প্ৰথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ২.৬

২.৬

আজ দণ্ডী বিসর্জনের দিন। খুব সকালে উঠে সোনা, লালটু, পলটু, আহ্নিক করল। সূর্যোদয়ের আগে ওদের আজ নদীর পাড়ে হাজির হতে হবে। আহ্নিক শেষে ওরা এসে উঠোনে দাঁড়াল। তরমুজ খেত পার হলেই নদী। সেই নদীতে ওরা ডুব দিতে যাবে। নদীতে বিল্বদণ্ড, যে দণ্ড এ-তিনদিন ওদের হাতে ছিল, তা আজ বিসর্জন দিতে যাবে। তারা গেরুয়া বসন ছেড়ে ফেলবে নদীর পাড়ে। ডুব দেবে জলে, ডুব দিলেই ফের তারা গৃহী হয়ে যাবে।

সূর্যোদয় না হতে আজ ঠাকুরবাড়ির সবাই নদীর পাড়ে নেমে যাবে—সোনাবাবুদের আজ দণ্ডী বিসর্জনের দিন, সে দিনে কি কি হয় সব জানে সামসুদ্দিনের মা। রাতে যখন ফতিমাকে পাশে নিয়ে শুয়েছিল, তখন গল্প করেছে, খুব ভোরে উঠে বাবুরা যাবে নদীতে ডুব দিতে। যা কিছু বসন-ভূষণ সন্ন্যাসীর সব ছেড়ে ফেলবে। ছেড়ে সব নদীর জলে ভাসিয়ে দেবে।

ফতিমা ভোর রাতের দিকে একটা স্বপ্ন দেখল। রাজপুরীর পাশে এক বন। বনে এক রাজপুত্র জন্ম নিচ্ছে। বৈশাখী পূর্ণিমা। এক মহামানবের জন্ম হচ্ছে। তারপরই সে স্বপ্ন দেখল—কিছু জরাগ্রস্ত মানুষ হেঁটে যাচ্ছে শহরের উপর দিয়ে, কারা যেন হাজার হাজার মৃতদেহ ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে এবং এক পাগল মানুষ সবাইকে ঘরে ফিরতে বলছেন। পাগল মানুষের সঙ্গে সে-ও সবাইকে ঘরে ফ্রিতে বলছে। কিন্তু কেউ ফিরছে না। এমন কি সোনাবাবু ওর প্রিয় জ্যাঠামশাইকে ফেলে পালাচ্ছে। ঘুম ভেঙে গেল ফতিমার। সে উঠে বসল। স্বপ্নটার সঙ্গে তার বইয়ের পড়া একটা ইতিহাসের দৃশ্য কিছু কিছু মিলে যাচ্ছে। সে চুপচাপ বসে থাকল কিছুক্ষণ। তারপরই সহসা মনে হল খুব সকালে, সূর্যোদয়ের আগে, এমন কী মনে হয় যখন কেউ ঘুম থেকে জাগবে না তখন ওরা নদীতে যাবে। ফতিমা বাইরে এসে দাঁড়াল। মোরগগুলি ডাকছে। সে নেমে যেতেই মোরগগুলি মাঠে শস্যদানা খেতে বের হয়ে গেল। সে চুপি চুপি পেয়ারা গাছের নিচে এসে দাঁড়াল। মাঠ ফাঁকা। শস্যদানা কিছু আর এখন পড়ে নেই। সে দেখল, সোনাবাবুর নেড়া মাথা, হাতে বিম্বদণ্ড, গায়ে গৈরিক বসন। সেই মহমানবের মতো মুখ চোখ সব। যেন খুব বড় হয়ে গেছে, লম্বা হয়ে গেছে সোনাবাবু। পাগল কর্তার মতো কোনওদিকে না তাকিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সে ধীরে ধীরে একা মাঠের ভিতর নেমে গেল।

একটা মিছিল যাচ্ছে মানুষের। সবার আগে পাগল মানুষ। পরে সোনা লালটু পলটু। পিছনে আশ্বিনের কুকুর এবং চন্দ্রনাথ। শশীভূষণ, ভূপেন্দ্রনাথ এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজন আরও পিছনে হেঁটে হেঁটে নদীর পাড়ে যাচ্ছেন। সবার শেষে যাচ্ছে ঈশম। সে ভোর রাতে জেগে গেছে, কারণ তাকে গিয়ে ডেকে তুলতে হবে সবাইকে। ভোর হয়ে গেছে, এবারে উঠতে হয়। সূর্য উঠতে দেরি নেই, সবাইকে ডেকে দেবার ভার ছিল তার।

ঈশম এই তিন ব্রহ্মচারীকে দেখবে না বলেই সকলের পিছনে আছে। দেখলে যা কিছু পুণ্য এই তিন বালক উপবীতের ঘরে অর্জন করেছে সব নষ্ট হয়ে যাবে। সে সেজন্য সবার শেষে, সবার পিছে থাকছে। ডুব দিয়ে উঠলেই আর কোনও বাধা-নিষেধ থাকবে না। সে ওদের সঙ্গে কথা বলতে পর্যন্ত পারবে।

ওরা যাচ্ছিল, ওদের উপবীত গলায়। ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে। ওদের মুখ উপবাসে কাতর। তিনদিন শুধু ফলমূল আহার এবং দুপুরে চরু রান্না হয়েছিল গতকাল। খেতে বিস্বাদ। আজ পুকুরে জাল ফেলবেন চন্দ্রনাথ। এবং বড় মাছ, পাবদা কই অথবা রুই মাছের ঝালঝোল। এই নদীর জলে নেমে গেলে সেই এক খাদ্যবস্তু মনোরম গন্ধ বয়ে আনে। চন্দ্রনাথ, ওরা নদীতে ডুব দিয়ে উঠলেই পুকুরে গিয়ে জাল ফেলবেন!

সোনা ধীরে ধীরে জলে নেমে গেল। পাশাপাশি দাঁড়াল তিনজন। পুবের আকাশ গাঢ় লাল। ঠাণ্ডা। কনকনে শীত। মনে হচ্ছিল সমস্ত শরীর এই হিমঠাণ্ডায় বরফ হয়ে যাচ্ছে। তবুও ওরা দাঁড়াল। মন্ত্রপাঠ করল। প্রথমে উত্তরীয় ফেলে দিল জলে। তারপর বিল্বদণ্ড জলের নিচে গুঁজে দিল। সেই দণ্ডী বিসর্জন দিয়ে আবার মন্ত্রপাঠ করল ওরা। এবার পরনে যে বাসটুকু ছিল তাও জলে ভাসিয়ে দিল। ওরা এবার সূর্য প্রণাম সেরে উঠে আসার সময় দেখল, ঈশম দাঁড়িয়ে আছে তরমুজ খেতে। ফতিমা ঈশমের পাশে দাঁড়িয়ে বাবুর দণ্ডী বিসর্জন দেখছে।

তখন পাগল মানুষ নদী সাঁতরে ও-পারে চলে যাচ্ছেন।

এ-ভাবেই ফতিমা দাঁড়িয়ে থাকে, বড় জ্যাঠামশাই নদী পার হয়ে যান। ফতিমা কী যেন বলতে চায় তাকে। মেলাতে যাবার সময় কী একটা কথা বলেছিল যার অর্থ সোনা বোঝেনি। মেলাতে ওরা একসঙ্গে পুতুলনাচ দেখেছিল একবার। রাবণের সীতা হরণ। এ-ভাবেই বর্ষা আসার আগে পাটগাছগুলি ক্রমে বড় হতে থাকে। শীতের ছুটিতে এসে দেখে গেছে ফতিমা ফসলবিহীন মাঠ, আর গ্রীষ্মের ছুটিতে এসে দেখতে পায় ফতিমা পাটগাছগুলি বড় হয়ে গেছে মাঠে। পাটগাছ বড় হলেই সে চুপি চুপি অতি সহজে এ-গাঁয়ে উঠে আসতে পারে। কেউ দেখতে পায় না, শহরের এক মেয়ে প্রায় চুপি চুপি অর্জুনগাছটার নিচে এসে বসে আছে। বাবুর জন্যে সে ঢাকা থেকে নানারকমের জলছবি নিয়ে আসে। কখনও রাজারানীর, কখনও প্রজাপতির। সে বাঘ-হরিণের ছবি আনে না। রাবণের সীতা হরণের ছবি আনতেও সে ভয় পায়।

এ-ভাবেই এ-দেশে নিদারুণ গ্রীষ্মের পরে বর্ষা আসে। থেকে থেকে এ অঞ্চলে ঝড় হতে থাকে। বৃষ্টি হতে থাকে। আবার কী রোদ! রোদের উত্তাপে শস্যের চারা সব জ্বলতে থাকে।

ঈশমের শরীর ভালো ছিল না বলে মাঠে যায়নি। সে কয়েতবেল গাছটার নিচে দাঁড়িয়েছিল। সোনা পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবুজ মাঠ দেখছে। মাঠে মাঠে কত কামলা। ওরা রোদের ভিতরে মাথলা মাথায় জমিতে নিড়ি দিচ্ছে। এবং গান গাইছে। সোনা এবং ঈশম বুঝি সেই গান শুনছিল। বেশ জারি জারি সারি সারি গান, গমকে গমকে আকাশে বাতাসে বাজছে।

ঈশম গাছের ছায়া দেখে এখন বেলা কত বলতে পারে। এই বেলায় জমিতে যারা নিড় দিচ্ছে, বেলাবেলি শেষ করতে পারবে কিনা, পারলে আকাশের যা অবস্থা, ঈশান কোণের একট বড় মেঘ দেখে টের পায় ঈশম ঝড় উঠবে এখুনি। তাড়াতাড়ি মাঠে যা কিছু আছে, যেমন গাই-বাছুর, ঘাস পাতা সব নিয়ে আসতে হবে।

ঈশম পাশের জামরুল গাছটার দিকে তাকাল। গাছের ডাল, বড় বড় পাতা সব জামরুলে ঢেকে গেছে। সদা সাদা ফল, কি মনোরম দেখতে, যেন সারা অঙ্গে লাবণ্য। ঝড় উঠলেই সব ঝুরঝুর করে পড়বে। মনে হবে কেউ যেন শুভ কাজে গাছের নিচে বড় বড় খৈ বিছিয়ে গেছে। ওর এই গাছ এবং ফলের জন্য মায়া হবে তখন।

তখন কালো রঙের মেঘটা আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে। কেমন ঘুরে ঘুরে অথবা আসলে নিজেই একটা মেঘের সমুদ্র তৈরী করে ফেলেছে। ঘুরে ঘুরে প্রচণ্ড ঢেউ তুলে মেঘগুলি ক্রমে কালো রং হয়ে যাচ্ছে। আকাশের অবস্থা বড় খারাপ। ঈশম বলল, চলেন কর্তা বাড়ি যাই।

কোথাও বজ্রপাতের শব্দ। দুটো একটা পাতা বাতসে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে উড়ে গেল। দু’এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ল শরীরে। দারুণ যে গ্রীষ্ম গেছে এই বৃষ্টি অথবা ঝড়ে তা ঠাণ্ডা হবে। সোনার এই বৃষ্টিতে বড় ভিজতে ইচ্ছে হচ্ছে।

জমিতে যারা পাট ধান নিড়ি দিচ্ছে, জমি থেকে তারা এখনও উঠছে না। তারা বৃষ্টির ঢলে জমি কাদা না হলে উঠবে না। ওরা প্রাণপণ কাজ করছে এবং উতরোলে গাইছে জারি জারি সারি সারি গান। যেন ঝড় অথবা বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমস্বরে গেয়ে চলেছে। এই শেষ সময়-আর ওরা এসে জমিতে বসতে পারবে না, নদীনালা পুকুর সব জলে ভরে আছে—বড় ঢল নামলেই নদীনালা উপচে জল জমিতে উঠে আসবে, তারপরই জোয়ারের জলে সরপুঁটি, বোয়াল মাছ। কাজ-কাম তখন কম। সারাদিন বৃষ্টি। বৃষ্টিতে মাছ মারো খাও।

সারা মাঠে মাথলা মাথায় মানুষ। জমিতে জমিতে জোয়ারের জল। কোথাও হাঁটু জল, কোথাও পায়ের পাতা ডোবে না। সারাদিন সারারাত বৃষ্টি। মাঠে মাঠে মানুষ। মাথলা মাথায় কোচ পলো হাতে মানুষ। ওরা সকাল-সন্ধ্যা কেবল মাছ মারবে। লণ্ঠন হাতে, কেউ পলো হাতে ঝুপঝাপ জল ভেঙে বড় মাঠে নেমে যাবে অন্ধকারে। অন্ধকারে মাছেরা মানুষকে এ-দেশে ভয় পায় না।

সুতরাং এই যে সব ঘাস এতক্ষণ রোদে পুড়ে যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল দাবদাহে পৃথিবীর শেষ রসটুকু বুঝি এবার বিধাতা শুষে নেবেন, তখন আকাশে আকাশে মেঘের খেলা। জলে আবার দেশ ভেসে যাবে। ওরা দু’জন তখনও ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির ভিতর গান শুনছিল। কত ঘাস এবং প্রজাপতি এই মাঠে। পঙ্গু বিবির কথা মনে পড়েছে ইশমের। আগামী হেমন্তে অথবা শীতে বুঝি তার বিবিটা মরে যাবে। ক্রমে বিবি বিছানার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। এত কাজ এই সংসারে সময় করে দু’বারের বেশি যে যাবে তা পর্যন্ত পারে না। মনে হয় কেবল কিছু-না-কিছু কাজ বাকি থেকে গেল।

ঝুপ ঝুপ করে এবার ঢল আরম্ভ হল। ঘাস পাতা সব ভিজে যাচ্ছে। জল পড়ছে টুপটাপ। সোনা, ঈশম, পাগল জ্যাঠামশাই সবাই দক্ষিণের ঘরে জানালাতে বসে আছে। বৃষ্টির শব্দ শুনছে। ঘাস পাতা কেমন বর্ষার জলে ভিজে ভিজে নাচছে। কোথাও একটা গরু ডাকছে—হাম্বা। বোধহয় ওর বাছুরটা এখনও মাঠে, বৃষ্টিতে ভিজছে।

টিনের চালে বৃষ্টি পড়ছিল–ঝুমঝুম। সোনা দুটো হাত দু’কানে চেপে রাখছে, সহসা হাত দুটো আবার আলগা করে দিচ্ছে। দিলেই বিচিত্র এক শব্দ। কান থেকে হাত আলগা করে দিলেই, বৃষ্টির ক্রমান্বয় অন্বেষণের মতো এই শব্দ। বার বার কান চেপে, হাত মৃদু আলগা করে—ওর এক ধরনের কানের ভিতর ঝমঝম খেলা, বেশ মজা পেয়ে যাচ্ছে সে। সে এমন একটা মজার খবর জ্যাঠামশাইকে দেবার জন্য ইজিচেয়ারের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। জ্যাঠামশাই ইজিচেয়ারে লম্বা হয়ে শুয়ে আছেন। হাত কচলে কবিতা আবৃত্তি করছেন। সমস্বরে সেই গানের মতো। যেন বলছেন, মায়া মাখানো জগতে কোথায় যে তুমি ঈশ্বর, এই মাটি এবং ঘাসে কখন কী ভাবে নেমে আস জানি না।

সোনা জ্যাঠামশাইর দু’কানে দু’হাত চেপে তালে তালে হাত খুলে দিয়ে তালি বাজাতে থাকল। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনতে বলল জ্যাঠামশাইকে—শুনতে পাইতাছেন না! ওঁয়া ওঁয়া কইরা কাঁদছে কারা? সে এমন বলল।

এই পৃথিবীতে নিয়ত কারা যেন কাঁদছে। আমরা জন্ম নেব এবার। ধনবৌ তখন বারান্দায় একটা বাঁশ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সেও সেই কান্না শুনতে পাচ্ছে। আমি এবারে জন্ম নেব। ব্যথায় নীল হয়ে যাচ্ছে ধনবৌ’র মুখ। উঠোন জলে ভেসে গেছে। জলে বৃষ্টির ফোঁটা বড় বড়। অজস্র তারার মতো জলের উপর ফুটছে। উঠোনে আঁতুড়ঘর। শুকনো কাঠ ফেলে দিয়ে গেছে ঈশম। পাটকাঠির বেড়া। উপরে শণের চাল। ঝাঁপের দরজা। ঈশম সারা দিন খেটে ঘরটা করেছে। ব্যথায় নীল হয়ে যাচ্ছে ধনবৌ’র মুখ এ-ঘরে কেউ নেই। তার ডাকে কেউ সাড়া দিচ্ছে না। কারণ সারা আকাশ যেন এখন মাথার ওপর ভেঙে পড়ছে। আকাশ ভেঙে প্লাবন নেমেছে। ব্যাঙ ডাকছে। কচু পাতায় পুতুলনাছ হচ্ছে। পাতাগুলি জলের ভারে নাচছে। রাম-রাবণের যুদ্ধ অথবা রাবণের সীতা হরণ। ধনবৌ’র মুখটা ব্যথায় নীল হয়ে যাচ্ছে। সে আর পারছে না।

বড়বৌ ভাবল, একবার খোঁজ নিয়ে যাবে। রাতের খাবার তৈরি করতে যাবে সে। সন্ধ্যা না হতেই রাতের খাবার করবে। খিচুড়ি আর বেগুন ভাজা। রান্নাঘরে যাবার সময় ধনের খবর নিতে হয়।

সে হাঁটু জলে কাপড় তুলে রান্নাঘরে উঠে যাবার সময়ই দেখল ধন একটা বাঁশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ দেখে টের পেল, পৃথিবীতে ঈশ্বর আসছে। সে তাড়াতাড়ি দক্ষিণের ঘরে গিয়ে ডাকল, ঈশম, একবার যাও নাপিত বাড়ি। নাপিত বৌকে ডেকে আন। ধন বড় কষ্ট পাচ্ছে ব্যথায়।

ঈশম যখন দরজায় এসে দাঁড়াল, বড়বৌ দেখল, ওর চোখ লাল।

—তোমার শরীর খারাপ?

—না মামি।

–চোখ লাল কেন?

—ইট্টু জ্বর হইছে। সাইরা যাইব।

এবার বড়বৌ বলল, লালটু কোথায়? পলটু!

—জানি না মামি।

—সোনা, এদিকে এস।

সোনা এলে বড়বৌ ছাতা খুলে দিল।—তুমি যাও। নাপিত জ্যেঠিকে ডেকে আনো।

—আমি যামুনে! ঈশম তাড়াতাড়ি গামছা মাথায় বের হয়ে এলে বড়বৌ বলল, ঈশম, তোমার শরীর ভালো না, তুমি শুয়ে পড় গে। রাতে ভাত খাবে না। বার্লি খাবে। ছেলেরা সব বড় হয়েছে। তোমার যা কাজ, এবার থেকে ওরা কিছু কিছু করবে।

বড়বৌ’র এমন কথায়, ঈশমের চোখ জলে ভার হয়ে এল। সে বলল, শুকনা গাছের গুঁড়ি আরও আছে। গোয়ালঘরে তুইলা রাখছি। অশুজ ঘরে লাগলে কইয়েন! দিয়া আমু।

সোনা এমন দিনে বৃষ্টিতে ভেজার একটা কাজ পেয়ে গেছে। সে তাড়াতাড়ি নেমে এল উঠোনে। এবং ছাতা মাথায় যাবার সময় দেখল মা বাঁশে হেলান দিয়ে কেমন ঝুলে আছে যেন। মা, তার মা! কী সুন্দর আর সজীব ছিল। এখন তার মা ক্রমে কি হয়ে যাচ্ছে। ঘরের বারান্দা টিন কাঠের, দুটো খুঁটির ওপর বাঁশ ঝুলছে এবং মা এখানে অন্যদিন তার ভিজা কাপড় মেলে দেন। কিন্তু আজ কাপড় নয়, ভিজা কাঁথাও নয়. মা নিজেই কেমন ঝুলে আছেন। সোনার বড় কষ্ট হল মাকে দেখে। মাটিতে মার পা দুটো ঈষৎ ঝুলে অথবা ছুঁয়ে আছে যেন মাটি। চোখ দুটো বড় বিষণ্ণ মায়ের। সে কেমন নড়তে পারছে না আর

বড়বৌ বলল, দাঁড়িয়ে কী দেখছিস! তাড়াতাড়ি যা! বলবি এক্ষুনি যেন চলে আসে।

সঙ্গে সঙ্গে ধনবৌ কাতর গলায় বলল, যা বাবা, নাপিত বাড়ির জ্যেঠিরে ডাইকা আন! লালটু কই গ্যাছে? অরে কখন থাইকা দ্যাখতাছি না। মার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে কথা বলতে। সে আর দাঁড়িয়ে থাকল না। সে এক দৌড়ে যাবে, এক দৌড়ে ফিরে আসবে। কোথাও কারও সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলবে না। গল্প করবে না।

সে ছুটল ছাতা মাথায়, জলে ভিজে ছুটল। ছাতায় জল আটকাচ্ছে না। গাছের নিচে জল পড়ছে টুপটাপ। ওর শরীর ভিজছে। কাদা-জল ছলাৎ-ছলাৎ ছড়াচ্ছে চারপাশে। সে মার কষ্টের মুখটা ভাবছে আর ছুটছে। পালবাড়ির বাঁশবাগান অতিক্রম করে সে মাঝিবাড়িতে উঠে গেল। নাপিতবাড়ির জেঠি, এখানে কি একটা কাজে এসেছে। সে ডাকল জেঠিকে, জেঠি তুমি লও যাই। মায় কেমন করতাছে।

মাঝিবাড়ির ছোটবৌর দাঁতগুলো ভোঁতা। কী সব বলছে মার সম্পর্কে! ওর এ-সব শুনতে ভালো লাগছে না। বৌটার দাঁত কালো। মার বয়সী কী তারও বড়, মনে হয় জ্যেঠিমার বয়সী। কালো কুচকুচে দাঁত কালশুটি কালপাহাড়ের মা! সোনা এবার উঁকি দিল ঘরে। কালপাহাড় ঘরে নেই। কালপাহাড় নিশ্চয়ই জোয়ারের জলে মাছ ধরতে গেছে। এমন বর্ষার দিনে সে মাঠে নেমে যেতে পারল না, জোয়ারের জলে সে সরপুঁটি, পিরের বোয়াল ধরতে পারল না। ওর ভিতরে কষ্ট! বড়দা মেজদা হয়তো পালিয়ে চলে গেছে মাছ ধরতে। তার ভিতর থেকে এমন দিনে মাছ ধরতে না পারার কষ্ট ঠেলে ঠেলে উঠে আসছে। সে বলল, অ জ্যেঠি, লও যাই! মায় কেমন করতাছে।

নাপিত জ্যেঠিকে খবর দিয়েই সোনা ছুটতে থাকল। ছুটছে আর ছুটছে। কাদা-জলে ওর জামা প্যান্ট নষ্ট হচ্ছে। তবু সে ছুটছিল। কারণ এখন জল নামছে অবিশ্রান্ত ধারায়। আহা, কী বৃষ্টি! মাঠ জমি সব জলে ভেসে যাচ্ছে। সে এসেই খবর দিল মাকে, মা, জ্যেঠিরে কইছি। সে বড় জ্যেঠিমাকে খবর দিল, জ্যেঠিমা, নাপিত জ্যেঠি আইতাছে। বড়বৌ তখন জল গরম করছে। আভারানী এসেছে ছুটে। দীনবন্ধুর দুই বউ মানকচু পাতা মাথায় এসেছে খবর নিতে। বড়বৌ সবার সঙ্গে জল গরম করতে করতে কথা বলছে।

.

সোনা দেখল, মা তখন টিনকাঠের ঘরটা থেকে কেমন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ছোট ঘরটায় ঢুকে যাচ্ছে। সোনার ইচ্ছা হচ্ছিল মার মাথায় ছাতা ধরে। মার মুখ এমন নীল বর্ণ হয়ে গেছে কেন! সেই যে সে একবার নীল রঙের একটা আলো জ্বলতে দেখেছিল একটা ঘরে, নীল রঙের আলোর ভিতর সে এবং অমলা, অস্পষ্ট মুখের ছবি, মার মুখ কী কষ্টে যেন তেমন নীলবর্ণ ধারণ করছে। মার কষ্ট আর সহ্য করতে পারছে না।

ঈশম তখন বৃষ্টিতে ভিজে আরও দুটো শুকনো কাঠের গুঁড়ি ফেলে দিয়ে গেল। মা ঘরে ঢুকে গোঙাচ্ছে। সোনার ভারি কষ্ট হতে থাকল। সে ঝাঁপ খুলে মাকে বলবে ভাবল, তোমার কষ্ট হচ্ছে মা, আমি কী করতে পারি! আমি জোয়ারের জলে মাছ ধরতে যাব, বড় বড় সরপুঁটি সব জোয়ারের জলে উঠে আসছে।

আভারানী বলল, বৌদি মুখটা দ্যাখছেন?

সোনার রাগ হচ্ছিল বড় জ্যেঠিমার ওপর। এখনও জ্যেঠিমা রান্নাঘরে কী করছে! বের হচ্ছে না।

বড়বৌ বলল, মুখ দেখেছি। সময় হয়নি। তুই ঘরে যা। আমি যাচ্ছি। ধনের মাথা কোলে নিয়ে বসে থাক।

সোনা রান্নাঘরে এসে দেখল বড় জ্যেঠিমা আবু-শোভার মার সঙ্গে ফিসফিস করে কী কথা বলছে। সে বুঝতে পারছে না কিছু। নিরামিষ ঘরের পাশে বৃষ্টির জল বড় বড় ফোঁটায় পড়ছে। জলে দুটো ব্যাঙ লাফাচ্ছিল। এমন বৃষ্টির দিনে মার কষ্ট, অথবা ছোট ঘরটায় মার গোঙানি সে সহ্য করতে পারছে না। তাড়াতাড়ি মাঠে নেমে গেলে এ-সব শুনতে হবে না, দেখতে হবে না, সে পলোটা নিয়ে ছাতা মাথায় মাঠে নেমে গেলে জ্যেঠিমা বলল, ভালো হবে না সোনা। জলে ভিজলে জ্বর হবে।

সোনা বৃষ্টির শব্দে জেঠিমার কথা শুনতে পেল না। সে ছাতাটা মাথায় দিল, এবং পা টিপে টিপে জল ভেঙে হাঁটছে। হাতে পলো। সে হাঁটছে। চারপাশে সতর্ক নজর, মাছ উঠে আসতে পারে। সে কালোজাম গাছটা পার হতেই শুনল কচুর ঝোপে কি খলবল করছে। সে উঁকি দিল ঝোঁপের ভিতর। মাছ! কৈ মাছ! পালেদের পুকুর থেকে নতুন জলের গন্ধ পেয়ে কৈ মাছ উঠে আসছে। সে পলো দিয়ে চাপ দিল। ভেবেছিল সব কটা কৈ পলোর নিচে, সে হাত দিয়ে দেখল মাত্র দুটো। রান্নাঘরের দরজায় সে মাছ দুটো ছুড়ে দিল। বলল, জ্যেঠি, দুটো কৈ। বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে টাপুর-টুপুর। সে তখন দুটো কৈ মাছ ফেলে দিয়ে আরও মাছের জন্য মাঠের ভিতরে নেমে গেল।

বৃষ্টি ফের জোর নামছে। আকাশটা ছাই রঙের। সুতরাং এসব দিনে বৃষ্টি ভিজে হাঁটুজল ভেঙে কোথাও যাওয়া অথবা ধানখেতে জোয়ারের জলে মাছ ধরা সবই সুখী ঘটনার মতো, আর ব্যাঙেরা ডাকছে চারদিকে। ডালে বসে কাক ভিজছে। পাখিরা আকাশে উড়ছে না। ঘন মেঘ সব এখন আকাশে পাখিদের মতো ডানা মেলে ঝাপটাচ্ছে। চারদিকে জল নামার শব্দ। পুকুরগুলি সব মাঠের জলে ভরে গেছে এবং কচুর পাতায় তখন পুতুলনাছ হচ্ছিল। বৃষ্টি পড়ছে টুপটাপ, পাতা ভিজছে, টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটায় কচুর পাতা নাচছে। সোনা পুতুল খেলা দেখছে—রাম-লক্ষণ-সীতা, রাবণ-শূর্পণখা। এখন কচুর পাতা পুতুলনাচের মতো। জলের ফোঁটায় ওরা হাত-পা তুলে নাচছে। কখনও হেঁটে যাচ্ছে যেন। কখনও ডগাগুলি বৃষ্টির ফোঁটায় মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। কচুর ঝোপটায় সোনা অনেকক্ষণ পুতুলনাচ দেখল। ওর মন ভালো না। সে ধানখেতে নেমে একটা পাতা ছিঁড়ল ধানের। ভাবল ফতিমা ওর সঙ্গে মেলায় পুতুলনাচ দেখেছে। ফতিমা ফেরার সময় সোনাকে একটা মন্দ কথা বলেছে। এই যে ঈশ্বর তাকে একটা ভাই দেবে, মাকে ভগবান একটা ভাই হতে পারে, বোন হতে পারে, দিয়ে যাবেন—সেটা যেন ঠিক না। ফতিমা মন্দ কথা বললে সোনার মনটা কেমন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। রাতে মাকে চুপিচুপি কথাটা বলে দিয়েছিল।

মা বলেছিল, ফতিমা নচ্ছার মেয়ে।

মা হয়তো আরও কিছু বলতে চেয়েছিল, তুমি ওর সঙ্গে যাবে না সোনা। তুমি ওর সঙ্গে কোথাও একা যাবে না।

মা তাকে বলেছিল, ঘরটায় ঢুকে মা বসে থাকবে, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবে, ঈশ্বর ভাইটাকে মার কাছে দিয়ে যাবে। ওর বড় জানার ইচ্ছা তখন, সে কী করে এসেছে মার কাছে?

মা বলত, ওকে কারা রাস্তায় ফেলে গিয়েছিল, মা তাকে রাস্তা থেকে তুলে এনেছে।

সোনা তখন হাউহাউ করে কাঁদত। কোনও কোনও দিন সে তার জামা প্যান্ট নিয়ে চলে যেত গোপাটে। সে অন্ধকারে একা-একা সেখানে বসে থাকত। মা তাকে খুঁজে নিয়ে আসত। কোলে তুলে বলত, সোনাকেও তার ভগবান কোল আলো করে রেখে গেছে।

এখন সোনার জানার বড় ইচ্ছা, মা এই যে আজ, ছোট্ট একটা ঘরে ঢুকে গেল, কাঠের শুকনো সব গুঁড়ি, গুঁড়িতে আগুন জ্বালানো হবে, ধূপ ফেলে মা আগুন জ্বেলে আরাধনা করবে, সেই এক ছোট ঘর থেকে মা তাকে নিয়ে তেমনি বের হয়েছিল কি-না।

কিন্তু কেন জানি, কি এক রহস্য এই জন্মের ভিতর, সে বুঝতে পারে না, ছুঁতে পারে না রহস্যটাকে। ধানপাতাগুলি নড়ছে। টুপটাপ বৃষ্টি। সে ছাতা মাথায় অল্প জলে দাঁড়িয়ে আছে। জল আর জল, পুকুর খাল বিল ভরে জমিতে জল উঠে আসছে। ধানের গোড়া জলে ডুবে গেছে, পাতাগুলি বাতাসে নড়ছে। সে ঝতে পারে না, ছুঁতে পারে না রহস্যটাকে। জোয়ারের জলে পা ডুবে যাচ্ছে। চারপাশের জমি, ধানখেত পাটখেত জোয়ারের জলে ভেসে যাচ্ছে। মা-র নীলবর্ণের মুখ দেখে সে-ও কেমন ব্যথায় নীল হয়ে যাচ্ছে।

আর তখনই সে দেখল একটু দূরে ধান গাছগুলি তিড়িং করে সরলরেখায় ছুটে যাচ্ছে। আবার দূর থেকে তিড়িং তিড়িং করে ধানগাছগুলি বৃত্ত সৃষ্টি করে ক্রমাগত এক জায়গায় এসে দাঁড়াচ্ছে। খেলাটা বড় মজার। গাছগুলি প্রাণ পেয়ে যাচ্ছে। কখনও সরলরেখায়, কখনও ছোট ত্রিভুজের মতো কোণ সৃষ্টি করে গাছগুলি ছুটে বেড়াচ্ছে। গাছের পাতা বৃষ্টির ফোঁটায় নড়ছে না। জলের নিচে মাছ ছুটে আসছে, খেতের ভিতর ঘুরছে—একটা দুটো নয়, অনেক ক’টা মাছ। জোয়ারের জলে তার পায়ের পাতা ডুবে গেছে কখন। হাঁটুর নিচে জল উঠে এসেছে। গাছের গোড়ায় জোয়ারের জলে খেলা করছে বলে ধানগাছগুলি এখন তিড়িং তিড়িং করে ছুটে বেড়াচ্ছে। সে এবার সন্তর্পণে ডাহুকের মতো পা বাড়াল। কারণ জলে বেশি শব্দ করতে নেই। বৃষ্টির শব্দ, ব্যাঙের শব্দ, ঝিঁঝিপোকার শব্দকে ডিঙিয়ে জলে তার পায়ের শব্দ কিছুতেই বেশি হবে না। মাটি জল শুষে নিচ্ছে বলে ফুফুরর্ এক শব্দ এবং জলের উপর অজস্র ফুটকরি। জলের উপর অজস্র ফুটকরি ভেসে উঠে ভেঙে যাচ্ছে, ভেসে যাচ্ছে। এত সব শব্দের ভিতরও সোনা সন্তর্পণে পা সূচালো করে একটা ডাহুকের মতো শিকারের আশায় এগোতে থাকল।

সে মাছগুলির পিছনে হেঁটে হেঁটে অনেক দূর চলে এসেছে। আর দুটো জমি পার হলেই ফতিমাদের পুকুর, মোত্রাঘাসের জঙ্গল। মোত্রাঘাসের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে জমির জলটা ওদের পুকুরে পড়ছে। মোত্রাঘাসের ভিতর ঢুকে ফতিমা নিশ্চয়ই মাগুর মাছ ধরার জন্য বঁড়শি ফেলেছে।

সামনের জমি উঁচু, জল কম। মাছগুলি এখনও গাছের গোড়ায় নড়ছে। কম জলে উজানে উঠে যাচ্ছে মাছ। সে মোত্রাঘাস অতিক্রম করে যেখানে ফতিমার মাছ ধরার কথা সেখানে গিয়ে বসে থাকবে কি-না ভাবল। কারণ সে বুঝতে পারছে না, এই যে চারপাশে সব ধানগাছ দ্রুত ছুটে বেড়াচ্ছে তার নিচে কি সব মাছ আছে। মাছ হতে পারে আবার সাপও হতে পারে। জলের নিচে মাছ না সাপ সে ঠিক বুঝতে পারছে না।

তখন একটা শোল মাছ কিছুতেই ধানখেতের আল পার হতে পারছিল না। আলে এসে মাছটা আটকা পড়েছে। এবং বাধা পেয়ে মাছটা জলে লাফ দিতেই দেখল সোনা ছাতা মাথায় পলো হাতে দাঁড়িয়ে আছে। মাঠময় জোয়ারের জল। সবাই জোয়ারের জলে মাছ ধরার জন্য কোচ পলো নিয়ে হাঁটছে। সোনা জলে দাঁড়িয়ে কি ভাবছে। মাছটা ভয়ে-ভয়ে লেজ নেড়ে সহসা মোত্রাঘাসের জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গেল। মাছটাকে এত সামনে পেয়েও সোনা ছুটে গেল না। সে জানত মাছটার সঙ্গে সে ছুটে পারবে না। ধীরে ধীরে খুব সন্তর্পণে আবার ডাহুকের মতো সে ধানখেতে হাঁটতে থাকল। যদি কোথাও বোয়ালের পির চোখে পড়ে। অথবা সোনার ইচ্ছা এখন বৃষ্টি আরও ঘন হোক, এবং পাটখেতে ঘন অন্ধকার নামুক। আকাশ ছেয়ে মেঘ তাড়কা রাক্ষসীর মতো ছুটে বেড়াচ্ছে এবং ভয়ঙ্কর বজ্রপাতের শব্দ। পৃথিবী যেন ভেসে যাবে। মাছেরা নিরাপদে জলের ভিতর খেলে বেড়াচ্ছে তখন। সোনাও খুব নিরাপদে ফতিমার পাশে চুপি চুপি দু’জনে ছাতা মাথায় মাছ ধরার নামে পাশপাশি বসে থাকবে। এক সঙ্গে বসে জল নামার শব্দ শুনবে। কোথাও তীক্ষ্ণ বিদুৎ চমকালে সে আর ফতিমা পরস্পর ভয়ে জড়িয়ে ধরবে। তারপর ছোট একটা কথা বলে ফতিমার মুখ দেখবে। মুখের রেখায় কি রং ফুটে উঠে দেখবে। যদি রঙটা জানপাড় আমগাছের সিঁদুরে আমের মতো হয়, যদি পাতার মতো রঙ ধরে, যদি ফতিমা রাগ করে অথবা ওদের চাকরটাকে বলে দেয়…ছিঃ ছিঃ, সোনা কি সব জোয়ারের জলে দাঁড়িয়ে ভাবছে! মার মুখটা মনে পড়ল। নীলবর্ণ মুখ। ঘরের কোণে শুকনো কাঠের গুঁড়ি জ্বলছে। আগুনের চারপাশে মা, জ্যেঠিমা সকলে গোল হয়ে বসে আছে। ওরা প্রার্থনা করছে হাত তুলে। রাত হলেই ঈশ্বর নেমে আসবেন পৃথিবীতে। আগুনের পাশে এক শিশুকে শুইয়ে দেবেন। সে যে কী নাম রাখবে ভাইটার! ভাই না বোন! বোন হলে ভালো হয়। আকাশে কী প্রচণ্ড মেঘর গর্জন। যেন সব দেবদূত মিলে পৃথিবী থেকে সব দুঃখ তাড়িয়ে দিচ্ছে। তাড়কা রাক্ষুসীকে তাড়িয়ে ওরা আকাশের অন্য প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। অথবা সে যেন দেখতে পেল চারপাশে আগুন, মা মাঝখানে। জ্যেঠিমা, নাপিত জ্যেঠি, আবুর মা আগুনের চারপাশে নৃত্য করছে। ভয়ে মা বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। শালুকপাতার মতো রঙ মুখে। মা যদি সোনার মনের ভাবটা এখন জানতে পারত! মা সোনার মা, জগতে একটি মাত্র মা, সোনার মা। সে মা-মা বলে ডেকে উঠল।

বিচিত্র সব চিন্তা সোনা আজকাল করতে শিখেছে। সেই অমলা ওকে কী যে শেখাল! তারপর থেকেই সে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যায় মাঝে মাঝে। কী সব আজে-বাজে দৃশ্য চোখের ওপর ভাসতে থাকে। আঁধার রাত, গ্রামের সব কুকুর-কুকুরী এবং মেনি গাইর বাচ্চা হবার আগের ঘটনা, বাচ্চা হবার আগে কোনও গ্রীষ্মের দিনে গরুটা সারা মাঠে ছুটে বেড়াত। কেউ কাছে যেতে সাহস পেত না। কাছে গেলেই লাফাত। তারপর ঈশমদা ওটাকে কত কায়দায় ধরে আনত। ঈশমদা আর ও-পাড়ার হরিপদ গরুটাকে নিয়ে সকালে কোথায় চলে যেত। গরুটা তখন হাম্বা করে ডাকত কেবল। হরিপদ কাঁধে দুটো বাঁশ, ঈশমদা গরুটার দড়ি ধরে রাখত। আর ফিরত রাত করে। এসেই ছোটকাকাকে কৌশলে কি বলত। সোনা কিছু বুঝতে পারত না। এই মেনি তখন গোয়ালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঠাকুমা বার বার সাবধান করে দিতেন ঈশমকে, ঈশম মেনিরে খাওয়ান দেইস না, দিলে পাল থাকব না।

ঠাকুমার কথা শুনে মনে হতো গরুটা সারা মাঠ ছুটিয়ে মেরেছে সকলকে। তার শাস্তি দিচ্ছে ঠাকুমা। সোনা তখনই দেখল অনেকগুলি ধানগাছ নড়ে উঠছে। নিশ্চয়ই ধানগাছের গোড়ায় জলের ভিতর অনেকগুলি মাছ এক সঙ্গে খেলা করছে। সোনা এবার পলোটা চেপে বসাল মাটিতে। সে পলোর উপর উঠে দাঁড়াল। উঠতেই একেবারে সর্বনাশ-ওর চোখের তারা বড় হয়ে গেল। গোল গোল হয়ে গেল। দূরে ধানগাছের আড়ালে জলে ডাঙ্গায় কী বড় সাদা বোয়াল! মাছটা চিৎ হয়ে আছে। ফোটকা মাছের পেটের মতো সাদা বোয়ালের পেট জলের ওপর ভাসছে। মাছটার সে সবটা এখন দেখতে পাচ্ছে। মাছটা খুশিতে এমন জোয়ারের জলে, মেঘলা দিনে লেজ নাড়ছে।

সোনা এর আগে কোনওদিন পিরের বোয়াল ধরেনি। ঈশমদা, চন্দদের চাকর, কালাপাহাড় পিরের বোয়াল ধরেছে। এবং এমন সব গল্প সোনা ঈশমদার কাছ থেকে শুনেছে। সোনা পিরের বোয়াল ধরা দূরে থাকুক, সে দেখেনি পর্যন্ত। আজ প্রথম দেখল। দেখে বুঝতে পারল, এটা মেয়ে বোয়াল, ডিমে পেট উঁচু। চিৎ হয়ে আছে। ওর কেন জানি সহসা মনে হল মা ঠিক বোয়াল মাছটার মতো অশুজ ঘরে শুয়ে আছে। আগুন জ্বলছে চারপাশে। জ্যেঠিমা ঘুরে ঘুরে নৃত্য করছে। মার নীলবর্ণ মুখ সাদা ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে।

সোনার মনে হল জলের ভিতর এত বড় মাছটাও কাতর। ব্যথায় নীলবর্ণ না হলে এত বড় মাছটা এমন কম জলে উঠে আসবে কেন!

আবার সেই ডাহুক, ডাহুকের মতো সে হাঁটছে। কিছু সাদা বক ধানখেতের উপর উড়ে বেড়াচ্ছিল। ওরা কম জলে কুচো মাছ ধরে খাচ্ছে। সোনার ইচ্ছা হল সাদা বকেরা যেমনি সন্তর্পণে পা বাড়ায়, জলে সে তেমনি হাঁটবে। বকগুলি গঙ্গাফড়িং খাচ্ছে এবং ছোট-ছোট পুঁটিমাছ ধরছে। ডারকিনা মাছ ধরছে। ডারকিনা, পুঁটি শাড়ি পরেছে বর্ষার জলে। লাল চেলি, তসর গরদ, ঠিক যেন পূজোমণ্ডপে মার মতো। তখন কে বলবে এই মা তার একটা ছোট ঘরে ঢুকে আগুন জ্বেলে বসে থাকবে!

কালাপাহাড় হলে এতক্ষণ কোচ ফিকে দিত বোয়ালটার গায়ে। এবং বোয়ালটাকে ডিমসুদ্ধু ধরে নিয়ে যেত। কিন্তু সে তা চাইল না। খেলাটা জমুক। বোয়ালের আরও কাছে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। অন্য বোয়ালগুলি যখন ওর উঁচু পেট কামড়াতে আসবে অথবা পির বাঁধবে সকলে মিলে, তখন সুযোগ মতো পলোতে এক চাপ এবং সঙ্গে-সঙ্গে আট-দশটা বোয়াল পলোর নিচে। একসঙ্গে সে এতগুলি বোয়াল নিয়ে যাবে কী করে!

গাভীন বোয়ালটার কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকল সোনা। ভয়, ওকে দেখে মাছটা না আবার গভীর জলে নেমে যায়। কিন্তু একটা খবর সে রাখে, গাভীন বোয়ালের ব্যথা উঠলে বেশি নড়তে পারে না। বোয়ালটার এখন নিশ্চয়ই ব্যথা উঠেছে। ডিম পাড়ার ব্যথা। মাছটার ভয়ঙ্কর কষ্ট। বৃষ্টির ফোঁটা বড় হয়ে পড়ছে না এখন। ছোট ছোট ফোঁটা। ঝোড়ো হাওয়া থেমে গেছে। কড়াৎ-কড়াৎ শুধু বজ্রপাতের শব্দ। গুটিকয় অন্য বোয়াল ঘুরে বেড়াচ্ছে হয়তো মাঠে। প্রসবের এক নিমজ্জিত গন্ধ এই জলের ভিতর অন্য মাছেদের উত্তেজিত করে তুলছে। এবং ওরা মেয়ে বোয়ালটার কাছে আসবেই। না এলে পেট ফুটে ডিম বের হবে না। পুরুষ বোয়ালেরা, কী ওরা মেয়ে বোয়ালও হতে পারে-জোরে-জোরে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়বে পেটে, পেট থেকে ডিম বার করে দেবে। মাছটা তাই নড়তে পারছে না। চিৎ হয়ে পড়ে আছে। সুতরাং সোনা একটা শ্যাওড়া গাছ হয়ে গেল! সে ছাতা মাথায় চুপচাপ ঠিক একটা ছোট্ট গাছের মতো মাঠের ভিতর মাছটাকে দেখতে থাকল। সে নড়ল না। উলানি পোকা পা কামড়ে ফুলিয়ে দিয়েছে। সে তবু চুলকাল না। চুলকালেই নুইতে হবে, নড়তে হবে। শ্যাওড়া গাছ ইচ্ছামতো নড়তে পারে না। সে অনেকক্ষণ নিজেকে শ্যাওড়া গাছ করে রাখল। অন্যান্য মাছেরা ডিমের গন্ধে উঠে আসুক, না আসা পর্যন্ত সে শ্যাওড়া গাছ হয়েই থাকবে। তখন কিনা একটা ছোট্ট বোয়াল ওর পা ঘেঁষে চলে গেল। কী আশ্চার্য, মাছটা ওকে শ্যাওড়া গাছ ভেবে ফেলেছে। মাছটা গা ভাসিয়ে বড় মাছটার পেট কামড়ে ধরল। পেট থেকে ডিম বার হচ্ছে। জলে জলে ডিম ভেসে স্রোতের মুখে কাগজের নৌকার মতো ভেসে গেল। সোনা সারাক্ষণ শ্যাওড়া গাছ হয়ে কাগজের বিন্দু-বিন্দু নৌকা জলের উপর ভাসতে দেখল।

জীবের এই জন্মরহস্য সোনাকে কিছুক্ষণ অভিভূত করে রাখল। গাছপালা পাখি নিয়ত তার চারপাশে বাড়ছে। বড় হচ্ছে আবার বিনষ্ট হচ্ছে। এই সব গাছের নিচে কত মাছ হবে আবার। বিন্দু-বিন্দু কাগজের নৌকা আবার মাছ হয়ে যাবে, বড় হয়ে যাবে, বড় হলেই জোয়ারের জলে উঠে আসবে। খেলা-করবে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবে। সোনা এমন মজার খেলা দেখতে দেখতে ক্রমে কেমন প্রস্তরীভূত হয়ে যাচ্ছে। ওর হুঁশ নেই যেন। তখন মনে হচ্ছে গ্রামের ভিতর থেকে তাকে কে ডাকছে—সোনাবাবু, আপনের আর মাছ ধরতে হইব না। বাড়ি আসেন।

সোনা দেখল বৃষ্টি মাথায় ঈশমদা গাছতলা থেকে ডাকছে। সে উঠে দাঁড়াল। একটা মাছও নেই সামনে। মাছগুলি এই জলে এসেছিল সন্তানের জন্ম দিতে। ওরা জন্ম দিয়ে চলে গেছে। কেবল কিছু জল আর ধানগাছ, আর বৃষ্টি, তাড়কা রাক্ষুসীর মতো মেঘেদের ভেসে বেড়ানো, এবং এক গভীর অন্ধকার চারপাশে যেন নামছে। সোনা খালি হাতে উঠে যাচ্ছে। সে এত সামনে এমন পিরের বোয়াল পেয়েও ধরতে পারল না। কেমন এক অন্য পৃথিবী ক্রমে তার রহস্য খুলে ধরছে। যত ধরছে তত সে সোনা থাকছে না, অতীশ দীপঙ্কর হয়ে যাচ্ছে। সে ফতিমার খোঁজে তাড়াতাড়ি মোত্রাঘাসের জঙ্গলে ঢুকে গেল। দেখল ফতিমা নেই। তার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।

বৃষ্টির ফোঁটা এবার বড় হয়ে পড়ছে। সে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে হাঁটল। টিলা ধরে বাড়ির সীমানায় উঠে দেখল, কচুর ঝোপে আবার পুতুলনাচ হচ্ছে। রাম-রাবণ-শূর্পণখা। সে মুখ ভেংচে দিল শূর্পণখাকে। শুধু রাম-রাবণ এখন কচুর ঝোপটায় যুদ্ধের মহড়া দিচ্ছে। ওর মন ভালো নেই বলে কচুর ঝোপে বৃষ্টির ফোঁটায় রাম-রাবণের যুদ্ধ দেখতে থাকল।

ঈশম আবার ডাকল, কি করতাছেন কচুর ঝোপে?

সোনা জল ভেঙে উঠোনে উঠে এল। ঈশম দক্ষিণের ঘরে চলে গেছে। সে এখন একা। কেউ নেই চারপাশে। রান্নাঘরের শেকল তোলা। ছোট্ট ঘরটার চারপাশে কত বড়-বড় সব সোনা ব্যাঙ। ওরা মুখ তুলে কেবল ডাকছে, তুমুল আর্তনাদের মতো মনে হচ্ছে, এই বৃষ্টির শব্দ, এবং কীট-পতঙ্গের ডাক। অজস্র বেতপাতা ঘরটার চারপাশে। ঘরের ভিতর থেকে ধোঁয়ার গন্ধ বের হচ্ছে। পিরের বোয়াল গেছে, মোত্রাঘাসের জঙ্গলে ফতিমা নেই, মা ছোট ঘরটায় চুপচাপ আগুন জ্বেলে শুয়ে আছে। ওকে আজ মেজদার সঙ্গে একা থাকতে হবে। একা থাকতে হবে ভয়ে ওর এই বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছা হল।

তখনই মনে হল ছোট্ট ঘরটায়, মা ভীষণ কষ্টে গোঙাচ্ছে। মার মুখ নীলবর্ণ। বড় জ্যেঠিমার গলা সে পাচ্ছে। নাপিতবাড়ির জ্যেঠি কথা বলছে। আবুর মা হারান পালের বৌ ঘরের ভিতর কী যেন করছে। মার কষ্টের আওয়াজটা কিছুতেই থামছে না। তার মতো অথবা মেজদার মতো মা আবার একটা ভাই ভগবনের কাছ থেকে চেয়ে নিচ্ছে। সে যে এখন এখানে একা দাঁড়িয়ে কী করবে বুঝতে পারছে না। পলোটা ফেলে দিল উঠোনে। এবং মা, তার মা, পুজোমণ্ডপের মা ছোট্ট ঘরটায় কী করছে এখন! সে স্থির থাকতে পারছে না। চুপি চুপি সে ছোট ঘরটার দিকে হেঁটে যাচ্ছে। পিরের বোয়াল ধরার সময় অথবা ফতিমা পাশে বসার মতো উত্তেজনায় ও কাঁপছে। ঠিক প্রর্থনা নয়, ঠিক কষ্ট নয়, ঠিক অন্য কিছু হচ্ছে এই সংসারে যা সে এতদিন জানতে পারেনি। সে চারপাশে যখন দেখল কেউ নেই, বেড়ার ফাঁকে গোপনে মুখ গুঁজে দিল

তারপর, তারপর সোনার এই সংসার জগত্ময় বিশ্বময় পাক খেতে থাকল। সে চোখের উপর এসব কী দেখছে। সে আশ্চর্য, না কী সে ক্রমে বোবা হয়ে যাচ্ছে! তার মা, তার একমাত্র মা, জগতে যার নাই তুলনা, মরা সাপের মতো অথবা ধাড়ি বোয়ালের মতো পেট উঁচু করে পড়ে আছে। বড় জ্যেঠিমা, নাপিতবাড়ির জ্যেঠি, হারান পালের বৌ সবাই খোলা পেটের উপর উবু হয়ে আছে। ওর এবার সহসা চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছা হল—মা! গলার রগ ফুলে উঠছে তার। পূজোর সময় বাবুদের বাড়ি পাঁঠা বলি হয়—ছাল তুলে নেওয়া বলির পাঁঠার মতো মাকে দেখতে। বীভৎস। ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। এ যেন তার মা নয়, সে তার এ-মাকে চেনে না। কারণ তখন পৃথিবীতে আর এক ঈশ্বর নামছিলেন। নাপিতবাড়ির জ্যেঠি তিনবার উলু দিতে বলছে। সবাই একটা জীবের পাশে দাঁড়িয়ে উলু দিচ্ছে। সোনা সেই ঈশ্বরকে দেখল। সে ওর জন্ম দেখল এবং নিজের জন্মের কথা ভেবে সে কেমন বেদনায় মূক হয়ে গেল। জল ভেঙে সে দক্ষিণের ঘরে উঠে গেল চুপচাপ। তেমনি বৃষ্টি পড়ছে বড় বড় ফোঁটায়। ঈশম বৃষ্টির শব্দ শুনছে দরজায় বসে। পাগল জ্যাঠামশাই ইজিচেয়ারে বসে আছেন। ঝড়ো হাওয়া বৃষ্টি এসব দেখে তিনি কেমন উদ্‌বিগ্ন। সোনা জলে ভিজে শীতে কাঁপছে। শশীভূষণ ওর গামছা দিয়ে শরীরের জল মুছে দিলেন। বললেন—তোর একটা বোন হয়েছে সোনা।

সোনা কথা বলতে পারছিল না। শীতে থরথর করে কাপছিল। শশীভূষণ চাদর দিয়ে ওর শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। সোনা তক্তপোশের উপর বসে স্থবিরের মতো চোখ মেলে তাকাল বাইরে। ভয়ঙ্কর কঠিন কিছু দেখে সে স্থবির হয়ে যাচ্ছে। জ্যাঠামশাই পর্যন্ত ওর এমন মুখ দেখে ভয় পেয়ে গেলেন।

সোনা একা জানালার পাশে চাদর গয়ে বসে থাকল। ক্রমান্বয় বৃষ্টি হচ্ছে। ক্রমান্বয় কচুর পাতায় পুতুলনাচ হচ্ছে। সব হয়ে যাচ্ছে একভাবে। বৃষ্টি, বজ্রপাত, পুতুলনাচ এবং জীবের জন্ম, সব একভাবে হয়ে যাচ্ছে। গাছের গুঁড়িতে কাগজের বিন্দু বিন্দু নৌকা মাছ হয়ে গেল। পুজামণ্ডপের মা আর মা থাকল না। কেমন একটা মরা সাপ হয়ে গেল। সে আর এই মাকে কাছে নিয়ে শুতে পারবে না। কেমন এক দূরারোগ্য ব্যাধি মানুষের শরীরে, মাকে ছুঁতে গেলেই তার এমন মনে হবে। সে এবার ভীষণ কষ্টে দু’হাঁটুর ভিতর মাথা গুঁজে দিল। মার নীলবর্ণের মুখটা কিছুতেই আর মনে করতে পারল না। কেবল সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *