নীললোহিতের চোখের সামনে – ৩

ভদ্রলোককে দেখে আমার বারবার বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়ছিল। বিভূতিভূষণ যদি এই লোকটিকে দেখতেন, তাহলে এঁর কথা খুব সুন্দরভাবে লেখায় ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। আমার সে—ক্ষমতা নেই। বিভূতিভূষণের একটি গল্প অস্পষ্ট মনে আছে। মুদির দোকানে সামান্য কর্মচারীর কাজ করত একজন বুড়ো লোক, দোকান-টোকান বন্ধ হয়ে যাবার পর স্নান করে শুদ্ধ হয়ে একটা নিরালা জায়গায়, গাছতলায় বসে কবিতা লিখত। নিজের কবিতাই আবেগে চোখ বুজে ঢুলে-ঢুলে পড়ত। সেই কবিতার হয়তো কোন মূল্য নেই, কিন্তু লোকটির অনাবিল আনন্দের দৃশ্যটি বিভূতিভূষণ অপূর্বভাবে ফুটিয়েছিলেন।

নীলমাধববাবু অবশ্য ওরকম দরিদ্র নন। পরিবেশ, অবস্থা সবকিছুই আলাদা।

ওঁর সঙ্গে দেখা উড়িষ্যার একটি ছোট্ট শহরে। শহর ঠিক বলা যায় না, যদিও রেলস্টেশন আছে, কিন্তু গ্রামই প্রায়। সুযোগ পেলেই মাঝে-মাঝে আমি এখানে—ওখানে বেরিয়ে পড়ি, সেইরকম ঘুরতে-ঘুরতে, ভদ্রক-এর কাছে সেই ছোট্ট জায়গাটায় গিয়ে পড়েছিলাম। দুপুরবেলা একটা বটগাছের নিচে বাঁধানো গোল বেদীতে বসেছিলাম চুপচাপ, কিছুই করার নেই, ফেরার ট্রেন সেই সন্ধের পর। জায়গাটায় কোন হোটেলও নেই। বাজারের কাছে গোটা দু-এক চায়ের দোকান—সেখান থেকে দুদিনের বাসি পাঁউরুটি ও আলুর দম নিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সেরে নিয়েছি। যে-টুকু ঘুরেটুরে দেখার, দু-এক ঘণ্টার মধ্যেই দেখা হয়ে গেছে, এখন কিছুই করার নেই, বটগাছের ছায়ায় বসে থাকা ছাড়া। স্টেশনের বেঞ্চির চেয়ে এ-জায়গাটাই ভালো, স্টেশনে বড্ড মাছি ভনভন করছিল।

মন্দ লাগছিল না বসে থাকতে, একা একটা অপরিচিত জায়গায় গাছতলায় বসে থাকলে নিজেকে বেশ পথিক পথিক মনে হয়—যেন আমি পায়ে হেঁটে নিরুদ্দেশ যাত্রার পথে গাছের ছায়ায় দু-দণ্ড জিরিয়ে নিচ্ছি। রেললাইনের ওপারে গোটা কয়েক শিমুলগাছ একেবারে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। কোথায় যেন অনেকক্ষণ ধরে একটা ঘুঘু ডাকছে ‘ঠাকুরগোপাল ওঠো, ওঠো’ বলে, ঘুঘুর ডাকে নির্জনতা অনেক বেড়ে যায়।

কুঁচোনো ধুতির ওপর ফতুয়া-পরা, হাতে ছড়ি—একজন প্রৌঢ় যেতে-যেতে থমকে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখতে লাগলেন। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েই রইলেন, কোন কথা বললেননা। খানিকটা বাদে আবার চেয়ে দেখি, তিনি তখনও তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। এবার আমি একটু লাজুকভাবে হাসলাম। তিনি এগিয়ে এসে আমার সঙ্গে আলাপ করলেন।

–কলকাতার ছেলে মনে হচ্ছে?

—কী করে বুঝলেন!

-দেখলেই বোঝা যায়। এদিকে কী করতে আসা হয়েছিল?

—এমনিই!

–এমনিই কেউ এখানে আসে? এখানে কি কিছু দেখার আছে নাকি?

মানুষ কোথায় কী দেখতে যায়—তা কারুকে বলে বোঝানো যায়না। যদি বলতাম, বটগাছের তলায় এই বাঁধানো বেদীটাই আমার দেখতে ভালো লাগছে, শুধু এটা দেখার জন্যই এখানে আসা যায়—তাহলে কি উনি বিশ্বাস করতেন? এমনি-এমনি ঘুরে বেড়ানো বোধহয় অপরাধ—আমি অপরাধীর মতন মুখ করে রইলাম।

সন্ধেবেলায় ট্রেন ধরব শুনে তিনি জোর করে আমাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। অনেকদিন তিনি কলকাতার কোন লোকের সঙ্গে কথা বলেননি। প্রৌঢ়ের নাম নীলমাধব সিংহ, বাড়িটা বেশ ছিমছাম পরিষ্কার—জংলা মাঠের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গিয়ে বেশ নিরালার সাদা একতলা বাড়ি। গেটের সামনে সাদা পাথরে লেখা আছে, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’।

নীলমাধব সিংহের পূর্বপুরুষ একসময় বাংলাদেশের লোক ছিলেন, শ-খানেক বছর ধরে উড়িষ্যার ঐ ছোট্ট জায়গাটায় আছেন। নীলমাধবের পিতৃ-পিতামহ মারোয়াড়ি মহাজনদের মতন চাষীদের টাকা দাদন দিতেন, তারপর প্রচুর সুদে টাকা উসুল করে নিতেন। বংশানুক্রমিক এই ব্যাবসাই ছিল, নীলমাধব ওটাকে ঘৃণিত কাজ মনে ক’রে নিজে ঐ-পেশা পরিত্যাগ করেছেন। এখন তিনি কিছুই করেননা।

বাড়িতে দুটি মাত্র লোক, নীলমাধব আর তাঁর স্ত্রী— স্থূলাঙ্গিনী বর্ষীয়সী মহিলা —আমাকে দেখে খাতির করবার জন্য এমন হাঁসফাস করতে লাগলেন যে আমি বিব্রত বোধ করলাম খুব। আমাকে খাওয়াবার জন্য তক্ষুনি ভাত চড়িয়ে দিলেন, কোন আপত্তি শুনলেননা।

বাড়ির ভেতরটা ঝকঝকে, আসবাবপত্রগুলো বেশ পরিচ্ছন্নভাবে সাজানো, দেখলে বোঝা যায়, এই প্রৌঢ় দম্পতির অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল, কোন কিছুর অভাব নেই। বাড়িতে খবরের কাগজ আসেনা, নীলমাধব আমাকে জানালেন যে গত সাত-আট বছরের মধ্যে তিনি একদিনও কাগজ পড়েননি। তবে তাঁর ছেলে একটা ব্যাটারির, রেডিও পাঠিয়েছে, সেটাই তাঁর বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগের অবলম্বন।

আধঘণ্টার মধ্যে ওঁদের পারিবারিক ইতিহাস আমার শোনা হয়ে গেল। ওঁদের দুটি ছেলে একটি মেয়ে, সবারই বিয়ে হয়ে গেছে। একজন ছেলে দিল্লিতে চাকরি করেন, অন্যজন রাউরকেল্লায়, মেয়েটির বিয়ে দিয়েছেন একটি ওড়িয়া ছেলের সঙ্গে, তারা থাকে ভুবনেশ্বরে। দুই ছেলে এবং মেয়ে-জামাই কত পেড়াপিড়ি করেছে ওঁদের নিয়ে যাবার জন্য, কিন্তু ওঁরা আর কোথাও যেতে চাননা। শহরের হৈ-চৈ ওঁদের একদম পছন্দ হয়না—এই গ্রামের প্রতিটি পায়ে-চলা রাস্তা, প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি গাছ তাঁর চেনা—এসব ছেড়ে কোথাও যেতে চাননা। এখানকার মানুষজনও ঐ-দম্পতিকে খুব ভালোবাসে। নইলে, মাঠের মধ্যে ফাঁকা বাড়িতে বুড়ো-বুড়ি পড়ে রয়েছে, কোনোদিন তো চুরি-ডাকাতিও হয়না।

তারপরেই আমি একটা বিচিত্র ব্যাপার জানতে পারলাম। কাচের আলমারিতে বেশ-কিছু বই আছে, অধিকাংশ বই-ই রামায়ণ-মহাভারত-জাতীয়। সময় কাটাবার জন্য সেগুলোতে চোখ বোলাচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখলাম, আলমারির একটা তাক জুড়ে একটাই বইয়ের অনেকগুলি কপি। একখানা নিয়ে পাতা উল্টে দেখলাম, ‘মানুষই ভগবান’; লেখকের নাম ‘অধম সেবক’

আমার হাতে বইটি দেখে নীলমাধব একগাল হেসে বললেন, ‘ও বইটা আমারই লেখা। চোদ্দবছর আগে কটক থেকে ছাপিয়েছিলাম। জওহরলাল নেহরু, বিধান রায়, মদনমোহন মালব্য, মেঘনাদ সাহা, রাজাগোপাল আচারি—সবাইকে পাঠিয়েছিলাম একখানা করে। অনেকে সার্টিফিকেট দিয়েছে। তোমাকেও একটা দিচ্ছি—‘

যে-বই জওহরলাল নেহরু, বিধান রায় ইত্যাদি পেয়েছেন, সে-বই একখানি আমারও পাওয়া নিশ্চয়ই ভাগ্যের কথা। সেরকম কৃতার্থ মুখ করেই বইটা নিলাম। পাতাগুলো লালচে হয়ে গেছে, বড়-বড় ভাঙা টাইপে চৌষট্টি পাতার বই। আগাগোড়া পদ্য। লেখা খুবই কাঁচা, ভগবান মানুষ হয়ে জন্মায়না, মানুষই আসলে ভগবান—এই কথা প্রমাণ করা হয়েছে। প্রথম আরম্ভ এইরকম :

দেহধাম জেন ভাই পুণ্য দেবালয়
পরিচ্ছন্ন রাখিলে তাহে দেবতার অধিষ্ঠান হয়…।

দুলাইন পড়েই ভক্তিভরে বইটি রেখে দিচ্ছিলাম। তিনি বললেন, ‘পড়ো—না, পড়ো, এখনও তো খাবার দেবার দেরি আছে!’

প্রৌঢ়ের উদ্‌গ্রীব চোখের সামনে আমাকে বইটির সবকটি পৃষ্ঠা পড়তে হল। আসলে ফাঁকি দিয়েছি, সব পড়িনি—পড়া যায়না, পাতা উল্টে চোখ বুলিয়ে গেছি মাত্র। কাঁচা লেখা হোক, তবু বিস্ময়কর নিশ্চিত। কয়েক পুরুষ ধরে বাংলাদেশের বাইরে আছেন, তবু বাংলা ভুলে না-গিয়ে তার চর্চা রেখেছেন তো, সেটাই বা কম কী!

নীলমাধব বললেন, ‘আর-একখানা লিখছি। তুমি শুনবে একটু? এখানার নাম দিয়েছি ‘নব গীতা’। দেশের এই যে দুরবস্থা এই যে এত চাঞ্চল্য, তার কারণ মানুষ এই জন্মরহস্য, এই পৃথিবীর রহস্য ভুলে গেছে! মানুষকে এই মায়াময় জগতের কথা আবার স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। সবকিছুই যে পূৰ্বনির্দিষ্ট, মানুষ শুধু নিমিত্তমাত্র…’

প্রৌঢ়ের আশা, আর বছর পাঁচেকের মধ্যেই ‘নব গীতা’র রচনা তিনি শেষ করতে পারবেন। তারপর কটক কিংবা বালেশ্বর থেকে ছাপিয়ে বিলি করবেন বিনা পয়সায়। আবার পাঠাবেন ইন্দিরা গান্ধী, জ্যোতি বসু, মোরারজী দেশাই প্রভৃতিকে। এবং এই বই পড়ামাত্রই সবার মন বদলে যাবে, সব হানাহানি বিশৃঙ্খলা থেমে যাবে, মানুষে-মানুষে ভাই-ভাই হয়ে যাবে।

ধপধপে সাদা চালের ভাত খেলাম, সঙ্গে মুগের ডাল, বেগুন ভাজা, 2 বাড়িতে তৈরি ঘি। নীলমাধবের স্ত্রী ভারি যত্ন করে খাওয়ালেন। তারপর খাটের ওপর শীতলপাটি বিছিয়ে দিলেন আমার বিশ্রামের জন্য। আর নীলমাধব অন্য খাটে বসে খুলে ধরলেন চারখানি লাল খেরোর খাতা। আমাকে পড়ে শোনাতে লাগলেন তাঁর ‘নব গীতা’, ওঁর স্ত্রীও ভক্তিভরে শুনতে লাগলেন। আবেগে কেঁপে—কেঁপে উঠছে নীলমাধবের গলা, উৎসাহে জ্বলজ্বল করছে ছানি-পড়া চোখ।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় হলে এই দৃশ্যটি কত সুন্দর লিখতে পারতেন। আমি আর কী লিখব। আসল ব্যাপার যা হয়েছিল, শুনতে-শুনতে আমার দারুণ ঘুম পেয়ে যেতে লাগল। অথচ ঘুমিয়ে পড়াটা খুবই অভদ্রতা। আবার খাওয়ার পর এরকম শীতলপাটিতে বসে ঘুম আটকে রাখাও শক্ত। সিগারেট খেতে খুব ইচ্ছে করছে, কিন্তু এইরকম প্রৌঢ়-প্রৌঢ়ার সামনে চট করে পকেট থেকে সিগারেট বার করতে কিন্তু-কিন্তু লাগছে! এক-একবার ঢুলুনি আসছে, আর আমি নিজের পায়ে চিমটি কাটছি। জোর করে চোখ টান করে চেয়ে থাকার চেষ্টা করছি। ঘুমটা তাড়াতেই হবে, কেননা, ঐ কবিতার ভাষা যতই দুর্বল আর পুরোনো হোক—এই এক নির্জন গ্রামে একজন প্রৌঢ় একখানি বই লিখে দেশের সব কোলাহল অনাচার থামিয়ে দেবে—এই আশা, এই দৃঢ় বিশ্বাসের দৃশ্যটি সত্যিই দেখার মতন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *