নীলাক্ষী লজ – রাজেশ চট্টোপাধ্যায়
আমাদের জীবনে তো এমন অনেক ঘটনাই ঘটে; যেগুলোর কোনো যুক্তি-সঙ্গত ব্যাখা আমরা কোনোদিনই ঠিক ভাবে করে উঠতে পারিনা ।দুঃস্বপ্ন ভেবে সেগুলোকে ভুলে যাওয়ায় শ্রেয় ।যাইহোক দার্শনিক আলোচনা একটু দূরে সরিয়ে রেখে এবারে আসলে কথাতে আসি ||
সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে 2011 সালে ইংরেজিতে স্নাতক করে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ. -এর জন্য ফর্ম ফিলআপ করতে গেছিলাম ।প্রচন্ড গরমের মধ্যে যখন ওখানে গেলাম; তখন দেখলাম কয়েকটা পৃথক ভাবে লাইন করা হলেও প্রতিটাতেই অনেকজন দাঁড়িয়ে ।তারপরে বেশ কয়েক ঘন্টা লাইনে থাকতে-থাকতে যখন হাঁপিয়ে উঠেছি তখন ফর্ম হাতে পেয়ে আবার সেটাকে তখনি ফিল-আপ করার প্রচেষ্টা শুরু করে দিলাম ।তাতে ফর্ম সাবমিট করতে-করতে আরও দেরি তো অবশ্যই হয়ে গেল আর সেই সাথে পেটের মধ্যে খিদের চোটে চোখে অন্ধকার দেখলাম ।ওখান থেকে বেরিয়ে প্রায় পড়ন্ত আলোতে কয়েক-পা হেঁটে যখন কোনো-মতে আমার শরীরটাকে একটা ঝুপড়ি মতো হোটেলে নিয়ে গিয়ে ফেললাম তখন হোটেলে কেউই বসে নেই আর একটা কালো-ছেঁড়া গেঞ্জি পড়া রোগা-পাতলা ছোট-ছেলে লাগোয়া সামনের রাস্তা থেকে একটু দূরে একটা জলের বালতি নিয়ে বসে এঁটো থালা গুলোকে ছোট্ট ভিজে কাপড় দিয়ে একমনে গুন-গুন করতে করতে পরিষ্কার করে পাশে রেখে দিচ্ছে আর মাঝে-মাঝেই ওখানে ঘোরা-ফেরা করা একটা পাগল লোককে অশ্লীল খিস্তি করে চলেছে ।একটা গেঞ্জি আর লুঙ্গি পড়ে যে লোকটা কাউন্টারে বসে ঘ্যাম নিয়ে হাত-পাখা নাড়ছে; এইই বোধহয় মালিক ।
-“এখন ভাত হবে?”
-“তা হোটেলে ভাত হবেনা? বসে পড়ুন “
যদিও এতক্ষন ধরে পিঠের ভারী ব্যাগটাকে পাশে রেখে বসে আগেই পড়েছিলাম ; ভাবলাম খালি-পেটে মাথা থেকে হাইজিনের চিন্তাগুলো বোধহয় ভিক্টরিয়া-মেমোরিয়ালে ঘুরতে যায় !
-“কি খাবেন? মাছ না চিকেন?”
-“মাছ”
-“এইই ! এখানে একটা মাছ-ভাত “
খাওয়া-দাওয়ার পরে যখন হাত-ধুচ্ছি তখন হঠাৎ বুঝতে পারলাম আমার ঘাড়ের কাছে কে যেন নিঃস্বাস ফেলছে ! ।পেছন ঘুরেই বেশ হক-চকিয়ে গেলাম ।দেখলাম সেই পাগলটা; ধুলো-মাখা আলু-থালু চুল; পরনে বোধহয় একটা 1947 সালের ময়লা জামা; এক দৃষ্টিতে আমার দিকে লাল-লাল চোখে তাকিয়ে আছে ।ঠিক তখনি একটা ফোন এলো ! ।দেখলাম বাবার ফোন ।হোটেলের বিল পেমেন্ট করতে-করতে ফোনটা রিসিভ করলাম ।
-“হ্যাঁ ! বলো !”
-“খেয়েছিস?”
-“এই মাত্র খেয়ে উঠলাম আর তোমার ফোন”
-“ফিরবি কিভাবে? “
-“মানে? “
-“অবরোধ আবার শুরু হয়ে গেছে ! হয় ট্রেন চলবেনা বা এলেও প্রচুর লেট হবে ! তাহলে আজকের রাতটা ওখানে কোথাও থেকে যা” ।বাবা একটানা কথাগুলো বলে গেলো ।
-“আচ্ছা ! বেশ বেশ ! আমি দেখছি কি করা যায় ! তোমাকে জানাচ্ছি আমি” ।ফোন কেটে দিয়ে বন্ধু দেবোত্তম কে একটা ফোন করলাম; ওর বর্ধমানে অনেক জানা-শোনা ।
-“বল রে !”
-“শোননা ! বলছি আজকে বর্ধমান এসেছি; তোর জানা কোনো ভালো লজ আছে? “
-“বোকার মতো কথা বলিসনা ! গোলাপবাগে থাকার প্রচুর লজ আছে ।কম খরচে যে-কোনো একটাতে থেকে গেলেই তো হলো ||”
ফোন কাটা মাত্র কে যেন কানের কাছে বিকট ভাবে চিৎকার করে উঠলো;
-“ঘার লট যা ! আভি কে আভি.. . ঘার লট যা ! রুকনা মাত.. রুকনা মাত”
শালা ! পাগল ! আরেকটু হলে বোধহয় আমার ব্রেনেই হার্ট-এটাক হয়ে যেতো !
সাত-পাঁচ না ভেবে হাঁটতে লাগলাম; আজকের রাতটা কোনো হোটেলেই কাটাবো বলে ।
রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা দূর যেতেই দেখতে পেলাম একটা চায়ের দোকান; দোকানের সামনে একটা বেঞ্চির ওপরে তিন-চারজন চা খাচ্ছে ।আর চায়ের দোকানের ঢিল-ছোঁড়া দূরত্বেই যেটা দেখলাম সেটা দেখে মনটা বেশ-বেশ ভালো হয়ে গেলো ।একটা সাইন-বোর্ডে লেখা “নীলাক্ষী; ফুডিং এন্ড লজিং” ।আমি কোনো দিকে না তাকিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেলাম ।শুনতে পেলাম; আমার পেছনে ফেলে আসা চায়ের দোকান থেকে কেউ বা কারা যেন বার-দুয়েক চেচিঁয়ে উঠলো; “এই ছেলে.. . এইই ছেলে.. .ওদিকে কোথায়.. . ” ।বাইরে তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে ।
ভেতরে ঢুকে সামনে বসা হোমড়া-চোমড়া লোকটিকে বললাম;
-“আজকের রাতটা থাকবো; কত পড়বে? “
মধ্যবয়সী লোকটার পরনে একটা সাদা-মাটা সুতির জামা; চোখে একটা অদ্ভুত ফ্রেমের বাইফোকাল চশমা; মাথায় চুলের সংখ্যাও বেশ কম। কিন্তু কি দারুণ ভাবে পকেট থেকে চিরুনি বের করে সেগুলোকে একবার আঁচড়ে নিয়েই; দাঁত বের করে এক গাল হেসে বলে উঠলো;
-“স্যার! 300 টাকা মাত্র”
-“রাতের খাবার পাওয়া যাবে? “
-“অবশ্যই ! অবশ্যই ! এই নিন আপনার চাবি; রুম নম্বর 11; ওপরে উঠে একদম ডানদিকে ।আর এখানে প্লিজ একটা সই করে দিন; পাশে ফোন নম্বর আর এড্রেস লিখতে ভুলবেন না যেন! ।
আমি লোকটার দেওয়া মোটা আর চাপ-চাপ ধুলো-জমা রেজিস্টার খাতাতে লাগোয়া পেনে সই-টই; করে যখন ওপরের সিঁড়ির দিকে যাচ্ছি তখন পেছন থেকে শুনতে পেলাম;
-“স্যার ! আমি একটু বাদে ছেলে পাঠিয়ে দিচ্ছি; ও আপনাকে সব বুঝিয়ে দেবে”
তাহলে এটাই রুম নম্বর 11 ।তালা খুলে ভেতরে ঢুকতে যাবো; এমন সময় পেছন থেকে গলা পেয়ে কেঁপে উঠলাম;
-“দাঁড়ান স্যার; অন্ধকারে পড়ে যাবেন; আমি আলো জ্বালিয়ে দিচ্ছি “
দেখলাম একটা শ্যামবর্ণ; বছর 15-16’র ছেলে; নিমেষে ভেতরে ঢুকে আলো জ্বালিয়ে দিলো ।
-“স্যার! এই পাশের টা ফ্যানের সুইচ”
-“আমাকে স্যার বলার দরকার নেই ।দাদা বলতে পারো ||”
-“আচ্ছা স্যার! ইয়ে ! সরি ! মানে দাদা!”
আমার হাল্কা হাসি পেলো; যদিও সেটা দেখালাম না;
-“তোমার নাম কি? আর তোমাদের এখানে কি ব্যাপার বলোতো? আর কাউকেই তো দেখছিনা ! সব ঘর তালা-বন্ধ!”
-“বাজার খুব খারাপ দাদা; যে চার-জন ছিলো ওরা আজকে দুপুরেই বেরিয়ে গেছে; আবার যখন সবাই কলেজে ভর্তি হবে তখন আবার সব ওকে হয়ে যাবে ।ও হ্যাঁ ! আমার নাম পল্টু ।”
-“কলেজ নয় পল্টু; বলো ইউনিভার্সিটি ! ।যাইহোক; রাত্রিতে রুটি-তড়কা হবে? “
-“আমিও এটাই বলতে চাইছিলাম ।হয়ে যাবে দাদা ||”
পল্টু চলে যেতেই আমি দরজা লাগিয়ে একবার বাড়িতে ফোন করে আমার থাকার ব্যাপারটা জানিয়ে দিলাম ।এবারে একটু সময় নিয়ে ভালো করে রুমটা দেখলাম ।একটা ছোট খাট; সাদা চাদর পাতা; একটা পুচকে বালিশ; পাশে একটা প্লাস্টিকের কালো চেয়ার; লাগোয়া বাথরুম অন্ধকার; সব সুইচ টিপেই দেখলাম আলো জ্বলছে না ! ।এই ভ্যাপসা-গরমে মাথার ওপরে ফ্যানটা আছে আর সেটা প্রয়োজনের থেকে এতটাই জোরে ঘোরে যে বাইরের একটাও শব্দ শোনা যাচ্ছে না ।একটা রাত কাটাবার জন্য ঠিক-ঠাকই ।ক্লান্ত শরীর; ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে সবটাই শেষ করে কিছু-ক্ষণের জন্য বিছানায় নিজেকে ছেড়ে দিলাম ।শুয়ে-শুয়ে ভাবতে লাগলাম এই রুমের এমনকি লজের সব আলোগুলোয় বড্ড মিটমিটে আর কেনই বা ফ্যানের হাওয়াতে দেওয়ালে লাগানো যে ক্যালেন্ডারটা উড়ছে; সেটা 2008 সালের ! ।
প্রচন্ড গরমে ঘুম ভেঙে গেলো ।যা বুঝলাম তা হলো; কিভাবে এক ঘুমে রাত্রি কেটে সকাল হয়ে গেছে; পাশের জানালা দিয়ে বিক্ষিপ্ত গাড়ি চলা-চলের আওয়াজ; খুব সম্ভবত পাওয়ার-কাট হয়ে গেছে; ঘামে ভিজে গেছে সারা শরীর; ।আর এই সব কিছুকে ছাপিয়ে প্রচুর খিদে পেয়েছে ।
নিজেকে গুছিয়ে নীচে নেমে এলাম ।দেখলাম আমার দিকে লজের মালিক কেমন যেন জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছে ।ভাবখানা এমন যেন পাঁচ-তারা হোটেলের মালিক ।আমার তখন এতটাই বিরক্তি লেগেছে যে কোনো কথা না বাড়িয়ে বলেই ফেললাম;
-“এই নিন আপনার তিনশো টাকা আর ফর্মালিটিস করার খাতাটা দিন”
-“স্যার! আমি কালকের জন্য অত্যন্ত লজ্জিত ও দুঃখিত ।প্লিজ বাসি মুখে বেরোবেন না ।এইই লাল্টু স্যারের জন্য পাশের দোকান থেকে জলদি চা নিয়ে আয়।”
-“Hey ! Mr. আপনি ওকে লাল্টু বলে ডাকছেন কেন? ” ।ততক্ষনে ছেলেটিও ওখানে এসে হাজির হয়েছে ।”ওর নামতো পল্টু !”
তখন দুজনেই দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে যেন নিজেদের মধ্যে কোনো সংক্ষিপ্ত মহাকাব্য আদান-প্রদান করে উঠলো ।সেই মুহূর্তে; নীরবতা ভেঙে লোকটি রেজিস্টার খাতার শেষের দিক থেকে একটা ফটো বের করে বললো;
-“এর নামই পল্টু ।ওরা দু’জনে যমজ; তবে এর কপালের কাছে এই দাগটা ছিল “
-” ছিল মানে ? “
-“স্যার ! তিন বছর আগে; আমার দাদা আগুনে পুড়ে মারা যায় ! তারপর থেকে আমি যেদিন-যেদিন রাত্রে সার্ভিস দিতে পারিনা; ওইইই দিয়ে দেয় ! ।আসলে আমাদের আজও খুব ভালোবাসে.. .
মাথাটা মুহূর্তে কেমন ঘুরে গেলো ।গলা শুকিয়ে কাঠ ।কোনোমতে ওখান থেকে সামনের বড়ো রাস্তার দিকে দৌড় লাগালাম ।নিজের হার্ট-বিট যেন নিজেই শুনতে পাচ্ছিলাম ।দৌড়াবার সময় পেছন থেকে খুব স্পষ্ট শুনেছিলাম;
-“দাদা খুউব ভালো.. . স্যার.. . স্যার.. .”
-“বল”
-“আবে ! কালকে রাতে ‘নীলাক্ষী’ বলে একটা লজে রাত কাটালাম.. . কি সাংঘাতিক.. . ওখানে ভূত দেখলাম রে ভাই.. . নিজের চোখে দেখলাম রে দেবু .. .উরিবাপরে ! বাপরে.. .”
-” সক্কাল-সক্কাল নেশা-টেশা করছিস নাকি? কিসব আজে-বাজে বলছিস ! “
-“ধুরর ! শালা ! আমি এইমাত্র ওখান থেকে ভয়ে পালিয়ে এসে বড়ো রাস্তার এদিকে তোকে ফোন করছি!”
-“আজকে বাড়ি ফিরে বিকালে ইরিগেশন-কলোনীর মাঠে দেখা কর ।আমি ভালো করেই জানি; ‘নীলাক্ষী’ বলে যে লজটার কথা তুই বলছিস; ওটা বছর-তিনেক আগে রেনোভেশনের সময় আগুনে পুড়ে গেছে আর মালিক-কর্মচারী সবাইই মারা গেছে; কেউ আর বেঁচে নেই…. … .. ..”
স্পাইনাল কড দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো ।অবর্ণনীয় অবস্থায় পেছন ঘুরে তাকালাম। একটা খুব বাজে ভাবে পুড়ে যাওয়া পরিত্যক্ত বাড়ি; রাশি-রাশি আবর্জনার মতো নাম-না-জানা গাছ ভেতরের অংশ আর বাইরের মরচে-পড়া ছোট্ট গেটকে শান্ত সাপের মতো জড়িয়ে রেখেছে ।একটা ডানদিক হেলে পড়া আধপোড়া বোর্ডে লেখা; “নীলা..”
রাস্তার ওপর পড়ে যেতে-যেতে শেষ বারের মতো আবছা দেখতে পেয়েছিলাম কারা যেন চায়ের দোকান থেকে চিৎকার করতে-করতে আমার দিকে ছুটে আসছে…