৫
গত দু’দিন ধরে শওকত সাহেব বজরায় বাস করছেন।
প্রথম রাতে বেশ অস্বস্তি লেগেছে। বজরার দুলুনি ঠিক সহ্য হয় নি। বজরা দুলছিল না কিন্তু তাঁর কাছে মনে হচ্ছিল খুব সূক্ষ্মভাবে দুলছে। নদীর জলস্রোতের শব্দও মনে হল মাথায় চাপ ফেলছে। দ্বিতীয় দিনে সব অস্বস্তি দূর হয়ে গেল। মনে হল রাত্রি যাপনের এরচে’ ভালো কিছু থাকতে পারে না।
বজরাটা চমৎকার। বসার ঘর, শোবার ঘর। খুব সুন্দর বাথরুম। ভেতরের চেয়ে বাইরের ব্যবস্থা আরো ভালো। ছাদের উপর আরামকেদারা। আরামকেদারার পাশে টেবিল। আরামকেদারায় শুয়ে পা দু’টিও যাতে খানিকটা উঁচুতে রাখা যায় তার জন্যে ছোট্ট টুল যার নাম ‘পা-টুল।’
করিম সাহেব আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ‘স্যার ব্যবস্থা কেমন?’
‘ব্যবস্থা ভালো।’
‘স্যার পছন্দ হয়েছে তো?’
‘হয়েছে।’
‘তাহলে স্যার ওসি সাহেবকে ধন্যবাদ দিয়ে একটা চিঠি দিয়ে দিবেন। উনি খুব খুশি হবেন। লোক ভালো।’
‘আমি চিঠি দিয়ে দেব।’
‘উনি জিজ্ঞেস করছিলেন, উনার বাসায় চায়ের দাওয়াত দিলে আপনি কবুল করবেন কিনা। উনার খুব শখ।’
‘হ্যাঁ যাব। চা খেয়ে আসব।’
‘আরেকটা কথা স্যার, ময়নাতলা স্কুলে একদিন যাওয়া লাগে।’
‘ঐখানে কি ব্যাপার?’
‘কিছুই না। টিচারদের সাথে চা-পানি খাবেন। ছাত্রদের দুই একটা কথা বলবেন।’
‘সেটা কবে?’
‘এই সোমবারে। মহাপুরুষদের কথা শুধু শুনলেই হয় না। চোখে দেখতেও হয়। এতে পুণ্য যেমন হয়— তেমনি….’
শওকত সাহেব কথা শেষ করতে দিলেন না, বললেন, ‘আমি যাব। আমাকে দেখলে যদি আপনার ছাত্রদের পুণ্য হয় তাহলে হোক কিছুটা পুণ্য।’
.
ওসি সাহেবের বাসায় চায়ের দাওয়াত রাতের খাবারে রূপান্তরিত হল। পোলাও—কোর্মার সমারোহ। প্রকাণ্ড কাতলা মাছের মাথা বিশাল একটা থালায় সাজিয়ে শওকত সাহেবের সামনে ধরা হল। ওসি সাহেব হাত কচলাতে কচলাতে বললেন, ‘স্যার আপনার জন্য মাছটা মোহনগঞ্জ থেকে আনা হয়েছে।’
শওকত সাহেব বললেন, ‘মাছের মাথা তো আমি খাই না। কখনো না।’
‘না খেলেও এর উপর হাতটা রেখে একটু তাকিয়ে থাকুন।’
‘কেন।’
‘ছবি তুলব স্যার।’
তিনি তাই করলেন। তিন দিক থেকে তিনবার ছবি তোলা হল। শুধু মাছের মাথার সঙ্গে ছবি না, ওসি সাহেবের সঙ্গে ছবি, তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে ছবি, ওসি সাহেবের ছেলের সঙ্গে ছবি এবং শেষ পর্যায়ে ওসি সাহেবের শালাকে পাশে নিয়ে ছবি।
ছবি তোলার পর্ব শেষ হবার পর ওসি সাহেবের স্ত্রী একটি দীর্ঘ কবিতা পড়লেন। তাঁকে উদ্দেশ করেই নাকি কবিতাটি লেখা হয়েছে। যদিও শওকত সাহেব সেই দীর্ঘ কবিতায় তাঁর অংশ কি আছে কিছুই বুঝলেন না।
মোফাজ্জল করিম সাহেব উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন—’অসাধারণ, অসাধারণ!’
কবিতাটি বড় ফ্রেমে বাঁধানো। চারদিকে লতা-ফুল-পাতা আঁকা।
নিমন্ত্রণ রক্ষা করার জন্যে পুষ্পও গিয়েছিল।
ফেরার পথে সে শওকত সাহেবের পাশে পাশে হাঁটতে লাগল। পুষ্পের সঙ্গে এখন প্রায় দেখাই হচ্ছে না। করিম সাহেব খবর দিয়েছেন—পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সারাক্ষণ পড়ে আর বাকি সময়টা বাবুর সাথে দুষ্টামি-ফাজলামি করে।
শওকত সাহেবের ধারণা তা নয়। মেয়েটি যে কোনো কারণেই হোক তাঁকে এড়িয়ে চলছে। তিনি এমন কিছু কি করেছেন যাতে তাঁকে এড়িয়ে চলা উচিত? তিনি মনে করতে পারলেন না। এখন অবশ্যি বেশ সহজভাবে তাঁর পাশে-পাশে হাঁটছে। বাবু সঙ্গে নেই। বাবু থাকলে সে নিশ্চয়ই বাবুর সঙ্গে আগে আগে হাঁটত এবং খানিকক্ষণ পর পর খিল-খিল করে হাসত।
বাবু নামের ছেলেটির সঙ্গে এই মেয়েটির এত ঘনিষ্ঠতা কী করে হয় তা তিনি ভেবে পাচ্ছেন না। এই ছেলের আশেপাশে কিছুক্ষণ থাকলেই তো রাগে গা জ্বলে যাবার কথা। এক দুপুরবেলায় ঐ ছেলে তাঁর ঘরে উপস্থিত—হাতে একটা দড়ি।
‘স্যার কি ঘুমুচ্ছেন না-কি?’
‘না।’
‘দড়ির একটা ম্যাজিক দেখবেন?’
‘না। ম্যাজিক দেখতে ইচ্ছে করছে না।’
‘খুব ইন্টারেস্টিং ম্যাজিক স্যার—দড়িটা কেটে তিন টুকরা করব; তারপর জোড়া লাগায়ে দিব।’
তিনি হাল ছেড়ে তাকিয়ে রইলেন। এই ছেলে তাঁকে ম্যাজিক না দেখিয়ে যাবে না।
‘নেন স্যার দড়িটা মেপে দেখেন।’
‘মাপতে হবে না, তুমি যা দেখাবে দেখাও।’
‘উঁহুঁ মাপেন। শেষে বলবেন অন্য দড়ি।’
তাঁকে দড়ি মাপতে হল।
বাবু বলল, ‘এখন বিস্মিল্লাহ বলে দড়িটা কাটেন।’
‘কাটাকাটি যা করার তুমিই কর।’
‘উহুঁ আপনাকেই কাটতে হবে।’
তিনি দড়ি কেটে তিন টুকরা করলেন। বাবু রুমাল দিয়ে কাটা টুকরাগুলো ঢেকে দিল এবং এক সময় আস্ত দড়ি বের করে আনল।
‘কেমন স্যার, আশ্চৰ্য না?’
‘হ্যাঁ আশ্চর্য।’
‘আসেন, আপনাকে শিখিয়ে দেই কি করে করা লাগে।’
‘আমি শিখতে চাচ্ছি না।’
‘শিখে রাখেন। অন্যদের দেখাবেন। যে দেখবে সেই মজা পাবে।’
তাঁকে দড়ি কাটার ম্যাজিক শিখতে হল।
এমন ছেলের সঙ্গলাভের জন্য পুষ্প এত ব্যাকুল হবে কেন? পুষ্পকে কি তিনি এই কথাটা জিজ্ঞেস করবেন?
পুষ্প তাঁর পাশাপাশি হাঁটছে। করিম সাহেব, ওসি সাহেবের সঙ্গে গল্প করতে—করতে এগুচ্ছেন। তাঁরা অনেক সামনে। ইচ্ছা করলে জিজ্ঞেস করা যায়। ইচ্ছা করছে আবার করছেও না।
পুষ্প বলল, ‘আজকের নিমন্ত্রণটা আপনার কেমন লাগল?’
তিনি বললেন, ‘ভালো।’
পুষ্প বলল, ‘আমি সারাক্ষণ আপনাকে লক্ষ করছিলাম। আপনি অসম্ভব বিরক্ত হচ্ছিলেন অথচ হাসিমুখে বসেছিলেন। আপনি তো অভিনয়ও খুব ভালো জানেন।’
‘ঠিকই ধরেছ।’
‘এরকম কষ্ট কি আপনাকে প্রায়ই করতে হয়?’
‘হ্যাঁ হয়।’
‘ওরা কিন্তু যা করেছে আপনাকে ভালবেসেই করেছে।’
‘তাও জানি।’
‘আপনি কি আমার উপর রাগ করে আছেন?’
‘না। রাগ করে থাকব কেন? রাগ করে থাকার মতো তুমি কি কিছু করেছ?’ পুষ্প তাঁকে বিস্মিত করে দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ করেছি।’
‘কি করেছ?’
‘আপনার কাছ থেকে দূরে-দূরে থাকছি।’
‘তুমি দূরে-দূরে থাকলেই আমি রাগ করব, এমন অদ্ভুত ধারণা তোমার কেন হল বল তো? আমি একা থাকতেই পছন্দ করি। তোমাদের বাড়ি ছেড়ে বজরায় এসে উঠলাম কি জন্যে? যাতে একা থাকা যায়। বজরার মাঝি দু’জনকেও বিদায় করে দিয়েছি। রাতে অবশ্যি খানিকটা ভয় ভয় লাগে।
‘আপনার লেখা কেমন হচ্ছে?’
‘ভালো হচ্ছে, খুব ভালো। এখানে বসে লেখার একটা প্রভাবও লক্ষ করছি— লেখার ধরন একটু মনে হল পাল্টেছে। প্রকৃতির কথা স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলে আসছে।’
পুষ্প বলল, ‘সারাক্ষণ আপনার মাথায় লেখা ঘুরে তাই না? লেখা ছাড়া আপনি আর কিছু ভাবতে পারেন না।’
তিনি হেসে ফেলে বললেন, ‘কবিতা শুনতে চাও?’
‘কবিতা?’
‘হ্যাঁ কবিতা। আমি আবৃত্তি ভালো করতে পারি না। আমার উচ্চারণ খারাপ। ‘র’ ‘ড়’-এ গণ্ডগোল করে ফেলি। ‘দ’ এবং ‘ধ’-তেও সমস্যা আছে। তবে প্রচুর কবিতা আমার মুখস্থ। রেনুর সঙ্গে বাজি রেখে একবার সারারাত কবিতা মুখস্থ বলে গেছি। বল কোন কবিতা শুনবে।’
‘যা বলব তাই মুখস্থ বলতে পারবেন?’
‘অবশ্যই পারব।’
‘আচ্ছা আষাঢ় মাস নিয়ে একটা বলুন।’
‘খুব সহজ বিষয় ধরলে। বর্ষা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ঋতু। বর্ষা নিয়ে তাঁর অসংখ্য কবিতা আছে—’
তিনি নিচু গলায় শুরু করলেন—
আষাঢ় হতেছে শেষ, মিশায়ে মল্লার দেশ
রচি “ভরা বাদরের” সুর।
খুলিয়া প্রথম পাতা গীত গোবিন্দের গাঁথা
গাহি “মেঘে অম্বর মেদুর।”
স্তব্ধ রাত্রি দ্বিপ্রহরে ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি পড়ে
শুয়ে শুয়ে সুখ অনিদ্রায়
“রজনী শাঙন ঘন ঘন দেয়া গরজন”
সেই গান মনে পড়ে যায়।
শওকত সাহেব হঠাৎ কবিতা আবৃত্তি থামিয়ে দিলেন। তিনি এ কি করছেন! মেয়েটিকে অভিভূত করার চেষ্টা করছেন! সেই চেষ্টাও ছেলেমানুষি ধরনের চেষ্টা। কোনো মানে হয় না। এর কোনো মানে হয় না।
পুষ্প বলল, ‘হঠাৎ থেমে গেলেন কেন?’
‘ইচ্ছা হচ্ছে না। আকাশে মেঘ নেই, বর্ষার কবিতা এই কারণেই ভালো লাগছে না।’
তিনি সিগারেট ধরিয়ে হনহন করে এগিয়ে গেলেন।
পুষ্প পেছনে পড়ে গেল।
.
পরদিন গেলেন ময়নাতলা স্কুলে।
জরাজীর্ণ স্কুল। দেখেই কান্না পায়। তিনি স্কুলে ঢোকামাত্র একদল রোগাভোগা ছেলে মিলিটারিদের মতো প্যারেড করতে-করতে এল। তাদের একজন দলপতি আছে। সে এসে স্যালুট করে হ্যান্ডশেকের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল। খুবই বিব্রতকর অবস্থা।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মানপত্র পাঠ করলেন স্কুলের বাংলার শিক্ষক তারিনীবাবু। হে মান্যবর, হে জগতের আলো, হে বিদগ্ধ মহাজ্ঞানী, হে বাংলার হৃদয়, হে দেশমাতৃকার কৃতী সন্তান …চলতেই লাগল। চেয়ারে বসে দীর্ঘ সময় এই জিনিস শোনা কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি গলায় জুঁই ফুলের মালা নিয়ে চুপচাপ শুনছেন। অনুষ্ঠানে এক ছেলে কবিতা আবৃত্তি করল। রিনরিনে গলায় বলল, ‘লিচু চোর। লিখেছেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।’ কিছুদূর আবৃত্তি করেই সে
গণ্ডগোল করে ফেলল। আবার শুরু করল গণ্ডগোল-আগের জায়গায় এসে আবারো
গণ্ডগোল। তারিনীবাবু ছেলেকে হাত ইশারায় ডাকলেন। সে কাছে এগিয়ে আসতেই, প্রচণ্ড চড় কষিয়ে বললেন—গাধা। যা পেছনে কানে ধরে বসে থাক।
শওকত সাহেব খুবই মন খারাপ করে লক্ষ করলেন ছেলেটি সত্যি-সত্যি সবার পেছনে কানে ধরে চুপচাপ বসে আছে। তিনি এই স্কুলে আসার কারণে বাচ্চা একটি ছেলে লজ্জিত ও অপমানিত হল।
অনুষ্ঠান শেষে হেডমাস্টার সাহেব ঘোষণা করলেন—’মহান অতিথির এই স্কুলে পদার্পণ উপলক্ষে আগামী বুধবার স্কুল বন্ধ থাকবে।’