২৪
এমনিতে আমার কোন চোখের দোষ নেই, কিন্তু মাঝে-মাঝে লোকে আমাকে ট্যারা বলে। মাঝে-মাঝে অর্থাৎ আমার চোখের দিকে কেউ চোখ রেখে তাকালে কোন খুঁত পাবেনা, বেশ গোল-গোল নিরীহ ধরনের চোখ, চোখের মণি যেখানে থাকার কথা সেইখানেই থাকে, ট্যারা বলে চেনার কোন উপায় নেই। কিন্তু মাঝে-মাঝে, একটু অমনোযোগী হলেই আমার চোখের তারাদুটো পাশের দিকে অদ্ভুতভাবে বেঁকে যায়, ঘাড়টাও একটু কাৎ হয়ে আসে। কোন অদ্ভুত বা বিস্ময়কর ব্যাপার দেখে যে আমার চোখ ট্যারা হয়ে যায়, তা কিন্তু নয়, যে-কোন সময়েই এরকম হতে পারে। অর্থাৎ আমার সামনে হয়তো কোন রূপসী যুবতী, কিন্তু আমার মুখ দেখলে মনে হবে, আমি তখন দেয়ালের পোস্টার পড়ছি মন দিয়ে। কিংবা রাস্তা পার হবার সময় পাশ দিয়ে ছুটে আসা ভয়ংকর ট্রাকটিকে লক্ষ্য করছি মনোযোগ দিয়ে, কিন্তু লোকের ধারণা, আমি নাকি তখন রাস্তার ওপারের কোন গজেন্দ্রগামিনীর দিকে তাকিয়ে বিমোহিত হয়ে আছি। অনেকসময় পাশের কোন লোক আমার হাত চেপে ধরে আর্তকণ্ঠে সাবধান করেছেন, ‘কী করছেন! মরবেন নাকি’ কী অর্থে তাঁরা মরার কথা বলেন, আমি বুঝতেই পারিনা।
মোট কথা, আমার চোখের তারার এইরকম খেয়ালী পাগলামি নিয়ে আমি ছেলেবেলা থেকেই মনঃকষ্টে আছি। বন্ধুবান্ধবরা সান্ত্বনা দিয়ে বলেছে, ও কিছু নয়, তুই একটু লক্ষ্মীট্যারা! লক্ষ্মীট্যারা কথাটা শুনতে খারাপ নয়, ওটা আমার খুব অপছন্দ নয়, কিন্তু অচেনা লোকেরা ভাবে, ওরকম করা আমার বদমাইসী! কেননা, ট্যারা লোকদের চোখ দেখলেই বোঝা যায়, আমার চোখ দেখে কিছুই বোঝার উপায় নেই, আমার চোখ দেখে বড়জোর কেউ বলতে পারে গোরুর মতন ড্যাবডেবে কিংবা ইঁদুরের মতন কুচো-কুচো কিংবা ভেড়ার মতন বোকা-বোকা (আকালে নিভৃতে যে-দু-একজন একেবারেই প্রশংসা করেনি, তাও অবশ্য নয়) —কিন্তু ট্যারা কেউ বলবেনা। কিন্তু সম্পূর্ণ আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেই, মাঝে-মাঝে হঠাৎ আমার চোখের তারা দুটো কোণের দিকে চলে যায়, ঘাড়টা বেঁকে যায়, তখন আমার কিছুই খেয়াল থাকেনা, কিন্তু অন্য লোকে ভাবে আমি টেরিয়ে তাকাচ্ছি। হয়তো গভীর মনোযোগ দিয়ে সিনেমা দেখছি, হঠাৎ অন্ধকারে পাশের দম্পতির কাছ থেকে কথা ভেসে আসে আমার উদ্দেশ্যে, লোকটা কী অসভ্য, সিনেমা না-দেখে আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে! আমি লজ্জিত হয়ে চমকে সোজা হয়ে বসি, ওঁদের তো বোঝানো যায়না যে, আমার ঘাড়টা ওঁদের দিকে বেঁকে গেলেও চোখের মণি দুটো আছে সিনেমার পর্দাতেই! একথা মুখে বলা যায়না, সেইসঙ্গে অবশ্য একথাও বুঝতে পারিনা, ওঁরাই-বা সিনেমার পর্দার দিকে না-তাকিয়ে আমার দিকে তাকালেন কেন! অথবা কোন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি হয়তো আমাকে কোন উপদেশ দিচ্ছেন, আমি খুবই আন্তরিকভাবে শুনছি, হঠাৎ তিনি ধমকে উঠলেন, কী, কথা গ্রাহ্যই হচ্ছেনা! অন্যদিকে তাকিয়ে থাকা হচ্ছে!— কলেজে পড়ার সময় যে এইরকম বকুনি কত খেয়েছি। বিনাদোষে আমার এই বকুনি খাওয়া
আমার এই দোষের কারণ সম্পর্কে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি। ডাক্তাররা কিছু বলতে পারেননা। আমার বাড়িতে একটা কথা শুনেছি, জানিনা সেটা কতখানি বিশ্বাসযোগ্য। শুনেছি, আমার জন্মের পর, আমার যিনি ধাত্রী বা ধাইমা ছিলেন, তিনি ছিলেন ট্যারা। জন্মের পর বেশ কয়েকবছর আমি তাঁর কোলেই মানুষ হয়েছি এবং আমি তাঁর মতন নকল করে তাকাবার চেষ্টা করতাম। ছেলেবেলা সেই ট্যারা ধাইমাকে নকল করা থেকেই নাকি আমার এই সাময়িক ট্যারা-দৃষ্টির অভ্যেস হয়ে গেছে। অনেক শিশু যেমন লম্বা কবিতা আবৃত্তি করে কিংবা দাঁত ওঠার আগেই রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে কিংবা ভালো করে দাঁড়াতে শেখার আগেই টুইস্ট নেচে কিংবা বেড়ালের ইংরেজি বলতে পেরে প্রতিভার স্ফুরণ ঘটায় ও বাপ-মায়ের মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত করে, আমারও তেমনি প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল—তিনবছর বয়েসেই আমি ট্যারা ধাইমার নকল করতে পারতাম, অবিকল তার মতন তাকাতে পারতাম লোকজনের অনুরোধে, সবাই তাই দেখে হাততালি দিতেন।
কিন্তু ছেলেবেলায় যা ছিল আমার প্রতিভার প্রকাশ, এখন সেই জিনিশই আমার প্রতিভার সমস্ত পথ আটকে রেখেছে। সোজাভাবে দেখতে না-পারা, সামনে তাকিয়ে পাশের জিনিশ দেখা, কিংবা পাশে তাকিয়ে সামনে দেখা—এই গোলমালই মনে হয়, আমার সমস্ত দুর্ভাগ্যের মূল কারণ। সে-কথা যাকগে, আমার এই সাময়িক ট্যারাত্ব কাটাবার আমি বহু চেষ্টা করেছি, পারিনি, একটু অন্যমনস্ক হলেই দেখেছি—সব ভুল হয়ে যাচ্ছে আমার। সুতরাং ভেবেছিলাম, চোখ দুটোকে ঢেকে রাখলে কেমন হয়। অর্থাৎ চশমা। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার এমনই প্রবল যে, হাজার চেষ্টা করেও চশমা নিতে পারিনি। চোখ দুটো আমার যতই দেখতে খারাপ হোক, আমার দৃষ্টিশক্তি সত্যিই খুব জোরালো। রাস্তায় বাস আসতে দেরি হলে শ্যামবাজারে দাঁড়িয়ে বন্ধুবান্ধবরা আমাকে অনুরোধ করে দ্যাখ তো, বালিগঞ্জ থেকে বাস ছাড়ল কিনা!—রামায়ণের যুগে জন্মালে আমার ধারণা, হনুমানের দরকার হতোনা, কন্যাকুমারিকায় দাঁড়িয়েই আমি অনায়াসে লঙ্কার অশোকবনে বন্দিনী সীতাকে দেখতে পেতাম। সুতরাং চোখের ডাক্তারের কাছে আমার কোন সুবিধে হয়নি, উল্টোপাল্টা এ বি সি ডি চার্টের একেবারে নিচে লেখা প্রিন্টেড অ্যাট ক্যালকাটা—তাও পড়ে দিয়েছিলাম বলে তিনি চোখ রাঙিয়ে আমাকে নিষেধ করে দিয়েছিলেন, যাতে আর কোনদিন তাঁর মূল্যবান সময় আমি নষ্ট না-করি!
হঠাৎ একদিন একটা সুযোগ এসে গেল। একদিন বাড়ি ফিরে দেখি, আমার মায়ের কাছে একজন বেশ বুড়ি মতন মহিলা বসে আছেন। বেশ পুষ্ট চেহারার বিধবা, নির্ভেজাল বাঙাল ভাষায় ঘর ভর্তি করে রেখেছেন। মা বললেন, একে চিনতে পারিস! এ হচ্ছে বিলুর মা, এ তোকে ছেলেবেলায় মানুষ করেছিল। শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এই সেই, এই সেই আমার ছেলেবেলার ধাত্রী? আমার ওঁকে চিনতে পারার কথা নয়। আমি ওঁকে দেখছি অন্তত পঁচিশ বছর বাদে। জন্মেছিলাম পুববাংলার এক গ্রামে, সেই গ্রামের, মাটির কথা এখনো মনে আছে, কিন্তু মানুষজন সব আবছা হয়ে গেছে।
শুনলাম, আমার ধাত্রী, অর্থাৎ, বিলুর মা, পাকিস্তান হবার পরও পুববাংলায় ছিলেন, বছর পাঁচেক আগে মাত্র রিফিউজি হয়ে এসেছেন, আছেন রানাঘাটের এক কলোনিতে। সত্তরের বেশি বয়েস, শরীর এখনো ভাঙেনি, কিন্তু চোখ দুটো নষ্ট হয়ে গেছে প্রায়, চোখে প্রায় কিছুই দেখতে পাননা।
চোখ দুটো নষ্ট হয়ে গেছে শুনে আমি দমে গেলাম। ওঁর কথা শোনা মাত্রই আমার মনে হয়েছিল ওঁর ট্যারা চোখের দিকে তাকিয়ে একবার মিলিয়ে নিতে হবে তো! ছেলেবেলার সেইসব কথা সত্যি কিনা! কিংবা ওঁর চোখের সামনে যদি আবার নকল করা শুরু করি, তবে এবার উল্টো ফলও হতে পারে এখন, আমার দোষ কেটে যেতে পারে! কিন্তু বিলুর মা এখন অন্ধ। ওঁর চোখের দিকে তাকিয়ে এখন আমার চোখ কী দেখবে?
বিলুর মা এসেছেন সাহায্য চাইতে। বাচ্চা নাতির হাত ধরে, খোঁজ করতে—করতে এসেছেন আমাদের বাড়িতে। মা একটা কাপড় আর কয়েকটা টাকা দিয়ে দায় মেটালেন।
বিলুর মা আমাকে একেবারে আদরে আদরে অস্থির করে তুললেন। আমার গায়েমাথায় হাত বুলিয়ে বিস্ময়ে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলতে লাগলেন, ‘সেই দুধের বাচ্চা এখন এত বড় হয়ে গেছে? অ্যাঁ? এ যে ডাঙর জোয়ান! অ্যা? আমার বুকের দুধ খাইয়েছি ওকে, সেই দুধের শিশু আজ এত বড়? অ্যাঁ?’ আমি খানিকটা অভিভূত হয়ে পড়ছিলাম বটে, কিন্তু একজন শহুরে আধুনিক যুবকের পক্ষে এইরকম নোংরা কাপড়-পরা বুড়ির হাত ছোঁয়া আদরে যতখানি অস্বস্তি প্ৰকাশ করা উচিত, তাও করছিলাম।
বিলুর মা আমাকে একটা অনুরোধ করে বসলেন। বললেন, ‘তোদের এত চেনাশুনো, আমার চোখের একটু চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিতে পারিস? গত পাঁচবছর ধরে চোখের এই অবস্থা। কলকাতা শহরে এলাম, অথচ কলকাতা শহর যে কী জিনিশ, চোখ মেলে দেখতে পারলামনা। ও আমার সোনা, ও আমার মণি, একটু ব্যবস্থা করে দিবি? বড় ইচ্ছে করে মরার আগে একবার চোখ মেলে দেখে যাই। দিবি?’
এই বৃদ্ধা সম্পর্কে কোন স্মৃতিই আমার মনে নেই, একেবারেই অচেনা লাগছে। কিন্তু, ওঁর বুকের দুধ খেয়েছিলাম—সেই কথা শুনে আমার বুকের মধ্যে একবার মুচড়ে উঠল। চোখের চিকিৎসা করা কি সহজ কথা? কত টাকা খরচ হবে, কোথায় কী ব্যবস্থা করতে হবে কিছু জানিনা, তবু মুখে না উচ্চারণ করতে পারলামনা, বললাম, ‘আচ্ছা, আমি ব্যবস্থা করে দেব, তোমার চোখ ভালো হয়ে যাবে!’ বিলুর মা আমার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করতে লাগলেন।
কোথায় আমার নিজের চোখ ভালো করার কথা, তার বদলে যাঁর কাছ থেকে আমি চোখ-ট্যারা রোগ পেয়েছি, তাঁর চোখ ভালো করার চেষ্টাতেই আমাকে ব্যস্ত হতে হল। বিলুর মা মাঝে-মাঝেই নাতির হাত ধরে আমাদের বাড়ি আসা শুরু করলেন। আমিও বন্ধুর মামা, কলিগের কাকা, প্রতিবেশীর শ্বশুর—ইত্যাদিদের ধরাধরি করে এক চোখের হাসপাতালে সীট জোগাড় করে ফেললাম, প্রায় *বিনাপয়সাতেই বিলুর মার চিকিৎসার ব্যবস্থা হল। ওঁর স্বাস্থ্য তখনো ভালো, চিকিৎসায় সুফলের আশাও পাওয়া গেল। প্রথমে ডাক্তাররা ওঁর দাঁতগুলো তুলে ফেললেন, মুখখানা তো ফোকলা হয়ে চুপসে গেল, তারপর চোখ অপারেশন হবে!
সেই সময় বিশেষ কাজে আমাকে যেতে হয় উড়িষ্যায়। মাসখানেক বাদে ফিরলাম, যথারীতি এই মাসখানেক আমার অন্যান্য বিষয় নিয়ে এত কিছু ভাবার ছিল যে, বিলুর মার বিষয়ে ভাবার সময় পাইনি। হঠাৎ একদিন বিলুর মা-কে আমাদের বাড়িতে দেখলাম। বুড়ি নিষ্পলক এক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, অন্য চোখটি তুলোর প্যাড দিয়ে ঢাকা। অপারেশন সার্থক হয়নি, আগে তিনি দুটি চোখেই সামান্য ঝাপসা দেখতে পেতেন, একটা চোখ অপারেশন করার পর সে-চোখটা একেবারে অন্ধ হয়ে যায়। বাকি চোখটা ডাক্তাররা আর অপারেশন করতে ভরসা পাননি। দয়াবশত ডাক্তাররা ওঁর অন্ধ চোখটায় একটা পাথরের চোখ বসিয়ে দিয়েছেন। সেই পাথরের চোখ নিষ্পলক।
বাকি চোখটা থেকে তুলোর প্যাড সরিয়ে অতিশয় ঝাপসাভাবে তাকিয়ে বুড়ি বললেন, ‘আমার আর কলকাতা শহর দেখা হলনা। তাতে কী! তুই তো চেষ্টা করিছিলি! বেঁচে থাকো, সুখে থাকো, রাজা হও, মানিক আমার, আহা, সেই দুধের ছেলে আজ কত বড়, আহা’—বুড়ির ঝাপসা চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল।
খেয়াল করিনি, কখন আমার চোখের মণি দুটো কোণের দিকে সরে গেছে, ঘাড় বেঁকে গেছে। আমি অন্য দিকে তাকিয়ে আছি, আমারও চোখে জল এল হঠাৎ। এখনো সেই অনুকরণ! বুড়ির চোখের জল দেখে আমার অমনি চোখের জল!