২.৯
তখন কোরবানের পশুটা ভয়ে হাম্বা হাম্বা ডাকছে। যেন সে তার বাছুর হারিয়ে এই মানুষের মেলায় চলে এসেছে। সে তার অবলা চোখে সব দেখছিল। ভিড় ক্রমে বাড়ছে। ফেলুর একটা হাতে এত শক্তি! অন্য হাতটা তো ওর মরা। শুকনো লতার মতো শুধু গায়ে লেগে আছে। যে কোনও সময় ফেলুর ইচ্ছা হয় ওটাকে ছিঁড়ে শরীর থেকে ফেলে দিতে।
ফেলু জীবটাকে এক হাতেই মসজিদের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এক হাতেই সে ধর্মের নামে কত কিছু করতে পারে মানুষেরা দেখুক। অঞ্চলের মানুষেরা দেখুক, ফেলু, যে ফেলুর হাত গেছে বলে সবাই পঙ্গু ভেবেছিল, যার বিবি আতরের গন্ধে পাগল বনে যায়, দিগবিদিক ফাঁক পেলেই ছোটে, কাণ্ডজ্ঞান থাকে না, সেই ফেলুর কী সাহস! সে আজ এক হাতে এমন পুষে বড় করা জীবকে, জীব থেকে সে কত বেশি অনুদান পাবে আশা করেছিল, দিন নেই রাত নেই ঘাস চুরি করে এনে খাইয়েছে, দুবেলা বাছুরটাকে সে কী আশ্চর্যভাবে সবল করে তুলেছে, সেই বাছুরকে সে এখন বিসমিল্লা রহমানে রহিম বলে ধর্মের নামে কোরবানী দেবে। কত বড় ফেলু এই যেন দেখানোর ইচ্ছা। যেমন সে হা ডু ডু ডু ডু বলে প্রতিপক্ষের উপর চেপে বসত তেমনি সে এখন ধর্মের নামে শরীরে জুস পাচ্ছে। এক হাত গেছে বলে তার কোনও শরম নেই। বরং অন্য হাতটা এত বেশি শক্ত, এবং এত বেশি সাহস তার প্রাণে যে ধর্মের নামে এক-কোপে দশটা কাফেরের গলা নামিয়ে দিতে পারে। কিন্তু জ্বালা এই কোরবানীর পশু নিয়ে। এতটা পথ সে বেস টেনে এনেছে। শিঙে দুটো প্যাঁচ দিয়ে রেখেছে বলে খুব বেশি একটা ছুটতে পারেনি। এখন কী বুঝতে পেরে চার পায়ের ওপর শক্ত হয়ে গেছে। নড়ছে না। এতবড় মেলার ভিতর তাকে ছোট করে দিচ্ছে। সে যে ফেলু এটা কেন হালার গরু বোঝে না!
এই দশ ক্রোশের মতো পথ মোটামুটি ভালোয় ভালোয় চলে এসেছে। কোনও গোঁয়ার্তুমি ছিল না। কিন্তু মসজিদে নিয়ে যেতে যত গোঁয়ার্তুমি। তা তুমি এক বাগি গরু আর আমি এক একচক্ষু ফেলা। কে কারে খায় দেখা যাক। বলেই সে শক্ত হাতে আবার লেজ মুচড়ে দিল। পাশের লোকেরা বলছে, আরে দ্যাখো মিঞা সিপাইগ কাণ্ড। নলে গুলি নাই। ফাঁকা আওয়াজ করে। তোমারে ডর দেখায়।
ফেলু তাচ্ছিল্য করে সব। তার তো সব জানা। জানা বলেই সে ভোররাতে আজান দিয়েছে। লোক জড় করেছে মিছিলের জন্য। মশাল জ্বালিয়ে সে সারারাত এ গাঁ ও গাঁ ঘুরেছে। সে মিছিলের শেষে। মিছিল যায়, ধর্মের মিছিল। মিছিলে হাজার সবুজ পতাকা, লাঠি, সড়কি এবং ধুলো উড়ছে। ওরা যায় আর যায়। যারা আরও দূরের মানুষ রাতে রাতে ওরা মশাল জ্বেলে বের হয়েছে। ওরা এসে গোলাকান্দালের বড় বটগাছটার নিচে সবাই থামবে। সেখান থেকে আবার লম্বা মিছিল। বিশ্বাসপাড়া, নয়াপাড়া, লতব্দি, বলব্দি এবং দন্দির মাঠ থেকে যারা মিছিল বের করেছে ওরা হাসান পীরের দরগায় এসে থেমেছে। ওরা দেখেছিল হাসান পীরের দরগাতে তখন পাগল ঠাকুর। এতবড় মিছিল দেখেই তিনি বের হয়ে এসেছেন। তিনি বুঝি পীরের সঙ্গে এতক্ষণ কথা বলছিলেন। আর কোরবানের পশুটার কথা ছিল হাসান পীরের দরগা পর্যন্ত জোরে কদম দেবে—কারণ, তখনও মিছিলটা পুরো মিছিল নয়, এদের আল্লা-হু-আকবর ধ্বনি শুনে আরও মানুষ এই মিছিলে যোগ দেবে, যারা দেবে না, কাফের তারা, তারা পবিত্র ইসলাম নয়, এমন সব লেখা আছে বড় বড় ইস্তাহারে। দরমাতে সব বড় বড় ইস্তাহার এঁটে নিয়েছে। মাথার ওপর সেই সব ইস্তাহার। আর ক্রমে ওরা এগুচ্ছিল। হিন্দু গ্রামের পাশে এলেই ভয়াবহ ধ্বনি। সাধারণ হিন্দু গৃহস্থরা ভয়ে বের হচ্ছে না মাঠে। কেবল পাগল ঠাকুর হাসান পীরের দরগায় মরা একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। মাথার ওপর অজস্র শকুন। ওরাও দেখছে একটা ধর্মের মিছিল যায়। কেউ কেউ উড়ে গেল। কতদূর যাচ্ছে মিছিলটা দেখতে।
.
কোরবানের পশুটা পথে বেশ হাঁটছিল। আর এখন শক্ত হয়ে আছে। ফেলু কিছুতেই নাড়াতে পারছে না; ঠিক যেমন হাসান পীরের দরগা পার হলে একটা মশালের মিছিল দেখে চার পা শক্ত করে দিয়েছিল। সে এটা জানত। দলটা বড় হলে, মিছিলে মশাল জ্বললে কোরবানের পশুটা ভয় পাবে। গলাটা টান টান করে রাখবে। দড়ি টানলে এক পা নড়বে না। চোখেমুখে আতঙ্ক। আমারে তোমরা কোন পীরের দরগায় নিয়া যাইবা। এই ত আছিল একডা পীরের দরগা, হাসান পীরের দরগা—এহানে আমারে রাইখা যাও! মনের সুখে ঘাস খাই। তারপর শালীর শালী কোরবানীর জীবটা একেবারে দুলকি চালে সেই যে হাঁটছিল আর থামে না। মাঝে মাঝে ঘাস দেখলে মুখ দিতে চেয়েছে, কিন্তু ফেলুর পা যাবে কোথায়! এক পা তুলে হড়কে শালা লাথি। যেন এই লাথি সে জীবের পাছায় মারছে না, মারছে বিবির পাছায়। শক্ত পা ওর নিমেষে এত বেশি রুক্ষ এবং নিষ্ঠুর হয়ে যায় যে আজ হোক কাল হোক বিবি তারে খাবে। খেতে না পারলে নিশুতি রাতে পালাবে। নাকি মানে মানে সে তালাক দেবে বিবিকে। তালাক দিলে লাভ হবে বিঘা দুই ভুঁই আর জমি যা আকালুদ্দিন দশ কুড়ি টাকায় বন্ধক রেখেছে সব খালাস পাবে। সে যে এখনি কী করে বুঝতে পারছে না। এতবড় ধর্মযুদ্ধে এসেও সে তার সামান্য ক্ষয়-ক্ষতির কথা ভুলে থাকতে পারছে না। দিমু এক হাতে গলার নালি ছিঁড়া। বোঝবা মিঞা মরদ আমি ক্যামন একখানা! হালার কাওয়া
হালার গরু! গরু তোমার মুখ দিমু ভাইঙ্গা! তুমি নড়তে চড়তে চাও না। কেবল মুততে চাও। গরুটা ভয়ে কেবল মুতছে। যে জীবটা এতক্ষণ বেশ আসছিল, বেশ হাঁটছিল, যেন সেও সবাইর সঙ্গে নামাজ পড়তে রওনা হয়েছে, সেই জীব এখন ঘাড় শক্ত করে পা বালিতে ঢুকিয়ে টান টান করে রেখেছে গলা। আর টানাটানি করলেই হড়হড় করে মুতে দিচ্ছে। সে যে কী করে চরে! এত ভিড়ের ভিতর তাকে জীবটা কী যে ছোট করে দিচ্ছে! কিছুতেই সে হাঁটিয়ে নিতে পারছে না। ক্রমে সবাই নদীর পাড়ে উঠে যাচ্ছে। দলে দলে ইস্তাহার মাথার উপর তুলে নাচাচ্ছে। আলি সাহেব একটা চোঙ মুখে ঢিবির উপর উঠে একের পর এক হিন্দু সাম্রাজ্যবাদের কথা বর্ণনা করছে। ধর্মের প্রতি আবহমানকাল ধরে যে হিন্দুদের ঘৃণা, সেই ঘৃণার কথা তির্যক্ ভাষায় প্রকাশ করছে! সবাই শুনতে শুনতে কান খাড়া করে দিচ্ছে। গরম রক্ত এবার টগবগ করে ফুটতে আরম্ভ করেছে। পুব দেশে যত কাফের আছে, কাফের নিধন করে পতাকা ওড়াও। কোরবানীর পশুটা পর্যন্ত গলা তুলে শুনতে পেল সেই যেন ঢাক বাজে ঢোল বাজে! জীবের গলা কাটলে শুধু থাকে রক্ত, অবলা জীবের মুখে টগবগ করে রক্ত ফুটছে, এ জীবের তবে নিদান হাঁকা দায়। ফেলু মরিয়া হয়ে হ্যাঁচকা টান দিল জীবটাকে। এবং হ্যাচকা খেয়ে সে পড়ে যেত, ফলে আর এক হাত সম্বল থাকত না, হাতটা তার ভাঙত। কিন্তু তখনই দুটো ফাঁকা আওয়াজ পীলখানার মাঠ পার হল। ভিড়ের ভিতর থেকে ফেলু কিছু দেখতে পাচ্ছে না! ফাঁকা আওয়াজেই যে যেদিকে পারছে ছুটছে এবং চরের ওপর ছড়িয়ে পড়ছে। কিছু দূরে এসেই ফেলু বুঝি টের পেল ওটা ফাঁকা আওয়াজ। সে একটা মানুষের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে বুঝে ফেলল সবই ফাঁকা আওয়াজ। গরুটা ফাঁক বুঝে লেজ তুলে ছুটতে চাইছে। সেও শালা টের পেল ফাঁকা আওয়াজ। সে বলল, হালার কাওয়া। তুমি গরুর পো টের পাইছ, গলায় তোমার আমি চাক্কু চালামু। আল্লার নামে কোরবানী দিমু।
আলি সাহেব তখন ঢিবিতে উঠে চেঁচাচ্ছে।—ভয় নেই। আপনারা ভয় পাবেন না। আপনারা ভয় পাবেন না। সব ফাঁকা আওয়াজ। আল্লার কুদরতে বন্দুকের নল থেকে গোলাগুলি বের হবে না। সব ধোঁয়া বের হবে। সব ধোঁয়া! ধোঁয়া। আপনারা কদম কদম বাড়ায়ে যান।
কদম কদম বাড়ায়ে যান, দাঁড়ায়ে যান সামনে। আজ সবে-বরাত। সব মৃত আত্মা বের হয়ে পড়ছে। তারা আজ মুক্ত। তারা দেখছে আপনারা যা সব ছাওয়াল আছেন—আল্লার দুনিয়ায় কিডা করছেন। আলি সাহেব কলিকাতা শহরে থাকেন। কথায় বার্তায় পুব দেশের মানুষের মতো কথা বলে আপনার জন হয়ে যান মাঝে মাঝে। তিনি বললেন, গরু, ভেড়া, দুম্বা যা কিছু কোরবানী দেবেন, সবই তারে দিবেন। আল্লাহর কাছে যে জীবন পেয়েছেন তারে তা ফিরায়ে দেবেন। না পারেন নিজেরে দেবেন।
এই শুনে সবাই আবার এগুতে থাকল।
বাবুরা ছাদ থেকে দেখছিলেন, এক ফাঁকা আওয়াজেই সব ছুটে পালাচ্ছে। বাবুদের ছেলেরা এমন দেখে কি হল্লা! আনন্দে ছুটে এসেছে নদীর পাড়ে। এবং ভূপেন্দ্রনাথ দূরবীন নিয়ে প্রাসাদের ছাদে বসে রয়েছেন। মাঝে মাঝে বড়বাবুকে দেখতে দিচ্ছেন। শঙ্কা তাঁর কমছে না। কারণ, আবার সবাই চরে এসে জমা হচ্ছে। ওরা বুঝতে পেরে গেছে পুলিশ সাহেব ভিড়টা এগুতেই ফাঁকা আওয়াজের নির্দেশ দিয়েছেন। ওরা টের পেয়ে ফের মরিয়া হয়ে গেছে। সে দেখল, যারা কোরবানীর জন্য পশু নিয়ে এসেছে তারা এবার সকলের আগে হাঁটছে। ভয় নেই। বিন্দুমাত্র শঙ্কা নেই। আল্লার কাছে যে জীবন পেয়েছেন তারে তা ফিরায়ে দেবেন—না পারেন, নিজেরে দেবেন। ওরা যেন নিজেকে দিতে এবার যাচ্ছে।
বল্লমের ইস্পাতে সূর্যাস্তের রোদ পড়ে ভীষণ এক কাণ্ড। হাজার হাজার এমনি সব ইস্পাতের ফলা আকাশের দিকে কারা ছুঁড়ে দিচ্ছে। ওরা কদম কদম এগিয়ে আসছে। কেউ যেন দামামা বাজাচ্ছে। তালে তালে উঠে আসছে কালীবাড়ির দিকে। বাজার বাঁয়ে রেখে ঠিক তারকবাবুর মাঠ বরাবর উঠে আসছে। মাঠে এখন কেউ নেই। কিছু কনেস্টবল। হাতে বন্দুক। একপাশে গোরা পুলিশ সাহেব। বাবুরা কৃতী লোক। ভূপেন্দ্রনাথ বাবুদের চিঠি নিয়ে সদরে দেখাসাক্ষাৎ করে এতবড় একটা বন্দোবস্ত করেছেন। নতুবা সুরাবর্দি সাহেবের আমল। লীগের রাজত্ব দেশে। সামসুদ্দিন বড় গোছের নেতা। সে আর এ-সবে মাথা দিতে পারে না। হরদম সে কলকাতা যাচ্ছে। আসছে। বাবুরা কৃতী না হলে এমন হয়! বন্দুকের সঙ্গীনে সূর্যাস্তের আলো। ওরা সবাই এখন নিলিং পজিশানে আছে। কেবল আদেশের অপেক্ষায়। হিন্দু-মুসলমানে এমন মারমুখী দাঙ্গা তাদের রুখতেই হবে।
ওরা উঠে আসেছ তো আসছেই। ফাঁকা আওয়াজে ভয় পাচ্ছে না। শুধু অবলা জীবের চোখ ভয়ে সাদা হয়ে গেছে। কান ঝুলে গেছে তার। ফেলু একটু হড়কে গেলেই বাগি গরুটা লেজ তুলে পালাবে। এই যে তামাশা—শালা সে কে, সে কিসের নিমিত্ত এসেছে এখানে বুঝেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। একবার ফেলুর হাত হিলে গেলেই হল, তখন দেখবে কার সাধ্য তারে আটকায়। কিন্তু ফেলুর এক হাতই এত শক্ত যে গরুটা তা গলায় টের পাচ্ছে। দড়িটা টানাটানিতে গলায় বসে যাচ্ছে। জীবটা শ্বাস নিতে পারছে না। সুতরাং শ্বাস ফেলার জন্য সেও কদম কদম এগিয়ে যাচ্ছে।
—হল্ট। একসঙ্গে বিশটা রাইফেলের ট্রিগারের শব্দ। ওরা সেফটি অন করে দিয়েছে। আর এক পা এগুলেই ট্রিগার টিপবে।
আল্লার কাছে যে জীবন পেয়েছেন তারে তা ফিরায়ে দেবেন। দামামা বাজছে তালে তালে। মহরমের মতো ঢোল বাজছে। আর তালে তালে সেই এক পবিত্র কোরআনের বাণী ভেসে বেড়াচ্ছে যেন কানে, না পারেন নিজেরে দেবেন। ওরা নিজেদের দিতে যাচ্ছে।
রূপগঞ্জ থানার ইসমাইল দারোগা চোঙ মুখে হাতে লেখা কাগজ পড়ে যাচ্ছিল, আপনারা আর অগ্রসর হইবেন না। কিঞ্চিৎ অগ্রসর হইলেই আইন ভঙ্গ করা হইবে। একশো চুয়াল্লিশ ধারা ভঙ্গ করিলে গুলি করিতে বাধ্য থাকিব। আমদের গোস্তাকি ক্ষমা করিবেন। অন্যত্র আমরা আপনাদের ধর্মকর্মের দাসানুদাস। বলেই সে পুলিশ সাহেবের সামনে এসে সেলুট করল এবং কানে কী ফিসফিস করে বলল। তারপর কাগজটা ফিরিয়ে দিল।
লাল বর্ণের মানুষ। চোখমুখ এমনিতেই লাল। সূর্যাস্তের জন্য সে মুখ আরও ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। বয়স খুব অল্প। দেখে মনে হয় শঙ্কায় ওর গলা শুকিয়ে আসছে। দামামার শব্দে কেউ কিছু শুনতে পাচ্ছে না! ওরা এগিয়ে আসছে তো আসছেই।
নানা রকমের শব্দ উঠছে, গরু-ভেড়ার শব্দ ঢাক-ঢোলের শব্দ, চোঙ মুখে বক্তৃতা। উত্তেজনা জিইয়ে রাখা চাই। সাহেবের মাথায় সব শব্দ রেল গাড়ির চাকার মতো ঝনঝন করে বাজছে। এবং ঠিক তক্ষুনি ওরা এত কাছে এসে গেছে যে হাতের কাছে পেলে মশালে আগুন জ্বেলে ওদের সবাইকে পুড়িয়ে মারবে। একটা বর্শা ঠিক তক্ষুনি ইসমাইল দারোগাকে উদ্দেশ্য করে ছুঁড়ে মারল কে। জনতার ভিতর থেকে হাজার হাজার বর্শা যেন ছুঁড়ে দেবে এবার তারা। এত প্রচণ্ড বেগে বের হয়ে গেল যে ইসমাইল টের পেল না, পিছনের দিকে তাকাতেই দেখল সাহেবের কান উড়ে গেছে।
ইসমাইল এবার চোখের উপর সর্ষে ফুল দেখতে থাকল।
যেন এতগুলি মানুষের জীবন রক্ষার্থে সাহেব নিজের রক্তাক্ত মুখ ঢেকে হুকুম দিলেন ফায়ার!
বাস, ফায়ার। বাস, গুলি ছুটতে থাকল। বন্দুকের নল থেকে এবার আর ধোঁয়া বের হচ্ছে না। কেবল গুলি বের হচ্ছে। বিশ রাউণ্ড গুলি ছুঁড়েই সিপাইরা ফের অ্যাটেনশান হয়ে গেল। হুকুম পাবার জন্য ফের কান খাড়া করে রাখল। কিন্তু কে কাকে হুকুম দেবে! আহত পুলিশ-সাবকে এখন ধরাধরি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কাছারিবাড়িতে। শিলাবৃষ্টির মতো সেই উচ্ছৃঙ্খল জনতা চরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ল। নিমেষে চর ফাঁকা। সূর্যাস্তের লাল রঙ, আর কত মানুষের তাজা রক্তে মাটি ভেসে যাচ্ছে। আর সেই কোরবানীর পশুগুলি পড়ি-মরি করে ছুটছে। ফেলু ছুটছে। ধুন্ধুমার লেগে গেল চোখে-কানে। ফেলু টের পাচ্ছে না কখন ওর মরা হাত উড়ে গেছে। হাতটা যে এতদিন রক্তশূন্য ছিল, অচল অসাড় হাত, যা সে বার বার কতবার ভেবেছে সময় ও সুযোগ মতো একদিন কলার ফ্যাতা কাটার মতো শুকনো হাতটা হ্যাৎ করে কেটে ফেলবে, পারেনি। বড় মায়া তার হাতের জন্য। অসাড় হাতটার জন্য সে কষ্ট পায়, তবু সে পারে না ফেলে দিতে—আজ একটা বন্দুকের নল থেকে গুলি বের হয়ে সোজা ওর হাত উড়িয়ে নিয়ে গেল। প্রাণটা উড়ে যেত, একটু ডান দিকে ঘেঁষে গেলেই বুকের কলিজাটা ফালা ফালা হয়ে যেত। এমন তার ধন্ধুমার লেগে গেছে যে এই অন্ধকারে কোথায় ছুটে যাচ্ছে টের পাচ্ছে না। কেবল মনে হচ্ছে হাতটা থেকে একটু একটু করে পানশে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সে কোরবানী দেবে বলে একটা পশু নিয়ে এসেছিল—সেটা না থাকলে খালি খালি লাগার কথা—তা পর্যন্ত সে টের পাচ্ছে না। সে একা, কেউ নেই পাশে। সে দাঙ্গার আসামী। তাকে ধরার জন্য এবার যেন লাশগুলি বের হয়ে পড়েছে। কেউ পাশে নেই। সবাই যে যেখানে পেরেছে পালিয়েছে। ওর চোখের সামনে ত্রিশ-চল্লিশটা মানুষ জবাই করা পশুর মতো হাঁটু মুড়ে মাটিতে পড়ে গেছে। এই অন্ধকারেও সেইসব লাশ তাকে ধরার জন্যে ছুটছে,—কোনখানে যাও মিঞা! আমাগ কার কাছে রাইখা যাও!
ফেলু ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে! অন্ধকারে মাঠের ওপর বলতে বলতে যাচ্ছে—হা আল্লা, এডা কি হইল! কোথায় গ্যালা মিঞা ভাইরা! এই রক্ত এখন কার বদলে যায়?
কেবল মনে হতে লাগল ওর মাথার ভিতর এখন কে মহরমের ঢোল বাজাচ্ছে। কেউ তার কথায় জবাব দিচ্ছে না। দিলেও সে শুনতে পাচ্ছে না। সে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে তো ছুটছেই।
পঙ্গু হাতটা নেই বলে শরীর হাল্কা। শুধু ক্ষতস্থানটা টনটন করে ব্যথা করছে। তাও সে কানে চোখে ধুন্ধুমার লেগে যাওয়ায় টের পাচ্ছে না। সে উথালপাথাল ছুটছে। কোনদিকে যে যেতে হবে, কোথায় কী ভাবে ছুটলে পথ সংক্ষিপ্ত হবে সে তা পর্যন্ত বুঝতে পারছে না। কেবল সে যেখানে হিন্দু গ্রাম পড়ছে, সে-সব গ্রাম এড়িয়ে যাচ্ছে। সে একটাও মিছিলের লোক পাশে দেখতে পেল না। কোনও লোক ছুটছে দেখতে পেলেই সে ভয় পেয়ে যাচ্ছে। ওকে ধরতে আসছে হয়তো। বাবুদের সব জঙ্গী কুকুরের মতো ছেলেরা বন্দুক কাঁধে বের হয়ে পড়তে পারে, এবং খবর রটতে কতক্ষণ। সবাই জেনে গেছে বুঝি ত্রিশ-চল্লিশটা লাশ পড়ে আছে শীতলক্ষ্যার চরে। সে হেরে যাওয়া মানুষ। বড় মাঠের অন্ধকারে সে টের পাচ্ছে না সে এখন কোথায় আছে। বাগি গরুটা থাকলেও এ-সময় ওর সামান্য বুঝি সাহস থাকত। নিজের বলতে তার এখন কিছু নেই। এমন কি এতদিনের হাতটা যা পাগল ঠাকুর হাতি দিয়ে ভেঙে দিয়েছিলেন, সে যে কী ভালোবাসায় হাতটা শরীরে ঝুলিয়ে রেখেছিল, এবং কত হেকিমি দানরি যে করেছে হাতটার জন্য, হাতে কালো তারে কড়ি বেঁধেছে, এই ধর্মযুদ্ধে এসে তার তাও গেল। এখন হালার কাওয়া, সে কানা ফেলু, সে টুণ্ডা ফেলু। হালার কাওয়া, পাগল ঠাকুর তারে এমন করেছে। সে কেন জানি একা। এই অন্ধকার মাঠে এসে সে তার হাতটার জন্য কষ্ট পেতে থাকল। সবাই দেখতে পাবে সকাল হলে একটা মরা হাত নদীর চরে পড়ে আছে। লাশগুলোর সঙ্গে মরা হাতটা বড় বেমানান। লাশের সঙ্গে মরা হাতটার মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
সে আর পারছে না। চারপাশে ঘন অন্ধকার এবং কিছু জোনাকি জ্বলছে ভুতুড়ে চোখের মতো। সে যে কতক্ষণ তাড়া খেয়ে ছুটছে এবং কতটা পথ এসে গেছে এক তাড়ায় অনুমান করতে পারল না। মনে হল, সে একটা বড় গাছের নিচে কখন দাঁড়িয়ে আছে। সে এবার গাছটার নিচে শুয়ে পড়বে ভাবল। সকাল হলে সে বুঝতে পারবে কোথায় এসেছে এবং কীভাবে যে দেশে ফিরে যাওয়া যাবে, আকালুদ্দিন যদি আগে আগে ফিরে যায়। সে নেই গাঁয়ে। ওর তবে পোয়াবারো। সে ফের উঠে আবার ছুটবে ভাবল। কিন্তু দাঁড়াতেই মনে হল, শরীরে আর বিন্দুমাত্র শক্তি নেই। অবশ হয়ে গেছে পা। এত শক্তি পায় তার আর এখন সে এক পা নড়তে পারছে না। সে বসে পড়ল এবং তার ঘুম এসে গেল।
সকালবেলায় তাজা রোদের ভিতর তাকে কে যেন ঠেলছে। তাকে জাগিয়ে দিচ্ছে। শেষ রাতের ঘুমে সে এমন অচেতন যে, সে কিছুতেই চোখ মেলতে পারছে না। ওর পিঠ কে চেটে চেটে দিচ্ছে। পিঠে ভীষণ সুড়সুড়ি লাগছে। তবু সে আলস্যে উঠতে পারছে না। চোখ মেলতে পারছে না। সে যে দাঙ্গা করতে গেছিল গতকাল তা পর্যন্ত সে ভুলে গেছে। এবং চোখের ওপর সূর্যের আলো এসে পড়লে সে ধড়ফর করে জেগে গেল। প্রথম সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না, ওর বাগি গরু এটা। গরুটা ওর পিঠে যা নুন ছিল চেটে খেয়েছে। হালার গরু বড় সেয়ানা। পথ চিনে ঠিক চলে এসেছে না কী গরুটা ওর সারাক্ষণ সঙ্গে সঙ্গেই এসেছে। সে খেয়াল করেনি। গরুর আর ধন্ধুমার লাগার কথা নয়। সে তাড়াতাড়ি ভাবল গরুটার মুখে একটা চুমু খাবে। কিন্তু খেতে গিয়েই মনে হল ওর, বাঁ হাতটা কাঁধে আর ঝুলে নেই। গরুটা দেখে ফেললে ভীষণ সরমের ব্যাপার। সে তাড়াতাড়ি গামছা দিয়ে ক্ষতস্থানটা ঢেকে দিল। গাইগরু আর বিবি সব সমান। দুবলা স্বামী টের পেলে কেবল মাঠে পালাবার চেষ্টা করে। সে বাগি গরুটা নিয়ে উঠে চারদিকে তাকাতেই এবার বুঝল—সে ঊর্ধ্বশ্বাসে ঠিক পথেই চলে এসেছে। এই সেই ফাওসার বিল সামনে, এখানে কাটা মোষের মুণ্ড ফেলে চলে গিয়েছিল কারা। এখানেই জালালি জলে ডুবে মরেছিল আর পাগল ঠাকুর জালালির মৃতদেহ নিয়ে মাঠের উপর ভয়ে ছুটছিলেন সাদা জ্যোৎস্নায়।
সে গরুটাকে নিয়ে যাচ্ছে। প্রায় দুলকি চালে। য্যান সে তার বিবিকে নিয়ে মেমানবাড়ি বেড়াতে গেছিল। দেখলে কে বলবে ওর মরা হাতটা নদীর চরে পড়ে আছে। হাতটা কার, এই হাত, দুবলা হাত, না কি সারা রাত রক্ত পড়ায় হাতটা এমন শীর্ণ হয়ে গেছে—হাতটা নিয়ে একটা ভীষণ কাণ্ড বেঁধে যাবে। মানুষটা কে, কোন মানুষের এমন একটা শীর্ণ হাত থাকতে পারে!
কিন্তু গ্রামের কাছে এসেই ওর বুকটা শুকিয়ে গেল। বিবিটা ওর ঘরে আছে তো! যদি থাকে তবু ভয়। ওর কাটা হাত দেখে বিবিটা আড়ালে হাসবে। ক্ষতস্থানে দুব্বা ঘাসের রস ঢেলে দিতে দিতে মুখ গোমড়া করে রাখবে। য্যান কত ভাব-ভালোবাসা। ফেলুর দুঃখে আন্নুর ঘুম আসছে না। তবু ছিনালি দ্যাখলে নিজের গলায় কোরবানীর চাকু চালাইতে ইসছা হয়। আমারে ফালাইয়া কোনখানে যাইস না। তুই ঘরে থাকলে বাথানের গরুর মত আমি হাম্বা হাম্বা করমু। আমি বেইমানি করমু না। কথা দে, যাইবি না। সে নিজেই কেমন একা একা নিজের সঙ্গে কথা বলছে।
এখন ফেলুকে দেখলে মনেই হয় না গতকাল সে গিয়েছিল ওই জীব নিয়ে শীতলক্ষ্যার চরে। সে জীবটাকে কোরবানী দেবে বলে নিয়ে গিয়েছিল।
সকালবেলা বড়বৌ দেখেছিল ফেলু যাচ্ছে মাঠের উপর দিয়ে। গরুটাকে সে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে না। বরং গরুটাই তাকে যেন টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। গরুটা আগে আগে হাঁটছে। ফেলু পিছনে। সে তার আদরের পশুটাকে নিয়ে গিয়েছিল কোরবানী দেবে বলে। কিন্তু কী ব্যাপার। ফেলু ফিরে এসেছে। সঙ্গে এসেছে বাগি গরুটা। শীতলক্ষ্যার চরে নামাজ পড়ার কথা। বাড়িতে ওরা সারা দিন রাত দুশ্চিন্তায় থেকেছে। কোনও খবর আসেনি। দাঙ্গা বেঁধে যেতে কতক্ষণ! একবার ইচ্ছা হল ঈশমকে দিয়ে খবর নেবে। কী খবর নিয়ে এসেছে ফেলু।
বিকেলে ঈশম গিয়েছিল ফেলুর কাছে। ফেলু ঈশমের সঙ্গে কথা বলেনি। সে একটা ছেঁড়া কাঁথায় শরীর ঢেকে শুয়েছিল। আর এ-গ্রামে থেকে গেছে আকালুদ্দিন। আকালুদ্দিনের খবর নিয়ে জানল, সে ফিরে আসেনি। আন্নুকে হাতের ইশারায় বড় কাফিলা গাছটার নীচে ডেকে নিয়ে গেলে, আন্নু বলেছে, তাকে কিছু বলছে না মানুষটা। এসেই যে কাঁথা গায়ে শুয়ে পড়েছে আর উঠছে না। এমনকি আনুকে খুব কাছে যেতে দিচ্ছে না। কেবল মাঝে মাঝে গোঙাচ্ছে।
সুতরাং বিকেলের দিকে ঈশম কোনও খবর নিয়ে আসতে পারল না। আর কার কাছে খবর পাওয়া যায়। সে সুলতানসাদি যাবে কিনা ভাবল। অথবা নদীর চরে চুপচাপ বসে থাকলে টের পাবে, হাটুরে মানুষেরা যাবে, তারা ঠিক খবর নিয়ে আসবে। বিকেলে সে আর বাড়ি বসে থাকল না। ছইয়ের নিচে বসে তামাক খেতে থাকল এবং হাটুরে মানুষেরা যখন ফিরছে, কী বলাবলি করছে কান পেতে শোনার চেষ্টা করল।
ঈশম সন্ধ্যার পর এসে খবর দিয়েছিল, খুব দুঃসংবাদ। জমিদারবাবুরা চল্লিশটা লাশ নামিয়ে দিয়েছে। সময় বড় খারাপ। বড়মামির চোখের দিকে তাকালেই ঈশম যেন ভয় পেয়ে যায়। সে বলল, বড়মামি, এটা যে কি হইতাছে বুঝি না।
শচি বললেন, তুই কাইল চইলা যা মুড়াপাড়া। ঠিক ঠিক কি হইছে জাইনা আয়।
—কাইল ক্যান। আইজই রওনা দেই। তবে কাইল বিকালবেলা ফিরা আসতে পারমু।
ইশম পরদিন বিকেলে এসে সব বিস্তারিত বললে, হিন্দু গ্রামের সব মানুষ ভীষণ খুশি হয়েছিল। ওরা সেদিন রাতে বিজয় উৎসব করেছিল গ্রামে। ওরা খোলকরতাল বাজিয়ে হরিসংকীর্তন দিয়েছে।