৬
আজ লিখতে খুব ভালো লাগছে।
কলম চলছে দ্রুত গতিতে। আকাশ মেঘলা। অল্প-অল্প বাতাস দিচ্ছে। সেই বাতাসে বজরা দুলছে। এই দুলুনির সঙ্গে কোথায় যেন লেখার খানিকটা মিল আছে। ঘুঘু ডাকছে। ঘুঘু নামের এই বিচিত্র পাখি সকালে বা সন্ধ্যায় কেন ‘ডাকে না? যেছে—বেছে ক্লান্ত দুপুরে ডেকে দুপুরগুলোকে কেমন অন্য রকম করে দেয়।
প্রকাণ্ড এক ছাতিম গাছের গুঁড়ির সঙ্গে নৌকা বাঁধা। বজরার জানালা থেকে ছাতিম গাছের ডালপালা এবং তাঁর ফাঁক দিয়ে দূরের আকাশ দেখা যায়। শওকত সাহেব লেখা থামিয়ে ছাতিম গাছটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর হঠাৎ মনে হল—বৃক্ষরাজি সবসময় আকাশ স্পর্শ করতে চায়। তারা সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। মানুষ চায় মাটি এবং জলের কাছাকাছি থাকতে। তিনি খুব কম মানুষকেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছেন—।
‘স্যার আপনের খাওয়া।’
বাবু টিফিন ক্যারিয়ার হাতে উঠে এসেছে।
তিনি আকাশের কাছ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। বাবু হাঁটুর উপর লুঙ্গি তুলে কালো গেঞ্জি গায়ে চলে এসেছে। কি কুৎসিত ছবি।
‘আজ স্যার গোমাংস। বৃষ্টিবাদলার দিন তো; খাইয়া আরাম পাইবেন। ধুম বৃষ্টি হইব, আসমানের অবস্থা দেখেন।’
‘তুমি টিফিন ক্যারিয়ার রেখে যাও। আমি খেয়ে নেব।
‘উপস্থিত থাইকা আপনেরে খাওয়াইতে বলছে।’
‘কে বলেছে। পুষ্প?’
‘পুষ্প ছাড়া আর কে? শেষ বাটির মধ্যে দৈ-মিষ্টি আছে।’
‘তুমি খেয়েছ?’
‘জ্বি না আপনের খাওয়া শেষ হইলে পুষ্প আর আমি খাইতে বসব।’
আজ তিন দিন হল পুষ্পের সঙ্গে তাঁর দেখা নেই। তার পক্ষে কাদা ভেঙে বজরায় আসা অবশ্যি কষ্টকর, তবু ইচ্ছে করলে সে কি আর আসতে পারত না? অবশ্যই পারত।
‘স্যার কি ‘মঠ’ দেখতে গেছিলেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমি গতকাল পুষ্পেরে নিয়া গেলাম। ঢুকলাম ভেতরে। পুষ্প না করতেছিল— সাপখোপ থাকতে পারে। আমি বললাম, ভয়ের কিছু নাই। আমি সাপের বাবা সর্পরাজ। হা-হা-হা।’
‘কি দেখলে?’
‘আরে দূর দূর—কিছু না–শেয়ালের গু ছাড়া কিছু নাই।’
শওকত সাহেব দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে খেতে বসলেন। যত তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করা যাবে তত তাড়াতাড়ি এই আপদ বিদেয় হবে।
‘স্যার আইজ কয় পৃষ্ঠা লেখলেন?’
‘লিখছি কয়েক পৃষ্ঠা।’
‘লেখা শেষ?’
‘না। কিছুটা বাকি আছে।’
‘এত লেখালেখি করেন—আঙুল ব্যথা করে না?’
তিনি চুপ করে রইলেন। কথাবার্তা চালানোর কোনো অর্থ হয় না।
‘আমি স্যার পরীক্ষার হলে তিন ঘন্টা লেখি তারপরে আঙুলের যন্ত্রণায় অস্থির হই। আঙুল যদি দাঁতের মতো বাঁধানোর ব্যবস্থা থাকত তা হইলে লেখকরা সব আঙুল বাঁধিয়ে ফেলত। কেউ রূপা দিয়া, কেউ সোনা দিয়া। ঠিক বললাম না স্যার?’
‘হ্যাঁ ঠিক।’
‘আপনে কি দিয়া বাঁধাইতেন? সোনা না, রূপা?’
‘বাবু।’
‘জ্বি।’
‘খাওয়ার সময় কথা বলতে আমার ভালো লাগে না।’
‘জানতাম না স্যার।’
‘কথা শুনতেও ভালো লাগে না।’
‘আর কথা বলব না স্যার। কি লেখলেন একটু পইড়া দেখি।’
‘না। লেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি কাউকে পড়তে দেই না।’
বাবু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘পড়লেও কিছু বুঝব না। স্যার আপনি—লালুভুলু পড়েছেন? একটা হিট বই—চোখের পানি রাখা মুশকিল। আমি যতবার পড়ি ততবার কাঁদি।’
শওকত সাহেব খাওয়া বন্ধ করে উঠে পড়লেন।
‘খাওয়া হয়ে গেল?’
‘কিছুই তো খান নাই। গো-মাংস ভালো লাগে না স্যার?’
‘লাগে। আজ খেতে ইচ্ছা করছে না। তুমি এখন টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে যাও।’
‘জ্বি আচ্ছা।’
শওকত সাহেব খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘তুমি পুষ্পকে একবার এখানে আসতে বল তো।’
‘কখন আসতে বলব, এখন?’
‘এক সময় এলেই হবে।’
‘সন্ধ্যার সময় আমি সাথে করে নিয়ে আসব। কোনো অসুবিধা নাই।’
‘থাক সন্ধ্যায় আসার দরকার নাই। আমার কাজ বাকি আছে।’
বাবু বজরা থেকে নেমে আবার উঠে এল।
‘আসল কথা বলতে ভুলে গেছি। আপনার চিঠি আসছে। এই যে নেন।’ একটিমাত্র চিঠি। তাও রেনু লিখে নি। লিখেছে স্বাতী।
বাবা,
অনেকদিন তোমাকে দেখি না।
তুমি কবে আসবে?
তুমি কি আমার সঙ্গে রাগ করেছ? মা বলেছে—পৃথিবীর সবার সঙ্গেই তোমার রাগ। আচ্ছা বাবা পৃথিবী বানান কি ঠিক হয়েছে?
মাকে জিজ্ঞেস করলাম পৃথিবী বানান। মা বলল, ‘তোমার যা ইচ্ছা লেখ।’
আমি কিছু জানি না। বাবা তোমার বই লেখা শেষ হয়েছে? আমার একটা দাঁত পড়েছে। আমি রেখে দিয়েছি—তুমি এলে দেখাব। মার কাছে লেখা তোমার চিঠি আমি লুকিয়ে পড়েছি।
ইতি
তোমার আদরের মেয়ে, স্বাতী।
চিঠিতে কিছুই নেই অথচ শওকত সাহেবের চোখে পানি এসে গেল। তিনি তৎক্ষণাৎ চিঠির জবাব লিখতে বসলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে স্বাতীকে কিছু লিখলেন না। লিখলেন রেনুকে।
রেনু,
স্বাতীর চিঠি পেয়েছি। খামের উপর তোমার হাতের লেখা ঠিকানা দেখে ভাবলাম তোমার চিঠি। চিঠি লিখছ না কেন বল তো? এক সময় তুমি তোমার রাগ এবং অভিমানের কারণগুলো আমাকে বলতে। দীর্ঘদিন সেইসব বলা বন্ধ করেছ। কোথায় যেন সুর কেটে গেছে। না-কি সুর কখনোই ছিল না, আমরা ভেবে নিয়েছি সুর আছে! একটা সময় ছিল—আমার অর্থবিত্ত ছিল না, খ্যাতি ছিল না, ক্ষমতা ছিল না, লেখার একটা কলম ছিল। আর ছিলে তুমি। তখন প্রায়ই ভাবতাম কোনটি আমার প্রিয়—কলমটা না তুমি?
আজো আমি ঠিক তেমনি করেই ভাবি কিন্তু তুমি বোধহয় তা বিশ্বাস কর না। তুমি অনেক দূরে সরে গেছ। আমি সেদিন যেখানে ছিলাম আজো সেখানে আছি।
ভালবাসা কি সেই সম্পর্কে আমার একটি থিওরি আছে। কাউকে কখনো বলি নি—তেমাকে বলি। আমার ধারণা প্রকৃতি প্রথমে একটি চমৎকার ‘নকশা’ তৈরি করে। অপূর্ব একটি ডিজাইন। যা জটিল এবং ভয়াবহ রকমের সুন্দর। তারপর সেই ডিজাইনটি কাঁচি দিয়ে কেটে দু’ভাগ করে। এক ভাগ দেয় একটি পুরুষকে, অন্য ভাগ একটি তরুণীকে। পুরুষটি তখন ব্যাকুল হয়ে ডিজাইনের বাকি অংশ খুঁজে বেড়ায়। মেয়েটিও তাই করে। কেউ যখন তার ডিজাইনের কাছাকাছি কিছু দেখে তখন প্রেমে পড়ে যায়। তারপর দেখা যায় ডিজাইনটি ভুল। তখন ভয়াবহ হতাশা। আমার মনে হয় প্রকৃতির এটা একটা মজার খেলা। মাঝে-মাঝে প্রকৃতি কি করে জান? মূল ডিজাইনের দুই অংশকে কাছাকাছি এনে মজা দেখে, আবার সরিয়ে নিয়ে যায়। প্রকৃতি চায় না এরা একত্র হোক। দু’জনে মিলে মূল ডিজাইনটি তৈরি করুক। প্রকৃতির না চাওয়ার কারণ আছে—মূল ডিজাইন তৈরি হওয়া মানে অ্যাবসলিউট বিউটির মুখোমুখি হওয়া। প্রকৃতি মানুষকে তা দিতে রাজি নয়। প্রকৃতির ধারণা মানুষ এখনো তার জন্যে তৈরি হয় নি।
তোমাকে এত সব বলার অর্থ একটিই—আমি সবসময় ভেবেছি তোমার কাছে ডিজাইনের যে অর্ধাংশ আছে তার বাকিটা আমার কাছে …
এই পর্যন্ত লিখে শওকত সাহেবের মনে হল তিনি মিথ্যা কথা লিখছেন। রেনুর কাছে মূল ডিজাইনের অর্ধাংশ নেই। রেনুর কাছে তিনি কখনো মিথ্যা বলেন নি—আজ কেন বলবেন?
‘স্যার, ও স্যার।’
শওকত সাহেব বের হয়ে এলেন। বাবু ছাতিম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে কুকুরের বাচ্চার মতো একটা কি যেন দেখা যাচ্ছে। বাচ্চাটি কুঁইকুঁই করছে।
‘কি চাও তুমি?
‘এটা স্যার শেয়ালের বাচ্চা। আমি একটা শেয়ালের বাচ্চা ধরে ফেলেছি। আচ্ছা স্যার শেয়ালের বাচ্চাকে কি কুকুরের মতো ট্রেনিং দেওয়া যায়?’
শওকত সাহেব তীব্র ও তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, ‘আর কখনো তুমি আমার আশেপাশে আসবে না। কখনো না।’
বাবু অবাক হয়ে বলল, ‘রাগ করতেছেন কেন স্যার?’
তিনি ক্ষিপ্তের মতো চেঁচালেন, ‘যাও তুমি, যাও বলছি!’
‘এমন করতেছেন কেন? আপনের কি হইছে?’
হৈচৈ শুনে লোক জমে গেল। শওকত সাহেব বজরার ভেতরে ঢুকে গেলেন। সারা বিকাল বিছানায় শুয়ে রইলেন। সন্ধ্যার আগে-আগে করিম সাহেব এলেন চা নিয়ে। হাসিমুখে বললেন, ‘দারুণ খবর পাওয়া গেছে স্যার। মঠ একটা না। আরো দু’টা আছে। দেখতে একই রকম, তবে সাইজে ছোট।’
শওকত সাহেব বললেন, ‘করিম সাহেব আপনি এখন যান। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।’
‘কি হয়েছে, জ্বরজ্বারি না-কি?’
‘জ্বি না।’
‘ভবেশবাবুকে খবর দিব?’
‘কাউকে খবর দিতে হবে না।’
‘মঠে কবে যাবেন বললে ব্যবস্থা করে ফেলি।’
‘করিম সাহেব, আমি চুপচাপ খানিকক্ষণ শুয়ে থাকব।’
‘চা খাবেন না?’
‘না। আমি রাতেও কিছু খাব না। খাবার পাঠাবেন না।’
করিম সাহেব চিন্তিত মুখে ফিরে গেলেন।
সন্ধ্যা মিলিয়ে গেল। বজরার মাঝি এল বাতি জ্বালাতে। তিনি তাকে ফিরিয়ে দিলেন। অন্ধকারে বজরার ছাদে বসে রইলেন। চারদিকে ঝিঁঝি ডাকছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আজো কি সেদিনের মতো ঝড় হবে?
রাতে খাবার নিয়ে এল পুষ্প। সে একা আসে নি, বাবুকে নিয়ে এসেছে। বাবুর হাতে হারিকেন।
পুষ্প বজরায় উঠে বাবুকে বিদেয় করে দিল। সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে শওকত সাহেবকে বলল, ‘আপনার খাবার এনেছি।’
তিনি চুপ করে রইলেন।
পুষ্প বলল, ‘খাওয়া শেষ করে আপনি আমার সঙ্গে যাবেন। আজ রাতে বাসায় থাকবেন। আজো ঐ দিনের মতো ঝড় হবে। দিনের অবস্থা ভালো না।’
‘আমার ক্ষিধে নেই পুষ্প।’
‘আপনি কী রাগ করেছেন?’
‘রাগ করি নি। কি নিয়ে রাগ করব আমি?’
‘বাবু ভাই বলছিল, আপনি নাকি তাকে খুব বকা দিয়েছেন। সে আপনার রাগ দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে। তার ধারণা ছিল আপনি ফেরেশতার মতো মানুষ।’
‘তোমার কি ধারণা?
‘আপনি খাওয়া শুরু করুন তারপর বলব।’
শওকত সাহেব খেতে বসলেন। পুষ্প ঠিক তার সামনে বসেছে। তার মুখ হাসি-হাসি। যেন কোনো একটা ব্যাপারে সে খুব মজা পাচ্ছে।
শওকত সাহেব বললেন, ‘খাওয়া শুরু করেছি এখন বল আমার সম্পর্কে তোমার কী ধারণা?’
‘আজ বলব না। আপনি যেদিন চলে যাবেন সেদিন বলব। তাছাড়া আমার মনে হয় আপনাকে বলার দরকার নেই। আমার মনে কি আছে তা আপনি ভালোই জানেন।’
পুষ্প এত নিশ্চিন্ত হয়ে কথাগুলো বলল যে তিনি চমকে উঠলেন। সেই চমক পুষ্পের চোখ এড়াল না।
‘বাবু ছেলেটিকে তোমার কি খুব পছন্দ?
‘হ্যাঁ পছন্দ।’
‘কতটুক পছন্দ?’
‘আপনি যতটুক ভাবছেন তার চেয়ে অনেক কম।’
‘কেন পছন্দ বল তো?’
‘ওর মধ্যে কোনো ভান নেই। লুকোছাপা নেই। যা তার মনে আসে সে তাই বলে। যা তার ভালো লাগে—করে। আমরা কেউ তা পারি না। আপনার যা ইচ্ছা করে আপনি কি তা করতে পারবেন?’
‘কেন পারবো না?’
‘না আপনি পারবেন না। আপনার সেই সাহস নেই, সেই ক্ষমতা নেই। এই যে আমি আপনার এত কাছে বসে আছি—আপনার যদি ইচ্ছেও করে আপনি আমার হাত ধরতে পারবেন না।’
‘পুষ্প।’
‘আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি—তুমি সত্যি জবাব দেবে?’
পুষ্প বলল, ‘আমি কখনো, কোনোদিনও আপনার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলব না। আমি প্রতিজ্ঞা করেছি।’
‘কখন প্রতিজ্ঞা করলে?’
‘যেদিন আপনাকে প্রথম দেখলাম সেই দিন। যেদিন পা ছুঁয়ে সালাম করলাম।’
‘ভালবাসা সম্পর্কে আমার একটি থিওরি আছে; তুমি কি শুনতে চাও?’
‘না আমি কিছুই শুনতে চাই না। আপনি কী প্রশ্ন করতে চাইছিলেন করুন।’
‘আমার সবসময় মনে হয়েছে বাবু ছেলেটিকে তুমি খবর দিয়ে এনেছ। তুমি আমার সঙ্গে এক ধরনের খেলা খেলতে চেয়েছ। তার জন্যে বাবুকে তোমার প্রয়োজন ছিল। আমার কথা কি ঠিক?’
‘হ্যাঁ ঠিক। আপনি আমাকে অবহেলা করছিলেন—আমার সহ্য হচ্ছিল না। আপনি জানতে চেয়েছেন তাই বললাম। জানতে না চাইলে কোনোদিনও বলতাম না।’
বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। করিম সাহেব ছাতা হাতে, মেয়েকে নিতে এসেছেন। তিনি শওকত সাহেবকে বললেন, ‘স্যার আপনিও চলুন। বৃষ্টির মধ্যে একা-একা থাকবেন।’
শওকত সাহেব শীতল গলায় বললেন, ‘আপনারা যান। আমার অসুবিধা হবে না। আমার একা থাকতে ইচ্ছে করছে।’
.
রাত ন’টার দিকে বৃষ্টি নামল।
তুমুল বর্ষণ। শওকত সাহেব বজরার ছাদে আরামকেদারায় এসে গা এলিয়ে দিলেন। তাঁর বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছা করছে। তীব্র ইচ্ছা। মানুষ তার জীবনের অধিকাংশ সাধই পূর্ণ করতে পারে না, কিছু ছোটখাট সাধ পূর্ণ করতে পারে।
বর্ষণ চলল সারা রাত। কখনো একটু কমে আসে—কখনো বাড়ে। বাতাসে বজরা দুলতে থাকে। তাঁর বড় ভালো লাগে।
শেষ রাতের দিকে জ্বরের ঘোরে তিনি আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। তাঁর মনে হল রেনু যেন এসে দাঁড়িয়েছে তাঁর পাশে। রেনু অবাক হয়ে বলছে—’কি হয়েছে তোমার, তুমি বৃষ্টিতে ভিজছ কেন?’
তিনি হাসিমুখে বললেন, ‘বৃষ্টিতে ভিজলেও আমার কিচ্ছু হবে না রেনু। আমি হচ্ছি ওয়াটার প্রুফ। যখন ক্লাস টেনে পড়ি তখন W.P. টাইটেল পেয়েছিলাম তোমার মনে নেই?’
রেনু বলল, ‘তুমি কি কোনো কারণে আমার উপর রাগ করেছ?’
‘না। কারো উপর আমার কোনো রাগ নেই। তোমার উপর একেবারেই নেই।’
‘কেন নেই বল তো?’
‘আমাদের ছোট মেয়েটি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গেল, সেই সময়ের কথা কি তোমার মনে নেই রেনু? বেচারী দিনের পর দিন অসহ্য যন্ত্রণায় কি কষ্ট করল। আমি তাকে একদিনও দেখতে যাই নি—কারণ ওর রোগ-যন্ত্রণা দেখা এবং দেখে সহ্য করার ক্ষমতা আমার ছিল না। ও তোমার কোলে মাথা রেখে ছটফট করছে, আমি ঘরে বসে লিখছি। ও মারা যাবার সময়ও বার বার বলছিল—’বাবা কোথায়, বাবা?’
‘থাক ওসব কথা।’
‘না না থাকবে কেন, তুমি শোন—মেয়ে মারা যাবার পরেও তুমি কিন্তু আমার উপর রাগ কর নি। তুমি আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে ছুটে এসেছিলে–সেই তোমার উপর আমি কী করে রাগ করি?’
বৃষ্টির তোড় বাড়ছে। বজরা খুব দুলছে। শওকত সাহেবের মনে হল তিনি রেনুকে আর দেখতে পারছেন না। নদীর তীরে পুষ্পকে দেখতে পাচ্ছেন। পুষ্প ব্যাকুল হয়ে বলছে—’আপনি খুব ভালো করে আমাকে দেখে বলুন তো আপনি যে ডিজাইনের অর্ধেক অংশের কথা বলছিলেন—সেই অর্ধেক কি আমার কাছে? দু’টি ডিজাইন একটু মিলিয়ে দেখবেন? তাড়াতাড়ি করতে হবে; আমাদের হাতে সময় বেশি নেই।
কাছেই কোথাও বজ্রপাত হল। বজ্রপাতের শব্দে সাধারণত পাখিরা চেঁচামেচি করে না। এইবার কেন জানি খুব চেঁচামেচি করছে।
***