নীললোহিতের চোখের সামনে – ২৫

২৫

কলেজ স্ট্রিটের রেলিং-দোকান থেকে একটা বই কিনে ফেললাম। অনেক দরাদরি করেও ষাট পয়সার কমে নামাতে পারলামনা, একটা আধুলি ও দশ পয়সার বিনিময়ে বইটি আমার হস্তগত হল।

বইটার আসল দামই বারোআনা। কিন্তু আমি অনেকক্ষণ ধরে বইটা নাড়াচাড়া করছিলাম বলে দোকানদার আমার উৎসাহ টের পেয়ে গিয়েছে। বইটার মলাট ছেঁড়া, পাতাগুলো হলদে আর মুড়মুড়ে, ছাপা হয়েছে আঠারোশ’ একাশি সালে।

বইটার নাম মাধব ও ললিতা, লেখকের নাম নিত্যানন্দ শাস্ত্রী। এ-বইয়ের নাম আমি আগে কখনো শুনিনি। গবেষক-টবেষক হবার মতন বিদ্যে আমার নেই, পুরোনো বইয়ের সাল-তারিখ আর ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা আমার স্বভাব নয়। তবে মাঝে-মাঝে জীবনটা একঘেয়ে লাগলে দু-একটা বেশ পুরোনো ধরনের বই পড়ে খানিকটা মুখ বদলাতে ভালো লাগে। সে-বইয়ের সাহিত্যমূল্যের জন্যে নয়—পুরোনো কালের আবহাওয়া, মানুষের স্বভাব-চরিত্রের কথা বেশ আকর্ষণ করে।

কিন্তু এ-বইটা আমি কিনলাম আর-একটি কারণে। বইটাতে বহুকাল আগের বিবর্ণ কালিতে নানারকম মন্তব্য লেখা আছে—সেগুলো থেকেও আর-একটা কাহিনীর আভাস ফুটে ওঠে। আগেকার দিনে গয়নার বাক্সে যেমন একটা বাক্সের মধ্যে আর-একটা বাক্স থাকত—এটাও সেরকম, উপন্যাসের মধ্যে উপন্যাস।

বইখানা একটা গ্রাম্য প্রেমের কাহিনী। এই বইখানা যে সাহিত্যের ইতিহাসে স্থান পায়নি, তাতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। ভাষা খুবই দুর্বল, বঙ্কিমবাবুর ব্যর্থ অনুকরণ। কিন্তু উননব্বই বছর আগে প্রকাশিত বই তো আর সাহিত্য—সমালোচকের মন দিয়ে পড়া যায়না। কাঁচা-কাঁচা ভাষায় সেকালের জীবনের কথা পড়তে বেশ ভালোই লাগে, ঘটনাগুলো সত্যিই মনে হয়। লেখক নিত্যানন্দ শাস্ত্রীমশাই স্বয়ং ব্রাহ্মণ হয়েও সেকালের পক্ষে রীতিমতন সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। বামুনের ছেলে আর তাঁতির মেয়ের প্রেম।

পরম শাস্ত্রজ্ঞ বংশের ছেলে মাধবকুমার ছেলেবেলা থেকেই খুব দুরন্ত; নদীর পারে, শ্মশানে, সে একা-একা ঘুরে বেড়ায়, তাঁতি-জেলে-কামার-কুমোরদের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব। তাঁতির বাড়ির মেয়ে ললিতার সঙ্গে সে খেলা করে, ঝগড়া করে —দুজনের বয়েস তখন যথাক্রমে এগারো ও নয়। তারপর মাধবকুমারকে পাঠানো হল বারাণসীতে—কিন্তু সেখানে গিয়ে শাস্ত্রপাঠে তার মন বসেনা, সর্বক্ষণ মনে পড়ে ললিতার কথা ‘বারাণসীর গঙ্গার তরঙ্গেও সে শুনিতে পায় ললিতার হাস্যধ্বনি। এই গঙ্গাই তো তাহাদের গ্রামের পার্শ্ব দিয়া বাহিয়া যাইতেছে।’

যাইহোক, মাধবকুমার তো একদিন খুব পণ্ডিত হয়ে অনেক টাকাপয়সা উপার্জন করে গ্রামে ফিরে এল—কিন্তু ততদিনে ললিতার বিয়ে হয়ে গেছে এবং বিধবা হয়েছে। মাধবকুমার তখন যেদিকে তাকায় সেদিকেই শ্মশান দেখে। কোন শাস্ত্রই তাকে সান্ত্বনা দিতে পারেনা! সমাজের এইসব বন্ধন যারা সৃষ্টি করেছে, তাদের উদ্দেশ্যে অভিশাপ দিতে ইচ্ছে হয়!

লেখক এই পর্যন্ত খুব সাহস দেখিয়েছেন অবশ্য। কিন্তু সেসময় বিদ্যাসাগর মশাই বিধবাবিবাহ আইন পাশ করালেও মাধব আর ললিতার বিয়ে দিতে সাহস পাননি! কারণ, তখন বিধবা বিয়ে হলেও—ব্রাহ্মণী বিধবার সঙ্গেই ব্রাহ্মণের ছেলের বিয়ে হতো। লেখক শেষপর্যন্ত ললিতাকে খ্রিস্টানী করে দিলেন, সে চলে গেল আসামে—আর মাধবকুমার বিবাগী হয়ে গেল। শেষের দিকে খুব একটা দার্শনিক তত্ত্ব দেওয়া আছে।

এই তো গেল আসল বইয়ের গল্প। বইখানা আঠারোশ’ বিরাশি সালে একজন কেউ কিনে আর-একজনকে উপহার দিয়েছিল। একজন পুরুষ যে একজন নারীকে উপহার দিয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কেন সন্দেহ নেই, তা পরে বলছি। শুধু লেখা আছে হে-কে বি। অর্থাৎ হে-নাম্নী কারুকে উপহার দিয়েছেন বি। রবীন্দ্রনাথও হে-নাম্নী নারীকে তাঁর বই উৎসর্গ করেছিলেন। এখানে ‘হে’ হয়তো হেমাঙ্গিনী বা হেমনলিনী বা হেমপ্রভা—এর থেকে বেশি আধুনিক নাম তখনকার পক্ষে ভাবা যায়না! আর ‘বি’ নিশ্চয়ই বিনোদবিহারী বা বিশ্বনাথ বা বিশ্বেশ্বর। বিকাশকান্তি বা বিভাসকুমার যদি হয় তো খুবই আধুনিক বলতে হবে! যাইহোক, আমি নারীটির নাম মনে-মনে বেছে নিলাম হেমপ্রভা এবং পুরুষটি বিশ্বেশ্বর!

উপহারের তলায় পুরুষ হস্তাক্ষরে লেখা, ‘এই বইটি শুধু তুমিই পড়িবে। ইহা শুধু তোমার একার।’ একথা লেখার মানে কী? বই কি কখনো একার জন্য হয়! তাছাড়া ‘মাধব ও ললিতা’ এমন কিছু একটা আহামরি বই নয়, কবিতার বইও নয় যে সেটাকে যত্ন করে লুকিয়ে রাখতে হবে।

আমি গোয়েন্দাগিরি শুরু করলাম। প্রথমেই লক্ষ করলাম, টাইটল পেজের এক কোণে লেখা আছে, ‘পৃষ্ঠা ৯৭’। বইটি মোট দেড়শো পাতা, তাহলে ৯৭ পৃষ্ঠাটির বিশেষত্ব কী? খুললাম। ৯৭ পৃষ্ঠায় পাঁচ-ছটি লাইনের তলায় লাল কালির দাগ দেওয়া! মার্জিনে সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, ‘লেখকরা যাদুকর!’ লাইনগুলি এই :

‘কোন বাক্য বিনিময় হইল না! মাধব ললিতার দিকে কয়েক পলক নির্নিমেষ চাহিয়া রহিল। ললিতা তখন অলিন্দে একটি রক্তবর্ণ ভিজা শাড়ি মেলিতেছিল, মাধবের দিকে চাহিয়াই চক্ষু নামাইয়া লইল, আবার চাহিল। সেই দু-এক পলকেই বহু কথা নিঃশব্দে উড়িয়া গেল বাতাসে—সেই কথা শুধু হৃদয় হইতে হৃদয়ে পৌঁছায়। আশ্বিন মাসের সেই সকালটি অনন্ত মুহূর্ত হইয়া দাগিয়া রহিল মাধবের বুকে।

ও হরি, এটা আসলে একটা অভিনব প্রেমপত্র। আমাদের এই বিশ্বেশ্বরবাবু ১৮৮২ সালে হেমপ্রভাকে চিঠি লেখার বদলে বইয়ের কয়েকটা লাইনে দাগ দিয়ে পাঠিয়েছিলেন! নিশ্চয়ই কোন আশ্বিনের সকালে তিনি হেমপ্রভাকে দেখেছিলেন লাল শাড়ি শুকোতে দিতে। চোখাচোখিও হয়েছিল—এবং দৈবাৎ এই বইতে সেরকম বর্ণনা পেয়ে চিঠির বদলে বইটাই দিয়েছিলেন। নিশ্চয়ই দুজনের জাতের মিল ছিলনা। তবে অতকাল আগে হেমপ্রভা বই পড়তে জানতেন—এটা বেশ আশ্চর্যের ব্যাপার, ব্রাহ্ম মেয়ে ছিলেন বোধহয়।

আরও আছে। হেমপ্রভা শুধু পড়তে জানতেননা লিখতেও পারতেন। মুক্তোর মতন ঝকঝকে হাতের লেখা। বইয়ের একেবারে শেষে। সাদা পাতায় স্পষ্ট মেয়েলি হাতের লেখা রয়েছে কয়েক লাইন। নিশ্চয়ই হেমপ্রভার লেখা। সম্ভবত বইটি তিনি বিশ্বেশ্বরকে ফেরত দিয়েছিলেন। চিঠি চালাচালির বদলে বই আদানপ্রদান অনেক সুবিধেজনক, অন্তত সেকালে ছিল! হেমপ্রভা লিখেছেন :

‘না, পুরুষ লেখকরা নারীর অন্তরের সমস্ত দুঃখ বেদনার কথা সম্যক বুঝিতে পারেনা। মাধব যেদিন উন্মাদের মতন ললিতার পিতার গৃহে ছুটিয়া আসিয়াছিল, সেদিন ললিতা তাহার দরজা খোলে নাই, ঘরের বাহির হয় নাই। মাধব তাহাকে বিশ্বাসঘাতিনী ভাবিয়া ফিরিয়া গেল। ছাই বুঝিয়াছ লেখক! তাহার কলমের মুখে চুনকালি! জানে না যে প্রাণের বিনিময়েও নারী তাহার দয়িতের সম্মান নষ্ট হইতে দেয়না। আমি শত দুঃখ সহিতে পারি—দুঃখ সহার ক্ষমতা নারীর জন্মগত—কিন্তু তোমাকে কোনো দুঃখ বা অসম্মান ভোগ করিতে দিবনা!

বাঃ, হেমপ্রভার কলমের তো বেশ ধার ছিল! অনায়াসেই লেখিকা হতে পারতেন। বোঝাই যাচ্ছে বিশ্বেশ্বরবাবু একদিন দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে হেমপ্রভাদের বাড়িতে এসেছিলেন—সেদিন হেমপ্রভা তাঁর সঙ্গে দেখা করেননি। সেই কি শেষ দেখা? শেষ পর্যন্ত বিয়ে হয়েছিল ওদের! সেটা আর জানা গেলনা। ৫৫ পৃষ্ঠাতেও দুটি লাইনের তলায় দাগদেওয়া। সেটা ওদের দুজনের মধ্যে কে দাগ দিয়েছে ঠিক নেই। ‘একবার ভাবিল মরিব। পরক্ষণেই আবার ভাবিল, না। মরিলে তো আর ও মুখ ধ্যান করিতে পারিবনা!’

বয়েসের হিশেব করলে বিশ্বেশ্বর আর হেমপ্রভা আমার ঠাকুর্দা আর ঠাকুমার চেয়েও বয়েসে বড়। এতদিন তাদের বেঁচে থাকার কথা নয়। তবু তাদের যৌবন কালের প্রণয়ের সৌরভ আমাকে ছুঁয়ে গেল। এরকম বইখানা ওদের কোন বংশধর সের দরে বেচে দিয়েছে! কী খেয়াল হল, বইটার শেষে আমি লিখলাম, ‘হে মাধব ও ললিতা, হে বিশ্বেশ্বর ও হেমপ্রভা, স্বর্গে কি তোমাদের দেখা হয়েছে? অমরলোকে কি মিলন হয়েছে, মিটেছে অতৃপ্ত বাসনা? ভালোবাসার মধ্যে ভুল বোঝাবুঝিটাই বড় সাংঘাতিক। আশা করি স্বর্গে ভুল বোঝাবুঝি নেই! জাতিভেদও নেই সেখানে।’

লেখকরা লেখে ভবিষ্যৎকালের পাঠকদের জন্য, আমি লিখলাম অতীতকালের উদ্দেশ্যে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *