নীললোহিতের চোখের সামনে – ১৮

১৮

মাত্র চারজন যুবক, তারা প্রায় আড়াইশো নারী-পুরুষকে দমন করে রেখেছে। দেখলে বেশ আনন্দ হবারই কথা। যৌবনের এই প্রচণ্ড শক্তি ও তেজই তো কাম্য। হোক-না একটু অসভ্য, একটু উগ্র, কিন্তু দুঃসাহস জিনিশটা সবসময়ই দেখতে ভালো লাগে। মাত্র চারজনে মিলে তো এতজন মানুষকে ভয় পাইয়ে রেখেছে।

শহরতলী। একদিকে নতুন উপনিবেশ গড়ে উঠেছে। তৈরি হচ্ছে নতুন রাস্তা। তার পাশে একটা চওড়া খাল! খালের ওপর ছবির মতন একটা কাঠের ব্রিজ, তার ওপারে ধানক্ষেত। খালপাড়ে কিছুটা জায়গা সিমেন্ট বাঁধানো, আশেপাশে কিছু ঘাসও পুরু হয়ে আছে। সারাদিন অসহ্য গরমের পর অনেকে ঐ জায়গাটায় বসতে আসে। দক্ষিণদিকটা বহুদূর উন্মুক্ত, তাই হু হু করে হাওয়া ছুটে আসে —বঙ্গোপসাগর থেকে একশো মাইল ছুটে এসেও সে-হাওয়া ক্লান্ত নয়, কলকাতায় এসে সে-হাওয়া একেবারে নীরস হয়ে যায়নি।

পার্ক নয়, তবু এ-অঞ্চলে বেড়াবার পক্ষে সবচেয়ে সুন্দর জায়গা ঐ খালধারের সিমেন্ট বাঁধানো পাড়, ঘাসের আসন আর কাঠের ব্রিজ। কাঠের ব্রিজের গায় হেলান দিয়ে দাঁড়ালে বাল্যকালের কথা মনে পড়ে। স্রোতে কচুরিপানার ভেসে যাওয়া দেখলে এক ধরনের বুক-মোচড়ানো উদাসীনতা আসে।

প্র্যামে বাচ্চা বসিয়ে মায়েরা এখানে একটু হাঁপ ফেলতে আসে। ছুটোছুটি করতে আসে বাচ্চার দল, ফ্রক-পরা কিশোরীরা ফড়িং ধরার জন্য দৌড়ায়। প্রেমিক—প্রেমিকার হাত মাটি থেকে ঘাস ছেঁড়ে, জলের ছায়ায় তাদের ঘন-ঘন মুখের ভাব বদলায়। দু-চারজন বৃদ্ধ কনুই চুলকোতে-চুলকোতে কথার ফোয়ারা ছোটায়। আর হাওয়া সবাইকে বারবার ছুঁয়ে যায়। সারাদিন গরমের পর এরকম মখমলের মতন মোলায়েম বাতাস ভারি বিস্ময়কর লাগে, মনে হয়, পৃথিবীতে এখন এই মুহূর্তে, যে জিনিশটা সবচেয়ে আরামের—সেটাই বিনামূল্যে এমন অপর্যাপ্ত পাওয়া যাচ্ছে কী করে?

এই দঙ্গলটার অধিপতি সেই চারজন যুবা। তাদের পোশাকের বৈশিষ্ট্য আছে, পোশাক দেখলেই বোঝা যাবে—তারা আর-সবার আলাদা। কালোরঙের খুব সরু প্যান্ট, কোমরে বেলটের বালসে জোড়া তলোয়ার কিংবা বাঘের মুণ্ডু মনোগ্রাম করা, লাল-কালো-সবুজে এমন অদ্ভুত বিকট কম্বিনেশানের জামাকাপড়, মিলগুলো ঐ ধরনের জামার কাপড় শুধু এইরকমের যুবাদের জন্যই তৈরি করে মনে হয়, বাঙালি হলেও এদের হাতে লোহার বালা, মাথার চুল তেল চুকচুকে এবং বিচিত্র কায়দায় আঁচড়ানো।

এই যুবক চারজন কোন-একটা জায়গায় স্থির হয়ে বসেনা, এরা টহল দিয়ে বেড়ায়। এদের দেখামাত্রই সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। প্রেমিক-প্রেমিকারাও চুপ করে গিয়ে সরে বসে, বাচ্চারা খেলা থামায়, বুড়োরা কথা বন্ধ করে।

এরা আড়ে আড়ে চায়। বাচ্চারা হয়তো একটা বল নিয়ে খেলছে—এরা মাঝখানে এসে একটা শট দিয়ে বলটা বহুদূরে পাঠিয়ে দেয়, খলখল করে হাসে। বাচ্চাদের মায়েরা কিছু বলতে গিয়েও থেমে যান। প্রেমিক-প্রেমিকাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় এরা গলা খাঁকারি দেয়, চেঁচিয়ে ওঠে, ‘ওকি হচ্ছে? ওকি হচ্ছে? মাকে বলে দেব!’ জলের ধারে ঝুঁকে-বসা প্রেমিক-প্রেমিকা মরা গাছের মতো কাঠ হয়ে যায় তখন। বুড়োদের পাশ দিয়ে যাবার সময়ও এরা বলে, ‘এই যে দাদু, একটা সিগ্রেট হবে? ছাড়ুন-না একটা।’ বৃদ্ধরা থুতনি নাড়া বন্ধ করে নিথর হয়ে যান, বোঝা যায় ভিতরে-ভিতরে তাঁরা জিভ দিয়ে দাঁতের মাড়ি চেপে আছেন, দু-একজন বৃদ্ধ আবার এদের খাতির করে সিগারেট বাড়িয়েও দেন।

একদিন একজন প্রেমিক বুঝি প্রতিবাদ করেছিল। ঠিক প্রেমিক না, দুটি মেয়ের সঙ্গে তাদের দূর সম্পর্কের মাসতুতো দাদা। দূর সম্পর্কের মাসতুতো দাদাকে অর্ধেক প্রেমিক বলা যায়। সে দুটি যুবতীকে দুপাশে বসিয়ে কোন বীররসের গল্প বলছিল, এই সময় এই চারজন যুবক পিছন থেকে আওয়াজ দেয়। সে তখন তেড়ে আসে—চেঁচিয়ে বলে, ‘কী ভেবেছেন কী আপনারা? লোকে ভাইবোনদের নিয়েও বেড়াতে আসতে পারবেনা? যা খুশি তাই করবেন? কুচ্ছিৎ অসভ্য কথা এইসব ছোট ছেলেমেয়েদের সামনে—’

তার ফলে সেই চারজন, সেই মাসতুতো দাদা প্রেমিককে চ্যাংদোলা করে তুলে জলে ফেলে দেয়। সে সাঁতার জানতনা, জলে নাকানি-চোবানি খেয়ে যখন প্রায় ডুবতে বসছিল, মেয়ে দুটি চেঁচাচ্ছিল অক্লান্তভাবে—তখন সেই চারজনই তাকে জল থেকে তুলে দিল! তার কলার ধরে দাঁড় করিয়ে বলেছিল, ‘কী চাঁদু, মাথা ঠাণ্ডা হয়েছে? নাকি আর-একটু মধ্যমনারায়ণ লাগবে?’

প্রতিবাদ করেছিল একজন বৃদ্ধও। ওরা সিগারেট চাওয়ায় বৃদ্ধটি খেঁকিয়ে উঠে বলেছিল, ‘কী, তোমার ঠাকুর্দার বয়েসী আমি, আমার কাছে সিগারেট চাইছ? কী ভেবেছ কী! হাওয়াটাকেই নোংরা করে দিলে এরা—’

এ-কথা শুনে সেই চারজন হাসতে আরম্ভ করে। বৃদ্ধ গাড়ি চেপে এসেছিলেন, ওরা হাসতে-হাসতে গাড়ির চাকার হাওয়া খুলে দিল, বৃদ্ধের ছড়িখানা পাশে পড়েছিল—সেখানা তুলে নিয়ে লোফালুফি করতে-করতে ভেঙেই ফেলল। ওদের একজন বৃদ্ধের কাছে এসে হাসতে-হাসতে ভাঙা টুকরো দুটো ফেরত দিয়ে বলল, ‘স্যরি দাদু, ছোট ছেলে তো আমরা—খেলা করতে গিয়ে ভেঙে ফেলেছি।’

আর-কেউ এখন প্রতিবাদ করে না। ওরা যখন পাশ দিয়ে যায়—সবাই বিনয়াবনতভাবে চুপ করে থাকে। যেন সম্রাটের সামনে বাধ্য প্রজা। না, এ-উপমাটা ঠিক হলনা, এই আড়াইশো নারী-পুরুষ যেন ওদের ক্রীতদাস—স্প্যানিশ দস্যুরা যখন ক্রীতদাসের ঝাঁক নিয়ে যেত—তখন তাদের চাবুকের সামনে ক্রীতদাসরা যেমন ভয়ে নিথর হয়ে থাকত—দৃশ্যটা সেইরকম।

ঐ চারজন যুবককে আমি অপছন্দ করতে পারিনি। ওদের ঔদ্ধত্য ও অসভ্যতা সীমাহীন, কুশিক্ষা ও কুরুচির ফলে ওরা সৌন্দর্য কিংবা সম্মান— কোনটারই মূল্য জানেনা। কিন্তু ওদের দুঃসাহসও তারিফ করার মতন—বাংলাদেশে দুঃসাহসও তো খুব সুলভ দৃশ্য নয়। ওরা নিজেদের কব্জির জোরের ওপর বিশ্বাসী, ওরা বেপরোয়া, ওরা কারুক্কে ভয় করেনা। ওরা জেনে গেছে, এই আড়াইশো লোক কখনো একতাবদ্ধ হয়ে ওদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেনা। সে উপাদান এদেশে নেই। ওরা তাই জনতাকে ভয় করেনা। ওরা পুলিশ কিংবা মৃত্যুকেও ভয় করেনা। ওদেরই মতন যুবকরা তো প্রায়ই গুণ্ডামি-বদমায়েসীর অভিযোগে পুলিশে ধরা পড়ছে, জেল-ফাঁসি হচ্ছে, তবু তো ওদের স্রোত ও তেজ কমেনি, ওরা দমে যায়নি। এই দুঃসাহসটুকুর প্রশংসা করতেই হয়। এত লোকের মধ্যে ঐ চারজনই যথার্থ শক্তিমান ও সাহসী।

কিন্তু আমার ভুল হয়েছিল। সেই ঘটনাটাই বলি। একদিন ওখানে একটি সতেরো-আঠারো বছরের মেয়ে তার বাচ্চা ভাইকে নিয়ে বেড়াতে এল। মেয়েটির ফুটফুটে গায়ের রং, একমাথা কোকড়া চুল, শাড়ি পরার ধরন দেখলে মনে হয়, সে অল্পকিছুদিন আগেও ফ্রক পরত। মেয়েটি হাতে একটা লালরঙের বল নিয়ে লোফালুফি করছে।

সেই যুবক চারজনের দৃষ্টি মেয়েটির ওপর পড়ল। তারা পরস্পর ঠেলাঠেলি করে নিজেদের মধ্যে কীসব বলাবলি করল। মেয়েটির সঙ্গে কোন বয়স্ক অভিভাবক নেই দেখে পুলকিত হয়ে তারা চেঁচিয়ে উঠল, ‘আজ নতুন জিনিশ এসেছে রে!’

মেয়েটি ওদের দিকে ভ্রূক্ষেপ করলনা। ছোটভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে হাল্কা পায়ে এগিয়ে গেল। বারবার এদিক-ওদিক পিছন ফিরে দেখছে, মেয়েটি কাকে যেন খুঁজছে। মেয়েটি ছোটভাইকে জিজ্ঞেস করল, ‘টুটু, গোরা কোথায় গেল? গোরা?’ ভাই বলল, ‘ডাকো না! তুমি ওকে ডাকো—’

মেয়েটি শূন্য উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে উঠল, ‘গোরা! গোরা! এদিকে এসো!’ এই বলে মেয়েটি হাতের লাল বলটা ছুঁড়ে দিল কোনাকুনি ভাবে রাস্তার দিকে।

বলটা যেভাবে ছোঁড়া হয়েছিল—তাতে সেটা বহুদূর গড়িয়ে যেত—কিন্তু তার আগে যুবক চারটি ছুটে এসে পা দিয়ে বলটা আটকাল—হাতে তুলে নিয়ে বলল, ‘বাঃ, মাইরি, বেশ্ বলটা তো!’

এতক্ষণ কেউ লক্ষ করেনি, পাশের অসমাপ্ত রাস্তাটার ঢালু জায়গায় দাঁড়িয়ে গোরা প্রাকৃতিক কর্ম সারছিল। হঠাৎ এবার সে ছুটে এল। ভালো করে বোঝা যায়নি প্রথমে, উল্কার মতন প্রচণ্ড গতিতে বাঘের মতন একটা বিশাল জানোয়ার ছুটে দৌড়ে এল, এসেই ঝাঁপিয়ে পড়ল বল-হাতে যুবকটির উপর। না, বাঘ নয়, একটা প্রকাণ্ড অ্যালসেশিয়ান কুকুর। যুবকটি আর্ত চিৎকার করে মাটিতে পড়ে গেল, কুকুরটা তার বুকে পা দিয়ে দাঁড়াল। মেয়েটি চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই, এই গোরা! কাম হিয়ার!’ সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রমুগ্ধের মতন কুকুরটা বল মুখে ফিরে এল মেয়েটির কাছে। আহ্লাদে ল্যাজ নাড়তে লাগল!

যুবকটি মাটি থেকে উঠেছে, সঙ্গীরা তার পোশাকের ধুলো ঝেড়ে দিল। তারপর চারজনেই এগিয়ে এসে পা ব্যাঁকা করে দাঁড়িয়ে অষ্টাদশী মেয়েটিকে বলল, ‘এই যে, শুনছেন! আপনার কুকুর মানুষকে অ্যাটাক করছে—আর-একটু হলে জানে মেরে দিত…’

মেয়েটি তার পাতলা ঠোঁট উল্টে হাসির ভঙ্গিতে বলল, ‘গোরা এমনিতে কারুকে কিছু বলেনা। আপনারা ওর বল ধরলেন কেন?’

যুবক চারজন আর-কিছু বলার আগে—অ্যালসেশিয়ানটা গম্ভীরভাবে দুবার ঘেউ-ঘেউ করে উঠল। যুবক চারজন আর-কিছু বললনা।

তারপর আমি সেখানে আর আধঘণ্টা ছিলাম। সেদিন সেখানে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যেতে লাগল। যেন বহুদিন পর ‘স্বার্থপর দৈত্য’র বাগানে বসন্ত এসেছে। মেয়েটি বল ছুঁড়ে-ছুঁড়ে কুকুরটিকে নিয়ে খেলা করতে লাগল—কুকুরটা ছুটে যাচ্ছে, কিন্তু মেয়েটির ডাক শুনে সঙ্গে-সঙ্গে ফিরে আসছে। ছোট ছেলেমেয়ের দলও সেই খেলায় যোগ দিল। আনন্দের কলরোলে খেলা জমে উঠল। সেদিন বুড়োরা নিশ্চিন্ত হয়ে বকবকানি চালিয়ে গেল, সেদিন প্রেমিক—প্রেমিকারা ঘন হয়ে বসে হাতে-হাত রাখল। একমাত্র সেই চারজন যুবকই স্থির হয়ে সেদিন বসেছে জলের ধারে। নিজেদের মধ্যে কথা বলছে—কুকুরটা তাদের পাশ দিয়ে যখন ছুটে যাচ্ছে—তখন তারা আড়ষ্টভাবে চুপ।

আমি ভুল করেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম ঐ আড়াইশো জনের জনতার মধ্যে ঐ চারজন যুবকই যথার্থ শক্তিমান। কিন্তু তাদের চেয়েও শক্তিমান একটা কুকুর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *