নীললোহিতের চোখের সামনে – ১০

১০

সেলুনটাতে বেশ ভিড়, আটটি চেয়ারে আটখানা কাঁচি খচাখচ শব্দ তুলে ব্যস্তভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আরও পাঁচ-ছয়জন মাথার খদ্দের প্রতীক্ষমাণ, আমিও তাদের মধ্যে একজন। সেলুনে চুল কাটার সময়টুকুই তেমন সুন্দর নয়, তার ওপর আবার অপেক্ষা করা—কিন্তু আমি বসেই রইলাম, কারণ আজ যখন ঠিক করে বেরিয়েছি, আজই চুকিয়ে ফেলব ঝামেলা।

ডাক্তারখানার মতন, আজকাল সেলুনেও পত্রপত্রিকা রাখা হয়। খান-কয়েক মেয়েদের ফ্যাশন পত্রিকা ও একটি ইংরেজি সচিত্র সাপ্তাহিক। যতদূর জানি, মেয়েদের চুল-কাটা বা দাড়ি কামাবার দরকার হয় না, এসব সেলুনে তারা কখনো আসবে না, তবু এখানে মেয়েদের ফ্যাশন পত্রিকা রাখার কী মানে হয় জানিনা। আর ঐ ইংরেজি সচিত্র সাপ্তাহিকটিও প্রায় মেয়েদেরই কাগজ। বেশ পুরোনো সংখ্যা, বোধহয় সের দরে কিনেছে।

ঐ পত্রিকাগুলো আমি স্পর্শ করলাম না, দুখানা ইংরেজি-বাংলা খবরের কাগজ ছিল, সেই দুটোই আদ্যোপান্ত পড়ে শেষ করতে লাগলাম।

ছেলেবেলায় ‘ইটালিয়ান’ সেলুনে বসে খবরের কাগজের জামা পড়ে যখন চুল কাটতাম, তখন পরামানিকদের সঙ্গে বেশ মধুর সম্পর্ক ছিল। চুল কাটতে—কাটতে অনেক গল্প হতো, সময়টা এত লম্বা মনে হতোনা। সংস্কৃত সাহিত্যে নরসুন্দর বা পরামানিক বা নাপিতদের খুব ধূর্ত বলা হয়েছে বারবার। অন্তত বাকচতুর। এখনকার সেলুনে অবশ্য সে-পরিচয় পাওয়া যায়না। এখন যাঁরা ঝকঝকে-তকতকে সেলুন খুলে চুল কাটার ব্যাবসা নিয়েছেন, তারা ভদ্র ও গম্ভীর, খদ্দেরদের সঙ্গে শুধু ‘ঘাড়টা তুলুন’ কিংবা ‘জুলপি কি লম্বা হবে স্যার?’ এই ধরনের কথা ছাড়া আর কোন কথা হয়না। চুল কাটার সময়টা আজকাল তাই এত বিরক্তিকর।

অবশ্য নিজেদের মধ্যে কথা বলতে কোন বাধা নেই। কাঁচি খচখচ করতে—করতে কিংবা ক্ষুর ঘ্যাসঘ্যাস করতে করতে একজন আর-একজনকে জিজ্ঞেস করতে পারে, ‘যদুদা, আজ তোমার ক’টা মাথা হল? আমার তো আজ শুধু ক্ষুরের কাজ, কেইচি ধরতেই পারলামনা’ ইত্যাদি।

সেলুনের একজন কর্মচারীর বয়েস পনেরো-ষোলো। সে এখনও পুরোপুরি নরসুন্দর হয়ে ওঠেনি। সে ব্রাশে সাবান মাখিয়ে দেয়, ক্ষুর সাফ করে, কাটা চুল পরিষ্কার করে। অর্থাৎ অ্যাসিস্ট্যান্ট। তাকে তার একজন সিনিয়ার কোলিগ জিজ্ঞেস করল, ‘এই হরেন্দর আজ তোর দুপুরেও ডিউটি, খেয়ে এসেছিস তো?’

ক্লিপ থেকে ফুঁ দিয়ে চুল বার করতে-করতে হরেন্দ্র বলল, ‘হ্যাঁ। রোজই তো আমার ন’টার মধ্যে খাওয়া হয়ে যায়।’

—রোজ ন’টায় খাস্? আর রাত্তিরে খাস্ কখন?

—ন’টা-দশটায়!

–দুপুরে কিংবা বিকেলে খিদে পায়না?

—চা খাই যে? চা খেলে আর খিদে পায়না।

-কে রান্না করে?

–বাবা।

বাবা কেন? মা করেনা?

–মা কাজ করতে যায়—

কথাবার্তাগুলো একঘেয়ে ধরনের। অর্থাৎ কথার জন্যই কথা বলা। যে

জিজ্ঞেস করছে এবং যে উত্তর দিচ্ছে, কারুরই বিশেষ মন নেই। কিন্তু আমাকে শুনতে হবেই, মানুষের কান তো আর বন্ধ করা যায়না।

—আজ কী খেয়েছিস?

—আলুসেদ্ধ আর ভাত।

-আর?

—কাঁচালঙ্কা।

—ডাল ছিলনা? মাখলি কী দিয়ে?

-ফ্যানাভাত তো, মাখব আবার কী?

হঠাৎ আমার একটু হাসি পেল, অকারণেই বলা যায়। হাসি লুকোবার জন্য আমি সিগারেট ধরিয়ে মুখটা ফেরালাম। এক্ষুনি ইংরেজি কাগজে একটা বিজ্ঞাপন পড়ছিলাম। ‘A course in Mughlai dishes for house wives. Fee rupees 75/—contact Mrs…’

মিসেস অমুক গৃহস্থ বধূদের মোগলাই রান্না শেখাবেন পঁচাত্তর টাকা ফি নিয়ে। আমি ভাবতে লাগলাম, মোগলাই রান্না শেখানো হবে কী পদ্ধতিতে? রেডিওতে রান্না শেখাবার মতন, এবার মাখন দিয়ে মাংসগুলো ভাজুন, চাকাচাকা করে পেঁয়াজ কেটে আদার রসে ভিজিয়ে… একজন এরকম বলে যাবে আর গিন্নীরা বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুনবে? নাকি সত্যি-সত্যি মাছ-মাংস-পোলাউয়ের চাল—ঘি—গরমমশলা এসব এনে হাতে-কলমে শেখানো হবে? কে আনবে সেগুলো, ছাত্রীরাই? নাকি মাস্টারনীই সেগুলো সরবরাহ করবেন! মাত্র পঁচাত্তর টাকা ফি-তে কি অতসব হয়? রান্না হয়ে গেলে কি নিজেরাই সেখানে বসে খাবে, না বাড়িতে নিয়ে যাবে? খাঁটি মোগলাই রান্নায় তো শুনেছি আসল জাফরান, মুক্তাভস্ম, একবারও ডিম পাড়েনি এমন মুর্গির মাংসটাংস লাগে, সেসব জোগাড় হবে কোথা থেকে?

হরেন্দ্র ছেলেটির স্বাস্থ্য কিন্তু খারাপ নয়, বেশ গড়াপেটা। কালো রং, কিন্তু তেলচকচকে। মুখখানা হাসিখুশি। আজকাল খাদ্যের গুণাগুণ নিয়ে অনেকেই খুব ভাবে। কারবোহাইড্রেট, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ভিটামিন—এসব মিলিয়ে একটা ব্যালান্সড ডায়েট খাওয়া দরকার। আর হরেন্দ্র খাচ্ছে ফেনাভাত আর আলু—দুটোই তো স্টার্চ না কারবোহাইড্রেট কী যেন, প্রোটিন-ফ্রোটিনের নামগন্ধ নেই—কিন্তু ওর তো দিব্যি স্বাস্থ্য। বিজ্ঞানের, অনেককথাই স্রেফ গাঁজাখুরি!

কথাবার্তা আরও অনেকদূর গড়িয়েছে। হরেন্দ্র চট্‌পট্ করে কাজ সারছে আর কথার জবাব দিচ্ছে।

—তোরা এখনও সেই ঘরেই আছিস? কী যেন গণ্ডগোল হচ্ছিলনা?

—ওখানে আর নেই। ও লোকটা বড্ড হারামি! (হারামি শব্দটা হরেন্দ্র উচ্চারণ করল অম্লান মুখে, গালাগাল বলে মনেই হলনা) রোজ খিটিমিটি-খিটিমিটি—এখন আমরা রেললাইনের ওধারে বস্তিতে একটা ঘর নিয়েছি।

—কত ভাড়া?

-সতেরো—

—সতেরো? আগেরটা পনেরো ছিলনা? এই বাজারে দুটাকা খরচ বাড়ালি?

আবার আমার হাসি পেল। চোখের সামনেই ইংরেজি কাগজে আর-একটি বিজ্ঞাপন,

A luxurious western style ground-floor flat, three bed-rooms with attached bath-rooms, dining and launge space-rent Rs. 1,800/-.

এইসব ভালো-ভালো বিজ্ঞাপন দেখলে শুধু হাসি পায়না, সিটি দিতে ইচ্ছে করে। তিনখানা শয়নকক্ষের ভাড়া আঠারোশো টাকা! অফিসটফিস নয়, মনুষ্যবাসের জন্যই, কেননা, স্পষ্ট লেখা আছে ‘বেডরুমস’। এই এক ধাঁধা! কাগজে এরকম বিজ্ঞাপন প্রায়ই দেখি। আঠারোশো টাকা দিয়ে যে-লোক ফ্ল্যাট ভাড়া নেবে, তার রোজগার কত? সে নিজেই একটা বাড়ি বানিয়ে ফেলে-না কেন?

ইচ্ছে হল, ফ্ল্যাটটা একদিন দেখে আসব। ভাড়া নিই-না-নিই, দেখতে দেবে নিশ্চয়ই। দেখতে চাই, ঐ ফ্ল্যাটের মেঝেগুলো সোনারুপো দিয়ে তৈরি কিনা! এর আগে তিন হাজার টাকা ভাড়ায় একটা ফ্ল্যাটের বিজ্ঞাপন চোখে পড়েছিল, সেই ফ্ল্যাটটা না-দেখে খুব মিস্ করেছি! ‘ওয়েস্টার্ন স্টাইল’—সেটাও কী ব্যাপার দেখে আসা মন্দ কী?

গ্রাউন্ডফ্লোর ফ্ল্যাট যখন বলেছে, তখন বাড়িটার নিশ্চয়ই আরও দু-তিনটি তলা আছে। দোতলা-তিনতলার ফ্ল্যাটগুলোও কি ঐরকম, না আরও বেশি ভাড়া? যদি তিনখানা ফ্ল্যাট থাকে, তাহলে বাড়ির মালিকের আয় মাসে চুয়ান্নশো টাকা। আর ঐরকম বাড়ি যার, সে কি শুধু একটাই বাড়ি বানিয়েছে? যাকগে, ওসব বড়-বড় ভাবনা।

বাংলা কাগজে পড়লাম, কোথায় যেন একজন জোতদারকে খুন করা হয়েছে গতকাল। দেশটা প্রায় নাগাল্যান্ড হয়ে উঠল। দুশো বিঘে জমি বেআইনিভাবে দখলে রেখেছিল নাকি জোতদারটি। দুশো বিঘে জমি থেকে বছরে কত আয় হয়, আমি জানিনা। তবে জোতদারটিকে খুব বুদ্ধিমান বলা যায়না। ঐসব জমিজমা বিক্রি করে কলকাতায় একখানা এই বিজ্ঞাপনের মতন ‘ওয়েস্টার্ন স্টাইল’ ফ্ল্যাটবাড়ি হাঁকিয়ে বসলেই পারত! অবশ্য দুশো বিঘে জমি বেচে কলকাতায় ছোটখাটো বাড়িও হতো কিনা জানিনা।

চুল কেটে বেরুতে আমার বেশ দেরি হয়ে গেল। একটা জায়গায় আমার খুব জরুরি যাওয়ার দরকার ছিল। ট্রামে-বাসে দারুণ ভিড়, তার ওপর এইরকম গরম। ধৈর্য রাখা গেলনা, ঝট করে একটা ট্যাক্সি নিয়ে ফেললাম। পনেরো পয়সায় যেখানে যাওয়া চলত, সেখান চারটাকা খরচ হয়ে গেল। মনে পড়ল, মাসে দুটাকা ঘর ভাড়া বেড়েছে বলে হরেন্দ্র ও তার সহকর্মী পনেরো মিনিট ধরে আফসোস করেছে। একটু খচ্‌মচ্ করল ভেতরটা, মনে হল, আমিও অপরাধী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *