৫
নদী কোথা থেকে আসছে—এর উত্তর তো আমরা ছেলেবেলা থেকেই জানি। স্যার জগদীশচন্দ্র বসু আমাদের জানিয়ে দিয়ে গেছেন, নদী আসে মহাদেবের জটা থেকে। কথাটা সত্যি কিনা মিলিয়ে দেখবার জন্য আমি নিজেও অনেক নদীর পাড়ে বসে জিজ্ঞেস করেছি, ‘নদী তুমি কোথা হইতে আসিতেছ?’ কুলুকুলু কলধ্বনির মধ্যে আমিও একই উত্তর শুনেছি, ‘মহাদেবের জটা হইতে।’
নদীর পাড়ে বসে আমি আর-একটি প্রশ্ন করেছি, যখনই যেখানে নদী দেখেছি, আমার মনের মধ্যে গুঞ্জরিত হয়ে উঠেছে সেই প্রশ্ন, ‘নদী, তুমি কোথায় যাচ্ছ?’ এর উত্তর পেতে আমার দেরি হয়েছে। সকালে, সন্ধ্যায়, একা বা দলবলের সঙ্গে, শহরে বা নির্জন প্রান্তরে যেখানেই আমি নদী দেখেছি, খুব গোপনভাবে জিজ্ঞেস করেছি, ‘নদী, তুমি কোথায় যাচ্ছ?’ কখনো এই উত্তর শুনিনি, ‘সমুদ্রে’। না, নদী আমাকে কোনোদিন কুলুকুলু কলধ্বনির মধ্যে বলেনি, আমি সমুদ্রে যাচ্ছি। অথচ জানি তো নদী সমুদ্রেই যায়, আর কোথাও তার যাবার উপায় নেই, তবু নদী কখনো নিজের মুখে সে-কথা বলেনা।
মানুষও তো যাচ্ছে মৃত্যুর দিকে, কিন্তু মানুষ কি সে-কথা বলে? রাস্তা দিয়ে একজন মানুষ হনহন করে হেঁটে চলেছে, যদি তাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করি, কী, কোথায় চলেছেন? তিনি কি উত্তর দেবেন, মৃত্যুর দিকে? অথচ, সেইটাই তো সত্যি উত্তর। কিন্তু, কোথায় চলেছেন, একথা জিজ্ঞেস করলে, সব মানুষেরই অন্তর্নিহিত একটি উত্তর, আর-একজন মানুষকে খুঁজতে। সবাই সারাজীবন আরেকজন মানুষকে খুঁজছে—সে-খোঁজাই বোধহয় মৃত্যুর কথা মনে পড়ায়না। নদীও যায় সমুদ্রের দিকে, কিন্তু সেকথা বোধহয় তার মনে থাকেনা, সেও বোধহয় আর-একটি নদীকে খোঁজে। পৃথিবীতে এমন একটিও নদী আছে কি, যে পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে একা-একা, সোজা গিয়ে সমুদ্রে পড়েছে? ভূগোলে এমন—কথা কখনো পড়িনি। এরকম চিরকুমারী ব্রহ্মচারিণী নদী বোধহয় পৃথিবীতে একটাও নেই। সব নদীই আর-একটা নদীকে খোঁজে, সমুদ্রে যাবার আগে।
যাইহোক, নদী আর মানুষের জীবন নিয়ে এই খেলো আর সস্তা তুলনাটা বেশি টেনে লাভ নেই। মানুষের কথা যাক, আমি শুধু নদীর কথাই বলি।
জগদীশচন্দ্র নদীর ভাষা বুঝতেন, আমার সে-ক্ষমতা নেই। আমি নদীর পাড়ে বসে জিজ্ঞেস করেছি, নদী, তুমি কোথায় যাচ্ছ? নদীর জলে তখন অস্পষ্ট কোলাহল, তরঙ্গের বিভঙ্গ, যেন নদীর মধ্যে তখন খুব একটা হাসাহাসি পড়ে গেছে, পিকনিকে মেয়েদের মতন তরল ইয়ার্কিতে আসল কথা গোপন করার চেষ্টা, বুঝতে পেরেছি, নদী আমায় উত্তর জানাতে চায়না, কিন্তু তার ছটফটানি দেখলে বুঝতে পারা যায়, সে অন্য নদীকে খুঁজতে যাচ্ছে।
এলাহাবাদের ত্রিবেণীসংগম’ আমি বার ছয়েক দেখেছি, কলকাতার কাছেই ত্রিবেণীও আমার দেখা, আরও অনেক নদীর মিলনকেন্দ্র দেখার স্মৃতি আমার আছে, তবু, কোথাও কোন নদী দেখলেই এখনো আমার মনে হয়—কোথায় সে অন্য নদীর সঙ্গে মিশেছে—একবার দেখে আসি। জগদীশচন্দ্র কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে গঙ্গোত্রীর অভিমুখে গিয়েছিলেন, আমিও একবার দুই নদীর মিলনকেন্দ্র আবিষ্কার করেছিলাম। জগদীশচন্দ্রের তুলনায় আমার প্রতিভা যত ছোট, ভাগীরথীর তুলনায় সেই নদীও তেমনি ছোট।
রোগা ছিরছিরে নদী, নাম হারাং। সাঁওতাল পরগনার নামসূচক গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। নদীর সাঁওতালি নাম হারাং, বাংলায় হারান বলতে ইচ্ছে হয় আমাদের, এমনই করুণ, অভিমানী, হারিয়ে যাবার মতন চেহারা; তার হারান নাম হলে অবশ্য আর নদী থাকে না, বলতে হয় নদ, কিন্তু নদ কথাটা আমার পছন্দ নয়, বিশ্রী শুনতে, মেয়ে-পুরুষ যাই হোক, সব নদীই নদী, যেমন সব পাখিই পাখি, পুরুষ পাখিদের তো আমরা পাখ বলিনা।
সেই হারাং নদীর পাশে ডাকবাংলো, সেখানে কয়েক বছর আগে গিয়েছিলাম আমরা কয়েকজন শহুরে বাবু ও বিবি। আমাদের পরনে চোঙা প্যান্ট, হাতে ট্র্যানজিস্টার, মহিলা দুজনের হ্রস্ব জামার ফাক দিয়ে বহু বাতাস ঢুকতে পারে —অর্থাৎ পোশাকের মধ্যে অনেক জানলা-দরজা, ঠোঁট ও পায়ের নোখ লাল, অদূরে দাঁড়ানো জিপগাড়ি। আমাদের সরু-মোটা গলা ও ট্র্যানজিস্টারের কর্কশ নিনাদে সেই নির্জন নদীতীর গমগমে হয়ে উঠেছিল, প্রতি সকালবেলা এক-চতুর্থ ডজন মুর্গি কিনে এনে মহোল্লাসে হত্যা করা হচ্ছে, খোঁজ করা হচ্ছে মহুয়ার, হিন্দি ফিলমের নায়কের মতন প্যান্টের পা গুটিয়ে হাঁটুর কাছে তুলে আমরা যখন—তখন নদী পেরিয়ে যাচ্ছি।
মহিলা দুজন বলেছিলেন, ‘মাগো, কী বিশ্রী নদীটা, দেখলে বমি আসে! আর কোন ডাকবাংলো পাওয়া গেলনা?’
সত্যি সে-নদী দেখে মুগ্ধ হওয়া যায়না, অনেক উদ্যোগ-আয়োজন করে খাড়া পাড় বেশ নেমে গেছে বটে, কিন্তু বহতা পরিসর আট-দশফুটমাত্র এবং হরেদরে হাঁটুজল। চারিপাশে এবড়ো-খেবড়ো পাথর ছড়ানো, জলের রং অপরিষ্কার, যেন নদী নয়, জঙ্গলের খোলা ড্রেন। সে-নদীর একমাত্র গুণ, রাত্রিবেলা অস্পষ্ট আলোয় যখন চতুর্দিক ঝাপসা—তখন শুধু হারাং নদীর জল চক্চক করে, শোনা যায় অস্পষ্ট ছলছল শব্দ। সেইটুকুমাত্র গুণের জন্যই আমরা সন্ধ্যাবেলা হারাং নদীর পাড়ে পাথরের চাঁই-এর ওপর বসতাম। খোলা গলায় বেসুরো গানের পরিহাস-রসিকতা হত, ওগো নদী আপনবেগে পাগলপারা—এই গানও কেউ গেয়েছিল।
ডাকবাংলোর কীপারের নাম লেটু, তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘লেটু, এ-নদীটা কোথা থেকে আসছে রে?’
লেটু কিছুটা অবাক হয়ে উত্তর দেয়, ‘আসেনি তো। এ-নদী তো এখানেই ছিল! ই হারাং নদী বটে!’
শুনে আমাদের দলের কেউ-কেউ হাসে। অনুমান করা যায়, হারাং নদী কাছেই কোনো পাহাড়ি জলপ্রপাত থেকে এসেছে। কিন্তু নদীটা গেছে কোনদিকে? সমুদ্রে নিশ্চয়ই নয়, এ-নদীর চোদ্দপুরুষেও কেউ সাগরদর্শন করতে পারবেনা। লেটুকে আবার জিজ্ঞাসা করলাম, প্রশ্নটার গুরুত্ব আনবার জন্য হিন্দিতে, ‘লেটু ই নদী ইধার কিনা দূরতক গিয়া? ‘লেটু হিন্দি জানেনা, তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করে; ‘উও জঙ্গলের মধ্যে কুথাও হারিয়ে গিয়েছে হবেক্।’
মুর্গি বিক্রি করতে আসে ওসমান মিঞা, সে অনেক জানেশোনে, বুড়োমানুষ —তার অনেক অভিজ্ঞতা, তাকে জিজ্ঞেস করলে জানা যায় হয়তো, কিন্তু জিজ্ঞেস করতে আমার ভরসা হয়না, আবিষ্কারের নেশায় আমায় পেয়ে বসে, মনেমনে সংকল্প করে ফেলি, নদীটা কোথায় গেছে দেখতে হবে। হঠাৎ নিশ্চয়ই শুকিয়ে যায়নি, যত ছোটই হোক এরও তো জলে স্রোত আছে।
পরদিন সকালে প্রাতরাশের পর কারুকে কিছু না-বলে আমি বেরিয়ে পড়েছিলাম একা, একটা গরাণ গাছের ডাল ভেঙে লাঠি বানিয়ে নিয়েছি, জুতো পরিনি, শুধু গেঞ্জি গায়ে—খাঁটি পর্যটকের চেহারা। কিছুটা যেতেই দেখতে পেলাম আমাদের দলের মহিলা দুজনের অন্যতমা হারাং নদীর খাদে নেমে বনতুলসী কিংবা ঘেটু পুষ্প -চয়নে ব্যস্ত। আমাকে দেখে মুখ তুলে বললেন, ‘কোথায় যাচ্ছ?’ আমি বললাম, ‘একটু এদিক দিয়ে ঘুরে আসছি!’ শ্রীমতী বললেন, ‘আমিও যাব।’ বললাম, ‘না-না, তোমায় যেতে হবেনা।’—একথা বলেই ভুল করেছিলাম। কেননা, মেয়েদের কোন জিনিশ বারণ করলে তারা শোনে কখনো? সেটাতেই জেদ ধরে। সুতরাং তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ যাব!’ আমি তবু বললাম, ‘না, যেতে হবেনা! ওরা বকাবকি করবে। তাছাড়া আমার ফিরতে দেরি হবে।’ শ্রীমতী বললেন, ‘বেশ করব যাব। তোমার সঙ্গে তো যাচ্ছিনা, আমি আলাদা যাচ্ছি।’—অর্থাৎ তিনি রইলেন নদীর অন্য পারে, সেই প্রাচীন রূপকথার নারী-পুরুষের মতন।
নদী কোথা থেকে আসছে—তা দেখার আমার কৌতূহল নেই, সুতরাং নদীর স্রোত যে-দিকে আমরা সেই দিকে হাঁটছিলাম। ক্রমশ জঙ্গল একটু ঘন হল, একটু গভীর, নদীর পাড় দিয়ে চলার রাস্তা নেই—এমন রুক্ষ পাথর ও আগাছার ঝোপ। তাছাড়া আর-একটা অসুবিধে, গ্রামবালকরা তাদের সকালের কাজকর্ম নদীর ধারেই সেরে রেখে যায়—যে-কোন মুহূর্তে তাতে পা পড়ার সম্ভাবনা। ওপার থেকে শ্রীমতী চেঁচিয়ে বললেন, ‘কী বিশ্রী জায়গা, আমার আর ভালো লাগছেনা।’ আমি বললাম, ‘কে তোমায় আসতে বলেছিল?’ শ্রীমতী রাগতভাবে বললেন, ‘চলো, ফিরে যাই।’ আমি বললাম, ‘তুমি ফিরে যাও। আমি যাবনা।’ শ্রীমতী এবার কাঁদো-কাঁদো, ‘এতটা চলে এসেছি, এখন আমি একলা ফিরব কী করে!’ আমি বললাম, ‘তাহলে যা-ইচ্ছে তাই করো।’ শ্রীমতী এবার বললেন, ‘নীলুদা, আপনি এরকম—’
তখনো নদী তেমন চওড়া হয়নি, কিন্তু জল গভীর হতে শুরু করেছে। কিছু একটা দেখতে পাবার উত্তেজনা এসেছে আমার মধ্যে। আমি এগিয়ে চললাম, শ্রীমতী একবার এপারে আসবার চেষ্টা করলেন কিন্তু জলে নেমে দেখলেন শাড়ি অনেকখানি তুলতে হয়, সুতরাং নিবৃত্ত হয়ে অগত্যা আবার সামনের দিকে এগুতে লাগলেন। এবং অবলীলাক্রমে মিথ্যা অভিযোগ করে বললেন, ‘তুমি শুধু-শুধু আমায় এতদূর নিয়ে এসে—এখন একা ছেড়ে দিতে চাও!’ বেশ জোরে হাওয়া বইছে সুতরাং আমাকে চেঁচিয়ে ওপার থেকে বলতে হল, ‘কী মিথ্যেবাদী! মোটেই আমি তোমাকে আনিনি। আমি একা-একা আসছিলাম, তুমিই তো জোর করে আমার সঙ্গে এলে।’ শ্রীমতী আরও রেগে গিয়ে বললেন, ‘মোটেই না। আমিই তো একা-একা ফুল তুলছিলাম। তুমিই তো দেখিয়ে-দেখিয়ে আমার সামনে দিয়ে আসছিলে, উদ্দেশ্য আমায় সঙ্গে ডাকা।’ আমি ঠোঁট উল্টে বললাম, ‘বয়েই গেছে আমার তোমায় ডাকতে!’
ক্রমে বেশ বেলা হয়ে এলো, রোদ্দুর প্রগাঢ়, ইচ্ছে হয় গা থেকে গেঞ্জিটাও খুলে ফেলতে। কিন্তু ওপারে মাত্র তো কয়েক হাত দূরেই শ্রীমতী, সুতরাং খালি গা হওয়া যায়না। পথে একটা ছোট্ট গ্রাম পেরিয়ে এলাম, একটা চায়ের দোকান পর্যন্ত নেই—এমন ছোট গ্রাম শুধু হোগলাপাতার কয়েকখানা ঘর আর কিছু মুর্গি ছাগল ও উলঙ্গ শিশু। আবার জঙ্গল। দুপুরের কাছাকাছি আমি সেই অভীষ্ট অঞ্চলে পৌঁছুলাম।
লাটুর মতো দেখতে একটা ছোট্ট টিলা, ভেড়ার লোমের মতন তার গায় ছোট-ছোট আশসেওড়ার জঙ্গল, তার মাঝখান দিয়ে বিনা নোটিশে নেমে এসেছে আর-একটা নদী, একটু পুরুষ ধরনের বলশালী নদী, পাথরের গায়ে ধাক্কা লেগে তার জলে সাদা ফেনা পর্যন্ত ওঠে। সেই নাম-না-জানা নদীতে এসে মিশেছে আমাদের হারাং। এখানেই হারাং-এর জন্ম সার্থক। হারাং যেখানে অন্য নদীতে মিশেছে—সেখানে তারও জল স্বচ্ছ, তার জল দুলছে, ঘূর্ণিতে নেচে উঠছে, আনন্দে সেখানে সে আত্মহারা, যেন সেই জায়গাটা অবিকল একটা পেঙ্গুইন এডিশান প্রয়াগসঙ্গম। ঐ ছিরছিরে, রোগা পটকা হারাং এখানে ঘূর্ণি ঘুরিয়ে নাচছে। আমি আবিষ্কারের আনন্দে সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম।
শ্রীমতী বললেন, ‘আমি ওপারে যাব!’ এখন তাঁর কণ্ঠস্বরে ক্রোধ নেই, অনুনয়। আমি বললাম, ‘চলে এসো!’ শ্ৰীমতী বললেন, ‘পারছিনা, তুমি এসো।’ আমিও পা ডুবিয়ে লাঠি বাড়িয়ে দেখলাম, জল বেশ গভীর, তাছাড়া স্রোতের টান খুব, পা স্থির রাখা যায়না। বললাম, ‘উঁহু, যেতে পারছিনা।’ শ্রীমতী করুণকণ্ঠে বললেন, ‘আমার একা ভালো লাগছেনা। না, তুমি এসো। যেমন করে হোক।’ —আমি বললাম, ‘একা কোথায়। এই তো এদিকে আমি রয়েছি, কতটাই-বা দূর।’ শ্রীমতী তবু বললেন, ‘না, তুমি এদিকে এসো। মাঝখানে নদীটা ভালো লাগছেনা।’ আমি বললাম, ‘তাহলে আগেই এলেনা কেন? যখন জল কম ছিল?’ শ্রীমতী বললেন, ‘আগে ইচ্ছে করেনি। কিন্তু এখন আমার একা ভালো লাগছেনা।’
শ্রীমতী তখন সেই দুই নদীর মেশার জায়গায় জলের ঘূর্ণি ও ঢেউভাঙার খেলার দিকে বিষণ্নমুখে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন।