২০
সেই যে, একটা বাচ্চা ছেলে পড়া করতে করতে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘বাবা, ‘মাই হেড’ মানে কী?’—বাবা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘মাই হেড মানে আমার মাথা’, ছেলেটি তখন পড়তে শুরু করেছিল, ‘মাই হেড মানে বাবার মাথা’–সেই গল্পটা আমার মনে পড়ল। এইরকম আর-একটা বহু পরিচিত গল্পও মনে পড়ল, আর—একটি খুব ছোট ছেলে পড়তে-পড়তে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘বাবা ‘প্রবোধ’ মানে কী?’—খবরের কাগজ পাঠরত অন্যমনস্ক বাবা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘প্রবোধ? —প্রবোধ মানে ইয়ে, মানে, প্রবোধ দেওয়া মানে সান্ত্বনা—ভালো করে চেঁচিয়ে—চেঁচিয়ে পড়ো!’ পাশের ঘর থেকে ছেলেটির মা এসে স্বামীকে বললেন, ‘খবরের কাগজ পড়ে কী এমন জগৎসংসার উদ্ধার করছ! ছেলেটাকে একটু পড়াতে পারো না? হ্যাঁ রে খোকা, প্রবোধ মানে কী বুঝলি?’ ছেলেটি গম্ভীরভাবে বলল, ‘প্রবোধ মানে ছোটমাসি!’
গল্পদুটি মনে পড়ায় আমি সামান্য হাসলাম।
বন্ধুর বাড়িতে বসে গল্প করছিলাম। বন্ধুর আটবছরের ছেলে টুবহু কী যেন দুষ্টুমি করেছে, নালিশ শুনে বন্ধুটি আমার সঙ্গে গল্প থামিয়ে ছেলেকে ডেকে পাঠালেন। জলদগম্ভীর স্বরে বললেন, ‘টুবলু এদিকে এসো!’ সেই আওয়াজ শুনে টুবলু তো দূরের কথা, আমি পর্যন্ত ভয়ে কেঁপে উঠলাম। দিব্যি হাসিখুশি স্বভাবের মলয়কে কখনো এমন গর্জন করতে আগে শুনিনি। টুবলুর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল, পায়ে-পায়ে এগিয়ে এল। বন্ধুটি তাঁর বিশাল একহাত রাখলেন ছেলের কাঁধে, অন্যহাত শূন্যে উত্তোলিত, টুবলুর ঠোঁট কাঁপছে, যে-কোন মুহূর্তে সে প্রবল একখানা চড় খাবার প্রতীক্ষা করছে, আমিও প্রতীক্ষা করছি।
কিন্তু আজকাল বাবারা ওরকম কর্কশ শাস্তি দেওয়া মোটেই পছন্দ করেননা। বন্ধুটি তাঁর ছেলেকে চড় মারলেননা, শুধু কটমট করে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। সেই রোষকশায়িত দৃষ্টি টুবলু বৈশিক্ষণ সহ্য করতে পারলনা, তার চোখ ছলছল করে উঠল, বন্ধুটি তখন তাকে এক ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, ‘আর করবে কোনদিন?’ টুবলু ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘না, না’–বন্ধু তখন তাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘যাও, আর কোনদিন যেন এরকম না-শুনি, সবসময় ভালো হয়ে থাকবে, কক্ষনো এমনকিছু করবেনা, যাতে অন্যলোক কষ্ট পায়, যাও, পড়তে বসো—’
এইসময় আমার এ-গল্পদুটি মনে পড়ায় আমি মনে-মনে ফিক্ করে একটু হাসলাম। তারপর বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হ্যাঁরে মলয়, সবসময় ভালো হয়ে থাকা মানে কী রে? টুবলু কী বুঝল?’
বন্ধু আমার দিকে ফিরে নিম্নস্বরে ইংরেজিতে বললেন, ‘ছোটদের শাসন করার সময় তা নিয়ে ওদের সামনে ইয়ার্কি করতে নেই। তাতে ওরা কুশিক্ষা পায়! —তারপর ছেলের দিকে ফিরে, ‘টুবলু যাও, পাশের ঘরে গিয়ে পড়তে বসো —এখানে আমি নীলুকাকার সঙ্গে গল্প করছি, বড়দের কথা বলার সময় ছোটদের থাকতে নেই।’
টুবলু চলে যেতে, আমি বললাম, ‘জানিস, একদিন বাসে একটা পকেটমার আমার পকেটে হাত ঢুকিয়েছিল—’
মলয় আমার দিকে অবাক হয়ে তাকালেন। আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, এই তো গতসপ্তাহেই মৌলালির মুখটায়, একটা পকেটমার আমার পকেটে হাত ঢুকিয়েই আবার টেনে বার করে নিয়েছে, আমি টের পেয়ে গেছি, তাকিয়েছি লোকটার মুখের দিকে—লোকটার মুখে একটা অদ্ভুত ধরনের তাচ্ছিল্য আর হতাশা, লোকটার জন্য আমার এমন মায়া হল— ‘
মলয় বললেন, ‘ব্যাপারটা কী, তুই কী বলতে চাইছিস?’
—ব্যাপারটা এই, আমার পকেটে টাকাকড়ি কিছু ছিল না। খুচরো পয়সাও ছিলনা। পকেট ছিল শুধু কয়েকটা বাজে ঠিকানা লেখা কাগজ মাত্র। এখন ঐ পকেটমারটা, অনেক বেছে-টেছে আমার পকেটেই হাত ঢুকিয়েছে—সেখানে লবডঙ্কা। এক বাসে তো আর দুবার পকেট মারা যায়না, তাই লোকটা অত্যন্ত নিরাশ হয়ে নেমে গেল। তখন আমার মনে হল, আহা বেচারা! ওকে শুধু-শুধু কষ্ট দিলাম! ওকে খুশি করার জন্য আমার পকেটে অন্তত কয়েকটা খুচরো টাকা অসাবধানে ফেলে রাখা উচিত ছিল। তাহলেই আমি ওর কাছে ভালো লোক হতে পারতাম। ও আমার দিকে অমন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাকাতনা! তুই কি টুবলুকে এইকথাই বোঝাতে চাইছিলি?
মলয় শুকনো হেসে বললেন, ‘তোর সবতাতেই চ্যাংড়ামি। সংসারের ঝক্কি তো এখনো কাঁধে চাপেনি, তাহলে বুঝতি, আজকাল ছেলেপুলে মানুষ করা কত শক্ত।’
সে-কথায় কান না-দিয়ে আমি বললাম, ‘সত্যিই ‘সবসময় ভালো হয়ে থাকবি’–এ-কথার মানে টুবলু কী বুঝল সেটা খুব চিন্তার বিষয়। তুই নিজেই ভেবে দ্যাখ ভালো হওয়ার কি শেষ আছে? তোর নিজের বাবার কাছে তোকে হতে হবে আদর্শ ছেলে, আবার তোর ছেলের সামনে তোকে আদর্শ বাবা, মায়ের কাছে সুপুত্র, স্ত্রীর কাছে সুযোগ্য স্বামী, অফিসে ওপরওয়ালাকে খুশি করার জন্য নিচতলার লোকদের ধাতানি দিতে হবে, নিচতলার লোকদের খুশি করার জন্য গাইতে হবে ওপরওয়ালার কেচ্ছা, বাসকন্ডাকটারকে খুশি করার জন্য রোগা হতে হবে, ভিখিরিকে খুশি করার জন্য পকেট ভরতি খুচরো পয়সা, পকেটমারের জন্য লুজ নোট, তুই বাড়িওয়ালা হলে ভাড়াটের সঙ্গে যে-ব্যবহার করবি, তুই ভাড়াটে হলে বাড়িওয়ালার কাছ থেকে চাইবি ঠিক উলটো ব্যবহার…অন্তত আড়াইশো রকমের উলটোপালটা আছে, এর মধ্যে’—
—আর বাজে বক্বক্ করিসনা। এবার চুপ কর্ তো!
–তুই এসব কিছু ভাবিসনা, না-ভেবেই তুই ছেলেটাকে বলে দিলি সবসময় ভালো হয়ে থাকতে?
—আমি ঠিক ভাবি। তোর মতন বাজে ব্যাপার ভেবে সময় নষ্ট করিনা। পৃথিবীতে মানুষের ভালো ব্যবহারের একটা স্ট্যান্ডার্ড আছে—সেই অনুযায়ী—
—টুবহু সেই স্ট্যান্ডার্ডের কী বুঝবে?
–ঠিকই বুঝবে, আস্তে-আস্তে বোঝাতে হবে।
এবার আমার গম্ভীর হবার পালা। আমি আস্তে-আস্তে বললাম, ‘আমার কিন্তু খুব ভয় হয় একটা কথা ভেবে। আমার মনে হয় একদিন যখন এইসব ছেলেরা বড় হয়ে উঠবে, তখন তারা বুঝতে পারবে, ওদের আমরা কত মিথ্যে কথা শিখিয়েছি, আমরা ওদের তাই হতে বলেছি, যা আমরা নিজেরা বিশ্বাস করিনা, আমাদের নিজেদেরই ব্যবহারের কোন স্ট্যান্ডার্ড নেই, আমরাই সুবিধা এবং সুযোগ অনুযায়ী—’
মলয় আমাকে থামিয়ে দিয়ে মাঝপথে ঈষৎ শ্লেষের সঙ্গে বললেন, ‘তুই এসব হঠাৎ কী করে টের পেলি? তুই কি আজকাল সোস্যাল সাইকলজি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিস নাকি?’
আমি দুঃখের সঙ্গে বললাম, ‘না, সে-বিদ্যে আমার নেই। আমি বুঝতে পারি আমার নিজের জীবন দিয়ে। আজ আমাকে তুই এরকম দেখছিস, কিন্তু আমি একসময় ভালো হবার চেষ্টা করছিলাম। আমরা অনেকেই তো গুরুজনদের উপদেশ অনুযায়ী পায়ে-পায়ে এগিয়েছি। কিন্তু কী দেখছি এখন? এখন দেখছি আমাদের অভিভাবক বা মাস্টারমশাই বা দেশ-নেতারা আমাদের যা উপদেশ দিয়েছিলেন, তাঁরা অনেকেই নিজেদের জীবনে তা অনুসরণ করেননি! আমাদের ইতিহাসের মাস্টারমশাইকে দেখেছি, তিনি গরিব লোকদের লাইফ ইনসিওরেন্স পলিসি কম টাকায় কিনে নেন! এই কি ইতিহাসের শিক্ষা? আমার দাদামশাইকে আমি কত মহৎ মানুষ বলে ভাবতাম, কিন্তু যেদিন জানতে পারলাম—’
–থাক্ থাক, ওসব কথা এখন থাক! কী সিনেমা দেখলি এর মধ্যে?
—এড়িয়ে যাচ্ছিস কেন? আমরা এইগুলো টের পেয়ে গেছি বলে আমাদের জেনারেশনে এত হতাশা, আমাদের সামনে কোন আদর্শ নেই। এসব জেনেশুনেও আমরা চুপচাপ রয়ে গেলাম। কিন্তু আমার মনে হয়, ঐ টুবলুরা যখন বড় হবে, তখন আর ওরা পরোয়া করবেনা! এসব উপদেশের ভণ্ডামি ওরা ধরে ফেলবে। ওরা আমাদের মুখের সামনে অবজ্ঞার সঙ্গে বলে উঠবে, ‘খুব তো বড়-বড় লেকচার ঝেড়েছিলে একসময়! তোমরা নিজেরা কী, তা আমাদের জানা আছে! এখন ফোটো!’—তাই আমার মনে হয়, উপদেশ না-দিয়ে আগে থেকেই ওদের কাছে ক্ষমা চেয়ে রাখা ভালো।
—তাহলে তুই কী বলতে চাস, ছোট ছেলেদের কিছুই শেখাবার নেই আমাদের?
—আছে। শুধু, কী করে আত্মরক্ষা করা যায়, সেই যুযুৎসু!