নীলশার্ট, লালগেঞ্জি – অশোক বসু

নীলশার্ট, লালগেঞ্জি – অশোক বসু

মাঝারি বয়সের নীলশার্ট পরা, মোটাসোটা লোকটা নিজেকে যতই স্বাভাবিক দেখাবার চেষ্টা করুক না কেন, আমি ঠিকই বুঝতে পারছিলাম ওগুলো সবই তার ওপর ওপর সাজানো ব্যাপার। আমি আর ছোটকা যে-বাসে শিলিগুড়ি থেকে ফিরছিলাম, সেই বাসে সেও যাচ্ছিল। ঠিক আমাদের সামনের সারির সিটে জানলার ধারে বসে খবরের কাগজ পড়ছিল। খবরের কাগজ পড়াটা যে নেহাতই একটা ভান, সেটা বুঝে নিতে আমার মোটেই অসুবিধে হচ্ছিল না। বেশ বুঝতে পারছিলাম সে ভেতরে ভেতরে কোনও চাপা উত্তেজনা বোধ করছে। কোনও স্টপে গাড়ি থামলেই সে সতর্ক হয়ে যাত্রীদের ওঠা-নামা লক্ষ করছিল। যেন ভয় পাওয়ার মতো কেউ আছে কি না দেখে নিচ্ছিল।

লোকটাকে দেখে এত কথা আমার মনে হত না, যদি-না কয়েকদিন আগের শিলিগুড়ির সোনার দোকানের দুর্ধর্ষ ডাকাতির কথা আমার জানা থাকত। ওই ডাকাতিতে স্বর্ণময়ী জুয়েলারির দরোয়ান আর এক কর্মচারীকে খুন করে ডাকাতরা লাখখানেক টাকার সোনার গয়না নিয়ে পালিয়ে যায়। কেউ ধরা না পড়লেও ছোটকার মুখে শুনেছিলাম ডাকাতরা শিলিগুড়ির আশেপাশের লোক বলে পুলিশ সন্দেহ করছে।

এতসব কথা ছোটকা কিন্তু জানত না। আমিও নীলশার্টের কথা ছোটকাকে এতক্ষণ বলিনি। কিন্তু বাসটা শিলিগুড়ি থেকে কয়েক মাইল দূরে ফুলবাড়ি আসতেই লোকটা যা কাণ্ড করল, ছোটকাকে না বলে থাকতে পারলাম না। ফুলবাড়িতে গাড়ি থামতেই সে উঠে দাঁড়াল, ব্যাগটা হাতে নিল, তারপর নামবে বলে সামনের দিকে যেতে গিয়েই একজনকে বাসে উঠতে দেখে থেমে গেল। আমি দেখলাম সে আবার নিজের জায়গায় চটপট বসে পড়ে কাগজটা ফের ব্যাগ থেকে বের করে নিয়ে নিজের মুখটা আড়াল করল। আর যাকে দেখে সে এত কাণ্ড করল, সেই লোকটা কিন্তু এসব কিছুই দেখেনি। বসবার জায়গা ছিল না বলে সে হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে রইল। ছোটকার বয়েসি পাতলা চেহারার এই লোকটা কালো ফুলপ্যান্ট আর লালগেঞ্জি পরে থাকলেও আমি মনে মনে তাকে পুলিশের ড্রেস পরিয়ে দিয়ে দেখলাম যে দিব্যি মানিয়ে যাচ্ছে।

ছোটকা সামনের দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, “কে, কোন লোকটার কথা বলছিস?”

আমি বললাম, “ওই যে জানলার ধারে বসে কাগজ পড়ছে। গুন্ডা-গুন্ডা দেখতে, নীলশার্ট…”

এপাশ থেকে লোকটার মুখ পুরো দেখা যাচ্ছিল না। ছোটকা একটু ঝুঁকে দেখল। আর দেখেই ছোটকার কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়ল। অস্ফুট গলায় শুধু বলল, “আরে!”

মনে হল লোকটা খুব মার্কামারা। ছোটকা তাকে চিনে ফেলেছে। ছোটকার মুখ গম্ভীর। আমি কিছু বলবার আগেই বাসের সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, “আর পরে যে লোকটা উঠেছে?”

লালগেঞ্জি পরা লোকটাকেও তখন পুরো দেখা যাচ্ছিল না। গাড়িতে ভিড় বেশি বলে অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে। লালগেঞ্জির সামনে-পেছনে তখন অনেক লোক। এমনিতেই সময়টা বিকেলের শেষাশেষি, গাড়ির মধ্যে অল্প আলো, তবু আমি ভিড়ের মধ্যে থেকে লোকটাকে ঠিক খুঁজে নিয়ে ছোটকাকে দেখালাম।

“ওই যে, চশমাপরা লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লাল গেঞ্জি, ইয়া গোঁফ।”

তখনই লালগেঞ্জিকে এত ভিড়ের মধ্যে থেকেও ফাঁক দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম। ছোটকা আমার পায়ে একটা ছোট্ট চিমটি কাটল। ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে আমিও অমনি অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। ছোটকাও জানলার বাইরে তাকিয়ে রইল। যেন এতক্ষণ সে বাইরের দৃশ্য দেখতেই মগ্ন।

ছোটকা নিচু গলায় বলল, “গোঁফটা কিন্তু দেখবার মতো। আর্মির লোকদের এরকম গোঁফ থাকে।”

একটু পরে গাড়ির আলো জ্বলে উঠতেই আমি আবার সামনের দিকে তাকালাম। লালগেঞ্জির চোখ অন্যদিকে। জনে জনে যেন সন্ধানী-দৃষ্টি ফেলে দেখে নিচ্ছে, যাদের খুঁজছে তেমন কেউ আছে কি না। ছোটকার মুখে শুনেছিলাম পুলিশ নাকি হন্যে হয়ে এখন ডাকাতদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমি সাবধান হয়ে গেলাম। কী জানি লোকটা যদি আবার দেখে যে আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি, তবে হয়তো আমাকেই কিছু সন্দেহ করে বসবে। থানা-পুলিশের নাম শুনলেই আমার বুকের ভেতর ঢিবঢিব করে।

ছোটকা ফিসফিস করে বলল, “ঠিক ধরেছিস তপু, খুবই সন্দেহজনক ব্যাপার।” ছোটকা এবার নীলশার্টের দিকে তাকাল। তখনও নীলশার্টের মুখের সামনে খবরের কাগজটা ধরা। এত অল্প আলোতে যে কাগজের লেখাগুলো মোটেই ভাল করে পড়া যায় না, সেটা হয়তো তার খেয়ালই নেই। ছোটকা তার দিকে তাকিয়ে আবার বলল, “মনে হচ্ছে শিলিগুড়ির ডাকাতির কেসের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক আছে। না, সেটা টেক-আপ করতে হচ্ছে তপু।”

আমি বুঝলাম ছোটকার মধ্যে দারুণ টেনশন এসে গেছে। শখের গোয়েন্দাগিরিতে ছোটকা ভীষণ উৎসাহী। যদিও কাগজে-কলমে এখনও কোনও গোয়েন্দাগিরিতে সে হাত দেয়নি, তবু মনে করে অদূর ভবিষ্যতে সে নামকরা ডিটেকটিভ হয়ে উঠবে। হরদম সে ডিটেকটিভ বই পড়ে আর খবরের কাগজে খুন ডাকাতি চুরির খবর থাকলেই সে নিজের মনে মনে অপরাধীর পেছনে ধাওয়া করে। ছোটকার যুক্তিগুলো অনেক সময় আমাকেও ভাবিয়ে তোলে।

আমার মধ্যেও তখন বিরাট উত্তেজনা। ব্যাপারটা যদি সত্যিই তাই হয়, তবে সেই দারুণ থ্রিলিং ব্যাপারটা আমিই প্রথম ছোটকাকে ধরিয়ে দিয়েছি। মনে মনে কিছুটা আত্মপ্রসাদ লাভ করলেও সঙ্গে সঙ্গে সতর্কও হয়ে উঠলাম। ডাকাতরা নাকি খুব বেপরোয়া হয়। দরকার পড়লে আরও দু’-চারটে খুনখারাপি করা ওদের কাছে জলভাতের মতো ব্যাপার। আমি নীলশার্টের দিকে এক পলক দেখে নিয়ে বললাম, “কিন্তু ডাকাতটার কাছে নিশ্চয়ই রিভলভার আছে। বেকায়দা দেখলে সোজা চালিয়ে দেবে।”

ছোটকা লালগেঞ্জির দিকে তাকিয়ে বলল, “সাদা পোশাকে থাকলেও পুলিশ কখনও বিনা অস্ত্রে থাকে না। আর জানবি, ভয় পেলে কক্ষনও ভাল কাজ হয় না। ক্রিমিনালদের ধরার ব্যাপারে পুলিশকে সাহায্য করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য।”

আমি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। নীলশার্ট তখন কাগজটা একটু সরিয়ে দিয়ে লাল গেঞ্জিকে দেখছিল। ওর চুরি করে দেখার ভঙ্গিটাই ওকে আরও বেশি সন্দেহভাজন করে তুলল। একটু দেখেই লোকটা আবার কাগজের আড়ালে মুখ লুকিয়ে ফেলল। আমি লালগেঞ্জির দিকে তাকালাম। তাকিয়েই চমকে উঠলাম। দেখলাম সে চিন্তিত মুখে নীলশার্টের কাগজ-পড়া দেখছে। মনে হল সে কিছু সন্দেহ করছে। আমি উত্তেজিতভাবে ছোটকাকে আঙুল দিয়ে খোঁচা দিলাম। কিন্তু বুঝলাম ছোটকাও সবদিকে নজর রেখেছে। নিচু গলায় বলল, “লোকটা পরের স্টপেই পালাবে। তার আগেই তাকে ধরতে হবে।”

বলেই ছোটকা উঠে দাঁড়াল। সামনের সিটের কাছে গিয়ে কিছু বলবে বলে নীলশার্টের দিকে তাকাল। সে কী, ছোটকা এক্ষুনি লোকটাকে চ্যালেঞ্জ করে বসবে নাকি! আমি দমবন্ধ করে অপেক্ষা করে থাকলাম। বাসভরতি এত লোক, কিন্তু কেউ ঘুণাক্ষরেও জানে না যে বাসের মধ্যে কী এক রোমহর্ষক সাংঘাতিক ঘটনা ঘটতে চলেছে।

কিন্তু ছোটকা সেসব কিছু করল না। নীলশার্টের দিকে হাত বাড়িয়ে খুব ভদ্রভাবে বলল, “কাগজটা দেবেন একটু?”

নীলশার্ট ছোটকাকে দেখে কেমন যেন বিস্মিত মুখ করল। কিছু না-বলে কাগজটা এগিয়ে দিল ছোটকার দিকে। ছোটকা কাগজ নিয়ে এসে আবার আমার পাশে বসল।

কাগজ চাইবার নামে ছোটকা যে লোকটার মুখ ভাল করে দেখে নিল, সেটা আমি ভাল করেই জানি। তবু ছোটকার মতো বুদ্ধিমান লোক কেন যে বোকার মতো এমন কাজ করল বুঝাতে পারলাম না। অপরাধীর মন নাকি সব সময়েই সন্দেহপ্রবণ থাকে। ছোটকার হাবভাবে সে নিশ্চয়ই সাবধান হয়ে যাবে। এতে পুলিশের কাজেরও অসুবিধে হয়ে যেতে পারে। গোয়েন্দাগিরির প্রথম সুযোগ পেয়ে অতিমাত্রায় উৎসাহে ছোটকা একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে।

একটু পরে ছোটকা বলল, “ব্যাপারটা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হয়ে এলাম। তবে ডাকাতটা পালাতে পারবে না।”

ছোটকা যে সত্যিই বোকার মতো কিছু করেনি একটু পরেই তা টের পেলাম। বাসটা তখন কোনও স্টপের খুব কাছে চলে এসেছে, কেউ কেউ নামবে বলে তৈরি হচ্ছে। নীলশার্টকেও দেখলাম উঠে দাঁড়িয়েছে। দেখামাত্র ছোটকাও লাফ মেরে উঠে দাঁড়াল। আমাকে বলল, “চুপ করে বসে থাকবি। সিট ছেড়ে একটুও উঠবি না।” বলে ছোটকা দ্রুত দরজার কাছে চলে গেল। টানটান রোমাঞ্চ আর উত্তেজনায় আমি সোজা হয়ে বসে থাকলাম। নীলশার্ট নামতে গেলেই ছোটকা তাকে ধরে ফেলবে। আর লালগেঞ্জি তো আছেই। তাকেও দেখলাম দরজার খুব কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে। এক্ষুনি সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটে যাবে।

হলও তাই। গাড়ি যেই থামল, নীলশার্টও অমনি লোকজনকে ঠেলেঠুলে দরজার কাছে চলে আসতে থাকল, আর ছোটকাও ঝাঁপিয়ে পড়ে দু’হাতে চেপে ধরল। কিন্তু এ কী, এ কী, ছোটকা তো জাপটে ধরেছে লালগেঞ্জিকে, নীলশার্টকে তো নয়, ডাকাত তবে কে?

লালগেঞ্জি ঝটকা মেরে ছোটকার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পালাবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ততক্ষণে নীলশার্টের হাতে রিভলভার উঠে এসেছে। কঠিন গলায় নীলশার্ট বলল, “অনু চৌধুরী, পালাবার চেষ্টা করলেই কিন্তু গুলি চালাতে বাধ্য হব। প্রাণের মায়া থাকলে সারেন্ডার করো। আমাদের সোর্সের খবর অনুযায়ী স্বর্ণময়ী জুয়েলারির খুন আর ডাকাতির কেসে দলের পাণ্ডা তোমাকেই আমরা খুঁজছিলাম।” বলেই এগিয়ে এসে লালগেঞ্জির পাকানো গোঁফ ধরে টান মারল। আর সঙ্গে সঙ্গে নকল গোঁফটা নীলশার্টের হাতে চলে এল।

গাড়িসুদ্ধ লোক তখন ভয়ানক অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ডাকাত শুনে সবাই গোল করে ঘিরে ধরল লালগেঞ্জিকে। একজন বলল, “দেব নাকি গণধোলাই?”

নীলশার্ট বলল, “না। আইন পুলিশের হাতেই থাকা ভাল। তবে আপনারা দয়া করে একটু অ্যালার্ট থাকবেন যাতে বদমাশটা পালাবার চেষ্টা না করে।” তারপর ছোটকার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ প্রসেনজিৎবাবু। আপনি না থাকলে একে ধরা আমার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ত।”

ব্যাপারটা ঠিকই ধরেছিলাম, কিন্তু ঘটনার চরিত্রগুলো অদলবদল হয়ে গিয়েছিল। নীলশার্ট হয়ে গেল পুলিশের অফিসার আর লালগেঞ্জি হয়ে গেল ডাকাত। পরে জিজ্ঞেস করাতে ছোটকা জ্ঞানীর মতো মুখ করে বলেছিল, “বুঝলি বোকারাম, একেই বলে বিশ্লেষণী ক্ষমতা আর পর্যবেক্ষণ শক্তি। পুলিশ অফিসার মিস্টার শর্মার সঙ্গে আমার পরিচয় না-ও যদি থাকত, তা হলেও কে ডাকাত আর কে পুলিশ বুঝতে মোটেই সময় লাগত না। মিস্টার শর্মাকে কাগজ নেবার সময় চোখ টিপে জানিয়েছিলাম আমিও আছি। যেখানে পাঁচদিন আগে অতবড় ডাকাতি হয়ে গেছে, পুলিশের জোর তৎপরতা চলছে, সেই শিলিগুড়ি থেকে এরকম প্রকাশ্যে আসবে, কোনও ক্রিমিন্যাল এত বড় বুদ্ধু হবে এটা ভাবা একটু কঠিন। তা ছাড়া একটা অল্পবয়েসি লোকের ওরকম বেমানান গোঁফ, ভিড়ের ফাঁক দিয়ে চুপিচুপি তাকানো, মাঝরাস্তা থেকে শেষবিকেলে বাসে উঠে লোকজনের মধ্যে মিশে থাকা—সবকিছুই অপরাধীকে চিনিয়ে দিয়েছিল। আর মিস্টার শর্মা যে এই কেসের তদন্ত করছেন, সেটা আগেই শুনেছিলাম। তবে তোর দোষ নেই। সবার আই-কিউ তো সমান হয় না। অনু চৌধুরীর দুর্ভাগ্য যে, সে যে-বাসে উঠেছিল, সেই বাসে স্বয়ং প্রসেনজিৎ সোম ফিরছিল।”

ছোটকার গা-জ্বালানো মুচকি মুচকি হাসিতে আমার রাগ হয়ে গেলেও চুপ করেই থাকতে হল। সত্যিই তো ছোটকা একটা কাজের মতো কাজ করেছে।

২৫ জুলাই ১৯৮৪

অলংকরণ: বিমল দাস

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *