৪
ছেলেবেলায় ইস্কুলে সবাইকেই প্রায় একটা রচনা লিখতে হয়। তোমাকে যদি এক লক্ষ টাকা দেওয়া হয়, তাহা হইলে তুমি কী করিবে? আমি লিখেছিলাম, আমি ঐ টাকা দিয়ে একটা ছোটখাটো জাহাজ কিনে কোন একটা দ্বীপ দেখতে যাব। খুব বকুনি খেয়েছিলাম মাস্টারমশাইয়ের কাছে। কেননা, ঐসব রচনায় লিখতে হয়, টাকা পেলে ইস্কুল বানাব কিংবা হাসপাতাল করব কিংবা গরিব দুঃখীকে দান করব—এই ধরনের। একেই তো আমার বাংলা লেখা খুবই কাঁচা, তার ওপর ঐরকম স্বার্থপর চিন্তা—সেই রচনায় আমি কুড়ির মধ্যে ছয় পেয়েছিলাম মোটে। কুড়ির মধ্যে আঠারো পেয়েছিল শৈবাল, আমারই পাশে বসত সে। শৈবাল সবিস্তারে প্রচুর আবেগের সঙ্গে বর্ণনা দিয়েছিল, ঐ টাকায় সে তাদের দেশের গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত একটা রাস্তা তৈরি করে দেবে, গ্রামবাসীর অনেক দুঃখ দূর হবে।
যাইহোক, আমি এখনো আমার মত বদলাইনি। কিংবা আমার মত বদলাবার সুযোগ দেবার জন্য কেউ আমাকে একলক্ষ টাকা দিয়েও দেখেনি। সুতরাং আমি কল্পনা করতে ভালোবাসি যে, ঐরকম কিছু টাকা পেয়ে গেলে আমি একটা জাহাজ কিনে ফেলবই—এবং সেই জাহাজে চড়ে নতুন-নতুন দ্বীপ দেখতে যাব। একলক্ষ টাকায় জাহাজ পাওয়া না-যাক, ছোটখাটো স্টিমার বা মোটরবোট হলেও আমার চলবে। এক-একজন মানুষের জীবনে এক-একটা বিশেষ শখ থাকে—আমার শখ, কোন জনমানবহীন দ্বীপে বেড়াতে যাওয়া। কোনদিন এই শখটা মিটবেনা বলেই কল্পনা করতে বেশি ভালো লাগে। এইজন্যই, ‘পদ্মানদীর মাঝি’র হোসেন মিঞা আমার প্রিয় চরিত্র।
গতসপ্তাহে আমার স্কুলের বন্ধু পরিতোষের সঙ্গে বহুদিন পর দেখা। সে বলল, খবর শুনেছিস?
-কী খবর?
—তুই শুনিসনি এখনো? সব্বাই জানে—শৈবাল লটারির টাকা পেয়েছে।
—কোন্ শৈবাল?
–সেই যে ইস্কুলে আমাদের সঙ্গে পড়ত, আমরা বলতাম মোটা শৈবাল—
-হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই নাকি? কোন্ লটারি, কত টাকা?
.
শৈবাল স্কুলে পড়াশুনোয় বেশ ভালো ছেলে ছিল। বাংলায় ফার্স্ট হতো প্রত্যেকবার। কিন্তু সেজন্য সে এখন বাংলার অধ্যাপক কিংবা সাহিত্যিক হয়নি, কী একটা ওষুধের কম্পানিতে কেমিস্টের চাকরি করে। স্কুলে ওর পাশাপাশি বসতাম আমি, অথচ বহুকাল ওর সঙ্গে দেখা হয়না।
পরিতোষের সঙ্গে শৈবালের এখনো যোগাযোগ আছে। পরিতোষ বলল, চল, শৈবালকে কংগ্রাচুলেশান জানিয়ে আসি! লটারিতে প্রাইজ পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা, ক্ষণজন্মা লোক না-হলে পায়না!
খবরের কাগজে প্রায় প্রত্যেক সপ্তাহেই লটারির ফলাফলের বিজ্ঞাপন দেখতে পাই। অর্থাৎ প্রত্যেক সপ্তাহেই এদেশে, একজন নতুন লাখপতি জন্মাচ্ছে। ভারি চমৎকার লাগে ভাবতে। এইরকমভাবে ভারতের পঞ্চান্ন কোটি লোকই যদি কোন একদিন লাখপতি হয়ে যায় তাহলে এক অপূর্ব সোসালিজমের জন্ম হবে। আমি লটারির টিকিট কাটিনা—কারণ একথা ঠিক জানি, পঞ্চান্ন কোটি লোকের আর সব্বাই যদি লাখপতি হয়ে যায়—তাহলে আমি তো আর একা বাকি থাকতে পারিনা —তাতে দেশের বদনাম হবে। তখন গভর্নমেন্ট থেকে এমনি-এমনিই একলাখ টাকা দিয়ে দেবে নিশ্চয়ই।
কিন্তু আমি এ-পর্যন্ত কোন লটারির টাকা-পাওয়া লোককে স্বচক্ষে দেখিনি। ফার্স্ট প্রাইজ তো দূরের কথা, একশো টাকার প্রাইজও চেনাশুনো কেউ পেয়েছে বলে শুনিনি। অচেনা লোকরাই ওসব পায়। কিন্তু শৈবাল, আমাদেরই স্কুলে পড়ত যে মোটা শৈবাল, সে প্রাইজ পেয়েছে, তাকে একবার চোখে দেখার লোভ সামলাতে পারলামনা। গেলাম পরিতোষের সঙ্গে।
গিয়ে শুনলাম শৈবাল তখনো অফিস থেকে ফেরেনি। শৈবালের স্ত্রী অলকা চেনে পরিতোষকে। সে আমাদের বসতে বলল। শৈবালের বোন অঞ্জনা, যাকে ছেলেবেলায় চিনতাম, চা দিয়ে গেল। চায়ের সঙ্গে দুটি ক্রিম ক্র্যাকার।
আমি আশা করেছিলাম, এসে দেখব, সারা বাড়িতে একটা বিরাট হৈ-চৈ চলছে, প্রচুর আত্মীয়-স্বজন এসেছে, দারুণ খাওয়াদাওয়া। লাখ টাকা প্রাইজ পেয়েও শৈবাল অফিস যাবে—এটাও আশা করা যায়না। অলকা আর অঞ্জনার মুখে কোন চাপা উল্লাসের চিহ্নও নেই। অঞ্জনা আমাদের সঙ্গে দু-চারটে কথা বলে ভিতরে চলে গেল। পরিতোষ ফিসফিস করে আমাকে জানাল, অঞ্জনা একটা বখাটে ছেলেকে বিয়ে করতে চায় বলে—ওকে বাড়ি থেকে বেরুতে দেওয়া হয়না।
একটু বাদেই শৈবাল এল, বেশ-কিছুটা অবাক, খানিকটা খুশিও হল। জিজ্ঞেস করল, চা খেয়েছিস? আমাদের চা খাওয়া হয়ে গেছে শুনে ও আর দ্বিতীয়বার অনুরোধ করলনা—শুধু নিজের জন্য চা দিতে বলল। অনুযোগ করে জানাল অফিসে বড্ড কাজের চাপ, রোজ ওভারটাইম করতে হয়—সাড়ে-ছটার আগে বেরুতে পারেনা।
শৈবাল গেল অফিসের জামা-কাপড় ছেড়ে আসতে। পরিতোষ আবার ফিসফিস করে বলল, এতগুলো টাকা পেয়েও শৈবালটা কীরকম কিপ্যুস আছে দেখলি? এতদিন বাদে এলাম, দিল কিনা শুকনো চা-বিস্কুট।
–বাঃ, টাকা পেয়েছে বলেই কি দুহাতে ওড়াবে নাকি?
—ওড়ানোর কথা হচ্ছেনা। চায়ের সঙ্গে দুটো সিঙ্গাড়া আর সন্দেশ দিতে পারতনা?
—চুপ, শৈবাল আর অলকা আসছে।
কথায়-কথায় লটারির টাকা পাওয়ার কথা উঠলই। শৈবাল পেয়েছে হরিয়ানার সেকেন্ড প্রাইজ একলক্ষ টাকা। অলকা রীতিমতন আপশোশ করতে লাগল, ফার্স্ট প্রাইজ না-পাওয়ার জন্য। ফার্স্ট প্রাইজ ছিল পাঁচলক্ষ টাকা। একবার লাক কেটে গেলে আর কি পাওয়া যায়! অলকা নাকি আগেই ভেবেছিল সি গ্রুপের টিকিট এবার ফার্স্ট প্রাইজ পাবে—ওর মন বলছিল। সি গ্রুপেরই টিকিট কিনেছে—সি গ্রুপ থেকেই এবার ফার্স্ট আর সেকেন্ড প্রাইজ উঠেছে—কিন্তু ওদেরটাই হয়ে গেল সেকেন্ড।
প্রাইজ পাবার পুরো কৃতিত্বটাই অলকা নিতে চায়। শৈবাল বিশেষ আপত্তি জানালনা তাতে, মুচকি হাসতে লাগল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, টাকাটা দিয়ে কী করবি, কিছু ঠিক করেছিস?
—অনেকে পরামর্শ দিচ্ছে, ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিটে রাখতে। কিন্তু আমি ভাবছি…আচ্ছা, এ-বাড়িটার কত দাম হবে বলতে পারিস?
—এই বাড়িটা? না, ঠিক আইডিয়া নেই।
–তবু মোটামুটি একটা আন্দাজ কর—নিচে একটা ফ্ল্যাট আছে। আর আমাদের এটা। আমরা ভাড়া দিই সাড়ে তিনশো করে—প্রত্যেক মাসে এতগুলো টাকা বেরিয়ে যায়। তাই ভাবছিলাম এই বাড়িটাই যদি কিনে ফেলা যায়—কিন্তু বাড়িওয়ালা আশি হাজার টাকা দর হাঁকছে।
অলকা বলল, আমি বলছি এ-বাড়ি কিনতে হবেনা। তার চেয়ে বরং লবণহ্রদে পাঁচ কাঠা জমি কিনে
শৈবাল বলল, জমি কিনে নতুন বাড়ি তৈরি করা কম হাঙ্গামা নাকি? আমি অফিস থেকে ছুটি পাবনা—নিজে দেখাশুনো করতে না-পারলে সবাই ঠকাবে। তার চেয়ে এ-বাড়িটাই ভালো, পজিশনটাও বেশ ভালো আছে। কিন্তু আশি হাজার টাকা, টু মাচ। তুই কী বলিস?
আমি কাঁচুমাচুভাবে উত্তর দিলাম, ভাই, বাড়ির দাম সম্বন্ধে আমার কোন আইডিয়া নেই।
—আশি হাজার যদি কিনতেই লাগে, তারপর কিছু রিপেয়ার করতেই হবে, তাতে অন্তত পাঁচ হাজার—বোনটার বিয়ের জন্য আর দেরি করা ঠিক নয়—তাতেও কম করে…
এরপর কিছুক্ষণ আলোচনা চলল, তাতে বেশ বোঝা গেল, একলাখ টাকায় শৈবালদের বাজেট কিছুতেই কুলোচ্ছেনা। কোনক্রমে টেনেটুনে যদি একলাখ টাকায় বাজেট করতেও পারে, তাহলে পরবর্তী দিনগুলো ওদের বেশ কষ্টে-সৃষ্টে টানাটানি করে চালাতে হবে। হাতে কিছু থাকবেনা। অলকা এরই মধ্যে পাঞ্জাব ও দিল্লির লটারির দুখানা টিকিট কিনে ফেলেছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, শৈবাল, হুগলিতে তোদের সেই দেশের বাড়িটা কী হল?
—সেখানে আর যাইনা। রাস্তাঘাট এত খারাপ যে যাওয়াই এক ঝঞ্ঝাট। সারা বছরই বলতে গেলে থকথকে কাদা—কে যাবে সেখানে। আমার এক কাকা থাকেন—
ও-বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমি পরিতোষকে বললাম, ইস্কুলের রচনায় শৈবাল লিখেছিল যে, একলক্ষ টাকা পেলে ও নিজের গ্রামের রাস্তা বানিয়ে দেবে। সে—কথা ওর এখন একবারও মনে পড়লনা কিন্তু!
পরিতোষ বলল, কী করে রাস্তা বানাবে এখন? দেখছিস না, ওর নিজের বাজেটই এতে কুলোচ্ছেনা। আমার তো মনে হচ্ছে, একলাখ টাকা পাওয়ার ফলে বেচারীকে না না-খেয়ে থাকতে হয় শেষে!
তারপর পরিতোষ আবার বলল, যে জিনিশটা আমরা এখনো পাইনি সে সম্পর্কে অনেককিছু কল্পনা করা যায়। যেমন ধর, পণ্ডিত নেহরু একসময় বলেছিলেন, ক্ষমতা পেলে তিনি সব ব্ল্যাক মারকেটিয়ারদের ধরে-ধরে ল্যাম্পপোস্টে ফাঁসিতে ঝোলাবেন। কিন্তু ক্ষমতা পাবার পর দেখলেন, ল্যাম্পপোস্টগুলো ঠিক মজবুত নয়, কিংবা ফাঁসির দড়ি ঠিক মতন পাওয়া যাচ্ছেনা—অর্থাৎ এ-ও সেই বাজেটে না-কুলোনোর ব্যাপার!
আমি মনে-মনে ভাবলাম, ভাগ্যিস আমি এখনো একলক্ষ টাকা পাইনি। তাই দ্বীপ দেখার স্বপ্নটা আমার এখনো অম্লান আছে।