৯
ঠিক বিকেল পাঁচটা বেজে পনেরো মিনিট, আউট্রাম ঘাটের সামনে যে-মূর্তি তার ডানদিকের কোণ ঘুরে আসবে একটি মেয়ে, মেয়েটির পরনে একটি বোম্বাই ছাপাশাড়ি, পায়ে গোলাপি রঙের ‘লাকি’ চটি, চুল বিনুনি-করা নয়, এলোখোঁপা, মেয়েটির হাতে থাকবে লাল রঙের হাতব্যাগ।
আর ঠিক সেই সময়েই ঐ মূর্তিটার দিক থেকে অকস্মাৎ বাঁক নেবে একটি ছেলে; ছেলেটির পরনে চওড়া-পাড় ধুতি এবং মুগার পাঞ্জাবি, মাথার চুল একটু কোঁকড়া, হাতে থাকবে ডি এইচ লরেন্সের কাব্যসংগ্রহ (পেপারব্যাক)।
ছেলেটি এবং মেয়েটি ঠিক পাঁচটা পনেরোয় ঐ মূর্তির দুপাশ দিয়ে এসে মুখোমুখি হবে। ছেলেটি বলবে, আরেঃ! কিন্তু মেয়েটির উদ্দেশ্যে নয়। মেয়েটির পিছন-পিছন আসা একটি মাঝবয়সী ভদ্রলোকও এইসময় বলবেন, আরেঃ! যদিও আগে থেকেই জানা, কিন্তু দুজনকেই আরেঃ! বলতে হবে যথোচিত বিস্ময় ফুটিয়ে। তারিখ, কোন এক রবিবার।
ওরা থমকে দাঁড়াবে। ভদ্রলোকটি এগিয়ে এসে যুবকটির কাঁধ চাপড়ে সোল্লাসে বলবেন, কী খবর! বহুকাল পর দেখা। আলাপ করিয়ে দি, এই আমার ভাগনি, অরুণা, অরুণা রায়, এখন স্কটিশে বি.এ. পড়ছে। আর, অরুণা, এ হচ্ছে সুবিমল সান্যাল—আমার অনেককালের চেনা। মেয়েটি রক্তিমগণ্ডে হাত তুলে নমস্কার করবে আলতোভাবে—ততক্ষণে ছেলেটির নমস্কার সারা হয়ে যাবে।
ঐ-যে ভদ্রলোকটি সুবিমল সান্যালের কাঁধ চাপড়ে বহুকাল পরে দেখা হবার জন্য পুলক সোচ্চার করলেন, তিনি অবশ্য সুবিমলকে কস্মিনকালেও চেনেননা, আগে কখনও দেখেননি। তবু তিনি বলবেন, এসো সুবিমল একটু চা-খাওয়া যাক। তাড়া নেই তো তোমার? আরে, অরুণার সামনে অত লজ্জা করছ কেন, অরুণা খুব স্মার্ট মেয়ে, কলেজে কত ডিবেট করেছে।
তারপর—
এখানেই স্বীকার করা ভালো, আমি রহস্যময় বা রোমাঞ্চকর লেখা একেবারেই লিখতে পারিনা। ঘটনার সাসপেন্স শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখা আমার পক্ষে অসম্ভব। খালি মনে হয়, শেষটা আগে বলে ফেলি, পাঠক আমার চেয়ে ঢের বুদ্ধিমান, সে বহু আগেই বুঝে ফেলে আমার বোকামির প্রয়াস দেখে হাসছে। কোন-এক রবিবার আউট্রাম ঘাটে পাঁচটা পনেরোয় কী-কী ঘটবে—তা আমি আগে থেকেই কী করে জানলাম, সেই কারণটাই বলি আগে।
কারণ খুব সোজা। সুবিমল আমার কাছে এসেছিল। সুবিমলের বিয়ে হবার কথাবার্তা চলছে। ওর বাড়ির লোক উনচল্লিশ জায়গায় পাত্রী দেখে, শেষ পর্যন্ত অরুণা রায়কে প্রায় পাকা পছন্দ করেছে। অন্যান্য জরুরি বিষয়েও মতের মিল হয়েছে দুপক্ষের। কিন্তু সুবিমল আধুনিক ছেলে, সে প্রেম করে অসবর্ণ বিরাহ করতে পারেনি বটে, কিন্তু একবারে চোখে না-দেখে বাপ-মায়ের কথা শুনেই একটা অচেনা মেয়েকে বিয়ে করে ফেলবে—এত কাঁচাও সে নয়। এ-বিষয়ে সে-বাড়িতে একটা বিদ্রোহই করেছে বলা যায়। অথচ, পাত্রীপক্ষের বাড়িতে গিয়ে ফরাসে বসে একটি লাজুক-লাজুক মেয়েকে দেখা—এ-প্রাচীন প্রথাতেও তার মত নেই। এতে নাকি নারীত্বের অবমাননা না কী-যেন হয়।
সুতরাং এই অভিনব পরিকল্পনা। পরিকল্পনাটা সুবিমলেরই। রাত্রে শুয়ে-শুয়ে এই পরিকল্পনাটা তৈরি করে সুবিমল নিজের বুদ্ধিতে কীরকম খুশি হয়েছে বুঝতে পারি। সুবিমল আমাকে বলল, এর মধ্যে খারাপ কিছু আছে, বল্? সহজ—সরলভাবে আলাপ-পরিচয় হবে—দুজনেই দুজনকে জানতে পারব আগে থেকে!
যাইহোক, বন্দোবস্ত সব ঠিকঠাক। ডুয়েল লড়ার সময় যেমন একজন সেকেন্ড ম্যান’ লাগে সেইরকম, সুবিমল আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়।
আধুনিক হবার প্রাণপণ চেষ্টায় সুবিমল হয়তো শেষপর্যন্ত একটা ‘প্রেম’ করে বিয়ে করার চেষ্টাই করে যেত, কিন্তু ইতিমধ্যে ও একটা ভালো সরকারি চাকরি পেয়েছে, এবং বছর না ঘুরতেই, ওকে ট্র্যান্সফার করেছে দুমকায়। সেই নির্জন জায়গায় কী করে একা-একা থাকবে—সেইজন্যই ওর বাবা-মা বিয়ের জন্য জোর করেছেন। সুবিমলও মত নাদিয়ে পারেনি।
আমি শুনে প্রচণ্ড খুশিতে হো-হো করে হেসে উঠে বললাম, ‘বাঃ, এ-তো চমৎকার ব্যাপার, মাইরি! বল, বল, তারপর কী হবে? মেয়েটা কি আগে থেকেই—তোর পরিচয় জানবে?’
—জানার তো কথা নয়। যদি না, নিজে গোপনে জেনে থাকে। মেয়েদের কৌতূহল তো জানিস!
—মনে কর ঐ সময়টাতেই যদি বাইচান্স আর-একটা তোরই মতো বা তোর চেয়েও ভালো চেহারার ছেলে এসে পড়ে—তবে ঐ মামা ভদ্রলোক তাকেই সুবিমল বলে পিঠ চাপড়াবে? ভদ্রলোক তো তোকে কখনো দেখেননি।
—ছবি দেখেছেন।
-বাঃ! সময়টাও বেছে নিয়েছিস চমৎকার! পাঁচটা পনেরো-পাঁচটা নয়, সাড়ে পাঁচটাও নয়—তাহলে প্ল্যান ধরা পড়ে যেতে পারত! তাছাড়া, শীতকালের ঠিক ঐ সময়টাতেই কনে-দেখা-আলো পড়ে, নারে?
সুবিমল এবার একটু লজ্জা পেল। আমি বললাম, ‘যদি এই মেয়েকেই তোর পছন্দ হয়—তবে ফুলশয্যার রাত্রে এই ঘটনাটা নিয়ে তোরা দুজনে খুব হাসাহাসি করতে পারবি। আচ্ছা বল, তারপর কী কী হবে?’ চা-খেতে তো বসা হল, বুঝলাম —কথাবার্তা কীরকম হবে?
—তারপর আর-কিছু ঠিক করা নেই। কথাবার্তা যে-ভাবে এগোয় আর-কী। হঠাৎ দেখা হলে লোকে যা কথা বলে আর কী!
—যাঃ! আমাকে তো সব জেনে রাখতে হবে! আমি যাতে আবার কোন বেফাস কথাবার্তা না-বলে ফেলি! আমার বোধহয় বেশি কথা বলাও ঠিক হবেনা। তাহলে না শেষকালে মেয়েটির আমাকেই পছন্দ হয়ে যায়। আমাকে একটু গম্ভীর প্রকৃতির লোক সাজতে হবে। তোর ভয় নেই, আমি ভুরু কুঁচকে নাকটা বেঁকিয়ে আমার মুখটা যতদূর সম্ভব কুচ্ছিৎ করে রাখব আগাগোড়া। কথাবার্তা কী বলবি বল, তুই নিশ্চয়ই কিছু ভেবে রেখেছিস।
সুবিমল হেসে বলল, ‘যাঃ, আগে থেকে ভেবে কোন কথা বলা যায়না।’
আমি বললাম, ‘কথাবার্তা কীরকম হবে আমি কল্পনা করতে পারি। মামা ভদ্রলোকটি পাকেচক্রে তোর চাকরির কথা জিজ্ঞেস করবে। তুই মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করবি তার কলেজের কথা। কোন্-কোন্ সাবজেক্ট বেশি ভালোবাসে। এম.এ. পড়ার ইচ্ছে আছে কিনা। মাঝখানে একবার, গঙ্গার দিকে তাকিয়ে, গঙ্গানদীতে চড়া পড়ে যাওয়ার সমস্যা আর সি এম পি ও’র দ্বিতীয় ব্রিজ বানাবার পরিকল্পনা নিয়ে কথা হয়ে যাবার পর—তুই তোর হাতের লরেন্সের কাব্যসংগ্রহটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে-করতে একফাকে অরুণা নাম্নী মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করবি, লরেন্সের কবিতা তার ভালো লাগে কিনা। মেয়েটি জানাবে, সে লরেন্সের ‘রকিং হর্স উইনার’ নামে একটি গল্প পড়েছে, (‘লেডি চাটার্লিস লাভার’ পড়ে থাকলেও বলবেনা)—তুই লরেন্সের যে-কোন একটা কবিতার চার-পাঁচলাইন চেঁচিয়ে পড়ে বলবি, আঃ, এটা পড়ে দেখুন, কী চমৎকার কবিতা। ঐ-ফাঁকে তোর দেখে নেওয়া উদ্দেশ্য, মেয়েটির ইংরেজি উচ্চারণ কেমন। কারণ, অফিসারের বউদের নানা পার্টিতে যেতে হয়—ইংরেজিটা একটু ভালো জানা দরকার!’
সুবিমল বলল, ‘যাঃ, তুই বেশি ইয়ার্কি করছিস। রবিবার ফ্রি আছিস কিনা বল্।’
আমি বললাম, ‘সুবিমল, তুই একটা গাধা!’
—বিয়ের আগে সবাইকেই গাধা-গাধা দেখায়!
—তুই ব্ল্যাকমার্কেট করছিস কেন?
—ব্ল্যাকমার্কেট?
—তাছাড়া কী? ঠিকঠাক করা বিয়েকে তুই প্রেমের বিয়ে বলে চালাতে চাস্! যেন এক সন্ধেবেলা দুজনেরই দুজনকে গভীর পছন্দ হয়ে গেল! তোর বাবা অবশ্য পণ নেবেননা জানি, বউভাতের খরচ বলে হাজার চারেক টাকা নিতে পারে! দানসামগ্রী নিয়ে কোন কথাই উঠবেনা, সে তারা মেয়েকে যা ভালো বোঝেন দেবেন। অবশ্য, তোর হাতঘড়িটা যে খারাপ হয়ে গেছে, সে-কথাটা কোনক্রমে ওঁরা জেনে যাবেনই। আর দুমকাতে গিয়ে নতুন সংসার পাততে হবে—সেজন্য আসবাবপত্র যদি মেয়ের মা মেয়ের জন্য শখ করে কিনে দেন, তাতে কার কী বলার আছে?
–তুই ঠাট্টা করছিস, কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ নয়।
—জানি। সকলেই বিদ্রোহী নয়। বিদ্রোহী সাজাও যায়না। মূর্তিমান উগ্র আধুনিক যখন একটি শাড়ি পরানো টাকার পুটলিকে বিয়ে করে, তখন সে বন্ধুদের কাছে কাঁচুমাচুভাবে বলে, কী করব ভাই—মা বুড়ো হয়েছেন, মায়ের ইচ্ছে—। কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যেও নয়। মা যদি অবুঝও হন, তবু তোকে দুঃখ দিয়ে ক’জন বিদ্রোহ করতে পারে, জানিনা। আমি তোকে সে-কথা বলছিও না।
–তুই জানিস না, আমি মা-বাবাকে বোঝাবার অনেক চেষ্টা করেছিলাম। তাছাড়া, বাড়ির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করব, কার জন্য? সেরকম মনের মতো মেয়ে পেলাম কোথায়? মনের মতো দূরের কথা, এই তিরিশ বছরের জীবনে একটা মেয়ের সঙ্গে তেমনভাবে আলাপই হল না। অথচ আমি মোটামুটি সুস্থ-স্বাভাবিক ছেলে! তোর যে-সমাজ পণপ্রথা ওঠাতে চায়, জাতিভেদ, কাস্টসিস্টেম ঘোচাতে চায়—সে-সমাজ ছেলেমেয়েদের সহজভাবে মেলামেশা করার সুযোগ দিয়েছে? খুব তো বিদ্রোহ-ফিদ্রোহ বড়-বড় কথা বলছিস! একটা ভিন্নজাতের মেয়েকে বিয়ে করে যে বাড়ির গোঁড়ামি ভাঙব—সেরকম একটা মেয়ের সঙ্গে আলাপ হল কোথায়? ওসব বড়লোকদের মধ্যে হয়—অথবা কবিটবিদের, আমরা মেশার সুযোগ পেলাম কোথায়? একটা মেয়ের সঙ্গে একটু একা কথা বললেই তো— অমনি সবার ভুরু কুঁচকে উঠল! তাই শেষ পর্যন্ত ভাবলাম, দূর ছাই!
—তুই যা করছিস তাতে আমি কোনই আপত্তি করিনি। আমি শুধু বলছি ইস্কাবনকে ইস্কাবন বলে ডাকতে। ঠিক করা বিয়ে যখন হচ্ছে, তখন পুরোপুরিই হোক! চল, আমরা মেয়ে দেখতে যাই মেয়েরই বাড়িতে। ফরাসের ওপর বসে লুচি-সন্দেশ সাঁটতে-সাঁটতে পাত্রীকে বলব, একটু হাঁটো তো মা! হারমোনিয়ামে রবীন্দ্রসংগীত শুনি। চুলের গোছায় হাত দিয়ে দেখি মোজা লুকোনো আছে কিনা! ভূদেব মুখুজ্যের লেখা থেকে ডিকটেশান দিয়ে হাতের লেখা দেখব, জিজ্ঞেস করব নেপোলিয়ানের ছোট ছেলের জন্মসাল। কলেজে ডিবেট-করা মেয়ে যখন বাপ—মায়ের কথাতেই বিয়ে করছে, তখন সে এসবও করতে বাধ্য।
সুবিমল আমার দিকে ভূ-কুঁচকে তাকাল আমার মতলব বোঝার জন্য। আমাকে তখন বক্তৃতায় পেয়ে বসেছে। আমি বললাম, ‘তুই পণই-বা নিবিনা কেন? তুই ইস্কুলে ‘পণপ্রথার কুফল’ সম্পর্কে রচনা লিখে ফার্স্ট হয়েছিলি, তাতে কী হয়েছে? যে-ছেলে অসুখের সময় বার্লি খেতে একেবারেই পছন্দ করতনা, সে যেমন পরে ডাক্তার হয়ে আবার সব ছোট ছেলেকে বার্লি খেতে বলে, কিংবা, প্রবীণ লেখকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে যে-নবীন লেখক—সেই যেমন এক সময় প্রবীণ হয়ে পরবর্তী নবীনদের দুচক্ষে দেখতে পারেনা, কিংবা ট্রেনের কামরায় খুব ভিড়—একজন লোক উঠতে পারছে না—কামরা শুদ্ধু লোক বলছে জায়গা .নেই জায়গা নেই—খুব কাকুতি-মিনতি করে উঠে আসার পর—সেই লোকটাই যেমন পরের স্টেশনে লোকদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ওইরকম আরেকটা লোককে বলে জায়গা নেই, জায়গা নেই—সেই একই যুক্তিতে তুইও ঠিক করছিস।’
বলাই বাহুল্য, সেই রবিবার সুবিমল আমাকে সঙ্গে নেয়নি। কিন্তু দুঃখের কথা এই যে, অরুণা রায় নাম্নী মেয়েটির সঙ্গে সুবিমলের বিয়েও হয়নি। সুবিমল যে তাকে পছন্দ করেনি তা নয়। কিন্তু পাকা দেখার দু-একদিন আগে স্কটিশচার্চ কলেজের একটি ছেলের চিঠি আসে তার কাছে, সুবিমল যদি অরুণাকে বিয়ে করে, তবে সেই ছেলেটি নাকি আত্মহত্যা করবে! ফলে সুবিমল অরুণার চরিত্রে সন্দিহান হয়ে, আর-একটি ম্যাট্রিক পাশ—কলেজে-না-পড়া মেয়েকে দ্রুত বিয়ে করে ফেলল। সেই বিয়েতে গতকাল আমি চানাচুর, কাটলেট এবং মুগের ডালের সন্দেশের নেমন্তন্ন খেয়ে এলাম।