১১
কথার মাঝখানে যদি হঠাৎ টিকটিকি ডেকে ওঠে টিটিক্ করে, তাহলে নাকি সে-কথাটা নির্ঘাৎ সত্যি হয়, ঠিক-ঠিক ফলে যায়। এই সংস্কারের মধ্যে যদি কিছুটাও সত্যি থাকে, তবে বলতে হবে, আমাদের বাড়ির সকলেই পরম সত্যবাদী। সকলেই প্রবক্তা। কারণ, আমাদের বাড়িতে যে-কোন কথার মধ্যেই অনবরত টিকটিকি ডেকে উঠছে টিক্টিক্-টিক্টিক্ করে।
এত টিকটিকি কোথা থেকে এল কে জানে। যখনই তাকাই, দেখি দেওয়ালের কড়িকাঠে অন্তত পাঁচ-ছটা নিস্পন্দ হয়ে পড়ে আছে। ঠাণ্ডা চোখ মেলে যে কে কোনদিকে তাকিয়ে আছে, বোঝার উপায় নেই।
টিকটিকির মতো এমন রহস্যময় জীব আমি দেখিনি। আজকাল টিকটিকির ভাবনায় আমার বহু সময় কেটে যাচ্ছে। হুবহু কুমিরের মতো দেখতে, কিন্তু কুমিরের চেয়ে অনেক উঁচুজাতের জীব এরা। যেমন বিড়ালকে যদিও বাঘের মতোই দেখতে, কিন্তু আমার নিশ্চিত ধারণা, বিড়াল বাঘের চেয়ে অনেক বুদ্ধিমান জীব। প্রথমত এরা মানুষের সংস্পর্শে থাকে। যাইহোক, টিকটিকি বিষয়ে দুটো সমস্যার কোন মীমাংসা আমি আজ পর্যন্ত করতে পারিনি। কারণ ওদের শরীরে কি মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কাজ করেনা? খাড়া দেওয়ালে ওরা থাকে কী করে? যতই ছোট হোক, ওদেরও শরীরের তো ওজন আছে? এর উত্তরে আমার এক বন্ধু বললেন, ওদের চারহাতে (অথবা চারটেই পা) নাকি এক ধরনের আঠা মাখানো থাকে। কিন্তু আমার বিশ্বাস হলনা। আঠা লাগানো থাকলে দেয়ালের গায় আটকে থাকতে পারে ঠিকই কিন্তু ছোটে কী করে? শুধু দেয়াল বেয়ে নয়, দেয়ালটা তবু মানা যায়—আমরা যেমন তালগাছে উঠি, কিন্তু ঘরের সিলিং-এ শরীরটা সম্পূর্ণ উল্টো করে কী করে ছোটে? আর কী বিদ্যুৎবেগে ছোটা, ঘণ্টার পর ঘণ্টা টিকটিকি যেমন চুপ করে পড়ে থাকে—সেই রকম ছুটতেও পারে প্রচণ্ড জোরে, গতিতে তখন হরিণকেও হার মানায়।
দ্বিতীয় সমস্যা টিকটিকিরা আসে কোথা থেকে? একথা কেউ ভেবে দেখেছেন? প্রত্যেকেরই বাড়িতে টিকটিকি আছে, টিকটিকি ছাড়া বাড়ি হয়না। কিন্তু একটা নতুন বাড়িতে কী করে আসে প্রথম টিকটিকিটা? পাশের বাড়ি থেকে? কিন্তু মাঠের মধ্যে একটা নতুন বাড়ি হল, কয়েকদিন পরেই সেখানে টিকটিকি দেখতে পাওয়া যাবে। আশেপাশে কোন বাড়ি নেই—তবু টিকটিকি আছে। ছারপোকা বা আরশোলার মতন তো ওরা মানুষের জামাকাপড় বা বাক্সে ভরে আসেনা, তবে কী করে আসে? এসপ্লানেডে যখন নতুন ল্যাট্রিন তৈরি হল, কয়েকদিন পরই সেখানে আমি টিকটিকি দেখেছি। বিস্ময়ে আমি কূলকিনারা পাইনি, আশেপাশের দুরন্ত গাড়িঘোড়ার রাস্তাঘাট পেরিয়ে টিকটিকিরা কি নিজে—নিজেই এসেছে এখানে? কতদূর থেকে ওরা দেখতে পায়? দূরের কোন বাড়ি বা হোটেল থেকে—একদিন নতুন বাড়ি ওঠার খবর পেয়ে, একটা টিকটিকি— না, একটা হলে বংশবৃদ্ধি হয়না, সুতরাং দুটো টিকটিকি একদিন যাত্রা করল। পথ দিয়ে বুকে হেঁটে-হেঁটে এগিয়ে,—ওখানকার রাস্তা দিয়ে সবসময় গাড়ি যাচ্ছে, সুতরাং অপেক্ষা করে করে ট্রাফিক লাইট দেখে—লোকের জুতো বাঁচিয়ে একজোড়া টিকটিকি এসে পৌঁছয় নতুন বাড়িতে? ভাবতেও আমার ভয় হয়!
যাইহোক, আমি আমার নিজের ঘরের টিকটিকিগুলোকে নিয়েই বিষম বিব্রত। ওরা আমার ঘুম কেড়ে নিচ্ছে।
আমার ঘরে টিকটিকি আছে ছটা, অর্থাৎ স্থায়ী বাসিন্দা ছটি। এছাড়া দু-একটা আগন্তুক আসে মাঝে-মাঝে—এবং বিতাড়িত হয়ে যায়। রান্নাঘরের বা বাথরুমের টিকটিকি হয় কালচে রঙের বা ডোরাকাটা, শোবার ঘরের টিকটিকিরা ফর্সা, ছিমছাম সুতরাং অন্য টিকটিকি এলে আমি নিজেও চিনতে পারি। আমার ঘরের টিকটিকিগুলোকে আমি আলাদা করে চিনি-একথা বললে হয়তো অবিশ্বাস্য শোনাবে। চার্লি চ্যাপলিন মশা ও মাছিদের আলাদা করে চিনতে পারেন, ওঁর সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘দিস্ ইজ নট ফিলিস,’ কে না জানেন! আমার সে-ক্ষমতা নেই যদিও কিন্তু আমার টিকটিকিগুলোকে রোজ দেখতে-দেখতে এখন আমি ওদের সত্যিই চিনে গেছি। ওদের আলাদা নামও দিয়েছি। এই ছটার মধ্যে পাঁচটা প্ৰায় একই সাইজের আর-একটা বিশাল বড়। সেটার সাইজ গিরগিটির মতো—কিন্তু দেখলে কুমির ছাড়া আর কিছুই মনে পড়েনা—সারা গায়ে এবং ল্যাজে খাঁজ কাটা, বিকট ড্যাবডেবে চোখ মেলে যখন তাকায়, তখন আমারও বুক শিউরে ওঠে। কিন্তু যতদূর জানি, টিকটিকি কখনও মানুষকে কামড়ায়নি, ঘুমের ঘোরেও না! সুতরাং ভয় কাটিয়ে উঠি। কিন্তু প্রায়ই মনে হয় ওটা যখন আমার দিকে চেয়ে থাকে, তখন বোধহয় মনে-মনে ভাবে—ইস্, আমার হাঁটা যদি আর-একটু বড় হতো তখন ঐ শুয়ে-থাকা নিরীহ, নরম চেহারার লোকটাকে কপ্ করে একেবারে গিলে ফেলতে পারতাম!—আমি ঐ বড়টার নাম দিয়েছি মাফিয়া। মাফিয়ার তাক্ অব্যর্থ। কখনও শিকার ফসকায়না, যতবড় পোকাই হোক—খপ্ করে এসে ধরবে।
আমাদের বাড়ির সামনে একটা বাগান আছে। সেইজন্য অনেক পোকা ও পতঙ্গ আসে ঘরের মধ্যে। সবগুলিই নিরীহ পোকা—কী সুন্দর রং-বেরং প্রজাপতি ও মথ বা ফড়িং। সেগুলো নিয়ন আলোর রডের পাশে এসে বসে। আর টিকটিকির শিকার হয়। পাঁচটা সমান সাইজের টিকটিকি—আমি ওদের নাম দিয়েছি, কোনরকম যুক্তি না-ভেবে সজারু, মুসোলিনি, কিফিল আর খাইবার। পঞ্চমটার নাম আর মনেই পড়েনা, তখন ওর নাম দিলাম তিন নম্বর। কেন এক নম্বর বা পাঁচ নম্বর নয়, তা ঠিক বলতে পারবনা—তিননম্বরই মনে পড়ল। ঐ তিননম্বরটাই পাঁচজনের মধ্যে সবচেয়ে দুরন্ত ও দুঃসাহসী। অন্যগুলো যখন দূরে একটা পোকা দেখে হিশেব করে, আস্তে-আস্তে এগোয়—তিননম্বরটা তখন সোজা ছুটে আসে, খপ্ করে চেপে ধরে। এই স্বভাবের জন্য, ও অনেক পোকা ধরতে পারে না, উড়িয়ে দেয়, আবার যখন ধরে, খুব তাড়াতাড়ি, অন্যগুলোর মতো একঘণ্টায় একটা নয়।
কিন্তু এইসব দেখতে-দেখতে আমার চোখ খারাপ হবার উপক্রম। রাত্রিবেলা শোবার পর যেই একবার চোখ পড়ে আলোর দিকে, আর চোখ সরতে চায়না, সেখানে তখন একটা ছোট্ট ফড়িংকে তাক করে আছে মুসোলিনি,—সুতরাং শেষ পর্যন্ত ধরতে পারে কিনা না-দেখে চোখ ফেরাতে পারিনা, তখন টিকটিকির ধৈর্যের সঙ্গে আমাকে পাল্লা দিতে হয়—ফড়িংটার ঠিক এক বিঘৎ দূরে মড়ার মতো পড়ে আছে টিকটিকিটা—কী যে ওর মতলব, কেনই বা ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ছেনা—কিছুই বোঝার উপায় নেই। সেই অবসরে আমি একটু চোখ ঘোরাতেই দেখি মাফিয়া হিংস্রভাবে গুটি-গুটি এগুচ্ছে একটা সবুজ মথের দিকে। সুতরাং আর চোখ ফেরানো যায়না। এইভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়। আর ওরা সবগুলোই নিয়ন আলোর কাছাকাছি থাকে বলে—আমাকে ঐ উজ্জ্বল আলোর দিকেই তাকিয়ে থাকতে হয়, সুতরাং বুঝতে পারছি নিজের চোখের ক্ষতি করছি। টিকটিকির চোখের কিন্তু অত চড়া আলোতেও কিছুই ক্ষতি হয়না।
ক্রমশ আমার এটা নেশার মতো হয়ে যায়। রাতের পর রাত আমি টিকটিকির পোকা ধরা দেখি। শুনেছি ডারউইন সাহেব ২৪ ঘণ্টা একটা ফুলের কলির দিকে তাকিয়ে ছিলেন—একটা ফুল আস্তে-আস্তে কীভাবে ফোটে দেখার জন্য। টিকটিকির শিকার ধরার দৃশ্যের মধ্যে কোন সৌন্দর্য নেই, একটা নিষ্ঠুর পাশবিকতা শুধু, তবু তাই দেখতে আমার নেশা ধরে যায়। টিকটিকিদের স্বভাব সম্পর্কে আমি অনেককিছু আবিষ্কার করে ফেলি। তার মধ্যে প্রধান হল, কোন্ টিকটিকি— অন্য টিকটিকিকে সহ্য করতে পারেনা। কাছাকাছি এলেই একজন আরেকজনকে তাড়া করে যায়। আমরা ছেলেবেলায় দেখতাম, টিকটিকি ধরতে গেলেই টিকটিকির ল্যাজ খসে যেত, ল্যাজটা ফেলে আসল টিকটিকিটা পালাত। আর সেই কাটা ল্যাজটাও জীবন্তের মতো নড়াচড়া করত। কিন্তু এখন দেখছি একটা টিকটিকি আর—একটার ল্যাজ সুযোগ পেলেই কামড়ে ধরে। তখন কিন্তু সেটার ল্যাজ খসে যায়না। তখন মুখ ফিরিয়ে অন্যটাকে কামড়ে ধরার চেষ্টা করে। একটা পোকার কাছাকাছি গিয়েও যে একটা টিকটিকি অনেকক্ষণ চুপচাপ পড়ে থাকে—সেটা কিন্তু শুধু উদাসীনতা বা প্রতীক্ষা নয়। আসলে তখন সে একচোখে দেখে পোকাটাকে, আর—এক চোখে দেখে দূরের আরেকটা টিকটিকিকে—একইসঙ্গে খাদ্য আহরণ ও আত্মরক্ষা—দুটোই চলতে থাকে। আরও বহু রহস্যময় স্বভাব আছে। একটা হয়তো আরেকটাকে তাড়া করে গেল, খানিকটা দূরে গিয়ে হঠাৎ কেন সে যে ভয় পেয়ে ঘুলঘুলির মধ্যে লুকিয়ে পড়ে কে জানে? কোনটা হয়তো তাড়া করে যায় ঘরের শেষ পর্যন্ত, কোনটা হয়তো একটু দূর দিয়েই হঠাৎ থেমে গিয়ে আবার একঘণ্টা চুপচাপ। কার যে গায়ের জোর বেশি—তারও বোঝার উপায় নেই—এই একবার সজারু তাড়া করছে কিলফিলকে—সে ভয়ে পালাচ্ছে, আবার একটু পরেই কিলফিল তাড়া করছে সজারুকে—তখন ওর কী ভয়! তাড়া করার সময় ডাক হয় অন্যরকম, খিস্-খিস্ খিস্-খিস্। আবার কেনই যে হঠাৎ একা-একা বুক ফুলিয়ে টিক্টিক্-টিক্টিক্ করে—তারও কোন মানে পাওয়া যায়না।
সবচেয়ে বিরক্তিকর লাগে, যখন কোন পোকা থাকেনা। অথচ ওদের পোকা ধরা দেখতে-দেখতে আমার নেশা লেগে গেছে। ঘুম আসছে না। তখন ইচ্ছে করে কোন জায়গা থেকে পোকা ধরে এনে ওদের সামনে ফেলে দিই। একদিন আমি এরকম করেছিলাম।
আমার বালিশের পাশে এসে বসল একটা মথ। বেশ বড়। দেখেই মনে হল আহা বড় সরল এই মথ বেচারা, জীবন সম্পর্কে কোন অভিজ্ঞতা নেই। আমার মাথার এত পাশে এসে বসেছে, কোন ভয়-ডর নেই, ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরলেই তো ওটা চাপা পড়ে মরবে। বেগুনে রঙের নরম তুলোট চেহারা, বোধহয় রাত্রে দেখতে পায় না—কেননা আমি এত কাছ থেকে ওকে দেখছিলাম, কোন ভয় পায়নি। তখন আমার মনে হল—এটা টিকটিকির সামনে পড়লে কী হয় দেখা যাক-না। ওদের সাধ্য নেই, এতবড় মথটাকে মারতে পারবে। একমাত্র মাফিয়ার কথা বলা যায়না, কিন্তু দেখলাম সেটা দেয়ালে নেই, বোধহয় ঘুলঘুলিতে বিশ্রাম নিচ্ছে। আমি মথটাকে আঙুল দিয়ে ঠেলে উঠিয়ে দিলাম। সেটা গিয়ে বসল উল্টোদিকের দেয়ালে। তখন আমি বিছানা থেকে উঠে আবার ওটাকে তাড়া দিলাম। তখন ওটা অন্ধের মতো কয়েক পাক ঘুরে এসে বসল আলোর কাছে। এমন ট্যালা, বসল প্রায় একটা টিকটিকির ঘাড়ের ওপর! সেটা তাড়াতাড়ি অমনি ভয়ে সরে গেল!
তখন মথটা বিশাল ডানা মেলে ওখানে বসে—আর পাঁচদিকে পাঁচটা রকেটের মতো পাঁচটা টিকটিকি। কারুর সাধ্য নেই ওটার সামনে এগোয় অথচ তাকিয়ে আছে লোভীর মতো। আমার মজা লাগতে লাগল। শেষ পর্যন্ত দেখি সেই দুর্দান্ত তিন নম্বরটা এগিয়ে এল। দাঁড়াল একেবারে মথটার মুখোমুখি। মথটা তবুও ওড়েনা। তিন নম্বরটা খ্যাক করে কামড়ে ধরল মথটার মাথা। আরম্ভ হল ডানা ঝটাপটি। আমি অবাক হয়ে দেখছি। তারপর দেখলাম আস্তে-আস্তে ফুলের পাপড়ির মতো মথটার দুটো বেগুনি ডানা খসিয়ে দিয়ে গিলছে তিননম্বর। অবিলম্বে শেষ হয়ে গেল।
সেইসময় বিষম অনুতাপ হল আমার। ছি, ছি, আমিই তো মথটার হত্যাকারী। একটু আগে উড়ে বেড়াচ্ছিল, টিকটিকিগুলোর ওপর জিঘাংসা জেগে উঠল আমার। কুৎসিত জীবগুলো কোন কাজে লাগেনা—মশা-মাছি-আরশোলা খায়না—শুধু সুন্দর সুন্দর মথ-প্রজাপতি ধ্বংস করে। এগুলো থেকে লাভ কী! আমি একটা ফুলঝাড়ু নিয়ে দেয়ালে-দেয়ালে টিকটিকিগুলো পেটাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওরা বিষম চালাক। আমার নাগাল থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে দেখে— আমি অনবরত ঝাঁটা চালিয়ে একটাকেও মারতে না-পেরে নিবৃত্ত হলাম শেষ পর্যন্ত।
হঠাৎ দেখি, আমার পায়ের কাছে একটা টিকটিকি। আরে, এ যে দেখি তিননম্বর। কী, আমাকেও কামড়াতে এসেছে নাকি? দেখি, নড়ে-চড়েনা। ঝাঁটা দিয়ে খোঁচা দিলাম, তবু নড়েনা। মরে গেছে! কোনবার হয়তো ওর গায়ে ফুলঝাড়ুর ঘা লেগেছিল। এত সহজে ওরা মরে যায়? কখন লেগেছে বুঝতেও পারিনি। যাক ভালোই হয়েছে, আসল আসামী মরেছে। আমি ওটার ওপর এক ঘা ঝাঁটা কষিয়ে ঠেলে দিয়ে শুয়ে পড়লাম।
পরদিন সকাল বেলা ওসব ভুলে গেছি। চা খেতে-খেতে কাগজ পড়ায় ডুবে গেছি। হঠাৎ মেঝেতে একটা দৃশ্য দেখে চমকে উঠলাম। অসংখ্য পিঁপড়ে একটা টিকটিকির মৃতদেহ টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মনে পড়ল আগের রাত্রের কথা। এই সেই তিননম্বর সেই দুর্দান্ত তিননম্বর, বিদ্যুতের মতো যার গতি, অতবড় মথটাকেও আক্রমণ করতে ভয় পায়নি—আজ সামান্য পিঁপড়েরা ওকে চিৎ করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কাল মথটার জন্য আমার দুঃখ হয়েছিল, আজ তিননম্বরের জন্যও আমার দুঃখ হল। খুবই দুঃখ, আমার প্রায় চোখে জল এসে গেল। কিন্তু সকালবেলা আমি একটা টিকটিকির দুঃখে কাঁদছি–মা এটা দেখতে পেলে আমাকে পাগল মনে করবেন ভেবে—আমি তাড়াতাড়ি চোখ মুছে নিলাম। ওটাকে আমার মারা উচিত হয়নি। জীবজগতের ব্যাপার, আহার্যের জন্য একজন আর-একজনকে মারবে। কিন্তু আমি এতবড় প্রাণী হয়ে ঐটুকু প্রাণীকে কেন মারতে গেলাম! দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখি, অন্য টিকটিকিগুলো দেয়ালের নানা কোণে লুকিয়ে থেকে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। যেন বলছে, কেন, কেন, কেন তুমি ওকে মারলে? কেন?