসব বলে কাউন্টারের পাশের পর্দাফেলা ঘরে ঢুকে গেল। আর একটু পরেই বোধ হয় নাচগান শুরু হবে।

আস্তে আস্তে খালি টেবিলগুলো ভর্তি হয়ে যাচ্ছিল। বেয়ারা, স্টুয়ার্ড কখনও এখানে কখনও সেখানে। ঠুং ঠাং কাঁটাচামচের শব্দ। সুখাদ্য এবং নানারকম মদের গন্ধে ঘরের মৃদু নীল আলো, নীল কাগজের চেন, আঙুরের মতো ঝোলানো বেলুনগুলো কেমন রহস্যময় হয়ে উঠেছিল।

বড়র মেজাজ খুলে গিয়েছিল। কথায় কথায় হাসছিল। ছোটর সঙ্গে বন্ধুর মতো গল্প জুড়ে দিয়েছিল। ছোট অর্ধেক বুঝছিল। অর্ধেক বুঝছিল না। ই-হাঁ করছিল। বেলুনে আঁকা হাতি, ঘোড়া, ভাল্লুক দেখছিল। বংগো, বাঁশি, ড্রাম দেখছিল। দেখছিল ও টেবিলে পিসির মতো একটা মেয়েকে—এমন সময় বেয়ারা আরও কয়েকটা বিল কাচের গ্লাসে রেখে গেল।

আবার কথা শুরু হল।

—তুমি বড় হয়ে কি হবে?

—বললাম তো।

—হতে হলে কি করতে হবে?

—বললাম তো।

—আচ্ছা বড় হয়ে তুমি মদ খাবে?

—খাব।

—কেন? ন্‌না বেশি না কম।

—বেশি। অনেক বেশি।

কথার মাঝখানে বেয়ারা এল। ফিরে গিয়ে হুইস্কি আনল। খালি গ্লাস তুলে নিল। খুব সন্তর্পণে। জোরে তুললে যেন গ্লাস ফুল হয়ে যাবে। ফুল হয়ে পাপড়িগুলো হাওয়ায় ছড়িয়ে দেবে।

টেবিলগুলো সব ভর্তি হয়ে গেছে। কয়েকটা সাদাকালো জাহাজি লোক জায়গা না পেয়ে ফিরে যাবে-যাবে, তক্ষুনি স্টুয়ার্ড প্রায় ছুটে গিয়ে ওদের কিসব বলতে লাগল। হাসিমুখে, শরীর একটু ঝুঁকিয়ে। ওরা শুনতে শুনতে বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে যেতেই স্টুয়ার্ডের মুখ কালো হয়ে গেল। কালো না নীল? নীল আলোয় নীল।

নাচগানের জায়গার কাছে তিনটে অল্পবয়েসী ছেলে বসেছিল। স্টুয়ার্ড গম্ভীর হয়ে তাদের কিসব বলল। বলতেই তারা রেগে গিয়ে কি যেন বলল। স্টুয়ার্ড তখন বেয়ারাকে ডাকল। বেয়ারা তিনটে মদের গ্লাস ওদের টেবিলে ঠকঠক করে বসিয়ে দিয়ে এল।

একটু পরে অ্যানাউনসার টাইয়ে হাত দিয়ে মাইকের সামনে কাশল। কথার মাঝখানেই হুড়মুড় করে হাততালি পড়ল। হাততালির মাঝখানেই পর্দা ঠেলে মেম বেরুল। মেম আগেরবারের চেয়েও সুন্দরী হয়ে গেছে। এবার আর কারও দিকে তাকাল না। হাসল না। সোজা গিয়ে মাইকের সামনে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে সামনের দিকে একটা উরু ঠেলে দিল। বাজনা শুরু হল। জোরে। বাজনা একটু ঝিমিয়ে যেতেই মেম গান ধরল। খুব সরু গলা। ঠেলে দেওয়া উরুর পরে লম্বা নখওলা আঙুল দিয়ে তাল দিতে লাগল।

গানের সব কথা বোঝা যাচ্ছিল না। শুধু একটা কথা—সে কথাটা বারবার ফিরে আসছিল। সেটা বুঝতে কারুরই অসুবিধে হচ্ছিল না।

কথার কথা না, সত্যি দ্য ব্লুউউউউউ বাআআআআআর্ড…। নীল পাখি নাকি, গায়িকার কাধেঁ। কই কাঁধে তো নেই। ফর্সা কাঁধের দুই প্রান্তে পোশাকের টুকরো। কোথাও নীল পাখি নেই। হয়তো উড়ে গেছে। উড়ে গেছে ঘরের মধ্যে।

ঘরের মধ্যে মৃদু নীল আলো। নীল আলো সবার চোখেমুখে, সারা গায়ে। নীল—নীল কার্পেটে। দেয়ালের ছায়াগুলোও কেমন নীলচে। সিগারেটের ধোঁয়া নীল। ধোঁয়ার রেণু-রেণু নীল উড়ছিল। এত নীলের মধ্যে নির্ঘাত কোথাও না কোথাও নীল পাখি লুকিয়ে আছে।

আবার কথা শুরু হল।

—শুনছ?

—হুঁ।

কেমন লাগছে?

—ভাল।

—ভাল, না খুব ভাল?

—শুধু ভাল।

এমন সময় বেয়ারা এল। খালি গ্লাস তুলল। তারপর আর একটা গ্লাসে হুইস্কি এনে টেবিলে রাখল। কোমরে ফিতে খাঁজ থেকে কয়েকটা বিল বার করল। বিলগুলো এধারের গ্লাসটার মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। বেয়ারা, নীল বেয়ারা। তবে কেমন বাজে নীল। পচা ডিমের নীল। পচা-ডিম বেয়ারা বাঁকানো কাউন্টারের কাছে ফিরে গেল।

মাথার পরে আঙুরের মতো বেলুন ঝুলছিল। দুটো বেলুন কখন যেন চুপসে গেছে। চোপসানো বেলুন দুটো হাতি, বাঘ, ভাল্লুক ছোট ছোট হয়ে গেছে।

আবার কথা শুরু হল।

—আমার বেলুনটা?

—বিলগুলো যোগ করো।

—বলো না বেলুনটা কোথায়?

—আহ বিলগুলো যোগ করা।

ছোট হাত ছোট কর গুনে একগাদা বিল যোগ করতে লাগল।

—যদি যোগ ঠিক হয় তা হলে।

—তা হলে?

বলেই কচিগলা হাসি জুড়ে দিল।

—হাসছ কেন?

—এমনি।

—বলো হাসছ কেন?

—তোমার কথা জড়িয়ে গেছে।

—সো হয়াট।

—তোমার চোয়াল ঝুলে গেছে।

—শাটাপ।

—তোমার চোখ লাল হয়ে গেছে।

—বাঁদর কোথাকার। মেরে ঠিক করব।

—পারলে তো।

—কি! আমি পারব না?

—না। ধাক্কা দিলেই পড়ে যাবে।

—তবেরে…

বেয়ারা ছুটে এল। স্টুয়ার্ড ছুটে এল। আশেপাশের সবাই চমকে তাকাল। আস্তে আস্তে সব আবার শান্ত হয়ে গেল। বিলের টাকা মিটল। মোটা বখশিস পেয়ে বেয়ারা লম্বা সালাম দিল। স্টুয়ার্ড একটা বেলুন এনে ছোটকে দিতে গেল। ছোট নিল না। বড়র হাতও ধরল না। আগেভাগেই হাঁটতে লাগল। পেছনে বড় বেয়ারার কাঁধে হাত দিয়ে হাঁটছিল।

নীল আলো আরও ঘন হয়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল। বাঁকানো কাউন্টার থেকে দরজা পর্যন্ত ঘন নীল। ওই লোকটা থেকে এই লোকটা পর্যন্ত সবাই নীল। দেওয়ালের ছায়াগুলো কিম্ভূত। কিম্ভূত বেঢপ নীল। সিলিংয়ে ঝোলানো কাগজের চেন অনেকটা ঝুলে পড়েছিল। ঝুলে আরও নীল হয়ে দুলছিল।

হঠাৎ কে ফস করে সিগারেট ধরাল। সিগারেটের ধোঁয়া—নীল ধোঁয়া উড়তে লাগল বেঁকে বেঁকে। ধোঁয়া না কুয়াশা? কুয়াশা। নীল কুয়াশা ভাসতে লাগল। ভাসতে লাগল ঘরের মধ্যে শীতের ভোরের কুয়াশা—ময়দানে যেমন থাকে—ন্‌না পাহাড়ের মাথায় ঠিক তেমনি মিহি, আদুরে, উড়ন্ত—শুধু রংটা নীল এই যা।

পাহাড়ের কুয়াশা হঠাৎ-হঠাৎ মরে গেলে নীল আকাশ দেখা যায়। ঘন নীল আকাশ। এখন তার বদলে মাঝে মাঝে নীল পাথরের ফুল দেখা যাচ্ছিল।

নীল কুয়াশার মধ্যে এমন সময় খুব জোরে বাজনা বেজে উঠল। বংগো, ড্রাম, বাঁশি। বাজনা ছাপিয়ে তীক্ষ্ণ, সরু গলা গেয়ে উঠল—দ্য রুউউউ বাআআআর্ড…

তখন থেকে গাইছে—নীল পাখি ওর কাঁধে। মেম—সুন্দরী মেম, জরির পোশাকপরা মেম— মাইকে এক হাত। একটা উরু সামনের দিকে এগুনো। উরুতে লম্বা নখওলা আঙুলগুলো তাল দিচ্ছিল।

বাজনা আরও দ্রুত প্রচণ্ড হয়ে উঠল। গলা আরও তীক্ষ্ণ সরু—দ্য ব্লুউউউউ বাআআআর্ড…। ঠিক তক্ষুনি কোথেকে একটা ছোট্ট নীল বাহারে পাখি সুন্দরী মেয়ের খোলা কাঁধে এসে বসল। তারপর ও কাঁধে। ও-কাঁধ থেকে আবার এ-কাঁধে।

৫ মার্চ ১৯৭২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *