নীলনয়নীর উপাখ্যান
অভূতপূর্ব, অভাবনীয় কান্ড। বেকসুর খালাসের হুকুম পেয়ে খুনের আসামি কোথায় আনন্দে উদ্বাহু হয়ে নাচবে তা নয়, সে কিছুক্ষণ বিহ্বলভাবে তাকায়। তারপরে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে। বলে, ‘আপনারা আমার সর্বনাশ করলেন। আমি মুক্তি চাইনি, শাস্তি চেয়েছি। আমি বাঁচতে চাইনি, মরতে চেয়েছি। এই পোড়ামুখ আমি কাকে দেখাব? এই পোড়াজীবন আমি কেমন করে কাটাব? কে আমাকে বিশ্বাস করে চাকরিবাকরি দেবে? আপনারা আমার সর্বনাশ করলেন। এ হুকুম ফিরিয়ে নিন, ফিরিয়ে নিন।’
জজসাহেব অবাক। জুরিরা বিমূঢ়। পাবলিক প্রসিকিউটর স্তম্ভিত। এঁরা সকলে আদালত থেকে উঠে চলে গেলেন।
জজসাহেব তাঁর চেম্বারে গিয়ে পাবলিক প্রসিকিউটরকে স্মরণ করলেন। তিনি প্রবেশ করতেই সাহেব বলেন, ‘স্যানিয়েল, এ যে হিতে বিপরীত। আমি তো ওকে একেবারে ছেড়ে দিতে চাইনি। চেয়েছিলাম যাতে ফাঁসি না হয়ে দ্বীপান্তর হয়। শুনানির আগে তোমাকে ডেকে বলেছিলুম, কাস্ট আয়রন কেস। সারদা হলে একে নির্ঘাত ঝুলিয়ে দিত। কিন্তু আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছে, নিরুপম আর নীলনয়নী এদেশের ওথেলো আর ডেসডিমোনা। আই বেগ ইয়োর পার্ডন, ডেসডিমোনা।
এখানে বলে রাখি, জজসাহেব ইংরেজি উচ্চারণ সম্বন্ধে খাঁটি ইংরেজ ছিলেন। তাঁর নাম চারুচন্দ্র রক্ষিত। কেউ তাঁকে সে-নামে উল্লেখ করলে তিনি চটপট শুধরে দিতেন, ‘ইউ মিন, চারু চাণ্ডার র্যাকসিট।’ তিনি একজন সিভিলিয়ান জজ। হাই কোর্টের সিভিলিয়ান জজেরাই তখনও সেশনস কেস শুনতেন। জুরিপ্রথা তখনও হাই কোর্টে বহাল ছিল, যদিও মফস্সল থেকে উঠে গেছে। ইতিমধ্যে দেশ স্বাধীন হয়েছে।
সেবারে পাবলিক প্রসিকিউটর মাথা চুলকে বলেছিলেন, ‘ইয়োর লর্ডশিপ আমায় কী করতে পরামর্শ দেন?’
সেবারে জজসাহেব পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘স্যানিয়েল, তুমিও যদি মনে কর এ লোকটি এদেশের ওথেলো, তাহলে মামলাটি এমনভাবে পরিচালনা করবে যাতে ওথেলোর প্রতি জুরির সহানুভূতি উদ্রেক হয়। যাতে জুরি মার্ডারের বদলে কালপেবল হোমিসাইড নট অ্যামাউন্টিং টু মার্ডার এই ভার্ডিক্ট দেয়।’
আইনত পাবলিক প্রসিকিউটরকে প্রভাবিত করা জজের কর্তব্য নয়। জজ হবেন নিরপেক্ষ। ফলাফল সম্বন্ধে উদাসীন। তবে তিনি জুরিকে বুঝিয়ে দিতে পারেন যে, নরহত্যা সবসময় দন্ডবিধি আইনের ৩০২ ধারার মধ্যে আসে না। কখনো কখনো ৩০৪ নম্বর ধারার প্রথমাংশ প্রযোজ্য। জুরিই মনস্থির করেন। জজ সাধারণত হস্তক্ষেপ করেন না।
পাবলিক প্রসিকিউটর আইনত জজের নির্দেশে কাজ করতে বাধ্য নন। তাঁকে যাঁরা নিযুক্ত করেছেন তাঁদের নির্দেশই তিনি পালন করবেন। এক্ষেত্রে প্রাণদন্ডেরই নির্দেশ। কেননা অপরাধটা একান্ত গুরুতর।
এইরকম ছিল মামলার শুনানির পূর্বের কথোপকথন।
পরিচালনকালে পাবলিক প্রসিকিউটর বোধহয় যথেষ্ট কঠোর হননি। কিছুটা কোমল হয়েছিলেন। তাহলেও এতটা কোমল নন যে জুরি আসামিকে একেবারেই অব্যাহতি দেবে। তিনি জজসাহেবকে বলেন, ‘আমি সরকারকে এখন পরামর্শ দিতে পারি খালাসের বিরুদ্ধে আপিল করতে। তখন রিট্রায়াল হবে।’
জজসাহেব হাঁ হাঁ করে ওঠেন। ‘তাহলে সারদা যে লোকটাকে নিশ্চিত ঝুলিয়ে দেবে।’
সে-সময় সারদাকান্ত সেনগুপ্ত ছিলেন অন্যতম সিভিলিয়ান জজ। আরও সিনিয়র। এর আগে তিনিই দায়রার মামলাগুলোর ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। ‘হাঙ্গিং জাজ’ বলে তাঁর কুখ্যাতি ছিল।
মিস্টার জাস্টিস র্যাকসিট সেদিন বাড়ি ফিরে গিয়ে দু-গ্লাস শেরি দিয়ে তাঁর মনের দুঃখ ডুবিয়ে দিলেন।
ওদিকে আসামি তো আদালত থেকে বেরোতেই চায় না, বলে, ‘কোথায় যাব? আমার বলতে কে আছে? একটি ছ-বছরের ছেলে।’
তখন নিরুপমের ভগ্নীপতি সত্যব্রত এগিয়ে এসে বলেন, ‘তোমার দিদি আছেন। তোমার ছেলেকে তাঁর ওখানেই পাবে। চলো আমার সঙ্গে।’
নিরুপম তাঁর সঙ্গেই দিদির বাড়ি যায়। সেখানে তার ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আর একদফা কান্নাকাটি করে। কিন্তু একটিও কথা বলে না।
দিদির পায়ে মাথা রেখে কিছুক্ষণ অশ্রুবর্ষণ করে। কিন্তু এক বারও মুখ খোলে না।
জামাইবাবুকে তার যা বলার ছিল তা সে একখানা কাগজ টেনে নিয়ে লিখে জানায়। ‘আমার ভগ্নীপতি সত্যব্রত ভট্টাচার্যকে আমি আমার নাবালক পুত্র নিরঙ্কুশ ভট্টাচার্যের গার্জেন নিযুক্ত করিলাম। লাইফ ইনসিয়োরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে আমার যা পাওনা তা তিনি আদায় করিয়া আমার পুত্রের কল্যাণে ব্যয় করিবেন।’ তারপর তার সেই কাগজের সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করার জন্য দুজন প্রতিবেশীকে ডেকে আনা হল।
সে-রাত্রে নিরুপম সেই বাড়িতেই ছিল। কিন্তু সকালে তার শোবার ঘরের দরজা খুলে দেখা গেল, সে উধাও।
অনেক খোঁজ করেও তার সন্ধান পাওয়া গেল না।
তার ছেলের পরবর্তী জন্মদিনে সে আপনিই এসে হাজির হল। তার পরনে গৈরিক। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘তুমি কি সন্ন্যাস গ্রহণ করেছ?’
সে বলে, ‘না। এই দ্যাখো আমার উপবীত। আমি গৈরিক ধারণ করেছি এইজন্য যে কেউ আমার পূর্বাশ্রমের কথা জানতে চাইবে না। আমিও জানাব না।’
দুই
এখন পূর্বাশ্রমের কথা বলি, যতদূর জানি।
চাঁপাতলার নীলকন্ঠ ঘোষ ছিলেন ডিরোজিয়োর সাক্ষাৎ শিষ্য। ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর একজন। ঘোষ বংশের ধারা ধরে তাঁর পুত্র নীলাম্বরও হিন্দু কলেজে পড়ে। হিন্দু কলেজ যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে রূপান্তরিত হয় তখন ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন নীলকমল, নীলরতন ও নীলবরণ ঘোষ।
নীলবরণের কন্যা নীলনয়নী। ওঁরা ডিরোজিয়ন বলে পরিচয় দিতেন। সেটা শুধু বাড়ির সদরমহলে। অন্দরমহলে চিরাচরিত পূজাপার্বণ, বারব্রত, চিকের আড়ালে বসে জলসা দেখা, বাইরে বেরোলে একহাত ঘোমটা। মেয়েদের সাধারণত ষোলো বছর বয়সের আগে বিয়ে হয়ে যেত। এঁরা পুরুষানুক্রমে সলিসিটর ও নীলরক্তের দাবিদার। বাড়িটাও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের কলোনিয়াল স্টাইলে।
নীলনয়নী ষোলো বছর বয়সে বিয়ে করবে না। কলেজে পড়বে। এবং বেথুনে নয়, প্রেসিডেন্সি কলেজে। ততদিনে প্রেসিডেন্সি কলেজের দরজা ছাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত হয়েছিল। সেটা প্রথম বার নয়। প্রথম বার হয়েছিল পি কে রায়ের আমলে। গত শতাব্দীর শেষভাগে। তখন তিন জন ব্রাহ্ম ছাত্রীকে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভরতি করা হয়েছিল। ইংল্যাণ্ডে তখনও কো-এডুকেশন চালু হয়নি। বাঙালি এ ব্যাপারে অগ্রণী।
এবার নীলনয়নী প্রেসিডেন্সি কলেজে গিয়ে দেখে, আরও অনেক ছাত্রী যোগ দিয়েছে। তারা বেশিরভাগই হিন্দু ঘরের। তারা এখন নিজেদের মধ্যে দল পাকায়। ছেলেদের সঙ্গে মেশে না। কিন্তু ক্রমে ক্রমে বাক্যালাপ শুরু হয়। নিরুপম ভট্টাচার্য বলে একটি ছাত্রের সঙ্গে নীলনয়নীর বন্ধুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। একজন ইংরেজ লেখক বলেছেন, ছেলেতে মেয়েতে বন্ধুত্ব হয় না, যেটা হয় সেটাও একপ্রকার প্রেম। সেটা সাধারণত বিবাহে পরিণত হয় না। থেকে যায় জীবনভরা হতাশায়।
আমাদের নিরুপম ও নীলনয়নী সে কথা জানত না।
শুধুমাত্র নীলনয়নীর সঙ্গে একসঙ্গে বসে ইংরেজি পড়ার জন্য নিরুপম আইএসসি-র পরে বিএ পড়ে। ফলে সে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে না। ইকনমিক্স অনার্স পড়ে। ইকনমিক্সে ফার্স্ট ক্লাস অনার্স পায়।
এদিকে নীলনয়নী অল্পের জন্য ফার্স্ট ক্লাস পায় না, ইংরেজিতে হাই সেকেণ্ড ক্লাস অনার্স পায়। সেইখানে তার পড়াশুনোয় ছেদ পড়ে। বাবা চরম পত্র দেন, ‘বিএ পাসের পরে বিয়ে পাস।’
মা-ও বলেন, ‘মেয়েরা কুড়িতে বুড়ি হয়। তোর বিয়ের বয়েস পার হয়ে যাচ্ছে। তোর জন্য আমরা সবাই উদ্বিগ্ন।’
এরপরে শুরু হয়ে যায় পাত্রপক্ষের কনে দেখা।
নীলনয়নী একে একে প্রত্যেকটি পাত্রেরই খুঁত ধরে। বলে, ‘ছেলেটি দেখতে ভালো, কিন্তু কেমন যেন হাবাগোবা, মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না।’ আর একজনের বেলায় বলে, ‘ইনি একজন বক্তিয়ার খিলজি, মুখ দিয়ে তুবড়ি ছোটে।’ আর একজনের বেলায় বলে, ‘রংটা কয়লার মতো ময়লা নয় বটে, কিন্তু খোট্টা গয়লাদের মতো।’ আর একজনের বেলায় বলে, ‘ইনি একটি কার্তিক, সাজপোশাক পরে ফুলবাবু।’ এমনি করে এক এক করে সবাইকে খারিজ করে।
তখন মা-বাবা বলেন, ‘তুই নিজেই স্থির কর কাকে বিয়ে করবি। কিন্তু যাকেই কর, অবিলম্বে করতে হবে।’
মেয়ে বলে, ‘আমার সহপাঠী নিরুপম ভট্টাচার্য আমাকে ভালোবাসে। আমিও তাকে ভালোবাসি। ভালোবাসাটাই সবচেয়ে বড়োকথা। দ্বিতীয় একজনকে যদি ভালোবাসতুম তাহলে দুজনের থেকে একজনকে বেছে নেওয়ার প্রশ্ন উঠত। তবে আমি বিলম্বের পক্ষপাতী। কারণ নিরুপম এখনও সেটল হয়নি। তার জন্য আরও সময় চাই।’ তারপরে সে বিশদভাবে নিরুপম ও তার পরিবারের পরিচয় দেয়।
মেয়ের মা চমকে উঠে বলেন, ‘সে কী করে? পাত্রটি যে বামুনের ছেলে? জামাইকে আমি আশীর্বাদ করব না জামাই আমাকে আশীর্বাদ করবে? জামাইকে আমি পাদ্য অর্ঘ্য দেব না জামাই আমার চরণবন্দনা করবে? পাপ, পাপ, মহাপাপ। তোর জন্য আমি কি নরকে যাব? না না, এ বিয়ে হতে পারে না।’
বাবা বলেন, ‘আমার কাছে কাস্ট জিনিসটা বড়ো কনসিডারেন্স নয়, ক্লাসটাই বড়ো। নিরুপম ইকনমিক্সে ফার্স্ট ক্লাস অনার্স পেয়েছে বটে, কিন্তু ওর পরিবারটা লোয়ার মিডল ক্লাস। ও যদি ধাপে ধাপে উন্নতি করে তাহলে একদিন লোয়ার মিডল ক্লাস থেকে মিডল ক্লাসে, তারপর আপার মিডল ক্লাসে প্রোমোশন পেতে পারে। কিন্তু তারজন্য কে জানে হয়তো তিরিশ বছর দেরি হবে। আমরা তিরিশ বছর কেন, তিরিশ মাসও অপেক্ষা করতে রাজি নই। ওকে যা হয় একটা-কিছু কাজ নিয়ে আরম্ভ করতে হবে, এই যেমন লাইফ ইনসিয়োরেন্সের এজেন্সি। আমি একটা ইনসিয়োরেন্স কোম্পানির সলিসিটর। আমি ওকে সাহায্য করতে পারি। আমার একটা ফ্ল্যাট খালি পড়ে আছে। সেটা সাহেবপাড়ায়। সেটা আমি ওকে ছেড়ে দিতে পারি। ঠিকানা ছকু খানসামা লেন না হয়ে রাসেল স্ট্রিট হলে বিজনেস আরও জমবে। ওকে একটা বেবি অস্টিন কারও ব্যবহার করতে দিতে পারি। তাহলে ওকে ট্রামে-বাসে চড়ে বড়োলোকের বাড়ি হাজির হতে হবে না, অস্টিন হাঁকিয়ে সারা শহর ঘুরতে পারবে। ও যদি উদ্যোগী পুরুষ হয়ে থাকে তো এক বছরের মধ্যেই আশাতীত সাফল্য অর্জন করতে পারবে। আমি ওকে এক বছর সময় দিতে রাজি।’
নিরুপমকে চায়ে নিমন্ত্রণ করা হয়। তার সঙ্গে কথা বলে নীলবরণ সন্তুষ্ট হন। বলেন, ‘তোমার ইংরেজি চোস্ত ইংরেজি। যে কোনো বিলেতফেরতা ব্যারিস্টারের মতো। তোমাকে আমি ব্যারিস্টার মহলে সুপারিশ করব। অনেকেই তোমার পলিসি কিনবে। কিন্তু আমার একটি মাত্র শর্ত। আমার মেয়ে যে স্টাইলে মানুষ হয়েছে তাকে তুমি সেই স্টাইলেই বরাবর রাখবে।
নিরুপম বলে, ‘নিশ্চয়ই।’ সে এক বছরের মধ্যে বিয়ে করতে রাজি হয়। তার ধারণা ছিল, তার রাজি হওয়া মানে তার মা-বাবারও রাজি হওয়া।
নীলনয়নীর মা সুধান, ‘তুমি কি ঠিক জান, তোমার মা-বাবাও রাজি হবেন? তাঁরা যদি রাজি থাকেন, এবাড়ির কর্তা গিয়ে ওবাড়ির কর্তার কাছে প্রস্তাবটা পাড়বেন। তার পরে পাকাদেখা। আর বছর খানেকের মধ্যে শুভকর্ম!’
নিরুপম যখন কথাটা বাবা হরনাথের কাছে ভাঙে তখন তিনি আগুন হয়ে বলেন, ‘বামন হয়ে চাঁদে হাত? শূদ্র হয়ে ব্রাহ্মণের ঘরে বিবাহ? আমরা পাশ্চাত্য বৈদিক। রাঢ়ি বারেন্দ্রর সঙ্গেও আমাদের চলে না। চলবে কিনা কায়স্থের সঙ্গে? আমি সামান্য স্কুলমাস্টার বলে কি আমার এমনই দুরবস্থা? অর্থের জন্য জাতিবর্ণ বিক্রয় করব? তুমি কি জান যে কায়স্থদের বিবাহের সময় কী মন্ত্র পাঠ করা হয়? নীলবরণ ঘোষ দাসস্য কন্যা নীলনয়নী দাসী। ওই দাসীটিকে তুমি যখন নিয়ে আসবে তখন ও তোমার গর্ভধারিণীর পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে গেলে শুনবে—আমি এইমাত্র চান করে উঠেছি, শুদ্দুরটা আমার গা ছুঁয়ে দিল। তিনি চানের ঘরে গিয়ে বালতি বালতি জল ঢেলে শুচি হবেন। বধূবরণ করবেন না, পাকস্পর্শ করতে দেবেন না, শূদ্রাণীকে রান্নাঘরে ঢুকতেই দেবেন না। কাজেই বুঝতেই পাচ্ছ, তোমার বউ অপমানিতা বোধ করে বাপের বাড়ি ফিরে যাবেন। তখন তোমাকেই ঘরজামাই হতে হবে। এটাও তোমার জেনে রাখা ভালো, তোমার ছেলের পইতে হবে না। ব্রাহ্মণসমাজ তাকে ব্রাহ্মণ বলে গ্রহণই করবে না। অগত্যা তাকে কায়স্থসমাজেই মিশে যেতে হবে। তার চেয়ে ভয়ংকর কথা, আমার আত্মা পরলোকে গিয়ে শান্তি পাবে না। তোমার ছেলে যদি পিন্ড দেয়, আমার আত্মা সে-পিন্ড গ্রহণ করতে পারবে না। পিন্ডর জন্য হাহাকার করবে। সে যে কী দুরবস্থা তা তুমি কল্পনা করতেও পারবে না।’
এবার নিরুপম তার মা নারায়ণীর কাছে যায়। মা বলেন, ‘দাসী বলে যাকে ঘরে আনবে আসলে সে-ই হবে রানি, আমি হব দাসী। সে এক সিন্দুক শাড়ি নিয়ে আসবে, দিনে তিন বার বদলাবে। আমার তো দুখানি মাত্র শাড়ি। ও একবাক্স গয়না নিয়ে আসবে, আমার তো দুখানি মাত্র চুড়ি। আমি রান্না করে ওকে চার বেলা খাওয়াব। আমি তো নিজে দু-বেলার বেশি খেতে পাইনে। তারপর ভেবে দ্যাখো তোমার নিজের ছোটোবোনের কথা। তার বয়স এখন বারো, এখন থেকে পাত্রের খোঁজ করতে হবে। কিন্তু কোনো ব্রাহ্মণ পরিবার কি ওর সঙ্গে ছেলের বিয়ে দেবে?’
নিরুপম ভাবনায় পড়ে যায়। ওর বাবা ওকে ডেকে বলেন, ‘চাণক্য পন্ডিতের কথামতো তোমার ষোলো বছর বয়স থেকে তোমার সঙ্গে আমি মিত্রবৎ আচরণ করেছি। তুমি শুধু আমার পুত্র নও, আমার মিত্র। তাই তোমাকে আরও একটা কথা বলি, এটা খুব কম লোকই জানে। এই মেয়েটির নাম নীলনয়নী হয়েছে এইজন্যে—এর চোখের তারা নীল?’
নিরুপম বলল, ‘হ্যাঁ, চোখের তারা নীল।’
‘এটা কেমন করে হল তা বোঝ? ব্রিটিশ আমলের আগে পোতুর্গিজ হার্মাদরা শুধু যে জমিদারদের ধনসম্পদ লুঠ করে নিয়ে যেত তা-ই নয়, সুন্দরী মেয়ে দেখলে তাকেও হরণ করে নিয়ে যেত। পরে চড়া মুক্তিপণ দিয়ে তাদের উদ্ধার করে আনা হত। তাদের বিয়ের পরে দেখা যেত তাদের সন্তানদের কারো কারো চোখের তারা নীল বা মাথার চুল কটা। এর মানে বোঝ? টাকার জোরে এটা ধামাচাপা দেওয়া হয়। সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ বা কায়স্থ পরিবারে তাদের বিয়েও দেওয়া হয়। কিন্তু তিন-চার পুরুষ অন্তর অন্তর দেখা যায় তাদের মেয়ের চোখের তারা নীল বা ছেলের মাথার চুল কটা। হুগলি জেলায় এমন কয়েকটি পরিবারকে আমি চিনি। চাঁপাতলার ঘোষেদেরও আদিনিবাস শ্রীরামপুরে। সেখানকার সম্ভ্রান্ত পরিবারে আমি এমন মেয়ে দেখেছি। নীল রক্তের কল্যাণে নীলনয়নী কন্যাদের সুপাত্রে বিবাহ হয়ে যায়। এবার ওরা সুপাত্র পেয়েছে তোমাকে। এর ফলে এই প্রাচীন ব্রাহ্মণ বংশে শুধু শূদ্রের সংমিশ্রণ নয়, যবনেরও সংমিশ্রণ ঘটবে। তোমাকে বন্ধুর মতো পরামর্শ দিচ্ছি, তুমি সময় থাকতে নিবৃত্ত হও, প্রবৃত্তি দমন করো।’
নিরুপম বলে, ‘এসব বাজে গুজব। এর অন্য বায়োলজিক্যাল ব্যাখ্যা আছে। আপনি যদি বিয়ে করতে বারণ করেন, আমি করব না। কিন্তু এ জীবনে বিয়েই করব না। আপনার নাতি হলে তো পিন্ড দেবে! হবেই না। তখন আপনার তথাকথিত পরলোকে আপনার তথাকথিত আত্মা হাহাকার করবে। কিন্তু তারজন্য আমি দায়ী হব না। আমি নিজে উপবীত ত্যাগ করব না। বেঁচে থাকলে পিন্ডদান করব। কিন্তু বেঁচে থাকতে কি আমার ইচ্ছে করবে? সঙ্গিনীহীন জীবন কে চায়?’
তখন বাবা একটু নরম হন। মা কিন্তু গরম। বলেন, ‘তোমার জন্য আমাদের এত গর্ব, তুমি এত বড়ো বিদ্বান, কিন্তু তোমার জন্য আমাদের লজ্জার সীমা থাকবে না। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাবে।’
নিরুপম পড়ে যায় বিষম দোটানায়। শ্যাম রাখবে না কুল রাখবে। এসব কথা নীলনয়নীকে বলতে সাহস পায় না। তাহলে সে সোজা জবাব দেবে, আমাকে বিয়ে করতে হবে না। তুমি কুলই রাখো। আমি বাবাকে বুঝিয়ে বলব যে, তোমার বাবা-মা এই বিয়েতে রাজি নন কাজেই এ বিয়ে হবে না। কিন্তু মাকে বোঝানো শক্ত হবে। আমাকে চেপে ধরবেন, ‘তুমি যাকে খুশি বিয়ে করো কিন্তু বয়স থাকতে থাকতে বিয়ে করা চাই। আমরা তো চিরদিনই বাঁচব না। তোর সময়মতো বিয়ে দিলে নাতির মুখ দেখে যেতে পারব!’
মায়ের পীড়াপীড়িতে বিব্রত হয়ে নীলনয়নী নিরুপমকে বলে, ‘আমার এখন উভয়সংকট। তোমাকে যদি বিয়ে করতে না পারি তাহলে অন্য একজনকে বিয়ে করতে হবে। কী করে সেটা সম্ভব? একজনকে ভালোবাসব আর-একজনকে বিয়ে করব? আমার দ্বারা তেমন কাজ হবে না।’
নিরুপম বলে, ‘তোমাকে আমি তেমন কাজ করতে বলব না। তুমি আমাকে ভালোবাস এইটে আমার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। এরজন্য যদি কুলত্যাগ অবশ্যম্ভাবী হয় তবে তাই হোক কিন্তু বিয়ে আমি করবই—আর কাউকে নয়, তোমাকেই।’ এটাও একপ্রকার বাগদান।
এরপরে সে লাইফ ইনসিয়োরেন্সের এজেন্সি নেয় ও নীলবরণের দেওয়া ফ্ল্যাটে গিয়ে বসবাস শুরু করে দেয়।
তা সত্ত্বেও নিরুপমের দোনোমনো ভাব কাটে না।
শেষে একদিন দেখা যায় নীলনয়নী গিয়ে নিরুপমের ফ্ল্যাটে হাজির হয়েছে আর এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন সে-ই গৃহিণী। রাত্রেও সেখানে থাকতে চায়, থেকেও যায়।
তখন নিরুপম বলে, ‘লোকে ভাববে কী? এটা যে বিয়ে না করে লিভিং টুগেদার।’
নীলনয়নী বলে, ‘তোমার যদি এতই মনে লাগে তবে তুমি কালকেই গিয়ে সিভিল ম্যারেজের নোটিশ দিয়ে দাও। আনুষ্ঠানিক বিবাহ কয়েক মাস পরে হবে, তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।’
তখন নিরুপমের আর পালাবার পথ থাকে না। সে নোটিশ দেয়।
নোটিশের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডক্টর গৌড়ের আইন অনুসারে সিভিল ম্যারেজ হয়ে যায়। উভয় পক্ষের প্রিয় বন্ধুরা সাক্ষী থাকেন। কিন্তু গুরুজনেরা কেউ আসেন না।
তারপর ওদের ধরে নিয়ে গিয়ে ঘোষ পরিবারে আনুষ্ঠানিক বিবাহ দেওয়া হয়। কন্যাপক্ষের অনেকে যোগ দেন। কিন্তু বরপক্ষের কেউ আসেন না। বরকর্তার স্থান নেন নিরুপমের এক ব্রাহ্মণ অধ্যাপক, বধূবরণ করেন অধ্যাপকগৃহিণী। যথারীতি বউভাত হয়। নীলনয়নীর রান্না আমন্ত্রিতরা সকলেই খান ও খেয়ে তারিফ করেন।
বিবাহে নিরুপম এক কপর্দকও বরপণ নেয় না। যা দেওয়ার তা নীলবরণ তাঁর কন্যাকেই দেন।
তারপর তারা রাসেল স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে গুছিয়ে বসে।
বছর কয়েক বেশ আনন্দেই কাটে, যদিও নিরুপমের মনে কাঁটা ফুটে থাকে যে তার মা-বাবা তার বিবাহকে স্বীকৃতি দেননি। এমন কথাও তার কানে আসে ওর বাবা নাকি বলেছেন, ‘ও যার সঙ্গে আছে সে ওর সহধর্মিণী নয়, সঙ্গিনী।’ আর মা নাকি মন্তব্য করেছেন, ‘সঙ্গিনী কেন? বলো রক্ষিতা।’
নিরুপমের ধারণা ছিল আর ওর বন্ধুরা বলেছিল, একটি নাতি হলে ওর মা-বাবা দেখতে আসবেন ও মেনে নেবেন। কিন্তু তেমন কিছু ঘটে না। কেবলমাত্র তার দিদি কল্যাণী তার জামাইবাবু সত্যব্রতকে খোঁজ নিতে পাঠান, কী হয়েছে, ছেলে না মেয়ে।
হিতৈষীরা পরামর্শ দেন, ‘ওঁরা দেখতে না আসুন, তোমরা গিয়ে দেখা করেও দেখিয়ে আনতে পারো।’
আর সব মেয়ের মতো নীলনয়নীরও সাধ ছিল শ্বশুর-শাশুড়ি ননদ-দেওরদের নিয়ে ঘরকন্না করতে। একদিন ওরা বাচ্চাকে নিয়ে হরনাথবাবুর বাড়ি যায়। দোতলা থেকে দেখতে পেয়ে নিরুপমের বোন সাবিত্রী নীচে নেমে এসে দরজা খুলে বলে, ‘তোমাদের সঙ্গে তো ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তোমরা কেন এসেছ? ফিরে যাও।’
নিরুপম বলে, ‘আমরা কি মা-র সঙ্গে দেখা করতে পারিনে?’
সাবিত্রী বলে, ‘মা আগে থেকে বলে রেখেছেন, তোমাদের মুখ দেখবেন না। বাবাকেও শাসিয়ে রেখেছেন। যাক, আমি দেখে রাখলুম। বাচ্চাটি তো বেশ সুন্দর হয়েছে। বলব বাবা-মাকে একথা। কী নাম রেখেছ?’
‘নিরঙ্কুশ। ও বড়ো হলে হিটলার কি স্ট্যালিন হবে।’
এরপর ওরা আর ওমুখো হয় না। সময়ের ওপর ছেড়ে দেয়।
বছর কয়েক বাদে নিরুপমের দুর্দিন আসে।
স্বাধীনতার পরে বিলিতি কোম্পানিগুলো ব্যাবসা গুটিয়ে নিতে আরম্ভ করে। তাদের মধ্যে ছিল নিরুপমের ইন্সিয়োরেন্স কোম্পানিও। যারা চলেই যাচ্ছে তাদের পলিসি কিনে কী লাভ হবে? পলিসি যখন ম্যাচিয়োর করবে তখন তো ওরা এদেশে থাকবে না।
নিরুপম পড়ে যায় ধাঁধায়। কোনো দেশি কোম্পানির এজেন্সি নেবে না কি?
ওদের অর্থসমস্যা এমন তীব্র হয় যে, এক এক করে বিলাসব্যসন ত্যাগ করতে হয়। জীবনযাত্রার স্টাইল খাটো হয়। তা সত্ত্বেও দেখা যায়, ক্লাবের বিল কমতির দিকে যাচ্ছে না। নিরুপম ড্রিঙ্কস খায় ও খাওয়ায়। ব্রিজ খেলে কখনো জেতে কখনো হারে।
নীলনয়নী একদিন সন্ধ্যা বেলা ক্লাবে গিয়ে উপস্থিত হয়। ব্রিজ খেলার টেবিলে নিরুপমের পাশে এক জাঁদরেল পারসি ভদ্রমহিলা। আর নিরুপম ইচ্ছে করে তাঁকে জিতিয়ে দিচ্ছে।
বাড়ি ফিরে নীলনয়নী জিজ্ঞেস করে, ‘ব্যাপার কী বলো তো? কে ওই ভদ্রমহিলা?’
নিরুপম বলে, ‘ওঁর নাম মিসেস সোডাওয়াটারওয়ালা। পোচখানওয়ালার কী যেন হন। ওঁরা পারসি। ওঁদের অনেকগুলো কোম্পানি আছে। যে কোনো একটাতে আমাকে ঢুকিয়ে দিতে পারেন।’
আর একদিন নীলনয়নী অনাহূতভাবে ক্লাবে হাজির হয়ে দেখে, ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলারা জোড়ে জোড়ে নাচছেন। তাঁদের মধ্যে নিরুপম আছে। তার পার্টনারকে মেমসাহেবের মতো দেখতে কিন্তু তাঁর বিদেশিনির মতো পোশাক নয়।
নীলনয়নী কিছুক্ষণ নাচ দেখে।
স্বামীর সঙ্গে বাড়ি ফিরে শুধায়, ‘ব্যাপার কী বলো তো? মহিলাটি কে?’
নিরুপম বলে, ‘উনি মিস শিরিন মেহতা। স্যার ফিরোজ শাহ মেহতার কী যেন হন। ওঁদের হাতে অনেকগুলি কোম্পানি আছে।’
এরপর নীলনয়নী জেদ ধরে, ‘আমাকেও রোজ ক্লাবে নিয়ে যেতে হবে।’
নিরুপম বলে, ‘সে কী কথা! তাহলে খোকনকে দেখবে কে? আমিই কি বাড়িতে থেকে যাব?’
তখন নীলনয়নী বলে, ‘তাহলে বাড়ি থাকো। আমিই তোমার সঙ্গে গ্রামোফোনের রেকর্ড বাজিয়ে নাচব। সেদিন তোমার স্টেপগুলো মোটেই বাজনার সঙ্গে ম্যাচ করছিল না। ব্লু ড্যানিউব ওয়ালতসের স্টেপস মোটেই ওরকম নয়। আমিও একসময় লেসন নিয়েছিলুম। তখন কথা চলছিল এক বিলেতফেরতা ব্যারিস্টারের সঙ্গে বিয়ের।’
কিন্তু বাড়িতে থেকে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে নাচের জন্য নিরুপমের একটুও উৎসাহ ছিল না। তাতে পরস্ত্রীর সঙ্গে নাচের উল্লাস নেই। আর ব্রিজ খেলার কী জানে নীলনয়নী?
এমনিই করে দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য শুরু হয়।
নিরুপম একদিন বলে ফেলে, ‘তোমার জন্য আমি কুলত্যাগ করেছি। তাই কি যথেষ্ট নয়? ব্রিজ ত্যাগ করতে হবে, ক্লাব ত্যাগ করতে হবে, ড্রিঙ্কস ত্যাগ করতে হবে? তুমি আমার জন্য কী ত্যাগ করেছ?’
নীলনয়নী এর কোনো জবাব খুঁজে পায় না। আহত হয়। বলে, ‘তাহলে তুমি আমাকেও ত্যাগ করো।’
এভাবে দাম্পত্যকলহ বেশিদিন থাকে না। ছেলেকে নিয়ে ওরা আবার সুখী সংসার গড়ে তোলে। কিন্তু খরচ তো কিছুতে কমতে চায় না।
তখন নীলনয়নী একদিন বলে, ‘আজকাল দুটো ইনকাম ছাড়া সংসার চলে না। স্বামীর ইনকাম আর স্ত্রীর ইনকাম। আমাকে তুমি অনুমতি দাও। আমিও একটা চাকরির সন্ধান করি।’
নিরুপম বলে, ‘তা কি হয়? বংশমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে যে। আমারও, তোমারও। বরঞ্চ স্টাইল একটু খাটো হোক কিন্তু বংশমর্যাদা খাটো হওয়া উচিত নয়।’
কয়েক মাস পরে নীলনয়নী আবার জেদ ধরে। সে চাকরির খোঁজে বেরোবে। রাঁধুনিকে ছাড়িয়ে দিয়েছে। সে নিজে রাঁধছে। এরপর কি আয়াকে ছাড়িয়ে দিতে হবে?
নিরুপমের জন্য পারসিরা কেউ কিচ্ছু করেননি। সে কোন মুখে নীলনয়নীকে নিরস্ত করবে?
কিছুদিন বাদে অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে একটা সাময়িক ভেকেন্সি হয়। আবেদন করামাত্র নীলনয়নী কাজটা পেয়ে যায়।
নিরুপম তো অবাক। সে বলে, ‘দ্যাখো, রেডিয়ো স্টেশনটা হল যত রাজ্যের বাউণ্ডুলেদের আড্ডা। সেখানে গিয়ে তুমি ওদের সঙ্গে মিশবে? তোমার নামে গুঞ্জন উঠবে। কী দরকার গুটি কতক টাকার জন্য মর্যাদাহানি?’
নীলনয়নী বলে, ‘গুটিকয়েক টাকা যে আমার বিশেষ দরকার। আর বাউণ্ডুলে যাঁদের বলছ তাঁরা কলকাতার বিশিষ্ট গায়ক-গায়িকা, লেখক-নাট্যকার, সে তারবাদক। ওঁদের সঙ্গে মিশলে তুমিও কালচার্ড হতে।’
নিরুপম ভুল বোঝে। বলে, ‘আমি কালচার্ড নই? ওরা কালচার্ড?’
নীলনয়নী মাফ চায়। বলে, ‘আমি ওকথা বলিনি, আমি শুধু বলতে চেয়েছি আমি নিজে কালচার্ড হয়েছি।’
নিরুপম সাবধান করে দিয়ে বলে, ‘ওদের প্রাইভেট লাইফ মোটেই নিষ্কলুষ নয়। পাঁকের ছিটে তোমারও গায়ে লাগবে।’
এরপর ওদের কারো কারো সঙ্গে জড়িয়ে নীলনয়নীর নামে বেনামি চিঠি আসতে থাকে। কোনো কোনো চিঠি ডিরেক্টর পর্যন্ত পৌঁছোয়। নীলনয়নী আশা করেছিল রেডিয়োতে টিকে যেতে পারবে। কিন্তু ওঁরা ওকে বাদ দিয়ে অন্য ব্যবস্থা করেন।
নিরুপম বলে, ‘আমি জানতুম, তোমার জন্য যাদের চাকরি হয়নি তারা ঈর্ষায় জ্বলছিল। তুমি আমাকে কিছু সময় দাও। আমি ইনকাম বাড়াব।’
কিন্তু নীলনয়নীর রোখ চেপে গিয়েছিল যে, সে-ও প্রমাণ করে দেখাবে সে উপার্জন করতে পারে। সে প্রেসিডেন্সি কলেজের হাই সেকেণ্ড ক্লাস ইংরেজি অনার্স পাওয়া ছাত্রী। অন্য কারও চেয়ে কম কোয়ালিফায়েড নয়। ট্র্যাভেল এজেন্সিতে ওর মতো মেয়েরা কাজ করছে। কেউ কেউ হোটেলের রিসেপশনিস্ট। সরকারি দপ্তরেও মেয়েরা হানা দিচ্ছে। যথেষ্ট সম্মানও পাচ্ছে। একটি মেয়েকে সে চেনে। তার আপিসের চাপরাশি পিয়োনরা তাকে বলে মেমসাহেব। দিদিমণি বললে সে সাড়া দেয় না। অথচ সে কোনোদিন বিলেত যায়নি, কোনো নামকরা কলেজেও পড়েনি।
নিরুপম কিন্তু মনে করে মেয়েরা আপিসে গিয়ে তাদের মাহাত্ম্য হারিয়ে ফেলেছে। কেউ যাদের দেখতে পেত না, যারা অন্তঃপুরে বাস করত, তারা যেন পর্দার বাইরে এসে খেলো হয়ে যাচ্ছে। আর সবটাই হচ্ছে গোটা কতক টাকার জন্য। দেশসেবা বা লোকহিতের জন্য নয়।
নীলনয়নী একটা সরকারি দপ্তরে চাকরি পেয়েও যায়। মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়।
নিরুপম বলে, ‘কী, আজ বস-এর সঙ্গে মোটরবিহারে বেরিয়েছিলে নাকি?’
নীলনয়নী চটে যায়। বলে, ‘তোমার বড়ো ছোটো মন। তোমার আসল চরিত্র ফুটে বেরোচ্ছে। মনুর মতো তুমিও মনে করো, ‘‘ন স্ত্রী স্বাতন্ত্রম অর্হতি’’। মেয়েরা কেউ স্বাধীনতার যোগ্য নয়। অথচ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কত মেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।’
মনোমালিন্য ক্রমে আরও তীব্র হয়। নিরুপম অভিযোগ করে, তার ছেলেটি অবহেলিত হচ্ছে। সে-ই আবার আবদার ধরে, তার আর একটি সন্তান চাই। সেটি হবে কন্যা।
নীলনয়নী বলে, ‘তুমি কখনো গর্ভধারণ করনি। সন্তানপ্রসবের যে যন্ত্রণা তা-ও তোমার অজানা। কেউ কেউ তো আঁতুরঘরেই মারা যায়। আমার তো রীতিমতো ভয় করে আবার মা হতে। তোমার কী? তুমি আবার বিয়ে করবে। এবার ব্রাহ্মণকুলে। আমার এই ছেলেটি ভেসে যাবে। এর ঠাকুরদা থাকতেও ঠাকুরদা নেই, ঠাকুমা থাকতেও ঠাকুমা নেই, পিসি থাকতেও পিসি নেই, খুড়ো থাকতেও খুড়ো নেই। এর মাতৃকুলে যারা আছে তুমি তো তাদের কাছে একে যেতে দিচ্ছ না, দেবেও না।’
নিরুপম শুধায়, ‘তুমি কি আর কখনো তাহলে মা হবে না?’
নীলনয়নী বলে, ‘আপাতত নয়। আগে সেটলড হই। চার-পাঁচ বছর পরে তোমাকে আর একটি সন্তান উপহার দিতে পারি। কিন্তু সে যে কন্যাই হবে এমন কথা দিতে পারব না।’
নিরুপম হেসে বলে, ‘কেউ দিতে পারে না। আচ্ছা, তোমাকে মা হবার জন্য চাপ দেব না। কিন্তু তা বলে কি এই মাঝখানটার সময়টা আমি তোমার সঙ্গে শুতে পারব না? আমাকে ব্রহ্মচারী হতে হবে?’
নীলনয়নী একটু ভেবে বলে, ‘আমি বুঝতে পারছি তুমি কী চাও। আমি তোমাকে ডিনাই করব না। কিন্তু তোমাকে কষ্ট করে সরঞ্জাম ব্যবহার করতে হবে। আজকাল তো সকলেই তা করছে।’
কিছুদিন পরীক্ষার পর নিরুপম বলে, ‘স্বাভাবিক মিলনের সিকির সিকি আনন্দ আমি পাইনে। আমার ওপর এই দায়টা না চাপিয়ে তুমি নিজেই যদি নাও! তোমাদেরও তো কতরকম সরঞ্জাম আছে!’
এভাবে দুজনের মধ্যে আবার কলহের সূত্রপাত হয়।
একদিন নীলনয়নী বলে, ‘এর একমাত্র সমাধান, স্টেরিলাইজড হওয়া। আমি রাজি আছি। তুমি যখন খুশি তখন আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি। আমারও আর সন্তানধারণের আতঙ্ক থাকবে না।’
নিরুপম গম্ভীর হয়ে বলে, ‘তার মানে আমি দ্বিতীয় সন্তানের মুখ দেখতে পারব না। নারী। নারী সৃষ্টি হয়েছে যার জন্য তার নাম মাতৃত্ব। মহামতি হিটলার বলেছেন, নারীর জগৎ হচ্ছে ক্যুখে, কিণ্ডের, কির্খে। সোজা বাংলায় রান্নাঘর, আঁতুড়ঘর, ঠাকুরঘর। তুমি যদি আর কখনো আঁতুড়ঘরে না যাও তবে তোমার নারীজন্ম বৃথা।’
নীলনয়নী হাসে। ‘আমি তো বললুম, তুমি আর বছর চার-পাঁচ সবুর করো। আঁতুড়ঘর তো আমি যাবই, শুধু মাঝখানকার ক-টা বছর বাদ যাবে। তবুও তোমাকে ব্রহ্মচারী হতে বলছিনে। আজকাল সবাই যা করে তুমিও তাই করবে। এটা এখন কমন প্র্যাকটিস।’
নিরুপম মোটেই সন্তুষ্ট হয় না। সে সরঞ্জাম ব্যবহার করা ছেড়ে দেয়। তখনকার মতো এই সমস্যা অমীমাংসিত থাকে।
নীলনয়নী একাই যা করবার করে। কিন্তু তার মন থেকে আশঙ্কা যায় না। অনেক দিন থেকে সে আলাদা শুতে অভ্যস্ত। সেটা শিশুর জন্য। শিশু বড়ো হওয়ার পরেও দেখা যায় সে একলাই শোয়, স্বামীকে প্রশ্রয় দেয় না।
একদিন নিরুপম ওর শোবার ঘরে ঢুকে ওকে একটি চমক দেয়। কোনোরকম সাধাসাধি না করেই উপগত হয়। তখন নীলনয়নীও একটা পালটা চমক দেয়। সে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে এমনভাবে প্রবেশপথ রোধ করে যে নিরুপম ব্যর্থ হয়।
রাগ করে নিরুপম বলে, ‘এর ক্ষমা নেই। নারী সবসময়ই পুরুষকে প্রবেশপথ ছেড়ে দেবে। এটাই নিয়ম। তুমি আমাকে আজ ইমপোটেন্ট বানালে।’ খাট থেকে নেমে যায় নিরুপম।
এরপর দেখা যায়, নীলনয়নী রোজ শোবার ঘরে খিল দেয়। নিরুপম মনের রাগ মনে পুষে রাখে।
কিছুদিন পরে ওদের টাকার টান পড়ে। নিরুপম অনেক চেষ্টা করেও অর্থ সংগ্রহ করতে পারে না। তখন নীলনয়নী কোনখান থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে আসে।
নিরুপম বলে, ‘টাকাটা পেলে কোথায়? বাপের বাড়ি থেকে? আমি বিয়ের সময় পণ নিইনি। পণপ্রথায় বিশ্বাস করিনে। বাপের বাড়ি থেকে টাকা নিলে সেটা প্রকারান্তরে বরপণ।’
নীলনয়নী তাকে আশ্বস্ত করে বলে, ‘বাপের বাড়ি থেকে টাকা নিইনি। নিয়েছি গোপালদার কাছ থেকে। তিনি বলেছেন, পেয়েবল হোয়েন এবল।’
গোপালদা ছিলেন একজন গান্ধীপন্থী কংগ্রেস নেতা। বার বার জেল খেটেছেন। চিরকুমার। তাঁর অনেক টাকা। তিনি সেই টাকার ট্রাস্টি। কাজেই কেউ চাইলেই দরাজ হাতে দিতেন। ফেরত চাইতেন না। কেউ ফেরত দিত, কেউ দিত না।
নিরুপম ক্ষুব্ধ হয়। বলে, ‘খদ্দরের ভেক ধরে যতসব ভন্ডসন্ন্যাসী। ব্রহ্মচারী নয়, বামাচারী, তোমার দাদা যা দিয়েছে তা দাদন। একদিন শোধ করতে হবে যৌবন দিয়ে।’
নীলনয়নী ভীষণ খেপে যায়। বলে, ‘আমি তোমার সঙ্গে ঘর করতে চাইনে। কালকেই চলে যাচ্ছি।’
নিরুপম বলে, ‘যাচ্ছ যাও কিন্তু খোকনকে নিয়ে যেয়ো না। খোকন আমার। আমার বংশধর। ভট্টাচার্য বংশের সন্তান।’
নীলনয়নী বলে, ‘তাহলে তুমি ওকে ভট্টাচার্য বাড়িতে রেখে এসো। ও তোমার সঙ্গে একলা এবাড়িতে থাকতে পারে না। আয়া ওকে মেরে ফেলবে।’
নিরুপম চুপ করে শোনে। ভট্টাচার্য বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার মতো মুখ তার নেই। আর আয়ার জিম্মায় ওকে ফ্ল্যাটে রাখতেও অনিচ্ছা। ও তো সত্যি চায়নি যে নীলনয়নী চলে যাক।
ওদিকে নীলনয়নী যাওয়ার জন্য জিনিসপত্র গোছাচ্ছে। আলাদা করে গুছিয়ে রাখছে খোকনের জিনিস। ওদের এই ঝগড়া মিটিয়ে দেওয়ার জন্য কেউ একজন মধ্যস্থ হলে ভালো হত।
নিরুপম তার দিদি কল্যাণীর বাড়ি গিয়ে বলে, ‘তুমি কি আমার ছেলেকে কিছুদিনের জন্য আশ্রয় দিতে পারবে?’
দিদি সব কথা শুনে বলেন, ‘দুই বংশের ঝগড়া অনেক দূর গড়িয়েছে। তুই তোর বউ ও ছেলেকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যা। দুজনকে ওখানে রেখে আয়। মায়ের সঙ্গে ছেলের বিচ্ছেদ ঘটাতে যাসনে।’
জামাইবাবু সত্যব্রত ভট্টাচার্যও সেই একই পরামর্শ দেন।
নিরুপম নীলনয়নীকে বলে, ‘চলো তোমাকে বাপের বাড়ি রেখে আসি। খোকনও তোমার সঙ্গে যাবে।’
নীলনয়নী মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, ‘তুমি আমাকে বন্দি করে রেখেছ, বাঁদির মতো খাটিয়েছ। আমি ঘর ঝাঁট দিয়েছি, বাসন মেজেছি, তোমার জুতো পালিশ করেছি। তোমার সেবার জন্য কী না করেছি! অথচ তুমি আমাকে বলেছ, আমি রোজ পাঁচখানা সাবান কেন ব্যবহার করি। একখানা হাত ধোয়ার জন্য, একখানা গা ধোয়ার জন্য, একখানা শৌচের জন্য, একখানা বেবির জন্য, একখানা কাপড়কাচার জন্য। আচ্ছা, এর কমে কোনো ভদ্রমহিলার চলে? অথচ তুমি নিজে রোজ এক টিন সিগারেট খাবে, এক প্যাকেটে তোমার কুলোবে না। তোমাকে নিয়ে আমি হদ্দ হয়েছি, আর সহ্য করতে পাচ্ছিনে। আমার সঙ্গে যাবে বলছ। সেখানে গিয়ে তুমি থাকবে আমার সঙ্গে না ছেড়ে চলে আসবে?’
নিরুপম চুপ করে থাকে।
নীলনয়নী বলে, ‘আমি বুঝতে পেরেছি, এটা ইবসেনের ডলস হাউস। তুমি আমাকে নিয়ে নোরার মতো খেলা করেছ, একটুও ভালোবাসেনি। পুতুল করে রেখেছ। আমাকে বাইরে বেরোতে দাওনি। যদি আমি বাইরে বেরোলুম, আমাকে সন্দেহ করলে। পাছে আমি পরপুরুষের প্রেমে পড়ি। অথচ আমি তোমায় সন্দেহ করিনি। ক্লাবে গিয়ে আমাকে না জানিয়ে তুমি পরনারীদের সঙ্গে ডান্স করেছ। তুমি যদি আমার সঙ্গে যেতে চাও তো চলো, কিন্তু দু-দিন বাদে ছেড়েই যদি চলে আসবে তো শুধু শুধু যাওয়া কেন? আমার ভাবনা তোমার জন্য নয়, খোকনের জন্য। তোমার সবাই আছে, ওর কেউ নেই। আমার সঙ্গে গেলে দাদামশায় পেত, দিদিমা পেত, মাসি পেত, মামা পেত, ভাই-বোনও পেত। কিন্তু ওরা সবাই শূদ্র। তোমরা ওদের ঘৃণা কর।’
নিরুপম প্রতিবাদ করে বলে, ‘না না নেলি, আমরা ঘৃণা করি না। ওটা তোমার ভুল ধারণা। আমি তোমাদের ওখানে থাকতে চাই না পাছে লোকে বলে আমি ঘোষেদের ঘরজামাই। তাতে আমার আত্মসম্মানে লাগবে। পুরুষমানুষের আত্মসম্মানই সব।’
নীলনয়নী বলে, ‘নারীরও আত্মসম্মান আছে। আমাকে আমার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে কেন? শ্বশুরবাড়িতে একটা রাতও আমি থাকতে পারিনি। সাবিত্রী কীভাবে আমাকে ফিরিয়ে দিল! যেন সমস্ত বাড়িটা অপবিত্র হয়ে যেত। এইসব লোয়ার মিডল ক্লাস মানুষদের সঙ্গে বাস করলে আমিই অপবিত্র হয়ে যেতুম। আমাকেই দিনে তিন বার সাবান মেখে চান করতে হত। না নিরুপম, এর কোনো ক্ষমা নেই। আজকের দিনে এ ব্যবহার অমার্জনীয়। ওরা আমাকে রিকগনাইজ করেনি। আমিও ওদের রিকগনাইজ করব না। আমার শুধু ভাবনা আমার বাচ্চাটার কী হবে।’
নিরুপম ভেতরে ভেতরে জ্বলে। উত্তর ভেবে পায় না। মাথায় খেলে যায় হিটলারের উক্তি। ফাইনাল সলিউশন। ইহুদিদের বেলায় তিনি যা প্রয়োগ করেন।
এরপর নিরুপমকে ঠিক প্রকৃতিস্থ বলা যায় না। আসলে লোকটা খারাপ নয়, কিন্তু যে-কাজটা করে সে-কাজটা খারাপ।
সে-রাত্রে নীলনয়নী শোবার ঘরের দরজায় খিল দিতে ভুলে গিয়েছিল। রাতের মাঝখানে নিরুপম গিয়ে ওর পাশে শোয়। ওর ঘুম ভেঙে যায়। একহাতে নিরুপমের গলা জড়িয়ে ধরে ও বলে, ‘ডার্লিং, তোমাকে ছেড়ে কি আমি থাকতে পারি? দু-দিন বাদে ঠিক ফিরে আসব।’ এই বলে সে আবার ঘুমিয়ে পড়ে।
সকাল বেলা যারা ওর ঘরে ঢোকে তারা দেখতে পায় নিরুপম নীলনয়নীর পায়ে মাথা খুঁড়ে কাঁদছে ও বলছে, ‘নেলি, আমায় ক্ষমা করো। আমি তোমায় মারতে চাইনি। তুমি বেঁচে ওঠো।’
খবর পেয়ে পুলিশ এসে ওকে ধরে নিয়ে যায়।
পোস্টমর্টেমে ধরা পড়ে নীলনয়নীর গলায় আঙুলের দাগ। ফরেনসিক পরীক্ষায় সেই দাগ মিলে যায় নিরুপমের আঙুলের ছাপের সঙ্গে। নিরুপম পুলিশকে বলেছিল, ঘটনাটা ঘটে গেছে ঘুমের ঘোরে। পরে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে তার স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করে। প্রত্যক্ষদর্শী ছিল না, কিন্তু সার্কামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স নিরুপমের বিপক্ষে যায়।
চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এনকোয়ারির পর ওকে দায়রায় সোপর্দ করেন। বিচার হয় হাই কোর্টের সেশনস বিভাগে। জুরির সাহায্যে বিচার।
জুরি কেন যে ওকে অব্যাহতি দিল সেটা রহস্য থেকে যায়।
তিন
নিরুপম সেই যে উধাও হল, তারপরে বছরে এক বার আসত তার ছেলের জন্মদিনে। এক রাত থাকত, তারপর আবার নিরুদ্দেশ।
নিরঙ্কুশ যখন সাবালক হয়ে তার মাতুলালয়ে চলে যায় তখন থেকে নিরুপম আর ছেলের জন্মদিনে আসে না। শুধু একখানা পোস্টকার্ড পাঠিয়ে দেয়। তাতে শুভকামনা জানায়। কিন্তু ঠিকানা দেয় না। ডাকঘরের মোহর থেকে জানা যায় সে কখনো হরিদ্বারে, কখনো দ্বারকায়, কখনো শ্রীরঙ্গমে, কখনো কাঞ্চিপুরমে, কখনো বেনারসে, কখনো পুরীতে।
সাত-আট বছর বাদে পোস্টকার্ড আসা বন্ধ হয়ে গেল। তাহলে কি সে মৃত? তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। হয়তো হিমালয়ের কোনো গুহায় বসে নির্জনে তপস্যা করছে যাতে তার পাপমোচন হয়।