১০
রামায়ণের রাবণ সীতাহরণের চেয়েও বড়ো অন্যায় কাজ করেছিলেন একটি। তখনকার ক্ষত্রিয়ধর্ম অনুযায়ী রূপসী নারীহরণ হয়তো খুব অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিলনা। তাছাড়া, সীতাহরণের প্রধান সার্থকতা, ঐ ঘটনাটি না-ঘটলে রামায়ণ এরকম একটি মহৎ কাব্য হয়ে উঠতে পারতনা। কিন্তু রাবণ সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে সীতাকে হরণ করতে গিয়েছিলেন কেন? সব ছদ্মবেশই যখন তিনি ধরতে পারতেন—তখন রামের ছদ্মবেশে গণ্ডি পার হলেই পারতেন।
রাবণ সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশ ধরার পর থেকেই মানুষ আর কোন সন্ন্যাসীকে ঠিক বিশ্বাস করেনা। সব সন্ন্যাসীকেই প্রথমে ভণ্ড সন্ন্যাসী বলে ভাবে।
সাধুসন্ন্যাসীদের সম্পর্কে আমার একটু দুর্বলতা আছে। আমার একেবারেই ধর্মবিশ্বাস নেই, নাস্তিকস্য নাস্তিক যাকে বলে, কিন্তু সন্ন্যাসীর জীবন আমাকে আকৃষ্ট করে। কোথাও শিকড় গাড়েনি, কোন আসক্তি নেই, সবকিছু ছেড়ে এই বিশাল বিশ্বে একা হয়ে গেছে এইসব মানুষ। গেরুয়া রংটার মধ্যেও খানিকটা ঔদাসীন্যের ছোঁয়া আছে। অবশ্য চেলাচামুণ্ডা বা ভক্তদের মাঝখানে বসে থাকেন যেসব সাধু তাঁদের সম্পর্কে আমি উৎসাহহীন। কিংবা কলকাতায় যেসব বিখ্যাত সাধু বা মোহন্ত মাঝে-মাঝে এসে ওঠেন—আর তাঁর বাড়ির সামনে বড়লোক ভক্তদের গাড়ির লাইন লেগে যায়—তাঁদের সম্পর্কেও আমার মনোভাব ব্যক্ত না করাই শ্রেয়। আমার ভালো লাগে একা-একা ভ্রাম্যমাণ সন্ন্যাসীদের একটু ঈর্ষাও হয়, মনের কোন একটা ইচ্ছে উঁকি মারে—আমিও ওদের মতন বেরিয়ে পড়ি।
জানি, খুনী কিংবা চোর-ডাকাতরাও সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে ঘোরে। কিংবা অনেক সাধুই আসলে গেরুয়া-পরা ভিখারি। অর্থাৎ সেই রাবণের ছদ্মবেশ। তবু প্রথম দেখলেই কোন সাধুকে আমার ভণ্ড হিসেবে ভাবতে ইচ্ছে করেনা, প্রথমে আমি তাদের বিশ্বাস করতেই চাই।
ট্রেনের থার্ড-ক্লাস কামরায় একদল ছেলে একজন সাধুকে ক্ষেপাচ্ছিল। এই সাধুটির বয়েস বেশি নয়, তিরিশের কাছাকাছি, খুবই রূপবান। সত্যিকারের গৌরবর্ণ যাকে বলে, টিকোলো নাক—তবে দাড়ি ও জটার বহর আছে। হঠাৎ দেখলে মনে হতে পারে, কোন সিনেমার নায়ক বোধহয় শুটিং-এর জন্য সাধু সেজেছে। তা অবশ্য নয়, আশেপাশে কোন ক্যামেরা নেই—তাছাড়া সন্ন্যাসীর মুখে যে নির্মল ঔদাসীন্য কোন সিনেমার নায়কের পক্ষে তা আনা খুব শক্ত। সাধুটি কোন জাত তা বোঝা যায়না। তবে বাঙালি নয়, বেশ দুর্বোধ্য হিন্দিতে কথা বলছিল। ওকে আমার খাঁটি সন্ন্যাসীই মনে হচ্ছিল।
একটি ছেলে তাকে বলল, ইস, গা দিয়ে গাঁজার বিটকেল গন্ধ বেরুচ্ছে! এই যে সাধুবাবা, একটু সরে বসো-না।
সাধু ছেলেটির কথা শুনতে পেলনা। স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
-কী বাবা, ভস্ম করে দেবে নাকি!
—ওসব এঁটেলু এখানে ছাড়ো! সাধু হয়েছ হেঁটে যেতে পারনা?
—গাঁজাফাজা থাকে তো বার করো!
-দাড়িটা আসল তো?
-টেনে দ্যাখ-না!
সন্ন্যাসীটিকে নিয়ে একটা তাণ্ডব শুরু হয়ে গেল। কেউ তার চুল-দাড়ি টেনে দেখতে লাগল, কেউ তার ঝোলা হাতড়াতে লাগল, কেউ তাকে ঠেলে সিট থেকে মাটিতে বসাতে চায়। সাধুটি শান্ত/ধরনের, রেগে উঠছেনা, দুর্বোধ্য হিন্দিতে কী যেন বলছে আর মাঝে-মাঝে হাত জোড় করছে। আমার কষ্ট হচ্ছিল ওর জন্য। তবে, রেলের কামরায় আট-দশটি ছেলে মিলে আজকাল যদি কিছু কাণ্ড শুরু করে, তার তো কোন প্রতিবাদ করা হয়না।
তবু আমি মৃদু গলায় বললাম, আহা থাক-না, বেচারী চুপচাপ বসে আছে—
একজন ছেলে বলল, ডব্লুটি’তে যাচ্ছে, তা আবার সীটে বসা কেন? আর-একজন বলল, আপনি চুপ মেরে থাকুন! আপনার সঙ্গে কোন কথা বলেছি?
আমাকে চুপ করেই যেতে হল। আমি দৃঢ় নিশ্চিত যে, ঐ আট-দশটি ছেলের মধ্যে অন্তত চার-পাঁচজন নিজেরা টিকিট কাটেনি। তবে, আজকাল নিজেরা একটা অন্যায় করেও অন্যদের সে-সম্পর্কে অভিযোগ জানানো যায়। মনে-মনে বললাম সাধুবাবা, কী আর করা যাবে, সব রাবণের দোষ!
ঐ ছেলেগুলোও নিশ্চয়ই আসলে খারাপ নয়। কলেজ থেকে ফেরার পথে একটু আমোদ করছে। আমোদটা যে মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে সেটুকু খেয়াল নেই। ঐ ছেলেগুলোর প্রত্যেকের সঙ্গে যদি আলাদাভাবে দেখা করা যায়, নিশ্চয়ই দেখব ভদ্র, বুদ্ধিমান ছেলে। আমারই মতন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে তো, আমার চেয়ে আর আলাদা কী হবে? একা-একা এরা প্রত্যেকেই সহজ সাধারণ, কিন্তু একটা দঙ্গল হলেই মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তখন একজন আর-একজনকে টেক্কা দিয়ে খারাপ হতে চায়। খারাপ হওয়াই আজকালকার ফ্যাশান, নইলে বন্ধুদের কাছে মান থাকেনা।
কোথায় কোন্ পাড়ায় কবে দুটো পাজী ছেলে চাঁদা দিতে রাজি হয়নি বলে এক ভদ্রলোককে ছুরি মেরেছিল, তারপর থেকে চাঁদা আদায়কারী ছেলেদের সম্পর্কেই মানুষের একটা বিশ্রী ধারণা হয়ে গেছে। ঐ ছেলে দুটিও আসলে ছদ্মবেশী রাবণ। নইলে, পাড়ায় সবাই মিলে চাঁদা দিলে পুজো,হবে, সবাই মিলে আনন্দ করবে—এইটাই তো স্বাভাবিক। বহুকাল ধরে এরকম চলছে, লোকে তো কখনো আপত্তি করেনি। তবে কারুর বেশি চাঁদা দেবার অসুবিধে থাকলে কিংবা না দিতে চাইলে মারধোর করার নিয়ম ছিল না। প্রথম যে ছেলে দুটো মারল, তারা আবহাওয়া বদলে দিল। ঐ ছেলে দুটো আসলে গুণ্ডা ছিনতাইবাজ, ওরা ‘চাঁদা আদায়কারীর ছদ্মবেশ ধরল কেন? সরাসরি ছুরি দেখিয়ে কেড়ে নিলেই পারত। রাবণের মতন আর-একটা অন্যায় করল বলে ওরা সমস্ত চাঁদা আদায়কারীদের ওপর কলঙ্ক দিয়ে গেল। এখন কেউ চাঁদা চাইতে এলেই লোকে সন্দেহ করে, দিতে চায়না। আর ওরাও দেখেছে, জোর করা কিংবা ভয় দেখানোই সহজ পথ—ফলে সম্পর্কটা এত বিশ্রী হয়ে গেল।
সেজোমাসি হন্তদন্ত হয়ে এসে চোখ গোলগোল করে বললেন, জানিস, সেই মেয়েটাকে আজ আবার দেখলাম ল্যানসডাউন রোডের মোড়ে—
জিজ্ঞেস করলাম, কোন্ মেয়েটা?
সেই যে সেদিন এসে কাঁদছিল! কী পাজী! কী পাজী! আজও ঠিক সেই একরকম—
মাস দু-এক আগে মেয়েটি আমাদের বাড়ির দরজার কাছে বসে কাঁদছিল। বছর পঁচিশেক বয়েস চেহারা, দেখলে মোটামুটি ভদ্র পরিবারেরই মনে হয়। শুধু কেঁদেই চলেছে, জিজ্ঞেস করলে কিছুই বলতে চায়না। আমার সেজোমাসি যেমন রাগী তেমনি দয়ালু। কথায়-কথায় লোকের ওপর রেগে ওঠেন—আমার ওপর তো অনবরতই রেগে আছেন। আবার লোকের দুঃখ-কষ্ট শুনলে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন—মনটা এত নরম। সেজোমাসি প্রথমে রাগ করে বলছিলেন, এই, তুমি এখানে বসে কাঁদছ কেন? কাঁদবার আর জায়গা পাওনি?
মেয়েটি আস্তে-আস্তে তার দুঃখের কথা বলল। কাল রাত্তিরে তার বাবা মারা গেছেন। মায়ের খুব অসুখ। তিনটে ছোটো-ছোটো ভাইবোন! পাড়ার ছেলেরা তার বাবার মৃতদেহ দাহ করার জন্য উদ্যোগ করছে, কিন্তু ওদের বাড়িতে একটাও টাকা নেই। পাটনায় কাকা থাকেন, তাঁকে টেলিগ্রাম করা হয়েছে, তিনি যদি টাকা পাঠান কিংবা আসেন…ভদ্র পরিবারের মেয়ে। কারুর কাছে টাকা চাইতেও পারছেনা। তার কানের দুলদুটো বাঁধা রেখে যদি গোটা পঞ্চাশেক টাকা দিই!
মেয়েটিকে দেখে সন্দেহ করার কোন উপায় নেই। তাছাড়া আমাদেরও তো মাসের শেষে প্রায়ই কোন টাকা থাকেনা, একটাকা-দুটাকা দিয়ে কাজ চালাতে হয়। তখন যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে? ধার যাক, মাসের শেষ রবিবারের সকালে? তাহলে তো আমাদেরও টাকার জন্য—
টাকার জন্য দুল বাঁধা নেবার কোন প্রশ্নই ওঠেনা, সেজোমাসিরই তখুনি চোখ ছলছল করতে শুরু করেছে। ঝড়াক করে দিয়ে দিলে পঞ্চাশ টাকা। বললেন, আরও যদি কিছু দরকার হয়, কাল এসো—
কাল আর আসেনি, কোনদিন আসেনি। দুমাস বাদে মেয়েটিকে সেই একই গল্প বলতে শুনেছেন আর-একটা বাড়িতে—সেই কাল বাবা মারা গেছে, পাটনায় কাকাকে টেলিগ্রাম, কানের দুল বাঁধা দেওয়া। সেজোমাসি রেগে আগুন। ব্লাডপ্রেসার বেড়ে গিয়ে সেজোমাসি না অজ্ঞান হয়ে যান!
মেয়েটি রাবণের মতন ওরকম ভুল করল কেন? এরপর সত্যিই যদি আর-কারুর বাবা মারা যাবার পর হঠাৎ বিপদে পড়ে সাহায্য চায়…তখন তার সত্যিকারের দুঃখের মুহূর্তেও তো লোকে তাকে রেগে তাড়া করে যাবে। কেউ বিশ্বাস করবেনা। ঐ মেয়েটির বাবা দুমাস ধরে প্রত্যেকদিন মারা যেতে পারেনা, টেলিগ্রাম পৌঁছুতে যতই দেরি হোক, দুমাস লাগেনা—তবুও মেয়েটির সত্যি-সত্যি সংসারে অভাব আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু ভিক্ষে করার তো অনেক পথ আছে। ঐরকম মিথ্যে গল্প বলায় ফল হল এই, সত্যিই যে ভিক্ষুক নয়, অথচ হঠাৎ বিপদে পড়েছে—সেও আর সাহায্য পাবেনা।
ছদ্মবেশ ধরার আগে এগুলো ভেবে দেখা নিশ্চয়ই উচিত। রাবণেরও উচিত ছিল।