নীলে কয়লা (অর্থাৎ জুয়াচোরের অদ্ভুত সাহস!)
প্রথম পরিচ্ছেদ
দারোগার দপ্তরে এ পর্যন্ত যে সকল প্রবন্ধ বাহির হইয়াছে, তাহার অধিকাংশই পুরাতন ঘটনা বলিয়া কোন কোন পাঠক দুই একটি নূতন ঘটনা লিখিবার নিমিত্ত আমাকে বার বার অনুরোধ করেন। তাঁহাদিগের অনুরোধ রক্ষা করিবার বাসনায় ইংরাজী ১৮৯৪ সালের একটি ঘটনা আজ এইস্থানে বিবৃত করিলাম। আমার বোধ হয়, সংবাদ—পত্র-পাঠকারী পাঠকবর্গের মনে এই ঘটনা এখনও উত্তমরূপ জাগরূক আছে।
কলিকাতার ভিতর হিল্জার কোম্পানির আফিস সৰ্ব্বজনবিদিত। ভিন্ন দেশীয় দ্রব্যাদি আমদানী করিতে ও এদেশীয় দ্রব্য সকল রপ্তানি করিতে, হিন্জার কোম্পানি সৰ্ব্বপ্রধান না হইলেও নিতান্ত সামান্য নহে। ইংরাজী ১৮৯৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রারম্ভেই হিন্জার কোম্পানির নিকট হইতে একখানি পত্র আমরা প্রাপ্ত হইলাম। সেই পত্রের সারমর্ম্ম এইরূপ ছিল;–
“আমরা আমাদিগের লণ্ডন নগরের আফিস হইতে এক পত্র পাইয়াছি। ইহার পূর্ব্বে আমরা যে সকল নীলের বাক্স কলিকাতা হইতে ‘দালমাটা’ জাহাজে রপ্তানি করিয়াছিলাম, তাহার সমস্তই সময় মত লণ্ডনে গিয়া উপস্থিত হয়, ও নিয়মিতরূপে সমস্তই বিক্রীত হইয়া যায়। কিন্তু এখন জানিতে পারা যাইতেছে যে, সেই সকল নীলের বাক্সের মধ্যে কেবলমাত্র চারিটি বাক্সের ভিতর নীলের পরিবর্তে কয়লা পাওয়া গিয়াছে। এ বড় সামান্য জুয়াচুরি নহে। নীল যে প্রকার অধিক মূল্যের দ্রব্য, তাহাতে যদি সেই নীলের পরিবর্তে ক্রমে এইরূপ আরও অধিক কয়লা বাহির হয়, তাহা হইলে কোম্পানির যে বিলক্ষণ ক্ষতি হইবে, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। এই ভয়ানক জুয়াচুরি যে লণ্ডন শহরে হইয়াছে, তাহা আমাদিগের বোধ হয় না। আমাদিগের বিবেচনায় উহা কলিকাতাতেই হইবার সম্ভাবনা। এই নিমিত্ত অনুরোধ যে, কোন উপযুক্ত এবং বিশ্বাসী কর্মচারীর হস্তে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের ভার অর্পিত হয়। নিবেদন ইতি।”
হিজার কোম্পানির উক্ত পত্রানুসারে পরিশেষে আমারই হস্তে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের ভার অর্পিত হইল। হিজার কোম্পানির আফিসে গিয়া জানিতে পারিলাম যে, বাক্সবন্দী নীল সকল ক্রীত হইয়া প্রথমে তাহাদিগের গুদামে আনীত হয়, এবং ক্রমে ক্রমে লণ্ডনে পাঠাইবার উপযুক্ত পরিমাণ মালের সংগ্রহ হইলে সেই সমস্ত বাক্স গুদাম হইতে বাহির করা হয়। প্রত্যেক বাক্সটি খুলিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখা যায় যে, উহার প্রত্যেকের ভিতর উৎকৃষ্ট বা অপকৃষ্ট কি প্রকারের নীল আছে। যে বাক্সের ভিতর যে প্রকারের নীল পাওয়া যায়, তাহার একটি হিসাব প্রস্তুত হয়। যেমন একটি একটি করিয়া বাক্সের পরীক্ষা হইয়া যায়, অমনি সেই বাক্স বন্ধ করা হয় ও তখনই চট দিয়া উক্ত বাক্স উত্তমরূপে মোড়াই করিয়া দ্রব্যের গুণাগুণ অনুসারে উক্ত চটের উপর চিহ্ন ও নম্বর লিখিয়া দেওয়া হয়। এইরূপে সমস্ত বাক্সের পরীক্ষা ও নম্বরাদি দেওয়া হইলে, পরিশেষে গরুর গাড়িতে বোঝাই দিয়া সেই সকল নীলের বাক্স জেটিতে পাঠাইয়া দেওয়া হয়। নীলের বাক্স সকল প্রায়ই বড় ও ভারি হইয়া থাকে; সুতরাং একখানি গরুর গাড়িতে চারিটি বাক্সের অধিক কখনই বহন করিতে পারে না। জেটীর ও কোম্পানির দুইজন সরকার জেটীতে একত্র উপস্থিত থাকিয়া সেই সকল বাক্স মিলাইয়া লয়, ও পরিশেষে উহা জাহাজে বোঝাই করাইয়া দেয়।
আরও জানিতে পারিলাম যে, যে চারিটি বাক্সের ভিতর নীলের পরিবর্তে কয়লা পাওয়া গিয়াছে, উহাদের একটি বাক্স ১৮৯৩ সালের ১৮ই ডিসেম্বর তারিখে মোরাণ কোম্পানির নীলের হাট হইতে ক্রয় করা হয়, অবশিষ্ট তিনটি বাক্সই টমাস কোম্পানির নিকট হইতে হিন্জার কোম্পানি ১৯শে ডিসেম্বর তারিখে ক্রয় করেন। সেইস্থান হইতে সেই সকল নীলপূর্ণ বাক্স অপর বাক্সের সহিত হিজার কোম্পানির গুদামে নীত হয়। সেইস্থানে কয়েক দিবস রক্ষিত হইবার পর পূৰ্ব্ববর্ণিত নিয়মানুসারে ২৩শে ডিসেম্বর তারিখে অন্যান্য অনেক নীলের বাক্সের সহিত সেই বাক্স চারিটিও ‘দালমাটা’ জাহাজে লণ্ডন নগরীতে প্রেরণ করা হয়। সেই চারিটি বাক্সের ভিতর যে সকল নীলবড়ি বোঝাই ছিল, তাহা অযোধ্যা প্রদেশে এদেশীয় লোকের কুঠিতে প্রস্তুত। সুতরাং প্রত্যেক নীলবড়ির উপর কোনরূপ নম্বর বা চিহ্ন ছিল না।
এই সকল ব্যাপার জানিয়া আমার মনে দুইটি প্রশ্ন আসিয়া আপনা-আপনিই উদয় হইল।
১ম। কোন সময়ে এবং কোন স্থানে নীলের পরিবর্তে বাক্সের ভিতর কয়লা প্রবেশ করিল?
২য়। এরূপ সাহসিক কার্য্যে কোন ব্যক্তিই বা সহজে হস্তক্ষেপ করিতে সমর্থ হইল?
উপরি উক্ত দুই প্রশ্নের উত্তরে ভাবিলাম, যে সময় এই নীল ক্রয় হইয়াছে, বা ক্রয়ের পর হিন্জার কোম্পানির গুদামে নীত হইয়াছে, সেই সময়ে এরূপ জুয়াচুরি হইবার সম্ভাবনা নহে। কারণ, জাহাজে বোঝাই করিবার মানসে যখন সেই সকল বাক্স গুদাম হইতে বাহির করিয়া পরীক্ষা করা হয়, সেই সময় পর্য্যন্ত সেই সকল বাক্সের মধ্যস্থিত নীলের কিছুমাত্র ব্যতিক্রম ঘটে নাই। তাহার পর বাক্সে চট মোড়াই হইয়া তাহার উপর নম্বর পড়িয়াছে। এরূপ অবস্থায় নিম্নলিখিত কয়েকটি স্থান ব্যতিরেকে এই জুয়াচুরি হইবার অপর কোনরূপ সম্ভাবনা নাই।
১ম। হিল্ডার কোম্পানির গুদাম হইতে গরুর গাড়ি বোঝাই হইয়া যে সময় নীলের বাক্স জেটিতে নীত হইয়াছে সেই সময় এই ঘটনা ঘটিতে পারে।
কিন্তু হিন্জার কোম্পানির গুদাম হইতে জেটী বহুদূরবর্তী নহে, বরং নিকটে। সুতরাং গুদাম হইতে জেটিতে মাল লইয়া যাইতে যে সময়ের আবশ্যক হয়, সে নিতান্ত অল্প। সুতরাং সেই অল্প সময়ের মধ্যে এরূপ একটি কার্য্য শেষ করা নিতান্ত সহজ নহে। কারণ, প্রথমতঃ যে চটের দ্বারা বাক্স মোড়া থাকে, সেই চট সবিশেষ সতর্কতার সহিত খুলিতে হইবে। তাহার পর বাক্স খুলিয়া তাহার ভিতর হইতে নীল সকল বাহির করিয়া লইতে হইবে, পরিশেষে কয়লা দ্বারা সেই বাক্স পরিপূর্ণ করিতে হইবে, এবং পুনরায় বাক্স বন্ধ করিয়া তাহার উপর সেই চট অতীব সাবধানের সহিত মুড়িতে হইবে। এই সকল কাৰ্য্য নিতান্ত অল্প সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হইতে পারে না। তাহার উপর যে গাড়িতে সেই সকল মাল বোঝাই ছিল, সেই গাড়োয়ানকে পর্য্যন্ত হস্তগত করিবার প্রয়োজন।
২য়। গরুর গাড়ি হইতে মাল নামাইবার পর জাহাজে উঠাইবার পূর্ব্বে যে অল্প সময়ের নিমিত্ত বাক্সগুলি জেটীর ভিতর রক্ষিত হয়, সেই সময়ের মধ্যে এই জুয়াচুরি হইলেও হইতে পারে।
কিন্তু জেটির ভিতর এইরূপভাবে জুয়াচুরি করিতে হইলে কেবলমাত্র জেটির সরকার ও হিজার কোম্পানির সরকার একত্র হইলেও এ কাৰ্য্য হইতে পারে না। জেটির অধিকাংশ লোককেই হস্তগত করিবার প্রয়োজন হয়।
৩য়। জাহাজের ভিতর এ কার্য্য অনায়াসেই সম্পন্ন হইতে পারে। কারণ, একে অনেক দিবস পর্য্যন্ত মাল সকল জাহাজের ভিতর থাকে, তাহার উপর জাহাজে কয়লারও অভাব নাই।
কিন্তু জাহাজের উচ্চ কর্মচারী হইতে সামান্য খালাসী পর্য্যন্ত সকলেই এক ষড়যন্ত্রে মিলিত না হইলে, দুই এক জনের দ্বারা এই কার্য সম্পন্ন করা নিতান্ত সহজ নহে।
৪র্থ। মাল সকল লণ্ডনে উপনীত হইবার পর লণ্ডনে এ কার্য্য হইলেও হইতে পারে।
কিন্তু বিলাতের অবস্থা আমি অবগত নহি। সুতরাং কি প্রণালীতে সেইস্থানের কার্য্য সকল নির্ব্বাহ হয়, তাহাও আমার বিদিত নহে। এরূপ অবস্থায় সেইস্থানে কোনরূপে এই কাৰ্য্য সম্পন্ন হইতে পারে বা না পারে, তাহা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নহে।
এই প্রকার অনেক কথা আমার মনে আসিয়া উপনীত হইতে লাগিল। কিন্তু কোন পন্থা অবলম্বন করিলে, এই মোকদ্দমার উপায় হইতে পারে, তাহার কিছুমাত্র স্থির করিতে পারিলাম না। যে সকল বাক্সের ভিতর হইতে কয়লা বাহির হইয়াছে, সেই সকল বাক্স এইস্থানে প্রেরিত হয় নাই, তাহা বিলাতে। সুতরাং উহা দেখিবার সুযোগ নাই; কাজেই কোন্ স্থান হইতে সেই সকল বাক্স ক্রয় করা হইয়াছে, সে সম্বন্ধে কোনরূপ অনুসন্ধান করিবারও উপায় নাই। উপরন্তু সেই সকল বাক্সের ভিতর যে সকল নীলবড়ি ছিল, তাহাতে নম্বরাদি কিছুই না থাকায় সেই সকল দ্রব্য অপহরণকারী ব্যক্তিগণ কর্তৃক এইস্থানে বিক্রয় করা হইয়াছে কি না, তাহাও জানিবার কোনরূপ উপায় নাই। এরূপ অবস্থায় কিরূপে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিব, তাহাই ভাবিতে ভাবিতে সেইদিবস অতিবাহিত হইয়া গেল।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
আমার প্রথম দিবসের অনুসন্ধানে কোন ফল ফলিল না। কিন্তু দ্বিতীয় দিবস অনুসন্ধানে বহির্গত হইবার পূর্ব্বে হঠাৎ আমার মনে হইল যে, কলিকাতায় সমস্ত গরুর গাড়িই মিউনিসিপাল আফিসে টেক্স দিতে বাধ্য আছে। সুতরাং প্রত্যেক গাড়িতেই মিউনিসিপালিটির স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র নম্বর আছে। আরও মনে হইল যে, ব্যবসায়ী ব্যক্তিগণ গরুর গাড়ি করিয়া কোনস্থান হইতে দ্রব্যাদি স্থানান্তরে পাঠাইবার সময় প্রত্যেক গাড়ির সহিত লোক পাঠাইতে পারেন না। তাঁহারা কেবল গাড়ির নম্বর লিখিয়া লইয়া গাড়োয়ানদিগের উপর বিশ্বাস করিয়া দ্রব্যাদি স্থানান্তরে পাঠাইয়া থাকেন। এরূপ অবস্থায় হিন্জার কোম্পানির গুদাম হইতে যদি অবগত হইতে পারা যায় যে, যে দিবসের প্রেরিত দ্রব্যের মধ্যে নীলের পরিবর্তে চারি বাক্স কয়লা পাওয়া গিয়াছে, সেই দিবস কোন্ কোন্ নম্বরের গরুর গাড়িতে সেই সকল দ্রব্যাদি জেটিতে পাঠাইয়া দেওয়া হইয়াছিল, তাহা হইলে সেই সকল গরুর গাড়ির নম্বর অবগত হইতে পারিয়া ক্রমে গাড়োয়ানগণকেও বাহির করিতে পারিব। তখন তাহাদিগের মধ্য হইতে যদি কোনরূপ কথা বাহির হইয়া যায়, তাহা হইলে সেই সামান্য সূত্রে এই মোকদ্দমার উপায় হইলেও হইতে পারে। এই ভাবিয়া দ্রুতপদে হিজার কোম্পানির আফিসে গমন করিলাম। সেইস্থানে গমন করিয়া জানিতে পারিলাম, এইরূপ ভাবে যে সকল দ্রব্যাদি গরুর গাড়িতে বোঝাই করিয়া স্থানান্তরে প্রেরণ করা হয়; সেই সকল গাড়ির নম্বর লিখিবার নিমিত্ত একখানি স্বতন্ত্র খাতা আছে। সেই খাতার প্রত্যেক পৃষ্ঠা দুই অংশে বিভক্ত। নম্বর ও গাড়োয়ানের নাম প্রভৃতি লেখা হইলে, নির্দ্দিষ্ট স্থানে লইয়া যাইবার নিমিত্ত তাহার এক অংশ গাড়োয়ানকে দেওয়া হয়, অপর অংশ আফিসে রাখা হইয়া থাকে। এই ব্যাপার জানিতে পারিয়া সেই সকল গাড়োয়ানের নাম ও গাড়ির নম্বর পাইব, মনে এইরূপ আশা হইল। কিন্তু সেই খাতা বাহির করিয়া যখন দেখিলাম, তখনই আমার সকল আশা দূরে পলায়ন করিল। সেই খাতায় যে সকল বিষয় লিখিয়া রাখার নিয়ম, তাহার কিছুই লেখা নাই, সকল পৃষ্ঠাই সাদা। আমার মনে যে একটু সামান্য আশার উদয় হইয়াছিল, এই অবস্থা দেখিয়া সে আশা দূরে পলায়ন করিল। হিন্জার কোম্পানির যে কর্মচারীর হস্তে সেই কার্য্যের ভার ছিল, তাহাকে সহস্র গালি দিতে দিতে সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম।
এই অবস্থার পর অনুসন্ধানের অন্য কোনরূপ উত্তম পন্থা প্রাপ্ত হইলাম না; তথাপি কয়েক দিবস ধরিয়া সেই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিলাম। কিন্তু সবিশেষ কোন ফলই প্রাপ্ত হইলাম না; অথচ ফেব্রুয়ারি মাসের দশ এগার দিবস ক্রমে গত হইয়া গেল।
১৮৯৪ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি তারিখের সন্ধ্যার কিছু পূর্ব্বে একটি লোক আসিয়া আমাকে সংবাদ দিল, “হিত্জার কোম্পানির আফিসে পুনরায় কি গোলযোগ হইয়াছে, এই নিমিত্ত আপনাকে সেইস্থানে লইয়া যাইবার নিমিত্ত আমি আসিয়াছি।”
উহার কথা শ্রবণ করিয়া আমি কহিলাম, “কিরূপ গোলযোগ হইয়াছে, তাহার কিছু তুমি বলিতে পার কি?”
উত্তরে সেই কহিল, “না মহাশয়! আমি আপনাকে যাহা বলিলাম, তাহার অধিক আর কিছুই আমি অবগত নহি।”
উহার উত্তর শ্রবণ করিয়া আমি আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না, তখনই তাহার সহিত হিজার কোম্পানির আফিসে গমন করিলাম। সেইস্থানে গিয়া জানিতে পারিলাম যে, পূর্ব্ববর্ণিত নিয়মানুসারে সেই দিবস অপরাহ্ণ তিনটার সময় আট গাড়ি নীল হিন্জার কোম্পানির আফিস হইতে দুই নম্বর জেটীতে পাঠাইয়া দেওয়া হয়। যে সকল গরুর গাড়িতে বোঝাই দিয়া সেই সকল নীল পাঠান হয়, তাহার মধ্যে এক গাড়িতে কেবলমাত্র তিন বাক্স নীল ছিল, অবশিষ্ট সাত গাড়িতে চারিটি করিয়া বাক্স থাকে। এই সমস্ত মাল “সিটি অব ডবলিন” জাহাজে বোঝাই দিয়া লণ্ডন শহরে লইয়া যাইবার নিমিত্ত প্রেরিত হয়। সমস্ত বাক্স গুদাম হইতে জেটীতে প্রেরিত হইবার কিয়ৎক্ষণ পরে আফিসের জনৈক ঊর্দ্ধ তন কর্মচারী বাক্স সকল নিয়মিতরূপে জেটীতে আনীত হইয়াছে কি না, তাহা জানিবার নিমিত্ত জেটীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন। অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পরিলেন যে, এক গাড়ি ব্যতীত সমস্ত বাক্সই জেটীতে পৌঁছিয়াছে। যে গাড়ি আইসে নাই, তাহাতে চারিটি বাক্স আছে ও উহার মূল্য পাঁচ সহস্র মুদ্রার ন্যূন নহে। এই অবস্থা দেখিয়া তাঁহার পূর্ব্বের চারি বাক্সের কথা মনে হইল। তখন তিনি নিতান্ত চিন্তিত হইয়া জেটী হইতে বহির্গত হইলেন, ও তাঁহার অধীনস্থ অনেক কর্ম্মচারীকে সেই গরুর গাড়ির সন্ধানের নিমিত্ত প্রেরণ করিলেন।
প্রায় একঘণ্টা পরে প্রেরিত কৰ্ম্মচারীগণের মধ্যে এক ব্যক্তি এক গাড়ি নীলের সহিত আসিয়া উপস্থিত হইল। বাবু নম্বরের সহিত বাক্সগুলি মিলাইয়া দেখিলেন। দেখিলেন, তাঁহাদিগেরই প্রেরিত বাক্স। তখন তিনি কর্ম্মচারীর উপর বিলক্ষণ সন্তুষ্ট হইয়া তাঁহাকে ধন্যবাদ প্রদান করিলেন, এবং পরদিবস তাঁহার মনিব কর্ম্মচারীর নিকট তাঁহার পক্ষে দুই চারি কথা বলিবেন বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিলেন। এদিকে জেটী হইতে সরকার আসিয়া সংবাদ দিল যে, গাড়ি জেটীতে গিয়া প্রথমে উপনীত হয় নাই, একটু বিলম্বে সেই গাড়ি জেটীতে গিয়া উপনীত হইয়াছে। সমস্ত মাল জাহাজে বোঝাই হইয়া গিয়াছে, এবং নিয়মিতরূপ রসিদও পাওয়া গিয়াছে।
সরকারের কথা শ্রবণ করিয়া বাবু একবারে বিস্মিত হইয়া পড়িলেন। এদিকে সরকার বলিতেছে, আট গাড়িতে যে সকল মাল গিয়াছিল, তাহার সমস্তই জাহাজে বোঝাই হইয়া গিয়াছে, ওদিকে চারি বাক্স মাল গাড়ি-সহিত তাহার সম্মুখেই রহিয়াছে। এরূপ অবস্থায় কি করা কর্তব্য, তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, বাবু আমাকে সংবাদ পাঠাইয়া দিয়াছেন।
এই সকল ব্যাপার শ্রবণ করিয়া এবং মাল-সহিত গরুর গাড়ি সম্মুখে দেখিয়া আমিও বিস্মিত হইলাম। তখন বাবুকে সঙ্গে লইয়া আমি জাহাজে গমন করিলাম, এবং সেই জাহাজে যে সকল বাক্স বোঝাই করা হইয়াছিল, তাহা গণিয়া দেখিলাম। দেখিলাম, উহাতে প্রকৃতই একত্রিশ বাক্স আছে। এই ব্যাপার দেখিয়া আমিও অতিশয় বিস্মিত হইলাম। কারণ, আমি পূর্ব্বে মনে করিয়াছিলাম, সরকারের ভ্রম হইয়াছে। প্রকৃত পক্ষে সাতাশ বাক্স বোঝাই দিয়া একত্রিশ বাক্সের রসিদ গ্রহণ করিয়াছে।
যখন দেখিলাম, বাক্স সকল জাহাজে বোঝাই করিতে কোনরূপ ভ্রম হয় না, তখন সেই সকল বাক্সের নম্বর সকল মিলাইয়া দেখিতে আরম্ভ করিলাম। ক্রমে দেখিলাম, যে নম্বরের চারিটি বাক্স এখনও সেই গরুর গাড়ির উপর রহিয়াছে, সেই নম্বরের ও সেই প্রকারে চারিটি বাক্স জাহাজের ভিতরও রহিয়াছে। তখন এই ব্যাপার দেখিয়া সেই বাক্স চারিটি জাহাজ হইতে নামাইয়া জেটির ভিতর আনাইলাম, এবং সবিশেষরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম। দেখিলাম, গরুর গাড়ির উপরিস্থিত বাক্স চারিটির সহিত ইহার কিছুমাত্র প্রভেদ নাই। উহাদের মোড়াই করা চট একই প্রকারের। সেই সকল চটে যেরূপ কাল কাল আঁজি আছে, তাহাও একই প্রকারের, এবং নম্বরও ঠিক্ একই প্রকারের, সামান্যমাত্র প্রভেদ নাই।
এই ব্যাপার দেখিয়া মনের ভিতর আরও অধিক পরিমাণে বিস্ময় আসিয়া উপস্থিত হইল। তখন সেই সকল বাক্স খুলিয়া উহার ভিতর নীল আছে, কি অপর কোন দ্রব্যাদি আছে, তাহা দেখিবার নিতান্ত ইচ্ছা হইল। ইচ্ছা যাহা হইল, কাৰ্যোও তখনই তাহা পরিণত করিলাম। যে চারিটি বাক্স জাহাজ হইতে নামাইয়া লইয়াছিলাম, প্রথমে তাহাই খুলিয়া ফেলিলাম। খোলা হইলে দেখিলাম যে, নীলের পরিবর্তে উহা পাথুরিয়া কয়লায় পরিপূর্ণ। এই ব্যাপার দেখিয়া আমি যে কেবলমাত্র বিস্মিত হইলাম, তাহা নহে; তখন বুঝিতে পারিলাম পূর্ব্বে লণ্ডন নগরে যে চারিটি বাক্সের ভিতর হইতে নীলের পরিবর্তে কয়লায় বাহির হইয়াছিল, সেই সকল বাক্স কোথায় পরিবর্তিত হইয়াছে। পূৰ্ব্বে মনে করিয়াছিলাম যে, এ জুয়াচুরি এখানে হয় নাই, লণ্ডন নগরেই হইয়াছে। কিন্তু এখন বুঝিতেছি, উহা লণ্ডনের কার্য্য নহে, এইস্থানেই সম্পাদিত হইয়াছে।
গরুর গাড়িতে যে বাক্স চারিটি বোঝাই ছিল, পরিশেষে তাহাও খুলিয়া দেখিবার ইচ্ছা হইল। দেখিলাম, উহার ভিতর যে প্রকারের নীল বোঝাই ছিল, সেই প্রকারই আছে, তাহার কিছুমাত্র বিপর্যয় ঘটে নাই।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
বাক্সগুলির এইরূপ অবস্থা দেখিয়া কাহা কর্তৃক এবং কিরূপে কোন স্থান হইতে এই সকল কাৰ্য্য সম্পাদিত হইয়াছে, তাহা জানিবার নিমিত্ত আমার নিতান্ত কৌতূহল জন্মিল। কিন্তু কি উপায়ে এই সকল বিষয় জানিতে পারিব, তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, চারি বাক্স নীল সহিত যে গাড়ি পাওয়া গিয়াছিল, সেই গাড়ির গাড়োয়ানকে ডাকিলাম। গাড়োয়ান নিকটেই ছিল, ডাকিবামাত্র সে আমার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম,
তোমার গাড়িতে যে চারিটি নীলের বাক্স বোঝাই ছিল, তাহা তুমি কোথা হইতে পাইয়াছিলেন?”
গাড়োয়ান। আমি আমার গাড়ি লইয়া কয়লা ঘাটের নিকট দিয়া গমন করিতেছিলাম, সেই সময়ে একটি বাবু আমাকে ডাকিলেন। আমি গাড়ি ফিরাইয়া তাঁহার নিকট গমন করিলে, তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “গাড়োয়ান তুমি ভাড়া যাইবে?” উত্তরে আমি কহিলাম, “যাইব।” তখন তিনি আমার গাড়িতে ঐ চারিটি বাক্স অপর কুলির সাহায্যে উঠাইয়া দিলেন।
আমি। এ বাক্স কয়েকটি কোথায় ছিল?
গাড়োয়ান। এগুলি সেই কয়লাঘাটের নিকটে এক স্থানে পড়িয়াছিল।
আমি। বাক্স চারিটি তোমার গাড়িতে বোঝাই করিবার পূর্ব্বে, উহা কোথায় লইয়া যাইতে হইবে, তাহা তুমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে কি?
গাড়োয়ান। জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম বৈ কি। কোথায় লইয়া যাইতে হইবে, তাহা প্রথমে জিজ্ঞাসা করিয়া আমার গাড়ির ভাড়া স্থির করিয়া লই। তাহার পর সেই সকল বাক্স আমার গাড়িতে বোঝাই করি।
আমি। কোথায় লইয়া যাইবার কথা হয়?
গাড়োয়ান। তেরহেটি বাজারে লইয়া যাইবার কথা হইয়াছিল।
আমি। ভাড়া হইয়াছিল কত?
গাড়োয়ান। ছয় আনামাত্র।
আমি। তেরহটি বাজারে কাহার দোকানে লইয়া যাইবার কথা হইয়াছিল?
গাড়োয়ান। কাহার দোকানে লইয়া যাইতে হইবে, তাহা তিনি আমাকে স্পষ্ট করিয়া বলেন নাই। কেবল আমাকে এইমাত্র বলিয়াছিলেন যে, তেরহটি বাজারের যে স্থানে এই মাল লইয়া যাইতে হইবে, তাহা তিনি নিজেই আমাকে দেখাইয়া দিবেন। সেইজন্য তিনি আমার গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে গমন করিবেন, এই কথা আমাকে পূৰ্ব্বেই বলিয়াছিলেন।
আমি। গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে সে আসিয়াছিল কি?
গাড়োয়ান। হাঁ মহাশয়! বরাবর তিনি আমার গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে গমন করিতেছিলেন।
আমি। তুমি সেই লোকটিকে চেন কি?
গাড়োয়ান। না মহাশয়! আমি তাঁহাকে চিনি না। ইহার পূর্ব্বে আমি তাঁহাকে আর কখনও দেখিয়াছি বলিয়া আমার মনে হয় না।
আমি। যে সকল মুটিয়া তোমার গাড়িতে মাল বোঝাই করিয়া দেয়, তাহাদিগকে তুমি চেন?
গাড়োয়ান। তাহাদিগকেও আমি চিনি না। তাহারা রাস্তার নগদা মুটিয়া।
আমি। সেই সকল মুটিয়াকে তুমি যদি এখন দেখিতে পাও, তাহা হইলে চিনিতে পারিবে কি?
গাড়োয়ান। পারিলেও পারিতে পারিব।
আমি। যে বাবু তোমার গাড়ি ভাড়া করিয়াছিল, এবং যে তোমার গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে যাইতেছিল, তাহাকে পুনরায় দেখিলে তুমি চিনিতে পারিবে কি?
গাড়োয়ান। তাহাকে আমি উত্তমরূপে চিনিতে পারিব। হাজার লোকের মধ্য হইতে আমি তাহাকে চিনিয়া বাহির করিতে পারিব।
আমি। তুমি ধরা পড়িলে কি প্রকারে?
গাড়োয়ান। কয়লা ঘাট হইতে মাল বোঝাই করিয়া আমি তেরহেটি বাজার অভিমুখে যাইতেছিলাম। যিনি আমার গাড়ি ভাড়া করিয়াছিলেন, তিনিও আমার গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে ফুটের উপর দিয়া যাইতেছিলেন। কিয়দ্দূর যাইলে পর যিনি আমার গাড়ি এইস্থানে লইয়া আসিয়াছেন, সেই বাবুকে দেখিতে পাই। তিনি আমার নিকটে আসিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করেন যে, এ মাল আমি কোথায় লইয়া যাইতেছি। উত্তরে আমি প্রকৃতকথা বলিলাম, কিন্তু তাহাতে তিনি সন্তুষ্ট না হইয়া বরং আমাকে অনর্থক গালি প্রদান করিলেন ও কহিলেন যে, আমি এই দ্রব্যাদি চুরি করিয়া লইয়া যাইতেছি, ইহা হিলজার কোম্পানির মাল এবং তিনি সেই কোম্পানির একজন কর্ম্মচারী। এই কথা শ্রবণ করিয়া কর্মচারীর কথা প্রথমে আমি বিশ্বাস করিলাম না। অধিকন্তু তাঁহার কথা যে মিথ্যা, তাহা প্রতিপাদন করিবার নিমিত্ত যে বাবু আমার গাড়িতে মাল বোঝাই করাইয়া দিয়াছিলেন, এবং যিনি আমার সঙ্গে সঙ্গে যাইতেছিলেন, তাঁহাকে ডাকিবার নিমিত্ত পশ্চাৎ ফিরিলাম। কিন্তু তাঁহাকে আর দেখিতে পাইলাম না। তথাপি আমি কোম্পানির কর্মচারীর কথায় বিশ্বাস করিতে পারিলাম না, বা তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া মাল-সমেত গাড়ি আফিসে ফিরাইয়া লইয়া যাইতে চাহিলাম না। তখন কৰ্ম্মচারী আমাকে চোর বলিয়া পুলিসের হস্তে সমর্পণ করিতে চাহিলেন। এই অবস্থা দেখিয়া কাজেই আমাকে তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হইতে হইল। কারণ, যাঁহার কথায় বিশ্বাস করিয়া আমি মাল লইয়া যাইতেছিলাম, তাঁহাকে আর খুঁজিয়া পাইলাম না। কর্মচারী, গাড়ি ও মালের সহিত আমাকে কোম্পানির আফিসে লইয়া উপস্থিত করিলেন।
আমি। যে বাবু তোমার গাড়িতে মাল বোঝাই করিয়া দিয়াছিল, তাহার পর আর তাহাকে দেখিতে পাইয়াছ?
গাড়োয়ান। না মহাশয়! আমি তাহাকে আর দেখিতে পাই নাই। আর পাইব কি না, তাহাও বলিতে পারি না।
আমি। যে বাবু তোমার গাড়িতে মাল বোঝাই করিয়া দিয়াছিল, সেই বাবু দেখিতে কি প্রকার? তাহার বয়স কত অনুমান হয়?
গাড়োয়ান। দেখিতে সুন্দর। বয়স বোধ হয়, পঁচিশ বৎসরের অধিক হইবে না।
আমি। তাহার গোঁপ দাড়ি আছে?
গাড়োয়ান। অল্পঅল্প গোঁপ আছে, কিন্তু দাড়ি নাই।
আমি। লম্বা-না বেঁটে?
গাড়োয়ান। লম্বা নহে, নিতান্ত বেঁটেও নহে।
আমি। মোটা না কাহিল?
গাড়োয়ান। মোটা নহে, কাহিলও বলা যায় না।
আমি। তুমি তাহাকে যতদূর দেখিয়াছ, তাহাতে তাহার অবয়বের মধ্যে দাগ বা এমন কোন চিহ্ন আছে বলিতে পার, যাহাতে যে ব্যক্তি তাহাকে না চিনে, সেও তাহাকে দেখিলে চিনিতে পারে?
গাড়োয়ান। এরূপ কোন চিহ্নাদির কথা ত আমার মনে হয় না।
আমি। কিরূপ কাপড় তাহার পরিধানে ছিল?
গাড়োয়ান। পরিধানে ধুতি ছিল।
আমি। গায় কি ছিল?
গাড়োয়ান। গায়ে একটি সাদা কামিজ ছিল বলিয়া আমার মনে হয়।
আমি। চাদর ছিল না?
গাড়োয়ান। না, কিন্তু একখানি র্যাপার ছিল।
আমি। কিরূপ র্যাপার?
গাড়োয়ান। বিলাতী র্যাপার, যাহা আজকাল সকলেই গায় দিয়া থাকেন।
আমি। কি রঙ্গের র্যাপার ছিল, তাহা মনে হয় কি?
গাড়োয়ান। র্যাপারের রং আমার বেশ মনে আছে; কমলা লেবুর যেরূপ রং, উঁহার সেই র্যাপারের রংও সেই প্রকার ছিল।
যে সময় আমার সহিত গাড়োয়ানের এইরূপ কথাবার্তা হইতেছিল, সেই সময় হিন্জার কোম্পানির কর্মচারীও সেইস্থানে উপস্থিত ছিলেন, ও আমাদিগের কথাবার্তা শ্রবণ করিতেছিলেন। আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি বলেন মহাশয়! গাড়োয়ান যাহা বলিল, তাহা প্রকৃত কি না?”
কর্ম্মচারী। আমার সহিত গাড়োয়ানের যে সকল কথাবার্তা হইয়াছিল, গাড়োয়ান তাহা প্রকৃতই বলিয়াছে।
আমি। গাড়োয়ান যেরূপ চেহারার লোকের কথা কহিল, সেইরূপ কোন লোক সেই সময় আপনি গাড়ির নিকটবর্তী কোনস্থানে দেখিয়াছেন কি, বলিতে পারেন?
কৰ্ম্মচারী। এইরূপ চেহারার লোক আমি সেইস্থানে দেখিয়াছি বলিয়া আমার মনে হয় না। তবে কমলা লেবুর রং যেরূপ, সেই প্রকারের একখানি র্যাপার গায়ে দিয়া একটি লোক সেই সময়ে সেইস্থান দিয়া গমন করিতেছিল; কিন্তু সে যে চোর, তাহা আমার বোধ হয় না। কারণ, সে আমাদিগের সকলেরই পরিচিত।
আমি। সকলেরই পরিচিত, এ কথার অর্থ কি?
কর্ম্মচারী। আমাদিগের আফিসে যত লোক কৰ্ম্ম করে তাহাদিগের মধ্যে সকলেই তাহাকে উত্তমরূপে চিনেন।
আমি। তাহার নাম কি?
কর্ম্মচারী। তাহার নাম নফরচন্দ্র পালিত।
আমি। নফরচন্দ্র আপনাদিগের আফিসে সকলের নিকট কিরূপে পরিচিত হইল?
কর্ম্মচারী। আমাদিগের আফিসের গুদাম হইতে যে সরকার দ্রব্যাদি সকল জাহাজে পাঠাইয়া দিয়া থাকেন, কিছুদিবস পূর্ব্বে তিনি ছয় মাসের ছুটি লইয়া আপনার দেশে গমন করেন। সেই কার্য্যে নফরচন্দ্র পালিত নিযুক্ত হইয়া বিলক্ষণ দক্ষতার সহিত ছয়মাস কাল আপনার কার্য্য নির্ব্বাহ করেন। পরিশেষে আমাদিগের পুরাতন সরকার প্রত্যাবর্তন করিলে সেই কাৰ্য্য হইতে তিনি অবসারিত হন। সেই পর্যন্ত আফিসে আর কোন কর্ম্ম খালি হয় নাই। সুতরাং নফরচন্দ্র আর কোন কাৰ্য্যে নিযুক্ত হইতে পারেন নাই; কিন্তু মধ্যে মধ্যে তিনি প্রায়ই আমাদিগের আফিসে আসিয়া থাকেন।
কর্মচারীর নিকট এই সকল বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া মনে মনে স্থির করিলাম যে, নফরের দ্বারা এই কার্য সম্পন্ন হইতে পারুক বা না পারুক, গাড়োয়ানকে কিন্তু একবার দেখাইতে হইবে। এই ভাবিয়া সেই কর্ম্মচারী ও সেই গাড়োয়ানকে লইয়া নফরের বাসা অভিমুখে প্রস্থান করিলাম।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
যে সময় আমরা নফরের বাসায় গিয়া উপনীত হইলাম, তখন রাত্রি প্রায় আটটা বাজিয়া গিয়াছে। নফরকে বাসায় দেখিতে পাইলাম না, কিন্তু অপরাপর লোকজনের নিকট হইতে অবগত হইলাম, সন্ধ্যার কিছু পূর্ব্বে নফর একবার বাসায় আগমন করিয়াছিল। কিন্তু আহারাদি না করিয়া বা কাহাকেও কিছু না বলিয়া, সে বাসা হইতে বহির্গত হইয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে। কোথায় গিয়াছে, তাহা কেহই বলিতে পারিল না। এই ব্যাপার দেখিয়া আমরা সেইস্থান হইতে ত খন চলিয়া আসিলাম। একবার ভাবিলাম এই সকল কার্য্য নফরেরই। গাড়ি সহিত মাল ধৃত হইয়াছে জানিতে পারিয়া ভয়ে পলায়ন করিয়াছে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হইল যে, নফরই যে এই কার্য্য করিবে, তাহারই বা কারণ কি? সে নিজের কোন কাৰ্য্যবশতঃ হয়ত স্থানান্তরে গমন করিয়াছে।
রাত্রি নয়টা বা দশটার সময় পুনরায় নফরের সন্ধানে তাহার বাসায় গমন করিলাম, তখনও তাহাকে পাইলাম না। রাত্রি বারটার পর আর একবার গমন করিলাম, তখনও নফর আপন বাসায় প্রত্যাগমন করে নাই। পরদিবস পুনরায় গমন করিলাম, সে দিবসও তাহার কোন সন্ধান পাইলাম না। এই সকল ব্যাপার দেখিয়া ক্রমেই নফরের উপর সন্দেহ তাধিক জন্মিতে লাগিল। শহরের ভিতর নানাস্থানে তাহার সন্ধানও করিলাম, কিন্তু কোন স্থানেই তাহার কিছুমাত্র সন্ধান পাইলাম না।
এইরূপে শহর ও শহরতলীর নানাস্থানে নফরচন্দ্রের অনুসন্ধান করিতে করিতে ২১শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অতীত হইয়া গেল। কিন্তু কোনস্থানেই তাহার কিছুমাত্র সন্ধান না পাইয়া পরিশেষে তাহার দেশেই গমন করা সাব্যস্ত করিলাম।
পূৰ্ব্বেই অবগত হইয়াছিলাম, নফরচন্দ্র পালিতের বাসস্থান—বাঁকুড়া জেলার অন্তর্গত সোনামুখি থানার অধীন সোনাটিকোল গ্রামে। অতঃপর সেইস্থানে গমন করিয়া তাহার অনুসন্ধান করিতে কৃতসঙ্কল্প হইলাম।
২২শে ফেব্রুয়ারি তারিখে রাত্রি দশটার সময় আমার একমাত্র আরদালি ও নফরকে দেখিলে চিেিত পারিবে, এরূপ একটি লোককে সঙ্গে লইয়া কলিকাতা পরিত্যাগ করিলাম।
২৩শে ফেব্রুয়ারি তারিখের প্রাতঃকালে পাঁচটার সময় বালিগঞ্জ স্টেশনে গিয়া উপনীত হইলাম, সেইস্থান হইতে বাঁকুড়া প্রায় ত্রিশ মাইল। পরদিবস প্রাতঃকাল ছয়টার সময় বালিগঞ্জ হইতে শকটারোহণে বহির্গত হইয়াই প্ৰথম তারাপুর গ্রাম পাইলাম। তাহার পরই দামোদর নদী পার হইয়া কটক রাস্তা বাহিয়া গমন করিতে লাগিলাম। ক্রমে মগা, তেওয়ারিডাঙ্গা, নন্দনপুর, দুর্লভপুর, গঙ্গাজলঘাটি প্রভৃতি অতিক্রম করিয়া গণ্ডেশ্বরী নদীর তীরে গিয়া উপনীত হইলাম। গণ্ডেশ্বরী পার হইলেই বাঁকুড়া শহর। ২৪শে ফেব্রুয়ারি প্রাতঃকাল ছয়টার সময় গণ্ডেশ্বরী পার হইয়া শহরের ভিতর প্রবেশ করিলাম।
২৪শে ফেব্রুয়ারি তারিখে বাঁকুড়ার উচ্চতম পুলিস কর্মচারীর আদেশ লইয়া বৈকাল তিনটার সময় সোনামুখি থানা-অভিমুখে যাত্রা করিলাম।
বাঁকুড়া হইতে সোনামুখি থানা প্রায় ছাব্বিশ মাইল হইবে। পূর্ব্বরূপ গরুর গাড়িতে আরোহণ করিয়া বর্দ্ধমানের পথ বাহিয়া খাসাবুল, রতনপুর, কুলবনা, রাজার বাগান, মারখা, বোনকোটা বালাটুর, চাঁদড়া, জামবাধা, বৃন্দাবনপুর, মুথুরাডাঙ্গা, আনুকুশা, ধালডাঙ্গা, বৌলা প্রভৃতি গ্রাম সকল অতিবাহিত করিয়া, অবশেষে ২৫শে ফেব্রুয়ারি তারিখের প্রাতঃকাল আটটার সময় আমাদের গন্তব্য সোনামুখি থানায় গিয়া উপনীত হইলাম।
থানার দারোগাবাবু সেই সময় থানায় উপস্থিত ছিলেন। যে অভিপ্ৰায় আমি সেইস্থানে গমন করিয়াছি, তাহা তাঁহার নিকট প্রকাশ করায় তিনি তাঁহার অধীনস্থ একজন কর্মচারীকে আমার সাহায্যের নিমিত্ত নিযুক্ত করিলেন। আহারান্তে আমরা সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম, ও দশ মাইলমাত্র পথ অতিবাহিত করিয়া সন্ধ্যা সতাটার সময় কৃষ্ণনগর নামক একস্থানে গিয়া উপনীত হইলাম। এইস্থান হইতে সোনাটিকোল গ্রাম দেড় ক্রোশের অধিক হইবে না। রাত্রিকালে সেইস্থানে গমন করা যুক্তি-সঙ্গত নহে বিবেচনায়, সেই রাত্রি কৃষ্ণনগর গ্রামেই অতিবাহিত করিলাম।
২৬ শে ফেব্রুয়ারি তারিখের রাত্রি শেষে সাড়ে চারিটার সময় আবশ্যকীয় লোকজন সঙ্গে লইয়া সেই গ্রামে গমন করিলাম, ও নফরচন্দ্র পালিতের পিতা মহেশচন্দ্র পালিতের বাড়ি বেষ্টন করিয়া ফেলিলাম। বাড়ির ভিতর তিনখানি মাত্র মাটির গৃহ। সেই গৃহ কয়েকখানির মধ্যে উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু নফরচন্দ্রের কোনরূপ সন্ধান পাইলাম না, বা তাহার পিতাও আমাদিগকে কোন কথা বলিল না।
সেই তিনখানি গৃহের মধ্যে দুইখানি নফরচন্দ্রের পিতা মহেশচন্দ্র পালিতের, অপরখানি মহেশচন্দ্রের ভ্রাতা অম্বিকাচরণ পালিতের। যে সময় আমরা সেইস্থানে গমন করিয়াছিলাম, সেই সময় অম্বিকাচরণও বাড়িতে উপস্থিত ছিল না। কিন্তু সে যে কোন সময় এবং কোথায় গমন করিয়াছে, তাহাও সন্তোষজনকরূপে কেহই আমাকে বুঝাইতে সমর্থ হইল ন!
নফরচন্দ্র পালিতের বাড়ী এইরূপে সন্ধান করিয়া যখন তাহাকে প্রাপ্ত হইলাম না, তখন মনে মনে সবিশেষ লজ্জিত হইয়া তাহাদিগের বাড়ি পরিত্যাগ করিলাম। পুনরায় কোন্ উপায় অবলম্বন করা কর্তব্য, তাহাই ভাবিতে ভাবিতে পুনরায় কৃষ্ণনগর অভিমুখে যাত্রা করিলাম; কিন্তু গমনকালে মহেশচন্দ্র পালিতের দুই তিন জন প্রবীণ আত্মীয়কে সঙ্গে করিয়া লইয়া গেলাম।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
নফরচন্দ্র পালিত পলায়ন করিয়া লুক্কায়িত ভাবে যে কোথায় অবস্থান করিতেছে, তাহা সহজে নির্ণয় করা নিতান্ত সামান্য বিষয় নহে। এদিকে কোন না কোনরূপ পন্থা অবলম্বন করিয়া উহার অনুসন্ধান করিতে সমর্থ না হওয়া বড়ই লজ্জার বিষয়! সুতরাং উপযুক্ত উপায় অনুসন্ধান একান্ত কর্তব্য –তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। এই ভাবিয়া তাহার আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে প্রথমে সন্ধান করাই মনে মনে স্থির করিলাম। এইরূপ উপায়েও যদি নফরচন্দ্রের কোনরূপ সন্ধান না পাওয়া যায়, তাহা হইলে সেই সময় উপস্থিত মত অপর কোনরূপ উপায় অবলম্বন করিতে হইবে।
নফরচন্দ্রের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে প্রথমে তাহার সন্ধান করিব, ইহা মনে মনে স্থির করিলাম। কিন্তু তাহার আত্মীয়স্বজন যে কে, তাহা কি প্রকারে জানিতে পারিব, প্রথমে সেই চিন্তা আসিয়া উপস্থিত হইল। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হইল যে, মহেশচন্দ্র পালিতের যে দুই তিন জন আত্মীয় আমাদিগের সঙ্গে আসিয়াছে, তাহাদিগের নিকট হইতে এই সংবাদ অনায়াসেই প্রাপ্ত হইতে পারিব। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া মহেশচন্দ্র পালিতের আত্মীয়গণকে নিকটে ডাকাইলাম। তাহাদিগের নিকট হইতে নফরচন্দ্র বা তাহার পিতার আত্মীয়স্বজনের নাম যতদূর জানিতে পারিলাম, তাহা লিখিয়া লইয়া পূর্ব্বোক্ত পন্থা অবলম্বনে সন্ধান করিতে প্রবৃত্তি হইলাম।
সেই দিবসেই কৃষ্ণনগর হইতে বহির্গত হইয়া তের মাইল পথ চলিয়া গণ্ডকোশ থানায় গিয়া রাত্রি বারটার সময় উপনীত হইলাম। পরদিবস প্রাতঃকালে আরও তিন মাইল পথ অতিবাহিত করিয়া করিমপুর গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইলাম। নফরচন্দ্রের মাতুল বিহারীলাল সিংহ এই গ্রামে বাস করিয়া থাকেন। বাড়ীতে গিয়া বিহারীলালকে দেখিতে পাইলাম না। অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম যে, দুইদিবস হইল, বিহারীলাল জামকুড়ি গ্রামে তাহার অন্যতম একটি ভগিনীকে দেখিবার নিমিত্ত গমন করিয়াছে। কোন্ দিবস প্রত্যাগমন করিবে, তাহার কিছুমাত্র স্থিরতা নাই। অনুসন্ধান করিয়া আরও অবগত হইলাম যে, আমি যাহার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছি, সেই নফরচন্দ্র পালিত ১৪ই ফেব্রুয়ারি তারিখে তাহার মাতুলালয়ে গমন করিয়া প্রায় আট নয় দিবস সেইস্থানে অবস্থিতি করিয়াছিল। সেই সময় তাহার খুল্লতাত অম্বিকাচরণ পালিত বোধ হয়, কোনরূপ সংবাদ পাইয়া সেইস্থানে গমন করে, এবং নফরচন্দ্রকে সঙ্গে লইয়া সেইস্থান হইতে স্থানান্তরে চলিয়া যায়। তাহারা যে কোথায় গমন করিয়াছে, তাহা কিন্তু কেহই বলিতে পারিল না। যেরূপ ভাবে নফরচন্দ্রকে অনুসন্ধান করিতে মনস্থ করিয়াছিলাম, এখন তাহার খুল্লতাত অম্বিকাচরণকেও সেইরূপ ভাবে অনুসন্ধান করিবার প্রয়োজন হইয়া পড়িল। গ্রামে যদি আরও কোনরূপ সংবাদ পাইতে পারি, এই আশায় প্রায় সমস্ত দিবস সেই গ্রামেই গুপ্তভাবে অবস্থিতি করিয়া রাত্রি প্রায় নয়টার সময় পুনরায় গণ্ডকোশ থানায় প্রত্যাগমন করিলাম।
রাত্রি একটার সময় গণ্ডকোশ থানা পরিত্যাগ করিয়া ২৮শে ফেব্রুয়ারি তারিখের প্রাতঃকাল ছয়টার সময় অপর আর একটি থানায় গিয়া উপনীত হইলাম। এইস্থানেই সেই থানার নাম করিতে চাহি না। থানার সব-ইনস্পেক্টারবাবু সেই সময় থানার সন্নিকটস্থ তাঁহার বাসায় নিদ্রা যাইতেছিলেন। থানার অন্যান্য কর্মচারী বা কনষ্টেবলগণ যাহারা উপস্থিতছিল, দারোগাকে সংবাদ দিবার নিমিত্ত তাহাদিগকে বলায় প্রথমে তাঁহার বাসায় গিয়া তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ করিতে কেহই সম্মত হইল না। কেন যে ইহারা আমার প্রস্তাবে প্রথমে সম্মত হইল না, তখন তাহা কিছুই বুঝিতে পারিলাম না; কিন্তু পরে বুঝিয়াছিলাম। কর্মচারীগণ প্রথমে দারোগা বাবুর নিকট গমন করিতে সম্মত হইল না সত্য; কিন্তু পরিশেষে তাহাদিগের বিপক্ষে তাহাদিগের ঊর্দ্ধতনকর্ম্মচারীর নিকট রিপোর্ট করিবে বলিয়া, ভয় প্রদর্শন করায় পরিশেষে অগত্যা তাহারা আমার প্রস্তাবে সম্মত হইল।
দারোগাবাবুর নিকট প্রাতঃকাল ছয়টার সময় হইতে ক্রমাগত সংবাদ পাঠাইতে পাঠাইতে ক্রমে নয়টা বাজিয়া গেল। নয়টার পর দারোগা বাবুর অসময়ে নিদ্রাভঙ্গ হইল। অসময়ে তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ হওয়াতে তিনি ক্রোধে নিতান্ত অধীর হইয়া আমার নিকট আগমন করিলেন ও কহিলেন, “আপনি কে? এবং কেনই বা অসমরে আমার নিদ্রাভঙ্গ করাইলেন?” উত্তরে আমি আমার পরিচয় প্রদান করিলাম ও কহিলাম, “আমি নিজের কোন কার্য্যের জন্য আপনার নিকট আগমন করি নাই। আমি সরকারী কর্মচারী, এবং সরকারী কর্ম্মের জন্যই আপনার নিকট আগমন করিয়াছি।”
দারোগা। আপনি সরকারী কর্মচারী, তাহা আমি কি প্রকারে জানিব? আপনার সরকারী পোষাক কৈ?
আমি। আমি সরকারী পোষাক পরি না, এবং উহা আমার সঙ্গেও নাই। কিন্তু আমি সরকারী কর্মচারী কি না, সে বিষয় যদি আপনার কোনরূপ সন্দেহ থাকে, তাহা আমি এখনই ভঞ্জন করিয়া দিতেছি।
এই বলিয়া আমাদিগের পরিচয়ের নিমিত্ত আমাদিগের সহিত যে নিদর্শন থাকে, তাহা আমার পিরাণের পকেট হইতে বাহির করিয়া দারোগাবাবুকে দেখাইলাম। তিনি উহা হস্তে লইয়া চক্ষু প্রায় মুদিত করিয়া ঘুরাইয়া ফিরাইয়া উত্তমরূপে দেখিলেন ও কহিলেন, “পুলিস কর্মচারীগণের এরূপ নিদর্শন পত্র থাকে, তাহা আমি ইতিপূৰ্ব্বে কখন দেখিও নাই বা শুনিও নাই। সুতরাং আপনার কথায় আমি বিশ্বাস করিতে পারি না।”
দারোগাবাবুর নিদ্রাভঙ্গ করিতে একে প্রায় তিনঘণ্টা কাল অতিবাহিত হইয়াছে, তাহার উপর তাঁহার এইরূপ কথা শ্রবণ করিয়া আমার মনে ক্রোধের উদয় হইল। তাঁহাকে কহিলাম, “আমি পুলিস-কৰ্ম্মচারী বলিয়া আপনার বিশ্বাস হউক বা না হউক, আপনি সরকারী কার্য্য নির্ব্বাহের নিমিত্ত আমাকে সাহায্য করিবেন কি না, বলুন?”
দারোগা। এরূপ অবস্থায় আমি আপনাকে কখনই সাহায্য করিতে প্রস্তুত নহি।
এই সময় হঠাৎ আমার মনে হইল যে, আমি প্রথমে বাঁকুড়ায় গমন করিয়াছিলাম, সেই সময় বাঁকুড়া জেলার সৰ্ব্বপ্রধান পুলিস কৰ্ম্মচারী কয়েকখানি পরোয়ানা লিখিয়া আমার হস্তে প্রদান করেন, ও আমাকে বলিয়া দেন যে, তাঁহার এলাকার মধ্যস্থিত কোন থানার কোন কর্মচারীর নিকট হইতে যদি কোনরূপ সাহায্য লইবার প্রয়োজন হয়, এবং যদি কেহ উপযুক্তরূপ সাহায্য প্রদান করিতে না চাহেন, তাহা হইলে তাঁহার প্রদত্ত পরোয়ানা সেই কৰ্ম্মচারীকে দেখাইলে তখনই তিনি আমাকে সাহায্য প্রদান করিবেন।
এই কথা মনে হইবামাত্র আমি আমার ব্যাগ খুলিয়া পরোয়ানা কয়েকখানি বাহির করিলাম ও দেখিলাম, সেই থানার দারোগাবাবুর নামেও একখানি স্বতন্ত্র পরোয়ানা আছে। দারোগাবাবুর শেষ কথার উত্তর প্রদান না করিয়া, সেই পরোয়ানাখানি তাঁহার হস্তে প্রদান করিলাম ও কহিলাম, “দেখুন দেখি! এখন আপনি আমাকে সাহায্য প্রদান করিতে প্রস্তুত আছেন কি না?”
আমার কথা শ্রবণ করিয়া দারোগাবাবু আমার প্রদত্ত পরোয়ানাখানি হস্তে লইলেন। অর্দ্ধ-নিদ্রিত ও অর্দ্ধজাগরিত অবস্থায় সেই পরোয়ানাখানি বার বার পাঠ করিয়া কহিলেন, “এই পরোয়ানায় আমাদিগের প্রধান কর্মচারীর নাম সহি আছে সত্য; কিন্তু হই। যে তাঁহার সহি, তাহা আমি বিশ্বাস করিব কি প্রকারে?”
আমি। আপনার প্রধান কর্মচারীর সহি না হয়, আমি জাল করিয়াছি। কিন্তু উহার উপর মোহর দেওয়া আছে, দেখিতে পাইতেছেন না?
দারোগা। মোহরের ন্যায় কি একটা আছে বটে। কিন্তু উহা যে প্রকৃত মোহর, তাহা আমি বিশ্বাস করিব কি প্রকারে? উপরোক্ত দারোগাবাবুর কথা শ্রবণ করিয়া প্রথমেই আমার মনে ক্রোধের উদয় হইয়াছিল। এখন সেই ক্ৰোধ আরও বর্দ্ধিত হইল। কিন্তু কোনরূপে আমার মনের বেগ সংযত করিয়া তাঁহাকে কহিলাম, “আমি এ সকল গোলযোগ বুঝি না। আপনি আমাকে স্পষ্ট করিয়া বলুন যে, আপনি আমাকে এখন সাহায্য প্রদান করিবেন, কি না?”
দারোগা। সাহায্য প্রদান করিব কি না, সে সম্বন্ধে আমি এখন কিছুই বলিতে পারিতেছি না। দিবা বারটার পর আমি আপনাকে তাহার উত্তর প্রদান করিব।
এই বলিয়া দারোগাবাবু গাত্রোত্থান করিলেন। তাঁহাকে গমনোদ্যত দেখিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “এখন আপনি কোথায় গমন করিতেছেন?”
দারোগা। এখানে বসিয়া অনর্থক সময় নষ্ট করিয়া লাভ কি? আমি আমার বাসায় গমন করিতেছি।
এই বলিয়া দারোগাবাবু সেইস্থান হইতে গাত্রোত্থান করিয়া আপনার বাসাভিমুখে প্রস্থান করিলেন। তাঁহার এইরূপ ব্যবহার দেখিয়া আমি অতিশয় বিস্মিত হইলাম। কিন্তু পূর্ব্বে আমার অন্তঃকরণে যে ক্রোধের উদয় হইয়াছিল, তাহা কোনরূপে সম্বরণ করিতে না পারিয়া, তিনি আমার সহিত যেরূপ ব্যবহার করিলেন, এবং যেরূপে আমাকে সাহায্য প্রদান করিতে অসম্মত হইয়া বাসায় গমন করিলেন তাহার সমস্ত অবস্থা বিবৃত করিয়া তখনই একখানি পত্র লিখিলাম, এবং সেই পত্র বাঁকুড়া জেলার সেই উচ্চতম পুলিস কর্ম্মচারীর নিকট ডাকযোগে প্রেরণ করিলাম।
এই অভিযোগ পত্র চলিয়া যাইবার কিয়ৎক্ষণ পরে আমার ক্রোধের উপশম হইল। তখন ভাবিলাম, দারোগাবাবু আমার উপর কেন এইরূপ ব্যবহার করিলেন, তাহার কিছুমাত্র অনুসন্ধান না করিয়া, কেন আমি উহার বিপক্ষে এরূপভাবে অভিযোগ করিলাম? কোন বিশিষ্ট কারণবশতঃ যদি আমার প্রতি এইরূপ ব্যবহার করিয়া থাকেন, বা হঠাৎ যদি উহার মস্তিষ্ক বিকৃত হইয়া থাকে, তাহা হইলে এরূপ অভিযোগ করা আমার উচিত হয় নাই। কারণ আমি নিশ্চয় জানি যে, পুলিস কর্মচারীর উপর এরূপ অভিযোগ হইলে, কোনমতে বিনাদণ্ডে তিনি কখনই মুক্তিলাভ করিতে সমর্থ হন না।
মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমি তাঁহার অধীনস্থ কর্মচারীগণের নিকট এ সম্বন্ধে একটু অনুসন্ধান লইলাম, ও তাহাদিগের প্রমুখাৎ অবগত হইতে পারিলাম যে, অধিক পরিমাণে অহিফেন সেবন করিয়া উহার মস্তিষ্ক একরূপ বিকৃত হইয়া গিয়াছে। সমস্ত রাত্রি ইনি নিদ্রা যান না। সন্ধ্যা ছয়টার সময় ইনি অফিসে গিয়া উপস্থিত হন, এবং অফিসে বসিয়া সমস্ত রাত্রি কৰ্ম্ম-কার্য্য নির্ব্বাহ করেন। প্রত্যূষে তিন চারিটার সময় ইনি আপনার বাসায় গিয়া শয়ন করেন, দিবা বারটা একটার কমে ইঁহার নিদ্রাভঙ্গ হয় না। এই সময়ের মধ্যে কোনদিবস যদি তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ করা হয়, তাহা হইলে ইনি সবিশেষ অসন্তুষ্ট হন, ও তখন ইহার হিতাহিত জ্ঞান বিলুপ্ত হইয়া যায়। এই সকল কারণবশতঃ দিবা একটার মধ্যে কেহই উহার নিদ্রাভঙ্গ করিতে সাহসী হয় না। সেই সময়ের মধ্যে যদি কোন সামান্য সামান্য কর্ম্মের প্রয়োজন হয়, উঁহাকে জাগরিত না করিয়াই উপস্থিত কর্ম্মচারীগণ সকল কার্য্য নির্ব্বাহ করিয়া থাকেন; কিন্তু তাহাতেও ইনি সন্তুষ্ট হন না। এইরূপ নানাকারণে থানার সমস্ত লোকই ইহার উপর অসন্তুষ্ট। ইনি সরকারী কৰ্ম্ম—কার্য্য যেরূপভাবে সম্পন্ন করিয়া থাকেন, তাহা ত স্বচক্ষেই দেখিলাম।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
সেই থানায় এই ব্যাপার দেখিয়া বিনা সাহায্যে আমি সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম। এইস্থান হইতে ডেঙ্গলা গ্রাম প্রায় ছয় মাইল ব্যবহিত। সেইস্থানে নফরচন্দ্র পালিতের ভগিনীপতি ব্রজমোহন সাঁইয়ের বাড়ি। সেইস্থানে নফরচন্দ্র বা তাহার খুড়া অম্বিকাচরণের কোন সন্ধানই পাইলাম না।
পরদিবস প্রাতঃকালে অর্থাৎ ১লা মার্চ তারিখে প্রায় নয় মাইল পথ অতিবাহিত করিয়া খাসবাগ গ্রামে গিয়া উপনীত হইলাম। সেই গ্রামে তাম্বিকাচরণের শ্বশুর হরিচরণ দত্তের বাসস্থান। অনুসন্ধান করিয়া সেইস্থানে অবগত হইতে পারিলাম যে, এক বৎসরের ভিতর নফর বা অম্বিকা কেহই সেই গ্রামে গমন করে নাই।
সেইস্থান হইতে মাহেশপুর প্রায় চারি মাইল। সেই গ্রামে অম্বিকাচরণের জামাতা বাস করেন। সেইস্থানে উহাদিগের কোন সন্ধান না পাইয়া, আরও ছয় মাইল পথ অতিবাহিত করিয়া বিউড় গ্রামে গিয়া উপনীত হইলাম। সেইস্থানে নফরের ভগিনীপতি কালীপদ সেনের বাসস্থান। সেই স্থানেও উহাদিগের কোন সন্ধান পাইলাম না।
বিউড় এবং বেটুর গ্রাম কেবলমাত্র চারি মাইলের ব্যবধানমাত্র। সেই গ্রামে অম্বিকাচরণের ভগিনীপতি বাস করেন। সেইস্থানে গিয়া অবগত হইলাম যে, গত ২৬শে ফেব্রুয়ারি তারিখে অম্বিকাচরণ একাকী সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হন, এবং আহারাদি করিয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করেন। সেইস্থান হইতে তিনি যে কোথায় গমন করিয়াছেন, তাহা কেহই বলিতে পারেন না। অম্বিকাচরণের সহিত নফরচন্দ্র সেইস্থানে গমন করে নাই। সুতরাং সে যে কোথায় গমন করিয়াছে, তাহার সংবাদ কেহই প্রদান করিতে পারিলেন না।
সেইস্থান হইতে সাঁইবনি গ্রামে গমন করিলাম। বেটুর হইতে এই গ্রাম চারি মাইলের অধিক নহে। সেইস্থানে অম্বিকাচরণের এক জামাতার বাসস্থান। সেইস্থানে কাহারও কোনরূপ সংবাদ না পাইয়া, বিষণ্নমনে তিনি মাইল পথ অতিবাহিত করিয়া রাত্রি প্রায় নয়টার সময় পুনরায় সেই কৃষ্ণনগর গ্রামে গিয়া উপনীত হইলাম। সেইস্থান হইতে রাধানগর গ্রাম প্রায় ষোল মাইল ব্যবহিত। সেই দিবস রাত্রি একটার সময় কৃষ্ণনগর হইতে বহির্গত হইয়া সেই রাধানগর গ্রামে গমন করিলাম। সেই গ্রামে অম্বিকাচরণের ভাইঝির বাড়ী। সেই স্থানেও উহাদিগের কোনরূপ সন্ধান না পাইয়া পরদিবস আরও আঠার মাইল পথ অতিবাহিত করিয়া পুনরায় নফরচন্দ্রের বাসস্থান সেই সোনাটিকোল গ্রামে গিয়া উপনীত হইলাম। নফরচন্দ্র পালিতের বাড়িতে উপনীত হইবা মাত্র জানিলাম যে, তাহার খুল্লতাত অম্বিকাচরণ আপন বাড়িতে প্রত্যাগমন করিয়াছেন। অম্বিকাচরণকে তাঁহার গৃহের ভিতরই প্রাপ্ত হইলাম, কিন্তু নফরচন্দ্রকে প্রাপ্ত হইলাম না। নফরচন্দ্র কোথায়, এই কথা অম্বিকাচরণকে জিজ্ঞাসা করায় তাহার বিষয় একবারে অস্বীকার করিল ও কহিল, “যে পর্য্যন্ত নফরচন্দ্র কলিকাতায় গমন করিয়াছে, সেই পর্য্যন্ত আমি তাহাকে দেখিতে পাই নাই।”
অম্বিকাচরণের এই কথা শ্রবণ করিয়া আমি মনে মনে তাহার উপর নিতান্ত অসন্তুষ্ট হইলাম, এবং সেইস্থানে তাহাকে অধিক আর কিছু না বলিয়া, তাহাকে সঙ্গে লইয়া সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম। পাঠকগণ পূৰ্ব্বেই আগত হইয়াছেন যে, এইস্থান হইতে কৃষ্ণনগর গ্রাম বহুদূরবর্তী নহে, ও সোনাটিকোল গ্রাম হইতে কৃষ্ণনগরে আসিতে হইলে একটি ক্ষুদ্র নদী পার হইতে হয়। সেই নদী কৃষ্ণনগর গ্রামের নিম্ন দিয়া প্রবাহিত হইয়াছে। অম্বিকাচরণকে লইয়া আমি সেই কৃষ্ণনগর গ্রামে পুনরায় গমন করিলাম। সেইস্থান সোনামুখি থানার অধীন। সুতরাং সেই থানার সাহায্য লইয়া এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হওয়া কৰ্ত্তব্য, এই ভাবিয়া সেইস্থানে পুনরায় যাইবার পরই সাহায্য পাইবার প্রত্যাশায় সোনামুখি থানার দারোগার নিকট এক পত্র লিখিয়াছিলাম। অম্বিকাচরণকে লইয়া কৃষ্ণনগরে উপস্থিত হইবার অব্যবহিত পরেই আমার সাহায্যার্থে একজন কর্মচারী গিয়া উপস্থিত হইলেন। আমার নিকট হইতে সমস্ত অবস্থা শ্রবণ করিয়া তাঁহার মনেও সম্পূর্ণরূপ বিশ্বাস হইল যে, অম্বিকাচরণই তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্রকে কোথায় লুক্কায়িত অবস্থায় রাখিয়া দিয়া, নিজে আপনার বাড়িতে আগমন করিয়াছে।
সেইস্থানে বসিয়া বসিয়া আমরা অম্বিকাচরণকে উত্তমরূপে বুঝাইলাম, কিন্তু কোনক্রমেই তাহার নিকট হইতে আসল কথা প্রাপ্ত হইলাম না। সে করিমপুর গ্রামে বিহারীলাল সিংহের বাড়িতে গমন করিয়া সেইস্থান হইতে নফরচন্দ্রের সহিত একত্র বহির্গত হইয়া স্থানান্তরে গমন করিয়াছিল। একথা স্বীকার করা দূরে থাকুক, করিমপুর গ্রামে তাহার জীবনে সে যে কখন গমন করিয়াছে, তাহা এ পর্যন্ত তাহাকে স্বীকার করাইতে পারিলাম না।
অম্বিকাচরণের এই প্রকার কথা শ্রবণ করিয়া মনে মনে অতিশয় ক্রোধের উদয় হইল। একবার ভাবিলাম, পরে যাহা হয় হইবে, এখন উহাকে সাধ্যমত প্রহার করিয়া উহার নিকট হইতে সকল কথা বাহির করিয়া লই। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবিলাম, কাহারও নিকট হইতে কোন কথা জানিয়া লইবার নিমিত্ত যদি তাহাকে প্রহার করা হয়, তাহ হইলে আইনানুযায়ী প্রহারকারীকে বিশিষ্টরূপ দণ্ড ভোগ করিতে হয়। এরূপ অবস্থায় অম্বিকাচরণের গাত্রে হস্ত প্রদান না করাই কৰ্ত্তব্য এইরূপ ভাবিয়া উহাকে প্রহার করিবার ইচ্ছা একেবারেই পরিত্যাগ করিলাম, ও অম্বিকাচরণ বুঝুক বা নাই বুঝুক, তাহাকে উত্তমরূপে বুঝাইবার নিমিত্ত অনেক চেষ্টা করিলাম, কিন্তু অম্বিকাচরণ কিছুতেই আমাদিগের কথায় সম্মত হইল না, এবং নফরচন্দ্রকে যে কোথায় রাখিয়া আসিয়াছে, তাহা প্রকাশ করিল না।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
কোন রূপেই যখন অম্বিকাচরণের নিকট হইতে কোন কথা প্রাপ্ত হইলাম না, তখন কোন উপায় অবলম্বন করিলে উহার নিকট হইতে প্রকৃত কথা জানিতে পারা যায় না। তাহার চিন্তা করিতে লাগিলাম। চিন্তার পর, একজন পুরাতন দারোগার কথা আমার মনে উদয় হইল। কিরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া একজন চোরের নিকট হইতে তিনি সমস্ত কথা বাহির করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, সেই সম্বন্ধে এক দিবস তিনি আমার নিকট গল্প করিয়াছিলেন। ভাল হউক, মন্দ হউক, আর সর্ব্বসাধারণে আমার উপর সন্তুষ্ট হউন বা অসন্তুষ্ট হউন, আমি কিন্তু সেই উপায় অবলম্বন করিতে আজ মনস্থ করিলাম। তিনি চোরের উপর যে ব্যবহার করিয়াছিলেন, আজ অম্বিকাচরণের উপর সেইরূপ ব্যবহার করিতে আমি কৃতসঙ্কল্প হইলাম।
কৃষ্ণনগর গ্রামে বর্ধমান যাইবার পথের উপর একটি সরকারী বিট হাউস বা চৌকিদার দিগের থাকিবার গৃহ আছে। সেই গৃহের সন্নিকটে একটি প্রকাণ্ড বটবৃক্ষের তলায় বসিয়া মনে মনে পূর্ব্বকথিতরূপ পরামর্শ সিদ্ধান্ত করিলাম। থানার কর্মচারীও সেই সময় সেইস্থানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁহার নিকট আমার মনে কথা প্রকাশ না করিয়া কহিলাম যে, “আমার জনকয়েক চৌকিদারের প্রয়োজন, এখানে কয়েকজন চৌকিদার আপাততঃ পাওয়া যাইতে পারিবে?”
কর্ম্মচারী। আট দশজন চৌকিদার অনায়াসেই পাওয়া যাইতে পারে। যদিও আবশ্যক হয়, এবং একটু সময় পাই, তাহা হইলে অরও যত চৌকিদারের আবশ্যকহইবে, তাহা আমি সংগ্রহ করিয়া দিতে পারিব।
আমি। অধিক লোকের আবশ্যক হইবে না, আট দশজন হইলেই আমার কার্য্য সম্পন্ন হইতে পারিবে। কিন্তু পরে কোন কথা কাহারও নিকট প্রকাশ না করে, এরূপ চৌকিদার হওয়া চাই
কর্ম্মচারী। চৌকিদার মাত্রই আমাদের বশীভূত। আমাদিগের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কথা তাহারা কেহই প্রকাশ করিবে না।
আমি। আচ্ছা আপনি তাহাদিগকে লইয়া এইস্থানে আনয়ন করুন, ও তিনচারিখানি কোদালিও সংগ্রহ করিয়া দিউন।
আমার এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র কর্ম্মচারী সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন, ও কিয়ৎক্ষণ পরেই আট দশ জন চৌকিদার ও তিন চারিখানি কোদালির সহিত আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কহিলেন, “আপনি যেরূপ আদেশ করিয়াছিলেন, সেইরূপ কাৰ্য্য হইয়াছে। এইসকল চৌকিদারকে এখন কি করিতে হইবে, তাহা তাহারা জানিতে পারিলে আপনার অভীপিত কার্য নির্ব্বাহ করিতে পারে।”
কর্ম্মচারীর কথা শ্রবণ করিয়া আমি করিলাম, “উহাদিগকে যাহা করিতে হইবে তাহা আমি নিজেই দেখাইয়া দিতেছি।”
এই বলিয়া অম্বিকাচরণকে সঙ্গে লইয়া আমি সেইস্থান হইতে গাত্রোত্থান করিলাম, এবং কর্ম্মচারী ও চৌকিদারদিগকে সঙ্গে লইয়া সেই গ্রামের সন্নিকটস্থ যে নদীর কথা পূর্ব্বে বলিয়াছিলাম, সেই নদীতীরে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই নদীতীরে একটি উপযুক্ত স্থান নির্দিষ্ট করিয়া সেই স্থানে একটি খাত প্রস্তুত করিতে চৌকিদারদিগকে আদেশ প্রদান করিলাম। বলিয়া দিলাম যে, সেই খাতের পরিমাণ দৈর্ঘ্যে তিন হস্ত, প্রস্থে, দুই হস্ত, এবং ঊর্দ্ধে চারি হস্তের ন্যূন হইবে না। আদেশ পাইবামাত্র চৌকিদারগণ খাত খনন করিতে আরম্ভ করিল। আমি, কর্মচারী এবং অম্বিকাচরণের সহিত একটু দূরে গিয়া উপবেশন করিলাম।
সেইস্থানে আমি কৰ্ম্মচারীকে সম্বোধন করিয়া কহিলাম, “দেখুন মহাশয়! যদি এইস্থানে আমরা কোন কার্য্য করি, তাহা হইলে আমাদিগের কি হইতে পারে?”
“আমার উদ্দেশ্য কর্ম্মচারী বুঝিতে পারিলেন ও কহিলেন, “পুলিস কোন একটা অন্যায় কার্য্য করিলে তাহার আর কি হইয়া থাকে? বিশেষত, যে থানার অধীনে সেই অন্যায় কার্য সম্পন্ন হইবে, সেই থানার উচ্চ কর্ম্মচারী উপস্থিত থাকিয়া যদি সেই কার্য নির্ব্বাহ করে, তাহা হইলে আরও কিছুই হইতে পারে না। কারণ, সেই অসৎ কার্য্যের অনুসন্ধান যে কৰ্ম্মচারী করিবে, সেই যদি সেই কার্যে নিযুক্ত থাকে, তাহা হইলে প্রকৃতকথা কি কখনও প্রকাশ হয়? কেন মহাশয়! আপনি আমাকে একথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন? কেন, আপনার কি কোনরূপ অসৎ কার্য্য করিবার ইচ্ছা আছে?”
আমি। ইচ্ছা না থাকিলে, আর আপনাকে বলিব কেন? আমার কার্য্য দেখিয়া আপনি কি আমার মনের ভাব বুঝিতে পারিতেছেন না?
কর্ম্মচারী। যদি আপনার মনের ভাব বুঝিতে পারিব, তাহা হইলে আপনাকে জিজ্ঞাসা করিব কেন?
আমি। চৌকিদার এই খাত প্রস্তুত করিতেছে, ইহা দেখিয়াও কি আপনি আমার মনোভাব বুঝিতে পারেন নাই?
কর্ম্মচারী। আপনার আদেশ প্রতিপালিত হইতেছে; কিন্তু আপনার অন্তরে কি অভিসন্ধি আছে, তাহা আমরা বুঝিব কি প্রকারে?
আমি। আমার অভিসন্ধির বিষয় যদি আপনি বুঝিতে না পারিয়াই থাকেন, তাহা হইলে আপনাকে বুঝাইয়া দিতেছি। অম্বিকাচরণের সমস্ত বিষয় আপনি অবগত হইয়াছেন; অম্বিকাচরণ কি প্রকৃতির লোক, তাহা আপনি এখন বুঝিতে পারিয়াছেন কি?
কর্ম্মচারী। বেশ বুঝিতে পারিয়াছি। বুঝিয়াছি যে, অম্বিকাচরণের ন্যায় মিথ্যাবাদী লোক আমার এলাকার ভিতর আর আছে কি না, সন্দেহ।
আমি। এরূপ অবস্থায় এরূপ মিথ্যাবাদী অম্বিকাচরণের অস্তিত্ব একবারে লোপ করা উচিত, কি না?
কর্মচারী। খুব উচিত। এ কার্য্যের নিমিত্ত আমি আমার সাধ্যমত আপনাকে সাহায্য করিতে প্রস্তুত আছি। এখন বুঝিতে পারিলাম যে, চৌকিদারগণ যে খাত প্রস্তুত করিতেছে তাহা খাত নহে; তাহা অম্বিকাচরণের গোরস্থান।
আপনাকে আর কোন কষ্ট করিতে হইবে না। আদেশ করুন, এখনই আমি ইহাকে হত্যা করিয়া এই কবরের মধ্যে প্রোথিত করি।
আমি। পূর্ব্বে হত্যা করিয়া পরিশেষে মৃত্তিকার ভিতর প্রোথিত করিলে আর কি হইল? মৃত্যুযন্ত্রণা যাহাতে এ ভালরূপ অনুভব করিতে পারে, তাহাই করা কর্তব্য না কি?
কর্ম্মচারী। একান্ত কর্তব্য। এখন কি করিতে হইবে, তাহাই বলিয়া দিন।
আমি। জীবিত অবস্থায় উহাকে মৃত্তিকার ভিতর প্রোথিত করিতে হইবে।
কর্ম্মচারী। এ উত্তম পরামর্শ। কবর প্রস্তুত হইবামাত্র আমি জীবিত অবস্থাতেই উহাকে মৃত্তিকাসাৎ করিতেছি। অম্বিকাচরণের সম্মুখেই আমার সহিত কর্ম্মচারীর এইরূপ কথাবার্তা হইল। আমাদিগের কথা শ্রবণ করিয়া অম্বিকাচরণ কি ভাবিল, বলিতে পারি না। কিন্তু এক এক বার আমার ও কর্মচারীর মুখের দিকে অবলোকন করিতে লাগিল, এবং মধ্যে মধ্যে চৌকিদারগণ যে কবর প্রস্তুত করিতেছিল, তাহার দিকেও লক্ষ্য করিতে লাগিল। সেই সময় কর্ম্মচারী অম্বিকাচরণকে পুনরায় কহিলেন, “দেখ অম্বিকাচরণ! তুমি এ পৰ্য্যস্ত যে সকল মিথ্যা কথা বলিয়াছ, তাহার প্রতিকারের নিমিত্ত ঐ দেখ কবর প্রস্তুত হইতেছে। যদি তুমি তোমার প্রাণরক্ষা করিতে চাহ, তাহা হইলে এখনও প্রকৃতকথা বল। বল, নফরচন্দ্রকে তুমি কোথায় রাখিয়া আসিয়াছ?”
কর্ম্মচারীর কথা শ্রবণ করিয়া অম্বিকাচরণ একটু হাসিল। বোধ হয়, তাহার মনে হইল যে, মিথ্যা কথা কহিবার নিমিত্ত জীবিত মনুষ্যকে কেহ কি কখনও কবর-কবলিত করিতে পারে? যাহা হউক, তখন অম্বিকাচরণ কহিল, “আমি মিথ্যে কথা বলিতেছি না। যখন আপনারা আমার কথায় বিশ্বাস করিতেছেন না, তখন আর আমি কি করিতে পারি? নফরচন্দ্রের সহিত আমার সাক্ষাৎ হয় নাই। আমি বলিতেও পারি না যে, নফরচন্দ্র এখন কোথায় আছে?”
অম্বিকাচরণের এই সকল কথা শ্রবণ করিয়া এ অবস্থায় তাহাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করা নিষ্প্রয়োজন বিবেচনা করিলাম। এদিকে আমার প্রস্তাবিত খাত প্রস্তুত হইয়া গেল। সেই খাতের ভিতর একজন চৌকিদারকে দাঁড় করাইয়া দেখিলাম, তাহার গহ্বর চৌকিদারের দৈর্ঘ্য অপেক্ষা প্রায় অৰ্দ্ধহস্ত অধিক হইয়াছে।
এইরূপ খাত প্রস্তুত হইলে অম্বিকাচরণকে সেইস্থানে লইয়া যাইবার নিমিত্ত চৌকিদারদিগকে আদেশ পাইবামাত্র চৌকিদারগণ অম্বিকাচরণকে লইয়া সেই খাতের নিকট উপস্থিত করিল। সেই সময় তাহার হস্ত দুইখানি উত্তমরূপে বন্ধন করিয়া তাহাকে সেই খাতের ভিতর দণ্ডায়মান অবস্থায় রাখিতে কহিলাম। দেখিতে দেখিতে আদেশ প্রতিপালিত হইল।
সেই সময় আমি অম্বিকাচরণকে কহিলাম, “দেখ অম্বিকাচরণ! এখনও যদি তুমি সত্য কথা বল, তাহা হইলে এখনও তোমার বাঁচিবার আশা আছে; নতুবা এইস্থানেই চিরদিবসের নিমিত্ত তোমাকে অবস্থিত করিতে হইবে।” উত্তরে অম্বিকাচরণ কহিল, “আমি মিথ্যা কথা বলি নাই, সত্য কথা বলিয়াছি। নফরচন্দ্র এখন কোথায়, তাহা আমি জানি না।”
অম্বিকাচরণের এই কথা শ্রবণ করিয়া ভাবিলাম যে, এ ব্যক্তি দেখিতেছি, সহজে প্রকৃতকথা বলিবে না। ইহার শেষ কতদূর গড়ায় দেখা যাক। এই ভাবিয়া মৃত্তিকার দ্বারা সেই খাত পূর্ণ করিবার নিমিত্ত চৌকিদারদিগকে আদেশ প্রদান করিলাম। আদেশ পাইবামাত্র তাহারা অম্বিকাচরণের চতুষ্পার্শ্বে মৃত্তিকা ফেলিতে আরম্ভ করিল। ক্রমে অম্বিকাচরণের হাঁটু পর্যন্ত মৃত্তিকায় ডুবিয়া গেল। সেই সময় পুনরায় অম্বিকাচরণকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি এখনও প্রকৃতকথা বলিতে, পর্যন্ত সম্মত আছ কি না, বল।”
অম্বিকাচরণ আমার কথার কোন উত্তর প্রাদন করিল না। এদিকে চতুর্দিক হইতে খাতের ভিতর মৃত্তিকা পড়িতে লাগিল, ক্রমে অম্বিকাচরণের কোমর পর্যন্ত মৃত্তিকার ভিতর ডুবিয়া গেল। সেই সময় কর্ম্মচারী পুনরায় অম্বিকাচরণকে কহিলেন, “এখন বিবেচনা করিয়া দেখ, প্রকৃতকথা বলিবে কি না?’ অম্বিকাচরণ কর্ম্মচারীর কথারও কোনরূপ উত্তর প্রদান করিল না; কিন্তু তাহার চোখ মুখ দেখিয়া অনুমান হইল যে, সে নিতান্ত ভীত হইয়াছে।
এদিকে মৃত্তিকা পড়িবার বিশ্রাম নাই। ক্রমে বক্ষঃস্থল ঢাকিয়া গেল, স্কন্ধদেশ পৰ্য্যন্ত মৃত্তিকা হইল, গ্রীবাদেশেও ক্রমে মৃত্তিকার ভিতর প্রবেশ করিল। সেই সময় অম্বিকাচরণ কহিল, “আপনারা প্রকৃতই কি আমাকে মৃত্তিকার ভিতর প্রোথিত করিবেন?”
আমি। এতক্ষণ পরে এখন কি তোমার সেই কথা মনে হইল? এত পরিশ্রম করিয়া এই খাত কি বৃথা খনিত হইয়াছে?
অম্বিকা। আর দেহের প্রায় সমস্তই মৃত্তিকার ভিতর প্রবেশ করিয়াছে, অবশিষ্ট আছে—কেবলমাত্র মস্তক। আপাততঃ অল্প সময়ের নিমিত্ত মৃত্তিকা নিক্ষেপ বন্ধ করুন, ও আমার দুই চারিটি কথা প্রথমে শ্রবণ করুন। পরে যাহা হয়—করিবেন।
অম্বিকাচরণের এই কথা শ্রবণ করিয়া সেই খাতের মধ্যে মৃত্তিকা নিক্ষেপ বন্ধ করিয়া দিলাম ও কহিলাম, “তুমি যাহা বলিতে চাহ, তাহা এখন বলিতে পার।”
অম্বিকা। আমাকে মারিয়া আপনার কি লাভ হইবে?
আমি। লাভ কিছু হউক বা না হউক, এই পৃথিবী হইতে একজন মিথ্যাবাদীকে অপসারিত করিয়া, লোকের কথঞ্চিৎ মঙ্গল সাধন করিতে পারিব।
অম্বিকা। আমি যে মিথ্যাবাদী, একথা আপনাকে কে বলিল?
আমি। কে আর বলিবে? আমি স্বচক্ষে যাহা দর্শন করিয়াছে, এবং স্বকর্ণে যাহা শ্রবণ করিয়াছি, তাহাতে আমার বেশ বোধ হইতেছ যে, তুমি আমার নিকট যাহা কিছু বলিয়াছ, তাহার একটিও সত্য নহে, সমস্তই মিথ্যা।
অম্বিকা। আপনার কি ধ্রুব বিশ্বাস যে, আমি নফরচন্দ্রকে কোনস্থানে লুক্কায়িত অবস্থায় রাখিয়াছি?
আমি। তাহা আর বলিতে অপেক্ষা আছে?
অম্বিকা। যদি আপনার সেই বিশ্বাসই হইয়া থাকে, তাহা হইলে এইরূপভাবে আমাকে আর কষ্ট দিবার প্রয়োজন নাই। আমাকে মুক্তি প্রদান করুন ও আমার সঙ্গে চলুন, নফর যে স্থানে আছে, তাহ আমি আপনাকে দেখাইয়া দিতেছি!
আমি। তোমার এ প্রস্তাবে আমি সম্মত হইতে পারি না। যদি তোমার প্রাণ বাঁচাইবার ইচ্ছা থাকে, তাহা হইলে নফরচন্দ্র কোথায় আছে, তাহা আমাকে বলিয়া দেও। আমি সেইস্থানে গমন করিয়া দেখিব যে, তোমার কথা সত্য কি না। যদি সত্য হয়, তাহা হইলে আমি প্রত্যাগমন করিয়া তোমাকে উদ্ধার করিব। আর যদি মিথ্যা হয়, তাহা হইলে আরও কিয়ৎ পরিমাণ মৃত্তিকা তোমার উপর চাপাইয়া দিব।
অম্বিকা। আপনি যেরূপ বলিতেছেন, তাহা আমার দ্বারা সম্পন্ন হইতে পারে না। কারণ, আমি তাহাকে যে স্থানে রাখিয়া আসিয়াছি, সেইস্থান আমি চিনি মাত্র; কিন্তু সেইস্থানের নাম জানি না।
আমি। তুমি এখনও মিথ্যা কথা বলিতেছ। তোমার উপর আমার আর কিছুমাত্র দয়া নাই।
এই বলিয়া চৌকিদারগণকে পুনরায় সেইস্থানে মৃত্তিকা নিক্ষেপ করিতে কহিলেন। বলিবামাত্র আদেশ প্রতিপালিত হইতে লাগিল, এবং মৃত্তিকার কিয়দংশ উহার মস্তকের উপরও পড়িতে লাগিল।
এই ব্যাপার দেখিয়া অম্বিকাচরণ চীৎকার শব্দে বলিতে লাগিল, “মহাশয়! বাঁচান, আর মিথ্যা কথা বলিব না। আমার অদৃষ্টে যাহাই হউক, আমি প্রকৃত অবস্থা সমস্তই বলিয়া দিতেছি।”
অম্বিকাচরণের এই কথা শ্রবণ করিয়া পুনরায় মৃত্তিকা নিক্ষেপ বন্ধ করিলাম, সেই সময় নাসিকা আচ্ছন্ন হইবার অতি অল্পমাত্রই বাকি ছিল।
অম্বিকা। আপিন যে বলিতেছেন, ওয়াড়িগ্রামে বিহারীলাল সিংহের বাড়িতে নফরচন্দ্রের সহিত আমার সাক্ষাৎ হয়, তাহা প্রকৃত। সেইস্থান হইতে আমি উহাকে সঙ্গে লইয়া বিষ্ণুপুর থানার এলাকাস্থিত গোঁসাইপুর গ্রামে মাধবচন্দ্র পালিতের বাড়িতে তাঁহাকে রাখিয়া আসিয়াছি। আপনি সেইস্থান গমন করিয়া দেখুন, তাঁহাকে প্রাপ্ত হন কিনা। যদি না পান, তাহা হইলে পরিশেষে আমাকে যে দণ্ড প্রদান করিবে, বিনা বাক্যব্যয়ে আমি সেই দণ্ডই গ্রহণ করিব।
আমি। তোমার কথামত আমি গোঁসাইপুর গ্রামে গমন করিতে প্রস্তুত আছি। সেইস্থানে উপস্থিত হইয়া যদি নফরচন্দ্রকে প্রাপ্ত হই, তাহা হইলে সেইস্থান হইতে প্রত্যাগমন করিয়া আমি তোমাকে এইস্থান হইতে নিশ্চয়ই উদ্ধার করিব। কিন্তু তোমার কথা যদি মিথ্যা বলিয়া সাব্যস্ত হয়, তাহা হইলে তোমার অদৃষ্ট যাহা ঘটিবে, তাহা বুঝিতেই পারিতেছ।
অম্বিকা। আপনি সেইস্থানে গমন করিয়া দেখুন, তাহা হইলেই বুঝিতে পারিবেন যে, আমি এখন প্ৰকৃতকথা বলিতেছি, কি না।
অম্বিকাচরণের এই কথা শ্রবণ করিয়া এতক্ষণ পরে আমার বিশ্বাস হইল যে, এখন অম্বিকাচরণ যাহা বলিতেছে, তাহা মিথ্যা নহে।
অম্বিকাচরণের কথার উপর বিশ্বাস করিয়া তাহাকে সেই খাত হইতে উঠাইতে প্রবৃত্ত হইলাম। কারণ, আর তাহাকে এইরূপ অবস্থায় মৃত্তিকার ভিতর রাখা যায় না। সে প্রকৃত কথা না বলিলেও তাহাকে এইরূপ অবস্থায় আর রাখিতে পারিলাম না। চৌকিদারদিগকে আদেশ প্রদান করিবামাত্র পুনরায় সেই খাতের মৃত্তিকা তাহার উপরে উঠাইল, অম্বিকাচরণও মুক্তি পাইল।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
অম্বিকাচরণকে সঙ্গে লইয়া তৎক্ষণাৎ সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম। যখন আমরা সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম, তখন বৈকাল চারিটা। সুতরাং অধিক পথ চলিতে অসমর্থ হইয়া কেবল দশ মাইল পথ অতিবাহিত করিয়া, জামকুড়ি নামক গ্রামে রাত্রি অতিবাহিত করিলাম।
৩রা মার্চ তারিখের অতি প্রত্যূষে সেইস্থান হইতে গাত্রোত্থান পূর্ব্বক আট মাইল পথ অতিবাহিত করিয়া, গোঁসাইপুর গ্রামে গিয়া উপনীত হইলাম। জানিতে পারিলাম যে, সেই গ্রামে মাধবচন্দ্র পালিত নামক এক ব্যক্তি বাস করিয়া থাকে; কিন্তু আজ কয়েক দিবস হইতে কোন কাৰ্য্যোপলক্ষে সে স্থানান্তরে গমন করিয়াছে। আরও জানিতে পারিলাম যে, নফরচন্দ্র পালিত নামক এক ব্যক্তি তাহার বাড়িতে পাঁচছয় দিবস পর্যন্ত অবস্থিতি করিয়াছিল; কিন্তু সেই সময় মাধবচন্দ্রের বাড়ীতে একটি বিবাহ উপস্থিত হওয়ায় বসন্তপুর গ্রাম হারাধন মণ্ডল নামক এক ব্যক্তির বাড়ীতে তাহাকে রাখিয়া আসিয়াছে। বসন্তপুর গ্রাম এইস্থান হইতে ছয় মাইলের ন্যূন নহে।
এইস্থানে আর কালবিলম্ব না করিয়া সেই ছয় মাইল পথ অতিবাহিত পূর্ব্বক হারাধন মণ্ডলের বাড়ীতে গিয়া উপনীত হইলাম। হারধান একটি পুরাতন ইষ্টক-নির্ম্মিত দ্বিতল গৃহে বাস করিয়া থাকেন। সেই দ্বিতল গৃহের একটি প্রকোষ্ঠের ভিতর গমন করিয়া দেখিলাম, নফরচন্দ্র সেইস্থানে একাকী বসিয়া আছে। কয়েক দিবস হইতে নফরচন্দ্রকে ধরিবার নিমিত্ত সে সকল পরিশ্রম করিয়া আসিতেছিলাম, আজ তাহার ফল প্রাপ্ত হইলাম। আমাদিগকে দেখিয়া প্ৰথমে নফরচন্দ্র একবারে বিস্মিত হইয়া পড়িল; কিন্তু বাক্যব্যয় না করিয়া, আমাদিগের সঙ্গে সঙ্গে সেই বাড়ী হইতে বহির্গত হইল। আমাকে দেখিয়া সে যতদূর বিস্মিত না হউক, কিন্তু অম্বিকাচরণকে আমার সহিত দেখিয়া তাহার আর বিস্ময়ের পরিসীমা রহিল না। সে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি ইহাদিগের সহিত কিরূপে এইস্থানে আগমন করিলেন?”
আমি। অম্বিকাচরণ যেরূপে আমাদিগের সহিত এইস্থানে আগমন করিয়াছ, তাহা তুমি পরে জানিতে পারিবে। এখন আমি তোমাকে দুই চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি, তুমি তাহার প্রকৃত উত্তর প্রদান করিবে কি?
অম্বিকা। দেখ নফরচন্দ্র! তুমি ইঁহার কথার উত্তরে কখন মিথ্যা কথা কহিও না। ইঁহার ন্যায় ভয়ানক লোক জগতে আছে কি না, তাহা সন্দেহজনক। তোমার নিমিত্ত আমি পূৰ্ব্বে মিথ্যা কথা বলিয়াছিলাম। কিন্তু সেই মিথ্যা কথা কহিবার নিমিত্ত আমি যে কিরূপ ফল প্রাপ্ত হইয়াছি তাহা আমিই অবগত আছি, এবং যতদিন বাঁচিব, ততদিন কোনরূপেই তাহা বিস্মৃত হইব না। তোমার অদৃষ্টে যাহাই থাকুক, তুমি কিছুতেই মিথ্যা কথা কহিও না।
নফর। যখন আপনি বলিতেছেন, তখন মিথ্যা কথা কহিব কেন? যাহা জিজ্ঞাসা করিবেন, আমি তাহার প্রকৃত উত্তরই প্রদান করিব।
অম্বিকা। আমি কি সাধ করিয়া বলিতেছি, ঠেকিয়াছি বলিয়াই বলিতেছি। কারণ, প্রথমে মিথ্যা বলিলেও পরে তোমাকে সত্য কথা বলিতে হইবে। ইহা এখন আমার বেশ বিশ্বাস হইয়াছে।
আমি। কি বল নফরচন্দ্র! তুমি আমার কথার প্রকৃত উত্তর এখন আমাকে প্রদান করিবে কি না?
নফর। যতদূর জানি, তাহা প্রকৃতই কহিব। মিথ্যা কহিয়া কোন কথা গোপন করিব না।
আমি। তুমি কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া, লুক্কায়িত ভাবে এখানে অবস্থিতি করিতেছিলে কেন?
নফর। মহাশয়। এক কার্য্য করিতে গিয়া দেখিলাম, সমস্তই প্রকাশ হইয়া পড়িল; তখন মনে অতিশয় ভয়ের উদয় হইল। ভাবিলাম, এ স্থানে অবস্থান করা আর কর্ত্তব্য নহে। সুতরাং কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া এই প্রদেশে আগমন করিলাম, ও পরিশেষে এইস্থানে লুক্কায়িত ভাবে বাস করিতেছি।
আমি। তুমি কি প্রকারে জানিলে যে, তোমার সমস্ত কার্য্য প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে?
নফর। আমি যে গাড়ির সহিত গমন করিতেছিলাম, যখন দেখিলাম, সেই গাড়ি হিন্জার কোম্পানির লোকের দ্বারা ধৃত হইল। তখন সহজেই অনুমান করিয়া লইলাম যে, আমাদিগের সকল কার্য্য প্রকাশ হইয়া পড়িবে। সুতরাং কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া একবারে এই প্রদেশে আগমন করিলাম।
আমি। কলিকাতা পরিত্যাগ পূর্ব্বক এই প্রদেশে আগমন করিয়া, আমাদিগের হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইলে কি?
নফর। না মহাশয়! ইংরাজের রাজত্বে কোনরূপ পরিত্রাণ পাইবার কি উপায় আছে যে আমি তাহা পাইব?
আমি। যদি তোমার এইরূপ বিশ্বাস ছিল, তবে তুমি কলিকাতা হইতে পলায়ন করিলে কেন?
নফর। চুরি করিলে ধরা পড়িব, ধরা পড়িলে জেলে যাইব, একথা সকলেই মনে মনে জানে। তবে লোকে চুরি করে কেন? পলায়ন করিলে পুনরায় ধৃত হইবে, একথাও নূতন নহে। তবে অপরাধীগণের মধ্যে অনেকেই প্রথম অবস্থায় একবার পলায়ন করিবার চেষ্টা করে কেন? আমার প্রকৃতিও সেই সকল লোকের প্রকৃতির সাদৃশ্য; সতরাং আপনিই বিবেচনা করিয়া দেখুন, আমি কেন পলায়ন করিয়াছিলাম।
আমি। আমি তোমার মনের ভাব এখন বেশ বুঝিতে পারিয়াছি। এখন আমার বেশ অনুমান হইতেছে যে, আমি তোমাকে যে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিব, তাহার উত্তরে তুমি মিথ্যা কথা কহিবে না।
নফর। আমি মহাশয়ের নিকট আজ প্রথম পরিচিত নহি, অনেক পূৰ্ব্ব হইতে আপনি আমাকে উত্তমরূপে অবগত আছেন। সুতরাং আপনি মনে মনে বেশ জানেন যে, আমি আপনার নিকট মিথ্যা কথা বলিব, কি সত্য কথা কহিব।
ইহার পর নফরচন্দ্রকে আমি আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া, সকলকে সঙ্গে লইয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। ক্রমে প্রায় ষোল মাইল পথ অতিক্রম করিয়া রাত্রি প্রায় এগারটার সময় পূর্ব্বোক্ত কৃষ্ণনগর গ্রামে আমরা সকলে আসিয়া উপনীত হইলাম।
পথে আসিতে আসিতে নানাপ্রকার কথোপকথন সূত্রে এই ঘটনার আনুপূর্ব্বিক ব্যাপার জানিবার নিমিত্ত নানা কৌশলে নফরচন্দ্রকে নানা কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম। নফরচন্দ্রও সমস্ত কথা ক্রমে আমার নিকট প্রকাশ করিল। কৃষ্ণনগরে আসিয়া আমি উহা লিখিয়া লইলাম। পরদিবস নফরচন্দ্রকে লইয়া বিষ্ণপুরে মাজিস্ট্রেট সাহেবের নিকটা গমন করিব, মনে মনে এইরূপ সঙ্কল্প করিয়া রাত্রির অবশিষ্টাংশ সেইস্থানেই অতিবাহিত করিলাম।
নবম পরিচ্ছেদ
পরদিবস প্রায় ষোল মাইল পথ অতিক্রম করিয়া আমরা বিষ্ণুপুর গ্রামে গিয়া উপনীত হইলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ মাজিস্ট্রেট সাহেবকে সেইস্থানে পাইলাম না, সেই সময় তিনি মফঃস্বলে কাছারি করিতেছিলেন। জানিতে পারিলাম যে, এখন তিনি সোনামুখি গ্রামে অবস্থিতি করিতেছেন। বিষ্ণুপুর হইতে সোনামুখি গ্রাম প্রায় আঠার মাইল ব্যবধান, পুনরায় আমরা সেইস্থানে গমন করিলাম। সেইস্থানে ডেপুটি মাজিস্ট্রেটবাবুর সহিত সাক্ষাৎ হইল। নফরচন্দ্র আমার নিকট যে প্রকার বলিয়াছিল, তাঁহার নিকটও সেই প্রকার কহিল। সেই সকল কথোপকথন আনুপূর্বিক বর্ণন করিতে গেলে পুস্তকের আকার বড় হইবে, অথচ সেই সকল কথা না বলিলেও এ ঘটনার সম্পূর্ণতা রক্ষা হয় না; সুতরাং পাঠকগণের অবগতির নিমিত্ত নফরচন্দ্র যে সকল কথা বলিয়াছিল, তাহার স্থূল বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হইল।—
“আমি বহুদিবস হইতে কলিকাতায় অবস্থিতি করিতেছি। কোন না কোন আফিসে সরকারের কার্য্য করিয়া আমি আমার জীবিকা নির্ব্বাহ করিয়া থাকি। বহুদিবস অতীত হইল, এক সময় হিন্জার কোম্পানির গুদাম সরকার মহাশয় কিছু দিবসের নিমিত্ত বিদায় গ্রহণ করিয়া আপনার দেশে গমন করেন। সেই সময় আমি সেই আফিসে একটি কাৰ্য্যে নিযুক্ত হই। নীল বা অন্যান্য দ্রব্যাদি যাহা বিলাতে রপ্তানি হইয়া থাকে, সেই সকল দ্রব্য গুদাম হইতে বাহির করিয়া জেটিতে প্রেরণ করা আমার কাৰ্য্য ছিল। বাক্স সকল গুদাম হইতে বাহির করিয়া আনিবার পর প্রথমে সেই সকল বাক্স খোলা হইত, এবং সেই সকল দ্রব্যের গুণাগুণ দেখিয়া পরিশেষে সেই সকল বাক্স বন্ধ করা হইত। বাক্স উত্তমরূপে বন্ধ হইলে যেরূপ চট দিয়া বাক্স সকল চিরদিবসই মোড়াই করা হইয়া থাকে, সেইরূপভাবে মোড়ক করিয়া প্রত্যেকের উপর পৃথক পৃথক নম্বর একই ভাবে দেওয়া হইত, ও পরিশেষে গরুর গাড়িতে বোঝাই করিয়া সেই সকল দ্রব্যাদি জেটীতে পাঠাইয়া দেওয়া হইত। আমাদিগের আফিসের এইরূপ কার্যপ্রণালী ছিল। এই প্রণালী অনুসারে কিছুদিবস কার্য্য করিলাম, পরিশেষে যিনি ছুটিতে ছিলেন, তিনি প্রত্যাগমন করিলেন; সেই সঙ্গে আমারও চাকরি শেষ হইল।
“ঢাকরি শেষ হইবার পর অনেক দিবস পর্যন্ত বেকার অবস্থায় বসিয়া রহিলাম; কিন্তু কোনস্থানেই আর কোনরূপ ঢাকরির সংগ্রহ করিয়া উঠিতে পারিলাম না। ক্রমে আমার খরচ পত্রের নিতান্ত অনটন হইয়া আসিতে লাগিল।
“কোন উপায় অবলম্বন করিলে কিছু অর্থের সংগ্রহ করিতে পারিব, একদিবস বসিয়া বসিয়া ইহা ভাবিতেছি, এমন সময় আমার মনে এই দুষ্কর্ম্মের বীজ প্রথমে অঙ্কুরিত হইল। সেই বীজ অতীব যত্নের সহিত হৃদয়ে ধারণ করিয়া চিন্তা করিতে করিতে ক্রমে বৃহৎ বৃক্ষে পরিণত হইল। তখন অন্য চিন্তা পরিত্যাগ করিয়া সেই চিন্তাতেই মন নিযুক্ত করিলাম। কালার দোকান করিব বলিয়া নিমতলায় একখানি ঘর ভাড়া লইলাম, এবং কতকগুলি কয়লা ক্রয় করিয়া সেইস্থানে রাখিয়া দিলাম।
“হিলজার কোম্পানি যেরূপ বাক্স করিয়া নীল সকল বিলাতে প্রেরণ করিয়া থাকেন, তাহা আমি জানিতাম। আরও জানিতাম, এক গাড়িতে চারি বাক্সের অধিক নীল বোঝাই হয়না; সুতরাং সেই প্রকারের চারিটি খালিবাক্স ক্রয় করিয়া আনিতে আমার কোন কষ্টই হইল না। আমি দোকান করিবার ভান করিয়া যে ঘর ভাড়া লইয়াছিলাম, সেই খালি বাক্স চারিটি সেই ঘরে লইয়া গিয়া তাহাতে উত্তমরূপে কয়লা বোঝাই করিলাম। পথে যেরূপ চটের দ্বারা নীলের বাক্স মোড়াই হইয়া থাকে, সেইরূপ চট ক্রয় করিয়া তাহার দ্বারা সেই চারিটি বাক্স উত্তমরূপে মোড়াই করিলাম। মুরগিহাটায় আর একটি স্থান ঠিক করিয়া সেই বাক্স কয়েকটি লইয়া সেইস্থানে রাখিয়া দিলাম।
“এইরূপে বাক্স চারিটি প্রস্তুত হইবার পর প্রত্যহই হিজার কোম্পানির আফিসের নিকট গমন করিয়া দেখিতে লাগিলাম যে, তাহাদিগের আফিস হইতে জেটাতে নীলের চালান হইতেছে কি না। প্রায় পনর দিবস পর্য্যন্ত এইরূপে যাতায়াত করিতে লাগিলাম, কিন্তু সেই পনর দিবসের মধ্যে কোনরূপ নীলের বাক্স আফিস হইতে চালান হইল না। এইরূপে আরও কয়েক দিবস অতীত হইয়া গেল। প্রায় কুড়ি দিবস পরে দেখিলাম, হিন্জার কোম্পানির গুদাম হইতে নীলের বাক্স গরুর গাড়িতে বোঝাই হইতেছে। সেই গাড়ি সকল যেমন বোঝাই হইতে লাগিল, অমনি গাড়োয়ানেরা আপন আপন গাড়ির চালান লইয়া জেটিতে গমন করিতে লাগিল।
“যখন প্রথম গাড়োয়ান বাহির হইল, তখন আমি তাহাকে কিছু বলিলাম না। দ্বিতীয় গাড়োয়ান আফিস হইতে বাহির হইয়া একাকী গমন করিতে লাগিল। আমিও দূর হইতে তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলাম। যখন দেখিলাম, হিন্জার কোম্পানির আফিস ছাড়াইয়া দূরে গমন করিয়াছে, তখন আমি দ্রুতপদে সেই গাড়ির নিকট গমন করিয়া সেই গাড়োয়ানকে কহিলাম, ‘হিজার কোম্পানির আফিস হইতে তুমি এই মাল লইয়া আসিতেছ?
গাড়োয়ান। হাঁ মহাশয়।
নফর। ইহাতে নীল বোঝাই আছে না?
গাড়োয়ান। শুনিয়াছি, নীল বোঝাই আছে।
নফর। তোমার গাড়ি দ্বিতীয় নম্বরে বোঝাই হইয়াছে না?
গাড়োয়ান। হাঁ মহাশয়।
নফর। তোমার চালানে লেখা আছে, এই মাল জেটীতে যাইবে?
গাড়োয়ান। হাঁ মহাশয়।
নফর। চালান লেখার ভুল হইয়াছে বলিয়া, আমি আফিস হইতে দৌড়িতে দৌড়িতে তোমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিয়াছি। এই চারি বাক্স মাল জেটীতে যাইবে না, এই মাল কয়লাঘাটে যাইবে। তুমি গাড়ি লইয়া আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আইস, যে স্থানে এই মাল রাখিতে হইবে, তাহা আমি তোমাকে দেখাইয়া দিব।
“যে সময় আমি হিজার কোম্পানির বাড়ীতে কর্ম করিতাম, সেই সময় এই গাড়োয়ান অনেকবার আমার নিকট হইতে চালান লইয়া আসিয়াছিল বলিয়া, আমাকে হিজার কোম্পানির একজন কর্মচারী বলিয়া সে জানিত। সুতরাং আমার কথায় বিশ্বাস করিয়া সে নীলের গাড়ি জেটীতে লইয়া না গিয়া আমার আদেশ মত আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিল, এবং পরিশেষে কয়লাঘাটে উপস্থিত হইলে তাহাকে বাক্সগুলি নামাইতে কহিলাম। সে আমার আদেশমত কার্য্য করিলে তাহার নিকট হইতে চালানখানি গ্রহণ করিলাম ও তাহাকে ভাড়া মিটাইয়া দিলাম। ভাড়া পাইয়াই গাড়োয়ান সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল। সেই বাক্স চারিটির উপর যে নম্বর লিখিত ছিল, তাহা লিখিয়া লইয়া আমি দ্রুতপদে সেইস্থান হইতে চলিয়া আসিলাম। নীলের বাক্সগুলি কয়লাঘাটেই পড়িয়া রহিল।
“মুরগিহাটায় যে স্থানে আমার কয়লা বোঝাই বাক্স কয়েকটি রাখা ছিল, তাহার উপর আনীত নম্বরগুলি ঠিক সেইরূপভাবে লিখিয়া দিলাম। নম্বরাদি লিখিতে হইলে কালি প্রভৃতি যে সকল দ্রব্যের প্রয়োজন হয়, তাহার সমস্তই আমি পূৰ্ব্ব হইতে সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিলাম।
“বাক্সগুলিতে নম্বর দেওয়া সমাপ্ত হইলে, রাস্তা হইতে একখানি গরুর গাড়ি ডাকিয়া আনিলাম। উহাতে সেই কয়লা বোঝাই বাক্স চারিটি বোঝাই দিলাম, এবং পূর্ব্ব গাড়োয়ানের নিকট হইতে চারি বাক্স নীলের চালানের কাগজ যাহা আমি গ্রহণ করিয়াছিলাম, তাহা আমি এই গাড়োয়ানের হস্তে প্রদান করিলাম ও কহিলাম, সেই চারি বাক্স নীল জেটিতে লইয়া যাইতে হইবে। গাড়োয়ান আমার নির্দেশমত বাক্স লইয়া জেটিতে গমন করিল। আমি দূর হইতে তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিলাম। যখন দেখিলাম, বিনা গোলযোগে তাহার গাড়ি জেটীর ভিতর প্রবেশ করিল, তখন আমি কয়লাঘাটে গমন করিলাম। নীলের বাক্স চারিটি এ পর্যন্ত সেইস্থানে পড়িয়াছিল। আমি তখন অপর আর একখানি গরুর গাড়ি ভাড়া করিয়া সেই বাক্সগুলি লইয়া তেরহেটি বাজারে গমন করিলাম। সেইস্থানে পূর্ব্ব হইতেই কয়েকজন দোকানদারকে আমি স্থির করিয়া রাখিয়াছিলাম। তাহাদিগের সহিত আমার এইরূপ বন্দোবস্ত হইয়াছিল যে, আমি যত পরিমিত নীল লইয়া তাহাদিগের দোকানে দিতে পারিব, তাহার অর্দ্ধেক মূল্যে তাহারা সমস্তই গ্রহণ করিবে। এই নীলের বাক্স চারিটি তাহাদিগের নিকট যেমন লইয়া গেলাম, অমনি তাহারা এই বাক্স খুলিয়া ফেলিল, এবং নীল সকল সকলে মিলিয়া অংশ করিয়া লইল। বলা বাহুল্য, তাহারা আমাকে অৰ্দ্ধেক মূল্য ক্রমে ক্রমে প্রদান করিয়াছিল, এবং আমিও ইচ্ছামত অপব্যয় করিয়া অতি অল্প দিবসের মধ্যেই সেই সমস্ত অর্থ নষ্ট করিয়াছিলাম।
“এইরূপে কিছুদিবস গত হইলে পুনরায় আমার তার্থের অনটন আরম্ভ হইল। তখন সেই পন্থা অবলম্বন করিয়া পুনরায় কিছু অর্থ সংগ্রহের বাসনা করিলাম। বাসনা মনে উদিত হইবামাত্র কার্য্যেও পরিণত করিলাম।
“পূর্ব্বরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া পুনরায় চারিটি বাক্স সংগ্রহ করিলাম, পুনরায় কয়লার দ্বারা উহা পরিপূর্ণ করিয়া পূর্ব্বের ন্যায় চটাদি মুড়িয়া মুরগিহাটায় লইয়া গিয়া রাখিয়া দিলাম। পরে যে দিবস আফিস হইতে নীলের চালান আরম্ভ ইহল; সেইদিবস পূৰ্ব্বকথিত উপায়ে আমি একটি গাড়োয়ানকে ভুলাইয়া কয়লাঘাটে লইয়া গেলাম, এবং সেইস্থানে নীলের বাক্স কয়েকটি রাখিয়া তাহাকে ভাড়া দিয়া গ্রহণ করিলাম। এদিকে কয়লা বোঝাই বাক্সে নম্বর দিয়া আর একখানি গরুর গাড়ি করিয়া উহা জেটিতে পাঠাইয়া দিলাম। পরে আমি কয়লাঘাট হইতে নীলের বাক্স চারিটি অপর আর একখানি গাড়িতে বোঝাই দিয়া তেরহেটি বাজারে আসিবার কালে দেখিলাম, আফিসের একটি লোক আসিয়া পথের মধ্যে গোলযোগ বাঁধাইয়া দিল। তখন আমার মনে ভয়ের উদয় হইল যে, এইবার আমি ধৃত হইব। এই ভাবিয়া সেইস্থান হইতে তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করিলাম, এবং পরিশেষে শহরেও থাকিতে সাহস না হওয়ায় কলিকাতাও পরিত্যাগ করিলাম। কিন্তু তাহাতেও আপনাদিগের হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইলাম না।”
এই বলিয়া নফরচন্দ্র নিরস্ত হইল।
এই সকল ব্যাপার শ্রবণ করিয়া এখন অবগত হইতে পারিলাম যে, কিরূপ উপায়ে এই ভয়ানক জুয়াচুরি সাধিত হইয়াছে। এই নূতন ধরণের জুয়াচোরের ব্যাপার শ্রবণ করিয়া অতিশয় বিস্মিত হইলাম, এবং মনে মনে নফরচন্দ্রের বুদ্ধিরও প্রশংসা করিতে লাগিলাম।
নফরচন্দ্র যাহা যাহা বলিল, মাজিস্ট্রেট সাহেব তাহার সমস্ত আদ্যোপান্ত লিখিয়া লইয়া আসামীকে আমার হস্তে প্রদান করিলেন। আমি ৪ঠা মার্চ তারিখে অপরাহ্নে সেই সোনামুখি হইতে আসামী সহিত বহির্গত হইয়া বার মাইল পথ অতিবাহিত করিয়া পরদিবস প্রত্যূষে পানাগড় স্টেশনে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। সেইস্থান হইতে রেলে আরোহণ করিয়া কলিকাতায় চলিয়া আসিলাম।
কলিকাতায় নফরচন্দ্রের বিচার হইল। পূর্ব্বকার কাগজপত্র এবং সাক্ষী সাবুদে বিচারে নফরচন্দ্র দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় ইংরাজী ১৮৯৪ সালের ৩রা এপ্রিল তারিখে দেড় বৎসরের জন্য কারাগারে প্রেরিত হইল। এতদূর শারীরিক পরিশ্রম করিয়া এত কষ্টে এই মোকদ্দমার প্রমাণ করিয়া দিলাম সেই নিমিত্ত আমিও গবর্ণমেন্ট হইতে দুইশত মুদ্ৰা পারিতোষিক প্রাপ্ত হইলাম।
[অগ্রহায়ণ, ১৩০২]