১৪
বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমরা দুজনেই হেসে লুটোপুটি। এক-একটা কথা আদ্ধেক উচ্চারণ করছি আর হাসির দমকে আমাদের শরীর কেঁপে-কেঁপে উঠছে। রাস্তার লোক আমাদের দিকে তাকিয়ে অবাক। অমিতাভ বলল, ‘জিনিয়াস! ওফ্, জিনিয়াসই বটে, হা-হা, হো-হো-হি-হি!’
খানিকটা বাদে, একটু সামলে নিয়ে আমরা দুজনেই খুব দুঃখিত হয়ে পড়লাম। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘বুঝলি অমিত, হেমন্তদার বাড়িতে আর আসা যাবেনা!’
অমিতাভ বলল, ‘মাথা খারাপ। অন্তত পাঁচ-ছ বছর না-কাটলে আমি আর এ-বাড়ির ধারে কাছে আসছিনা!’
হেমন্তদা কানপুরে মাস আষ্টেক ছিলেন, সেখান থেকে ফিরে এসেছেন শুনে আমি আর অমিতাভ ওঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু কানপুরে গেলে মানুষ এমন বদলে যায়?
হেমন্তদা আমাদের ছেলেবেলার হীরো। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মিশে বখে গিয়ে আমি যখন অধঃপতনের দিকে বেশ দ্রুত গড়াতে শুরু করেছিলাম, হেমন্তদা সেই সময় আমাকে উদ্ধার করলেন। হেমন্তদা তখন অ্যাপ্লায়েড সাইকোলজি নিয়ে রিসার্চ করছেন, উন্নত দীপ্তিমান চেহারা, সুস্পষ্ট কণ্ঠস্বর—ভিড়ের মধ্যে থাকলেও হেমন্তদার দিকে সহজেই চোখ পড়ে। হেমন্তদা তাঁর বাড়িতে একটা সার্কল করেছিলেন, সেখানে আমাদের ডেকে নিলেন। হেমন্তদার সান্নিধ্যে এসে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য—সবকিছুই হেমন্তদা কত ভালো জানেন, আর কী সরলভাবে আমাদের বুঝিয়ে বলতেন। শিশু ও কিশোরদের মনস্তত্ত্ব বিষয়ে হেমন্তদার নিজস্ব কতকগুলো ধারণা ছিল, সেই অনুযায়ী তিনি আমাদের বিনামূল্যে শিক্ষা দিতেন। সত্যি বলতে কী, আমি অন্তত যথেষ্ট উপকৃত হয়েছিলাম। হেমন্তদাই আমাদের শিখিয়েছিলেন, যুক্তি দিয়ে সবকিছু বিচার করবে। নিজের যুক্তি দিয়ে যা শেষ পর্যন্ত মানতে পারবে না তা আর কারুর কথাতেই মানবেনা—সে তোমার ঠাকুর্দাই বলুক, বা মাস্টারমশাই বলুক বা হেমন্তদাই বলুক!
দু-একবছর বাদে অবশ্য হেমন্তদার বাড়ির স্টাডি সার্কল বন্ধ হয়ে গেল, হেমন্তদা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হলেন, কিন্তু আমরা কয়েকজন ওঁর অন্তরঙ্গ রয়ে গেলাম। হেমন্তদা বিয়ে করলেন, লতিকা বৌদিকেও আমাদের অসম্ভব ভালো লাগত। চেহারায় যেমন মানিয়েছে দুজনকে, তেমনি স্বভাবেও, লতিকা বৌদির ব্যবহার মধুর কিন্তু ন্যাকামি নেই। প্রায়ই সন্ধেবেলা আমরা হেমন্তদার বাড়িতে আড্ডা জমাতাম। লতিকা বৌদি কড়াইশুঁটি বেটে ডিমের সঙ্গে মিশিয়ে একরকম চপ বানাতেন, তার অপূর্ব স্বাদ ঘন-ঘন কফি কিংবা চা, এবং ততদিনে আমরা হেমন্তদার সামনে সিগারেট খেতে শুরু করেছি। অমিতাভ বেশ ভালো রসিকতা করতে পারে—পৃথিবীর যে-কোন বস্তুই তার রসিকতার উপলক্ষ হতে পারে আড্ডার ফাঁকে-ফাঁকে অমিতাভর রসিকতা শুনে হেমন্তদা আর লতিকা বৌদির বিশুদ্ধ উচ্চহাস্যধ্বনি এখনো আমার কানে বাজে। লতিকা বৌদির যখন সন্তান হল, নার্সিংহোমে আমরা দেখতে গিয়েছিলাম। কী সুন্দর ফুটফুটে ছেলে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা ছেড়ে হেমন্তদা মিলিটারি ইনটেলিজেন্স-এর বড় চাকরি নিলেন। সেই সূত্রেই ওঁকে কানপুরে গিয়ে আটমাস থাকতে হল। কলকাতা ছেড়ে যখন যান, তখন ওঁদের বাচ্চাটির বয়েস ন-মাস।
ফিরে আসার পর আমি আর অমিতাভ দেখা করতে গেলাম। কানপুরে হেমন্তদার বোধহয় তেমন বন্ধু জোটেনি, আড্ডা মারার সুযোগ ছিলনা, অফিসের সময় ছাড়া সারাক্ষণ বাড়িতেই কাটাতেন। তার ফলে কী সাংঘাতিক পরিবর্তন!
হেমন্তদার ছেলের বয়স এখন বছর দেড়েক, বেশ স্বাস্থ্যবান, কিন্তু ভয়ানক একরোখা। অমিতাভ একটু গালটিপে আদর করতে গেছে অমনি প্যাঁ করে শানাই—এর সুরে কেঁদে উঠল। হেমন্তদা তাড়াতাড়ি যেই কোলে তুলে নিলেন, অমনি সঙ্গে-সঙ্গে চুপ। হেমন্তদা বাথরুমে ছিলেন একটু আগে, পাজামার দড়িটা ভালো করে আঁটেননি, সেই অবস্থায় ছেলেকে কাঁধে করে ঘুরতে লাগলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ছেলের কী নাম রাখলেন হেমন্তদা?’ হেমন্তদা মুখ ফিরিয়ে জবাব দিলেন, ‘নাম রেখেছি শ্রুতিধর। এমন আশ্চর্য স্মৃতিশক্তি তোমায় কী বলব। যে-কোন কথা একবার শুনলেই মনে রাখে। দেখবে? বুলবুল, মুংকু, রিংকু, সোনা-সোনা, বলো তো সেই ছড়াটা? জ্যাক অ্যান্ড জিল ওয়েন্ট আপ দি হিল। বলো, বলো? বলো মিন্টু সোনা—’
ছেলেটা গোলগোল চোখ করে কতক্ষণ তাকিয়ে রইল। আমরাও উদ্গ্রীব, দেড়বছরের ছেলে ইংরেজি ছড়া শোনাবে এ-এক পরমাশ্চর্য ব্যাপার। ছেলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বিনা নোটিশে আবার শানাই-এর প্যা ধরল। হেমন্তদা দমলেননা। ‘থাক, থাক্, আচ্ছা সেই বাংলাটা বলো, ওপারেতে লঙ্কাগাছ রাঙা টুকটুক করে—এইটা বলো, আজ সকালেও তো বললে, কাকু, কাকুরা এসেছেন, শোনাও, কই?’
ছেলে আবার প্যা—অ্যা—অ্যা—অ্যা—
আমার মনে হল ছেলে শ্রুতিধর হতে পারে, কিন্তু কান্নার ব্যাপারটাই তার স্মৃতিতে প্রধান হয়ে গেঁথে আছে। অমিতাভ বলল, ‘থাক্ হেমন্তদা, ওর বোধহয় এখন মুড ভালো নেই।’ হেমন্তদা বললেন, ‘না না, এই তো একটু আগে হেসে—হেসে কত খেলা করছিল। আচ্ছা এই দ্যাখো।’
হেমন্তদা টাইপরাইটারের ঢাকনাটা খুললেন, ছেলেকে বললেন, ‘শ্রুতিধর, বলো তো ‘বি’ কোটা?’ ছেলে এবার কোল থেকে ঝুঁকে খটাখট টাইপরাইটারের চার-পাঁচটা চাবি টিপল তার মধ্যে ‘বি’ অক্ষরটাও আছে। আমরা বিস্ময়ে হতবাক। হেমন্তদা উদ্ভাসিত মুখে বললেন, ‘দেখলে? আশ্চর্য না? খোকন বলো তো বেড়ালের ছবি কোথায়?
ছেলে দেয়ালের দিকে বেড়াল আঁকা ক্যালেন্সরের দিকে আঙুল বাড়িয়ে উং গিং বুম বাম লাল্লাল—এই ধরনের কী-একটা বলল। আমরা বললাম, ‘সত্যি, কী আশ্চর্য! ভাবাই যায়না!’
হেমন্তদা পরিতৃপ্তির হাসি হাসতে-হাসতে বললেন, ‘ওর মামা একজন বিরাট ডাক্তার, তিনি তো বলেন,এ-ছেলের মধ্যে জিনিয়াসের চিহ্ন আছে। আমি অবশ্য কথাটা হেসে উড়িয়ে দি। কিন্তু ছেলেটা এমন সব আশ্চর্য-আশ্চর্য কাণ্ড করে, এই বয়েসের ছেলের পক্ষে ভাবাই যায়না সত্যি! দেখবে আর-একটা?’
এরপর আমরা দেড়ঘণ্টা ছিলাম, অনবরত চলল এইসব, হেমন্তদা ছেলেকে এক-একটা অসম্ভব সব ব্যাপার করে দেখাতে বলছেন, এ-বি-সি-ডি বলা থেকে শুরু করে ভারতনাট্যমের মুদ্রা পর্যন্ত, আর ছেলে কখনো মুখ দিয়ে দুর্বোধ্য আওয়াজ বার করছে শুধু, কখনো কেঁদে উঠছে তারস্বরে, কখনো এটাসেটা ভাঙছে। কোমরের পায়জামার দড়ি আলগা করে বাঁধা, কাঁধে ছেলে–হেমন্তদাকে হাস্যকর দেখাচ্ছে। ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য—এসব প্রসঙ্গ কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছে, সর্বক্ষণ শুধু ছেলের কথা। যে-হেমন্তদা শিশু মনস্তত্ত্বে বিশেষজ্ঞ, যিনি আমাদের যুক্তিবাদী হতে শিখিয়েছিলেন, সেই হেমন্তদাই দেড় বছরের ছেলেকে নিয়ে এমন আদিখ্যেতা করছেন—যা দেখে যে-কোন লোকের হাসি পাবে। আমরা অতি কষ্টে হাসি চেপে বসে রইলাম।
লতিকা বৌদিরই অনেক বদল হয়েছে। আমাদের আর চপ-টপ কিছুই খাওয়ালেননা। চেহারা এবং কথাবার্তা সবই ভোঁতা হয়েছে একটু, উনিও হেমন্তদাকে তাল দিতে লাগলেন, ছেলেকে দিয়ে ছড়া বলাবার চেষ্টায় নাজেহাল হলেন ছেলের যখন কান্না ওঁর মুখখানাও তখন কাঁদো-কাঁদো।
বাইরে বেরিয়ে অমিতাভ আর আমি প্রাণ খুলে হেসে নিলাম। দুজনে ঠিক করলাম, ছেলেটা বেশ বড় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আর হেমন্তদার বাড়িতে আসব না।
সত্যিই চার-পাঁচবছর আর যাইনি। কিন্তু এর মধ্যে অমিতাভর সঙ্গে আবার আমার ঝগড়া হয়ে গেল। প্রায় মুখ দেখাদেখিই বন্ধ। অর্পিতা ছিল আমার বান্ধবী, বেশ ব্যাপারটা জমে উঠেছিল, একসঙ্গে সিনেমা দেখা, লেকে বেড়ানো-টেড়ানো বেশ চলছিল—এই সময় অমিতাভর সঙ্গে ওর আলাপ করিয়ে দিয়েই নিজের সর্বনাশ ডেকে আনলাম। অমিতাভ চমৎকার রসিকতা করতে পারে, পোশাক পরে সবসময় আধুনিকতম, চলন্ত ট্রামের জানালা দিয়ে ট্যাক্সি ডেকে নেমে পড়া ওর স্বভাব। সুতরাং আমার যা নিয়তি—সবসময় প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়া, ব্যর্থ হওয়া—তাই হল, অমিতাভ ঝপ্ করে অর্পিতাকে বিয়ে করে ফেলল! ব্যাপারটাকে হাসিমুখে মেনে নেব—এতখানি স্পোর্টিং স্পিরিট সত্যিই আমার নেই। সেই অমিতাভ বিশেষ করে অর্পিতার ব্যবহারে আমি সত্যিই দুঃখ পেয়েছিলাম। দিনকতক সিরিয়াসলি দাড়ি রাখার কথাও ভেবেছি।
কিন্তু সব দুঃখই একসময় পুরোনো হয়ে ফিকে হয়ে যায়। হৃদয়ে সেইসব পুরোনো দিনের কথা আর ঢেউ তোলেনা। সুতরাং একটা মিউজিক কনফারেন্সে যখন আমার সঙ্গে অমিতাভ আর অর্পিতার চোখাচোখি হয়ে গেল, তখন আর রক্তে ঝড় উঠল না। এবং ওরা দুজনে যখন এসে কথা বলতে এল, আমি মুখ ফেরাতে পারলামনা। এমনকী ওদের বাড়িতে যাবার নেমন্তন্নও গ্রহণ করে ফেললাম।
ফিটফাট সাজানো সংসার ওদের, স্বামী-স্ত্রী আর একটি আড়াই বছরের মেয়ে। বিয়ের আগে অমিতাভর ঘরটা কী অগোছালোই থাকত—এখন দেখলে চেনাই যায়না। আরও অনেককিছু চেনা যায়না। মেয়ের নাম রেখেছে পূর্বা, বেশ মিষ্টি—মিষ্টি কথা বলে, ঠাণ্ডা, কাঁদেনা, মুখখানা অর্পিতার মতনই মিষ্টি। অমিতাভ আর আমি অনেক পুরোনো দিনের কথা ঝালিয়ে নিলাম। প্রায় চারবছর দেখা হয়নি।
কথার মাঝে-মাঝে মেয়েটি এসে বাধা দিচ্ছিল। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের কতরকম প্রশ্ন, কতরকম কৌতূহল—সেগুলোর জবাব না দিলে চলেনা—সুতরাং বারবার আমাদের কথা বাধা পাচ্ছিল। নিজের মেয়ের এসব প্রশ্নে বাবা হয়তো বিরক্ত হয়না—কিন্তু আমি আর কতক্ষণ সহ্য করব। বুঝতে পারলাম, ঐ মেয়েকে বাদ দিয়ে কোন কথা বলা যাবেনা। অর্পিতা কয়েকবার ওকে পাশের ঘরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল—কিন্তু মেয়ে কিছুতেই যাবে না, বাবাকে ছেড়ে সে থাকতে পারেনা। সুতরাং কথার কথা হিসেবে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কীরে অমিত, মেয়েকে কোন্ স্কুলে ভর্তি করবি?’
অমিতাভ বলল, ‘এখুনি কী, মোটে তো আড়াই বছর বয়েস।
—বাড়িতে কিছু শেখাচ্ছিস-টেখাচ্ছিস?
—অমিতাভ হো-হো করে হেসে উঠে বলল, ‘না ভাই। ছড়া শেখানো কিংবা নাচ শেখানো—তারপর বাড়িতে লোকজন এলে জোর করে তাদের সেইসব শোনানো? এসব আমার ধাতে নেই।’
আমি বললাম, ‘বেঁচেছিস।’
-দ্যাখ-দ্যাখ মেয়েটা কী করছে কাগজ-পেন্সিল নিয়ে। একটা ফাঁক পেলেই মেয়েটা আপন মনে ছবি আঁকে।
আমি হাই তুলে বললাম, ‘তাই তো দেখছি।’
অমিতাভ বলল, ‘আনন্দবাজারে যেসব ‘আঁকা বাঁকা’ বেরোয়, তার থেকে পূর্বা অনেক ভালো আঁকে। সম্পাদকের কাছে পাঠালে লুফে নেবেন।’
আমি উদাসীনভাবে বললাম, ‘পাঠালেই পারিস।’
—তুই দেখবি ওর আঁকা কয়েকটা ছবি?
–না, আমি আর দেখে কী করব? আমি আর্ট ক্রিটিকও নই, ছবি ছাপার ব্যাপারেও আমার বিন্দুমাত্র হাত নেই।
-সেজন্য নয় এমনিই দ্যাখ-না—বিশ্বাসই করা যায়না, ঐটুকু মেয়ে…
অর্পিতা কাছেই দাঁড়িয়ে চা তৈরি করছিল, বলল, ‘ওর এক মামা তো বড় আর্টিস্ট, তারই ছোঁয়া লেগেছে বোধহয় মেয়েটার।
শুনেছিলাম বটে অমিতাভর এক মামা বোম্বেতে হিন্দি সিনেমার আর্ট ডিরেক্টার। তিনি হলেন গিয়ে বড় আর্টিস্ট। ঢোক গিলে আমি বললাম, ‘বাচ্চাদের অনেকসময় আঁকিবুকি ছবি আঁকার ঝোঁক দেখা যায় বটে—কিন্তু বড় হলে আর ওসব কিছু থাকেনা।’
অমিতাভ অত্যন্ত বিরক্তির মুখ করে বলল, ‘না রে, পূর্বার মধ্যে খুব অল্পবয়েস থেকেই ছবির দিকে একটা টান…মানে যখন ওর মাত্র ছ’মাস বয়েস—তখন ওর দিকে একটা পুতুল আর একটা লালরঙের পেনসিল বাড়িয়ে দিতে দেখা গেল—ও কিছুতেই পুতুলটা নেবেনা, লাল পেনসিলটাই নেবে!’
আমি স্তম্ভিতভাবে কিছুক্ষণ অমিতাভর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর বললাম, ‘বাচ্চাদের সঙ্গে ষাঁড়ের খুব মিল আছে জানিস? ওরাও লাল রং খুব ভালোবাসে। তোর মেয়ে লাল রং বলেই পেনসিলটা ধরতে গিয়েছিল, শুধু পেনসিল বলেই নয়।’
অর্পিতা বঙ্কিম হাস্যে বলল, ‘আপনার কথাবার্তা ঠিক আগের মতোই আছে দেখছি।’—অর্পিতার এই মন্তব্যের ঠিক কী মানে তা বোঝা না-গেলেও এটুকু বুঝতে পারলাম, ও আমার কথাটা মোটেই পছন্দ করেনি। কেননা আমার চায়ে ও চিনি দিতে ভুলে গেছে এবং অতি ট্যালটেলে বিস্বাদ লিকার।
এরপর দেড়ঘণ্টা ধরে অমিতাভ আর অর্পিতা আমাকে ওদের মেয়ের শিল্প—প্রতিভা বোঝাবার চেষ্টা করল। দুটো লম্বা আর একটা গোল দাগ দেখিয়ে অর্পিতা বলল, ‘দেখেছেন কী চমৎকার মানুষ এঁকেছে—অনেকটা ওর বড় মামার মতো। আর এই দেখুন এই একটা হরিণ। আর কী আশ্চর্য দেখুন, ও কখনো পাহাড় দেখেনি—অথচ কী সুন্দর পাহাড়ের ছবি এঁকেছে।’ অমিতাভ বলল, ‘পূর্বা জন্তু—জানোয়ার আঁকতে খুব ভালোবাসে—পূর্বা, কাকামণিকে একটা বাঁদর কিংবা হনুমান এঁকে দেখাও তো। এই নাও পেনসিল, নাও আঁকো।’—আমি বললাম, ‘কী রে অমিত, ও বাঁদর আঁকার জন্য তোর মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে কেন?’—এত রসিকতাজ্ঞান ছিল অমিতের, কিন্তু তখন হাসলনা গ্রাহ্যই করলনা, বলল, ‘আঁকো মামণি, এঁকে দেখাও।’
টেকনিকটাই শুধু বদলেছে। ব্যাপারটা সেই একই আছে। দেড় ঘণ্টায় আমি ক্লান্ত বিরক্ত, গলদঘর্ম হয়ে উঠলাম। বাইরে বেরিয়ে মনে পড়ল, হেমন্তদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমি আর অমিত কীরকম হেসেছিলাম। আজ অমিতের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমি হাসতেও পারছিনা।
সেদিন আমার দুটি বিষয়ে উপলব্ধি হল। এক অর্পিতাকে বিয়ে না-করে আমি খুব জোর বেঁচে গেছি। আর দ্বিতীয়ত, বিয়ে করলেই যদি বাবা হতে হয়—এবং বাবা হলেই যদি হেমন্তদা কিংবা অমিতাভর মতন বোকা হয়ে যেতে হয়—তবে ইহজীবনে আমি সংসারধর্ম কিছুতেই গ্রহণ করছিনা।