নীললোহিতের চোখের সামনে – ১৬

১৬

–আপনি আপনার ছেলেকে ভালোবাসেন?

টিকিট চেকারটি সচকিতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এ আবার কী প্রশ্ন? নিজের ছেলেকে কে না ভালোবাসে?’

—আপনার ছেলে আপনাকে খুব ভালোবাসে?

–ঐ যে বললাম আপনাকে, ছেলেটা হয়েছে এমন, মায়ের চেয়ে বাপের ওপরেই বেশি টান—কিছুতেই ছাড়তে চায়না, নাইটডিউটির সময় তো ওকে এড়িয়ে আসাই মুশকিল আমার। শেষকালটায় বাথরুমে যাবার নাম করে— একরকম পালিয়েই আসতে হয়— বুঝলেন না, চারমেয়ের পর একছেলে তো, আদরটা একটু বেশিই।’

—ছেলের নাম কী?

—দেবব্রত। ডাক নাম কিন্তু দেবু নয়। দেবু যেন একটু বুড়ো বুড়ো—ওর ডাকনাম মানিক, আমার বউ তো মশাই চেয়েছিল ছেলের নামের জন্য তারাশঙ্কর বাঁড়ুজ্যে কিংবা বনফুলকে চিঠি লিখবে, তা আমি বললাম ওঁরা ব্যস্ত মানুষ—

ভদ্রলোক গড়গড় করে অনেককথা বলতে লাগলেন। বহুদিন বোধহয় আমার মতন এরকম নিরীহ শ্রোতা পাননি। মধ্যরাত্রে ট্রেন ছুটছে প্রচণ্ড বেগে, দারুণ শীত, কামরায় বেশি লোক নেই—বেশ হাত-পা মেলে ছড়িয়ে শোওয়া যায়, শরীরটা চাইছিলও শুয়ে পড়তে, কিন্তু ইচ্ছে করেই বসে আছি। আমাকে রাত তিনটের সময় নামতে হবে রাজখারসোয়ানে। এখন একবার ঘুমিয়ে পড়লে—রাত তিনটেয় ঘুম ভাঙা অসম্ভব—স্টেশন পেরিয়ে যাবে। টিকিট চেকারটি নিজের কাজ সেরে আমার পাশেই বসেছিলেন—সুতরাং আমিই নিজের থেকে ওঁর সঙ্গে আলাপ শুরু করেছি। আর এরকম মাঝবয়সী লোকদের সঙ্গে আলাপ জমাবার সবচেয়ে সহজ উপায় তাদের ছেলেমেয়ের গল্প বলার সুযোগ দেওয়া।

লোকটি ছেলের কথায় একেবারে গদগদ। এক ছেলে ছাড়া তাঁর যে আরও চারটি মেয়েসন্তান আছে—তাদের কথা ভুলেই গেছেন, শুধু ছেলে কী করে, কেমন করে খায়, তার কত বুদ্ধি—এই নিয়ে সাতকাহন।

আমি মনোযোগ দিয়ে শোনার ভান করছিলাম। মাছ ধরে তুলবার আগে যেমন বঁড়শিতে অনেকখানি সুতো ছাড়তে হয়—আমিও তেমনি লোকটিকে কিছুক্ষণ সুযোগ দিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ছেলেকে কী পড়াবেন ঠিক করেছেন?’

—এখন কী পড়াশুনোর কথা? মোটে তো সাড়ে-তিনবছর বয়েস।

—তবুও আগে থেকে প্ল্যান না-করলে আজকাল ছেলেমেয়েদের…

—ভাবছি, হাজারিবাগে মিশনারি স্কুলে দেব—ওখানে আবার বোর্ডিং তো—আমার ওয়াইফ কি ছেলেকে ছেড়ে থাকতে পারবে… আমারও হেঁ—হেঁ—

—আর্টস পড়াবেন, না সায়েন্স?

—আর্টস পড়ে আজকাল কী হয়? কিছু না! সায়েন্সেই দেব—তারপর যদি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে…আজকাল অবশ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেও বেকার—

—ছেলেকে আপনার মতন রেলের চাকরিতে ঢোকাবেননা?

-রেলের চাকরি? ছ্যা ছ্যা—এরকম ছ্যাঁচড়া কাজ—আমার তেইশবছর সার্ভিস হয়ে গেল, তবু তো প্রমোশন পেলামনা সেরকম, না মশাই ছেলেকে আর এ-লাইনে দেবনা।

—কেন, রেলের চাকরিতে তো আয় কম নয়। আপনি তো আজ এইরাত্রেই অন্তত তিরিশ টাকা রোজগার করলেন দেখলাম। ইঞ্জিনিয়ার হয়ে কি এর চেয়ে বেশি টাকা রোজগার করতে পারবে?

লোকটি তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমিও সোজাসুজি তাকিয়ে রইলাম, চোখ সরিয়ে নিলামনা। তখন থেকে রাগে আমার শরীর জ্বলছিল। লোকটিকে চরম আঘাত দেবার জন্য আমি মনে-মনে তৈরি হচ্ছিলাম। ডালটনগঞ্জ থেকে আসার পথে পুরো রাস্তাতেই জোচ্চুরির একটা বিরাট জাম্ আমার চোখে পড়েছিল। এ-লাইনে থার্ডক্লাসে অধিকাংশ যাত্রীই আদিবাসী ওরাওঁ-সাঁওতাল কিংবা দরিদ্র বিহারী—গোটা কামরায় আমার মতন তথাকথিত ভদ্রশ্রেণীর লোক মাত্র পাঁচ-সাতজন, এবং আমরাই শুধু টিকিট কেটেছি। বাকি আর একজনও টিকিট কাটেনি। টিকিট কাটার কোন রেওয়াজই নেই মনে হল ওদের মধ্যে। সাত্তিরবেলা টিকিট কাউন্টারে লোক থাকেনা সবসময়-থাকলেও একজনকে টিকিট দিতেই অনাবশ্যক দেরি করে-খুচরো পয়সা না-থাকার ওজর তুলে টিকিটকাটা বন্ধ রাখে, ইতিমধ্যে ট্রেন এসে যায়—সবাই তখন টিকিটের লাইন ছেড়ে দৌড়ে ট্রেনে উঠতে যায়—গেটের কাছে একজন চেকার দাঁড়িয়ে থাকে হাত পেতে—সবাই তার হাতে সিকি-আধুলি গুঁজে দিয়ে যায়। এখন কামরার মধ্যে ওরা মড়ার মতো পড়ে-পড়ে ঘুমোচ্ছে—একটু আগে এই টিকিট-চেকার ভদ্রলোকটি যখন সবাইকে ধাক্কা মেরে টিকিট চাইছিলেন, প্রত্যেকেই চোখ না-খুলেই হাত বাড়িয়ে একটি করে আধুলি বাড়িয়ে দিচ্ছিল। আমিই শুধু বোকার মতন সাড়ে-পাঁচটাকা খরচ করে টিকিট কিনেছি। অন্তত সত্তর-আশিটি আধুলি এই চেকার ভদ্রলোকের পকেটে ঝন্‌ঝন্ করছে।

ভদ্রলোক একটু কঠোরভাবে বললেন, ‘তার মানে?’

আমি হেসে বললাম, ‘মানে তো আপনিও জানেন; আমিও জানি। রাগ করছেন কেন? আমি তো পুলিশ নই, আপনার কোন ক্ষতি করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি শুধু আমার কৌতূহল মেটাচ্ছি! আপনার যা রোজগার দেখলাম, তাতে মনে হয়—আপনার ছেলেকে এই লাইনে ঢোকানোই তো স্বাভাবিক।’

ছেলের প্রসঙ্গ তুলে অনেকক্ষণ কথা বলায় ভদ্রলোকের মনটা নরম হয়ে গিয়েছিল। আমার কাছে তিনি আর লুকোলেন না। খানিকটা অনুতাপের সঙ্গে বললেন, ‘এইজন্যই তো ছেলেকে আর এ-লাইনে আনবনা। আমরা এ-জীবনটা অধর্ম করে গেলাম, পেটের দায়ে অনেকরকম কাজ করেছি—কিন্তু ওকে আর এসব পাপের মধ্যে আনবনা। ও যাতে সৎভাবেই নিজেরটা নিজে, মানে বুঝলেন না, দিনকাল কি আর চিরদিন এক থাকবে? ওরা যখন বড় হবে তখন অবস্থা অনেক পালটে যাবে—তখন রেলেও কি আর এসব চলবে ভাবেন?’

—তাহলে আপনার মনে হয় দিনকাল বদলাবে?

-বদলাবে না? নিশ্চয় বদলাবে!

—কিন্তু আপনার এই বাইশবছর সার্ভিসে কিছু বদলেছে দেখলেন? নাকি অবস্থা আগের চেয়েও খারাপ হয়েছে! ব্রিটিশ আমলে কি এত বিনাটিকিটে লোক যেত?

–সেকথা ছাড়ুন, কিন্তু অবস্থা এরকম থাকবেনা। আমি বলে রাখছি, দেখবেন, আপনারও তো বয়েস বেশি না; দেখে যাবেন দেশের অবস্থা এরকম থাকবেনা —পরবর্তী যুগের ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি ইয়ে, মানে তারা অন্যায় সহ্য করবেনা—

খুব আশাবাদীর মতন ভদ্রলোকের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মাফলারটা ভালো করে গলায় জড়িয়ে তিনি ভবিষ্যতের একখানা মহান ছবি আঁকতে লাগলেন। আমি এবার ওঁকে চরম অস্ত্রখানা দিয়ে আঘাত করার জন্য শান দিতে লাগলাম।

আমি খুব বিনীত কাঁচুমাচু ভাবে বললাম, ‘দেখুন, অনেকদিন থেকেই আমার একটা কৌতূহল আছে, যদি কিছু মনে না-করেন, একটা প্রশ্ন করব?’

—করুন-না। যা খুশি আপনার বলুন, আমাদের আর মনে করা না-করা। —আচ্ছা আপনার কি মাঝে-মাঝে এরকম ভয় হয়না—যে, আপনার ছেলে বড় হয়ে উঠে আপনাকে আর একটুও ভালোবাসবে না, একটুও ভক্তিশ্রদ্ধা করবেনা?

—সে তো আজকাল অনেক ছেলেমেয়েই—সেকথা কে বলতে পারে? তবে ঠিক মতন যদি শিক্ষা দেওয়া যায়—ভদ্র-সভ্য ছেলে কি আর একেবারেই নেই বা থাকবে না বলতে চান?

–না, আমি তা বলতে চাইনা। ঠিক মতন শিক্ষা পাওয়া ছেলেদের কথাই আমি বলছি। ঠিক মতন শিক্ষা পেলে আপনার ছেলে কি আপনাকে ঘেন্না করতে শুরু করবেনা?

—ঘেন্না করবে? নিজের বাবাকে? শিক্ষা মানে এই?

—শিক্ষা পেলেই সে ন্যায়-অন্যায় স্পষ্ট বুঝতে পারবে। তখন কি সে বুঝতে পারবেনা যে, তার বাবা একজন চোর? তার বাবা এইসব গরিব-দুঃখী সাঁওতালদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে তাকে লেখাপড়া শিখিয়েছে। ঐ যারা লেংটি পরে থাকে, শীতের রাত্রেও একটুকরো ন্যাতা জড়িয়ে থাকে—তাদের হাত থেকে আধুলি নিয়ে আপনি আপনার ছেলেকে জামাকাপড় কিনে দিয়েছেন! এতে কি তার প্রচণ্ড একটা রাগ হবেনা? কিছু মনে করবেন না, আমি শুধু আপনার একার কথাই বলছিনা—অনেকদিন থেকেই আমার জানার কৌতূহল—যারা চুরি, কিংবা ব্ল্যাকমার্কেট করে, যারা ঘুষ নেয়, যারা মানুষকে ঠকিয়ে নিজের বাড়ি-গাড়ি বানায়, তারা আর সবকিছু অগ্রাহ্য করতে পারে—তারা দেশের দুঃখ-দুর্দশার কথাও হয়তো ভাবে কিন্তু একথাও কি তারা একবারও ভাবেনা—যে তাদের নিজেদের ছেলেমেয়েরাই একদিন তাদের ঘেন্না করবে! নিজের ছেলেমেয়ের ভালোবাসা পেতেও তারা চায়না? নাকি এইসব চোরদের ছেলেমেয়েরাও চোর হয়? তাদের আরও বড় চোর করে তোলার জন্য শিক্ষা দেওয়া হয়। আপনার ছেলেকেও কি আপনি চোর করবেন!

—না, না নিষ্পাপ শিশু, তাকে আমি…আমি ওকে সুশিক্ষাই দেব। তাতে যদি ও আমাকে ঘেন্না করে তো করুক! আপনি বুঝবেন না, এখানে এ-লাইনে আমি যা করছি—তা না-করেও উপায় নেই, অনেকেই এটা করছে, আমি একা যদি ভালো হবার চেষ্টা করি—তাতে আমিই শুধু ঠকব, সবাই আমাকে বলবে বোকা—আমি একা বেশি বাড়াবাড়ি করলে, একা-একা সৎ হবার চেষ্টা করলে হয়তো তারাই আমার বিরুদ্ধে…তবু একজন রুখে দাঁড়ানো উচিত ছিল, আমি পারিনি, সংসর্গ দোষে আমিও অসৎ হয়েছি—কিন্তু আগামীকালের ছেলেমেয়েরা নিশ্চয়ই এ-সবকিছু ভেঙে ফেলবে—আমি আমার ছেলেকে সেই শিক্ষাই দেব—তার ফলে যদি ওর বাবার প্রতিও ওর ঘেন্না আসে তো আসুক—তবু ও তো সৎ হবে—এই আমার সান্ত্বনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *