নীলকর ফেডি ও ডাকাত বিশ্বনাথ – অগ্নি মিত্র
করালী বক্তা, হরিশ* শ্রোতা৷
নিশূত রাতে চারদিক নিঝুম৷ মাঝে মাঝে দু-একটা নিশাচর পাখির ডাক৷ বৈঠকখানায় হরিশ একখানা কৌচে আধশোয়াভাবে বসে আছে৷ মেঝেয় বসে করালী৷ মোমবাতির শিখাটা মাঝে মাঝে অল্প হাওয়ায় কাঁপছে৷
-‘আমাদের সর্দার একটা কতা বলত বাবু৷ বলত, ওই যে নীলগাচের ফুল দেকিস বেগনিবন্ন, ওডার মানে কী তা জানিস? নাল আর নীল মিলে হয় বেগনি৷ তার নীলডা ওই কুটেলসায়েবগোর, আর নালবন্নটা আমাদেরই অক্ত-বুজেচিস?’
একটু থেমে দম নিয়ে করালী আবার বলতে শুরু করলে, ‘সর্দারের কতাডা ঝে কত বড়ো সত্যি তা আজও মালুম করতিছি বাবু৷ সর্দারের বাড়ি যে গাঁ, আমারও বাড়ি সেই গাঁয়েই ছেলো-নদে জেলার গাদড়া-ভাতছালা৷ সর্দারের ফাঁসির পর দলও ভেঙি গ্যালো, আমরাও ফেরার হয়েলাম৷ বহু বচ্চর এদিক-ওদিক ঘুর্যে ঘুর্যে শ্যাষ তাবাদি এই পিঁপড়েগাছিতি এক কুটুমবাড়ির হাতায় একখান কুঁড়ে বেঁদি আচি৷ তারপরেত্থে আর ডাকাতি করি নাই৷ ঠিকে মাইন্দারি করি, জন-টিকিরি খাটি৷ কিন্তু বাবু কুটির কাজ আজ তাবাদি করি নাই৷ নীলকুটির নামে মোর বুকির অক্ত অ্যাকনো ঝ্যান ঝলাৎ মেরি ওটে৷ কিন্তু ওই ঝে কতায় কয় না, অবাগা যায় বঙ্গে তো কপাল যায় সঙ্গে? যেখেনে বসত কত্তি নেগেচি, তর উত্তরদিকি কাটগড়ার বড়ো কুটি আর দখিনদিকি মোল্লাহাটির বড়ো কুটি৷ নীলের দাপটে মাটি তো কবেই নাল হয়েচে, এবার ইছেমতী, বেত্তরবতী, কপোতাককি, ভৈরব-সব নদীর জলও নাল হয়ে যাবে৷ আচ্চা বাবু, ওনারা আজার জাত বলে ঝা খুশি তাই করেই যাবে, এর কোনো পিতিকার নাই? ওনারা ঝা করে তা কত্তি জঙ্গলের জানোয়ারও লজ্জা পাবে৷ এই নীল-বিষ আমাগোর দ্যাশে কেডা এনেলো কতি পারো বাবু?’
-‘পারি৷ কিন্তু তুমি তো তাকে চিনতে পারবে না করালী৷’
-‘না পাল্লাম, তউ নামডা তো জেন্যি রাকি৷ মরার আগেও সেই সায়েবরে দুডো মুখখার রানি দিয়ে মত্তি পারবো৷ জানা থাকলি নামডা তুমি আমারে কয়ে দ্যাও বাবু৷’
-‘সে সাহেবের নাম লুই বন্নো৷’
-‘নুই বন্নো? নীল বন্নেরই কাচাকাচি৷’
-‘সে সাহেব কিন্তু ফরাসি সাহেব, ইংরেজ নয়৷ তুমি ফরাসডাঙার নাম শুনেচ?’
-‘তা আর শুনি নাই?’
-‘বন্নো সাহেব ফরাসডাঙার কাছে তালডাঙা আর গোন্দলপাড়ায় প্রথম দুটো নীলকুঠি খোলেন৷’ তোমার বয়েস তো বললে তিন-কুড়ি দশ বছর? ধরো তোমারও জন্মের দশ-এগারো বছর আগে নীলবিষ বাংলাদেশে প্রথমে এল৷’
কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইল করালী৷ তারপর আপন মনেই কয়েকবার বিড়বিড় করলে, ‘নুই বন্নো-নুই বন্নো-নুই বন্নো-‘
হরিশ মৃদুস্বরে বললে, ‘তোমাদের সর্দারের কথা থেকে যে দূরে সরে এলে৷’ করালী সংবিৎ ফিরে পেয়ে বললে, ‘না বাবু এই যে কচ্চি৷’
করালী শুরু করলে তার সর্দারের কাহিনি-
দুর্ধর্ষ বিশে ডাকাতের নামে থরহরি কম্প পড়ে গেছে নদিয়া জেলায়৷ এত অল্প সময়ের ভেতর একটা গরিব বাগদি চাষির ছেলে যে কেমন করে এতবড়ো একটা ডাকাত দল গড়ে তুলেছে, সেইটেই অবাক কাণ্ড৷ সে যে কখন কোথায় থাকে, তার হদিশ দলের লোকেরাও সব সময় জানতে পারে না৷ জানে শুধু তার এক নম্বর সাগরেদ মেঘা৷ বিশে কখনো বামনিতলার জঙ্গলে, কখনো চাপড়ায়, কখনো খোদ গোয়ারি-কেষ্টনগরে, কখনো-বা উলো কিংবা শান্তিপুর অঞ্চলের কোনো জঙ্গলে৷ তার দলের সাগরেদরা ছাড়া আর যারা তাকে নিজের চোখে দেখেছে-কেউ কন্যাদায়গ্রস্ত গরিব, কেউ জমিহীন কৃষক, কেউ নীলকরের অত্যাচারে হৃতসর্বস্ব৷ যারা দেখেছে, তার বলে, কালো পাথরের কোঁদা মূর্তির মতো চেহারা, গায়ের শক্তি অসুরের মতো কিন্তু চোখের চাউনিতে দয়া, মায়া, মমতা যেন ঝরে পড়ছে৷ আবার সেই চোখই যখন ক্রোধের আগুনে জ্বলে ওঠে, তখন তা বড়ো ভয়ংকর৷ সে চাউনি শুধু তারাই দেখেছে, যারা অসহায় গরিবের ওপর নির্যাতন করে৷
চাষির ছেলে হঠাৎ এতবড়ো ডাকাত হয়ে উঠল কেন?
অভাব? অভাব তো পুরুষানুক্রমে চিরসঙ্গী৷ স্বভাব? বিশ্বনাথ বাগদির ঊর্ধ্বতন চৌদ্দপুরুষে কেউ কোনোদিন ডাকাতি কেন, সামান্য চুরিও করেনি৷ জমি চাষ করেছে, জমিদারের প্রাপ্য মিটিয়ে বছরে ছ-মাস হয়তো আধপেটা খেয়ে কাটিয়েছে, খরা-অজন্মায় কপাল চাপড়ে কেঁদেছে৷ উপোস দিয়ে দিন কাটিয়েছে কিন্তু কারও একদানা ধানে হাত দেয়নি৷ সেই ঘরের ছেলে এতবড়ো ডাকাত হয়ে উঠল যে তার ভয়ে সারা জেলা কাঁপছে?
সারা জেলা নয়, কাঁপছে অত্যাচারী জমিদার, কঞ্জুস ধনী, কুঠিয়াল নীলকর আর কোম্পানি সরকার৷ কই, সাধারণ মানুষ তো বিশে ডাকাতের নামে কাঁপে না? বরঞ্চ আপদ-বিপদে তারা ছুটে যায় সেই ডাকাতের কাছে৷ সাহায্যের জন্যে হাত বাড়িয়ে বসে আছে বিশে ডাকাত৷ এমনকী, যে বড়োলোক জমিদার প্রজার দুঃখ দেখে, তেমন অবস্থা দেখলে খাজনা মুকুব কোরে-তারও তো ভয় করতে হয় না বিশে ডাকাতকে? গরিবের ওপর অত্যাচার কোরো না, অন্যায় জুলুম করো না চাষি গেরস্থের ওপর, তাহলেই তুমি নিশ্চিত৷ বিশে ডাকাত কেন ডাকাত হয়েছে? গরিবের ওপর শক্তিমানের অত্যাচার দেখতে দেখতে তার মন ফুঁসে উঠেছিল বলেই লাঙল ছেড়ে সে হাতে নিয়েছে তরোয়াল৷ নিজের বাপকেই সে শক্তিমানের হাতে নির্দয় প্রহারে নিহত হতে দেখেছিল৷ সে স্মৃতি তাকে মরীয়া করে তুলেছে৷
সর্দারের হুকুম তামিল করতে কমপক্ষে হাজার অনুচর লাঠি, বল্লম, কিংবা বন্দুক হাতে সব সময় তৈরি হয়ে আছে৷ তারা সবাই একদিন চাষি ছিল৷ কেউ উৎখাত হয়েছে জমিদারের অত্যাচারে, কেউ-বা কুঠিয়াল নীলকর সাহেবদের খাঁই মেটাতে মেটাতে সর্বস্বান্ত হয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে৷ এতকাল ধরে যারা অদৃষ্টকে দায়ী করে কেবল চোখের জলই ফেলে এসেছে, তারাই দলে দলে ছুটে এসেছে বিশ্বনাথ সর্দারের কাছে৷ হিন্দু-মুসলমান ভেদ নেই৷ চোখের জল মোছার উপায় বাতলে দেবার মতো মরদ যখন রয়েছে তখন বছরের পর বছর শুধু পড়ে পড়ে মার খাওয়া কেন? বিশ্বনাথ সর্দারকে ওস্তাদ মেনে তারা লাঠি ধরেছে সর্দারের হুকুমে৷ পাঁচ থেকে পঞ্চাশ, পঞ্চাশ থেকে এক-শো, এক-শো পাঁচ-শো থেকে হাজার, হাজার থেকে তারপরেও আরও কত? কেউ সঠিক বলতে পারে না, বিশে ডাকাতের সাগরেদের সংখ্যা কত৷ কোম্পানি সরকারের গোয়েন্দারা হার মেনেছে৷ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন জেলার ম্যাজিস্ট্রেট স্বয়ং৷ জুতোর ঠোক্করে যারা নেড়ি কুকুরের মতো লেজ গুটিয়ে পালাতে অভ্যস্ত, সেই নেটিব রায়তের ঘরের একটা ছেলে সারা জেলাময় এত বড়ো একটা হুলুস্থূলু কাণ্ড বাধিয়ে তুলবে তা তো কল্পনারও অতীত ছিল! লোকটা নাকি ডাকাতির টাকা বিলিয়ে দেয় গরিবদের ভেতর! ঘটা করে দুর্গোৎসব করে প্রতি বছর৷ উৎসবের চারদিন অন্নসত্র বসে যায় আস্তানায়৷ বৃদ্ধ, শিশু, পঙ্গু, স্থবির, দরিদ্র নারী-সবাইকে নিজের হাতে করে বস্ত্র বিতরণ৷ দীনদুঃখি তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালে ভরা হাতে হাসিমুখে ফিরে আসে৷ সারা জেলায় শয়ে শয়ে অক্ষম বৃদ্ধ, ভূমিহীন কৃষক আর নিরাশ্রয় দরিদ্র বিধবার ভরণ-পোষণের সব দায়দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে লোকটা৷ বাগদির ছেলে বিশে এখন বিশ্বনাথবাবু৷ ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট আর পুলিশসাহেব কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না, লোকটার উদ্দেশ্য কী? ডাকাতি করে কেউ যদি সব টাকাকড়ি বিলিয়েই দেয় তাহলে তার ডাকাত হওয়ার কী ছিল? টাকা যদি নিজের ভোগেই না লাগল তাহলে এত ঝুঁকি নেওয়ার কোনো অর্থ হয়?
দিনের পর দিন দল ভারী হয়ে উঠছে বিশ্বনাথের৷
গরীবের একটি মাত্র পরিচয়, সে গরিব৷ তার আবার অন্য জাতপাতের বিচার কী? বিশ্বনাথের প্রধান অনুচর মেঘা তো মুসলমান৷ পরের সারিতে যারা আছে তাদের ভেতর বাগদির ছেলে করালীও যেমন একজন, কৈবর্তের ছেলে গোপালও তেমনি একজন৷ আর আছে শান্তিপুরের জোলার ছেলে তাজুদ্দিন৷
সর্দারের হুকুম বড়ো কড়া হুকুম৷
-‘ভাইসব, অত্যেচার অনাচারের পিতিকার কত্তি হবে বল্যেই আমরা এই পথে নেমিচি, অত্যেচার করাডা আমাদের ধম্মো না৷ ঝে বড়োনোক টাকার গরমে গরিবরে ভিটে ছাড়া করে, চোকের জল ঝরায় তার খ্যামা নাই! কিন্তুন খেয়াল থাকে ভাইসব, ডাকাতি কত্তে গে, মায়ের জাতের গায়ে ঝ্যান অ্যাকটা কড়ে আঙুলির ছোঁয়াও না নাগে, ছোঁয়া ঝ্যান না লাগে ছোটো বাচ্চা-কাচ্চা আর গোমাতার গায়ে! আমরা পাপের পিতিশোদ নিতি নেমিচি, আমাদের হাতে ঝ্যান পাপের কালি না নাগে! হাত দেবা না গরিবির গায়, হাত দেবা না রাহি পথিকির গায়৷ সে ঝেদি নাখ টাকার মালিকও হয় তাউ পথ চলতি কালে গায় হাত দেবা না৷ দরকার হলি তারে চিটি পেটয়ে তার বাড়ি গে ডাকাতি করব আমরা, কিন্তু পথে-ঘাটে কারও পর আচমকা ঝেঁপিয়ে পড়বা না! তবে হ্যাঁ, ঝেঁপিয়ে পড়বা তখনই, ঝ্যাকন দ্যাকবা, পথে একা পেয়ে কোনো শয়তান কাউরি নিগৃহ কচ্চে, মায়ে জেতের ইজ্জতে হাত দেবার উয্যুগ কচ্চে৷ ত্যাখন দশজনাই থাকো আর একলাই থাকো, ঝেঁপিয়ে পড়ে নারীর সম্ভম ঝেঁদি রককে কত্তি না পারো তালি আর বামনিতলার জঙ্গলে ফিরে এসো না৷ তেমন সাকরেদে বিশে ডাকাতের দরকার নাই! হেঁদু ভেয়েরা, মা দূর্গার নাম নে’ পিতিজ্ঞে করো, মোচরমান ভেয়েরা আল্লার নামে কসম খাও! মনে রাকবা, অত্যেচারীর যম হব বল্যেই আমরা জোট বেঁদিচি, অত্যেচার কত্তি নামিনি৷’
চিঠি দিয়ে আগেভাগে জানিয়েই ধনীর ঘরে ডাকাতি করতে যেত বিশ্বনাথ৷ চিঠিতে জানিয়ে দিত, সেই রাতে সে অতিথি হবে৷ ধনী গৃহী যদি নির্বিবাদে তার চাহিদা মিটিয়ে দিত তাহলে সে-ও নির্বিকারেই বিদায় নিত-কারো গায়ে হাত দিত না৷ অহেতুক রক্তপাত একেবারেই পছন্দ করত না সর্দার৷
শান্তিপুর থেকে একটার পর একটা অভিযোগ আসছে৷
তাঁতিদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে কুঠিয়াল সাহেবরা৷ শুধু নীলের লোভেই তাদের মন খুশি নয়, আরও চাই৷ নজর পড়েছে তাঁতিদের ওপর৷ নামমাত্র দাম ধরে দিয়ে তাঁতিদের বোনা কাপড় ঘর থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে তারা৷ শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে কাপড়৷ কুঠিয়াল সাহেবদের আছে লেঠেল, পাইক৷ দশাসই চেহারার ভোজপুরি-হিন্দুস্তানি জোয়ান তারা৷ সাহেবদের নিতান্ত বিশ্বস্ত হুকুমবরদার৷ ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে৷ এক ঘা লাঠির হুকুম থাকলে দশ ঘা মেরে মাথা ফাটিয়ে মাটিতে ফেলে রেখে আসে৷ তার ওপর সাহেবদের সঙ্গে সব সময়ই থাকে বন্দুক পিস্তল৷ তাদের ইচ্ছেয় বাধা দিলে সে বাধা মানছে কে? অঢেল লাভের এতবড়ো সুযোগ হাতের ভেতর থাকলেও যদি সে সুযোগ কাজে লাগানো না গেল তাহলে সেই সাত সমুদ্র পেরিয়ে ইন্ডিয়ায় আসার দরকার কী ছিল?
হ্যাঁ, অঢেল লাভ৷ মাঞ্চেস্টার তখনও এত জমজমাট হয়নি৷
এদেশের তাঁতিদের বোনা কাপড় ইংল্যান্ডের বাজারে পাঠাতে পারলে চার গুণ, ছ-গুণ এমনকী আট গুণ টাকা লাভ! কোন মূর্খ এ সুযোগ ছেড়ে দেয়? নীল তো রইলই, তার ওপর যদি কাপড় পাঠিয়েও লাভের কড়ি গোনা যায় তবে তো দু-বছরে লাখোপতি!
হার্মাদের মতো তাঁতিদের ঘরে ঘরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে কুঠিয়ালরা৷ কখনো দয়া করে দু-চার আনা দাম ধরে দেয়, কখনো তাও না৷ সাহেবদের হুকুমবরদার ভোজপুরি লেঠেলরা লাঠির ঘায়ে জখম করে বীরবিক্রমে ঢুকে যায় তাঁতিদের ঘরে৷ মেয়ে-পুরুষ, বৃদ্ধ-শিশু বাছবিচার নেই৷ কাপড়গুলো কেড়ে নিয়ে যায় তারা৷ একটু দূরে ঘোড়ার পিঠে বসে হো হো করে হেসে ওঠে কুঠিয়াল সাহেব৷
শান্তিপুরে ঘরে ঘরে উঠেছে কান্নার রোল৷
সেই কান্নাভেজা চোখেই শান্তিপুরের তাঁতিরা একদিন দেখল, আগুন জ্বলছে নীলকুঠিতে৷ একটা কুঠি নয়, বহু কুঠি৷ একদিন নয়, পর পর কয়েকদিন৷ যে সব কুঠিয়াল সাহেবরা জোর-জুলুমে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল, তাদের কারও কুঠি রেহাই পায়নি৷ লাভের টাকা সব লুঠ হয়ে গেছে৷ লুঠে করে আনা হাজার হাজার কাপড়ও উধাও৷ শুধু তাই নয় কুঠির বাঙালি দেওয়ান, আমিন, গোমস্তার দলকেও বন্দি করে নিয়ে গেছে বিশে ডাকাতের দল৷ নিজের দেশের গরিবদের ওপর অত্যাচারে সাহেবদের দোসর হিসেবে কাজ করবার জন্যে কঠোর শাস্তি তাদের প্রাপ্য৷ শোনা গেল, তাদের কঠিন শাস্তিই দিয়েছে বিশে ডাকাত৷ কুঠি থেকে কেড়ে আনা কাপড়গুলো বিলিয়ে দেওয়া হয়েছে দুঃস্থ গরিব হাজার হাজার লোকের ভেতর৷
করালী এতক্ষণ পরে একবার থামলে৷
মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল হরিশ৷ গামছায় মুখ মুছে একটু দম নিয়ে করালী বলল, ‘ক্যামন নাগতেছে বাবু?’
-‘তুমি বলে যাও৷’
-‘কতি কতি চোকি জল এসি যায় বাবু৷ ঝেদি কন, অ্যাতো ঝে লুটপাট কল্লি তা তোরা পালি কী? তার জবাবে কই, নুটের ভাগ পাওয়ার নোবে তো মোরা সেই মোপুরুষির দলে ভিড়ি নাই? তেনার শিককেই ঝে আলাদা৷ ওই টাকায় কত গরিবদুককির উবগার হবে, তাগোরি মুকি হাসি ফুটে ওঠবে, সেইডেই আমাগোর নাব৷ নজ্জা নেবারনের একখানা বস্তর তাবাদি নাই, এমন কত অগুন্তি নোক গাঁয়ে গাঁয়ে আচে, তার সব খবরই যে থাকত আমাগোর সর্দারের নকোদপ্পোনে৷ সব বস্তর বিলয়ে দেলে সর্দার৷ ঝাদ্দের বউ কানি পর্যে আসার উপায় আচে, তারা নিজের হাতে নে গ্যালো৷ আর ঝে সব বউ ঝির আসারও উপায় নাই, তাদের পেত্যেকের নামে দুইখেন করে কাপড় পিত্তিবাসির হাতে পেটয়ে দেলে সর্দার৷ নোকগুলো সেই ঝে একগাল হাসিতি মুখ ভরয়ে চল্যে গ্যালো আর মোদ্দের সদ্দার মুকি হাসি চোকি জল নে আমাগোর পিতি দিষ্টিপাত কল্যে, সেই আমাগোর ঝে সব পাওয়া হয়ে গ্যালো বাবু৷ কতকাল আগের কথা! তউ মনে হয় ঝ্যান সিদিন!’
গামছা দিয়ে আবার চোখ মুছে নিলে করালী৷ ধরা গলায় বললে, ‘এইবার এমানদারি আর বেইমানির কতা কই বাবু৷’
দুর্ধর্ষ এবং নৃশংস নীলকর স্যামুয়েল ফেডি৷
নির্মমতায় সারা জেলার সমস্ত নীলকরকেই ছাড়িয়ে গেছে সে তখন! তার আরও বাড়তি সুবিধে জেলা সদরে খোদ ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলোর পাশেই তার নীলকুঠি৷
চরমে উঠেছে ফেডির অত্যাচার৷
জমি হেজে যাক, মজে যাক, খরা অজম্মা, বান, ভূমিকম্প যাই হোক না কেন, তার পাওনা নীলগাছ তার চাই-ই৷ সে পাওনা তার হিসেবমতো, রায়তের হিসেবে নয়৷ কুঠিতে নীলগাছ পৌঁছে না দিলে গুদাম ঘরে আটক, বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, গোরুবাছুর কেড়ে নিয়ে যাওয়া-এ সব তার অতি সাধারণ শাস্তি৷ ধান হোক না হোক, খোরাক জুটুক না জুটুক, তার পাওনা মিটিয়ে দিতেই হবে৷
একটু থেমে করালী বললে, ‘বাবু, তোমরা হচ্চো কলকেতার নোক৷ নীলির গাচ তো চোকি দ্যাকো নাই৷ কালকেসুন্দির গাচ চেনো? বন-বাদাড়েও হয়, বাড়ির আনাচি-কানাচিও হয়৷ এই ধরো, মাথায় আড়াই কি তিন হাত, পাতাগুলো তেতুলির পাতার মতো ডাঁটার দুই ধারে সাজানো থাকে, কেমন ঝকঝকে হলুদ রঙা ফুল-‘
-‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, বুঝতে পেরেচি!’-হরিশ বললে, আমাদের বাড়ির পেছনেই আছে৷
-‘দেখতি ওইরকম ধারার-ই গাচ, তবে কালকেসুন্দির মতো অতখানি ঝোপড়ালো হয় না৷ এটটু ফাঁকা আর নম্বা কিসিম৷ মাথায়ও ওই আড়াই-তিন হাতই হয়, তার বেশি না৷ বচ্চোরে দুই দফায় চাষ৷ অ্যাকবার কাত্তিক-অগ্রাণে, অ্যাকবার ফাল্গুন চত্তির মাসে৷ তা কোনো চাষই কামাই দেয়া চলবে না ফিটি সায়েবের কুটির এলাকায়৷ আমরা কেউ কেউ কতাম ফিটি সায়েব, আর সদ্দার সে গুয়ের বেটার নাম দিয়েলো শিমুল সায়েব৷’
হরিশ বললে, ‘হয়তো স্যামুয়েল থেকেই শিমুল করে নিয়েছিলেন তোমাদের সর্দার৷ সাহেবের পুরো নাম ছিল স্যামুয়েল ফেডি৷’
-‘তাই হবে৷’-ঘাড় নেড়ে সায় জানালে করালী৷
আবার আরম্ভ হল কাহিনি৷
যতদিন এদেশি ধনী জমিদারদের ওপর দিয়ে বিশ্বনাথের ডাকাতির পালা চলেছে, ততদিন তাকে নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায়নি কোম্পানি৷ কিন্তু শান্তিপুরে নীলকর সাহেবদের অতগুলো কুঠির ওপর আক্রমণ হওয়ার পর টনক নড়ল কোম্পানির, আতঙ্ক শুরু হল কুঠিতে কুঠিতে৷ কিন্তু ফেডির ধাত আলাদা৷ তাছাড়া ম্যাজিস্ট্রেট তার বন্ধু, বাংলোর পাশেই কুঠি৷ তার ভয় কী? তার অত্যাচার চলতেই লাগল৷
বিশ্বনাথ ক-দিন ধরেই ভাবছিল ফেডির কথা৷ মেঘা, তাজু আর করালীকে সে-কথা সে জানিয়েও রেখেছে৷ সবাই একবাক্যে রাজি৷ সাহেবের অত্যাচার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে, তাকে শায়েস্তা না করলেই নয়৷
একদিন গোপাল খুব উত্তেজিত ভাবে একটা খবর নিয়ে এল৷ রাগে তখনও সে থরথর করে কাঁপছে৷
-‘কী হল্য রে গোপলে, অত হাঁপাতে নেগিচিস ক্যান?’-জিজ্ঞেস করলে বিশ্বনাথ৷
-‘হাঁপাচ্ছি না সদ্দার কাঁপতিচি৷ ফিটি সায়েব আসাননগরে কাল কী করে আয়েচে শোনবা? ফকির মোল্লারে কুটিতি কদ কর্যে তার গতরভারে তো আদ্দেক কর্যে ছেড়ি দিয়েলো, কাল তার বাড়িতি চড়াও হয়্যে বিবিডা ত্যাকন কোলের বাচ্চাডারে মাই খাওয়াতি নেগেলো, তার কোলেত্থে বাচ্চাডারে মাটিতি ফেলয়ে দিয়ে বিবির চুলের মুটি ধর্যে হিড়হিড়য়ে টেন্যে নে যেতে উয্যুগ করেলো৷’
বিশ্বনাথ বসে ছিল, চকিতে উঠে দাঁড়াল৷ তার চোখ দুটো তখন বাঘের মতো জ্বলছে৷
-‘মেঘা! আজ আমাবস্যের দেয়ালি, আজ মা কালীর পুজো!’
বিশ্বনাথের ডাকটাও শোনালো যেন বাঘের গর্জনের মতো৷
-‘মা সীতের গায় হাত দেচে! আজ রাত্তিরিই আবণ-বধ কত্তি হবে! কারে কারে নিবি হিসেব কর্যে অস্তরপাতি গুছয়ে নে৷’
-‘নিচ্চি৷ কিন্তু তুমি নিজি কি যাবা সদ্দার?’
-‘তুই কী কচ্চিস মেঘা? মায়ের গায়ে হাত দেচে আর ব্যাটা তার পিতিশোধ নিতি না গে জঙ্গলের মদ্দি একা বস্যে থাকতি পারে?’
গভীর রাত৷
অতর্কিত চারদিক থেকে বহু কন্ঠের হইহই শব্দে কেঁপে উঠল ফেডি সাহেবের কুঠি৷ সেই সঙ্গে অগুন্তি মশালের আলো৷
বুক কেঁপে উঠল ফেডির৷ ভয়ে কেঁদে ফেললে মেমসাহেব৷ সেদিন আবার ফেডির বন্ধু লিডিয়ার্ড নামে এক সাহেবও তার কুঠিতে অতিথি৷ বিবিকে কুঠির পেছনদিকে পালাতে বলে বন্দুক হাতে তুলে নিলে ফেডি৷ লেডিয়ার্ডের সঙ্গেও বন্দুক ছিল৷
কুঠির ভেতর থেকে দুটো বন্দুক গর্জন করে উঠল৷
কিন্তু বিপক্ষ দলে কয়েক-শো মানুষ৷ তারা শুধু লাঠি-বল্লম সম্বল করেই আসেনি৷ আট-দশটা বন্দুক তাদের হাতে৷ একটার পর একটা গুলি চালালে টোটা ফুরোতে কতক্ষণ? হয়তো তেমন বেশি সংখ্যায় টোটাও ছিল না ফেডির কুঠিতে৷ একটু পরেই কুঠির ভেতর থেকে বন্দুকের গর্জন ক্রমেই বিলম্বিত হতে লাগল৷ তারপর একসময় দোর্দণ্ডপ্রতাপ নীলকরের বন্দুক একেবারেই নীরব৷ সব কার্তুজ ফুরিয়ে গেছে৷ স্যামুয়েল ফেডি তখন সম্পূর্ণ অসহায়৷
কুঠির উত্তরদিকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইলিয়ট সাহেবের বাংলো৷
সেদিক থেকে কোনো আক্রমণ এলে কী করা হবে তার ব্যবস্থাও আগে থেকেই করে রেখেছিল বিশ্বনাথ৷ জন্য পঞ্চাশেক বাছাই তিরন্দাজ৷ আর চার-পাঁচ জন বন্দুকধারী অনুচরকে মোতায়েন করে দিয়েছে সেদিকে৷ কিন্তু ইলিয়ট সাহেব তখন গুলি চালাবে কী, থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সে বোধ হয় তখন ইশাইয়ের নাম জপ করছিল৷
বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়েছে করালী৷ সে যেন ফিরে গেছে তার প্রথম যৌবনে৷ পঞ্চাশ বছর আগেকার সে-রাতের ঘটনা যেন এই মুহূর্তে এখানে তার চোখের সামনেই ঘটছে৷
-‘সদ্দারের পাছ পাছ সব্বাই তো কুটির মদ্দি সেঁদয়ে গ্যালো বাবু৷ মোর পর ভার পড়ল কুটির পেছনদিক পাহেরার৷ মোর দলবল নে মুই তো পাহেরা দিচ্চি, হটাৎ দেকি, পুকুরির পাড়ে মেমসায়েবের জুতো৷ লজর চালয়ে দেকি, জলের মদ্দি অ্যাকটা ভুট করা কেলে হাঁড়ি৷ আর কি বুজতি বাকি থাকে, কেলে হাঁড়ির তলায় কেডা? সামলাতি পাল্লাম না বাবু৷ গলায় ঝ্যাতো জোর আচে তাই দে চেঁচয়ে বললাম, তুমি ক্যানো পালয়েচো মেমসায়েব? আমরা বুটেলও না, কেরেস্তানও না৷ মেয়েজাতের গায় আমরা হাত দি না৷ তোমার পেরাণের ভয় নাই, ইজ্জতও কেউ নষ্ট করবে না৷ তুমি উটে আসতি পারো৷ আমাগোর সদ্দার মায়ের জাতকে মায়ের জাত বলেই সম্মান করে, তোমার ভাতারের মতো অবলা ইস্তিরিনোকের না¨ছনা করে না!-তা বাবু মেমসায়েব ওটলে না৷ ভয়ে যে সিঁটিয়ে আচে! তা ঝা হোক, কুটি নুট হল, ফিটি সায়েব আমাগোর বন্দি হল, সায়েবরে নিয়ে আমরা বাগদেবী খালের অ্যাক জঙ্গলে চল্যে আলাম৷ সায়েব তো ত্যাকন ভয়ে আদমরা হয়েই আচে৷ মেঘাদা বল্লে, সদ্দার কী ডণ্ড দেবা এরে? হাউমাউ কর্যে কান্দে ওটলে সায়েব৷ পা জড়য়ে ধল্লে সদ্দারের৷ আমাগোর দিকি তাকয়ে সদ্দার বল্লে, তোরা কী ডণ্ড চাস?
-‘মিত্যুদণ্ড! আমরা সব্বাই অ্যাকবাক্যিতি তাই কলাম৷ তাই শূন্যে সায়েব পাগলের মতো সদ্দারের পা জড়ায়ে ধরে কান্দতি নেগেলো, আমারে মের্যে ফেলো না, আমার বিবিডে তালি বেধবা হয়ে যাবে৷ শুনিচি তুমি ইস্তিরিনোকেরে ছেদ্দা করো, তালি তার কতা অ্যাকবার ভাবো৷
-‘গোপলে চেঁচয়ে ওটলে, ফকির মোল্লার বিবির কোলেত্থে বাচ্চা ছুড়ে ফেলয়ে তেনার চুলের মুটি টানার সোমোয় এ কতা মনে ছেল না সায়েব?
-‘মেঘাদা বললে, সদ্দার, তুমি ঝা হুকুম দেবা, তাই তামিল হবে৷ তউ আমার অ্যাকটা কতা ঝেদি ন্যাও তো কই, এ সমিন্দিরে দেকে মনে হচ্ছে, চেপি ধল্লি চিঁচিঁ করে, ছেড়ি দিলি নাফ মারে৷ ওর কাছে হিসেব ন্যাও দিনি, কত চাষিরি ও ঘর ছাড়া করেলো, আর কত চাষির বিবিরি বেধবা-বেওয়া কর্যে ছেড়য়েচে?
-‘সদ্দারের পা জড়য়ে ধর্যে কান্দতিই নাগলো সায়েব৷ বললে, এই দফা মোরে ছেড়ি দাও সদ্দার, মুই জেবনে আর নীল করবো না, কারোর ক্ষেতি করবো না, মোর নীলির কারবার গুটয়ে নে চল্যে যাবো৷
-‘সদ্দার বললে, সাচা কতা দেচ্চ?
-‘সায়েব বললে, আমাগোর যিশুকেষ্টার নামে পিতিজ্ঞে কর্যে কচ্চি সদ্দার৷
-‘তাজু চেঁচয়ে ওটলে, যিশুকেষ্টোরে ও ভারি মানে! ওর কতায় লরম হয়ো না সদ্দার৷’
একটু দম নিয়ে করালী আবার বলতে লাগল, ‘মুইও ছেড়ি দিতি মানা করলাম বাবু৷ কিন্তুন দয়ার শরীল সদ্দারের৷ সায়েবের সেই মেকি কান্দুনি শুনে তারে মাপ কর্যে দেলে৷ সায়েব কথা দে’ গ্যালো, এ কতা সে কাউরি কবে না, এই জঙ্গলের গোপন আস্তানার কতা কারুর কাচে ফাঁস করবে না৷
-‘ছাড়ান পায়ে চলে গ্যালো সায়েব৷ মেঘাদা বড়ো বিষেদমনে বললে, দয়া ঝে নিতি জানে তারেই দয়া করা চলে সদ্দার৷ ও সমিন্দিরে ছেড়ি দিয়ে কাজডা বোধায় তুমি ঠিক কল্যে না৷’
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একটু থামল করালী৷ তারপর আবার আরম্ভ হল তার কাহিনির উপসংহার অংশ৷
মেঘা এবং অন্যান্য অনুচরদের কথাই ছিল ঠিক৷
ছাড়া পেয়েই আগের মূর্তি ধরল ফেডি৷ কিংবা আগের চেয়ে আরও ধূর্ত নৃশংস মূর্তি৷ প্রথমেই ম্যাজিস্ট্রেট ইলিয়টকে সে জানালে বিশ্বনাথের গোপন আস্তানার খবর৷ কয়েকদিনের ভেতরেই ধরা পড়ল বিশ্বনাথ, মেঘা আর জনাকয়েক সাগরেদ৷ ইলিয়ট সাহেব দেরি না করে তাদের পাঠিয়ে দিলেন দূরে দিনাজপুর জেলখানায়৷ কিন্তু ক-দিন পরেই সব ক-জনকে নিয়েই জেল থেকে পালিয়ে এল বিশ্বনাথ৷ এবার তার একমাত্র চিন্তা, উপযুক্ত প্রতিশোধ নিতে হবে ফেডির ওপর৷
পর পর নীলকুঠি আক্রমণের খবরে আগেই কোম্পানি সরকারের টনক নড়েছিল৷ এবার একেবারে জেলা সদরে খোদ ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলোর পাশেই কুঠি আক্রমণ! আর দেরি করা চলে না৷
কত শক্তি রাখে বিশে ডাকাত?
তার সঠিক অনুমানও করতে পারছে না ইংরেজ কর্তৃপক্ষ৷ এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে তার দাপটে নদিয়ার সমস্ত শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে৷
দক্ষ সেনাপতি ব্ল্যাকওয়ার৷
তার অধীনে একটা গোরাপল্টন আর চার-পাঁচটা নেটিভ সেপাই পল্টন এসে ছাউনি ফেললে নদিয়ায়৷ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল গোয়েন্দা-কোথায় সেই ভয়ংকর ডাকাতটার আস্তানা?
দলবল নিয়ে তার আগেই বামনিতলার জঙ্গল ছেড়ে গা ঢাকা দিয়েছে বিশ্বনাথ৷ নদিয়া জেলার ভেতরেই আছে অথচ এতগুলো গোয়েন্দা লোকটাকে খুজে বের করতে পারছে না?
বিরক্ত ইলিয়ট, বিব্রত ব্ল্যাকওয়্যার, আক্রোশে ক্ষিপ্ত স্যামুয়েল ফেডি৷
নচ্ছার ডাকাত সর্দারটাকে কোতল না করতে পারা পর্যন্ত ফেডির মনে শান্তি নেই৷ মাঝে মাঝে আবার আপনমনেই হাসে ফেডি৷ অতবড়ো একটা ডাকাত দল চালায় অথচ লোকটা কতবড়ো মূর্খ! শত্রুর প্রতিজ্ঞাকে সে বিশ্বাস করে৷
হঠাৎ একদিন একজন ধনীর বাড়িতে ডাকাতি৷
কোনো গোয়েন্দা মারফত আগেই খবর পেয়েছিল ব্ল্যাকওয়্যার৷ কিছু গোরা আর কিছু নেটিভ সেপাই নিয়ে ওঁত পেতে বসে ছিল ইংরেজ সেনাপতি৷ ধরা পড়ল বিশ্বনাথের কয়েকজন অনুচর আর তার পালিত পুত্র মানিক৷
সব ক-জন ডাকাতকেই অনেক টাকা পুরস্কারের লোভ দেখিয়েছিল ব্ল্যাকওয়্যার৷ কিন্তু কাউকে টলানো যায়নি৷ তারা ফাঁসিতে যাবে সেও স্বীকার কিন্তু তাদের সর্দারের গোপন আস্তানার খবর তারা দেবে না৷ ইংরেজ বেইমানি করতে জানে এবং পারে, ফেডি সাহেব তা করেও দেখিয়েছে৷ কিন্তু বিশে ডাকাতের সাগরেদরা বেইমানি করে না৷
সাগরেদরা বেইমানি করেনি, বেইমানি করলে সর্দারের নিজেরই পোষ্যপুত্র৷ অনেক টাকা পুরস্কারের লোভ সে সামলাতে পারলে না৷ বিশ্বনাথের তখনকার গোপন আস্তানার হদিশ ইংরেজ তার কাছেই পেল৷
মুহূর্তমাত্র দেরি করার অবসর নেই৷ গোটা সেনাবাহিনী নিয়ে সেনাপতি ব্ল্যাকওয়্যার ছুটল কুনিয়া গ্রামের কাছাকাছি এক জঙ্গলের দিকে৷ সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেট ইলিয়ট আর স্যামুয়েল ফেডি৷
কুনিয়ার জঙ্গলকে চারদিক থেকে সেপাইরা ঘিরে ফেলেছে৷ তাদের হাতে উদ্যত বন্দুক৷ কোনোদিক দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার উপায় নেই৷
গোরার দল খবর পেয়ে গেছে এবং তারা অতি দ্রুত এগিয়ে আসছে, এ খবর যখন বিশ্বনাথের কাছে এসে পৌঁছোল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে৷ কার মুখ থেকে তারা খবর পেয়েছে তাও জানতে পারলে সে৷
দু-চোখে শুধু দু-ফোঁটা জল৷ আর কিছু নয়৷
বলতে বলতে হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেললে করালী৷ সেই কান্নাভাঙা স্বরেই সে বলতে লাগল, ‘বাবু, সদ্দারের সঙ্গে সিদিন কুন্যের জঙ্গলে মুইও ছেলাম৷ আমাগোর সব্বায়ের দিকি অ্যাকবার খালি চোক বুলয়ে নেলে সদ্দার৷ তারপর বললে, তোরা ঠিকই মালুম কর্যেচিলি রে৷ জাতসাপেরে ছেড়ি দিতি নাই৷ ঝাক, ঝে ভুল করিচি তার মাশুল আমারেই দিতি হবে৷ শোন, মোর পরেই তো ওদের ঝ্যাতো আগ, আমারে পালি হয়তো আর কারুর কতা অ্যাকন ওদ্দের মনে থাকবে না৷ আমি ধরা দিচ্চি, সেই ফাঁকে তোরা ঝে ঝিদিকি পারিস পালিয়ে যা-
-‘মেঘাদা বললে, তা হবে না সদ্দার৷ ধরা দিলি আমরা একসঙ্গেই দেবো৷
-‘মেঘাদার পিঠি হাত রাখ্যে সদ্দার বললে, পাগলামি করিস না মেঘা৷ তাতে অনত্থক অ্যাতোগুলো পেরাণই যাবে, নাভের নাভ কিচু হবে না৷ তার চে তোরা পালয়ে গে ঝেদি আবার দল কত্তি পারিস, তাই করিস৷
-‘আমার পিঠিও হাত রাখ্যে সদ্দার অ্যাকটা কতা বলেলো বাবু! বলেলো, কুটেলরা নীল অক্তের সোয়াদ পেয়ে মানুষখেকো বাগের মতো খেপি উটেচে রে করালী, এ-দেশ ছেড়ি বড়ো সউজি ওরা যাবে না৷ পালয়ে যা-পারিস তো আবার পিতিকারে নামিস৷’
করালীর গলা কান্নায় এত ধরে এল যে কিছুক্ষণ সে কোনো কথাই বলতে পারলে না৷ তারপর একটু সামলে দিয়ে বলতে আরম্ভ করলে, সদ্দার নিজে এগয়ে গ্যালো৷ জঙ্গলের বাইরি ত্যাকন মেজেস্টর সায়েবের পাশে ফিটি সায়েবও দেঁড়য়ে আচে৷ তার দিকি তাকয়ে সদ্দার বললে, শিমুল সায়েব, আমি তোমারে হাতের মদ্দি পেয়েও ছেড়ি দিয়েলাম, সে কথা কি তোমার মনে আছে? আমার সাগরেদরা সব্বাই তোমার মাতা নিতি চেয়েলো, তুমি আমার পা জড়য়ে ধর্যে পেরাণ ভিকক্ষে চেয়ে নেলে! তোমার যিশুকেষ্টোর নাম নে পিতিজ্ঞে কল্লে, আর কোনোদিন গরিবির পর জুলুম করবা না, কারবার গুটয়ে নে চল্যে যাবা, আরও কত কী! তোমার সব পিতিজ্ঞেই তুমি ভেঙিচো সায়েব৷ তোমার পাপের মাপ নাই৷ অ্যাকন বুজতি পেরিচি, ক্যালকেউটেরে ছেড়ি দিয়ে সিদিন আমি কী ভুলই না করেলাম৷ ভেবি দ্যাকো দিনি, নীলির নোবে হন্যে কুকুরির চেও অধম হয়ে তুমি কত গাঁ জ্বালয়ে দেচো, কত মানষিরি পতের ভিকিরি করেচো, কত গেরস্তর ঘরের বউরি তুমি বেধবা করেচো? আর আমি অ্যাদ্দিন ঝা করে আয়েচি, তা আমার দেশের গরিবির জন্যিই কর্যেচি৷ বেঁচি থাকলি আমি তাই-ই কর্যে যাতাম৷ কিন্তু তোমরা ঝে আমারে বাঁচতি দেবা না, তা তো আমি বুজতিই পারতিচি৷ শোনো সায়েব, বিশে বাগদি মিত্যুরি ভয় করে না৷ আমি কিন্তুন তোমাদের পা জড়য়ে ধরে পেরাণ ভিককে কত্তি যাচ্ছি নে৷ এই আমি হাসিমুকি ধরা দেলাম, তোমাদের এংরাজ কেরেস্তানের আইন-বেচারে ঝা খুশি, তোমরা তাই কত্তি পারো৷
-‘এই ছেলো মোদ্দের সদ্দারের শেষ কতা বাবু৷’
হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল করালী৷ হরিশের চোখও তখন জলে ঝাপসা হয়ে এসেছে৷
-‘সবই ঝ্যাকন কলাম, ত্যাকন শ্যাষের কতাটুকুও কয়ে বুকির মদ্দিডা এটটু হালকা করি৷ একদিনির মদ্দি ফোজদুরি বেচার সেরি ফ্যালালে সায়েবরা৷ ফাঁসির হুকুম হয়ে গ্যালো৷ মা গঙ্গার কুলি নে গে সব্বাইরি ঝ্যান দ্যাকোনোর জন্যিই সদ্দারকে তেনারা খোলা জাগায় ফাঁসির দড়িতি ঝুলয়ে দেলে৷ অ্যাতখানি কর্যেও তেনাদের রোক মরে নাই বাবু! সদ্দার তো ত্যাকন আর বেঁচি নাই, তউ তেনার শরীলডারে অ্যাকটা নোয়ার খাঁচায় পুর্যে কাছের অশত্থ গাচের ডালে ঝুলয়ে রেকে দেলে! কী কবো বাবু, কতি গেলি বুক ফেটি যায়, সদ্দারের গবেভাধারিণী মা পাগলের মতো হয়ে সায়েবগোর কাচে ছেল্যের হাড় কয়খানি খালি চেয়েলো, তেনারা সেটুকু দয়াও করে নাই৷’
স্তব্ধ হয়ে বসে আছে হরিশ৷ তার চোখের জলও যেন শুকিয়ে গেছে৷ আলিপুর জেলখানার পেটা ঘড়িতে ঢং ঢং করে পাঁচটা বাজল৷
তখনও আলো ফোটেনি৷ রাতের রেশ রয়েছে৷
* হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখ্যোপাধ্যায়