২৩
কোরাস গান শুনতে-শুনতে একটা গলাই সাধারণত প্রধান হয়ে কানে আসে। বোঝা যায় দশ-বারো জন গাইছে, কিন্তু একটা গলা তার মধ্যে আলাদা, বেশি সুরেলা বেশি জোরালো, অন্যরা যখন পরের লাইনটা গাইবে কিংবা আগের লাইন রিপিট করবে—এই নিয়ে দ্বিধা করে, তখন সেই একটি গলা গানটাকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
তাকিয়ে থাকলে কিন্তু বোঝা যায়না, কোরাসের গায়ক-গায়িকাদের সেই আলাদা গলাটা কার। মানুষের চেহারা দেখে আর যাই বোঝা যাক গানের গলা কিছুতেই অনুমান করা যায়না। তবু আমি উৎসুক চোখে সেই মেয়েটিকে খোঁজার চেষ্টা করছিলাম। আমার ইচ্ছে ছিল মেয়েটিকে ধন্যবাদ জানানোর। যাত্রা সুগম হচ্ছিল ওর জন্য। কিন্তু খুঁজে পাইনি, ধন্যবাদ জানানো হয়নি।
উত্তরবঙ্গের সরকারি বাস, ছেড়েছে মনুমেন্টের কাছ থেকে, সকালবেলা। শীত চলে গেছে, অথচ গরম পড়েনি—এমন সুন্দর সময়। বাসে চল্লিশ—পঁয়তাল্লিশজন যাত্রীর মধ্যে যদি আঠারো-কুড়িজন একবয়েসী মেয়ে থাকে, যদি তারা একই কলেজের, একই ক্লাসের ছাত্রী হয়, তবে তারাই সে আবহাওয়া অধিকার করে থাকবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! বেথুন বা ভিক্টোরিয়া বা ব্রেবোর্ন কলেজের ছাত্রীরা এক্সকারশানে চলেছে।
প্যাসেজের দুপাশে সীট, বাঁদিকের সীটগুলো সবই নিয়েছে ঐ মেয়েরা, ডানপাশে অন্য যাত্রীরা, আমি জায়গা পেয়েছি একেবারে শেষের দিকে, ঝাঁকুনি—এলাকায়। এ ঝাঁকুনিতে খবরের কাগজ পড়া যায়না, বেশিক্ষণ জানালা দিয়ে প্রকৃতি দেখতেও ভালো লাগেনা। ঐ মেয়েরা মিউজিক্যাল চেয়ার খেলার মতন ঘন-ঘন পরস্পর জায়গা বদল করছিল, যে-যার বেশি সখী সে বসছিল তার পাশে, চাপা রসিকতা, সম্মিলিত হাসি। হঠাৎ শুরু হল কোরাস গান।
আগে থেকে গান গাইবে ঠিক করেনি, রিহার্সাল দিয়ে আসেনি, সুতরাং তাদের মধ্যে, নিশ্চয়ই তাদের মধ্যে একজন কেউ, প্রথম তুলেছিল গানের প্রস্তাব, সেই শুরু করেছিল এবং তার গলাই গানের গতি নিয়ন্ত্রণ করছিল। সে কে, আমি দেখিনি। যারা গাইছিল, তাদের প্রায় সবারই সুরেলা গলা—তবু একজনের গলা সবাইকে ছাড়িয়ে যায়।
আজকাল সব মেয়েই রবীন্দ্রসংগীত গায়, সবাই মোটামুটি নির্ভুল গায়, এইজন্য অধিকাংশ সময়ই রবীন্দ্রসংগীত শুনতে ভালো লাগেনা, একঘেয়ে মনে হয় আমার। তাছাড়া, রবীন্দ্রনাথের আড়াই হাজার গানের মধ্যে পঁচিশ-তিরিশখানা গানই সবাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে গায়। কিন্তু চলতি বাসে, একটু উঁচু স্কেলে উৎসাহভরা সতেজ গলায় বারো-চোদ্দজন মেয়ের গান, তার চার্ম আলাদা। মাঝে-মাঝে একটু—আধটু সুর-ছুট, লাইন ভুলে গিয়ে সবাই মিলে দমকা হাসি—এসবই সেই গানের সার্থকতার অঙ্গ।
মন দিয়ে শুনছিলাম। পথ এগিয়ে যাচ্ছে তরতর করে, দূরত্বের বিরক্তি টের পাচ্ছিনা। মেয়েগুলির রবীন্দ্রসংগীতের স্টক কম নয়, একটা শেষ হলেই থেমে যাচ্ছেনা, কেউ জিজ্ঞেস করছেনা, তুই এটা জানিস? একজন কেউ ধরছে অন্য গানের প্রথম লাইন, আর কয়েকজন ঠিক গলা মিলিয়ে গেয়ে উঠছে।
চা খাবার জন্য বাস থামল। মেয়েরা তখনও গানের ঝোঁকে আছে, নেমে ঘুরতে লাগল সাবলীলভাবে, প্রায় সবাই সুশ্রী ও স্বচ্ছন্দ। হুড়োহুড়ি করে চা—সিঙ্গাড়া খেয়ে বাসে উঠল, বাস চলা শুরু করতেই ওদের গান আবার শুরু হলো! লক্ষ করলাম যে-কয়েকটি মেয়ে টকাস্-টকাস্ করে ইংরেজিতে কথা বলছিল, তারাও রবীন্দ্রসংগীত জানে।
বেলা বেড়েছে, প্রত্যেক যাত্রীই নিজেদের সীট গরম করে ফেলেছে, কেটে গেছে আড়ষ্টতা, সবাই নিজেদের হাত-পা ও ব্যক্তিত্ব ছড়াবার জন্য উসখুস করছে। সামনে ডানদিকের সীটগুলোতে বসেছে সেই জাতের কয়েকজন লোক, যারা টাকা দিয়ে পৃথিবীর যাবতীয় সুখ কিনে ফেলতে চায়। তবে নিজেদের গাড়িতে না-গিয়ে সরকারি বাসে চেপে যাচ্ছে কেন তারা, সেটা একটা সমস্যা। হয়তো নতুনত্বের জন্য। তাদের একজন গলা খাকারি দিয়ে বলল, ‘আপলোগ হিন্দী গানা জানেননা? থোড়া হিন্দী গানা করুন-না!
হিন্দী গান সম্পর্কে আপত্তি করার কিছুই নেই। এক-একটা ব্যাপার সম্পর্কে এমন একটা স্তর এসে যায়, যখন আর আপত্তি করার কোন মানে হয়না। বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা সস্তা কুরুচিপূর্ণ হিন্দী গান গেয়ে উচ্ছন্নে যাচ্ছে— এরকম একটা অভিযোগ কিছুদিন আগেও অনেকের মনে ছিল। কিন্তু এখন প্ৰতি পাড়ায় হিন্দী সিনেমায় বরাবর ভিড়, রেডিওতে বিরিধভারতীর সারাদিন চিৎকার, প্রতি পূজা প্যান্ডেলে হিন্দী গানের কান ফাটানো আওয়াজের পর এখন আর আপত্তি জানানো অর্থহীন! মশা, মাছি ধুলোর মতন বাংলাদেশে হিন্দী সিনেমার গান মেনে নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া পিকনিকে, চলতি বাসে সবরকম গানই চলতে পারে। পিকনিক-টিকনিকে গেয়ে আনন্দ করার মতন হালকা জমাট গান বাংলাতে বেশি নেই।
কিন্তু রবীন্দ্রসংগীত থামিয়ে হিন্দী গান গাইতে বললে বাঙালির সেণ্টিমেণ্টে এখনও সুড়সুড়ি লাগে। কারুর শালিকের ডাক শুনতে ভালো লাগে বলেই দোয়েল পাখিকে শালিকের মতন গান গাইতে বলার কোন মানে হয়না। আমি ব্যাপারটা পছন্দ করলাম না। অবশ্য, আমি বসে আছি একেবারে শেষদিকে, আমার আপত্তি করার কোন প্রশ্ন ওঠেনা। মনে পড়ল আর-একটা ঘটনা, একবার ট্রেনে চেপে ওয়ালটেয়ার যাচ্ছিলাম, দুজন বাচ্চা ভিখিরি কায়দায় পাথরের টুকরো বাজিয়ে চমৎকার গান করছিল। গানের ভাষা বুঝিনি এক বর্ণ, তামিল বা তেলুগু হয়তো, কিন্তু ভারি সুন্দর দুলকিচালের সুর। বাচ্চাদুটোকে দাঁড় করিয়ে গান শুনছিলাম, পাশে বসা দুজন কাপড়-ব্যবসায়ী একসময় ‘বলে উঠেছিল, এই, হিন্দী গানা নেহি জানতে হো? বাচ্চাদুটো তখন নিজস্ব গান থামিয়ে অক্ষম বেসুরো গলায় হিন্দী সিনেমার দুখানা চলতি গান গাইবার ব্যর্থ চেষ্টা করল। হিন্দী গানের অনুরোধে আমি চটিনি, কিন্তু ভিখিরি দুজন যখন পয়সা চাইল, কাপড়ের ব্যবসায়ী দুজন তখন হাত গুটিয়ে মুখ ফিরিয়ে রইল, আমি ঈষৎ ঝাঁঝালোভাবে বললাম, ওদের গান গাইতে বললেন, আর পয়সা দিলেননা? ব্যবসায়ী দুজন বাঁকাভাবে উত্তর দিল, কাকে ভিক্ষে দেব-না-দেব, তাও কি আপনার কাছে জেনে নিতে হবে নাকি? আমি মনে-মনে বলেছিলাম, আচ্ছা ঠিক আছে, দেখা যাবে! একটু রাত্তির হতেই কাপড়ের ব্যবসায়ী দুজন যখন ঘুমে ঢুলতে লাগল, আমি সিগারেটের আগুনে তাদের কাপড় পুড়িয়ে গোল-গোল গর্ত করে দিতে লাগলাম। এমন কিছু অন্যায় করিনি, কাপড়ের ব্যবসায়ী তো ওরা, একটা কাপড় নষ্ট হলে আর কী যাবে-আসবে!
এখন অবশ্য ঐ ধরনের কাণ্ড কম করি। চুপচাপ বসে লক্ষ্য করে যেতে লাগলাম শুধু। মেয়েগুলো বোধহয় অনুরোধ শুনতে পায়নি, গান গেয়েই চলেছে। আবার তারা, টাকা দিয়ে যারা পৃথিবীর সব সুখ কিনতে চায়, একটু বিগলিতভাবে বলল, ‘ইয়ে, শুনিয়ে, আপ লোগ বহুৎ আচ্ছা গানা করেন, লেকিন একটো হিন্দী গান যদি শুনায়ে দেন—’
মেয়েগুলো থামল, ভ্রুভঙ্গি করল, হেসে উঠল কলস্বরে। আবার একটা রবীন্দ্রসংগীত শুরু করল।
টাকা দিয়ে যারা পৃথিবীর সব সুখ কিনতে চায়, তারা একটু দমে গেল। কিন্তু নিরাশ হলনা। হিন্দী গান শোনার ইচ্ছে তখন তাদের প্রবল। এবার তারা অস্ত্র বার করল।
সুটকেস থেকে বেরুলো ট্রানজিসটার রেডিও। নব্ ঘোরাতেই ঝনঝন করে উঠল হিন্দী সিনেমার গান। তীব্র, ধাতব, শ্রিল। মেয়েগুলি একমুহূর্তের জন্য থামল, তারপরই আবার দ্বিগুণ জোরে গাইতে লাগল। সুরের জগতে এক লণ্ডভণ্ড কাণ্ড শুরু হয়ে গেল। সম্পূর্ণ দুরকম গান মারামারি করতে লাগল বাসের মধ্যে। মেয়েরা গাইছে ‘ওগো, নদী আপন বেগে পাগল পারা, আমি স্তব্ধ চাপার তরু…’ আর ট্রানজিস্টার গাইছে, ‘তুম বিন যাউ কাঁহা!…’ প্রতিযোগিতায় মেয়েরাই জিতছে, তারা ঢেকে দিচ্ছে ট্রানজিস্টারের আওয়াজ, কিন্তু তারা একটু দম নিতে থামলেই ফুঁড়ে উঠছে সেই ধাতব সুর! মেয়েরা পরের গান ধরল আরও তালের, আরও দ্রুত লয়ে ‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, কে কোথা ধরা পড়ে, কে জানে!’ আর ট্রানজিস্টারও ধরল ডুয়েট, ‘শাওন কি মহিনে, পবন কিয়ে তোড়ো (আরে বাবা, তোড়ো নেহি, তো—ড়ো, তো—ড়ো)।’
টাকা দিয়ে যারা পৃথিবীর সব সুখ কিনতে চায় তারা একটু হেরে গেলেও নিবৃত্ত হলনা। এবার তারা আরও দুটো ট্রানজিস্টার বার করল। তিনটেতেই টপ স্পীডে চালাল একই হিন্দী গান। এবার আর মেয়েরা পারবে কেন? তিনজন লতা মুঙ্গেশকারের সঙ্গে কি আর বারো-চোদ্দজন কলেজের মেয়ে পারে? তাদের গলা ছাপিয়ে ট্রানজিস্টারের সরু আওয়াজ সারা বাসে ক্যান-ক্যান করতে লাগল।
এবার মেয়েরা একটু থামল, তারপর তারা অন্য পন্থা ধরল। দেখা গেল, তারা হিন্দী গানও ভালো জানে, জানবেই, স্বাভাবিক। রবীন্দ্রসংগীত থামিয়ে ট্রানজিস্টারকে হারাবার জন্য, ওতে যে হিন্দী গান হচ্ছিল, তারাও সেটাই গাইতে লাগল। তখন আর গানটা বড় কথা নয়, ট্রানজিস্টারকে হারানোই যেন প্রধান। একমুহূর্ত থামছেনা তারা, গানের ফাঁকে-ফাঁকে যে-বিজ্ঞাপন অন্ধকারে পথ দেখাবে অমুক ব্যাটারি কিংবা ‘সত্যিকারের কফির স্বাদ অমুক কফিতেও’ তা-ও গাইতে ছাড়বেনা।
গান ছেড়ে চেঁচামেচিটাই প্রধান হয়ে পড়ায় একটুবাদেই তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তারা চুপ করল, ট্রানজিস্টার চেঁচাতে লাগল অবিশ্রান্তভাবে। কোরাসে যে—মেয়েটির গলা প্রধান শোনা যাচ্ছিল, তার পরাজয়ের জন্যই আমি একটু দুঃখ বোধ করছিলাম।
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে একটি মেয়ে বলল, ‘ঐ ট্রানজিস্টারটা কিন্তু দেখতে বেশ সুন্দর, না রে?’
টাকা দিয়ে যারা পৃথিবীর সুখ কিনতে চায়, তারা তা পেয়ে অত্যন্ত তৃপ্ত এখন। গদগদভাবে মেয়েটির উদ্দেশে বলল, ‘দেখবেন? নিন-না।’
মেয়েরা তারপর থেকে খুব মনোযোগ দিয়ে ট্রানজিস্টারে হিন্দী গান শুনতে লাগল। ভাব হয়ে গেল ডানপাশের লোকদের সঙ্গে।