নীলাম্বরের খিদে

নীলাম্বরের খিদে

লোকটা দিব্যি উবু হয়ে বসে চায়ের পেয়ালায় সুড়ুত সুড়ুত করে চুমুক দিচ্ছিল, হঠাৎ আমার প্রশ্নে চোখদুটো তুলে তাকাল।

আমি লক্ষ করলাম ওর সামনের দাঁতদুটো স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিই যেন বড়, ঠোঁটদুটো ফাঁক করলেই সেদুটো চোয়ালের দুদিক থেকে একরকম আগ বাড়িয়ে বেরিয়ে আসছে।

লোকটা কিছুক্ষণ সেভাবেই নিঃশব্দে হাসল, তারপর কেমন ঘ্যাসঘেসে গলায় খাঁটি বাংলাদেশি টানে বলল, ”রাজামশাই যে এখনও এইসব দেখছেন না, কী করে জানলেন কর্তা আপনি?”

আমি অস্বস্তিটা দূরে ঠেলে দিয়ে হেসে বললাম, ”হে হে, সেই আর কী! ইতিহাস তো এভাবেই চাপা পড়ে যায়, সাক্ষী থাকে পুরনো ইট,কাঠ, পাথর। ঠিকমত রক্ষণাবেক্ষণ না হলে …!”

লোকটা আমাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিল, আশপাশ একবার তাকিয়ে নিয়ে একনাগাড়ে বেজে যাওয়া সাপের বীণের মত অদ্ভুত ঝিমধরানো লয়ে বলল, ”ইতিহাস নয় কত্তা, জ্যান্ত মানুষ!”

মানুষ কথাটার শেষটা এমন একটা সাপের মত হিসহিস টান দিয়ে শেষ করল লোকটা, যে আমি এরপর আর কী বলব বুঝতে না পেরে ওর দিকে তাকালাম।

বেশভূষা দেখে একটু ছিটগ্রস্থ মনে হচ্ছে, কিন্তু তা অভাবের তাড়নাতেও হতে পারে ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন ভাবলাম, যেচে বাড়িতে ডেকে আনলাম, মাথার গোলমাল টোলমাল নেই তো?

এমনিতে লোকটাকে মাঝেমধ্যেই আমার বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে দেখতাম। একমুখ খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি, কোটরের অনেকটা ভেতরে ঢুকে যাওয়া দুটো ঘোলাটে চোখ। অপরিচ্ছন্ন ঠোঁট, লম্বাটে গোলাকার মাথায় কেমন ধু ধু মরুভূমির বুকে দু-একটি পাতাবিহীন গাছের মত কয়েকগাছি কেশ তালগাছের মত খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

কিছু মানুষকে দেখলেই মনে হয় এ নামেমাত্র বেঁচে আছে, আসলে ভেতরে ভেতরে মরে গেছে অনেকদিন। এই লোকটাও যেন তেমনই। বারান্দা থেকে লক্ষ করতাম, সামান্য কুঁজো হয়ে লোকটা যখন হাঁটে, চোখের ভেতরের ধূসর নেত্রবলয়দুটো দিকশুন্য মরা মাছের মত তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে। কয়েক পা করে হেঁটেই কুকুরের মত জিভ বের করে হাঁপায়। তারপর আমার বাড়ির দিকে একবার আলগোছে তাকিয়েই আবার হাঁটতে শুরু করে।

সেই তাকানোর মধ্যে অবশ্য সন্দেহের কিছু ছিলনা, আমার ভাড়া নেওয়া এই বাড়িটা গ্রামের একদম শেষপ্রান্তে, কাছেপিঠে কোন গৃহস্থ আবাস নেই। তাই রাস্তা দিয়ে চলার সময় কৌতূহলে এদিকে তাকানো কোন পথচারীর পক্ষে খুব স্বাভাবিক। তাছাড়া গ্রামের লোকেদের কৌতূহল একটু বেশিই হয়, খেয়াল করে দেখেছি।

লোকটাকে সাধারণত দেখতাম সকালবেলা, ন’টা দশটা নাগাদ। আর যখনই দেখতাম, ঊর্ধ্বাঙ্গে কোন পোশাক থাকতনা। নিম্নাঙ্গে শুধুমাত্র পাতলা সুতির একটা লুঙ্গি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে পরা। পা-দুটো ভেজা, কপালে লম্বা সিঁদুরের একখানা তিলক। কাঁধের একদিক থেকে ঝোলে শতচ্ছিন্ন ভিজে গামছা।

দেখলেই মনে হয় কাছের কোন পুকুর থেকে স্নান সেরে ফিরছে। তিলক দেখে পুজোর কথাও মনে হয়। আমার বাড়ি শেষ হতেই ওদিকে শুরু হয়ে যাচ্ছে পরিত্যক্ত অরণ্য। সেখানে যে শুধুই আগাছা এবং বড়বড় গাছপালা রয়েছে তাই নয়, হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে খুঁজলে পুরাকালের কিছু ইট বা ভাঙা দুর্গের ধ্বংসাবশেষও চোখে পড়বে।

আর চোখে পড়বে অজস্র ছোট বড় পুকুর। কোনোটা মজে গিয়েছে, কোনোটায় এখনও জল টলটল করছে।

এখানে এসেছি ঠিক একসপ্তাহ হল। তবে এরমধ্যেই আমার কাজ বলতে গেলে পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। সকালে জলখাবার সেরে বেরিয়ে পড়ি, হাঁটা দিই সাইটের দিকে। সেখানে কুড়িজন স্থানীয় লোক নিয়ে আপাতত পরিষ্কার করার কাজ চলছে। ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে তাদের তদারক করি। কাজ শেষে যখন বাড়ি ফিরি, তখনও ব্যস্ততা থেকে রেহাই নেই, হেড অফিসের সঙ্গে ল্যাপটপে ইমেল চালাচালি চলে ঘনঘন। দুই দেশের যৌথ কাজ বলে কথা, আলোচনা হয় গোটা প্রজেক্টটার প্ল্যান, প্রোগ্রেস, বাজেট নিয়ে।

সকালে বেরনোর আগে যখন বাড়ির সামনের খোলা রোয়াকে একটু আয়েশ করে বসতে আসি, তখনই রোজ লোকটাকে খেয়াল করি। আশ্বিন মাস শেষ হতে চলেছে, শীত এখনও উঁকি না দিলেও বাতাসে ঠাণ্ডা ঝলক মাঝেমধ্যেই শিরদাঁড়ায় কাঁপুনি ধরায়।

সেখানে এই লোকটার কী শীতও করেনা?

আজ শুক্রবার, জুম্মাবার বলে এই তল্লাটে আজ সব ছুটি রয়েছে, শ্রমিকেরা কেউ কাজ করবে না। কাজেই আমারও ছুটি। গায়ে পাতলা একটা চাদর জড়িয়ে এসে বসেছিলাম বাইরের রোয়াকে। আমার চারবছরের পুরনো ভৃত্য ইকবাল বেশ বড় একখানা মাগ ভর্তি কফি দিয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে একগোছা স্যান্ডউইচ। আলু, গাজর এবং আরো নানারকম সবজী দিয়ে বানানো। স্যান্ডউইচে এক কামড় করে দিচ্ছিলাম আর উপভোগ করছিলাম বাইরের প্রকৃতিকে। শীতের আগমন না হতেই চারপাশের গাছগাছালিতে কেমন একটা ধূসর রঙ লেগেছে, দূরে পাখির কলতান শোনা যাচ্ছে বেশ জোরে। দেখতে দেখতে আমার ছোটবেলায় বড় হয়ে ওঠা বীরভূমের সেই গ্রামের কথাই মনে পড়ে যাচ্ছিল বারবার।

সত্যি, দেশ আলাদা হতে পারে, মানুষ দেশ ভেঙে দু-টুকরো করতে পারে, কিন্তু প্রকৃতি সেকথা শুনবে কেন? সে তো সবজায়গাতেই চিরন্তন, অবিনশ্বর।

এইসব যখন দার্শনিক কথা মনে মনে ভাবছি, ঠিক তখনই পেছনের জঙ্গলের দিক থেকে খকখক করে কাশতে কাশতে আসতে দেখেছিলাম লোকটাকে। বসে বসে একঘেয়ে লাগছিল, তাই ভাবলাম সেভাবে তো কারুর সঙ্গে এখানে পরিচয় হয়নি, এর সাথেই একটু আলাপ করা যাক।

কিন্তু এখন দেখছি কাজটা আহাম্মকের মতই করেছি। লোকটা নেহাতই বাজে বকে।

এটা বাংলাদেশের একটা প্রত্যন্ত গ্রাম। আমি ভারত সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগের একজন আরকিওলজিস্ট। আমার আসল কাজের জায়গা হল কুচবিহারের দিনহাটা মহকুমার গোঁসানিমারি গ্রাম। গোঁসানিমারি গ্রামে প্রাচীন কামতা সাম্রাজ্যের প্রচুর ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। তখন অবশ্য সেই অঞ্চলের নামও ছিল কামতাপুর। ত্রয়োদশ শতকে পাল বংশের পতনের পর কামরূপ অর্থাৎ এখনকার আসামের কিছু অংশ, বাংলাদেশের উত্তরভাগ ও কুচবিহার দিনাজপুরের কিছুটা নিয়ে গড়ে উঠেছিল কামতা সাম্রাজ্য। বেশ কয়েকশো বছর ছিল এই সাম্রাজ্যের দাপট, তারপর বাংলার গৌড়ের সুলতান হুসেইন শাহ এসে গোটা সাম্রাজ্যকেই ধ্বংস করে দেন।

কুচবিহারের গোঁসানিমারি গ্রামে এখনও ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে কামতা সাম্রাজ্যের অনেক দুর্গ, রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ। ভারত সরকার গোটা অঞ্চলটাকেই এখন আরকিওলজিক্যাল সাইটে পরিণত করেছেন। সেখানেই গত চারবছর ধরে পোস্টেড ছিলাম আমি।

কিন্তু সম্প্রতি ভারত বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, কামতা সাম্রাজ্যের যে অঞ্চলগুলো বর্তমানে বাংলাদেশে পড়ছে, সেখানেও অনুসন্ধানকার্য চালানো হবে। যেহেতু আমাদের মত ভারতীয় আরকিওলজিস্টদের কামতা সাইটগুলো সম্পর্কে আগে থেকেই অভিজ্ঞতা রয়েছে, আমাদের কিছুজনকে বেছে নিয়ে একটি দল গঠন করা হয়েছে এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন সাইটে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রাথমিক অনুসন্ধানের জন্য। বাংলাদেশের আরকিওলজিস্টরাও অবশ্য আমাদের সাহায্য করবেন।

আমার ভাগ্যে পড়েছে কামতা সাম্রাজ্যের শেষ রাজা নীলাম্বরের দুর্গ, বসতভিটে ইত্যাদি। এগুলো সবই এখন বাংলাদেশে। বাংলাদেশের একেবারে উত্তরদিকে রংপুর নামে একটি জেলা রয়েছে, আমাদের পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহারের দিনহাটা থেকে সেই রংপুর মোটে ঘন্টা তিনেকের পথ। সেই রংপুর জেলারই পীরগঞ্জ উপজেলার এক গ্রামে এখন রয়েছি আমরা।

আমরা বলতে আমি, আমার আটবছরের মেয়ে নূপুর, ওকে সর্বক্ষণ দেখভাল করা বাসন্তীদি, আমার চাকর ইকবাল। আর রয়েছে মুকুন্দ। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া এদেশীয় লোক হিসাবে মুকুন্দকে দেওয়া হয়েছে আমার সঙ্গে, যে এক্সক্যাভেশন চলার সময় স্থানীয় মানুষের মদত নিতে সাহায্য করবে, শ্রমিক জোগান দেবে আর আমার থাকার ব্যবস্থা করবে।

মুকুন্দ এদিককারই ছেলে, পুরাতত্ত্বের ওপর একটা সার্টিফিকেট কোর্স করে সে এখন রাজধানী ঢাকা শহরে পুরাবিভাগে কন্ট্রাক্টের ভিত্তিতে কাজ করে। ছেলেটা বেশ করিৎকর্মা, আমার ভারতীয় টাকা বাংলাদেশী মুদ্রায় ভাঙানো থেকে শুরু করে মোবাইলের নতুন কানেকশনের ব্যবস্থা, সব প্রথম দিনেই ঝটপট করে ফেলেছে।

গ্রামের এককোণে এই বাড়িটা তালাবন্ধ অবস্থায় পড়েছিল, বাড়িওয়ালা থাকে রংপুর শহরে। মুকুন্দই সব যোগাযোগ করে বাড়িটা ভাড়া নিতে সাহায্য করেছে। তবে অনেকবার বলা সত্ত্বেও সে নিজে আমাদের সঙ্গে থাকছেনা, এই বাড়ি থেকে মিনিটপাঁচেক দূরে সে তার এক আত্মীয়ের বাড়ি রয়েছে।

আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, যে গ্রামটায় রয়েছি, তার আলাদা করে কোন নাম নেই। পীরগঞ্জ সদর থেকে দক্ষিণে প্রায় চোদ্দ কিলোমিটার দূরে রয়েছে ধাপেরহাট বন্দর। সেই বন্দরের পাশ দিয়ে চলে গেছে রংপুর থেকে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা যাওয়ার মহাসড়ক। ধাপেরহাট বন্দর থেকে পশ্চিমে প্রায় দশ কিলোমিটার এলে তবে এই গ্রামে পৌঁছনো যায়।

সবাই এটাকে নীলাম্বর রাজার গ্রাম বলেই চেনে।

যেদিন প্রথম পাসপোর্ট হাতে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে গাড়িতে করে ধুলো উড়িয়ে সোজা এই গ্রামে এসেছিলাম, সেদিন স্থানীয় গ্রামবাসীরা কৌতূহলী চোখে ভিড় জমিয়েছিল আমাদের গাড়ির চারপাশে। বাংলা ভাষায় কথা বললেও এই অঞ্চলের অধিবাসীদের টানটা একটু আলাদা।

মুকুন্দ ওদের সংক্ষেপে বুঝিয়েছিল, ”ইনি ডঃ প্রীতম সেনগুপ্ত, ভারত থেকে আসছেন।”

ডক্টর কথাটা শুনে সামনের একজন উল্লসিত গলায় বলেছিল, ”ডাক্তারবাবু?”

”আহ এ ডাক্তার সে ডাক্তার নয়।” মুকুন্দ মাছি তাড়ানোর ভঙ্গীতে হাত নেড়ে বলেছিল, ”ইনি ইতিহাসের ডাক্তার বুঝলি? এখানে নীলাম্বর রাজার দুর্গ, রাজবাড়ি এগুলোকে সব পরিষ্কার করে টুরিস্ট সাইট করবে গরমেন্ট, তখন দেখবি এই গ্রামে কত ভিড় হবে, দোকানপাটে ছেয়ে যাবে, তোরা সব বড়লোক হয়ে যাবি …।”

বড়লোক কে কত হবে জানিনা, তবে শুনতে শুনতে লোকগুলোর মুখে একটা ভয়মেশানো সমীহের ভাব ফুটে উঠেছিল। বাচ্চাগুলো পরম আদরে হাত বুলোচ্ছিল সরকারী তরফে দেওয়া আমার গাড়িটার গায়ে।

কেউ কেউ অবাক চোখে দেখছিল আমার মেয়ে নূপুরের পরনের দামী জামাটাকে।

একজন মুরুব্বি গোছের লোক একটু পরে এগিয়ে এসে বলেছিল, ”রাজার বাড়ি পরিষ্কার কী না করলেই নয়? ওদিকে তো কেউ যায়না, গেলে নানা বিপদ হয়।”

মুকুন্দ তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতে বলেছিল, ”বিপদ আবার কী! বলছি গরমেন্টের কাজ! কত টাকা ঢালা হচ্ছে জানো?”

লোকটা মাথা নেড়ে আবার বলেছিল, ”কদ্দিন চলবে এই কাজটা?”

”তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তিন-চারমাস লাগতে পারে বা তার বেশিও।” মুকুন্দ গম্ভীর গলায় উত্তর দিয়েছিল।

লোকটা মাথা চুলকে অন্যদের সঙ্গে দৃষ্টিবিনিময় করে টরে বলেছিল, ”তা আমাদের গাঁয়ের ছেলেরা কাজ-টাজ পাবে?”

”পাবে বৈকী!” মুকুন্দ ঘাড় নেড়েছিল, ”প্রথমে তো জায়গাগুলো পরিষ্কার করতে হবে, তখন গ্রামের জোয়ান ছেলেরাই তো হাত লাগাবে। রোজ হিসেবে মজুরিও পাবে।”

এখানকার মানুষের সারল্যমাখা মুখচোখ দেখে সেদিনই বুঝেছিলাম আশপাশের পৃথিবী যতই উল্কার গতিতে এগিয়ে চলুক না কেন, এই গ্রামটা থমকে আছে বহু আগেই।

পাঁচশো বছর আগে কামতা সাম্রাজ্য আসামে বা কুচবিহারে যতদূরই বিস্তৃত থাকুক, শেষ রাজা নীলাম্বরের রাজবাড়ি ছিল এখানে। নীলাম্বর ছিলেন কামতা সাম্রাজ্যের শেষ ও শ্রেষ্ঠ রাজা। রাজবাড়িকে মাঝখানে রেখে চারদিকে বিশাল প্রস্থ নিয়ে তিনি খনন করেছিলেন এক সুগভীর পরিখা।

সেই পরিখার নাম নীলদরিয়া।

নীলদরিয়া এখনও রয়েছে, কিন্তু পর্যবসিত হয়েছে অপরিচ্ছন্ন এক জলাশয়ে। এতদিন এইদিকটা কোন পুরাতাত্ত্বিক অভিযান হয়নি। এবার মূলত আমার নেতৃত্বে এই নীলদরিয়া, তারমধ্যেকার ভগ্নপ্রায় পরিত্যক্ত রাজবাড়ি, পাশের বিশাল প্রাচীরে ঘেরা রাণীরঘাটে খনন শুরু হবে। কিছুদিন পর অবশ্য কিছু জুনিয়র আরকিওলজিস্টও পাঠানো হবে আমার তত্ত্বাবধানে কাজ করার জন্য। তখন নিয়মিত স্পেসিমেন কালেক্ট করে ছবি তুলে পাঠাতে হবে বাংলাদেশ পুরাতত্ত্ব বিভাগে, তারপর সেখান থেকে সপ্তাহে একবার তদারকির অফিসার আসবেন, এমনই অনেকরকম কথা হয়ে রয়েছে। গোটা প্রোজেক্টের জন্য সময় প্রাথমিকভাবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে তিনমাস। পরে হয়ত পরিস্থিতি বুঝে সময় আরো বাড়ানো হতে পারে।

উঁচু নিচু ঢালু উপত্যকাপ্রবণ এই অঞ্চল, মধ্যে মধ্যে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কোন ভগ্ন স্থাপত্য। কাছাকাছি জমজমাট জায়গা বলতে আধঘন্টা দূরের চতরাহাট। সেখানে বেশ বড় বাজার আছে, আসার পর প্রয়োজনীয় টুকিটাকি কেনার জন্য সেখানে গিয়েওছিলাম একদিন। চতরাহাটের পাশ দিয়েই মেঠো রাস্তা চলে এসেছে এই গ্রামে। সেই রাস্তা দিয়ে ফেরত আসতে বেশ লেগেছিল, ভাষার টানটা বাদ দিলে মনেই হচ্ছে না যেন অন্য কোন দেশে এসেছি।

নীলাম্বর রাজার সময় যত সমৃদ্ধিই থাক, এখন এই গ্রামে জনবসতি সেভাবে নেই। বড়জোর একশো ঘর লোকের বাস। প্রত্যেকেই হতদরিদ্র, ঘরের সামনে একচিলতে করে সবজী ফলিয়ে আর মাঠে চাষবাস করে কাটে তাদের নিস্তরঙ্গ জীবন। তারা কেউ তেমন আলাপীও নয়, কিংবা আলাপী হলেও ভাষাগত সমস্যার কারণে আর আমাদের শহুরে হাবভাবে তাদের আড়ষ্টতা কাটতে চায় না। আমাদের সাইটের জন্য সব শ্রমিক গ্রাম থেকে পাওয়াও যায়নি, জোগাড় করে আনতে হয়েছে আশপাশের কয়েকটা গ্রাম থেকে।

তাই স্রেফ আলাপ করার জন্যই আজ সকালে ডেকে এনেছি এই লোকটাকে।

ভাবতে ভাবতে কোথায় চলে গিয়েছিলাম, সম্বিৎ ফিরল লোকটার কথায়, ”তোমার নাম কী মা?”

আমি ফিরে তাকিয়ে দেখি, কখন পায়ে পায়ে ভেতর থেকে নূপুর এসে দাঁড়িয়েছে আমার চেয়ার ঘেঁষে। পরনে লাল-হলুদ ফুল ছাপ দেওয়া একটা হাঁটু পর্যন্ত ফ্রক, চোখে সারাক্ষণ পরে থাকা চশমা। বাসন্তীদি এই সাতসকালেই পরিপাটি করে চুল বেঁধে দিয়েছে ওর, দুদিকে দুটো ঝুঁটি এলিয়ে পড়েছে কাঁধের দু’পাশে।

লোকটার প্রশ্ন শুনে নূপুর বড় বড় চোখ মেলে তাকাল আমার দিকে।

আমি বললাম, ”ওর নাম নূপুর।”

লোকটা কিছুক্ষণ জুলজুল করে তাকিয়ে রইল নূপুরের দিকে, তারপর আপাদমস্তক দেখে বলল, ”বয়স কত মা তোমার?”

আমি নূপুরকে আদর করে কাছে টেনে নিলাম। লোকটার দিকে তাকিয়ে বললাম, ”নূপুর কথা বলতে পারে না। জন্ম থেকেই। ও এই আটবছরে পড়েছে। আমার স্ত্রী ওর জন্মের পরপরই মারা গিয়েছিলেন। তখন থেকে ওর বাবা-মা দুটোই আমি।”

এই কথা শোনার পরে সবার মুখেই একটা আহা-উহু বা করুণার ভাব দেখতে পাই। নিজের মেয়ে বলে বলছি না, নূপুরের মুখখানা এমন মায়াভরা আর সারল্যে মাখা, চোখদুটো এমন ভাষা ভাষা ফুটফুটে, যে ওর শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কথা শুনলে সবারই প্রথমে মন খারাপ হয়ে যায়।

আর সত্যিই নূপুর যে ভারী ভাল মেয়ে। আমাকে কাজের জন্য কয়েক মাস এখানে, কয়েক মাস ওখানে করে বেড়াতে হয় বলে ওকে আর স্কুলে দিইনি, কিন্তু বাড়িতে ও চমৎকার পড়াশোনা করে। তাছাড়া ওর আঁকার হাতও খুব ভাল। এই তো, এখানে কয়েকদিন হল এসেছি, এরমধ্যেই কাল এসে দেখাল, কল্পনা থেকে কেমন সুন্দর একটা পুরনো রাজবাড়ির ছবি এঁকে ফেলেছে। আগে আমরা গোঁসানিমারিতে যখন থাকতাম, সেখানেও এমনই সুন্দর সব ছবি এঁকে ও সবাইকে তাক লাগিয়ে দিত।

আমি ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশি ভাবিনা। প্রাইভেটে সব পরীক্ষা দেওয়াব, আঁকাজোকা যা করতে চায় শেখাব, তারপর ওর নিজের যা ইচ্ছে, ও সেটাই করবে।

এই লোকটার চোখে অবশ্য তেমন কোন দুঃখের ভাব ফুটে উঠে দেখলাম না। খুব স্বাভাবিক কোন কথা শুনেছে এমন ভাবে সে ভ্রূ কুঁচকে বলল, ”আপনি এখানে কদ্দিন থাকবেন?”

লোকটার ভাবগতিক দেখে এবার বিরক্ত লাগল। কেন যে যেচে ঘরের মধ্যে ডেকে আনলাম! এসে থেকে মিশাইলের মত প্রশ্ন ছুঁড়ে যাচ্ছে, অথচ ওর নিজের নামটাই এখনো বলল না।

আমি একটু দায়সারাভাবে বললাম, ”সরকারী কাজ, অন্তত মাস তিনচারেক তো লাগবেই। আপনি তো প্রায়ই দেখি এখান দিয়ে জঙ্গলের দিকে কোথাও যান। কোথায় যাওয়া হয় ওদিকে? আর তো কাউকে যেতে দেখি না!”

লোকটা আমার অপেক্ষাকৃত রূঢ় প্রশ্নে রাগল না। আবার সেই ঘ্যাসঘেসে গলায় মাথা দুলিয়ে বলল, ”আপনি যাকে খুঁজতে এসেছেন, তাঁকে যে আমিও খুঁজছি কত্তা! সেইজন্যই ওদিকে যাই, আবার চলেও আসি। হে হে।”

”মানে?” আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না, ”আমি আবার কাকে খুঁজতে এসেছি!”

লোকটা কেমন একটা অদ্ভুত হাসি হেসে উঠে দাঁড়াল। তারপর আমার রোয়াক থেকে নেমে চলে যেতে যেতে বলল, ”আপনার মেয়েটা ভারী মিষ্টি। আট বচ্ছর বয়স বললেন, তাই না? সাবধানে রাখবেন কত্তা। এলাম।”

”আসলে কী বলুন তো, এখানকার লোকেরা বিশ্বাস করে শেষ রাজা নীলাম্বর মারা যাননি।” মুকুন্দ নীলদরিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে দূরের নারকেলগাছগুলোর দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল।

আমি ভ্রূ কুঁচকে বললাম, ”মারা যাননি বলতে?”

মুকুন্দ বলল, ”মানে আপনাদের নেতাজীর মত আর কী। সুলতান হুসেইন শাহের দলবল যখন নীলাম্বরকে বন্দী করে গৌড় নিয়ে যাচ্ছিল, তখন তিনি সিপাইশান্ত্রীদের কড়া পাহারার মধ্যে থেকে সটান নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর থেকে তাঁর আর নাকি কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। রাজা নীলাম্বর ছিলেন এখানকার মহামারী দেবীর একনিষ্ঠ উপাসক, সেই থেকে এই তল্লাটের মানুষ বিশ্বাস করে নীলাম্বর রাজা আজও নাকি বেঁচে আছেন, মহামারী দেবীর পুজো তিনিই নিত্য করে থাকেন। তাঁর পুজোতেই দেবী তুষ্ট আছেন, কোন বড় বিপদ হলেও তিনিই রক্ষা করবেন।”

আমি আর মুকুন্দ দাঁড়িয়েছিলাম নীলদরিয়ার সামনে। কেমন যেন মনে হচ্ছে প্রকাণ্ড একটা দৈত্য হাঁ মুখ করে রয়েছে এখানে, গোটা বিশ্বচরাচরে আর কেউ কোথাও নেই।

গোটা অঞ্চলকে ঘিরে বৃত্তাকারে খনন করা এই নীলদরিয়া যেন অস্বাভাবিক নিস্তব্ধ, অনেক নীচে কালো মিশমিশে জলের দিকে তাকালে গা ঘিনঘিন ছমছম করে। যেন মনে হয় বিশ্বব্রহ্মান্ডের যাবতীয় অন্ধকারের আধার এই কুয়োর মত পরিখাটি।

আগেই বলেছি রাজা নীলাম্বর এই সুবিশাল পরিখাটি বানিয়েছিলেন নিজের রাজবাড়িটিকে আকস্মিক শত্রু আক্রমণের হাত থেকে সুরক্ষার জন্য। পরিখাটি যথেষ্ট গভীর, নিচু হয়ে দেখলেই বোঝা যায়। প্রায় সিকিভাগ অংশ ছাড়া পুরোটাই জলের মধ্যে ডুবে আছে। কিন্তু জল অত্যন্ত নোংরা। অন্তত চার-পাঁচশো বছর এর কোন সংস্কার হয়নি, কিন্তু তাই বলে জল শুকিয়েও যায়নি। কাছেই নদী আছে বলে হয়ত। এদিকওদিক থেকে যথেচ্ছ গাছপালা-গুল্ম ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জলের ওপর। এত বড় জলাশয়, সাপখোপও নিশ্চয়ই নিশ্চিন্তে বংশপরম্পরায় বাস করছে এর মধ্যে।

আমি পায়ের ওপর ভর দিয়ে উঁচু হয়ে নীলদরিয়া পেরিয়ে মাঝখানে অবস্থিত নীলাম্বরের রাজবাড়ির দিকে চোখ সরু করে তাকালাম। রাজবাড়ি বলতে অবশ্য এখন নামেই, কয়েকটা প্রাচীন ইটের প্রাচীর এদিক ওদিক মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে পৌঁছনোর জন্য নীলদরিয়ার ওপরে একটা অস্থায়ী দড়ির সেতু বানানো আছে। বছরকয়েক আগে কোন কারণে ওই সেতুটা বানানো হয়েছিল। যদিও মুকুন্দর কথা অনুযায়ী এখন কেউ ওই সেতু পেরিয়ে রাজবাড়িতে যাওয়ার সাহস করে না।

প্রথম দিন সাইট পর্যবেক্ষণ করতে এসে ওই নড়বড়ে সেতু পেরিয়ে গিয়েছিলাম রাজবাড়ির আঙিনায়। হলদেটে শুকনো ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে প্রাচীন ইটের সারির মধ্য থেকে মাথা তুলেছে বিশাল বিশাল বট-অশ্বত্থের মহীরুহ। কোথায় অন্দরমহল ছিল, কোথায়ই বা বসত রাজদরবার তার কোনমাত্র হদিশ পাওয়া যায় না। শুধুমাত্র একপাশে একটা টুঙ্গি এখনও অবশিষ্ট রয়েছে, তাও ক্রমশ গজিয়ে ওঠা বট-অশ্বত্থের শিকড়বাকড়ের গর্ভভেদী চাপে ভেঙে পড়েছে প্রায়।

আর ঈশান কোণে নিস্তব্ধ সাক্ষীর মত দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা মিনার। সেটারও ফাঁকে ফাঁকে থাবা বসিয়েছে বৃক্ষগুল্ম। সেই মিনারের গায়ে যে এককালে পত্রাকৃতি খিলান ছিল, তা বোঝা যায় ভাল করে দেখলে। গোটা জায়গাটাই প্রমাণ করে, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কীভাবে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনগুলোর অধিকাংশই এর মধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে।

আমার কাজ শুরু হওয়ার আগে মুকুন্দর নিয়োগ করা স্থানীয় ছেলেগুলো এখন প্রাথমিক সংস্কার করছে গোটা চত্ত্বরটা। আমি নীলদরিয়ার এপাশ থেকে তাদের খুদে খুদে শরীরগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম। সবাই অবশ্য কড়া শর্তে কাজ করছে, বিকেল চারটের পর কেউ এ তল্লাটে থাকবে না। যত সব গ্রাম্য কুসংস্কার আর কী!

মনে মনে হিসাব করলাম। হুসেইন শাহ নীলাম্বরকে বন্দী করে গৌড় নিয়ে যাচ্ছিলেন ১৪৯৮ সালে, অর্থাৎ যে বছরে ভাস্কো ডা গামা এসে নেমেছিলেন কালিকটে। তার মানে পাঁচশো বছরেরও বেশি আগে নীলাম্বর রাজা এখানে রাজত্ব করতেন এবং নিজের ক্ষমতাবলে পশ্চিমে কামরূপ, দক্ষিণে ঘোড়াঘাট অবধি নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন তিনি। এতবছর আগের সেই বীর বাঙালি নৃপতির কথা ভেবে অবচেতনেই আমার বুকের ভেতরটা গর্বে ভরে উঠল। এমন কত সব সাহসী রাজা রয়েছেন বাংলার অতীতে, তাঁদের বীরগাথার উপাখ্যান কেন পড়ানো হয় না ইতিহাসে কে জানে!

এই গ্রামে মুষ্টিমেয় যে কজন মানুষের বাস, তারা যে কোন কারণেই হোক, এই নীলদরিয়ার দিকটায় খুব একটা ঘেঁষে না, এসে থেকেই লক্ষ করেছি আমি। কারণ নীলদরিয়া আসতে গেলে আমার বাড়ি পেরিয়ে সেই অগভীর জঙ্গলের মধ্য দিয়েই তাদের আসতে হবে। সেদিনের সেই লোকটা ছাড়া কাউকে একদিনে তেমন চোখে পড়েনি আমার। একমাত্র ওই লোকটাই প্রতিসকালে ভিজে গায়ে কপালে তিলক এঁকে যায় এদিক থেকে।

আমার কী মনে পড়তে মুকুন্দর দিকে তাকালাম, ”আচ্ছা, আমার বাড়ির পেছনে যে জঙ্গলটা ওখানে কোন মন্দির আছে?”

মুকুন্দ ওর গলায় ঝোলানো দূরবীন দিয়ে দূরের রাজবাড়ির দিকে দেখছিল, আমার এই প্রশ্নে দূরবীনটা চোখ থেকে নামিয়ে বলল, ”মন্দির? আপনার বাড়ির পেছনে? আপনার বাড়ির পেছন থেকে তো জঙ্গল শুরু হয়ে যাচ্ছে স্যার, তারপরেই এই নীলদরিয়া। জানেন তো, নীলাম্বর রাজার সময়ে কেউ কোন অপরাধ করলেই তাকে হাত-পা বেঁধে ফেলে দেওয়া হত এই পরিখায়? এটা ছিল সাক্ষাৎ মৃত্যুকূপ! লোকজন ভয়ে এদিকে পা-ই দেয় না তো মন্দির! যে সব মন্দিরে নিত্য পুজো হয়, সেগুলো সব লোকবসতির দিকে আছে। কেন, মন্দিরে পুজো টুজো দেওয়ার আছে নাকি স্যার?”

আমি বলব না বলব না করেও লোকটার কথা বলাই সমীচীন বোধ করলাম। গতকাল বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় লোকটা নাকি আমাদের বাড়ির দিকে বেশ খানিকটা এগিয়ে এসে উঁকিঝুঁকি মারছিল, বাসন্তীদি দেখেছে। আমি কাজ থেকে ফিরতেই আমাকে বলল। নতুন দেশ, নতুন জায়গা, বাসন্তীদি একা নূপুরকে নিয়ে থাকে। ইকবাল অর্ধেক সময়েই নানাকাজে ব্যস্ত থাকে, বাজার-হাট, দোকানপাট সব তো ওকেই করতে হয়।

 মুকুন্দ সব শুনে-টুনে বলল, ”ভিজে গায়ে কপালে তিলক? আপনার বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে হরিহর পাগল স্যার। তবে সে রোজ সকালে ওই জঙ্গলে আসে কিনা সেব্যাপারে আমি খোঁজ নিয়ে আপনাকে বলব।”

”হরিহর পাগল?” আমি বললাম, ”সে আবার কে?”

মুকুন্দ বলল, ”হরিহর পাগল গ্রামেরই একটা কালীমন্দিরে পুজো করত। আমরা ছোট থেকেই দেখছি। ওরা অনেক পুরুষ ধরে পুজো করে আসছে। হঠাৎ করে কোথা থেকে কী হল, হরিহরের মেয়েটা মরে যেতে মাথাটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। ঠিকমত মন্দিরে পুজোও করত না, দিনরাত গিয়ে ভাঙা মহামারী মন্দিরে বসে থাকত আর বিড়বিড় করে বকত। তবে ইদানীং অনেককাল তাকে দেখিনি। ভেবেছিলাম মরে টরে গেছে বোধ হয়। অবশ্য আমিও তো এখন এখানে থাকি না। এখন আপনার কথা শুনে বুঝতে পারছি ব্যাটা এখনও বেঁচে আছে।”

”মহামারী মন্দিরটা কোথায়?” আমি একটা শুকনো গাছের ডাল কুড়িয়ে নিয়ে নীলদরিয়ায় ফেলে দিতেই তা পাক খেতে খেতে নীচের গহ্বরে তলিয়ে গেল। পরিখাটা এতটাই গভীর, যে সেটা জলে পড়ার সময় যে শব্দটা হওয়া উচিত, সেটাও শুনতে পেলাম না।

আমার গা-টা কেমন শিরশির করে উঠল। মনে হল, আমি আর মুকুন্দ যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, ঠিক সেখান থেকেই হয়ত কত মানুষকে নীচে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে কয়েক শতাব্দী আগেও! আশপাশের নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন গাছগুলো যেন একেকটা সেই শতাব্দীর পর শতাব্দী অপেক্ষা করা অতৃপ্ত আত্মা, যাদের আর্তচিৎকার কোন অতীন্দ্রিয় জগৎ থেকে শব্দেতর আওয়াজ হয়ে এসে পৌঁছচ্ছে আমার মানসকর্ণে।

মুকুন্দ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই একটা চিৎকার শুনে আমরা পিছন ফিরে তাকালাম।

যে অগভীর পরিত্যক্ত জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আমার বাড়ির দিক থেকে নীলদরিয়ায় আসতে হয়, সেদিক থেকে ছুটতে ছুটতে আসছে আমার সারাক্ষণের ভৃত্য ইকবাল। তার এমনিই একটু ভারী চেহারা, অনভ্যাসের ছোটায় রীতিমত হাঁপাচ্ছে, তবু দৌড়ের গতি কমাচ্ছে না। মুখে উদ্বেগের ছাপ সুস্পষ্ট।

কাছে এসে ইকবাল দম নিতে নিতে বলল, ”দাদা, নূপুরকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”

”মানে?” আমি ইকবালের কথার কোন মাথামুণ্ডু বুঝতে পারলাম না প্রথমে।

নূপুর পারতপক্ষে বাড়ি থেকে কোথাও বেরোয় না, বিকেলে সামনে কদাচিৎ হাঁটতে বেরোলেও ওর পাশে ছায়ার মত থাকে বাসন্তীদি। আমার নিজের বাবা-মা মারা গিয়েছেন ছাত্রাবস্থাতেই, স্ত্রী চলে যাওয়ার পর আমার মেয়েই আমার সব। মা-মরা মেয়ে বলে শুধু নয়, নূপুরের কথা বলতে না পারার ওই প্রতিবন্ধকতা যেন বাবা হিসাবে আমাকে সারাক্ষণ একটা আলাদা চিন্তার মধ্যে রাখে। তার ওপর বিদেশ বিভূঁই, মেয়েটা কিছু বিপদ হলে তো কাউকে ডাকতেও পারবে না চিৎকার করে। সেইজন্যই আরো বাসন্তীদিকে রাখা। আমি ছাড়া বাসন্তীদিও নূপুর কী বলতে চায় তা বুঝতে পারে।

সেখানে নূপুরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানেটা কী!

মিনিটদশেকের মধ্যে জঙ্গলের মধ্যেকার সরু পায়ে চলা শুঁড়িপথ ঝড়ের গতিতে পেরিয়ে গিয়ে পৌঁছলাম বাড়িতে।

বাড়ির সামনেই ভয়ার্তমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাসন্তীদি, আমাকে দেখেই হাউমাউ করে যা বলল তার সারমর্ম হল, ইকবাল বেরিয়েছিল বাজারে, নূপুর বাইরের রোয়াকে বসে নিজের মনে রঙ তুলি দিয়ে ছবি আঁকছিল। নূপুরের জলখাবার খাওয়া হয়ে গেলে বাসন্তীদি গিয়েছিল স্নানে। গ্রামাঞ্চলের বাড়ি বলে এই তল্লাটের পাকাবাড়িগুলোতেও বাথরুম ঘরের সঙ্গে লাগোয়া নয়, বাড়ির পেছন দিকে উঠোনের মধ্যে হাতপাঁচেক হেঁটে বাথরুম যেতে হয়।

প্রতিদিনই বাসন্তীদি নূপুরকে আঁকতে বসিয়ে স্নানে যায়, আজও গিয়েছিল। কিন্তু স্নান সেরে ফিরে এসে দেখে, নূপুর নেই। প্রথমে বাসন্তীদি তেমন ভয় পায়নি, ভেবেছিল নূপুর বুঝি সামনের বাগানে ঘুরছে। কিন্তু তারপর যখন এদিকওদিক খোঁজাখুঁজি করেও যখন নূপুরকে পাওয়া গেল না, তখন বাসন্তীদি কিছুদূরের চায়ের দোকানটায় ছুটে গিয়ে সব বলে চারপাঁচজন লোককে ডেকে নিয়ে আসে। ইতিমধ্যে ইকবালও ফিরে এসেছে। সেও কাছেপিঠে খোঁজ করেছে। কিন্তু কেউ নাকি নূপুরকে দেখেইনি।

মুকুন্দ ছেলেটা অল্পবয়স হলে কী হবে, বেশ চটপটে। পাঁচমিনিটের মধ্যে নীলদরিয়ায় কাজ করতে থাকা কয়েকজনকে নিয়ে চলে এল, তারপর গোটা গ্রামটা তন্নতন্ন করে খুঁজতে লোক পাঠিয়ে দিল।

আমার মাথা কাজ করছিল না। দিশেহারাভাবে আমি থেবড়ে বসে পড়লাম বাড়ির রোয়াকে। নূপুর, পৃথিবীতে নিজের বলতে আমার একমাত্র ওই একটি রক্তমাংসের প্রাণ, আমার নূপুর! সে কোথায় গেল?

আমার হঠাৎ হরিহর পাগল বলে লোকটার কথা মনে পড়ে গেল। লোকটা সেদিন যাওয়ার আগে কেমন একটা তেরচাভাবে মেয়েকে সাবধানে রাখার কথা বলে গিয়েছিল, তার ওপর বাসন্তীদিও কাল ওকে উঁকিঝুঁকি মারতে দেখেছে। ও-ই কিছু করল না তো?

আমি উদ্ভ্রান্তের মত বললাম, ”মুকুন্দ, ওই হরিহর বলে লোকটার খোঁজ নাও তো! ওই লোকটার হাবভাব আমার সেদিন একদম ভাল লাগেনি!”

”হরিহর পাগল? লোকটা খ্যাপাটে বটে, কিন্তু বদ শুনিনি। আচ্ছা আমি এখুনি দেখছি।” মুকুন্দ বুঝতে পারছিল আমার অবস্থা, বাসন্তীদিকে দিয়ে এক গ্লাস জল এনে বলল, ”স্যার, আপনি এটা খেয়ে নিন, মাথা ঠাণ্ডা রাখুন। এটা একেবারে ছোট গাঁ, আপনার মেয়ে কোথায় আর যাবে? হয়ত দেখবেন কাছেপিঠেই কোথাও খেলছে। এখুনি চলে আসবে। আমি সবজায়গায় খুঁজতে লোক পাঠিয়েছি।”

আমার মুখে কথা সরছিল না। নূপুর এমনিতে হাসিখুশি, কিন্তু এই আটবছর বয়সেও ওর পৃথিবীটা খুবই ছোট। আমি, বাসন্তীদি, ইকবাল আর নিজের মনে পড়াশুনো, গল্পের বই, ছবি আঁকা, এইসব নিয়েই ওর জগৎ। দুম করে কোন বাড়িতে ঢুকে মিশে যাওয়ার মত বা চট করে কারুর সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতানোর মত মেয়ে নয় ও। ওকে যে ভগবান বাকি সকলের মত কথা বলার শক্তি দেননি, তা ও এইবয়সেই বোঝে। তাই অচেনা কারুর কাছে যেতেও চায় না।

তাছাড়া এই গ্রামে সব মিলিয়ে তো খুব বেশি লোক নেই। কারুর বাড়ি গেলে কী এরমধ্যে এখানে খবর চলে আসত না? এই আধঘন্টায় পুরো গ্রামই তো বলতে গেলে জেনে গেছে!

রোয়াক পেরিয়েই ছোট্ট একফালি বাগান, সেখানে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে গ্রামের কিছু লোক। তারা নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করছে, তাদের মৃদু গুঞ্জন এসে পৌঁছচ্ছে আমার কানেও।

একটা বয়স্ক লোক, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, মাথায় টুপি, মাথা নেড়ে বলল, ”আমি আগেই বলেছিলুম, রাজার বাড়ি না ঘাঁটানোই ভাল। তখন তো কেউ শুনলেনা আমার কথা। বলল নাকি গরমেন্টের হুকুম! আরে বাবা, এখন যদি মেয়েটার ভালমন্দ কিছু হয়ে যায়, তখন কী গরমেন্ট এসে বাঁচাবে?”

আমি সাদা চোখে মুকুন্দর দিকে তাকাতেই ও বুঝতে পেরে সাথে সাথে আঞ্চলিক টানে জোর গলায় ধমকে উঠল, ”অ্যাই, তোমরা এখানে জটলা পাকাচ্ছ কেন শুধু শুধু? খুঁজতে হলে খোঁজো, এখানে দাঁড়িয়ে গুলতানি মেরো না।” কথাটা বলতে বলতে ও ডানপাশে কী যেন দেখে থমকে গেল।

একটু ঝুঁকে পড়ে তুলে আনল একটা খাতা। চওড়া মলাট, মোটা পাতা।

আমার চোখে আবার জল এসে গেল।

ওটা আমার নূপুরের আঁকার খাতা। মেয়েটা আঁকতে এত ভালবাসে, ওর প্রাণের চেয়েও প্রিয় ওই খাতাটা।

উল্টোদিক থেকে দেখলাম মুকুন্দ একদৃষ্টিতে খোলা খাতাটার দিকে চেয়ে আছে। পাশে অবিন্যস্তভাবে ছড়িয়ে থাকা তুলি, রঙ, রঙের প্যালেট।

আমি বললাম, ”ওতে নূপুর আঁকে। তুমি তোমার লোকজনদের ফোন করো না, কিছু হদিশ পাওয়া গেল কীনা?”

মুকুন্দ খাতার খোলা পাতা থেকে চোখ সরাল না, কী যেন দেখতে দেখতে বলল, ”স্যার, আপনি কী কখনও ওকে মহামারী মন্দিরে নিয়ে গিয়েছিলেন এর মধ্যে?”

মুকুন্দর এমন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে আমি কী বলব কিছু বুঝতে পারলাম না। মুকুন্দ যে মন্দিরের নাম বলছে, সেটার নাম আমি কিছুক্ষণ আগে ওর মুখেই প্রথমবার শুনেছি। বাংলাদেশে এসেছি মাত্র সপ্তাহখানেক হল, আসার পর বাবামেয়েতে কোথাও বেরনোই হয়নি, মন্দিরে যাওয়া তো অনেক দূরের কথা!

আর আমার মেয়েটাকে খুঁজে পাচ্ছি না, এরমধ্যে এইসব মন্দির-টন্দির নিয়ে মুকুন্দ কেন পড়ল সেটাও মাথায় ঢুকছে না।

আমি কিছুটা উষ্মাভরে বললাম, ”আমি চিনিই না কোথায় ওই মহামারী মন্দির। কেন কী হয়েছে?”

মুকুন্দ খাতার খোলা পৃষ্ঠাটা আমার দিকে ঘুরিয়ে সোজা করে মেলে ধরল, ”এটা তো মহামারী মন্দিরের ছবি স্যার! আপনার মেয়ে যদি না-ই গিয়ে থাকে, তবে এই ছবিটা আঁকল কী করে! এ যে হুবহু মিলে যাচ্ছে।”

আমি বিস্মিতচোখে খাতাটা মুকুন্দর হাত থেকে টেনে নিলাম। ছবিটা দেখে এই চিন্তাগ্রস্থ মনেও একটা ভাললাগার রেশ ছড়িয়ে গেল, কারণ অসম্ভব সুন্দর এঁকেছে নূপুর। এই ছবি দেখে কেউ বিশ্বাস করবে না যে নূপুরের বয়স মাত্র আট।

গোধূলিবেলার ছবি। এদিক ওদিক শুকনো পাতা, গাছপালার মধ্যে অস্তমান সূর্যের কমলা আভা দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। ছবিটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটা একটা পরিত্যক্ত অরণ্য। ছবির ঠিক মাঝখানে দেখা যাচ্ছে একটা ছোট ভগ্নপ্রায় মন্দির। ওপরের চূড়া দেখে মন্দির বলে বোঝা গেলেও সেটির আকৃতি নিঃসন্দেহে একটু অদ্ভুত। মন্দিরটার পাঁচটা চূড়া একইসাথে রয়েছে, মনে হচ্ছে পাঁচদিক থেকে পাঁচটি পৃথক মন্দির বানাতে শুরু করা হয়েছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে কোনটাই ঠিকমত শেষ না করে এবড়োখেবড়ো ভাবে পাঁচটাকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে মাঝখানে। সেই পাঁচটা খণ্ডের পাঁচটা প্রবেশদ্বারও যেন কোনরকম স্থাপত্যের নীতি অনুসরণ না করে একে অপরের গায়ে লেপ্টে পড়েছে।

মন্দিরটা বোঝাই যাচ্ছে যে বহু পুরনো। নূপুরের পাকা হাতের তুলিতে জরাজীর্ণদশাগুলো চমৎকার ফুটে উঠেছে। বাঁ দিক থেকে বটগাছের একটা মোটা ঝুড়ি এসে যেভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে ঠেসে ধরেছে মন্দিরের একটা প্রবেশপথকে, আঁকাটির প্রশংসা না করে উপায় নেই। গোধূলিসন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে মন্দিরের গর্ভগৃহ দেখা যায় না, ভেতরে কোন বিগ্রহ আছে কিনা বোঝাও যায়না, শুধু ভেতরের জমাট রহস্যময় অন্ধকারটা যেন কেমন ভয়ের উদ্রেক করে।

 আমি মুকুন্দকে বললাম, ”তুমি …তুমি নিশ্চিত এটা মহামারী মন্দিরের ছবি?”

মুকুন্দ বলল, ”আলবাত! এই তো, আপনার বাড়ির পেছনের জঙ্গলের যে শুঁড়ি পথ দিয়ে আমরা নীলদরিয়ায় যাই, সেটা দিয়ে কিছুটা গিয়ে বাঁহাতে আরেকটা শুঁড়িপথ চলে গেছে, ওদিকটা আরো ঘন জঙ্গল। কেউ যায় না তো। সেটা দিয়ে কিছুদূর গেলেই মহামারী মন্দির। মন্দিরের পেছন দিয়েও সোজা নীলদরিয়ায় পৌঁছনো যায়।”

আমি লক্ষ করছিলাম, মহামারী নামটা মুকুন্দর মুখে শোনামাত্র সামনের ইতস্তত দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর মুখের অভিব্যক্তি কেমন পাল্টে যাচ্ছিল। একজন এগিয়ে এসে খাতাটা চেয়ে নিয়ে দেখতেই সবাই খাতার ছবিটার ওপর হুমড়ি খেয়ে কী সব বলাবলি করতে শুরু করল।

 নূপুরের নিরুদ্দেশ, মহামারী মন্দির এইদুটোর মধ্যে কোন যোগসূত্র খুঁজে পেয়ে কি ওদের ষষ্ঠেন্দ্রিয় কোন অশুভ ইঙ্গিত দিচ্ছে? যা আমি বাবা হয়েও বুঝতে পারছিনা?

আমি আর দেরি করলাম না। কিছুক্ষণ আগেই মুকুন্দর মুখে শুনেছিলাম হরিহর পাগল নামের সেই খ্যাপাটে লোকটা মহামারী মন্দিরে বসে থাকে। আর বাসন্তীদির কাছ থেকে শুনেছি লোকটা আমাদের বাড়ির দিকে অকারণে ঘুরঘুর করে। এইসব কটা তথ্য একসাথে জট পাকিয়ে আমার স্নায়ুগুলোকে দুশ্চিন্তায়, আশঙ্কায় জর্জরিত করে দিচ্ছিল।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বাড়ি থেকে বেরোতে বেরোতে বললাম, ”আমাকে নিয়ে চলো সেই মন্দিরে মুকুন্দ। এক্ষুনি।”

* * *

নূপুরকে মহামারী মন্দিরের সামনের নোংরা হয়ে থাকা চাতালে যখন খুঁজে পেলাম, তখন বেলা প্রায় বারোটা। উত্তেজনায় দুশ্চিন্তায় শুধু আমার নয়, মুকুন্দ, ইকবাল আর বাসন্তীদিরও মুখ কালো হয়ে গেছে।

দূর থেকে দেখলাম নূপুর শুয়ে আছে চাতালের ওপর। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে কাছে ছুটে গেলাম, গিয়ে দেখলাম ওর শ্বাসপ্রশ্বাস সব ঠিক আছে। চোখদুটো বোজা, মুখে অদ্ভুত এক প্রশান্তির ছায়া। সারা শরীরে কোথাও কোন আঘাত বা অন্য কিছুর চিহ্ন নেই।

চার-পাঁচবার ওর গায়ে টোকা দিতেই ও ধড়মড়িয়ে উঠে চারদিক দেখতে লাগল।

আমি আকুলভাবে ওর সারা গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বললাম, ”নূপুর! অ্যাই নূপুর! এখানে এলি কী করে? তুই ঠিক আছিস তো মা?”

নূপুর কিছুক্ষণ আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

আমি ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে আবার অধীর হয়ে বললাম, ”তোকে কী কেউ এখানে নিয়ে এসেছিল? কে? তুই তাকে চিনিস? সেদিনের সেই কপালে তিলক আঁকা লোকটা কী? ঠিক করে বল তো মা!”

নূপুর এবার ওর বাঁ হাতের তর্জনীটা তুলে আমার দিকে এমন ইশারা করে অঙ্গভঙ্গি করতে লাগল, যাতে আমি চমকে উঠলাম।

এ কী করে সম্ভব!

ওর এই হাতের ইশারা আমি ছাড়া বোঝে আর শুধু বাসন্তীদি। আমি বিস্মিতচোখে বাসন্তীদির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সেও চোখ বড়বড় করে একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে, একবার নূপুরের দিকে।

আমি আর কথা বাড়ালাম না, মেয়েকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলাম দু-হাতে, তারপর হাঁটা দিলাম বাড়ির দিকে।

মনের মধ্যে কেমন যেন ঝড় উঠেছে, তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে চারপাশ।

বাড়িতে এসেও স্বস্তি নেই। আমাদের বাড়ি থেকে সবচেয়ে কাছে যে বাড়িটা, তাতে হঠাৎ দেখি কান্নার রোল উঠেছে। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করাতে জানতে পারলাম ওই বাড়ির জোয়ান ছেলেটা গতকাল থেকে জ্বরে ভুগছিল, আজ কেউ কিছু বোঝার আগেই হঠাৎ হার্টফেল করে মারা গেছে। নূপুরের ফিরে আসায় গ্রামবাসীরা আমার বাড়ি থেকে গিয়ে এখন ভিড় জমিয়েছে সেখানে।

কেন জানিনা মনটা একদম ভাল লাগছে না। যদিও আমি এসবে বিশ্বাস করিনা, তবু অবচেতনে কেউ যেন কু গাইছে আমার মনে।

সেদিনের পর থেকে আমাদের জীবনটা যেন একধাক্কায় ওলটপালট হয়ে গেল।

কত কিছু যে একসঙ্গে ঘটতে লাগল, তা আমার পক্ষে ভাষায় ঠিকমত বর্ণনা করা সম্ভব নয়। একদিকে নূপুর পাল্টে যেতে লাগল। ভীষণভাবে দ্রুতগতিতে পাল্টে যেতে লাগল। আমার হাসিখুশি মেয়েটা কেমন যেন থম মেরে বসে থাকতে শুরু করল সারাক্ষণ। প্রায় দিনই দেখতাম সে নিজের মনে আঁকছে, কিন্তু সেই আঁকার মধ্যে কোন আনন্দের অভিব্যক্তি নেই। ওকে সেইসময় দেখলে মনে হয়, কেউ যেন জোর করে ওকে দিয়ে আঁকাচ্ছে। সেইসময় ওকে কেউ ডাকলে ও এমন বিরক্ত হতে শুরু করল, যেটা কখনও আমি ওর মধ্যে দেখিনি। তাছাড়া ফাঁক পেলেই ও ছাদে চলে যেতে লাগল। ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে আনমনে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে শুরু করল সেইদিকে, যেদিকে জঙ্গলের মধ্যে রয়েছে সেই ভাঙা মহামারী মন্দির।

অন্যদিকে সেদিনের প্রতিবেশী ছেলেটির আকস্মিক মৃত্যুর পর আরো দু’জনের সেভাবেই হঠাৎ মৃত্যু হল কোন এক অজানা জ্বরে। বাংলাদেশের এই প্রত্যন্ত গ্রামে চিকিৎসাব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল, কারুর কিছু হলে যেতে হয় সেই চতরাহাটে। সেখানে এই জ্বর সময়ই দিচ্ছে না, এক-দুদিনের মধ্যেই রুগী মারা যাচ্ছে।

বাড়িতে বাসন্তীদি মুখে কিছু না বললেও আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম গোটা ব্যাপারটায় সে ভয় পেতে শুরু করেছে। নূপুর আগে ফুল, ফল, আকাশ, নদী এইসবের ছবি আঁকতেই ভালবাসত, কিন্তু ইদানীং ও ওসব আর আঁকে না। তার ছবিগুলো সবসময় কোন প্রাচীন ভগ্নস্তূপ বা মন্দিরের পটভূমিকায় বিষণ্ণতায় মোড়া থাকে।

আমি নূপুরকে হাবে ভাবে সেদিনের কথা আরো খুঁটিয়ে জানতে চেয়েছি, কিন্তু প্রত্যেকবারই আকারে ইঙ্গিতে ও সেই অদ্ভুত কথাটাই বুঝিয়েছে।

শুধু তাই নয়, বাসন্তীদি বলতে লাগল, প্রায়ই ও ঘুমের ঘোরে রাতে উঠে বসে, উঠে বিছানা থেকে নেমে পড়তে চায়, ছুটে চলে যেতে চায় বাড়ির বাইরে। তখন তাকে জোর করে আটকে রাখতে হয়। কিন্তু সেইসময় ওর গায়ে যেন অসুরের শক্তি ভর করে, বাসন্তীদি অনেক কষ্টে আটকায়।

দুশ্চিন্তায় আমার রাতের ঘুম উড়ে গেল, আমি নূপুরকে আমার কাছে নিয়ে শুতে শুরু করলাম। কিন্তু কোন সুরাহা হল না। নূপুর একইরকম আচরণ করতে লাগল রাতে। কী এর সমাধান ঠাহর করতে পারলাম না। অন্যদিকে গ্রামের ওই জ্বরও একটা আলাদা দুশ্চিন্তার সৃষ্টি করল। ঠিক করলাম, একদিন ছুটি পেলেই বাড়ির সবাইকে নিয়ে শহরে গিয়ে বড় ডাক্তার দেখিয়ে আসব।

কিন্তু আমার কাজের চাপ দিনদিন বাড়তে লাগল। যে-কোন পুরাতাত্ত্বিক খননের নিয়ম হল আগে গোটা অঞ্চলটাকে ভাল করে সার্ভে করতে হয়। তাই আসার পর প্রাথমিকভাবে স্থানীয় দিনমজুরদের দিয়ে ওপর ওপর পরিষ্কার করানো হয়ে গেল দিনসাতেকের মধ্যেই। তাদের ওপরেও কড়া নজর রাখতে হল, কারণ এত প্রাচীন সাইট, ভারী কোন আঘাতে ভেতরের নিদর্শন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

প্রাথমিক পরিষ্কারের পর বাংলাদেশ পুরাতত্ত্ব দপ্তর এই কাজের জন্য রাডারের ব্যবস্থা করলেন। মাটির নীচের নিদর্শনগুলো ভালভাবে সার্ভে করার জন্য একধরনের রাডার হয়, সেইগুলো মাটি ভেদ করে স্ক্যান করতে পারে।

আর এই সমস্ত কাজের জন্য আমার ঢাকা যাওয়ার প্রয়োজন পড়ল। একদিন নয়, দু-তিনদিনের জন্য।

মন ভাল নেই, সারাক্ষণ একটা অজানা আশঙ্কায় ভেতরটা আড়ষ্ট হয়ে রয়েছে, এমন অবস্থায় নূপুরকে রেখে যেতে আমার একদম ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু পেটের দায় বড় বালাই, ইকবালকে সব বুঝিয়ে দিয়ে বাসন্তীদির জিম্মায় নূপুরকে রেখে আমি আর মুকুন্দ একদিন সন্ধেবেলা গাড়ি করে রওনা হয়ে গেলাম।

গাড়িতে যখন উঠছি, তখন পশ্চিমদিকে সূর্যের কমলা আভা ম্রিয়মাণ। পাখিরা দূরের জঙ্গল থেকে দিনশেষে একজোট হয়ে ফিরছে নিজেদের বাসায়। আমাদের বাড়িটা জঙ্গলের প্রান্তে বলে আলো এমনিতেই কম ঢোকে, এখন আরো অন্ধকার হয়ে রয়েছে।

বাসন্তীদি অস্ফুটে বলল, ”দাদা, আপনি তাড়াতাড়ি আসবেন তো? আমার খুব ভয় করছে। কী করে যে এই দু-তিনদিন কাটবে! নূপুর যদি আবার …!”

আমি আড়চোখে নূপুরের দিকে তাকালাম। অন্যসময় আমি দু-তিনদিনের জন্য কোথাও গেলে বাড়ি থেকে বেরনোর শেষ মুহূর্ত অবধি ও আমাকে ছাড়তেই চায় না, কেমন ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে। ওর জিভে কথা বলার শক্তি না থাকলেও গোটা শরীরের অভিব্যক্তি দিয়ে ও যেন কাকুতি মিনতি করে, ”ও বাবা, যেয়ো না প্লিজ! আমি তোমায় ছেড়ে থাকতে পারব না।”

সেইসময় ওর অবোধ অনুরোধে আমার বুকটা মুচড়ে উঠত, মনে হত, ধুর, সব ছেড়েছুড়ে দিই, ওকে নিয়ে কাটাই জীবনটা।

কিন্তু আজ যে আমি নতুন দেশে আসার পর তিনদিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি, সেই খবরটা ও জানলেও কোনরকম ব্যাকুলতা দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমার ছোট ট্রলিটা ইকবাল গাড়িতে তুলছে, আমি ঝুঁকে পড়ে জুতোর ফিতে বাঁধছি, বাসন্তীদি এগিয়ে দিচ্ছে দরকারি টুকটাক জিনিস, ও কিন্তু নিজের মনে বারান্দার এক কোণে বসে এঁকে যাচ্ছে। যেন বাবা চলে যাচ্ছে, ওর কোন হেলদোল নেই।

বাসন্তীদি ওর দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে নিল, তারপর নীচুগলায় বলল, ”দাদা, সেদিন যে ওই ভাঙা মন্দিরে নূপুর বলল, ও নাকি আপনি এসে ডাকলেন বলেই পিছন পিছন ওখানে চলে গিয়েছিল, সে-সেটা কী করে হয়?”

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সেদিন নূপুরের ইশারা বুঝতে পেরে আমিও চমকে উঠেছিলাম। ওকে নাকি আমিই ডেকে নিয়ে গেছি ওই ভাঙা মন্দিরে। অথচ তা কী করে হয়, আমি তো তখন মুকুন্দর সঙ্গে সাইটে। তবে কী নূপুর স্বপ্নের ঘোরে আমাকে দেখেছিল? কিন্তু এমন তো আগে কখনও ও করেনি!

আমি নিজেকে সামলে নিলাম, এখন এইসব নিয়ে কথা বললে বাসন্তীদি আরো ভয় পেয়ে যাবে।

কথা ঘুরিয়ে বললাম, ”ওসব বাচ্চা মেয়ের কথা বাদ দাও। হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছিল, ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখেছে।”

”না দাদা!” বাসন্তীদি ভয়ার্ত গলায় বলল, ”আপনাকে বলব বলব করে বলা হয়নি, মিন্তি বলে কাজের যে মেয়েটাকে রেখেছি, সে একটা কথা বলছিল। ওই যে বুড়ো মত পাগল লোকটাকে নিয়ে এসেছিলেন বাড়িতে, তাকে নূপুরের সেদিনের ব্যাপারটার পর আর এদিক দিয়ে যেতে দেখিনি। কিন্তু মিন্তি বলছিল গতকাল দুপুরে ও যখন ছাদে কাপড় মেলতে উঠেছিল, স্পষ্ট দেখেছে লোকটা পেছনের পাঁচিল দিয়ে উঁচু হয়ে এদিকে কী যেন দেখার চেষ্টা করছে।”

আমার দেরি হয়ে যাচ্ছিল, ছ’টা বাজতে চলেছে প্রায়। সন্ধে সন্ধে না বেরোতে পারলে পৌঁছতে গভীর রাত হয়ে যাবে। যদিও এখানকার হাইওয়েতে নাকি সারারাত একইভাবে গাড়ি চলে। মুকুন্দ বলছিল, লম্বা পাল্লার পথ সবাই এখানে রাতেই অতিক্রম করে, তবুও দেরি করে পৌঁছলে রাতে ঘুম হবে না, আর ঘুম না হলে কালকের মিটিং এ প্রেজেন্টেশনটাও ভাল করে দিতে পারব না।

আমি ঘড়িটা দেখে নিয়ে বললাম, ”ওই হরিহর পাগলের মজা আমি এসে দ্যাখাচ্ছি। তুমি শুধু এই তিনটে দিন ওকে আগলে রাখো। আর অন্য কেউ এলে খবরদার বাড়িতে ঢুকতে দেবেনা। আর যা সব অসুখ হচ্ছে এখানে, নূপুরকে গ্রামের মধ্যে বের করবে না।। মনে থাকবে?”

বাসন্তীদি একপাশে মাথা হেলিয়ে ঢোঁক গিলে বলল, ”মিন্তি আরো বলছিল দাদা। আপনারা যে রাজার বাড়ি খুঁড়তে এসেছেন, সেখানে কেউ ঢুকলেই নাকি তার জীবনে অনর্থ নেমে আসে। ওই যে রাজা, তার নাকি মেয়ে ওই নীলদরিয়ায় …।”

আমার পক্ষে আর দেরি করা সম্ভব ছিল না। এরপর বেরোলে আর যাওয়ার কোন মানে হয় না। আর আজ রাতের মধ্যে পৌঁছতে না পারলে গোটা প্রোজেক্টের ডিজাইন, স্থানীয় শ্রমিকদের লেবার চার্জ স্যাংশান সব পিছিয়ে যাবে। নীলাম্বর রাজার মেয়ে যে নীলদরিয়ায় আত্মহত্যা করেছিল এমন গল্প সেদিন মুকুন্দও বলছিল বটে, আমি বেশি গুরুত্ব দিইনি।

আমি গাড়িতে উঠে বললাম, ”আমি এসে শুনব বাসন্তীদি। তোমরা ওকে নিয়ে সাবধানে থেকো।”

গাড়ি করে গ্রাম থেকে একেবারে বেরোনোর মুখে বাজার এলাকায় একটা জটলা দেখতে পেলাম। মুকুন্দ কৌতূহলী হয়ে গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল কী হয়েছে। জানতে পারলাম গ্রামের আরেকজন মহিলারও খুব জ্বর। কিছুতেই কমছে না। ইতিমধ্যেই ডাক্তার আনতে চলে গেছে বাড়ির লোক।

শুনে মনটা ভীষণ তেতো হয়ে গেল। চারপাশে এসব কী হচ্ছে?

এখান থেকে ঢাকা শহর প্রায় তিনশো কিলোমিটার রাস্তা, যেতে অন্ততপক্ষে সাত-আটঘন্টা তো লাগবেই। তবে রাস্তা মাখনের মত মসৃণ। বোগরা রঙপুর হাইওয়ে দিয়ে আমাদের গাড়ি হু হু করে ছুটতে লাগল ঢাকা নগরীর দিকে। বাসন্তীদি আমাদের রাতের খাবার প্যাক করে দিয়েছে, দশটা নাগাদ কোথাও গাড়ি দাঁড় করিয়ে খেয়ে নেব।

আমি চুপ করে বসেছিলাম। যাচ্ছি বটে, কিন্তু মনে একটুও শান্তি নেই। নূপুরের ব্যাপারে প্রচণ্ড একটা অস্থিরতায় ভুগছিলাম। কী করা উচিত, কার সাথে এই ব্যাপারে পরামর্শ করবো সেটাই তো বুঝতে পারছিনা। হাইওয়ের দু’পাশে জ্বলতে থাকা উজ্জ্বল আলোগুলো ঝড়ের গতিতে একে একে পেরোতে পেরোতে দিশেহারা হয়ে পড়ছিলাম।

এমনসময় মুকুন্দ হঠাৎ মুখ খুলল, বলল, ”আপনার ওই রান্নার দিদি যা বলছিল, সেটা কিন্তু এই সব এলাকায় সব মানুষই বিশ্বাস করে স্যার।”

”মুকুন্দ।” আমি জানলা দিয়ে বাইরে থেকে আসা ঠাণ্ডা হাওয়া খেতে খেতে মুখটা ভাল করে মুছে নিলাম, ”তুমি তো সেদিন বলেছিলে রাজা নীলাম্বরের মেয়ে ওই নীলদরিয়ায় আত্মহত্যা করেছিল। কিন্তু রাজার বাড়ি ঢুকলে কোনো ক্ষতি হয়, সেটা তো কখনও …।”

”শুনুন স্যার।” মুকুন্দ হাত নেড়ে বলল, ”আপনি পুরোটা না শুনলে ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন না। এইসব গ্রামে অনেকরকমের বিশ্বাস মানুষের মনে জড়িয়ে আছে।”

”বেশ। বলো। সত্যি বলতে কী, আমাদের ইতিহাস তো রাজা নীলাম্বরকে বেশি মনে রাখেনি। কামতা সাম্রাজ্যে খেন রাজবংশের তিনজন রাজা ছিলেন, নীলধ্বজ, চক্রধ্বজ আর নীলাম্বর। নীলাম্বর বীর ছিলেন এবং শেষে হুসেইন শাহের কাছে পরাস্ত হন। তারপর কামতা রাজবংশ লুপ্ত হয়ে যায়। এইটুকুই আমরা জানি। তোমাদের এইসব গল্পই বলো, আর বুজরুকীই বলো, এসব আমরা জেনে আসিনি।” আমি বললাম।

মুকুন্দ বলল, ”স্যার, শুধু এই অঞ্চল বলে নয়, আমাদের গোটা রঙপুর জেলাতেই নীলাম্বর রাজাকে সবাই খুব ভক্তি করে। কারণ এই একটিমাত্র বাঙালি সেইসময় বিদেশী শক্তিদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়ে গেছেন, আরাকান হামলা, বিদেশী পর্তুগীজদের আক্রমণ, কোনকিছুতেই পর্যুদস্ত হননি, তাদের হারিয়েছেন বীরের মত। রংপুর জেলার বিভিন্ন জায়গায় তিনি অজস্র দুর্গ তৈরি করেছিলেন, সেগুলোর ধ্বংসাবশেষ এখনও ইতিউতি ছড়িয়ে আছে। সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে আছে নীলাম্বর রাজার বীরগাথা, অনেক লৌকিক অলৌকিক কাহিনীও।”

ইতিহাসের রাজাদেরকে বীরোচিত দেখাতে গিয়ে গল্পের গরু যে কতটা গাছে ওঠানো যেতে পারে, সেই অভিজ্ঞতা আমার এই দপ্তরে কাজের সুবাদে অনেক আগে থেকেই আছে। সেসব নিয়ে আমার কোন কৌতূহল নেই। আমি বললাম, ”বুঝলাম। কিন্তু সেসব অলৌকিক গল্প পরে শুনব। তুমি সেদিন নীলাম্বরের মেয়ের কথা বলেছিলে, সেটাই বলো।”

মুকুন্দ বলল, ”কোনটা সত্যি, কোনটা গুজব, তা তো জানিনা স্যার, আমি পুরোটাই বলছি। রাজা নীলাম্বরের ছিল একটাই মেয়ে, তার নাম ছিল কাঞ্চনমণি। রাজা, রাণী, রাজপরিবারের সবাই তাকে চোখে হারাতেন। প্রচণ্ড আদরে মানুষ হচ্ছিল কাঞ্চনমণি। তখন রাজা নীলাম্বরের একেবারে বৃহস্পতি তুঙ্গে। সাম্রাজ্য বিস্তার করতে করতে চলে গেছে দক্ষিণে ঘোড়াঘাট পর্যন্ত। রাজধানী কামতাপুর থেকে এই নীলদরিয়া হয়ে সেই ঘোড়াঘাট অবধি বানিয়েছেন বিস্তীর্ণ রাজপথ। তখন দিল্লীর মোঘল আর বাংলার পাঠান শাসকদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই রয়েছে। এদিকে নজর দেওয়ার সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই তাঁদের নেই। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নীলাম্বর নিজের রাজ্যকে অনেকদূর প্রসারিত করে ফেলেছিলেন।”

আমি সম্মতির ভঙ্গীতে মাথা নাড়লাম। মুকুন্দ ঠিক বলছে। বাংলায় তখন এমন অনেক বীর রাজা ছিলেন। যেমন প্রতাপাদিত্য, রাজা গণেশ, চাঁদ রায়, কেদার রায়। এঁরা প্রত্যেকেই সেইসময় নিজেদের স্বাধীন শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।

”রাজকন্যা কাঞ্চনমণির বিয়ে হয় খুব অল্প বয়সে। বিয়ের কিছু পরেই বিধবা হয় সে। তখন তো জানেনই সতীদাহ প্রথা কেমন ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা বাংলায়। নিয়ম অনুযায়ী নিজের স্বামীর সঙ্গে চিতায় সহমরণে যেতে হত কাঞ্চনমণিকে। কিন্তু রাজা নীলাম্বর কিছুতেই তাঁর একমাত্র মেয়েকে জ্যান্ত পুড়ে মরতে দিলেন না, লুকিয়ে রাখলেন নীলদরিয়ার মাঝের ওই রাজবাড়িতে। এদিকে রাজ্যের কিছু লোক সেইজন্য ক্ষেপে উঠল। সবার জন্য যা নিয়ম, রাজার মেয়ে বলে তার অন্যথা কেন হবে? রাজার অমাত্যদের মধ্যেই কিছু লোক এই নিয়ে ক্ষুব্ধ হতে লাগল। আর তাদের নেতৃত্ব দিতে লাগল রাজ্যের মন্ত্রী শচীপাত্রর ছেলে অত্রুুর।”

”শচীপাত্র!” আমি মাথা নাড়লাম, ”হ্যাঁ, নীলাম্বর রাজার এই মন্ত্রীর রেফারেন্স আছে ইতিহাসে। কিন্তু তার ছেলে অত্রুুরের নাম কোথাও পাইনি।”

মুকুন্দ বলল, ”অত্রুুরের নিজের বোনকে কিছুদিন আগেই চিতায় জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। সেখানে বিধবা হয়েও কাঞ্চনমণি রাজকন্যা বলে জীবিত থাকবে এটা অত্রুুর কিছুতেই সহ্য করতে পারছিল না। একদিন নীলাম্বর রাজবাড়িতে ছিলেন না, কোন এক রাজকার্যে লোকলস্কর নিয়ে রাত্রিবাস করছিলেন অনেক দূরের এক দুর্গে। সেই সুযোগে সে নিজের দলবল নিয়ে রাতের অন্ধকারে হামলা চালাল কাঞ্চনমণির মহলে। তাকে জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া হতে লাগল শ্মশানে।”

আমি শুনতে শুনতে গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়েছিলাম, মুকুন্দ থামতেই বলে উঠলাম, ”তারপর? কাঞ্চনমণিকে পুড়িয়ে মেরে ফেললো?”

”না।” মুকুন্দ মাথা নাড়ল, ”তার আগেই অত্রুুরের দলের লোকদের হাত থেকে কীভাবে যেন নিজেকে ছাড়িয়ে কাঞ্চনমণি ঝাঁপ দিয়েছিল নীলদরিয়ায়। তার তখন আট বছর বয়স।”

আমি চুপ করে রইলাম।

মুকুন্দ বলল, ”রাজা নীলাম্বর যখন খবর পেয়ে এলেন, ততক্ষণে কাঞ্চনমণির দেহ নীলদরিয়ার কুমীরের পেটে চলে গেছে। ক্রোধে উন্মত্ত রাজা তখুনি অত্রুুরকে ধরে আনতে সৈন্য পাঠালেন। কিন্তু অত্রুুরও ততদিনে নিজের দলকে বেশ শক্তিশালী বানিয়ে ফেলেছে। সে রাজ্য থেকে পালাল।”

”তারপর?”

”আপনাকে সেদিন বলছিলাম রাজা নীলাম্বর ছিলেন দেবী মহামারীর উপাসক। এই দেবী অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। গ্রামের পর গ্রাম মড়কে উজাড় হয়ে যায় তাঁর কোপে। রাজা তখন স্বয়ং দেবীর আরাধনায় বসলেন। আপনার মেয়ে যেখানে গিয়েছিল, সেই মন্দিরেই। ভয়ঙ্কর নাকি সেই আরাধনা। পুজোশেষে অত্রুুর নাকি যে স্থানেই ছিল, সেখানেই রক্তবমি করতে করতে মারা যায়। তারপর ধীরে ধীরে সেখানে লাগে মড়ক। দিনকয়েকের মধ্যে অত্রুুরের গোটা দল কোন অজানা রোগে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।”

আমি এতক্ষণ বেশ আগ্রহের সঙ্গে শুনছিলাম, এবার নড়েচড়ে বসলাম। আমাদের দেশের ইতিহাসের সমস্যাই এই, ঠিকমত গ্রন্থিত না থাকায় এর মজ্জায় মজ্জায় এমন গুজব, অলৌকিক কল্পনা মিশে আছে যে পুরাতত্ত্ববিদ হিসেবে আমাদেরও মাঝেমাঝে ধোঁয়াশায় পড়ে যেতে হয়। মুকুন্দর গায়ে এখন যতই শহুরে শিক্ষিত জল হাওয়া লাগুক, এইসমস্ত গল্পগুলো ছোট থেকে ওর মাথাতে এমনভাবে ঢুকে রয়েছে, যে এই ব্যাপারে ওর সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই।

আমি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললাম, ”নূপুরকে তো দেখছ মুকুন্দ, দিনের পর দিন কেমন পাল্টে যাচ্ছে। কী করা যায় বলো তো? এদিক থেকে কাছের শহর বলতে তো তোমাদের ওই রঙপুর। সেখানে নিয়ে গিয়ে কোন ভাল ডাক্তার দেখাব কী?”

মুকুন্দ চুপ করে রইল, তারপর বলল, ”স্যার, আপনি হয়ত এসব মানবেন না, ভাববেন অশিক্ষিত গ্রামের লোকেদের গুজব। কিন্তু আপনি যবে থেকে রাজবাড়ি সংস্কারের জন্য এসেছেন, গ্রামের সবাই কিন্তু ভয়েই রয়েছে। আরো বেশি করে আপনার মেয়ের জন্য। আর এই পরপর কয়েকজন মারা যেতে সেই ভয় আরো জাঁকিয়ে বসছে মানুষের মনে।”

”আমার মেয়ের জন্য? কেন?” আমি চকিতে ওর দিকে তাকালাম, ”আমার কাজের মধ্যে আমার মেয়ে কোত্থেকে এল? আর তার সঙ্গে এই জ্বরের সম্পর্কটাই কী?”

মুকুন্দ ঢোঁক গিলল। তারপর বলল, ”স্যার, এ তল্লাটে সবাই মনে করে, পাঁচশো বছর ধরে রাজা নীলাম্বর এই অঞ্চলে মিশে রয়েছেন। তিনি খুঁজে চলেছেন তাঁর মেয়ে কাঞ্চনমণিকে। তাঁর আরাধ্যা ওই মহামারী দেবীকে ওইজন্যই সাহসভরে কেউ পুজো করে না। কারণ সবাই বিশ্বাস করে, রাজা নীলাম্বর এখনও মহামারী দেবীর পুজো করেন ওই ভাঙা মন্দিরে। আর সেইজন্যই দেবী তুষ্ট আছেন, এই অঞ্চলে কোন মড়ক লাগে না।”

এবার আমি আর বিরক্তি চাপতে পারলাম না, মুখ দিয়ে একটা আওয়াজ করে বলেই ফেললাম, ”ননসেন্স!”

মুকুন্দ দোনোমনা করতে করতে বলেই ফেললো, ”রাজকন্যা কাঞ্চনমণি তো নীলদরিয়ায় আত্মহত্যা করেছিল আট বছর বয়সে। ওই বয়সী কোন মেয়ে নীলদরিয়ায় থাকলেই রাজা নাকি তাকে কাঞ্চনমণি ভেবে নিজের কাছে টেনে নিতে চান। আর সেইজন্য সেইসময় দেবীর পুজোয় ব্যাঘাত ঘটে, অমনি শুরু হয় কোন রোগের প্রাদুর্ভাব। এরকম কয়েকবার ঘটেওছে। সুস্থ সবল কোন ওই বয়সী কিশোরী হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে গ্রাম থেকে। ওইজন্য গ্রামে কোন মেয়ে একটু বড় হলেই তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দূরে কোথাও।”

”তুমি থামবে?” আমার মনে পড়ে গেল, সেদিন ওই হরিহর পাগল লোকটাও এইভাবেই মেয়েকে সাবধানে রাখার কথা বলেছিল। আমি রেগেমেগে বললাম, ”তখন থেকে ভুলভাল বকে চলেছ। এগুলো এই অঞ্চলের লোকেদের মস্তিষ্কপ্রসূত কল্পনা, বুঝেছ? ঐতিহাসিক কোন সত্যতা নেই এর পেছনে।”

মুকুন্দ এবার চুপ করে গেল। অনেকক্ষণ পর বলল, ”স্যার, ইতিহাস কিন্তু রাজা নীলাম্বরের মৃত্যু নিয়ে পুরো নীরব।”

”কেন নীরব হবে?” আমি ঝাঁঝিয়ে উঠে বললাম, ”নীলাম্বরকে যুদ্ধে পরাস্ত করে গৌড়ের সুলতান হুসেইন শাহ বন্দী করে নিয়ে যান গৌড়ে। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।”

”না। সম্পূর্ণ ভুল।”

মুকুন্দর কথার মধ্যে এমন এক আত্মপ্রত্যয় ছিল যে আমি একটু চমকে গেলাম, ”ভুল কী করে বলছ?”

”হুসেইন শাহ তো এদিকে কোন নজরই দেননি প্রথমে। তিনি মোঘলদের সঙ্গে লড়াইতেই ব্যস্ত ছিলেন। মন্ত্রী শচীপাত্র তার ছেলে অত্রুুরের ওইরকম শোচনীয় হত্যার প্রতিশোধ নিতে বিশ্বাসঘাতকতা করেন রাজা নীলাম্বরের সঙ্গে। তিনিই ষড়যন্ত্র করে হুসেইন শাহকে আহ্বান করেন কামতা সাম্রাজ্য আক্রমণ করতে। নীলাম্বর সেই আকস্মিক আক্রমণে প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও পরে সন্ধি করেন। দুই তরফে একটা ওপর ওপর বন্ধুত্ব তৈরি হয়। কিন্তু শচিপাত্র সেই বন্ধুত্বকে কিছুতেই সহ্য করতে পারেননা। তিনি চেয়েছিলেন নীলাম্বর রাজা একেবারে শেষ হয়ে যাক। শচীপাত্রেরই কুবুদ্ধিতে সুলতান হুসেইন শাহ নীলাম্বরকে বলে পাঠান যে তাঁর বেগমরা নীলদরিয়ার রাজবাড়ির অন্তঃপুরে এসে দেখা করতে চান রাজপরিবারের মহিলাদের সঙ্গে। নীলাম্বর সরলমনে অনুমতি দিলে বোরখার আড়ালে এই নীলদরিয়ার রাজবাড়িতে প্রবেশ করে হুসেইন শাহের সশস্ত্র সেনারা। তখনই ওই অতর্কিত হামলায় নীলাম্বর বন্দী হন।” মুকুন্দ আমার দিকে তীক্ষ্নচোখে তাকাল, ”আপনিই বলুন স্যার, যদি অত্রুুরের ঘটনা বানানো হয়, তবে শচীপাত্র ষড়যন্ত্র করল কেন?”

আমি আর বেশি তর্ক করতে উৎসাহ পেলাম না। এইসব নিয়ে নিজেদের মধ্যে তর্কবিতর্ক করে কোন লাভও নেই। নূপুরকে এই অবস্থা থেকে সারিয়ে তুলতে হবে, আর সেইজন্য চালাকচতুর স্থানীয় লোক হিসেবে মুকুন্দকে আমার প্রয়োজন।

আমি বললাম, ”তা তুমি কী বলো। নূপুরের অবস্থা তো দিনদিন দেখছ। আমার কী করা উচিত?”

মুকুন্দ কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে রইল, তারপর বলল, ”আমার মনে হয় স্যার, আপনার মেয়েকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত। কিছু জিনিষ আজও পৃথিবীতে ঘটে, যার কোন ব্যাখ্যা হয় না। জেদের বশে ঝুঁকি নেওয়া কী ঠিক? একবার ক্ষতি হয়ে গেলে তো আর কিছু করার থাকবে না।”

মুকুন্দর কথার মাঝেই আমার ফোন বেজে উঠল। বাসন্তীদি।

আমি রিসিভ করে কানে দিয়েই স্তম্ভিত হলাম। বাসন্তীদি অঝোরে কাঁদছে। নূপুরকে আবার পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা চলে আসার পর বাসন্তীদি নূপুরকে চোখ চোখেই রেখেছিল। নূপুর বাইরের ঘরে বসে আঁকছিল, আর বাসন্তীদি পাশে বসে রাতের রান্নার জন্য তরকারি কুটছিল। নূপুরের একটা অন্য রঙের বাক্সর প্রয়োজন হওয়ায় সে ভেতরের ঘরে আনতে যায়। অনেকক্ষণ কোন সাড়াশব্দ না পাওয়ায় বাসন্তীদি ভেতরে গিয়ে দেখে নূপুর নেই। বাড়ির পেছনের বাথরুমও ফাঁকা। ওরা অন্ধকারে বাগানেও খুঁজে দেখেছে। কেউ কোথাও নেই।

আমার হাতপা কাঁপতে শুরু করেছিল। হিষ্টিরিয়া রুগীর মত চেঁচিয়ে বললাম, ”ওই মন্দিরটা? ওখানে পাঠিয়ে দেখেছ কাউকে?”

বাসন্তীদি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ”ইকবালদা দুজন লোক নিয়ে টর্চ জ্বেলে দেখে এসেছে দাদা। নূপুর ওখানেও নেই।”

বোগরা-রঙপুর হাইওয়ে থেকে সটান ইউ-টার্ন নিয়ে নীলাম্বর রাজার গ্রামে গাড়ি প্রায় উড়িয়ে নিয়ে আসতে সময় লাগল প্রায় পৌনে একঘন্টা। এই পঁয়তাল্লিশ মিনিটে আমি ঢাকাতে সদরদপ্তরে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি যে বিশেষ জরুরী কারণে আজ যেতে পারছি না। ফোনটা রেখে টেনশনে নখ খেতে গিয়ে রক্ত বের করে ফেলেছি আঙুল থেকে, আর মুকুন্দ ক্রমাগত ফোনে গ্রামের লোকেদের সঙ্গে কথা বলে গেছে।

এ সব কী শুরু হল? বেশ তো ছিলাম কাজ আর মেয়েটাকে নিয়ে। হঠাৎ করে এ কোন অশনিসংকেত দেখা দিল আমাদের জীবনে?

গ্রামে যখন পৌঁছলাম তখন রাত প্রায় ন’টা। ঢোকার মুখে যে বাড়ির সামনে জটলা দেখেছিলাম, সেখানে এখন চাপা কান্নার রোল।

আমি ফ্যাকাশে মুখে তাকালাম মুকুন্দর দিকে। কেউ কিছু না বললেও বুঝতে ভুল হয় না এর মধ্যেই মৃত্যু এসে থাবা বসিয়েছে ওই মহিলার দেহে।

আমি মুকুন্দর বলা কথাগুলো ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই কেমন কেঁপে উঠলাম।

এখন মেঘমুক্ত আকাশে ঝিকমিক করছে অজস্র তারা। এই গ্রামে এমনিই আলো কম, তার মধ্যে আমাদের বাড়িটা শেষপ্রান্তে হওয়ায় সেখানটা অন্ধকার সন্ধে নামলেই জমাট বেঁধে থাকে।

বাড়ির সামনে গিয়ে দেখি আগেরদিনের চেয়ে আজ বাড়ির সামনে জটলা আরো বেশি। বাড়ির মেয়েবউরাও বাদ নেই। তারাও চলে এসেছে। সবাই নিজেদের মধ্যে ভয়ার্ত চোখে কী যেন বলাবলি করছে।

বাসন্তীদি ফোন করেছে একঘন্টা হতে চলল। তারও বেশ কিছুক্ষণ আগে থেকে নূপুর নিখোঁজ, ইকবাল খুঁজেও এসেছে জঙ্গলের ওই ভাঙা মন্দিরে। তার মানে প্রায় দু’ঘন্টার কাছাকাছি হল এই নিশুতি রাতে নূপুর চোখের আড়ালে।

ভয়ে, আতঙ্কে আমার গলা শুকিয়ে আসছিল।

ভিড় ঠেলে বাড়ির রোয়াকের কাছে পৌঁছেই দেখি, হরিহর পাগল বসে আছে রোয়াকের ওপর রাখা একটা জলচৌকিতে। আমি বাইরে থেকে ভেবেছিলাম সবাই বুঝি নূপুরের কারণে ভিড় জমিয়েছে। কিন্তু এখন দেখি তা নয়। হরিহর পাগল উত্তেজিত গলায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে, ”আমি প্রথমদিনই বলে গিয়েছিলাম, মেয়েটাকে সাবধানে রাখতে। নীলাম্বর রাজার গাঁয়ে এসেছে আটবচ্ছরের মেয়েকে সঙ্গে করে। কোন মানে হয় এইসব বেয়াদপির? এইবার দ্যাখো না কেমন অনর্থ বাধে গাঁয়ে। মেয়েটা তো মরবেই, সঙ্গে মহামারীদেবীর কোপে চারদিক একেবারে শেষ হয়ে যাবে। এরমধ্যেই চারটে গেছে।”

আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। লোকটার স্পর্ধা, বাসন্তীদির কাছ থেকে ওর আমাদের বাড়িতে উঁকিঝুঁকি মারার ঘটনা শোনা, সেদিনের সাবধানবাক্য, সব একসঙ্গে মিলে আমার মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দিল। নতুন জায়গা, স্থানীয় সবাই আমার বিরুদ্ধে চলে গেলে কী হবে, ওইসব কিচ্ছু না ভেবে গিয়ে লোকটার কাঁধদুটো চেপে ধরলাম।

লোকটা আজকেও খালি গায়ে একটা ময়লা ধুতি জড়িয়ে রয়েছে। চিৎকার করছে বলে মুখ থেকে মাঝেমাঝেই থুতু ছিটকে আসছে। আমার এই হঠাৎ আক্রমণে ও হকচকিয়ে গেল।

আমার মাথায় খুন চেপে গিয়েছিল। আমি কর্কশ গলায় বললাম, ”বল কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস নূপুরকে। এক্ষুনি বলবি, নাহলে আমি পুলিশে ফোন করবো।”

চাঁদের আলোয় হরিহর পাগলের মুখটা দেখলাম ঝুলে পড়ল আমার কথা শুনে, তারপর বলল, ”আমি কেন লুকিয়ে রাখতে যাব আপনার মেয়েকে…?”

আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। ঠাস করে লোকটার গালে একটা চড় মেরে দিলাম। ভেবেছিলাম আশপাশের লোকেরা কিছু বলবে, কিন্তু কেউ কিছু বলল না। সবাই জটলা পাকিয়ে গোলগোল চোখে দেখতে লাগল।

মুকুন্দ ততক্ষণে এগিয়ে এসে আমাকে আটকাতে উদ্যত হয়েছে, ”স্যার, ওকে ছেড়ে দিন। আপনি মাথা ঠাণ্ডা করুন, শুনুন …।”

আশ্চর্যের ব্যাপার, হরিহর পাগল চড় খেয়ে কোন পাল্টা আঘাতের দিকে গেল না, উল্টে সেই সাপের বীণের মত সুর ধরা গলায় বলল, ”শুনুন, আপনার মেয়েকে নীলাম্বর রাজা নিয়ে গেছে। আপনি কোনোমতেই ওকে আটকাতে পারবেন না। নীলাম্বর রাজা এইবয়সী মেয়েকে ছাড়েনা, কারণ আটবছরের মেয়ে এই গ্রামে এলেই তার মধ্যে প্রবেশ করে তাঁর মেয়ের আত্মা। বুঝলেন? আপনার মেয়েকে ফিরে পেলেও সে আপনার মেয়ে থাকবে না, দেখে নেবেন।”

নীলাম্বর … নীলাম্বর … নীলাম্বর! আমি এবার হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে বাঘের মত লাফিয়ে পড়লাম হরিহর পাগলের ওপর। তীব্র আক্রোশে কিল, চড়, ঘুষি কিচ্ছু বাদ রাখলাম না। রাগের মাথায় হয়ত খুনোখুনি হয়ে যেত, মুকুন্দ এবং আরো কয়েকজন অতিকষ্টে আমার হাত থেকে ওকে ছাড়াল।

আশ্চর্যের ব্যাপার! এত মার খেয়েও লোকটার কোন বিকার নেই। ঠোঁটের একদিকটা কেটে গেছে। সেখান থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। রক্তটাকে চেটে নিয়ে হরিহর পাগল বলল, ”আমাকে মারলে সত্যিটা উল্টে যাবে না। আপনার মেয়ে এখন নীলদরিয়ায় আছে। বিশ্বাস না হলে গিয়ে দেখুন। আমি সেইটে বলতেই এসেছিলাম এখানে।”

সেদিন আর কয়েক মুহূর্ত দেরি করলে যে কী হত, ভাবতে এখনো আমার বুক কাঁপে।

না, হরিহর পাগল ভুল বলেনি। সেই জ্যোৎস্না রাতে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আমি, মুকুন্দ আর যে কয়েকজন রুদ্ধশ্বাসে গাছপালা মাড়িয়ে ছুটেছিলাম নীলদরিয়ার দিকে, এখনও সেই দৃশ্য মনে করলে আমার মাথার ভেতর যন্ত্রণা শুরু হয়।

নিঝুম নিস্তব্ধ রাত। তার মধ্যে আকাশছোঁয়া বিশাল বিশাল বুনো গাছগুলো কেমন যেন কবরখানায় শুয়ে থাকা সমাধির মত নিশ্চলচোখে দেখছে আমাদের। দূরের রাজবাড়ি থেকে ভেসে আসছে অজানা কোন জন্তুর কাতর ক্রন্দন। তারই মধ্যে আমরা পাঁচ-ছ’জন গিয়ে পৌঁছলাম নীলদরিয়ায়। গ্রামের অধিকাংশই আসেনি, শুধু আমাদের কাতর অনুরোধে কয়েকজন অসমসাহসী যুবক সঙ্গ নিয়েছিল আমাদের।

এতদিন এই বিশাল গহ্বরকে সূর্যের আলোতেই দেখেছি। এখন এই অন্ধকারে বিরাট নীলদরিয়াকে দেখে শিরদাঁড়া দিয়ে কেমন বরফকুচি নেমে গেল। কালো মিশমিশে একটা বিকট অশুভ বলয় যেন গোটা অঞ্চলটাকে চাকার মত ঘিরে রেখেছে। গোটা এলাকায় যেন প্রাণের কোন অস্তিত্ব নেই, পুরোটাই স্তব্ধ হয়ে রয়েছে পাঁচশো বছর আগের মৃতপুরীতে।

ওপরের আকাশে মিটমিট করছে নক্ষত্রপুঞ্জ, দূরে অতৃপ্ত শবদেহের মত মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে নীলাম্বর রাজার বসতভিটের ধ্বংসাবশেষ।

নীলদরিয়ায় উঁকি দিয়ে নীচের জলের দিকে তাকানোর সাহস আমার আর হল না, তার আগেই মুকুন্দর জোরালো টর্চের আলো এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল নূপুরকে।

হ্যাঁ, নূপুরই। হিমচোখে দেখলাম এই রাত দশটার সময় মৃত্যুকূপ নীলদরিয়ার একদম ধারে পা দুটো হাঁটুর কাছে মুড়ে বসে রয়েছে নূপুর।

তার চোখের পাতা খোলা, কিন্তু দৃষ্টি যেন শূন্য, অনেকদূরে সে তাকিয়ে রয়েছে নীলাম্বরের রাজবাড়ির দিকে। এতটাই ধারে বসে রয়েছে, যে একটু জোরে হাওয়া দিলেও যেন সে পড়ে যাবে নীলদরিয়ার গহ্বরে।

দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে কোলে নিতে গিয়ে আমার হাতদুটো শিরশির করে উঠল। নূপুরের হাত পা বরফের মতই ঠাণ্ডা, সেটা এতক্ষণ এই হিমরাতে এখানে বসে থাকলে হওয়াটা বিচিত্র নয়। কিন্তু, আমার দিকে তাকিয়েও ওর কোন ভাবান্তর হল না। যেন চোখটাই শুধু রয়েছে আমার দিকে, দৃষ্টি চলে গেছে আমাকে ভেদ করে পেছনের অরণ্যে।

শান্ত শীতল প্রস্তরমূর্তির মত তার ভঙ্গী।

এই গোটা সময়ে আমাদের সঙ্গে ছায়ার মত ছিল হরিহর পাগল। তাকে আর অগ্রাহ্য করতে পারিনি, তার ওপর রাগও করতে পারিনি। কারণ সে বলল বলেই আমরা নীলদরিয়ায় এসে খুঁজে পেলাম নূপুরকে।

বাড়িতে এসে নূপুরকে যখন বিছানায় শোয়ানো হল, তখন ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাত ছুঁই ছুঁই। আমার চোখে একফোঁটা ঘুম নেই, মেয়েকে ফিরে পাওয়ার আনন্দও নেই। শুধু মনে হচ্ছে, এ যেন সমুদ্রে হিমশৈলের চূড়ামাত্র। মনে হচ্ছে, বিপদের কোন অনন্ত আবর্তে আমি নিজের অজান্তেই ঢুকে পড়েছি, এখন অনন্তকাল ধরে তাতে পাক খেয়ে যেতে হবে। আর সেই পাক খেতে খেতে শেষ হয়ে যাব আমি, নূপুর দুজনেই।

গ্রামের অন্যান্য সব লোক চলে গেলেও সেরাতে আমার সঙ্গে বাইরের ঘরে বসে রইল মুকুন্দ আর ইকবাল। বাসন্তীদিকে আমি ঘরে নূপুরের পাশে ঠায় বসে থাকতে বলেছিলাম।

আমি ক্লান্ত গলায় বললাম, ”এর শেষ কোথায়? আমি তো কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না মুকুন্দ! আমি কী ইন্ডিয়া ফিরে যাব?”

মুকুন্দ মাথা নাড়ল। আজকের ঘটনার পর সম্ভবত ও আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার শক্তিটুকুও পাচ্ছে না ভেতর থেকে।

আমি যন্ত্রণাক্লিষ্ট ভাঙা গলায় বললাম, ”আমার-আমার ওই মেয়ে ছাড়া কেউ নেই। ও কী মরে যাবে?”

”মরবে না যদি বলিঠাকুরাণীর মন্ত্রটা জানেন।”

আমি চমকে তাকালাম কণ্ঠস্বর লক্ষ করে। দেখি, সবাই চলে গেলেও হরিহর পাগল উবু হয়ে বসে রয়েছে একেবারে ঘরের চৌকাঠের কাছে। এতক্ষণ ওকে খেয়ালই করিনি।

কেন জানিনা, এবার আর ওই লোকটাকে অগ্রাহ্য করতে পারলাম না। দুর্বলকণ্ঠে বললাম, ”কী মন্ত্র?”

হরিহর পাগল বলল, ”মহামারীদেবীকে ওই মন্ত্রেই পুজো করতে হয়। সেই পুজো না করলে আপনার মেয়ে তো যাবেই, দেবীর কোপে গাঁয়ের পর গাঁ-ও উজাড় হয়ে যাবে।”

আমি একটু রুষ্ট হয়ে বললাম, ”এখানে তো কেউ পুজোই করেনা এখন ওই মন্দিরে। পরিত্যক্ত হয়েই তো পড়ে থাকে শুনেছি। তবে দেবী তুষ্ট থাকেন কী করে?”

”আপনাকে কে বলল কেউ পুজো করে না?” হরিহর পাগল আবার সেই মরা মাছের মত চোখ করে তাকাল, ”আপনাকে তো প্রথমদিনেই বলেছিলাম যে আপনি যার খোঁজে এসেছেন, তিনি ইতিহাস নন, এখনও অস্তিত্ব রয়েছে তাঁর। তিনিই পুজো করেন মহামারীর। তিনিই তুষ্ট রাখেন দেবীকে। পাঁচশো বছর ধরে। হ্যাঁ এটা ঠিক, কেউ তাঁকে দেখেনি। কিন্তু না দেখলেও তিনি নীলদরিয়ার নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে মিশে আছেন।”

আমি কপালের দু’পাশের রগ টিপে ধরলাম। চারদিক থেকে এত কথায় আমি দিশেহারা হয়ে পড়ছি। কোনটা সত্য, কোনটা অসত্য, কোনটা কল্পনা, সেই সীমারেখাও লোপ পেয়ে যাচ্ছে মনের মধ্যে।

”কে তিনি?” বললাম আমি।

হরিহর পাগল আমার চোখে চোখ রেখে বলল, ”যার বাড়ি, যার সাম্রাজ্যে আপনি এসেছেন, সেই রাজা নীলাম্বর।”

আমি তেতো গলায় বললাম, ”তা তিনিই যখন পুজো করেন, এখন করছেন না কেন?”

আমার গলার মধ্যে এমন একটা বিদ্রূপ প্রচ্ছন্ন আকারে লুকিয়ে ছিল যে, হরিহর পাগল দেখলাম ক্ষেপে উঠল। আশ্চর্য, লোকটাকে যখন মারছিলাম, তখন কিছু বলল না আর এখন রীতিমত তেরিয়া হয়ে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলল, ”সে তো আপনারই মেয়ের জন্য। আট বচ্ছরের মেয়ে দেখলেই যে নীলাম্বর রাজা সব ভুলে তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সেই মেয়ের মধ্যে দেখতে পান তাঁর নিজের মেয়েকে। আর তখনই দেবীর পুজোয় ফাঁকি পড়তে থাকে। শুরু হয় মহামারীর। যেমন হয়েছিল আমার মেয়েটার সময়।”

আমি মুকুন্দর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, চুপ করে থাকলেও তার চোখ মৌনভাবে হরিহর পাগলের কথাকেই সম্মতি জানাচ্ছে। এই কথাগুলোই গাড়িতে আসতে আসতে মুকুন্দ বলছিল।

আমি এবার বললাম, ”কী হয়েছিল তোমার মেয়ের?”

হরিহর পাগল উত্তেজিত হয়ে বলল, ”আপনার মত জেদ ধরে বসেছিলাম যে। সক্কলে বারণ করেছিল, বলেছিল সাত পুরোলেই মেয়েটাকে কোথাও পাঠিয়ে দাও। এই গাঁয়ে কেউ আট বচ্ছরের মেয়ে রাখতে সাহস করে না। আমি শুনিনি। জেদ চেপে গিয়েছিল ঝর্ণাকে এখানেই মানুষ করব।”

”ঝর্ণা তোমার মেয়ের নাম?” আমি বাধা দিয়ে বললাম।

”ছিল।” হরিহর পাগল চোখে চোখ রেখে উত্তর দিলেও স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম তার গলাটা এবার কেমন বুজে আসছে, ”সাত পেরিয়ে আটে পড়ার কয়েকদিনের মধ্যে গণ্ডগোল শুরু হল। আমি তখন গ্রামের দুটো মন্দিরে পুজো করি। সারাদিন বাড়ি থাকতুম না। মেয়ে গিয়ে ভাঙা মহামারী মন্দিরে বসে থাকতে শুরু করল। প্রথমে দু-একবার বকাবকি করেছি, বেশি গুরুত্ব দিইনি। ওদিকে টুকটাক কলেরায় মানুষ মরতে শুরু করল আর আস্তে আস্তে ঝর্ণাও কেমন হয়ে গেল। দিনরাত হয় মহামারী মন্দির, নয়তো নীলদরিয়ায় গিয়ে বসে থাকত। হয়রান হয়ে খুঁজতে খুঁজতে শেষে যখন খুঁজে পেতাম, জিজ্ঞেস করলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত, বলতো তুমিই তো ডাকলে বাবা! তাই তো এলাম।”

আমি চমকে উঠলাম। সেদিন মহামারী মন্দিরে নূপুরও অঙ্গভঙ্গি করে এইটাই বুঝিয়েছিল। আমি নাকি ওকে ডেকেছি।

অধীর গলায় বললাম, ”তারপর?”

”এভাবে মাসদুয়েক চলল। শেষের দিকে পরিষ্কার বুঝতে পারতাম, ঝর্ণার শরীরটাই শুধু ওর রয়েছে, ভেতর ভেতর ও নেই, সেখানে বাস করছে অন্য কারুর আত্মা। আমি কী করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। দু-একবার গ্রাম থেকে নিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কোন লাভ হল না। রাজার দৃষ্টি একবার পড়লে আর কিছুতেই নিষ্কৃতি পাওয়া যায়না। বাবার রূপ ধরে এসে ভুলিয়ে নিয়ে যায় মেয়েকে।”

আমার শুনতে শুনতে বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল। হাতপা’গুলো অবশ হয়ে যাচ্ছিল ভয়ে।

”তারপর একদিন ঝর্ণা আর ফিরে এলনা। সেদিন ওকে তন্নতন্ন করে খুঁজলাম, পরেরদিন সকালে রঙপুর থানায় গিয়ে ডায়রিও করলাম। কিন্তু ওকে কেউ কোথাও খুঁজে পেলাম না।” হরিহরের গলাটা কাঁপতে লাগল, ”পাড়ার একজন বলল ওকে সেদিনও নীলদরিয়ার দিকে যেতে দেখেছিল।”

আমি চুপ করে রইলাম।

হরিহরের চোখ জলে ভরে এসেছিল, ধুতির খুঁটটা তুলে চোখের কোণটা মুছে নিয়ে বলল, ”তারপর থেকে আমি কেমন যেন হয়ে গেলুম। ওই আমার একটামাত্র মেয়ে ছিল। আমার বউও শোকে দুঃখে একবছরের মধ্যেই মরে গেল। তারপর থেকে আমি দিনরাত ওই মহামারী মন্দিরে গিয়ে বসে থাকি। দেবীর পুজো হয় না, কেউ যায় না, শুধু ফাঁকা মন্দিরটাই পড়ে আছে, সেটাও যে কোনোদিন ভেঙে পড়তে পারে। তবু দেবীকে মনপ্রাণ দিয়ে ডাকি, যদি কখনও কিছু সুরাহা হয়। যদি আমার কান্না শুনে রাজামশাইয়ের মন গলে।”

যে আমি ঘন্টাকয়েক আগে গাড়িতে বসে মুকুন্দর বলা কাহিনীকে বুজরুকি বলে উড়িয়ে দিয়েছিলাম, সেই আমিই কেন জানিনা এই কিছুক্ষণের ব্যবধানে বলা হরিহরের তথাকথিত এই আজগুবি গল্পকে আর আজগুবি বলে উড়িয়ে দিতে পারলাম না। একজন অসহায় বাবার মন যখন দুশ্চিন্তায় আশঙ্কায় পরিপূর্ণ হয়ে থাকে, তখন সন্তানের হিতার্থে যুক্তি জানলা দিয়ে পালিয়ে যায়। শিক্ষাদীক্ষা-যুক্তিবোধ সবই তখন ফিকে হয়ে আসে অজানা বিপদের ভয়ে।

হঠাৎ করেই যেন আমি আর হরিহর একই পংক্তিতে নেমে এলাম, অসহায় এক বাবা ছাড়া আমাদের দুজনের যেন আর কোন পরিচয় নেই!

আমি দুর্বলচিত্তে বললাম, ”তার মানে তুমি বলছ, নূপুরেরও …!”

হরিহর পাগল মাটির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল দু’পাশে, তারপর বলল, ”সবই ভবিতব্য কত্তা! সবই নিয়তির ডাক! নয়ত আপনি এত জায়গা থেকে মরতে এখানেই বা কাজে এলেন কেন! আর আসার সময় আপনার মেয়েই বা সাত পেরিয়ে আটে পড়ল কেন!”

”এই তুমি অনেকক্ষণ ধরে বাজে বকে চলেছ।” এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকা ইকবাল যেন হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে, ”এখন আবার ফেরত নিয়ে চলে গেলেই তো হল। নূপুরের কিচ্ছু ক্ষতি হবে না, আমি থাকতে কিচ্ছু হতে দেব না ওর।”

আমি কাতরচোখে ইকবালের দিকে তাকালাম। কুচবিহারের গোঁসানিমারিতে যাওয়ার পরে পরেই ইকবাল আর বাসন্তীদিকে কাজে বহাল করেছিলাম। তখন নূপুর অ্যাত্তটুকুন, বড়জোর চারবছর। সেই থেকে ওরা দুজন কোলেপিঠে করে বড় করে তুলছে ওকে, ইকবালের ওর ওপর মায়া তো থাকবেই!

ইকবাল তীক্ষ্নচোখে আমার দিকে তাকাল, ”দাদা, চলুন আমরা কাল সকালেই দেশে ফিরে যাই। আপনি অফিসে জানিয়ে দিন যে আপনি আর এখানে থাকতে পারছেন না। আমরা আবার গোঁসানিমারির কোয়ার্টারে ফিরে যাই চলুন!”

আমি ধীরে ধীরে ওর কথায় সায় দিলাম। এই অ্যাসাইনমেন্টটা আমার কেরিয়ারের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। নিজের কর্মক্ষমতা ও মেধার জোরে অনেককে টপকে দুই দেশের এই যৌথ প্রোজেক্টের একজন আরকিওলজিস্ট হিসেবে জায়গা করতে পেরেছিলাম আমি। আমার চেয়ে সিনিয়র কিছু মানুষ তালিকায় থাকলেও যোগ্যতার নিরিখে নিজেকে প্রমাণ করে এই প্রোজেক্টে নির্বাচিত হয়েছিলাম আমি।

সেখানে কাজ শুরু হওয়ার পর মাঝপথে এইভাবে চলে যাওয়াটা খুবই বাজে প্রভাব ফেলবে আমার কেরিয়ারে। কিন্তু যা প্রভাব ফেলার ফেলুক, আমি পরক্ষণেই সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেললাম মন থেকে। কোন কিছুই আমার জীবনে নূপুরের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়।

আমি ইকবালের কথায় সায় দিয়ে বললাম, ”আমি কালই ইমেল করছি।”

অদূরে বসে থাকা হরিহর পাগল মাথা নিচু করে নিজের মনেই হাসল। আমি সেটা দেখেও না দেখার ভান করলাম। আমি একজন বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষিত মানুষ, কয়েকটা গেঁয়ো অশিক্ষিত লোকের বানানো গুজবে প্রভাবিত হব কেন? নূপুরের নিশ্চয়ই কোন সমস্যা হচ্ছে, যেটা আমরা কেউ বুঝতে পারছি না। আপাতত এখান থেকে ওকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া খুবই প্রয়োজন। এই বয়সের বাচ্চারা কোনকিছু ভুলতে খুব বেশি সময় নেয় না। এই পরিবেশে ওর যে অসুবিধাটা হচ্ছে, সেটা ও খুব শীগগিরই ভুলে যাবে।

আমি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। দুদিনের মধ্যে এখান থেকে চলে যাব। আপাতত গোঁসানিমারি নয়, যাব কলকাতায়। গিয়ে কিছুদিন নূপুরের সঙ্গে আমি সারাদিন সময় কাটাব। কলকাতায় ও খুব বেশি যায়নি। এবারে সব জায়গা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাব। তার সঙ্গে পরামর্শ করবো কোন নামজাদা মনস্তত্ত্ববিদের সঙ্গে।

 ভাবতে ভাবতে আমি দাঁতে দাঁত চেপে ভেতরের ঘরের দিকে তাকালাম। ওখানে ঘুমিয়ে আছে আমার একমাত্র সম্বল,আমার নিষ্পাপ নূপুর।

সারিয়ে আমি ওকে তুলবই।

বাংলাদেশের এই প্রোজেক্ট থেকে মুক্তি পেতে খুব বেশি সমস্যা হল না। আমার এগারো বছরের চাকরি জীবনের রেকর্ড অত্যন্ত ভাল থাকায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমার আবেদনকে বেশ বিবেচনার সঙ্গেই দেখলেন, সঙ্গে আমি যেমন চেয়েছিলাম, একমাসের ছুটিও মঞ্জুর করলেন। আমার পরিবর্তে ভারতবর্ষ থেকে বিকল্প একজন আরকিওলজিস্টও পাঠানোর বন্দোবস্ত হয়ে গেল। ভদ্রলোকের নাম ডঃ অনিরুদ্ধ মিদ্যা। তিনিও এতদিন কামতা সাম্রাজ্যের সাইটেই ছিলেন, তবে কুচবিহারে নয়, আসামে।

ঠিক হল, ডঃ মিদ্যা আসা পর্যন্ত দুদিন আমি থাকবো এখানে, তারপরই গাড়ি করে সোজা ঢাকা, সেখান থেকে বিমানে কলকাতা। আমি যতদিন কলকাতায় থাকবো, ইকবালও ঘুরে আসবে কুচবিহারে ওর নিজের বাড়ি থেকে। আর বাসন্তীদি যাবে আমাদের সঙ্গেই।

আজও যখন ফাঁক পেলেই অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করি, শূন্যচোখে হিসেব করি লাভ-লোকসানের, তখন ভাবি নীলদরিয়ায় সেই অতিরিক্ত দুটোদিন যদি না থাকতাম, তাহলে হয়ত আজ আমার জীবনে সবকিছু অন্যরকম হত।

নীলদরিয়ায় নূপুরকে খুঁজে পাওয়ার পর কেটে গিয়েছিল পাঁচটা দিন। এর মধ্যে নূপুরের উন্নতি বা অবনতি কোনোটাই হয়নি। আগের মতই সে সারাক্ষণ উদাস চোখে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে থাকে, আমার বা বাসন্তীদি, কারুর ডাকেই সেভাবে সাড়া দেয় না। তবে আশার কথা এই যে, সেদিনের পর থেকে নূপুর আর আঁকার খাতা ছোঁয়নি, কোন পুরনো মন্দির বা রাজপ্রাসাদের ছবিও আঁকেনি। আমিও এই ক’টা দিন আর ঝুঁকি নিইনি, নূপুরকে ঘরে রেখে বাইরে কোথাও বেরোইনি বললেই চলে।

তবু, তবু আমি শেষরক্ষা করতে পারলাম না। নীলাম্বর রাজার দৃষ্টি থেকে বাঁচাতে পারলাম না নূপুরকে।

সেদিন আমাদের দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে বেরনোর কথা ছিল। ডঃ মিদ্যা সকালেই চলে এসেছিলেন গ্রামে, উঠেছিলেন আমাদের বাড়িতেই। আমাদের পর এই বাড়িটায় উনিই ভাড়া থাকবেন। মুকুন্দ এবার কাজে সহযোগিতা করবে ওঁকে। সকালবেলা থেকেই নূপুর যেন ভীষণ আনমনা হয়ে যাচ্ছিল। ওকে সেভাবে কেউ কিছু বলিনি যে আমরা এখান থেকে চলে যাচ্ছি। তবু বাক্সপ্যাঁটরা গোছানো, বিছানা খুলে ফেলা, সব কিছু দেখে ও আন্দাজ তো ঠিকই করতে পেরেছিল।

দশটা নাগাদ হরিহর পাগল এল। এরমধ্যে মুকুন্দ গাড়ির ড্রাইভারকে সঙ্গে নিয়ে রংপুর শহরে গিয়েছে গাড়িটাকে সার্ভিসিং করিয়ে আনতে। আমি আজ হরিহরের সঙ্গে হেসেই কথা বললাম। বাসন্তীদিকে বলে চা-জলখাবার আনতে বললাম। কিন্তু প্রথমদিনের মত আজ আর হরিহর উবু হয়ে বসে আয়েশ করে চা খেতে তেমন উৎসাহ দেখাল না। বরং গম্ভীরমুখে বারবার নূপুরের দিকে তাকাতে লাগল।

আমি আলতো হেসে বললাম, ”কী হরিহর? কীবুঝছ? তোমাকে বলেছিলাম না, নূপুরকে এখান থেকে আমি নিয়ে যাবই।”

হরিহর ওর সামনের সেই স্বাভাবিকের চেয়ে বড় দাঁতদুটো বের করে ঘাড় নেড়ে বলল, ”পারবেন না কর্তা!”

”পারব না মানে?” আমার এবার ভারী রাগ হল। কোথাকার কোন অশিক্ষিত গ্রাম্য লোকের কথায় সেদিন সাময়িক প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলাম বলে এরা কী ভেবেছে, আমার নিজস্ব যুক্তিবোধ-টোধ সব হারিয়ে গেছে নাকি!

উষ্মাভরা কণ্ঠে বললাম, ”পারছি তো। দেখতেই পাচ্ছ আর দু’ঘন্টার মধ্যে এখান থেকে বেরিয়ে যাব। রাত ন’টার মধ্যে ঢাকা। কাল ভোরে কলকাতার ফ্লাইট। না পারার কী দেখলে হে? তোমার রাজামশাই নিশ্চয়ই তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে এই কয়েকদিনেই জেনে গেছেন যে আমরা নূপুরকে নিয়ে ভাগলবা হচ্ছি। কিছু করার হলে তো এই ক’দিনেই করতে পারতেন। তাছাড়া…।” আমি ঘরের দিকে একবার চকিতে তাকিয়ে নিয়ে গলা নামিয়ে বললাম, ”নূপুর আস্তে আস্তে পাল্টেও যাচ্ছে। খুব শীগগিরই সেরে উঠবে ও। সবকিছু ঠিকঠাক মিটলে কলকাতা থেকে মুকুন্দকে ফোন করে জানাব, খবর পাবে’খন।”

”যাকে নিয়ে যাচ্ছেন সে আপনার মেয়ে নূপুর নয়।” বিড়বিড় করতে করতে সাফ জানাল হরিহর, ”নূপুরের শরীরটাই রয়েছে মাত্র। ভেতরে ঢুকে বসে রয়েছে নীলাম্বর রাজার মেয়ে, কাঞ্চনমণি। রাজা কিছুতেই কাঞ্চনমণিকে গ্রাম থেকে বেরোতে দেবে না। আপনি মিলিয়ে নেবেন। ঝর্ণাও শেষের দিকে চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। ওটা মোমবাতি নেভার আগে দপ করে জ্বলে ওঠার মত। রাজা এখন মরণকামড়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ওদিকে দেবীও পুজো পাচ্ছেন না। আজ ভোরেও একজন গেল।”

আমার এবার এত রাগ হল যে ইচ্ছে করছিল সামনের ফুলদানিটা হরিহরের টাকমাথায় জোরে বসিয়ে দিই। কিন্তু অনেককষ্টে নিজেকে সংবরণ করলাম। যাওয়ার আগে আর বেকার অশান্তি চাইছি না। রাগের চোটে কোন কথা বলতে পারলাম না, দাঁতে দাঁত চেপে তাকালাম ভেতরের দিকে।

আর তখনই চোখে পড়ল সেই অদ্ভুত, হাড়হিম করা দৃশ্যটা।

এই বাড়িটার কাঠামোটা একটু অদ্ভুত। বাইরের রোয়াকে বসলে বাড়িকে সমান দু’ভাগে ভাগ করে পেছনের খিড়কি অবধি চলে যাওয়া গলি দিয়ে চোখ চলে যায় একেবারে পেছনের উঠোনে। সেখানে কিছুটা খোলা জায়গায় পাতকুয়ো, তার পাশে বাথরুম।

বাসন্তীদি কুয়োর দিকে পেছন করে উঠোনে টাঙানো দড়ি থেকে একটা একটা করে জামাকাপড় তুলছিল। নূপুর বসেছিল পাতকুয়োর পাশেই ছোট একটা টুলে। চোখের চশমাটা খুলে জামার খুঁট দিয়ে ও সেটাকে মুছছিল, এমন সময় মুহূর্তের অন্যমনস্কতায় সেটা হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল কুয়োর মধ্যে।

আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই ঘটনাটা ঘটে গেল।

আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে স্পষ্ট দেখতে পেলাম, নূপুর যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে কুয়োটার কিনারায় উঠে দাঁড়াল। তারপর অদ্ভুত এক সরীসৃপের মত শরীরটাকে একটুও না বেঁকিয়ে কুয়োর ভেতরে নেমে গেল। এমনকী পাশের দড়িতেও হাত দিল না। সিঁড়ি দিয়ে মানুষ যেভাবে মাথা সোজা করে নামে, সেভাবেই ওকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখলাম কুয়োর গহ্বরে।

গোটা ঘটনাটা দিনের আলোয় আমার চোখের সামনে এমন দ্রুতগতিতে ঘটে গেল, যে আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এতটাই হতভম্ব হয়ে গেলাম যে নূপুরকে সোজা কুয়োর মধ্যে নেমে যেতে দেখেও আমার হাত পা-গুলো আটকে গেল চেয়ারে। কয়েক মুহূর্ত পর যখন ছুটে গেলাম, ততক্ষণে নূপুর একইভাবে সোজা হয়ে উঠে চলেছে কুয়োর ওপরে, টুলটায় বসে পড়েছে নির্বিকার ভঙ্গীতে। চশমাটা ভাল করে মুছে ঠুসে দিয়েছে নাকের ডগায়।

গোটা দৃশ্যটা চোখের সামনে দেখে আমি ঠিক প্রকৃতিস্থ হতে পারছিলাম না। পাতকুয়ো পরিষ্কার করার মিস্ত্রীরা যেভাবে কুয়োর ভেতরের খাঁজগুলোয় পা দিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে নামে, সেই নামার মধ্যে অনেক স্বাভাবিকত্ব থাকে, থাকে অনেক সাবধানতা। কিন্তু নূপুরের নামা এবং ওঠা দেখে মনে হচ্ছিল ও যেন জন্ম জন্ম ধরে এইভাবে কুয়ো থেকে ওপরে ওঠে নামে, ওর জন্য যেন খাটেনা কোন অভিকর্ষ বল, মাধ্যাকর্ষণের সূত্র।

দেখতে দেখতে অবচেতনেই একটা আতঙ্ক এসে জড়ো হয় মনে।

আমার পেছন পেছন হরিহর পাগল আসার সময় নূপুরের কুয়োতে নামাটা না দেখলেও কুয়ো থেকে ওঠার দৃশ্যটা দেখেছিল। সে কিছু না বলে আমার হাতটা চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল, ”এখন কিচ্ছু বলবেন না কত্তা! কিচ্ছু বুঝতে দেবেন না ওকে। বাইরে চলুন!”

আমি মন্ত্রাবিষ্টের মত আবার বাইরের বারান্দায় ফিরে এলাম। আমি আর হরিহর যে ওই দৃশ্যটা দেখতে পেয়েছি, তা নূপুরের চোখে পড়েনি। সে আগের মতই নির্বিকার বসে রইল। মুখে কোন হাসি নেই, চোখদুটোতে নেই কোন অনুভূতি। দৃষ্টি নিশ্চল।

হরিহর বাইরে এসেই বলল, ”আপনি এখনো আমার কথা বিশ্বাস করছেন না? ওটা নূপুর নয়। কোন আটবছরের বাচ্চাকে দেখেছেন ওইভাবে কুয়ো দিয়ে উঠতে নামতে পারে?”

আমার মাথা ঘুরছিল কেমন। এতটাই শরীরটা অবসন্ন লাগতে শুরু করেছিল, মনে হচ্ছিল পড়েই যাব।

এ কাকে নিয়ে আমি কলকাতা যাচ্ছি? এ কী সত্যিই আমার নূপুর নয়?

ঠিক সেইসময়েই খবরটা এল। যে ড্রাইভার ছেলেটি মুকুন্দর সঙ্গে আমার অফিসের গাড়িটা রঙপুর শহরে সার্ভিসিং এ নিয়ে গিয়েছিল, সেই ফোন করল। গাড়িটা সার্ভিসিং করিয়ে ফেরার পথে মারাত্মক দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। একটা বাইকের বেকায়দায় হঠাৎ মোড় নেওয়াতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সোজা গিয়ে ধাক্কা মেরেছে রাস্তার পাশের একটা গাছে। মুকুন্দ’র কপালের একদিকটা কেটে গেছে, ড্রাইভার ছেলেটিরও হাত মুচকেছে। গতি কম থাকায় দুজনের তেমন ভয়াবহ কিছু না হলেও গাড়িটার সামনের বনেটটা পুরো তুবড়ে গেছে।

ছেলেটা ফোন রাখার আগে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ”স্যার, আজ তো আর আপনার যাওয়ার প্রশ্নই নেই। আমি আর মুকুন্দদা এখন রঙপুর হাসপাতালে এসেছি। পুলিশ এসে গিয়েছিল, সরকারি গাড়ি দেখে খুব বেশি ঝামেলা করেনি। আমরা গাড়িটাকে কোন গ্যারাজে রেখে বাস ধরে ফিরব। আপনি আজকের ফ্লাইটটা বাতিল করুন স্যার। ওইজন্যই ফোন করলাম।”

আমি ফোনটা রেখেও স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না। এই দুর্ঘটনা কী কাকতালীয়? নাকি হরিহরের কথা অনুযায়ী রাজা নীলাম্বরের অঙ্গুলিহেলন?

আমি সাদাচোখে হরিহরকে বললাম, ”একটা কোন গাড়ি পাওয়া যাবে? এ-একটা গাড়ি? আমাদের গাড়িটা অ্যাকসিডেন্ট করেছে। আমাকে যে করে হোক আজ ঢাকা পৌঁছতেই হবে হরিহর! প্লিজ!”

হরিহর মাথা নাড়ল, ”এত তাড়াতাড়ি গাড়ি কোত্থেকে পাবেন? আনতে হবে সেই চতরাহাট থেকে। তার ওপর ঢাকা অনেক দূরের রাস্তা, কেউই আজ বললে আজই যেতে রাজি হবে না।”

আমি বিমূঢ়ভাবে ওর দিকে তাকালাম এবার, দুর্বল কণ্ঠে বললাম, ”হরিহর, কী চাইছে তোমাদের রাজা? আমার ওই মেয়ে ছাড়া কেউ নেই, ওকে ছাড়া আমি শেষ হয়ে যাব।”

আমার গলায় এমন এক বেদনাভরা আকুতি ছিল বলেই হয়ত হরিহরেরও চোখে স্পষ্ট দেখলাম জল চলে এল। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থকে বলল, ”আমি বুঝতে পারছি কর্তা! আমিও তো মেয়ের বাপ, আমারও তো এইটুকু দুধের মেয়েই ছিল। সেইজন্যই ঘুরেফিরে আপনার কাছে আসছি যদি কোনভাবে কিছু করতে পারি। আমার মনে হয় আপনি কোনভাবেই এখান থেকে নূপুরকে নিয়ে যেতে পারবেন না। নীলাম্বর রাজা আটকে দেবেই। আজকের বিপদটা দেখলেন তো, তাও অল্পের ওপর দিয়ে গেল। বেশি জোরাজুরি করলে ফল আরো খারাপ হতে পারে। এভাবে হবেনা। অন্য উপায় ধরতে হবে কর্তা!”

আমি আর দ্বিধা করলাম না, হরিহরের হাতদুটো ধরে ছলছল চোখে বললাম, ”কী উপায় বল হরিহর, তুমি যা বলবে আমি তাই করবো। শুধু নূপুরকে ভালভাবে এখান থেকে নিয়ে যেতে চাই। ও যেন আবার আগের মত হয়ে যায়।” বলতে বলতে কেঁদে ফেললাম আমি।

হরিহর বিড়বিড় করল, ”ঝর্ণা তো চলে গেছিলই, তারপরেই এইচত্ত্বরে একটা দারুণ জ্বরে মারা গিয়েছিল অনেকে। সেটা এবারেও হবে। নূপুরকে আর এই গ্রামকে বাঁচাতে গেলে অন্যপথ নিতে হবে। সোজাভাবে হবেনা কর্তা। ভক্তকে শাসন করবেন দেবী নিজে।”

”মানে?”

”নীলাম্বর রাজার হাত থেকে নূপুরকে বাঁচাতে পারেন একমাত্র মহামারী দেবী নিজে, আর কেউ নয়।” হরিহর আঙুল উঁচিয়ে বলল।

আমি শুনছিলাম। যুক্তি-বুদ্ধি অনেক আগেই লোপ পেয়ে গিয়েছিল, এবার বললাম, ”কীভাবে?”

হরিহর বলল, ”আমরা সবাই বিশ্বাস করি রাজা নীলাম্বর নিজে মহামারী দেবীর পুজো করেন। তিনি এখনও এই নীলদরিয়ার আকাশে বাতাসে মিশে আছেন। মহামারী দেবী প্রচণ্ড ভয়ঙ্করী। তাঁর পুজোয় সামান্য বিচ্যুতি ঘটলে এই গোটা তল্লাটে তাঁর ধ্বংসলীলা শুরু হবে। এই গ্রামে আটবছরের কোন মেয়ে এলেই তার মধ্যে কাঞ্চনমণির আত্মা ভর করে, আর নীলাম্বরও তাকে টেনে নিতে চান নিজের কাছে। যতদিন না নীলাম্বরের অভীষ্ট পুরোপুরি পূর্ণ হয়, বাদ পড়তে থাকে দেবীর পুজোয়। ফলে দেবী কুপিত হতে থাকেন, একজন-দুজন করে লোক মরতে শুরু করে। যেটা এরমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। কাজেই বুঝতেই পারছেন, এটা এমন এক অবস্থা, যাতে নুপুরেরও ক্ষতি, আমাদের গ্রামেরও ক্ষতি। নীলাম্বর রাজা যেদিন পুরোপুরি নূপুরকে টেনে নেবেন, সেদিন তাঁর আত্মা তৃপ্ত হবে, পুজোও বন্ধ হয়ে যাবে। গ্রামে শুরু হবে মহামারী। যেমন ঝর্ণার বেলায় হয়েছিল। সেই মহামারী থেমেছিল কয়েকমাস পর। ততদিনে রাজা আবার মন দিয়েছিলেন পুজোয়।”

”তাহলে উপায়?” আমি অসহায় গলায় বললাম।

হরিহর বলল, ”উপায় একমাত্র একজনই জানেন। তিনি হলেন চন্দ্রনাথ বাচস্পতি।”

”কে তিনি?”

”চন্দ্রনাথ বাচস্পতি একজন জ্ঞানী ব্রাহ্মণ। এখন থাকেন চতরাহাটে। সেখানকার এক প্রসিদ্ধ কালীমন্দিরের তিনি প্রধান পুরোহিত। ওঁর পূর্বপুরুষই ছিলেন নীলাম্বর রাজার কূলপুরোহিত, যিনি রাজার সঙ্গে পাশাপাশি আসনে বসে দেবীর আরাধনা করতেন।” হরিহর চোখ বন্ধ করল, ”যদিও উনি এখন আর এই গ্রামে আসেননা, কিন্তু বংশানুক্রমে তাঁর কাছেই আছে বলিঠাকুরাণী মন্ত্রের পুঁথি। আর নীলাম্বর রাজা স্বয়ং ছাড়া তাঁরই একমাত্র বংশানুক্রমে অধিকার আছে দেবী মহামারীকে পুজো করার।”

কে চন্দ্রনাথ বাচস্পতি, বলিঠাকুরাণী মন্ত্রই বা কী, এমন হাজারো প্রশ্ন আমার মনের মধ্যে কিলবিল করলেও আমি সেগুলোতে ভ্রূক্ষেপ করলাম না। বললাম, ”হরিহর, তুমি যে করে হোক, ওঁকে নিয়ে এসো এখানে। তুমি যা চাইবে, আমি তাই দেব। যত টাকা লাগে আমি তোমায় দেব। তুমি শুধু আমার নূপুরকে বাঁচিয়ে দাও।”

হরিহর পাগলের চোখটা একবার জ্বলে উঠেই নিভে গেল। কাটা কাটা গলায় বলল, ”দেখেন কর্তা, নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ছিল বলে নূপুরকে নিয়ে এত চিন্তিত ছিলাম। আপনি না থাকলে পাঁচিল দিয়ে কী জানলা দিয়ে চোখে চোখে রাখতাম, যাতে কিনা দুমদাম বিপদ না হয়ে যায়। আপনারা বড়মানুষ, শিক্ষিত মানুষ। কিন্তু তাই বলে যদি এখন টাকার গরম দেখান, তাহলে আমাকেও পিছু হটতে হয়। হরিহর রায় টাকার পরোয়া করেনা। কে আছে আমার? টাকা নিয়ে কী আমি ধুয়ে জল খাব?”

আমি সঙ্গে সঙ্গে হরিহরের হাত চেপে ধরলাম, ”আমার মাথার ঠিক নেই হরিহর! তুমি কিছু মনে করো না। যে করে হোক একটা উপায় বের করো।”

কিছু মানুষ আছেন, যাদের দেখলে আপনা থেকেই মনে শ্রদ্ধা আসে, ভক্তি জন্মায়। চন্দ্রনাথ বাচস্পতিও তেমনই একজন। বয়স সত্তরের কোঠায় হলেও ঋজু গড়ন, মেদবিহীন দেহ। গৌরবর্ণ দেহে শক্তির লক্ষণ সুস্পষ্ট।

প্রথম যখন দেখলাম, তখন কালীমন্দিরে তাঁর পুজো সবেমাত্র শেষ হয়েছে। পরনে গরদের ধুতি, ঊর্ধ্বাঙ্গে নামাবলী। কপালে রক্ততিলক।

আমি আর হরিহর সকাল সকাল পৌঁছে গিয়েছিলাম চতরাহাটে। মুকুন্দ এখনও পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। গাড়িটা প্রাথমিক ঝামেলার পর সারানো চলছে। গাড়ি সারাইয়ের ক্ষতিপুরণ বাবদ ঢাকা থেকে টাকা আসবে, তারপর আমি এখান থেকে রিলিজ পাব।

সব মিলিয়ে আমার যাওয়া অন্তত চার-পাঁচদিন পিছিয়ে গেছে।

সবই ভবিতব্য।

বাচস্পতিমশাই সব শুনে টুনে বললেন, ”মহামারী দেবীর পুজো! সে তো ভয়ঙ্কর কঠিন! হ্যাঁ, এটা ঠিক যে পারিবারিক সূত্রে বলিঠাকুরাণী পুঁথি আমার কাছেই আছে। পুজোর পদ্ধতিও জানি অল্পবিস্তর। কিন্তু, কখনো তো সেই পুজো করিনি! আমি কী পারব?”

হরিহর সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ”পারলে একমাত্র আপনিই পারবেন ঠাকুরমশাই। আমাদের গ্রামের চারপাশে অদৃশ্য বলয়ের মত রয়েছেন রাজা নীলাম্বর। তাঁর গ্রাস থেকে এই স্যারের মেয়েকে বাঁচাতে আপনিই একমাত্র পারবেন! একটা আটবছরের শিশু সে ঠাকুরমশাই। আর চোখগুলো এমন মায়াবী, আপনার দেখলেই স্নেহ হবে।”

বাচস্পতিমশাই এবার তাকালেন আমার দিকে, ”আপনি ভারতবর্ষ থেকে আসছেন? কোথায় বাড়ি আপনার? খোদ কলকাতাতেই?”

”এখন কলকাতাতেই বাড়ি কিনেছি বটে, কিন্তু আমার আদি বাড়ি বীরভূম জেলায়।” আমি নতমস্তকে বললাম।

 ”ওহ বীরভূম জেলা? এই যে মহামারী দেবী ইনি আসলে আপনাদের পশ্চিমবঙ্গের বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের দেবী ছিলেন। এখন সম্ভবত সেটা বাঁকুড়া জেলা।”

”হ্যাঁ, বিষ্ণুপুর বাঁকুড়াতেই।” আমি বললাম।

”হ্যাঁ। ওখানকার রাজবংশেও উনি পূজিত হন। হয়ত এখনও সেই পুজো অব্যাহত আছে। শুনেছি নীলাম্বর রাজার পিতামহ রাজা নীলধ্বজ বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হন বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের সঙ্গে। তখনই সেই রাণী এসে এখানে দেবীর পুজো শুরু করেন, মহামারীদেবীকে এখানে পটে অধিষ্ঠিত করানো হয়। দেবী আসার পরই কামতা সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধি খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়। আর তা চরমে ওঠে নীলাম্বরের সময়ে।” বাচস্পতিমশাই চোখ বন্ধ করে বলে চলেছিলেন, ”আমাদেরও আদি বাড়ি সেখানেই। রাজা নীলধ্বজের বিবাহের সময় বিষ্ণুপুর থেকে মহামারীদেবীর সঙ্গে এসেছিলেন আমার পূর্বপুরুষও। তারপর থেকে আমরাই পুরুষানুক্রমে পুজো করতাম দেবীর। কিন্তু নীলাম্বরের কন্যা কাঞ্চনমণির মৃত্যুর পর নীলাম্বর পুজোর ভার নিজের কাঁধে তুলে নেন। ধীরে ধীরে সেই মন্দির সম্পর্কে অঞ্চলে একটা ভয় ছড়িয়ে পড়ে। তারপর থেকে আমাদের বংশের কেউ আর কখনও ওই পুজো করেননি।”

আমি আকুলভাবে বললাম, ”ঠাকুরমশাই, আমার ওই একটাই মেয়ে। আপনি দয়া করে কিছু করুন। নূপুরের কিছু হয়ে গেলে …।”

বাচস্পতি হাত নাড়লেন, ”আমার বলা এখন শেষ হয়নি ডঃ সেনগুপ্ত। বলিঠাকুরাণীর মন্ত্র দিয়ে মহামারী দেবীর পূজার্চনা অত্যন্ত ভয়াবহ পদ্ধতি। দেবী খচ্চরবাহিনী, কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথির গভীর রাতে পূজারী ব্রাহ্মণকে দেবীর দিকে পেছন করে বসে করতে হয় পূজার্চনা। পুজোর ভোগও পুরোহিতকেই রান্না করতে হয়। সেই ভোগরান্নারও বিশেষ পদ্ধতি আছে। গোটা অনুষ্ঠানে সামান্য কোন ত্রুটিবিচ্যুতি হলে মহামারী তো শুরু হয়ই, পুরোহিত নিজেও নির্বংশ হন।”

হরিহর ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, ”ঝর্ণা যেদিন নিখোঁজ হয়েছিল, সেদিনও কৃষ্ণপক্ষের নবমীই ছিল মনে আছে। রাজা শেষ ছোবল সেদিনই দেন।”

আমি অধীর হয়ে প্রশ্ন করলাম, ”আর এখন? এখন কোন পক্ষ চলছে?”

হরিহর কিছু বলার আগেই বাচস্পতিমশাই বললেন, ”আজ রাতেই কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথি। কিন্তু আমাকে একটু ভাবার সময় দিন ডঃ সেনগুপ্ত। আমার একটু চিন্তা করা প্রয়োজন। এটা ছেলেখেলার বিষয় নয়।”

আমি চমকে উঠলাম। হাতে তারমানে মাত্র কয়েক ঘন্টা! কাতরগলায় বললাম, ”আমি বুঝতে পারছি পণ্ডিতমশাই। আপনার ওপর এতবড় ঝুঁকি রয়েছে জানলে আপনার স্ত্রী বা পরিবারের লোকেরা অনুমতি দেবেননা। কিন্তু … কিন্তু বিশ্বাস করুন। একজন অসহায় বাবা হয়ে বলছি, ওই একটা মাত্র মেয়ে ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই!”

”আমার কারুর থেকে অনুমতি নেওয়ার প্রশ্ন নেই। আমি বিপত্নীক, সন্তানাদিও নেই। কিন্তু তবু সময় চাইছি নিজের জন্য। এই পুজোয় কিছুমাত্র ত্রুটি ঘটলে গোটা এলাকায় যে সর্বনাশ নেমে আসবে, তার দায় তো আমাকেই বহন করতে হবে। সেই পাপের ভাগী আমি হব কিনা ভেবে দেখি।” বাচস্পতিমশাই এতক্ষণ নিজের বাড়ির বৈঠকখানায় বসে কথা বলছিলেন, এবার উঠে দাঁড়ালেন, ”আপনি চিন্তা করবেন না। যদি আমি পুজো করি, আমি ঠিক সময়েই পৌঁছে যাব। আচ্ছা, নমস্কার।”

ভদ্রলোক ভেতরে চলে গেলে আমি হতাশ গলায় হরিহরের দিকে তাকালাম, ”কী হবে হরিহর? উনি তো নিশ্চিত কিছু বললেন না! কাল যদি উনি না আসেন! ঝর্ণার মত নূপুরও কী কাল …!”

”আপনি ঘরে চলুন কর্তা!” হরিহর আমাকে শান্ত করে বাইরে নিয়ে এল, ”এত চিন্তা করবেন না। বাচস্পতিমশাই খুব ভাল মানুষ। তিনি এমন কিছু করবেন না, যাতে কোন ক্ষতি হয়।”

প্রায় টলতে টলতে বাড়ি ফিরলাম। কাল সারাটা রাত ঘুমোইনি। প্রচণ্ড ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও একমুহূর্তের জন্য ঘুম আসেনি চোখে। খালি বারবার চোখ চলে গেছে নূপুরের ঘরের দিকে। মনে হয়েছে কে ও? কে ওইঘরে শুয়ে আছে নূপুরের দেহটাকে দখল করে? কী চাইছে সে?

পাঁচশো বছর আগের এক পিতাকন্যার সম্পর্কের মধ্যে আমরা বাপ-মেয়েতে কেন জড়িয়ে পড়লাম। কীসের জন্যই বা পড়লাম! দুই বিদেহী আত্মার মাঝে কেন বলি হতে হবে আমার নিরপরাধ মেয়েটাকে! এই কথাগুলো মনে হলে নিজের অজান্তেই চোখের কোণে জল এসে যাচ্ছে।

বাড়ির সামনে এসে কী মনে হল, আর ঘরের ভেতরে ঢুকলাম না। মনের মধ্যে হাজার ঝড় উঠেছিল একসঙ্গে। মনে হচ্ছিল, শুধুই চন্দ্রনাথ বাচস্পতির ভরসায় বসে থাকাটা কী ঠিক? বাবা হিসেবে আমি কী করছি মেয়ের জন্য?

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কেমন আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম। হরিহর পাগল চলে যেতে মনের সমস্ত শক্তি একত্র করে বাড়ি না ঢুকে হেঁটে চললাম জঙ্গলের দিকে।

সূর্য এখন মধ্যগগনে। রোদের তেজ রয়েছে যথেষ্ট। তবু জঙ্গলের মধ্যে কিছুদূর এগিয়ে নীলদরিয়ার দিকে না গিয়ে বাঁ-হাতে সরু পায়ে হাঁটা পথটা ধরতেই ঝুপ করে কেমন যেন অন্ধকার নেমে এল চারপাশে। শীত করতে লাগল বেশ। সেদিন রাতের অন্ধকারে টর্চ নিয়ে এসেছিলাম, উত্তেজনাও ছিল, তাই বুঝতে পারিনি, নীলদরিয়ার দিকের চেয়ে এদিককার জঙ্গল অনেক বেশি ঘন। শুধু ঘন বললে ভুল হবে কেমন যেন আদিম একটা গন্ধ রয়েছে চারদিকে। পা ফেললেই মনে হচ্ছে এদিকে কেউ কখনও আসেনি।

আসেনা।

সরু-মোটা গাছপালার মধ্যে দিয়ে সতর্ক হয়ে এগোচ্ছিলাম, হঠাৎ জুতোর ওপর দিয়ে সরসর করে কী যেন চলে গেল। চমকে উঠলেও থামলাম না, এখন এইসব তুচ্ছ ব্যাপারে মাথা ঘামাবার সময় নেই।

লক্ষ করলাম, এইদিকে গাছগুলোর উচ্চতা অনেক বেশি, এতটাই উঁচু যে তাদের ছড়ানো ডালপাতায় আকাশ প্রায় ঢেকে গিয়েছে। আর সেইজন্যই ভেতরে তেমন কোন আলো নেই। মাঝেমাঝেই মুখের সামনে ভনভন করছে কিছু পোকা, সেগুলোকে মাছির মত তাড়াতে তাড়াতে হাঁটছিলাম আমি।

মিনিট দশেক এবড়োখেবড়ো পথে হাঁটতে সেই মন্দিরটা চোখে পড়ল। সত্যিই দিনের আলোয় বুঝলাম, সেদিন নূপুরের আঁকা সেই ছবিটার সঙ্গে হুবহু সাদৃশ্য মন্দিরটার। সামনেটা বুনো ঝোপঝাড় আগাছায় ভর্তি হয়ে রয়েছে। আমি তারই মধ্যে দাঁড়িয়ে পুরাতত্ত্ববিদের দৃষ্টিতে মন্দিরটা দেখতে লাগলাম।

কামতা সাম্রাজ্যের যে ক’টি মন্দির দেখার সৌভাগ্য আমার এর আগে গোঁসানিমারি বা অন্যত্র হয়েছিল, প্রতিটিই পাথরের। কিন্তু ব্যতিক্রমীভাবে এই মন্দিরটি টেরাকোটার তৈরি। তবে আমি আশ্চর্য হলাম না। একটু আগে বলা চন্দ্রনাথ বাচস্পতির কথা মনে পড়ল আমার। মহামারী দেবীর পুজো এখানে শুরু হয় বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের রাজকুমারী রাণী হয়ে আসার পর। তাই এই মন্দিরও বিষ্ণুপুরের আদলে মাকড়ায় তৈরি। দোচালা আদলের পাঁচটি চালা মধ্যিখানে এসে মিশে গেছে একটি চূড়ায়, গঠনগত প্রকৃতিতে বিষ্ণুপুরের জোড়বাংলা মন্দিরয়ের সঙ্গে মিল থাকলেও এই মন্দিরটা অবশ্যই খুব অদ্ভুত।

আমি ভালভাবে দেখার জন্য মন্দিরে ওঠার সিঁড়িতে পা রাখলাম। সিঁড়ি অবশ্য নামেই, দু-এক জায়গায় ধাপের অস্তিত্ব দেখে বোঝা যায়। প্রবেশতোরণের খিলানটাও ভেঙে পড়েছে, খিলানটার ওপরে একটা কুলুঙ্গির মধ্যে রয়েছে একটা হাতির মূর্তি, সেটা তবুও কিছুটা আস্ত আছে। আমি একবার ভাবলাম মোবাইল কামেরায় ছবি তুলি, পরক্ষণেই আমার আসার আসল উদ্দেশ্যটা মনে পড়ে গেল।

মন শক্ত করে আমি উঠে গেলাম গর্ভগৃহের দিকে।

হরিহর পাগলের কথা অনুযায়ী এই মন্দিরে খচ্চরবাহিনী দেবী মহামারী রয়েছেন, এবং তাঁকে নিয়মিত পুজো করেন পাঁচশো বছর আগের রাজা নীলাম্বর। পাঁচশো বছর কোন মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তার মানে পুজো করার কথা সত্যি হলে ধরে নিতে হবে, পুজো করেন রাজা নীলাম্বরের বিদেহী আত্মা। আমার একঝলকের জন্য মনে হল, দেবী একজন অশরীরীর কাছ থেকে পুজো নেন কীভাবে?

গর্ভগৃহের সামনেটা অপেক্ষাকৃত কম আগাছায় ভর্তি। আমি জুতো খুলব না পরে ঢুকব দোনোমনা করতে করতে জুতোটা খুলেই ফেললাম। খালি পায়ে ভেতরে ঢুকলাম।

ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হাওয়া যেন এসে আমাকে জমিয়ে দিল। কোন সুপ্রাচীন এক্সক্যাভেশন সাইটে প্রথমবার ঢুকলে সে আদি গন্ধটা পাওয়া যায়, সেটাই বহুগুণ বর্ধিত হয়ে ছাপিয়ে ঢুকল আমার নাকে। তীব্র গন্ধে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে আমি ভেতরটা ভাল করে দেখলাম।

গর্ভগৃহটা একেবারেই ছোট, তায় অন্ধকার। মাঝখানে রয়েছে একটি প্রাচীন বিগ্রহ। একটা দেবীমূর্তি। আমি ঝুঁকে দেখতে গিয়ে পরক্ষণেই আমার ভুলটা শুধরে নিলাম। না, মূর্তি নয়, একটা পট।

বিশাল আকৃতি সেই পটের মাঝবরাবর আঁকা রয়েছে এক দেবীমূর্তির ছবি। ধারালো মুখ একদিকে বাঁকানো, পটের রঙ টং এখন আর কিছু বোঝা যায় না, গোটাটাই কেমন মেটে বর্ণ ধারণ করেছে। দেবী অষ্টভূজা, মাথায় মুকুট। মুখ ধারালো, ডানদিকে বাঁকানো। বাঁদিকের একেবারে উপরের হাতে একটা খড়গ। অন্যহাতগুলোয় ছোটবড় নানারকম অস্ত্র, সেগুলো পটের অস্পষ্টতার জন্য বোঝা যাচ্ছে না।

দেবী বসে আছেন একটি বড়সড় চতুষ্পদ প্রাণীর ওপর। ঘোড়া কী? আমি চোখ সরু করে দেখে বুঝলাম, ঘোড়ার মতই, তবে আকারে আয়তনে বেশ খর্ব অর্থাৎ খচ্চর। ইনিই তাহলে খচ্চরবাহিনী দেবী মহামারী। এখানকার গ্রামবাসীরা বিশ্বাস করে, এঁকে নীলাম্বর রাজা নিয়মিত পুজো করে তুষ্ট করে রেখেছেন বলেই এই তল্লাটে কোন মারণরোগ ছড়ায় না।

আমি আর দেরি করলাম না। যুক্তিবুদ্ধি বিসর্জন দিয়েই এখানে এসেছি, এখন হাতজোড় করে দেবীকে বলতে শুরু করলাম, হে মহামারী দেবী, আমার একটামাত্র মেয়ে ওই নূপুর। তাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে দেবেন না। আমি সর্বস্বান্ত হয়ে যাব। দয়া করুন আমায় দেবী!

কাতরকণ্ঠে একই আর্তি বারবার জানাতে জানাতে কখন আমার চোখ দিয়ে যে জল গড়াতে শুরু করেছিল, আমি নিজে জানিনা। এই জনমানবহীন অরণ্যের গভীরে এই শতাব্দীপ্রাচীন গর্ভগৃহে একাকি দাঁড়িয়ে একজন অসহায় পিতার সমস্ত দুঃখই যেন অশ্রু হয়ে ঝরছিল আমার চোখ থেকে।

ঠিক তখনই আমি শব্দটা পেলাম।

কেউ একজন এদিকে এগিয়ে আসছে। স্যাঁতসেঁতে লতাপাতার ওপর দিয়ে আসছে বলে অতটা জোরে শব্দ না হলেও গতিটা যে বেশ দ্রুত তা বোঝা যাচ্ছে।

নিজের অজান্তেই আমার হৃৎস্পন্দন কেমন প্রবল হতে শুরু করল। যে আসছে সে কী রক্তমাংসের মানুষ?

আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় যেন সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে মাথা নেড়ে জবাব দিল, ”না না না!”

সামনের পটের দেবীমূর্তিটির একদিকে হেলানো মুখের আমার দিকে ফেরানো চোখটাও যেন সহসা জেগে উঠেছে, রক্তবর্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলছে, ”কেন এলি এখানে? চলে যা, চলে যা এখুনি! নীলাম্বর আসছে আমার কাছে। তুই চলে যা!”

আমার মাথার ভেতরটা কেমন করছিল। নিজেকে আর সামলাতে না পেরে আমি পিছলে পড়লাম পটের সামনের মাটিতে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা সেই মাটি, আমার সারা শরীর যেন কেঁপে উঠল। তখনই দেখলাম, সামনে পড়ে রয়েছে কিছু টকটকে লাল রঙের ফুল। তাজা জবাফুল। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগেই কেউ ছিঁড়ে এনেছে গাছ থেকে।

হিমচোখে দেখলাম পেছন থেকে একটা বিশাল ছায়া এসে পড়েছে ঘরে, অন্ধকারের মধ্যে আরো কয়েকগুণ বেশি মিশমিশে কালো একটা অন্ধকারের ছায়া! টের পেলাম বাইরে ঝড় উঠেছে। প্রবল আকস্মিক ঝড়। সেই ঝড়ে গর্ভগৃহের প্রবেশপথের সামনে ভেঙে পড়ছে দু-একটা গাছ, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আমার বেরোনোর রাস্তা!

* * *

জ্ঞান হারিয়ে কতক্ষণ শুয়েছিলাম জানিনা, জলের ছিটেয় ধড়মড়িয়ে জেগে উঠলাম। দেখি আমার মুখের দিকে ব্যাকুলচিত্তে তাকিয়ে রয়েছে হরিহর পাগল।

আমাকে চোখ মেলতে দেখে সে বলল, ”উঠুন কর্তা, শীগগিরই উঠুন! এইখানে কেন এসেছিলেন একা একা?”

আমি ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকালাম। স্মৃতিশক্তি সব যেন লোপ পেয়ে যাচ্ছে আমার, কী করে যে কী হল, এখানে এলাম, তারপর একটা ঝড় উঠল, ভীষণ ঝড় … তারপর … কে যেন আসছিল …!

আমি দুর্বল গলায় বললাম, ”নূপুর? আমার নূপুর কোথায় হরিহর?”

”নূপুর বাড়িতে রয়েছে। সন্ধে হয়ে গেছে। বাচস্পতিমশাই এসে পড়েছেন, আমি ওঁকে নিয়ে আসতে গিয়ে শুনি আপনি সকাল থেকে বাড়িই ফেরেননি। তারপর খুঁজে খুঁজে এসে দেখি এইখানে এইভাবে শুয়ে আছেন! এইখানে … এইখানে কী করে এলেন আপনি কর্তা?” হরিহর এক নিঃশ্বাসে বলে যাচ্ছিল।

বাচস্পতিমশাই যে শেষপর্যন্ত আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা উপলব্ধি করে আমি আনন্দের চোটে তাড়াতাড়ি উঠে বসতে গিয়ে টের পেলাম আমার গোটা জামাকাপড়টাই ভিজে সপসপ করছে। হাতে পায়ে অসম্ভব ব্যথা।

চোখদুটো ভাল করে কচলে নিয়ে উঠে বসতে গিয়ে মাথার ওপরেই নক্ষত্রে ভরা আকাশ দেখে আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম!

একী! একোথায় শুয়ে রয়েছি আমি! চারদিক তাকিয়ে দেখি, এ যে নীলদরিয়ার পাড়! ওই তো, ওই তো কাছেই সেই নড়বড়ে সাঁকো, ওপাড়ে রাজবাড়ি যাওয়ার। কিন্তু আমি তো গিয়েছিলাম মহামারী মন্দিরে, ওখানেই শেষ অবধি ছিলাম বলে মনে পড়ছে। তাহলে নীলদরিয়ায় খাদের একদম কিনারে এইভাবে পড়ে রয়েছি কী করে?

কে নিয়ে এল এখানে আমায়?

বাচস্পতিমশাইয়ের সাজ আজ সম্পূর্ণ অন্যরকম। পরণে লাল টকটকে ধুতি, ঊর্ধ্বাঙ্গে শোভা পাচ্ছে শুধুমাত্র ধপধপে সাদা উপবীত। মাথা পরিষ্কারভাবে কামানো, শুধু সুদীর্ঘ পুরুষ্টু ব্রহ্মকেশটুকু মাথার পেছন থেকে উৎপন্ন হয়ে নেমে গেছে কাঁধ পর্যন্ত।

কিছুক্ষণ আগে ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীরে হরিহরের কাঁধে ভর দিয়ে আমি কোনোমতে বাড়ি ফিরেছি। ইতিমধ্যে মুকুন্দ মোটামুটি সুস্থ হয়ে এসেছে। তবে তার কপালে এখনো ব্যান্ডেজ জড়ানো।

হরিহর বসে আছে অদূরেই। সে বাচস্পতিমশাইকে সাহায্য করতে গিয়েছিল, কিন্তু বৃদ্ধ তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। বাচস্পতিমশাই এখন গম্ভীরমুখে একটি শতচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মলিন পুঁথি বারবার খুলছেন ও বন্ধ করছেন।

মুকুন্দ বলছিল, আসার পরে পরেই নাকি নূপুরকে তিনি দেখেছেন এবং চমকে উঠেছেন। নূপুরের মধ্যে যে আসলে নূপুর নেই, বাস করছে অন্য কেউ, তা মুখে প্রকাশ না করলেও তাঁর চোখে পরিষ্কার ধরা পড়েছিল।

রাত যখন আটটা, তখন চন্দ্রনাথ বাচস্পতি আমার দিকে তাকিয়ে মুখ খুললেন, ”আমরা ঠিক এগারোটার সময় রওনা দেব মহামারী মন্দিরে। সঙ্গে চারজনের বেশি যাবেন না। আমি মন্দিরে গিয়ে মায়ের ভোগ রান্না করবো।”

আমি বললাম, ”ভোগের সামগ্রী?”

আমি সব নিয়ে এসেছি।” বাচস্পতিমশাই সঙ্গের ঝোলাটি দেখালেন, ”পুজো শেষ হতে দু’ঘন্টা মত লাগবে। সেইসময়টুকু বাকিরা বাড়ি চলে আসবেন। ভেতরে থাকব কেবল আমি, আপনি আর নূপুর। আমি বিগ্রহের সামনে পেছনদিকে মুখ করে বসে পুজো করবো। আপনারা দুজন দু’পাশে বসবেন। পুজো চলা কালীন পেছন ফিরে তাকাবেন না। সাবধান, সামান্য ভুলে কিন্তু সব শেষ হয়ে যেতে পারে।”

আমার বুকের ভেতরটা উত্তেজনায় কাঁপছিল। এমনিতেও মাত্র কিছুক্ষণ আগে ঘটে গেছে সেই অপার্থিব ঘটনাটা। আমি হলফ করে বলতে পারি আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যে মহামারী মন্দিরের গর্ভগৃহে, কিন্তু হরিহর আমাকে আবিষ্কার করেছে নীলদরিয়ার কিনারায়। আর একটু ওদিকে গেলেই এতক্ষণে আমার ঠাই হত নীলদরিয়ার গহ্বরের কালো অন্ধকারে।

আমার হঠাৎ মনে হল এই যুদ্ধে যেন আসল প্রতিদ্বন্দ্বী আমি আর রাজা নীলাম্বর। এই লড়াই আসলে দুই পিতার মধ্যে স্নেহের অধিকার নিয়ে। রাজা নীলাম্বর আমাকে ওইভাবে নীলদরিয়ায় ফেলে রেখে নিজের শক্তি দেখালেন। যেন ইঙ্গিতে বোঝাতে চাইলেন, নূপুরের মধ্যে এখন যেহেতু বাস করছে কাঞ্চনমণি, নূপুর এখন তাঁরই। কোনোভাবেই তাঁর গ্রাস থেকে আমি সাধারণ একজন পিতা হয়ে মুক্ত করতে পারব না নূপুরকে।

আর আমারও জেদ, নূপুরকে এই কবল থেকে মুক্ত করবই। তারজন্য যতদূর যেতে হয় আমি যাব।

আমি হরিহরের কানে ফিসফিস করলাম, ”হরিহর! সত্যিই নূপুর বিপন্মুক্ত হয়েছে কিনা কী করে বুঝব?”

”বাচস্পতিমশাই নিশ্চয়ই তাঁর আরাধনায় দেবীকে তুষ্ট করতে পারবেন।” হরিহর বলল, ”দেবী তুষ্ট হলে ওই জ্বরের প্রকোপও বন্ধ হবে, আর কাঞ্চনমণিও নূপুরের দেহ থেকে মুক্ত হবে কর্তা!” হরিহর বলল।

জানিনা কী আছে অদৃষ্টে, আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

অবশেষে এল কৃষ্ণপক্ষের সেই নবমীর রাত। যে রাত আমি জন্মজন্মান্তরেও ভুলব না। যে রাতের কথা মনে পড়লে মধ্যরাতে আজও বিছানায় আতঙ্কে চমকে উঠি, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।

যে রাত আমার জীবনে শেষ নিঃশ্বাস অবধি একটা কালো অভিশাপ হয়ে থেকে যাবে।

রাত এগারোটা নাগাদ আমরা সবাই মিলে হাঁটা দিলাম মহামারী মন্দিরের দিকে। গ্রামের মধ্যে খুব বেশি কাউকে এই ব্যাপারে জানানো হয়নি, কারণ জানিয়ে কোন লাভ নেই। এই মধ্যরাতে কেউ সেখানে যেতে রাজী হবে না।

আমি, বাচস্পতিমশাই আর হরিহর পাশাপাশি হাঁটছিলাম। আমাদের সামনেই কড়া নজরে নূপুরকে কোলে করে নিয়ে চলেছে ইকবাল, তার পাশে পাশে হাঁটছে মুকুন্দ। ইকবাল টর্চ নিয়ে এসেছিল, টর্চের সেই জোরালো আলো মাঝেমধ্যেই সে ফেলছে দু’পাশের গাছগুলোতে, নিকষ কালো অন্ধকারে আচমকা আলোর ঝলকানিতে প্রতিটা গাছই যেন বিরক্ত হয়ে অদ্ভুত কিছু শব্দের মাধ্যমে তাদের অসন্তোষ জানান দিচ্ছে।

আমার স্নায়ু ক্রমশই প্রচণ্ড ভয়ে আশঙ্কায় দুর্বল হয়ে আসছিল। তবু নিজেকে প্রাণপণে টেনে নিয়ে চলছিলাম সেই মন্দিরের দিকে।

মন্দিরের চাতালে পৌঁছে বাচস্পতিমশাই থামলেন, ঝোলা থেকে বড় একটি মোমবাতি বের করে তাতে আগুন ধরালেন, তারপর পিছন ফিরে হরিহরদের বললেন, ”তোমরা এখানেই দাঁড়াও। একটু পরে চলে যেও। ভয় নেই। সব মিটে গেলে আমরা নিরাপদে পৌঁছে যাব বাড়িতে।”

চাতালের ওপর গর্ভগৃহের দিকে পেছন করে বসে তিনি কয়েকটা শুকনো কাঠ বের করলেন ঝোলা থেকে, সেগুলো জড়ো করে জ্বালিয়ে দিলেন চাতালেই। আগুন ভাল করে ধরতে ধরতে তিনি একে একে নানা ছোটবড় তাম্রপাত্রে সাজাতে লাগলেন ভোগসামগ্রী।

আমি তাকিয়ে রয়েছি দেখে উনি বললেন, ”মায়ের ভোগ বানাচ্ছি আগে। বলিঠাকুরাণী মন্ত্রের পুঁথিতে যেমনটি নির্দেশ দেওয়া আছে, তেমনভাবেই।”

নূপুরকে তখনও ইকবাল কোলে শক্ত করে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু তারমধ্যেই বুঝতে পারছিলাম নূপুর কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠছে। কৃষ্ণনবমীর রাতের নিঝুম তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে, আশপাশের বাতাসের আন্দোলনে কেমন যেন শিকারি পাখির মত ধীরে ধীরে খর হয়ে উঠছে ওর চোখ, ইকবাল বাধ্য হয়ে ক্রমেই নিজের বাঁধন দৃঢ় করছে।

আমি সেদিকে বারবার তাকালেও বাচস্পতিমশাই গুরুত্ব দিলেন না। কাঠের ওপর একটা তামার কড়াই চাপিয়ে বললেন, ”সব মাপ করে বাড়ি থেকে এনেছি। বলিনারায়ণী পুঁথিতে রয়েছে পাঁচপোয়া বাদশাভোগ চাল, পাঁচপোয়া মুগডাল, পাঁচপোয়া বিশুদ্ধ ঘি, পাঁচটি কাঁচকলা ও পাঁচমুঠো সৈন্ধব লবণ দিয়ে কাঠের আগুনে প্রস্তুত করতে হবে মহামারী দেবীর ভোগ।”

আমি কৃতজ্ঞ নয়নে সেই শুদ্ধাচারী বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে রইলাম। জঙ্গলের ঝিঁঝিঁ জাতীয় পোকার গুঞ্জন ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু তার মাঝেও আমার মনে হল, একটা নিকষ কালো অন্ধকার যেন জমাট বেঁধে রয়েছে গোটা মন্দিরচত্বরের ওপরে। অন্ধকারের মধ্যে সেটা যেন আরো বেশি কালো, ঘন।

ভোগ প্রস্তুত করে ইকবালের কাছ থেকে নূপুরকে কোলে নিয়ে বাচস্পতিমশাই প্রবেশ করলেন গর্ভগৃহে। সঙ্গে আমিও ঢুকলাম। মোমবাতির হলদেটে আলোয় ঘরটা যেন সকালের চেয়ে আরো বেশি রহস্যময় লাগছিল।

কিন্তু একি! কয়েকঘন্টা আগে যে অবস্থা দেখে গেছি, এখন তো তার সঙ্গে কোন মিলই নেই!

খচ্চরবাহিনী মহামারী দেবীর পট যেমন ছিল তেমনিই রয়েছে, কিন্তু তার চারপাশে যেন শয়তানের নৃত্যলীলা চলেছে এতক্ষণ ধরে। গোটা জায়গাটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে শকুন, চিল এবং ওইজাতীয় কিছু পাখির কাটা পা, রক্তাক্ত নোংরা হয়ে থাকা শরীর, এদিক ওদিক আঁশটে গন্ধ ছড়াচ্ছে রক্তাক্ত পাখির পালক।

আমি ভয় পেয়ে বাচস্পতিমশাইয়ের দিকে তাকাই, ”এসব তো সকালেও ছিল না! এত নোংরা করল কে!”

বাচস্পতিমশাই বিচলিত না হয়ে হাতের মোমবাতি, ঝোলা ও পুঁথিটা একটা পরিচ্ছন্ন জায়গায় নামিয়ে রাখলেন। তারপর ঝোলা থেকে একটা ছোট ঝাঁটা বের করে নোংরাগুলো সাফ করতে করতে বললেন, ”এটা জানাই ছিল। মহামারী দেবীর পুজো করার অধিকার এই পাঁচশো বছরে রয়েছে শুধুমাত্র রাজা নীলাম্বরের। সেই অধিকারে তিনি আমাদের ভাগ বসাতে দেবেন কেন! যেনতেন প্রকারে আমাদের পুজো যাতে ভণ্ডুল হয়, সেই চেষ্টাই তিনি করবেন। গোটা পরিবেশকে অশুদ্ধ করাটা তার মধ্যেই পড়ছে।”

নূপুর একইরকম ভাবলেশহীন চোখে বসে আছে ঘরের এক কোণে। বাচস্পতিমশাই ধীর লয়ে এগিয়ে গেলেন ওর দিকে, একটা কাপড়ের শক্ত ফালি দিয়ে ওর হাত আর পা-দুটোকেই বাঁধলেন, এমনভাবে যাতে কোনভাবেই ও হাঁটা তো দূর, উঠে দাঁড়াতেও না পারে।

আমি সেদিকে তাকিয়ে বাধা দিতে গিয়েও থেমে গেলাম। কিছুসময়ের জন্য নূপুরের যদি হাতে পায়ে ব্যথা লাগে তো লাগুক, নিশ্চয়ই কিছু একটা ভেবেই বাচস্পতিমশাই ওকে বাঁধলেন।

বাচস্পতিমশাই কিছুক্ষণের মধ্যেই গোটা গর্ভগৃহ পরিষ্কার করে নোংরাগুলোকে পুঁটলি করে আমাকে বললেন বাইরে গিয়ে হরিহরদের দিয়ে আসতে, যাতে ওরা সেটা যাওয়ার সময় ফেলে দেয়। তারপর জল দিয়ে ধুতে লাগলেন পুরো জায়গাটা।

গর্ভগৃহের বাইরে বেরোতেই যেন ঠাণ্ডা আমাকে জাঁকিয়ে ধরল। তাকিয়ে দেখি, হরিহর, ইকবাল আর মুকুন্দ আমার দিকে ভয়ার্তচোখে তাকিয়ে আছে। কাছে যেতেই ইকবাল আমার হাত চেপে ধরল, ওর গলা ধরে এসেছে, ”দাদা, নূপুর মা ঠিক হয়ে যাবে তো?”

এত উদ্বেগ, এত দুশ্চিন্তার মধ্যে আমার মনটা হঠাৎ ভাললাগায় দ্রবীভূত হয়ে উঠল। মনে হল, আমি নাহয় এত ঝুঁকি নিচ্ছি আমার নিজের মেয়ের জন্য, নূপুরের জন্য। কিন্তু এই যে হরিহর, ইকবাল, বাচস্পতিমশাইয়ের মত মানুষগুলো এই গহীন রাতে এত বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতিতেও আমার পাশে রয়েছেন, এঁদের তো কোন স্বার্থ নেই! নূপুর তো এঁদের কেউ হয় না। আমার জন্য আজ বাচস্পতিমশাই বিপদে পড়তে পারেন, হরিহর বিপদে পড়তে পারে, অন্যরাও পারে।

এতগুলো মানুষের পিতৃসুলভ স্নেহের যে হাত নূপুরের মাথার ওপর রয়েছে, তা অগ্রাহ্য করা কী এতই সহজ? এতগুলো মানুষের টান কাটিয়ে পারবে নীলাম্বর আমার মেয়েকে নিয়ে যেতে?

আমি বললাম, ”তোমরা এবার ফিরে যাও। আশা করি সব ঠিকঠাকই হবে ইকবাল।” বলার সময় গলাটা যদিও আমার কেঁপে গেল।

গর্ভগৃহে প্রত্যাবর্তন করতেই বাচস্পতিমশাই বললেন, ”মনে রাখবেন ডঃ সেনগুপ্ত, রাজা নীলাম্বরয়ের আত্মা কিন্তু আশেপাশেই রয়েছেন। কড়া নজর রাখছেন আমাদের এবং নূপুরের দিকে। তাঁর উদ্দেশ্য যাতে কোনভাবেই আমরা দেবীকে তুষ্ট করে নূপুরকে রক্ষা করতে না পারি। আর আমাদের উদ্দেশ্য হবে নূপুরের শরীর থেকে কাঞ্চনমণির আত্মাকে দূর করা। নূপুরের কাঠামোটা নয়, পরিপূর্ণ নূপুরকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। বুঝলেন?”

আমার গলা ক্রমশই শুকিয়ে আসছিল, তবু সাহসভরে বললাম, ”হ্যাঁ ঠাকুরমশাই।”

বাচস্পতিমশাই হাতে বলিনারায়ণী পুঁথিটা ভক্তিভরে নিয়ে দেবীর সামনে একটি বড় আসন পেতে প্রথমে সাষ্টাঙ্গে দেবীকে প্রণাম করলেন, তারপর দেবীর দিকে পেছন ফিরে নিজের উপবীত ডান হাত দিয়ে স্পর্শ করে বসলেন আসনে।

নূপুর বসে রইল ঘরের এক কোণে, বাচস্পতিমশাইয়ের ডানদিকে। আমার দিকে তাকিয়ে বাচস্পতিমশাই তাঁর বাঁ পাশে আমাকে বসতে ইঙ্গিত করলেন। মৃদুকণ্ঠে বললেন, ”খচ্চরবাহিনী মহামারী দেবীর পুজো খুবই অদ্ভুত। অন্য পুজোর সঙ্গে একেবারেই মেলে না। এই পুজোয় বেলপাতা আর রক্তজবা ফুল ছাড়া কিছু লাগে না। কিন্তু মন্ত্রোচ্চারণ ও ভোগরন্ধনই আসল কাজ। তাতে সামান্য ত্রুটি হলেই…।”

বাক্য অসমাপ্ত রেখে বাচস্পতিমশাই হাতে তুলে নিলেন পাঁচটি করে বেলপাতা আর রক্তজবা। সামনে মোমবাতির আলোয় ধিকধিক করছে অন্তত পাঁচশো বছরের পুরনো বলিনারায়ণী পুঁথিটা। সেদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে চোখ বন্ধ করে উদাত্তকণ্ঠে বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলেন।

 ভাস্বরাং বন্ধনীং শূলযুক্ত হস্তাঞ্চ দক্ষিণে পাণ্ডুবর্ণ খচরারূঢ়াং

 দক্ষকর্ণদ্রূপার্জিতাং উদঞ্চ সমরাকান্তা বামে পঞ্চধ্বজা-কুলাং।।

 দক্ষাঙ্খি লৌহপঞ্চাম্যকটকাট্যাং ময়োবনাং

 দংষ্ট্রাকরালবদনাং গোবেয়ক শিরোমণিং।।

কতক্ষণ মন্ত্রোচ্চারণ চলেছিল তা আমি সঠিক গুণে বলতে পারব না, তবে যেটুকু ভীষণ প্রকটভাবে চোখে পড়ছিল যেটা হচ্ছে যত মন্ত্রোচ্চারণ এগোচ্ছিল, ততই নূপুরের মধ্যে ছটফটানি বেড়ে চলছিল।

আর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল বাইরের আকাশে ঝড়ের দাপট। শুকনো ঝড়। তবু সেই বিকট কড়-কড়-কড়াৎ বজ্রপাতের শব্দে কানে টাকা লেগে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এ যেন সমানে সমানে যুদ্ধ চলছে দেবীকে তুষ্ট করার প্রতিযোগিতায়।

একদিকে শুদ্ধাচারী শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ব্রাহ্মণ চন্দ্রনাথ বাচস্পতি, অন্যদিকে এই অঞ্চলের অলৌকিক পুরুষ রাজা নীলাম্বর।

মন্দিরের বাইরের একটা গাছের বিশাল ডাল হঠাৎ করে ভেঙে পড়ল গর্ভগৃহের প্রবেশমুখেই। আমি সভয়ে তাকালাম সেদিকে। ডালটা লতাপাতা সমেত ভেঙে পড়েছে, এভাবে প্রলয় চললে তো আমাদের এখান থেকে বেরনোর রাস্তাই বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু কিছু করার নেই। এখন ওঠায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আর ঝড়, বজ্রপাত এসবই সম্ভবত রাজা নীলাম্বরের লীলা।

আমি একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে নূপুরের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ছিলাম। ওইটুকু আটবছরের শিশু এত ধকল কী নিতে পারে? লক্ষ করছিলাম ও যেন ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়ছিল, আবার থেকে থেকে কেউ যেন কোন উত্তেজক দিয়ে চাঙ্গা করে তুলছিল ওকে। তখন ওর চোখের দৃষ্টি বনবন করে ঘুরছিল, মুখ দিয়ে কর্কশ শব্দে বেরিয়ে আসছিল বিজাতীয় সমস্ত আওয়াজ।

আমি ক্রমশ উতলা হয়ে উঠছি দেখে বাচস্পতিমশাই আমাকে চোখের ইঙ্গিতে শান্ত থাকতে বললেন। বাধ্য হয়ে আমি বসে উসখুস করতে লাগলাম।

এ যেন অনন্ত পূজার্চনা। বাচস্পতিমশাই একটুও না থেমে মন্ত্রচ্চারণ করেই যাচ্ছেন আর বেলপাতা ও রক্তজবা একটু করে ছিঁড়ে ছিঁড়ে হাত পেছনে ঘুরিয়ে ছুঁড়ে দিচ্ছেন দেবীর পায়ে।

আর প্রতিটি অর্ঘ্যের পরই আরো যেন চঞ্চল আর হিংস্র হয়ে উঠছে নূপুর।

পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হতে শুরু করল। বাইরের ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চড়তে শুরু করল বাচস্পতিমশাইয়ের মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ, সঙ্গে ততটাই অস্বাভাবিক হয়ে পড়তে লাগল নূপুর। ওর মুখ দিয়ে বেরনো আর্তনাদগুলোতে বাবা হয়েও আমার শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কাঞ্চনমণির আত্মার চাপে আমার মেয়েটার খুব কষ্ট হচ্ছে, তীব্র বেদনায় নূপুর যেন নীল হয়ে যাচ্ছে।

শেষে যখন ওর মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোতে শুরু করল, আমি আর থাকতে পারলাম না। বাচস্পতিমশাইয়ের যাবতীয় নিষেধাজ্ঞা ভুলে চেঁচিয়ে উঠলাম, ”নূপুর! নূপুর! কী হয়েছে তোর মা! কষ্ট হচ্ছে কোন?”

কখনও কখনও স্নেহের আতিশয্য বিড়ম্বনা ডেকে আনে। সেই ছিল আমার প্রথম ও অন্তিম ভুল, যে ভুলটা একলহমায় মিথ্যে করে দিল সব আয়োজনকে।

শেষ করে দিল এতোগুলো মানুষের প্রচেষ্টাকে।

বাচস্পতিমশাই রোষকষায়িত নেত্রে আমার দিকে তাকালেন।

আমি ভুল বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে চুপ করে গেলাম।

কিন্তু ততক্ষণে যা ঘটার ঘটা শুরু হয়ে গেছে। বাইরের সেই দামাল অতিমানবিক ঝড়টা যেন এবার সোজা ধেয়ে এল যেন ঘরের মধ্যে। একটা কালো অতিপ্রাকৃত অশুভ শক্তির মত ধূলিপুঞ্জ চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে তোলপাড় করে দিতে লাগল গর্ভগৃহ। প্রচণ্ড বিধ্বংসী সাইক্লোন যেমন সমুদ্রতীরে আছড়ে পড়ে সবকিছু একলহমায় উড়িয়ে নিয়ে চলে যায়, সেভাবেই যেন আমরা ছিটকে পড়লাম একেকজন একেকপাশে।

আমার চোখ জ্বালা করছিল, পেটের ভেতর থেকে নাড়িভুঁড়ি সব যেন উল্টে আসছিল, সারা শরীর তীব্র দহনে এমনভাবে জ্বলছিল যেন আগুনের লেলিহান শিখার মতে ফেলে দেওয়া হয়েছে আমাকে।

তারই মধ্যে আমি চেতনা লোপ পেতে পেতে দেখলাম, হাত ও পায়ের সেই শক্ত বাঁধন হেলায় ছিঁড়ে দিয়ে নূপুর উঠে দাঁড়িয়েছে। নূপুরের ওইটুকু কোমল দেহটি বাড়তে বাড়তে ভীষণ আকার ধারণ করে গর্ভগৃহের ছাদ ছুঁয়েছে প্রায়, চোখদুটো জ্বলছে ভাঁটার মত।

কী হিংস্র, কী বীভৎস সেই মুখ তা বর্ণনা করার সাধ্য আমার নেই। মুখের দু’পাশ দিয়ে বেরিয়ে আসছে ফেনা, দাঁতগুলো যেন বড় হয়ে আরো কদাকার করে দিয়েছে আমার নূপুরের সুন্দর মুখটাকে। বিকট অট্টহাস্যে ঢেকে যাচ্ছে গোটা গর্ভগৃহ।

আমার মাথায় হঠাৎ খুন চেপে গেল। হরিহর ঠিকই বলেছিল, এই হিংস্র চেহারা আমার নূপুরের হতে পারেনা। এ নূপুর নয়, কখনওই নয়। এ সেই কাঞ্চনমণি, এই সেই কাঞ্চনমণির অতৃপ্ত আত্মা, যে নূপুরের দেহে ঢুকে পড়ায় রাজা নীলাম্বর কিছুতেই নূপুরকে ছাড়ছে না।

হঠাৎ আমার মধ্যে কী হল, তীব্র শারীরিক কষ্টের মধ্যেও আমি শরীর সমস্ত শক্তি একত্র করে উঠে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে নূপুর ওরফে কাঞ্চনমণি বেরিয়ে গেছে গর্ভগৃহ থেকে, বিকট আওয়াজ করতে করতে লম্বা লম্বা পায়ে ছুটছে জঙ্গলের ডালপাতা মাড়িয়ে। রাগে, আক্রোশে আমিও ওর পিছু নিলাম।

পেছন দিকে ক্ষীণ শব্দে বাচস্পতিমশাইয়ের বারণ শুনতে পেলেও আমি থামলাম না। অনেক হয়েছে পুজো আচ্চা, নাটক। আমার মেয়েকে ওই করাল বাপমেয়ের কবল থেকে উদ্ধার করতে যা করার আমাকেই করতে হবে। অন্যরা কেউ তা পারবেনা।

আমিও উন্মাদের মত সেই প্রেতসম মূর্তির পেছনে দৌড়তে লাগলাম। আমাকে আসতে দেখে নূপুরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সেই পিশাচিনীর উল্লাস আরো বেড়ে গেল। বেড়ে গেল তার ছোটার গতিও। একসময় মনে হল, সে বুঝি ছুটছে না, মাটির থেকে সামান্য উঁচুতে ভেসে পালাচ্ছে দ্রুতগতিতে। আমি হাল ছাড়লাম না। অনেকক্ষণ অন্ধকারে থাকতে থাকতে চোখ সেই অন্ধকারের মধ্যেই আলো খুঁজে নেয়, আমিও সেইভাবে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ছুটছিলাম। কী করছি, কেন করছি সেই চেতনাবোধ অনেকক্ষণ আগেই লোপ পেয়েছিল, অদ্ভুত মোহাবিষ্টের মত ছুটে চলেছিলাম সেদিকে, ওই প্রেতিনীকে ধ্বংসের মোক্ষ নিয়ে।

যেখান থেকে শুঁড়িপথ বেঁকে আসছে মহামারী মন্দিরের দিকে, প্রেতমূর্তিটা সেখান থেকে ডানদিকে বেঁকল, অর্থাৎ নীলদরিয়ায় যাওয়ার রাস্তা ধরল। আমি ছোটার গতি আরো বাড়িয়ে দিলাম। এই কয়েকদিন প্রত্যহ একাধিকবার নীলদরিয়ার এই পথে এসেছি, কোথায় কোন গাছ, কোথায় কোন বাঁক, তা আমার ভালমত চেনা।

কিছুদূর ছোটার পরেই সেই বিশাল প্রান্তর শুরু হল। যা শেষ হয়েছে নীলদরিয়ায় গিয়ে। এতক্ষণ জঙ্গলের মধ্যে ছুটছিলাম বলে বুঝিনি, এখন খোলা আকাশের নীচে হঠাৎ চলে এসে বুঝলাম ঝড়ের তাণ্ডব এখনও শেষ হয়নি। আশ্চর্যের ব্যাপার, বৃষ্টির ফোঁটা নেই একটুও। অথচ হাওয়া বইছে পাগলের গতিতে, আর সেই হাওয়ায় আন্দোলিত হচ্ছে নীলদরিয়া ঘিরে থাকা বিশাল বিশাল দৈত্যের মত গাছগুলো।

সে যে কী ভীষণ দৃশ্য, তা ভাবলে আমার হাত পা এখনও ঠাণ্ডা হয়ে যায়। নূপুরের ছদ্মবেশে থাকা সেই অশরীরী প্রেতমূর্তিটা বলতে গেলে আলোর চেয়েও দ্রুত গতিতে ছুটছিল নীলদরিয়ার কিনারায়।

আমিও ওর মতলবটা বুঝতে পেরে নিজের ছোটার গতি বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। এতজোরে ছুটছিলাম যে মনে হচ্ছিল আর একটু হলেই আমার হৃদপিণ্ডটা গলা দিয়ে বেরিয়ে আসবে। আমার পায়ের শিরাগুলো বিদ্রোহ ঘোষণা করছিল, হাঁটু খুলে আসতে চাইছিল প্রচণ্ড পরিশ্রমে, কিন্তু আমি কিছুতেই থামলাম না। তীরে এসে তরী ডুবে যেতে আমি দেব না।

হরিহরের মেয়ে ঝর্ণার মত কৃষ্ণপক্ষের নবমীতিথিতে নীলদরিয়ার গহ্বরে ডুবে মরতে দেব না আমার ফুলের মত নূপুরকে। আর সেটা করার জন্য যদি আমার প্রাণবায়ু চিরকালের জন্য স্তব্ধও হয়ে যায়, সে যাক!

 আমার ধারণাই সঠিক ছিল। মূর্তিটা অলৌকিকভাবে ছুটতে ছুটতে গিয়ে দাঁড়াল নীলদরিয়ার কিনারায়। ঝাঁপ দেওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে সে আমার দিকে পেছন ফিরে একঝলক তাকাল।

ওহ! কী বীভৎস সেই চাউনি! মনে হল যেন সেই চাউনির সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের গোটা পরিবেশটাই এই গভীররাতে অশরীরীদের প্রমোদউদ্যানে পরিণত হয়েছে। প্রচণ্ড হিমেল হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছে আমায়, কালো ঘন মেঘের মত অন্ধকার মিলিত অশুভশক্তির মত ঘিরে ফেলছে আমাকে। আশপাশের গাছপালা, দূরের কালো মেঘের মত উঁচিয়ে থাকা রাজবাড়ির ইটপাথর সব আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে, বলতে চাইছে আমরা সবাই আছি, তুমি একা!

তুমি একা!

আমার বুকের ভেতরটা জমে বরফ হয়ে গেলেও আমি নিরস্ত হলাম না, প্রচণ্ড আক্রোশে মূর্তিটার একদম কাছে গিয়ে টিপে ধরলাম ওর গলাটা। কিছুতেই ওকে আমি নীচে ঝাঁপ দিতে দেব না। কিছুতেই নয়।

শরীরের সমস্ত জোর নিয়ে এলাম আমার দুই হাতে, হাতের পাঞ্জা দিয়ে গুঁড়িয়ে দিতে লাগলাম ওই প্রেতাত্মার সব আস্ফালন!

নূপুরের দেহ জুড়ে থাকা ওই আত্মাটা নিজের ধারালো নখ দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিতে চাইল আমাকে, উপড়ে ফেলতে চেষ্টা করল আমার চোখদুটো। কিন্তু পেরে উঠল না আমার শক্তির সঙ্গে। আসলে আমি যে নিশ্চিত ছিলাম, মূর্তিটার ওই পরাক্রম শেষ করে দিতে পারলেই আমি ফিরে পাব আমার আদরের নূপুরকে।

একজন অসহায় বাবার মেয়েকে বাঁচানোর শেষ প্রচেষ্টার সঙ্গে পারবে কেন কেউ, সে যতই হোক না কেন শতাব্দীপ্রাচীন আত্মা!

অনেকক্ষণ চলল আমাদের সেই শরীরী-অশরীরীর লড়াই। সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করে চলল অন্ধকারে ঝড়ে মাতালের মত দুলতে থাকা গাছগুলো। অবশেষে মূর্তিটা যখন নিস্তেজ হয়ে আসছে, আমি বুঝতে পারছি নূপুরকে ফিরে পাওয়া এখন আর সময়ের অপেক্ষামাত্র, সেইসময়েই এতক্ষণের প্রচণ্ড সংগ্রামে আমার চেতনা লোপ পেল।

জ্ঞান হারিয়ে নীলদরিয়ার ধারে আছড়ে পড়তে পড়তে আমি টের পেলাম, আমার অভীষ্ট সফল। প্রেতমূর্তিটা হেরে গেছে একজন বাবার স্নেহের কাছে। সেও ঢলে পড়েছে আমার পাশে।

কাঞ্চনমণির আত্মা মুক্তি দিয়েছে নূপুরকে। চিরতরে।

সেই অভিশপ্ত ঘটনার পর কেটে গেছে ছ’টা মাস। আর এই ছ’টা মাসে বদলে গেছে অনেক কিছু। বদলেছে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি, বদলেছি আমি।

আজ সকালবেলা ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই হাতে এসে পৌঁছল একটা চিঠি। খামটার মুখ বিসদৃশভাবে ছেঁড়া, সেটাই এখানকার দস্তুর। কারণ ভেতরের চিঠিটা আমার হাতে আসার আগে পড়া হয়েছে অন্তত তিন জায়গায়।

চিঠিটা লিখেছেন ডঃ অনিরুদ্ধ মিদ্যা। রঙপুর থেকে। আমি অলসভাবে ছোট চ্যাপ্টা তেলচিটে তক্তাটায় শুয়েছিলাম, মাথার ওপর ঘুরছিল ঘটাং ঘটাং ফ্যান। এখন চিঠিটা হাতে নিয়ে বিছানার ওপর আধশোয়া হয়ে বসলাম। প্রেরকের নামটা দেখে আমার শরীরটা শক্ত হয়ে উঠল। এই গরমেও হঠাৎ শীত করতে শুরু করল, গায়ের রোমগুলো জেগে উঠে খাড়া হয়ে পড়তে লাগল।

চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল জল, তীব্র কষ্টে আবার দগ্ধ হতে শুরু করলাম আমি।

আমি সেদিন ভুল করেছিলাম। প্রচণ্ড ভুল। কাঞ্চনমণির আত্মার বিনাশ করতে গিয়ে মেরে ফেলেছিলাম আমার আদরের নূপুরকেও। আমারই হাতের প্রচণ্ড শক্তিতে নূপুরের দেহের গলার হাড় গুঁড়িয়ে গিয়েছিল, কাঞ্চনমণি তার দেহ থেকে বেরিয়ে গেলেও নূপুরের আর সেখানে ফিরে আসবার কোন উপায় ছিল না।

হরিহর অন্যান্যদের নিয়ে যখন নীলদরিয়ায় এসেছিল, ততক্ষণে ঝড় থেমে গিয়েছিল। আমি অচেতন পড়ে ছিলাম। আর নূপুরের নিস্প্রাণ দেহটা পড়ে ছিল আমার পাশেই। ওর মুখে নাকি গত কয়েকদিনের সেই গাম্ভীর্য সরে গিয়ে খেলা করছিল অদ্ভুত এক প্রশান্তির দ্যুতি।

মহামারী মন্দিরের সামনেই মৃত অবস্থায় পড়েছিলেন বাচস্পতিমশাই। চোখ খোলা, শূন্য দৃষ্টি ছিল মহামারী মন্দিরের দিকে তাকিয়ে। খচ্চরবাহিনী পুজোর নিয়ম অনুযায়ী আমারই ক্ষণিকের ভুলের জন্য প্রাণ দিতে হয়েছিল তাঁকে।

সেদিনের পর থেকে নীলাম্বর রাজার গ্রামে আর কেউ সেই অজানা জ্বরে মারা যায়নি। আমি পুলিশ আসার আগে পর্যন্ত আত্মহত্যার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলাম। হরিহর, মুকুন্দ, ইকবালরা আমায় ছায়ার মত ঘিরে ছিল।

এটা রঙপুর সেন্ট্রাল জেল। আমি ভারতীয় নাগরিক, আমার পাসপোর্ট আর অন্যান্য নথি সব বাজেয়াপ্ত করেছে বাংলাদেশ সরকার। নিজের মেয়েকে গলা টিপে খুন করার মত জঘন্য অপরাধের আসামী আমি। জানিনা ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনায় আমার পরবর্তী গন্তব্য কোন দেশের জেল হবে। আপাতত কড়া নজরদারিতে রাখা হয় আমাকে।

ভারত বাংলাদেশের এক্সট্র্যাডিশন চুক্তি অনুযায়ী আমার মত অপরাধীকে ভারত সরকারের হাতে তুলে দেওয়ার কথা, কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য আমি মানসিকভাবে সুস্থ নই, এখন জেলের মধ্যেই চলছে আমার চিকিৎসা। একমাস পর আমার মানসিক স্থিতি বুঝে নাকি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

তবে আমি তা নিয়ে একেবারেই ভাবিত নই। যে দেশেই থাকিনা কেন, এক মুহূর্তের জন্যও যদি সুযোগ পাই, আমি নিজেকে শেষ করে দিতে কার্পণ্য করবো না।

প্রাণপণ চেষ্টা করবো আমার নূপুরের কাছে চলে যেতে।

আমি খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলিয়ে চিঠিতে চোখ বুলোলাম। ডঃ মিদ্যা লিখেছেন পুরোদমে এক্সক্যাভেশন শুরুর আগে নীলদরিয়ার ভেতরের পুরো জল নিষ্কাশন করা হয়েছে। সেখানে পাওয়া গেছে বেশ কিছু কঙ্কাল, প্রত্যেকটিই সাত-আট বছরের।

আমি জানলা দিয়ে দূরে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। আমি জানি নীলদরিয়ার পেটে এখনও অনেকগুলো ঝর্ণা শুয়ে আছে।

চোখ মুছে চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলে দিলাম বাইরে। বুকের ভেতরের যন্ত্রণাটা হঠাৎই যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেল।

আপনাদের কাছে আমার একটাই অনুরোধ, যদি আপনার আট বছরের মেয়ে থাকে, তবে আর যেখানেই যান না কেন, বাংলাদেশের রঙপুরে নীলাম্বর রাজার গ্রামে যাবেন না।

যাবেন না নীলদরিয়াতেও।

আটবছরের কোন মেয়ে পেলেই নীলদরিয়ার খিদে জেগে উঠবে, আর রাজা নীলাম্বর তাঁর নিজের মেয়ে ভেবে টেনে নেবেন আপনার মেয়েকে। তখন হাজার চেষ্টাতেও কিচ্ছু করতে পারবেন না।

কথাটা দয়া করে মনে রাখবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *