১
তিনি ট্রেন থেকে নামলেন দুপুরবেলা।
দুপুরবেলা বোঝার কোনো উপায় নেই। চারদিক অন্ধকার হয়ে আছে। আকাশ মেঘে মেঘে কালো। বৃষ্টি এখনো নামে নি, তবে যে কোনো মুহূর্তে নামবে বলে মনে হয়। আষাঢ় মাসে বৃষ্টিবাদলার কোনো ঠিক নেই। এই বৃষ্টি, এই রোদ। ময়মনসিংহ থেকে যখন ট্রেন ছাড়ল তখন আকাশ ছিল পরিষ্কার। জানালার ওপাশে ঝকঝকে রোদ। তিন ঘন্টা ট্রেনে কাটিয়ে ময়মনসিংহ থেকে এসেছেন ঠাকরোকোনা নামের স্টেশনে। কত দূর হবে, চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মাইল! এই অল্প দূরেই আকাশের এমন অবস্থা? না-কি মেঘে মেঘে ময়মনসিংহ শহরও এখন ঢেকে গেছে?
ট্রেন ছেড়ে যাবার পর তাঁর মনে হল, ঠিক স্টেশনে নেমেছেন তো? স্টেশনের নাম পড়েন নি। পাশে বসা এক ভদ্রলোক বললেন, ‘এটাই ঠাকরোকোনা–-নামেন নামেন।’ তিনিই অতি ব্যস্ত হয়ে জানালা দিয়ে সুটকেস, বেতের ঝুড়ি, হ্যান্ডব্যাগ নামিয়ে দিলেন। তাঁর ব্যস্ততার কারণ অবশ্যি সঙ্গে সঙ্গে বোঝা গেল—এখানে ট্রেন এক মিনিটের জন্যে থামে। জিনিসপত্র সব নামানোর আগেই ট্রেন ছেড়ে দিল। দু’টি পানির বোতল ছিল, একটি নামানো হল। অন্যটি রয়ে গেল সিটের নিচে।
‘স্লামালিকুম। আপনি কি শওকত সাহেব?’
তিনি জবাব দিলেন না। অসম্ভব রোগা এবং আষাঢ় মাসের গরমে কালো কোট পরা লোকটির দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
‘স্যার, আমার নাম মোফাজ্জল করিম। আমি ময়নাতলা হাই স্কুলের অ্যাসিসটেন্ট হেডমাস্টার।’
মোফাজ্জল করিম সাহেব দুটো হাত বাড়িয়ে দিলেন। মনে হচ্ছে হ্যান্ডশেক জাতীয় প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে চান। মফস্বলের লোকজন হ্যান্ডশেক করার জন্যে দুটো হাত বাড়ায়। এরা যা করে তাকে পাশ্চাত্যের হ্যান্ডশেক বলা যাবে না। প্রক্রিয়াটির নাম খুব সম্ভব মোসাহাবা। যার দ্বিতীয় অংশে আছে কোলাকুলি। এই মুহূর্তে লোকটিকে জড়িয়ে ধরার কোনোরকম ইচ্ছা তাঁর হচ্ছে না। তিনি এমন ভাব করলেন যেন বাড়িয়ে দেয়া হাত দেখতে পান নি। মোফাজ্জল করিম সাহেব তাতে খানিকটা অস্বস্তি ঠিকই বোধ করবেন। তবে মফস্বলের লোকরা এইসব অস্বস্তি দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পারে।
‘করিম সাহেব আপনি ভালো আছেন তো?’
‘জ্বি স্যার ভালো। খুব ভালো। আপনার কোনো তকলিফ হয় নাই তো? আমি একবার ভেবেছিলাম ময়মনসিংহ থেকে আপনাকে নিয়ে আসব। ঘরে লোকজন নাই। আমার স্ত্রী গত হয়েছেন দুই বৎসর আগে ভাদ্র মাসে। সংসার দেখার কেউ নাই। স্যার আপনার মালপত্র সব এইখানে?’
‘জ্বি। তবে একটা পানির বোতল সিটের নিচে রয়ে গেছে।’
‘এ্যাঁ কী সর্বনাশ।’
মোফাজ্জল করিম দ্রুত স্টেশনের দিকে রওনা হলেন। তাঁর ভঙ্গি দেখে মনে হল পানির বোতল না, এক বাক্স হীরে-জহরত সিটের নিচে রয়ে গেছে। শওকত সাহেব দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এই লোকটা যন্ত্রণা দেবে। প্রচুর কথা বলবে। কারণে-অকারণে এসে সময় নষ্ট করবে। তিনি কুড়ি দিন নিরিবিলিতে থেকে যে কাজটা করতে যাচ্ছেন তা করতে দেবে না। পানির বোতল ট্রেনে রয়ে গেছে শুনে লোকটি স্টেশনের দিকে ছুটে গিয়ে প্রমাণ করল, সে বেআক্কেল ধরনের এবং অতিরিক্ত উৎসাহী। দু’টা জিনিসই খুব বিপজ্জনক।
মোফাজ্জল করিমকে আসতে দেখা যাচ্ছে। শওকত সাহেব আগে লক্ষ করেন নি, এখন লক্ষ করলেন লোকটির বগলে ছাতা। ডান বগলে ছাতা, সেই হিসেবে ডান হাতটা অকেজো থাকার কথা, দেখা যাচ্ছে লোকটার ডান হাত খুবই সক্রিয়। ছাতাটা যেন শরীরেরই অঙ্গ।
‘স্যার ব্যবস্থা করে আসলাম।’
‘কি ব্যবস্থা করে আসলেন?’
‘স্টেশন মাস্টারকে বলেছি—সে টেলিগ্রাফ পাঠিয়ে দিয়েছে বারহাট্টা। বারহাট্টা স্টেশনে আমার ছাত্র আছে। সে বোতল পাঠিয়ে দিবে।’
‘এত ঝামেলার কোনো দরকার ছিল না।’
‘ঝামেলা কিসের স্যার? কোনো ঝামেলা না।’
‘আপনি আমাকে স্যার-স্যার করছেন কেন?’
মোফাজ্জল করিম বিস্মিত গলায় বললেন, ‘স্যার বলব না? আপনি কী বলেন? এত বড় একজন মানুষ আপনি, এত বড় লেখক। অজ পাড়াগাঁয়ে এসেছেন। আমাদের পরম সৌভাগ্য। আমি একবার ভেবেছিলাম স্কুল ছুটি দিয়ে সব ছাত্রদের নিয়ে আসি।’
শওকত সাহেব আঁতকে উঠলেন। কী ভয়াবহ কথা! এই বিপজ্জনক মানুষটিই কি তাঁর কেয়ারটেকার হিসাবে থাকবে? মনে হচ্ছে প্রথম দিনেই জীবন অতিষ্ঠ করে তুলবে।
‘স্যার, স্টেশন মাস্টার সাহেব এককাপ চা খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছেন। চলেন যাই।’
‘চা এখন খেতে ইচ্ছা করছে না।
‘একটা চুমুক দিবেন। না হলে মনে কষ্ট পাবে। এরা বিশিষ্ট লোক তো কখনো দেখে না। আপনার নামও শোনে নাই। বই পড়া তো দূরের কথা। দোষ নাই কিছু। অজ পাড়াগাঁ জায়গা। স্যার আসেন। জিনিসপত্র নিয়ে চিন্তা করবেন না। লোক লাগিয়ে দিয়েছি। এরা নৌকায় নিয়ে তুলে ফেলবে।’
‘নৌকায় যেতে হয় না-কি?’
‘জ্বি। বেশি সময় লাগে না। দেড় থেকে দু’ঘন্টা। বাতাস আছে। পাল তুলে দিব—শাঁ শাঁ করে চলে যাব। স্যার চলেন। চা-টা খেয়ে আসি।’
শওকত সাহেব বিরক্ত মুখে রওনা হলেন।
মোটাসোটা থলথলে ধরনের স্টেশন মাস্টার সাহেব বিনয়ে প্রায় গলে পড়ে যাচ্ছেন। তাঁর চোখে দেবদর্শনজনিত আনন্দের আভা। তিনি তাঁর চেয়ার শওকত সাহেবের জন্যে ছেড়ে দিয়ে নিজে একটা টুলে বসেছেন। অন্য একটা টুলে চায়ের কাপ, একটা পিরিচে দুটো নিমকি। অন্য আরেকটা পিরিচে বানানো পান, পানের পাশে একটা সিগারেট এবং ম্যাচ। আয়োজনের অভাব নেই।
কিছু না বললে খারাপ দেখা যায় বলেই শওকত সাহেব বললেন, ‘কি ভালো?’
‘জ্বি স্যার ভালো। একটু দোয়া রাখবেন। জঙ্গলের মধ্যে পড়ে আছি আজ নয় বছর। বদলির জন্যে চেষ্টা কম করি নাই। অনেক ধরাধরি করেছি—লাভ হয় নাই। মফস্বল থেকে চিঠি গেলে এরা স্যার ফেলে দেয়। খাম খুলে পড়েও না।’
প্রসঙ্গ ঘুরাবার জন্য শওকত সাহেব বললেন, ‘স্টেশনঘরের সঙ্গে লাগোয়া বিরাট একটা গাছ দেখলাম। কী গাছ এটা?’
‘এটা স্যার শিরীষ গাছ। গত বৈশাখ মাসে ঐ গাছের ডাল ভেঙে স্টেশনঘরের উপরে পড়ল। ঘর জখম হয়ে গেল। বৃষ্টিবাদলা হলে ঘরে পানি ঢুকে। রিপেয়ার করার জন্য এই পর্যন্ত দু’টা চিঠি লিখেছি—কোনো লাভ নাই। ওদের স্যার মফস্বলের জন্য আলাদা ফাইল আছে। চিঠি গেলেই ঐ ফাইলে রেখে দেয়। খুলেও পড়ে না। স্যার, সিগারেটটা ধরান, আপনার জন্য আনিয়েছি।’
শওকত সাহেব সিগারেট ধরালেন। স্টেশন মাস্টার বললেন, ‘গোল্ড লীফ ছাড়া ভালো কিছু পাওয়া যায় না। বেনসন আনতে পাঠিয়েছিলাম। পায় নাই। মাঝে-মধ্যে পাওয়া যায়। দামী সিগারেট খাওয়ার লোক কোথায়? সবাই হতদরিদ্র।’
শওকত সাহেব দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ভাবলেন, এই অঞ্চলের সবাই বেশি কথা বলে। যার সঙ্গে দেখা হচ্ছে সেই কথা বলছে। অনবরত কথা বলছে। ভাগ্যিস মোফাজ্জল করিম সাহেব নেই। তিনি নৌকার খোঁজ-খবরে গেছেন। তিনি থাকলে দু’জনের মধ্যে কথা বলার কম্পিটিশন শুরু হয়ে যেত। মোফাজ্জল করিম সাহেব সম্ভবত জিততেন। মাস্টারদের সঙ্গে কথা বলায় কেউ পারে না।
‘স্যার কত দিন থাকবেন এখানে?’
‘ঠিক করি নি। পনেরো-বিশ দিন থাকব।’
‘শুনলাম, নির্জনে একটা লেখা শেষ করার জন্য এসেছেন?
শওকত সাহেব দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। নির্জনতার যে নমুনা শুরু হয়েছে—খুব বেশি ভরসা করতে পারছেন না।
‘স্যার পান খেলেন না?’
‘পান আমি খাই না। থ্যাংক ইউ। আমি বাইরে একটু দাঁড়াই।’
‘বাইরে দাঁড়ায়ে কী দেখবেন স্যার, কিছুই দেখার নাই। শীতকালে তাও একটু হাঁটাহাঁটি করা যায়—বর্ষাকালে অসম্ভব। কাঁচা রাস্তা, হাঁটু পর্যন্ত কাদা। দিন-রাত বৃষ্টি। খাওয়া-খাদ্য কিছু নাই। ইলিশ মাছ এক জিনিস-দুই বছরে চোখে দেখি নাই। তরকারির মধ্যে আছে ডাঁটা, পুঁইশাক আর ঝিঙ্গা। এই তিন জিনিস কত খাওয়া যায় বলেন? পটল এক জিনিস কেউ চোখেও দেখে নাই। অথচ শহর-বন্দরে এই জিনিস খাওয়ার লোক নাই।’
শওকত সাহেব স্টেশনঘর থেকে বের হয়ে এলেন আর তখনি ঝেঁপে বৃষ্টি এল। শিরীষ গাছের ঘন পাতায় বৃষ্টি আটকে যাচ্ছে। কতক্ষণ এ রকম থাকবে কে জানে। শওকত সাহেব মুগ্ধ হয়ে গাছ, বৃষ্টি এবং দূরের মাঠ দেখতে লাগলেন। সামনের অনেকখানি ফাঁকা। দৃষ্টি অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়া যায়। শহরের সঙ্গে গ্রামের এই রোধহয় তফাৎ। শহরে দৃষ্টি আটকে যায়। গ্রামে আটকায় না।
ছাতা মাথায় মোফাজ্জল করিমকে হন হন করে আসতে দেখা যাচ্ছে। পায়ের জুতা জোড়া খুলে তিনি হাতে নিয়ে নিয়েছেন। প্যান্ট ভাঁজ করে হাঁটু পর্যন্ত তুলে দিয়েছেন। শওকত সাহেব আঁতকে উঠলেন, তাকেও কি এইভাবে যেতে হবে? বৃষ্টির জোর খুব বেড়েছে। শিরীষ গাছের একটিমাত্র ডালে ছ’সাতটা কাক বসে-বসে ভিজছে। অন্য ডালগুলো ফাঁকা। কাকরা কি একটি বিশেষ ডাল বৃষ্টির সময় আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করে? এই ডালটায় নিশ্চয়ই কোনো সুবিধা আছে।
স্টেশন মাস্টার সাহেবও ছাতা হাতে বের হয়েছেন। তিনি নিজেই ছাতা মেলে শওকত সাহেবের মাথার উপর ধরলেন। বিরক্ত মুখে বললেন, ‘এই যে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, খুব কম করে হলেও সাতদিন থাকবে।’
শওকত সাহেব বললেন, ‘একটা মজার জিনিস দেখুন তো। এতগুলো ডাল থাকতে কাকরা সবাই একটা ডালে বসে আছে কেন?’
‘পশুপাখির কি স্যার কোনো বুদ্ধিশুদ্ধি আছে? একজন একটা ডালে বসছে। গুষ্টিসুদ্ধ সেই ডালে গিয়ে বসছে। স্যার ভেতরে চলেন। বৃষ্টিতে ভিজতেছেন।’
‘আপনি ছাতাটা আমার হাতে দিয়ে চলে যান। বৃষ্টি দেখতে আমার ভালোই লাগছে।’
‘একদিন-দু’দিন লাগবে স্যার। তারপর দেখবেন যন্ত্রণা। গ্রামদেশে সবচে’ খারাপ সময় হইল বর্ষাকাল।
মোফাজ্জল করিম সাহেব একটা চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে কি যেন কিনলেন, তারপর আবার যেদিক থেকে এসেছিলেন সেদিকে রওনা হলেন। শিরীষ গাছের ঐ ডালটায় আরো কিছু কাক এসে বসেছে। অন্য ডালগুলো এখনো ফাঁকা। যখন ঝড়-বৃষ্টি থাকে না তখন এরা কি করে? অন্য ডালগুলোতে বসে? নাকি কখনো বসে না? প্রচণ্ড শব্দে কাছে কোথাও বজ্রপাত হল। ধক করে বুকে ধাক্কা লাগল। এত বড় শব্দ অথচ কাকদের মধ্যে কোনোরকম চাঞ্চল্য লক্ষ করা গেল না। সম্ভবত তারা শব্দটা কী, কখন হবে, কোথায় হবে জানে বলেই চুপচাপ আছে। আরো দু’টা কাক এসে সেই ডালটাতেই বসল। আশ্চর্য তো!
নৌকা বেশ বড়।
ভেতরে তোশকের বিছানায় রঙিন চাদর। দু’টা বালিশ, একটা কোলবালিশ। মোফাজ্জল করিম বললেন, ‘বিছানা-বালিশ সব বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছি। আরাম করতে করতে যাবেন।
শওকত সাহেব বললেন, ‘কোলবালিশ এনেছেন কেন?’
‘ঘরে ছিল। নিয়ে এসেছি।’
তিনি যে শুধু কোলবালিশ এনেছেন তা না, টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার দাবার নিয়ে এসেছেন। নৌকার চুলায় সেইসব খাবার গরম করা হচ্ছে। দুপুরের খাওয়া শেষ করে নৌকা ছাড়া হবে।
বৃষ্টির তেজ অনেক কমেছে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। তবে বাতাস আছে।
করিম সাহেব বললেন, ‘এই বৎসর মারাত্মক বন্যা হবে। কি বলেন স্যার?’
শওকত সাহেব জবাব দিলেন না। কথা বললেই কথার পিঠে কথা বলতে হবে। ইচ্ছা করছে না। এক ধরনের ক্লান্তিও বোধ করছেন। বিছানায় শুয়ে পড়লে হয়। কোলবালিশ দেখার পর থেকে কোলবালিশ জড়িয়ে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে।
‘স্যার, তরকারিতে কেমন ঝাল খান তা তো জানি না। আমি বলেছি ঝাল কম দিতে। খুব বেশি কম হলে কাঁচা মরিচ আছে। আমার নিজের গাছের কাঁচা মরিচ, অসম্ভব ঝাল। সাবধানে কামড় দিবেন?’
শওকত সাহেব কিছুই বললেন না। এক জায়গায় বসে একদিকেই তাকিয়ে আছেন। চোখের সামনের দৃশ্য এখন খানিকটা একঘেয়ে হয়ে গেছে। নৌকার চুলা থেকে ভেজা কাঠের কারণে প্রচুর ধোঁয়া আসছে। চোখ জ্বালা করছে। ধোঁয়া অন্যদিকে সরানোর জন্যে করিম সাহেব তালপাতার একটা পাখা দিয়ে ক্রমাগত হাওয়া করে যাচ্ছেন। এতে কোনো লাভ হচ্ছে না। বরং ধোঁয়া আরো বেশি হচ্ছে।
‘করিম সাহেব।’
‘জ্বি স্যার।’
‘আমি, আপনাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছি। যদি কিছু মনে না করেন।’
‘অবশ্যই বলবেন স্যার। অবশ্যই।’
‘আমি মানুষজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে তেমন আগ্রহ বোধ করি না। ভালো লাগে না। চুপচাপ থাকতে পছন্দ করি।’
‘সেটা আপনাকে বলতে হবে না। আপনাকে দেখেই বুঝেছি। স্টেশন মাস্টার সাহেবকে এই কথা বলছিলাম।’
‘করিম সাহেব, আমি আমার কথাটা শেষ করতে পারি নি—আপনাদের ওখানে আমি যাচ্ছি খুব নিরিবিলিতে কিছু কাজ করতে। শহরের পরিবেশে মন হাঁপিয়ে গেছে। নতুন পরিবেশের কোনো ছাপ লেখায় পড়ে কি-না সেটা দেখতে চাচ্ছি। কাজেই আমি যা চাই তা হচ্ছে—নিরিবিলি।’
‘স্যার আপনাকে কেউ বিরক্ত করবে না। গ্রামের লোকজন যদি আসেও; সন্ধ্যার পর আসবে। এরা আপনার কাছ থেকে দু’একটা মূল্যবান কথা শুনতে চায়।’
‘আমি কোনো মূল্যবান কথা জানি না।’
‘এটা তো স্যার, আপনি বিনয় করে বলছেন।’
‘না, বিনয় করে বলছি না। বিনয় ব্যাপারটা আমার মধ্যে নেই।’
খাবার সময়ও খুব যন্ত্রণা হল। করিম সাহেব প্লেটে ভাত তুলে দিচ্ছেন, তরকারি তুলে দিচ্ছেন। শওকত সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘প্লিজ কিছু তুলে দেবেন না। যা দরকার আমি নিজে নেব। কেউ খাবার তুলে দিলে আমার খুব অস্বস্তি লাগে।’
‘আপনি তো স্যার কিছুই নিচ্ছেন না, মুরগির বুকের গোশত একটু দিয়ে দেই।’ তিনি শুধু যে মুরগির বুকের গোশত দিলেন তাই না, এক টুকরা লেবু নিজেই শওকত সাহেবের প্লেটে চিপে দিলেন।
‘কাগজি লেবুটা স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো। আমার গাছের কাগজি স্যার।’
‘ভালো।’
‘ছ’টা কাগজি লেবুর গাছ আছে—এর মধ্যে দু’টা গাছ বাঁজা। ফুল ফোটে— ফল হয় না। গাছগুলো কাটায়ে ফেলব ভেবেছিলাম-আমার মেয়ে দেয় না। ও কি বলে জানেন স্যার? ও বলে বাঁজা গাছ বলেই কেটে ফেলবে? কত বাঁজা মেয়েমানুষ আছে। আমরা কী তাদের কেটে ফেলি? আমি ভেবেছিলাম কথা খুবই সত্য। আমার নিজের এক ফুপু ছিলেন বাঁজা। কলমাকান্দায় বিয়ে হয়েছিল। খুব বড় ফ্যামেলি। তারা অনেক চেষ্টাচরিত করেছে। ডাক্তার-কবিরাজ কিছুই বাদ দেয় নাই। তারপর নিয়ে গেল আজমীর শরিফ। সেখান থেকে লাল সুতা বেঁধে নিয়ে আসল। খোদার কি কুদরত—আজমীর শরিফ থেকে ফেরার পর একটা সন্তান হল। আমি চিন্তা করে দেখলাম—আমার লেবু গাছের বেলায়ও তো এটা হতে পারে।’
শওকত সাহেব হাত ধুতে ধুতে বললেন, ‘নিশ্চয়ই হতে পারে। আপনি একটা টবে গাছ দু’টাকে আজমীর শরিফে নিয়ে যান। লাল সুতা বেঁধে আনুন।’
করিম সাহেব কিছু বললেন না, তাকিয়ে রইলেন। সম্ভবত রসিকতাটা তিনি ধরতে পারেন নি।
‘করিম সাহেব।’
‘জ্বি স্যার।’
‘আপনাদের ওখানে পোস্ট অফিস আছে তো?’
‘জ্বি আছে। আমাদের গ্রামে নাই। শিবপুরে আছে। আমরা পোস্টাপিসের জন্যে কয়েকবার দরখাস্ত দিয়েছি। পোস্ট মাস্টার জেনারেলের এক শালার বিবাহ হয়েছে আমাদের গ্রামে, মুনশিবাড়িতে। উনার মারফতে গত বৎসর একটা দরখাস্ত দিয়েছি। উনি আশা দিয়েছেন—হয়ে যাবে।’
‘শিবপুর আপনাদের গ্রাম থেকে কতদূর?’
‘বেশি না, চার থেকে সাড়ে চার মাইল।’
‘আমি আমার স্ত্রীর কাছে একটা চিঠি পাঠাতে চাই—পৌঁছানোর সংবাদ।’
‘কোনো চিন্তা নাই স্যার। চিঠি এবং টেলিগ্রাম দু’টারই ব্যবস্থা করে দেব।’
শওকত সাহেব সুটকেস খুলে চিঠি লেখার কাগজ বের করলেন। বৃষ্টি আবার জোরেশোরে এসেছে। এক হাত দূরের জিনিস দেখা যায় না এমন বৃষ্টি। এর মধ্যেই নৌকা ছাড়া হয়েছে। নৌকার মোট তিনজন মাঝি। একজন হাল ধরে বসে আছে। দু’জন দাঁড় টানছে। বৃষ্টির পানিতে ভেজার জন্যে তাদের মধ্যে কোনো বিকার নেই। যে দু’জন দাঁড় টানছে তাদের দেখে মনে হচ্ছে—দাঁড় টানার কাজে খুব আরাম পাচ্ছে। করিম সাহেব ছাতা মাথায় দিয়ে বাইরে বসে আছেন। শওকত সাহেবের অসুবিধা হবে এই কারণে তিনি ছই-এর ভেতর যেতে রাজি হন নি। শওকত সাহেব সুটকেসের উপর কাগজ রেখে পেন্সিলে দ্রুত লিখে যাচ্ছেন। তাঁর লেখা কাঁচা তবে গোটা-গোটা—দেখতে ভালো লাগে।
কল্যাণীয়া,
হাতের লেখা কি চিনতে পারছ?
নৌকায় বসে লেখা—কাজেই অক্ষরগুলো এমন চ্যাপ্টা দেখাচ্ছে।
ঠাকরোকোনা স্টেশনে ঠিকমতোই পৌঁছেছি। মোফাজ্জল করিম সাহেব উপস্থিত ছিলেন। নাম শুনে মনে হয়েছিল ভদ্রলোকের দাড়ি থাকবে, মাথায় টুপি থাকবে এবং মাপে লম্বা, ন্যাপথলিনের গন্ধ মাখা কোট থাকবে গায়ে। কোটের অংশ শুধু মিলেছে। ভদ্রলোক সারাক্ষণ কথা বলেন। অনায়াসে তাঁকে কথা-সাগর উপাধি দেয়া যায়। কথা-বলা লোকজন কাজকর্মে কাঁচা হয়। ভদ্রলোক তা না। তাঁকে সর্বকর্মে অতি উৎসাহী মনে হল। তাঁর অতিরিক্ত রকমের উৎসাহে ঘাবড়ে যাচ্ছি। ভাত খাওয়ার সময় ভদ্রলোক নিজে লেবু চিপে আমার পাতে ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন। অবস্থাটা ভাবো।
আসার সময় তোমার মুখ কালো বলে মনে হল। তাড়াহুড়ায় জিজ্ঞেস করা হয় নি। তাছাড়া ভাবলাম বিদায়-মুহূর্তে কোনো কারণে আমার উপর রাগ করে থাকলেও তা প্রকাশ করবে না। ইদানীং কথা চেপে রাখার এক ধরনের প্রবণতা তোমার মধ্যে লক্ষ করছি। একবার অবশ্যি আমাকে বলেছিলে “তোমাকে কিছু বলা আর গাছকে কিছু বলা প্রায় একরকম। গাছকে কিছু বললে গাছ শুনতে না পেলেও গাছের ডালে বসে থাকা পাখিরা শুনতে পায়। তোমাকে বললে কেউ শুনতে পায় না।” এই কথাগুলো তুমি ঠাট্টা করে বলেছ; না মনের বিশ্বাস থেকে বলেছ আমি জানি না। মন থেকে বললেও আমার প্রতিবাদ করার কিছু নেই। আমি নিজেও বুঝতে পারছি আজকাল তোমার কথা মন দিয়ে শুনছি না। আমাকে বলার মতো কথাও কি তোমার খুব বেশি আছে? সংসার, ছেলেমেয়ে নিয়ে তুমি ব্যস্ত হয়ে পড়েছ। রাত দশটা পর্যন্ত বাচ্চাদের পড়িয়ে, খাইয়ে-দাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে তুমি যখন ক্লান্ত—পরিশ্রান্ত তখন আমি বসছি লেখা নিয়ে।
সময় কোথায়? খুব সূক্ষ্ম হলেও সংসার নামক সমুদ্রে দু’টি দ্বীপ তৈরি হয়েছে। একটিতে আমি, অন্যটিতে ছেলেমেয়ে নিয়ে তুমি। তাই নয় কি?
স্বেচ্ছানির্বাসনে কিছুদিন কাটাতে এসেছি। পরিকল্পনা মতো লেখালেখি করব, তার ফাঁকে অবসরের সময়টা আমাদের জীবন নিয়ে চিন্তা-ভাবনাও করব। জীবনের একঘেয়েমিতে আমি খানিকটা ক্লান্ত। নতুন পরিবেশ সেই ক্লান্তি দূর করবে; না আরো বাড়িয়ে দেবে কে জানে! ভালো লাগবে বলে মনে হচ্ছে না। সারাজীবন শহরে থেকেছি। শহরের সুবিধা ও অসুবিধায় এত অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে, নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানো কষ্টকর হবে বলে মনে হয়। কষ্ট করার একটা বয়স আছে। সেই বয়স পার হয়ে এসেছি। তাছাড়া এখনি হোমসিক বোধ করছি। আসার সময় স্বাতীর জ্বর দেখে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম ঘর থেকে বেরুবার আগে তার কপালে চুমু খেয়ে আসব। ড্রাইভার নিচে এত ঘনঘন হর্ন বাজাতে লাগল যে, সব ভুলে নিচে নেমে এলাম। বেচারির জ্বরতপ্ত কপালে চুমু খাওয়া হল না। আমার হয়ে ওকে আদর করে দিও। আমার থাকার জায়গা কী করা হয়েছে এখনো জানি না। মোফাজ্জল করিম সাহেবকে কিছু জিজ্ঞেস করি নি। জিজ্ঞেস করলেই তিনি লং প্লেইং রেকর্ড চালু করবেন। তা শুনতে ইচ্ছা করছে না।
আস্তানায় পৌঁছেই আস্তানা সম্পর্কে তোমাকে জানাব। জায়গাটা পছন্দ হলে তোমাকে লিখব।
সবাইকে নিয়ে চলে আসবে। তবে জায়গা পছন্দ হবে বলে মনে হচ্ছে না।
অনেক অনেক দিন পর তোমাকে দীর্ঘ চিঠি লিখলাম।
ভালো থাক এবং সুখে থাক।
প্রচুর বানান ভুল। এইভাবে টাইপিং এ সমস্যা হলে ছবি তুলে পিডিএফ বানিয়ে দেওয়া যায়।
পিডিএফ পাওয়া যায় অনলাইনে। তবে পিডিএফ অস্পষ্ট থাকলে আমাদেরও ভুল বেশি হয়। এরকম হলে যদি ধরিয়ে দেন, বা যে বইগুলোতে বেশি বেশি ভুল সেগুলো ধরিয়ে দিলে আমরা আবার ভাল প্রিন্টের পিডিএফ সংগ্রহ করে বইগুলো নতুন করে দিতে পারি। ধন্যবাদ।