নীল অপরাজিতা – ৩

মোফাজ্জল করিম সাহেব ফজর ওয়াক্তে ঘুম থেকে ওঠেন।

হাত-মুখ ধোয়ার আগেই চুলা ধরিয়ে ভাতের হাঁড়ি চাপিয়ে দেন। ওজু করে নামাজ শেষ করতে করতে চাল ফুটে যায়। মাড় গেলে আগুন-গরম ভাতে তিন চামুচ ঘি ঢেলে খাওয়া শুরু করেন। খাওয়া শেষ হতে হতে সূর্য উঠে যায়। তিনি রওনা হয়ে যান স্কুলে। স্কুল তাঁর বাড়ি থেকে আড়াই মাইল। বর্ষাকালে নৌকায় অনেক ঘুরপথে যেতে হয়। দু’থেকে আড়াই ঘন্টার মতো লাগে। স্কুলে পৌঁছতে হয় আটটার আগে। যারা এবার এসএসসি দিচ্ছে তাদের স্পেশাল কোচিং হয় আটটা থেকে দশটা। তাঁর উপর দায়িত্ব হল অঙ্ক এবং ইংরেজির। আগে শুধু অঙ্ক করাতেন। নলিনীবাবু দেখতেন ইংরেজি। নলিনীবাবুর হাঁপানির টান খুব বেড়ে যাওয়ায় কিছুদিন ধরে আসছেন না। করিম সাহেবের উপর ডাবল দায়িত্ব পড়ে গেছে। খুব চাপ যাচ্ছে। স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। সন্ধ্যায় বাসায় ওসি সাহেবের এক শালা পড়তে আসে। মহা মূর্খ। এক মাস টেন্স পড়াবার পর জিজ্ঞেস করলেন, আমি বাড়ি যাই ইংরেজি কি? সে পাঁচ মিনিটি চিন্তা করে বলল I am home going. তিনি প্রচন্ড থাবড়া দিলেন। সে আগের চেয়েও গম্ভীর গলায় বলল, I home going. তাঁর ইচ্ছা করছিল শক্ত আছাড় দেন। একে বলে পন্ডশ্রম।

আজ করিম সাহেব ঘুম থেকে উঠে দেখেন পুষ্প তার আগেই উঠে বসে আছে। কেরোসিনের চুলায় চাল ফুটছে। তিনি খুশি গলায় বললেন, ‘তুই এত সকাল-সকাল উঠলি যে! রাতে ঘুম ভালো হয় নাই?’

‘হয়েছে।’

‘সকালে উঠে ভালো করেছিস মা। সুন্দর করে কয়েকটা পরোটা বানিয়ে ফেল। উনি রাতে না খেয়ে ঘুমিয়েছেন। ক্ষিধে নিয়ে ঘুম ভাঙবে। গোশত-পরোটা দিবি। আর একটা ডিম ভেজে দিস।’

‘তুমি থাকবে না বাবা?’

‘না। একদিন কামাই হয়ে গেছে। অঙ্ক হল প্রাকটিসের ব্যাপার। পরপর দুই দিন কামাই দিলে সব ভুলে যাবে। সব গরু-গাধার দল।’

‘একা-একা উনার কাছে নাশতা নিয়ে যাব বাবা?’

‘হুঁ।’

‘আমার কেন জানি ভয়-ভয় করে। কি গম্ভীর। কাল রাতে একটা কথাও বললেন না। আমি জানি আজও বলবেন না। নাশতাও খাবেন না। তাছাড়া আমার পরোটাও ভালো হয় না বাবা।’

‘তুই একটু ভুল করছিস মা। এইসব মানুষ খাওয়া-খাদ্য নিয়ে মোটেই মাথা ঘামায় না। তুই পোলাও-কোর্মা দিলে যেভাবে খাবেন, ডাল-ভাত দিলেও একইভাবে খাবেন। কিছুক্ষণ পর তুই যদি জিজ্ঞেস করিস, কি দিয়ে খেলেন? বলতে পারবে না। হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে।

পুষ্প হেসে ফেলল।

করিম সাহেব বললেন, ‘হাসছিস কেন?’

‘তুমি যেভাবে কথা বলছ তাতে মনে হয়—এই রকম মানুষ তুমি কত দেখেছ। আসলে এই প্রথম দেখছ।’

‘দেখতে হয় না মা। আন্দাজ করা যায়।’

‘ভদ্রলোককে তোমার কি খুব পছন্দ হয়েছে?’

‘পছন্দ হবে না, কী বলিস তুই। নিজে যা ভালো মনে করেন তাই করেন। কাল রাতের কথা চিন্তা কর—অন্য কেউ হলে কি করত? শরীর যত খারাপই হোক দু’মুঠ ভাত খেত। আমাদের খুশি করার জন্য করত। উনি তা করলেন না। কে খুশি হল কে হল না তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই।’

পুষ্প হাসতে হাসতে বলল, ‘উনি যদি খারাপ কিছু করেন, তুমি তারও একটা ভালো ব্যাখ্যা বের করবে।’

‘তা তো করবই। কারণ খারাপ কিছু করার ক্ষমতাই এঁদের নেই। সৃষ্টিশীল মানুষ হচ্ছে ঈশ্বরের মতো। ঈশ্বর যেমন মন্দ কিছু করতে পারেন না, এঁরাও পারেন না।’

‘উনাকে দেবতা ডাকলে কেমন হয় বাবা?’

‘ডাকতে পারিস কোনো অসুবিধা নেই, তবে মনে-মনে ডাকাই ভালো। রেগে যেতে পারেন। এই জাতীয় মানুষদের রাগ বেশি থাকে।

‘বাবা, নামাজ শেষ করে আস। তোমার ভাত হয়ে গেছে। শুকনো মরিচ ভেজে দেব?’

‘দে।’

ভাত খেতে খেতে তিনি পুষ্পকে একগাদা উপদেশ দিয়ে গেলেন—বার-বার খোঁজ নিয়ে আসবি উনার ঘুম ভাঙল কি না। ঘুম ভাঙতেই চা দিবি, তারপর বলবি আমার কথা।’

‘তোমার কথা কি বলব?’

‘ঐ যে স্কুলে গেলাম, সন্ধ্যার পর ফিরব। উনি দুপুরে কি খেতে চান জিজ্ঞেস করবি। মতির মার খোঁজ নিবি। আমি জেলেপাড়ায় বলে যাব ওরা মাছ দিয়ে যাবে।

‘বাবা উনি যদি বলেন, তোমাদের এখানে খাব না; বাবুর্চির ব্যবস্থা করতে বলেছিলাম—সেই ব্যবস্থা করে দাও!’

‘তাহলে বলবি, বাবা এসে ব্যবস্থা করবেন। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করবি।’

‘বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কীভাবে শান্ত করব? উনি তো ছেলেমানুষ না।’

‘এই ধরনের মানুষ স্বভাব-চরিত্রে ছেলেমানুষ থাকে।’

‘কোত্থেকে যে তুমি এইসব ধারণা পেয়েছ কে জানে!

‘উনি তো ঘরে আছেনই। আমার কথা অক্ষরে-অক্ষরে মিলিয়ে নে।’

‘আচ্ছা মিলিয়ে নেব।’

‘আর শোন্ মা, উনি যদি ঘুরতে-টুরতে যেতে চান—নিয়ে যাবি।’

‘কাদার মধ্যে কোথায় ঘুরবেন?’

‘কাদা-পানি এইসব নিয়ে এঁদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আমরা সাধারণ মানুষরা এইসব নিয়ে মাথা ঘামাই। এই বুঝি পায়ে কাদা লেগে গেল, এই বুঝি হাত নোংরা হল। যাঁদের মন পরিষ্কার তাঁরা শরীরের নোংরা নিয়ে মাথা ঘামান না। মন যাদের নোংরা, শরীর পরিষ্কারের জন্যে তাদের চেষ্টার শেষ নাই।’

‘আমি তো এই দলে পড়ে যাচ্ছি বাবা। নোংরা আমি সহ্যই করতে পারি না। আমার মন কি নোংরা?’

করিম সাহেব থতমত খেয়ে গেলেন। হাত ধুতে ধুতে বললেন, এইটা একটা কথার কথা বললাম। আমি রওনা হয়ে যাচ্ছিগো মা। মতির মাকে খবর দিতে ভুলবি না।

.

পিরিচ দিয়ে ঢাকা চায়ের কাপ হাতে দরজার ওপাশে পুষ্প বেশ কিছুক্ষণ হল দাঁড়িয়ে আছে। কেন জানি তার অসম্ভব ভয় করছে। সে প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলল, ‘আপনার চা। ভেতরে আসব?’

শওকত সাহেব কিছু বললেন না। নিজে উঠে দরজা খুলে দিলেন। পুষ্প ঢুকল। তিনি বললেন, ‘কেমন আছ পুষ্প?’ তাঁর গলার স্বর এত আন্তরিক যে পুষ্প হকচকিয়ে গেল। শওকত সাহেব চায়ের কাপ হাতে নিতে-নিতে বললেন, ‘কাল রাতে আমি তোমাকে একটা ভুল কথা বলেছিলাম। আমি বলেছিলাম ধুতরা ফুল বিষাক্ত। এটা ভুল। ধুতরা ফুল বিষাক্ত না। সাদা এবং নীল মেশানো ফুল। খুব সুন্দর। ধুতরার ফল বিষাক্ত। ফুল নয়।’

পুষ্প নিচু গলায় বলল, “আমি জানি।’

‘জান তাহলে রাতে বললে না কেন?

পুষ্প আগের চেয়েও মৃদু গলায় বলল, ‘বলেছি। মনে-মনে বলেছি।’

‘মনে মনে বলেছ মানে?’

পুষ্প খুব নিচু করে বলল, ‘কেউ যখন ভুল কথা বলে তখন আমি মনে-মনে বলি, কথাটা ভুল। মুখে কিছু বলি না।’

‘কাউকেই বল না?’

‘খুব যারা প্রিয় তাদের বলি।’

‘এ রকম খুব প্রিয় মানুষ তোমার ক’জন আছে?’

পুষ্প জবাব দিল না। তিনি আবার বললেন, ‘প্রশ্নটার জবাব দাও। মনে-মনে বলতে হয় না; সরাসরি বলা যায় এমন প্রিয় মানুষ তোমার ক’জন আছে?’

‘নেই।’

‘তোমার বাবা। তিনি তো আছেন।’

পুষ্প চুপ করে রইল। তিনি শান্ত গলায় বললেন, ‘বাবা কি তোমার খুব প্রিয় নন?’

‘হ্যাঁ প্রিয়, খুবই প্রিয়।’

‘তবু ঠিক সে রকম প্রিয় নয়—তাই—কি?’

‘স্যার আমি আপনার জন্যে নাশতা নিয়ে আসি। রাতে খান নি, আপনার নিশ্চয়ই খুব ক্ষিধে পেয়েছে।’

‘এত ব্যস্ত হবার কিছু নেই। তুমি বস তো। তোমার সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প করি। দাঁড়িয়ে আছ কেন? বস। আরাম করে বস।

পুষ্প তবু দাঁড়িয়েই রইল। সে এখনো চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। তিনি মেয়েটাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছেন। এমন কিছু কি তিনি বলেছেন যাতে সে এতটা ভয় পেয়েছে। তিনি আবারো বললেন-’পুষ্প বস।

পুষ্প বসল।

তার বসা দেখে তিনি চমকে উঠলেন। স্বপ্নে পুষ্প ঠিক এইভাবেই বসেছিল! এমন ভঙ্গিতেই মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল!

মেয়েটার ভয় ভাঙিয়ে দেয়া দরকার। মজার কিছু কথা বলে তাকে জানিয়ে দেয়া দরকার যে, তিনি ভয়াবহ কোনো মানুষ না। এই মেয়ে একবারও হাসে নি। হাসলে তাকে কেমন দেখায়?

‘পুষ্প’

‘জ্বি।’

‘গত রাতে তোমাদের বাড়ির বারান্দায় বসে একটা ব্যাপার নিয়ে ভাবছিলাম। ব্যাপারটা তোমাকে বলি। গত রাতে বারান্দায় বসে-বসে আমি কত বিচিত্র শব্দ শুনলাম কিন্তু ব্যাঙ ডাকতে শুনলাম না। খুবই অবাক হলাম। তারপর ভেবে—ভেবে এর একটা কারণও বের করলাম। কারণটা সত্যি কি-না তুমি বল তো। দেখি তোমার কেমন বুদ্ধি।’

পুষ্প খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। মেয়েটাকে আজ এত সুন্দর লাগছে কেন? অসহ্য সুন্দর। এক রাতে সে নিশ্চয়ই বদলে যায় নি। তাহলে কি তাঁর দেখার চোখ বদলে গেছে। স্বপ্নটার কারণে—এটা হচ্ছে নাতো?

তিনি পুষ্পের চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘কাল পূর্ণিমা ছিল বলে আমার ধারণা। ফকা ফকা জ্যোৎস্না। ব্যাঙ ডাকে ডাঙায় উঠে। চাঁদের আলোয় তাদের দেখা যায়। ব্যাঙগুলো ডাকছিল না, কারণ তারা ভাবছিল ডাকলেই, শব্দ শুনে শেয়ালের পাল এসে উপস্থিত হবে। চাঁদের আলোয় তারা বুঝে ফেলবে কোথায় ব্যাঙরা আছে। শেয়াল এসে এদের কপাকপ খাবে। এই ভয়ে ব্যাঙের দল চুপ করে ছিল। তোমার কি ধারণা আমার যুক্তি ঠিক আছে?

পুষ্প কথা বলল না। তাকিয়ে রইল।

তিনি বললেন, ‘আমার যুক্তি ঠিক নেই?’

‘মনে হয় ঠিক।’

‘মোটেই ঠিক নেই। আমি তোমাকে ভুল যুক্তি দিয়েছি। শেয়াল দেখে ব্যাঙরা ভয় পাবে কেন? লাফ দিয়ে পানিতে নেমে যাবে।’

পুষ্প বলল, ‘তাহলে তারা ডাকছিল না কেন?’

‘আকাশে মেঘ হলে কিংবা মেঘ হবার সম্ভাবনা থাকলেই ব্যাঙ ডাকে। চাঁদের আলো থাকা মানে—মেঘ নেই। কাজেই ওরা চুপ করে ছিল। বুঝতে পারছ?’

‘জ্বি পারছি।’

পুষ্প এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে খুব অবাক হয়েছে।

তিনি বললেন, ‘তোমার বাবা কোথায়?’

‘উনি স্কুলে গেছেন। সন্ধ্যার পর ফিরবেন।’

‘আচ্ছা পুষ্প তোমাদের এই জায়গায় দেখার মতো কি আছে?’

‘কিছুই নেই।’

‘একেবারে কিছু নেই তা কি হয়। কিছু নিশ্চয়ই আছে।’

‘নদীর ঐ পাড়ে পুরানো মঠ আছে।’

‘মঠ কি জিনিস?’

‘আমি নিজেও জানি না—বজলুর রহমান চাচা দেখে এসে বলেছিলেন—এই জিনিস পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে থাকলে তারা এটাকে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য বানিয়ে ফেলত। জিনিসটা বাংলাদেশের মতো গরিব দেশে আছে বলে কেউ খবরও রাখে না।’

মেয়েটার ভয় সম্ভবত কেটে গেছে, সহজভাবেই কথা বলছে।

শওকত সাহেব বললেন, ‘বজলুর রহমানের কথার উপর কোনোরকম গুরুত্ব দেয়া ঠিক না পুষ্প।’

পুষ্প বলল, ‘তা আমি জানি। কিন্তু উনি এত ভালোমানুষ যে, কথা শুনলেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে।’

‘ভালো মানুষ কী করে বুঝলে?’

পুষ্প জবাব দিল না। কিন্তু তার মুখে এই প্রথম হাসি দেখা গেল। মেয়েটা খুব সুন্দর করে হাসে।

‘শোন পুষ্প, উনি ভালোমানুষ কি না তা কিন্তু তুমি জান না। উনার আচার—ব্যবহার কাণ্ডকারখানা তোমার পছন্দ হয়েছে—তাই তাঁকে ভালোমানুষ ভাবছ।

‘উনি কি ভালোমানুষ না?’

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে শওকত সাহেব বললেন, ‘যেসব সৎগুণ থাকলে আমরা মানুষকে ভালোমানুষ বলি তা তাঁর নেই। তবে তাঁর চরিত্রে কিছু মজার ব্যাপার আছে। যে কারণে আমিও তাঁকে পছন্দ করি। তাঁর বিস্মিত এবং মুগ্ধ হবার ক্ষমতা অসাধারণ। এইটিই তাঁর একমাত্র গুণ।’

পুষ্প উঠে দাঁড়াল।

‘আপনার নাশতা নিয়ে আসি।’

‘এক মিনিট দাঁড়াও। আমার ধারণা তুমি মনে-মনে বলেছ—’আপনার কথাটা ভুল’ তাই না?’

‘জ্বি—আমি বলেছি।’

‘আচ্ছা যাও নাশতা নিয়ে আস।’

পুষ্প থেমে-থেমে বলল, আমি কি আপনার সঙ্গে যাব? মঠ দেখানোর জন্যে?

‘না। কাউকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে আমার ভালো লাগে না।’

‘আপনি তো জানেন না কোথায়।’

‘খুঁজে বের করে নেব। তাছাড়া মঠ দেখতেই হবে এমন তো কোনো কথা নেই। আমি কিছু দেখার জন্যে আসি নি। যাও নাশতা নিয়ে এসো।’

.

নাশতা খেয়ে তিনি খাতা খুলে বসলেন। বেরুতে ইচ্ছা করছে না। জানালার পাশেই টেবিল। দৃষ্টি বাইরে চলে যাচ্ছে। কী সুন্দর আকাশ। আকাশে আবার মেঘ জমতে শুরু করেছে। বর্ষা দেখার জন্যে আসলে গ্রামেই আসা উচিত। জানালার পাশে, বিরাট একটা আতা গাছ। তিনি গাছগাছালি বিশেষ চেনেন না। কিন্তু আতা গাছ চেনেন। ছেলেবেলায় যে বাড়িতে ছিলেন, সে বাড়িতে দু’টি আতা গাছ ছিল।

তিনি অনেকক্ষণ আতা গাছের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ছেলেবেলার বন্ধুকে যেন অনেকদিন পর দেখলেন। আতা গাছের ডালে কাকের বাসা। সেই বাসায় কাকের ছানা দেখা যাচ্ছে। তা তো হওয়ার কথা না। আষাঢ় মাস ঝড়-বৃষ্টির মাস। পাখিদের এই সময় বাচ্চা ফুটানোর কথা না। প্রকৃতি এই ভুল করবে না। তিনি কি চোখে ভুল দেখছেন?

কে বলেছিল কথাটা—কোনো লেখকের লেখার টেবিল জানালার পাশে থাকা উচিত না। জানালার পাশে টেবিল থাকলে তারা কখনো লিখতে পারেন না।

আসলেই বোধহয় তাই। লেখকের লেখা উচিত চার দেয়ালের ভেতরে আবদ্ধ থেকে। তখনি তাঁরা মনের জানালা খুলে দিতে পারেন।

তিনি প্রথম লাইনটি লিখলেন।

তিনি তাঁর পাণ্ডুলিপি অসংখ্যবার কাটবেন—কিন্তু প্রথম লাইনটি বদলাবেন না।

প্রথম লাইনটি হচ্ছে—”পাখি হিসেবে কাক বেশ অদ্ভুত।”

লাইনটি তাঁর পছন্দ হচ্ছে না। পছন্দ না হলেও উপায় নেই। এই পাণ্ডুলিপির প্রথম লাইনটি—গ্রহণ করা ছাড়া গতি নেই।

কি লিখবেন সব ঠিক করা আছে। ঘটনা সাজানো আছে। এই লেখায় কি বলতে চান তাও তিনি জানেন। দিনের পর দিন এই লেখাটি নিয়ে তিনি ভেবেছেন। চরিত্রগুলো এখন আর চরিত্র নেই—রক্তমাংসের জীবন্ত মানুষ। বলতে গেলে গত ছ’মাসে এই চরিত্রগুলোর কারো না কারো সঙ্গে তাঁর রোজই দেখা হয়েছে।

শুরুতে লেখার গতি মন্থর ছিল, কিছুক্ষণের ভেতর গতি বেড়ে গেল। অতি দ্রুত কলম চলতে লাগল। এক বৈঠকে যে করেই হোক পঁচিশ পৃষ্ঠার মতো লিখে ফেলতে হবে। চরিত্রগুলোকে বেঁধে ফেলতে হবে। যেন এরা কিছুতেই বেরিয়ে যেতে না পারে।

বিকেল পাঁচটায় লেখার টেবিল থেকে উঠলেন। বৃষ্টি এখনো নামে নি। আকাশ অন্ধকার হয়ে আছে। তিনি অত্যন্ত ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত বোধ করছেন। দুপুরে কিছু খান নি।

পুষ্প ঠিক দু’টার সময় খাবার নিয়ে এসেছিল। তিনি রূঢ় গলায় বলেছেন, ‘আমি লিখতে বসেছি। খবরদার আমাকে বিরক্ত করবে না।’

পুষ্প কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, ‘আপনি দুপুরে খাবেন না?’

‘লেখার টেবিল ছেড়ে উঠলেই খাব। তোমাকে আসতে হবে না। আমি তোমাকে ডেকে আনব। কিন্তু তুমি আর আসবে না। লেখার সময় বিরক্ত করলে আমি খুব রাগ করি।’

পুষ্প আর বিরক্ত করে নি। কিন্তু বেশ কয়েকবার এসে উঁকি দিয়ে গিয়েছে। একজনকে অভুক্ত রেখে সে নিজেও খাবার নিয়ে বসতে পারে নি।

শওকত সাহেব লেখা কাগজগুলো সুটকেসে ঢুকিয়ে ফেললেন। তিনি এখন হাঁটতে বের হবেন। বৃষ্টির পানি এসে লেখাগুলো আবার নষ্ট না হয়।

এই অবেলায় ভাত খেতে বসার কোনো মানে হয় না। রেনু চার পাঁচটা টিনের কৌটা দিয়ে দিয়েছে। একটায় পনির, দু’টা কৌটায় বিস্কিট, একটিতে কাজু বাদাম। রাত জেগে লেখার সময় তাঁর ক্ষিধে পায়। ক্ষিধের রসদ। পনিরগুলো টুকরো করে কাটা। দু’স্লাইস পনির এবং কয়েকটা কাজু বাদাম মুখে দেয়ামাত্র ক্ষিধে কমে গেল। তিনি ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। তার মিনিট দশেকের ভেতর আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। শোঁ-শোঁ শব্দে বাতাস বইতে লাগল। পুষ্প ছুটে এল দোতলায়। ঘর তালাবন্ধ। মানুষটা গেল কোথায়? সত্যি-সত্যি ঝড় হচ্ছে।

.

আষাঢ় মাসে এমন ঝড় কি হওয়ার কথা?

কালবৈশাখী হবে বৈশাখে। আশ্বিন মাসে আশ্বিনা ঝড়। আষাঢ় মাসে প্রবল বৃষ্টিপাত ছাড়া তো কিছু হবার কথা না। শওকত সাহেব খানিকটা দিশাহারা হলেন। ঝড়ের প্রথম ঝাপ্টার সময় তিনি একটা পুকুরপাড়ে। আশেপাশে কোনো জনমানব নেই। খুঁটিতে বাঁধা একটা গরু তারস্বরে চিৎকার করছে। পুকুরপাড়ে পাকা কালীমন্দির। সেই মন্দিরের দরজা তালাবন্ধ। উত্তর দিকে ধানখেত। কী ধান এগুলো? আউস ধান নিশ্চয় মন্দিরের পাশ দিয়ে কাঁচা রাস্তা গিয়েছে নদীর দিকে। ঝড়ের সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা কি ঠিক হবে? মাথার উপর গাছের ডাল ভেঙে পড়তে পারে। খোলা মাঠে থাকাই তো সবচে’ ভালো। আউশের খেতে নেমে পড়বেন?

বৃষ্টি নেমেছে মুষঝারে। বৃষ্টির পানি কনকনে ঠাণ্ডা। সুচের মতো গায়ে বিঁধছে। তিনি ভিজে পুরোপুরি জবজবে হয়ে গেছেন। চশমার কাচ বৃষ্টির পানিতে অস্পষ্ট হয়ে আছে। এখন চশমা থাকা না-থাকার মধ্যে কোনো বেশ কম নেই। তিনি চশমা খুলে হাতে নিয়ে নিয়েছেন। এখন একজন অন্ধের সঙ্গে তাঁর কোনো তফাৎ নেই।

ঝড়ের আরেকটা প্রবল ঝাপ্টা এল। বাতাসের কী প্রচণ্ড শক্তি! তাঁকে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যায়।

‘হুই হুই হুই…’

তিনি এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। কেউ কি ডাকছে তাঁকে? শিস দেয়ার মতো তীক্ষ্ণ শব্দ হচ্ছে বাতাসের। এই শব্দ ছাপিয়ে মানুষের গলা ভেসে আসার কথা না। ‘হুই হুই, ভদ্রলোক! হুই!’

হ্যাঁ তাকেই ডাকছে। গামছা পরা একজন কে এগিয়ে আসছে। অতি দ্রুত আসছে।

‘আপনে কোন্ দেশি বেকুব? ঝড়ের সময় নাইরকেল গাছের নিচে?’

তাই তো! তিনি এতক্ষণ কয়েকটা নারিকেল গাছের নিচেই দাঁড়িয়ে আছেন।

তিনি সরে এলেন। বেশিদূর সরতে পারলেন না—বাতাস তাঁকে ধানখেতে নিয়ে ফেলল। হাতের মুঠিতে ধরা চশমা মট করে ভেঙে গেল। হাত জ্বালা করছে। কেটেছে নিশ্চয়ই। কতটা কেটেছে কে জানে।

নারকেল গাছের নিচ থেকে যে তাকে সরতে বলল, দেখা গেল সে-ই খুটিতে বাঁধা গরুটির মালিক। গরু ছেড়ে দিয়ে সেও পলকের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। শওকত সাহেব কাদা-পানিতে মাখা হয়ে বৃষ্টি এবং ঝড় কমার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। ঝড় পুরোপুরি থামার জন্যে তাঁকে আধঘন্টার মতো অপেক্ষা করতে হল। এই আধঘন্টায় ময়নাতলা গ্রামের উপর ছোটখাট তাণ্ডব ঘটে গেল। বেশ কিছু কাঁচা বাড়ি ধসে গেল। কয়েকটা বাড়ির টিনের চাল উড়ে গেল। ময়নাতলা হাই স্কুলের প্রাইমারি সেকশানের কোনো চিহ্নই রইল না।

শওকত সাহেব বাড়ির দিকে রওনা হয়েছেন। চশমা নেই বলে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। চশমা থাকলেও খুব যে লাভ হত তা না। ঘন অন্ধকার। আকাশ এখনো মেঘে মেঘে ঢাকা। ঘনঘন বিজলি চমকাচ্ছে। যে ব্যাঙের ডাক শোনা যাচ্ছে না বলে অনেক গবেষণা করেছেন—সেই ব্যাঙের ডাক এখন চারদিক থেকেই শোনা যাচ্ছে। সেই ডাকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঝিঁঝির ডাক

হারিকেন হাতে কে যেন আসছে। শওকত সাহেব অপেক্ষা করতে লাগলেন। লোকটি কাছে এসে অবাক হয়ে বলল, ‘আপনে কেডা?’

‘আমার নাম শওকত।’

‘কোন বাড়ির?’

‘মোফাজ্জল করিম সাহেবের বাড়িতে থাকি।’

‘আপনে তো যাইতেছেন উল্টা পথে। এই পথ গেছে সোহাগী নদীর ঘাটলায়।’

‘কী নদী বললেন?’

‘সোহাগী।’

‘নদীর নাম ছোট গাঙ না?’

‘আমরা মুখের কথায় বলি ছোট গাঙ। ভালো নাম সোহাগী।’

‘শুনে খুশি হলাম। আপনি কি আমাকে মোফাজ্জল করিম সাহেবের বাড়িতে নিয়ে যাবেন? চশমা ভেঙে যাওয়ায় কিছুই দেখছি না।

‘দেখনের কিছু নাই—আপনে ডাইনের রাস্তা ধইরা নাক বরাবর যান।’

শওকত সাহেব নাক বরাবর রওনা হলেন। জোনাকি পোকাগুলো আজ নেই। থাকলে খানিকটা আলো কি আর ওদের কাছ থেকে পাওয়া যেত না? ঝড় সম্ভবত বেচারিদের উড়িয়ে নিয়ে গেছে।

পুষ্প কখন থেকে হারিকেন হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে তার আত্মা শুকিয়ে গেছে। এত বড় একটা ঝড় সে খালি বাড়িতে পার করেছে। বিকট শব্দে আতা গাছের একটা ডাল ভেঙেছে। সে ভেবেছিল পুরো বাড়িটাই বুঝি ভেঙে পড়ে গেছে। তার চেয়েও বড় ভয় এই ঝড়ে বিদেশি মানুষটা কোথায় ঘুরছে। কোনো বিপদ-আপদ হয় নি তো? বাবাই বা কোথায়? নৌকায় থাকলে নির্ঘাৎ নৌকা ডুবে গেছে।

পুষ্পের গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। তাদের বাড়ি গ্রামের এক প্রান্তে। আশেপাশে কোনো বাড়ি ঘর নেই যে সে ছুটে গিয়ে বলবে—’আমার বড় বিপদ। আমাকে একটু সাহায্য করুন।’

শওকত সাহেব নিঃশব্দে উপস্থিত হলেন। পুষ্প হারিকেন উচিয়ে ধরল। তিনি লজ্জিত ও বিব্রত গলায় বললেন, ‘ঝড়ের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। চশমা-টশমা ভেঙে একাকার করেছি।’

পুষ্প কিছুই বলল না।

‘চিনতে পারছ তো আমাকে? কাদা মেখে ভূত হয়ে আছি। তোমাদের বাড়িতে ডেটল জাতীয় কিছু আছে? হাত কেটে ফেলেছি।’

পুষ্প হারিকেন উঁচু করে ধরেই আছে। কিছু বলছে না। মনে হচ্ছে সে একটা ঘোরের মধ্যে আছে।

‘তুমি বোধহয় খুব দুশ্চিন্তা করছিলে। এমন ঝড় শুরু হবে কল্পনাও করি নি। তবে মজার ব্যাপার কি জান-–I enjoyed it. শুধু না—I enjoyed it thoroughly. করিম সাহেব কোথায়? উনি ফেরেন নি?’

‘না।’

‘তুমি পুরো ঝড়ের সময়টা একা ছিলে?’

‘জ্বি। আপনি কুয়াতলায় আসুন। কাদা ধুয়ে তুলুন। আমি সাবান এনে দিচ্ছি। হাত কতটা কেটেছে?’

‘বেশি না।’

‘দেখি।’

তিনি হাত মেলে ধরলেন। অনেকখানিই কেটেছে। রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। ‘কুয়াতলা কোন দিকে? আমি এখন প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। হারিকেনটা ভালোমতো ধর।’

পুষ্প বলল, ‘চশমা ছাড়া এখন আপনার চলবে কি করে?’

‘সুটকেসে আমার আরেকটা চশমা আছে।’

.

শওকত সাহেব মাথায় প্রায় তিন বালতি পানি ঢেলে ফেললেন। পুষ্প বলল, ‘আর পানি দেবেন না, ঠাণ্ডা বাধিয়ে বসবেন।’

তিনি হাসিমুখে বললেন, ‘পানিটা গরম, গায়ে ঢালতে খুব আরাম লাগছে। বৃষ্টির পানি কি যে ঠাণ্ডা ছিল কল্পনাও করতে পারবে না। মনে হচ্ছিল শীতে জমে যাচ্ছি। শোন পুষ্প তোমাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না—তুমি খুব কড়া করে এক কাপ চা বানাও।’

পুষ্প নড়ল না। সে তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়ে আছে। পুষ্প আবার বলল, ‘আর পানি ঢালবেন না। আপনি নির্ঘাৎ অসুখ বাধাবেন।’

‘আমার কিচ্ছু হবে না। আমি হচ্ছি ওয়াটার প্রুফ। যখন ক্লাস টেনে পড়ি তখন একবার বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে পৌষ মাসের শীতে পুকুরের পানিতে সারারাত গলা ডুবিয়ে বসে ছিলাম। যদি অসুখ না বাধাই তাহলে একশ’ টাকা পাব; এই ছিল বাজি। বাজিতে জিতে একশ’ টাকা পেলাম এবং “ওয়াটার প্রুফ” টাইটেল পেলাম। এদিকে আমার বন্ধুরা যারা সারারাত পুকুরপাড়ে বসে ছিল—তাদের প্রত্যেকের ঠাণ্ডা লেগে গেল। একজন তো নিউমোনিয়ায় মর-মর হল।

যে পুষ্প এতক্ষণ গম্ভীর হয়ে ছিল সে খিলখিল করে হেসে উঠল।

তিনি বললেন, ‘তুমি দেখি হাসতেও পার! আমি ভেবেছিলাম তুমি হাসতে পার না।’

পুষ্প বলল, ‘আপনি কি সত্যিই ওয়াটার প্রুফ টাইটেল পেয়েছিলেন?’

সত্যি পেয়েছিলাম। একটা রাবার স্ট্যাম্প বানিয়েছিলাম যেখানে লেখা

Md. Shawkat
W.P.

W.P. মানে ওয়াটার প্রুফ। বুঝলে পুষ্প, কেন জানি খুব আনন্দ লাগছে। কারণটা ধরতে পারছি না।

পুষ্প বলল, ‘আমি বলব কারণটা কি?’

‘বল তো।’

‘ঝড়ের সময় আপনি খুব ভয় পেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন মারা যাচ্ছেন। যখন দেখলেন মারা যান নি এবং ঝড় শেষ হয়েছে তখন আনন্দে মন ভরে গেল।’

‘যুক্তি তো তুমি ভালোই দিয়েছ। ভেরি গুড। আই লাইক ইট। তোমার বুদ্ধি তো ভালোই।’

‘আপনি কি ধরেই নিয়েছিলেন বুদ্ধি খারাপ হবে?’

‘খারাপ হবে ধরি নি। এভারেজ বুদ্ধি ধরেছিলাম। ভালোও না, খারাপও না।’

‘আপনি কি নিজেকে খুব বুদ্ধিমান মনে করেন?

‘হ্যাঁ করি। তুমি কর না?’

‘হ্যাঁ আমিও করি।’

.

‘ওয়াটার প্রুফ’ টাইটেল রাখা তাঁর সম্ভব হল না। গোসল শেষ করে গা মুছতে গিয়ে মনে হল জ্বর আসছে। হাত-পা কেমন জানি করছে। মাথা ভার ভার হয়ে গেছে। পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্যে নিজের ঘরে ঢুকে সিগারেট ধরালেন। সিগারেট বিস্বাদ লাগল। তিনি বিছানায় শুয়ে পড়লেন। গায়ে চাদর টেনে দিলেন। চাদরে শীত মানছে না। পুষ্পকে বলতে হবে কম্বল-টম্বল দিয়ে যেতে।

কম্বলের কথা মনে আসতেই-–দু’লাইনের কবিতাও মনে এসে গেল।

“ভঞ্জের পিসি তাই সন্তোষ পান
কুঞ্জকে করেছেন কম্বল দান।”

এখন এই কবিতা মাথার ভেতর ক্রমাগত ঘুরপাক খেতে থাকবে। কিছুতেই মাথা থেকে তাড়ানো যাবে না।

ভঞ্জের পিসি তাই সন্তোষ পান
কুঞ্জকে করেছেন কম্বল দান।

স্বাতীকে এই কবিতা তিনি শোনাতেন। অতি দ্রুত আবৃত্তি করতেন। স্বাতী কিছু না বুঝেই হাততালি দিত এবং খিলখিল করে হাসত। হামাগুড়ি দিয়ে তাঁর কাছে এগিয়ে আসত। একবার স্বাতী খাটে বসে আছে—তিনি ঘরে ঢুকে দ্রুত কবিতা পড়লেন। স্বাতী হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসতে গিয়ে খাট থেকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।

রেনু ছুটে এসে মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে চিৎকার করে উঠল—’কি হয়েছে? আমার মেয়ের কি হয়েছে?’

রেনুর সেই হাহাকার এখনো বুকে বিঁধে আছে। কবিতার সঙ্গে সঙ্গে সেই হাহাকারও মনে আসে।

ভঞ্জের পিসি তাই সন্তোষ পান
কুঞ্জকে করেছেন কম্বল দান।

এ কি যন্ত্রণা! লাইন দু’টি আরো গভীরভাবে মাথায় বসে যাচ্ছে। এক সময় মাথা থেকে ছড়িয়ে পড়বে শরীরে। শরীরের রক্ত-কণিকাগুলোও তাল মিলিয়ে আবৃত্তি করতে থাকবে।

.

পুষ্প চা নিয়ে ঢুকেছে।

তিনি পুষ্পের দিকে তাকালেন। পুষ্প চায়ের কাপ টেবিলে রেখে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। মেয়েটি কি এখনো তাকে ভয় পায়? হ্যাঁ নিশ্চয়ই পায়। সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক এখন আর তাঁর কারো সঙ্গেই নেই। By pains men come to greater pains. বড় হবার জন্যে মানুষকে নানা ধরনের কষ্ট করতে হয়। তারপর দেখা যায় তার জন্যে আরো বড় কষ্ট অপেক্ষা করছে।

‘পুষ্প তুমি আমাকে একটা কম্বল দিতে পার?’

পুষ্প হ্যাঁ-না কিছুই বলল না। খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কপালে হাত রাখল। না—মেয়েটা তাকে খুব বেশি ভয় এখন পায় না। ভয় পেলে এত সহজে কপালে হাত রাখতে পারত না।

‘পুষ্প।’

‘জ্বি।’

‘কবিতা শুনবে?’

পুষ্প চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। কিছুই বলল না।

তিনি নিচু গলায় বললেন—

‘ভঞ্জের পিসি তাই সন্তোষ পান
কুঞ্জকে করেছেন কম্বল দান।’

পুষ্প কপাল থেকে হাত সরিয়ে, আবার কপালে অন্য হাত রাখল। গা মনে হল পুড়ে যাচ্ছে। সে কি করবে বুঝতে পারছে না। বাবা এখনো ফিরে নি—ময়নাতলা স্কুলের দপ্তরি ইউনুসকে দিয়ে চিঠি লিখে পাঠিয়েছেন—আমার ফিরিতে কিঞ্চিৎ বিলম্ব হইবে। ঝড়ে স্কুলগৃহের বিপুল ক্ষতি হইয়াছে। হেডমাস্টার সাহেবের অফিসকক্ষের কাগজপত্র বিনষ্ট হইয়াছে। একটা ব্যবস্থা না করিয়া আসিতে পারিতেছি না। এদিকে হেডমাস্টার সাহেব প্রাতঃকালে নেত্রকোনা গিয়াছেন, এখনো ফিরেন নাই।

শওকত সাহেব চোখ খুলে আবার বন্ধ করে ফেললেন। আলো চোখে লাগছে। ‘পুষ্প।’

‘জ্বি।’

‘কুঞ্জ কে জান?’

‘জ্বি না।’

‘জীর্ণ দেউল এক, এক কোণে তারি;
অন্ধ নিয়াছে বাসা কুঞ্জ বিহারী।’

‘আমি আপনার জন্য একটা লেপ নিয়ে আসি।’

‘বাতি নিভিয়ে দিয়ে যাও পুষ্প। বাতি চোখে লাগছে। আমার মনে হয় তুমি আমার কবিতা শুনে ভয় পাচ্ছ। ভাবছ আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সে রকম কিছু হয় নি। জ্বর আসার মুহূর্তে কি করে জানি এই কবিতাটা মাথার ভেতর ঢুকে গেছে—কিছুতেই তাড়াতে পারছি না। তোমার এ রকম হয় না?

‘হয়।’

পুষ্প নিচে নেমে এল। ইউনুসকে পাঠাল, ভবেশবাবুকে খবর দিয়ে আনতে। তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করেন। চিকিৎসক হিসেবে তাঁর কোনোরকম খ্যাতি নেই। নিজেই বলেন, ওষুধপত্র যা ছিল সব শেষ। আবার ঢাকায় গিয়ে আনতে হবে। এখন আছে এক প্যাকেট চিনির গুঁড়া। ভগবানের নাম নিয়ে ঐ দিয়ে দি। ভগবানের অসীম লীলা। এতেই রোগ আরোগ্য হয়।

.

ভবেশবাবু তৎক্ষণাৎ এলেন।

রোগীর কপালে হাত দিয়ে বললেন, ‘হোমিওপ্যাথির কর্ম-না। জল চিকিৎসা। মা জননী, প্রচুর জল দিয়ে শরীর ঠাণ্ডা করা লাগব। জলের ব্যবস্থা করেন। শীতল জল।

শওকত সাহেব টকটকে লাল চোখে তাকালেন। সব কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কি একটা জরুরি কথা বলা দরকার। কথাটা মনে পড়ছে না। তবে কবিতার দু’চরণ এখন আর মাথায় ঘুরঘুর করছে না।

ভবেশবাবু, মাথায় পানি ঢালতে শুরু করলেন।

ঘুমে শওকত সাহেবের চোখ জড়িয়ে আসছে। এখন আরামবোধ করছেন। পাশ ফিরে ঘুমুতে ইচ্ছা করছে। পাশ ফেরা যাবে না। পাশ ফিরলে কানে পানি ঢুকবে।

ভবেশবাবু বললেন, ‘একটু কি আরাম লাগছে স্যার?’

‘লাগছে।’

‘হরে হরে, কৃষ্ণ কৃষ্ণ—জল চিকিৎসার উপর চিকিৎসা নাই। জল হইল আপনার সর্বরোগগ্রাসিনী। জলে যেসব প্রাণী বাস করে তাদের এই কারণে কোনো রোগ-বালাই হয় না। নীরোগ জীবনযাপন করে।’

শওকত সাহেব বললেন, ‘আপনি জানলেন কিভাবে? এরা অসুস্থ হলে তো আপনাকে খবর দেবে না। ইচ্ছা থাকলেও এদের ক্ষমতা নেই।’

‘স্যার আপনি একেবারেই কথা বলবেন না। চুপ করে থাকেন।’

‘শরীরটা ভালো বোধ হচ্ছে—এই জন্যে কথা বলছি—জ্বর মনে হচ্ছে কমেছে, ভবেশবাবু আপনার কাছে থার্মোমিটার আছে?’

‘আজ্ঞে না। আমি হোমিওপ্যাথি করি। থার্মোটিমার এলোপ্যাথ ডাক্তারদের যন্ত্র। আমি নীতিগতভাবে ব্যবহার করি না।’

‘জ্বর বুঝেন কীভাবে?’

‘গায়ে হাত দিয়ে বুঝি।’

‘গায়ে হাত দিয়ে আমার জ্বর আপনার কত মনে হয়েছিল?’

‘এক শ’ চারের উপরে ছিল। এখন এক শ’ দুই।’

শওকত সাহেব পুষ্পের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমার ঐ হ্যান্ড ব্যাগ খুলে দেখ প্লাস্টিকের একটা বক্স আছে। ওষুধপত্র এবং থার্মোমিটার থাকার কথা।’

থার্মোমিটার পাওয়া গেল। দেখা গেল জ্বর সত্যি-সত্যি এক শ’ দুই। শওকত সাহেব বললেন, ‘ভবেশবাবু আপনি ভালো চিকিৎসক।’

‘এই কথাটা স্যার আপনি কাগজে লিখে দিয়ে নাম সই করে যাবেন। সার্টিফিকেটের মতো সাথে রাখব।’

পুষ্প বলল, ‘আরো পানি ঢালবেন চাচা?’

ভবেশবাবু বললেন, ‘অবশ্যই—পানি জ্বর ধুইয়া নিয়ে যাইতেছে। সেই সঙ্গে রোগের যে বিষ ছিল—সেই বিষ।’

‘ভবেশবাবু।’

‘আজ্ঞে স্যার।’

‘আপনাদের এখানে যে নদী আছে তার নাম কি?’

‘নদীর নাম সোহাগী।’

‘আমিতো জানতাম—ছোটগাঙ।’

‘আগে তাই ছিল—বজলুর রহমান বলে এক পাগল কিসিমের লোক নাম বদলায়ে দিল।’

‘কীভাবে বদলালো?’

‘মজার ইতিহাস। সভা মিছিল করে একটা হুলস্থুল করেছেন। রোজ সকালে উঠে নদীর ধার দিয়ে দৌড়াতেন আর চিৎকার করতেন—সোহাগী, সোহাগী, সোহাগী। স্কুলে ছাত্রদের গিয়ে বলেছেন—তোমরা এই নাম চারদিকে ছড়ায়ে দিবে। তারপর আপনের গান বাঁধলেন সোহাগী নাম দিয়ে।’

‘গানের লাইন মনে আছে?’

‘আজ্ঞে প্রথম কয়েকটা চরণ আছে।’

‘বলুন তো দেখি।’

‘ও নদী তোর কানে আমি চুপে বলিলাম—
সোহাগী তোর নামরে নদী, সোহাগী তোর নাম।’

‘এখন সবাই কি নদীটাকে এই নামেই ডাকে?’

‘জ্বি, ডাকে। সবাই ডাকে।

শওকত সাহেব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন—‘আসলে সবাই বোধহয় মনে মনে চাচ্ছিল—এই নদীর সুন্দর একটা নাম হোক। যেই মুহূর্তে নাম পাওয়া গেল—সবাই সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণ করল।’

ভবেশবাবু বললেন, ‘আর জল ঢালতে হবে না বলে মনে হয়। জ্বর আরো কমেছে। এখন জ্বর হচ্ছে এক শ’ এক। পুষ্প মা, থামোমিটারটা নিয়ে দেখ তো ঠিক বললাম কিনা।’

শওকত সাহেব বললেন, ‘দেখতে হবে না। আপনার কথা বিশ্বাস করলাম।’

‘আজ্ঞে না। পরীক্ষা হয়ে যাক।’

‘পরীক্ষা করা হল। জ্বর ঠিকই এক শ’ এক।’

‘রোগীকে এখন ঘুমাইতে হবে। পুষ্প মা, রোগীকে একা কইরা দাও। কেউ থাকলেই রোগী কথা বলবো। ঘুম হবে না।’

তারা বের হয়ে আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শওকত সাহেব ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম ভাঙল রাত এগারোটার দিকে। চোখ মেলেই দেখলেন-বিছানার পাশে পুষ্প বসে আছে। একটু দূরে চেয়ারে পা তুলে মোফাজ্জল করিম সাহেব বসে আছেন। তাঁর মুখ ভয়ে পাংশুবৰ্ণ।

মোফাজ্জল করিম সাহেব বললেন, ‘স্যার আপনার শরীর এখন কেমন?’

‘ভালো। শরীর ভালো। আমি আপনােেদর দারুণ উদ্বেগে রেখেছি—দয়া করে ক্ষমা করবেন।’

‘কিছু খাবেন স্যার? খাওয়ার রুচি হয়েছে?’

‘না। তবে একেবারে খালি পেটে থাকা বোধহয় ঠিক হবে না। একগ্লাস দুধ খেতে পারি।’

.

এশার নামাজ শেষ করে করিম সাহেব খেতে বসলেন।

পুষ্পও বসল তাঁর সঙ্গে। করিম সাহেব বললেন, ‘তোর উপর দিয়ে আজ খুব ঝামেলা গেছে।’ পুষ্প কিছু বলল না।

‘ভবেশবাবুকে বুদ্ধি করে খবর দিয়ে খুব ভালো কাজ করেছিস মা। ভবেশবাবু চিকিৎসা কিছু জানেন না। কিন্তু এরা প্রাচীন মানুষ; অনেক টোটকা ফোটকা জানেন। সময়মতো পানি না ঢাললে অবস্থা হয়ত আরো খারাপ হত। তুই তো কিছু খাচ্ছিস না মা!’

‘আমার খেতে ভালো লাগছে না।’

‘তোর আবার জ্বর আসে নি তো। দেখি বাঁ হাতটা আমার কপালে ছোঁয়া তো।’

‘জ্বর নেই বাবা।’

‘না থাকুক, ছোঁয়াতে বলেছি ছোঁয়া।’

পুষ্প বাবার কপালে হাত রাখল। করিম সাহেব বললেন, ‘হাত তো সোহাগী নদীর পানির মতো ঠাণ্ডা।’

‘বলেছিলাম তো, জ্বর নাই।’

‘হুঁ। তাই দেখছি। এদিকে আরেক কাণ্ড হয়েছে—উনার আসার খবর দিকে-দিকে রটে গিয়েছে। কলমাকান্দার সার্কেল অফিসার চিঠি দিয়ে লোক পাঠালেন—উনাকে নিয়ে তাঁর বাসায় যেন এককাপ চা খেতে যাই। আমি বলেছি ঠিক আছে।’

‘নিজ থেকে ঠিক আছে বললে কি জন্যে—উনি তো যাবে না তুমি জানোই।’

‘যেতেও পারে। এরা ঘনঘন মত বদলায়—কাল সকালেই হয়ত বলবেন, করিম সাহেব এক জায়গায় বসে থাকতে তো আর ভালো লাগছে না। চলুন একটু ঘুরাফেরা করি।’

‘কোনোদিনও এই কথা বলবেন না। মাঝখানে তুমি অপমান হবে।’

‘আমাদের স্কুলের সেক্রেটারির বাসায়ও গিয়েছিলাম—বললাম উনার কথা। মহামূর্খ নামও শোনে নাই। যাইহোক বললাম তরফদার সাহেব একটি সংবর্ধনা স্কুলের তরফ থেকে তো দেয়া লাগে। উনি বলেন সংবর্ধনা দিয়ে কি হবে? মন্ত্রী-টন্ত্রী হলে সাহায্য পাওয়ার ব্যাপার ছিল। মূর্খের কথাবার্তা আর কি। যাইহোক শেষকালে রাজি হয়েছেন। তিন শ’ টাকা সংস্থান করেছেন। একটা হাতে লেখা মানপত্র দেয়া হবে। স্কুলের সব টিচাররা মিলে উনাকে নিয়ে চা-টা খাবেন। এককাপ চা, সিঙাড়া, মিষ্টি আর ধর একটা করে কলা।’

‘তোমাদের স্কুলের অর্ধেকটা উড়িয়ে নিয়ে গেছে ঝড়ে আর তোমরা উনার সংবর্ধনায় পয়সা খরচ করবে?’

‘স্কুল উড়িয়ে নিয়ে গেছে; আবার হবে—উনাকে পাব কোথায়?’

খাওয়া শেষ করে করিম সাহেব কুয়াতলায় হাত ধুতে গেলেন। পেছনে-পেছনে পুষ্পও এলো। চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় আবছা করে সব দেখা যাচ্ছে। পুষ্প থালাবাসন ধুচ্ছে। করিম সাহেব একটু দূরে বসে সিগারেট টানতে টানতে মেয়েকে দেখছেন। তাঁর বড় মায়া লাগছে। মেয়েটা কষ্টে পড়ে গেছে। একা কত কি দেখতে হচ্ছে। মতির মাকে কাল যেভাবেই হোক জোগাড় করতে হবে।

‘পুষ্প।’

‘জ্বি বাবা।’

‘কয়েকজন গ্রাম্য গাথককে খবর দেয়া দরকার। সন্ধ্যাবেলা একদিন এইখানে আসর করলে, উনি খুব পছন্দ করবেন।’

‘উনাকে না জিজ্ঞেস করে কিছুই কোরো না বাবা!’

‘জিজ্ঞেস করেই করব। আমাদের কত বড় সৌভাগ্য চিন্তা করে দেখ তো মা—উনার মতো মানুষ এই বাড়িতে আছেন। আমার তো বিশ্বাসই হয় না। ওসি সাহেবকে বলেছি একটা বড় বজরা নৌকা যদি দু’একদিনের জন্যে জোগাড় করতে পারেন।’

‘উনাকে পেলে কোথায়?’

‘স্কুলঘর ঝড়ে উড়ে গেছে শুনে দেখতে গেছেন। তখন বললাম। ওসি সাহেব উনার বিশেষ ভক্ত, লেখা পড়েছেন।’

কুয়াতলা থেকে দোতলার ঘর দেখা যায়। শওকত সাহেবের ঘরের বাতি নেভানো। সেই ঘরের দিকে পিতা এবং কন্যা অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *