১৫
জামাটা পিঁজে গেছে, কলারের পাশ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে আঁশ, কাঁধের পাশে সামান্য ফাটতে শুরু করেছে, ডানহাতের কনুইয়ের কাছটায় একবার শেলাই করা, তবু জামাটা ফেলতে মায়া হয়। নীল-শাদায় ডোরাকাটা আমার জামাটার বয়েস পাঁচ বছর পূর্ণ হল, এবার ওকে তোরঙ্গের নিচে নির্বাসন দেবার কথা, কিংবা আগামী বছরের দোল খেলার জন্য জমিয়ে রাখা, কিংবা বাসনওয়ালীদের রুক্ষ হাতে সমর্পণ করলেও হয়, কিন্তু কিছুতেই জামাটাকে বিদায় দিতে আমার ইচ্ছে করেনা, নরম মোলায়েম স্পর্শ দিয়ে সে আমার শরীরের সঙ্গে লেগে থাকে। ডায়িং-ক্লিনিং-এ পাঠালে পাছে ওর সর্বস্বান্ত হয়ে যায়, তাই আমি ওকে নিজেই সাবধানে বাড়িতে কেচে নিই। এখন শীতকাল কোট বা সোয়েটারের নিচে পরলে ওর ছেঁড়া অংশ আর তেমন চোখে পড়েনা, কিন্তু বুকের কাছাকাছি থাকে।
জামাটাকে বিসর্জন দেওয়া মানেই তো কত স্মৃতি নষ্ট করা। অনেক জামাকাপড়ের মধ্যে কোন একটার প্রতিই অনেকসময় বেশি মায়া পড়ে। গত পাঁচ বছরে আমার কত জামা ছিঁড়ল, হারাল—কিন্তু এই নীল-শাদায় ডোরাকাটা জামাটাই আমার প্রাণের বন্ধু।
মনে পড়ে পাঁচ বছর আগে নতুন এই জামাটা কিনে দুমকায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। রামপুরহাট থেকে বাসে যাবার পথে প্রথম শীতের অবসন্ন আলোর সন্ধ্যায় কোন একটা কারণে হঠাৎ আমার খুব মন খারাপ হয়ে যাবার পর চোখে পড়েছিল ছোটোখাটো দু-চারটে পাহাড় অবোলা জন্তুর মতন রাস্তার খুব কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। আমি হিমালয় অভিযাত্রী সংঘের সদস্য কোনদিনই হবনা, কিন্তু প্রায়ই আমার কোন পাহাড় চূড়ায় উঠতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে কোন পাহাড়ের শিখরে একা উঠে উড়িয়ে দিই আমার নিজস্ব পতাকা। সেদিন হাতের কাছেই অতগুলো চমৎকার শান্তশিষ্ট পাহাড় দেখে আমার খুব লোভ হচ্ছিল। এই নীল-শাদা ডোরাকাটা জামাটাকে আমি সেদিন পতাকা করে উড়িয়েছিলাম।
সেই বাসে চারজন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রী ছিল। কী ঝকঝকে কথা আর খুনসুটি হাসি তাদের, কার না ইচ্ছে হয় ওদের সঙ্গে একটু ভাব জমাতে, সংক্ষিপ্ত প্রবাসের দিনগুলো রঙ্গরসে ভরাতে। কিন্তু আমি হেরে গেলাম, যেমন অনেক খেলাতেই হেরে যাই। বাস ছাড়ার আধঘণ্টার মধ্যে একটি মেয়ের ভ্যানিটি ব্যাগ পড়ে গিয়েছিল, আমি শশব্যস্তে সেটা তুলে দিয়ে ভূমিকা পর্যন্ত সেরে রেখেছিলাম, মেয়েটি আমার দিকে মৃদু হেসে বলেছিল, ধন্যবাদ। আরও আড়াই ঘণ্টা একসঙ্গে যেতে হবে—মাঝপথে ওদের জন্য চা এনে দিয়ে কিংবা অন্য কোন ছলে ওদের সঙ্গে আলাপ জমাবার পরিকল্পনায় মশগুল ছিলাম। কিন্তু শেষপর্যন্ত আমি হেরে গেলাম। মেয়ে চারটি তাদের কাচভাঙা কণ্ঠস্বরে প্রেসিডেন্সি কলেজ, লেকে সাঁতারের ক্লাব, নিউ মার্কেটে কোন্-কোন্ চিত্রাভিনেত্রীকে নিয়মিত দেখা যায়, —এইসব আলোচনায় বিভোর হয়েছিল। আমি মন দিয়ে ওদের কথা শুনছিলাম, ওদের মুখের রেখায়, হাসির ভঙ্গি, শাড়ির ভাঁজ—এবং মেয়েদের আরও যা-যা দেখার শুধু তাই দেখছিলাম, তখন জানলার বাইরে তাকাইনি, পাহাড় কিংবা জঙ্গল দেখিনি, প্রকৃতি দেখার সময় ছিলনা। চোখের সামনে জ্যান্ত প্রকৃতি থাকতে কে আর বনজঙ্গল দেখতে চায়। হঠাৎ ওদের মধ্যে একজন তার হাতের কব্জি তুলে বলল, ইস্, ঘড়িটা বোধহয় বন্ধ হয়ে গেছে। অনুরাধা, তোর ঘড়িতে কটা বাজে রে?
চারটি মেয়েরই হাতে ছোট জুলজুলে ঘড়ি, কিন্তু দেখা গেল চারজনের ঘড়িতে চাররকম সময়। তাই তো স্বাভাবিক! ওরা তন্বী, ওরা যুবতী ও সৌভাগ্যবতী— ওরা চারজনই আলাদা-আলাদা সময় ভোগ করবে—তাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু ওরা সঠিক সময় জানার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল। ওরা সময় নিয়ে কলহ করে কালহরণ করতে লাগল। অনুরাধার ধারণা তার ঘড়িটাই ঠিক, কিন্তু রুচিরা বলছে তার ঘড়ি রেডিও মেলানো। পারমিতার দৃঢ় বিশ্বাস তার ঘড়ি কখনো এক সেকেন্ডও শো—ফাস্ট হয়না—আর দময়ন্তীর ঘড়ি তো থেমেই আছে—ধুক্ ধুক্ শব্দও নেই। মোটমাট ওদের পরস্পরের ঘড়িতে পাঁচ থেকে আধঘণ্টা সময়ের তফাৎ। শেষ পর্যন্ত কার ঘড়িতে ঠিক সময়—তা জানার জন্য ওরা পরস্পরের মধ্যে বাজি রাখল। রুচিরা বলল, অন্য কারুর ঘড়িতে দ্যাখ তাহলে কটা বাজে।
মেয়েদের সবচেয়ে কাছের সীটে আমি বসে আছি। আমার ফুলহাতা নীল—শাদা ডোরাকাটা জামাটায় কব্জি পর্যন্ত বোতাম-আঁটা। ওরা আমার দিকে আলতোভাবে তাকিয়ে পরোক্ষে প্রশ্ন করল, কটা বাজে? কিন্তু আমার সঙ্গে ঘড়ি নেই, আমি ঘড়ি হাতে দিইনা। সময়কে অত নিখুঁতভাবে জানার কোন ইচ্ছে আমার নেই। আলোর যেমন সাতটা রং, সেইরকম ভোর, সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধে, রাত্রি, গভীর রাত্রি—এই সাতটা বেলা আমি খালিচোখে দেখতে পাই—এতেই আমার কাজ চলে যায়। কিন্তু মেয়েগুলোর সঙ্গে আলাপ করব এই তো সুযোগ। ঘড়ি নেই শুনলে ওরা কি আর আমায় পাত্তা দেবে? আমার বেশভূষা দেখে ওরা ধরেই নিয়েছে আমার যখন চোখ, কান, নাক সবই ঠিক আছে—তখন হাতে ঘড়িও আছে—তাই তো থাকে। সুতরাং আমি স্মার্ট হবার জন্য বললাম, আপনাদের ঘড়ির সময়গুলো যোগ করে চার দিয়ে ভাগ দিন—তাহলেই ঠিক সময় পেয়ে যাবেন।
মেয়েদের কোন উত্তর দেবার সুযোগ না-দিয়েই আমার পাশের সীট থেকে একজন যুবা বলে উঠল—এখন ঠিক চারটে বেজে সাতচল্লিশ! যুবকটি আস্তিন গোটানো কব্জি উঁচু করে ঘড়িটা চোখের সামনে তুলে ধরেছে—ঘড়িটার চেহারাই এমন ইম্প্রেসিভ যে দেখলেই মনে হয়—ওরকম ঘড়ি ভুল সময় দিতে পারেনা। যুবকটি তবুও তার সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করল, কী রে বরুণ, তোর ঘড়িতে কটা বাজে? সঙ্গী উত্তর দিল, ঠিক ঐ চারটে বেজে সাতচল্লিশই। রুচিরা সঙ্গে-সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, দেখলি, বলেছিলাম-না, আমারটাই—
যুবক দুজনের নিখুঁত পোশাক, চুল ও জুতো সমান ঝকঝকে এবং ওদের হাতে সঠিক সময়। ওরাই জিতে গেল। যুবক দুজনের একজন ঐ মেয়েদের মধ্যে একজনের দিকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা, আপনি কি প্রশান্তর বোন? সেই মেয়েটি সঙ্গে-সঙ্গে উদ্ভাসিত মুখে বলল, হ্যাঁ, আপনি আমার দাদাকে চেনেন বুঝি? যুবকটি বলল, হ্যাঁ, চিনি, মানে আপনার দাদার এক বন্ধু আমার খুব বন্ধু, সেই হিসেবে একবার…আমার বন্ধুর নাম সিদ্ধার্থ মিত্র। রুচিরা বলে উঠল, ও, সিদ্ধার্থদা? হ্যাঁ, হ্যাঁ—
সব মিলে যাচ্ছে। এরপর আর কথার অভাব হয়না—যুবকদুটির সঙ্গে মেয়ে চারটি প্রচুর ভাব বিনিময় করতে লাগল। আমি একেবারে হেরে গেলাম। আমার দিকে ওরা ফিরেও চাইলনা। বিষণ্ন মুখে আমি প্রকৃতি দেখা শুরু করলাম জানলা দিয়ে।
সূর্য সবে ডুবছে, ডিমের কুসুম-লাল একদিকের আকাশ। চওড়া পথে শুধু আমাদের বাসটা একমাত্র ছুটছে, মাঝে-মাঝে ধাবমান গাছ, দূরে-কাছে দু-একটি টিলা। মন খারাপ হলেই প্রকৃতিকে বেশি ভালো লাগে সন্দেহ নেই। মেয়ে চারটিকে ক্রমশ আমার অসহ্য লাগতে লাগল—মনে হল, হালকা প্রগল্ভা, ফচকে মেয়ে সব—সময়ের মর্ম বোঝেনা—তবুও হাতে ঘড়ি পরা চাই! আর ক্রমশই আমি পথের পাশের নীরব দৃশ্যে মুগ্ধ হয়ে যেতে লাগলাম।
বাস থামল এক জায়গায়। চা খেতে নেমে আমি কন্ডাক্টরকে জিজ্ঞেস করলাম, এরপর আরও বাস আছে? সে বললে অনেক-অনেক। সেই বাসটা যখন আবার ছাড়ল—আমি আর তাতে উঠলামনা।
আস্তে-আস্তে পথ ছেড়ে মাঠের মধ্যে হাঁটতে লাগলাম। লাল কাঁকর মেশানো জমি, সজনে আর মহুয়া গাছ এদিক-ওদিক ছড়ানো। নির্জনতা এখানে গগনস্পর্শী। কাছেই একটা খুব ছোট পাহাড়, পাহাড় নয়, টিলা কিংবা ঢিবিও বলা যায়—আমি সেটার দিকে এগিয়ে গেলাম।
মনের ভেতরটা বিষম ভারী, বিষণ্নতা আর অভিমান চাপ বেঁধে আছে! সেই নির্জন প্রান্তরে একাকী দাঁড়িয়ে মনে হল যেন সারা জীবনটাই বঞ্চিত হয়ে গেছি। অথচ কী জন্য? বাসের মধ্যে চারটি ঝকঝকে মেয়ে আমার সঙ্গে কথা না বলে আর-দুজনের সঙ্গে কথা বলেছে, সেইজন্য? অসম্ভব অবাস্তব এই বিষণ্ণতা—সামান্য একটা জিনিশও না-পেলে—সারা জীবনের সমস্ত না-পাওয়া দুঃখ এসে ভিড় করে।
টিলাটার পাথরগুলো খাড়া এবং মসৃণ—একটাও গাছ বা লতা নেই। কিন্তু খাঁজ রয়েছে অনেক, বেশি উঁচুও নয়। একবার সামান্য পা পিছলে ধাক্কা খেতেই ধারাল পাথরের খোঁচায় কনুইয়ের কাছে জামাটা ছিঁড়ে গেল। ইস, নতুন জামা। আর-একটা দুঃখ বাড়ল। যুক্তিসংগতভাবে পর্যাপ্তভাবে আজ আমার মন খারাপ করার সময়।
কিন্তু টিলাটার ওপরে যখন উঠে দাঁড়ালাম, সব বদলে গেল। বুকের মধ্যে একধরনের নিঃসঙ্গতা আছে। কিন্তু প্রাকৃতিক নিঃসঙ্গতা এত বিশাল যে তার রূপ অন্যরকম। টিলার ওপর দাঁড়িয়ে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়, সাঁওতাল পরগনার আকাশ ও প্রান্তর। দূরের গ্রামে দু-চারটি ফুটকি-ফুটকি আলো—এ ছাড়া পাতলা জল মেশানো ছাইরঙে ভরে গেছে দশদিক। টিলার ওপর আমি একা দাঁড়িয়ে —কিন্তু একটুও নিঃসঙ্গ মনে হলনা। মনে হল এই পাহাড় এই আকাশ ও ভূবিস্তার—এই বুনো ঝিঁঝির ডাক ও হাওয়ার খেলা—এসবই যেন আমার। আমি এদের সম্পূর্ণভাবে ভোগ করতে পারি। আমি জীবনে অনেক খেলায় হেরে গেছি—কিন্তু আমি একটা পাহাড় জয় করেছি। এই পাহাড়চূড়ায় আমার পতাকা উড়িয়ে দিতে হবে। পকেটে একটা রুমাল পর্যন্ত নেই, আমি তখন আমার নীল-শাদা ডোরাকাটা জামাটা খুলে পতাকার মতন উড়িয়ে আপন মনে বলেছিলাম, এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটা বড়ো মধুর। যে যাই বলুক, নানান দুঃখকষ্ট মিলিয়ে বড়ো আনন্দেই বেঁচে আছি। হে সময়, আমাকে আর-একটু সময় দাও।