১৯
আপনাদের এখান থেকে তো পাকিস্তানের বর্ডার খুব কাছে, তাই না?
—এই তো, মাইলখানেক! ঐ যে তালগাছগুলো দেখছ, ওর ওপাশেই।
—লোকজন বর্ডার পেরিয়ে যাতায়াত করেনা?
-হরদম হরদম! পাঁচটা টাকা দিলেই দালালরা ওপারে নিয়ে গিয়ে বাসে তুলে দেয়। এপারেও সেই সিস্টেম। আর স্মাগলিংও হচ্ছে প্রচুর। হবেনাই-বা কেন, সারা বর্ডার জুড়ে তো আর পুলিশ বসিয়ে রাখতে পারেনা! পুলিশ থাকলেই—বা কী, ডানহাত বাঁহাতের ব্যাপার—
—এদিকে রিফিউজি আসেনি?
—আসেনি আবার!
হালদারমশাই চোখ ছোট করে আমার দিকে তাকালেন। তারপর ফিসফিস করে গোপন কথা বলার মতন বললেন, ‘আরে ভাই, কী বলব তোমাকে! কী সুন্দর নিরিবিলি ছিল জায়গাটা আগে। এই বাঙালরা আসবার পর একেবারে ছারখার করে দিল! জায়গাটা নোংরা করেছে কী রকম, ওদের একগাদা কাচ্চাবাচ্চা, তার ওপর আবার দল পাকানো—’
আমি একটুও দমে না-নিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ সত্যি, বাঙালরা আসবার পর পপুলেশন এমন বেড়ে গেছে হঠাৎ এক-একটা জায়গায়।’
—শুধু পপুলেশন বেড়েছে নাকি? দ্যাখো তো পাঞ্জাবে, ওখানকার রেফুজিরা কীরকম অ্যাকটিভ! গায়ে খেটে দুদিনের মধ্যে কীরকম দাঁড়িয়ে গেছে সবাই! আর বাঙালরা, কাজকর্ম করার দিকে মন নেই, খালি বাকতাল্লা আর চেঁচামেচি! এক—একজনের আবার তেজ কী! এসেছিস আমাদের গাঁয়ে—কোথায় একটু ভদ্র হয়ে থাকবি, তা না—এইজন্যই তো বাঙালদের—
অর্থাৎ কিনা এখানকার বাঙালদের চেয়ে পাঞ্জাবের বাঙালরা অনেক ভালো!
— পাঞ্জাবের বাঙাল? হাঃ, হাঃ, হাঃ-রেফুজি মানেই বাঙাল বলছ? তা মন্দ নয়।
কথা হচ্ছিল মালদার এক গ্রামে। আমার মাঝে-মাঝে ঘুরে বেড়ানোর বাতিক আছে। এদিকটায় কখনো আসিনি শুনে আমার এক বন্ধু তার কাকাকে চিঠি দিয়ে পাঠিয়েছে।
হালদারমশাই অতি সজ্জন লোক, একসময় ছোটখাটো জমিদার ছিলেন, এখন সব জমিজমা গেছে, এখন চিনির ব্যাবসা করছেন। মাঝারি অবস্থা কিন্তু অতিথি-আপ্যায়নে কোন ত্রুটি নেই। আমি ওঁর ভাইপোর বন্ধু এবং শহুরে লেখাপড়া শেখা ছেলে হয়েও গ্রামে এসেছি—আমাকে এমন বেশি খাতির করতে লাগলেন যে রীতিমতন অস্বস্তি বোধ করতে হয়। আমার স্নান করার জন্য গরম জলও দিতে চান—আমার ঘোরতর আপত্তি সত্ত্বেও।
হালদারমশাই প্রায় সারাটা জীবন গ্রামে কাটালেও এমনিতে বিশেষ গোঁড়ামি নেই। আমি ওঁর ছেলের বয়সী হওয়া সত্ত্বেও বললেন, সিগারেট-টিগারেট খাওয়া যদি অভ্যেস থাকে আমার সামনে লজ্জা কোরোনা। লজ্জা করে শুধু-শুধু দম আটকে থাকবে কেন? আমার নিজের তো একদিন বিড়ি না-হলে কোষ্ঠ পরিষ্কার হয়না। উনি নিজে ব্রাহ্মণ কিন্তু জাতের বিচার তেমন নেই, গাঁয়ের হিন্দু-মুসলমান অনেকেই তাঁকে মানে।
কিন্তু মুশকিল হল এই বাঙালদের বিষয়ে। বাঙালদের ওপর ওঁর বেশ একটা চাপা রাগ আছে। আমার কাছে এক গণ্ডা বাঙালদের নিন্দে করে ফেললেন। আমি হুঁ হাঁ দিয়ে গেলাম। হালদারমশাই আমাকে তো কিছু জিজ্ঞেস করেননি—ধরেই নিয়েছিলেন আমিও একজন ঘটি। এখন আমি মহাফ্যাসাদে পড়লাম। নিজে বাঙাল হয়ে অন্য বাঙালদের নিন্দে অনবরত শোনা যায়না। কিন্তু মাঝে-মাঝে আমাকে একটা অদ্ভুত ভদ্রতাবোধ পেয়ে বসে। আমার মনে হল, এখন যদি হালদার—মশাইয়ের কাছে আমি আত্মপরিচয় দিই, তাহলে উনি দারুণ লজ্জায় পড়ে যাবেন—আমার দিকে আর তাকাতে পারবেননা। সেই লজ্জায় ওঁকে ফেলতে আমার ইচ্ছে হলনা। আবার ওঁর কথায় সায় দিয়ে গেলে মনে হবে, আমি বাঙালত্ব অস্বীকার করে ঘটিদের দলে ভিড়তে চাইছি। যদিও আমি প্রকৃত অর্থেই বাঙাল এবং রেফিউজি। আমার বাবা-ঠাকুর্দা ছিলেন পূর্ববঙ্গে—আমিও বাল্যকালে ছিলাম এবং ওখানে আমাদের বাড়ি ছিল, এখানে এক টুকরো জমিও নেই।
হালদারমশাই আমার কাছে খুব অন্তরঙ্গভাবে গোপনে বাঙালদের নিন্দে করেছিলেন, বাড়ির বাইরে অবশ্য তিনি প্রকাশ্যে আর বাঙাল বলেননা। বলেন ইস্টবেঙ্গলের লোক। একটু রেগে গেলে রেফিউজিগুলো!
হালদারমশাইয়ের সাত-আটবছরের ছেলেকে একজন যুবক বাড়িতে পড়াতে আসে। রোগা চেহারার লাজুক ছেলেটি। সে একদিন পড়িয়ে চলে যাচ্ছে, হালদারমশাই আমাকে বললেন, ‘ঐ যে ছেলেটি দেখলে, খুব ভালো ছেলে, মন দিয়ে পড়ায় রতনকে। ছেলেটি বাঙাল হলেও খুব সিনসিয়ার–পড়াশুনায় খুব আগ্রহ। বাঙালদের মধ্যে এরকম ভালো ছেলেও দুটো-একটা আছে, আই মাস্ট অ্যাডমিট ‘
হালদারমশাইয়ের বয়েস প্রায় ষাটের কাছাকাছি, তাঁর মা এখনো বেঁচে আছেন। তিনি এসে হালদারমশাইকে বললেন, ‘ও খোকন, দুটো বাঙাল ছোঁড়াকে ডেকে নে আয়, নারকোলগুলো পেড়ে দেবে। ওরা এমন তড়বড়িয়ে গাছে উঠতে পারে—’
হালদারমশাই আমার দিকে তাকিয়ে বিগলিত হাস্যে বললেন, ‘লম্ফ দিয়ে গাছে ওঠে, ল্যাজ নাই কিন্তু!’ আমি হাসব না কী করব বুঝতে পারলামনা।
এইরকম অবস্থা আমার আগে আরও দু-একবার হয়েছে। অন্য ধরনেরও। কফি হাউসে একবার এক মারোয়াড়ি বন্ধুর সঙ্গে বসেছিলাম। মারোয়াড়ি মাত্রেই তো আর কুটিল ব্যবসায়ী নয়। আমার সেই বন্ধুটি সেবার বি. এ. পরীক্ষায় ইংলিশ অনার্সে ফার্স্ট হয়েছিল, বেশ গরিব এবং জলের মতন বাংলা বলে। হঠাৎ আর—এক বন্ধু আমাদের টেবিলে উপস্থিত হয়েই বলা শুরু করল, ‘আরে ভাই মারোয়াড়িদের জ্বালায় আর পারা গেলনা। আজ বড়বাজারে গিয়েছিলাম, এক ব্যাটা ভুঁড়ি দাস—।’ আমি বন্ধুটিকে যতই চোখ টিপছি, সে কিছুতেই বোঝেনা। মারোয়াড়ি বন্ধুটি মিটিমিটি হাসতে লাগল আর বলল, ‘যা বলেছেন! মারোয়াড়ির জাতটাই দেশটাকে…
হালদারমশাইয়ের মেয়ে কলেজে পড়ে, ছুটিতে এই সময়েই গ্রামের বাড়িতে এসেছে। মেয়েটির নাম অর্চনা, নেহাত মন্দ নয় গোছের চেহারা—তবে শহরের কলেজে পড়ে বেশ স্মার্ট হয়েছে। আমাকে দেখে অন্তঃপুরিকা হয়ে রইলনা, সপ্রতিভভাবে গল্প করতে লাগল। বেশ বুদ্ধিমতী মেয়ে, অর্চনাকে আমার ভালোই লাগছিল! মালদার কলেজে পড়ে অর্চনা, কলকাতা সম্পর্কে দারুণ কৌতূহল, আমাকে বারবার কলকাতার কথা জিজ্ঞেস করছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।
এদিকে হালদারমশাইয়ের বাঙাল ফিক্সেশন—যে-কোন কথাতেই ঘুরিয়ে—ফিরিয়ে তিনি বাঙালদের কথা আনবেনই। গভর্নমেন্ট তাঁর কিছু জমিজায়গা কেড়ে নিয়ে রেফিউজিদের দিয়েছে, এই হল প্রথম রাগের বিষয়। রেফিউজিদের দিতে না-হলেও যে গভর্নমেন্ট অতিরিক্ত জমি কেড়ে নিতই—সেটা ভুলে যান। বাঙালদের সম্পর্কে তাঁর আর-একটা রাগের কারণ, বাঙালরা নাকি বড্ড বেশি রগচটা, কথায়-কথায় ঝগড়া করতে আসে। আর খাইছি-শুইছি ধরনের ভাষা তাঁর দুকানের বিষ।
অৰ্চনা বলল, ‘জানো বাবা, আমাদের ক্লাসে দুটো বাঙাল মেয়ে আছে, তাদের কথা শুনে কিন্তু একদম বোঝা যায়না। আমি তো কিছু বুঝতে পারিনি। তারপর ওরা ওদের বাড়িতে একদিন আমাকে খাওয়ার নেমন্তন্ন করল—প্রত্যেকটা খাবারেই এত ঝাল না, উঃ, জিভ জ্বলে গিয়েছিল, তখনই বুঝলাম—! তার ওপর আবার শুটকি মাছ, আমার তো এমন বমি পেয়ে গেল…’
হালদারমশাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ও কথা শুনলে ঠিকই বোঝা যায়, যতই লুকোবার চেষ্টা করুক, বাঙালদের চিনতে…কী চেনা যায়না?’
আমি কাঁটা হয়ে বসে রইলাম। হালদারমশাই আমাকে বুঝতে পারেননি। এখন বুঝতে পারলে চোর ধরা পড়ার অবস্থা হবে। আমি আর আমার আত্মপরিচয় দেবার সুযোগ কিছুতেই পাচ্ছিনা। এমনকী একথাও আমার মনে হল, আহা ওরা নিজেদের বাড়িতে বসে নিরিবিলিতে একটু বাঙালদের নিন্দে করছে—তাতে আমি বাগড়া দিই কেন! পরনিন্দার মতন মুখরোচক জিনিশ আর নেই—ক’জনই-বা এ জিনিশ করেনা?
অর্চনা আমাকে বলল, ‘আমাদের গ্রামটা ঘুরে দেখছেন সব? চলুন, নদীর পাড়টায় যাবেন?’
—নদীর পাড় খুব সুন্দর বুঝি?
—আগে খুব সুন্দর ছিল—ফাঁকা মাঠ, ঝপঝপ করে পাড় ভেঙে পড়ত— এখন আর বেশি যাইনা—এখন ওদিকটা রিফুজি কলোনি হয়েছে তো! বাঙাল ছেলেগুলো এমন প্যাট-প্যাট করে তাকায়—যেন কোনোদিন মেয়ে দেখেনি
আমি আমার চোখে হাত বুলিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম, আমারও দৃষ্টি প্যাটপেটে কিনা।
হালদারমশাইকে আমি বললাম, ‘কাকাবাবু, কাল তো চলে যাব, আমাকে একটু পাকিস্তানের বর্ডারটা দেখিয়ে দিন!
তিনি বললেন, ‘ও আর দেখার কী আছে? দেখে কি কিছু বোঝা যাবে?’ —তবু চলুন।
ধানক্ষেতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, ‘ঐ যে ঐ তালগাছের লাইন ওখানেই পাকিস্তানের শুরু।’
আমি চুপ।
উনি আবার বললেন, ‘ঐ একটা খড়ের বাড়ি দেখছ? বাড়িটা পড়েছে পাকিস্তানে, আর উঠোনটা ইন্ডিয়ায়। হেঃ, হেঃ হেঃ—’
আমি চুপ।
—এরকম ভাগাভাগির কোন মানে হয়? সাহেবরা একটা দাগ টেনে দিল -আর অমনি দেশটা দুভাগ হয়ে গেল! আর আমাদের ন্যাতারাও সব যেমন!
আমি চুপ।
—কী হে চুপ করে আছ যে?
–এমনি, মনটা খারাপ লাগছে।
—কেন?
–এমনিই আর কী! আচ্ছা কাকাবাবু, যদি মনে করেন, পার্টিশানের দাগটা আরও দেড়-দুমাইল এদিকে পড়ত তাহলে আপনার বাড়িটাও পাকিস্তানে পড়ে যেত। আপনিও তাহলে রিফিউজি হয়ে—লোকে আপনাকে বাঙাল বলত—
—ইঃ, বললেই হল? আমার এখানে সাতপুরুষের বাস—
—ওখানেও অনেক বাঙালের—
হঠাৎ হালদারমশাই একটু চুপসে গেলেন। তারপর বিষণ্নভাবে বললেন, ‘ওরে বাবা, বুঝি, বুঝি, ঠিকই বুঝি। ভিটেমাটি ছেড়ে এতগুলো লোক এসে কত দুঃখে পড়েছে—আমাদেরই মতন তো সবকিছু—তবু মাঝে-মাঝে মনে থাকেনা। বুঝলে না, মানুষ ছোটখাটো স্বার্থ নিয়েই বেশির ভাগ সময়—তবু মনের ভেতরে—’
আমি আর-কিছু বললামনা। চুপ করে গেলাম আবার।