নীললোহিতের চোখের সামনে – ২৬

২৬

এখন মেয়েদের যে গোল চশমা বেরিয়েছে, সেগুলো আমার পছন্দ হয়না। মস্ত বড় গোল-গোল ফ্রেমের সানগ্লাস আজকাল পথেঘাটে অনেকমেয়ের চোখে দেখতে পাই, সেগুলো দেখলেই আমার নাক কুঁচকে যায়।

স্বপ্না বলল, ‘ওরকম বিশ্রীভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?’

আমি বললাম, ‘কী করব বলো! আমার মুখখানাই যে বিশ্রী দেখতে। আমি তো আর চেষ্টা করলেও সুন্দর হতে পারিনা! কিন্তু তোমার মুখখানা তো সুন্দর, তুমি অমন বিচ্ছিরি চেহারা করেছ কেন মুখের?’

–কোথায়, বিচ্ছিরিটা আবার কোথায় দেখলেন?

–ঐ যে চোখে বিকট গোল সানগ্লাস পরেছ! খুলে ফ্যালো!

—এই চশমাটা বিচ্ছিরি! এটাই হচ্ছে লেটেস্ট গো-গো ব্যাপার। আপনার কোন টেস্ট নেই!

—এটা শুধু আমার টেস্টের ব্যাপার নয়। পৃথিবীর যাবতীয় কবি-সাহিত্যিক—শিল্পীদের টেস্টের ঠিক উল্টো! চিরকাল টানা-টানা চোখ বলতেই সুন্দর চোখ বুঝিয়েছে, যেমন পটল-চেরা চোখ কিংবা নদীর বাঁকের মতন ভুরু! তার বদলে ভুরু-টুরু সব ঢেকে একি বিশ্রী চশমা! কথাতেই বলে গোল-গোল চোখ মানেই বোকা-বোকা ব্যাপার, কিংবা শাকচুন্নীরা চোখ গোল-গোল করে তাকায়। ছবিতে দ্যাখনি, যত ভূত কিংবা শাকচুন্নী, আঁকা হয় সবারই চোখ গোল? আর তোমরা ইচ্ছে করে…

–যান যান, আপনি তো ভারি বোঝেন! আজকাল অন্যসব স্মার্ট ছেলেরা এইরকম সানগ্লাসই পছন্দ করে।

—আমি অবশ্য তেমন স্মার্ট নই। তবে ডুবে-ডুবে জল খেতে জানি ঠিকই, বুঝলে! আজকালকার ছেলেরা মেয়েদের খুব ভয় করে—মুখের ওপর একদম নিন্দে করতে পারেনা, মেয়েদের যা দেখে তাই প্রশংসা করে। কিন্তু ছেলেরা যখন আলাদাভাবে নিজেদের মধ্যে গল্প করে, তখন তোমাদের সম্পর্কে যা বলে, তা যদি কখনো শুনতে—

—কী বলে, কী বলে, বলুন-না!

—ইস, বলব কেন? ছেলেদের গোপন কথা তোমাদের জানিয়ে দেব কেন?

—যান বলতে হবেনা। আমরাও নিজেদের মধ্যে গল্প করার সময় ছেলেদের সম্পর্কে কী বলি, তাও আপনাকে বলবনা!

–সে তুমি না-বললেও আমি জানি।

—কী করে জানবেন? মেয়েরা কক্ষনো সেসব কথা ছেলেদের সামনে বলবেনা!

—না-বললেই-বা। লেখকরা তবু সব জেনে যায়। লেখকরা অন্তর্যামীর ছোট ভাই কিনা।

—আহা-হা, ভারি তো লেখক আপনি! সম্পাদকদের খোসামোদ করে-করে একটা-দুটো লেখা ছাপান! তাও কেউ পড়েনা!

–এই স্বপ্না, বাজে কথা বলবেনা! আচ্ছা দ্যাখো, মেয়েরা নিজেদের মধ্যে ছেলেদের সম্পর্কে কী রকম আলোচনা করে। আমি সব বলে দিচ্ছি! দ্যাখো, মেলে কিনা!

স্বপ্না পা থেকে চটিটা একবার খুলে আবার পরল। টেবিলের ওপর ছড়ানো আঁচলটা গুছিয়ে পিঠে রাখল, কালো চশমাটা খুলে ঝকঝকে চোখে তাকাল, একটা আঙুল থুতনিতে কায়দা করে ছুঁইয়ে বলল, ‘বলুন, শুনি!’

আমি সিগারেট ধরিয়ে বললাম, ‘মনে করো, তুমি আর গায়ত্রী হাজরা মোড় দিয়ে আসছিলে, এমন সময় বরুণ সরকারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল! তোমরা দুজনেই আগে বরুণকে দেখেছ, কিন্তু তোমরা ওকে ডাকলেনা—তুমি গায়ত্রীকে বললে, ঐ ছেলেটাকে দ্যাখ, পাশ থেকে বরুণের মতন দেখতে। গায়ত্রী বলল, মতন আবার কী, ও তো বরুণই! (তুমিও সেটা ভালোই জানো!) তুমি বললে, ও বোধহয় অমলের বাড়িতে গিয়েছিল—অমল তো এইদিকেই থাকে! গায়ত্ৰী বললে, তাই নাকি, অমলের বাড়ি বুঝি এখানে?

(গায়ত্রীও খুব ভালোভাবেই জানে যে অমলের বাড়ি মনোহরপুকুরে!) তারপর বরুণ ঠিক যেই তোমাদের দিকে তাকিয়েছে, অমনি তোমরা একটা হিন্দী সিনেমার পোস্টার খুব মন দিয়ে দেখতে লাগলে।

বরুণ তখন কাছে এগিয়ে এসে ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করল, এদিকে কোথায় যাচ্ছেন?

তোমরা উদাসীনভাবে বললে, এখানেই আমাদের এক বন্ধুর বাড়িতে এসেছিলাম! আপনি বুঝি এদিকেই থাকেন?

বরুণ হেসে বলল, না, আমিও আমার এক বন্ধুর বাড়িতেই যাচ্ছিলাম। যাক, আর যাবনা!

তোমাদের দুজনেরই জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল, কোন্ বন্ধুর বাড়ি? অমলের? কেননা তোমাদের দুজনেরই অমল সম্পর্কে বেশ ইন্টারেস্ট আছে! অমল দারুণ ব্রাইট ছেলে। যাইহোক, তোমরা মুখে সে-কথা বললেনা। গায়ত্রী জিজ্ঞেস করল, কেন, যাবেননা কেন?

বরুণ একটা মনোমতো কথা বলার সুযোগ পেয়ে গেল। সে পল নিউম্যানের মতন কাধ ঝাঁকিয়ে বলল, আপনাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল—এখন আর বন্ধুর বাড়িতে কে যায়! আপনারা এখন কোথায় যাবেন?

এরপর বরুণ অতি বাস্ততায় বেশ কয়েকটা উল্টোপাল্টা কথা বলে ফেলল। সে বলল যে, তোমরা যদি গড়িয়াহাটার দিকে যাও, তাহলে ও পৌঁছে দিতে পারে ওর গাড়িতে—ওদিকে ওর একটা দরকার আছে। তোমরা সেদিকে যেতে চাও না শুনে ও তোমাদের পার্ক স্ট্রিটে নিয়ে যাবার প্রস্তাব দিলে—ওখানে আরেক কোন্ বন্ধুর সঙ্গে ওর অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, একটা রেস্তোরাঁয়—তোমরা গেলে ও খুবই খুশি হবে।

গায়ত্রী সে-প্রস্তাবেও রাজি হলনা। যদিও পার্ক স্ট্রিট যাবার খুব অনিচ্ছা ছিলনা, কিন্তু ওর ধারণা প্রস্তাবটা দেবার সময় ও শুধু স্বপ্নার দিকে তাকিয়েই বলছিল! আর স্বপ্নাও রাজি হলনা। যদিও অনিচ্ছা ছিলনা তারও, কিন্তু সে ভাবল, আহা, অন্যসময় তো ছন্দাকে দেখলেই বরুণ একেবারে গদগদ হয়ে পড়ে। আর এখন—।

খানিকটা নিরাশ হয়ে গেলেও বরুণ হাল ছাড়লনা। আরও কিছুক্ষণ ঝুলোঝুলি করল, আর তোমরা দুজনেই খুব হাসতে-হাসতে ওকে প্রত্যাখ্যান করলে। তারপর বরুণ তোমাদের কোকাকোলা খাইয়ে বিদায় নিল—তোমরা দুজনেই লক্ষ রাখলে, ও অমলের বাড়ি যায় কিনা। কারণ, বরুণ যদি তোমাদের অমলের বাড়ি নিয়ে যাবার কথা বলত, তোমরা তক্ষুণি রাজি হতে।

বরুণ চলে যাবার পর, গায়ত্রী বলল, শুধু-শুধু অনেকটা, দেরি হয়ে গেল!

তুমি বললে, সত্যিই, মা আজ বলেছিল, তাড়াতাড়ি ফিরতে। আসলে, তোমাদের দুজনের কারুরই বরুণের সঙ্গে কথা বলতে এবং ওর আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করতে খারাপ লাগেনি। বরুণ যদি আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে তোমাদের কাছে কাকুতি-মিনতি করত, তাও তোমরা বিরক্ত হতে না। ছেলেদের অনুরোধ কিংবা আবেদন উপেক্ষা করতে মেয়েরা খুব ভালোবাসে। আবার ছেলেরা সবসময় নানা অনুরোধ না-করলেও মেয়েরা চটে যায়।

যাইহোক, একটুক্ষণ তোমরা দুজনেই অন্যকথা বলার পর, গায়ত্রী বলল, বরুণ ছেলেটা কিন্তু এমনিতে বেশ স্মার্ট, না-রে?

তুমি তখন বললে, হ্যাঁ, কাঁধ দুটো বেশ চওড়া। ক্রিকেট খেলে তো— অর্থাৎ, গায়ত্রী বরুণের দুটো প্রশংসা করার পর তুমিও দুটো প্রশংসা করলে! তারপর যখন তোমার মনে হল, গায়ত্রী একটু বেশি বেশি প্রশংসা করছে, তখন তুমি বললে, তবে যাই বলিস, ওর হাসিটা একটু ক্যাবলা-ক্যাবলা।

(বরুণের ধারণা, তাকে পল নিউম্যানের মতন দেখতে।)

গায়ত্রী তখন বলল, তাকানোটাও কীরকম কীরকম যেন! মাঝে-মাঝে বড্ড ন্যাকা হয়ে যায়!

অর্থাৎ ওর দুটো নিন্দে করার পর গায়ত্রীও দুটো নিন্দে করে ফেলল। এবং কী করে যেন অমলের সঙ্গে ওর একটা তুলনা এসেই গেল। আর অমলের তুলনায় বরুণ যে কিছুইনা—’

স্বপ্না অনেকক্ষণ ধরেই আমার কথায় ফুলে-ফুলে হাসছিল, এবার হো-হো করে হেসে বলল, ‘একদম গল্প! কিছু মেলেনা। মেয়েরা কক্ষনো এরকম করে কথা বলেনা। আপনারা কিছু জানেননা, শোনেননা, শুধু বানিয়ে-বানিয়ে লেখেন।’

আমি বললাম, ‘মেয়েদের আর-একটা দুর্বলতা এই, তারা নিজেদের সম্পর্কে সত্যি কথা শুনলে একদম মানতে চায়না! যাক গে, এবার শোনো, ছেলেরা যখন নিজেরা শুধু থাকে, তখন কী রকম কথা বলে।’

–থাক, সে আর বলতে হবেনা। সে আমাদের ভালোই জানা আছে। ছেলেরা খুব অসভ্য হয়।

-সব ছেলেই অসভ্য? তুমিও কিছু জানোনা। তোমাকে একটা সত্যি কথা বলি, ছেলেরা যখন শুধু নিজেরা থাকে, তখন মেয়েদের কথা একদম বলেইনা! তাদের নিজস্ব কত কথা আছে, রাজনীতি, স্পোর্টস, দেশের অবস্থা, শিল্প-সাহিত্য—এইসব, মেয়েদের কথা বলে সময় নষ্ট করতে যাবে কেন?

-থামুন, থামুন! ঢের জানা আছে! সব হ্যাংলা এক-একটা—

—সত্যি বলেছি, ছেলেরা নিজেদের মধ্যে মেয়েদের কথা একদম বলেনা। গোপন রাখে। যদি-বা বলে, তাও এলিজাবেথ টেলর কিংবা ইন্দিরা গান্ধী কিংবা ভার্জিনিয়া উলফ—এইসব বিখ্যাত নারীদের কথা—অথবা রাস্তায় সম্পূর্ণ কোন অচেনা মেয়ে দেখলে তার সম্পর্কে—কিন্তু নিজেদের চেনা মেয়েদের সম্পর্কে কোন কথাই বলে না কখনো। নেহাত দু-চারটে বোকা ছেলে আছে অবশ্য, তারা ছাড়া—

-আপনি নিজেকে খুব চালাক ভাবেন, না?

—আর-একটা কথা শোনো। ছেলেদের বান্ধবীরা যখন খুব সাজগোজ করে আসে, লেটেস্ট ফ্যাশান নিয়ে আলোচনা করে—তখন তারা একটা খুশির ভাব দেখায় বটে, কিন্তু মনে-মনে তারা অন্য একটি মেয়ের স্বপ্ন দেখে। প্রত্যেক ছেলেই সেইরকম একটি মেয়েকে ভালোবাসতে চায়—যে মোটামুটি সুন্দরী তো হবে নিশ্চয়ই, কিন্তু যার মধ্যে কোন ন্যাকামি থাকবেনা, যে কখনো শাড়ি-গয়নার জন্যে লোভ করবেনা, যে ছেলেদের সঙ্গে সবরকম অবস্থায় মানিয়ে নিতে পারবে, যদি কখনো দুঃখ-কষ্ট আসে, রোদ-ঝড়-জলেও সেই মেয়েটি হাসিমুখে তার পাশে থাকবে—আবার আনন্দ কিংবা সুখের সময়েও—। অবশ্য এরকম মেয়ের দেখা সে কখনো পাবেনা, তাও জানে। তোমরা মেয়েরা নানারকম শাড়ি-গয়নার ডিজাইন আর গোল কালো চশমা আর লেটেস্ট হেয়ার ডু করে, পুরুষদের ভোলাতে চাইছ, অথচ পুরুষরা মনে-মনে ভালোবাসে একটি নিরাভরণ, নিরভিমান সুন্দরী মেয়েকে।

স্বপ্না দর্পের সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, বেশ করব, এই গোল চশমা পরব। আপনাদের পছন্দে-অপছন্দে আমাদের কিছু যায় আসেনা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *