১২
সেইদিন আমি প্রথম অনুভব করেছিলাম, বাংলা সাহিত্যে সতীদাহের পরের অধ্যায় প্রায় কিছুই লেখা হয়নি।
কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাটে এক বুড়ি ভিক্ষের জন্য অনেকক্ষণ ধরে আমার কাছে পেড়াপিড়ি করছিল। আমি তাকে বারবার প্রত্যাখ্যান করতে-করতে রূঢ় হয়ে উঠছিলাম। কোথায় সিগারেট টানতে-টানতে গঙ্গার প্রথাগত সৌন্দর্য দেখব, তা নয় চোখের সামনে এক গলিত চেহারার বুড়ি। তাছাড়া ক্রমশ বিরক্ত ও রূঢ় হয়ে উঠছিলাম, অন্য একটি কারণে। আমার পকেটে কোন ছোট খুচরো ছিলনা, ছিল সিকি-আধুলি। ভিখিরি-টিখিরিদের মাঝে-মাঝে দু-চারটে পয়সা দিতে না-পারার মতো কৃপণ আমি নই, আবার টপ্ করে একটা সিকি দিয়ে দেবার মতো উদারও হতে পারিনা। আসলে এই বুড়িকে কিছু দেবার জন্যই পকেটে হাত দিয়েছিলাম, তারপর সিকির কম কিছু না-পেয়ে, আবার ওকে না-দেওয়া মনস্থ করেই ক্রমশ বিরক্ত হয়ে উঠছিলাম। কিন্তু বুড়িটার একঘেয়ে নাকেকান্না থামেনা, সুতরাং আমি স্থানত্যাগ করার উপক্রম করছি, তখন হঠাৎ সে আমার মুখের কাছে মুখ এনে বলল, ‘কালু না? ও কালু, চেয়ে দ্যাখ, আমায় চিনতে পারিনা?’
বলাই বাহুল্য, আমার নাম কালু নয় এবং ঐ অশীতিপর বৃদ্ধাকে চিনতে পারার কোন প্রশ্নই ওঠেনা। কিন্তু সে ততক্ষণে আমার হাত চেপে ধরেছে—ঠাণ্ডা, . শিরা-ওঠা হাতের কেমন যেন হিলহিলে স্পর্শ। আমার শরীর শিউরে উঠলেও, আমি তৎক্ষণাৎ জোর করে হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা না-করে সংযত-শান্ত গলায় বললাম, ‘তোমার ভুল হচ্ছে বুড়ি, আমার নাম কালু নয়।’
—আমার ভুল হয়না। একেবারে কালুর মুখখানা বসানো। সেই ডাগর ডাগর চোখ, কেষ্টপানা চুল—আমি কালুকে চিনিনা? তুই আমাকে চিনতে পারলিনা কালু?
সত্যিই আমি কালু নই!
—বাড়ি কোথায়? ফরিদপুর না? মাইজপাড়ার দক্ষিণবাড়ির কালু না তুই? আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। বাকি কথাগুলো সব সত্যি। পূর্ববঙ্গে ওখানেই আমাদের বাড়ি ছিল—সে কতদিন আগে, আঠেরো বছর আর দেখিনি। খেজুর গাছ থেকে রস চুরি করতে গিয়ে মাঝরাত্রে পুকুরের মধ্যে পড়ে গেছি আমি —মনে পড়ল সেই বাল্যকাল। কিন্তু সেখানে কালু কে ছিল? আমার ও-নামের কোন শৈশবসাথীর কথাও মনে পড়েনা। সব বৃদ্ধাকেই প্রায় একরকম দেখতে—তবু, এই বুড়ির কোঁকড়ানো মুখের দিকে তন্নতন্ন করে তাকিয়েও আমি একে কখনো দেখেছি, কিছুতেই মনে হলনা।
তারপর আর-একটা কথা মনে পড়তেই আমার মাথার মধ্যে ঝনঝন করতে লাগল। জীবনানন্দের কবিতায় যেমন হঠাৎ ভয়াবহভাবে জলে পড়ে যাবার কথা আছে, আমিও যেন এখানে দাঁড়িয়ে থেকেই অকস্মাৎ খেজুর গাছ থেকে পুকুরে পড়ে যাব।
কারণ, আমি বুঝতে পেরেছি, ইনি কার কথা বলছেন। আমার বাবার ডাক নাম ছিল কালু! আমার চোখ ডাগর ডাগর তো দূরের কথা—বরং মেয়েরা বলে হাতির চোখের মতন—দেখা যায় কী যায় না—কিন্তু সে যাই হোক—আমার সঙ্গে আমার বাবার চেহারার কোন সাদৃশ্য আমি কখনও দেখিনি, স্মরণকাল থেকেই আমি তাঁকে দেখেছি চক্চকে টাকমাথার এক ভারিক্কি চেহারার ভদ্রলোক। সুতরাং, আমার বাবার সঙ্গে যদি কোনকালে আমার চেহারার কোনরকম মিল থেকেই থাকে—সে নিশ্চয়ই অনেককাল আগের কথা, আমার জন্মেরও বহু আগে, অন্তত চল্লিশ বছর আগেকার কথা। আমার বাবার মৃত্যুই হয়েছে অনেকদিন।
আমি চকিতে কণ্ঠস্বরে সম্ভ্রম এনে বললাম, ‘আপনি কি আমার বাবার কথা বলছেন? আমার বাবার ভালো নাম ছিল এই…।’
বৃদ্ধা এক গাল হেসে বললেন, ‘তুই কালুর ছেলে? পেন্নাম কর, পেন্নাম কর—আমি তোর সম্পর্কে ঠাকুমা হই। দূর সম্পর্কের না, আমার মরার খবর শুনলে তোদের তিনরাত্তির অশৌচ হবে। আমার কথা শুনিসনি তুই? আমি হলাম গে চিন্তামণি, লোকে বলত চিন্তে ঠাকুরুন, তোর বাবার আপন কাকিমা হই। হা কপাল, আমি কালুর বিয়ের খবরই শুনিনি, আজ তার কতবড় জোয়ানমদ্দ ছেলে! কেমন আছে রে কালু?’
—তিনি মারা গেছেন।
সেই ভিখারিণী, অর্থাৎ আমার ঠাকুমা খুব চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘সবাই মরে, শুধু চিন্তে বামনিই মরেনা।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি এখানে কতদিন আছেন?’
—কী জানি বাবা, সেসব কি আমার মনে আছে। সেই যে-বছর প্রথম যুদ্ধ বাধল—
কথাটা আমার পক্ষে হজম করা শক্ত। সে তো প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপর আর যাননি?’
—নাঃ! লোকে যেমন বেড়াল পার করে, তেমনি আমার ছোট দেওর ভবানী আমাকে কাশীতে পার করে দিয়ে গেল। তা বাবা বিশ্বনাথ আমাকে পায়ে ঠাই দিয়েছেন—ভবানীকে তুই চিনিস?
না, আমি চিনিনা। আমরা কুলীনের বংশ—আমার বাবার সময় থেকে সবাই মডার্ন হওয়া শুরু করেছে, কিন্তু আমার ঠাকুর্দারই ছিল মাত্র চারটি বউ। তাঁরও বাবা-কাকাদের ক’টা করে বউ ছিল—সেসব কথা ইতিহাসে আছে, আমি জানিনা। সারা বিশ্বে আমার কতজন অসাক্ষাৎ কাকা-জ্যাঠা ছড়িয়ে আছে, আমার পক্ষে জানা সম্ভবও নয়।
যাইহোক, আমার চিন্তামণি ঠাকুমার সঙ্গে আমি কাশীতে তাঁর বাড়িও গিয়েছিলাম। সেটাকে বাড়ি বলা যায়না, মণিকর্ণিকা ঘাটের পিছনদিকে একটা বাড়ির একতলায়—কাশীতে যেসব বাড়ির একতলা অব্যবহার্য—ঠাণ্ডা ও অন্ধকারে ষাঁড় ও কুকুরের রাত্রি-নিবাস, সেইখানে তিনি থাকেন। কী করে বা কী সাপ্নে যে এতদিন বেঁচে আছেন—জানিনা। ওঁর মুখ থেকে সেকালের কিছু গল্প শুনলাম —সেইসঙ্গে ওঁর জীবনের ইতিহাস। আমি এখনও সেসব কথা বিস্তৃতভাবে লেখার যোগ্য হয়ে উঠিনি। আমার মন অস্থির, আমি ‘আধুনিকতা’ নামের এক দুঃস্বপ্নে ডুবে আছি। কিন্তু স্বীকার করতে লজ্জা নেই, সেদিন আমার চোখে জল এসেছিল। রামমোহন সতীদাহ বন্ধ করে খুবই মহৎ কাজ করেছিলেন নিশ্চিত। কিন্তু আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই দৃশ্য—পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর আগে, বাংলাদেশের গ্রাম থেকে একটি যুবতী বিধবাকে—বিয়ে হয়েছিল মাত্র ছ’বছর আগে—স্বামী সন্দর্শন হয়েছে মাত্র চারদিন—সমস্ত আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ছিনিয়ে এনে—একা নির্বান্ধব অবস্থায় রেখে গিয়েছিল কাশীতে। বোধহয় উদ্দেশ্য ছিল এই, যুবতী বিধবা গ্রামে থেকে কখন কীভাবে বংশের নামে কালি দেয় কে জানে —তার চেয়ে দূর বিদেশে যা ইচ্ছে হোক। নির্বাসনে পাঠাবার আগে আমারই মামাতো-খুড়তুতো ঠাকুর্দারা এঁর গা থেকে শেষ টুকরো সোনার গয়না পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছে। আমি একজন নবীন যুবা, ওল্টানো চুল, প্যান্টালুন ও টেরিলিনের শার্ট পরে, সিগারেট ফুঁকতে-ফুঁকতে গঙ্গার বিখ্যাত সৌন্দর্য দেখায় বিঘ্ন ঘটানোর জন্য যে-কুচ্ছিৎ চেহারার বুড়ি ভিখিরিকে প্রায় ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিতে যাচ্ছিলাম, তিনি আমারই রক্ত-সম্পর্কের ঠাকুমা।
তিনি কিন্তু কাশীতে আসার পর থেকেই ভিখারিণী হননি। আমারই কোন এক পিসতুতো ঠাকুর্দা না কী যেন, যাঁর নাম ছিল তারিণীশঙ্কর—তিনি ছিলেন মহানুভব—প্রথম পনেরো বছর নিয়মিত প্রতিমাসে চিন্তামণি ঠাকুমাকে সাতটাকা করে মনি অর্ডারে পাঠিয়েছিলেন। প্রত্যেক মাসে, কখনো ভুল হয়নি। তিনি মারা যাবার পর তাঁর ছেলে হরগোবিন্দও কয়েক মাস পাঠিয়েছিল। একবার চিন্তামণি ঠাকুমা এখানকারই একজন লোককে ধরে-করে হরগোবিন্দকে একটা চিঠি লেখান —তাতে লিখেছিলেন, বাবা হরগোবিন্দ, আজকাল তৈজসপত্রের দর আগুন, তুমি আমাকে এখন থেকে যদি দশটা টাকা পাঠাও, বড় ভালো হয়। অত না পারো, অন্তত ন’টা টাকা পাঠিয়ো। আমি চিরকাল তোমার ছেলেমেয়েদের আশীর্বাদ করব। এই চিঠি পেয়ে হরগোবিন্দর কী মতিভ্রম হয় কে জানে—সে হঠাৎ টাকা পাঠানোই বন্ধ করে দেয়! এরপর আরও তিনখানা চিঠি লিখেও উত্তর বা টাকা আসেনি। তখন চিন্তামণি ঠাকুরুনের বয়েস চল্লিশ পেরিয়ে গেছে—তখন আর অন্যপথে যাবারও উপায় নেই, সুতরাং ভিক্ষাবৃত্তি। ‘হরগোবিন্দ কি বেঁচে আছে?’—তিনি আমায় জিজ্ঞেস করলেন।
পৃথিবীর কোথায় কোন্ হরগোবিন্দ বেঁচে আছে কি মরে গেছে—তার আমি কী জানি! আমি চুপ করে রইলাম। নিজের কথা শেষ হবার পর তিনি খুঁটিয়ে—খুঁটিয়ে অন্যদের কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। আমাদের কুলীন বংশের নানা শাখা-প্রশাখা ধরে এর-ওর কথা। আমি যে-কজন সম্পর্কে জানি বলতে লাগলাম। অর্ধ শতাব্দী আগে যে জায়গা ছেড়ে চলে এসেছেন, পাকিস্তান হয়ে যেসব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে সে-খবরও রাখেননা—যেসব আত্মীয়স্বজন ওঁকে চরম অবহেলা করেছে,—তাদের সম্পর্কে ওঁর কতখানি ব্যগ্রতা! ঠাকুমার দেওয়া বাতাসা ও কলার টুকরো খেতে-খেতে হঠাৎ আমার এক জ্যাঠতুতো দাদার কথা মনে পড়ল। তিনি কিছুদিন আগে এক শুদ্দুরের বিধবা মেয়েকে বিয়ে করেছেন। সে-খবর শুনে ওঁর কী অবস্থা হয় আমার দেখতে ইচ্ছে হল। আমি জানিয়ে দিলাম।
ভেবেছিলাম, উনি আঁৎকে উঠবেন। অথবা কাঁদবেন। আমাদের অত বড় ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের বংশে সে-ছেলেটা কালি লেপে দিয়েছে শুনে ওঁর দীর্ঘ জীবনের নির্যাতিত সতীত্বেও যেন কালি পড়বে। উনি তাকে শাপ-শাপান্ত করবেন।
কিন্তু সেই বলি-জর্জর বৃদ্ধা মুখের চামড়া আরও কুঁচকে একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আহা ছেলেমানুষ, না-বুঝে কী না কী করেছে। আমি কাল বিশ্বনাথের মন্দিরে ওর নামে পুজো দেব—যাতে ছেলেটা জীবনে সুখ পায়!’