নীললোহিতের অন্তরঙ্গ – ৭

মেয়েদের সবচেয়ে সুন্দর লাগে, আমার চোখে, যখন তারা প্রবল বাতাসের স্রোতের বিপরীত দিকে হাঁটে। হু-হু করছে হাওয়া, চুল এলোমেলো এবং আঁচলটা পিছনের দিকে ডানার মতন উড়তে থাকে, মেয়েরা তখন বদলে যায়, তাদের চোখমুখ অচেনা মনে হয়। সেইরকম হু-হু করা বাতাসের মধ্যে দিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে-হাঁটতে একপলক তাকিয়ে বরুণাকেও আমার হঠাৎ সুন্দরী মনে হল। অন্য কোন সময় মনে হয়নি, একটু পুরুষালি ধরনের চেহারা বরুণার, বেশ লম্বা, গায়ের রং ফর্শার কাছাকাছি হলেও রাজপুতানিদের মতন চওড়া হাতের কবজি এবং নাকটা গুজিয়ার মতন ছোট্ট, আর বোঁচা। অন্যসময় সুন্দরী মনে হয়না, কিন্তু তখন সেই মুহূর্তে বরুণাকে মনে হল বত্তিচেল্লির আঁকা ‘থ্রি গ্রেসেস’-এর অন্যতমা। আমি বরুণার দিকে পাপচোখে আবার তাকালাম। কিছু একটা কথা বলা দরকার, তাই বললাম, দারুণ হাওয়া দিচ্ছে না?

বরুণা যেন অন্যজগৎ থেকে কথা বলছে, সেইভাবে উত্তর দিল, আঃ, আমার ইচ্ছে করে, সমুদ্রের ওপর একটা ছোট্ট ডিঙি নিয়ে একলা এ-রকম হাওয়ার মধ্যে দিয়ে ভেসে যাই।

কথা হচ্ছিল নদীর পাড়ে। পাশেই বিশাল নিষ্প্রাণ দামোদর। ইউনেস্কোর উদ্যোগে একটা প্রোগ্রাম হয়েছিল, গ্রামের অশিক্ষিত চাষী-মজুররা কথা বলার সময় কতগুলো শব্দ ব্যবহার করে, সাধু বাংলা তারা কতখানি বোঝে এইসব তথ্য সংগ্রহ করার। কলেজের কোন একটা পরীক্ষার পরের ছুটিতে আমি বাই চান্স সেই চাকরি পেয়ে যাই। ন’জন ছেলে এবং পাঁচজন মেয়ের একটি দল মিলে আমরা গ্রামে-গ্রামে ঘুরতাম, ইস্কুলবাড়িতে ক্যাম্প করা হতো। সেই দলের একটি মেয়ে বরুণা, তখন আমরা বর্ধমানের কলানবগ্রামে, শক্তিগড় অঞ্চলে। দলের আর—চারটি মেয়ে আর-চারশো মেয়েরই মতন, তারা ছেলেদের থেকে একটু দূরে আলাদা দল মিলে থাকে, লাজুক লতার মতন আড়ে আড়ে চায়, হাসির কথায় চুপ করে থাকে, আবার অকারণে হাসে, অকারণে ভয় পায়, পদে পদে, ‘ইস কী বিশ্রী কাদা, উঃ কী বিচ্ছিরি গন্ধ…’। দলের মধ্যে যে মেয়েটি সবচেয়ে সুন্দরী ছিল—তাকে আমরা ছেলেরা আড়ালে বলতাম, মিস পুঁটুলি, শাড়ি-ব্লাউজে জড়ানো একটা পুঁটুলির মতনই দেখতে ছিল তাকে। আমাদের বিকাশ মাঝে-মাঝে মন্তব্য করত, ইস্, অতই যখন লজ্জা, তখন চাকরি করতে আসা কেন?

একমাত্র বরুণা ছিল আলাদা, ডাকাবুকো ধরনের, অহেতুক লজ্জার বালাই নেই, ছেলেদের সঙ্গে পাশাপাশি হাঁটছে, ছোটখাটো খানাখন্দ দেখলে দিব্যি লাফিয়ে পার হচ্ছে, কখনো-বা কাদার মধ্যে হাঁটু ডুবিয়ে সাঁওতালনির মতন হি-হি করে হাসছে। বরুণা বলত, আমি চাকরিটি নিয়েছি কেন জানেন? এই যে বাড়ির লোকজন ছাড়াই একা-একা বেড়াবার সুযোগ পেলাম। বেড়াতে আমার এত ভালো লাগে।

সেইসময় আমার একটা গুরুতর অসুখ ছিল। ঘন-ঘন প্রেমে পড়া। ঘণ্টায় ষাট মাইল স্পীডে কোন গাড়ি ছুটে যাচ্ছে, তার জানলায় বসে-থাকা কোন মেয়ের মুখ দেখেও এমন প্রেমে পড়ে যেতাম যে, মনে হতো, একে না-পেলে আমি বাঁচবনা! সাতদিন আহারে রুচি থাকতনা। সুতরাং বরুণার সঙ্গে যে আমি প্রেম করবার চেষ্টা করব, তাতে আর আশ্চর্য কী! বাকি ছেলেরা অন্য চারটি মেয়ের পিছনেই ঘুরঘুর, তাদের মুখের একটু হাসি বা চোখের ঝিলিক দেখবার জন্য হা—পিত্যেশ করে বসে থাকত। বরুণাকে ওরা একটু ভয় ভয় করত, তাছাড়া বরুণা বেশ লম্বা, অন্য ছেলেদের প্রায় সমান-সমান—দলের মধ্যে আমি একটু বেশি লম্বা ছিলাম বলে—আমার পাশেই বরুণাকে একটু-একটু মানাত। কিন্তু হায় হায়, বরুণার সঙ্গে আমার এক বিন্দুও প্রেম হলো না।

বলাই বাহুল্য, আমাদের সঙ্গে একজন প্রৌঢ় দলপতি ছিলেন—আমরা যে-কাজের জন্য এসেছি সেটা সার্থক হচ্ছে কিনা দেখার বদলে—ছেলেরা-মেয়েরা সবসময় আলাদা থাকছে কিনা, এটা লক্ষ রাখাই ছিল যে তাঁর প্রধান দায়িত্ব। আমরা তাঁকে গ্রাহ্য করতাম না, এবং সবথেকে অগ্রাহ্য করত বরুণা। বরুণা অনবরত আমাদের মধ্যে চলে আসছে, খপ করে যখন-তখন হাত ধরছে, ইয়ার্কি করে পিঠে কিল, পুকুরপাড়ে পা ধুতে গেলে গায়ে জল ছিটিয়েছে—এমনকী সন্ধের পরও এসে বলেছে, চলুন-না এ গ্রামের শ্মশানটা দেখে আসি। কিন্তু গলার স্বর একটু গাঢ় করে কথা বলতে গেলেই বরুণা চোখ পাকিয়ে বলেছে, এই, ওকি হচ্ছে, ন্যাকামি? ইস, একেবারে গদগদ দেখছি!—না, ওরকম মেয়ের সঙ্গে প্রেমের কথা বলা যায়না, ওদের সঙ্গে শুধু বন্ধুত্ব।

বরুণার বাড়ির কথা একটু-একটু শুনেছিলাম। যৌথ পরিবার, জ্যাঠামশাই বিষম আচারনিষ্ঠ, গোঁড়া, বাবা— অধিকাংশ প্রৌঢ় মধ্যবিত্ত যেরকম হয়, কোন বিষয়েই কোন জোরালো মতামত নেই, মা বহুকাল হাঁপানিতে শয্যাশায়ী, দাদা কাঠের ব্যবসা ফেঁদেছে—আরও অনেকগুলো ভাইবোন। অর্থাৎ বরুণাদের বাড়িতে গিয়ে বরুণাকে দেখলে কোন বৈশিষ্ট্যই দেখতে পেতামনা নিশ্চিত, সব মেয়ের মতনই গুটি-গুটি কলেজ যায়—বাড়ি আসে, মাসিপিসির সঙ্গে নাইট শো-তে সিনেমা যায়, দাদার বন্ধুরা বাড়িতে এলে সে ঘরে ঢোকা বারণ। কিন্তু বাড়ির সঙ্গে খুব বোঝাবুঝির পর চাকরি নিয়েছে, আমাদের দলপতি নীতীশদা ওর কাকার বন্ধু—তিনি ওর ওপর নজর রাখবেন এই শর্তে। বাড়ি থেকে সেই প্রথম আলাদা বেরিয়েছে বরুণা, তার চরিত্র আমূল বদলে গেছে, পায়ে-পায়ে ওর চঞ্চলতা। বরুণার মধ্যে একটা প্রবল অ্যাডভেঞ্চারের নেশা দেখেছিলাম।

বরুণা বলত, পৃথিবীতে কত জায়গা আছে, আমার ইচ্ছে করে একা-একা ঘুরে বেড়াই। কোন একটা অচেনা পাহাড়ের চূড়ায় উঠছি, আঃ, ভাবতে যা ভালো লাগে!

আমি বলতাম, ইস, মেয়ে হয়ে শখ কত!

বরুণার চোখ ঝলসে উঠত। তীব্র স্বরে বলত, কেন, মেয়েরা বুঝি পারেনা? ছেলেরাই সব পারে? দেখলাম তো কত ছেলে মেয়েরও অধম। দেখবেন,

আমি একদিন আফ্রিকা চলে যাব, একটা নতুন নদী কিংবা জলপ্রপাত আবিষ্কার করব! আমি হা-হা-করে হাসতাম। বলতাম, দেখা যাবে! বড়জোর স্বামীর সঙ্গে হুডু জলপ্রপাত দেখতে যাওয়া কিংবা বাবা-মার সঙ্গে এলাহাবাদের ত্রিবেণী—এর বেশি না!

বরুণা তখন রাগের চোখে দুম করে আমার পিঠে এক বিরাশি সিক্কা কিল! আল্পস পাহাড়ের উচ্চতা মিসিসিপি নদীর দৈর্ঘ্য ওর মুখস্থ ছিল। হিটাইট সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কারের ব্যাপারে একজন সুইডিস মহিলার অভিযানের কথা ও আমাকে শুনিয়েছিল। বরুণাও ছেলেমানুষের মতন কল্পনা করত, ও নিজেও একদিন মধ্যপ্রাচ্যে কিংবা হিমালয়ের জঙ্গলে কিছু একটা আবিষ্কার করে ফেলবে।

সেবার আমাদের দলে বরুণা সত্যিই একটা অ্যাডভেঞ্চারের সঙ্গী হয়েছিল। মরা দামোদরের পাড়ে আমরা দুপুরে এসে থেমেছি। বিষম হাওয়া দিচ্ছে, মেঘলা আকাশ। প্রত্যেকের দশজন করে চাষীকে ইন্টারভিউ করার কথা, আসবার পথে, একটা বাজার দেখে তা আমরা সেরে ফেলেছি। শেষ শীতের শুকনো দামোদর —বিরাট চাওড়া—কিন্তু বেশিরভাগই বালি দেখা যাচ্ছে, মাঝে-মাঝে জল। আমরা ঠিক করলাম, হেঁটে দামোদর পার হব। বিদ্যাসাগর মশাই নাকি বর্ষার দামোদর সাঁতরে পার হয়েছিলেন, আমরা শীতের দামোদর হেঁটে রেকর্ড করব। তখন ‘আওয়ারা’ বইটা সদ্য রিলিজ করেছে, আমি আর বিকাশ রাজকাপুরের ভঙ্গিতে হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট গুটিয়ে নিলাম। হঠাৎ বরুণা বলল, আমিও যাব! দলপতি নীতীশদা আঁতকে উঠে বললেন, না, কক্ষনোনা, বরুণা যাবেনা। বরুণা ততক্ষণে আঁচল কোমরে বেঁধেছে, বলল যাবই! নীতীশদা বললেন, না বলছি! অনেক জায়গায় কোমর এমনকী বুকজল। বরুণা বলল, তা হোক, আমি সাঁতার জানি। ঐ তো চাষীর মেয়েরা পার হচ্ছে। নীতীশদা বললেন, ওরা ঠিক-ঠিক জায়গা চেনে। এক-এক জায়গায় দারুণ স্রোত আছে।… বরুণা, যেয়োনা বলছি, তাহলে তোমার বাবাকে আমি নালিশ করতে বাধ্য হব! বরুণা এবার ঠোঁট উল্টে বলল, করুন গে যান, আমার বয়ে গেল।—ততক্ষণে সে ঢালু পাড় দিয়ে নামতে শুরু করেছে!

প্রথমে বালি, বালির ওপর দিয়ে আমরা তিনজনে ছুটতে লাগলাম। বরুণার শাড়ি হাওয়ায় ফুলে উঠে পত পত করে উড়ছে! খুশিতে ওর মনখানা উদ্ভাসিত সুশ্রী। আমারও এমন ভালো লাগছিল যে, আমি ল্যাং মেরে বিকাশকে বালির ওপর ফেলে দিয়ে দুজনে গড়াগড়ি করলাম, বরুণা মুঠোমুঠো বালি আমাদের গায়ে ছুঁড়ে মারতে লাগল। পাড়ে দাঁড়িয়ে বাকি সবাই দেখছে—ওরা ভদ্র, সভ্য, ওরা মাটিতে গড়াগড়ি দেবার কথা চিন্তাই করতে পারেনা। একটু পরেই জলের ধারার কাছে পৌঁছোলাম। ঠাণ্ডা টলটলে জল—অঞ্জলি ভরে মুখে ছিটোলাম তিনজনেই, তারপর নেমে পড়লাম। বরুণা শাড়িটা হাতে ধরে উঁচু করে নিল! ক্রমশ-ক্রমশ জল হাঁটু ছাড়াল—তখন বরুণা শাড়ি ছেড়ে দিয়ে বলল, ভিজুক গে।

সেই জল ছাড়িয়ে আবার বালি—ওপর থেকে বোঝা যায়না, কত চওড়া নদীর খাত। আবার বালি ছাড়িয়ে জল। এবার জল ঊরু ছাড়িয়ে গেল—জল ঠেলার সাঁ সাঁ শব্দ, বরুণা আনন্দে একেবারে খল খল করছে, একবার হোঁচট খেয়ে পড়তে গিয়ে আমার হাত চেপে ধরল। আমি ওর কাঁধ ধরে বললাম, এবার দিই ডুবিয়ে? ও বলল, ইস্, আসুন-না দেখি, আমারও গায় কম জোর নেই।

কোমর ছাড়িয়ে প্রায় বুক পর্যন্ত জল। বিকাশ বলল, জল আরও বাড়বে নাকি? বরুণা সেকথা গ্রাহ্য না-করে উত্তর দিল, এত ভালো লাগছে, আমরা যেন ওপারে কী আছে জানিনা, যেন একটা নতুন জায়গায় যাচ্ছি!— হাওয়া খুব জোর, জলেও স্রোতের টান লাগল, আর ব্যালান্স রাখা যাচ্ছেনা, বিকাশ ভয়ে ভয়ে বলল, হঠাৎ জোয়ার-টোয়ার এল নাকি! আমি কিন্তু সাঁতার জানিনা! বলতে-বলতেই বিকাশ হুমড়ি খেয়ে পড়ল, আমাকে জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠল, আমি বললাম, আরে ওকি করছিস! বরুণা বলল, সাঁতার জানেননা তো এলেন কেন! বিকাশ বলল, চলো আমরা ফিরে যাই। বরুণা বলল, মোটেইনা! আমার দিকে ফিরে বলল, আপনি তো সাঁতার জানেন, আসুন আপনি আমি দুজনেই যাই! বিকাশ বলল, নিলু, আমাকে আগে এপাড়ে পৌঁছে দিয়ে যা! আমি পা রাখতে পারছিনা! দুচোখ ভরা বিদ্রূপ নিয়ে বিকাশের দিকে তাকাল বরুণা। তারপর সাঁতারের ভঙ্গিতে জলে গা ভাসিয়ে দিয়ে বরুণা বলল, আমি তাহলে একাই চললাম।

চাকরিটা ছিল মাত্র তিন সপ্তাহের। শেষ হয়ে যেতে তারপর আর কেউ কারো খোঁজ রাখিনি। শুধু বিকাশের সঙ্গে মাঝে-মাঝে দেখা হয়। কিছুদিন আগে বিকাশ বলছিল, তোর সেই দেবী চৌধুরানী মার্কা মেয়েটাকে মনে আছে? বরুণা? সেদিন আমাদের এক কলিগের বাড়িতে গিয়ে দেখলাম, তার বউ সেই বরুণা। কী চেহারাই হয়েছে! চেনা যায়না—এর মধ্যেই তিনটে বাচ্চা।

তার কিছুদিন পর আমিও একদিন বরুণাকে দেখেছিলাম দুপুরবেলা চলন্ত ট্যাক্সিতে। টাক মাথায় আলু-আলু মার্কা একজন লোক, নিশ্চয়ই বরুণার স্বামী, মুটিয়েছে বলে বরুণার মুখখানাও ভোঁতা ধরনের, সঙ্গে একটা দেড় বছরের ছেলে, খুব সম্ভবত হিন্দি সিনেমার দুর্গম পাহাড় কিংবা নির্জন হ্রদের দৃশ্য দেখতে যাচ্ছে। না চেনার কী আছে, এইটাই তো স্বাভাবিক ও সাধারণ ঘটনা!

বরুণার কথা আজ আবার মনে পড়ল, কেননা, কাগজে দেখছিলাম আটটি বাঙালি মেয়ে হিমালয়ে উঠে রন্টি শৃঙ্গ জয় করেছে। ভাবছি এই খবরটা পড়ে বরুণা খুশি হবে, না দুঃখিত হবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *