নীলবর্ণ বিড়াল

নীলবর্ণ বিড়াল

রাকেশ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নীলবর্ণ শৃগালের স্বপ্ন দেখছিল।

কাল রাতে সদ্য-সদ্য গল্পটা পড়েছে ও। আচমকা নীলের গামলায় পড়ে গিয়ে নীল রঙের চেহারা হয়ে গিয়েছিল বেচারা শেয়ালটির। তারপর যখন সে জঙ্গলে ফিরে গেল তখন সমস্ত পশু-পাখি তাকে জঙ্গলের রাজা বলে মেনে নিল। কারণ, নীল রঙের শেয়াল তো তারা জীবনে কখনও দেখেনি! অতএব সেই অদ্ভুত রঙের প্রাণীটিকেই তারা সকলে মেনে নিয়েছিল বনের রাজা বলে।

রাকেশ দেখছিল, একটা নীল রঙের শেয়াল ওকে এসে ডাকছে, ‘রাকেশবাবু,

আমি কিন্তু গল্পের শেয়াল নই। সত্যিকারের নীল রঙের শেয়াল।’ রাকেশ অবাক হয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিগ্যেস করল, ‘সত্যি?’ শেয়ালটা বলল, ‘সত্যি।’

আর তারপরই রাকেশকে হতভম্ব করে দিয়ে ‘মিউ-মিউ’ করে ডেকে উঠল। শেয়াল ‘মিউ-মিউ’ করে ডাকছে! রাকেশ চমকে উঠল। আর তক্ষুনি ওর ঘুম ভেঙে গেল।

ঘুম ভাঙতেই দেখল বিছানায় ওর কোলের কাছে গুটিসুটি মেরে বসে আছে একটা নীল রঙের বিড়াল। ‘মিউ-মিউ’ করে ডাকছে। কাচের গুলির মতো নীল চোখজোড়া জুলজুল করে রাকেশেরই দিকে তাকিয়ে। সরু ঝাঁটার কাঠির মতো নীল রঙের গোঁফ। গায়ের রং গাঢ় নীল। শুধু লেজের ডগায় খানিকটা কালো ছোপ।

রাকেশ ভাবল, ওর স্বপ্নের ঘোর বোধহয় এখনও কাটেনি। ভাবল, চিমটি কেটে একবার দেখি তো! যেমন ভাবা তেমনি কাজ। কিন্তু চিমটি কাটতে গিয়েই আবার অবাক। এ কী! ওর ধবধবে ফরসা গায়ের রং এরকম নীল হয়ে গেল কেমন করে! তারপরই বাকি দুর্ঘটনাগুলো একে-একে রাকেশের চোখে পড়ল।

ঘরের দেওয়াল, বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড়, টেবিল-চেয়ার, ফ্যান, ঘরের মেঝে—সর্বত্র শুধু নীল আর নীল। কোনওটার রং উজ্জ্বল নীল, কোনওটা ঘোলাটে নীল, কোনওটার রং কালচে নীল, আবার কোনওটা স্রেফ কুচকুচে কালো।

বিছানার বেড়ালটা তখনও ‘মিউ-মিউ’ করে ডেকে চলেছে।

রাকেশ ধড়মড় করে উঠে বসল। পাশে মা নেই। অনেকক্ষণ আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়েছেন। এখন নিশ্চয়ই রান্নাঘরে। রাকেশের কান্না পেয়ে গেল। কোনওরকমে চিৎকার করে ও ডেকে উঠল, ‘মা, মা!’ মা ছুটে এলেন প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে।

মা-কে দেখে রাকেশের চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল—কালচে নীল গায়ের রং। চোখের তারাটুকু শুধু কালো, বাকি অংশটা উজ্জ্বল নীল। ঝকঝকে দাঁতেরও একই দশা। অবশ্য মাথার চুলগুলো কুচকুচে কালো- -যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেছে।

বিছানা থেকে নেমে একছুটে গিয়ে মা-কে জাপটে ধরল রাকেশ। শাড়ির ভাঁজে মুখ লুকিয়ে জড়ানো গলায় বলল, ‘এসব কী কাণ্ড, মা? আমি কি ভুল দেখছি?’

মা ওর মাথায় হাত বুলোতে লাগলেন। আশ্বাস দিয়ে বললেন, ‘না রে, তোর চোখের ভুল নয়, আমরা সব্বাই ওই নীল রঙেরই সবকিছু দেখছি। সকালে ঘুম ভেঙেই দেখি এই দশা। তবে ভয়ের কিছু নেই। একটু আগেই রেডিয়োতে আর টিভিতে বলেছে, সারা পৃথিবী জুড়েই নাকি একইরকম কাণ্ড হয়েছে। এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

মায়ের কথায় রাকেশ বিশেষ ভরসা পেল বলে মনে হল না। ও বিছানায় বসা বেড়ালটাকে দেখিয়ে বলল, ‘ওই দ্যাখো—’

মা হাসলেন, বললেন, ‘ওটা তো তোর মিনু। রং পালটানোর ধাক্কায় ওর রঙও ওরকম নীল হয়ে গেছে। নে, এব হাত-মুখ ধুয়ে পড়তে বোস দেখি—।

মা-কে রোজকার মতো সহজ স্বাভাবিক দেখে রাকেশের বিস্ময় আর আতঙ্ক ধীরে-ধীরে কাটতে লাগল। মা ব্যস্তভাবে রান্নাঘরে চলে যেতেই ও টুথব্রাশে খানিকটা টুথপেস্ট লাগিয়ে নিল। টুথব্রাশের রং এমনিতেই নীল ছিল। অতএব ওটার রঙের তেমন রদবদল হয়নি। কিন্তু সাদা টুথপেস্ট একেবারে গাঢ় নীল রঙের হয়ে গেছে ।

মুখ ধুতে বেসিনের কাছে গিয়ে রাকেশ যথারীতি আবিষ্কার করল সাদা ওয়াশ বেসিন ঘন নীল। এতক্ষণে ওর ভয়টা কেটে গিয়ে বেশ একটা মজা টগবগ করে উঠল। হাত-মুখ ধুয়ে ও এদিক-ওদিক উঁকিঝুঁকি মেরে দেখতে লাগল।

মা রান্না ছেড়ে টানা বারান্দার রেলিঙে ভর দিয়ে পাশের বাড়ির টুকির মায়ের সঙ্গে গল্প করছিলেন। হাসাহাসিও করছিলেন দুজনে।

রাকেশ শুনল, পাশের বাড়ির মাসিমা বলছেন, ‘দিদি, ভাতের আজ যা চেহারা হয়েছে, টুকির বাবা ভাত খেয়ে অফিস গেলে হয়!’

সত্যিই তো, নীল রঙের ভাত কি আর চাট্টিখানি ব্যাপার! রাকেশ ভাবল। মা তখন বলছেন, ‘আমারও তো একই অবস্থা, ভাই। ভাত, ডাল, হলুদ, লঙ্কা সব যে একেবারে ভোল পালটে ফেলেছে।’

টুকির মা-কে বেশ চিন্তিত মনে হল। উনি বললেন, ‘রাতারাতি এ কেমন ভোজবাজি হল বলুন তো, দিদি! আমার তো ব্যাপার-স্যাপার সুবিধের ঠেকছে না।’

মা বললেন, ‘একটু আগেই রেডিয়োতে বলেছে, বিজ্ঞানীরা এটা নিয়ে খুব মাথা ঘামাচ্ছেন। শিগগিরই এর সমাধান করে দিলেন বলে— ‘

রাকেশ আর দাঁড়াল না। ছুট-পায়ে চলে এল রাস্তার দিকের ঝুলবারান্দায়।

ওমা! এ কী! আকাশে যে-সূর্যটা উঠেছে সেটার রংও যে ঘন নীল! আকাশের নীল রঙের সঙ্গে ওটা প্রায় মিশে গেছে। আর চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে নীল রোদ্দুর। যে-ক’টা গাছপালা দেখা গেল সবই কালচে নীল। শুধু কালো রঙের কাকগুলো নীলরঙা টিভি-অ্যানটেনার ওপরে বসে একইরকমভাবে ‘কা-কা’ করে ডাকছে।

রাকেশ মুগ্ধ চোখে চারদিক দেখতে লাগল।

একটু পরেই মা বারান্দায় এসে হাজির। হাতে একগ্লাস দুধ। ওকে ডেকে

বললেন, ‘নে রাকা, চটপট খেয়ে নে দেখি। উনুন জ্বলে যাছে।’

রাকেশ ব্যাজার মুখে দুধের গ্লাস হাতে নিল। নীল রঙের দুধ! মায়ের দিকে মুখ তুলে আবদারের গলায় বলল, ‘তুমিই বলো না, এরকম দুধ কেউ খেতে পারে?’

মা ব্যস্তভাবে বললেন, ‘পারে পারে, খুব পারে। যদি সবকিছুর রং এরকমটাই থেকে যায়, আর আগের মতো ফিরে না আসে, তা হলে অবস্থাটা কী হবে শুনি! নীল রঙের দুধ, ভাত, সবই তো খাওয়া অভ্যেস করতে হবে, তাই না? মানুষ তো আর না খেয়ে থাকতে পারবে না। নে, তুই চটপট খেয়ে গ্লাসটা বেসিনের কাছে রেখে দিস, আমি যাই—।’

মা ব্যস্ত পায়ে চলে যাচ্ছিলেন, রাকেশ জিগ্যেস করল, ‘বাবা এখনও আসেনি?’

মা বললেন, ‘উঁহু। প্রায় একঘণ্টা তো হয়ে গেল বাজারে গেছে। মনে হয়, বাজারে আজ হইচই পড়ে গেছে। নে, দুধটা জলদি খেয়ে নে।’ মা হুউশ্ করে চলে গেলেন।

রাকেশ অতি সাবধানে দুধের গ্লাসে একটা চুমুক দিল। মাগো! কীরকম গা গুলোচ্ছে। কিন্তু দুধের স্বাদটা একইরকম আছে। শুধু রং পালটে গেলেই খাওয়ার ইচ্ছেটা পালটে যায় কেন কে জানে! নইলে রাকেশ তো দুধ খেতে ভালোই বাসে।

মিনু কখন যেন বিছানা ছেড়ে নেমে এসে পায়ের কাছে ঘুরঘুর করছিল আর ডাকছিল ‘মিউ-মিউ’ করে। বোধহয় দুধের গন্ধ পেয়েছে। ওকে খানিকটা দুধ দিয়েই দেখা যাক তো, খায় কি না। গ্লাস থেকে কিছুটা দুধ মেঝেতে ঢেলে দিল রাকেশ। ঠিক মিনুর সামনে। কিন্তু দেখল, বেড়ালটা প্রথমে কেমন যেন হকচকিয়ে গেল৷

বাবার কাছেই রাকেশ শুনেছে কুকুর, বেড়াল, গরু, মানুষের মতো বর্ণালির সাত রং দেখতে পায় না। এমনকী লাল কাপড়ের টুকরো দেখিয়ে স্পেনে যে ষাঁড়ের লড়াই হয়, সেখানে ষাঁড় মোটেই লাল কাপড় দেখে খেপে ওঠে না। সে বেচারা কাপড়টাকে দেখে গাঢ় ছাই রঙের। আসলে কাপড়ের টুকরোটার দ্রুত নড়াচড়াতেই সে খেপে উঠে ওটাকে তাড়া করে।

সুতরাং হিসেবমতো মিনুও নিশ্চয়ই দুধটাকে এখন কালো রঙের দেখছে। কারণ, ওর পক্ষে তো আর নীল রং দেখা সম্ভব নয়। হয়তো সেইজন্যেই ও দুধটার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে।

অবশেষে ঘ্রাণশক্তিরই জিত হল। গন্ধে-গন্ধে জিভ বাড়িয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা দুধের স্বাদ নিল মিনু। তারপর ‘চক-চক’ শব্দে গোটা দুধটাই চেটেপুটে সাফ।

মিনুর দেখাদেখি চোখ বুজে অতিকষ্টে গ্লাসের দুধ শেষ করল রাকেশ। তারপর এর জল খেয়ে গ্লাস মায়ের কাছে রেখে এসে পড়ার বই নিয়ে বসল।

ইতিহাস বই খুলেই রাকেশ বুঝল, পড়াশোনা করা মোটেই সম্ভব নয়। কারণ বইয়ের গাঢ় নীল রঙের পৃষ্ঠায় খুদে-খুদে কালো অক্ষরগুলো ভালো করে দেখতে পাওয়াই মুশকিল।

রাকেশ মনমরা হয়ে প্রত্যেকটা বই আর খাতার পৃষ্ঠা উলটে-উলটে দেখতে লাগল। দূর ছাই, স্কুলে গিয়ে তা হলে আর কী হবে! বই ছেড়ে উঠে বাবার টেবিল থেকে ট্রানজিস্টার রেডিয়োটা নিয়ে এল ও। সুইচ অন্ করে নব ঘুরিয়ে কান পাতল। সঙ্গে-সঙ্গেই শুনতে পেল বিশেষ ঘোষণা : ‘…সেই কারণেই সবকিছু বিবেচনা করে রঙের অবস্থা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত স্কুল-কলেজ, সরকারিবেসরকারি সমস্ত প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। সরকারিভাবে জানানো হয়েছে, বিজ্ঞানীরা এই আশ্চর্য ঘটনা নিয়ে দ্রুত গবেষণা করছেন এবং স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। জনসাধারণের নিরাপত্তার কথা ভেবে সবরকম যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখার জন্যে সরকার অনুরোধ জানিয়েছেন………।’

সুইচ টিপে রেডিয়ো অফ করে দিল রাকেশ। রঙের সামান্য রকমফেরের জন্যে এ কী কাণ্ড হল!

এমনসময় ‘ফোঁস’ করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাবা এসে ঘরে ঢুকলেন। রাকেশকে বললেন, ‘রাকা, তোমার ইস্কুল ছুটি।’

রাকেশ দেখল, বাবার পরনে নীল আদ্দির কাপড়ের পাঞ্জাবি, নীল ধুতি। গায়ের রং কালচে-নীল।

পাঞ্জাবি খুলে হ্যাঙারে টাঙিয়ে রাখতে-রাখতে বাবা আবার বললেন, ‘বাজারে তো একেবারে হুলস্থূল কাণ্ড। অদ্ভুত-অদ্ভুত রঙের সব জিনিস বিক্রি হচ্ছে : নীল ফুলকপি, নীল রজনীগন্ধা, আর মাছের বাজারে কালো-কালো পোনা মাছের টুকরো।’

‘কেন, কালো রঙের কেন?’ রাকেশ জানতে চাইল।

বাবা হেসে বললেন, ‘হবে না! রক্তের রঙই যে কুচকুচে কালো হয়ে গেছে! এ ছাড়া বাজারে শুনলাম, গাড়ি-ঘোড়া, স্কুল-কলেজ, অফিস-কাছারি সব নাকি অনির্দিষ্টকালের জন্যে বন্ধ থাকবে।’

‘হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ। এইমাত্র রেডিয়োতে বলেছে।’

‘কই, দেখি, রেডিয়োটা দে তো—।’

রাকেশ রেডিয়োটা বাবাকে দিল। তারপর বইপত্র গুছিয়ে রেখে আবার ঝুলবারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।

উলটোদিকের বাড়ির ছাদে তিনটে গাঢ় নীল রঙের পায়রা বসেছিল। ওবাড়ির তপনদা পায়রা পোষে। সেদিকে তাকিয়ে থেকে রাকেশ ভাবছিল : সত্যি, কী অদ্ভুত ব্যাপার! সূর্যের সাত রঙের ছ-ছ’টা রং উধাও হয়ে যাওয়ার জন্যে কী বিপত্তি! সারা পৃথিবীর জীবনযাত্রা একেবারে অচল। রাস্তাঘাটে গাড়ি চালানোও বিপজ্জনক। চারদিকে শুধু নীল রং অথবা কালো রং। আর তা নইলে তাদের কমবেশি মিশেল দিয়ে তৈরি কোনও নীলচে রং। এই ধরনের পরিবেশে গাড়ি চালাতে গিয়ে অভ্যেস না থাকায় ড্রাইভাররা হয়তো অ্যাকসিডেন্টই করে বসবে। সেইজন্যেই রেডিয়োতে যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখার অনুরোধ জানিয়েছে।

সিনেমা হলগুলোও বন্ধ থাকবে নিশ্চয়ই। নীল ছাড়া বাকি সব রং উধাও হয়ে গেলে রঙিন ছবির আর বাকি থাকল কী! আবার সাদা-কালো সিনেমাতেও একই বিপদ! সাদা রং বলে কিছু থাকবে না। তার বদলে শুধু নীল আর নীল! ঠিক টিভির মতোই দশা!

যতদিন রংগুলো ছিল ততদিন বোঝা যায়নি সেগুলো কত জরুরি। বোঝা যায়নি, সেগুলো না থাকলে লাগাতার বন্ধ শুরু হয়ে যাবে মানুষের জীবনে। এখন দিনগুলো কাটবে কেমন করে সেই নিয়েই রাকেশের চিন্তা।

বিকেলবেলায় বাবার কাছে শুনল, কলকাতার সমস্ত রং কোম্পানি নতুন কোনও ব্যবসা খোলার কথা ভাবছে নানান দোকানে তাদের যত রং ছিল সব ভোল পালটে নীল অথবা কালো হয়ে গেছে। এদিকে বুড়ো মানুষদের চুলদাড়ি সব নীল হয়ে গিয়ে তাদের ভারি চমৎকার লাগছে। সেই দেখে কালো চুল যাতে তাড়াতাড়ি পেকে গিয়ে নীল হয়ে যায় তার জন্য মানুষ কৃত্রিম উপায়ে চেষ্টা করছে। বিভিন্ন সেলুনে কালো চুল নীল করার জন্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে।

এরাকেশ অবাক হয়ে বাবার কথা শুনছিল। এমনসময় রেডিয়োতে বলল, পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে কয়েক লক্ষ দুর্ঘটনা ঘটেছে। হিমালয়ের বরফে ঢাকা চুড়ো আকাশের নীল রঙের সঙ্গে মিশে যাওয়ায় মোট সাতাশটি এরোপ্লেন এভারেস্ট ও কাঞ্চনজঙ্ঘায় আছড়ে পড়েছে। ভারতবর্ষে এ-পর্যন্ত তিনজন পুরুষ ও একজন মহিলা এই রং বদলের ঘটনায় সম্পূর্ণ পাগল হয়ে গেছেন।

এরকম চমকে দেওয়া আরও কতসব দুর্ঘটনা!

রাকেশের খুব মন খারাপ লাগছিল। ও পায়ে-পায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। সন্ধে ঘন হয়ে আঁধার নেমে এসেছে। কিন্তু আকাশে চাঁদ-তারা কই? গাঢ় পিচ রং আকাশে ঘোর নীল রঙের চাঁদ। ভালো করে ঠাহর করা যায় না। আর তারা? চোখে প্রায় পড়ে না বললেই চলে। ইস, এরকমভাবেই কাটবে প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত!

রাকেশ ঘরে ফিরে এল। ঘরে নীল আলো জ্বলছে। টিউব লাইট আর বাল্ব। দুটোর অবস্থাই একরকম। বাবা-মা চুপচাপ বসে। মায়ের মুখে সকালের ঠাট্টার লেশমাত্র নেই এখন। বাবাও যেন বেশ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। মুখ গম্ভীর। রেডিয়ো সামনে নিয়ে বসে আছেন। রেডিয়ো ছাড়া আর উপায় কী! গল্পের বই পড়া বন্ধ। খবরের কাগজ পড়া বন্ধ। টিভি দেখা বন্ধ। ঘরে বসে-বসে সকলেই বোধহয় এইরকম হাঁফিয়ে উঠেছে।

রেডিয়োতে গানের অনুষ্ঠান শুনছিলেন বাবা। হঠাৎই রাকেশের দিকে ফিরে বললেন, ‘রাকা, খেয়াল করছিস, যারা খবর পড়ে শোনাচ্ছে তাদের মাঝে-মধ্যে কীরকম আটকে যাচ্ছে! নীল কাগজে কালো লেখা পড়তে গিয়ে খবর পড়ুয়ারা একেবারে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে।’

রাকেশ সামান্য হাসল।

মা বললেন, ‘তবু রেডিয়ো ছাড়া আর উপায় কী বলো

রাকেশ জিগ্যেস করল, ‘খবরে কিছু বলেছে, বাবা?’

‘হ্যাঁ, বলেছে। মার্কিন বিজ্ঞানীরা অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানিয়েছেন, সূর্যের মধ্যে কোনও একটা গোলমালের জন্যেই এরকম বিচিত্র ঘটনা ঘটেছে। চব্বিশ ঘণ্টা না কাটলে তাঁরা নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারছেন না।’

মিনু রাকেশের পায়ে-পায়ে ঘুরছিল। রাকেশ ওকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে লাগল। তারপর একটা কালো বল নিয়ে ওর সঙ্গে খেলতে শুরু করল। সময় যেন আর কাটতেই চাইছে না।

এমনি করেই একসময় রাত দশটা বাজল। কোনওরকমে খাওয়াদাওয়া সেরে রাকেশ মায়ের পাশে শুয়ে পড়ল। মিনুও শুয়ে পড়ল ওর কোল ঘেঁষে। বাবা পাশের ঘরে যাওয়ার সময় বলে গেলেন, ‘রাকা, মন খারাপ করিস না। কাল সকালে উঠেই দেখবি স-ব ঠিক হয়ে গেছে।’

বাবার কথাটা যে এরকম হাতেনাতে ফলে যাবে সেটা রাকেশ কল্পনাও করতে পারেনি।

ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই ও অবাক। ধবধবে সাদা মিনু ‘মিউ-মিউ’ করছে কালকের মতোই। চোখের ভুল নয়তো! রাকেশ শুয়ে-শুয়েই দেখল চারপাশ। ঘরের দেওয়াল আবার সাদা হয়ে গেছে, ফরসা হয়ে গেছে ওর গায়ের রং, জানলা দিয়ে ঠিকরে পড়েছে সোনা রঙের ঝকঝকে রোদ। পাশে তাকিয়ে দেখল, মা নেই। আগেই উঠে পড়েছেন।

রাকেশ লাফিয়ে উঠে বসল। মনটা দারুণ খুশি হয়ে উঠল ওর। যাক, সবকিছু আবার তা হলে আগের মতোই স্বাভাবিক হয়ে গেছে! কিন্তু হল কেমন করে? রাকেশ বিছানা ছেড়ে ছুটল রান্নাঘরের দিকে— মায়ের সন্ধানে।

সেখানে পৌঁছে দ্যাখে বাবা হাত-পা নেড়ে মাকে কীসব যেন বোঝাতে চেষ্টা করছেন। একহাতে বাজারের দুটো থলে। থলে দুটো উঁচু করে বাবা মাকে বলছেন, ‘এই দ্যাখো, ধরো এটা হল সূর্য। সূর্য থেকেই তো সাদা আলো আসছে আমাদের পৃথিবীতে—।’

মা বাধা দিলেন, ‘সাদা আলো কোথায়! ও তো হলদে আলো।’ বাবা একটা অদ্ভুত শব্দ করে ধৈর্য হারালেন। তারপর বললেন, ‘দুর ছাই! তোমাকে বলে লাভ নেই। তারচেয়ে বরং রাকাকে বলি।’

রাকেশ খুশি-খুশি মেজাজে বলে উঠল, ‘সব রং আবার ঠিকঠাক হয়ে গেছে, বাবা। কিন্তু ওরকম ওলটপালট হয়েছিল কেমন করে? রেডিয়োতে কিছু বলেছে?’

‘আরে সেটাই তো তোর মাকে বোঝাতে চেষ্টা করছিলাম। রেডিয়োতে সংক্ষেপে যা বলল, তা হল এই : গত পরশু রাতে—অর্থাৎ, ধরে নে, তিরিশ ঘণ্টা আগে, সূর্যে একটা বিস্ফোরণ ঘটেছিল। কী কারণে এই বিস্ফোরণ, তা এখনও বিজ্ঞানীরা বুঝে উঠতে পারেননি। তবে বলেছেন, সেই বিস্ফোরণের ফলে সূর্যকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল বিচিত্র এক তেজস্ক্রিয় বিকিরণ। সেই বিকিরণ সূর্যের সাদা আলো থেকে ছ-ছ’টা রং একেবারে শুষে নিয়েছিল। তারা শুধু গেট-পাস দিয়েছিল নীল রংটাকে। ফলে সব জিনিসকেই নীল রঙের দেখাচ্ছিল। তা ছাড়া, ওই বিকিরণের প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল সূর্যের কাছের তিনটে গ্রহে—বুধ, শুক্র আর পৃথিবীতে। সেইজন্যে আমাদের এখানকার কৃত্রিম আলোগুলোও—মানে, টিউব লাইট, বাল্ব সব—নীল রঙের আলো ছড়াচ্ছিল…।’

‘কিন্তু কালো রংটা?’ ভাতের হাঁড়িতে হাতা নাড়তে-নাড়তে মা প্রশ্ন করলেন। তার জবাব দিল রাকেশ, ‘কালোটা কোনও রং নয়, মা। বরং কোনও রং না থাকলে সেই জিনিসটাকে আমরা কালো দেখি।’

মায়ের মুখের চেহারা দেখে বোঝা গেল রাকেশের ব্যাখ্যা তাঁর মনঃপূত হয়নি।

সেটা অনুমান করে বাবা বললেন, ‘যাই হোক, ভারতীয় সময় অনুযায়ী গতকাল রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ সূর্যকে ঘিরে থাকা ওই বিচিত্র বিকিরণ মিলিয়ে গেছে মহাশূন্যে। ফলে বর্ণালির বাকি ছ’টা রং আজ সকাল থেকেই আবার ফিরে পাওয়া গেছে। আর পৃথিবীর ওপর থেকেও কেটে গেছে ওই বিকিরণের প্রভাব। সুতরাং রাতের আলোতেও আর কোনও গোলমাল থাকবে না। সিনেমা টিভিও দেখা যাবে আগের মতোই।’

বাবা বাজারের থলে দুটো বগলদাবা করে রাকেশকে লক্ষ্য করে গলা নামিয়ে বললেন, ‘রাকা, এবারে রঙের ব্যাপারটা ছোট্ট করে তোর মাকে বুঝিয়ে দিই, কী বলিস?’

রাকেশ মজা পেয়ে ঘাড় কাত করল। মা রান্নায় মগ্ন হলেও এদিকে যে কান পেতে আছেন তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

গলাখাঁকারি দিয়ে বাবা বলতে শুরু করলেন, ‘শোনো, সূর্যের যে সাদা আলো—মানে, তোমার মতে হলদে, কিন্তু বিজ্ঞানীদের মতে ওটাই সাদা আলো— ওই সাদা আলো ভাঙলে দেখা যাবে ওর ভেতরে সাতটা রং মিশে আছে। আকাশে রামধনু উঠলে বর্ণালির সেই সাতটা রং আমরা আলাদা করে দেখতে পাই। দিনেরবেলা সব জিনিসের ওপরেই সাদা আলো পড়ে, কিন্তু তবুও বিভিন্ন জিনিসকে আমরা বিভিন্ন রঙের দেখি। এরকমটা কেন হয়? ধরো, এই যে তুমি লাল রঙের শাড়ি পরে আছ, এই শাড়িটাকে লাল দেখানোর কারণ এটা বর্ণালির লাল রং ছাড়া আর সব ক’টা রংই শুষে নিয়েছে। শুধু গেট-পাস দিয়েছে লাল রংটাকে। যেমন ওই বিকিরণ নীল রংটাকে ছেড়ে দিয়েছিল। যে-জিনিস সব রং শুষে নেয় তাকে আমরা কালো দেখি। আর যে-জিনিস বর্ণালির সব ক’টা রংকেই ফিরিয়ে দেয়—মানে, ছেড়ে দেয়—তাকে আমরা দেখি সাদা রঙের। যেমন আমার এই ধুতি-পাঞ্জাবি, হাঁড়ির ওই ভাত। এবার তো বুঝলে?’

মা হাতা নাড়তে-নাড়তে বললেন, ‘ঢের বুঝেছি। এখন চটপট বাজারটা করে আনো দেখি। কাল তো নীল ভাত খেতেই পারোনি, আজ ভালো করে দুটো সাদা ভাত খেয়ে অফিসে যেয়ো।’

বাবা চলে গেলেন। যেতে-যেতে বললেন, ‘কাল খবরের কাগজ পড়তে পারিনি। আজ দেখি কোনও টেলিগ্রাম বেরোল কি না—

মা রাকেশকে বললেন, “কী হল, রাকা, যাও, পড়তে বোসো গিয়ে—।’ রাকেশ পড়ার টেবিলে ফিরে এল। মিনু টেবিলের নীচে চুপটি করে বসে। জানলা দিয়ে বাইরের রোদ দেখতে রাকেশের খুব ভালো লাগছিল। ও উঠে গিয়ে গরাদে মুখ ঠেকিয়ে চোখ তুলে তাকাল সূর্যের দিকে। আজ সূর্যটাকে কী দারুণ দেখাচ্ছে! কই, এতদিন তো এরকম মনে হয়নি! বরং সূর্যটা যেন সকলের কাছে বেশ পুরোনো হয়ে গিয়েছিল। অথচ আজ একেবারে ঝকঝকে নতুন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *