নীললোহিতের অন্তরঙ্গ – ৩

কী খাবেন বলুন? চা না কফি? আমি রীতিমতন চিন্তার ভান করে বললাম, উঁ, কোন্‌টা খাওয়া যায়? কিছু কি খেতেই হবে? দুটোর একটাও যদি না খাই?

ঝর্না হেসে ফেলে বলল, আপনি না খেতে চাইলে কি আপনাকে আমি জোর করে খাওয়াব? কেন, কিছু খাবেননা কেন? ঠাণ্ডা কিছু খাবেন?

—ঠাণ্ডা মানে?

–স্কোয়াশ আছে। লেমনেড বা কোকোকোলা আনিয়ে দিতে পারি। যা গরম পড়েছে।

—না, না, ওসব নয়! গরমে গরম জিনিশই আমার পছন্দ। আচ্ছা, এক কাপ চা-ই দিন। শুধু চা কিন্তু, না থাক, বরং কফিই করুন। কিংবা চা—কোন্‌টা তাড়াতাড়ি হবে?

–আপনি কোনটা খাবেন বলুন-না! কতক্ষণ আর লাগবে?

—আপনাকেই বানাতে হবে তো? না লোক আছে? তাহলে ওসব থাক্ না, এই তো বেশ বসে-বসে গল্প হচ্ছে।

–যাঃ, আপনি ঠিক করে কিছু বলতে পারেননা। দাঁড়ান চা করে আনছি। আমারও চা খেতে ইচ্ছে করছে!

ঝর্না চা করে আনতে গেল। গরমজল চাপিয়েই তার ফিরে আসার কথা। তারপর জল গরম হলে আবার গিয়ে চা ভেজাবে। কিন্তু এলনা। আমি উঁকি মেরে দরজার কাছে দেখলাম, ঝর্না হিটারে কেটলি চাপিয়ে কাপ-ডিস ধুচ্ছে। চা বানিয়ে ওর আসতে আরও চার-পাঁচ মিনিট লাগবেই।

আমি সতর্ক ক্ষিপ্র পায়ে এগিয়ে গেলাম টেবিলের দিকে। টেবিলের ওপরেই চাবির গোছা পড়ে ছিল। আলমারির চাবিটা খুঁজে বার করতে একটু সময় লাগল। তারপর আলমারির পাল্লায় যাতে ক্যাচ ক্যাচ শব্দ না হয়, সেইজন্য খুব সাবধানে নিঃশব্দে আমি আলমারিটা খুলে ফেললাম। এতক্ষণ চা-কফির নামে টালবাহনা করতে-করতে আসলে আমি মনস্থির করে নিচ্ছিলাম।

পাঠক নিশচয়ই আমাকে চোর ভাবছেন। তা ভাবুন, কী আর করা যাবে! অবস্থার গতিকে মানুষ কত কী করে!

ঝর্নার সঙ্গে আমার বন্ধু সুকান্তর বিয়ে হয়েছে। বছরখানেক মাত্র, তাও বিয়ের পর মাসখানেকের জন্য ওরা সাউথ ইন্ডিয়ায় বেড়াতে গিয়েছিল, তারপর ঝর্না দুমাস ছিল পাটনায় ওর বাপের বাড়ি। সুতরাং ঝর্নার সঙ্গে ভালো করে আমার আলাপই হয়নি। এই তো কয়েকমাস মাত্র ওরা নতুন ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে গুছিয়ে বসেছে।

সুকান্ত যখন বাড়ি থাকেনা, সেই সময়টা জেনেই এসেছি। সুকান্তটা মহা ধুরন্ধর ছেলে, ও বাড়িতে থাকলে সুবিধে হবেনা। এখন ফ্ল্যাটে শুধু বাচ্চা চাকর আর ঝর্না। ঝর্না শুধু সুন্দরীই নয়, মনটাও খুব নরম। এই আমার সুযোগ। পাঠক, নিশ্চয়ই আমাকে চোর ছাড়াও অন্যকিছু ভাবছেন। তা ভাবুন, কী আর করা যাবে।

ঝর্না চা নিয়ে ফিরে আসার আগেই আমি আবার আমার জায়গায় ফিরে এসে বসেছি। আলমারি যথারীতি বন্ধ। চাবি আবার টেবিলের ওপর

চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, অপূর্ব। অনেকদিন এমন সুন্দর চা খাইনি!

ঝর্না জিজ্ঞেস করল, চিনি ঠিক হয়েছে তো? আপনি কতটা চিনি খান জানিনা।

আমি বললাম, একেবারে নিখুঁত হয়েছে। এক-একজনের হাতই এমন থাকে যে সেই হাতে চা বানালে কতটা চিনি কতটা দুধ তার কোন প্রশ্নই আসেনা—

বাবারে বাবা! এই কথাটা যে ছেলেরা কত মেয়েকেই বলতে পারে!—আপনাকে আগে কেউ এরকম বলেছে?

—বলেনি আবার!

—কিন্তু কথাটা পুরোনো হয়ে গেছে কি? শুনলে এখনো একটু-একটু আনন্দ হয়না?

ঝর্না হাসল। প্রসঙ্গ বদলে বলল, আপনার বন্ধুর কাছ থেকে আপনার অনেক গল্প শুনেছি, আগে খুব দেখা হতো আপনাদের দুজনের তাইনা? কই আপনি তো এ-বাড়িতে বেশি আসেননা।

—সুকান্ত আর চায়না যে আমরা এখানে বেশি আসি।

—যাঃ! ও বলেছে একথা?

—ঠিক মুখে বলেনি—কিন্তু এখন নতুনভাবে ঘরটর সাজিয়েছে, সুন্দরী স্ত্রী বাড়িতে—এখন আর ব্যাচিলর আমলের বন্ধুদের কেউ তেমন পছন্দ করেনা!

—মোটেই নয়। দাঁড়ান, ও আজ আসুক তো—আজ আপনার সামনেই ওকে জিজ্ঞেস করব। ও এক্ষুনি ফিরবে।

—এখন ফিরবে? এখন তো সাড়ে চারটে বাজে। সুকান্তর অফিস থেকে ফিরতে-ফিরতে সাড়ে ছটা-সাতটা হয়না?

–অন্যদিন তাই হয়, তবে আজ তাড়াতাড়ি ফিরবে। আজ ইভনিং শো-এ একটা সিনেমায় যাবার কথা আছে।

সুকান্ত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে শুনে আমি চঞ্চল হয়ে উঠলাম। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, তাহলে আমি আজ চলি। আমার একটু কাজ আছে।

ঝর্না অবাক হয়ে বলল, এক্ষুনি যাবেন? ওর সঙ্গে দেখা করে যাবেননা?

—আজ আর না, আর-একদিন…

প্রায় দরজার কাছে চলে এসেছি, এইসময় ঝর্না আমার হাতের বইগুলো লক্ষ করল। জিজ্ঞেস করল, আপনার কাছে, ওগুলো কী বই? গল্পের বই আছে নাকি—অনেকদিন পড়িনি—

আমি একগাল হেসে বললাম, ও আপনাকে বলতে ভুলেই গেছি। দেখুন তো কী ভুলো মন আমার। এগুলো আপনাদেরই বই। সুকান্তকে বলবেন এগুলো আমি পড়তে নিয়ে গেলাম।

ঝর্নার মুখখানা কালো হয়ে গেল। লীলায়িত হাতে চূর্ণ অলক ঠিক করছিল, হাতখানা রয়ে গেলে সেখানেই। বলল, কোথায় ছিল বইগুলো?

আমি কিন্তু মুখের হাসি মুছিনি। বললাম, আলমারিতে, আপনি যখন চা করতে গিয়েছিলেন, তখন আপনাদের আলমারির বইগুলো দেখছিলাম। অনেকদিন ধরেই এই বইগুলো—

ঝর্না বলল, ও কিন্তু বইয়ের আলমারিতে কেউ হাত দিলে বড়ো রাগ করে। আমাকে স্ট্রিক্টলি বারণ করে দিয়েছে কারুকে বই দিতে—

সে কি আর আমি জানিনা। সুকান্তর স্বভাব এতদিন বাদে ঝর্না আমাকে বোঝাবে? এমনকী, বইয়ের আলমারির এককোণে ছোট্ট নোটিশ ঝুলিয়ে রেখেছে, ‘আমার একখানা পাঁজরা চান দিতে রাজি আছি। বই চাইবেননা।

আমি তবু হা হা করে হেসে বললাম, আরে, ওসব কথা অন্যদের জন্য। সুকান্তর সঙ্গে আমার সেরকম সম্পর্কই নয়। আমরা হস্টেলে এক ঘরে থাকতাম, এক বিছানায় শুয়েছি, এক ব্লেডে দাড়ি কামিয়েছি—

সেই মুহূর্তে জুতো মশমশিয়ে সুকান্ত এসে ঢুকল। আমাকে দেখে বলল, কী রে, আজকাল পাত্তাই পাইনা কেন তোর।

ঝর্না এমনিতে খুব ভদ্র। সুকান্ত ফেরামাত্রই বইয়ের কথা তুললনা। বরং মুখোজ্জ্বল করে বলল, আপনি তাহলে আর-একটু বসুন। এক্ষুনি যাবেন কী?

খানিকটা বাদে সুকান্ত যখন ঘন-ঘন আমার হাতের বইগুলোর দিকে তাকাচ্ছে, আমি নিজে থেকেই বললাম, সুকান্ত, আমি এই কটা বই পড়তে নিচ্ছি, কবে ফেরত দেব ঠিক নেই। তাড়া দিসনি।

সুকান্তর মুখখানাও কালো হয়ে গেল। ঝর্নার দিকে একবার কটমট করে তাকাল। অর্থাৎ, তুমি বুঝি ওকে আলমারি খুলে দিয়েছ? তারপর আমার দিকে তাকিয়ে কঠিনভাবে বলল, দেখি, কী কী বই?

আমি সহাস্যে বইগুলো এগিয়ে দিলাম। পাঁচখানা বই, সুকান্ত প্রত্যেকটার পাতা উল্টে দেখল, মুখ তুলে আমার চোখে চোখ রাখল। আমিও তীব্র দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। দুটি নেকড়ে বাঘ যেন পরস্পরের ওপর লাফিয়ে পড়ার জন্য তৈরি। ঝর্না আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি তাহলে আর-একটু চা খান! ওর জন্য তো চা করবই—

—হ্যাঁ চা খাব। সঙ্গে যদি আরও কিছু থাকে, তাতেও আপত্তি নেই।

ঝর্না ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া মাত্রই আমি সুকান্তকে ফিসফিস করে বললাম, দ্যাখ চাঁদু, বেশি চালাকি করবি তো বউয়ের সামনে প্রেসটিজ পাংকচার করে দেব! ঝর্না ঘরে ফেরা মাত্রই সুকান্ত অতিশয় উৎসাহ দেখিয়ে বলল, আরে, ওর কথা আলাদা! ও যখন যে-বই চাইবে দেবে। ও আমার কতকালের বন্ধু, ওর সঙ্গে আমি….

সুকান্তর আলমারি থেকে যে-পাঁচখানা বই বেছে নিয়েছি, তার প্রত্যেকটিই আমার। এর মধ্যে একখানা আবার ব্রিটিশ কাউন্সিলের বই, আমাকে টাকা গচ্চা দিতে হয়েছে। সুকান্ত বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে বই নিয়ে চিরকাল মেরে দিয়েছে। বেশি পীড়াপীড়ি করলে সুকান্ত মুখ কাচুমাচু করে বলত, বইগুলো হারিয়ে গেছে!

এখন সুকান্ত বিয়ে করেছে। ওর বউ আলমারি কিনে সব বই সাজিয়ে রেখেছে। এখন এই আমাদের সুযোগ মাঝে-মাঝে ওর বাড়িতে এসে চা খাওয়া ও বইগুলো ফেরত নিয়ে যাওয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *