নীললোহিতের চোখের সামনে – ১

পাঁচটি সুস্থ সবল শহুরে যুবক চিড়িয়াখানায় গেছে কেন? চিড়িয়াখানায় ওরা কী দেখবে? পাঁচটি ছেলে হঠাৎ এক বিকেলবেলা ঠিক করে ফেলল, ‘চল্ চিড়িয়াখানায় জন্তুজানোয়ার দেখে আসি’—এটা আমার কীরকম অবিশ্বাস্য মনে হয়। যুবকরা বিকেলবেলা যাবে খেলার মাঠে কিংবা সিনেমায় লাইন দেবে কিংবা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে গুলতানি করবে—মেয়েদের দেখলে এক চোখ বন্ধ করবে বা শিস্ দেবে কিংবা রাজনৈতিক মিছিলে যোগ দিয়ে তেজী শ্লোগান দেবে কিংবা অন্য পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মারামারি-পটকাবাজি করবে—এগুলোই স্বাভাবিক।

জন্তুজানোয়ার সম্পর্কে যদি শখ থাকেই তাহলে সকালবেলা কুকুরের গলায় চেন বেঁধে বেড়াতে বেরুবে অথবা বন্দুক নিয়ে জঙ্গলে যাবে শিকার করতে। কিন্তু চিড়িয়াখানায় জানোয়ার দেখতে যাবে কেন? অবশ্য চিড়িয়াখানায় কতরকম জানোয়ার আছে আমি জানিনা।

চিড়িয়াখানায় সাধারণত যায় কারা? অধিকাংশই কলকাতার বাইরের লোক। কলকাতার দ্রষ্টব্য জায়গাগুলোতে কলকাতার লোক সাধারণত যায়না। গ্রাম থেকে, অন্য প্রদেশ থেকে লোকেরা কলকাতায় বেড়াতে এলে চিড়িয়াখানায় যাবেই। কলকাতার লোকও যায়, রবিবার বা ছুটির দিন সপরিবারে, তিন-চারটে বাচ্চা থাকবেই— এবং সবই ঐ-বাচ্চাদের জন্যই। শিশুদের বিস্ময় বড়রা উপভোগ করে। আরও কেউ-কেউ যায়, বিশেষত অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা, খাবারদাবার ও পানীয় সঙ্গে নিয়ে চিড়িয়াখানার সুন্দর মাঠে পিকনিক করে

যুবক-যুবতীরাও যায়, কিন্তু তারা একা নয়, এবং একসঙ্গে দুজনের বেশি নয়। পাখি কিংবা পশু দেখার দিকে তাদের বেশি ঝোঁক নেই, সাদা বাঘ দেখার জন্য তারা লাইনে দাঁড়ায়না, তারা অলস পায়ে ঘুরে-ঘুরে খোঁজে একটি নিরিবিলি বসার জায়গা। সেরকম জায়গা পাওয়াও যায়, মাঠে অপূর্ব ফুলের শোভা, জলের ধারে গাছের ছায়া, ছিমছাম বেঞ্চ। কখনো ভেসে আসে সিংহগর্জন, হস্তির বৃংহিত। একসঙ্গে হাজার পাখির ডাক—আর ওরা দুজন সম্পূর্ণ আলাদা ভাষায় ফিসফিস করে কথা বলে।

এদের সবাইকেই চিড়িয়াখানায় মানায়, কিন্তু ঐ পাঁচজন যুবক কেন? ওরা কি ছেলেবেলায় চিড়িয়াখানা দেখেনি? যৌবনে এই পশুপ্রীতি কেন? অবশ্য চিড়িয়াখানায় কত জাতের পশু আছে আমি জানিনা। একবার চিড়িয়াখানায় পুকুরের ধার দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে লজ্জা পেয়ে পাশ কাটিয়ে গিয়েছিলাম। ঝোপের আড়ালে দুজন বসে আছে, তাদের ব্যাঘাত ঘটাতে চাইনি। হঠাৎ কানে এসেছিল সেই ঝোপ থেকে মেয়েলি কণ্ঠস্বর, ‘আঃ হচ্ছে কী, ছাড়ো ছাড়ো, ইস, না আর কোনোদিন আসবনা, জানোয়ার কোথাকার!’ মেয়েটি চিড়িয়াখানায় বসে কোন্ জানোয়ারের কথা বলেছিল, আমার দেখা হয়নি।

সেই যুবক পাঁচজনও বিশেষ কোন খাঁচার সামনে ব্যগ্র হয়ে দাঁড়াচ্ছেনা। তারাও ঘুরছে হাল্কা পায়ে। পাঁচজনই পরেছে সরু প্যান্ট, চক্রাবক্রা জামা, অতি—কায়দায় আঁচড়ানো চুল। সন্ধানী চোখে ঝোপে-ঝাড়ে নিরালা বেঞ্চে উঁকি মারছে। দৈবাৎ কোন ছেলেমেয়ে পাশাপাশি দেখলেই জমে যাচ্ছে তারা। বোঝা গেল, তারা পশুপাখি দেখতে আসেনি, এমনকি মেয়ে দেখতেও আসেনি, এসেছে এত দূরে পয়সা খরচ করে অন্যদের জ্বালাতন করতে। ওদের নিজেদের কোন মেয়ে—সঙ্গী নেই, সুতরাং অন্যদের ওরা শান্তিতে থাকতে দেবেনা।

ওদের ভাষা খুব চেনা। ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে-থাকা ছেলেমেয়েদুটির একেবারে কাছে গিয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে বলবে, ‘এই যে, অ্যাঁ, কলেজ পালিয়ে এইসব! মাকে বলে দেব!’…পিরীতি কাঁটালের আটা, লাগলে পরে…’, ‘মাইরি, মেয়েটার মুখে কিরকম লপচু-লপচু ভাব দেখছিস্!’ ‘আরে শালা, আবার পদ্যের বই এনেছে, পদ্য শোনানো হচ্ছিল!’ ইত্যাদি।

ছেলেটি-মেয়েটি কিছুক্ষণ আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকে, তারপর সুড়-সুড় করে উঠে যায়, একটু দূরে গিয়েই দ্রুত পা চালায়। পাঁচটা চোঙা প্যান্ট-পরা ছেলের ব্যবহারের প্রতিবাদ করবে, এমন সাহস ওদের নেই। ওরা পৃথিবী উল্টে দিতে পারে। ছেলেমেয়েদুটি উঠে পালিয়ে গেলে ওরা সাফল্যে অট্টহাসি হাসে।

তবে, ওরকম নিভৃতে বসে থাকা ছেলেমেয়ে ওরা বেশি পাচ্ছিলনা। তিন—চার জায়গায় হানা দিয়েই স্টক শেষ। কিন্তু ওরা আট আনার টিকিট কেটে ঢুকেছে, ওদের পয়সা উসুল হচ্ছিলনা। ঘুরতে-ঘুরতে ওরা একটা বড় দলের সামনে এসে পড়ল।

পাখির ঘরের সামনে শতরঞ্চি বিছিয়ে বসেছে একটি দল, প্রায় পঁচিশ-তিরিশ জন, অর্ধেক-অর্ধেক ছেলেমেয়ে। সম্ভবত কোন ক্লাব, তারা সঙ্গে খাবার এনেছে, হার্মোনিয়ম তবলা ও গানের খাতা এনেছে। স্বাস্থ্য ও প্রাণসম্পদে ভরা ছেলেমেয়ে, অনাবিল হাসি ও আনন্দ করতে জানে। তারা কেউ কারুকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাচ্ছেনা, কেউ গদগদ নয়, রসিকতার জন্য খারাপ ভাষা ব্যবহার করার দরকার হচ্ছেনা।

সেই পাঁচজন যুবক একটু দূরে পা ফাঁক করে দাঁড়াল। ঐ-দলের মেয়েগুলোর মুখের ওপর তীব্র দৃষ্টি বুলিয়ে ওরা অবস্থাটা যাচাই করার চেষ্টা করতে লাগল। ওরা যেন সুনীতিরক্ষক পুলিশ। কোথাও ছেলে আর মেয়েরা একসঙ্গে বসেছে, এটা ওরা সহ্য করবে না। এখানেও ওরা আওয়াজ দেওয়া শুরু করবে কিনা, সেটা ঠিক করতে একটু সময় নিল। ঐ-দলে প্রায় পনেরো-ষোলোজন ছেলে আছে, যদিও কালচার-মার্কা ক্যাবলাকান্ত ছেলে সব, ধুতি-ফুতি পরা ল্যাজে—গোবরে, এদের শালা রুখে ওঠার ধক্ নেই, তবু যদি ওঠে, পনেরোজন তো, দেখা যাক্।

ওদের দলের অনুষ্ঠান এবার আরম্ভ হবে। শীত শেষ হয়ে এসেছে, মেঘ নেই, তকতকে নীল আকাশ, রঙিন ফুলে চিড়িয়াখানার মাঠটা রঙের সমুদ্র, দুর্লভ সব পাখির ঘরের সামনে ওরা আনন্দ করতে এসেছে। গোল হয়ে বসেছে, কয়েকটা ফ্লাস্ক থেকে বেরুল কফি, কাগজের গেলাসে ঢালা হতে লাগল, একজন বলল, ‘আগেই খাওয়া-দাওয়া? আগে গান শুরু হোক্!’ আরেকজন বলল, ‘কফি খেতে-খেতে গান!’ আরেকজন বলল, ‘এই মন্দিরা সেই যে ফুলগুলো এনে—ছিলে?’ মন্দিরা বলল, ‘ও হ্যাঁ, সেগুলো তো দেওয়া হয়নি!’

এরা পাঁচজন একটু দূরে পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। এতগুলো মেয়ে দেখেও ওরা এখনও আওয়াজ দিতে পারছেনা, এইজন্যে বেশ অস্বস্তি। একজন ফিসফিস করে বলল, ‘ফিস্টির নামে ফষ্টিনষ্টি করতে এসেছে শালারা।’ আর একজন বলল, ‘এসব পাবলিকের জায়গায় ওসব বেলেল্লাপনা, মামদোবাজি নাকি?’ আরেকজন, ‘দেব শালাদের ধুনে?’

সেই দলটায় গান শুরু হবার আগে একটি মেয়ে উঠে সবাইকে একটা-একটা করে গোলাপ ফুল দিল। লাল গোলাপ, তাজা। মেয়েটির হাতে অনেক গোলাপ ছিল, সবাইকে দিয়েও ফুরোলনা, হাতে অনেক রয়ে গেল। মেয়েটি খুব ছটফটে হাসিখুশি খোলামেলা ধরনের। ফুলগুলো নিয়ে সে এদিক-ওদিক তাকাল। বেশ কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়েও ওদের দেখার জন্য ভিড় জমিয়েছে, মেয়েটি তাদেরও একটি করে ফুল দিল। দিতে-দিতে সে সেই পাঁচজন যুবকের সামনে এল, দ্বিধা করলনা, বলল, ‘আপনারা ফুল নেবেন? নিন-না!’

সেই পাঁচজন জবরদস্ত মস্তান একটু অপ্রস্তুত। লজ্জায় তারা শরীর বেঁকাতে লাগল। মেয়েটি টপাটপ তাদের হাতে একটা করে গোলাপ দিয়ে ফিরে গেল নিজের দলে। সেই পাঁচজন ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল বোকার মতন, পরস্পর মুখ—তাকাতাকি করতে লাগল।

গান শুরু হয়ে কিছুক্ষণ চলার পর ওরা তখনও দাঁড়িয়ে। যে-মেয়েটি ফুল দিয়েছিল, ওরা পাঁচজন তাকেই একদৃষ্টে দেখছে। সেই দল থেকে আরেকটি ছেলে উঠে এসে ঐ পাঁচজনকে বলল, ‘আপনারা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন, আসুন—না আমাদের সঙ্গে বসবেন।’

এরা অতিশয় ভদ্র হয়ে বলল, ‘না, না— ‘

সেই ছেলেটি বলল, ‘কেন আসুন-না, অনেক জায়গা আছে।’

পায়-পায় এগিয়ে এসে এরা বসল ধারের দিকে। চোঙা প্যান্ট, পা মুড়ে বসতে অসুবিধে হয়, বসেছে এঁকেবেঁকে, আনস্মার্টভাবে, হাতে ফুল। ওরা কোরাস গাইছে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে। তারপর একজন এদের জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনারা গান জানেননা? একটা গান শোনান-না!’

এরা সমস্বরে বলল, ‘না-না আমরা গান জানিনা!

–সে কি, কোন গান জানেননা?

-না।

আসলে ওরা পাঁচজনেই অনেক সিনেমার গান দু-তিন লাইন করে জানে। কিন্তু এরকম জায়গায় বসে কখনো গান করেনি, তাই সাহস পেলনা।

—ঠিক আছে আমাদের সঙ্গে কোরাসে গলা মেলান!

—কী গান?

—আলোকের এই ঝর্না ধারায় ধুইয়ে দাও!

ওরা এ-গান জানেনা। তাদের সবাই যখন প্রাণখুলে একসঙ্গে গাইতে লাগল, এরা পাঁচজন শুধু বসে রইল চুপ করে। পরস্পরের মুখের দিকে দেখছে মাঝে—মাঝে। অবিলম্বেই ওদের কথা আর-সবাই ভুলে গেল। আপনমনে গান গাইছে তারা। এরা পাঁচজন একটু বাদেই উঠে পড়ল, কারুর কাছ থেকে বিদায় না—নিয়েই চুপচাপ চলে গেল।

বেশ-কিছুটা দূরে গিয়ে ওরা একসঙ্গে হাসিতে ফেটে পড়ল। একজন বলল, ‘যাঃ শালা কী ন্যাকামি মাইরি!’

আরেকজন বলল, ‘মেয়েটা বেশ দেখতে ছিল, ওকে পেলে কলজেটা বাঁধা দিতাম।’

আরেকজন হাতের গোলাপ ফুলটা মাটিতে ছুঁড়ে বলল, ‘ধ্যুৎ যত মেয়েলিপনা।’

আরেকজন ফুলের পাপড়িগুলো ছিঁড়তে লাগল নিঃশব্দে।

আরেকজন ফুলটা গোপনে পকেটে রেখে বিমর্ষভাবে বলল, ‘আজ আর কিছু ভালো লাগছেনা, চল বাড়ি যাই।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *